গত দু’দিন থিম পার্ক দেখে আজ চলেছি পাহাড়ের পথে। ট্যামবরিন মাউন্টেন। গোল্ড কোস্ট থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে মাউন্ট ট্যামবরিন। খুব সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাড়ি করে যেতে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগল। আঁকাবাঁকা রাস্তার দু- পাশে কখনও সমুদ্র আবার কখনও ঘন বন দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ট্যামবরিন মাউন্টেনের গ্যালারি ওয়াক। এই সুন্দর রাস্তার দু-দিকে রয়েছে রকমারি দোকান, আর্ট গ্যালারি, স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান। এখানকার স্থানীয় অ্যাবোরিজিনাল শিল্পীদের তৈরি ডট পেন্টিং বেশ জনপ্রিয়। এক সময়ের অবহেলিত এই শিল্প আজ বিশ্বের দরবারে সম্মানের সঙ্গে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি কফি শপ আর রেস্তোরাঁ। আমরা এখানে ব্রেকফাস্ট করে দিন শুরু করলাম।
রেইন ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে মাত্র দশ মিনিট ড্রাইভ করে পৌঁছে গেলাম ট্যামবরিন রেইন ফরেস্ট স্কাই ওয়াক। এখান থেকেই শুরু হয় রেইন ফরেস্টের পথে যাত্রা। দেড় কিলোমিটার হাঁটা পথ। ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে ঘুরে দেখা যায় এই ফরেস্ট। এরপর ব্রিজের উপর দিয়ে ৩০০ মিটার স্কাই ওয়াক করে পৌঁছে গেলাম ৩০ মিটার উপরে। উপর থেকে অবাক বিস্ময়ে নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী আর রেইন ফরেস্টের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রকৃতি কত স্নেহে, কত যত্নে এই পাহাড়কে সাজিয়ে রেখেছে। এই পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ যেন মনের সব চিন্তা-ভাবনাকে মুহূর্তের মধ্যে ভুলিয়ে দিতে পারে। এখানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ভেসে আসা পাখির কলতান শুনতে পেলাম। পাথরের উপর জল পড়ার শব্দও শুনতে পেলাম। মনে হল কাছেই কোথাও একটা ঝরনা রয়েছে। নিস্তব্ধতা আমাদের সব ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তোলে, আজ বুঝতে পারলাম। চোখে না দেখেও মনের আয়নায় অনেক কিছুর দেখা মেলে।
রেইন ফরেস্ট ট্রেইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছালাম কার্টিজ ফল্স-এর কাছে। এবার বুঝতে পারলাম এই জলপ্রপাতের শব্দই কিছুক্ষণ আগে আমি বেশ অনেকটা দূর থেকে পেয়েছি। আশপাশে সারিসারি ইউক্যালিপটাস গাছ। সেই সঙ্গে রয়েছে স্টেগহনফার্ণ, বট গাছ, আরও অনেক রকমের লতানো গাছপালা। জলপ্রপাতটা এই সব গাছপালা দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে। নীচে দেখলাম একটি বিরাট রক পুল। আর তাতে রয়েছে অনেক রকমের মাছ, ইল আর কচ্ছপ। এখানে কেউ এসে এদের বিরক্ত করে না। প্রকৃতি নিজের হাতে যত্ন করে এদের বাসভূমি সাজিয়ে দিয়েছে।
ঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারলাম এবার কোথাও লাঞ্চ করতে হবে। তাই আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম সিডার ক্রিক ভাইনইয়ার্ড। এখানে ওয়াইন তৈরি হয়। তাছাড়াও এখানে আছে সিডার ক্রিক রেস্তোরাঁ। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এই রেস্তোরাঁ খোলা থাকে। রেস্তোরাঁর বাইরে বাগানে বসে খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। ট্যামবরিন মাউন্টেনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে লাঞ্চ করলাম।
লাঞ্চ শেষে আমাদের আজকের শেষ গন্তব্যস্থল গ্লোওয়ার্স কেভের দিকে রওনা দিলাম। ট্যামবরিন মাউন্টেনে বেড়াতে এসে গ্লোওয়ার্স কেভ না গেলে, যাত্রাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সিডার ক্রিক এস্টেট থেকে শুরু হল আধ ঘণ্টার গাইডেড ট্যুর। প্রথমে রেইন ফরেস্টের ভিতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে তারপর একটা কেভ দেখতে পেলাম। এটি কৃত্রিম ভাবে বানানো হয়েছে। এই কেভ- এর ভিতরে হাজার হাজার গ্লোওয়ার্ম-এর বসতি তৈরি করা রয়েছে। গ্লোওয়ার্ম-এর জন্য বিশেষ রকমের আবহাওয়া এবং পরিবেশ প্রয়োজন। ট্যামবরিন মাউন্টেনের আবহাওয়া এখানে গ্লোওয়ার্ম-এর প্রজননের পক্ষে উপযোগী।
কেভ-এর ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভিতরে ঢুকে প্রথমে কিছুই প্রায় দেখতে পাওয়া যায় না। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের চোখ যখন অন্ধকারে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে যায়, ঠিক তখনই চারিদিক থেকে ফুটে ওঠে এক উজ্জ্বল আভা। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই ওয়ার্ম-এর আলো জ্বল জ্বল করছে। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, একমাত্র নিজের চোখে দেখলেই বিশ্বাস করা যায়।
দিনগুলো দেখতে দেখতে কেটে গেল। গোল্ড কোস্টে আজই আমাদের শেষ দিন। তাই আজকের দিনটা রেখেছি কিছুটা রিল্যাক্স করার জন্য। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে রওনা দিলাম কুরামবিন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংকচুয়ারির দিকে। গোল্ড কোস্ট থেকে ২১ কিলোমিটার দক্ষিণে, পৌঁছাতে মাত্র আধ ঘণ্টা সময় লাগল। ২৭ হেক্টর জমি নিয়ে কুরামবিন রেইন ফরেস্টের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে এই ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংকচুয়ারি। এখানে যেমন অস্ট্রেলিয়ার সব নেটিভ অ্যানিম্যাল দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই আবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা আর পশুপাখিও রয়েছে।
ক্যাঙ্গারুকে হাতে করে খাবার খাওয়ানো আর কোয়ালাকে আদর করার বিরল অভিজ্ঞতা হল এখানে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ট্যুরিস্ট অস্ট্রেলিয়াতে আসে শুধুমাত্র কোয়ালা আর ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য। এখানে খুব সহজেই সেই শখ মেটানো যাবে। এছাড়াও এখানে নানারকমের আদিবাসীদের অনুষ্ঠান দেখতে পেলাম। বাচ্চাদের ব্যস্ত ও আনন্দিত রাখার জন্যও এখানে অনেক রকমের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার লাল পান্ডা খুব ভালো লাগল।
কুরামবিন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংকচুয়ারি থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ সেরে নিলাম। এরপর ফিরে এলাম সার্ফারস প্যারাডাইসে। এখান থেকেই শুরু হবে সার্ফারস প্যারাডাইস রিভার ক্রুজ। সময়মতো নৌকায় উঠে বসলাম। দেড় ঘণ্টা ক্রুজে বিশ্রাম নেওয়া আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। নৌকা ভ্রমণে বেরিয়ে মনে হল ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’। নেরাং নদীর উপর দিয়ে নৌকা ভেসে চলেছে। এখান থেকে গোল্ড কোস্টের হাই রাইজ বিল্ডিংগুলো আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।
নদীর দুপাশে গোল্ড কোস্টের সব থেকে দামি বাড়িগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এসব বাড়ির অধিকাংশই পৃথিবীর সব নামকরা ধনী লোকেদের মালিকানায় রয়েছে। বোটের ক্যাপ্টেন বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা করতে করতে আমাদের নিয়ে চলেছে। তার ধারাভাষ্য থেকে বেশকিছু নতুন তথ্য জানা গেল। সময়টা যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আমরা আবার ফিরে এলাম সাফারস প্যারাডাইসে।
সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে। গাড়ি নিয়ে এবার হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলের নীচেই একটা রেস্তোরাঁতে ডিনার করে হোটেলে ফিরে গেলাম। হোটেলের বারান্দা থেকে সার্ফারস প্যারাডাইসের জন কোলাহল শোনা যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু আলো। মনে হল এই ‘স্বর্ণকুমারী’ রাতেও জেগে থাকে। কিন্তু আমাদের তো আর সারারাত জেগে থাকলে চলবে না, কাল সকালে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
সকালে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল লোকজন এরই মধ্যে উঠে মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে পড়েছে। পুব আকাশে সূর্যের আলো সবেমাত্র দেখা দিচ্ছে। গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগছে। সকালের এই শান্ত পরিবেশটা উপভোগ করতে করতে এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। তারপর শেষবারের মতো গোল্ড কোস্ট-কে বিদায় জানিয়ে আমরা প্লেনে উঠে বসলাম।
(সমাপ্ত)