শ্রেয়া বলল, ‘কেন মা, সব মা তো মেয়ের বিয়ে দেয়, আমি যদি মেয়ে হয়ে ঘটা করে মায়ের বিয়ে দিই, তাতে দোষেরই বা কী? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে তাতে?’

কাকলি ও-পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। মেয়ের কথা শুনে এ-পাশ ফিরলেন। মজা পেলেন। তবু কপট রাগ দেখালেন। বললেন, ‘বড্ড বাচাল হয়েছিস আজকাল। এসব আবার কী কথা?”

শ্রেয়া বিছানায় উঠে বসে। বালিশটাকে টেনে কোলে নিয়ে তাতে একটা চাপড় কষিয়ে বলে, ‘এইটাই তো কথা। এখন যুগ পালটেছে মা। এখন আর এটা করতে নেই, ওটা মানায় না, ওটা শোভা পায় না— এসব নিয়ে মানুষের মাথা ঘামানোর সময় নেই। এই ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে এসেও যদি শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রের পরাকাষ্ঠা হয়ে থাকো, তাহলে তুমি স্রেফ বাতিলের দলে। বুঝলে? আমি যদি দাঁড়িয়ে থেকে তোমার বিয়ে দিই, মানুষ আমাকে রিওয়ার্ড দেবে। মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়বে।’

—মুখরোচক খবর হবে। তাই তো? ভুলে যাস না আমাদের সমাজ বলে একটা কথা আছে।

—কীসের সমাজ মা? তুমি উইডো, সিঙ্গল মাদার জেনেও তোমার অফিসে, রাস্তায়, পাড়ায় কেউ তোমাকে রেয়াত করে? কুদৃষ্টি, কুপ্রস্তাব দেয় না? কেন দেয়? দেয় কারণ তোমার সিঁথি সাদা। কাল ওই সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর চড়লেই দেখবে মানুষের দৃষ্টি পালটে গেছে।

—অনেক হয়েছে। নে এবার ঘুমো। রাত অনেক হল। কাল অফিস আছে। তোর ক’টায় ক্লাস?

—আমার অত চাপ নেই।

শ্রেয়া আজ বালিশ বগলদাবা করে মায়ের ঘরে চলে এসেছে। বলেছে, ‘মা আমি আজ তোমার কাছে শোব।”

কাকলি বললেন, “কেন রে ঘুম আসছে না বুঝি?

শ্রেয়া ছোট্টবেলার মতো আদুরে গলায় বলে, ‘না ঠিক তা না। এমনি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শোব আজ।”

—বুড়ো মেয়ের এ আবার কী বায়না? এত বছর পরে মাকে মনে পড়ল বুঝি? আজ কী হল তোর?

—কী হল, বা কী হতে চলেছে, তা সে কাউকেই বুঝিয়ে বলতে পারবে না। মাকেও না। আজ যা ঘটে গেছে, তাতে রাতের একাকিত্ব তার সহ্য হবে না। লোকটার অনেক বয়স। হিসেব মতো বাপেরই বয়সি ভদ্রলোক। তা হোক গে। শ্রেয়া জাস্ট লোকটার প্রেমে পড়ে গেছে। সারা শরীরের রোমে রোমে এক আশ্চর্য শিহরণ শ্রেয়াকে কাঁপিয়ে বলে দিচ্ছে, ‘ইয়েস ইউ আর ইন লভ৷’ কিন্তু মাকে কথাটা বলা অ্যাবসার্ড। জাস্ট ইম্পসিবল। অথচ এই মুহূর্তে তার মা ছাড়া আর কী অবলম্বন আছে, যে তার ওপর মনের সব ভার ছেড়ে দিয়ে শান্ত হতে পারে সে? অতএব মাকে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে দাও মায়ের বুকে। শ্রেয়া তা-ই করল।

কাকলি বললেন, “দ্যাখো, বুড়ো মেয়ের কাণ্ড দ্যাখো।’

মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ উশখুশ করার পরে ঘুমিয়ে পড়েছে শ্রেয়া। ভোরে কাকলি যখন বিছানা ছেড়েছেন, শ্রেয়া তখন ঘুমিয়ে কাদা। লেট রাইজার শ্রেয়ার শোয়ার ধরন হল, পাশ ফিরে পা তুলে দেবে পাশ বালিশে। সব জানলা ভারী পর্দায় ঢাকা। রোদের চিকনরেখারও সাধ্যি কী যে শ্রেয়ার ঘুমন্ত চোখে চুমু দেবে! পাশ ফিরে শোয়া শ্রেয়ার মাথার নীচে বালিশ, মাথার ওপরেও বালিশ চাপানো থাকে। হলে হবে কী? ঠাঁইনাড়া হয়েছে গতরাতে। মায়ের বিছানায় তার ঘুমটা তাই ভাজা চিনেবাদামের আলগা খোসার মতো খসে পড়েছে চোখ থেকে। বালিশে ঢাকা বলতে গেলে খনিগর্ভের মতো অন্ধকারে যে, মেয়ের চোখ দুটো জ্বলছে, কল্পনাই করেননি কাকলি। কারণ, বেলা ন’টার আগে চোখ খোলার পাত্রী নয় শ্রেয়া। আর তাছাড়া কাকলি হয়তো ভেবেছেন, মেয়ের সামনেই বা কীসের লজ্জা? তাই বেডরুম লাগোয়া বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো বেদিংস্যুটটা অবলীলায় খসিয়ে দিলেন কাকলি।

বালিশের গর্ভ থেকে মায়ের গড়ন-সৌষ্ঠবের শরীর দেখে চমকে যায় শ্রেয়া। তার বুক কেঁপে ওঠে। কী অপরূপ মেদহীন চকচকে তকতকে ত্বক! কাকলি একটা একটা করে অন্তর্বাসে ঢেকে ফেলেন শরীর। সেই ইস্তক বালিশের নীচে শ্রেয়া পাথর হয়েছিল। তবু মেয়ের নিঃশ্বাসের শব্দ কি পেলেন কাকলি? মুহূর্তের তৎপরতায় সালোয়ার স্যুটে পা গলিয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘কী রে ঘুম ভাঙল? শ্রেয়া সটান উঠে বসে বিছানায়। কাকলি তখনও কামিজ পরার ফুরসত পাননি।

শ্রেয়া ওর কোলের ওপর পাশ বালিশে দু’হাতের কনুই ডুবিয়ে হাতের চেটোয় গ্রীবার ভর দিয়ে বসে। মায়ের অর্ধ অনাবৃত শরীরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ পাকিয়ে কপট শাসনের ভঙ্গি করেন কাকলি। বলেন, ‘মার খাবি! কী দেখছিস অমন করে?’

মায়ের ধমকে মৃদু নাড়া খায় শ্রেয়া। বলে, “ওয়াও মা, তুমি এখনও কত সুন্দর আছো।’ কাকলি আবার মেয়েকে কপট ধমক লাগান৷

মেয়েকে ভেঙচে বলেন, ‘হুম সুন্দর আছ। অসভ্য মেয়ে কোথাকার। তোর বড়ো মুখ বেড়েছে আজকাল। কী বলিস তার ঠিক ঠিকানা আছে?’

—মা, বাবা তো দশ বছর হল চলে গেছে। আমিও তো বড়ো হয়ে গেছি। তুমি এখন অনায়াসেই বিয়ে করতে পারো। –তুই থামবি?

—কেন? কীসের ভয় তোমার? সোসাইটি? ড্যাম ইওর সোসাইটি।

—তা বললে হয়? সমাজে থাকতে গেলে…

—মা, আমার বিয়ের কথা তুমি ভাবো না? কেন ভাবো? আমার ভবিষ্যৎ ভেবে তো? তেমনি তোমার ভবিষ্যৎ ভাবাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার বিয়ের পর কে দেখবে তোমাকে? আমি কি পারব ছুটে ছুটে আসতে তোমার কাছে? অনেকের ইচ্ছে থাকলেও ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বা লজ্জায় মরে যায়। কিন্তু আমি তো নিজে তোমাকে বলছি।

শ্রেয়ার গাল টিপে দিয়ে আদুরে গলায় কাকলি বলেন, ‘আমার মেয়েটা কবে যে আমার মা হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি তো!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...