মনে রাখবেন, অর্ধসত্য কিংবা ভুল ধারণা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বিশেষকরে চোখ সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে, চোখের সঠিক যত্ন নেওয়া আবশ্যক। কারণ, চোখের যত্ন সামগ্রিক স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবুও চোখের বিষয়ে প্রায়শই মিথ এবং ভুল ধারণা পোষণ করেন অনেকে, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য অনুপযুক্ত। তাই চোখের যত্ন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কারণ যারা দৃষ্টিহীন, তারা বোঝেন দৃষ্টিহীনতা কী যন্ত্রণা! অতএব, জেনে নিন চোখ সম্পর্কে কী কী ভুল ধারণা বা মিথ আছে এবং চোখের যত্ন নেবেন কীভাবে? আজীবন দৃষ্টিসুখ উপভোগ করার বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন দিশা আই হসপিটাল-এর চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বসুপর্ণা মজুমদার।
(মিথ ১)_আবছা আলোতে পড়া চোখের ক্ষতি করে
সবচেয়ে প্রচলিত মিথগুলির মধ্যে একটি হল— ম্লান আলোতে লেখাপড়া করা চোখের পক্ষে ক্ষতিকারক। আসলে ম্লান আলোতে লেখাপড়া করলে চোখের অস্থায়ী চাপ বা অস্বস্তির কারণ হতে পারে কিন্তু এতে চোখের কোনও স্থায়ী ক্ষতি করে না। আসল বিষয়টি হল, কম আলোতে ফোকাস করার জন্য চোখের উপর চাপ পড়ে, যার ফলে চোখে ক্লান্তি আসে। তবে এতে চোখের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয় না। লেখাপড়ার সময় পর্যাপ্ত আলো ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এটি চোখের চাপ কমাতে পারে এবং লেখাপড়াকে আরও আরামদায়ক করে তুলতে পারে।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ম্লান আলোতে লেখাপড়া করলে, চোখও ওই ভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তাই এ নিয়ে অযথা মাথা না ঘামিয়ে বরং মাঝেমধ্যে চোখে বিশুদ্ধ জলের ঝাপটা দিন, চোখ ভালো থাকবে, ক্লান্তিও দূর হবে চোখের।
(মিথ ২)_টিভির খুব কাছাকাছি বসা ক্ষতিকর
আমরা অনেকেই শুনেছি যে, টেলিভিশন সেট-এর খুব কাছাকাছি বসে কিছু দেখলে আমাদের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। সম্ভবত টেলিভিশন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে এই ধারণা প্রচলিত। এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, আধুনিক টিভিগুলি থেকে ক্ষতিকারক বিকিরণ নির্গত হয় না। তবে টিভির কাছে বসে থাকলে চোখের অস্থায়ী চাপ বা অস্বস্তি হতে পারে। কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হবে না। যদি কেউ ধারাবাহিক ভাবে টিভি দেখেন, তা সে কাছ থেকেই হোক আর দূর থেকেই হোক, টিভি দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে উঠে গিয়ে চোখে বিশুদ্ধ জলের ঝাপটা দিলে চোখ ভালো থাকবে।
(মিথ ৩)_চোখ ভালো রাখার জন্য সেরা খাবার গাজর
গাজরকে চোখের সুস্বাস্থ্যের জন্য চূড়ান্ত খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয় প্রায়শই। কারণ গাজরের উচ্চ ভিটামিন ‘এ’, যা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য মনে করা হয়। যাইহোক, গাজর উপকারী হলেও, গাজরই একমাত্র খাবার নয়, যা চোখের স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণ ভালো রাখবে। বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি, সাইট্রাস ফল এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ— চোখের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোনও একটি খাবারের উপর ফোকাস করার পরিবর্তে সুষম পুষ্টি গ্রহণ করা উচিত।
(মিথ ৪)_চশমা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স পরলে চোখের ক্ষতি হবে
কিছু লোক বিশ্বাস করেন যে, কন্ট্যাক্ট লেন্স পরলে আপনার চোখকে লেন্সের উপর নির্ভরশীল করে তুলবে এবং দীর্ঘদিন লেন্স। ব্যবহার করলে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাবে। বাস্তবে চশমা এবং কন্ট্যাক্ট লেন্স দৃষ্টি-সমস্যা দূর করে, যা স্বচ্ছ দৃষ্টি দান করে এবং চোখের চাপ কমায়। স্বাভাবিক বার্ধক্য বা অন্যান্য কারণে দৃষ্টিশক্তি পরিবর্তিত হয়, কন্ট্যাক্ট লেন্সের কারণে নয়। অতএব, চিকিৎসক পরামর্শ দিলে অবশ্যই কন্ট্যাক্ট লেন্স পরবেন।
(মিথ ৫)_চোখের ব্যায়াম দৃষ্টি-সমস্যা নিরাময় করতে পারে
এমন দাবি করা হয় যে, চোখের নির্দিষ্ট ব্যায়াম দৃষ্টি-সমস্যা উন্নত করতে পারে, এমনকী নিরাময় করতে পারে। হয়তো কিছু ব্যায়াম চোখের ফোকাস করার ক্ষমতা উন্নত করতে পারে, কিন্তু চোখের বা লেন্সের আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে না। মনে রাখবেন, চোখের স্বাস্থ্যহানি ঘটলে, প্রেসক্রাইবড লেন্স কিংবা অস্ত্রোপচার-ই চোখের সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার উপযুক্ত বিকল্প।
(মিথ ৬)_শুধুমাত্র বয়স্কদের নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার প্রয়োজন
অনেকে মনে করেন যে, শুধুমাত্র বয়স্কদের নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু সব বয়সের নারী-পুরুষদের জন্য চোখের পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং চোখের ক্ষতি হওয়ার আগে সমস্যা শনাক্ত করতে হলে, ওদের চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। প্রাপ্তবয়স্কদের গ্লুকোমা, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো অবস্থার শনাক্তকরণ আবশ্যক। তাই বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ ছাড়াই নিয়মিত চোখ পরীক্ষার প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত চোখের পরীক্ষা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস শনাক্ত করতেও সাহায্য করতে পারে পরোক্ষে।
(মিথ ৭)_কম্পিউটার স্ক্রিনে বেশিক্ষণ চোখ রাখলে সমস্যা হতে পারে
কম্পিউটার স্ক্রিনে দীর্ঘ সময় চোখ রাখলে সাময়িক সমস্যা হতে পারে চোখের, কিন্তু চোখের স্থায়ী ক্ষতি হয় না। মনে রাখবেন, শুষ্ক চোখ, মাথাব্যথা এবং মাঝেমধ্যে দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার সমস্যা ক্ষণস্থায়ী। আপনি যখন দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন, তখন আপনার পলকের হার কমে যাবে। যার কারণে কম্পিউটার বা স্মার্টফোন ব্যবহার করার পরে আপনার চোখ শুষ্ক বোধ হবে। ফলস্বরূপ, আপনার চোখ দ্রুত ক্লান্ত হতে পারে। এই উপসর্গগুলি উপশম করতে ‘২০-২০-২০’ নিয়ম অনুসরণ করুন। অর্থাৎ প্রতি ২০ মিনিটে, কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কিছু দেখুন। অতিরিক্ত ভাবে নিশ্চিত করুন যে, আপনার স্ক্রিন একটি উপযুক্ত দূরত্ব এবং কোণে রয়েছে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো আপনার চোখকে আর্দ্র রাখতে প্রয়োজনে কৃত্রিম অশ্রু ব্যবহার করতে পারেন।
উপসংহার
চোখের ভালো দৃষ্টি এবং সামগ্রিক চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য চোখের যত্ন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। তাই, চোখ সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলিকে সরিয়ে রেখে, প্রয়োজনে পেশাদার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চোখের যত্ন নিন। মনে রাখবেন, নিয়মিত চোখের পরীক্ষা এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা আজীবন আপনার দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করবে।