প্রাতরাশের পর্ব সেরে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। রোদের তাপ বাড়ছে। উচিত ছিল আরও সকাল সকাল বেরোনো। এখানকার মজা এটাই— রোদ বাড়লেই শীত উধাও।
আদিবাসী এবং স্থানীয় মানুষজনের দেখা মিলছে পথে। কেউ কেউ ছাগল, ভেড়ার পাল নিয়ে চলেছে। কেউবা মাথায় ধানগাছ কিংবা ঘাসের বোঝা নিয়ে হাঁটছে। কলসি নিয়ে মহিলাদের জল আনার দৃশ্যও চোখে পড়ছে। বাড়ির দাওয়ায় উঠোনে মুরগি চরে বেড়াচ্ছে। এখানকার প্রায় প্রতি বাড়িতেই আছে একটা মুরগির ঘর, যা এখানে ‘কুকুড়া-ঘর’ নামে পরিচিত। পোষ্য হিসেবে গরু, কুকুরও আছে। লোকজনের মুখে প্রশান্তির ছাপ। নগর-সভ্যতার নানান সুখ-অসুখ যেন এরা দূরে সরিয়ে রেখেছেন। যদিও এখানকার বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোটরযান, ডিশ টিভি, মোবাইল ফোন প্রবেশ করেছে। তবুও, এখনও প্রকৃতির রূপ, রস, বর্ণ এবং গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে এরা বসবাস করছেন এবং জীবনযাপন করছেন।
টেকাবাড়ি পেরিয়ে বালিগুদা ফরেস্ট রেঞ্জে প্রবেশ করলাম। জঙ্গলের নীরবতা ভাঙছে শুকনো পাতা হাওয়ায় ওড়ার শব্দ এবং নাম না-জানা নানান পাখির ডাকে। উঁচু উঁচু শাল, সেগুন, পাইন সবুজ গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে রোদ্দুর নকশা আঁকছে লাল মাটি আর কালো পিচ পথের উপর। মাঝেমধ্যেই আছে গ্রাম পঞ্চায়েত ভবন। দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম বেশ সন্তোষজনক।
সামনেই নজরে পড়ল ফ্লেক্স-বোর্ড— মিডুবাণ্ডা ওয়াটারফল। গাড়ি থামল। চালক বলল এটা হচ্ছে দাসিংবাড়ি ওয়াটারফল। নেমে পড়লাম। সামান্য হাঁটতেই গাছপালার ভিতর থেকে জলের শব্দ। একটু এগোতেই সিঁড়িধাপ। নামতে নামতে বেশ কয়েকটি পিকনিক পার্টির সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজ শান্ত পরিবেশ ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আরও কিছুটা নামতেই সাউন্ড সিস্টেমের শব্দ কমছে, জলপ্রপাতের শব্দ বাড়ছে।

ডানদিকের এক শুঁড়ি-পথে জলপ্রপাতের উপরের অংশে পৌঁছানো যায়। আমরা সেই পথে না গিয়ে প্রপাতের পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এটাকে ঠিক জলপ্রপাত না বলে ঝরনাধারা বলাই শ্রেয়। তবে জলধারার ছান্দসিক অবতরণ উপভোগ্য। অসম, প্রায় ফুট খানেক উচ্চতার সিঁড়িধাপ ভেঙে ফিরতি পথ অতিক্রম করার পর বেশ ক্লান্ত লাগছে। বেলা বেড়েছে। গরম অনুভূত হচ্ছে।
রূপসি শোনপুরা
গাড়ি কিছুটা এগিয়ে বাঁ-হাতি রাস্তায় ঘুরল। চালক বলল, আমরা এখন চলেছি শোনপুরা গ্রামের উপত্যকার দিকে। এখানে আলাদা ভাবে কোনও স্পট নেই। দুচোখ ভরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করুন। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। এমনটাই তো চেয়েছিলাম। প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময়। পথের প্রতিটা বাঁকে নির্বাক সুন্দর প্রকৃতির অসামান্য রূপের ডালি সবুজ-নীল পাহাড়শ্রেণির অকল্পনীয় বৈচিত্র্যে মনে পড়ে যায় আরব সাগরের তীরবর্তী পশ্চিমঘাট সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কথা।
শোনপুরা উপত্যকার ছবির মতো গ্রামের অবস্থান সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মন চাইছিল ওই গ্রামের আঙিনায় চলে যেতে, কিন্তু আমাদের আজ আরও কিছু দর্শনীয়স্থল দেখতে হবে। তাই প্রকৃতির সেই অমলিন সৌন্দর্য, উপত্যকার সবুজের বৈচিত্র্যে রৌদ্রছায়ার খেলা ক্যামেরাবন্দি করে অ্যাবাউট টার্ন।
ছায়াময় কফি বাগান
সামনে নেচার পার্ক। কফি আর গোলমরিচ বাগান। সেই সঙ্গেই রয়েছে আরও নানান ধরনের গাছ। মূলত এটি কফি গার্ডেন। বাইরের পাঁচিলে ছবি। প্রবেশমূল্য আছে। বাগানে উঁচু উঁচু গাছের ঘনত্বে রোদ্দুরের প্রবেশ সীমিত। তাই বেশ শীতল শিরশিরানি আমেজ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।
ডলুরির সঙ্গে দেখা
রাস্তার ধার ঘেঁষে সুনীল আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঘন পাইন গাছের সমাবেশে জায়গাটার সঙ্গে কাশ্মীর না হলেও, হিমাচলের পাইন জঙ্গলের সাদৃশ্য মেলে। এখানেও পিকনিক পার্টিদের হুল্লোড়। পাইন গাছের পাশ কাটিয়ে লাল মাটির উপর রোদ্দুর এবং ছায়ার নকশা দেখতে দেখতে মিনিট দশেক হাঁটলেই দেখা হবে নদীর সাথে। ডলুরি নদী। দু-পাশে সোনালি বালিতটের মাঝে ক্ষীণ ধারায় নিজের পথ তৈরি করে আপন খেয়ালে সে বয়ে চলেছে। বর্ষায় তার রূপ অন্য। দামাল। তবে স্থানীয় মানুষজনের কথায়, ঘুরতে আসা মানুষেরা যেন ডলুরিতে স্নান করা থেকে বিরত থাকেন। আপাত শান্ত ডলুরির হিমশীতল জল আঁজলা ভরে চোখে মুখে ছিটোতেই শরীরে এক অপরূপ প্রশান্তির অনুভব!





