মা-বাবার ঝগড়ায় এমনিতেই রবির নেশা পুরোপুরি কেটে গিয়েছিল। বাবার মদ খাওয়ার পুরোনো অভ্যাস নিয়েই ঝগড়া শুরু হয়েছিল। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল শত চেষ্টা করেও রবি মনে করতে পারল না যে, সে কখন বাবাকে মদ খেতে দেখেছে।
বিয়ের পর সঙ্গীতা শ্বশুরবাড়িতে কমদিনই থেকেছে। এখন শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যে ঝগড়া দেখে নিজের সঙ্গে অনেক মিল দেখতে পাচ্ছিল সে।
রবিবার সঙ্গীতা, আরতি আর রমাকান্তর নতুন একটা রূপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
শাশুড়ির এক প্রশ্নের উত্তরে সঙ্গীতা জানল, ‘রবির বেড়াতে যাওয়া বা সিনেমা দেখতে যাওয়ার কোনও শখ নেই। কত মাস হয়ে গেছে আমি কোনও সিনেমা দেখিনি।”
—তিন ঘন্টা সিনেমা হলে বসে আজেবাজে ছবি দেখে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। রবি নিজের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করল। সারাদিন টিভিতে প্রচুর ফিল্ম দেখানো হয়ে থাকে। সঙ্গীতা ওগুলো দেখেই শখ পূরণ করে।
—আসলে তোরা বাপ-বেটা কেউই বউদের শখ পূরণ করার জন্য খরচা করতে চাস না। আরতিদেবী সঙ্গীতার হাত নিজের হাতে শক্ত করে ধরে ছেলের কথায় টিপ্পনি কাটলেন।
—তুমি প্রতিটা কথায় আমাকে কেন টেনে আনো বলো তো? আমি বিয়ের এক বছরের মধ্যে তোমাকে অন্তত পঞ্চাশটা সিনেমা দেখিয়েছি। রমাকান্ত বউয়ের কথার প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন।
—সিনেমা দেখার শখ তোমার ছিল, আমার নয়। মুখ ঝামটা দিলেন আরতি।
—তাহলে তুমি হলে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে, তাই না?
কপট রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেললেন আরতি। সঙ্গীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জানো সঙ্গীতা, আমার ফিশফ্রাই, ভাজাভুজি, চপ-কাটলেট খেতে খুব ভালো লাগত আর তোমার বাবার ওগুলো খেলেই অম্বল হতো। বাইরের খাবার একেবারে পছন্দ করত না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি শোনো।
—হ্যাঁ, বলুন না মা! উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গীতা বলে উঠল।
—আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে তোমার শ্বশুররমশাই আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে এক প্লেট ফিশফ্লাই কিনে দিয়েছে। ফিশ ফ্রাই-টা যখন হাতে দিচ্ছে তখন উনি বিশাল পোজ দিয়ে বলে উঠলেন, “এই নাও আজ আবার তোমার পছন্দের ফ্লাইয়ের স্বাদ গ্রহণ করো।”
—আমি তো অবাক হয়ে বলে উঠলাম, তুমি এর আগে কবে আমাকে ফিশ ফ্রাই খাইয়েছ! উত্তরে উনি বললেন, ‘কেন তোমার মনে নেই? হনিমুনে দিঘায় গিয়ে তোমাকে খাইয়েছিলাম, সেকথা ভুলে বসে আছো?’
মায়ের কথায় সঙ্গীতা আর রবি দু’জনেই হেসে উঠল। রমাকান্তও মিটমিট করে হাসছিলেন। ছদ্মকোপ দেখিয়ে আরতিও স্বামীর দিকে তাকালেন কিন্তু তাঁর চোখে স্পষ্টই স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান ধরা ছিল।
হঠাৎ রমাকান্ত উঠে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে রবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “শুধু শুধু তোর মা আমার নামে মিথ্যা গল্প ফেঁদে তোদের সঙ্গে ঠাট্টা করছে, এটা আমি কিছুতেই আর মেনে নেব না।”
—তাহলে এই ব্যাপারে তোমাকেও কিছু বলতে হয় বাবা। রবি খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হয়ে বলল।
—রবি, তুই এখনই দোকানে গিয়ে চপ, ফিশফ্রাই সব নিয়ে আয় তো তোর মায়ের জন্য। তোর মা যদি চায় নিজের শরীর খারাপ হোক তাতে আমার কী বলার আছে?
—আমার কী চাই সেটা নিয়ে নয় বরং আমরা কথা বলছিলাম, রবি সঙ্গীতাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায় না, সেটা নিয়ে। আরতি মনে করান স্বামীকে।
—রবি! উত্তেজিত কণ্ঠে রমাকান্ত ছেলের নাম ধরে জোরে বলে ওঠেন।
—হ্যাঁ, বলো বাবা। বাধ্য ছেলের মতোই রবি বলে।
—তুই কি সারাজীবন বউকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাস না, এই অভিযোগ শুনে যেতে চাস?
—একদম না।
—তাহলে চারটে সিনেমার টিকিট কেটে আন লক্ষ্মী ছেলে আমার।
—নিয়ে আসছি কিন্তু চারটে কেন?
—আমি আর আরতিও তোদের জন্য তিন ঘন্টার কষ্ট ভাগ করে নেব।
—ঠিক আছে নিয়ে আসব। রবির কণ্ঠস্বর কিছুটা নিস্তেজ শোনাল।
—নিজের ভাগ্যের উপর একটু কেঁদেই না হয় মনটা একটু হালকা করে নেব।
—ঠিক আছে বাবা।
—তাহলে এখনই কিছু ফ্রাই-টাই আর সিনেমার টিকিট কেটে নিয়ে চলে আয়। রমাকান্ত ছেলেকে বললেন।
—তাহলে টাকা দাও।
—এখন তুই দিয়ে দে, আমি পরে তোকে দিয়ে দিচ্ছি।
—ধার চলবে না।
—আমার কাছে সব দু’হাজার টাকার নোট। রমাকান্ত বললেন।
—আমি খুচরো করে দেব।
—কেন, আমাকে তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? রবি মুচকি হেসে চুপ করে রইল।
আরতি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আবার কিপটেমি করছ?’
রমাকান্তও কপট রাগ দেখিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন কিন্তু কথাগুলো ওনাকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। হঠাৎই হেসে উঠে রমাকান্ত পার্স থেকে চারটে পাঁচশো টাকার নোট ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
স্বামীকে পরাস্ত করতে পেরেছেন বুঝতে পেরে আরতিও হেসে উঠলেন। ঘরের পরিবেশ হাসিতে ভরে উঠল।
সেদিন রাতে সঙ্গীতা আর রবিও একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় রাত কাটিয়ে দিল। দীর্ঘদিন বাদে রবি হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে সঙ্গীতাকে আদরে ভরিয়ে দিতে পেরেছিল। প্রেমের পর আত্মসমর্পণ যেমন মানসিক শান্তি দিতে সক্ষম ঠিক তেমনি দুশ্চিন্তার ভার কম করে মানুষকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করতেও কার্যকরী।
পরের দিন সকাল ছ’টা নাগাদ রান্নাঘরে বাসনের আওয়াজে সঙ্গীতার ঘুম ভাঙল। এত সকাল সকাল ওর ওঠার অভ্যাস ছিল না। তাড়াতাড়ি যদি ঘুম ভেঙে যেত সারাদিন মাথাব্যথা নিয়ে সঙ্গীতা পড়ে থাকত।