নবজন্ম

আজ অনেকদিন পর আবার এক নতুন সাজে সেজেছে ইমন-কল্যাণ। আজ এই অনুষ্ঠান শুধুমাত্র এই বাড়ির মালিক ও মালকিনের পঞ্চম পুণ্যতিথি বলে যে তা কখনওই নয়, কারণ সেই ভয়ঙ্কর দিন কখনওই তিথি ভুলতে পারে না। আজকের দিনে সে তার একান্ত নিজের বলেই যাদের জানত, তার মা ও বাবাকে হারিয়েছে। আর তাদেরকে হারাতেই এই সমাজের কদর্য, স্বার্থপর রূপ ওর সামনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে। আজ সেই সকল স্মৃতি ওর মনের আনাচে কানাচে উঁকি মারছে। কিন্তু কিছু বিশেষ কারণে আজ তার মন কিছুটা তৃপ্ত আবার শান্ত।

আজ বহুদিন ধরে চলে আসা নানান পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তার মায়ের মনের ইচ্ছে সে আজ পূরণ করতে চলেছে। আর তারই সঙ্গে অনেক মানুষের অনেক প্রশ্নের জবাব আজ বিনা বাক্যব্যয়ে করেই দিতে পারবে, এটা ভেবেই সে আজ অনেক তৃপ্ত। আজ সকল অপেক্ষার অবসান হবে কিছু সময় পর। আজ দীনু কাকা, মঙ্গলা পিসি আর যারা বাইরের কাজ করেন, প্রত্যেকে নতুন উদ্যমে কাজ করছেন।

আবার বহুদিন পর এই বাড়ি অনেক মানুষের কথায় ভরে উঠবে। সত্যিই তিথি দিদির হাত ধরেই এইসব মানুষগুলো যেন আরও কয়েক বছর বাঁচার রসদ পেল। কিন্তু তিথি সে এরপর কী করবে, তার তো পথচলা এই পর্যন্তই ছিল। তাকে তো এবার তার নতুন ঠিকানা খুঁজতে হবে। কখনও কখনও গভীর চিন্তায় আমরা আমাদের বাহ্যিক পরিবেশ থেকে এতটাই সরে যাই যে, আমাদের আশেপাশে কোনও মানুষের উপস্থিতিও আমরা টের পাই না।

তিথি নিজের ভাবনার মধ্যে এমন ভাবে ডুবেছিল যে, বাবা ও মায়ের ছবির ভিতর যে কারোর প্রতিচ্ছবি এসে পড়েছে সে সেটা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। এবার সে পিছন ফিরতেই বাগানের মালি দামু দাদাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?” তার প্রশ্নে দামু কিছু একটা ভেবে বলল, ‘এজ্ঞে ওই ভালোমানুষ দাদা, দিদিরা এয়েছেন গো দিদিমণি, তোমার খোঁজ করতাছেন। আমি উনাদের বৈঠকখানাতে বসায়ে এলুম।’

তিথি সব শুনে বুঝতে পারল, কাদের কথা দামু বলছে। দামুকে বিদায় করে নিজের মনে হাসল, আহা এই সহজ সরল মানুষগুলো কত সুন্দর ভাবে মানুষের কাজের উপর বিশ্বাস রেখে তাদের পরিচয়ের সামনে একটা বিশেষণ ব্যবহার করে তাদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। সত্যিই তো মেঘা, রুমেলা, কৌশিক, নীল— এরা সততার সঙ্গে সমাজের উদ্ধারে নিজেদের ব্রতী করেছে। আর তাদের সাহায্যেই আজ তিথিও এত বড়ো কাজটা করতে পারবে।

নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ওর নজর চলে গেল সোজা লনের দিকে, যেখানে তার কিছু পরিচিত প্রতিবেশী, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত কিছু অতিথি আর এই বাড়ির মালিকের কিছু আত্মীয় নিজেদের আসনে বিরাজ করছেন। এত জনসমাবেশের কারণ বুঝতে না পারায় কিছু কৌতূহলী চোখ তিথিকে খুঁজছে, আর কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে তা নিয়ে নিজেদের মত পোষণ করছেন, ফলে একটা মৃদু গুঞ্জনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।

যথাসময়ে তিথি তার ভালোমানুষ বন্ধুদের (দামু দাদার মতে) নিয়ে সকলের সামনে উপস্থিত হল। সকলের সামনে দুই হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানাল। এরপর সে আজকের এই অনুষ্ঠানের মূল কারণে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাল— সে আগে সকলকে কিছু পুরোনো কথা জানাতে চায়, যা এই বাড়ির সঙ্গে যুক্ত, তার জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই বলে সে সকলকে আজ থেকে পাঁচশ বছর পিছনে নিয়ে গেল।

ইমন-কল্যাণ-এর প্রধান আকর্ষণ ছিল তার মালিক কল্যাণ রায় আর মালকিন ইমন রায়। দুইজন ছিলেন যেমন প্রাণবন্ত, তেমনই তাদের ছিল পরোপকারী মন। সকলের খুব প্রিয়, কোনও শত্রু তাদের ছিল না। পৈতৃক ব্যাবসা সামলানোর পরও সকলের বিপদ-আপদে ঠিক পৌঁছে গেছেন ওনারা। শুধুমাত্র একটি কষ্ট ভগবান তাদেরকে দিয়েছেন, সেটা হল সন্তান-সুখ থেকে বঞ্চিত থাকার দুঃখ। এই দুঃখের একদিন অবসান হল এই ছোট্ট তিথিকে দত্তক নিয়ে।

কিন্তু এই মেয়ে যত বড়ো হতে লাগল ততই ইমনের মনে নানান ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হল। কারণ সে বেশ বুঝতে পারছিল তাদের অবর্তমানে আশেপাশের লোকজন তাকে নানাভাবে বিরক্ত করবে। যে সত্য ওনারা তিথিকে কোনওদিন জানতে দিতে চাননি, সকলে মিলে সেটাই আগে তার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। এইসব ভেবেই ইমন ঠিক করলেন যে, তিনি তিথিকে এমন ভাবেই মানুষ করবেন যেন সকল পরিস্থিতির জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত রাখে।

যখন তিথির ষোলো বছর পূর্ণ হল, তখন থেকেই তিনি তার সকল প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতেন, ‘সব বাবা-মা সন্তানকে সেরা জিনিসটা তুলে দেন, আমরাও তাই করবার চেষ্টা করি। কিন্তু সন্তান যদি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তবেই হবে মুশকিল। কারণ সকলের সবদিন এক নাও যেতে পারে। তাই এই উপযুক্ত সময় নিজেকে তৈরি করার, একে কাজে লাগাও। নিজেকে সকল পরিস্থিতির জন্য তৈরি করো। আমরা তোমার এই নিজেকে গড়ার কাজে সাহায্যের জন্য আছি, কিন্তু তারপর তোমাকে নিজেকে সফল ভাবে সমাজের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তোমার সেই উন্নতি, প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র তোমার— যা কেউ কখনও কেড়ে নিতে পারবে না।’

এতসব কথা ঠিক মতোন করে সবটা তিথির বোধগম্য হতো না। কিন্তু যখন মা এইসব কথা বলতেন তখন মাকে যেন ভীষণ অচেনা মনে হতো। এই ভাবেই বেশ ক’টা বছর আনন্দের সঙ্গে কাটছিল। তিথির স্কুল-জীবন শেষ হতেই কল্যাণবাবু তার উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সময় সব সময় একরকম যায় না। হঠাৎই একটা দুর্ঘটনার ফলে এই রায় দম্পতির জীবনের প্রদীপ নিভে গেল। তিথি খবর পেয়ে এসে দেখল সব শেষ।

এই ভাবে তার জীবনে যে এরকম বিপর্যয় নেমে আসবে তা তার কল্পনার অতীত। যখন সে সকল ক্রিয়াকর্ম মিটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে তখন অতিপরিচিত মানুষদের ব্যবহার তার কাছে খুব অদ্ভূত লাগতে লাগল। যারা এতদিন তাকে খুব ভালোবাসত এখন কেমন ঈর্ষার চোখে দেখছে, বলছেও যে তার নাকি কপাল খুলে গেল। সে ভাবত, তার যা হারিয়ে গেল তাতে কীভাবে সে লাভবান হয়। নিজের মা-বাবাকে হারিয়ে কেউ কি খুশি হয়।

এইসব ভাবনা নিয়ে সে বিদেশ ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। কারণ তার পড়া শেষ হতে এখনও কয়েক বছর বাকি। সেইসময় জিনিসপত্র গোছানোর সময় তার হাতে আসে মায়ের ডায়েরি। যার প্রথম পাতার উপর তিথির উদ্দেশ্যে লেখা, তিথির জন্য মায়ের আশীষ। সেই ডায়েরি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে নতুন করে জানতে শুরু করল। সে এইদিন প্রথম জানল যে, সে দত্তক কন্যা। তাই আশপাশের লোকজনের থেকে তার মা তাকে কীভাবে আগলে রেখেছেন। তার মা ও বাবা তাকে তাদের যথা সর্বস্ব দিয়ে মানুষ করতে চেয়েছেন। এইসবের বদলে তার মা তার কাছে একটাই দাবি রেখেছেন, ‘জীবনে তুই অনেক বড়ো মাপের মানুষ হয়ে আশপাশের সকলকে দেখিয়ে দে যে, তুই শুধুমাত্র মা ও বাবার আশীর্বাদ নিয়ে, নিজের যোগ্যতায় নিজের একটা আলাদা জগৎ ও পরিচয় তৈরি করেছিস। তোর বাবার সমস্ত কিছুই তোর হওয়া সত্ত্বেও তুই সকল বৈভব দূরে রেখে নিজের কর্মের দ্বারা এইসব কিছু অর্জন করে দেখা। তখন আমরা যেখানেই থাকি আমাদের তোকে নিজের সন্তান বলে ভাবতে গর্ববোধ হবে। মনে হবে কাউকে আমরা আমাদের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী হিসেবে এই পৃথিবীতে রেখে যেতে পারলাম। আর আমাদের অবর্তমানে তুই এই বাড়ি কোনও এক সংস্থাকে দিয়ে দিবি, যারা এখানে অনাথ শিশুদেরকে যথার্থ শিক্ষা দিয়ে বড়ো করতে পারে। এটা আমার একটা স্বপ্ন।’

এইসব কথা বলতে গিয়ে কখন যে তার দুই গাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এসেছিল, তা তিথি খেয়াল করেনি। চোখ মুছে সে সকলকে জানাল যে, আজ সে তার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছে। এই বাড়ি সে ‘নবজন্ম’ নামে এক সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছে। এই বলে সে রুমেলা, নীল, কৌশিক আর মেঘার হাতে বাড়ির কাগজ আর কিছু চেক তুলে দেয়। আর সকলকে বলে সে আজ থেকে এইসব কিছু থেকে মুক্ত। তার নতুন ঠিকানায় সে কেবল তার মা ও বাবার স্মৃতি হিসেবে তাদের ফোটোটাই নিয়ে যাবে। কিন্তু এখানকার পুরোনো কাজের লোক আগের মতোই এখানে থাকবে।

তার এই মহৎ উদ্দেশ্য জানার পর ওখানে উপস্থিত সকলে এতটাই অবাক হলেন যে, বলার মতো কিছু ভাষা খুঁজে পেলেন না তাঁরা। শুধু এই মেয়েটিকে আজ মন থেকে আশীর্বাদ জানালেন। কারণ সে আজ প্রতিষ্ঠিত শুধুমাত্র কারওর দয়ার জন্য নয়। তার মধ্যে যে মেধা ছিল, সহনশীলতা আর শালীনতাবোধ ছিল, তার জন্যই আজ সে সকলের থেকে আলাদা। আজ সকলের সামনে তার ‘নবজন্ম’ হল।

ভাসান

“ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ?

ঠাকুর যাবে বিসর্জন!”

প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে দেবীমূর্তির বিসর্জনের সময় এই লাইন দুটো শুনলেই ক্ষেপে যেত বৈদেহী, রেগে গিয়ে বলত — আচ্ছা, এটার মানেটা কী বলো তো মা! অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতেও মা দুগ্‌গার ভাসান হয় কী করে? শুভ শক্তির কি আদৌ কখনও বিসর্জন হয় নাকি?

বাড়ির একমাত্র মেয়ের নাম ‘বৈদেহী’ রাখায় আপত্তি করেছিলেন ঠাকুমা উমাদেবী। ছেলের বউ কৃষ্ণা মানে বৈদেহীর মাকে বলেছিলেন, রামায়ণের সীতামাতা যে জনমদুঃখিনী ছিলেন, বউমা তার নামে মেয়েটার নাম রাখবে? শুনে কৃষ্ণা উত্তরে বলেন, আমার নামটাও তো আপনার মহাভারতের দ্রৌপদীর নামে মা, উনিই বা কী এমন সুখী ছিলেন! তা আমি কি কিছু খারাপ আছি এখন, বলুন তো?

কথাটা অবশ্য তখন কিছু ভুল বলেননি কৃষ্ণা। অন্তত বছর ছয়েক আগে অবধি তো বৃদ্ধা শাশুড়ি, সরকারি চাকুরে স্বামী আর গবেষণারত একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল ওনার। ছিল, কিন্তু এখন আর নেই, এখন শুধু অতীতের সুখস্মৃতিটুকু পড়ে রয়েছে ঠাকুর ভাসানের পর জল থেকে ভেসে ওঠা কাঠামোর মতোই!

এইতো ক’দিন আগে বিতান এসেছিল ওর মাকে নিয়ে নিজের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। সামনের নভেম্বর মাসেই বিয়ে; অক্টোবরে পুজোর মধ্যে তো আর এসব কাজ এগোনো সম্ভব নয়, তাই আগেভাগেই বেরিয়ে পড়েছে নিমন্ত্রণপত্র বিলোতে। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে সম্বন্ধ করে বিয়ে হচ্ছে পোস্ট ডক্টরেট রিসার্চ স্কলার বিতানের। বৈদেহীর ইউনিভার্সিটির সহপাঠী ছিল বিতান। শুধু বন্ধুত্বই নয়, দু’জনের সম্পর্কটা এগিয়েছিল আরও খানিকটা। যার জেরে কৃষ্ণার মনে হল— বিয়ের কার্ডটায় তো কনের জায়গায় ওনার মেয়ের নামটাও থাকতে পারত আজ !

—আচ্ছা, ও কি সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত কিছু জানিয়েছিল বিতানকে?” অনেকবার জিজ্ঞেস করবেন ভেবেও কখনও করা হয়ে ওঠেনি প্রশ্নটা।

‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট’ বা সংক্ষেপে ‘নেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে “সিএসআইআর’ থেকে স্কলারশিপ পেতে কোনও অসুবিধে না হলেও, রিসার্চ পেপারগুলো ঠিকমতো পাবলিশ না হওয়ায় একটু দুশ্চিন্তাতেই ছিল অন্তর্মুখী বৈদেহী; গবেষণাপত্র প্রকাশনা, ল্যাবে কাজ, থিসিস লেখা ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নানান সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় বেশ কিছুদিন থেকেই খানিকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সে।

তবে সেবারটা যেন একটু বেশিই থম মেরে গিয়েছিল মেয়েটা! কারণ জিজ্ঞেস করেও কোনও যুৎসই উত্তর না পেয়ে কৃষ্ণারা ভেবেছিলেন, হয়তো বা রিসার্চের পড়াশোনার চাপ। মেয়ে তাঁর বরাবরই বড্ড মিতভাষী, চাপা স্বভাবের, তাই মা হয়েও মেয়ের মনে কী ঝড় বইছে তা ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পাননি কৃষ্ণা! ঝড়ের আগের সেই ছিল ওর শেষ নিস্তব্ধতা। আর তারপরই তো জন্ম এক অকালপ্রয়াণের অনন্ত নীরবতার!

বহুকাল আগে নিজের অল্প বয়সে সাহিত্যিক শংকরের লেখা ‘কত অজানারে’ বইটা পড়বার সময় কৃষ্ণা একবারও ভাবেননি যে ভবিষ্যতে ষাটের কাছাকাছি বয়সে এসে প্রায় ছয় বছর ধরে নিয়মিত যাওয়া আসায় সেই উপন্যাসে বর্ণিত কলকাতা-র সুপ্রাচীন ‘লাল বাড়িটি’র আনাচ-কানাচ প্রায় একরকম মুখস্থই হয়ে যাবে তার! তবে আজ দীর্ঘ ছয় বছরের অপেক্ষার অবসানে শুনানি, নির্দেশ আর রায়দানের পর নিজের পক্ষের উকিলের সাথে কথা বলে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে এই প্রথমবারের মতো যেন একটু স্বস্তিই পাচ্ছিলেন উনি।

প্রখ্যাত রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরি থেকে নিজের একমাত্র মেয়ে বৈদেহীর প্রাণহীন ঝুলন্ত নিথর দেহটাকে নামিয়ে প্রাপ্ত সুইসাইড নোটে দায়ী-অপরাধীর নাম উদ্ধারের পরও যখন পিএইচডি গাইড অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরটিকে ‘বিশাখা অ্যাক্টের’ আওতায় গড়ে ওঠা “ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি’ সামান্য শোকজ নোটিসটুকুও ধরাল না আর পুলিশ ও প্রাথমিক পর্যায়ের তদন্ত সেরেই দায় ঝেড়ে ফেলল, তখন বৈদেহীর বাবা মৃতা মেয়ের বদনামের আশঙ্কায় প্রথম দিকে কোর্টে কেস ফাইল করতে মত দেননি। পরে অবশ্য মেয়ের আত্মার শান্তি কামনায় আর স্ত্রী কৃষ্ণার কথায় নিমরাজি হলেও পোড়খাওয়া নিরীহ মানুষটির ধারণা ছিল যে, মেধাবী ছাত্রীর মধ্যবিত্ত পরিবারকে একদিন ওই টাকা আর ক্ষমতার কাছে হার মানতেই হবে। কিন্তু যে চলে গেল সব কিছু ছেড়ে, সে তো আর ফিরে আসবে না। তাই আর কী দরকার এইসব আইন- আদালতের ঝুট-ঝামেলার? উমাদেবী কিন্তু তখন নাতনির সুবিচার পাওয়ার আশায় কেস চালাতে নিজের হাফ-পেনশনের টাকাটা নিজেই দিতে চেয়েছিলেন, যদিও সেটার প্রয়োজন পড়েনি কখনও।

মেয়ে বৈদেহীর হয়ে ন্যায়ের লড়াইয়ে অনেক আইনি জটিলতার মারপ্যাচ এই ক’বছরে ভালোই বুঝতে শিখেছেন কৃষ্ণা। কিন্তু আজও বুঝে উঠতে পারলেন না যে, এখনও যখন এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে তখন আমাদের দেশের ক্রমশ অগ্রগামী সুসভ্য সমাজ কেন হঠাৎ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পুরুষ বনাম নারীতে ভাগ হয়ে যায়? কেন এই ভাগাভাগিটা সত্যি- মিথ্যা, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত বা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে ঘটে না ? মানবিকতার ঊর্ধ্বে কেন স্থান পায় পুরুষতন্ত্র কিংবা নারীবাদ?

আইনের ফাঁকফোকর আর দীর্ঘসূত্রতার মতোই এই বিবাদও কিন্তু সাহায্য করে আসল অপরাধীকে শাস্তির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যেতে, সে তার সামাজিক লিঙ্গ-পরিচয় যাই হোক না কেন! প্রায় সবাই সম্ভাব্য নির্যাতনকারী অথবা নির্যাতিতার চরিত্র ও স্বার্থ বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সত্যিই ঠিক কী এবং কেন ঘটেছিল— সেই সত্য উদ্ঘাটনের তাগিদ বা আসল সমস্যা প্রতিকার করার উপায়ের খোঁজ কারওর মধ্যেই চোখে পড়ে না।

আসলে রসালো ‘কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি’র গুজব যে নিরপেক্ষ খবরের চেয়ে অনেক বেশি মুখরোচক; কিন্তু, কেউই ভেবে দেখেন না যে, ঠিক কীরকম মানসিক অবস্থা কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিতে পারে! সত্য সেলুকাস, বড়ো বিচিত্র দেশ…!

নামের সামনে ডক্টরেট আর পিছনে আরও নানান ডিগ্রি ও দেশি-বিদেশি অ্যাওয়ার্ডধারী উচ্চশিক্ষিত সমাজের তথাকথিত সম্মানীয় ‘ভদ্রলোক’টি হাইকোর্টের অর্ডারে সাসপেন্ড হয়ে আজ থেকে পুলিশি হেফাজতে থেকেই যে আরও নামী এবং দামি উকিল ধরে উচ্চতর আইনি স্তরে আবেদন করবে, তা ভালোভাবেই জানেন কৃষ্ণা। তবে তিনিও এখন প্রস্তুত মেয়ের হয়ে আরও বড়ো লড়াইয়ের জন্যে….

আচমকা খেয়াল হয়-— আজ রাত পোহালেই তো কাল ভোরে মহালয়া। দেবীপক্ষের শুরু, প্রায় এক সপ্তাহ পর মায়ের বোধন আর ঠিক তার ক’দিন পরই প্রতিমা নিরঞ্জন। এখন তো কলকাতাতে মহালয়ার দিন থেকেই পুজো-প্যান্ডেলের উদ্বোধন শুরু হয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। দেবী দশভুজাকেও আজকাল ক্লাবের পুজো পাওয়ার জন্য সেলিব্রেটিদের হাতে ফিতে কাটার অপেক্ষা করতে হচ্ছে— ভেবেই একচিলতে তির্যক হাসি খেলে যায় কৃষ্ণার ঠোঁটে!

হাইকোর্ট চত্বর থেকে বেরিয়ে বাসে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকের বাদ্যি সমেত ছোটো ট্রাকের পেছনে মণ্ডপগামী মা দুর্গার কাগজ ঢাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলেন কৃষ্ণ—

‘অসুর থাকছে কতক্ষণ ?

অসুর যাবেই বিসর্জন।’

মিষ্টি গল্প

জানলার কার্নিশে চুপটি করে বসে আছে দিতি। ও বাড়ির ছাদে মিনু বউদির চার বছরের ছেলেটি খেলছে। অন্যদিন দিতি ডেকে ডেকে ওর সাথে কথা বলে। কিরে শুটকি কী করিস, কী খেলিস? ভারি মিষ্টি লাগে শুনতে আধো আধো কথা। আজ দিতি চুপ করেই রইল। ওর মনে আজ অন্য সুর।

কত কী ভেবেছিল! আজকের দিনটি স্পেশাল হবে সবার জন্য! বিশেষ করে কাকাই-এর জন্য একটা সারপ্রাইজ থাকবে, সারপ্রাইজটা পেয়ে কাকাই ওকে জিজ্ঞেস করবে, ‘কী খাবি বল তো দিতি মা!’ দিতি ফস করে বলবে, “আম সন্দেশ, নলেন গুড়ের রসগোল্লা, ফুচকা, আইসক্রিম।’ খুব মজা হবে হই-হুল্লোড় হবে। কিন্তু হিসেব গরমিল হয়ে গেল। কাকাই যে ওর উৎসাহে এমন ভাবে… কাকাই ওর রোল মডেল, অথচ…!

বাবা, মা বাড়িতে কেউ নেই, থাকলেই বা কী হতো! আকাশ পাতাল কত কী ভাবছে দিতি। হঠাৎ হাওয়ায় সরসর করে টেবিলের উপর থেকে পেনটা ঠকাস করে মেঝেতে পড়ল। বড্ড বিরক্ত দিতি। এক লাফে মেঝেতে নেমে কলমটা তুলে প্রায় ছুঁড়ে ড্রয়ারে রেখে দিল। খাতাটাও ড্রয়ারে রেখে দিল। যাহ! সব বাদ, সব বন্ধ! এখন ওর একটাই চিন্তা হবে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কোনওরকমে ঢুকে, ডিগ্রি নিয়ে চাকরি জোগাড় করা। দেয়ালে ওর হাতে আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখ। পেনসিল স্কেচ আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখে মিষ্টি একটা হাসি, একেবারে যেন জীবন্ত। ও এঁকেছিল। কাকাই দেখে অবাক, খুব খুশি হয়ে কাকাই ছবিটাকে বাঁধিয়ে রেখেছে। আরিব্বাস এ মেয়ে তো ভার্সেটাইল জিনিয়াস।

মাকে বলেছিল, ‘বউদি, আমি ওকে গড়েপিটে তুলব। দেখবে দারুণ হবে তোমার মেয়ে, দশের মধ্যে এক।”

অথচ সেই কাকাই! মানুষের কত রূপ, কত পরিবর্তন। মানুষও যেন ক্যামিলিয়ানের মতো রং বদলায়।

ক’দিন ধরেই দিতির মনে খুশির হিল্লোল ছিল তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি, জানতে দেয়নি। সারপ্রাইজটা সেইদিনই দেবে ঠিক করে রেখেছিল। ওর লেখা একটি গল্প এক জনপ্রিয় পত্রিকায় ছাপা হবে। সম্পাদকমশাই নিজে ফোন করে জানিয়েছেন, শুনেই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছে দিতি।

ওহ, এত আনন্দ! এত আনন্দ! এমন একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত পত্রিকা! কাকাইও লিখত। খুব শখ ছিল ওই পত্রিকা কাকা-র লেখা নেবে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। দিতির এই গল্পটা কাকাই এডিট করেছিল। পড়ে বলেছিল ভারি মিষ্টি গল্পটি। দিতি গল্পটির নাম দে, ‘মিষ্টি গল্প’। সেই মিষ্টি গল্পটিই ছেপে বেরোচ্ছে। কাকাই খুব খুব খুশি হবে।

গতরাতে তো ঘুমই হয়নি দিতির। কখন যে সকাল হবে! একটু চোখ লাগতে না লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় যাচ্ছে আর আসছে। ঘর বার করছে, কখন পেপার দাদু আসবে! সাত সকালে টিং টিং বেল বাজতেই ছুটে এসেছে,

—বইটা এনেছ পেপার দাদু?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার জিনিস ভুলি কী করে দিদি? সেই হিম্মত কি আমার আছে!

পেপারের সাথে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ময়ূরের মতো কিছুক্ষণ নেচে নিল। খুলে নিজের লেখাটির উপর হাত বোলাল। দুই পাতার ‘মিষ্টি গল্প’। বাহ, কেমন সুন্দর ছবি দিয়েছে। মন ভরে গেল। আনন্দে উত্তেজনায় বুকের ভিতর ধুকপুকুনিটা বেড়েই চলছে। বই বুকে জড়িয়ে দে ছুট দোতলায় কাকাইয়ের ঘরে। ঘরের সামনে এসে থমকে গেল, দরজা বন্ধ। ঘুমোচ্ছে? ডেকে তোলা ঠিক হবে না। কাল অনেক রাত পর্যন্ত এই ঘরে লাইট জ্বালানো ছিল। কাকাই অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে, কাম্মা অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ে। থাকুক ডেকে কাজ নেই, বরং ঘরে গিয়ে অন্য লেখাগুলো দেখা যাক৷ ভালো করে পড়া যাক।

ঘরে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল দিতি। অনেকগুলো গল্প প্রবন্ধ কবিতা! হঠাৎ কান্নার ডাকে হুশ ফিরল,

—কিরে ন’টা যে বেজে গেল কখন উঠবি? আজ এত দেরি কেন রে? কলেজ ছুটি তাই?

হুড়মুড় করে উঠে বসল দিতি। সত্যি অনেক বেলা হয়ে গেল। বইটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

–কাম্মা, কাকাই উঠেছে?

—উঠেছে মানে! বাজার করে পর্যন্ত ফিরে এসেছে। একটু আগে তোর মায়ের ফোন এসেছিল, ওরা খুব ভালো আছে আর খুব ঘুরছে।

বইটা বুকে চেপে ছুট লাগাল। কাম্মা চিৎকার করে উঠল, “ওরে পাগলি ধীরে ধীরে, পড়বি তো! দেখিস যেন হাত পা না ভাঙে।’ একদমে ছুটে এসে কাকাই-এর সামনে দাঁড়াল। দুই হাতে বুকের উপর বইটা পরম সোহাগে জড়ানো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কাকাইয়ের দিকে। চোখে পলক পড়ে না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। কাকাই কী বলবে এবার! দারুণ সারপ্রাইজ! ফিস ফিস করে বলল, “কাকাই সেই, মিষ্টি গল্প দেখো পত্রিকায়…।’ কাকাই কেমন যেন ভাবলেশহীন।

—কিছু বলবি? কী হয়েছে?

—সেই মিষ্টি গল্প। তুমি এডিট করেছিলে। দেখো ছবিটাও কেমন মিষ্টি। তোমার প্রিয় পত্রিকায় আজ বেরিয়েছে।

—তাই নাকি। আচ্ছা। বেশ।

—কখন পড়বে কাকাই?

—আজ খুব ব্যস্ত আছি রে মা। রেখে দে টেবিলে, পরে দেখব।

—তোমার সবচাইতে প্রিয় পত্রিকা কাকাই।

—হ্যাঁ আগে খুব পড়তাম, এখন আর সে মান নেই। এখন লেখাগুলো আগের মতো ধারালো নয়, শাঁসালো নয়। যা পায় তাই ছাপে। রেখে দে, রেখে দে, পরে দেখব।

দিতির দুই চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি হঠাৎ নিভে গেল। একেবারে কেমন পালটি খেল কাকাই! ওর উৎসাহে এমন ভাবে জল ঢেলে দিল! ওর লেখার মান নেই! যেই না ওর লেখা বেরোল সেই সঙ্গে পত্রিকার মান নেমে গেল! ধোপা যেমন পাথরে কাপড় বাড়ি মারে ঠিক তেমনই ওর বুকে কেউ যেন ঠাস ঠাস করে মারল। এত কান্না পাচ্ছে, পা আর সরছে না।

নিজের ঘরে এসে বসল, খুব কান্না পাচ্ছে। দু’ফোঁটা জল গড়িয়েই পড়ল, আটকাতে পারল না দিতি। এত আনন্দ, উত্তেজনা, এক ফুৎকারে একেবারে নিভে গেল। অথচ কাকাই …! বাবা-মাকে জানায়নি এখনও দিতি। আর জানাবেও না। কী হবে! মা তো বলেই বসবে, “লিখে কি আর তোমার পেট ভরবে? মন দিয়ে পড়াশোনা করো। ভালো নম্বরে ভালো চাকরি। এখন এসব শখ ছাড়ো। লিখে পেট ভরবে না।’

মা একেবারে মিছে অবশ্য বলে না। ঠিকই, রোজগার তো করতেই হবে নইলে উদরপূর্তি হবে কী করে? সবাই কেবল উদরপূর্তির কথাই ভাবে। মনের ফুর্তির কথা কেউ ভাবে না। একজন লেখকই জানে লিখে তার কতটা মনের ফুর্তি হয়। সেটির কি কোনও দাম নেই! ঠিকই, লেখক-এর যেন কোনও পাত্তাই নেই! এক একটি লেখার পিছনে এত এত পরিশ্রম থাকে অথচ কারও হুঁশ নেই, সবার-ই টাকার চিন্তা। কত পেলে? যখন শোনে খুবই সামান্য কিংবা কিছুই হয়তো পায় না, তখন বলতে তাদের মুখে এতটুকু বাধে না— তবে তো এ সবই ভুতের বেগার খাটা, নাই কাজ তো খই ভাজ। লেখা যেন সহজলভ্য জল-ভাতের মতো হয়ে দাঁড়ায়।

আজ মনে অনেক উথাল-পাথাল হচ্ছে। ভাবছে লেখাটা ছেড়েই দেবে। কিন্তু ছেড়ে দিতে চাইলেই কি আর ছেড়ে দেওয়া যায়? এ তো দমকা হওয়ার মতো মনের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছুটে আসে। কেউ কি আটকাতে পারে নাকি আটকানো যায়? না আটকানো উচিত? জোর করে বন্ধ করা মানে, লেখক সত্তাকে গলা টিপে হত্যা করা। একটি সুস্থ মানুষের সুচিন্তিত সুস্থ ভাবুক মন পঙ্গু করে দেওয়া।

সারাটা দিন বড়ো ম্যাড়মেড়ে কাটল। সন্ধের আগে একটু বেরোল দিতি। একাই চক্কর কেটে এল খানিকক্ষণ। বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মণিদা আর লিনি পিসির সাথে দেখা হল। কাউকেই ওর লেখার কথা কিছু বলল না। কাকাই-এর কাছ থেকে এত বড়ো আঘাত পাওয়ার পর আর ওর মুখে রা-টি নেই। মন ভেঙে গেছে, বড়ো হতাশ লাগছে। সন্ধের পর ছাদে মাধবীলতার পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। মাধবীলতার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল, একটু হাত বুলিয়ে দিল সোহাগে। আহারে এই মাধবীলতা ওর গল্পে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে, কত ভাবে বর্ণনা করেছে। ওরও কপাল মন্দ। ভেবেছিল মাধবীলতাকে গল্পে বাঁচিয়ে রাখবে, ওর প্রিয় গাছ।

দুই চোখে জল টলটল করছে এমন সময় কান্নার কথা কানে এল। পাশেই কাকাই-এর ঘর। দিতি মোটেই আড়ি পাতেনি, আড়ি পাতা ওর স্বভাব নয়। তবে কথাগুলো স্পষ্ট ওর কানে বাতাসের সাথে ভেসে এল।

কাম্মা বলছে, “কী গো তুমি মেয়েটাকে অমন আঘাত দিলে কেন? সারাদিন মনমরা হয়েছিল? ঠিক যেন চাবুকের বাড়ি মেরেছ। এত আনন্দ নিয়ে এসেছিল! মনটাই খারাপ করিয়ে দিলে।’

—গিন্নি, জানো তো ঘোড়াকে চাবুক মারতে হয়। শুধু চাবুক নয়, যোদ্ধাদের পায়ের জুতোর সামনে লোহার একটা ভোঁতা পেরেক থাকে। দরকারে ওটা দিয়ে মারে।

—সেই তো! কেন যে এত নিষ্ঠুরতা!

—গিন্নি, ঘোড়াকে যত চাবুক মারবে, যত আঘাত করবে, তত ছুটবে। তত সে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোবে এবং পৌঁছোতে পারে। নইলে ঘোড়া বিন্দাস হাওয়া খেতে খেতে এলোমেলো ঘুরতে থাকে।

—তার সাথে এর কী সম্পর্ক?

—আরে বাবা তুমি উকিলের বউ হয়েও কিছুই বুঝলে না। এখনই যদি দিতি-কে অনেক বাহবা দিই, “দারুণ’, ‘দারুণ’ বলি, ওর লেখার মান একই জায়গায় থেমে থাকবে। ও বেশি দূর এগোতে পারবে না। ও অতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকবে।

—তাই বলে…!

—হ্যাঁ, তাই এমন আঘাত দিলাম। দেখবে ওর জেদ আরও বাড়বে, এই আঘাতই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তুমি কী ভেবেছ? গতকাল রাতেই আমি পত্রিকাটি কিনে এনে বারে বারে পড়েছি। চমৎকার লিখেছে আমার দিতি। যেমন শব্দ চয়ন, তেমনই সহজ সরল, তেমনই আবেগ। দারুণ দারুণ দারুণ, অফিসে সবাইকে দেখালাম। গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছে। ওর গল্পগুলো যেন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সহজ সরল মিষ্টি গল্প।

—কিন্তু ও কি বুঝবে! দিতি কিন্তু ভারী অভিমানী। পরে যদি সেই অভিমানটাই মনে ধরে বসে থাকে!

—আরে দাঁড়াও না, দু’দিন দেখি। পরে ঠিক আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না। দিতি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।

মাধবীলতার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিতির হঠাৎ আকাশ সমান আনন্দ হল। মনটা ভালো হয়ে গেল। উফ দারুণ খুশি। মাধবীলতাকে আরেকবার ছুঁয়ে নিল। ছুটে নিজের ঘরে পা বাড়াতেই, উহ মাগো। ওর লম্বা একগুচ্ছ কালো চুল মাধবীলতায় পেঁচিয়ে গেছে। দিতির লেখক মন বুঝে নিল মাধবীলতাও মনের আনন্দে ওকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কোনওরকমে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এল। উত্তেজনায় থরথর! কী করবে! কাকাই-কে আজ আরেকবার নতুন করে জানল, নতুন করে চিনল, আরও যেন শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

টেবিলের ড্রয়ারের ফাঁক দিয়ে কলমটা উঁকি দিচ্ছে, ওর প্রিয় অস্ত্র। হাতে চেপে ধরল, কলমটায় চুমু খেল। লিখবে ও আবার লিখবে, অনেক অনেক লিখবে। নিজের মনকে উজাড় করে দেবে। ভরে উঠবে সাদা কাগজ একের পর এক। কিন্তু কী লিখবে! আচ্ছা আজকের এই হাসি-কান্না ভরা খুশির দিনটাই না হয় লেখা যাক, মিষ্টি একটা গল্প হবে।

পাত্রপক্ষ

পিসিমা হাই সুগারের রুগি, তাই মিষ্টি খাওয়া একেবারে মানা। এটা শুনে পাত্রীর বাবা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হরি ময়রার দোকানের বিখ্যাত হিংয়ের কচুরী নিয়ে এলেন। লোভে পড়ে পিসিমার দ্বারা গোটা পাঁচেক কচুরী সাবাড়। আর তারপরই শুরু হল পিসিমার পেটে মোচড় দেওয়া। সে ভয়ংকর মোচড়, কোনও বাধা মানতে চায় না। পিসিমা প্রমাদ গুনলেন।

পিঠ সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের বাথরুমটা কোথায় দেখান। আর একটা গামছা দেন আমারে।” পিসিমার ভাইঝি অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পিসিমার এই কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরে যায় আর কী। এরপর ওই বিবাহের প্রস্তাবের গাড়ি সে যে কারণেই হোক বেশি দূর এগোয়নি। শ্যালিকাও পিসিমার সাথে আর কোনও পাত্রী দেখতে যায়নি।

আমার এক খুড়শ্বশুর ভীষণ রসিক মানুষ। এবার শোনাই ওনার মুখে শোনা গল্প। আগেকার দিনে কিছু ছেলে থাকত ভীষণ লাজুক। বাবা মাকে বলত, ‘মেয়ে তোমরাই দেখে পছন্দ করো। আমার যাওয়ার দরকার নেই।”

জলপাইগুড়িতে এরকমই একটি ছেলে আমার খুড়শ্বশুরের বন্ধু, তার সম্বন্ধ এল জলপাইগুড়ির এক বিত্তশালী পরিবার থেকে। ছেলেটি দিল্লিতে চাকরি করে। বাড়িতে আসবে বিয়ের আগে। বাবা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে প্রচুর ধারদেনা করেছেন। দেনা তখনও সব মিটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেলে এসে বিয়ের আগে বন্ধুদের আড্ডাতে পৌঁছল। বন্ধুদের মধ্যে ফিসফিসানি! এক বন্ধু বলেই ফেলল, “হ্যাঁ রে তুই মেয়ে দেখেছিস!”

ছেলে বলল, “ওসব বাবা-মা সেরেছেন। ওনাদের পছন্দ ই আমার পছন্দ।”

এরপর ছেলে বহুবন্ধু পরিবৃত হয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় উপস্থিত হল। কনে এল পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে জামাইবাবুদের ধরা পিঁড়িতে চড়ে। ঘনিয়ে এল শুভদৃষ্টির সময়। মুখের সামনে থেকে হাতের পান সরল। ছেলে অতি আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের পরই আমার খুড়শ্বশুরের কাঁধে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারাল।

কনের সামনের দিকের তিনটি দাঁত বিসদৃশ ভাবে উঁচু হয়ে ছিল। তখনকার দিনে উঁচু দাঁত নীচু করে স্বাভাবিক করার চিকিৎসা আসেনি। সব শোনার পর খুড়শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর।ত

উনি বললেন, ‘তারপর আর কী! জ্ঞান ফিরতে ওই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ের বাবার থেকে অনেক টাকা পণ নিয়েছিলেন ছেলের বাবা। ধমকে ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর!’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তারপর আর কী, তিনটে বাচ্চা হল। সব ঠিক হয়ে গেল।”

এর বেশি আর ‘তারপর শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করা যায় না। তার উপর রসিকবাচন পারদর্শী শ্বশুরমশাই।

এক আত্মীয়র আন্দামানে মারাঠি মেয়ের সাথে প্রেম হয়। মেয়েটি বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ভালোরকম শিখে ফেলে। এতে অবশ্য তার বাঙালি প্রেমিকেরও অবদান ছিল। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে এসে মেয়েটির ভবিষ্যতের নন্দাই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘গুঁতোর মানে জানেন’

স্মার্ট উত্তর দেয়, ‘একটু এদিকে আসলেই বুঝিয়ে দিতে পারব।’

নন্দাইমশাই উত্তর দেন, ‘যাওয়ার দরকার নেই, বুঝেছি বাংলা শেখা অনেক দূর এগিয়েছে।”

মেয়ে দেখতে আসার আগে কমজোর মেয়েদের আগে ভালো করে ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রথম সতর্কবাণী, বেশি কথা বলবে না। দ্বিতীয় সতর্কবাণী, আজ অন্তত লাজুক ভাবে বসে থাকবে। তৃতীয় সতর্কবাণী, গুরুজন সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি কোনও একটি মেয়েকে পছন্দ হওয়ার পর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কারণ বেরনোর সময় মেয়েটির কথায় নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ হওয়াতে।

মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিল, ‘এখানে সম্বন্ধ পাকা না হলেও আপনারা আবার আসবেন।’ কথাটা খারাপ কিছুই বলেনি, লোকজন খারাপ ভাবে নিয়ে নেয়।

আর আরেক জায়গায় পাত্রী অতিরিক্ত মাথা নীচু করে প্রণাম করতে করতে পাত্রপক্ষের সাথে বসে থাকা নিজের ছোটো বোনকেও প্রণাম করে ফেলেছিল।

আমার এক পরিচিতা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসবে না বলে জেদ করে কোনও মেক-আপ ছাড়াই, হাওয়াই চটি পরে, গায়ে কালো শাল জড়িয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিমাতে পাত্রপক্ষের সামনে এসে বসে। সেই পরিচিতা যথেষ্ট সুন্দরী এবং ভালো মনের মেয়ে ছিল। জহুরির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। পাত্র বাবা-মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই মেয়েকে ওখানেই পছন্দ করে জানিয়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়িতে পুরো পরিবারের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে মেয়েটি।

আগেকার দিনে মেয়ে গান গাইতে জানে কিনা সেটা সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করা হতো। একটু আধটু গান গাইতে জানলেই চলত। মোটা মেয়ে হলে গান ধরত— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে… আর তারপর আমার এই দেহ খানি তুলে ধর…।

আর কালো মেয়ে গাইত আপনারা ভাবছেন— কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, মোটেই না। আগ বাড়িয়ে নিজের উইক পয়েন্টের ঢাক কেউ পেটায় নাকি?

একটু বিনয়ী কালো মেয়েরা গাইত— তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। অর্থাৎ আমি যেরকমই দেখতে হই না কেন, তুমি তোমার অন্তরের মহানুভবতা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

আবার একটু উদ্ধত কালো মেয়েরা গাইত — আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খোলাব না, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।

শেষ করি একটি মিষ্টি প্রেমের মিষ্টি পরিণতি দিয়ে। একই পাড়াতে থাকত একটি সুদর্শন ছেলে এবং অতি সুন্দরী একটি মেয়ে। দুজনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত। আসতে যেতে একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে পারত না। দু’জনে সমবয়সি ছিল। ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেয়েটিকে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটির সম্বন্ধ দেখে দিল্লিতে বিয়ে হয়ে গেল।

এরপর কর্মসূত্রে ছেলেটিও দিল্লি চলে যায়। সংসার হয় এবং পাকাপাকি ভাবে দিল্লিবাসী হয়ে যায়। এর অনেক দিন পর নিজের বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে দিল্লিতে সেই মেয়েটির বাড়িতেই পৌঁছোয় ছেলেটি পাত্রর বাবা হয়ে। আর পাত্রী ছিল অল্প বয়সের প্রেম নিবেদন করতে না পারা সেই মেয়েটিরই কন্যা। এক দেখাতেই বিয়ে পাকা।

সবার আগে লাফিয়ে পড়ে ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ হওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিল। দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে গেল নিজেদের পূর্ব পরিচয়ের ঠিকানা। আইনি জীবনসঙ্গী হিসেবে জীবনে পাওয়ার প্রাপ্তি অপূর্ণ থাকলেও, ‘বেয়াইন’ হিসেবে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রাপ্তির মূল্য কম কীসে?

সম্বন্ধ বিভ্রাট

আজকাল ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে মানুষ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। যারা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছে, সেই ছেলেমেয়েদের গল্প এখানে নয়। এখানে তাদের নিয়ে গল্প যারা সুবোধ ছেলে বা মেয়েটির মতো পাত্রী বা পাত্র নির্বাচনের দায় বাবা-মার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

সম্বন্ধ আনা এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়া কাজটি বড়োই কঠিন। সফল হলেও একটা কিন্তু লোক লাগিয়েই দেবে। আর বিফল হলে তার গুষ্টির তুষ্টি একদিন দু’দিন নয়, দীর্ঘদিন চলবে। আজকাল এই কাজটা কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা হাতে নিয়েছে। তাতে হতাশ হয়ে ফিরে আসার লাইন অবশ্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আগেকার দিনে ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে পাত্রের বাড়ির থেকে দল বেঁধে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ছিল এক সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব। মনে যাই থাকুক না কেন ভাবটা থাকত- – মশাই আপনার ঘাড়ের বোঝা কমাতে এলাম, নির্ভর করছে আপনার কৃতকর্মের উপর। তাতে ছেলের বাবা-মা ছাড়া থাকত পরিবারের বা বন্ধুবর্গের মধ্যের একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তি।

গুষ্টিশুদ্ধ নিয়ে এসেও নীতিবাগীশ পাত্রপক্ষের বয়ঃজ্যেষ্ঠর কড়া নির্দেশ আসত— কন্যা পছন্দ না হলে সেই বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা অনুচিত হবে। কিন্তু এটা ভুলে যেত পাড়ার মিষ্টির দোকানদার, মিষ্টি আর ফেরত নেবে না। সব ক্ষেত্রে এই আদেশ অবশ্য কার্যকারী হতো না। বিশেষ করে খাদ্যরসিক পেটমোটা পিসেমশাই যদি থাকতেন।

মেয়ে পাত্রপক্ষের পছন্দ হলে, সবচেয়ে আগে বদলে যেত পাত্রীর বাবার শারীরিক ভঙ্গিভাবটা, খুব সস্তায় ভালো মাল ছেড়ে দেওয়া ব্যাপারীর মতন।

আমার মা যেচে পড়ে অনেক সমাজসেবা করতেন। প্রায়ই আবেগমথিত হয়ে পরোপকারিকতার ভূত মাথায় চাগাড় দিত। পাড়ার এক অতি ফোঁড়ে লোক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে যেতেন, আর তার খেসারত দিতেন ওনার স্ত্রী। বেচারিকে প্রচুর টিউশন পড়িয়ে কোনওমতে সংসারের হাল ধরতে হতো। ঘরে চার চারটি অবিবাহিত মেয়ে। খুব নিরীহ এক পুরোহিতমশাই আসেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য বড়ো মেয়েটিকে নির্বাচন করতে। সমাজসেবার অঙ্গ হিসেবে আমার মা সম্বন্ধটা এনেছিলেন।

মাড়োয়ারিদের বাড়িতে জজমানি করে পুরোহিতমশাই ভালোই উপার্জন করেন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের সাদামাটা পাকা বাড়িতে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। পত্নি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। ছেলেকে কাপড়ের দোকান খুলে দিয়েছেন বেহালা চৌরাস্তায়। মেয়েটি ক্লাস সিক্সের বেড়াও ডিঙোতে পারেনি। দেখতেও সাদামাটা, তবে মনটা খুব ভালো। এর আগে অনেক সম্বন্ধ এসেছে ও গেছে। এহেন পাত্রীকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করার পর পুরোহিতমশাই যারপরনাই বিপদের সামনে পড়লেন।

পাত্রীর বাবা হঠাৎ করে তাঁকে ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেন। বেচারা পুরোহিত তখন সবে পাত্রী নির্বাচন করে রসগোল্লার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। রসগোল্লা হাতে নিয়ে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাত্রীর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আপনি কী কন বুঝি না আমি।’ আমার মাতৃদেবী দেখলেন হাতে পাওয়া সাফল্য ছিটকে গেল বলে! সাকসেস রেট নীচে চলে যাবে… ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি সামলে দিয়ে ডিল পাকা করলেন।

আমার এক পিসি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ছেলের উপর রাগ করে উঠে এসেছিলেন এই বলে, “তুই এক কাজ কর একটা বরমালা এনে এখনই পরিয়ে দে, আমি চললাম।’

ভাইটি খুব অল্প বয়সে চাকরি নিয়ে বাইরে যায়, হাত পুড়িয়ে খায়। বেচারার আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল না। না পারত সন্ধ্যাবেলার পার্টিতে বসতে। চাকরি পাওয়ার আট বছর বাদে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। ভাইটির মা দু’বছর ধরে ছত্রিশটি পাত্রী দেখেছেন, আর সব ক’টা না করার অকাট্য যুক্তি দিয়ে সম্বন্ধ বানচাল করেছেন।

এই প্রথম ভাইটি নিজে গেছিল দেখতে। পাত্রী দেখতে ভালো, বাড়িঘর ভালো, পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আট মাস বাদে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। আর এইখানেতেই বাঁধল মুশকিল।

মা বললেন, ‘পরীক্ষাটা দিয়ে পাস করে নিক, তারপরে পাকা কথা হবে।’ ছেলে দেখল সমূহ বিপদ, আবার একটা অজুহাত মা পেয়ে গেছে।

ছেলের মাসি মেয়ে দেখতে এসে ছেলেকে আড়ালে ডেকে বলেছিলেন, “শোনো বাবু, যদি সারাজীবন ব্যাচেলর না থাকতে চাও, নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিও।’

বাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘পরীক্ষা হতে এখন অনেক দেরি। বিয়ের পর অনেক সময় পাবে।’ ব্যস, এতেই আগুনে ঘি পড়ল।

—আমি থাকতে এত বড়ো কথা। তোর বিয়ে তুই কর, বলে আমার পিসি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। বিয়ে সেই পাত্রীর সাথেই হয়েছিল এবং একমাসের মধ্যে। ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন।

এবার শোনাই আমার এক মাসতুতো শ্যালিকার মুখ থেকে শোনা গল্প। মাসতুতো শ্যালিকার ছিল এক বিধবা পিসিমা। পিসিমা এক ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন। জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা একাই সামলে ছেলেকে মানুষ করেন। ছেলে বিখ্যাত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। যাদবপুরে কচুরিপানা ভর্তি জমি রাত জেগে জবরদখল করে তার উপর বাড়ি তুলেছেন পিসিমা। সেই জায়গা এখন উঠতি বনেদি পাড়া, আর সেই টালির চালের বাড়ি এখন তিন তলা আলিশান অট্টালিকা। পিসিমা কর্পোরেশন স্কুলে চাকরি করেন। এইমত অবস্থায় উপযুক্ত পাত্রর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন পিসিমা।

পিসিমার আপন বলতে দাদা, বউদি আর ভাইঝি। যেখানেই পিসিমা পাত্রী দেখতে যান, সাথে যান দাদা, বউদি ও ভাইঝি। জীবন যুদ্ধে প্রচুর লড়াই করে পিসিমার রসবোধ কমে কথাবার্তায় বেপরোয়া ভাব এসে গেছিল। মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়ে পছন্দও হয়েছে। ঠিক হল এবার ছেলে এসে দেখলেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।

একটা ঘরে ফেরার গল্প (শেষ পর্ব)

শেষ পর্ব

অর্জুন কে চুপ হয়ে যেতে সাঞ্ঝা আবার প্রশ্ন করল, ‘কেন স্কুল থেকে পালালে?’

—যার বাপ-মা নেই, সে তো অনাথ। অনাথের আবার ঘর কীসের! পরিবার কীসের! বাপ-মায়ের পদবি, নিজের নাম থেকে মুছে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোলাম এই হাওড়া স্টেশনে। সাথে ছিল আমার স্কুলের বইপত্র ভর্তি একটা স্কুলব্যাগ। রাতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে একা একা বসে, সেই বইগুলো পড়তাম। খিধে পেলে এর ওর কাছ থেকে খাবার চাইতাম। কেউ কেউ কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। কেউ আবার দয়া পরবেশ হয়ে আধ-খাওয়া খাবার ছুড়ে দিত। ধীরে ধীরে রেল পুলিশ থেকে শুরু করে, অনেক নিত্যযাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের নজরে পড়লাম আমি। আসা যাওয়ার পথে, তাদের অনেকেই যেচে এসে আমার সাথে কথা বলতেন। পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দিয়ে, বড়ো হয়ে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিতেন তাঁরা। এইরকমই একজনের অনুপ্রেরণায়, উদ্যোগে ন্যাশনাল ওপেন স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। মাঝেমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কোনও গণ্ডগোল হলে, পুলিশের তাড়া খেয়ে, কলকাতার দিকে পালিয়ে যেতাম। তখন কোনওদিন ধর্মতলায় মেট্রো-সিনেমার নীচে, কোনওদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটাতাম। এইরকম ভাবে চলতে চলতে একদিন মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে গেলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। বড়ো এক সরকারি অফিসারের পরামর্শে কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের চাকরির পরীক্ষায় বসলাম। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কলকাতার এক অফিসে অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হলাম। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে মন চায়নি কোনওদিন। গত তিন বছর ধরে, এদেরকে নিয়েই আছি এইখানে। আমাকে নিয়ে মোট একুশজনের বাস এখানে। তুমি থাকতে চাইলে, আমরা বাইশজন হব…!

ওর পোষ্যদের সারাদিনের দায়িত্ব শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝা’র উপরে চাপিয়ে দিয়ে, এর পরে আরও বছর তিনেক বেশ নিশ্চিন্তে কলকাতায় তার অফিস-কাছারির কাজ সামাল দিয়েছে অর্জুন। রোজ সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে ফিরে এসে হ্যাজাক জ্বেলে পোষ্যদের নিয়ে যথারীতি রাতস্কুল চালিয়েছে সে। ইত্যবসরে শ্রাবণী যেমন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, সাঞ্ঝাও মুক্ত-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছে। বিল্টু আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। কিন্তু অর্জুনের মাথায় ঘুরছে, আরও অনেক বড়ো পরিকল্পনা। গত এক বছরে অফিসের বড়ো কর্তাদের কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছে সে— রাঁচি শহরে তার ‘বদলি’ প্রার্থনা করে।

নতুন বছরের শুরু থেকেই শ্রাবণী, সাঞ্ঝা ও অর্জুন— তিনজনের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে; বিল্টুকে দিয়ে যে করেই হোক মাধ্যমিকে ভালো ফল করাতেই হবে। সেই দিনটা ছিল, বিল্টুর মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। বিল্টুকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে, অর্জুন অফিসে ঢুকতেই, বড়োকর্তা অর্জুনের হাতে ওর বহু-প্রার্থিত ‘রাঁচি-বদলির’ অর্ডারটা ধরিয়ে দিলেন।

অগত্যা রাঁচি যাওয়ার আগে, শ্রাবণী, বিল্টু আর সাঞ্ঝার উপর তার পোষ্যদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, অর্জুন ওদেরকে জানাল, ‘সামনে আমাদের অনেক বড়ো দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এখন সবার আগে আমাকে রাঁচিতে গিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। তারপরে আমার সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ করতে পারলেই, এখানে ফিরে এসে তোদের সবাইকে নিয়ে রাঁচি চলে যাব। ততদিন তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই রাত-স্কুল চালানোর সব দায়িত্ব তোদের উপরেই রইল।”

এর প্রায় বছর খানেক বাদে, একদিন ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পার মন্দিরে ছিন্নমস্তা দর্শন সেরে, অর্জুনের কলকাতা অফিসের প্রাক্তন বড়োকর্তা অম্বরীশবাবু ট্রেকারে করে, রামগড় সদর মোড়ে এসে নামলেন। সেখান থেকে ট্রেকার পালটে রাঁচি যেতে হবে। ট্রেকার স্ট্যান্ডে পৌঁছে, রাঁচি যাওয়ার একটা ট্রেকারে উঠে বসতেই, অম্বরীশবাবুর সাথে অর্জুনের দেখা হয়ে গেল।

অর্জুনই প্রথমে কথা বলল, ‘স্যার, আপনি এখানে?’

—এই তো কাল এসেছি এখানে। রাজরাপ্পা গিয়েছিলাম; ছিন্নমস্তা দর্শনে। আজ রাতেই রাঁচি থেকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ? তোমার তো এখন রাঁচিতে থাকার কথা, অম্বরীশবাবু জানতে চাইলেন অর্জুনের কাছে। অর্জুন এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, তার পাশে বসা দুই মহিলার সাথে অম্বরীশবাবু’র পরিচয় করিয়ে দিল।

—এদের কথা আপনাকে আমি আগে অনেকবার বলেছি; আজ এদের সাথে দেখা হয়ে গেল আপনার। এর নাম শ্রাবণী, আর এ হচ্ছে সেই সাঞ্ঝা। আপনি তো জানেন, ও ভুটকি গ্রামের মেয়ে। সেই ভুটকি গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে, সেখানে মেয়েদের একটা স্কুল চালু করেছি। সেটা এখন সাঞ্ঝাই চালায়। আশপাশের গ্রাম থেকে আপাতত জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে সকলের। সাঞ্ঝাকে ফিরে পেয়ে, শুধু ওর পরিবার নয়, গোটা মহকুমার মানুষ উল্লসিত, গর্বিত। বিডিও, মহকুমা শাসক থেকে শুরু করে জেলা শাসক পর্যন্ত, সকলেই সাঞ্ঝার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে, ওর এই কৃতিত্বকে সাধুবাদ জানিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

অর্জুনের কথা শুনে অম্বরীশবাবু’র চোখেমুখে খুশির ঝলক। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “বাঃ! এ তো দারুণ খবর! তবে এ তো গেল সাঞ্ঝার কথা। শ্রাবণী কী করছে এখন?”

—এই রামগড়ে আপাতত একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, অনাথ শিশুদের সেখানে রেখে, তাদের পড়াশোনার একটা বন্দোবস্ত করেছি। তবে আমি আমার অফিস সামলে, ওদের দেখাশোনা করার জন্য কতটুকুই বা আর সময় পাই! অনাথ আশ্রমের সবটা শ্রাবণী’ই দেখাশোনা করে।

—আর তোমার হাওড়া স্টেশনের পোষ্যদের কী খবর? তাদেরকে তুমি রামগড়ে নিয়ে এসেছ না-কি!

—না, না! ওরা ওদের জায়গাতেই আছে। প্রতি শনি-রবিবার দুটো দিন হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পোষ্যদের কাছে ছুটতে হয় আমাকে। সারা সপ্তাহ ধরে বিল্টুই ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলায়। তবে সম্প্রতি ও আবার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে সে। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে, ওদের সবাইকে রামগড়েই নিয়ে আসার কথা ভাবছি। কিন্তু এতজনকে রাখতে গেলে, নিজেদের একটা বড়ো বাড়ি হলে ভালো হয়।

কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অর্জুন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসে সে, ‘এই দেখুন, কথা বলতে বলতে আসল লোকের সাথেই তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছি। এ হচ্ছে, আমাদের সেই শান্তা। ও এখন এখানকার স্থানীয় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি’তে পড়ছে। এই রামগড়ের আশ্রমে, শ্রাবণীর হেফাজতেই থাকে ও। শান্তা এখনও একই রকমের শান্ত। তবে ও শুধু আমাকে জানিয়েছে যে, ও বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ শান্তাকে আদর করতে করতে অম্বরীশবাবুর সঙ্গে শান্তারও পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলল না অর্জুন।

সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে, অম্বরীশবাবু অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন, “কিন্তু এই ছুটির দিনের সকালে, এমন সদলবলে তুমি কি হাওড়ায় চললে না-কি?’

না, না, এই সপ্তাহে আমার আর হাওড়া যাওয়া হচ্ছে না। তবে আমার বদলে এই সপ্তাহে শ্রাবণী হাওড়া যাচ্ছে আজ। দু’দিন থেকে, পরশু দিন ফিরে আসবে ও।

অর্জুন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, অম্বরীশবাবু ফিরে জানতে চাইলেন, “তাহলে তুমি চললে কোথায়!”

—সম্প্রতি দাদু’র সাথে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সূত্রেই জানলাম, ইদানীং দাদুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দাদুকে আমার বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা সব জানিয়েছি!

—সব! অম্বরীশবাবু’র গলায় এবার অন্য রকমের সুর!

—হ্যাঁ, সব! তাই দাদুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন বাদে আজই প্রথম ঘরে ফিরতে চলেছি আমি। অম্বরীশ চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলতে বলতে মুচকি হেসে এবার সাঞ্ঝার দিকে একবার তাকাল অর্জুন!

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৬ পর্ব)

৬ পর্ব

তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে, অর্জুনের ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স’-এর কোনও হদিশ করতে পারল’ না নিখিল। প্ল্যাটফর্মের দোকানদার থেকে শুরু করে, রেলের বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অর্জুনের খোঁজ করার পরে, সবার কাছ থেকে একই কথা জানতে পারল নিখিল, ‘অর্জুন সরকারি চাকরি করে। কলকাতায় ওর অফিস। সারাদিন সেখানকার কাজকর্ম সেরে, সন্ধ্যার পরে তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে অর্জুন। ওখানেই রাতে ওর পোষ্যরা আসবে, ওদের অর্জুন স্যারের কাছে পড়াশোনা করতে। তারপরে পড়াশোনা শেষ হলে, পোষ্যদের খাইয়ে দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, ওই স্টেশন চত্বরেই যেদিন যেখানে মর্জি, সেখানে বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেয় অর্জুন।”

পরদিন সকালে নিখিল অফিসে পৌঁছে, বড়োকর্তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। গতকাল সন্ধ্যায় সংগ্রহ করা, অর্জুন স্যার সংক্রান্ত সবিশেষ তথ্য বড়োকর্তাকে জানাতে জানাতে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল নিখিল। ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড-রেসিডেন্স বলে কোথাও কোনও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই স্যার। তবে আপনার ফাইলে যা তথ্য রয়েছে, তার কোনওটাই অসত্য নয়। কোনও অনাথ ছেলে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে জীবন কাটিয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি করে, সরকারি অফিসের অফিসার হতে পারেন, তা আমাদের অর্জুন-স্যারকে না দেখলে কোনওদিন বিশ্বাসই করতে পারতাম না। শুধু তাই নয়; সারাদিন এই অফিসে এইভাবে নিজেকে উজাড় করে পরিশ্রম করার পরে, রাতে আবার ওই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে গিয়ে, বহু অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসান। তারপরে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথেই প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে, পরদিন আবার যে-কেউ এইভাবে অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারে; তা অর্জুন স্যারকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। অর্জুন স্যার আমাদের ভগবান!” দু’-হাত কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে অম্বরীশ চ্যাটার্জীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিখিল।

ওদিকে পরপর পাঁচদিন অফিস কামাই হওয়ার পরে, নিখিল যেদিন অর্জুনের খোঁজে হাওড়া স্টেশনে এসেছিল, সেদিনই সকালে শ্রাবণীকে সঙ্গে নিয়ে, এস আই জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন গিয়েছিল হাসপাতালেই। সাঞ্ঝাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে, সন্ধ্যার পরে যথারীতি হাওড়া স্টেশনের তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সাঞ্ঝাকে নিয়ে ফিরে এল অর্জুন। হাওড়া স্টেশন চত্বরে পা রাখতেই, রেল পুলিশের লোকজন, প্ল্যাটফর্মের স্টলমালিকরা থেকে শুরু করে, তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওর পোষ্যরা সকলেই এসে অর্জুনকে জানাল, ‘আজ তোমার অফিস থেকে তোমার খোঁজে একজন লোক এসেছিলেন। তোমার বাড়ি, ঘরদোর সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন তিনি।’

একথা শোনার পরে অর্জুনের কাছে সাঞ্ঝা জানতে চাইল, ‘আপনার ঘর এখান থেকে কতদূর?”

সাঞ্ঝার কথায় মুচকি হেসে অর্জুন জানাল, ‘এই তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া গোডাউনের পাঁচিল ঘেঁষেই আমাদের সবার ঘরবাড়ি। আমাদের সবার মানে, আমাদের এই ক’জন অনাথের।’

—কিন্তু সবাই যে বলছে, আপনি অফিসে চাকরি করেন! তাহলে কাছাকাছি কোথাও আপনার বাড়িঘর আছে নিশ্চয়ই।

—সে ছিল একসময়। রাঁচি স্টেশনের দক্ষিণদিকের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। আমরা মানে মা-বাবা, দাদু ও ঠাকুমা। আমার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার। দিল্লির একটা নামকরা হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে রাঁচি আসতেন। হঠাৎ করে কী একটা গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে গেলেন তিনি।

—তারপর… অর্জুন কথা বলতে বলতে একটু থামতেই, ফিরে জানতে চাইল সাঞ্ঝা।

—তারপর আর কী! আমার মা ছিলেন রাঁচির একটা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা। মা যে স্কুলে পড়াতেন, আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, মা নেই। বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দাদুকে একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। এর পরে আমার সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়ল দাদুর উপরে। দাদু আমাকে রোজ স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতেন।

অর্জুন বলতে লাগল, ‘স্কুলে গেলেই সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষিকারা সবাই আমার কাছে আমার মা-বাবা’র সম্বন্ধে জানতে চাইত। দিনের পর দিন সেটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগতে লাগল। একদিন স্কুল থেকে আমিও পালালাম!’

ক্রমশ…

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৫ পর্ব)

জঙ্গল থেকে ঘাস-পাতা সংগ্রহ করে, ওই ঘরের মেঝেতে পেতে তার উপরে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হয়। গ্রামের প্রান্তের ওই স্থান চারিদিক থেকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সারারাত ভয়ে-যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকতে হয়, একেকটা দশ-এগারো বছরের শিশুকন্যাকে। ওই পাঁচ-ছ’টা দিন ওদেরকে এতই অস্পৃশ্য মনে করে সবাই যে, পরিবারের কোনও লোক, কোনও খোঁজ নিতেও আসে না তাদের। ওই জঙ্গলঘেঁষা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই ঘরের ধারেকাছে কোথাও কোনও জলের সংস্থানও নেই। নিজেকে ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করার কোনও উপায় পর্যন্ত নেই। ওদের গ্রামের মেয়েরা অনেকে ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণেই মারা যায় সেখানে।

ওর মা-ঠাকুমাকেও ছোটো থেকে দেখেছে সাঞ্ঝা— প্রতিমাসে ওই পাঁচ-ছ’টা দিন বাড়ি ছেড়ে, ছোটো বাচ্চাদের ঘরে ফেলে রেখে, গ্রামের প্রান্তের ওই ঘরে দিন কাটাতে চলে যেতে। বছর তিনেক আগে সাঞ্ঝা’র মাকে এইরকমই একরাতে ভাল্লুকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে মায়ের সাথে আর কোনওদিন দেখা হয়নি সাঞ্ঝার।

সাঞ্ঝার বাবা ঝরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করে। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা আর কোনওদিন বাড়িতে ফেরেনি। দাদু-ঠাকুমার কাছে মানুষ হচ্ছিল সাঞ্ঝা। পড়াশোনা করার জন্য ওদের তুটকি গ্রাম থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের মাঞ্চুগঞ্জের স্কুলে বছরের পর বছর আসা যাওয়া করে, দশ ক্লাস পাশ করে, এগারো ক্লাস পেরিয়ে বারো ক্লাসে উঠেছে সাঞ্ঝা। তাই সাঞ্ঝা ভাবে, অন্যায় অবিচারে ভরা এই সামাজিক কু-প্রথাকে যদি মেনে নিতে হয়, তাহলে আর পড়াশোনা করে আমার লাভটা কী! এই গ্রাম ছেড়ে, জেলা ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালাতে না পারলে, আমার অবস্থাও একদিন আমার মায়ের মতনই হবে।

পাঁচদিনের প্রথম দিনটা এইসব ভাবতে ভাবতে অতিবাহিত হয়ে যায়। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাউকোর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সাঞ্ঝা। বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, সাঞ্ঝা এসে পৌঁছোয় গোধিয়ার সতেরো মাইল বাসরাস্তার উপরে। একটা কয়লা বোঝাই লরিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায় সাঞ্ঝা। লরি থেকে একটা লোক নেমে এসে, ও কোথায় যেতে চায়, জানতে চাইলে তাকে ওই অঞ্চল ছেড়ে ওর পালানোর ইচ্ছার কথা, কারণ সহ সবিশেষে জানানোর পরেই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সাঞ্জা জ্ঞান হারায়। মাঝরাতে সাঞ্ঝা নিজেকে আবিষ্কার করে, একটা চলন্ত ট্রেনের টয়লেটের মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর সাঞ্ঝা আর কিছু জানাতে পারে না অর্জুনকে!

পরপর ক’দিন এই ভাবে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আর হাসপাতালে যাতায়াতের ফলে, অফিসমুখো আর হতে পারেনি অর্জুন। আজ প্রায় বছর চারেক হল, ডালহৌসি পাড়ার কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের এক দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে অর্জুন। ঝড় হোক, জল হোক, হাজার দুর্যোগেও অর্জুনের গরহাজিরা কারও চোখে পড়েনি কোনওদিন। এহেন অর্জুন বিনা কোনও সংবাদে, এইভাবে যে কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারেন না তার অফিস কর্তা অম্বরীশ চ্যাটার্জী।

গত চার-পাঁচদিন ধরে অর্জুনকে যতবারই মোবাইল ফোনে ধরার চেষ্টা করেছেন উনি, ততবারই হয় ‘নো আনসার’, নয় তো জানতে পেরেছেন অর্জুনের ফোনটা রয়েছে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’। অর্জুনের চাকরির নিয়োগপত্র ও জয়েনিং লেটার সম্বলিত ফাইলটা বের করে বারকয়েক চোখ বোলালেন অম্বরীশ। সব জায়গাতেই ওর স্থায়ী ঠিকানা লেখা রয়েছে, ‘প্ল্যাটফর্ম-সাইড রেসিডেন্স, প্ল্যাটফর্ম নম্বর তেইশ, হাওড়া স্টেশন’। নামের জায়গায় লেখা শুধু ‘অর্জুন’; পদবির কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। মা- বাবার নামের পাশে লেখা, ‘নট-অ্যাপ্লিকেবল’; বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘অরফ্যান’। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লেখা রয়েছে, “ইতিহাসে এমএ’।

অম্বরীশবাবু ফাইল থেকে অর্জুনের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে, তা অফিস পিওন নিখিলের হাতে দিয়ে, ওকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, একবার অর্জুনের খোঁজে যেতে বললেন। নিখিল যথারীতি বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। লঞ্চে নদী পেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছোল সে।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৪ পর্ব)

৪ পর্ব

আরও ঘণ্টা-দুয়েক মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরে, অর্জুনরা দেখল, মেয়েটা চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে, খোট্টা ভাষায় অর্জুন মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?” —সাঞ্ঝা, সাঞ্ঝা ওঁরাও!

—ঘর কোথায় তোমার?

—ভুটকি গ্রাম; তহসিল মাণ্ডু; জিলা রামগড়।

—এখানে এসেছ কেন? ট্রেনেই বা চড়েছিলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নের আর কোনও উত্তর দিতে পারল না সাঞ্ঝা। আবার চোখ বুজল সে। এস আই জয়ন্ত ঘোষ এবার রোগীর বেডের পাশের বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অর্জুনকে বলল, “এবার আমাকে ফিরতে হবে অর্জুন। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ফিরে রিপোর্ট করতে হবে অফিসে। তবে এ তো মনে হচ্ছে, তোমার ঝাড়খণ্ডেরই লোক। যেসব জায়গার নাম বলছে ও, তার কিছু কি চিনতে পারলে তুমি?”

এস আই সাহেবের প্রশ্নের জবাবে অর্জুন জানাল, ‘হ্যাঁ, ভুটকি হচ্ছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রামগড় জেলার উত্তর প্রান্তের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাঁচি থেকে পঁচাশি কিলোমিটার, আর রামগড় সদর শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম ‘ভুটকি’। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হচ্ছে মাণ্ডু। তাও প্রায় বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে নিকটবর্তী বাস রাস্তা হচ্ছে একশো নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে অবস্থিত গোধিয়া সতেরো মাইল; ভুটকি থেকে যার দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। ভুটকির উত্তর এবং পশ্চিম দিক হাজারিবাগের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা— সেই প্রত্যন্ত ভুটকি থেকে মেয়েটা রাঁচি এল কী করে! আর সেই সুদূর রাঁচি থেকে এই হাওড়া স্টেশনেই বা ও এল কী উদ্দেশ্যে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অর্জুন আবার জানাল, আপনি এখন ফিরে যান ঘোষদা। আমি আরও একটু থেকে দেখি; যদি কিছু জানতে পারি ওর সম্বন্ধে। তবে ফিরে গিয়ে আপনি যদি একটা কাজ করে দেন, তাহলে খুব ভালো হয়। হাওড়া স্টেশনে ফিরে, আপনার কাজকর্ম সেরে, একটু তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমার পোষ্যগুলোকে বলবেন, হ্যাজাকটা জ্বেলে নিয়ে ওরা যেন পড়তে বসে যায়। সামনেই ওদের পরীক্ষা। কাল ঝড়-বৃষ্টির দরুন পড়াশোনাটা হয়নি ঠিকমতো। আজকে যেন ওরা পড়াশোনাটা শুরু করে দেয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফিরে গিয়ে জানতে চাইব—কে কী পড়ল! আর বিল্টুকে একটু আলাদা করে ডেকে বলে দেবেন, কোনও কারণে আমার ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে ও যেন সবাইকে ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়।”

সন্ধ্যার পরে সাঞ্ঝা চোখ মেললে, ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অর্জুন আবার জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমাকে এখানে এই হাওড়া স্টেশনে কে নিয়ে এসেছে?”

—কেউ না, আমি একাই এসেছি! কিন্তু আমি এখন কোথায়? অর্জুনের কাছে চোখ বুজেই জানতে চায় সাঞ্ঝা।

—তুমি রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছিলে। সেখান থেকে তোমাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি ভুটকি থেকে রাঁচিতেই বা এসেছিলে কেন? আবার ট্রেনে করে হাওড়াতেই বা এলে কেন?

অর্জুনের প্রশ্নে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সাঞ্ঝা। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে দু’-হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে, নিজের বুকফাটা যন্ত্রণার কথা সব উজাড় করে দেয় সে। ওর ভুটকি গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, মনের দরজা খুলে, সব বাইরে বের করে আনে সাঞ্ঝা।

সাঞ্ঝার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার তুটকি গ্রামে। তার পুরো নাম সাঞ্ঝা ওঁরাও। ছোটোবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। স্কুলের এগারো ক্লাস পাশ করে এখন সে বারো ক্লাসে পড়ে। ওদের গ্রামের ছাউপদি প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই ওর ঘর ছাড়া। এটা শুধু ওর গ্রামের প্রথা নয়; এটা গোটা গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডের দুঃসহ এক প্রথা। এই প্রথার শিকার হয়ে, সেই দশ-এগারো বছর বয়স থেকে প্রতিমাসে ঋতুস্রাবকালীন পাঁচ-ছয়দিন ওর গ্রামের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, গ্রামের বাইরে একটা চালা ঘরের মধ্যে গিয়ে থাকতে হয় ওকে। এ যন্ত্রণা শুধু সাঞ্ঝার নয়। ওখানকার আপামর সব মহিলাদের এই প্রথা মেনে চলতে হয়। সেই ঘরের না আছে কোনও দরজা, না আছে কোনও জানলা।

ক্রমশ…

 

একটা ঘরে ফেরার গল্প (৩ পর্ব)

৩ পর্ব

আজ সকালে বেড-রোল গুটিয়ে তেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন টয়লেটের বিপরীত দেয়ালে তালাবন্ধ ঢাউস কাঠের বাক্সটা খুলে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে, টয়লেটের দিকে তাকাতেই অর্জুন বুঝতে পারল, তখনও পর্যন্ত টয়লেট একরকম ফাঁকাই রয়েছে বলা চলে। তার মানে ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা বাজলে কি হবে, এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে পারেনি। প্রাতঃকৃত্য-স্নানাদি সেরে, বাইরে বেরোতেই অর্জুনের চোখে পড়ল — বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস এসে দাঁড়িয়ে আছে। জামা-প্যান্ট-জুতো গলিয়ে, পিঠব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, ধীর পায়ে অর্জুন চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন এস্ক্যালেটরের দিকে পা বাড়াল। তার পুষ্যিগুলোকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, রোজকার মতন টিফিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে, স্কুলমুখো রওনা করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

সারারাত ধরে দুর্যোগ-ক্লিষ্ট, অনিশ্চিত যাত্রার শেষে, ক্লান্ত আচ্ছন্ন শরীরে মালপত্র টানাটানি করে প্যাসেঞ্জাররা সব ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে অর্জুন খেয়াল করল, জিআরপি’র লোকজন ধরাধরি করে কাউকে যেন ওই ট্রেনের সাধারণ কামরা থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে, প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে অনেকে চলার পথে সেদিকে অগ্রসর হয়ে, উকিঝুঁকিও মারছে। অর্জুনও কৌতূহল দমন করতে না পেরে সেদিকেই পা বাড়াল।

ভিড় ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছোতেই, এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে— একটা মেয়ে পাশ ফিরে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জামা-প্যান্ট রক্তে ভেজা; যা দেখে ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ কেউ মন্তব্য করছে, ‘চল চল, পাগলি-টাগলি হবে’। আবার কেউ বলছে, “না না, রেপ কেস! চল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঝামেলা বাড়ানো।’ অর্জুন কাছে গিয়ে, জিআরপি’র একজন এসআই-কে দেখে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে এর?”

—কী যে হয়েছে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সারারাত সাধারণ কামরার টয়লেটের মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল। প্যাসেঞ্জাররা নাকি রাত থেকেই ওকে এইরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে ওই টয়লেটের মধ্যে। ঝামেলা এড়াতে কেউ আর কোনও সাড়াশব্দ করেনি। অনেকে বলছে, রেপ-কেস হতে পারে। কিন্তু জ্ঞান না ফিরলে, কিছুই জানা যাচ্ছে না— জিআরপি’র এসআই জয়ন্ত ঘোষ মেয়েটির রক্তে ভেজা জামা-প্যান্টের দিকে ইঙ্গিত করে, অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

এই স্টেশন চত্বরে রেল পুলিশের সব লোকজনই অর্জুনকে খুব ভালো করে চেনে। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাই এসআই-এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভালো ঠেকছে না। এক্ষুনি একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।’ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই, পাশেই বিল্টুকে দেখতে পেল অর্জুন। বিল্টুর হাতে ওর দলবলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করার জন্য দু’শো টাকা দিয়ে বলল, “তুই সবার টিফিনের বন্দোবস্ত করে, সকলকে স্কুলে পাঠিয়ে দিবি ঠিকমতো। আমি একে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুই চট করে কুলিদের থেকে একটা হ্যান্ড ব্যারো নিয়ে আয়।”

এরপরে এসআই জয়ন্ত ঘোষ আর অর্জুন দু’জনে মিলে মেয়েটাকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে এল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটার অবস্থা দেখে, ওকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নিয়ে, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন প্রভৃতি প্রক্রিয়া চালু করে দিল। মেয়েটার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় জয়ন্ত ঘোষের সাথে অর্জুন ওয়ার্ডের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দুপুরের পরে, ক্ষণিকের জন্য মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার জানালেন, ‘মেয়েটি শারীরিক ভাবে অসম্ভব রকমের দুর্বল। মনে হয় চার-পাঁচদিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষীণ স্বরে কিছু হয়তো বলছে, যদিও তার বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরলেও, আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। দেখুন, আবার জ্ঞান ফিরলে, ওর কাছ থেকে যদি কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন! পরীক্ষায় ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। তবে মেয়েটি ঋতুকালীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভালো করে জ্ঞান না ফিরলে, বেশি জোর জবরদস্তি করে কিছু জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।’

ক্রমশ…

 

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব