সারা রাত জেগে মশার কামড় খেয়ে যোগী একটি দোকান পাহারা দেয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই দায়িত্ব ছিল ওর বাবার উপর। পরস্ত্রী আসক্ত যোগীর বাবা সংসার ধর্ম ত্যাগ করে বস্তির এক মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ায় অধুনা সেই কাজের গুরুভার এখন যোগীর উপর ন্যস্ত। কাজটা সহজলভ্য ছিল না মোটেই। যোগী বয়সে ছোটো বলে কাজটা প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেই কারণে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে কাজটা হাতে পাওয়ার জন্যে। মায়ের কান্নায় শেষ পর্যন্ত মালিককে রাজি হতে হয়েছিল। ওদের সংসারে যোগীই একমাত্র কর্ণধার সংসারটা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে। সুতরাং যোগীর দায়িত্ব তূলনামূলক ভাবে ছিল অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি। যোগী ঘুমালে ওদের সংসার চলবে কী করে?

মালিকের দোকান বস্তিপাড়ার অদূরে। তিনি থাকেন অন্যত্র। এই তল্লাটে সবগুলো দোকানের তুলনায় তাঁর দোকানটাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেই কারণে একটি পাহারাদার তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। কম খরচে বিশ্বস্ত একটি লোক। অন্তত কেউ চুরি করতে এলে সে না পারুক চিৎকার চেঁচামেচি করে আশেপাশের লোকজনদের যেন সচকিত করে তুলতে পারে।

রাতের অন্ধকারে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলেও সহজে ঘুম আসতে চায় না। সোনা মনে মনে তীব্র আক্রোশে মরমে জ্বলে মরে। কেবলই ভাবে যোগীর কাজটা যদি তার কপালে লাগত তাহলে মনে কোনও ক্ষোভ থাকত না। দিব্বি রসে-বশে সে দিনাতিপাত করতে পারত! মাসের শেষে পাঁচশো টাকাই বা কম কীসের? যত তুচ্ছই হোক, তবু বুক চিতিয়ে বলা যেত সে রোজগার করে বা চাকরি করে। ওই একটা ব্যাপারেই সোনার যত হিংসে যোগীর উপরে।

অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে যোগী পাহারায় বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে থাকে। মনে মনে ভাবে সত্যি বাপটা কী স্বার্থপর ও অপদার্থ! কারও কথা একবারও চিন্তা করল না? তার অবর্তমানে কীভাবে সংসারটা চলবে, কীভাবে দিন কাটবে কোনও কিছুর তোয়াক্কা পর্যন্ত করল না। অথচ সোনার বাপটা সংসারের জন্যে কী পরিমাণ প্রাণপাত করে! সংসারটা চালানোর জন্যে সে নিজের কথা বোধহয় কখনও ভাবেও না।

সারাদিন নিরলস পরিশ্রম করে ঠোঙা তৈরি করে। তারপর যায় পায়ে হেঁটে বাজারে বিক্রি করতে। তারই ফাঁকে সোনার মায়ের সাথে বসে বড়ি, পাপড় আর আচার তৈরি করে। খাটিয়া বাঁধতে জানে। দিন মজুরির সন্ধানে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ি ফেরে, তখনও মুখে থাকে একরাশ নির্মল হাসি।

নিজের হাতে আনাজ কিনে আনে। তারপরে একসাথে বসে সকলে মিলে নৈশভোজন করে। যোগীর মতো সোনাকে রাতের পর রাত জাগতে হয় না। মশার কামড় খেয়ে দোকান পাহারা দিতে হয় না। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারে আগামীদিনের নতুন স্বপ্ন নিয়ে। গরিবের ঘরেও যে সুখ বিরাজ করে এটা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

যদিও এক অখ্যাত দিনে সমস্ত চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটে। তখনও আর মাত্র কয়েকটা কাগজ বিক্রি করার বাকি ছিল। সেদিন কাগজ বিক্রির ব্যস্ততায় কখন যে লাল বাতির পরিবর্তে সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছিল যোগী তা খেয়াল করতে পারেনি। সেদিন কেন যেন সকলেই কাগজ কেনার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সেদিনের সান্ধ্য কাগজে হয়তো বিশেষ কোনও উত্তেজনাপূর্ণ বা রোমাঞ্চকর খবর ছাপা হয়েছিল, যার দরুন ছিল মানুষের অপ্রত্যাশিত চাহিদা৷ সেদিন এক মুহূর্তের জন্যেও সময় নষ্ট করার অবকাশ ছিল না। হাতে কাগজ দিয়ে পয়সা গুনে অন্য গাড়ির দিকে ছুটে যেতে হচ্ছিল।

যোগী সেইসময় সিগন্যালের দিকে পিঠ দিয়ে কাগজ বিক্রি করতে ব্যস্ত ছিল। টের পায়নি কখন সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছিল। দূর থেকে সবুজ বাতির সংকেতে দ্রুতগতিতে গাড়ি ছুটে আসছিল। নিমেষে তীরবেগে ছুটে আসা একটি গাড়ির বাঁদিকের সামনের চাকায় যোগী মুহূর্তের মধ্যে হঠাৎ পিষে গিয়েছিল। সোনা ভয়ে ও আতঙ্কে সহসা চিৎকার করে উঠেছিল গাড়ির কর্কশ আওয়াজে। অবশ্য যোগী সেই মুহূর্তে সোনার সাবধানিসূচক চিৎকার শুনতে পেয়েছিল কিনা বলা কঠিন। লোকজনের ভিড়ে যোগী একেবারে আড়াল হয়ে গিয়েছিল।

অতঃপর যোগী একসময় সাদা কাপড়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আর দেখা যায়নি তাকে। চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। জীবিতাবস্থায় যে গাড়ি চাপা পড়ল, মৃত্যুর পরে সেই আবার গাড়ির অন্যতম যাত্রী। কথাটা ভাবতেই কেমন যেন অসহায় লাগছিল সোনার।

সাথীহারা সোনা, যোগীর অনুপস্থিতির কারণে সেদিন অসহায় ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে তার মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিল। সেদিন নিদারুণ শোকে দুঃখে সোনার আহার নিদ্রা পর্যন্ত ঘুচে গিয়েছিল। যোগীর শেষ মুহূর্তের করুণ দৃশ্যটা বারংবার তার মানসপটে ভেসে উঠছিল। সেই রাত্রে সোনা যোগীর কথা ভাবা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পাচ্ছিল না। তারপর কী মনে করে সোনা একসময় শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ে। সবার অলক্ষ্যে সে চলে যায় যোগীর অবর্তমানে দোকান পাহারা দিতে। ক্লান্ত শরীরে ভারাক্রান্ত মনে ভোরের দিকে চোখের পাতা জড়িয়ে আসায় আর জেগে থাকা সম্ভব হয়নি। কুকুরকুণ্ডলী অবস্থায় সে দোকানের দোরগোড়ায় শুয়েছিল।

পুব আকাশে তখন সবেমাত্র সূর্য উকি দিতে শুরু করেছিল। পাখিদের ভোরের কূজনও প্রায় থেমে গিয়েছিল। তার অনেক পরে বেলা আটটা নাগাদ দোকান খুলতে এসে স্বয়ং মালিক সোনার ঘুম ভাঙায়। ধাক্কা দিতেই সোনা নিদ্রাজড়িত চোখ মেলে তাকায়। মালিক সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ভ্রুযুগল কুচকে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে— – তুই কে? তুই এখানে শুয়ে আছিস কেন?

সেদিনের নিদারুণ দুঃসংবাদটা জানানোর উদ্দেশ্যেই বোধহয় রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে সোনার বাইরে বেরিয়ে আসা। সোনা উদাস চোখে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়— – বাবুজী, যোগী গাড়ি সে টকরা কর মর গ্যায়া পিছলি রাত। ও জীবিত নেহি হ্যায়।

অভিব্যক্তিতে বিশেষ কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না। ব্যবসায়ী মন নিজের আর্থিক লাভ-লোকসানে যতটা আগ্রহী পরের জাগতিক লাভ-লোকসানে তাঁর ততটাই অরুচি।

সে নির্বিকার চিত্তে বলে ওঠে— গাড়ি সে টকরা কর মর গ্যায়া? কোই বাত নেহি। একদিন তো মর না হী থা!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...