অতীনদা সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, “আমার বাবা মারা যান বেশ কিছু বছর আগে। আর আমি তো এখানে ছিলাম না, যদি আপনার বাবার সেই চিঠি আমাদের বাড়িতে এসে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই জবাব দেব। বাবার হয়ে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
মেয়েটিকে দেখে অতীনদার খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয় তখনই একটা সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিলেন। সব শোনার পর মেয়েটি আর অপেক্ষা না করে হন হন করে চলে গেল।
মেয়েটি চলে যেতেই অতীনদা বাবার ঘরে গিয়ে একটা চেন টানা স্যুটকেসে যত পুরোনো চিঠিপত্র ছিল, সব খুলে দেখতে লাগলেন। তার মধ্যে সত্যি একটা খামের ভেতর মেয়েটির বাবার চিঠির সাথে মেয়েটির একটা ফটোও ছিল। অতীনদা ঠিক করলেন সোজা মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেবেন।
একটা ছুটির দিন দেখে অতীনদা নকুলদাকে নিয়ে মেয়েটির বাড়ি ফার্ন রোডে গিয়ে হাজির হলেন।
একদম না জানিয়ে যাওয়াতে যদিও মনে একটা সংকোচ হচ্ছিল, তাও আর দেরি করেননি চিঠি চালাচালিতে। ডোরবেল বাজাতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চাই?”
অতীনদা বললেন, এই বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছেন। অতীনদাদের ভেতরে নিয়ে এল সেই লোকটি। লোকটিকে দেখে মনে হয়েছিল, বাড়ির কেয়ার টেকার।
তারপরেই ভেতর থেকে বেশ ভরাট গলায় প্রশ্ন, ‘সম্পদ, কারা এসেছেন?’
—দু’জন বাবু এয়েচেন সাহেব। নকুলদাকে দেখে তো কেয়ার টেকার লাগত না মোটেই। বাবা নিজের বড়ো ছেলের মতোই ব্যবহার করতেন নকুলদার সাথে।
উনি ভারী পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। তখন ঘরের চারিদিকে নজর পড়তেই অতীনদা দেখতে পেলেন, একটা বেশ প্রমাণ সাইজের ছবি তাতে টাটকা মোটা বেলি ফুলের মালা দেওয়া। অতীনদা ভাবলেন, হয়তো মেয়েটির মা-এর অল্প বয়সের ছবি। অতীনদাকে ওই ভাবে দেখতে দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে দাঁড়িয়ে কেন? বসুন বসুন। কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ আপনাদের আগমন, জানতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম। আগে বসুন।”
—এই সম্পদ যা যা! সামনের দোকান থেকে একটু মিষ্টি আর সিঙ্গাড়া নিয়ে আয়। অনেকদিন পর বাড়িতে অতিথি হয়ে এলেন আপনারা।
অতীনদা ফটোর দিকে আঙুল উচিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন, ইনি আপনার কে হন?”
—না না! মনে কেন করতে যাব। ও আমার একমাত্র মেয়ে অলকানন্দা।
কথাটা শোনার পর অতীনদা একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন। নকুলদা এক ঠেলা মারতেই অতীনদার ঘোর কেটে গিয়েছিল।
—জানেন, খুব ভালো মেয়ে ছিল আমার আলো। আমি ওকে আলো বলেই ডাকতাম। কোনওদিন ওকে অবাধ্য হতে দেখিনি। হাইয়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম হয়েছিল তাই আমি এই ছবিটা বাঁধিয়ে ওকে উপহার দিয়েছিলাম। ফটোটা জড়িয়ে আমার বুকে মাথা রেখে বলেছিল, ও বাবি! এটা তোমার আলোমা? ছোটোবেলায় মাকে হারায় বলে আমি ওকে চোখের আড়াল করতে চাইতাম না। আড়াই বছর আগে বন্ধুদের সাথে আমার মেয়ে কলেজ টুরে নৈনিতাল বেড়াতে গিয়েছিল। আমার একদম ওকে ছাড়তে ইচ্ছে ছিল না। তখনই এক বিপর্যয় ঘটে। গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়াতে গাড়ির ভিতর যারাই ছিল তারা সবাই মারা গিয়েছিল। বলেই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে অতীনদার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—কিন্তু উনি তো আমাদের বাড়ি এসেছিলেন গতকাল সন্ধেবেলা। আমার বাবাকে আপনার লেখা চিঠি ও ওনার ফটোর কথা বলছিলেন। আমার বাবা তো মারা গেছেন কিছু বছর আগে, তাই সব চিঠির উত্তর দিতে পারেননি। বিশ্বাস করুন, আমার খুব অবাক লাগছে। আমি সেইজন্য আর চিঠি চালাচালির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম এখানে।
—কিন্তু আপনি কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু খুলে যদি বলেন। আপনাদের নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি।
অতীনদা নিজের আর নকুলদার নাম বললেন। অতীনদা সব গল্প করলেন যা যা ঘটেছে এতদিন। আরও বললেন, “যখন অতীনদার বাড়িতে এসেছিল অলকানন্দা তখনকার এই ছবির সাথে একটু পার্থক্য দেখলাম। এত স্পষ্ট কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না তাকে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি তখন।’
মেয়েটির বাড়ি থেকে আসার পর আর কোনও দিন অতীনদা তাকে দেখতে পাননি। অতীনদা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, নিজেই মনকে শান্ত করার জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে টুলটুলদির সঙ্গে বিবাহে যুক্ত হন। বিয়ের পরে ওনাদের দুই যমজ মেয়ে হয়। দিদি বড়ো মেয়ের নাম রেখেছেন ‘অলকা’, আর ছোটোটির নাম ‘নন্দা’।
আজ আমরাও বড়ো হয়ে গেছি, তবে ছুটিছাটাতে এখনও ফুলিয়ার বাড়িতে যাই সদলবলে। অঘটন কিন্তু আজও ঘটে!
(সমাপ্ত)