ননীগোপাল বলল, ‘না প্রভু, আপনি সেবা করুন।’
জীবনকৃষ্ণ দেশলাই জ্বালিয়ে কলকের ভিতর গুঁজে দিয়ে দু’হাতে ধরে লম্বা একটা টান দিয়ে কলকেটা এগিয়ে ধরে বললেন, “নিন বাবাজি। চরম হয়েছে। খুব আনন্দ পাবেন আনে। নিন, নিন লজ্জা করতি হবে না।”
ননীগোপাল একটু বেকায়দায় পড়ল। এখনও কতটা পথ বাকি, কে জানে! পথের সাথীরে চালে চলে না! সে হাত বাড়ায়। তারপর কষে দু’-তিনটে টান।
দমের কাজ সে শিক্ষে করেছিল কয়েক মাস এক গুরুর আখড়ায়। দমে ঘাটতি পড়ার কথা নয়। পড়েওনি। কিন্তু অনেকদিন বাদে আবার ননীগোপাল যেন নিজেরে ফিরে পেয়েছে। সেই আট বছর আগের ননীগোপাল। মনের ভিতরের ফুরফুরে বাতাস বেরিয়ে এসে সামনের রূপনারাণের জলে তিরতির কথা ফেলত তখন। তার পাশের সুন্দরী সেই জলের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে বসে থাকত। দু’জনেই জলের চলন দেখত। মুখে কোনও কথা নেই। কোথা থেকে একখান বিকেল উজাড় হয়ে যেত। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। তার কোনও চাওয়া নেই। বাউলানি শুধু বলত, আমারে নিয়ে একটু এদিক ওদিক যাবা। তাতেই হবে। কত বৈষ্ণব-বাউলের আখড়ায় যে ঘোরা হয়েছে, কত মোচ্ছবে যে দু’জনে মিলে গেছে তা বলে ফুরোনো যাবে না।
তখন বয়স তার তিরিশের কোঠায়। গায়ে বল, বুকে বল, কণ্ঠে বল। আর সব বলের বল ওই ঝুমরা। ননীগোপাল গায়, আর সে একতারা বাজায়। বুগবুগি বাজায়। দান এলে নিজের ঝোলার ভিতর দানের চাল-ডাল, টাকাকড়ি ভরে নেয়। ননীগোপাল বৈরাগীর তখন খুব নাম। ওই ‘বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি’, ‘পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর’, ‘গুপ্তচন্দ্রপুর’- গোছের ঝিলিক মারা কথাবার্তা দিয়ে নাম করা নয়। ননীগোপাল নিজের কণ্ঠের জোরে নাম করেছিল। তত্ত্বগানের আসরে তাকে হারানো খুব সহজ কাজ ছিল না। আর তার যে ছিল একখান টুকটুকে বাউলানি। তার গানের সঙ্গে সঙ্গে বাউলানির ঝোলা ভরে উঠতে সময় লাগত না। এক বছরের ভিতর একখানা সোনার কাঁকন গড়িয়ে দিয়েছিল ননীগোপাল।
—কী বাবাজি, কেমন ঠাওড়ান?
ননীগোপাল কথা বলে না। সে যে কত কতদিন বাদে সুখের বাড়িতে পা রেখেছে। সে চোখ প্রায় বুজেই পা চালায়। রাস্তা টের পায় এক প্রেমিক মানুষের নরম পায়ের চাপ। রাস্তা তার ভালোলাগা বুঝিয়ে ননীগোপালের কমদামি চটির উপর থেকেই তার নিজের ধুলো দিয়ে ননীগোপালকে সাজিয়ে দেয়। ননীগোপাল হাঁটে। হাঁটে না উড়ে চলে! উড়ে যে তাকে যেতেই হবে। সেবার নসরৎপুরের এক বাবাজির আখড়ায় গিয়েও তার প্রাণপাখিকে ধরে ফেলতে পারেনি। আখড়ায় সাদা আলখাল্লা আর জনতা লুঙ্গি পরা, চূড়োকেশের এক সহজ মা কয়েছিল, ‘এই তো কয়েকদণ্ড আগে আমাদের সদাব্রত-র সঙ্গে সে টইটম্বুর বোষ্টমী গেছে বাঘনাপাড়ায়। এট্টুস আগে আলি তার দেখা পাতি পারতেন, গোঁসাই।’
জীবনকৃষ্ণ কলকের নল ঝেড়ে সব ছাই ফেলে দিয়ে আবার নিজের ঝোলার ভিতর তা চালান করে দেন। তারপর বলেন, ‘বুঝলেন বাবাজি, এট্টুস এই দমের কাজ করে নেয়া থাকলি দীনদয়ালের কৃপায় পথের কষ্ট আর কষ্টই নয়। ফুস করে দেখপানে আমরা অজয়কৃষ্ণের মোচ্ছবে হাজির হয়ে যাবানে।’
এইসময় গান জীবনকৃষ্ণের গলা ছেড়ে এমনি এমনিই বেরিয়ে আসতে চাইছে। এতে নিশ্চই গাঁজার হাত আছে। ‘ঠিকের ঘরে ভুল পড়েছে মন/ কিসে চিনবিরে মানুষ রতন।/ আপন খবর নাই আপনারে / বেড়াস পরের খবর করে।/ আপন খবর জানলে পরে/ পরকে চেনা যায় তখন।”
জীবনকৃষ্ণ মেজাজি সুর ফেলছেন। গান থামিয়ে কথা। কথার পিঠে গান। দিলখোলা স্বর হয়েছে তাঁর। বুঝলেন বাবাজি, মানুষ চেনাটা ঝকমারি ব্যাপার। আপনার একবার মনে হবে খুব চিনি। কিন্তু এট্টুস পরেই ভুল ভাঙবে।
ননীগোপাল এই জায়গাটা থেকে সরে থাকতে চায়। নিজের জীবনের ক্ষত উসকে উঠুক, সে চায় না। গাঁজা সেবন করার পর তার পা হালকা হয়েছে, শরীর পেঁজা তুলোর মতো ভাসছে। এই ভালোলাগাটা সে নষ্ট করতে চায় না। বুঝলেন গোঁসাই, শুনিচি আজকের এই মোচ্ছব নাকি মেলা বড়ো মোচ্ছব। লোকজন মানসিক করে এখানে চলে আসে তা পূরণ করতি। এখানে দিনেরবেলায় নাকি চলে হাপু গান, ধুয়োজারী গান! এখানের এত নাম-ডাক কেন বলতি পারেন?’
জীবনকৃষ্ণের বুগবুগি ক্ষেপে ওঠে। দোতারায় আঙুল পড়ে। গলা ছাড়েন জীবনকৃষ্ণ, ‘শুন সজনী রে সে আগুন জ্বলে দিবারজনি/ নীচেতে চুল্হা আছে/ তাতে হাঁড়ি বস্যা আছে/ সে আগুন জ্বলে দিবারজনি।”