রামায়ণের কাহিনি এই অঞ্চল জুড়েই। এখনও অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেতে যেতে আমাদের বাঁ-হাতে ঘন জঙ্গলের দিকে ইশারা করল ড্রাইভার। একটা কাঁচা সরু পথ ভিতরে চলে গেছে এঁকেবেঁকে। ড্রাইভার বলল, এটাই নাকি জটায়ু মন্দির অর্থাৎ রামায়ণে জটায়ু নাকি এখানেই আহত অবস্থায় পড়েছিলেন! অসম্ভব কিছুই নয়, হতেই পারে। সব ইতিহাস। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
পথে কিছু দর্শনীয় জায়গা আছে বৈকি। অনেকেই নামছে, তবে আমরা সেখানে দাঁড়ালাম না। আমাদের মন টানছে ধনুশকোডি। সন্ধের আগেই ধনুশকোডি থেকে ফিরতে হবে। কারণ, রাতে সেখানে নাকি মানুষ নয়, অতিপ্রাকৃতরা ঘুরে বেড়ায়। গাড়ি এগোচ্ছে, দুই দিকেই কেবল গাছ আর গাছ, সবুজের বাহার।
মুগ্ধ হয়ে দুই ধারে নারকেল গাছের বাগান দেখতে দেখতে ধনুশকোড়ি পৌঁছে গেলাম। ধীরে ধীরে সবুজ বনানী সরে গেল। পথে ধনুশকোডি গ্রাম, টপকে চলে গেলাম। আগে দুটি সাগরের মিলনস্থল দেখে আসি। ধনুশকোড়ি পিছনে ফেলে আমাদের গাড়ি নাক বরাবর ছুটে চলেছে।
এবার কিন্তু পথের দু-পাশে ছোটো ছোটো বালিয়াড়ি, পাথর। এগোতে এগোতে হঠাৎ দেখলাম চওড়া পাকা রাস্তা দিয়ে আমরা এগোচ্ছি, কিন্তু রাস্তার দু’পাশেই গভীর জলরাশি! যেন হাত বাড়ালেই জল ছোঁয়া যায়। একটু নামলেই সাগর জলে ডুব মারা যায়। এটি দুটি সাগরের সঙ্গমস্থল। এক কথায়— -অপূর্ব! নয়নাভিরাম!
আমার এক হাতে ভারত মহাসাগর আর অন্য হাতে বঙ্গোপসাগর। আপ্লুত হয়ে গেলাম। আমাদের রাস্তা এসে একটি পয়েন্টে শেষ হয়ে গেল, সেখানেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। সূচালো হয়ে আসা ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একেবারে শেষ সীমান্ত, তীরের ফলার মতো দেখতে কিছুটা। এই বিন্দুতে দুই সাগর মিলেমিশে একাকার। কিন্তু দু’জনেই তাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ ভাবে বজায় রেখেছে, একেই বলে প্রকৃতির খেলা।
ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলের একেবারে শেষ বিন্দুতেই আমি দাঁড়িয়ে, ভাবা যায়! ঘন নীলাকাশের নীচে শোভা পাচ্ছে অশোক স্তম্ভ। আমার সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে— কেবল জল আর জল। একেবারে সামনে নাক বরাবর ২০ কিমি দূরে শ্রীলংকা আর পিছনে আমার দেশ।
মিলেমিশে একাকার হলেও কিন্তু দুই সাগরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেছে। একদিকে নীল জল, অন্যদিকে অলিভ গ্রিন জলরাশি। মাঝে হালকা একটি রেখা বোঝা যায়, যদিও দুই সমুদ্র একেবারে আলিঙ্গনাবদ্ধ। অশান্ত ভারত মহাসাগরে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। সাদা ফেনায় ভরে যাচ্ছে…। সেই সমুদ্রে নামা নিষেধ, পুলিস পাহারা দিচ্ছে। এদিকে বঙ্গোপসাগর একেবারে শান্ত সমাহিত যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন ঋষি। একেবারেই স্থির। এও সম্ভব! মিলেমিশে গেছে তবু পার্থক্য স্পষ্ট। যেন মায়ের দুই ছেলে, একটি দামাল, অন্যটি একেবারে ধীর স্থির।
এটিই নাকি রামসেতুর অংশ। দেহ মন কেঁপে উঠল। আমি হয়তো সেই সেতুর উপরেই দাঁড়িয়ে আছি। যদিও বর্তমানে খালি চোখে সেই সেতু মোটেই দেখতে পেলাম না। তবে অনুভব করলাম। সেতু প্রায় দেড় কিলোমিটার গভীরে আছে এবং ধীরে ধীরে আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। সমুদ্রপথে যেতে হলে একমাত্র এখান দিয়েই লংকা যাওয়া সম্ভব। অনেকে বাইনোকুলারে শ্রীলংকা দেখার চেষ্টা করছে। চারিদিকে পর্যটকদের ভিড়। কাটা ফল, আইসক্রিম, ইডলি বিক্রি হচ্ছে।
এবার ধনুশকোডি গ্রামে যাওয়া যাক। ফেরার পথে এই একই রাস্তায় এল ধনুশকোডি গ্রাম। দুই দিকে বালিয়াড়ি আর পাথর, ধুধু প্রান্তর,ওই বহুদূরে সমুদ্র। একদা ছোট্ট একটি গ্রাম বর্তমানে জনশূন্য। খাঁ খাঁ করছে। এখনও ভাঙা কিছু বাড়ি, সরকারি অফিস, একটি চার্চের কিছু অংশ, বাজার, রেলওয়ে স্টেশন ভেঙে চুরে দুমড়ে-মুচড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। সবাইকে যেন জানাচ্ছে এই যে, এটি এখন ধ্বংসস্তূপ হলেও আমরা কিন্তু এখনও সেই গ্রামের অস্তিত্ব বয়ে বেড়াচ্ছি।
দেখতে দেখতে এক পশলা মেঘ এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। জায়গাটি দেখে বড়ো কান্না পায়! বড়ো মন খারাপ করা জায়গা। জানা গেল শ্রীরামচন্দ্র নাকি সেতু বানানোর জন্য এখানেই প্রথম বসতি শুরু করেন। ওই যে বললাম— বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সেই শুরু। তারপর থেকেই এই গ্রামটি রয়ে যায়। আসে ব্রিটিশরা, বহু লোক খ্রিস্ট ধর্মালম্বী হয়। তারই সাক্ষী ভেঙে যাওয়া চার্চ। এখনও চার্চের ভিতরের অংশ তেমনই রয়েছে। চার্চের ভগ্নাংশ দেখলে আন্দাজ করা যায়, বেশ বড়ো মজবুত ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে। গা ছমছমে, শিহরণ জাগানো একটি জায়গা। কিন্তু কেন?
জানলাম ১৯৬৪ সালে এক বিরাট ঘূর্ণিঝড়ে রাতারাতি ধনুশকোডি গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। সেদিনটি ছিল ২২ ডিসেম্বরের রাত। সারা গ্রাম, চার্চ তখন সেজে উঠেছে বড়োদিনের আনন্দে। ঠিক সেই সময়… প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় সমুদ্রের তলায় চাপা পড়ে। ধ্বংস হয়ে যায়, তলিয়ে যায় চলন্ত যাত্রীবোঝাই পম্বন-ধনুশকোডি প্যাসেঞ্জার ট্রেন। ট্রেনটিতে ছিল ১১৫ জন যাত্রী। এতগুলো মানুষের ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার চাপা পড়ে গিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে।
চমকে উঠলাম, হয়তো আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমার পায়ের তলায় এখনও রয়ে গেছে কিছু কঙ্কাল! এখনও খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে অসংখ্য নরদেহ! উদাসী জায়গা, মন খারাপ করা জায়গা। কেবল সোঁ সোঁ হাওয়ার শব্দ! যেন আজও বাতাসে তাদের দীর্ঘশ্বাস! সাইক্লোনে কত প্রাণ অকালে চলে গেল! সেই সময় ছিল না ইন্টারনেট, ছিল না এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আগে থেকেই বিধ্বংসী ঝড়ের খবর কেউ পায়নি। তাই অতর্কিতে আচমকাই তলিয়ে গেল একটি আস্ত গ্রাম, একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। স্টেশনের ধ্বংসাবশেষ আজও পড়ে আছে। তারপর থেকেই সরকার গ্রামটিকে বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে।
একদা জনবহুল আজ জনশূন্য, ভূতুড়ে বলে পরিচিত। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিল মৎস্যজীবী। তবে আজও কিছু নৌকা চোখে পড়ল। শহর থেকে এসে জেলেরা মাছ ধরতে যায় গভীর সমুদ্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। যদিও বিকেল হলেই একটি মানুষও আর ওই তল্লাটে থাকে না। এই জায়গায় বিকেলের পর আর কেউ আসে না। তখন নাকি সেখানে নানা অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়! শোনা যায় কান্না! শোনা যায় ঘণ্টাধ্বনি। অনেকেই এসব ভূতুড়ে বলে মনে করে। ভারতবর্ষের হনটেড প্লেসের মধ্যে এটি অন্যতম।
ট্যুরিস্টদের জন্য কিছু চিপস, কোলড্রিংস, ডাবের ছোটো ছোটো দোকান আছে। আর আছে ঝিনুকের তৈরি কিছু ঘর সাজানোর জিনিস, মেয়েদের চুড়ি-মালা। সবকিছু ছাপিয়ে যেন বিষাদ ভরা বাতাস বইছে সর্বক্ষণ নীরবে, আমার তো তেমনটাই মনে হল। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধে নামবে। ভাবলাম, এবার রাতের অন্ধকারে চাক্ষুষ করি প্রান্তিক এই ভূতুড়ে গ্রাম! দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত, পূর্ব উপকূলের। কিন্তু না, বুকটা দুরু দুরু করে কেঁপে উঠল। আর দুঃসাহস দেখিয়ে কাজ নেই। ড্রাইভার তো শুনে রেগেই আগুন, সে আমাদের ছেড়েই চলে যেতে চায়। মাথায় থাকুক আমার ভূত দেখা!
এরই মাঝে জেনে নিলাম গ্রামের এই অদ্ভুত একেবারে নতুন ধরনের নামের হেতু। স্থানীয় দু-একজন যেমনটা ব্যাখ্যা করল- শ্রীরামচন্দ্রের লংকা জয়ের পর বিভীষণ এখানে আসেন। ঠিক এই জায়গাটিতে বিভীষণ এবং শ্রীরামচন্দ্র তাদের ধনুক সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করে যুদ্ধ সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। সেই থেকে নাম হয়েছে— ধনুশকোডি (এন্ড অফ বো)।
আবার অনেকের মতে, পূর্ব উপকূলের এই শেষ বিন্দুটি দেখতে ঠিক ধনুকের মতো অর্ধগোলাকার আবার তীরের ফলার মতো ছুঁচলো একটি বিন্দু। সেই থেকে নাম হয়েছে ধনুশকোডি। (কোডি অর্থ এন্ড)।
ধনুশকোডি থেকে ফেরার পথে কিছু জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা ঘুরে দেখা হল। ছোট্ট টিলা মতোন। টিলার উপর থেকে রামেশ্বরম দ্বীপটির চারিদিক একেবারে স্পষ্ট। প্রতিটি পথ, প্রতিটি খাঁজ। কেবল সবুজ, নিশ্ছিদ্রঘন সবুজ আর নীল জল। একমাত্র এইখান থেকেই হয়তো শ্রীলংকায় যাওয়ার পথ খোঁজা সম্ভব ছিল। এর নাম গন্ধমাদন মন্দির। ঠিক এই জায়গাটিতে বসেই নাকি রামচন্দ্রের সঙ্গে হনুমান লঙ্কার দিক নির্ণয় করেছিল।
দেখলাম মিষ্টি জলের কুয়ো। অদ্ভুত! কে কবে কীভাবে মিষ্টি জলের একটি স্রোত আবিষ্কার করল! চারিদিকে লোনাজল কিন্তু কুয়োর জল একেবারে নরমাল। পান করার উপযোগী। বেশ মিষ্টি জল! স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, এইখানেই নাকি শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীর জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সত্যি-মিথ্যা জানি না, তবে ব্যাপারটি সত্যিই ভাবায়। সবাই জল খাচ্ছে, আমি নিজেও খেয়ে দেখলাম। সমুদ্রের জল মুখে দিতেই আমার মুখটা জ্বলে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কুয়ো থেকে জল নিয়ে দেখলাম, একেবারে মিষ্টি জল। যেই আবিষ্কার করুক, যিনিই এটি তৈরি করুন, তিনি সাধারণ নন।
দেখলাম জটায়ু মন্দির। কাঁচা রাস্তা দিয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতরে কিছুটা জায়গা, মন্দির বলে তেমন কিছু না থাকলেও, জায়গাটি কিন্তু আছেই৷ এই মাটি একসময় হয়তো জটায়ুর রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। মাটি ছুঁয়ে কপালে হাত ঠেকালাম, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আবার বৃষ্টি! সর্বক্ষণই সমুদ্রের ধারে রৌদ্র ছায়া, মেঘ-বৃষ্টির খেলা চলল।
রাত সাড়ে আটটায় ট্রেন, চেন্নাই এক্সপ্রেস। মাত্র দুটি ট্রেন আছে। ট্রেন এগিয়ে চলল। কিছুটা এসেই ব্রেক! ধীরে, অতি ধীরে সমুদ্রের উপর দিয়ে চলতে লাগল। সেই বিখ্যাত পম্বন ব্রিজের পাশ দিয়ে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! ফারাক্কা ব্রিজের মতো দুই পাশে লোহার গরাদ নেই, কেবল জলের উপর রেললাইন পাতা। ঝিকঝিক করে সমুদ্র পেরিয়ে ট্রেন আবার মাটি স্পর্শ করল। থ্যাঙ্ক গড! তবে সব কি আর সম্পূর্ণ হয়! ভ্রমণের কিছু বাকি রয়েই যায়। সেই বাকিটুকু সম্পূর্ণ করার জন্য আবার হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় অজানায়। ভ্রমণপিপাসু আমরা আবার ঘর ছাড়ি। পরের বার সকালবেলার টিকিট নেব। সাগরের উপর দিয়ে ট্রেনে চড়ার থ্রিল নেব, নীল জলরাশির সৌন্দর্য দেখব। এবার সেটা মিস করলাম। কারণ রাত ন’টায় জল-স্থল-অন্তরীক্ষ আঁধারে মিলেমিশে একাকার। বাইরের দৃশ্য কিছুই উপভোগ করতে পারলাম না। কেবল অনুভব করলাম, আমরা সাগর পাড়ি দিচ্ছি, কু-ঝিক-ঝিক…।
পিছনে পড়ে রইল সেই ধনুশকোডি, যেখানে এই রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে অশরীরীরা! হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া তাদের ঘর! খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘূর্ণি ঝড়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন। হয়তো এই সময় ধনুশকোডি অশরীরীদের হাহাকারে ভরে উঠেছে। হয়তো তারা দূর থেকে আমাদের দেখছে, ভাবছে কত শত রোজ এমন আসে, আবার চলে যায়। কেউ থাকে না ভয়ে। কিন্তু কেউ কি দেখেছে তাদের! সে দুঃসাহস কারও হয়নি। অদ্ভুত এক রহস্য।