চা-বাগানের ঢাল বেয়ে উপচানো সবুজ আর কাঞ্চনজংঘার ব্যাকড্রপ, টয়ট্রেন আর ম্যালের কোলোনিয়াল ফ্লেভার, ধূমায়িত চায়ের কাপের সুগন্ধী আমেজ– ইকোয়েশন একটাই, দার্জিলিং। আক্ষরিক অর্থেই কুইন অফ দ্য হিল্স আমায় টানছিল তার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে। তাই বাগডোগরা থেকে সটান গাড়িতে চড়া। পুরোটাই আপহিল জার্নি। পাহাড়ের গায়ে আটকানো মেঘ আর বনান্ত জুড়ে সবুজ, নেশা ধরিয়ে দেয়। কার্সিয়াং, টুং, সোনাদা, ঘুম পেরোতেই টয়ট্রেনের সঙ্গে দেখা। শহরে ঢোকার মুখে পর্যটক আর স্থানীয় দোকানপাটের ভিড় ঠেলে অবশেষে চেনা ম্যালের চৌহদ্দিতে। ম্যালে সেই চেনা পর্যটকের ভিড়, ঘোড়া তার সওয়ারি খুঁজছে, শীত পোশাকের পশরা ঠাসা দোকানপাট।
বিকেল থেকে ইলশেগুঁড়ি আরও রোমান্টিক করে তুলল দার্জিলিং-কে। একটু উষ্ণতার জন্য তাই সেঁধিয়ে গেলাম প্রিয় কাফে গ্লেনারিজ্-এ। ভিতরে সেই চেনা অ্যাপায়নের আঁচ, সেই কেক-প্যাস্ট্রির আহ্বানে ভরা অনুষঙ্গ। দ্বিতল এই কাফে বস্তুত দার্জিলিংয়ের সাহেবি কেতাদুরস্ত চেহারাটা আজও ধরে রেখেছে।
ঠান্ডা বাড়ছে। সঙ্গে শনশনে হাওয়া। গরম ধোঁয়া ওঠা ক্যাপুচিনো আর কাচের শার্সির বাইরে একটা, দুটো করে আলো জ্বলে ওঠা দার্জিলিং। গ্লেনারিজ-এ বরাবরই কিছু সৌম্য মেধাবী বিচ্ছুরণ টের পাই। দেয়ালের দিকে চোখ পড়ে, নানা দেশি-বিদেশি মানুষের সাক্ষর ও মন্তব্য লেখা চিরকুট। বছর খানেক আগে আমার লিখে যাওয়া চিরকুটটাও খুঁজে ফেলি ওই কাগজের ভিড়ে। বরাবরই এ আমার প্রেমের পার্বত্য শহর।
এসব ভাবতে ভাবতেই খাবার এসে গেল। রোস্ট চিকেন সাব সান্ডউইচ, চিকেন হট ডগ ও ফ্রায়েড এগ এন সসেজ। কুয়াশা, পাহাড়, ঝিরঝিরে বৃষ্টি সব মিলিয়ে বাইরের দার্জিলিং তখন সত্যি রানির মতোই সেজে উঠেছে। গায়ে তার অজস্র আলোর সলমাচুমকির উড়ান।
পরদিন ভোরে গাড়ি করে টাইগার হিলের পথে চললাম। কাঞ্চনজংঘায় রঙের খেলা দেখার নেশা মনকে আবিষ্ট করে রাখল। ওই সৗন্দর্য এমনই যে, বহুক্ষণ কথা বলতে পারিনি চাক্ষুস করার পর। ঝকঝকে দিন। কাঞ্চন হাসিমুখে স্বাগত জানাচ্ছে দার্জিলিংঙের পর্যটকদের। ব্রিটিশরা বুঝেছিলেন এর উচ্চতার কারণে চা চাষের জন্য দার্জিলিং হল আদর্শ। ফলে ব্রিটিশ টি প্ল্যানটার্সদের বাসস্থান হয়ে উঠল দার্জিলিং। এটি ধীরে ধীরে ব্রিটিশ রাজাবাহাদুরের গ্রীষ্মকালীন আবাস হয়ে উঠল। দার্জিলিং এলে, হেরিটেজ টয়ট্রেনে ঘুম হয়ে বাতাসিয়া লুপ ঘোরার মজাটাই আলাদা। এই জয় রাইড মাস্ট-ডু’র মধ্যে পড়ে।
পরদিন ব্রেকফাস্টের আদর্শ জায়গা হিসাবে বেছে নিলাম কেভেন্টরস্-এর রুফটপ। অর্ডার দেওয়ার পর এসে পড়ল এখানকার ট্র্যাডিশনাল প্ল্যাটার– রোস্টেড বেকন, চিকেন সসেজ সালামি ও পোচ্ড এগ্স। সঙ্গে হট চকোলেট। রোদে গা এলিয়ে স্রেফ আলসেমি করেই কাটিয়ে দেওয়া যায় দার্জিলিং। আর তা না চাইলে বিকল্প তো আছেই, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট ঘুরে দেখা, হিলকার্ট রোডে লম্বা ওয়াক বা জু কিংবা তেনজিং নোরগে হিমালয়ান ইন্সটিটিউট-এ সময় কাটানো। আর আপনি যদি একটু সৌখিন হন তাহলে আপনার অপেক্ষায় আছে জোয়ি’স পাব। কোলোনিয়াল চার্ম-এর সবটুকু রূপসুধা মেলে ধরবে এই সুন্দরী পাহাড়ের রানি– বছরের যে-কোনও সময়ে,যখনই যান।