সড়কপথে চলেছি সিমলা। দূরত্ব ৯০ কিমি। শুরুর সকালটা ছিল ঝলমলে, রৗদ্রোজ্জ্বল। সমতল থেকে পাকদণ্ডি পথে উঠতেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। টয় ট্রেনের লাইনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলে বেশ কিছুক্ষণ। পথে চায়ের জন্য একবার বিরতি পড়ে। পুনরায় পাকদণ্ডি পথে চাকা গড়ায়। কিন্তু সিমলা ঢোকার আগেই জ্যামে আটকে পড়ি। ভরা সিজনে রাস্তা জুড়ে গাড়ির মেলা। অতিকষ্টে যখন কালীবাড়ির গেস্ট হাউসে পৌঁছোই, বেলা তখন বেলা ৩-টে।
বিকেলে পায়ে পায়ে পৌঁছোই ম্যাল চত্বরে। শহরের প্রধান কেন্দ্রস্থল এই ম্যাল। অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে ম্যাল চত্বর সরগরম। নিওগথিক শৈলীতে নির্মিত অ্যাংলেসিয়ান চার্চের সামনে ও তার আশেপাশে, কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসি মন্দিরে। কালীবাড়ির চত্বরে বসেই সাক্ষী হই অপূর্ব এক সূর্যাস্তের। মগ্ন হয়ে দেখি সন্ধ্যারতিও। পরদিন আমরা যাব কিন্নরের পথে।
সিমলা থেকে সারাহান ১৭২ কিমি। ২২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছি। ঘন্টাখানেক পরে দাঁড়াই গ্রিনভ্যালি ভিউ পয়েন্টে। ঘন সবুজ উপত্যকা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্রিনভ্যালির অপার্থিব সৌন্দর্যকে লেন্সবন্দি করে, ছুটি কুফরির পথে। স্থানীয়রা ইয়াক নিয়ে রাস্তার ধারে পর্যটকদের অপেক্ষায়। এখান থেকে হিমালয়ের অসাধারণ রূপ ধরা পড়ে। পেরিয়ে গেল ফাগু, নারকান্ডা। পথ চলতি পাহাড়ি ঢালে রয়েছে আপেল বাগান। কিছুস্থানে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে আপেল সুরক্ষিত রাখার জন্য নেট দিয়ে পুরো বাগান ঢাকা হয়েছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের ঢালে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে।
পথে দেখা শতদ্রু নদীর সঙ্গে। নদীর উদ্দাম প্রবাহধারা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলি। শতদ্রুর ভাঙা পাড় জুড়ে রয়েছে অসংখ্য৷বড়ো-বড়ো বোল্ডার। একটা ঝোলা ব্রিজও চোখে পড়ে। এই নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। ঘন্টা পাঁচেক পথ পেরিয়ে এলাম রামপুর। রামপুরকে বলা হয় কিন্নর রাজ্যের প্রবেশদ্বার। শহরের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে শতদ্রু। রামপুর ছিল বুশাহার রাজাদের রাজধানী৷এক সময় হিমাচলের প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি ছিল। এক হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে প্যালেস দেখতে চলি। ১৯ শতকে তৈরি পদম প্যালেস অবশ্য বাইরে থেকে দেখেই ক্ষান্ত হই। প্যালেস অভ্যন্তরে ঢোকার অনুমতি মেলে না। রামপুর থেকে ২৩ কিমি দূরে জিওলি। জিওলিতে জাতীয় সড়ক ছেড়ে এবার ডানদিকের চড়াই পথ ধরি। পাহাড়ি নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে উঠতে থাকে গাড়ি। পাকদণ্ডি পথ শেষে পৌঁছোয় সারাহানের সীমানায়।
৭৫৮৯ ফিট উচ্চতায় পাহাড় ঘেরা নৈসর্গিক সৗন্দর্যে ভরপুর এক ছোট্ট জনপদ সারাহান। ভীমাকালী মন্দিরের কাছেই আমাদের বুকিং করা হোটেলের অবস্থান। আসলে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এখানকার পর্যটন বিকাশ। শীতে এখানে প্রবল তুষারপাত হয়। একসময়ে এখানে বুশাহার রাজাদের রাজ্যপাট ছিল।
সারাহানের প্রধান দ্রষ্টব্য ভীমাকালি মন্দির। এটি ৫১ পিঠের অন্যতম। এখানে সতীর কান পড়েছিল। মন্দিরটির আকার অনেকটা প্যাগোডা ধর্মী। মন্দিরের গায়ে কাঠ ও পাথরের অপূর্ব কারুকাজ। কিংবদন্তী ছড়িয়ে মন্দিরের পাথরে পাথরে। মন্দিরের ডানপাশে ও উলটোদিকে গেস্ট হাউস। আর মন্দিরের প্রধান ফটকের সন্নিকটে সুন্দর ফুল বাগিচা। দিনের আলোয় টান পড়ে। ফেরার পথে আপেল বাগানের মাঝে দুর্দান্ত সূর্যাস্তের সাক্ষী হই।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটি হোটেলের ছাদে। যদি শ্রীখন্ড পর্বতের দর্শন মেলে। কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ। মেঘে ঢাকা আকাশে শ্রীখণ্ডের খণ্ডাংশও কপালে জোটে না। এবার চা খেয়ে চলি বুশাহার রাজবাড়ি পদম প্যালেস দেখতে। মন্দিরের পিছনের দিকে অল্প কিছুটা দূরেই এই প্রাসাদ। আপেল বাগানের মধ্য দিয়ে গেছে পথ। স্থানীয় মানুষজন বাগানে কাজ করছে। গাছে গাছে কাঁচা আপেল ধরে আছে থরে থরে। পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরি রাজপ্রাসাদ। উপরে ঢেউ খেলানো টিনের ছাদ।
পরের গন্তব্য সাংলা। সারাহান থেকে বেরিয়েছি সকাল সাড়ে ৯টায়। ১৭ কিমি জিগজ্যাগ রাস্তা শেষে জিওরি। আরো ৬ কিমি পাকদণ্ডি পথ পেরোতেই কিন্নর জেলায় প্রবেশ। জেলা বিভাজিত নদী শতদ্রু। ব্রিজ সংলগ্ন তোরণদ্বার। কাছেই এক ঝরনার সঙ্গে দেখা। গ্রীষ্মে তার স্লিম শরীর। বহু পর্যটক দেখি, ফলসের জলে পা ডুবিয়ে সেলফি তুলছে। ভাবনগর, ওয়াংটু টপকিয়ে টোপরি। মিলিটারি অধ্যুষিত এলাকা। এই পথেই শুভদৃষ্টি হল কিন্নর কৈলাসের সাথে। যদিও তার আবছা অবয়বই কেবল অবলোকন করি। আরও ১০ কিমি ভাঙাচোরা পথ পেরোতেই করছাম। শতদ্রু ও বসপার মিলনস্থল। করছাম থেকে ভয়ংকর সুন্দর প্রকৃতিকে অনুসঙ্গ করে আরও ২৮ কিমি পাড়ি ।
সামনে হিন্দুস্থান টিবেট হাইওয়ে। সোজা পথটা গেছে রেকং হয়ে কল্পায়। ডান দিকের অন্য পথটা সাংলায়। চলেছি সেই পথেই। বসপাকে সঙ্গী করে গাড়ি ওঠে পাহাড় শীর্ষে। একপাশে অতল খাদ। অন্য পাশে খাড়াই পাথুরে দেয়াল। কোথাও আবার কোনও রকমে পাথর কেটে বানানো রাস্তা। অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলা। খাদের দিকে তাকাতেই মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। প্যাঁচানো পথটা ওঠে ওপরে। প্রকৃতি আরও সুন্দর ভাবে সামনে আসে। দুধারের পাইন আর দেওদারের জঙ্গল যেন জাপটে ধরে।
শেষে সাংলার সঙ্গে সত্যি দেখা হয়ে যায়। বসপা নদীর বাঁধের পাশ দিয়েই সাংলা গ্রামে প্রবেশ করি। দু’দিকে পাহাড় ঘেরা পরিমন্ডল। মাঝে টিয়া সবুজ উপত্যকা, বহমান বসপা, আর পাহাড় কোলে স্থানীয়দের রঙিন ঘরবাড়ি। এই নিয়েই স্বপ্নের সাংলা। উপত্যকার মাঝখানে আমাদের বুকিং করা হোটেলের অবস্থানটা অসাধারণ। জানালা খুললেই দেখা মেলে ঝলমলে বরফশৃঙ্গ। ওপর থেকে ভ্যালির ভিউ, বয়ে চলা বসপা, নদী পাড়ের জমাটি সবুজ আর স্থানীয়দের ঘরবাড়ির এক অনবদ্য কোলাজ ছবি হয়ে ধরা দেয়।
কিন্নর জেলার সেরা উপত্যকা সাংলা। শহুরে সভ্যতার ক্লান্তিতে বিষণ্ণ, ভাঙাচোরা মনকে সারিয়ে তোলার সেরা ডেস্টিনেশন। স্থানীয় মানুষের কাছে অবশ্য বসপা উপত্যকা বলে বেশি পরিচিত। চারপাশে সবুজে মোড়া পাহাড়ের সারি। হিমাচলের এক টুকরো স্বর্গ বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। উপত্যকাকে আরও সুন্দর করেছে বসপা নদী। শীতে এই উপত্যকা পুরো বরফে ঢেকে যায়। তখন বরফ প্রসাধনে তার সৗন্দর্য আরও খোলতাই হয়ে ওঠে। সেই সুন্দরের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায় সহজেই। ডটকম তাড়িত জীবনের গতি আর ব্যস্ততার মাঝেও চিরশান্তির সাকিন হয়ে ওঠে।
লাঞ্চের পর রওনা দিলাম কামরু গ্রামের দিকে। কামরুতে আছে ইতিহাস সাক্ষী কামরুদুর্গ। আমাদের হোটেল থেকে বেশ খানিকটাই পথ। পথ চলতে মিলল আলু ও মটরশুঁটির খেত। লাগোয়া চিলগোজা ও আপেল বাগান। পথের ধারে পড়ল এক তোরণদ্বার। এখান থেকেই উঠে গেছে দুর্গ-শীর্ষ পর্যন্ত চড়াই সিঁড়ি পথ।
সংকীর্ণ গলিঘুঁজি পথ পেরিয়ে দুর্গের দেখা মেলে। লোহার গজাল দেওয়া প্রকাণ্ড দুর্গ প্রাসাদের গেট। দরজায় আওয়াজ করতেই কেয়ারটেকার ভিতর থেকে শিকল খুলে দিল। রীতি মেনে কোমরে মোটা সুতলি বেঁধে ও মাথায় হিমাচলি টুপি পরে ভিতরে প্রবেশ করি। চারশো বছরের পুরানো কাঠের পাঁচতলা দুর্গ। রাজা বীরভদ্র সিংহ নির্মাণ করেন।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই সাংলা বাজারের দিকে। দিনের আলো ক্রমশ ম্লান হয়। সূর্য বিশ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই, কনকনে হাওয়ার দাদাগিরি শুরু হয়। আবছা বিকালে দেখি বেরিনাগের মন্দির। আর ব্রিজের উপর থেকে গর্জনরত প্রবাহমান বসপাকে। স্থানীয় বাজারটা বেশ বড়োসড়ো। সমতলের প্রায় সমস্ত জিনিসিপত্র-ই মজুত। অবশ্য দাম একটু বেশি। বাজার ঘুরে এবার হোটেলের পথে। ঠান্ডার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে।
রাতের পাহাড়ি প্রকৃতি, নদীর বয়ে চলা শব্দ আর অসীম আকাশে অগুণতি তারা যেন এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। রাত গভীর হতে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উপত্যকায়। চারপাশে বরফের মুকুট পড়া পাহাড় সারি তার মাঝে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রকৃতি যেন এক অপার্থিব রূপ ধারণ করে।যেদিকে তাকাই সেইদিকেই তুষারাবৃত শৃঙ্গের অনিন্দ্য শোভা। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী। মনে হচ্ছিল যতটা সম্ভব চোখ ভরে, মন ভরে, এমনকী অন্তরাত্মা দিয়ে অবলোকন করি।
ধীরে ধীরে প্রথম আলোর ছটা পড়ে তুষার মুকুটের গায়ে। উষার আলস্য ভেঙে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে বাসা ছেড়ে। কুয়াশা ভেজা বাতাসে কনকনে ঠান্ডার আমেজ। যেন এক স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গেছি। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আলোর তারতম্যে পালটাচ্ছে প্রকৃতির রূপ-রং।
কীভাবে যাবেন – হাওড়া থেকে কালকা মেলে সরাসরি কালকা। সেখান থেকে টয় ট্রেন অথবা সড়ক পথে গাড়িতে সিমলা পৌঁছোতে হবে। বিকল্পে আকাশ পথে ট্রেনে দিল্লি অথবা চন্ডীগড়। উভয় স্থান থেকে সড়কপথে গাড়িতে সিমলা পৌঁছোতে হবে। দিল্লি থেকে কালকা-চন্ডীগড় শতাব্দী এক্সপ্রেস চলে। সিমলা থেকে গাড়ি বুকিং করে সারাহান ও সাংলা দেখতে হবে। এই রুটে বাস চললেও নিজস্ব গাড়ি থাকলেই সুবিধা।