মেয়ের মাধ্যমিক দেবার সময় হল এখনও পুতুল খেলার শখ গেল না। পুরোনো, নতুন কোনও পুতুলই সে ফেলতে রাজি নয়। ছেলেরও একই অবস্থা ভাঙা ব্যাট, ফাটা বলও যেন মহার্ঘ সম্পত্তি।
বাবার কথা মনে হল অরুণালোকের। বাবা বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে প্রায় পঁচাত্তর বছর এক ভিটায়। আজও গ্রামের বাড়িতে গেলে চোরকুঠুরি থেকে এক একটা জিনিস বের করে ছেলেকে দেখায় অরুণালোকের বাবা— দ্যাখ, তোর বাবার খেলার জিনিস। মরচে ধরা নাট বলটু, লোহার হাতুড়ি, টিনের বাক্স। বাবা যে কেন এসব ফেলে দেয় না !
বিধান অ্যাপার্টমেন্টের সবাই একে একে দেখা করে যাচ্ছে। সৃজার চোখে জল। ছোটো ফ্ল্যাট বাড়িতে এই এক সুবিধে, সবাই সবাইকে চেনে। দু’-একজন বাদ দিলে সবাইয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক মধুর। মজুমদার মাসিমাকে দেখে সৃজা ডুকরে কেঁদে উঠল। অথচ দু’দিন আগেই গাল ফুলিয়ে বলেছিল, ‘সুইমিং পুল আছে, জিম আছে, বাচ্চাদের জন্য আলাদা পার্ক,
চোর-ডাকাতের ভয় নেই, সাপ-ব্যাঙের ভয় নেই, উটকো লোকের বেল বাজানোর ভয় নেই। একেবারে নিরাপদ। জানলা খুললে দূরে দারুচিনি দ্বীপ!”
বাচ্চাদের ছেড়ে কোথাও কিছুক্ষণ যাওয়ার প্রয়োজন হলে এতদিন মজুমদার মাসিমা ভরসা। তিনি শুনে বললেন, “প্রায় সারা জীবনই তো একতলায় কাটালাম রে। এ এলাকায় দেখ না, কত একতলা নিজস্ব বাড়ি। কাকে ক’টা পুলিশ পাহারা দিয়ে রেখেছে বল, ডাকাতির কথা শুনেছিস এখানে এসে?”
এই কথাগুলো অরুণালোকও সৃজাকে বলত। সন্তোষপুরে একতলা-দোতলা বাড়িই বেশি। ওদের তো নিজস্ব সিকিউরিটিও নেই। আমাদের নেপালি দারোয়ান আছে।
কিন্তু সৃজার কানে এসব কথা ঢুকত না। অরুণালোক হাসপাতালে চাকরি করে, তাই শিফটিং ডিউটি করতে হয়। ইভনিং বা নাইট-ডিউটি থাকলে সৃজার টেনশন বেড়ে যায়। জানলাও খুলতে চায় না। ফ্ল্যাট থেকে অদূরে কয়েকটা ছোটো ঘর আছে। ওখানে মদ খেয়ে নিজেদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-মারামারি হয়। একদিন সকালে নাইট ডিউটি করে এলে সৃজা বলল, “জানো কাল সারা রাত ঘুমাইনি। ওদের কী ঝগড়া!”
এবার আর লাগোয়া বস্তি নেই। নেই বিরক্তিকর মশা। নেই প্যাকিং-মুভিং-এর খাটুনি। এক কিমিও দূর নয়। লরি করে নিজে হাত লাগিয়ে একদিন যেমন এ ফ্ল্যাটে এসেছিল, তেমনটা ঘটল না এবার। এবার প্রফেশনাল লোক আনা হয়েছে। তারা মসৃণ ভাবে সবকিছু সামলে নিচ্ছে। শুধু কী কী বাদ দিতে হবে তারা তা জানে না। সৃজা একটা পুরোনো ব্লাউজ হাতে নিয়ে তাকিয়েই রইল। কতদিন পরা হয়নি ব্লাউজটা! ভুলেই গেছিল। নেবে কি সঙ্গে? আর কি কোনওদিন পরবে? না, শুধু বোঝা বাড়াবে না। এসেছিল এক লরিতে, এখন যাবে দু-লরি। এরপর কি তিন লরি, চার লরি? আবার কী নিরাপত্তার অভাব হবে? আরও ভালো কোনও নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে! কোথায় আছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা? অরুণালোক ভাবে।
তিন
পাকা দু-দিন হল স্বর্ণলতায় আসা। অর্ধেকও গোছানো হয়নি। এরই মধ্যে ঠিক উপরের তলার মিসেস গুপ্ত ও সৃজার মধ্যে বেশ ভাব হয়েছে। প্রবীণার সংসারে শুধু স্বামী। ছেলে সিঙ্গাপুরে থাকে। আগে এ ফ্ল্যাটে যারা থাকত, তাদের সঙ্গে মিসেস গুপ্তের যোগাযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। অরুণালোক ভাবল, অসুস্থ স্বামী ছাড়া আপনজন বলতে তো কেউ নেই, না-হয় করলেনইবা একটু বাচালতা। আমাদেরও তো কথা বলার, মেলামেশার লোক চাই। ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মিস্টার বিশ্বাস। তিনি মিসেসকে নিয়ে একবার আলাপ করে গেছেন। তবে ঠিক সামনের ফ্ল্যাট তালা বন্ধ। হয়তো বাইরে কোথাও গেছেন।
আজ অরুণালোক ডিউটি যেত না। কিন্তু এক কলিগের জ্বর হওয়ায় ইভনিং ডিউটি করতে হবে। ইনচার্জ ফোনে জানাল। সৃজা খুশি নয়। ডিউটি করতে রাজি হওয়ায় সে বিরক্ত। তবে বাধা দিতে পারবে না। অরুণালোক রেগে যাবে, উলেটাপালটা কথা বলবে, “চব্বিশ ঘণ্টা বসে বসে তোমাদের পাহারা দিলে চলবে!”
আগের ফ্ল্যাট হলে অরুণালোক সাবধান করত — – কোলাপসিবল গেটে ডবল লক করবে। জানলা বেশি খোলা রাখবে না। কেউ কলিংবেল টিপলে জিজ্ঞেস করে দরজা খুলবে… ইত্যাদি। কিন্তু এই সাততলায় কী বলবে অরুণালোক
চার
অরুণালোককে সাধারণত দু-বার কলিংবেল টিপতে হয় না। আজ ইভনিং ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরে এল। সৃজার সাড়া পেল এবার, ‘কে?’
—আমি।
তবু যেন দরজা খুলতে সময় লাগল। বিকেলে দেখে যাওয়া মুখের সঙ্গে এ মুখের বিস্তর ফারাক। গোলাপি মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে। ভালো খবর বা খারাপ খবর— যাই থাকুক অরুণালোক বাড়ি আসা মাত্রই সৃজা গড়গড়িয়ে সব বলে দেয়। তবে কী বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ির কোনও খারাপ খবর! তাহলে ও তো চুপ থাকার পাত্রী নয়। এ অভিমানের ইঙ্গিতও নয়। কী হল? কথাটা চোখে চোখেই বলল ক্লান্ত অরুণালোক। এবার সৃজার বাঁধ ভাঙল।
—এ ফ্ল্যাট আমাদের মিথ্যে বলে বিক্রি করে গেছে, জানো। তাই এত কম দাম! আমি আর এ ফ্ল্যাটে থাকব না। তুমি কালই বিক্রির ব্যবস্থা করো।
—ঘটনাটা কী?
—গুপ্ত মাসিমা সন্ধেবেলা এসেছিলেন। জানো কী বললেন? শুনলে তুমি তাজ্জব হয়ে যাবে!
—আঃ জানব কী করে!
—আমাদের সামনের ফ্ল্যাটে গত মাসে এক মহিলাকে নৃশংস ভাবে খুন করেছে কেউ! এখনও তার হদিশ পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ওটা তালাবন্ধ। দুপুরবেলা ঘটেছে! আমি বাবা কালকেই চলে যাব। অপ্রত্যাশিত ঝটকা।
—ও কোনও ব্যাপার নয়। এই সহজাত ঢঙে সৃজার ভয় তাড়াতে পারল না অরুণালোক।
—শিফটিং করতে তোমার যা খরচ হয়েছে, আমি গয়না বেচে দেব। ফিরে চলো। ওখানে ফ্ল্যাট আর বিক্রি করব না। বরং এটাই আবার বিক্রি করে দাও। দু’-এক লাখ কমে হলেও ছেড়ে দাও।
সে রাতে কখন ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই। সকালে কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল সৃজার। অরুণালোক অঘোরে ঘুমাচ্ছে। প্রশান্ত মুখ, যেন কোনও দুশ্চিন্তা নেই। কলিংবেল মানে দুধ বা কাগজ বা কাজের মাসি। যেই হোক, দরজা খুললেই সামনে আরেকটা দরজা বন্ধ। কিন্তু বায়; নিথর কিন্তু খতরনাক। সৃজা এই দরজার সামনে দাঁড়াতে পারছে না। আগে যারা ছিল, তারাও দাঁড়াতে পারেনি।
অরুণালোকের অফিস যাওয়া বন্ধ। একদিন, দু’দিন, তিনদিন। সৃজার নাছোড়বান্দা ভাব কমলেও পুরোনো ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল। অরুণালোক বোঝায়, সামনের ফ্ল্যাট চিরদিন এভাবে বন্ধ থাকবে না। রহস্য একদিন উন্মোচিত হবেই। দেখবে, হয়তো ওদের পরিচিত কেউ এর সঙ্গে জড়িত। হয়তো ওর স্বামীই লোক লাগিয়ে, হয়তো ওই মহিলাই ভালো ছিল না। সৃজা এসব শোনে না। বেডরুমের জানলা খুলে সবুজ ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ‘-এর দিকে তাকিয়ে থাকে।
অরুণালোক পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ছেড়ে এলে আর ফেরা যায় না সৃজা। এখানে কিছুদিন কাটিয়ে দাও। শুনছি বাইপাসের ধারে আরেকটা আশি তলার প্রোজেক্ট হবে। একেবারে নতুন। নো পাস্ট, নো প্রেজেন্ট। অনলি ফিউচার। বলো, কোন ফ্লোরটা তোমার পছন্দ?’





