অরণ্য ছুঁয়ে উপত্যকায়

এখনও ভেজা সবুজের গন্ধ পাচ্ছি। গাড়ি জানলায় শুকনো পাতার মুখ জুড়ে প্রবল হাওয়ার ঝাপটা অনুভব করছি। খুনিয়া মোড় থেকে বাঁদিকে বেঁকে গাড়িটা ছুটে চলেছে হুহু করে। এটাই চাপড়ামারি যাবার রাস্তাও। এ পথ ধরেই পৌঁছোনো যায় জলঢাকা হাইডেল প্রজেক্টে। বিন্দু যাবার রাস্তা এটাই। লাটাগুড়ি থেকে খুনিয়া প্রায় ২৪ কিলোমিটার। আমরা ধূপঝোরা-মূর্তি হয়ে খুনিয়া মোড় এসেছি। দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। জটলাদা স্টিয়ারিংয়ে মোচড় দিল। চন্দ্রচূড় ওয়াচটাওয়ারের রাস্তাটাকে ডানহাতে ফেলে আবার বাঁদিকে টার্ন নিলাম। খানিকটা যেতে, সামনেই পথ আটকাল পিচকালো হাইওয়ে। বাঁদিকে শিলিগুড়ি, ডানদিকে অসম। আমাদের গাড়িটা হাইওয়ে টপকে চলল সোজা। এটা চাপড়ামারির জঙ্গল এরিয়া। দুর্দান্ত রাস্তা। দুপাশে ঘন জঙ্গলের নিবিড় আলিঙ্গন। থেকে থেকেই একটা বিকট চিনচিনে শব্দ কানের পর্দাতে কাঁপন ধরাচ্ছে। মনে হল বিরাট মাপের কোনও ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। জঙ্গলে আসা থেকে অনেকবারই শুনলাম সেই ছমছমে জঙ্গুলে শব্দ। হয়তো এই ডাকটার জন্যই জঙ্গলটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর।

ক্যালেন্ডারে গ্রীষ্মের দহন। আসার আগে ভেবেছিলাম অরণ্যছায়ায় বেশ শীতল শান্তিতেই দিন কাটবে। কিন্তু গতকাল অবধিও দগদগে রৌদ্রে সেদ্ধ হয়েছি। হঠাৎই মাঝরাত থেকে একলা পাগল আষাঢ় ঝাঁপিয়ে এল। গহন বনে মেঘ নামল ঠিকই। মনের গভীরে তবু ভয়ের বিরাম নেই। বৃষ্টির যা দাপট, পানঝোরা পৌঁছোতে পারলে হয়। বেলা হতে বৃষ্টি থামল। ভয় সিঁধল বুকের তলায়। এবার শুধু ছুটির আনন্দেই ছুটে চলা পানঝোরার দিকে, এরই আর-এক নাম চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প। রাতভোর শাওনগান সমে ফিরতেই মেঘভাঙা রোদ্দুর ভেজা সবুজের বুকে কত যে হিরে-মানিক ফুটিয়ে তুলল তার ইয়ত্তা নেই। ডিজিক্যামের খিদেটা দারুণভাবে মিটছে। আর মনের খিদে? তার কথা এখন নাই-বা বললাম। বলা যায় না, এত প্রশংসা খামখেয়ালি প্রকৃতির হজম নাও হতে পারে। ঝমঝমিয়ে নামলেই সর্বনাশ।

 

নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে করতে পার হয়ে গেলাম আরও ৩-৪ কিলোমিটার পথ। বাঁহাতেই পড়ল চাপড়ামারি এন্ট্রি পয়েন্ট Dooars। তাকে ফেলে গাড়ি ছুটল আরও ২ কিলোমিটার। এরপরেই অরণ্য অভিযান। আমার তো তেমনি মনে হল। পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা ঘুরে গেল বাঁদিকে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে। আদাড়বাদাড় চাকায় পিষে, সরু ঘন অরণ্যপথে এগিয়ে চলেছি। বুকে রোমাঞ্চ আর আনন্দের মিশেল। জটলাদা বলল, ‘এখানে যখনতখন হাতি বেরিয়ে আসে।’ ওমনি যেন খুলে গেল অরণ্যদেবের দুয়ার। ওই বোধহয় বেরিয়ে আসছে একদল বুনোহাতি। বৃহৎ বৃংহনে মাতিয়ে তুলছে বনান্তের শান্ত বাসর। দুপাশের জঙ্গল হুমড়ি খেয়ে পড়ছে গায়ের উপর। পথেঘাটে এলিয়ে রয়েছে লতাগুল্মের গুচ্ছ। রাস্তা নামছে আর উঠছে। মধ্যে মধ্যে ঝোরা ছাপিয়ে গাড়ির চাকা যতটা পারে সাবধানে পার হচ্ছে। এ জঙ্গলে যেটকু রোদের ছাড়পত্র মিলেছে সেটুকুতেই ভাষা পেয়েছে অরণ্যানির অন্তর। কল্পনা ছেঁড়া সত্যির সাম্রাজ্যে এখনও হাতির দর্শন মিলল না। ‘মিলবে মিলবে সবুর করো।’ জটলাদা আশ্বাস দিল।

সবুরই করলাম। একসময় বড়ো বড়ো গাছের রাজত্ব শেষ হল। আগাছার জঙ্গল শুরু। পাশে পাশে তারের বেড়াজাল। ‘এগুলো কি হাতির জন্য?’ জটলাদা জানাল, ‘হাতির জন্য তো বটেই। তবে এসব মূলত প্ল্যান্টেশনের জন্য।’ গহিন জঙ্গল। জনমনিষ্যি নেই। কোথা যেন একজন মানুষ হেঁটে আসছে আমাদের দিকে। আশ্চর্য! ঘর নেই, বসতি নেই অথচ মানুষ আছে? এল কোত্থেকে? জটলাদা আমাদের সন্দেহের নিরসন ঘটাল। ‘ওরা নেপালি আদিবাসী। বহুদূর গ্রাম থেকে আসে। কেউ হাটে যায়, কেউ আবার অন্য কোথাও কাজ করে।

‘এই জঙ্গলে গ্রাম!’ চোখ কপালে উঠল।

‘তোমরা যেখানে যাচ্ছ, পানঝোরা, সেটা ছাড়িয়ে রেললাইন। আবার সেটা পার করে অনেকটা নীচে নেমে ওদের গ্রাম। পানঝোরা গ্রাম।’

‘বেশ কথা। এসেছি যখন সেখানেও যাব।’

মিষ্টভাষি জটলাদার ঘাড়টা এবার ঢক করে নড়ে উঠল। কোনও কিছুতেই না নেই তার। কে বলবে, এই মানুষটা এর আগে আমাদের দেখেইনি। পথেই এক নদী। নাম জানি না। তবে ডুয়ার্সের বেশিরভাগ জায়গাতেই মূর্তি নদী তার জলধারার শাখাপ্রশাখাকে খেলিয়ে দিয়েছে অবলীলায়। এ হয়তো তারই কোনও বন্যরূপ।

অবশেষে ইকো-ক্যাম্পের চূড়াটা দেখা গেল। এসে গেছি। কাছে যেতে তারের বেষ্টনীতে আটকালাম। জটলাদার হাতের চাপে আমাদের গাড়িটা দুবার হাঁক দিয়ে উঠল। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল একটি ছেলে। বছর ষোলো-সতেরো হবে। তারের গেটটাকে খুলে দিতেই গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পের শ্যামলসবুজ চৌহদ্দিতে, দুটি সবজে ছাতার মাঝখানে। ছাতার তলায় একটি করে কাঠের গুঁড়ি কেটে বসার জায়গা বানানো। মোট চারটি কটেজ। সামনেই খাদ নেমে গেছে। কিছুদূরেই মূর্তি বয়ে চলেছে সগর্জনে। তার গর্জন ধাক্বা খাচ্ছে দূরের সবুজ পাহাড়ে। মাথার উপর আসমানি নীল চাঁদোয়া। বৃষ্টিধোয়া ছেঁড়া ছেঁড়া তুলো মেঘে মন উদাসী সাম্পান। কোথাও আবার নীল ক্যানভাসে মেঘেলি আলপনা। বাঁদিকে মূর্তির বুকে রেলব্রিজ। মাঝেমধ্যেই ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে ছুটে চলেছে রেলগাড়ি।

পানঝোরা ইকো-ক্যাম্পেরই দেখভাল করে একটি ছেলে, নাম রোশন ছেত্রী। বছর কুড়ি-বাইশের বেশি হবে না। একটা কটেজ খুলে দিল আমাদের জন্য। নরম বিছানায় মুহূর্তে এলিয়ে পড়া। যে-জঙ্গলের পথটা ধরে এলাম তার দূরত্ব মোটামুটি ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। সময় লাগল আধঘণ্টার উপর। কোমরের হাড়গুলো ঠিকঠাক জায়গায় আছে কিনা সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ ছিল। নাড়িভুঁড়ির কথাটা না হয় বাদই দিলাম। যাই হোক, রাস্তাটা কিন্তু সত্যিই অসাধারণ। অনেক ন্যাশানাল পার্ক-ই আজ বড্ড পলিশড হয়ে গেছে। বড়ো কৃত্রিম মনে হয়। সেই আদিমতার গন্ধগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু পানঝোরা আসার এই রাস্তাটা এখনও তার সেই অনাদি আদিমতার সাজটুকু বজায় রেখেছে।

বাইরে থেকে হাঁক দিল জটলাদা, ‘গ্রামে যাবা তো?’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ যাব।’

‘তবে আর দেরি কোরো না। ঝটপট চলো।’

জটলাদা আজন্ম লাটাগুড়ির। নিজের ভাষা বাঙাল হলেও গত এগারো বছর ধরে আমাদের মতো পর্যটকদের সঙ্গে থাকতে থাকতে মুখের ভাষায় ঘটি-বাটি সব একাকার। কটেজে তালা মেরে জটলাদার পিছুপিছু চললাম পানঝোরা গ্রামে। ও বাবা! সে এক রাস্তা বটে। প্রথমে তো মূর্তির পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে যাওয়া। তারপর আবার চড়াই বেয়ে সোজা রেললাইনে। আমাদের ডানহাতেই ব্রিজ। একখানা কাঞ্চনকন্যা এলেই সমূলে সবাড়। পরদিনই কাগজে বড়ো বড়ো করে হেডিং, ‘ডুয়ার্সের হাতি নয়, রেলের ধাক্বায় এবার দুই পর্যটক আর স্থানীয় মানুষ’।

আরও একটা রাস্তা ছিল। তবে স্থানীয় মানুষই সে রাস্তার শরণাপন্ন হতে নিষেধ করলেন। অগত্যা তাই রেললাইন ধরেই চলা। বেশ অনেকটা যাবার পর ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে গাঁয়ের দিকে। নেমেই চোখে চোখ। বেশ কিছু কৌতূহলী নেপালি মুখ। ওরা বুঝতেই পারছে যে আমরা টুরিস্ট। যেখানে-সেখানে গোবর ছড়ানো। গাছপালায় ছাওয়া বাড়িগুলো উঁচু উঁচু। নীচে কাঠের বিম আর তার উপরে ঘর। জটলাদা বলল, হাতির হাত থেকে বাঁচার জন্যই এমন ব্যবস্থা। কিছু মেয়ে একটা জায়গায় জটলা করে খুব হাসাহাসি করছে নিজেদের মধ্যে। আমাদের দেখে খানিক থমকে গেল বটে। তবে কিছু পরেই যথারীতি সেই হা হা হি হি-র মজলিস। কেন জানি না, নিজেকে কেমন কার্টুন কার্টুন মনে হচ্ছিল। ওদের ভাষাও তো বুঝি না ছাই।

অতএব ফেরার পথ ধরাই মনস্থ করলাম। একদল হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে পথ ছেড়ে দিল। মোরগ ব্যাটার খুব আস্পর্ধা। দিব্যি রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের দিকে ফিরেও চাইল না। এই পানঝোরা গ্রামটা পেরোলেই মেন রোড। সেটা ধরে চালসা মোটামুটি ঘণ্টাখানেক লাগে। একটা দোকানে খানিক বসে আবারও সেই একই পথ ধরে ব্যাক টু ইকো ক্যাম্প। ভাত, ডাল, ভাজা, সবজি আর মাছের কারি দিয়ে দুপুরের দারুণ খাবার। এবার একটু না গড়ালেই নয়। বিকেল চারটেয় বেরোব চাপড়ামারি ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাহাড়মেশা নদীর শোভা দেখতে দেখতে, আলতো ফুরফুরে হাওয়া কখন যেন ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন প্রায় আড়াইটে বেজে গেছে। ঘুমটা ভেঙে গেল। বাইরে দেখি ক্ষ্যাপা শ্রাবণের বিপুল ক্ষ্যাপামি। প্রকৃতির সাজসজ্জা দারুণ লাগছে। কিন্তু মনের ঘরে এমন কুডাক কেন? বৃষ্টি না থামলে ট্রেলে যাব কী করে? ভালো-খারাপের দ্বন্দ্বে চোখের পাতাটা আবার ভারী হয়ে এল।

ঘুম ভাঙতেই মিরাকেল। ভুবন উজিয়ে চিকন রোদের ছটায় চকচক করছে কাছেদূরের সবুজগুলো। মূর্তির শরীর জুড়ে সোনার আলোর নাও ভাসছে। চারটের সময়েই বেরোনো হল। সঙ্গে গাইড রোশন ছেত্রী। গাড়ি ছুটল সকালের সেই জঙ্গলপথে। একই রাস্তা, আলাদা রোমাঞ্চ। শোভাও যেন অন্যরকম। থেকে থেকেই দু-তিনটে করে ময়ূর-ময়ূরী বনের আগল ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মাখামাখি রোদ্দুরের গায়ে বিচিত্র রং ছড়িয়ে পলকে হারিয়ে যাচ্ছে জমাট সবুজের গোপন বুকে। চোখ ক্যামেরায় সে ছবি ধরা পড়ল বটে কিন্তু ডিজিক্যামেরার সাধ্য কী ওই ঝলকছবির পলক ধরে? আর ক’দিন পরেই বর্ষা। তখন ময়ূরের রংকলাপী পালক যাবে ঝরে। তারপর আবার নতুন করে পালক গজাবে, রং ধরবে ওদের শরীরে।

সাড়ে চারটেয় চাপড়ামারি এন্ট্রি পয়েন্ট। সেখান থেকে অরণ্যগভীরে আরও কিলোমিটারখানেক। গাড়িটা থামল এক জায়গায়। আরও একটা গাড়ি আমাদের আগেই এসেছে। সামনেই ঈগল নামক চাপড়ামাড়ি নজরমিনার। একলা বাইসন দাঁড়িয়েই ছিল আমাদের জন্য। এক্সট্রিম জুমে পটাপট ছবি। নজরমিনারের পাশেই চাপড়ামারি বনবাংলো। সামনেই জলাশয়। তার পাশে গোল করে বাঁধানো একটি জায়গা। সেখানেই থাকে বাইসনদের খাদ্য লবন। হাতির পাল আসে জল খেতে। বাইনোকুলারে চোখ রাখলে বাইসন, হাতি কিংবা গ্রে হেডেড ফিশিং ঈগলের থ্রি-ডি এফেক্ট। প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটল। দলে দলে বাইসন এসে জুটল। হরেক পাখির ডাকে চুপচাপ জঙ্গলটা মাঝে মাঝেই নড়েচড়ে উঠছে। কখনও এমন নিস্তব্ধতা জাঁকিয়ে বসছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা হবেই। বনের সিপাইয়ের মতো আমাদের সজাগ চোখ ইতিউতি ছড়িয়ে পড়ছে পলকে। ওই দূরের গাছগুলো নড়ছে যেন! ‘ওই তো হাতি…’

‘কোথায় কোথায়?’

‘এই হাতি দেখে যা রে-এ-এ-এ।’

ব্যস, হয়ে গেল। জঙ্গলজুড়ে যেন ডাকাত পড়েছে। কিছু বেআক্বেল পর্যটকদের জন্য সব বানচাল। যদিও বা গাছপালাগুলো নড়ে উঠেছিল তাও থেমে গেল। দলে দলে বাইসন দেখেই চক্ষু জুড়োই। আচ্ছা, জঙ্গল মানেই কি হাতি, গন্ডার, বাঘ, ভাল্লুক? এই যে এত রোমাঞ্চ, এত ঘন সবুজের নিঃস্বার্থ নিবিড়তা, এত রূপ-রস-গন্ধ, এসব কি কিচ্ছু না? যে যাই বলুক, আমার এতটুকুও দুঃখ হল না হাতি দেখতে পেলাম না বলে। আমার এক্সাইটমেন্টটা অন্য জায়গায়। সেই জঙ্গলের রাস্তা ধরেই আবার ফিরতে হবে ইকো-ক্যাম্পে। সন্ধে নেমে এসেছে। চাপড়ামারিতে যারা বিকেলের ট্রেলটা করেন তারা নেপালি ট্রাইবাল ডান্সটা দেখতে পান। সেটা হয় ওই চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পেই।

ফেরার পথে সঙ্গী হল জঙ্গলে আসা আরও একটি গাড়ি। পুরো রাস্তাটাই তখন সেজে উঠেছে রাতজোনাকির ঝিকিমিকি আলোয়। মনে হচ্ছে সবকটা আলো এক হয়ে এখনই একটা তারা হয়ে যাবে। আর সেই তারার আলোয় ফিরে আসবেন ভূতের রাজা। আমাদের জন্য নিয়ে আসবেন ইচ্ছেখুশির বর। পিছনের গাড়িটা মাঝেমাঝেই ঝোরার জঙ্গলে আটকে যাচ্ছিল। দেখাদেখি আমাদের গাড়িটাও থেমে যাচ্ছিল ওদের সাথে। ওরা এগোলে তারপর আমাদের গাড়ি চলছে। এ জঙ্গলের নিয়মই এটা। কেউ কাউকে ফেলে এগিয়ে যায় না। রেগে গেলে লোককে বলতে শুনেছি ‘অসভ্য ছেলে, জঙ্গলে গিয়ে থাক’। কেন বলে? এটা সেই অসভ্য ছেলেটির শাস্তি না পুরস্কার? শহরের পথেঘাটে কে কোথায় পড়ে আছে আমরা ক’জনইবা খেয়াল রাখি? তবু আমরাই সভ্য! আর দিনেরাতে যারা একের বিপদে অন্যের পাশে দাঁড়ায় তারা অসভ্য? মানুষের তৈরি কংক্রিটের জঙ্গল আর প্রকৃতির তৈরি সবুজ জঙ্গলের মধ্যে পার্থক্য বোধহয় এটাই।

কাঁটায়-কাঁটায় সন্ধে ছ’টা। শুরু হল আদিবাসী সংস্কৃতির বর্ণিল আসর। প্রথমে উদ্বোধনী সংগীত। হারমোনিয়াম এবং কণ্ঠদানে রোশন ছেত্রী। কোন ফাঁকে পোশাক বদলে বাঁধানো মঞ্চটায় উঠে পড়েছে সে। ইকো-ক্যাম্পের আরও একটি ছেলে থুম্বা বাজাল। সমবেত কণ্ঠে নেপালি সংগীত আর তারপরেই ঝলমলে নাচ। অপূর্ব! ছোটো থেকে বড়ো সব মেয়েরাই সেই পানঝোরা গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে রোজ আসে আসর মাতাতে। ভ্রামণিকদের মনে কিছু সময়ের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে যায় ওদের জীবনছবি থেকে উঠে আসা সুখভাসানো রং। কালচারাল কলকাতায় ব্যান্ড নিয়ে এত মাতামাতি, এত মিডিয়া হাইপ। অথচ কোন প্রত্যন্ত অরণ্যগহিনে বেঁচেবর্তে থাকা এইসব বাজনদার, গায়ক, নৃত্যশিল্পীদের কেউ কদর করে না। শুধু সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের বিলাসিতার সঙ্গী এরা। তাতেই ওদের মুখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙে। সবশেষে দলবেঁধে আঁধার রাত্রির বুকে পা ফেলে চলে যায় গাঁয়ের পানে। পথে আলো ধরে না কেউ। কারণ ওরাই যে এই বুনোরাত্রির বুকে ফুটে থাকা একেকটা জোনাকি। ‘তুমি আঁধার-বাঁধন ছড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো, জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ।’

বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের দল ফিরে গেল গাড়ি করে। সন্ধের বাকি সময়টা কাটল গুঁড়ি কাটা চেয়ারে সেই ছাতার তলায় বসে। আপনমনে রবি ঠাকুর গুনগুনিয়েই চলল আমার কণ্ঠে। কত সন্ধে রাতের গান সেসব। চোখ ছাপিয়ে পাহাড়ের গায়ে বিন্দু বিন্দু আলোর নৈশ অভিসার। ওগুলো গাড়ি যাচ্ছে, জটলাদা বলল। সকল নৈশব্দ্যকে লোহার চাকায় পিষে দিয়ে সেতু পেরোচ্ছে রাতের গাড়ি।

রাত ডুবল গভীরে। মুরগির ঝোলে পেট ভরিয়ে ঘুম নামল চোখে। আদিমতার কোলে পেরোল আরও একটা রাত। সকালে আবার বৃষ্টি। জলভেজা সূর্যের লাল আবির ধুয়ে গেছে। রোদ উঠল, একটু পরে। বেরোবার সময় হল। যাবার আগে শেষ কয়েকটা ছবিবন্দির পালা চলল পাঁচ-ছ মিনিট ধরে। তারপর আবারও সেই জঙ্গল টপকে পিচরাস্তায় ওঠা। বাঁদিকে বেঁকে গাড়ির সঙ্গে জঙ্গলও চলল অচিনপুর। আরও ৮ কিলোমিটার। সামনেই বাঁহাতে বেঁকে পাথুরে উতরাই ধরে খানিকটা নামা। এটাই কুমানি মোড়। চোখের সোজাসুজি উচ্ছল নদী। বড়ো বড়ো পাথরে ঠেস দিয়ে কাপড় কাচা চলছে জোরকদমে। নদীটার ওপাশেই ঝকঝকে সবুজ ধানখেত। রোদের সোনা শীতল পাটি বিছিয়েছে সেখানে। আর এপাশে মানে আমাদের গাড়িটা যেদিকটা দিয়ে ঘুরে যাবে সেখানে নদীর উত্তাল রূপ। সদ্য পড়া বৃষ্টির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে নদী। ওই যে দুরের বন-বনানীর আড়াল, সেখান থেকে নদী বইছে নিজের মতো। গাড়ি চলার পাথুরে গর্তের রাস্তা টপকে নদী ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইচ্ছেমতো।

জটলাদা খানিক্ষণ রাস্তাটার গতিবিধি বুঝল। গাড়ি নিয়ে আদৌ যাওয়া যাবে তো? চাকা ফেঁসে গেলেই সোজা নদীগর্ভে। বেশ ভয়-ভয়ই করছিল। কিন্তু সেই ভয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল অচেনাকে চেনার এক অদ্ভুত আনন্দ। যাই হোক, জটলাদার গাড়ি ফাঁকা দেশলাই বাক্সের মতো হেলেদুলে নেচেকুঁদে পাথুরে গর্তের নদীরাস্তা পেরোল। আমরা পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। খুব সাবধানে পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে পার হলাম সেই জলের স্রোত। আবার চলা। ভয়ংকর পাথুরে চড়াই পথ। আশেপাশে দু-একটা বাড়ি। খুব সাবধানে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলল জটলাদা। বড়ো ছোটো পাথর টপকে রীতিমতো নাচতে নাচতে পৌঁছোলাম কুমাই ভ্যালি। কুমানি থেকে কুমাই প্রায় ২ কিলোমিটার। এবার রাস্তাটা ঝকঝকে বাঁধানো। কুমাইয়ে পৌঁছেই মনে হল প্রাণখুলে নিশ্বাস নিতে এসেছি। মাঝখানে বাঁধানো সড়ক, সোজা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গেছে। দুপাশে আদিগন্ত সবুজ নিশ্বাসের চারণভূমি। দূরে, তবু মনে হচ্ছে যেন ছুট্টে গেলেই ছুঁতে পারব উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে। কানের কাছে অবিরত টুংটং শব্দের অনুরণন। সবুজ উপত্যকার বুকজুড়ে আপনমনে চরে বেড়াচ্ছে গোরু-মোষের দল। গোপালক বালক চুপটি বসে খানিক দূরে। অন্যপাশে দুই দেহাতি নারী রঙিন ছাতার ছায়ায় ভাগ করে নিচ্ছে জীবনের টুকরো আলাপচারিতাগুলোকে। স্বচ্ছ আসমানিয়া পেঁজা তুলোর সাজ পরেছে আবার। বিপুল সবুজের গালিচা চিরে পিচকালো রাস্তা হারিয়েছ চা-বাগানের কোলে। সেটা পেরিয়ে সামসিংয়ের পথ। পাহাড়সবুজ উপত্যকা ছুঁয়ে গাড়ি ছুটল সে পথেই। পিছনে পড়ে রইল একদল সরল প্রাণ, বুনোফুলের হাসি, রোমাঞ্চের বাঁধভাঙা ঢেউ, এক বুক সবুজ তাজা নিশ্বাস আর ওই গোরুগুলোর গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুংটুং শব্দ… না না, শব্দ নয়, এই বিপুলা পৃথিবীর মাঝে অতি কষ্টে টিকে থাকা কিছু জীবনের সুর। জানান দেয়, আমরাও আছি।

প্রয়োজনীয় তথ্য

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চেপে সরাসরি পৌঁছে যান নিউ মাল জংশন। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চাপড়ামারি যাওয়া যায়। এছাড়া লাটাগুড়ি এসেও চাপড়ামারি যাওয়া যায়। মাল জংশন থেকে চাপড়ামারি-পানঝোরা-কুমানি-কমাই-সামসিং-সুনতালেখোলা ঘুরতে দিনপ্রতি গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প বা পানঝোরা ইকো-ক্যাম্পে থাকতে হলে যোগাযোগ করুন -ডিএফও, ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন-২, অরণ্যভবন, জলপাইগুড়ি অথবা, রেঞ্জ অফিসার, ইকো টুরিজম রেঞ্জ, লাটাগুড়ি, জলপাইগুড়ি।

 

ডুয়ার্স-এর ডাকে

‘হুজ্জতে বঙ্গাল’– কথাটা মোগল আমলের। ঠিক কোন সম্রাটের আমলে প্রচলিত হয়, তা জানা যায় না, তবে বাঙালির হুজুগে জাতি হিসাবে প্রসিদ্ধি বেশ কয়েক শতাব্দীর। কিন্তু ‘রম্যাণি বীক্ষ’ যাদের আরাধ্য তাদের কাছে ভ্রমণের নেশা শুধুই হুজুগ হতে পারে না। এখন সংসারী মানুষের ভ্রমণসূচী শুধু কর্মস্থল নয়, অনেক বেশি নির্ধারণ করে সন্তানের স্কুল। তাই এবারের পুজোর ছুটিতে আমাদের গন্তব্য হল ডুয়ার্স।

অনেক সময় লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য বড়ো হয়ে দাঁড়ায় দুরারোগ্য ভ্রমণের নেশায় আক্রান্ত মানুষের কাছে। তাই আমার জীবনসঙ্গীর শিলিগুড়িতে বদলি হওয়ায় তার পেশাদারি ও আমাদের সাংসারিক জীবনে অনেকটাই ঝক্বি নেমে এলেও, সবুজ ঘেরা বন সংলগ্ন ক্যাম্পের মধ্যে কোয়ার্টারে আমি মাঝেমধ্যে গিয়েও থাকতে পারব, আর সঙ্গে পাব ডুয়ার্সের বন, সিকিম বা দার্জিলিং-এর পাহাড়ে বেড়ানো, সান্দাক ফু ট্রেকিং-এর সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি স্বপ্নের তোড়ে ঝক্বিটাকেও শাপে বর মনে হল।

পুজোর ছুটিতে বক্সা, জলদাপাড়া ছুঁয়ে অরণ্য-বিহারের সিলেবাস মোটামুটি সম্পূর্ণ করলাম। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলাম কোচবিহারের কিছুটা ঐতিহাসিক সফর। অবশ্য আমাদের শালুগড়া মিলিটারি ক্যাম্প-এর এক পাশেই জঙ্গল। কপাল ভালো থাকলে হাতি, চিতা, বুনো শুয়োর, বাইসন এসবের দেখা মিলতে পারে। ওখানকার বাসিন্দারা অবশ্য উক্ত প্রাণীগুলোর একটারও মুখোমুখি হওয়া সৌভাগ্য মনে করে না বরং আতঙ্কে থাকে। তবে আমি ও আমার কন্যা যতবারই গেছি গরু ও বাঁদর ছাড়া আর কিছু পাইনি। তাই এক বন থেকে উজিয়ে আরও আরও বনের দিকে যাত্রা।

ইংরেজির ডুয়ার্স নামটাই সর্বাধিক প্রচলিত। অথচ এর উৎপত্তি বাংলার ‘দুয়ার’ শব্দ থেকে, যে-শব্দটি একই অর্থে অসমিয়া, নেপালি, হিন্দি, মৈথিলি, ভোজপুরি, মগধি ও তেলুগু ভাষাতেও প্রচলিত। এই দুয়ার বা দরজা, হিমালয় পর্বতের প্রবেশদ্বার নাকি বিশেষ করে ভুটান যাওয়ার প্রবেশপথ (ভুটান থেকে সমতলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ১৮টি প্রণালী এই অঞ্চলে) তা নিয়ে একাধিক মত থাকতে পারে, তবে স্বর্গের দুয়ার বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। নেপাল ও উত্তর ভারতের ‘তরাই’ অঞ্চলের সমতুল্য বাংলার ডুয়ার্স। ৮,৮০০ বর্গ কিলোমিটারের বিস্তীর্ণ এই সমভূমিকে শঙ্কোষ নদী পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ‘পশ্চিম ডুয়ার্স’ ও অসমের অন্তর্গত ‘পূর্ব ডুয়ার্স’-এ ভাগ করেছে।

একসময় কোচ রাজবংশের কামতা রাজ্যের অধীন এই অঞ্চলটির দখল নিয়ে ভুটানের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ভুটানের কাছ থেকে ১৮৬৫ সালে ডুয়ার্স পুনরুদ্ধার করার পর পূর্ব ভাগ জুড়ে যায় অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় আর পশ্চিম ডুয়ার্স কালক্রমে ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলা হিসাবে পরিচিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৪৯  সালে পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যের একটি জেলা হিসাবে জলপাইগুড়ির অন্তর্ভুক্তি ঘটে। খানিকটা এই ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখেই হয়তো আমার ভ্রমণসূচীতে নিসর্গ দর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস দর্শনটা শামিল ছিল। কুচবিহার, ডুয়ার্স এবং ভুটানের ফুন্টশোলিং শহরটা ঘুরে নেওয়ার পর আবিষ্কার করলাম গন্তব্য বাছাই একদিক দিয়ে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। এবারের সংক্ষিপ্ত সফরসূচিটাই জানাচ্ছি।

তাশিগোমাং স্তূপঃ প্রথম দিন বিকেলটা বরাদ্দ ছিল শিলিগুড়ির পুজো মণ্ডপগুলোর উদ্দেশ্যে। মাঝারি ভিড় অথচ জমজমাট আলো ঝলমল অসাধারণ মণ্ডপসজ্জায় ঘুরে বেড়ানোয় ক্লান্তি জাগে না, কারণ যানজটে আটকে ভিড়ে ফেঁসে নাকাল হতে হয় না। দুপুরে খাওয়ার পর বেরিয়ে নেমে পড়লাম একটি তিব্বতি বৌদ্ধ স্তূপ তথা বিহারে। এটা আসলে মূল ভ্রমণসূচীর বাইরে। আমাদের সেবক মিলিটারি স্টেশন থেকে বাজার যাওয়ার পথে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে একটা খুচরো আউটিং। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে এই ছোটো স্তূপটির কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। তিব্বতি লামা কালু রিনপোচে ১৯৯৬ সালে এটির প্রতিষ্ঠা করেন। এটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে ড্রোডন কুনছব চোডি বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। জনৈক লামার কাছে এর বিষয় নানা তথ্য সংগ্রহ করলাম। নিজের কার্ডও দিল। দেখলাম ইংরেজিতে কথা বলার সময় হিন্দি বা বাংলা জানে না কথাটা জানানোয় বেশ দম্ভ ও তাচ্ছিল্য ছিল।

কোচবিহারঃ

গাড়ি নিয়ে প্রথমে ডেলো যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পুজোর মধ্যে কোনও গাড়ি পেলাম না, বদলে তৎকালে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের টিকিট পেয়ে গেছি আগের দিনই। অনেক চেষ্টায় সকালে শিলিগুড়ি স্টেশনে ছেড়ে দেওয়ার মতো একটা বাহন পাওয়া গেল। ভোর ৫.৩০-এ চারজন গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ৭.১৫-য় উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। বাগান, বাঁশবনের পরিচিত দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণে পেৌঁছে গেলাম নিউ কুচবিহার স্টেশনে সকাল ১০.১০  নাগাদ। একটা অটো প্রথমে ৮০০ টাকা হাঁকলেও পরে অন্য প্রতিযোগীদের কোটেশন অনুযায়ী ৬০০ টাকায় রাজবাড়ি-সহ অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান দেখাতে রাজি হল। ভুটানের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব মধুর ছিল না। ইংরেজ সরকারকেও যুদ্ধ করতে হয়েছে ভুটানের কবল থেকে বাংলার এই তরাই অঞ্চলকে মুক্ত রাখতে। ১৭৭২-১৭৭৩ সালে কোচবিহার ভুটান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাদের প্রতিহত করতে ৫ এপ্রিল ১৭৭৩-তে কোচবিহার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে এবং ভুটানের দখলদারি মুক্ত হয়ে কোম্পানির অধীনে করদ রাজ্যে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর আগস্ট ১৯৪৯ পর্যন্ত কোচবিহার ভারত ভূখণ্ড বেষ্টিত রাজ্য ছিল। শেষ রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ চুক্তি সাক্ষর করে ২০ আগস্ট ১৯৪৯ সালে কোচবিহারকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেন।

কোচরাজপ্রাসাদঃ  ১৮৮৭ সালে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই বিশাল প্রাসাদটি নির্মাণ করান বৃটেনের ‘বাকিংহাম প্যালেস’-এর অনুকরণে। প্রাসাদটির নাম ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’। উত্তর-দক্ষিণে ১২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও পূর্ব-পশ্চিমে ৯০ মিটার প্রস্থের মোট ৪৭৬৮ বর্গ মিটারের এই বিশাল অট্টালিকা আমার চোখে ভারতের অন্যান্য রাজপ্রাসাদের তুলনায় খানিক সাদামাটা মনে হল। কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সাদামাটা নয়। মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ কেশব চন্দ্র সেনের কন্যাকে বিয়ে করেন যার ফলশ্রুতিতে কোচবিহারে নবজাগরণ বা রেনেসাঁ এসেছিল মনে করা হয়। নৃপেন্দ্র নারায়ণকে আধুনিক কোচবিহারের রূপকার বলা হয়। বাগানটা শীতকালে নানা মরশুমি ফুলে সেজে থাকে। পুজোর ছুটি বলে স্থানীয় মানুষেরও ভিড় ছিল। প্রাসাদটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে এবং এর অধিকাংশটা জুড়েই অফিস। কিয়দংশে আছে সংগ্রহশালা। সপ্তদশ থেকে একাদশ শতকের নানা পাথরের মূর্তি। লেপচা, ভুটিয়া, রাভা, রাজবংশী, মেচ, গোর্খা, টোটো ইত্যাদি উত্তরবঙ্গীয় উপজাতির সাংস্কৃতিক চিত্র, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, মুদ্রা, শীলমোহর, পোশাক এবং অবশ্যই রাজা-রানিদের ছবির সংগ্রহ দেখলাম। ভুটানের সরকারি মোহর ও অন্যান্য নিদর্শন ছিল।

মদনমোহন মন্দিরঃ  রাজবাড়ি থেকে গেলাম মদনমোহন বাড়ি। কোচবিহার জেলা শহরেই এই মন্দির। ১৮৮৫-১৮৮৯-এর মধ্যে নৃপেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে নির্মিত এই মন্দিরে মা কালী, মা তারা, মা ভবাণী এবং অবশ্যই মদনমোহনের বিগ্রহের নিত্য পুজো হয়। পুজোর ভিড়েও বেশ শান্ত মনোরম পরিবেশ। মন্দির সংলগ্ন আনন্দময়ী ধর্মশালা। কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে মোট ২৭টি মন্দিরের প্রধান এটি। বাকি মন্দিরগুলোর তালিকাও এখানে দেওয়া আছে। এখানে এসে বাকি দর্শনীয় জায়গাগুলোর সন্ধান পেয়ে অটোওয়ালাকে বাড়তি ৮০ টাকা দিয়ে ঝটপট বুড়ি ছুঁইয়ে দিতে রাজি করালাম।

সাগর দিঘিঃ  একদিকে কোচবিহার পুরসভা আর এক দিকে নিউ কালেক্টোরেট বিল্ডিং-এর প্রতিবেশে এই হ্রদটি ভারি মনোরম। প্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি দেখার একঘেয়েমি কেটে যায় সাগর দিঘির পাড়ে এলে।

ব্রাহ্ম মন্দিরঃ  নৃপেন্দ্র নারায়ণের উদ্যোগে ১৮৬০-৮০-র মধ্যে নির্মিত ব্রাহ্ম মন্দির। গোটা জেলা ও শহর জুড়ে যেখানে হিন্দু মন্দিরের প্রাবল্য, সেখানে এই মন্দিরটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্যই দর্শনীয়। রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন এই মন্দির ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে কোচবিহারের বৈষ্ণবীয় হিন্দু সমাজের সহাবস্থানের সাক্ষ্য।

বড়োদেবী মন্দিরঃ  দেবীবাড়ি অঞ্চলে এই দুর্গা মন্দিরটি ইউরোপিয়ান স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন। দুর্গা পুজোর সময় বলে মস্ত মেলা বসেছিল।

ডাঙ্গার আই মন্দিরঃ  কোচবিহার শহরের গুঞ্জাবাড়িতে এই মন্দিরটি তৈরি করান শিবেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী কামেশ্বরী দেবী। সময়কাল ১৮৩৯-৪৭ সাল। এটা মদনমোহনের মাসির বাড়ি। আমরা অটো থেকে নামলাম না। আরও বহু জায়গায় যেতে হবে।

বাণেশ্বরঃ  শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে পেলাম বাণেশ্বর শিব মন্দির। শিবলিঙ্গটি গর্ভগৃহের মেঝের ১০ ফুট নীচে। কাছাকাছি আছে অর্ধনারীশ্বর মন্দির। এখানে একটি জলাশয়ে কচ্ছপ প্রজনন ক্ষেত্র (টার্টেল নেস্টিং বিচ) আছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি কচ্ছপ সংরক্ষণ সংস্থার অর্থানুকুল্যের কথা লেখা আছে। কচ্ছপকে ‘মোহন’ বলে উল্লেখ করা আছে হয়তো বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের প্রেক্ষিতে।

সিদ্ধেশ্বরীঃ  বাণেশ্বর থেকে আরও ২ কিলোমিটার ভেতরে গেলাম সিদ্ধেশ্বরী মন্দির দেখতে। কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণ ১৮৩০ সালে। পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, দেবত্র বোর্ডের অধীনস্থ মন্দির ও ধর্মশালা বেনারসেও রয়েছে। জায়গাটাকে মন্দিরের বদলে গৃহস্থের শান্ত প্রাঙ্গণ বলে মনে হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বৃক্ষ পবিত্র বৃক্ষ হিসাবে রক্ষিত। কাছাকাছি ধলগুড়িতে আছে সটিরহাট হ্যাচারি।

সারা কোচবিহার জলপাইগুড়ি জেলার মূল রাস্তা এমনকী গলিগুলোও অধিকাংশ অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান। শুধু এই সিদ্ধেশ্বরী যাওয়ার রাস্তাটাই এখনও পাকা নয়, তবে কাজ চলছে। চাকচিক্যহীন মন্দিরগুলো কেবল ঐতিহাসিক কারণে আর ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য সিলেবাস কমপ্লিট করার কারণে দ্রষ্টব্য। আমাদের ক্লান্তই লাগছিল। তবু বুড়ি ছুঁতে চললাম দিনহাটা স্টেশনের দিকে কামতেশ্বরীর উদ্দেশ্যে। রাস্তায় এক জায়গায় দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম।

সিদ্ধিনাথ মন্দিরঃ  রাস্তায় পড়ল সিদ্ধিনাথ মন্দির। এটি আরও পুরোনো– ১৭৯৯-১৮৪৩-এর মধ্যে মহারাজ শিবেন্দ্র নারায়ণ দ্বারা নির্মাণ শুরু হয়ে শেষ হয় হরেন্দ্র নারায়ণের আমলে। টেরাকোটার এই মন্দিরটির পাঁচটি গম্বুজাকৃতি চূড়া।

কামতেশ্বরী মন্দিরঃ  দিনহাটা স্টেশন থেকে আরও ৮ কিমি যেতে হল। ১৬৬৫ সালে নির্মিত হয়েছিল মূল মন্দিরটি মহারাজ প্রাণ নারায়ণের রাজত্বকালে। সেটি ধবংস হয়ে যাওয়ায় দেবী কামতেশ্বরীর জন্য মন্দির পুনর্নিমাণ করা হয়।

ভেবেছিলাম সেদিনই শিলিগুড়ি ফিরব। কিন্তু ভ্রমণসূচী শেষ করে শহরে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে রাজবাড়ির ঠিক মুখোমুখি মহারানি প্যালেস হোটেলে রাত্রিবাস করতে হল। কথা ছিল ২০ তারিখটা বিশ্রাম নেব আর অষ্টমীর অঞ্জলি দেব। ২১ তারিখে জলদাপাড়া আর বক্সা দেখার জন্য বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টের ইন্সপেকশন বাংলো বুক করা ছিল।

বিন্নাগুড়ি-জলদাপাড়াঃ

টানা গাড়ি যেহেতু পাওয়া গেল না, তাই জলপাইগুড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে বক্সার জঙ্গল দেখার জন্য আবার ট্রেনই ভরসা। হুট করে হোটেল রিসর্টও পাওয়া মুশকিল হবে। তাই আমরা জলদাপাড়া ও বক্সা দেখেছিলাম বিন্নাগুড়িকে কেন্দ্র করে। জলদাপাড়া বা বক্সা ভ্রমণের জন্য বিন্নাগুড়ি যাওয়া মোটেই জরুরি নয়। গিয়েছিলাম বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টে ওর বন্ধু থাকে বলে। শুরুতেই বাধা। সকালবেলা ট্রেন ধরব, পুজোর মরশুমে চড়া দরেও কোনও গাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল না। রাতে প্রবল বৃষ্টি। অগত্যা ওর অফিসের এক কর্মীর গাড়িতে সকাল ৬টায় শিলিগুড়ি স্টেশন। ৭.৩০-এর শিলিগুড়ি-বামনহাট প্যাসেঞ্জার ধরে বিন্নাগুড়ি। স্টেশনে গাড়ি নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল আমাদের সম্পূর্ণ অজানা বন্ধুর বন্ধু। এমইএস-এর ইন্সপেকশন বাংলো-তে থাকা।

দুপুরে খেয়ে ওর বন্ধু জেমস্-এর সৌজন্যে পাওয়া একটা মারুতি এস্টিম নিয়ে বেরোলাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের উদ্দেশে। জলদাপাড়ায় হাতি সাফারির সময় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩ টে। ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রবেশ নিষেধ। হাতির পিঠে চড়ে জল জঙ্গল পেরিয়ে ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত। এইটুকু যাত্রায় কয়েকটা পাখি, নেউল, বাঁদর আর হরিণ ছাড়া অন্য কোনও পশু চোখে পড়ল না। তবে ওয়াচ টাওয়ার থেকে গণ্ডার, বাইসন এবং দূরে চিতা দেখা গেল। এই চিতা চা বাগানের ত্রাস, না চাইতে হানা দিয়ে প্রলয় ঘটায়। আর আমরা দেখতে এসেছি দেখে কত ভাও খাচ্ছে। আর যে হাতিটার পিঠে চড়ছিলাম সে ছাড়া কোনও বুনো হাতি তো সামনে এল না, দূরেও দেখা গেল না। ১৪১ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনভূমি দিয়ে বয়ে গেছে তোর্সা নদী। জলদাপাড়ার সুপারস্টার একশৃঙ্গ গণ্ডার। তাছাড়া স্বমহিমায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, বুনো শুয়োর, চিতাবাঘ, সম্বর হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, হগ ডিয়ার ইত্যাদি আছে। আর আছে ৩৫০ প্রজাতির পাখি। মেছো ঈগল আর ধনেশ চোখে পড়ল। সাপেরা এখন শীতঘুমে।

প্রবেশমূল্যঃ  ২৫ টাকা (ভারতীয়) ও ১০০ টাকা (বিদেশি)। হাতি সাফারিঃ ১৪০ টাকা মাথাপিছু। জিপ সাফারিঃ  ৪৫০ টাকা। অন্য গাড়িঃ  ৫০-২০০ টাকা। গাইডঃ ১০০ টাকা গাড়ি পিছু। ক্যামেরাঃ  ২৫ টাকা (স্থির) ও ২৫০ টাকা (ভিডিও)। মাদারিহাটে ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন্স অফিস থেকে সাফারির পারমিট করাতে হয়।

দক্ষিণ খয়েরবাড়ি প্রকৃতি উদ্যানঃ  ফেরার পথে এই উদ্যান দেখতে গেলাম। রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে। রাস্তাও পাথুরে এবড়ো খেবড়ো। ভেতরে পার্কে সার্কাস থেকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন দেওয়া কয়েকটা বাঘ ও চিতাবাঘ। ডাব খেলাম। বিশেষ কিছু দেখার নেই।

গোসাইঘাটা ইকো পার্কঃ  পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত এই ইকোপার্কে সময়াভাবে আর ঢুকিনি।

এই দুই জায়গায় নতুন কিছু দেখার মতো পেলাম না, তবে বন ও চা বাগানের যুগলবন্দিটা সারা পথ তাড়া করে বেড়ালেও একঘেয়ে লাগে না। ডুয়ার্সের এই বিশেষত্বই পর্যটকদের টানে সবচেয়ে বেশি। বন্যজন্তুর দেখা মিলুক না মিলুক, ছায়াতরুর পায়ের নীচে ঘন সবুজ চা গাছের সারি চিরে মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটলে মনে হয়, এই পথ যেন সত্যি না শেষ হয়।

বক্সা জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্যঃ ২২.১০-এ বিন্নাগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগের দিনের গাড়িটা নিয়ে গেলাম জয়ন্তী জঙ্গলে ঢোকার পারমিট করাতে। বক্সা জঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত জয়ন্তী জায়গাটাই খুব সুন্দর। প্রবেশের জন্য জন প্রতি ১৭০ টাকা প্রবেশমূল্য ও গাড়ির জন্য আলাদা টাকা দিতে হল। ভিডিও ক্যামেরা হলে তার বাড়তি শুল্ক। এমনি ক্যামেরারও নাকি চার্জ আছে, তবে মোবাইলে ক্যামেরা থাকলে কিছু বলার নেই। ‘ডিফেন্স’ লেখা গাড়ি বলে ছাড় হল না। জয়ন্তী নদীর নামে শহরের নাম। বেশিরভাগ পর্যটক রাজাভাতখাওয়া থেকেই পারমিট করায়। আমরা ওদিকটা যাইনি।

জয়ন্তী থেকে ১৩ কিমি হেঁটে ‘মহাকাল’ গুহা পেরিয়ে বক্সা যাওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা। ‘মহাকাল’ একটা স্ট্যালেগমাইট ও স্ট্যালেগটাইট জাতীয় চূনাপাথর দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে সাজানো গুহা। একগাদা ত্রিশূল পতাকা লাগিয়ে গুহাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বারোটা বাজানো হয়েছে। চাইলে সাঁওতালবাড়ি থেকে ৩.৯ কিলোমিটার ট্রেক করে বক্সা যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। তা ছাড়াও বেশ কয়েকটা ট্রেকিং রুট আছে যেমন ‘রোভার্স পয়েন্ট’ পর্যন্ত হাঁটা। পদব্রজে চলার জন্যও অনুমতিপত্র নিতে হয়। ‘পদসংখ্যা পথ ট্রেক’ যা বক্সা কেল্লা থেকে আদমা হয়ে রাইমাতুং পর্যন্ত গেছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেক রুট। অনেককে হাঁটতে দেখলাম। এর জন্য বন বিভাগের গেস্টহাউস বা বন সংলগ্ন হোটেলে থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হয়। হেঁটে ডুপকা গ্রামেও যাওয়া যায় যেখানে ‘পুকরি মারি’ নামে একটা পুকুর আছে। শিঙি মাগুরে কিলবিল করা জলাশয়টা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র। ডুপকা গ্রামের ডুপকা উপজাতির মানুষরা আসলে ভুটান থেকে আগত মহাযানপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ‘ডুকপা’ কথাটা ‘ড্রুকপা’ শব্দ থেকে এসেছে।

যাইহোক, বাঘের সন্ধানে সুন্দরবন থেকে বক্সা। নোনা জল থেকে পাহাড়ি অরণ্য দাপিয়ে বেড়ানো ডোরাকাটা। উত্তর দিকে ভুটান-ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর ছুটেছে সিনচুলা পর্বত, পূর্ব সীমান্ত ছুঁয়েছে অসম রাজ্য আর দক্ষিণে রয়েছে ৩১ নং জাতীয় সড়ক। বক্সা পাহাড়ের গায়ে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প তৈরি হয়েছিল ১৯৮৩-তে ভারতের ১৫তম বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে। পরে ১৯৯১ সালে বক্সা অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয় ৩১৪.৫২ বর্গ কিলোমিটার যার মধ্যে ১১৭.১০ বর্গ কিলোমিটার বক্সা জাতীয় উদ্যান। তরাইয়ের নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র। তবে ডুয়ার্সের অন্যান্য অরণ্য থেকে এর ফারাক এর পাহাড়ি ভূ-প্রকৃতিতে।

উত্তরে প্রায় লাগায়ো ভুটানের ফিপসু বন্য প্রাণী অভয়রাণ্য আর পূর্বে মানস জাতীয় উদ্যান। ফলে বক্সার জঙ্গল এশিয় হাতিরা ভুটান ভারত পারাপারের পথ হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে মূলত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ভাগ করা হয়। বাঘ ছাড়াও এশিয় হাতি, গউর, বুনো মোষ, বুনো শুয়োর, সম্বর হরিণ, সিভেট, চিতাবাঘ, জংলি কুকুর, প্যাঙ্গোলিন, কালো ভালুক, লাল জংলি মোরগ, চার প্রজাতির ধনেশ-সহ ২৮৪ ধরনের পাখি এই বনের অন্যতম আকর্ষণ যদিও তেনাদের সাক্ষাৎ পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের। আমরা গাড়িতে যেতে যেতে অবশ্য যে পাখিগুলো দেখলাম তার মধ্যে ধনেশ আর বুলবুল ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারলাম না। শালিক আর বকও ছিল। কিন্তু ওগুলো তো দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে বনের বন্য সৌন্দর্য, বন্য প্রাণী অদর্শনের হতাশা মিটিয়ে দিল। এমনিতে অক্টোবর থেকে মার্চ হল ঘোরার সময়। পুজোর সময় বর্ষাস্নাত বনের সবুজ দারুণ মায়াবী।

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দু-তিনটে হাতি ও কয়েকটা হরিণকে তিড়িং-বিড়িং করে একটু দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেতে দেখে তেমন রোমাঞ্চ হল না। গেলাম ঐতিহাসিক বক্সা কেল্লা দেখতে যা ব্রিটিশ ভারত ভুটানের কাছে ১৮৬৫ সালে যুদ্ধে জিতে নিয়েছিল। এই কেল্লা অবশ্য পরবর্তী কালে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কয়েদ করে রাখার কাজেও ব্যহূত হয়েছে। এই অরণ্যে ‘মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ’ শিব মন্দির আছে যেখানে শিব চতুর্দশীর দিন ১০,০০০ ভক্ত জমায়েত হয়। সেটাও বুড়ি ছুঁয়ে নিলাম। শাল, শিমুল, চম্পা, গরম, চিক্রাসি কোনটা কোন গাছ ঠাওর করে উঠতে না পারলেও, গাছের ছায়ায় ঘুরে বেড়াতে দারুণ লাগছিল। আর গাছ বেয়ে যাদের উঠতে দেখলাম প্রথমটায় বুঝতে পারিনি ওরা কারা। একটু লক্ষ্য করতে দেখলাম ওরা প্রকাণ্ড কাঠবেড়ালি। অনেক প্রজাতির সাপও রয়েছে যাদের সঙ্গে মোলাকাতের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না আমার সহ পর্যটকদের। কিন্তু জঙ্গলের সুপার স্টার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেলাম না।

বর্ষার পর পুজোর সময়টা এমনিতেই বন্য জন্তু দেখার জন্য প্রশস্ত নয়। বরং শুনলাম বেশ উদ্বেগজনক খবর। খাতায় কলমে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ ক্ষেত্রতে যত সংখ্যক বাঘ থাকার কথা বাস্তবে সংখ্যাটা তার ধারে কাছেও নেই। চোরা শিকারটা উন্মুক্ত গোপনীয়তা। কোনও ফরেস্ট অফিসার নিজের কোয়ার্টার থেকে বাঘের ডাক শুনতে পেলে সভয়ে বুঝতে পারেন অন্তত একটা হলেও আছে। বক্সা পোস্ট অফিসও দ্রষ্টব্য কারণ এখনও নাকি এখানে রানারদের দ্বারা চিঠি বিতরণ করা হয়। ওটা অবশ্য আমাদের দেখা হল না।

সব দোষ চোরা শিকারের নয়। ভুটান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদীগুলো এত পলি বয়ে এনে তরাই অঞ্চলে বিছিয় দেয়, যে বন্যা একটা লাগাতার সমস্যা। এর ফলে এমন অনেক প্রাণীও বিলুপ্তির পথে যারা শিকারিদের কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়। তাছাড়া চোরাচালানকারী এমনকী অসম থেকে উগ্রবাদীরা ঢুকে গাছপালা কেটে নিয়ে জায়গাটা নষ্ট করছে।

বিন্নাগুড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল। নেহাত রান্নার বালাই নেই। সন্ধে থেকে ইনস্পেকশন বাংলোর ডাইনিং-এ কিছু বন্ধু তাদের পরিবারকে নিয়ে ছোটো আড্ডা ও নৈশাহার-এর জমায়েতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা স্ন্যাক্স পানীয়র পর্ব পার করে পেৌঁছোনোয় সরাসরি খাবার টেবিলেই বসতে হল। ওর বন্ধু জেমস-এর অনুরোধ রেখে পরের দিনটাও থাকা গেল না। আমাদের কলকাতা ফেরার টিকিট কাটা রয়েছে। ভদ্রলোক খুব উৎসাহিত হয়ে নিজেদের ক্যান্টনমেন্ট ঘুরিয়ে দেখাতে চাইছিলেন। অবশ্য এই ক্যান্টনমেন্টের চেয়ে ওর বর্তমান দফতর তথা আবাসস্থল যে মিলিটারি ক্যাম্পে তা অনেক অনেক গুণ সুন্দর।

সকালে বামনহাটা-শিলিগুড়ি ইন্টারসিটি ধরে ফেরা। যাদের আরও দূরে ফিরতে হবে, তারা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন যাবেন অথবা বাস স্টপ। ফেরার পথে যথারীতি রেস্তোরাঁ থেকে দুপুরের খাবার কিনে নেওয়া।

সেবক মিলিটারি স্টেশন ঢুকেই শুনলাম বুনো হাতির একটা ছোটো দঙ্গল এসে অনেক অনর্থ করে গেছে। হায় রে। হায় রে বক্সাদুয়ার, হায় রে জলদাপাড়া, হায় রে উজিয়ে ঘোরা!

সঙ্গের সহায়ঃ ছাতা, ওষুধ, যথেষ্ট শীতবস্ত্র, ক্রিম, লোশন, সানস্ক্রিণ লোশন আর ভুটান যেতে হলে অবশ্যই নিজের ছবি ও পরিচয়পত্র। ভুটানের জন্য মুদ্রা পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। সর্বত্র ভারতীয় টাকা চলে ও বিনিময় একই।

যাত্রার উপায়ঃ  বিমানে বাগডোগরা হয়ে যেতেই পারেন। তবে কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ির অজস্র ট্রেন। শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেল, পদাতিক, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা, কাঞ্চনজঙঘা, হাটেবাজারে ইত্যাদি। কলকাতা স্টেশন থেকে গরিব রথ, কলকাতা হলদিবাড়ি, কলকাতা-ডিব্রুগড় ইত্যাদি। হাওড়া থেকে শতাব্দী, তিস্তা-তোর্সা, হাওড়া-এনজেপি এসি এক্সপ্রেস (সপ্তাহে দু’দিন), গুয়াহাটি এক্সপ্রেস, হাওড়া-কাটিহার এক্সপ্রেস, কর্মভূমি ইত্যাদি। মরশুমে এত ট্রেনেও টিকিটের আকাল পড়ে যায়। তাছাড়া ধর্মতলা থেকে রাজ্য সরকারের রকেট, ও বিভিন্ন প্রাইভেট ভলভো ছাড়ে শিলিগুড়িগামী। আসানসোল, অন্ডাল ও বোলপুর থেকেও এনজেপি-র ট্রেন আছে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব