যোগীর প্রতি মালিকের হৃদয়হীন মন্তব্যে সোনা আহত হয়। মনে মনে ভাবে একগাল বাসি থুতু মালিকের মুখে ছিটিয়ে দিতে পারলে বোধহয় প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কিছুটা মিটত। ইচ্ছেটা চরিতার্থ করতে না পেরে সে গুমরে মরে। সতীর্থ হওয়ার কারণে যোগীর মৃত্যুর খবরটা মালিকের কানে পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল তার জীবনের অন্যতম নৈতিক কর্তব্য। সোনা তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হয়।

মালিক সেই মুহূর্তে সুবর্ণ গোলকের ন্যায় একটি আশাতীত প্রস্তাব ছুঁড়ে দেয়— বোল তু কাম করেগা?

বলাবাহুল্য সোনার কাছে চির আকাঙ্ক্ষিত এবং লোভনীয় এক সুযোগ। সোনার কাছে তখন উভয় সংকট। মালিকের মুখ নিঃসৃত কথাটা শোনামাত্র অন্তরটা চকিতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। সোনা ভাবে যোগীর পরিত্যক্ত স্থানে আসীন হলে যোগীর বিদেহী আত্মা যদি কোনও ভাবে দুঃখ পায়? আবার ভাবে মাসান্তে ওই পাঁচশো টাকাই বা কম কীসের? যোগীকে সে এই কারণেই এককালে হিংসে করত। আজ মালিকের অযাচিত প্রস্তাবে সম্মতি জানানোই হবে সবদিক থেকে বুদ্ধিমানের পরিচয়। কিন্তু বিবেক সায় দিচ্ছিল না।

মালিকের প্রস্তাবে স্বীকৃতি জানালে যোগীর প্রতি তার যে অন্যায় অবিচার করা হবে। সোনা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে চোখে চোখ রেখে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জবাবদিহি করে— নেহি বাবুজী। মেরে সে ইয়ে কাম নেহি হো পায়গা।

সোনার এই অস্বাভাবিক আচরণে মালিক অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়। তুচ্ছজ্ঞানে অস্বীকার করায় মালিক অতিশয় কুপিত হয়ে ওঠে। অবাধ্যতার কারণে মুহূর্তে তার চুলের মুঠি ঝাঁকিয়ে নিতম্বে সজোরে এক লাথি মেরে বলে— শালা শূয়ার কা বাচ্চা, ভাগ ইঁহাসে।

এত লাঞ্ছনা ও অপমান সত্ত্বেও সোনার চোখে জল আসে না। শোকে-দুঃখে চোখের জল যেন সব জমাট বেঁধে গিয়েছিল। অসহায় সোনা লাথি খেয়ে দোকানের বারান্দা ছেড়ে এক সময় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।

প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকেলেও সোনা কাগজ বিক্রি করতে আসে। আসে বাধ্য হয়ে, বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না বলে। কিন্তু চৌরাস্তায় এসে সব ফাঁকা মনে হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন প্রতিযোগীহীন নিষ্কণ্টক কর্মভূমি, তবু নিজেকে বড়ো একাকী এবং অসহায় মনে হয়। দৃষ্টির সীমারেখায় যাবতীয় সবকিছুই আগের মতো বর্তমান, নেই শুধু তার প্রাণসখা যোগী। সোনার সমস্ত সত্তা জুড়ে তখন কেবল যোগীর উপস্থিতি। অন্যদিনের মতো ছোটাছুটি করে কাগজ বিক্রি করতে সেদিন তার মোটেও ভালো লাগছিল না। সব কীরকম অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হচ্ছিল।

খোলা রাস্তা কাগজ বিক্রি করার অফুরন্ত অবকাশ। তবু দু’পায়ে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পর্যন্ত তার আয়ত্তে ছিল না। জীবনযুদ্ধে হার-জিত, জয়-পরাজয় সব যেন তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। যোগীর কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তে চোখ দুটো নিমেষে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। দু’চোখের কোণ বেয়ে অবিরাম ধারায় নেমে আসছিল অশ্রুধারা। মনে পড়ছিল যোগীর বলা সকরুণ আকুতি — আমি মরলে তুই কাঁদবি তো? সোনা ভাবে ও কি আমাকে কাঁদাবে বলেই এত শীঘ্র মৃত্যুবরণ করল? সত্যি-মিথ্যা যাচাই করবে বলে? ওর মৃত্যু সম্পর্কে ও কি আগাম কিছু জানতে পেরেছিল?

যোগীর কথা ভাবতে ভাবতে সে বিভোর হয়ে গিয়েছিল, অনুতাপের আগুনে পুড়ে মরছিল। যোগী বেঁচে থাকতে তার উপর সে অনেক অন্যায় অপরাধ করেছিল। কিন্তু এখন শুধুই স্মৃতিচারণ। যোগীর কাছে সে ক্ষমাপ্রার্থী। বিষাদগ্রস্ত মনে সে সিমেন্ট বাঁধানো ফুটপাথের উপর বসেছিল এক মনে। হাতে রাখা ছিল পুরোনো একটি খবরের কাগজ। সেটা বিক্রির জন্যে নয়। ছবি সহ যোগীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন। রাস্তার পান দোকানওয়ালা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল কাগজখানা।

অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাম্বুল রসে কণ্ঠনালি সিক্ত করার অছিলায় উক্ত পান দোকানের সামনে দাঁড়াতেই ছেলেটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। বাঙালি মাত্রই ভাবুক হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সোনা নামের সেই হতভাগ্য ছেলেটিই সেদিন আমাকে ওর ব্যাপারে গল্প লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পড়ন্ত বিকেলে ফুটপাথে পড়ে থাকা ছেলেটিকে কী মনে করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ভিক্ষে চাইতে আসছে। পরে অবশ্য আমার সেই ভুল ভেঙেছিল, বুঝেছিলাম সেইসব কিছু নয়। ওর হাতে ধরা সেদিনের কাগজখানা আমার চোখের সামনে মেলে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কম্পিত স্বরে অনুরোধ করেছিল এই বলে— বাবু, এতে কী লেখা আছে আমারে একবার পইড়া শুনাবেন?

পরের দুঃখে ব্যথা পাওয়ার মতো সংবেদনশীল হৃদয় ঈশ্বর যে আমাকে দেননি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেদিন বন্ধুর বিরহে বিরহী সোনার স্বমুখে ওর দুঃখের কথা শুনে আমি যারপরনাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। উপেক্ষা করতে পারিনি। ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওর কথা শুনে। দাঁত দিয়ে চুন কেটে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। সুদূর দিল্লি শহরে একটি পান দোকানের সামনে ঢিলে-ঢালা জামা-প্যান্ট পরিহিত অজ্ঞাত কুলশীল একটি নাবালক ছেলের মুখে বাংলা মিশ্রিত হিন্দি কথা শুনে ওকে উপেক্ষা করি সেই সাধ্য আমার ছিল না। আদ্যোপান্ত খবরটা পড়ে ওকে বাংলায় বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।

আমাকে বাঙালি জেনে ও তারপর ভাবাবেগে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। ওকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটি সেদিন কাগজ বিক্রি করতে পারেনি বলে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলাম। পকেট থেকে বের করে কয়েকটা টাকা ওর হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে শুধু বলেছিলাম— একটা কথা মনে রেখো, যার যত শীঘ্র মৃত্যু হয় জানবে ঈশ্বরের সে ততই প্রিয়! তুমি কেঁদো না বা দুঃখ কোরো না। ও মুক্তি পেয়ে গিয়েছে! ও যেখানে গিয়েছে একদিন আমাদের সকলকেই যেতে হবে। সবাই যাওয়ার জন্যই আসে। কেউ আগে কেউ পরে, এই যা তফাৎ। তুমি এখন বাড়ি যাও।

একমুখ পানের পিক রাস্তার উপর ফেলে শেষে আমিই একসময় রওনা হয়েছিলাম নিজ গন্তব্যের দিকে। ওকে দেখলাম নিঃসাড় নিস্তেজ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও আগের মতোই অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। দুই গাল বেয়ে নেমে আসছিল সরু একটি জলের ধারা। দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে আলো-আঁধারের গোলকধাঁধায় ছেলেটি একসময় সত্যি সত্যি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

আমি ছিলাম ওই পান দোকানের স্থায়ী ক্রেতা। আইটিও-তে আমার অফিস। ওই পথে আমার রোজ যাতায়াত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেদিনের পরে ছেলেটিকে আর কখনও কোথাও দেখা যায়নি। এই বিশাল বিপুল মায়াঘেরা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সে যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল কে জানে!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...