শ্বশুর-শাশুড়ির আসার খবরটা আসতেই সঙ্গীতার মুখ ভার হয়ে গেল। ওর স্বামী রবিরও পুরো ব্যাপারটা নজর এড়াল না। এক সপ্তাহ আগেই সঙ্গীতার বড়ো ননদ মীনাক্ষী নিজের দুটো বাচ্চাকে নিয়ে টানা দশদিন কাটিয়ে গেছে রবিদের বাড়িতে। সুতরাং এত তাড়াতাড়ি আবার শ্বশুর-শাশুড়ি আসবে শুনে সঙ্গীতা বিরক্ত বোধ করছিল।

—এরকম মুখ করে ঘুরো না সঙ্গীতা। দশ পনেরো দিনেরই তো ব্যাপার। প্রথমবার ওনারা আমাদের এখানে কিছুদিন থাকতে আসছেন। তাই আমি কিছুতেই ওনাদের না করতে পারলাম না।

রবির কথাগুলো শুনে সঙ্গীতা আরও বিরক্তি সহকারে উত্তর দিল, ‘আমার নিজের শরীরই ভালো যাচ্ছে না। ওনাদের দেখাশোনার জন্য লোক ঠিক করো আগে, তাহলে আমার কোনও নালিশ শুনতে হবে না। ওনারা যতদিন খুশি থাকুন না, আমার কিছু যায় আসে না।’ সঙ্গীতার কথা বলার ভঙ্গিতেই ওর মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল।

মা-বাবার এখানে আসা নিয়ে রবির মনেও শঙ্কার মেঘ জমা হচ্ছিল। কারণ আগে মীনাক্ষীর সামনেও সঙ্গীতার সঙ্গে ওর বেশ কয়েকবার ঝগড়া হয়েছিল। মীনাক্ষী নিশ্চই ওদের ঝগড়ার খবর মা-বাবাকেও জানিয়ে থাকবে। রবি ভালো করেই জানে মা-বাবা পুরোনো দিনের মানুষ এবং তাঁদের ধ্যানধারণা যে সবই ভুল এমনটা তো নয়।

বিয়ের পাঁচ মাস যেতে না যেতেই রবির প্রায়দিনই সঙ্গীতার সঙ্গে ঝগড়া হতো। এই পরিস্থিতি আরও ঘন ঘন তৈরি হয় এখন। এটা দুটি বয়স্ক মানুষকে যে চিন্তিত করে তুলবে এবং তাঁদের দুঃখ দেবে এটা ভাবাটা ভুল নয়। কীভাবে মা-বাবার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে এই ভাবনা রবিকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলছিল। আগে করোনার অছিলা দিয়ে ওনাদের আসা স্থগিত রেখেছিল। এখন সেই বাহানাও করা চলবে না।

সঙ্গীতার মানসিক পরিস্থিতিও কিছুটা রবির মতোই। বেশি কাজের বোঝা বাড়বে, এটা সঙ্গীতার শুধুমাত্র একটা বাহানা। সঙ্গীতা চাইছিল না শ্বশুর-শাশুড়ি প্রথমবার এসে ওর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা করুক। ওনারা ওদের নিয়ে চিন্তা করবেন কিংবা ওদের বোঝাবার চেষ্টা করবেন— সেটা সঙ্গীতার পক্ষে খুবই অপমানজনক। এই পরিস্থিতি যাতে না আসে সেটাই সঙ্গীতা চাইছিল। রবিকে সেইজন্যই ও বারণ করছিল শ্বশুর-শাশুড়িকে বাড়িতে নিয়ে আসতে।

দু’দিন পর সঙ্গীতার শ্বশুর-শাশুড়ি ছেলের বাড়ি এসে পৌঁছোলেন। দুজনের কেউই ছেলে-বউয়ের মধ্যে দু’বছর ধরে চলতে থাকা ঝগড়ার কথা তুললেন না। সঙ্গীতার জন্য ওনারা দুটো শাড়ি উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন সারা দিনটা নানারকম গল্প করে খুব সুন্দর ভাবে কেটে গেল। সঙ্গীতাও মনে মনে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল।

—মা-বাবার সামনে আমি কোনও তর্ক করব না তোমার সঙ্গে আর তুমিও ওনাদের সামনে আমার সঙ্গে কোনওরকম কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া করবে না রবি। সঙ্গীতার এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে রবি শুতে চলে গেল।

পরের দিন যা ঘটল সেটা ওরা দুজনে কেউ-ই কল্পনাই করেনি। সেদিন সন্ধেবেলা রবি বন্ধুদের সঙ্গে আকণ্ঠ মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকল। সপ্তাহে প্রায় তিন-চারদিন ও এমনটাই করত এবং এটাই ছিল সঙ্গীতার সঙ্গে ওর ঝগড়ার কারণ।

রবি বাড়ি ঢুকতেই সঙ্গীতার নাকে মদের গন্ধ গেল। রাগে ওর মাথা গরম হয়ে উঠল কিন্তু ও নিজেকে সংযত করে নিল। মুখে একটা কথাও বলল না।

রবির বেশির ভাগ বন্ধু-বান্ধবই নেশাখোর প্রকৃতির। রবি নিজে মফস্সলের ছেলে এবং কিছুটা শহুরে হাবভাবের অভাব থাকাতে শহরের ছেলেরা ওর সঙ্গে খুব একটা মিশত না। ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত স্তরের ছেলেরা ওর বন্ধু হয়ে উঠেছিল যারা কিনা সস্তার মদ খেতেই অভ্যস্ত।

রবি বাড়ি ফিরলে ওর মা ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে রবির কাছে যেতেই ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলেন।

—তুই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিস? শঙ্কিত গলায় আরতিদেবী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন।

—একজন বন্ধুর বাড়িতে পার্টি ছিল, জোর করে ওরা খাইয়ে দিল। মা-কে কোনওরকমে কাটিয়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল রবি।

আরতি নিজের স্বামী রমাকান্তর দিকে ফিরে অভিযোগের সুরে বললেন, ‘রবির এই বদভ্যাস তোমার জন্যই হয়েছে।” -বাজে কথা বোলো না। রমাকান্ত এক কথায় স্ত্রীকে থামিয়ে দিলেন।

—আমি ঠিকই বলছি। আরতির মুখে ভয়ের লেশমাত্র দেখা গেল না! রবি যখন ছোটো ছিল ও তোমাকে রোজ মদ খেতে দেখত আর এখন সে নিজেই খাওয়া শুরু করেছে।

—দশ বছর আগেই আমি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।

—যখন ব্লাডপ্রেশার বাড়ল আর বুঝতে পারলে লিভার খারাপ হতে শুরু করেছে তখন তুমি মদ খাওয়া ছেড়েছ। আমি কত বুঝিয়েছি যে বাচ্চাদের উপর এর খারাপ প্রভাব পড়বে কিন্তু তুমি আমার একটা কথাও শোনোনি। এখন আমাদের ছেলের এই করে শরীর খারাপ হবে এবং এর জন্য তুমি দায়ী।

—আরতি, বাজে কথা বলা বন্ধ করো।

স্বামীকে রাগতে আরতি আগেও বহুবার দেখেছেন। তাই দমে না গিয়ে নিজের বক্তব্যে স্থির থেকে তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গীতা অনেক চেষ্টা করল শাশুড়িকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু পারল না। রবিও বাবাকে চুপ করার জন্য বারবার বলতে লাগল কিন্তু রমাকান্তও বলা বন্ধ করলেন না।

রাগ দমন করতে না পেরে রমাকান্ত আরতির গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই সঙ্গীতা শাশুড়ির হাত ধরে টেনে অন্য ঘরে তাঁকে নিয়ে এল। রবিও অনেক্ষণ রমাকান্তের পাশে বসে তাঁকে রাগ কন্ট্রোল করার পরামর্শ দিতে লাগল এবং রমাকান্ত চুপচাপ বসে ছেলের কথা শুনতে লাগলেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...