শারীরিক সৌন্দর্য সম্পূর্ণ করে ত্বকের লাবণ্য। তাই, ত্বকের লাবণ্যকে ধরে রাখা জরুরি। কিন্তু ত্বকের লাবণ্য নষ্ট করে অ্যালার্জি। আর এই অ্যালার্জির প্রকোপ বৃদ্ধি পায় শীতকালে। শীতের শুষ্ক হাওয়া, হাওয়ায় ভেসে থাকা জীবাণু, ত্বকের ক্ষতি করে। শুধু তাই নয়, খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, এমনকী পরনের বস্ত্র থেকেও হতে পারে অ্যালার্জি। অতএব, অ্যালার্জি থেকে রেহাই পেতে হবে। কারণ, ত্বকের লাবণ্য নষ্ট করার পাশাপাশি, অ্যালার্জি আপনাকে শারীরিক কষ্ট দেবে, আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন এবং ঘরে-বাইরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
অনেকসময় দেখা যায়, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করার ফলে, সাধারণ অ্যালার্জি থেকেও বড়ো ধরনের রোগে আক্রান্ত হন রোগী। অ্যালার্জি সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা এবং সমাধানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন কনসালটেন্ট ডার্মাটোলজিস্ট অ্যান্ড কসমেটোলজিস্ট ডা. শ্রাবণী ঘোষ জোহা।
অ্যালার্জি কী?
অ্যালার্জি বলতে চিকিৎসা পরিভাষায় আমরা বুঝি আমাদের “ইমিউন সিস্টেম’ বা ‘প্রতিরোধ শক্তি’র অত্যধিক সংবেদনশীলতা। অ্যালার্জি’র বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘হে ফিভার’। এই হে ফিভার বলতে আমরা বুঝি সিজন চেঞ্জ-এর সময় যখন চোখ চুলকায়, লাল হয়, নাক দিয়ে জল পড়ে এই বিশেষ উপসর্গগুলি। শ্বাসনালির অ্যালার্জি-কে অ্যাস্থমা বলে। আর এই অ্যাস্থমা হয় শ্বাসনালিতে ধুলো ঢুকলে। এছাড়া, হয় ত্বকের অ্যালার্জি। যাদের অ্যালার্জির ধাত আছে, তাদের নানারকম খাবার ওষুধ (অ্যাসপিরিন, অ্যান্টিবায়োটিক) প্রভৃতি অ্যালার্জি বাড়িয়ে দেয়। এর জন্য সাবধান হতে হবে।
সাধারণ ভাবে চামড়াতে যে-কোনও র্যাশ বেরোলেই সবাই অ্যালার্জি বলে থাকেন। এটা ঠিক নয়। অ্যালার্জি জনিত যেসব চামড়ার অসুখ আছে, সেগুলি চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অ্যালার্জি কেন হয়?
এই প্রবণতা সাধারণত আমাদের রক্তে থাকে। পরিবেশ দূষণজনিত কারণে অনেক ক্ষেত্রে এর বহিঃপ্রকাশ হয়। নানাধরনের অ্যালার্জি চামড়াতে আমরা দেখি। প্রথমেই বলি আমবাতের কথা। এক্ষেত্রে চামড়া চুলকে লাল হয়ে ফুলে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১ থেকে ৪ ঘণ্টা বাদে মিলিয়ে যায়। একে আমরা আরটিক্যারিয়া বলি। হঠাৎ করে এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেলে, ওষুধ কিংবা খাবার জিনিসের কথা ভেবে দেখতে হবে। এই আমবাত আবার কখনও ঠান্ডা হাওয়া, পরিশ্রম, রোদ, লোকালাইজড প্রেসার ইত্যাদি কারণেও হতে পারে।
অ্যালার্জির প্রকার ভেদ
এছাড়া আরও নানাধরনের অ্যালার্জি দেখা যায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস আমরা খুব দেখি। এ ধরনের বাচ্চাদের ত্বক খুব শুষ্ক হয়। খুব সহজেই এদের ডার্মাটাইটিস বা একজিমা শুরু হয়ে যায়। বাচ্চাদের চামড়ায় যদি বার বার একজিমা হয়, অবশ্যই ডার্মাটোলজিস্ট-কে দেখাবেন। একটা কথা খুব চালু আছে— ত্বকের অ্যালার্জি ঠিক হলে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাস্থমা বাড়ে। এটা একেবারে ভুল কথা। ত্বকের অ্যালার্জি ও অ্যাস্থমা একই কারণে হয়। ত্বক সংবেদনশীল (হাইপার সেন্সেটিভ) হলে স্কিন অ্যালার্জি, শ্বাসনালি সংবেদনশীল হলে অ্যাস্থমা হয়। দুটো রোগ একসঙ্গে থাকতেই পারে। কোনও একটার বহিঃপ্রকাশ আগে হয়। তার মানে কারও একজিমা-র লক্ষণ আগে দেখা যায়, কারও অ্যাস্থমা আগে দেখা যায়। ত্বকের চিকিৎসার জন্য অ্যাস্থমা তৈরি হতে পারে না।
প্রতিকার কী
যদি আমবাতের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়, ঠোঁট ফুলে যায়, অবশ্যই তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, এইক্ষেত্রে শ্বাসনালির পর্দা ফুলে শ্বাসরোধ করতে পারে। যাদের এ ধরনের অসুবিধা হয়, সবথেকে আগে একটা অ্যান্টি হিস্টামিন ট্যাবলেট জিভের তলায় রাখতে হবে। হাসপাতালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে হবে।
এবার আসা যাক একজিমা প্রসঙ্গে। শরীরের যে-কোনও অংশে হতে পারে একজিমা। এক্ষেত্রে চুলকে চুলকে ত্বক মোটা হয়ে যায়, কখনও তরল নির্গত হয়, তাকে আমরা সাধারণ ভাবে একজিমা বলে থাকি। সবরকম একজিমা সঠিক চিকিৎসার দ্বারা কম করা সম্ভব।
এ ছাড়া হয় কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস। এই ধরনের অ্যালার্জি হয় কোনও কিছু গায়ে লাগলে। অর্থাৎ এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে ত্বকে কিছু লাগলে, সঙ্গে সঙ্গে অসুবিধা হতে পারে, কিংবা কয়েকদিন পরেও সমস্যা শুরু হতে পারে। যেমন, বিছুটিপাতা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে চামড়া চুলকোতে থাকে, একথা সবাই জানেন। আবার অনেকেই দেখেছেন, কৃত্রিম (ইমিটেশন) গয়না পরলে অসুবিধা হয়। প্রধানত, নিকেল থেকে অ্যালার্জি হয়। এই ক্ষেত্রে যে জিনিসের থেকে অ্যালার্জি হচ্ছে, সেটা বাদ দিতে হবে।
অনেক সময় নানা ধরনের কসমেটিক্স লাগালে ত্বক জ্বালা করে, ফুলে যায়। সেক্ষেত্রে কোনও একটা কেমিক্যাল ত্বক সহ্য করতে পারে না, তাই অসুবিধা হয়। আবার দেখা যায়, কিছু কিছু ত্বক এত সেন্সিটিভ, সবরকম জিনিসে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কসমেটিক্স ব্যবহার করবেন। যাদের সেন্সিটিভ স্কিন তাদের বিভিন্ন রকম প্রোডাক্ট নিয়ে পরীক্ষা না করাই বাঞ্ছনীয়।
অনেক গৃহবধূ দেখে থাকবেন, হাতের চামড়া উঠছে, একজিমার মতো হচ্ছে— এটাও এক ধরনের অ্যালার্জি। নানা ধরনের ক্ষার জাতীয় সাবান, সবজির রস, বাসনমাজা, ফুল তোলা ইত্যাদি কারণে এগুলি বেড়ে যায়। অবশ্যই দস্তানা ব্যবহার করতে হবে। কারণ, এই জিনিসগুলি হাতে লাগলে বারবার অসুবিধা হতে পারে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, হেয়ার ডাই ব্যবহার করে অনেকেরই খুব অসুবিধা হয়। এটাও এক ধরনের কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস, সেক্ষেত্রে ডাই একেবারে ব্যবহার না করাই উচিত। হেয়ার ডাই শুধু মাথায় অ্যালার্জি তৈরি করে তা নয়, শরীরের বিভিন্ন জায়াগায়ও হতে পারে। যাদের ডাই অ্যালার্জি আছে তাদের মাথায় রং না করাই ভালো।
অনেকসময় নানা ধরনের ওষুধ থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে। নতুন ওষুধ খেতে খেতে বা বন্ধ হলে কারও যদি র্যাশ হয়, অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন। ড্রাগ অ্যালার্জি কখনও কখনও খুব ভয়ংকর আকার ধারণ করে। এতটাই ভয়াবহ হতে পারে যে, সমস্ত শরীরে চামড়া আলগা হয়ে যেতে পারে। আমরা একে টক্সিক এপিডার্মাল নিউরোলিসিস বলি। রীতিমতো জীবন-মরণ সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে মৃগীরোগের ওষুধ, ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ, পেনকিলার, অ্যান্টিবাইওটিক্স- – এসব ওষুধে যদি সমাধান না হয়, তখনই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সবারই এই অসুবিধা হবে। কারও কারও সিস্টেম এমন হয়, যাদের সব ওষুধ সহ্য হয় না। এটা আগে থেকে বোঝারও কোনও উপায় নেই। তাই, সাবধান থাকাই ভালো। যদি কোনও অ্যালার্জি হয়, চিকিৎসককে অবশ্যই জানাবেন।
অ্যালার্জি হলেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যদি শ্বাসকষ্ট হয়, খুব বেশি অ্যালার্জি হয়, তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। একবার কারণ বুঝতে পারলে, তখনই প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নিন।





