বেলা বেড়েছে। আবাসে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর চলেছি ‘হিল ভিউ পার্ক ’-এর পথে। এটা দারিংবাড়ির একটি সুসজ্জিত উদ্যান। ছোটোদের মনোরঞ্জনের আয়োজন প্রধান হলেও, বড়োদের প্রবেশে বাধা নেই। পার্কে প্রবেশমূল্য আছে। সাজানো উদ্যানের মাঝে মাঝেই আছে শাবক সহ বাঘ, জিরাফ, জেব্রার সিমেন্ট নির্মিত অবয়ব। আছে দোলনা, ফোয়ারা, টয়ট্রেন, নানান প্রজাতির রঙিন ফুল গাছ। তবে, সবথেকে আকর্ষণীয় হচ্ছে সুন্দর ভিউপয়েন্ট করিডোর। এই লম্বা করিডোর-এ উঠে দেখে নেওয়া যায়। দারিংবাড়ির অসাধারণ ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক ভিউ। বহু দূর বিস্তৃত নীল-সবুজ পাহাড়শ্রেণির দৃশ্য দেখে মন ভরে যাবে। কাশ্মীর না হলেও, ‘ওড়িশার কাশ্মীর’ দারিংবাড়ি-র সৌন্দর্য পর্যটকদের মন মোহিত করবে। প্রকৃতি এখানে তার রূপের ডালি উজাড় করে দিয়েছে।

নেচার পার্কে শুশ্রুত

হিল ভিউ পার্কের অদূরেই ‘নেচার পার্ক’। এখানেও প্রবেশমূল্য লাগে। এই প্রাকৃতিক উদ্যানটি দেখতে হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। পার্কে জানা অজানা প্রচুর ফুল, ফলের গাছ। পরিচিতি সহ মূল্যবান আয়ুর্বেদিক গাছ-গাছড়ার সমাবেশ। এইসব গাছের ঔষধি গুণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সীমিত। উদ্যানের এদিক ওদিক ঘুরলেই চোখে পড়বে — ওড়িশার আদিবাসীদের বাসস্থান সহ তাঁদের পূর্ণাবয়ব রেপ্লিকা। এক জায়গায় হস্তিশাবক সহ হাতিদের রেপ্লিকা দেখে মনে হয় জীবন্ত! গাছ-গাছালির সবুজ রঙের এত বৈচিত্র্য, তা এই উদ্যানে না এলে বোঝাই যাবে না। পার্কের মধ্যমণি আয়ুর্বেদাচার্য শুশ্রুত মুনির মূর্তি। ফোয়ারার জলের অসংখ্য সূক্ষ্ম বিন্দু পশ্চিমের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্ট রামধনুর সাত রঙের ওপারে সূর্যদেব কখন যেন টুপ করে ডুব দিলেন তা বুঝতে বুঝতেই সন্ধ্যার আঁধারে দারিংবাড়ি-র দৃশ্যপট অন্য মাত্রা পেল।

আশ্চর্য চৌম্বক-ক্ষেত্র!

আজকের দিনটা হাতে রয়েছে। কোথায় যাওয়া যেতে পারে তা জানার জন্য শরণাপন্ন হলাম আমাদের আবাসস্থলের ম্যানেজারের কাছে। তাঁর পরামর্শে প্রাতরাশের পর্ব সেরে চলেছি “ইকো ট্যুরিজম সেন্টার’— মাগুাসুরু।

অনেক অনেক বছর আগে, কত বছর তা অবশ্য কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারেন না। তবে স্থানীয় আদিবাসী বয়স্ক মানুষদের কথা অনুযায়ী, ভয়ংকর ভূমিকম্পে মাণ্ডাসুর অঞ্চলের এক সু-উচ্চ পাহাড়-শিখর ফাটল ধরে দু-ভাগ হয়ে যায়। ওই দুটি পাহাড়চূড়ার খুব কাছাকাছি যদি কোনও বিমান ভুলেও এসে যায়, তা হলে বিমানের ইঞ্জিন নাকি বিকল হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। ওই পাহাড়চূড়ার অঞ্চলে এক অদৃশ্য চৌম্বক-ক্ষেত্র, যা তৎকালীন ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট, তাই ওই পাহাড়চূড়ার নাম— – ম্যাগনেটিক পয়েন্ট। কেউ কেউ স্থানটিকে ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ও বলেন।

প্রবেশমূল্য দিয়ে ‘ইকো ট্যুরিজম সেন্টার’ মাণ্ডাসুরু-তে প্রবেশ করলাম। বাঁদিকে সুসজ্জিত উদ্যান আর ডানদিকে ঝাঁ-চকচকে লগ-হাট, ভ্রমণ-পিয়াসীদের প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য উপভোগের জন্য রয়েছে সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থা। অপূর্ব নৈসর্গিক নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশে এক-দুদিন কাটানোর আদর্শ স্থান। প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্যের ডালি উজাড় করে দিয়েছে এই মাণ্ডাসুরুতে। রয়েছে ভিউপয়েন্ট। ওয়াচ-টাওয়ার। ছোট্ট ক্যান্টিনে চা, স্ন্যাকস, কফি…। আর, সেই চা, কফি পান করতে করতেই নয়ন মেলে দেখে নেওয়া যায় দূরের দুই লালচে-বাদামি ম্যাগনেটিক পাহাড়চূড়ার সম্মোহক দৃশ্য। চারদিকের হরেক শেড-এর সবুজ

গাছ-গাছালির কনট্রাস্ট-এ অপরূপ মোহিনী হাতছানি দেখে মনে হতেই পারে— আহা! ইচ্ছেডানায় ভর করে যদি একবার ওই পাহাড়চূড়া প্রদক্ষিণ করে আসা যেত, তা হলে… তা হলে…..

বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পথে সুসজ্জিত উদ্যানে একটু বিশ্রাম। গাছ-গাছালির মাঝে দোলনা প্রভৃতির একধারে মাতা মেরী-র করুণাঘন মূর্তি। অপূর্ব স্বর্গীয় শান্তির পরিবেশ। পার্কের উলটোদিকের ছোট্ট দোকানে ঝালমুড়ির স্বাদ নিতে নিতে জানা গেল, কাছেই আছে এক সুন্দর ঝরনা। তবে, পাহাড়ি জঙ্গল-পথ ভেঙে অনেকটা পেরিয়ে তার দর্শন মিলবে। কিন্তু পথ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিরত থাকলাম।

এমু পাখি!

ওড়িশায় এসে এমু পাখিদের দেখা মিলবে, তা ভাবিনি। মাগুাসুরুর চৌম্বক পাহাড় দেখে এবার যাওয়া যাক এমু পাখিদের আস্তানায়। উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে কিছুটা অঞ্চল ঘিরে এমু পাখির ফার্ম। জাল ঘেরা জায়গায় এমু পাখিরা বিচরণ করছে। কোনও কারণে আজ পরিচর্যাকারীরা নেই। স্থানীয় একটি ছোটো ছেলে জানাল, এখানে এমুর মাংস বিক্রি হয়। আজ অবশ্য পাওয়া যাবে না। হেসে বললাম, আমরা মাংস কিনতে আসিনি। এমু পাখি দেখতে এসেছি।

লাভার্স পয়েন্ট

পাকা সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে গাড়ি লাল মাটির পথ ধরে এসে পৌঁছাল ‘লাভার্স পয়েন্ট’ ডাডুবাড়ায়। ফুলবনি এখান থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার। উঁচু-নিচু পাহাড়ের খাত বেয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট এক খরস্রোতা নদী।

ছোটো-বড়ো পাথরের বাধা এড়িয়ে উচ্ছল গতিতে সে এগিয়ে আসছে আপন খেয়ালে। তারপর লাভার্স পয়েন্ট ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে অবিরাম।

এখন জানুয়ারির প্রথমার্ধ। বর্ষায় এই নদীর রূপ নিশ্চয়ই আরও দামাল হয়। পাথরের চাতালে পিকনিক পার্টিদের হুল্লোড়। সাউন্ড সিস্টেমের শব্দ এখানকার নিস্তব্ধ পরিবেশ খান খান করে দিচ্ছে। নদীজলের কলধ্বনি ম্লান। চলছে রান্নার আয়োজন। অতি উৎসাহী কয়েকটি যুবক নদীর জলে গা ডুবিয়ে বসে আছে। সতর্ক ভাবে স্রোতস্বিনীতে পা বাড়িয়ে পরখ করলাম, পাথরের উপর শ্যাওলার আস্তরণ বেশ পিচ্ছিল। অতএব, নো রিস্ক। সৌন্দর্য দর্শন করেই শাস্তি।

শীত নেমে এল

বেলা পড়তির দিকে। আবাসে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহার। বিকেলে ছাদের উপর চেয়ারে বসে আড্ডা দিতে দিতে সূর্যাস্তের রঙিন আকাশ দেখা, সেইসঙ্গে সন্ধ্যার আঁচল বিছানো শুরু। রাতের অন্ধকার জমাট হতেই অজস্র নক্ষত্ররাজির উজ্জ্বল সমাবেশ দেখতে দেখতেই জমিয়ে শীত নেমে এল ‘ওড়িশার কাশ্মীর’ দারিংবাড়ির উপত্যকায়। আমরাও আর বেশি রাত না করে ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম।

আক্ষেপ

খুব সকালে ঘুম ভাঙল। দারিংবাড়ির মেয়াদ শেষ। আজ আমাদের বাড়ি ফেরার দিন। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে এলাম। পুবের আকাশ লাল। এখনই সূর্যোদয় হবে। উৎসুক দৃষ্টি মেলে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করেও বরফের লেশমাত্র দেখা গেল না! থেকে গেল আক্ষেপ৷

প্রয়োজনীয় তথ্য: দারিংবাড়ি ভ্রমণের উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি।

কীভাবে যাবেন: হাওড়া স্টেশন থেকে ১২৮৩৯ চেন্নাই মেল ছাড়ে এবং পরদিন সকালবেলা ব্রহ্মপুর (বেরহামপুর) পৌঁছায়। বেরহামপুর থেকে আগাম বুকিং-এ গাড়ি পাবেন দারিংবাড়ি যাওয়া এবং ফেরার চুক্তিতে।

কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য রয়েছে রিসর্ট, রিট্রিট, হোমস্টে, জঙ্গল ক্যাম্প, ইকো হোম প্রভৃতি।

কীভাবে ফিরবেন: হাওড়া ফেরার ট্রেন হিসেবেও ১২৮৪০ চেন্নাই মেল সুবিধাজনক। বেরহামপুর পৌঁছে হাতে সময় থাকলে গোপালপুর সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে পারবেন।

পুনশ্চ: শীতের উপযুক্ত শীতপোশাক এবং সঙ্গে অবশ্যই রাখবেন বৈধ পরিচয়পত্র (আধার কার্ড, ভোটার কার্ড), প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, পানীয় জল এবং শুকনো খাবার।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...