ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল সমর। মেয়েটা একেবারে সামনে। অনেক দূর থেকে লাউডস্পিকারে গানের কয়েকটা লাইন ভেসে আসছে ‘যদি তারে নাই চিনি গো…’। মনে হচ্ছে দূরে কোথাও বিয়ে বাড়ি থেকে আওয়াজটা আসছে। এই শীতের রাতে ঘন কুয়াশায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। দেখে মনে হবে পুরো কলকাতা শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। রাস্তা একেবারে ফাঁকা।

সমর তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল গাড়ির সামনে। লাইট পোস্টের আলোয় দেখল মেয়েটা গাড়ির চাকার নীচে এসেও অল্পের জন্য বেঁচে গেছে, তবে ধাক্কাটা বেশ জোরে লেগেছে। রাস্তার অল্প আলোতে ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। এত রাতে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে চোখেও পড়ল না। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। মনে মনে ভাবল, তাহলে কি গাড়িটাকে ব্যাক করে পাশ কাটিয়ে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরের মানুষটা বলে উঠল— কী করছ সমর? তুমি না একজন মানবদরদি বলে অহংকার করো? তাহলে এত রাতে অবলা একটা মেয়েকে রাস্তায় ছেড়ে পালাবে? কোথায় গেল তোমার সেই মন?

সমর কোনও কিছু না ভেবেই গাড়ির হেডলাইটটা জ্বালিয়ে মেয়েটির দেহটাকে গাড়ির তলা থেকে বের করে আনল। মেয়েটি তখন অচৈতন্য অবস্থায়। মাথায় এবং হাতে বেশ চোট লেগেছে মনে হচ্ছে। মেয়েটির দেহটিকে পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে হাতটা নাকের কাছে নিয়ে দেখল এখনও নিঃশ্বাস চলছে। খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। যে করে হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। সমর হাসপাতালে পৌঁছেই ইমারজেন্সিতে মেয়েটিকে ভর্তি করে দিল। বাইরে এসে হাসপাতালের সব ফরমালিটি করে যখন ইমারজেন্সির বাইরে এসে বসল, তখন প্রায় মাঝ রাত। কিছুই ভালো লাগছিল না।

আজকাল ওর এই হয়েছে এক জ্বালা। অফিসে অডিটিং চলছে বলে রোজই বেশি রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফিরতে। তার উপর অডিটরদের ফাইফরমাশ আর আবদার মেটাতে মেটাতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আজ অডিটরদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েই এত রাত হয়ে গেল ফ্রিতে। কোথা থেকে আবার এক উটকো ঝামেলা এসে জড়ো হল। একটাই নিশ্চিন্তি যে, আগামীকাল রবিবার, ছুটির দিন। আর এই ছুটি বলেই তো অডিটরদের আবদার মেনে নিতে হল সমরকে। ভাবতে লাগল কী করে এর থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এত রাতে কোনও বন্ধু-বান্ধব বা অফিস কলিগকেও ফোন করাটা ঠিক হবে না। এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কানে ভেসে এল কেউ যেন চিৎকার করে কিছু বলছে। তাকিয়ে দেখল, ইমারজেন্সি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে জোরে জোরে বলছেন, পাঁচ নম্বর বেডের পেশেন্টের সঙ্গে কে আছেন? সমর এগিয়ে গেল।

—আজ্ঞে আমি, সমর সামন্ত।

—আপনি সম্ভবত ওঁর হাজব্যান্ড? আচ্ছা আপনি ওঁকে মারধর করেননি তো? এত চোট পেল কী করে বলুন তো? —আজ্ঞে, রাস্তা পার হতে গিয়েই এই বিপদ৷

—হাতে পায়ের চোটগুলো খুব সাংঘাতিক নয়। ওগুলো সেরে যাবে কিন্তু মাথায় মনে হয় খুব চোট লেগেছে। তাই জ্ঞান আসতে দেরি হবে। প্রয়োজনে অপারেশনেরও প্রয়োজন হতে পারে। আপনি একটা অপারেশনের কনসেন্ট দিয়ে যান। দরকার হলে আমরা আপনাকে জানিয়ে দেব। আপনার নম্বর তো আমাদের রেকর্ডে দিয়েছেনই। আপনি আর এত রাতে শুধু শুধু কেন বসে থাকবেন। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিন। আগামীকাল সকালে বড়ো ডাক্তার আসবেন, তখন বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব জানিয়ে দেব। তবে ভয়ের কিছু নেই। মনে হচ্ছে রাতেই জ্ঞান ফিরে আসবে। আমরা ড্রিপ শুরু করে দিয়েছি। আপনার স্ত্রী-র নামটা কী? সমর এত তাড়াতাড়ি কিছু ভেবে না পেয়েই বলে ফেলল— অনামিকা।

—ঠিক আছে, আপনি এখন যেতে পারেন। আমরা তো আছি। চিন্তার কোনও কারণ নেই।

সমর কিছু বলার আগেই ডাক্তার ভিতরে চলে গেলেন। সমরের শরীরটা যেন বড়ো ভারী বোধ হতে লাগল। কিছু খাওয়াও হয়নি। খুবই ক্লান্ত লাগছে। এ আবার কোন ঝামেলায় আটকে পড়ল কে জানে। এ সব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল।

( দুই )

পরের দিন সকালবেলা সব কাজ সেরে নিয়ে, ব্যাংক-এর চেক বই, এটিএম কার্ড সঙ্গে নিয়ে রওনা হল সমর। হাসপাতালে পৌঁছেই খবর নিল বড়ো ডাক্তার এসে অনামিকা-কে দেখে গেছেন কিনা। রিসেপশনে খবর নিতেই তাকে জানাল — গতকাল রাতেই আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাই রুমে শিফ্‌ট করে দেওয়া হয়েছে। বড়ো ডাক্তার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, রুম নম্বর ১০৭-এ।

সমর আর দেরি না করে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। ডাক্তারবাবু বললেন— মি. সামন্ত, অনামিকা-কে আমি দেখেছি। এখন ওর জ্ঞান এসেছে। আগামীকাল সকালেই আপনি এসে ওকে নিয়ে যেতে পারেন। ভয়ের কিছু নেই। বাইরের চোটগুলোও তাড়াতাড়ি সেরে যাবে। তবে ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে হবে সম্পূর্ণ না সেরে ওঠা অবধি।

সমর ভেবে দেখল, জ্ঞান যখন এসে গেছেই তখন আর দেখা করে লাভ নেই। বরং আগামীকাল সকালে এসে ওর সব বিল চুকিয়ে দিয়ে চলে যাবে। ওর জ্ঞান এলে মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। ওর হঠাৎ মনে পড়ল, আচ্ছা মেয়েটির ঠিকানাটা তো ওরও জানা নেই। যাক, ওতে কিছু যায় আসে না। ওর কর্তব্য ও করে দিয়েছে। আগামীকাল হাসপাতালে গিয়ে টাকাটা চুকিয়ে দিলেই হবে।

সমর দিল্লিতে বড়ো হলেও, চাকরি করতে কলকাতায় আসার পর থেকেই সে কলকাতার ছেলেই হয়ে গেছে। দিল্লিতে মা, বাবা যে ক’দিন বেঁচেছিলেন সে ক’দিন দিল্লিতে যাতায়াত ছিল। আর এখন অফিসের কাজ ছাড়া মোটেই দিল্লি যাওয়া হয় না। সব পাট চুকে গেছে দিল্লির সঙ্গে। ব্যাংক-এর চাকরিটা নিয়ে যখন কলকাতায় এসেছিল, তখন থেকেই মানিকতলা মেইন রোডে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আছে। কখনও নিজে রান্না করে আবার কখনও হোটেলে খেয়ে নেয়। অফিস থেকে ফিরতে প্রায় রোজই দেরি হয় বলে রান্নার লোকও রাখতে পারেনি। মাঝে মাঝে খুব একা যে লাগে না তা নয়। সে কারণেই গতকাল সিনেমা দেখে মনটা একটু পরিবর্তন করতে গিয়ে কী বিপদটাই না হল !

( তিন )

পরের দিন মোবাইলের রিং-টা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল সমরের। ভাবল এত ভোরে কে আবার ফোন করল।

—হ্যালো, কে বলছেন?

—আজ্ঞে, আমি হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনার স্ত্রী, অনামিকা দেবীকে আজ ছেড়ে দেওয়া হবে। আপনি ঠিক দশটায় এসে বিল মিটিয়ে দিয়ে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন। উনি এখন সুস্থ আছেন।

—হাসপাতালে পৌঁছেই সব বিল ‘ক্লিয়ার’ করে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। হাসপাতাল থেকে কিছু দূরে আসতেই আবার হাসপাতাল থেকে ফোন এল। গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে ফোনটা ‘অন করল। অন্যদিক থেকে রিসেপশনিস্ট-এর কণ্ঠস্বর ভেসে এল –আপনি কোথায়? আপনার স্ত্রী, অনামিকাদেবী আপনার জন্য হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন।

সমর কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। একবার ভাবল, হাসপাতালে আর সে ফিরে যাবে না। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, হাসপাতালের রেকর্ডে তো ওর নাম ঠিকানা সবই লিখিয়েছে সে। কিছুক্ষণ গাড়ি-র স্টার্ট অফ করে চুপ করে ভাবতে লাগল, কী করা উচিত হবে। অনেক ভেবে আবার গাড়িটা নিয়ে ফিরে চলল হাসপাতালের দিকে। এখন তো ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে, তাই ওকে গিয়ে ওর বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দিলেই হল। এসব ভাবতে ভাবতে হাসপাতালে পৌঁছে ওর কামরায় পৌঁছেই দেখল অনামিকা হাসপাতাল ছাড়ার জন্য একেবারে তৈরি হয়েই বসে আছে।

সমর বলল— চলুন, এবার আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। কিন্তু অনামিকার চোখ দুটো সমরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

উত্তর দিল— চলো।

গাড়িতে বসে সমর জিজ্ঞাসা করল – আপনার বাড়ি কোথায়?

—কী সব আবোল তাবোল বলছ। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আমি কী করে হাসপাতালে এলাম তাই…ই মনে করতে পারছি না। ডাক্তারবাবু যে বললেন, তুমি আমার স্বামী। তবে আপনি, আজ্ঞে এসব করছ কেন? হেঁয়ালি ছেড়ে সোজাসুজি বলো। আমি তো তোমার সঙ্গেই যাব। কোনও স্ত্রী কি অন্য বাড়িতে যায়?

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...