ঘটনাটা আমার এক বন্ধুর। সেই বন্ধুর নাম দেবাঞ্জন। সঙ্গীত জগতে যাকে গীতিকার বলে সবাই জানে। তিন হাজার গান লিখে সে ইতিমধ্যেই খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী থেকে শুরু করে কলকাতা এবং মুম্বইয়ের বিখ্যাত শিল্পীরা পর্যন্ত তার লেখা গান গেয়েছেন। আর ছোটোখাটো শিল্পীরা যে তার লেখা গান কত গেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এহেন মানুষটি যদি অতিমাত্রায় নারী-সঙ্গকামী হয়ে পড়ে, তাহলে কার কী বলার থাকে। যদিও দেবাঞ্জনকে কোনওদিন নারীর পিছনে ছুটতে হয়নি, নারীরাই তার পিছনে ছুটেছে।

গান লিখে আজ তার নামডাক হয়েছে বলে যে সুন্দরী নারীরা তার ফেউ হয়েছে এ কথা ঠিক নয়। সে যখন ক্লাস এইটে পড়ত তখন থেকেই তার পিছনে সুন্দরী মেয়ের ফেউ লেগেছে। তার যাকে মনে ধরেছে শুধু তার সঙ্গেই সে প্রেম করেছে। অন্য মেয়েদের সে কখনও লেজে খেলায়নি, সরাসরি উপেক্ষা করেছে। তার উপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে কত মেয়ে যে নীরবে চোখের জল ফেলেছে তা আর কী বলব! এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সে মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে, “আচ্ছা আমার মন তো একটা। এই একটা মন নিয়ে ক’টা মেয়েকে খুশি করতে পারি বল তো?’ তার এ কথার কোনও উত্তর দিতে পারিনি।

আমরা যখন নেতাজি বিদ্যামন্দিরে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন পাড়ার ক্লাবে ‘দুই মহল’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। কলেজ পড়ুয়া কেয়াদি তখন ‘দুই মহল’ নাটকে নায়িকার অভিনয় করে রীতিমতো পাড়ার যুবকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সুন্দরী নারী যখন স্টেজে সুন্দর অভিনয় করে তখন পাড়ার উঠতি যুবকদের মাথা খারাপ না হয়ে উপায় কী। বাস্তবিকই কেয়াদি তখন কেয়া ফুলের মতোই সুন্দর ছিল। সে যখন সেজেগুজে সরকার পাড়ার রাস্তা দিয়ে হরিণীর মতো হেঁটে যেত তখন দেখতাম পাড়ার দাদারা তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। কেয়াদি তখন যদি ভুল করে কারওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসত, সে নিজেকে ধন্য মনে করত।

যে কেয়াদিকে নিয়ে তখন পাড়ার-বেপাড়ার উঠতি যুবকদের এত মাতামাতি, তাকেই কিনা প্রেমে পড়তে হল হাফপ্যান্ট পরা সতেরো বছরের কিশোর দেবাঞ্জনের সঙ্গে। সে সময় প্রেম কী জিনিস সে ব্যাপারে আমার কিছুই বোধগম্য ছিল না। অথচ সে সময় আমার বন্ধু কিশোর দেবাঞ্জন কেয়াদির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে, যা ছিল আমার কাছে একদম অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

আমি যখন পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছি, তখন দেখতাম দেবাঞ্জন লাল ভেলভেটের হাফ প্যান্ট ও সাদা জামা পরে কেয়াদির সঙ্গে দেদার গল্প করছে। পড়া ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতাম পরস্পর মুখোমুখি দুটো যুগল মূর্তি খোশগল্পে মশগুল। পৃথিবী লয় হয়ে গেলেও বুঝি ওদের হুঁশ হতো না, এমনই ওরা প্রেমালাপে মত্ত ছিল।

যাই হোক, দেবাঞ্জনকে খুঁচিয়ে কেয়াদির প্রেম সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি তাই বলছি। দেবাঞ্জনের বাবার তখন কলকাতার বড়বাজারে একটা কাপড়ের দোকান ছিল। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখের দিন সেই দোকানে খুব ধুমধাম করে হালখাতা হতো। বহু লোকের সমাগম হতো। নিমন্ত্রিত অতিথি এলেই দোকানের কর্মচারীরা গোলাপ জল স্প্রে করে জামায় ছিটিয়ে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে দোকানের ভিতর পেতে রাখা ধবধবে সাদা ফরাসে নিয়ে গিয়ে বসাত। বসতে না বসতে কেওড়া দেওয়া ঠান্ডা সরবত হাতে এসে যেত। তার পর একটি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট উপহার দেওয়া হতো। এভাবেই দোকানের মালিকের সঙ্গে খরিদ্দারের একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠত। এখনও হয়। তবে এখন পয়লা বৈশাখের উৎসবের জাঁকজমটাই বেশি, আন্তরিকতার বড়ো অভাব। দোকানদারদের অতিথি আপ্যায়নের আদবকায়দাটা বড়ো মেকি।

দেবাঞ্জন তখন কলকাতার বড়বাজারের দোকানে খুব একটা যেত না। কেন না তাকে তখন মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বলা হয়েছিল। সে জন্য বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছিল। স্কুলে যাওয়া আর নিয়মিত প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসা ছাড়া দেবাঞ্জন অন্য কোনও সময় পড়ার ধার দিয়েই যেত না। বাকি সময়টা সে ক্রিকেট খেলে কিংবা উদয়ন সিনেমায় ইংরেজি ছবি দেখে কাটাত। তা না হলে হেডলি চেজ, আগাথা ক্রিস্টি নয়তো নীহাররঞ্জন গুপ্তর বই তো আছেই। এ তো গেল তার দিনেরবেলার রুটিন। সন্ধে থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ছিল কেয়াদির সঙ্গে গল্প করা। প্রায় পাঁচ বছরের ছোটো দেবাঞ্জনের মধ্যে কেয়াদি তখন কী খুঁজে পেয়েছিল কে জানে। অবশ্য যার সাথে যার মজে মন কিবা হাড়ি কিবা ডোম!

কথায় বলে প্রেম অন্ধ। প্রেম বয়স মানে না, কদর্য কুৎসিত চেহারা নিয়ে চুলচেরা বিচার করে না, মানে না কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ। তাই বুঝি মানুষ বলে, প্রেমের বিচিত্র গতি। যার কোনও ধরাবাঁধা রাস্তা নেই। শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকের নায়ক ওথেলো ছিল অত্যন্ত কুৎসিত কালো আর তার প্রেমিকা ডেসডিমোনা ছিল যেমন ফর্সা তেমনই সুন্দরী। ওথেলো কালো বলে ডেসডিমোনাকে কোনওদিন ভাবিয়ে তোলেনি। বরং ওথেলোর প্রতি তার প্রেম ছিল অত্যন্ত গভীর।

প্রতি বছরের মতো সেবারও পয়লা বৈশাখের দিন মোহনবাবু তাঁর ছেলে দেবাঞ্জনকে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে মোটর চড়িয়ে বড়বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। ব্যাপারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছেলের। লেখাপড়া শেষ করে দেবাঞ্জন ভবিষ্যতে এই দোকানের মালিকের আসনে বসবে, তার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন মোহনবাবু তাঁর ব্যবসায়ী বন্ধুদের। ফরাস পাতা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে দেবাঞ্জনের সে দিন নিজেকে যুবরাজ বলে মনে হয়েছিল। হালখাতা তো নয়, যেন মনে হচ্ছিল তার অভিষেক হচ্ছে!

সেই প্রথম মোহনবাবু দোকানের নতুন খাতাটি দেবাঞ্জনের দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘কোন খদ্দের কত টাকা জমা দিচ্ছে লিখে রাখবে। মনে রেখো, লেখাপড়ার পাট চুকলে তোমাকেই এ দোকানের হাল ধরতে হবে।’

দেবাঞ্জন তখন লাল মলাট দেওয়া খাতাটি হাতে নিয়ে যুবরাজের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে। সন্ধে হতে না হতেই আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড়ে গমগম করতে লাগল দোকান। এক এক করে খদ্দের এসে দেবাঞ্জনের হাতে টাকা দেয় আর দেবাঞ্জনকে সঙ্গে সঙ্গে নতুন খাতায় তাদের নাম ও টাকার অঙ্কটি লিখে রাখতে হয়।

যুবরাজের তখতে বসে দেবাঞ্জন লক্ষ্য করে তার বাবা মোহনবাবু সন্ধে থেকে প্রতিটি খদ্দেরের সঙ্গে হেসে কথা বলছেন। তাঁর অভ্যর্থনার কোনও খামতি নেই, কোনও ক্লান্তি নেই— টাকার নেশা বড়ো নেশা! ব্যবসায় লাভ করতে হলে খদ্দেরের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকতে হবে। বিরক্তবোধ করলে চলবে না। কেন না, সবুরে মেওয়া ফলে। অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকলেও দেবাঞ্জনের মন কিন্তু পড়েছিল সাতাশ কিলোমিটার দূরে মফস্বলে কেয়াদির কাছে। যাকে একদিন চোখে না দেখলে আর একটু কথা না বললে তার পেটের ভাত হজম হতো না!

এক সময় হালখাতার পাট চুকিয়ে হাতে রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে আর একটি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যখন দেবাঞ্জন মফস্বলের বাড়িতে ফিরে এল, তখন রাত অনেক হয়েছে। লোডশেডিং বলে সুকান্ত পল্লীটা নিঝুম অন্ধকারের রূপ নিয়েছে। দেবাঞ্জন বাবার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, এই মিষ্টির প্যাকেটটা কেয়াদিকে দিয়ে আসি।’

—আচ্ছা। আর শোন কেয়ার মা শিবতলায় যাত্রা দেখতে গেছেন। তুই ততক্ষণ কেয়াদির বাড়িতে থাকিস। উনি যাত্রা দেখে ফিরে এলে তখন তুই চলে আসিস। দেবাঞ্জনের মা বলল।

—ঠিক আছে। বলে দেবাঞ্জন একেবারে খুশিতে ডগমগ হয়ে কেয়াদির বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

দেবাঞ্জনদের মতো কেয়াদিরাও ছিল এক সময়ে উদ্বাস্তু। দেশভাগের পর কেয়াদিরা সপরিবারে পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ধুবুলিয়া ক্যাম্পে এসে উঠেছিল। ক্যাম্পে থাকাকালীন কেয়াদির বাবা যক্ষ্মা রোগে মারা যান। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মফস্বলের এই কলোনি, সুকান্ত পল্লীতে তাদের চার কাঠা জমি বরাতে জুটেছে। কেয়াদিরা দু’বোন, এক ভাই। বড়ো বোন ঝুনুদির বিয়ে হয়েছে বিহারের বেগুসরাই জেলায়। আর তার দাদা আসামে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে চাকরি করেন। বলতে গেলে বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি বাইরেই থাকেন।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...