অরুণিমা

‘সাগ্নিক, আজ দিদি আর জামাইবাবু আসছে খেয়াল আছে তো? ট্রেনের সময়টা নেট-এ চেক করে স্টেশনে পৌঁছে যেও। দেখো দিদিদের যেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করতে হয়। আমি আজ কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না। বাইরে থেকে ডেলিগেট্স আসছে। ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর হবে না’, অরুণিমার কথাগুলো সাগ্নিকের কানে ঢুকল। কাজের থেকে চোখ না তুলেই স্ত্রীকে উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। ফোন করে দাও, ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে।’

‘বিয়ের পর প্রথমবার ওরা আমাদের বাড়ি আসছে। এখান থেকে কেউ না গেলে ওরা খারাপ মনে করবে। তোমার দিদি যখন এখানে এসেছিল তখন তুমি এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে কাজ করেছিলে। এখন একটা দিন তুমি করতে পারছ না?’ বিরক্তি চাপতে পারে না অরুণিমা।

নিরুত্তাপ গলায় সাগ্নিক উত্তর দেয়, ‘দিদি আমাদের সুখের সংসার দেখতে এসেছিল। আমরা যে অত্যন্ত সুখে রয়েছি সেটা দিদিকে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় দিদিকে খুব নিরাশ মনে হল। বিয়ের পরেই ভেবে নিয়েছিলাম যখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, নিজের টাকাপয়সাও যার যার নিজের, বন্ধুবান্ধবও দুজনের আলাদা তখন তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার হয় কী করে? এটাই বেশ ভালো ব্যবস্থা। তুমিই বলো না?’

অরুণিমার নিজের করা ব্যবস্থাই আজ হঠাৎ করে মোড় ঘুরে ওকেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।

ছয় বছরের প্রেমপর্ব শেষ করে সাগ্নিক আর অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বিয়ের আগের গভীর প্রেম ওদের দুজনের সংসারের চৌকাঠ পার করে বাইরে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। একে অপরকে অপমান করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করত না। মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ওদের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে হোটেল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হোটেলের ম্যানেজার। অগত্যা হোটেল ছাড়তে ওরা বাধ্য হয়েছিল।

অথচ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল ছ’দিনের জন্য। ম্যানেজারের কথা শুনেই অরুণিমা তাই রেগে ওঠে, ‘আমরা আগে থেকে পুরো টাকা দিয়ে রুম বুক করেছি। আপনি আমাদের চলে যেতে কীভাবে বলছেন?’

‘আপনি ঠিকই বলছেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনাদের জন্য হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের আমি অসুবিধায় ফেলতে পারি না। আর আপনি অ্যাডভান্স টাকা দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাগের মাথায় আপনারা স্বামী-স্ত্রী হোটেলের সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করেছেন। কাপ, কাচের বাসন ভেঙেছেন। সুতরাং সেগুলোর টাকা তো আপনাদেরই চুকোতে হবে। এই সব টাকা কেটে নিয়ে যে-টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ ম্যানেজারের উত্তরে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারে সাগ্নিক আর অরুণিমা।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসে ওরা। হোটেল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে স্থির করে নেয় পরের দিনই ওরা হোটেল ছেড়ে দেবে। ব্যস, আর কোনও কথা হয় না ওদের মধ্যে।

পরের দিন হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খুঁজে নেয় সাগ্নিক। কারণ ফেরার টিকিট কাটা ছিল চারদিন পরের তারিখে। সুতরাং দু’জনেরই আগে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় ছিল না ওদের কাছে।

‘হ্যাঁ রে কেমন কাটল তোদের ওখানে?’ সাগ্নিকের মায়ের কণ্ঠস্বরে অরুণিমা মোবাইল থেকে মুখ তোলে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরার আগে সাগ্নিকের বাবা-মায়ের অনুরোধে তিনদিনের জন্য ওরা এখানে এসেছে। সাগ্নিকের বাবা, মা দুজনেরই বয়স হয়েছে তারপর ওই একমাত্র ছেলে। সুতরাং ছেলে-ছেলে বউয়ের কাছেই ওদের যা কিছু আশা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও মেয়েকে কাছে পাওয়া হয় না। আর অরুণিমাও মেয়েই হয়ে উঠেছিল ওদের কাছে কারণ পাঁচ বছরেরও বেশি দেখছেন ওনারা ওকে।

‘হ্যাঁ জায়গাটা তো বেশ ভালোই, খারাপ কাটেনি কয়েকটা দিন’, কম কথায় সারবার চেষ্টা করে অরুণিমা কিন্তু ওর নিষ্প্রভ চেহারা সাগ্নিকের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

‘কী ব্যাপার বল তো? তোকে আর বাপ্পাকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। মনেই হচ্ছে না এই কদিন আগে তোদের বিয়ে হয়েছে। কোনও সমস্যা?’

‘মা, তোমাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল করে ফেলেছি। সাগ্নিক আর আমার একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।’

‘কী বলছিস তুই? ছয় বছর তো একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারতিস না। বাপ্পাকে কত বলেছিলাম, দিদির বিয়েটা হয়ে যেতে দে, তারপর বিয়ে করিস কিন্তু তোরা দুজন আমার কথাই শুনিসনি।’

‘তুমি ঠিকই বলছ। সত্যি বলতে কি এই কয়দিনে সাগ্নিকের আসল রূপটা আমার সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। মনেই হচ্ছে না এই মানুষটার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম,’ গলা বুজে আসে অরুণিমার।

‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। ভেবেছিলাম তোরা দুজন সুখী হলে আমরাও আনন্দে থাকব। এখন তো সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমার এটাই দুঃখ যে ছয় বছরের পরিচয়েও তোরা একে অপরকে চিনতে পারলি না।’

‘মা, এটা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। কয়েকটা দিন আরও দেখি। সাগ্নিক বলছিল একান্তই যদি কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব।’

‘খবরদার, ভবিষ্যতে কখনও এই কথা মুখে আনবি না। বাপ্পার সাহস তো কম নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনও ডিভোর্সের কথা উচ্চারণই করেনি আর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চারদিন বিয়ে হয়েছে তোদের আর এখনই ডিভোর্স নেওয়ার কথা ভাবছিস!’ অরুণিমা বেশ বুঝতে পারে সাগ্নিকের মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

‘মা, এখনই এতটা উত্তেজিত হয়ে পোড়ো না। ছয় মাসের মধ্যে কিছু করব না। তবে সব ফ্যামিলিতেই কোনও কাজ কখনও না কখনও প্রথমবারই করা হয়। বিয়ে করার অর্থ এও তো নয় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেও বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে,’ অন্যমনস্কভাবে অরুণিমা কথাগুলো বললেও, সাগ্নিকের মায়ের ছায়াঘন অন্ধকার মুখখানা তিরের মতো অরুণিমার বুকে গিয়ে বিঁধল।

দিদিকে স্টেশন থেকে আনা নিয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সাগ্নিকের মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছিল। ভাবল মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু শান্ত হবে, এই ভেবে বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল সাগ্নিক।

‘কী রে, ব্যাপার কী তোর? আজ হঠাৎ মায়ের কথা কী করে মনে পড়ল?’ সাগ্নিকের গলা শুনেই মা অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন।

‘তুমি কী যে বলো মা! কাউকে ভুলে গেলে তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন আসে। আর তুমি তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছ।’

‘ভালো লাগল বাপ্পা তোর কথা শুনে। আর বল, কেমন সংসার করছিস?’

‘আজ অরুণিমার দিদি, জামাইবাবু আমাদের এখানে আসছেন। অরুণিমা খুব খুশি। আমাকে বলেছে ওদের স্টেশন থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার কাজ আছে, যেতে পারব না,’ বলে হালকা হবার চেষ্টা করে সাগ্নিক।

‘তোর কী হয়েছে বাপ্পা? পাড়ার মধ্যে কারও দরকার হলে, সাহায্যের জন্য তুই ঝাঁপিয়ে পড়তিস…অতিথি আমার তোমার হয় না, সকলেরই তার জন্য করা উচিত,’ মা বোঝাবার চেষ্টা করেন।

‘দিদিও তো এসেছিল। অরুণিমা দিদির সঙ্গে অপরিচিতের মতোই ব্যবহার করেছে। এটা আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।’

‘সংসারে নানা কথা হয় কিন্তু তাই বলে অশান্তি বাড়ালে বাড়তেই থাকে। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে সুতরাং একটু বুঝে চললে পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’

‘মা, তুমি সবসময় আমারই দোষ ধরো। আমি যদি ঠিকমতো উত্তর না দিতে পারি তাহলে সেটা আমার হার হবে। তুমি তো জানো হার স্বীকার করা আমার ধাতে নেই।’

‘সব কিছুকেই হার-জিত হিসেবে ধরছিসই কেন? বিবেক বলেও তো মানুষের কিছু থাকে। বিবেক যা বলে তাই সকলের করা উচিত। যাই হোক, তোদের খবরাখবর বল।’

‘এমনি সব ঠিকঠাকই আছে। তুমি আর বাবা কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে দেখছি। এখন ফোন রাখি। অরুণিমাকে বলিস পরে ওর সঙ্গে কথা বলব কারণ এখন ওর অফিস বেরোনোর সময়।’ এই বলে ফোন রেখে দেন সাগ্নিকের মা।

ছোটো থেকেই অরুণিমার উপর ওর মায়ের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। বাবা বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন তাই মায়ের সঙ্গেই সময় কেটেছে বেশি অরুণিমা ও ওর দিদি অমৃতার। বয়সে ছোটো বলেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, অরুণিমা একপ্রকার মায়ের ন্যাওটাই ছিল। ছোটো থেকেই মায়ের কাছে অরুণিমা শিখেছে, নিজের ভালোর জন্য সবসময় সজাগ থাকাটা এবং ব্যক্তিত্ব রাখাটা খুব দরকার যাতে অপর পক্ষ দেখে ভয় পায়। এমনকী কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের ভয় দেখাতে হবে এমনটাও অরুণিমার, মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা সবসময় বলতেন, ‘সবরকম বিপদ থেকে আমি তোদের বুক দিয়ে আগলেছি। তোদের বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার পরিবারের লোকজন আমার জীবন প্রায় নরক করে তুলেছিল। ওরা তখন বুঝতে পারেনি যে আমি নরম মাটি দিয়ে তৈরি হইনি, রুখে দাঁড়িয়েছি ওদের বিরুদ্ধে।’

অরুণিমার কাছে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল অটল সত্যি। এমনকী মায়ের অনুমতিতেই সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা এগোতে পেরেছিল।

বিয়ের পরেও নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সাগ্নিক এবং ওর মা-বাবা-দিদির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল অরুণিমা।

সংসারে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে সাগ্নিকের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। সাগ্নিকের প্রতিশোধপ্রবণতার প্রমাণ হাতেনাতে পেল যখন সাগ্নিক অরুণিমার দিদিকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে অস্বীকার করে মুখের উপরে ওকে জানিয়ে দিল। অরুণিমারও স্টেশন যাবার উপায় ছিল না অফিসের কাজের জন্য। অগত্যা ফোন করে অরুণিমা দিদিকে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি করে ওদের বাড়ি চলে আসতে। বাড়িতেও কাজের লোককে অতিথিদের ঠিক করে অভ্যর্থনা করার কথা বুঝিয়ে অফিসের জন্য রওনা হল অরুণিমা। কিন্তু মন পড়ে রইল বাড়িতে।

‘জানিনা, দিদি কী ভাবছে আমাদের সম্পর্কে। বিয়ের পর প্রথমবার আমাদের বাড়ি আসছে তাও জামাইবাবু মানে কৃষ্ণেন্দুদা-র সঙ্গে। মুম্বই যখন পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম তখন প্রায়ই হস্টেল থেকে দিদির ওখানে পালিয়ে যেতাম। দিদির যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না। আর রান্না করতে দিদি প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং সেই সঙ্গে খাওয়াতেও। রোজই নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াত। আর আজ যখন দিদিরা আসছে তখন আমরা কেউই বাড়িতে রিসিভ করার জন্য থাকছি না,’ অফিসের সহকর্মীর কাছে মনের অস্থিরতাটা চেপে রাখতে পারে না অরুণিমা।

অরুণিমা নিজে রান্নাঘরে ঢুকতে পছন্দ না করলেও দিদির কাছে শুনেছিল, কৃষ্ণেন্দুদা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আগে থেকেই সব রকমের ফল, সবজি, খাবার কিনে ফ্রিজ ভরে রেখেছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলায় অফিস থেকে যখন বাড়ি পৌঁছোল, ভিতরে পা দিতেই হাসির শব্দ ভেসে এল অন্য ঘর থেকে। নিজের অজান্তেই অরুণিমার ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল। ঘরের দিকে পা বাড়াল অরুণিমা।

‘কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কীসের জন্য? আমাকেও তো কিছু বল দিদি।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে অরুণিমা বলল, ‘ভেরি সরি, কৃষ্ণেন্দুদা। কিছুতেই স্টেশন যেতে পারলাম না, অফিসে ছুটি পেলাম না। নিজের লোকেদের জন্যই চাকরি করা অথচ দেখুন তাদের দরকারেই ছুটি পাওয়া যায় না।’

‘নিমি, এত দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাগ্নিক, অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বরং বলতে পারো, তোমার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই হয়নি,’ কথাটা বলেই কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে।

‘আঃ! তুমি রাখবে। নিমিকে দেখলেই হল। ওর পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চাও না। বেচারা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে,’ অমৃতা কৃষ্ণেন্দুকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘আমি তোমার বোনকে কেন খ্যাপাব? আমাদের জন্য বেচারা শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগবে কেন? আমরা তো দিব্যি আরামেই সময় কাটাচ্ছিলাম,’ কৃষ্ণেন্দু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি কৃষ্ণেন্দুদা। আমি না থাকলেই সবাই বেশি খুশি থাকে,’ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে অরুণিমা।

‘দ্যাখো ভাই, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাগ্নিকই দিতে পারে। আমরা তো মাত্র কয়েক ঘন্টাই এসেছি। আমার তো আবার শালির সঙ্গ বেশি ভালো লাগে।’ কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে অরুণিমাও হেসে ফেলে।

সাগ্নিক শান্তস্বরে বলে ওঠে, ‘কৃষ্ণেন্দুদা, আপনি ভুল করছেন। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিই।’

‘বাঃ, ভায়া! কৌশলটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেছ দেখছি। এত বছর বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এটা এখনও আমি রপ্ত করতে পারলাম না,’ কৃষ্ণেন্দু আবার হেসে ফেলে।

‘দেখছিস দিদি, যে আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তার কাছে আমার কী আর এক্সপেকটেশন থাকতে পারে?’ অরুণিমার স্বরে কথার ঝাঁঝ স্পষ্ট ধরা পড়ে।

‘তুই শুধু শুধু সিরিয়াস হয়ে পড়ছিস। সাগ্নিক তোর সঙ্গে মজা করছে। সব কথার কি মানে ধরতে আছে?’ অমৃতা বোনকে বোঝাবার চেষ্ট করে।

‘আমি তো বলা, শোনা সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি দিদি। মা তো প্রথমেই সাবধান করেছিল যে আমাদের আর সাগ্নিকদের বাড়ির কালচারে আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু আমিই তখন কথা শুনিনি।’

‘বুঝেছি। আজকাল বুঝি মায়ের কথাতেই উঠছিস বসছিস?’ গম্ভীর হয় অমৃতা।

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, আর এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মায়ের থেকে ভালো আমার ভালো-মন্দের কথা আর কে ভাববে বল? মা আমাদের দু’জনের বন্ধুও তো বটে। কেন, তোর এটা মনে হয় না দিদি?’

‘মায়ের কথায় সংসার চালাচ্ছিস? সংসারটা তোর আর সাগ্নিকের না আমাদের মায়ের যে, মা তোর সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে চাইছে?’ সাগ্নিক আর অরুণিমা দুজনের মধ্যে একটা টেনশন চলছে এমন আাঁচ পেয়ে, রাগত গলায় অমৃতা বোনকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।

দুই বোনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণই সাগ্নিককে নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসে। অমৃতা ঠিকই করে নেয় বোনকে বোঝানো দরকার কারণ কথাবার্তার মাঝেই বুদ্ধিমতী অমৃতা বুঝে নিয়েছিল সাগ্নিক আর ওর বোনের সম্পর্কটা একটু শুধরোনো দরকার।

‘দিদি, আমি জানি সংসারটা আমাদের, কিন্তু মায়েরও আমাকে বলার অধিকার আছে। মা-কে আমি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। প্রয়োজনে আমি মায়ের জন্য সবকিছু করতে পারি। এখন আমাদের বিয়েটা বাঁচাবার জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছে। তুই বিশ্বাস করবি না দিদি, বিয়ের পর সাগ্নিক কতটা বদলে গেছে। সব সময় নিজের মত আমার উপর চাপাবার চেষ্টা করে। আমার যে আলাদা একটা আইডেনটিটি আছে সেটা ও মানতে চায় না। মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল শক্ত হাতে সাগ্নিকের এই অভ্যাসটা দমন করতে, নয়তো আমাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ফেলতে ও এক মুহূর্তও দেরি করবে না। সুতরাং সাগ্নিক যাই করুক না কেন আমি সাবধান হয়ে গেছি।’

‘কী বলছিস তুই?’ অমৃতা বিস্ময় চাপতে পারে না। ‘সাগ্নিকের নিন্দে করাটা মায়ের কাছে কি খুব দরকার ছিল? আমাদের জন্য মায়ের চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও একটা সংযমের সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। তুই এখন বাচ্চা নোস যে সব কথায় মা-কে টেনে আনতে হবে। নিজের ডিসিশন নিজেকেই নিতে হবে।’

‘আচ্ছা ছাড় দিদি, এসব কথা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে তোদের কষ্ট হয়নি তো?’

‘কষ্ট কেন হবে? সাগ্নিক তো স্টেশনেই ছিল। বাড়ি নিয়ে আসা থেকে খাওয়াদাওয়া যত্নের কোনও ত্রুটি রাখেনি।’

‘আর একটা দিন দিদি কষ্ট কর। এর পর পাঁচদিনের ছুটি রোববার নিয়ে। খুব মজা করব। বাইরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। বাড়িতে ওসব ঝঞ্ঝাটই রাখব না,’ অরুণিমা দিদির গলা জড়িয়ে ধরে।

‘না রে সে হবে না। কৃষ্ণেন্দু বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, আমিই নতুন নতুন রান্না করে তোদের খাওয়াব। সাগ্নিক রান্না করে?’

‘হ্যাঁ। আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেরাই আলাদা করে খাবার বানিয়ে নিই। মায়ের কথামতো রান্না করে খাইয়ে সাগ্নিকের অভ্যাস আমি খারাপ করতে চাই না। রান্না করাটা কি খালি মেয়েদেরই কাজ, তুই বল না দিদি?’ দিদির কাছে সব কথা বলতে পেরে, এখন কিছুটা হালকা অরুণিমা। প্রায় জড়তাহীনভাবে বলল, ‘সংসার করবার প্রথমেই মা সাবধান করে দিয়েছিল যে, রান্না না করার সবথেকে ভালো দিক হল, বাড়িতে ভালো রান্না হলে খেয়েদেয়ে বাড়ির পুরুষ-মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হবে। অযথা মেদ বাড়বে। এই ভালো, এতে চেহারাও ভালো থাকবে, বাড়িঘর নোংরাও হবে না।’

‘হ্যাঁ। তাই জন্যই মা, বাবাকেও নিজের জীবন এবং সংসার থেকে দূরে রেখেছিল,’ অমৃতার গলায় মায়ের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ে।

‘কী বলছিস তুই দিদি?’ অরুণিমার স্বরে অবিশ্বাস।

‘না, না কিছু না। আমার মুখ থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।’

‘না, দিদি। তুই আমার থেকে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিস। তোকে বলতেই হবে,’ অরুণিমা জেদ ধরে।

‘লুকোবার মতো কিছু নয়। মা তোকে যেটা শেখাচ্ছে নিজের জীবনেও ওই একই জিনিস করেছে। তুই তখন খুব ছোটো ছিলি। কিন্তু আমার সব মনে আছে। বাড়িতে রান্নার লোক ছিল কিন্তু মা ওকেও রান্না করতে দিত না আর নিজেও করত না। বাবা অফিস যেত চা পাউরুটি খেয়ে, বাড়ি এসেও কপালে কিছু জুটত না। মা বদারও করত না। বাবা নিজেই রাতে কিছু বানিয়ে নিত, আমার বাবার জন্য কষ্ট হতো, তাই বাবাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতাম। রান্না করার শখটা হয়তো আমি বাবার থেকেই পেয়েছি,’ অমৃতা বলে।

‘কিন্তু বাবা তো শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে বদলি নেয় বাবা। রান্নার লোকটাকে বাবা ছাড়িয়ে দেয় মায়ের জেদের কাছে হার মেনে। ছোটোবেলায় আমরা মানুষ হয়েছি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে।’

‘বাবার মুখটাই আমার ঠিক করে মনে পড়ে না,’ স্মৃতি হাতড়াতে থাকে অরুণিমা।

‘তোর মনে থাকার কথাও নয়। আমারই তখন দশ বছর বয়স। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য শহরে চলে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলে স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, গিফ্টও নিয়ে আসত আমাদের জন্য। মা জানতে পেরে, স্কুলকর্তৃপক্ষকে বলে, বাবার স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার মায়ের ওপর রাগ বাড়তে থাকে। মায়ের স্বার্থপরতার জন্য মা-কে আমি ভালোবাসতে পারিনি। মা-ও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তাই আমাকেও হস্টেলে পাঠিয়ে নিজের কর্তব্যে ইতি টেনে দিয়েছিল মা,’ না চাইতেও অমৃতার চোখ চলে ভরে যায়।

‘মনে আছে দিদি, তুই শুধু ছুটিতে বাড়ি আসতিস। তখন আমরা দুই বোন খুব মজা করতাম।’

‘তোর জন্যই তো বাড়িতে আসতাম। মা-র কোথায় সময় ছিল আমাদের জন্য?’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। পরে মা আমাকেও তো হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। সুমন কাকু সেসময় খুব বড়িতে যাতায়াত করত। আমাদের ফ্যামিলিটা ভেঙে দেওয়ার পিছনে ওনারও বিশাল ভূমিকা রয়েছে।’ অমৃতা বুঝতে পারে সুমন কাকুর উপর অরুণিমার রাগ আজও এতটুকু কমেনি।

‘নিজের সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ করিস না নিমি। এই অভ্যাস ছাড় দেখবি তোরই ভালো হবে। এখন নিজের সংসার সামলা। তোর সংসার ভেঙে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব।’

‘তোর কি মনে হয় সব দোষ আমার?’

‘আমি তোর দিদি হই। তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। দোষ কার সেটা বিচার করার আমি কে? কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, তোর নিজের সংসার তুই নিজেই একমাত্র বাঁচাতে পারিস,’ অমৃতা স্পষ্ট কথাটা বোনকে বলেই ফেলে।

‘কী হল? দুই বোনের না হয় অনেকদিন বাদে একসঙ্গে দেখা হয়েছে মানছি কিন্তু তাই বলে খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ নাকি?’ কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্যে দু’জনকে প্রশ্নটা করে।

‘ওঃ সরি কৃষ্ণেন্দুদা। কথা বলতে বলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না। আমাকে দশ মিনিট দিন, ফ্রেশ হয়ে সোজা ডিনার টেবিলে পৌঁছোচ্ছি,’ জিভ কেটে অরুণিমা উত্তর দেয়।

অরুণিমার সংসারে অমৃতা আর কৃষ্ণেন্দুর আসাটা একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে এসেছিল, যেটা অরুণিমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতে পেরেছিল। একটা সপ্তাহ হইচই, ঘোরাফেরা করে অমৃতারা চলে যেতেই আবার বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল।

দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন অরুণিমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। অফিসেও কাজে মন দিতে পারত না অরুণিমা।

একদিন রোজকার মতো সাগ্নিক নিজের ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। অরুণিমা এসে পিছন থেকে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। সাগ্নিক অবাক হয়, কারণ এই স্পর্শ ও প্রায় ভুলতেই বসেছিল।

‘চলো খাবে চলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ অরুণিমার গলায় সেই প্রথম অন্তরঙ্গতা অনুভব করল সাগ্নিক। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আনালে?’

‘আনাইনি, নিজে বানিয়েছি। রেস্টুরেন্টে এই খাবার পাওয়া যায়?’ অরুণিমা হাসে। সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে দেয় অরুণিমা। সুরভিত গন্ধের আবেশে সাগ্নিকের অরুণিমাকে যেন নতুন লাগে। অরুণিমা সাগ্নিকের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মনের কথাগুলো ঠোঁটে এসে পড়ে সাগ্নিকের, ‘ইশ, দিদি যদি আরও কয়েকদিন আগে আসত!’ অরুণিমা কিছু বলে না মুখে। পরম নিশ্চিন্তে সাগ্নিকের বুকে মাথা রাখে। মোমবাতির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা শুধু সাক্ষ্য থাকে বিরল এই মিলন দৃশ্যের।

 

টান

সবুজ ঘাসের ওপর চাপ চাপ রক্তের দাগ। জানোয়ারও সহ্য করতে করতে একসময় ফুঁসে ওঠে। আর এরা তো মানুষ! দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার লাভা স্রোত তো এরকম হবেই!

ডুয়ার্সের লাবডুঙ চা-বাগান। ছোট্ট চা-বাগান। তাই চা পাতার উৎপাদনও কম। মালিকের অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশা প্রায় অনাহারে থাকা শ্রমিকদের বঞ্চনার আগুনে পুড়িয়েছে দীর্ঘদিন। পরিণাম মালিক রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার থ্যাঁতলানো রক্তাক্ত শরীর ঘিরে জেগে থাকা একরাশ প্রশ্ন ও হতাশা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেই, ইউপিএসসি-র চাকরিটা জুটে গেল অভীকের। স্ট্যাটিসটিকাল ইনভেস্টিগেটর কাম অফিসার। অনেক পরিশ্রম ছিল তার জন্য। মেধাবী অভীক পেরেকটা ঠিক জায়গাতেই পুঁততে পেরেছিল। বেশ মোটা মাইনে। কাঁটাকলের আরও দুজন পেল। অর্ক ও দেবারতি। দেবারতি কিছুদিন পরেই বার্কলে ইউনিভার্সিটি-তে গবেষণা করতে চলে গেল। অর্করও পালাই পালাই ভাব। কলেজ সার্ভিস কমিশনের দিকে তাকিয়ে বসে।

প্রথম দিন থেকেই চা-বাগানের এতো সমস্যার মাঝেও, অভীক আস্তে আস্তে মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে কোথায় যেন ও একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছিল। মায়ের কথাটা মনে ছিল, ফেস দ্য ব্রুট। চোখে চোখ রেখে সমস্যার মোকাবিলা করো। শেষ সাক্ষাতে বিদ্যামন্দিরের দীপংকর মহারাজের কথাটা যেন কানে বাজে ওর, মানুষের জন্যও কিছু করিস!

আলিপুরদুয়ার স্টেশন রোডের শেষে ওর অফিস। ডিএম অফিস লাগোয়া। ওর থাকার জায়গা কিন্তু কাছাকাছি চা-বাগান কোরাঙ্গিনির বাংলোয়। ভারি মনোরম পরিবেশ। আলিপুরদুয়ারের বারোটা চা-বাগানের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র, শ্রমিকদের অবস্থা, অনুন্নয়নের কারণ থাকলে তার খোঁজ ও উন্নয়নের নকশা বানানো তবে সব কিছুর মূলে যেন থাকে শ্রমিকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এক কথায়, মানব মূলধনের রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। আর মাথার ওপর ডিএম, অশোক ভুটিয়া।

ডিএম ভালো বাংলা বলতে পারেন। শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। প্রচন্ড মেধাবী। হাই পাওয়ার গ্লাসের নীচে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রশাসনটা দারুণ বোঝেন। খুব বড়ো মনের মানুষ। কর্মীদের বিপদতারণ তিনি। এক মন ভালো করা পরিবেশ ওনার অফিসে।

প্রথম দিন থেকেই অভীকের সাথে ভালোলাগার সম্পর্ক ডিএম-এর। ওনার স্ত্রী বাঙালি। ভালো গানের গলা। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। অশোকবাবু আবার কবি মানুষ। লেখালেখি করেন অবসরে। অভীকের কবিতা পড়ে একদম আপ্লুত। তবে ও অন্য একটা কারণও বুঝতে পেরেছে। ওনার মৃত ছেলে আকাশের সাথে নাকি ওর অনেক মিল। তাই ভালো লাগায় অপত্যস্নেহের ভাগই বেশি পায় সে।

সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য সে একটা টান অনুভব করে এখন। সত্যিই এরা যেন প্রকৃতির সন্তান। সবুজের মাঝে যেন এক একটা সবুজ মানুষ। বঞ্চনা, অবজ্ঞা এদের দিনলিপি। ওর বাবার কথা মনে পড়ে খুব। সমাজবিজ্ঞানী বাবা বলতেন, রাষ্ট্র সব মানুষের সমস্যার কাছে সব সময় পৌঁছোতে পারবে না। ট্রিকল ডাউন থিওরি থাকবেই। মানে গাছের ওপরের পাতা বেশি জল পাবে আর নীচের পাতায় জল চুঁইয়ে পড়বে। সরকারি সুবিধা কিছু মানুষের কাছে বেশি মাত্রায় যাবে। তাই বেশি-পাওয়া মানুষগুলো যখন কম-পাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তখনই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। তখনই বাস্তব হবে ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ প্রতি ঘরে।

আলিপুরদুয়ারের চা-বাগানগুলোতে, চা পাতার উৎপাদন অন্যান্য বাগানের তুলনায় অনেক কম। মালিকরা উৎপাদন বেশি করতে চায়। চা-বাগান ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠকে অভীক বেশ কয়েবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বহু পুরোনো চা গাছগুলো থেকে বেশি উৎপাদন আশা করা বৃথা। কচিপাতা উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে গাছগুলো। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেও বিপুল আর্থিক চাপের কারণে, পিছিয়ে আসছে অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকরা।

আর কথায় আছে, সুস্থ শরীরে বাস করে সুস্থ মন। অপুষ্টি যেখানে যাপন চিত্র, সেখানে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা সর্বাধিক আশা করা যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব! উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রথম প্রযোজন। দিনপ্রতি একশো টাকায় অন্তত চারজনের একটা পরিবারের ভালো ভাবে চলা এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে খুবই কষ্টকর। তাই লাভের অঙ্ক কষার সাথে, শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে বাঁচার হিসাবটাও কষা দরকার।

চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের বাঁচা সত্যিই নিম্নমানের। হাজারো না পাওয়ার মাঝে বেঁচে থাকা ওদের। এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। সাহসী অভীক একটা কাণ্ড করে বসল। বেশ কয়েবার চা-বাগান শ্রমিকদের অবস্থা জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে কিছু করার আর্জি মেল করেছে সে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! হঠাৎ সুযোগটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে গেল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েজন সদস্যকে নিয়ে চা-বাগান উন্নয়নমন্ত্রী, আলিপুরদুয়ার চা-বাগান পরিদর্শনে আসেন। ডিএম, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, অভীক এবং অবস্থা খারাপ এমন চা-বাগানের মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী। আশোকবাবুকে বার বার অনুরোধ করে অভীক আলোচনার স্থান কোরাঙ্গিনি চা-বাগানের অডিটোরিয়ামে করতে বলে।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল এর পিছনে। অন্য বাগানগুলোর থেকে কোরাঙ্গিনি অনেকটাই পিছিয়ে। উৎপাদন কম এখানে। এটাকে মালিকরা ঢাল করে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজের চোখে দেখে যাক শ্রমিকদের অবস্থাটা।

আশানুরূপ কাজই হল। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে চা-বাগানের মালিকরা, শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে ভুল তথ্য দিতে থাকল। মন্ত্রী তাকে শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থাটা বোঝানোর কথা বলতেই, অভীক কাণ্ডটা করে বসে। সামনে থাকা জল ভর্তি গেলাসের মধ্যে নিজের পেনটা ডুবিয়ে দিয়ে মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে বসে, পেনটা ঠিক কী দেখছেন? বাঁকা না সোজা? বাকরহিত মন্ত্রী ও অন্যরা। এরকম উপস্থাপনা তাঁরা আশাই করেননি। মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভীক বুঝল, কেল্লা ফতে! জল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দেখলে, পেন তো বাঁকা দেখাবেই। অর্থাৎ ম্যানেজারদের চোখে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে গেলে তা সত্য হবে না। অবস্থার অসদ বিম্বটাই ধরা পড়বে এবং তাতে মালিকদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

এর পর সব কিছু তার পরিকল্পনা মাফিকই হল। শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে তাদের ঘর, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা দেখে আবেগতাড়িত মন্ত্রী। বাগানের ম্যানেজারকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব কিছু ঠিকঠাক করতে নির্দেশ দিলেন। দেখভালের দাযিত্ব দিলেন ডিএম-কে। শ্রমিকদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে বললেন অভীককে। ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী মাসে দিল্লি আসার প্রস্তাব দিলেন। অশোকবাবুর উৎফুল্ল মুখ বলে দিল ওনার খুশির কথা।

অভীক মনে মনে এটাই চাইছিল। শ্রমিকদের বাঁচার অযোগ্য পরিবেশের কথা প্রচার করতে হবে ব্যাপক ভাবে। লজ্জায় ফেলতে হবে সভ্য সমাজকে। বোঝাতে হবে, পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে এদের ব্রাত্য করা যাবে না। তবে যদি কাজ হয়। কদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী চা-বাগান শ্রমিকদের, বিনা পয়সায় চাল-ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অবস্থা কতটা শোধরাবে!

সারা চা-বাগানে এখন শুধু দিন বদলের স্বপ্ন। অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোর কাছে অভীক এখন নয়নের মণি। সে প্রত্যাশার চাপটা বোঝে। দিল্লি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। পুরো দাযিত্ব ডিএম নিজে নিয়েছেন। সসস্ত সময় ধরে উন্নয়নের রূপরেখা বানিয়ে চলেছে অভীক। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে টি টুরিজমের প্রস্তাব রাখছে। টি টুরিজম হলে বাগানের পুরুষগুলো হোটেল, দোকান, রিকশা বা ভ্যান চালানো অথবা গাইডের কাজ করতে পারবে। সহায়ক অর্থনীতি। মহিলাদের চা পাতা তোলার সাথে সাথে, পুরুষগুলোও কিছু আয় করলে বাঁচার পরিবেশ, পদ্ধতি আস্তে আস্তে বদলাবে নিশ্চিত। বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে শুরু করবে। দিনের শেষে মাতাল মরদগুলো ভূমিকা বদলে তখন হয়ে উঠবে প্রেমিক সোয়ামি!

সারা রাত প্রজেক্টটারে কাজ করে শুতে অনেক দেরি হয়েছে অভীকের। সঞ্চিতাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছে অনেক বার। পায়নি। মেযেটা বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে তার ভালোবাসা অনুভব করে অভীক। কতদিন দেখা হয়নি! একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুতে গেল সে।

পরদিন সকালে চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল অভীকের। কী হল আবার! বাইরে বেরিয়ে চমক। ও কি স্বপ্ন দেখছে? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? কাল যার কথা মনে করেছে বারবার সে-ই এখন সামনে। মূর্তিমান বর্তমান। আনন্দে উত্তেজনায় নীচে নেমে দেখল, চা-বাগানের মেয়েদের মাঝে সঞ্চিতা। অভীকের মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে আনন্দ-ঝরনা হয়ে সঞ্চিতা সকলকে জানিয়ে দিল, দুদিন থাকবে সে এখানে। ওইদিন সকলের জোরাজুরিতে রাত্রে খাওয়াদাওয়া, ক্যাম্প ফায়ারের আযোজন, অনেক রাত অবধি চলল নাচ গান। সারা চা-বাগান যেন নতুন প্রাণের উৎসবে মেতেছে। সঞ্চিতা যেন বঞ্চিত মানুষগুলোর মনে রাশি রাশি আনন্দ উল্লাসের জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিল।

পরদিন সকালে খুশির খবর আবার। অশোকবাবু সকালের খবরের কাগজটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরের হাত দিয়ে, মন্ত্রী কথা রেখেছেন। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। মালিকপক্ষের সংগঠনও মেনে নিয়েছে। বাগানের সকলেই এই খুশির খবর, সঞ্চিতা আসার কারণ হিসেবে দেখছে। হাসি মুখে সঞ্চিতার সাথে অভীকও একরাশ টাটকা বাতাস ভরে নিল আগামীর জন্য।

দুটো দিন যেন সত্যিই আনন্দ ভৈরবী তার জীবনে। সঞ্চিতার মুখে শুনেছে শিলিগুড়িতে ব্যাংক অফিসারদের ট্রেনিং ছিল। সে ম্যানেজ করে চলে এসেছে অভীকের কাছে। দুদিন পরেই তাকে আবার ফিরতে হবে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে তার অফিস মালদায়। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে।

দুটো দিন হইচই করে কেটেছে ওদের। চা-বাগান ঘুরে দেখেছে। প্ল্যান্ট-এ গিয়ে চা পাতা তৈরি দেখেছে। অভীক ওকে ফার্স্ট চা তৈরি করে খাইয়েছে। মালদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাকও করে দিয়েছে। সঞ্চিতা বাগানের বাচ্চাদের চকোলেট বিলিয়েছে। সঙ্গে আনা জামা-কাপড় চা তুলতে আসা মেয়েদের দিয়েছে। সাজের জিনিসের অবস্থাও তাই। অভীকের মুখে চা-বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনে, সত্যিই ও মানুষগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। শুধু সঞ্চিতার সারপ্রাইজ ভিজিটের খবর মাকে জানাতে পারেনি অভীক। দিন পাঁচেক আগে ঝড়ের তাণ্ডবে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। শত যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ঠিক হতে কতদিন লাগবে কে জানে!

অশোকবাবু ও বউদিকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে সঞ্চিতা চলে যাবার আগের রাত্রে। গান আড্ডা গল্প মাউথ অরগানে ভালো লাগা যেন টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওদের ঘিরে। সেই সময়ে বিদায়বেলায় চোখের জলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বউদিকে। সারা রাত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওদের দুটো শরীর চাঁদের আলো গায়ে মেখে ভালোবেসেছে, আগামীর স্বপ্ন এঁকেছে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকালের প্রতীক্ষা করেছে।

তবে এ সকাল বড়ো মন খারাপ করা সকাল কোরাঙ্গিনি চা-বাগান জুড়ে। ফোনে ওর মুখে বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের কথা শুনে সঞ্চিতা বলেছিল, একদিন আসবে এখানে। কথা রেখেছে সে। এক সমুদ্র ভালোবাসায় সকলকে ভাসিয়েছে। চা পাতা তুলতে এসে মেযেরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। অশোকবাবু ও তনিমা বউদিরও মন ভালো নেই। সত্যিই যেন জাদু জানে মেযেটা! সকলের মতো অভীকও চেয়েছে, আর কদিন থেকে যাক। কিন্তু মুখে বলতে পারেনি। সঞ্চিতা ম্যানেজার হয়ে বছর খানেক আগে জয়েন করেছে মালদা হেড অফিসে। ওর তাই কাজের বেজায় চাপ, জানে অভীক। শুধু নির্বাক সাক্ষী থেকেছে বিদায়বেলায় চোখের জল নিয়ে। কাল সারারাত যেন শেষের কবিতা-র অনুভব ছিল অভীকের কাছে। তারাদের মিটিমিটি সঙ্গে করে সঞ্চিতার স্মৃতির কোলাজ বানিয়েছে সে রাতজাগা হয়ে কখন আকাশ আলোর খেলায় মেতেছে সে খেয়ালই করেনি। ছোট্ট পাখিটার ডাকে যেন জেগে উঠল মানসঘুম থেকে। জানলায় বসে ল্যাজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে গেয়ে তাকে সুপ্রভাত জানাল পাখিটা। তার মনের দুঃখের খবর পেয়েছে বোধহয়!

 

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। তাহলে লাইন ঠিক হল এতদিনে! ফোনের ওপাশে মায়ের গলা। ও হ্যালো বলতেই, মায়ের কান্নার আওয়াজ।

এও কী সম্ভব! শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের পাশে ট্রেনিং সেরে সেবক রোড ধরে, হোটেলে আসার পথে পিছন থেকে একটা লরি ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে অটোর পিছনে। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পাস থেকে একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়ে চলে যায় সঞ্চিতাকে। থ্যাঁতলানো দেহটা আইসিসিইউতে লড়েছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সে আর নেই! সঞ্চিতা আর নেই!

অভীক মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাটে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। তাহলে দুদিন চা-বাগানের মানুষগুলোর মাঝে কাটিয়ে গেল, সে কে? অভীককে ভালোবাসার আবিরে যে রাঙিয়ে গেল, সে কে?

 

বিকৃতি

আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বারবার রজত ওই অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজের চ্যাট বক্সটা খুলছে, ডিপিটা দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে।

ভদ্রমহিলার মুখটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড় বেয়ে কোমর অবধি নেমে এসেছে। সুঠাম দেহের গঠন, চুলের পাশ থেকে প্রসারিত হয়েছে ফরসা দুটো হাত যেন কোনও চিত্রকরের অঙ্কিত দুটি বঙ্কিমরেখা। বয়স বড়োজোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। প্রথম মেসেজটা ওপার থেকেই এসেছিল, ছোট্ট একটা, হাই!

রজত প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কোনও উড়ো মেসেজ। তাই অফিসিয়ালি রিপ্লাই দিয়েছিল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

একসাথে অনেকগুলো স্মাইলি এসেছিল। রজত একটু অবাক হয়। এত রাতে সচরাচর এরকম রিপ্লাই কে দেবে?

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল,

কে আপনি?

ধরুন, আপনার কোনও বান্ধবী।

মানে?

কেন আপত্তি আছে? ছবি না দেখে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায় না?

রজতের আকর্ষণটা বেড়ে গেছিল। এরকম প্রত্যুত্তর সে অনেক দিন পায়নি।

আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

এই মহাবিশ্বের কোনও একটি ক্ষুদ্র শহরের বাসিন্দা।

হেঁয়ালি করছেন?

সরকারি আধিকারিকের সাথে হেঁয়ালি? না, অত সাহস নেই।

ভদ্রমহিলার চমকপ্রদ জবাবগুলো রজতের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন প্রায় সারাদিনই ও ফোন কাছে কাছে রাখে। কিন্তু সেই রহস্যময়ী সারাদিনে একবারও অনলাইন আসে না। শুধুমাত্র একবার। রাত বারোটার পর।

অতএব, রজতও সেই সময়টাই বেছে নিয়েছে। মনে মনে একবার কল্পনা করে অবয়বটাকে। আজ সে ঠিক করেছে, ভদ্রমহিলার নাম জানতে চাইবে।

তাই প্রথমেই বলে, এতদিন কথা বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি কি?

লোকে মধুরিমা বলে!

বেশ, আমিও ওই নামেই ডাকব।

যা ইচ্ছা!

একবার দেখা করা যায় কি?

এই প্রশ্নের পর টানা কুড়ি মিনিট কোনও রিপ্লাই আসেনি। ইতিবাচক কোনও কিছুর আশা নিয়ে রজত ফোনের দিকে তাকিয়েছিল। চার্জটা ক্রমশ কমে আসছে। প্লাগে চার্জারটা কানেক্ট করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল। অবশেষে রিপ্লাই এল, সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই

অবশ্যই, আগে চিনি, জানি..

রজত নিরাশ হয়নি। বরং আশার একটা ক্ষীণ আলেয়া জ্বলে উঠেছিল। ওর পুরো মনটা আলোকিত করে তুলেছিল। মুখভঙ্গি না দেখেও শুধু কয়েটা রিপ্লাই যে, কোনও মানুষকে এতটা সম্মোহিত করতে পারে সেটা জানা ছিল না রজতের।

আজকাল আর তার কাজে মন নেই। সে এখন শুধু বারবার ওই নম্বরটাতে কল করে।

সুইচ অফ! ট্রু কলারে দেখেও কোনও লাভ হয়নি।

তাই শুধু রাতের গহিন অপেক্ষা। এখন রাত হলেই কেমন নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সে। অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বলেই ফেলে, মধুরিমা, মধুরিমা, আমি তোমায় ভালো…

কী?

ভালোবেসে ফেলেছি!

তাই বুঝি! এত তাড়াতাড়ি?

দেরির কী আছে শুনি? তোমার কি আমাকে পছন্দ না?

তুমি যে বিবাহিত!

হ্যাঁ, রজত তো বিবাহিত। দীর্ঘ সংসারজীবন অতিক্রম করে এসেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথক ভাবে। একই বাড়িতে থাকলেও রজতের স্ত্রী মল্লিকা থাকে নীচের তলায়, রজত উপরতলায়। এখনও মল্লিকা সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুর ছোঁয়ায়।

 

রজতের আজকের চাকরির পদটা একদা মল্লিকার বাবারই দেওয়া। বিয়ে পর বেকার জামাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া শ্বশুরের দাযিত্ব! সেই দাযিত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন মল্লিকার বাবা পরিমলবাবু। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে জামাইকে সরকারি অফিসে পার্মানেন্ট পদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে জমি কিনে ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বদলে চেয়েছিলেন, মেয়ে কাছে বাকি জীবনটা কাটাতে। সেটাই কাল হয়েছিল। মরতে হয়েছিল জামাইয়ে হাতে। তাও সুখ। মরেও সুখ। মেয়ে তো ভালো আছে। কিন্তু সত্যিই কি ভালো ছিল মল্লিকা?

রজতের এনে দেওয়া ওষুধগুলো খেতে খেতে দিন দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছিল মল্লিকা। শুধু ঘুম পেত, অনিচ্ছাকৃত কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত না। ক্রমে নীরবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করাই ওর ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। রজত বলত, ওগুলো নাকি বাতের ব্য়থার ওষুধ, খেলে বার্ধক্য আসবে না কোনও দিন।

মল্লিকাও সরল বিশ্বাসে দিনের পর দিন নিঃশব্দে জলের তোড়ে গিলত সেগুলো। কখনও কোনও প্রশ্ন করত না। আসলে বাঙালি মেযো কখনওই স্বামীর সামনে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে না। দৃঢ় গলায় কোনও কিছুর সদর্থক কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এই চিরকালীন ব্যর্থতাই হয়তো কালের নিষ্ঠুর নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে।

এই অনাড়ম্বর জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই রজতের। তাই সে আবারও প্রেমে পড়েছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যবারের থেকে একটু অন্যরকম। কথা বলতে বলতে সেই সুতোর জটে সে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার থেকে বেরোনোর উপায় পাচ্ছে না। সে বেরোতে চায়ও না। বরং আরও প্রবল ভাবে নিজেকে সেই জটের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চায়। সংসার সুতোয় গিঁট দিতে চায়। অতঃপর, মধুরিমার সম্মতি চাই। তাই আবারও মুষ্টিভিক্ষা করে, তুমি কি আমার হবে মধুরিমা?

সম্ভব?

জীবনটা বড়ো বিষাদ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস।

বেশ, তবে দেখা কোরো।

বলো। কোথায় আসতে হবে?

কাল, পার্ক হোটেলে। বাকি ডিটেলস কাল সকালে আমি তোমাকে সেন্ড করে দেব।

ওকে!

মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সবকিছুই যেন নিমেষে রঙিন হয়ে গেছে রজতের কাছে। পাথুরে মাটিতে আবার জলীয় স্পর্শে ঘাস গজিয়েছে। কাল সে অনেকগুলো গোলাপ নিয়ে যাবে মধুরিমার জন্য। ভালো করে দেখতে পাবে ওর মুখটা। না জানি, সে কতই না সুন্দর হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে রজতের।

পরদিন সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে, প্রায় দশটা বাজতে যায়। চটপট করে ব্রেকফাস্ট সেরে মোবাইল খুলে দেখে, মধুরিমা অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে। দেরি না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।

আজ রজত অনেকটা পারফিউম দিয়েছে। তার এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। কোনও দিনও খুলে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ প্রয়োজন পড়ল।

এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল পার্ক হোটেলে। তারপর রিসেপশনে ফরম্যালিটিস কমপ্লিট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দুশো বাহাত্তর নম্বর রুম। সেখানেই অপেক্ষা করছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত সুন্দরী।

ঘরের সামনে এসে আলতো করে নক করে রজত। আপাদমস্তক কালো ওড়নাতে ঢাকা একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। সম্মোহিতের মতো কোনও অজানা স্নায়বিক নির্দেশনায় ঘরে ঢুকে আসে রজত। বসে পড়ে সোফার উপর। প্রশ্ন করে, তুমিই মধুরিমা?

ইঙ্গিতে উত্তর আসে, হ্যাঁ!

এখনও কি নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে?

ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে একটা মদের গেলাস বাড়িয়ে দেয় রজতের দিকে। বশীভূতের মতো সেটা হাতে নিয়ে একচুমুকে শেষ করে ফেলে সে। এভাবে পরপর তিনবার। রজতের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সোফার উপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, কালো ওড়নাটা সরিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা। বিস্ফারিত দৃষ্টি, যেন আগুন ঝরছে সমস্ত দেহটা থেকে!

চিত্কার করে বলে ওঠে, কেন এরকম করলে তুমি বলো? আমাকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন একের পর এক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে গেলে? একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না? কত সম্মান করেছিলাম তোমাকে। আমার ভগবান ভাবতাম।

সেদিন যখন তুমি ফোনটা ভুল করে আমার ঘরে রেখে চলে গেছিলে, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তুমি আমায় এতদিন যে-ওষুধগুলো খাইয়ে, ওগুলো কোনও সুস্থ মানুষের সেবনযোগ্য নয়। ওই ড্রাগসগুলো নিলে যে-কোনও সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে।

অ্যাকচুয়ালি, তুমি আমাকে বদ্ধ পাগল বানিয়ে রাখতেই চেয়েছিলে! যাতে বাইরের দুনিয়ার সামনে কখনও আমাকে না নিয়ে যেতে হয়, আর তুমি নিজের মতো করে স্বেচ্ছাধীন জীবনযাপন করতে পারো, ইচ্ছামতো নারীসঙ্গে বুঁদ হতে পারো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেব না মি. রজত সান্যাল! কারণ আসল মনের অসুখ তো তোমার, অসুস্থ তুমি! উন্মাদ তুমি, নাহলে এভাবে একের পর এক নারীসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারো না। বিকৃত মানসিকতাও একপ্রকার ভয়ংকর অসুখ, যার একমাত্র ওষুধ মৃত্যু!

রজত মল্লিকার হাত দুটো আটকাতে যায়। কিন্তু পারে না। শরীর ইতিমধ্যেই অবশ হয়ে গেছে। মল্লিকা হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সেই শেষের মুহূর্তটা আসতে আর কিছুক্ষণ মাত্র বাকি!

যে যেখানে দাঁড়িয়ে

সরাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সহেলি। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা কাক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে। আজ যে সহেলির কী হল কে জানে। শুধু কি আজ? নাকি প্রতিদিন?

মা, ও মা। আজ তো পঞ্চমী। আজই ঠাকুর চলে আসবে। কাল বিকেল থেকে নো এন্ট্রি। তাহলে কিন্তু এগারোটার পর বাবার স্কুটারে… তুমি তো ধ্যারধ্যারে স্কুটারে যেতে চাও না। উঁহু যেতে হবে কিন্তু।

আহা, তোমার পড়া নেই নাকি বিট্টু? পড়াশোনা না করলে বাবার তবু সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটার জুটেছে, তোমার ভাঙা সাইকেলও জুটবে না। যাও পড়তে বসো।

ও মা তুমি যাবে না, তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে রিইউনিয়নে?

যাব না, পড়তে বসো। (বেশ জোর গলায় বলে)

পাশের ঘর থেকে সহেলির শাশুড়ি বলে উঠলেন, আহা বউমা কতবার বলেছি না, আমার দাদুভাইকে সকাল সকাল উঠেই বকবে না। যাও না একটু ঘুরেই এসো। দুপুরে তো সব হয়ে যায়। আমি, নিরু আছি তো নাকি।

বউমার বিছানায় বসে নলিনীদেবী বলতে থাকেন, বউমা ভাত-কাপড়ের শাড়িটা পরে যেও। ওটা তোমায় খুব মানায়।

সহেলি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, তাইতো আমার বন্ধুদের আর অত ভালো শাড়ি আছে নাকি? ওরা এত ভালো শাড়ি তো চোখেই দেখেনি। নলিনীদেবী খানিকটা সংকুচিত হয়ে বেরিয়ে যান।

 

বর্তমানে সুনীলের ব্যাবসাটা পড়তির দিকে। অভাবের সংসারে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় হাড়ভাঙা খাটুনি। সন্ধ্যার দিকে আবার সহেলির টিউশন ব্যাচ আসতে শুরু করবে। অলস ভাবে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই তোশকের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছোটো ছোটো দুটো ডেয়ারি মিল্ক। একটা চিরকুটে জড়ানো। তাতে লেখা একটা বিট্টুর আরেকটা বিট্টুর মায়ের জন্য। হ্যাপি বার্থডে।

চকোলেট দুটো নিস্পৃহ ভাবে টেবিলের পাশে তুলে রাখে। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটাতে পিক পিক শব্দে একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। কালই সুনীল নেট প্যাক ভরে দিয়েছে। অভাবের সংসার হলেও সহেলির জন্য এসব ছোটোখাটো বিলাসিতা করেই ফেলে সুনীল।

 

তৃণা: সহেলি আর শ্রুতকীর্তি আসবে তো রে।

মেঘনা: শ্রুতি তো আসবে। আর সহেলির বর সুনীলের দোকানটা তো আমাদের পাড়াতেই। ও বলেছে, বউকে পাঠাবে।

তৃণা: এখান থেকে কিন্তু সোজা টক-ঝাল-মিষ্টি-তে যাব। তারপর সিনেম্যাক্স।

ওই তো সহেলি আসছে। কি সুন্দর ছিল বল! আমাদের ফার্স্ট গার্ল। তেমন নাচ করত। গ্র‌্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট না করে, মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে, নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারল।

মলি: মুদির দোকান তো কি? আমার বর তো স্কুল টিচার ছিল। মার সহ্য করতে না পেরে তো মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

মেঘনা: ও ভাবে বলিস না। ওর বরকে আমি চিনি। খুব কেয়ারিং। খুব ভালো। আমার কর্তার থেকে তো শতগুনে ভালো।

আরে, আয় আয় সহেলি। কতদিন পর দেখলাম, একই আছিস। আমরা তো মুটিয়ে গেছি। সেই যে কাকুর বাৎসরিকে দেখেছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাকিমাও চলে গেলেন।

সহেলি: সবই আমার ভাগ্য। আমার উপর রাগ করেই… হয়তো!

মেঘনা: ছাড় তো। জানিস শ্রুতকীর্তি আসবে। কি যে সুন্দরী হয়েছে না। ওয়েল মেইনটেইন্ড। রেডিও জকি, নিউজ রিডার কত কিছু যে করছে। অর্ঘ্যদা তো মাথায় করে রেখেছে। কাল বার্থডে পার্টির পিকগুলো দেখছিলাম। যা একটা ডায়মন্ড রিং দিয়েছে না ওর বর।

তৃণা: গতবার একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট। আর আমার বর? চাকরি করি বলে, একটা পুঁতির মালাও দেয় না। এই সহেলি কিছু বল। চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ নাকি?

সহেলি: মাথাটা খুব ধরেছে রে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

 

রাজস্থানি কারুকার্য মণ্ডিত সদর দরজাটা খুলে যায়। সহেলি ঢুকে পড়ে ১৬০০ স্কোয়ার ফিটের অন্দরমহলে। এল আকৃতির বিশাল বৈঠকখানা। তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রযিংরুম, লিভিংরুম, কিচেন, বাথরুম আর ছোট্ট ব্যালকনি। পুরো ফ্ল্যাটটার ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচুর্য আর শৌখিনতা।

দুধ সাদা মার্বেল ফ্লোর, পারসি কাজের কার্পেটে মোড়ানো। বেইজ রঙের গা ডোবানো নরম গদি আঁটা সোফা। আর তাতে রয়েছে নানা রঙের কুশন। টেক্সচার ফিনিশড দেয়ালে কোথাও যামিনী রায় কোথাও বা রাজা রবিবর্মার পেইন্টিং। একটা বিশাল ওপেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। তাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক শো-পিস।

ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড়ো, সুদৃশ্য কাটলারি সেট সাজানো, মাঝখানে একটা সুদৃশ্য ঝুড়িতে রয়েছে অনেকগুলি সতেজ ফল। সহেলি একঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে বেড়ায়। শৌখিন মডিউলার কিচেন ক্যাবিনেটে সাজানো কিচেনটা দেখে, নিজের স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরটা মনে পড়ে সহেলির। বেডশিট, পর্দা, কুশনকভার, পিলোকভার এমনকী সেন্টার টেবিলের সদ্য ধোঁয়া ওঠা টি পট-এর টি কোজি… সমগ্র আপহলোস্ট্রি জুড়ে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। লাল, নীল, ফুশিয়া, গ্রাসগ্রিন, লেমন-ইযেলো।

এক একটা রং যেন মনের সব মেঘ কাটিয়ে একরাশ রোদ্দুর নিয়ে এসেছে। বাথরুম থেকে শাওয়ার-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গুনগুন করে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠের গান। সহেলি ধীরে ধীরে বেডরুমের দিকে এগোয়। বিশাল খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিংটেবিল সাজানো। খাটের পাশে ছোট্ট বেডসাইড টেবিল। তাতে একটা ফটোস্ট্যান্ড-এ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। সুখী সুখী আদুরে ছবি। সহেলি এগিয়ে আসে। ফটোর মেযেটা খুব চেনা চেনা। তারই প্রিয় বান্ধবী শ্রুতি, ওর ছেলে ও বর।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়িটা ঢং ঢং করে ওঠে। হয়তো এক্ষুনি শ্রুতি বেরিয়ে আসবে। আর নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হবে। কোথা থেকে শুরু করবে কে জানে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে যায়। একি! এই মলিন বেশে সে কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে! কী বলবে নিজের কথা সে? না না, সে এক্ষুনি চলে যাবে। ছুটে বেরিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। হঠাৎ কে যেন পিঠে এসে হাত রাখে…

 

একি, এত বেলা অবধি শুয়ে আছো যে? তোমার শরীর কি খারাপ? সহেলি চোখ খুলে সুনীলকে দেখতে পায়। চারদিকে একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারে সে শ্রুতকীর্তির লেকটাউনের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ইন্দিরা কলোনির জীর্ণ ঘরে শুয়ে আছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সহেলি। সুনীল বলে, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো। আমি ম্যানেজ করছি। সারাদিন তো অনেক পরিশ্রম হয়।

সহেলি সুনীলের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ঠিক আছে শরীর। সুনীল উজ্জ্বল মুখে বলে যায়, আজ পাঁঠার মাংস আনলাম বহুদিন পরে, জমিয়ে রান্না করো তো। সহেলি মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সুনীল একটু দমে যায়। মনে মনে তার সহেলিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। কোথায় রাজরানি হয়ে থাকবে, তা নয়। সুনীল ওর মুখে হাসি দেখার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে কিন্তু সামর্থ্যই বা কতটুকু? সহেলির ফেলে যাওয়া স্মার্ট ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ে, শ্রুতকীর্তি সেনের ঝাঁ চকচকে প্রোফাইল।

 

আজ বারোটা থেকে আড্ডা উইথ শ্রুতকীর্তির সম্প্রচার। রেডিও মিষ্টির অন্যতম সঞ্চালিকা সে। স্বামী অর্ঘ্য সেন একটা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের উচ্চপদে আসীন। আয়নায় নিজেকে দেখে শ্রুতকীর্তি। তার গলা শুনেই কত মানুষের দিন শুরু হয়।

টিভির চ্যানেলে যখন আজ সকালের আমন্ত্রণে সঞ্চালনা করে তখন অগুনতি মানুষের কাছে ফ্যাশন ডিভা হয়ে ওঠে। বান্ধবীরা তার মতো কেরিয়ার আর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। চোখ দুটো এখনও ফোলা, তাতেই বা কি। এখনই চড়া আইলাইনার আর চড়া কাজল দিয়ে নিপুণ ভাবে ঢেকে ফেলবে, কাল রাতের সব যন্ত্রণার, সব অশ্রুর ইতিহাস। বালিশের কভারে কেউ এক ফোঁটা চোখের জলের দাগ পাবে না।

কালকের প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকী ছোট্ট রনিকেও না, ছুটে গেছে ওয়াশরুমে। চোখের জল আর শাওয়ারের জল কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে… দেয়ালে কান পাতলেও কেউ শুনতে পায়নি, এতটুকু হাহাকার! প্রতিটা দিন জলভরা চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢেকে, মেকি হাসি মেখে, মিশে গেছে হাজার হাজার স্রোতে।

 

গাড়িতে এসে এসি-টা অফ করে জানলাটা খুলে দেয় শ্রুতকীর্তি। দমকা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সামনে ফ্রিঞ্জ করে কাটা লকসগুলো উড়ছে। না আজ যেতেই হবে জল শহর। সব কাজ বাতিল হয় হোক। তিস্তা পার্কে তাদের স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন যে।

শ্রুতকীর্তি জানে, কালকের পার্টির জের চলবে আজকের তিস্তা পার্কের বন্ধুদের সমাবেশেও। তৃণা, মেঘনা ছুটে এসে বলবে, অর্ঘ্যদা কি কেয়ারিং রে। শ্রুতকীর্তিকে মিষ্টি হেসে বলতে হবে, কী যে বলিস…। বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে, তোরা কিচ্ছু জানিস না… কিচ্ছু না। অর্ঘ্য তার প্রতি কোনও দিনও কেয়ারিং নয়, ওপেন রিলেশনশিপে বিশ্বাসী তার স্বামী অর্ঘ্য।

বিয়ের পরদিনই সে জেনে গেছে, স্বামীর জীবনে তার শুধু সামাজিক অস্তিত্বটুকুই আছে। এই বিশেষ দিনটা যে, কত বঞ্চনার… কত উপেক্ষার… তা সে-ই শুধু জানে। দীর্ঘ ছয় বছরে কোনও জন্মদিনকে অর্ঘ্য উষ্ণ শুভেচ্ছা আর সান্নিধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং অর্ঘ্যের বস আর বিজনেস পার্টনারদের হই-হুল্লোড় আর উল্লাসে শ্রুতকীর্তির বিশেষ অনুভূতিগুলো দম আটকে মরেছে।

প্রতি বছরই অর্ঘ্য রিমাইন্ডারের দৌলতে অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে এটিএম কার্ড ছুড়ে দিয়েছে। আর সে-ও কলের পুতুলের মতো স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ণ রেখে একের পর এক ঈর্ষণীয় উপহার কিনেছে। প্রাচুর্য আর নিপুণ অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সব উপেক্ষাকে। বছরের পর বছর এভাবেই ব্লটিং পেপারের মতো সব অপমান শুষে নিতে নিতে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

ছন্দপতন ঘটল সেদিন, যখন সে ছুটে গিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে দ্বিতীয় মাতৃত্ব লাভের সুখবর জানাতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণী তথা নারী মুক্তির ধ্বজাধারী শাশুড়ি-মা, গর্ভপাত করার প্রস্তাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বংশের প্রদীপ রনি যখন আছেই তখন দ্বিতীয় সন্তান তাদের কাছে বাহুল্য আর দুর্ঘটনা বৈ তো নয়!

প্রথম সন্তান কন্যা হলে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রশ্ন আসত। এত বড়ো আঘাত সহ্য করতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রুতকীর্তি, আর তাতেই হিংস্র হয়ে ওঠে অমাযিক, প্রোগ্রেসিভ মুখোশের অর্ঘ্য।

মাঝে মাঝে সহেলির কথা খুব মনে পড়ে। আজ মেয়েটার জন্মদিন কেমন আছে কে জানে। তবে তার থেকে ভালো নিশ্চয়ই। মাঝে মাঝে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছে। স্বাধীন, চাকুরীরতা সে। কিন্তু পারেনি, ছোট্ট রনির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে যে ওর যে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে। আর নিজের সুখী সুখী ইমেজটা যে আজকাল বড্ড প্রিয় হয়ে উঠেছে। পৈতৃক বাড়িতে শয্যাশাযী, স্থবির মা। প্রোমোটারের উৎপাত। আর অন্যদিকে সেন পরিবারের অসীম পেশি শক্তি। লড়াইটা বেশ কঠিন। কারও সহানুভূতির পাত্রী সে হতে পারবে না, কোনও দিন।

 

সই, আমি শ্রুতি, চিনতে পারছিস?

তোর গলা চিনব না। তুই আমার নম্বর পেলি কোথায়?

আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলি? পার্স ফেলে এসেছিস? শরীর ঠিক আছে? আমি আসছি। ঠিকানাটা বল।

ইয়ে মানে… থাম থাম। তুই কোথায় বল? আমি তো বেরোবই, কাজ আছে একটা। আমিই যাচ্ছি। হ্যাঁ যাচ্ছি, কদমতলায় তো?

 

বাহ শ্রুতি, তোর ডায়মন্ড রিং-টা কি দারুণ রে। বার্থডে স্পেশাল?

বাঁ হাতের কনুই-এর কাছটা ভীষণ জ্বলছে শ্রুতকীর্তির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্ঘ্যর টাকায় কেনা আংটিটা দেখতে থাকে সহেলি। ধীরে ধীরে কুর্তির আস্তিনটা গোটায় শ্রুতকীর্তি। বেরিয়ে আসে দগদগে ক্ষতটা। মনে হয় ক্ষতটা যেন জ্বলজ্বলে হিরের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এ ক্ষত চিনেছে সহেলি। ননদ নিরু যখন ওর মাতাল স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্স কেস ফাইল করে ফিরে এল, তখন থেকেই খুব চেনা এই ক্ষত। এত কষ্ট শ্রুতিটার?

চোখের জল লুকিয়ে জোর করে হেসে বলে, শ্রুতি তোর কান্নার অভ্যাস নেই তো? কিছুক্ষণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্রুতকীর্তি বলে, প্লিজ সই কাঁদিস না আমার জন্য। আমার চোখের জল একবার বেরোলে আর থামে না রে। অনেক কষ্টে আটকে রাখি। আমি তোকে কত হিংসে করেছি জানিস। তোর সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলো করতাম। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোযে্ট পাঠাইনি।

 

কোর্ট মোড়ের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে রাকেশকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে শ্রুতকীর্তি। এদের স্যানট্রোতে আর নয়।

খোলা আকাশের নীচে একবার বুকভরে শ্বাস নিতে পেরে অদ্ভুত আরাম লাগছে। নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর ডাকের সাজের প্রতিমা দেখল সে। মা দুর্গা তো শক্তিরূপিণী।

যদি নিরু পারে, মলি পারে, তবে সেও পারবে। এখন সোজা বসু ক্লিনিক। তারপর দেশবন্ধু পাড়ায় মায়ের কাছে। মা যতই স্থবির হয়ে যাক আজ তাকে গিয়ে বলতেই হবে, সে তার সন্তানদের নিয়ে নতুন পৃথিবী গড়বে।

 

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে-বাড়ির কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সহেলি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। রাজবাড়ির মোড়ের সামনে ঠাকুর চলে এসেছে। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন মনেই বলে ওঠে, ক্ষমা করে দাও মা। আমি শ্রুতিকে হিংসে করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কখনও চাইনি। আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকতে পারি যেন। বিট্টুকে মানুষ করো আর শ্রুতিকে ভালো রেখো। ওকে শান্তি দিও।

সামনে বিডিও অফিসের দোকানে ছোট্ট সিঙ্গাড়াগুলো সুনীল খুব ভালোবাসে। দাঁড়িয়ে পড়ে সহেলি। মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে…

সেই সুরে, বাঁধন খুলে

অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে, অকারণে

ভুলে যাওয়া গানের বাণী,

ভোলা দিনের কাঁদন হাসি

ভালোবাসি, ভালোবাসি।

চলতি হওয়ার স্রোতে অনেক অবহেলা করেছে সুনীলকে! আর না। ফেরার পথে নীলিমাদেবীর মিষ্টি পান নিয়ে যেতেই হবে। আজ ওনার যে বড্ড অভিমান হয়েছে।

এমন একটা মিছিল হোক…

তিতলি শেষমেশ তুই…! আমি ভাবতে পারছি না। কেন…? কেন এসব? তিস্তার কথাগুলো অনেকটা আর্তনাদের মতোন শোনাচ্ছিল।

সিরিয়াসলি আমিও ভাবিনি বউদি। তুমি এতটা রিঅ্যাক্ট করবে। নিজের মনের ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রেখে লোকজন যে ঘরে ঘরে ক্রাইম করছে তার থেকে এটা হাজার গুন বেটার। আমি যা করি সামনাসামনি। বুঝলে? আমার কোনও কিছুই যেমন লোকদেখানো নয়, তেমন কোনও কিছুই আড়াল নয়। আমি যা, আমি তাই-ই। প্লিজ তোমাকে একটাই রিকোয়েসট তুমি কথাটা বাবা-মার কানে তুলো না। সবার প্রশ্নের গাদা গাদা উত্তর দিতে দিতে সত্যি সত্যিই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি জানো! মুখ ঘুরিয়ে বলে যাচ্ছিল তিতলি।

ওর হাতে তখনও ধরা ছিল আধপোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ছাদের ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে তিতলি সিগারেট টানছিল। আর ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে এসেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে তিস্তার।

ল্যাম্পপোস্ট আর ছাদের ঠাকুরঘর থেকে যে-হলুদ টিমটিমে আলোর রেখাগুলো ত্যারছা ভাবে পড়ছিল দেয়ালের অন্ধকার কোণায়, তাতে ধোঁয়া, আলো, অন্ধকার মেশামেশি করে একটা আলতো জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার নিচ্ছিল।

প্রশ্ন চিহ্ন তো বটেই। তিতলি আজ এতটা ফেরোশাস হয়ে উঠেছে ভাবতে তখনও কোথায় একটা বাধছিল তিস্তার। এমনটা কী সত্যি হবার ছিল? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।

মনে হচ্ছিল এইতো সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম মজুমদার বাড়িতে পা রেখেছিল তিস্তা। ওদের প্রেমের বিয়ে ঠিকই কিন্তু বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসা, আর বিয়ের পরে প্রথমবার সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে বউ হিসেবে মেলে ধরার দিনটার মধ্যে যে কতটা ফারাক, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তিস্তা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিয়ের পাত্রী হিসেবে তিস্তার সাতাশ বছর এমন কিছু ছোটো নয়। অনেকে তো এই বয়সে প্রথম মা-ই হয়ে যায়। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়লে আজও একটা চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধে বুকের ভীতু তুলতুলে জায়গাটায়।

চৌকাঠে পা দিতে না দিতেই বরেরবাড়ি সমেত গোটা পাড়া অন্ধকার হয়ে গেছিল; হুলুস্থুল কাণ্ড। অপয়া অপবাদের অদৃশ্য খাঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়কের খুড়তুতো, পিসতুতো সবকটা বোন ওই অন্ধকারেই যারপরনাই টাকাপয়সার ক্লেম করতে শুরু করে দিয়েছিল। গুরুজনদের বাঁকা চোখে নতুন বউয়ের দিকে তাকানো আর বোনদের ঠিকঠাক টাকা না পাওয়ায় মন কষাকষির তেমনই একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে তিস্তার চোখের জল মুছিয়েছিল তিতলি। ঠিক যেন ছোট্ট একটা প্রজাপতিই বটে; কত বয়স হবে তখন ওর। এই তেরো-চোদ্দো বছর। দিব্যি হেসেখেলে গল্প করে মন ভুলিয়ে দিয়েছিল তিস্তার। মামাতো একমাত্র বোন হলেও সায়কের বাকি বোনেদের সঙ্গে জোট বেঁধে দাদার পকেট কাটার দিকে যায়নি সে। বরং বউদির দুঃখু দুঃখু মুখ দেখে হাসিমুখে ম্যানেজ করেছিল সবটা।

পাড়াপড়শির, ঘরের লোকের কথার খোঁচা, এমনকী সায়কের সামান্য বেসরকারি অফিসে চাকরি জানা সত্ত্বেও বাকি বোনেদের জোরাজুরিকে বিরক্তির চোখেই দেখেছিল ছোট্ট ননদ তিতলি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই ননদকে দিনে দিনে নিজের বোন বলেই মনে হয়েছিল তিস্তার। একটু একটু করে হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজবে জেনেও ছিল তিতলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরি করতে চায়। পড়তে চায় ওর প্রিয় বউদির মতো সাহিত্য নিয়ে। মিষ্টি একটা ভালোলাগা ডানা ঝাপটে উঠেছিল তিস্তার বুকের মধ্যেও। মন বলেছিল, কেউ তো এখনও আছে, যে অন্তত বাংলা বিষয় নিয়ে পড়াকে কোনও উপায় নেই তাই পড়ছে, এমনটা মনে করে না।

কী গো তুমি এখনও ছাদে? করছটা কী? কখন থেকে পিসাই এসে বসে। তোমার হাতের চা চাইছে। সায়কের গলায় চমকে উঠে তিস্তা সিঁড়ির দরজার কাছে সরে গেছিল। না দেখলেও বুঝতে পারছিল ছাদের কার্নিশ টপকে একটা হলুদ আগুন পাশের জঙ্গুলে জমিটায় ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

যাচ্ছি যাচ্ছি। তুমি হঠাৎ ওপরে উঠে এলে কেন? আমি নামছি।

তিতলি কোথায়? ছাদে না? একটা হরর মুভি ডাউনলোড করেছি। কখন থেকে একসঙ্গে দেখব ভাবছি। ম্যাডামের দেখাই নেই।

তিতলি তাড়াতাড়ি নীচে আয়। মুভি দেখবি। বলে তিস্তা প্রায় জোর করেই সায়ককে নিয়ে নীচে একতলায় চলে আসে। বলা যায় না যা রাগ সায়কের। একেই কলকাতায় ওই দলবাজির কলেজটা দুচক্ষে দেখতে পারে না সায়ক। তার ওপর তার নিজের বোন এসব নেশা করছে বিন্দুমাত্র জানতে পারলে, হয়তো সারাজীবনের জন্যই কথা বন্ধ করে দেবে তিতলির সঙ্গে। জানে সব রাগটা গিয়ে পড়বে তিতলির ওপর। কারণ নিজের বাড়ি শক্তিনগরের মতো মফস্সলে রীতিমতো ভালো গভর্নমেন্ট কলেজে চান্স পেয়ে, তিতলি একটা বছর নষ্ট করে অনেকটা নিজের জেদেই কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছে। এখানে নিজের পিসির বাড়ি থাকলেও রয়েছে কলেজেরই কাছাকাছি কোনও একটা মেস-এ। তাছাড়া রয়েছে আরও নানা কারণ।

চোখে আঙুল দিয়ে যেটা দেখা যায় সেটা হল তিতলির স্বাধীনতা। তার অবাধ বাঁধনছাড়া অগ্রাহ্য করার একটা ইমম্যাচিওর মন।

 

তোর দাদা কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে তিতলি। এখানে এলে…।

সেটাই করতে হবে। এখানে আসাটাই বন্ধ করে দিতে হবে।

আমি কি তাই বলেছি তিতলি? তোর দাদা কিছু একটা আন্দাজ করেছে, মানুষটাকে তো আমি চিনি। আমাকে কী বলছিল জানিস রাতে? বলছিল, ঠিক মনে পড়ছে না দাদু মারা যাওয়ার আগে তিতলিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিল জানো? কিছু না হলেও কবিতার শেষ একটা লাইন আজও মনে আছে আমার, জানলা দিয়ে তিতলিটা ওই খিলখিলিয়ে হাসে। আর ডায়ারির পাতা থেকে সেটাকে বেছেই সবাই ওর এই নাম দিয়েছিল।

উফ্ বউদি তুমি না সাংঘাতিক সেন্টু দাও। সত্যি এত ইমোশন রাখো কোথায়? আমি যতদূর জানি পিছন ফিরলেই সবাই তোমার সেন্টুর গাঁ…। উপ্স সরি সরি…। চোখ মুটকে তিস্তার সামনে ছদ্ম লজ্জার অভিনয় করে তিতলি।

এসব ছাড়। যেটা বলব বলব করেও তোকে বলা হচ্ছিল না, শক্তিনগর থাকতে ওই যে ছেলেটা কী নাম যেন…।

বিতান…।

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা করিস এখন? কথা হয়?

অত ঘুরিয়ে বলার কী আছে? পোঁদে লাথ মেরেছি। বড্ড ঘ্যানঘ্যান করত। একটু কাছাকাছি ছিলাম বলেই ওর সম্পত্তি আমি? তা তো নয়। তাছাড়া কলকাতায় এসে পড়াটা, চাকরি করাটা, আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যেখানে আমার বাবা-মা সায় দিয়েছে সেখানে এলিতেলি হায়দার আলি, ও কে…?

কিন্তু তুই যে তখন বলেছিলিস ও তোকে…।

চু চু চু মুখ দিয়ে আওয়াজ করে তিতলি। তুমিও না বউদি…। সবাইকেই নিজের মতো ইমোশনের ফুল ট্যাংকার ভাবো। ছাড়ো তো। শোনো তবে কেউ পার করে দেবে না আমায়,

সময় আছে এখনও

চলো নতুন করে কাঁটাঝোপে পা ফেলি একবার…।

কবিতার লাইন বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা সিগারেটের প্যাকেট পকেটে পুরে তিতলি মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়!

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তিস্তা। একদম… একদম পালটে গেছে তিতলি। ওর ইনোসেন্সগুলো কোথায় যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। তিতলির এখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই বাংলা সেই সাহিত্য ভালোবেসে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখা মেযেরা এখন নাকি কলেজের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মিছিলে হাঁটছে। অনশন করছে।

রাজনীতি কী? রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? জানে না তিস্তা। সত্যি কথা বলতে কী জানতেও চায় না। তবে এটা জানে রাজনীতির রং দলভেদে পালটায় না; রাজনীতির একটাই রং স্বার্থ।

কেন জানে না আপনা আপনি মনটায় একটা খারাপ লাগার বুড়বুড়ি কাটছিল।

নিজের বোনের মতো ওর মাথায় হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করছিল, এই স্বার্থপর সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তিতলির একটা পরিচয় হোক। আর কিছু না।

 

খবরটা এত তাড়াতাড়ি এভাবে আসবে ভাবতেই পারেনি তিস্তা। তখনই ওলা বুক করে ছুটে গেছিল মামা শ্বশুরের বাড়িতে। সারাজীবনের সেই চরম অপবাদ অপয়া মাথায় করে নিয়ে নেহাত নির্লজ্জের মতো উস্কোখুস্কো চুলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিতলিদের বাড়িতে। নাহ্ কেউ কোনও আপ্যায়ন করেনি। সেটা যে তার প্রাপ্য হবে না, সেটাও জানত। কারণ শ্বশুরবাড়ির প্রথম দিনে সে পা রাখতেই আলো নেভা, সায়কের হাজার একটা পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও, সরকারি চাকরি না পাওয়া আর শেষমেশ তিতলির…।

প্লিজ প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। একদম ভালো লাগছে না।

কিন্তু তিতলি…।

তোমাদের কোনও ঝামেলা হবে না বলছি তো! আমি তো সবটা মিটিয়ে এসেছি।

তোর শরীরটা …।

আমার শরীর ঠিক আছে বউদি। এত কষ্ট পেও না। আমি ঠিকই আছি। আজ নতুন কিছু না। আমরা প্রায়ই মেলামেশা করতাম। কোনও কিছুই জোর করে হয়নি।

তিতলি তোর এখন সবে ২৪, আর এই বয়সে বাচ্চা নষ্ট?

আচ্ছা বউদি এটা ধরে নিতে বাধা কোথায়? আমি ছেলেতেও খুশি নই, মেয়েতেও নই, আর যদি বা হিজড়া হতো তাকে সমাজছাড়া করার আগেই সাহস দেখিয়ে তড়িঘড়ি শরীর থেকেই খসিয়ে দিলাম। হ্যাঁ তোমরা অবশ্য এর নাম নষ্টা, বেশ্যা দিতেই পার। তোমরা বড়ো। এসবের লাইসেন্স তোমাদের আছে।

তবে আমি কিনা একটু অন্য ধাঁচের, এসব গায়ে মাখি না। আবার তোমার মতো লুকিয়ে কাঁদবও না। বরং সমাজের পাঁক থেকে তুলে আনব পদ্মফুল। সেই সময় এসে গেছে বউদি। সবার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালটা উত্তর তো দিতেই হবে। তাই না?

তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবি? ওর বাড়ি রাজি হবে তো? তোরা যে…।

হাসালে বউদি। এমন খান্ডারনি মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না। আর আমিও চাই না। এগারো মিনিটের সুখের জন্য বিয়ে করতে লাগে না। তারপর ভালো না লাগলেই কোর্ট কাছারি হ্যানা-ত্যানা। ধুত্তোরি…।

কিন্তু মামা যে বলছিল…?

ওসব ভাটের কথা। সেদিন ক্লিনিক থেকে ফিরে একটু টান্টু খেয়ে কীসব বকেছিলাম বলে ভয় পেয়ে তোমাদের জানাল। আর তুমিও… মাইরি পারও বটে…! পরশু দুপুরে আমাদের ব্রিগেডে একটা মিটিং…

তিতলি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। কিছু কথা কানে আসছিল, কিছু আসছিল না।

তিস্তা দেখছিল শেষ বিকেলের রোদ মাখা কমলা আলোটা পর্দার পাশ দিয়ে তিতলির মুখ, বুক, চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর সদ্য মা হওয়ার অস্বীকার করা অস্তিত্বকে। তিতলির স্বপ্ন অন্য রকম। অন্য রঙের। সেই স্বপ্নের রং তিস্তা চেনে না, সেই পথের বাঁকেও কোনও দিন আটকা পড়েনি সে।

তবু দিনশেষে সায়কের কাছে ফিরে যেতে যেতে ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, সমাজের যে-অন্ধকারকে আলোর পরিচয় দিতে আজ তিতলি বা তার সমবয়সিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, গলা ফাটাচ্ছে, পুলিশের লাঠি না মেনে দিনে দিনে আরও আরও বেশি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, পাঁক ঘেঁটে গল্প খুঁজে পত্রিকা সাজাচ্ছে তারা নিজেরাও কি সেই একই অন্ধকারের দোষে দোষী নয়? নাহলে তিতলির শরীরে ছোট্ট একটা ভ্রূণকে এভাবে দুহাতে অগ্রাহ্য করার…। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। আচ্ছা, চলে আসবার সময় তিতলির চোখের কোলটা কেমন যেন চিকচিকিয়ে উঠেছিল কি! নাকি সবটাই মনের ভুল…?

ওলা ক্যাবটা তিস্তার বাড়ির পথ ধরেছে। দমকা একটা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা। ঝড় উঠবে…। অন্ধকার করে এসেছে। একটা ভোঁতা শব্দ হতেই পাশ ফিরে তাকায় তিস্তা। বাইরে থেকে মথ বা প্রজাপতি জাতীয় কিছু ওলার জানলার গায়ে ক্রমাগত ফরফর করে আঘাত করছে। ও কি ভেতরে ঢুকতে চাইছে?

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। তিস্তা গাড়ির হাতল ঘুরিয়ে কাচটা নামাতে চায়। পারে না, লকটা খুব শক্ত।

কালোমেঘ চিরে শেষবারের মতো একফালি আলো আছড়ে পড়ছে শহরের রাস্তায়। নাহ্ সে আলোর কোনও রং নেই। তিস্তার মন বলছে, এ শহরের বুকে একদিন ঠিক, একদিন এমন একটা মিছিল হবে যে-মিছিলের নির্দিষ্ট কোনও রং থাকবে না, থাকবে না নির্দিষ্ট মত, মতাদর্শ। সব রং তখন মিলেমিশে যাবে। মিলেমিশে যাবে কেবল একটা… একটা মিছিলে। হাজার মানুষের সে মিছিলে একটাই জয়গান হবে। জয়গান হবে মানবতার।

 

দূরত্ব

পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু ‘পূর্ণিমা, পূর্ণিমা’। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। ‘দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

‘আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত।’ পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে।’ বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন ‘কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর ক’দিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে, পেনশনের মোটা টাকা– তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?’

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন ‘এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক।’ পূর্ণিমা চমকে উঠলেন ‘কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দু’দিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে। আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।’ ‘ব্যস– চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না।’ পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

short story
Bengali story Durotwo

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, তারা চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’কামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রী-র অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায়রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে ঞ্জবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন ‘টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর’, সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন। গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, ‘বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা’র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন ‘কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ?’ পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য।’ অবাক পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! কি হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা– টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘দাদা চুপ কর।’

‘চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?’

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো।’ পিকলু মাথা হেঁট করে পাউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।’ পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, ‘আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।’

‘মা, বাবার আজকাল কী হয়েছে?’ পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। ‘জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন ‘পূর্ণিমা, আর টাকাপয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের,’ বলে শুয়ে পড়লেন।

‘কি! আমরা বাবার টাকা নেব? ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সঙ্গে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না’, পাপু উঠে চলে গেল। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর– সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগি মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।’

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়েও হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো।’ পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, ‘কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে,’ পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, ‘বেশি আয়োজন কোরো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে।’ মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তাঁর ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। আপনি টাকা-পয়সার কথা কী যেন বলছিলেন?’ প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’ ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘কী ভেবেছ তুমি, এ ভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!’

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা কোরো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বলল ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাডাতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ঞ্জকজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ ভোরবেলায় মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দু’চোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে

নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

বাবা

কী যেন নাম বললে তোমার বাবার? ইন্দ্রনাথ মুখার্জী? স্মিত হেসে মাথা নাড়াল পত্রালি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবা মুখোপাধ্যায় লিখতেন।

ভদ্রলোক দ্রুত হাতে স্টেপল করা কাগজগুলো উলটে যাচ্ছেন। প্রায় না দেখেই খসখস খসখস করে সই করছেন প্রত্যেকটায়। দুটো ভুরুর মধ্যিখানে গভীর ভাঁজ। মনক্ষুণ্ণ হচ্ছিল পত্রালির। তার মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কশিট, অত অত নম্বর একবারও চোখ পেতে দেখছেন না এই জ্ঞানী ব্যক্তি! জীবনের প্রথম দুটো বড়ো পরীক্ষায় এলাকা এবং স্কুলের নাম খবরের কাগজে তুলেছিল পত্রালি। একটি স্থানীয় চ্যানেল তাকে নিয়ে খবরও করেছিল। লাজুক মুখে বাইট দিয়েছিলেন পত্রালির মা। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া জড়িয়ে হাসি মুখে তার বাবা বলেছিলেন, আমার মেয়ে সত্যিই আমার গর্ব! আমি নিজে শিক্ষক কিন্তু ওকে আর কতটুকু সময় পড়িয়েছি আমি?

যাক, এখন অবশ্য সবই অতীত। এইসব রেজাল্ট দেখে যদি কেউ সত্যি সত্যিই একটা চাকরি দিত পত্রালিকে! প্রতিবার চাকরির পরীক্ষায় বসার আগে এই এক ফর্মালিটি! গেজেটেড অফিসারের সই চাই। আগে দুতিনবার সুকুমারকাকুই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো তিনি না ফেরার দেশে। অগত্যা স্টেশন রোডের এই আদিত্য সাহার অ্যাপযে্টমেন্ট নিতে হয়েছে পত্রালিকে। পত্রালি এনাকে চিনত না। ভাগ্যিস তৃপ্তি যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল!

সই শেষ করে আদিত্যবাবু কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের উলটো প্রান্তে ঠেলে দিলেন। নাও, তোমার কাজ শেষ। এইবার আমি অফিসের জন্য তৈরি হই।

হাতজোড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পত্রালি বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। সকাল সকাল আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। মাফ করবেন।

আদিত্য সাহার বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রঙ্গন, জবা, নয়নতারা আরও কিছু নাম না-জানা ফুলের গাছ রয়েছে। মূল দরজা থেকে বেরিয়ে বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে একটা ফুটফুটে ছোট্ট ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল পত্রালি।

আহা রে! দেখি দেখি, তোমার লাগেনি তো বাবু?

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে ঘরের দিকে দৌড় দিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে আদিত্যবাবুর ডাক শুনতে পেল পত্রালি। এই যে শুনছ, একটু দাঁড়াও তো।

বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। চোখদুটো ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মানে প্রভাতসখা হাইস্কুলের শিক্ষক, সাড়ে তিন বছর আগে যাঁর নামে মিটু অভিযোগ উঠেছিল?

মুহূর্তেই পত্রালির মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। মনে হল তার পায়ে নীচের মাটি দুলছে। চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবী এখন আবছা। দুটো কান তরল লাভার মতো তেতে উঠেছে। যে-কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পেটের ভেতর কী যেন পাক খাচ্ছে সরীসৃপের মতো। জ্ঞান হারাতে হারাতেও মায়ে মুখটা মনে করে, আদিত্যবাবুর বাড়ির কারুকাজ করা লোহার গেটটা ধরে নিজেকে সামলে নিল পত্রালি। শান্ত আর নির্লিপ্ত সুরে বলল, হ্যাঁ, একটা সাজানো অভিযোগ।

বিশ্বাস করো কাকিমা, আমি এক বর্ণ মিথ্যে বলছি না। তুমি যখন মামকে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতে যেতে, স্যার আমাকে…! একদিন নয়, দুদিন নয়, চার-পাঁচবার এই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছি আমি। তাও স্যারের সম্মানার্থে আমি মুখ খুলিনি।

ইন্দ্রনাথবাবু কোনও কথার প্রতিবাদ করেননি। একবারও কনফ্রন্ট করার চেষ্টা করেননি। পাথরের মতো শীতল আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খোলা জানলার সামনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পত্রালির মা তখন ঘেমে নেয়ে কেঁদেকেটে একশা। মহিলা সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে হাই-প্রেশারের রোগী। থাইরয়ে, কোলেস্টেরলে আধমরা। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই ছোটাছুটি করছিলেন। বেসিনের সামনে গিয়ে ওয়াক তুলছিলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের ড্রাম টেনে আনতে যাচ্ছিলেন। চেঁচামেচি আর উত্তপ্ত আবহ দেখে পত্রালিদের পাশের বাড়ির লোকেরা উঁকি মারছিল। মিঠু কিন্তু এসব দেখেও দেখেনি। সে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছিল এক সুরে। পত্রালিদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত বিকাশকাকুর মেয়ে মিঠু। মা নেই। বাবা মদ্যপ। মুদি দোকান চালাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে প্রতি মাসে ক্লাবের ছেলেদের হাতে মারধোর খায়।

হাই স্কুল পেরিয়ে মিঠু, ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর পায়ে এসে পড়েছিল। আমাকে আপনি পড়াবেন স্যার? বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আমার। কিন্তু আমি পড়তে চাই।

পত্রালি অবাক হয়ে মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এই কি সেই মেয়ে যে, দিনের পর দিন ওদের বাড়িতে এসে না খেয়ে থাকার অজুহাত দিয়ে গোগ্রাসে লুচি, তরকারি, পরোটা, আলু কষা গিলেছে। ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর টাকায় কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর‌্যন্ত পৌঁছেছে? বাজারে বেরোলেই যার জন্য একটা চুড়িদার, একটা শাড়ি শখ করে কিনে এনে পত্রালির মা এতদিন ধরে বলে এসেছেন, থাক না। মা নেই। বাবাটা অসভ্য। ও তো আমাদের মেয়ে মতোই!

এসব যখন হচ্ছে, পত্রালি তখন কলেজের শেষ বর্ষে। তার কাছে সবটা জলের মতো পরিষ্কার। তাই মুখ লুকোনোর জায়গাটুকুও পায়নি সে। অবোধ সেজে না বোঝার ভান করতেও পারেনি। তার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েের বড়ো একটা মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে তার বাবাকে ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত করে দিচ্ছে! তাদের সাজানো-গোছানো সংসারটা চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর পত্রালির কানে তখন ভাসছে পাড়া-বেপাড়া, দুবেলা যাতায়াতের পথে ট্রেনের চার-পাঁচ নম্বর বগিতে কলেজের ছাত্রদের মুখে শোনা, মিঠুর দুষ্কর্মের কাহিনি। নোংরা মেয়েছেলে শব্দবন্ধ না জুড়ে সাধারণত ওই মেযোর নাম নেয় না কেউই।

মিঠুর শরীরের ভাষা লক্ষ লক্ষ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল পত্রালিকে। মিথ্যে বলতে গিয়ে অতি দক্ষ মানুষও কিন্তু ভাবার জন্য, বানানোর জন্য একবার থমকায়। পত্রালি একবারও বাবার সামনে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ায়নি। তার মনের কোণে কোথাও সেই ইচ্ছেটাই আসেনি। কারণ সে জানত, ওই জঘন্য কাজ ইন্দ্রনাথবাবু কিছুতেই করেননি। তার বাবা কোনও দিন কোনও ছাত্রছাত্রীকে তার থেকে আলাদা চোখে দেখেননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পত্রালি দেখেছে, ইন্দ্রনাথবাবু সন্তানজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগলাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ মুখার্জী একজন আদর্শ শিক্ষক। আজও পত্রালি সে কথা মানে।

রিটায়ারমেন্টের তিনদিন আগের ওই প্রবল ধাক্কাটা ইন্দ্রনাথবাবু সামলাতে পারেননি। অসৎ হয়তো চাপে পড়ে আত্মহত্যা করে, কিন্তু সৎ তো মহাকালের কাছ থেকে করুণার বদলে মৃতু্য চেয়ে নিতে পারে। মিঠু চলে যেতে তিনি পড়ার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন। পত্রালির মায়ে তখন পাগলপারা অবস্থা। বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়েছে। বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন পত্রালির মাকে। মহিলার মানসিক দিকটা সেই থেকেই ক্ষতবিক্ষত। পত্রালির মা এখন একটা কচি শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন। খাইয়ে না দিলে খাবেন না। চান করবেন না। সারাদিন গুম মেরে বসে থাকবেন। মাঝে মাঝে কাঁদবেন। পত্রালি যখন আদর করে দুহাত বাড়িয়ে ডাকবে, তখন এমন করে স্থূল শরীর নিয়ে থপথপিয়ে ছুটে আসবেন, যেন প্রাইমারি স্কুলের কোনও ছোট্ট বাচ্চা!

মিঠুর ওই কাণ্ডের পরদিন সকালেও ইন্দ্রনাথবাবু নিজে থেকে বাইরে বেরোননি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হব হব। সন্দেহ তখন শীর্ষে। ঘরের দরজায় একের পর ধাক্কা মেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছিল পত্রালি। একদিকে অসুস্থ মা। আর একদিকে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে যাওয়া একটা শরীর, ভালোবাসার ভালো লাগার ছোঁওয়া, শখানেক ডাকনাম, হাত ধরে ধরে হাঁটতে শেখানো লম্বাটে আঙুল আর অসীম স্নেহধারার অধিকারী তার বাবা। মামা, মামি, দূর সম্পর্কের দাদারা বুড়ি ছোঁওয়ার মতো ছুঁয়ে গিয়েছিল পত্রালিকে। অবশ্য মামার আবেগ বরাবরই একটু বেশি। তাই হয়তো দাদুর উইল অনুযাযী কিছু চাষ জমির ভাগ পেয়েছেন পত্রালির মা।

ইন্দ্রনাথবাবুর কর্মস্থল খালি করে ছুটে এসেছিলেন সহকর্মীরা। স্কুলের খোলা ময়দানে বাবার মরদেহ আগলে মাথা নীচু করে বসতে হয়েছিল পত্রালিকে। কারণ বেলা বাড়তে মিটু ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল যত্রতত্র, মফস্সলের আনাচে-কানাচে। তবে ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে ইমেজ নষ্ট হয়নি। মাস ছয়ে যেতে না যেতেই আবার এক মাঝবয়সি লোককে ফাঁসাতে গিয়ে মিঠু নিজেই একটা ঘূর্ণির ভেতর তলিয়ে যায়।

আপনার সঙ্গে কথা বলে আমরা সত্যিই ইমপ্রেসড। আপনার রিটেন পরীক্ষার মার্কসও তো বেশ ভালো।

বেশ প্রশংসা নিয়ে পত্রালির মুখের দিকে তাকালেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখ্য প্রশ্নকর্তা। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিহিত চারজন জাঁদরেল অফিসার সামনেই বসে রয়েছেন। পত্রালি নম্র ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাল, অনেক ধন্যবাদ স্যার, থ্যাংক ইউ।

তবে একটা শেষ জিজ্ঞাস্য আছে আমাদের। আপনার বয়স তো খুবই কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। প্রশাসনিক পদের চারপাশে লোভ কীভাবে ধূর্ত শ্বাপদের মতো ওঁত পেতে থাকে জানেন তো? যদি কোনও দিন পা পিছলে যায়, ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন, কী করবেন?

একে অন্যের সঙ্গে চোখ চাওয়াচায়ি করছেন অফিসাররা। স্মিত হাসল পত্রালি। তারপর সরাসরি প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক অথচ সৌম্য গলায় জবাব দিল, আদর্শ আর প্রলোভনের মধ্যে থেকে আমি আদর্শকেই বেছে নেব স্যার। কারণ আমার আদর্শ হলেন আমার বাবা। কোনও মূল্যে আমি তাঁকে হারতে দিতে পারব না।

স্বীকারোক্তি

ডা. চ্যাটার্জি বললেন, এটা নিশ্চয়ই আপনার সবসময় হয় না?

টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও, অর্পণের চোখ মোটেও ডা. চ্যাটার্জির উপর ছিল না। বরং তার দৃষ্টি ছিল ঘরের দেয়াল ঘড়ি, মানুষের ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি, একটা ক্যালেন্ডার বা ওর রিভলভিং-এর একটু উপরে একটা এসির উপর। জায়গাটা চেম্বার আর কর্পোরেট অফিসের এক মিশ্রণ মনে হচ্ছিল।

মুখ ফিরিয়ে এবার বলল, একেবারেই না। হয়তো মনের কোথাও থাকে অনুভূতিটা। কিন্তু তীব্র ভাবে জেগে ওঠে, যখন ও আমার কাছাকাছি থাকে। যেমন ধরুন, খাবার টেবিলে। আমার কাছাকাছি বসে খাচ্ছে বা আমার বাইকে। বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

আর কোথাও? টেবিলের উপর দুটো কনুই তুলে, হাতের উপর কায়দা করে নিজের চিবুক রাখলেন ডা. চ্যাটার্জি। ফরসা মুখ আর হালফ্যাশনের চশমায় মুখে আগ্রহের রেখা।

না, সবচেয়ে বেশি হয়, গলা এক স্কেল নামিয়ে বলল অর্পণ, যখন আমরা বিছানা শেয়ার করি।

তখন কোনও সমস্যা? মানে, প্রসেসটা চলার সময় আপনার কোনও অনুভূতি?

ঘরে কেউ নেই। তাও বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ডা. চ্যাটার্জির চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভাসা সুরে বলল, প্রবলেম মানে, ব্যাপারটার মধ্যে যেন একশো শতাংশ থাকতে পারি না। একটা নতুন বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আর সে জন্যেই তো আপনার কাছে…

আসলে, কাউন্সেলিং-এর পরিভাষায় এটাও এক ধরনের ডবল পার্সোনালিটি। এই স্টেজটাকে আমরা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজির মধ্যে রাখলেও, আমরা বুঝি নর্মাল আর অ্যাবনর্মাল-এর মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা প্রায় অসম্ভব, ডা. চ্যাটার্জির কাউন্সেলিং সত্তা জেগে উঠেছে।

অর্পণের মনে হচ্ছিল, উনি একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন এগোনোর। মন বলছিল, আরও প্রশ্ন ভেসে আসবে। সেটাই স্বাভাবিক। উত্তর তো দিতেই হবে। না হলে সমাধান মিলবে কেমন করে।

আসলে, সত্যিটা এটাই। আবার বলতে শুরু করেছেন উনি, আমরা যতই বলি, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার তা কিন্তু নয়। কিছু স্মৃতি অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি থাকলেও, ভীষণ সতেজ থাকে। মানে, আমরা ভিতর থেকে, অবচেতন মনে তার থেকে ডিট্যাচড্ হতে চাই না।

চেম্বারের ভেতরের নিস্তব্ধ হিম পরশে আর ডা. চ্যাটার্জির নরম সাহচর্যে ইতিমধ্যেই অশান্ত ভাবটা কমতে শুরু করেছিল। স্বস্তি নেমে আসছিল। অর্ণব অফিস কলিগ হলেও ইনটিমেট ফ্রেন্ড। ডা. সৌম্যশেখর চ্যাটার্জির নাম সাজেস্ট করে বলেছিল, ওনাকে সব বলতে পারবি। ওনার সমাধান একেবারেই অফবিট। পেশাদারিত্বর সঙ্গে গোপনীয়তাও দারুণ বজায় রাখেন। জাস্ট চেক করে দেখতে এসেছিল। নির্ভরতাটা তৈরি হচ্ছে। শ্রদ্ধা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সমাধান আছে নিশ্চই?

অবশ্যই আছে। আই গ্যারান্টি। বন্ধুর মতো, নিজের মতো করে আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে এই টেকনিকটাকে আমরা বলি, ফ্রি অ্যাসোসিয়েন অবাধ অনুষঙ্গ। এতে আপনি অনেকটা হালকা বোধ করবেন। আর সমাধানটা অনেক মাইনর ব্যাপার। জাস্ট একটা উপসংহার টানার মতো।

থমকাল অর্পণ। এখনও পর্যন্ত ডা. চ্যাটার্জির সঙ্গে এই অ্যাপযে্টমেন্টের বেশ কয়েটা ধাপে প্রথমে থেমে, তারপর এগোতে হয়েছে। সুতো ছাড়ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে। সমস্যা নিয়ে একজন কাউন্সেলর-এর পরামর্শ নিতে আসা। লাজুক ভাব আর হাসির মোটামুটি ব্যালেন্স যেমন অফিসে করে, সেরকম ভাবে বলল, আসলে, এ রকম অ্যাফেয়ার তো আজকের যুগে সবারই একটা-দুটো থাকে। পাসিং অ্যাফেয়ারের মতো। তা পেরিয়ে সবাই চলেও যায়। বিবাহিত জীবন শুরুও হয়ে যায় জমাটি ভাবে। আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগেরই কাহিনি অনেকটা এ রকমই।

একদম ঠিক বলেছেন। তবে ঘটনার রেখাপাত সবার মনে একরকম ভাবে হয় না। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মনের আলাদা আলাদা স্তর।

অর্পণকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র আর শিক্ষিত মনে হয় বলেই কি শুরু থেকেই ডা. চ্যাটার্জি এতটা টেকনিক্যাল স্বর বজায় রাখছেন? হতেও পারে। বেশ কিছুটা বাতাস বুকে ভরে নিয়ে অর্পণ বলল, যে-সমাধান আপনি দেবেন, তাতে কি মনের ভারি ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে কি আর রেজাল্ট পাবেন, মি. মিত্র? কিন্তু রেজাল্ট আসে। আর সে চেঞ্জ আপনি বুঝতে পারবেন আপনা থেকেই।

ফিল-গুড ভাবটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে। বুঝতেও পারছে অর্পণ। প্রথমে ভেবেছিল, কোনও জ্যোতিষের কাছে যাবে। টিভি খুললেই তিন মিনিটে কালসর্পদোষ, ব্যাংদোষ, টিকটিকিদোষ কাটানো হয়। স্ক্রিনের নীচের ফোন নাম্বারে ফোন করলেই এদের চেম্বারে। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য এদের হাতের মুঠোয়। জ্যোতিষির ডিগ্রিতে সব এক একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী আর ত্রিকালজ্ঞ। অর্ণবকে বলতেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, কাউকে বলিস না, অ্যাড এজেন্সিতে এই পদে চাকরি করিস। বিজ্ঞাপন এখন তোকেই টুপি পরাচ্ছে! ভাবতে পারি না।

তখন আর কথা এগোয়নি। এখন মনে হচ্ছে অর্ণবের কথা শুনে একদম ঠিক করেছে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বলল, ওকে। কিন্তু সলিউশনটা কী?

কিছু না। ছোট্ট একটা কনফেশন।

কনফেশন! কার কাছে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে অর্পণের।

হেসে ফেলেছেন ডা. চ্যাটার্জি। নট সো ফাস্ট। কারও-র কাছে না। নিজের কাছে। কেউ থাকবেও না।

মানে?

খুব সহজ মি. মিত্র। নিজের ভেতরে যদি কোনও পাপবোধ থেকেও থাকে, তা খুঁড়ে, তুলে ফেলে দিন স্ট্রেট…

সেটাই তো বলছি। মানে…

দেখুন, আপনি নিশ্চয় চার্চে কনফেশন বক্স দেখেছেন।

হুঁ….

উলটো প্রান্তে একজন পাদরি বসে থাকেন। কিন্তু তাঁর কাজ হল শুধু শুনে যাওয়া। অনেকেই বলে, তা করে তারা রিলিফ পেয়েছে।

তাহলে কি চার্চে, বিভ্রান্ত লাগছে অর্পণের।

না, না। আসলে নিজের ভেতরের কথাগুলো আপনি কোনও দিন কাউকে পুরোটা বলেননি। সেটাই নিজে এবার একটা কাগজে পুরো লিখে ফেলুন।

এক মিনিট। আপনাকে তো…

সরি, মি. মিত্র, আমাকেও আপনি পুরোটা বলেননি। ইনফ্যাক্ট বলতে পারছেন না। তাই বলছি, লিখে ফেলুন পুরোটা।

হ্যাঁ, তারপর?

সিম্পল। কোনও ভরা পূর্ণিমার রাতে, যখন কেউ দেখছে না সেটাকেই কুচিয়ে টুকরো করে চোখের সামনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিন। এ টুকুই। দেখবেন, অনেকটা রিলিভড হয়ে যাবেন।

সত্যি কি এটা হতে পারে? এর কোনও সাযে্নটিফিক জাস্টিফিকেশনই তো নেই।

সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের সব সলিউশন, বিজ্ঞান মেনে হয় না মি. মিত্র। একবার ট্রাই করুন শুধু। ডা. চ্যাটার্জি হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়েছেন। টলে যাওয়া বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অর্পণ, কিন্তু মুন লাইটই কেন?

মুন ইজ আ লাভ সিম্বল। চাঁদের আলোর একটা ম্যাজিকাল পাওয়ার আছে।

ওকে, কবে করতে বলছেন এটা? কাল বাদ পরশুই কিন্তু পূর্ণিমা আছে। মোবাইল খুলে বং ক্যালেন্ডার-এ ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছে অর্পণ।

দুচোখ বুজে কী যেন ভাবলেন ডা. চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, পরে করতে গেলে আবার বেশ কিছুদিনের অপেক্ষা। কামিং ডেটটাই কাজে লাগান।

একটা কথা, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল অর্পণ, বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা বেশ সিক্রেট। এটা নিশ্চয়ই ডিসক্লোজ হবে না কোনও ভাবেই?

শুনুন মি. মিত্র, কোনও কাউন্সেলরই এক জন পেশেন্ট-এর কেস হিস্ট্রি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

থ্যাংক ইউ। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনে অর্পণ।

 

তোফা দুপুরের ঘুমের পরও আলিস্যি ভাবটা ছেড়ে যাচ্ছিল না। রোববার মানেই শেষ তিন মাসে পাতলা খাসির মাংসের ঝোল আর ভাত। শেষ পাতে একটু টক দই। ঘুম ঘুম ভাবটা খাবার টেবিলেই ফিল করে অর্পণ। নতুন ফ্ল্যাট-এর ইএমআই-এর সময় যত এগিয়ে গেছে, তত বেশি করে এই অলস ভাবটা ঘিরে ধরেছে। উত্তরপাড়ায় জিটি রোড গঙ্গার কোল ঘেঁসে এই ফ্ল্যাট। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল। সে সময় ওর বয়স আঠাশ। কোম্পানি চেঞ্জ করে বহুজাতিকে যোগদান করে, ডিজাইনার হিসেবে তখনই ঈর্ষণীয় পে-স্কেলে চলে গিয়েছিল। আর এখন তো উন্নতির চরমসীমায়।

অ্যাড-এর ফিল্ডে অর্পণ মিত্রকে সমস্ত ক্লাযে্নট এক ডাকে চেনে। গ্র‌্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র‌্যাজুয়েশন না করে স্পেশালাইজড কোর্স করতে গোঘাট থেকে সোজা কলকাতায়। একেবারে রেসিডেন্সিয়াল। দুবছর পর ক্যাম্পাস থেকেই একটা মোটামুটি কোম্পানিতে। দেশের বাড়িতে আর ফিরলই না। বছর তিনেক গড়িয়াতে দুজনের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকা। গোঘাটে দাদার সংসারে বাবা-মা থাকলেও, বেশ কয়েবার কাটিয়ে গেছে এখানে।

ঘরে ঢুকে বক্স খাটের পাশের ড্রয়ারের উপরে বিকেলের চা রাখল ঐশিকি। এই তিনমাসে দুপুরে অন্তত ছুটির দিনে তাকে ঘুমোতে দেখেনি অর্পণ। প্রচণ্ড হেলথ কনশাস বলেই কি ঘুমোয় না! তিন মাসের নব বিবাহিত জীবনে, এখনও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। চায়ের গন্ধের সঙ্গে ঐশিকির লম্বা চুলের শ্যাম্পুর গন্ধটাও মিশে যাচ্ছে। একটা ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলেও এখনই কাছে টানাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

সদ্য ঘুমিয়ে উঠেছে। বাসি গন্ধ, মাথা চাড়া দিল যেন। উঠে বসে চা বিছানায় নিল। খোলা ব্যালকনিতে চলে গেছে ঐশিকি। এ সময়টায় ওর বাড়ি থেকে মা বা বাবা কেউ একজন ফোন করে। চোখ সরিয়ে রাখল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। পুরুষ্ট গোঁফে আর একটু বেড়ে ওঠা ভুঁড়িতে, সুখের ঝলক নাকি স্বামী হয়ে ওঠার আদল প্রকাশ পাচ্ছে!

চা খেয়ে আলিস্যি ভাবটা যাচ্ছে না। আজ রাতে কী করবে ভাবতেই বুকে শান্তির হাওয়া। একটা বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া।

চা শেষ করে চিত হয়ে শুল অর্পণ। স্যান্ডো গেঞ্জিটা উঠে গেছিল। নামিয়ে নিল পাজামার উপর ঠিক ঠাক। সুখের উড়ানকে সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছে। এমনকী সুদেষ্ণার সঙ্গে কাটানো সময়ে তো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল বা কলেজে কারও-র সঙ্গে ক্রাশ হয়নি। প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটে যখন এসে বলেছিল, রীতিমতো মুখ টিপে হাসাহাসি হয়েছিল। হোস্টেলে অলক বলেছিল, তোরা মফস্সল বা একটু ভিতর দিকের ছেলেরা কেমন যেন একটু বাড়তি চাপা প্রকৃতির হোস। গ্রাম শব্দটা যেন ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া।

ভ্রূ কুঁচকে অর্পণ বলেছিল, আর তোরা সিটির লোকেরা সত্যি কথা বলে যে ডিক্সনারিতে কিছু হয়, তা বোধহয় বিশ্বাসই করিস না।

অলক চোখ গোল্লা করে বলেছিল, তুই কিন্তু অন্যরকম। আগ লাগা দেগা তু।

তো আগুনই লেগেছিল। সে আগুন যে কী কী পোড়ায়, বুঝতে সময় লাগেনি। ইনফরমাল কমিউনিকেশনের চতুর্থ ক্লাসেই চোখ গেছিল অর্পণের। হ্যাঁ, তবে উপরের ঠোঁটের এক সেমি উপরের তিলটায়। পাশের ডেস্কে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছিল বলে অলক এক সময়ে ফিসফিসিয়ে বলেও ছিল, পুরো ম্যাডোনা তো রে। ঠোঁটে হাসি চলে এসেছিল।

ক্লাস শেষ করেই সিনেমাটোগ্রাফিক বিস্ফোরণ। তবে ম্যাডোনা না, সুচিত্রা সেন টাইপ। এগিয়ে এসে একেবারে মিসাইল, সোজাসুজি কারও-র সম্পর্কে কিছু বলতে না পারাটা হিপোক্রেসি। বুঝতে পারছিস?

ঠোঁটে হাসিটা রেখে বলে উঠেছিল অর্পণ, ফ্যাকাল্টির সামনে তোর তিল নিয়ে আলোচনা করলে ভালো লাগত?

বাঃ! স্মার্টনেসের তো অভাব নেই।

অভাব কেন হবে। আশির দশকের কেবলু বাংলা সিনেমার নায়ক আর কোথায় পাবি এখন!

সুদেষ্ণা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলেও, অলক পিঠ চাপড়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিল, তেরা হোগা গুরু।

সত্যিই হয়েছিল এবং এগিয়ে গিয়েছিল একটু দ্রুত গতিতে। প্রথম প্রেম আর তার ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে লেকের ধার সুদেষ্ণার সঙ্গে সে সম্পর্ক এগিয়েছিল চোখের পলকে। সিনেমার হলে একই ফাউন্টেনে চুমুক, লাইব্রেরিতে স্টাডিনোট লোড করা বা গড়িয়াহাটের ফুট ধরে হাঁটা হু হু করে কেটে গেছিল দিনগুলো। একই গতিতে শেষ হয়েছিল কোর্সের বছর দুটোও।

অর্পণের মনে হয়েছিল ছেদ পড়তে এবার বাধ্য, কারণ সুদেষ্ণা বর্ধমানে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা বলছিল। ঠিক সেই সময় অর্পণের হঠাৎ চাকরি। আর সুদেষ্ণার আবার একটা স্পেশাল কোর্সে ভর্তি হওয়া।

 

চব্বিশে চাকরি কি অর্পণকে বেপরোয়া করে দিয়েছিল? ছুটির দিনে নতুন কেনা বাইকে বোম্বে হাই রোড ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া বা বাইকে রাতের কলকাতা আবিষ্কার ওর আর সুদেষ্ণার। এ ছাড়াও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ভাড়ার ফ্ল্যাটে সুদেষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া।

অফিসিয়ালি দাঁড়ি টানলাম, এই জাতীয় কথা কোনও দিন ওরা পরস্পরকে বলে, সম্পর্ক থেকে বেরোয়নি। কেউ কোনও দিন কাউকে পরে ফোন করে বা দেখা করে কৈফিয়তও চায়নি। সেটা সম্পর্কের চোরাটানের মৃত্যু হতে পারে বা, দুজনের ইগো ফ্যাক্টর হতে পারে। এমনকী নিজের তরফে ঠিক কী, সেটাও নিশ্চিত করে অর্পণ বলতে পারে না। মনের গভীরে স্মৃতি থেকে যাওয়াতেই কি কোথাও পাপবোধ! প্রথম কয়েক মাস ব্যস্ত রুটিনের ফাঁকেও মনে হতো, একবার যোগাযোগ করলে কেমন হয়। তারপর একদিন সেখানেও ধাক্কা।

ছোটোখাটো মনোমালিন্য ওদের মধ্যে হলেও তা দীর্ঘস্থাযী হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজ করে নিত সুদেষ্ণাই। তাই কোনও দিন সেভাবে ওর মুখ গম্ভীর দেখেনি। স্পেশাল কোর্স শেষের ঠিক একমাস পর এলগিন রোডের এক ক্যাফেতে রবিবারের দুপুরে হাজির হয়ে দেখতে পেয়েছিল গম্ভীর মুখ। বাইরেও আকাশের মুখ ভার। অসাধারণ সুন্দর মিউজিকের সঙ্গতেও দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ হয়েছিল নিঃশব্দে।

এই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউটা ক্র‌্যাক করতে পারলাম না। অথচ পোস্টিং কলকাতাতে ছিল, আর প্যাকেজও ছিল অ্যাট্রাকটিভ। সুদেষ্ণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নীচের ঠোঁট।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল অর্পণ, তো?

তো কিছুই নয়। দিল্লিতে একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি। ওরা ইন্টারেস্টেড। এক সেকেন্ড থেমে সুদেষ্ণা যোগ করেছিল, আমিও।

সোজা হয়ে বসেছিল অর্পণ, ভালো খবর। কিন্তু কলকাতাতে আরও দুএকটা ট্রাই করলে হতো না?

ইনস্টিটিউটে শর্মা স্যার বলছিলেন, দিল্লির অফারটা নিয়ে নেওয়া উচিত। ওদের নাকি প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনিং স্টাইলটা গোটা ইন্ডিয়ায় খুব খাচ্ছে। আর আহমেদাবাদ আইআইএম-এর দুজন প্রাক্তন মিলে অফিসটা খোলায়, শেখার স্কোপটা বেশি হবে।

অন্যমনস্ক হয়ে খালি কফি কাপটা একবার নাড়াচাড়া করে অর্পণ বলেছিল, ও, তাহলে তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছিস।

এভাবে ভাবছিস কেন, যে-কোনও অবস্থাতেই কলকাতা ফিরে আসতে পারি। আরও অনেক বেটার এক্সপেরিযে্ন্স নিয়ে। অফিসের দুদুটো অ্যাসাইনমেন্ট একসঙ্গে চলতে থাকায় রাতের ফোন ছাড়া সে সপ্তাহে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বর্ধমানে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সুদেষ্ণা। দিল্লি যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে ওর বাবা-মা ছাড়তে এসেছিল। আগে থেকে কোনও পরিচয় না থাকায় সামনে যেতে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।

দিল্লিতে সেটলড হয়ে ফোনে বেশ কয়েবার কথা হয়েছিল। সে ফোনও কমে আসছিল তিন-চার মাস পর। তারপর দুদুটো নম্বর অস্তিত্বহীন।

শোক করেনি অর্পণ। নিজের প্রেমের নির্লিপ্তিতে নিজেই কিছুটা অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভাবার এত সময় ছিল না। নিজের কেরিয়ার গ্রাফ রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। কোম্পানি চেঞ্জ করে সাধারণ বেসরকারি অফিসে চাকরি থেকে অনেকগুনে বেশি রোজগার মোটেও মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি। দুবছরের মাথায় ফ্ল্যাট নিয়ে পরের ছবছর শুধু তার ইএমআই গুনে গেছে নিঃশব্দে।

১৮ লাখের টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে উঠে এসে প্রথম প্রথম উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারির যুদ্ধটা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ভালো লাগত। রাতে ফ্ল্যাটে একা থাকার পীড়া যে-একেবারেই দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু ক্লান্তি খুব দ্রুত ঘুমের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলত।

এ রকম অবস্থাতে ছটা বছর কেটেছিল অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। নতুন করে কারও-র সঙ্গে জড়ানোর সময় ছিল না। ছুটির দিনে বাজার, গোছগাছ, রান্নার লোককে বুঝিয়ে দেওয়া আর বাকি সময়টা ল্যাপটপে প্রোজেক্ট ডিজাইন। গোঘাট থেকে বউদি আর মায়ের অনবরত ফোন ভেসে আসছিল।

বিয়ের প্রস্তাবে খুব বেশি চমকায়নি। হিসেব কষে দেখেছিল ফ্ল্যাটের ঋণশোধে বাকি আর সাত বছর। ইনক্রিমেন্ট স্টেডি রেটে বাড়ছে। জিডিপির লোয়ার গ্রোথের দাঁত ওদের ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শরীর-মন একযোগে বলে উঠেছিল বিয়ের এটাই সঠিক সময়। আর তা ছাড়া এতগুলো বছর অন্য কারও-রও তো মনে পড়েনি। সুতরাং দায়ের প্রশ্ন আসছে না বোধহয়। আর নিশ্চিত সমাধান তো এবার হাতের কাছেই।

চন্দননগরে ঐশিকিদের বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখা। মোটামুটি খবর নেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারফেক্ট চয়েস। বাংলায় অনার্স গ্র‌্যাজুয়েট। তবুও বাইরে দুতিনবার মিট করে নিয়েছিল। লম্বা চুল, হাইট, রং-এ জোরদার লাগলেও, সুদেষ্ণার সঙ্গে তুলনায় যায়নি। চন্দননগর ষ্ট্র‌্যান্ডেই রবিবারের এক সন্ধেতে জিজ্ঞাসা করেছিল ঐশিকীকে, ওর অতীত জীবনের কথা। কোনও পাস্ট অ্যাফেয়ার, এ বিয়েতে রাজি কিনা, ছোটো ছোটো প্রশ্নে জানার চেষ্টা করেছিল।

ঐশিকির সোজা-সাপটা সরল উত্তরে কিছুতেই নিজের অতীতকে সামনে আনার সাহস দেখাতে পারেনি। বিয়ের পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও নিষ্কলঙ্ক ঐশিকীর আচরণে, নিজের অতীতকে বার বার গিলতে হয়েছে। একটা অ্যাফেয়ার কী করে অপরাধবোধে পরিণত হয়, ভেবে বের করতে পারেনি। অগত্যা ছুটে যাওয়া ডা. চ্যাটার্জির কাছে।

 

ঘুমানোর ভান করেই শুয়েছিল। একটা হালকা উত্তেজনা তো বটেই, দুপুরে ভালো রকম ঘুমের জন্যও ঘুম আসতে চাইছিল না। কাল খুব সকালে উঠে প্রোজেক্টের একটা কাজ ছকে নিতে হবে বলেছিল। তাই ঐশিকি আজ আর কোনও উষ্ণতা চায়নি। ভীষণ কম্প্রোমাইজিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং মেয়ে। সম্পর্কের সতেজতা আর স্নিগ্ধতা দুটোই সমান ভাবে মেনটেইন করতে পারে। এভাবেই তিন মাস অর্পণকে যেন অদৃশ্য হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

মধ্য কুড়িতে সম্পর্ক উন্মাদনা খোঁজে হয়তো, মধ্য তিরিশে স্থিতাবস্থা। সংসারের বৃত্তে এ ভাবেই বোধহয় ঢুকে পড়তে হয়। আজকের রাতের পর নিশ্চই পুরোপুরি ঢুকে পড়বে। সন্ধেবেলা চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঐশিকির চোখ এদিক ওদিক ঘোরে। বিশেষত ছুটির দিনে। মনে হয়েছিল রাতই সঠিক সময়।

রোজের মতো আজও ঐশিকি টয়লেটে উঠল। এসি অফ করল। মিনিট চারেক সময় ব্যয় করে টয়লেটে ও। এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এক মিনিট অপেক্ষা করে উঠে পড়ল অর্পণ। ভাগ্যিস অ্যাটাচড্ বাথ নয়। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিল। টয়লেটের আলো জ্বলছে, জলও পড়ছে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল ব্যালকনিতে। নিজের ল্যাপটপে কম্পোজ করেছিল প্রায় তিন পাতার কনফেশন। প্রিন্ট আউটও বের করে রেখেছিল। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে পাতাগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলল। সামনে চাঁদের আলোয় ভরা গঙ্গা। দ্রুত হাওয়ায় বড়ো মায়াবী এ চরাচর। টুকরোগুলো হাত থেকে ছোড়ার আগের মুহূর্তেই, স্থির হতে হয়।

পাশের ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে আসে প্রায় একই রকম কাগজের টুকরো। অসংখ্য। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই পাশের জানালা থেকে সরে যায় ঐশিকির মুখ। হাতের ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোকে এবার ছেড়ে দেয় অর্পণ। দুটো স্বীকারোক্তি প্রায় একইরকম হয়ে মিলেমিশে প্রবল হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মিশে যায়। যেমন করে বসন্তের হাওয়া আর চাঁদের আলো মিশে যাচ্ছিল…

 

বেহায়া

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে অনন্যা বাইরের ঘরে এসে দেখল, শাশুড়ি-মা বসে শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করছেন। অনন্যা এসেই সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরে অফিস যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বাই বলে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। অজয়ের বাবা অনিরুদ্ধবাবু খুবই ভালোবাসেন অনন্যাকে।

সুগন্ধা বললেন, অনন্যা, আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অজয়ের পিসিমা আসবেন সন্ধেবেলা।

মা, তাড়াতাড়ি আসা তো মুশকিল। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা তো বাজবেই। এসে দেখা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। বলে নিজেই জোর করে হাসি টেনে আনে মুখে। আর তাছাড়া পিসিমা তো আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন না। নিজের গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

খানিক আগেই স্বামী অজয় ঘরে ঢুকেছে, অনন্যা খেয়াল করেনি। অজয়ে গলার আওয়াজে ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল অনন্যার। ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতেই অজয় বলল, বাজে কথা বোলো না অনন্যা। ঠিক সময় চলে এসো।

হাসতে হাসতেই অনন্যা বেরিয়ে গেল।

মায়ে গম্ভীর মুখ দেখে অজয় সুগন্ধাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? মুড খারাপ?

না, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে অজয় বাবার দিকে তাকাল। অনিরুদ্ধবাবু ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ইশারায় কথা বলে বাবা ছেলে দুজনের মুখেই চাপা হাসি ফুটে উঠল।

অজয় অফিস চলে গেলে অনিরুদ্ধবাবু নিজের স্ত্রীকে বললেন, আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করব, দিদি আসার আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু তুমি এত কেন চুপচাপ?

স্বামী প্রশ্ন করতেই রাগে ফেটে পড়লেন সুগন্ধা। চুপ করে থাকব না তো আর কী করব? আর কত অ্যাডজাস্ট করব? সকাল থেকে ওইরকম বেহায়া ছেলের বউকে দেখে এমনিতেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

বেহায়া? অনন্যা? একথা কেন বলছ?

হাবভাব দেখছ তো, একে দেখে এ বাড়ির বউ বলে মনে হয়? সবসময় ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সাজগোজ তারপর এই প্রাইভেট চাকরি! আর কথাবার্তার তো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভেবেছিলাম বাড়ির বউ নম্র, ভদ্র হবে, মা-বাবার দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে। কিন্তু না, যাই বলি না কেন এমন উত্তর দেবে যে, তারপর আর কিছু বলা চলে না। সব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ আমাদের মেয়ে অপর্ণাকে দেখো, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি যা বলছেন তাই মাথা নীচু করে মেনে নিচ্ছে। আর আমাদের অজয় এমন একটা বেহায়া মেয়েে এনে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে তার কাঁধে হাত রাখলেন, এখনই এত অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ কেন? মাত্র চারমাস হয়েছে অনন্যা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি ওর কোনও রকম ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলো না। তুমিও তো পড়াশোনা করেছ, তুমিও যথেষ্ট মডার্ন। এই কদিন অনন্যাকে দেখেই তুমি ওর নামকরণ করে ফেলেছ বেহায়া! এটা ঠিক নয় সুগন্ধা। অজয় যথেষ্ট দাযিত্ববান ছেলে। ও অনন্যাকে যখন নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করেছে, তখন নিশ্চই সে অনন্যার গুণ দেখেই ঘরে এনেছে।

হ্যাঁ, গুণ তো আছে বটেই। সেই জন্যই তো অজয়কে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অনন্যা যা বলে তাতেই সায় দেয় অজয়। ও সাজগোজ আর বউয়ে রূপ দেখে এমন মজেছে যে, অনন্যা যাই করুন না কেন তাতে তার সাত খুন মাপ হয়ে যায়। আমিই শুধু ওর কোনও গুণ দেখতে পাই না কেন কে জানে!

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীয়ের রাগ দেখে হেসে ফেলেন। একটু রসিকতা করার ইচ্ছা সামলাতে পারেন না। সুগন্ধা কখনও কোনও শাশুড়িকে দেখেছ ছেলের বউয়ে গুণ এত সহজে মেনে নিতে? তোমার তো কত গুণ ছিল কিন্তু তোমার শাশুড়ি কোনও দিন সেটা স্বীকার করেছেন?

এত রাগের মধ্যেও স্বামীর কথা শুনে সুগন্ধা হেসে ফেলেন।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, ঠিক আছে, আমি এখন বেরোচ্ছি। রাগ কোরো না, বিশ্রাম নাও। দিদি এলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই বলে অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যান।

সুগন্ধা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের লোককে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দুপুরে একটু ফ্রি হয়ে সবে শুতে যাবেন, ফোনটা বেজে উঠল। বড়ো ননদের ফোন যিনি সন্ধেবেলায় ওঁদের বাড়ি আসছেন থাকতে।

সুগন্ধা, আমি ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাব। ততক্ষণে আমাদের বউমাও নিশ্চয় বাড়ি এসে যাবে? বিয়ের সময়ে ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি।

হ্যাঁ দিদি, অনন্যা বলেছে ও চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে, বলে ফোন নামিয়ে রাখেন সুগন্ধা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সুগন্ধা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। সন্ধেবেলায় অনেক কাজ আছে। কিন্তু শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। তিন বছর আলাপের পর মাত্র চারমাস আগে অজয় আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে। অনন্যার মা-বাবা দুজনেই প্রফেসর। বেঙ্গালুরুতে অনন্যা বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, মডার্ন, সুশিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে

অজয় অনন্যাকে পছন্দ করে, এটাই সুগন্ধার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সন্তনের খুশিতে, সংসারের আনন্দেই সুগন্ধা পরিপূর্ণ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অনন্যার সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার পরেই একটাই শব্দ দিনরাত ওনার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করল, বেহায়া।

সুগন্ধা ভালোমতোই জানেন, অনন্যা অজয়কে চোখে হারায়। অনন্যার অফিস বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। যার ফলে অজয়ে আগে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় আর ফেরেও অজয় ফেরার অনেকটা পরে।

কলকাতায় অফিস যাতায়াত করাটা একটা সমস্যা কিন্তু অনন্যা বাড়ি এসেই চটপট জামাকাপড় বদলে, ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে বসে গল্প করতে শুরু করে দেয়। কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর চেহারায়। সুগন্ধা অবাক হয়ে যান যত ওকে দেখেন। বাড়িতে এমন ভাবে থাকে, দেখে যে কেউ ভাববে ও বাড়ির মেয়ে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ নয়।

রান্নাবান্নার কোনও শখ নেই অনন্যার। একদিন সুগন্ধা খুব আদর করেই অনন্যাকে বলেছিলেন, অনন্যা, ছুটির দিনগুলোতে একটু একটু করে রান্নাটা শিখে নাও।

কেন মা? ঝট করে অনন্যা বলে ফেলে।

রান্নার জন্য লোক আছে ঠিকই কিন্তু একটু আধটু রান্না তো সকলেরই শিখে নেওয়া উচিত।

সে কাজ চালাবার মতো রান্না আমি করে নিতে পারব। ওটাতেই এখন কাজ চলবে। পরে কখনও শিখে নেব, বলেই অনন্যা শাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

মা রান্নাঘরে ঢুকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি একবার হ্ঁযা বলো, এখুনি একজন ফুল টাইম রান্নার লোকের ব্যবস্থা করছি। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আমি তো বলি তুমি সবসময়ে জন্য একটা লোক রেখেই নাও।

বাড়ির ভিতর সবসময় কাজের লোক ঘোরাফেরা করবে ভেবেই সুগন্ধা মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখনকার মতো অনন্যাকে চুপ করানোর জন্য বলেন, ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে হবে শিখে নিও। এখন লোকের আমার কোনও প্রযোজন নেই। প্রমিলা সব কাজই তো করে দিচ্ছে।

অনন্যা আর সুগন্ধার কথোপকথন যখন হচ্ছিল তখন অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা আর ছেলে, দুজনের কথা শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।

আজ সুগন্ধা অনিরুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে অনন্যার বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগ উগরে দিলেন, নিজের চোখেই দেখছ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। যখনই কিছু শেখার কথা বলি অমনি গলা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যে, রাগও করতে পারি না।

স্ত্রীয়ে নালিশ শুনে হেসে ফেলেন অনিরুদ্ধবাবু, তুমি কতটা শাশুড়ি হিসেবে রাগ দেখাতে পারো আমার খুব জানা আছে।

সন্ধেবেলায় উমাদিদি আসার আগেই অনিরুদ্ধবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, যাতে সুগন্ধার মনে ক্ষোভ না তৈরি হয়।

চা-জলখাবার খেতে খেতে উমা অনন্যা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। কেমন বউ হয়েছে? শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে কিনা? অফিসে এতটা সময় কাটায়, তাহলে বাড়ির কাজ করে কখন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুই দিলেন, আমাদের সেবার কীসের দরকার! আমরা কি কেউ অসুস্থ? অনন্যা খুব ভালো মেয়ে দিদি। দাযিত্ব নিয়ে সব কাজ করে।

অনন্যার কথা ওঠাতে সুগন্ধার মুখের উপর কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। উমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবই নজর করল। মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন উমা। অনিরুদ্ধর থেকে বেশ অনেকটাই বড়ো উমা। মা-বাবার মৃতু্যর পর ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। সম্পর্কের মান দুজনেই রক্ষা করে চলেছেন।

বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন উমা। এখন বয়ে হওয়ায় আরও বেশি পূজাপাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সেকেলে

আচার-বিচার মেনে চলেন। কোনও এক মহারাজ-এর কাছে দীক্ষিত। কাশীধামে থাকেন মহারাজ। দেশের যেখানেই মহারাজের প্রবচন থাকে, উমা ঠিক কিছু একটা করে

চার-পাঁচদিনের জন্য সেখানে পৌঁছে যান।

কলকাতার রাজারহাটে এবার মহারাজের শিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেটার জন্যই উমার রাঁচি থেকে কলকাতায় আসা। ওঁরা বসে গল্প করতে করতেই অজয় আর অনন্যাও অফিস থেকে চলে এল। পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনন্যা নিজের ঘরে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে ডিনার করতে করতে সকলে আড্ডায় মেতে উঠল। অন্যান্য সময়ে মতো অনন্যাও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। অনন্যার এই ব্যবহার উমার চোখে অতিরিক্ত স্পর্ধার বলেই মনে হতে লাগল।

এরপর শুরু হল নাগরিকতা বিল নিয়ে আলোচনা। অনন্যা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল এই বিল সে সমর্থন করে না। অথচ উমা নিজের বাড়িতে স্বামীকে এই বিলের সমর্থনে সবসময় কথা বলে আসতে শুনেছেন। অনন্যার কথাবার্তায় উমার খালি মনে হতে লাগল, অনন্যা একপ্রকার তার স্বামীকেই অপমান করছে। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল উমার। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান স্বল্প হওয়াতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

অনন্যা অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলছিল, বাবা আমাদের অফিসে আমার কিছু সহকর্মী এই বিলের বিরোধিতা করে একটা মিছিল বার করার প্ল্যান করছে। আমার এতে পুরো সমর্থন রয়েছে।

উমা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ইচ্ছে করে অনন্যাকে থামাবার জন্য বলে উঠলেন, আমি ভাবছিলাম এবার মহারাজের শিবিরে যাওয়ার সময় সুগন্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ওখানে দুটো দিন থেকেও নেবে আর মহারাজের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। কী বউমা, তোমার শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে ওই দুটো দিন সংসার সামলে নিতে পারবে তো?

কিন্তু পিসিমা, মা তো শিবিরে যাবেন না।

সুগন্ধা হতচকিত হয়ে পড়েন। এই বেহায়া মেয়েটা বলে কী? আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা ও ঠিক করবে? উমাও অনন্যার কথা শুনে যেন শক খেলেন। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে, এর মধ্যেই ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস পাচ্ছে মেযো? একটু গম্ভীর হয়ে উমা বললেন, মহারাজের কাছে দু’দণ্ড বসে ওনার কথা যে-শোনে, তার জীবনে কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে না।

পিসিমার কথায় রসিকতা করার ইচ্ছেটাকে কিছুতেই দমাতে পারল না অনন্যা। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, সে কী পিসিমা, তাহলে আপনার মহারাজের জন্য দেখছি, ডাক্তারদের ক্লিনিকগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে! সাবধান হতে বলবেন মহারাজকে, নাসা থেকে ওনাকে তুলে নিয়ে না চলে যায়, হা হা হা বলে হাসিতে ফেটে পড়ে অনন্যা।

খুব গম্ভীর দেখায় উমাকে। বলেন, বউমা, আমার মনে হয় আধ্যাত্মিক বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সেজেগুজে অফিসে যাওয়া এক ব্যাপার আর আধ্যাত্মিক চেতনা অন্য জিনিস।

পিসিমার কঠোর স্বর শুনে অনন্যা ভিতরে ভিতরে একটু মুষড়ে পড়লেও, স্বভাবসুলভ কৌতুকের বশেই বলে ফেলল, পিসিমা সত্যিই আধ্যাত্মিক আলাপ-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

অনন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার উমা সুগন্ধাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তাহলে তুমি যাবে তো সুগন্ধা?

সুগন্ধার কাছে বাড়ির শান্তি সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু ননদের মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনও দিনই তাঁর হয়নি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি মনে হয় যেতে পারব না দিদি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। পায়ে ব্যথাটা খুব বেড়েছে।

উমার মুখের উপর অসন্তোষের ছায়া এসে মিলিয়ে গেল। অজয়ও বলে উঠল, হ্যাঁ মা, তোমার তো ওখানে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। পিসি, তুমি বরং একাই ঘুরে এসো।

রাতে সবাই ঘরে শুতে চলে গেলে উমা, সুগন্ধার সঙ্গে সোফায় এসে বসলেন, সুগন্ধা তোমার ছেলের বউ তো দেখছি খুব স্মার্ট। ফটফট করে মুখের উপর কথা বলে।

সুগন্ধা কী বলবেন ভেবে পান না। চুপ করে থাকেন।

তোমাকে সাবধান করছি সুগন্ধা, ওকে এত বেশি বাড়তে দিও না। লাগাম নিজের হাতে রাখো।

হেসে ফেলেন সুগন্ধা। দিদি ও বাড়ির বউ। ঘোড়া হলে না হয় লাগাম কষে ধরতাম। সুগন্ধা বরাবরই শান্তিপ্রিয়। অশান্তি কোনও দিনই ওনার পছন্দ নয়।

সুগন্ধাকে চুপ থাকতে দেখে উমাই আবার মুখ খুললেন, এ যেরকম মেয়ে দেখলাম বাড়ির কাউকে ও পরোযা করে না বলেই মনে হয়। সবসময় সেজেগুজে, মেক-আপ করে রয়েছে। বড়োদের সামনে মুখ বন্ধ করে থাকার সভ্যতাটুকুও ওর জানা নেই। এইসব মেযো স্বামীকে ভালো মতন আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে। দেখো তোমার সংসারে ভাঙন না ধরায়।

ছেলের বউকে কীভাবে রাখা উচিত, এ বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার সুগন্ধার কাছে উজাড় করে দিয়ে উমা পরের দিন সকালে মহারাজের শিবিরে চলে গেলেন। ওখান থেকেই উমা নিজের বাড়ি চলে যাবেন এটাই প্রথম থেকে স্থির ছিল।

পিসিমা চলে যেতে অজয় অনন্যাকে বলল, তুমি তো পিসির সামনে প্রচুর কথা বলছিলে দেখলাম। এত কথা মা কোনও দিন বলতে সাহস করেননি।

মা যত ভালোমানুষ না অজয়, সেরকম ভালোমানুষ হয়ে আজকের দুনিয়ায় কোনও কাজ করা যায় না। মাঝেমধ্যে বলতেও হয়। শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে কথাগুলো অনন্যা বলতেই, সুগন্ধা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দেখলেন অনন্যাকে। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি অনন্যা। ওর চেহারায় সবসময় একটা তরতাজা ভাব, মুখে প্রশান্তি এবং যথেষ্ট সুন্দরী সে।

অপর্ণা, অজয়ে থেকে চার বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়ি বরোদায়। বছরে একবার আসে

মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছেলেকে আনে।

স্বামী সুজয় সবসময় আসতে পারে না। ভাই অজয়ে বিয়ে সময় মাত্র পাঁচদিনের জন্য আসতে পেরেছিল। তাই ছেলের স্কুলের ছুটি পড়তেই, এবার কুড়ি দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে অপর্ণা হাজির হল বাপের বাড়িতে। বাড়তি আগ্রহ, অনন্যার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার। সুজয় আসতে পারেনি অফিসে জরুরি কাজ থাকার জন্য। এমনিতে অপর্ণা খুবই স্বামীর অনুগামী। কিন্তু একলা বাপের বাড়ি আসায় বেশ একটা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।

অনন্যার সঙ্গে জমেও গেল খুব অপর্ণার। সুগন্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অপর্ণার সঙ্গে বেশি করে, সময় কাটাবার জন্য অনন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল।

দুদিন যেতে না যেতেই অনন্যা একদিন অপর্ণাকে বলল, এ কী দিদি, আজকাল ম্যাচিং গয়না পরে সাজগোজ করে থাকার যুগ। আর তোমার গলায়, হাতে লাল-কালো সুতোয় খালি মাদুলি পরা! এসব কোথা থেকে জোগাড় করেছ?

অপর্ণা আমতা আমতা করে উত্তর দিল, আমার শাশুড়ি-মা সারাদিন মন্দির, দেবতা, বাবাজি, পুরোহিতদের নিয়ে থাকেন। বাড়িতে কিছু একটা হলেই, একটা মাদুলি নিয়ে পরের দিনই উপস্থিত হন। আমাকে এরকম দেখছ, তাহলে সুজয়কে দেখে কী বলবে? সারা শরীরে এই মাদুলি। এভাবেই ওকে অফিস করতে হয়। ওর অফিসে নিশ্চই ওকে নিয়ে ওর কলিগরা হাসাহাসি করে।

অনন্যা এবার জোরে হেসে উঠল, দিদি, সুজয়দার অফিসে যদি আমার মতো মেয়ে থাকে, তাহলে তো নিশ্চই সুজয়দাকে নিয়ে হাসবেই।

অনন্যার কথা বলার ভঙ্গিতে অপর্ণাও হেসে উঠল। অনন্যা এটা কিন্তু খুব খারাপ। নন্দাইকে নিয়ে এরকম রসিকতা তাও আবার ননদেরই সামনে!

সন্ধেবেলা শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, দিদি তুমি শাড়ি আর সু্য়ট ছাড়া আর কিছু পরো না? যেমন ধরো ওযে্টার্ন ড্রেস?

না, অনন্যা। আমার শাশুড়ির শাড়িই পছন্দ।

তুমি তো তোমার পছন্দের কথাও ওনাকে জানাতে পারো। এখন তো সবাই সবরকমের পোশাক পরছে।

অপর্ণাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে অনন্যা।

বাইরের ঘরে বসে অপর্ণা এবং অনন্যার সব কথাই সুগন্ধা শুনতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বেহায়া মেযোর এতদূর স্পর্ধা যে, নিজের নন্দাইকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে একটুও আটকায় না। আবার ভিতরে ভিতরে খুশিও হচ্ছিলেন নিজের মেয়ে অপর্ণার প্রতি অনন্যার ভালোবাসা দেখে। মেয়ে আগেও যতবার এসেছে এতটা আনন্দে ওকে কখনও থাকতে দেখেননি সুগন্ধা।

অপর্ণা আসার চার-পাঁচদিন পরেই হঠাৎ সুগন্ধার ভাই ফোন করে জানাল, ওনার ছেলে রাতুল তার ফ্যামিলির সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে আসছে। ফোন আসার পর থেকে সুগন্ধা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় যখন খবরটা শুনলেন তখন ওদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক মনে হলেও অনন্যা, শাশুড়ি এবং ননদের মুখের উপর লক্ষ্য করে কালো মেঘের ঘনঘটা।

সারাদিনই অপর্ণা কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা না বলে নিজের ঘরেই বন্ধ থাকল। হাসিখুশি মেযো হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। অপর্ণার ছেলে খুবই শান্ত, ও নিজের মতো অাঁকা, বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাকে বিরক্ত করার কথা ওর মনেও হয় না।

পরের দিন অনিরুদ্ধবাবু আর অজয় অফিস চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করল সুগন্ধার ঘরে অপর্ণা। নীচু স্বরে দুজনে কিছু কথা বলছে। অপর্ণার ছেলে বসে টিভি দেখছে। অনন্যা, শাশুড়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এতদিনে এই বাড়িটা, বাড়ির লোকজনগুলো বড়ো আপন হয়ে উঠেছে তার। ও জানতে চাইছিল, কেন ওদের দুজনের মুখে অমাবস্যার ছায়া পড়েছে, মামার ছেলে রাতুলের নাম শুনে।

অপর্ণার গলা শুনতে পেল, মা, আমি কালই বরোদায় ফিরে যাচ্ছি। টিকিটের ব্যবস্থা এখুনি অজয়কে বললেই করে দেবে।

না অপু, এত কষ্ট করে এই তো এলি, এরই মধ্যে…

মা আমি রাতুলের মুখও দেখতে চাই না।

কিন্তু রাতুল তো ফ্যামিলির সঙ্গে আসছে, তুই চিন্তা করিস না। ইগনোর করিস।

মা, তুমি সবসময় এই একই কথা বলো, ইগনোর কর। আমি কিছুতেই ওর মুখ দেখতে পারব না।

বাইরে দাঁড়িয়ে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে। অপর্ণাকে বলে, দিদি তুমি কেন এখান থেকে যাবে? এটা তোমার বাপের বাড়ি, মানে তোমারও নিজের বাড়ি। তোমরা আমার আপন। তোমার কষ্ট মানে আমারও কষ্ট। আমাকে আপন ভেবে নিজের কষ্টের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?

অপর্ণা জড়িয়ে ধরে অনন্যাকে, নিশ্চই শেয়ার করব। এতদিনে তুইও আমার বড়ো আপন হয়ে উঠেছিস। রাতুল আমার মামার ছেলে। অত্যন্ত অভদ্র, রুঢ় এবং চরিত্রহীন। আমার বিয়ে কিছুদিন আগে এখানে এসেছিল এবং আমাকে একদিন একা পেয়ে আমার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। আমি চ্ঁযাচাতে এবং থাপ্পড় মারাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। অথচ ওকে কিছু বলার বদলে মা আমাকেই চুপ থাকতে বলে, ইগনোর করতে বলে। আমার বিয়েে আসেনি। এতদিন পর যখন আসছে, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না।

অনন্যা ননদের হাত চেপে ধরে, তোমাকে ওর মুখ দেখতে হবে না দিদি।

কিন্তু ও তো আসছে!

সুগন্ধা চুপ করে ছিলেন। অনন্যা বলে, মা তুমি শুধু নও, অনেক মা-ই এমন করেন। মেয়েেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু বাড়ির সাপোর্ট না পেলে এই ক্ষত আরও গভীর হয়ে ওঠে মেয়েের মনে। সেদিন দিদির কাছে শোনার পর, রাতুলের গালে চারটে থাপ্পড় মেরে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে দিদিকে আজ চলে যাওয়ার কথা বলতে হতো না। যাই হোক, যা হওয়ার ছিল হয়েছে। দিদি তুমি একদম চিন্তা কোরো না। এছাড়াও দেখছি, যে যখন খুশি কলকাতায় মানে এখানে চলে আসছে। ফলে মা-কে একগাদা কাজ করতে হয়। মা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিও অফিসে থাকি। ইচ্ছে করলেও কোনও সাহায্য করতে পারি না। দিদিকে তো আমি কোনও ভাবেই কষ্টে থাকতে দেব না। বলেই অনন্যা তত্ক্ষণাৎ অজয়কে ফোন করল।

অজয়, প্লিজ একটা কাজ করতে হবে। মামাকে ফোন করে বলো, যে-হঠাৎই আমরা বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি। মা কিছু জানত না। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকে টিকিট কেটে, কাউকে জানাওনি।

অজয়ে উত্তর কেউ শুনতে না পেলেও অনন্যার মুখ হাসিতে ভরে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, এখুনি ফোনটা করো। বলে ফোন কেটে দিল।

অপর্ণার মুখের উপর থেকে চিন্তার ছায়া কেটে গিয়ে হাসিতে মুখ ঝলমল করে উঠল। সুগন্ধার মুখে হাসি ফুটতেই অনন্যা সুগন্ধার কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, মা, এইসব করতে হয়। ভালোমানুষ হয়ে কাজ চলবে না। আমার মতো স্পষ্টবক্তা এখনকার দিনে দরকার। অজয় তোমার ভালোমানুষির অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি এসে গেছি।

এমন ভাবে কথাগুলো বলল অনন্যা, সুগন্ধা আর অপর্ণা জোরে হেসে উঠলেন।

সুগন্ধা অনন্যার চুলে বিলি কাটতেই ঝট করে অনন্যা উঠে বসল, আমার চুলে এখন হাত দেওয়া যাবে না মা, সবে স্ট্রেটনিং করিয়েছি।

সুগন্ধা হেসে হাত সরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধার ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলেন উমার ফোন। ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

উমা মহারাজের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই অনন্যার প্রসঙ্গে চলে এলেন, কী সুগন্ধা তোমার বেহায়া বউটার কী খবর?

দিদি, ওই বেহায়া বউটাই আমার মনের পুরো জায়গাটা জুড়ে বসে গেছে। আরও অন্য কিছু কথা বলে সুগন্ধা ফোন রেখে আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় উমাদি যথেষ্ট আশ্চর‌্য হয়েছেন।

ঘরে আসতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, পিসি কী বললেন?

কিছু না। ওই আমরা সবাই কেমন আছি।

কেন মা, জিজ্ঞেস করলেন না, বেহায়া মেযো নতুন কী খেল দেখাচ্ছে?

সুগন্ধা শক খেলেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ একথা বলছ কেন?

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনন্যা। মা চিন্তা কোরো না। আমার খুব ভালো লেগেছে এই নামটা। আজকে দিদি আর তোমার কথা যেমন কানে এসেছিল, সেরকমই ওইদিনও পিসিমা আর তোমার কথাগুলো কানে গিয়েছিল। তোমাকে বললাম না, ভালোমানুষির যুগ শেষ। এখন চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু এটা সত্যি আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। বলে সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরল অনন্যা।

অপর্ণা লক্ষ্য করছিল। হেসে বলল, মা, এটা কী হচ্ছে?

সরি সরি রে বাবা, বলে সুগন্ধা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের কান ধরতেই তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। অনন্যা মিছিমিছি কলার তোলার ভান করে বলল, দেখলে তো, এই বেহায়া মেযে শাশুড়িকেও কান ধরিয়ে ছাড়ল।

তিনজনেরই মিষ্টি হাসিতে ঘরের ভিতরটা আনন্দে ভরে উঠল।

সংঘাত

সুখে থাকতে গেলে একজন মানুষের কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয়? মানুষের উপর বিশ্বাসের? সম্পর্কের উপর আস্থার? সহানুভূতির? নাকি, অনেক অর্থ উপার্জনের ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে সুখ, যেরকম বলে থাকেন অনেকে। জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ, গলা ফাটিয়ে নিজের অধিকার ঘোষণা করার অধিকার– সুখে থাকার জন্য এইরকম কত বিষয়েরই না দরকার পড়ে!

কিন্তু সবসময় কি এই সবকিছু খুব সহজে মেলে? সহজে পাওয়ার রাস্তায় কত না বাধা। মানুষের রিপু বড়ো পরশ্রীকাতর। সে বড়ো হিংসুক। বড়ো লালসা তার! চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রতারণা, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, ছল– ইত্যাকার হাজাররকম প্রকাশ সেই লালসার। এই কি তবে মানুষের নসিব? মানুষ একটু সুখে থাকবে, তাতে আর একজন মানুষের খুব কি কিছু আসে-যায়, যদি না সেই সুখ অন্য কারও বঞ্চনার মাধ্যমে এসে না থাকে? যুক্তি বলে, যায় না। বুদ্ধি বলে, অবশ্যই যায়।

তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে যেতে গিয়ে এই সব কথাই মনে মনে ভাবছিল সুজাতা। রোজ সকালে ঠিক এভাবেই অত্যন্ত ব্যস্ত পা ফেলে তাকে স্টেশনে আসতে হয়। অফিসযাত্রীদের ভিড়টা এসময়েই সবচেয়ে বেশি থাকে। পা মাড়িয়ে, কনুই দিয়ে সহযাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে মানুষের চলমান শরীরগুলো উন্মত্তের মতো প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কারওর অন্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। মানুষ কি ধীরে ধীরে উন্মাদ বা পাশবিক হয়ে যাচ্ছে? কে জানে!

পিছন থেকে এসে একটা লোক সুজাতার পা মাড়িয়ে চলে যেতেই সে চাপা গুঙিয়ে উঠল। লোকটি বোধহয় একটু ভদ্রগোছের। সুজাতার গোঙানি শুনে অন্তত পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে গেল, ‘দুঃখিত’! হায়, দুঃখ প্রকাশে যদি শরীরের ব্যথা কিছুমাত্রাতেও কমত! যদিও ব্যথার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর সময় সুজাতারও নেই। ভোরে বাড়িতে একটা ব্যাচ পড়তে আসে। তাদের পড়িয়ে উঠতে বেলা চড়ে যায়। অন্যান্য দিন যদিও সে কিছুটা সমবেদনামূলক ছাড় পায়, কিন্তু সেটি হওয়ার জো নেই আজ। স্কুলপরিদর্শনে সরকারের অফিসারেরা আসছেন। ছাত্রছাত্রীদের কালকেই সে পইপই করে বলে দিয়েছিল যাতে আজ কেউ কামাই না করে। সরকারি বাবুরা যদি দেখেন স্কুলে পড়াশুনা ভালো হচ্ছে, ছেলেমেয়েদর মধ্যে পড়ার এবং বাবা-মায়েদের মধ্যে তাদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে, তাহলে স্কুলের জন্য বাড়তি কিছু অনুদান চাইবার মুখটা থাকে।

কিন্তু এত সহজে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিছুতেই। শেষমুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলো যেন না ডোবায়।

মালতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের দিদিমণি সুজাতা। মালতীপুর জায়গাটা খুব বড়ো হয়তো নয়, তবে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ অঞ্চলে ধান খুব ভালো হয়। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান রিকশায় চেপে সুজাতা যখন স্কুলের দিকে যায়, রাস্তার দুধারে হলুদ হয়ে যাওয়া ধানগাছগুলি হাওয়ায় মাথা দোলাতে থাকে। মাটিতে বীজ পোঁতা থেকে, কচি সবুজ ধানগাছগুলির বেড়ে ওঠা, তারপরে সেগুলির সোনালি হতে থাকার প্রতিটি দৃশ্য এখন তার চেনা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এত বর্ধিষ্ণু গ্রামেও বিকাশের লক্ষণগুলি তেমন স্পষ্ট নয়। টিউবওয়েলে ঠিকমতো জল ওঠে না, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা নামমাত্র। কে বলবে, এখানেও বছর-বছর ভোটের হাওয়া বয়। নেতাদের গরম বক্তৃতায় তেতে ওঠে সমাজজীবন। ভোট হয়ে যায়। উন্নয়নও ঝিমিয়ে পড়ে। জীবন চলতে থাকে সেই একইরকম শম্বুকগতিতে। তাই এখানে চাকরি করতে আসার ইচ্ছে থাকে না সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও। সুজাতাই কি পোস্টিংটা পেয়ে খুব খুশি হতে পেরেছিল?

তার অবশ্য অন্য সমস্যাও কিছু ছিল। তবে সবকিছুর উপরে, এখানে বদলি হয়ে আসতেও তার মন চায়নি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, কোনওরকম সামাজিক সুযোগসুবিধাহীন জায়গায় পঙ্গু হয়ে থাকার চেয়ে কষ্টকর আর কী হতে পারে?

তার উপর রাতুল এখনও যথেষ্ট ছোটো। শ্বশুর-শাশুড়িও বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু যদি মনোময় কলকাতায় চাকরি করত, একটা কথা ছিল। তাকেও তো বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দিয়েছে।

সুজাতা তাই বাস্তবিক খুবই আতান্তরে পড়ছিল। অনুরোধে যদি কিছু হয়, সেই ভেবে সত্যপ্রিয় মজুমদারের কাছে পৗঁছেও গিয়েছিল একদিন। টাকমাথা, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। সারাদিন পান চিবোচ্ছেন। দেখলেই মনে হয় ধুরন্ধর, ভোগী মানুষ। সব শুনে বাঁকা হেসে বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি কি মনে করেন অসুবিধা আপনার একার? কিন্তু তাই বলে, লোকে শহর ছেড়ে নড়বে না, এরকম হলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার হালটা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারছেন?’

সুজাতা এরপরও তার নাচার অবস্থাটা আর একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেছিল। সত্যপ্রিয়বাবু থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কত্তা তো ভালো পোস্টেই আছেন, তাই তো? তা আপনার আর টাকাপয়সার কী দরকার? অসুবিধা হলে ছেড়ে দিন না। আমরাও তো সেটাই চাই। আপনার পুরোনো লোকেরা সব বাস্তুঘুঘু হয়ে গেছেন। চাকরির বাজারের যা অবস্থা তাতে নতুন টিচার অনেক কম মাইনেয় পাওয়া যাবে।’

জিভটা মুহূর্তে তেতো হয়ে গিয়েছিল লোকটার চাঁচাছোলা বক্তব্য শুনে। কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সত্যপ্রিয়র চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল সুজাতা। সত্যিই তো, প্যানেলে এখনও শতসহস্র যুবক-যুবতি অপেক্ষা করছে চাকরি পাওয়ার জন্য। একটা জায়গা খালি হওয়ার খবর পেলেই তদ্বিরের ধুম পড়ে যায় বলে শোনা যায়। যার যেখানে যত প্রভাবশালী খুঁটি আছে, তাদের ব্যবহার করার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কপালের শিকে তো এক-আধজনেরই ছেঁড়ে। আর সত্যপ্রিয় মজুমদারের মতো লোকেরা দিব্যি মাতব্বরি করার সুযোগ পেয়ে যান।

তাকে ম্লানমুখে চেম্বারের বাইরে বের হতে দেখে রামকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। বগলে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে সে কোথাও যাচ্ছিল। সুজাতাকে দেখে গলায় খানিকটা শ্লেষ এনে কথা শুরু করে।

‘কী? হল না বুঝি?’– মুখে একফালি হাসি ঝুলিয়ে রাখল রামকুমার, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে।

ম্লান হাসল সুজাতা, যার মানে, না।

রামকুমার বলল, ‘আপনাদের কিছু হবেও না। কেন হবে? এত বছর ধরে চাকরি করছেন, এখনও সরকারি কর্তারা কীসে তুষ্ট সেটা ধরতে পারলেন না?’

রামকুমার খুব অর্থবহ দৃষ্টিতে সুজাতার দিকে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ে গেল সহকর্মী তপতীর কথা। সাধারণ গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে তপতী। কিন্তু মেয়েটির বাস্তববোধ দেখার মতো। সুজাতাদের বয়সি হলেও তপতী তাদের থেকে বেশ খানিকটা পরিণত। বছরকয়েক শহরের জল পেটে পড়তেই, তপতী গ্রাম ছেড়ে এসে এখানেই একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে বসল। বিয়ে-থা করেনি। গ্রাম থেকে বাবা-মাকে নিয়ে এল।

সেই তপতীর আবার গ্রামে পোস্টিং হতে সে বেঁকে বসল। সুজাতাদের কাছে বলল, ‘এই অর্ডার আমি পালটে তবে ছাড়ব।’ বাস্তবে ঘটলও তাই। তপতীর বদলে অন্য কোন শিক্ষকের ঘাড়ে বদলির কোপটা পড়ল, তা অবশ্য সুজাতা জনে না। তপতী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জানতে হবে, কোন পুরুষের কী চাহিদা! লোকটা বোকা ছিল বুঝলি! খুব বেশি আপস করতে হল না। বাঁ হাতের মুঠোয় আদর করে কিছু ছাপানো কাগজ গুঁজে দিতেই গলে গেল!’

আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তপতী বলল, ‘তুই চাইলে লোকটার সঙ্গে আমি একবার কথা বলে দেখতে পারি। খুব বেশি কম্প্রোমাইজ না করে যদি হয়ে যায় ক্ষতি কী? আর একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় বল তো? পৃথিবীর প্রত্যেককে আপস করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে. কেউ কম করছে, কেউ বেশি। এত সতীপনা করলে নিজেকেই ভুগতে হবে আজীবন!’

তপতীর চাপা গলায় বলা কথাগুলো কানে যেন গরম সিসের মতেই ঢুকল সুজাতার। সে মরে গেলেও পারবে না তপতীর মতো করে ভাবতে। কঠিন গলায় বলল, ‘না, তার দরকার হবে না!’ তক্ষুনি তার চোখের সামনে মনোময়ের সহজ ঋজু চাহনিটা ভেসে উঠেছিল।

আজকাল পনেরো দিনে একবার বাড়িতে আসার সুযোগ পায় মনোময়। আর তাই নিয়ে তার খেদের অন্ত নেই। যে দু-একদিন বাড়িতে থাকে মনোময়, সুজাতার ইচ্ছে করে না তাকে ছেড়ে দূরে যেতে। এটা শুধু প্রেমের জন্য নয়। নির্ভরতার জন্য, বলা যেতে পারে। মনোময় একটা ভাড়াবাড়িতে থাকে। সকাল-সন্ধে কাজের মাসি এসে তার জন্য রান্না করে চাপাঢাকা দিয়ে রেখে চলে যায়। অধিকাংশ দিন সেই ঠান্ডা খাবারই গিলতে হয় তাকে। সুজাতার বুকটা ভেঙে যায় এসব কথা শুনে। মনোময় বোঝে। তাই আজকাল ক্লিষ্ট হাসি ঠোঁটে টেনে এনে বলে, সে ভালো আছে।

সুজাতা এখন দিব্যি বোঝে, সেই ভালো থাকার মানে কী! সকালের ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে ঘণ্টাদেড়েক যাত্রার পর, কম করে দু-কিলোমিটার হাঁটা। তবে পৌঁছোনো যায় স্কুলে। সেদিন অংকের বিনোদবাবু বলছিলেন, ‘আপনি একটা সাইকেল কিনে নিন মিসেস মিত্র। এখানে একটু খোঁজখবর নিলে পুরোনোও পেয়ে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে স্কুলে আসবেন, আবার ফেরার সময় স্টেশনে রেখে বাড়ি চলে যাবেন।’

সুজাতাও দেখেছে, গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা এখানে সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন্তু সুজাতার বড়ো সংকোচ হয়।

ইংরেজির বিনতা মিস বলেছিলেন, ‘একটা কথা তোকে বলে রাখি সুজাতা। আমাদের গ্রামটা আর আগের মতো নেই বুঝলি? পাশের গ্রামে পলিটিক্যাল মারামারি নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই খুনজখম হয় বলে শুনি। তার ছোঁয়াচ এ গ্রামেও লাগছে। কাজেই সাবধানে রাস্তা চলবি । তুই নতুন লোক। কখনও রাত করে ফিরবি না।’

বিনোদবাবু বললেন, ‘শুধু পলিটিক্যাল বলছেন কেন? আমাদের স্কুলের কতগুলো মেয়ে গত দু-তিন বছরে উধাও হয়ে গেছে কেউ খোঁজ রেখেছে? সব নারীপাচারের ব্যাপার, বুঝলেন মিসেস মিত্র! কেউ দেখার নেই!’

বিনোদবাবু খেদের সঙ্গে জিভে শব্দ করলেন। ভয়ে শিউরে উঠছিল সুজাতা। সব শুনে মনোময়ও কম উদ্বিগ্ন হল না। বলল, ‘তোমার ছুটিছাটা জমা নেই? কোনওমতে ওসব নিয়ে এ বছরটা কাটিয়ে দাও সুজাতা। সামনের বছর দেখি, কাউকে ধরেকরে কিছু করা যায় কিনা!’

বিছানায় শুয়ে থাকা মনোময়ের শরীরের উপর নিজেকে হিঁচড়ে তুলে এনে সুজাতা বলল, ‘আর ততদিনে আমার যদি একটা কিছু হয়ে যায়? তুমি এত দূরে থাকো, তুমি তো খবরও পাবে না! আমার খুব ভয় করে।’

মনোময় বলল, ‘ভয়ের কী? তুমি একা অত দূরে চাকরি করতে যাও? আরও অনেকে ওই স্টেশনে বা কাছাকাছি স্টেশনে নামে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে। তোমরা দল বেঁধে যাওয়া-আসা কোরো। দেখবে কোনও বিপদ থাকবে না।’

মুখে এ কথা বলে সুজাতার মনে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেও মনোময়ের গলায় যেন জোর নেই। সুজাতাও হয়তো সেটা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছুই করার নেই, মনে করে চুপ করে রইল দুজনেই।

দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানখেতকে সাক্ষী রেখে ট্রেনটা ছুটছে। সুজাতাদের স্কুলের হেডমাস্টার অভ্রনীল দত্ত, বিপ্লবী মানুষ। একসময় নাকি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করতেন। কিন্তু রাজনীতির ক্লেদটা নিজের চোখের সামনে দেখার পরেই এক মুহূর্ত আর থাকেননি তার মধ্যে। ইদানীং বেশ হালছাড়া হতাশ গলাতেই কথাবার্তা বলে থাকেন। একদিন স্টাফরুমে সুজাতাকে ঝুঁকির কথা বলতে শুনে, নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘খুব বেশি ভেবো না এসব নিয়ে সুজাতা। পৃথিবীটা এরকম-ই। এভাবেই চলবে। তুমি আর আমি কিছু ভাবলেই যে সেটা হয়ে যাবে, এমন নয়। আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি, আমার কিংবা তোমার মতে কিছুই হওয়ার নয়।’

তারপর থেকে প্রবীণ এই শিক্ষকের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বই হয়ে গেল সুজাতার।

মানুষের সত্ত্বা সবসময়ই দ্বৈত। যে-অভ্রনীল অন্য সময় সুজাতাকে স্ত্বান্না দেন, সেই তিনিই কোনও কোনওদিন চরম বিরক্তিতে বলে ওঠেন, ‘ভেবে দ্যাখো একবার, সরকারি যোজনাগুলিকে গ্রামীণ জনতার কাছে পৗঁছে দেবে কে? না আমরা। পোলিয়ো ড্রপস খাওয়ানোর প্রচার কে করবে? আমরাই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের বোঝাবে, গ্রামীণ মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাবে, সাক্ষরতা অভিযান চালাবে, বিনে পয়সার বই বন্টন করবে, বাচ্চারা স্কুলে না এলে বাড়ি থেকে টেনে আনবে, সরকারি কর্তারা এলে জলপানির ব্যবস্থা করবে কে? কেন, আমরা!’

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথাটা যে কত দূর সত্যি, তা আজ হাড়ে-হাড়ে টের পেল সুজাতা। দশটা বাজতে না বাজতে স্কুলের সামনে এসে হাজির হয়েছে ধুলোমাখা দুটো গাড়ি। ঝটপট দরজা খুলে চার-পাঁচজন মানুষ নেমে এলেন। ততক্ষণে তাদের দেখতে গ্রামের কৗতূহলী মানুষজন ভিড় করেছে। আজ স্কুলে অ্যাটেনডেন্স একশো শতাংশ। এর পুরো কৃতিত্বটাই অবশ্য স্কুলের অশিক্ষক কর্মীদের। অভ্রনীলের একটা বড়ো চিন্তা তাতে দূর হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সুজাতারাও।

সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতার নাম জয়ন্ত গুহ। ক্লাসগুলো খুব কম সময়ে পরিদর্শন করে ফিরে এলেন স্টাফরুমে। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসলেন সরকারি প্রতিনিধিরা। তাদের ফেরার তাড়া আছে। ফলে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে তারা রাজি নন।

জয়ন্ত গুহ গম্ভীর চোখে হেডমাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের কথাও শুনি–!’

খুকখুক করে একটু কেশে নিলেন অভ্রনীল। তারপর বললেন, ‘আমাদের স্কুলবাড়িটার অবস্থাটা তো নিজের চোখেই দেখলেন স্যার। আমাদের এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে অনেকবার বলেছি। কাজ হয়নি। আরও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ধরুন, স্কুলে যে-টিউবওয়েলটা আছে, তাতে জল ওঠে না ঠিকমতো। বাচ্চারা জল খেতে পারছে না। স্কুলের মূল দরজাটা চুরি হয়ে গেছে। সকালবেলা এসে আমরা দেখতে পাই অবলা জীবের বিষ্ঠায় ভরে আছে ক্লাসঘর। পরিষ্কার না করলে ভদ্রভাবে বসা পর্যন্ত যাবে না। কে পরিষ্কার করবে? এখানে তো  কোনও সাফাইকর্মীও নেই!’

অভ্রনীল হাঁফিয়ে উঠলেন সমস্যার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে। জয়ন্ত গুহরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে গিয়েই এমন ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত। তাই, তার মুখেচোখে কোনও ভাবান্তর ধরা পড়ল না। কেবল বললেন, ‘সমস্যা কোথায় নেই অভ্রনীলবাবু? এই তো, আমরা শহর থেকে আসছিলাম। আসার পথে গাড়ির টায়ার গেল ফেটে। এটা সমস্যা নয়?’

জয়ন্ত গুহের রসিকতায় তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা হেসে উঠলেন।

জয়ন্ত তাদের থামিয়ে বললেন, ‘যাক সে কথা। ঘটনা হচ্ছে, অভ্রনীলবাবু, আমি আপনাদের কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে আসিনি। স্কুলের ডেভেলপমেন্টের জন্য পঞ্চায়েতের কাছে সরকারি টাকাপয়সা আছে। এত দূর থেকে আমরা তো আর সবটা দেখে উঠতে পারি না! আপনাকেই প্রধানের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিতে হবে। তবে একটা কথা, মিড-ডে মিলের ব্যাপারে সরকার কিন্তু এখন খুবই কড়া। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজেই ওই প্রকল্পটা যাতে ঠিকভাবে চলে সেটা দেখবেন।

‘মিড-ডে-মিল?’ অভ্রনীল আঁতকে ওঠেন, ‘সত্যি বলতে কী জয়ন্তবাবু, সপ্তাহে তিনদিনের বেশি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না হয় না। বাসনপত্র নেই। জ্বালানি কেনার টাকা পাওয়া যায় না। আপনারা কেবল আমাদেরই দোষ দেখেন!’

অভ্রনীল রেগে উঠতে গিয়েও উলটোদিকে বসে থাকা সুজাতার ভয়ার্ত মুখচোখ দেখে চুপ করে যান। সরকারি লোকেদের কাছে কোন বিষয়গুলি তুলে ধরা হবে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মিটিংয়ে মিড-ডে মিলের বিষয়ে প্রবলভাবে সরব হয়েছিলেন অভ্রনীল। তার বক্তব্য ছিল, একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক এইবার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাচ্চারা মিড-ডে মিলের মতো সরকারি প্রকল্প থেক বঞ্চিত হবে, আর সব দোষটা এসে পড়বে শিক্ষকদের উপর– এটা চলতে পারে না।

তখনই অজানা আতঙ্কে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিল সুজাতার। মরিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘এমন চরম মনোভাব নেওয়া ঠিক হবে না স্যার। আপনি মোটরসাইকেলে গ্রামের মধ্য দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। কেউ যদি আপনাকে একা পেয়ে অপহরণ করে, তাহলে? আপনি আছেন বলেই আমরা জোর পাই।’

‘তা বলে কি চুপ করে থাকব দিনের পর দিন?’ অভ্রনীল রেগে গিয়েছিলেন সেদিনও। তারপর নিজেকে সামলে, শান্ত গলায় বললেন, ‘মনে রেখো, এটা আমার গ্রাম। আমার মাতৃভূমি। আমার কিছু অধিকার আছে। পাঁচটা মানুষ আমায় সম্মান করে। সবকিছু এত সহজ হবে না।’

ভূগোলের দিদিমণি চিত্রা সমর্থন করেছিল সুজাতাকে। বলল, ‘আমার মনে হয় সুজাতা ঠিক কথাই বলেছে স্যার। আপনি না হয় এখানকার ভূমিপুত্র। আমরা তো তা নই। সকালবেলা সংসার গুছিয়ে রেখে শহর থেকে এখানে আসি চাকরি করতে। কাজেই, আমার মনে হয় কৗশল নিয়ে চলাই সমীচীন হবে।’

অভ্রনীল খানিকটা থমকে গেলেন শিক্ষিকাদের প্রত্যুত্তরে। শেষে নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘কৗশল কাকে বলে, আপনারাই বলে দিন আমায়। প্রধানের কাছে মিড-ডে মিলের টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী আসে। সেগুলো ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আংশিক দেওয়া হয়। হেডমাস্টারের আলাদা ঘর আছে। কিন্তু প্রথমত সেটি জরাজীর্ণ, বসার অযোগ্য, উপরন্তু পঞ্চায়েত মেম্বারের বাড়ির পশুখাদ্য সব ওখানেই থাকে, আপনারা জানেন। স্কুলবাড়িটা ভেঙে পড়ছে, কারওর নজর আছে সেদিকে? সরকারি লোকজন তো দেখেশুনে আমাদেরই দোষ দেবেন। বলবেন, আপনারাই ঠিকভাবে যত্ন নেননি। শাস্তিও দিতে পারেন তারা। তখন কোন কৌশলটা কাজে লাগবে বলুন তো!’

সুজাতা আর কোনও কথা বলেনি। চিত্রাও চুপ করেই ছিল। কারণ ওরা সকলেই জানত, অভ্রনীল যতই গলা ফাটান, সে কেবল অরণ্যেরোদন ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এই গ্রামে প্রধানের প্রতিপত্তি সীমাহীন। সামনে অবশ্যই একটা ভদ্রতার আড়াল আছে। কিন্তু বাস্তবে যে তার ভয়ংকর লোকলস্করের সঙ্গে ওঠাবসা, এ কথাও গ্রামে সকলে জানে। তাই কেউ মুখ খোলে না। কে জানে, কোন কথায় আবার কোন সংঘাতের আগুন জ্বলে ওঠে!

অভ্রনীলের অভিযোগ লোকটি নতমস্তকে শুনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যাবে– এটাই তো ঘটেছে বারবার।

সরকারি প্রতিনিধিরা আসার আগেরদিন অভ্রনীল নিজেই স্কুল বসার আগে একজন মজুরকে ডেকে এনে গোটা স্কুল সাফ করালেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। সুজাতা অবশ্য বলছিল, সে-ও অর্ধেক খরচ দেবে। স্কুল সাফ করা কি একা হেডমাস্টারের দায়িত্ব?

অভ্রনীল রাজি হননি। গলা নামিয়ে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাতে নিজেকে অনেক বোঝালাম সুজাতা। কিন্তু মন সায় দিল না আপসে। বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাকেই সামনে না এনে উপায় নেই সুজাতা। কাউকে আড়াল করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।’

সুজাতা চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচল তাকে ক্রমাগত পীড়িত করছে।

অভ্রনীল ফের বললেন, ‘ভয় পাচ্ছ?’

সুজাতা ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিল, ‘একটু।’

অভ্রনীল বললেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না, দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই, মরব না’– শুনেছ তো এই রবীন্দ্রসংগীতটা? তাহলে? সমস্যার প্রতিকার তো একদিন কাউকে না কাউকে করতেই হবে। তাহলে আমরাই বা নই কেন? এখনই বা নয় কেন?’

জয়ন্ত গুহ পোড়খাওয়া আমলা। ফুঁসে উঠলেন, ‘দোষের ভাগি তো আপনাকেও হতে হবে অভ্রনীলবাবু। এই স্কুল দেখাশোনার দায়িত্ব সরকার আপনার উপর সঁপেছে। ইস, কী অবস্থা করেছেন স্কুলটার! চোখে দেখা যায় না!’

অভ্রনীল ম্লান হেসে বললেন, ‘কেন কিছু হয়নি, সবই আপনাকে বলেছি স্যার। তারপরও…!’

জয়ন্ত গুহর পাশে বসে থাকা অন্য অফিসারটি এবার মুখ খুললেন, ‘ঞ্জসব বাহানা না হয় না-ই শোনালেন! আমরা সবকিছুই জানি। গ্রামের বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা শিক্ষক স্কুলেই আসেন না। কেবল মাইনে নেন। আমরা এও জানি, সেই মাইনে থেকে সামান্য টাকা গ্রামেরই কোনও বেকার যুবককে দিয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষকতার কাজটা করিয়ে নেন।’

জয়ন্ত গুহ হাসেন, ‘যা হোক, এটুকু দায়িত্ববোধ তো তাদের আছে, কী বলো সরকার! এটুকু অন্তত বোঝে যে, স্কুলটা খুলতে হবে।’

সরকার বলে যেতে থাকেন, ‘আমরা জানি, এ স্কুলেও সেই ঘটনা ঘটে। প্রধানসাহেব আমাদের সবই জানিয়েছেন। লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ হবে না অভ্রনীলবাবু।’

অভ্রনীল স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে। বলতে গেলেন, তার স্কুলে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। তিনি গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এইসময় বিনোদবাবু এসে তার কানে কিছু যেন বললেন। মিটিং ছেড়ে বাইরে এলেন অভ্রনীল। গ্রামের প্রধান অরূপ মাইতি এসেছেন। মুখে বিগলিত হাসি। দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠল অভ্রনীলের। ভ্রূদুটো কুঁচকে গেল।

প্রধান বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’

অভ্রনীল প্রমাদ গুনলেন।

প্রধান বললেন, ‘শহর থেকে বাবুদের যে-দলটা এসেছে, তারা আজ এখানেই থাকবেন। কাল এখান থেকেই অন্য জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে যাবেন। ওদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হয়।’

অভ্রনীল বললেন, ‘পঞ্চায়েত করুক। আমায় বলছেন কেন?’

প্রধান বললেন, ‘সে তো করবই। কিন্তু, আপনার স্কুলের দুই দিদিমণিরও বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাবুদের একটু যত্নআত্যি…!’

প্রধানের কথা শেষ করতে দিলেন না অভ্রনীল। বলে উঠলেন, ‘ওরা অনেক দূর থেকে আসেন। সংসার, ছোটো বাচ্চা আছে। ওদেরকে তো ছাড়তেই হবে ভাই!’

‘ছাড়তেই হবে, মানে?’ প্রধানের গলা চড়ে যায়, ‘ঞ্জই স্কুলে চাকরি করতে হলে ওদের যে এটুকু করতেই হবে মাস্টারমশাই!’

অভ্রনীলের যে কী হয়ে গেল, হঠাৎই হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন প্রধানের গালে। অরূপ মাইতির টকটকে গায়ের রং ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। তাকে কিছু বলতেও হল না। তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভ্রনীলের উপর।

তার পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য অবশ্য প্রস্তত ছিল না সুজাতা। সমস্ত ক্লাসঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছেলেমেয়েদের দল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে দুষ্কৃতীদের উপর। আর অভ্রনীল দূর থেকে চ্যাচাঁচ্ছেন, ‘ওরে ছেড়ে দে। মারের পালটা মার নয়।…’ কিন্তু তার দুচোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব