অসহ্য গরমের পর ঝেপে বৃষ্টি নামলে শরীরে এবং মনে যে-শান্তি আসে, পৃথার কথা শুনে অভিজিতেরও সেই অনুভূতি হল হঠাৎ। এমন সময় আবার মিহিরের ফোন। ফোনটা রিসিভ করে মিহিরের কথা শোনার পর অভিজিৎ জানালেন, ‘না, আমরা শপিং করিনি। মুম্বইয়ের কলিগরা কাজে আটকে গেছে, শপিং-এ আসতে পারবে না জানিয়েছে। আমরা তোমার জন্য মল-এর বাইরে বেঞ্চ-এ অপেক্ষা করছি। তুমি গাড়ি নিয়ে এসো।’
এক সন্ধেবেলা মিহির বাড়ি ঢুকল হাসি মুখে। একটা প্রিন্টেড পেপার পৃথা-র হাতে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখো এটা, আমার প্রোমোশন লেটার।’
পৃথা প্রোমোশনাল লেটারটি খুলে এক ঝলক দেখে বলল, ‘বাহ্, দারুণ ব্যাপার, কনগ্র্যাচুলেশনস।’
—‘স্যালারিও বেড়েছে অনেকটাই”, বলেই পৃথাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মিহির।
পৃথা বলল, ‘রেস্তেরাঁয় খাওয়াতে হবে কিন্তু।’
—চলো, আজই যাব। রেডি হয়ে নাও।’ জানাল মিহির।
সত্যিই সেদিন পৃথাকে নিয়ে গিয়ে একটা বড়ো রেস্তোরাঁয় ডিনার করিয়েছিল মিহির। আর সেদিনের শপিং মল-এর বাইরের বেঞ্চে বসে যে-জীবনকাহিনি শুনেছিল অভিজিতের থেকে, রাতে মিহিরের পাশে শুয়ে সবটাই জানিয়েছিল পৃথা। সব শুনে মিহির বলল, ‘স্যার-এর জীবনে যা ঘটেছে তা সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু কী আশ্চর্য, স্যার-এর জীবনে যে, এত বড়ো ঝড় বয়ে গেছে, তা আমরা অফিসে এতটুকুও টের পাইনি। তাই, সব শুনে যেন অবিশ্বাস্য লাগছে।”
—এটাই সত্যি। তাই, তোমাদের বস্ মহিলাদের সঙ্গে ককটেল পার্টিতে গেলেও, একটা চাপা ঘৃণার ভাব রয়েছে মহিলাদের প্রতি। কারণ, সব মেয়েকে দেখে এখন তাঁর স্ত্রী বিদিশার মতো প্রতারক মনে হয়। আমি পুরোনো বন্ধু বলেই হয়তো তাঁর ধারণা কিছুটা হলেও বদলাতে পেরেছি।’ কথাগুলো মিহিরকে জানাল পৃথা।
একটু থামার পর পৃথা মিহিরকে বলল, ‘একটা কথা বলব?”
—’হ্যাঁ বলো…’
—যদি তুমি অনুমতি দাও তো আমি তোমার বস্-এর সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কিছু কথা বলব, মানুষটা বড়ো দুঃখী। আমি কথা বললে তোমার খারাপ লাগবে না তো?’
পৃথার কথার উত্তরে মিহির জানাল, ‘দ্যাখো, তুমি আমার স্ত্রী। আমরা ভালো বন্ধুও পরস্পরের। আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস এবং ভালোবাসা রয়েছে। তোমার উদ্যোগে যদি আমার বস্-এর জীবনে কোনও পরিবর্তন আসে, তাহলে আমার ভালো লাগবে। বন্ধু হিসাবে তোমাকে ভরসা করে তিনি যখন সবকিছু জানিয়েছেন। তাই তুমি যদি দশটা কথা বলে কাউন্সেলিং করো, তাহলে আমি কেন মন খারাপ করব? এতে আমার পূর্ণ সম্মতি রইল।’
মিহির তার প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা রাখার জন্য খুব ভালো লাগল পৃথার এবং আবার নতুন করে বুঝতে পারল, তাদের দাম্পত্য সত্যিই সুখের।
এক ছুটির দিনে সকালে মিহির এবং পৃথা দু’জনে পরিকল্পনামাফিক পৌঁছে যায় অভিজিতের ফ্ল্যাটে। দরজা খুলে অভিজিৎ প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় ওদের দেখে…!
—তোমরা হঠাৎ!”
—সারপ্রাইজ ভিজিট। ভিতরে আসতে বলবে না?’ হাসতে হাসতে জানাল পৃথা।
উত্তরে অভিজিৎ জানালেন, “তোমরা এসেছ দেখে খুবই ভালো লাগছে। আসলে ঘরে সব অগোছালো তো…। আচ্ছা, এসো তোমরা ভিতরে।”
ঘরে ঢুকে পৃথা দেখল, বসার ঘরের সোফার উপর মদের বোতল, গেলাস, ছাইদানি সব ছড়ানো রয়েছে। অভিজিৎ কিছুটা লজ্জা পেয়ে গিয়ে সবকিছু অন্য ঘরে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ওদের সোফায় বসার ব্যবস্থা করে দেন।
—স্যার, আমি একটু আসছি। গাড়িটা লক করতে ভুলে গেছি বলে ছুতো করে সরে যায় মিহির। আসলে পৃথার সঙ্গে এই পরিকল্পনা করে রেখেছিল মিহির। যাতে ওর বস্ নিরিবিলিতে পৃথার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলে হালকা হতে পারেন নির্দ্বিধায়।
—কী খাবে, চা নাকি কফি?’ প্রশ্ন করল অভিজিৎ।
—একটু আগেই আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি। বরং ব্যস্ত না হয়ে তুমি বোসো, একটু কথা বলি। জানাল পৃথা।
অভিজিৎ একটা চেয়ার টেনে বসল পৃথার সামনে। তারপর পৃথা বলতে শুরু করল, ‘তোমার আঁকার নেশাটাকে বাড়াও অভিজিৎ। আমি খুব খুশি হব যদি তুমি আগের মতো রং তুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকো।”
খুব বিষাদমাখা কণ্ঠে অভিজিৎ জানাল, ‘এখন আর ধৈর্য রাখতে পারি না আঁকতে গিয়ে।”
—কিন্তু জীবনটা তো আর সাদা-কালো করে রাখতে পারো না তুমি। ভুলে যাও কী ঘটেছে। যে তোমায় ঠকিয়েছে, তাকে জিততে দিও না। তুমি এভাবে দিন কাটালে আদতে বিদিশা-ই জিতে যাবে। জীবনের রং ছড়িয়ে দাও তোমার ক্যানভাসে।” —এমন আরও অনেক প্রেরণামূলক কথা বলে অভিজিতের আরও ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল পৃথা।
এরপর মাঝেমধ্যে পৃথা ফোনে কথা বলত অভিজিতের সঙ্গে। একদিন মিহির এবং পৃথা একটা পেইন্টিং এগজিবিশন-এ নিয়ে যায় অভিজিৎ-কে। আর ওই প্রদর্শনীতে গিয়ে মন ভালো হয়ে যায় অভিজিতের এবং তিনি যেন নতুন ভাবে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেন। এরপর অবসর সময়ে রং-তুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শুরু করেন অভিজিৎ।
সময় বয়ে চলে। এভাবেই মিহির এবং পৃথার সঙ্গে অভিজিতের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। কিন্তু হঠাৎই মুম্বই ট্রান্সফার হয়ে যান অভিজিৎ। স্বাভাবিক ভাবে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায় তাদের মধ্যে। এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ একটা চিঠি এল ক্যুরিয়ার-এ। খামের উপর মিহির এবং পৃথা-র নাম লেখা।
চিঠি খুলে ওরা দেখল, অভিজিতের চিঠি। তাতে লেখা—
প্রিয় মিহির ও পৃথা,
দূরভাষে এই খুশির খবরটা দিতে ইচ্ছে হল না, তাই চিঠিতে জানাচ্ছি। এটা রেখে দিও যত্নে। তোমাদের প্রতি এ আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার। তোমাদের প্রেরণায় আমি নতুন জীবন পেয়েছি। সবাই যে বিদিশা নয়, তার প্রমাণ পেয়েছি আমি। তোমাদের প্রেরণায় আমি জীবনে নতুন করে পেয়েছি সাগরিকাকে। ও ছবি আঁকে আমার মতো। আমরা বিয়ে করব আগামী সপ্তাহে। আর ওই বিয়ের রিসেপশন-এ আমাদের একটা যৌথ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন থাকবে। উদ্বোধক হিসাবে চাই তোমাদের দু’জনকে। আমি ফ্লাইট -এর টিকিট পাঠিয়ে দেব। তোমাদের দু’জনকেই আসতে হবে।
—অভিজিৎ ও সাগরিকা।
চিঠিটা পড়ার পর মিহির এবং পৃথা দু’জনে আনন্দে জড়িয়ে ধরল পরস্পরকে। তারপর মিহিল বলল, ‘পৃথা তুমি জিতে গেছ। তোমার উদ্যোগ সফল। সত্যিই গর্ব হচ্ছে তোমার জন্য।”
সেদিন আনন্দে আবার ওরা ডিনার করেছিল একটা বড়ো রেস্তোরাঁয়।
(সমাপ্ত)