দেশে আমরা যৌথ পরিবারের জয়গান গাই। বেশিরভাগ টিভি ধারাবাহিকে তাই তুলে ধরা হয় যৌথ পরিবারের কাহিনি। যেখানে দেখা যায় শাশুড়ি, ননদ, কাকিমা, পিসিমা, জা, ঠাকুরপো, শ্বশুর, কাকা-শ্বশুর প্রভৃতি চরিত্রদের নিয়ে সমৃদ্ধ ধারাবাহিকগুলো। অবশ্য শুধু টিভি ধারাবাহিকেই নয়, বাস্তবেও আমরা যৌথ পরিবারের ভালোমন্দ দিক নিয়ে চর্চা করি প্রায় সময়। প্রবীণরা অনেকেই যৌথ পরিবারের কনসেপ্টকে ‘ভালো’ বলে থাকেন। কিন্তু বাড়ির ছেলে বিয়ে করে যখন বউ নিয়ে আসে এবং তারপর যদি যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তখন বাড়ির বউয়ের দিকে আঙুল তুলে দোষারোপ করে সবাই। অনন্দরমহল থেকে পাড়ার চায়ের দোকান, সর্বত্রই শুরু হয়ে যায় বউমার সমালোচনা। যৌথ পরিবার ভালো নাকি ছোটো পরিবার-ই সুখী পরিবার— এই নিয়ে চলে জোর চর্চা।
সবাই জানেন, যৌথ পরিবারের এই কাহিনি কোনও অঞ্চলে কিংবা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এই কাহিনির ব্যপ্তি সারা দেশ জুড়ে। পৌরাণিক কাহিনি কিংবা ইতিহাসের বেশিরভাগ কাহিনিতেও প্রাধান্য পেয়েছে এই যৌথ পরিবার ভাঙার বিষয়টি। ইংরেজরা ভারত ছাড়ার পর এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে বলা যায়।
আসলে বিচ্ছেদের এই বিষয়টি আজকের নয়, অনেক প্রাচীন। মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার এই মানসিকতা প্রায় জন্মগত। অথচ দেখুন, একটা গাছ ভেঙে যাওয়ার আগে আরও কিছু গাছের জন্ম দিয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ মানে সমাপ্তির বার্তা দেয়। অবশ্য মানুষের মধ্যে এই বিচ্ছেদের শিক্ষা সেই পৌরাণিক কিংবা ঐতিহাসিক কাহিনি থেকে। রামায়ণেও যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে বাস করতে হয়েছে রাম, লক্ষ্মণ এবং সীতাকে। ঠিক তেমনই মহাভারতেও দেখা যায়, যুদ্ধ এবং বিচ্ছিন্নতার ঘটনা। আর ঐতিহাসিক কাহিনিতে তো বিচ্ছেদ কোনও নতুন বিষয় নয়।
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশরা যখন আমাদের অনেক অত্যাচার করেছিল তখন তাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভারতবাসী এক হয়ে লড়ার পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আর সেই একতা নেই। হয়তো রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে, বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে, কলকাতা থেকে দিল্লি করা হয়েছে ভারতের রাজধানী কিন্তু বিচ্ছেদের সমস্যা বেড়েছে বৈ কমেনি।
আমরা এখন ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। নানা অজুহাত দেখিয়ে চলছে এই বিভাজনের রাজনীতি। কোথাও ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে বলা হচ্ছে, এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আর এই বিভাজনে লাভবান হচ্ছেন ধনী ব্যক্তিরা। আর গরীব যে তিমিরে ছিল, সেখানেই আছে। প্রশ্ন জাগে মনে, শুধু ৮৫ হাজার লোককে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ালে কি জোটবদ্ধ করা যায়?
আমাদের দেশে বিভাজনের এই রাজনীতি সর্বত্র। সংসার থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্র সর্বত্র বাড়ছে বিচ্ছেদ। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, সবকিছুর শুরুটা হয় অনেক লোকজনকে নিয়ে কিন্তু কিছুদিন পর ধীরে ধীরে শুরু হয় মতানৈক্য এবং অবশেষে বিভাজন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো বিভাজনের পর উৎসবও করা হয় মিষ্টান্ন বিতরণ করে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক বিচ্ছেদ-ই কষ্ট দেয়। ভারত-পাকিস্তান কিংবা ভারত-বাংলাদেশের বিভাজনও ওই একই বিষয়।