সর্বদা একই ছন্দে চলে না জীবন। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা সব মিলিয়েই আমাদের জীবন। তাই মন খারাপ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু মন কেন খারাপ হয় জানেন? ভেবে দেখবেন, প্রতিটি ঘটনার পিছনে কোনও না কোনও অন্তর্নিহিত কারণ থাকে। কারণটা যদি একবার চিহ্নিত করতে পারেন, সমাধান খোঁজাটা আপনার পক্ষে সহজ হবে। তবে বেশিক্ষণ মন খারাপকে টিকিয়ে রাখা ঠিক নয়। কারণ এতে হতাশা তৈরি হয়। নিজের উপর রাগ হয়, কোনও কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। এমনকী সেই সময় অন্যের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের, সামনে আসতেও ইচ্ছে করে না। এর পাশাপাশি, মন খারাপ শরীরের উপরেও কুপ্রভাব ফেলে। অতএব, জেনে নিন মন ভালো করার সহজ কিছু উপায়।
মেলামেশার পরিধি বাড়াতে চেষ্টা করুন
সব সময় মন ভালো না লাগার সমস্যা তাদের মধ্যে বেশি দেখা যেতে পারে, যারা বেশিরভাগ সময় একা থাকেন। তাই, যতটুকু সম্ভব সমাজে সবার সঙ্গে মিশতে এবং বন্ধুত্ব করতে শিখুন। এতে আপনি তাদের মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় ও ভালো ভাবে জীবনযাপনের কৌশল জানতে এবং শিখতে পারবেন। এছাড়া, নিজের মনের কথা কোনও বিশেষ বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে শেয়ার করে মন হালকা করুন।
যদি লাগাতার আপনার এই মনখারাপের পর্যায়টা চলতে থাকে, তাহলে জোর করে হলেও কারও সঙ্গে কথা বলে দেখুন, অনেকটা হালকা লাগবে। সে আপনার পরিবারের কিংবা পাড়ার কেউ হলেও অসুবিধা নেই। দেখবেন, কিছুক্ষণ কথা বলার পর আপনার মন অনেকটাই ভালো লাগতে শুরু করবে। মনে রাখবেন, ‘Talk therapy’-র মাধ্যমে অনেক জটিল মানসিক সমস্যাগুলোর সমাধান সহজেই করা যায়। তাই, সাধারণ মন ভালো না লাগার সমস্যা এর মাধ্যমে সহজেই দূর করতে পারবেন।
বই পড়ে মন ভালো রাখুন
বর্তমান সময়ে বই পড়ার ট্রেন্ড অনেক কমে গিয়েছে এবং এই জেনারেশন মোবাইল, কম্পিউটার ছাড়া কিছুই জানে না। কিন্তু বই পড়ে মন ভালো রাখার এই প্রক্রিয়া এক সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। যখন আপনি কোনও ভালো বই পড়েন, তখন আপনার মন সম্পূর্ণ ভাবে সেই বই-এর তথ্যের উপরে ফোকাস করে থাকে। যার ফলে, বই এর মধ্যে থাকা তথ্য, রহস্য, গল্প, কাহিনি, চরিত্র ইত্যাদি আপনাকে আপনার চিন্তা, দুঃখ এবং ভয় থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।
নিয়মিত ভাবে নিজের ফাঁকা সময়ে বই পড়ার অভ্যেস করতে পারলে দেখবেন, আপনার মন আগের থেকে অনেক ফুরফুরে এবং খুশি থাকবে। অনেকেই বই পড়ার অভ্যেসের মাধ্যমে নিজের মন মেজাজ ভালো করতে সফল হয়েছেন। ভালো ভালো বই পড়ে আপনি নিজের মুড সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে ফেলতে পারবেন।
জীবনের উদ্দেশ্যের প্রতি ফোকাস করুন
যদি আপনার জীবনে কোনও উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে এখনই নিজের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করুন। কারণ উদ্দেশ্য ছাড়া আপনার জীবনে কোনও মানে থাকবে না, আর তাই মন ভালো রাখতে সমস্যা হবে। যদি আপনি নিজেই না জানেন যে, জীবনে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, তাহলে খুশি থাকবেন কীভাবে! যখন আপনার জীবনের একটি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবেন, তখন দেখবেন আপনার মন সেই উদ্দেশ্যের প্রতি ফোকাসড হয়ে থাকবে। যখনই আপনার মন খারাপ লাগবে, আপনি নিজের উদ্দেশ্য, জীবনে কী করতে চান, জীবনে কী পেতে চান— সেগুলোর বিষয়ে ভাবতে থাকুন। যখনই আপনি এটা করবেন, তখন মনের ফোকাস আবার উদ্দেশ্যের প্রতি চলে আসবে এবং মনে উৎসাহ ভাব তৈরি করবে।
আরও উদার করুন মনকে
সবাই কিন্তু অন্যকে সাহায্য করার মতো মানসিকতা রাখতে পারেন না এবং এটা স্বাভাবিক। তবে, জীবনে একদিন হলেও আর্তের পাশে দাঁড়িয়ে দেখবেন, মনটা শান্তিতে ভরে গেছে। মানুষ কেন শুধু, রাস্তায় কত রকমের নিরীহ প্রাণী রয়েছে যারা কষ্ট পাচ্ছে, একদিন তাদের জন্যও কিছু করে দেখুন, সুফল পাবেনই।
যখন আমরা মন থেকে অন্যকে সাহায্য করি, তখন আমাদের মধ্যে একটি পজিটিভ ফিলিং এবং এনার্জি তৈরি হয়ে থাকে। আর এই ইতিবাচক শক্তি আমাদের মনে প্রচুর শান্তি এবং সন্তুষ্টির ভাব এনে দেয়। তাই, যদি আপনার মন ভালো না লাগে, তাহলে কোনও অসহায় ব্যক্তির জন্য কিছু করুন।
মন ভালো করা গান শুনুন
যদি আপনার মন খারাপ থাকে তাহলে দ্রুত মন ভালো করতে হলে আপনার ভালো লাগা গানগুলো শুনুন। গান শুনলে আমাদের মনে হঠাৎ খুশির অনুভব সৃষ্টি হবে এবং মনের দুশ্চিন্তাগুলোর থেকে আপনার মনযোগ সরে যাবে। গবেষণা বলছে যে, যখন আমরা আমাদের পছন্দের গান শুনি, তখন আমাদের ব্রেন-এর মধ্যে ডোপামাইন (dopamine) নামের একটি কেমিক্যাল নিঃসৃত হয়। আর এই ডোপামাইন কেমিক্যাল মূলত আমাদের মন মেজাজ ভালো রাখার কিংবা খুশিতে ভরে রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই, যদিও বা আপনার গান শোনার প্রতি তেমন আগ্রহ না-ও থাকে, আপনি হেডফোনস কানে লাগিয়ে একবার একটি গান শুনে দেখুন। দেখবেন, আপনার খারাপ হয়ে থাকা মন ভালোলাগায় ভরে যাবে।
পজিটিভ ভাবুন
আমাদের মন খারাপ তখন লাগে, যখন আমাদের মনে বিভিন্ন ধরনের নেগেটিভ ভাব বা কথার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। কেউ খারাপ ব্যবহার করল, কেন কাজ সঠিক ভাবে হল না কিংবা জীবনে যেটা চাইছি সেটা পাচ্ছি না— এরকম অনেক কারণ থাকতে পারে মন ভালো না লাগার। কিন্তু যদি আপনি এই সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতেই থাকেন, তাহলে মন ভালো হবে না এবং জীবনে এগিয়ে যেতে অসমর্থ থাকবেন। তাই, যে-কোনও সমস্যা হোক না কেন, নিজের মনকে একটাই প্রশ্ন করুন, এই সমস্যার উচিত সমাধান কী হতে পারে? যখন আপনি নিজেকে এই প্রশ্ন করবেন, তখন আপনার মন কেবল সমাধানের উপরে ফোকাস করতে শুরু করবে, যার ফলে আপনি একটি উদ্দেশ্য পাবেন এবং মন হালকা হবে। মনে রাখবেন, সমস্যা প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে কিন্তু সফল এবং খুশি সেই ব্যক্তি হতে পেরেছেন, যিনি সমস্যার সমাধান পাওয়া নিয়ে উদ্যোগী হন।
কিছুক্ষণ হেঁটে আসুন
মন খারাপ লাগলে তাড়াতাড়ি মন ভালো করার উপায় হল, বাইরের থেকে একটু হেঁটে আসা। অন্ততপক্ষে ১৫ মিনিট বাইরে হেঁটে আসতে পারলে আপনার এনার্জি লেভেল এবং মুড বুস্ট হবে। এছাড়া, কিছুক্ষণ হেঁটে আসার ফলে মন পরিষ্কার হবে এবং মন ফুরফুরে হয়ে যাবে। হাঁটা এবং দৌড়ানোয় প্রচুর হেল্থ বেনিফিট রয়েছে যার জন্যে প্রত্যেকদিন ১৫ মিনিট করে হলেও হাঁটুন।
নিজেকে ব্যস্ত রাখুন কাজে
সকাল থেকে বিকেল কোনও কাজ ছাড়া বসে-শুয়ে থাকলে, বেশি মন খারাপ করে। মনে রাগ রাগ ভাব, চিন্তা, অলস বা কুঁড়ে ভাব, কথা বলতে ইচ্ছে না করা— এই সমস্ত সমস্যা দেখা দেবে। প্রচুর দুশ্চিন্তা এবং নেগেটিভ থটস উঁকি দিয়ে যাবে। তাই, প্রত্যেকদিন নিজেকে কাজ দিন, নতুন কিছু শিখুন বা নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করুন। যখন আপনি ব্যস্ত হয়ে থাকবেন, তখন মাথায় নেগেটিভ থটস আসার সুযোগ পাবে না, যার ফলে আপনার মন ভালো থাকবে। এছাড়া, যখন আপনি ছোটো-বড়ো কাজগুলোকে সঠিক ভাবে সম্পূর্ণ করে ফেলবেন, তখন মনে একটি সন্তুষ্টির ভাব তৈরি হবে। আর এই সন্তুষ্টির ভাব কিছু ফিল গুড কেমিক্যাল রিলিজ করবে, যার ফলে দিনের শেষে মন ভালো হয়ে উঠবে।
মেডিটেশন করুন
দ্রুত মন ভালো রাখার দারুণ উপায় হল— নিয়মিত ভাবে ধ্যান বা মেডিটেশন করা। এতে নিজের মধ্যে প্রচুর ভালো পরবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে কিছু সময় মেডিটেশন করে দেখবেন, প্রথম দিন থেকেই নিজের মধ্যে এক ধরনের পজিটিভ পরিবর্তন অনুভব করতে পারবেন। তবে ধ্যান-এর সঙ্গে ব্যায়াম অভ্যেস করতে পারলে, আরও ভালো ফল পাবেন। ধ্যান এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনি আপনার মন সতেজ এবং চিন্তামুক্ত করে রাখতে পারবেন।
জোরে জোরে হাসুন
বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে যে, জোরে জোরে হাসির অভিনয় (act of smiling) করলেও আমাদের মুড ভালো হয়ে যায় এবং আমরা খুশি অনুভব করতে শুরু করি। এর মধ্যে কারণ অবশ্যই রয়েছে। হাসির ফলে জরুরি কিছু ব্রেইন কেমিক্যাল নিসৃত হয়ে থাকে, যেগুলো আমাদের মন মেজাজ ভালো করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আপনার হাসার মুড না থাকলেও, জোর করে হাসুন, ভালো কাজ হবে এবং আপনার মন ভালো লাগবে। এছাড়া, মন ভালো করার জন্য আপনি কোনও হাসির সিনেমা দেখতে পারেন বা এমন কোনও বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন, যে আপনাকে হাসাতে পারবে বলে আপনি জানেন। আসল কথা হল, যদি আপনি সব সময় খুশি থাকতে চান, তাহলে নিজের মানসিকতা পজিটিভ রাখতে চেষ্টা করুন। কারণ, সব সময় নেগেটিভ কথা ভাবলে, আপনার জীবন থেকে আনন্দ উধাও হয়ে যেতে পারে।