দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

জন্মের গল্প

বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে, অন্যমনস্কতা বেড়েছে ভীষণ ভাবে। বিশেষ করে অফিস ছুটির পর। কখন যে বাস, ট্রেন ধরে আমাদের স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসি, হুঁশ থাকে না। সম্বিৎ ফেরে লোকাল ট্রেনটা যখন ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। গমগম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই গেটের দিকে। ব্রিজ পার হলেই দেবনগর স্টেশন, জন্মাবধি এই অঞ্চলেই আমার বসবাস।

আজ আমাকে অন্যমনস্কতা সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ডাউন লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়েছি, এটাই আপ-এ যাবে। কামরায় তাড়াতাড়ি ওঠার সুবাদে পেয়েছি জানলার পাশের সিট। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আদর্শ বসার জায়গা। কিন্তু হতে পারছি কই! মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে, চাপা টেনশন। উদ্বেগটা গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে। গত তিনবছর ধরে আমার একটা বিশেষ পরিচয় তৈরি হয়েছে, আমি একজন লেখক। নামি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। এখন অবধি গল্পকার। উপন্যাসে হাত দিইনি। কবিতা আমার ঠিক আসে না। প্রবন্ধ লেখার মতো পাণ্ডিত্য আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম কলেজবেলায়, কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। দু’তিনটের বেশি লিখিনি। বন্ধুরা ভালো বলেছিল। তবে চর্চাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাইনি। কারণ আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বড়োবাজারের এক ওষুধের হোলসেলারের খাতা লেখে। দাদার লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি-র পর বিভিন্ন বিজনেস ট্রাই করে যাচ্ছিল। পুঁজির জোর নেই, ফেল করছিল বিজনেসগুলো। বাড়িতে মা, শ্বশুরবাড়ি ফেরত পিসি আর বোন, তখন স্কুলে পড়ে সে। একার রোজগারে ছ’জনের খাওয়াপরা চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বাবা। এরপর বোনের কলেজে পড়া, বিয়ে দেওয়া এসব আছে।

গল্প লেখার শৌখিনতা সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বেরিয়েই ঢুকে গিয়েছিলাম এখনকার চাকরিতে। একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। আমার চাকরির টাকায় একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল সংসারে। এদিকে দাদাও ফুড প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের বিজনেসে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার সুফল অবশ্য সংসারের গায়ে তেমন লাগেনি, দাদা দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছিল বহুদিন অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকাকে। তবু বলব দুই ভাই দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবার নিত্যদিনের আর্থিক অনটন থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছিল।

ছুটির দিনগুলো সত্যিকারের অবসরের দিন মনে হতো। তখনই আমার মাথায় আবার গল্প লেখার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, ছুটির সময়টা পাড়ায় আড্ডা না মেরে ভালো কাজে লাগাই। লিখে ফেললাম একটা গল্প। কাকে পড়াই? কেমন হয়েছে জানতে হবে তো। কলেজের সেই সব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাউকে খুঁজে নিয়ে পড়ানোর চেয়ে একটা সহজ কাজ করে ফেলা যাক, গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে নামি পত্রিকা ‘প্রিয়ভাষা’-র ঠিকানায়। আমি যে পাঠিয়েছি, কেউ তো জানতে যাচ্ছে না। মনোনীত না হলে লজ্জার কিছু নেই।

আমাকে অবাক করে গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। লেখাটা পাঠানোর পর থেকেই প্রিয়ভাষার প্রতিটি সংখ্যার ওপর নজর রাখতাম।

যে-সংখ্যায় বেরোল আমার গল্প, দু’কপি কিনে ফিরলাম বাড়ি। এক কপি বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এতে আমার লেখা একটা গল্প বেরিয়েছে।

সূচিপত্র ঘেঁটে গল্পের প্রথম পাতাটা বার করে ফেলল বাবা। তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন অচেনা কেউ! মুখে কিছু বলল না, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, মাধবী, তোমার ছেলে কী কান্ড ঘটিয়েছে দ্যাখো!

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গলাটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল বাবার। আসলে আমাদের বংশে এতবড়ো কান্ড কেউই ঘটায়নি। একেবারেই সাদামাটা গৌরবহীন বংশ।

বাবাকে যে-কপিটা দিয়েছিলাম, কদিনের মধ্যেই দুমড়ে-মুচড়ে একসা করে ফেলল। চেনাপরিচিতদের ধরে ধরে দেখাচ্ছে, পড়াচ্ছে ছেলের গল্প। এমনটা হবে আন্দাজ করেই আমি দু’কপি পত্রিকা কিনেছিলাম। প্রিয়ভাষার মতো বড়ো পত্রিকায় গল্পটা বেরোনোর ফলে চেনা, অচেনা মানুষের থেকে প্রচুর ফিডব্যাক পেলাম। কলেজের সেইসব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুরাও আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলাম একের পর এক গল্প লেখা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। আমাদের এলাকার শিক্ষিত, বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে লাগলাম।

গত তিনবছর ধরে জাগ্রত অবস্থায় আমি গল্প নিয়ে ভেবে যাই। কখনও গভীর ভাবে, অফিসে কাজের সময় আলতো ভাবে। অফিস ছুটির পর ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধে। টানা আটঘণ্টার ডিউটি শেষ হওয়ার ফলে মনটা থাকে উৎফুল্ল, আইডিয়াগুলো দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে মাথায়।

আমি যেহেতু কোম্পানির ল্যাবে আছি, তাই শিফটিং ডিউটি। ছ’টা দু’টো, দু’টো দশটা। সপ্তাহন্তর ডিউটির শিফট বদলে যায়। জেনারেল ডিউটি নয় বলে বাস, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা পাই। ভাবনায় বিশেষ বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু আজ এখন অবধি গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারিনি। ইতিমধ্যে দু’টো স্টেশন পার করেছে ট্রেন। ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। আসলে হয়েছে কি, এ বছরই প্রথমবার আমি পুজোসংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। ‘প্রিয়ভাষা’ থেকে নয়, প্রায় ওরকমই নামি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি দিয়ে লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। গল্পটা কত তারিখের মধ্যে দিতে হবে লেখা আছে তাতে। চিঠি দিয়ে লেখা চাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথমবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যেচে পাঠিয়েছি, কয়েকবার মৌখিক আবেদনে দু’একজন সম্পাদক লেখা চেয়েছেন। ‘চিঠি’ মানে তো রীতিমতো অফিশিয়াল ব্যাপার! আর তাতেই বিরাট চাপে পড়ে গেছি আমি। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, সময় মতো যদি না দিতে পারি গল্পটা! আর তো কোনওদিন লিখতে বলবেন না সম্পাদক। পুজোসংখ্যায় লেখার সুযোগ হারানোর মানে, এক লাফে অনেকটা বিখ্যাত হওয়ার চান্স মিস করা। এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

কোনও গল্প লেখার প্রাথমিক পর্যায়টা আমার কাছে এই রকম, চার পাঁচটা প্লট মনের চারপাশে ঘুরঘুর করে। সবই অপূর্ণ, অস্পষ্ট। বলতে পারা যায় প্রায় বিষয়ের আকার। শুধুমাত্র গল্প হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু আছে সেখানে। যে-কোনও একটাকে বেছে নিয়ে মনে মনে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, এগোবে কেমন ভাবে, শেষ করব কোথায়… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতে থাকি। যদি দেখি বেছে নেওয়া প্লটটাকে গল্প হিসেবে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছি না, সেটাকে তখনকার মতো সরিয়ে রেখে অন্য একটা প্লটকে নিয়ে আসি সামনে। ভাবনার এই প্রক্রিয়ায় হঠাৎই, বলতে গেলে আমার অজান্তে একটা প্লট পূর্ণতা পেয়ে যায়। লিখতে বসে যাই গল্পটা। কিন্তু এই প্রসেস কাজ করছে না পুজোসংখ্যার গল্পটা লিখতে গিয়ে। বাড়তি উত্তেজনা আর লিখিত আকারে দেওয়া সম্পাদকের ডেডলাইন আমার ভাবনার ধরনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছি সেই সব লেখকদের, যাঁরা বহুবছর ধরে ডেডলাইন মেনটেইন করে লিখে চলেছেন। আমার বোধহয় বড়ো লেখক হওয়া হল না।

ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। ছোটো খালব্রিজ। রোজকার সেই গমগম শব্দ আজ যেন আরও বেশি গম্ভীর শোনাচ্ছে। যেন ব্রিজটা বলছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরুণ লেখক। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হাতে মাত্র পাঁচটা দিন।

প্ল্যাটফর্মে নেমে খেয়াল করি বেশ মেঘ করেছে আকাশে! ট্রেন হাওড়া ছাড়ার সময় এত মেঘ ছিল না। বিকেল চারটেতেই দেবনগরে সকাল সন্ধে। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে! লিখতে বসা হবে না। সাদা পাতার সামনে বসে ভাবতে হবে। ইদানীং আবার না লিখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে বউদি তাড়া দেয়। বলে, কী এত ভাবছ বলো তো! তোমার বড্ড খুঁতখুঁতানি বাই। আরে বাবা, তোমার লেখাটাই এত সুন্দর, যা লিখবে লোকে গোগ্রাসে পড়বে। …বলার পর বউদি আমার জন্য চা বানানোর উদ্যোগ নেবে। মানা করলে বলবে, তুমি খেলে আমারও একটু খাওয়া হয় আর কি। আমার লেখা নিয়ে বউদির এই যে এত উৎসাহ, এর একটা কিঞ্চিৎ বাস্তব দিকও আছে। লিখে টুকটাক রোজগার হয় আমার। সেই টাকাটা বোন, বউদি কিছুতেই আমার মূল রোজগারের সঙ্গে মেশাতে দেবে না। লেখা ছাপা হয়েছে দেখলেই, দু’জনেই নানান বায়না করতে থাকে। শৌখিনতার বায়না। লিপস্টিক, পারফিউম, ঝুটোগয়না ইত্যাদি। মা, বাবা, দাদার জন্যেও কিছু কিনে আনে, আমার জন্যেও। এই খাতে খরচ করতে আমারও ভালো লাগে। পুজোসংখ্যায় গল্পটা লিখতে পারলে টাকা অনেক বেশি পাব। শুনেছি পুজোর লেখায় বেশি দেয়। সম্পাদকের চিঠিতে অবশ্য অ্যামাউন্টের উল্লেখ নেই।

প্ল্যাটফর্মের শেড পেরোতে চলেছি, চোখ গেল সিমেন্টের বেঞ্চের নীচে, একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা আছে। ছ’সাত মাসের বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায় না, তা সত্ত্বেও এই বাচ্চাটা কার, বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। জবার পুত্রসন্তান। বাচ্চাটার পিঠের কাঁথা, গায়ের জামা আমি চিনি। কারণ, জবা এঁটুলির মতো করে কোলে নিয়ে ঘোরে। কখনওই কাছছাড়া করে না। বাচ্চাটা এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেন? জবা গেল কোথায়? প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে এক দু’জন প্ল্যাটফর্মবাসীকে দেখা যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার বলতে আমি এখন একাই। লোকাল ট্রেনটা থেকে আরও যারা নেমেছিল, পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। গল্প মাথায় না আসার হতাশায় আমি শ্লথ হয়ে পড়েছিলাম। এখন বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় দেখে চলে যেতে মন চাইছে না। একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে আমাকে, বাচ্চাটাকে কেউ যদি চুরি করে পালিয়ে যায়! প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া খুবই সহজ। লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে, ছাড়ার মুখে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কেউ যদি উঠে পড়ে কামরায়, চট করে চলে যাবে নাগালের বাইরে। জবাপাগলি ফিরে এসে বাচ্চাটাকে না দেখতে পেয়ে যে কী মূর্তি ধারণ করবে, কল্পনা করতেই ভয় পাচ্ছি আমি।

আপাতত বাড়ি যাওয়া স্থগিত রেখে বেঞ্চটায় গিয়ে বসলাম। জবার বাচ্চার পাহারায় বহাল হলাম আর কি! পায়ের খানিক দূরেই কাঁথার ওপর শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। হাত-পা একটু আধটু নাড়ছে। মুখটায় হাসিহাসি ভাব। পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, কী করব জানি না। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ভোলানোর প্রবৃত্তি আমার নেই। জবাপাগলি স্নানটান করে বলে তো মনে হয় না। শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজলে অথবা মাছ চুরি করতে পুকুরে নামলে স্নান করা হয় ওর। এই যার স্বভাব সে তার বাচ্চাকে তেলটেল মাখিয়ে স্নান করাবে, আশা করাই বৃথা। বাচ্চাটার গায়ের কাঁথা, জামা ছ’মাস ধরে এই একটাই দেখে আসছি। কাঁথা, জামা, বাচ্চাটা মিলিয়ে সাক্ষাৎ একটা উৎকট গন্ধের মণ্ড। যতই কাঁদুক ওকে আমি হাতে নিতে পারব না।

জবার এই অপরিষ্কার থাকার কারণেই লোকে ওকে পাগলি বলে। মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকলেও, পুরো পাগলি সে নয়। যথেষ্ট সেয়ানা। বিশেষ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে। জবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। তখন বাচ্চাটা হয়নি। বাচ্চা সমেত জবাকে নিয়ে আরও একটা দারুণ গল্প হতে পারে। তবে সে ঝুঁকি আমি নিচ্ছি না। আগের গল্পটা লিখে বিরাট ফেঁসে গেছি। সন্তানের প্রতি জবার নিরেট অবসেশন, এটাই আমার জবাকে নিয়ে পরের গল্পের মেন থিম হওয়ার কথা। ওকে খুঁটিয়ে খেয়াল করেই বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে। সেই অবজার্ভেশন থেকেই আমি আন্দাজ করতে পারছি, খুব বেশি সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে হবে না, জবা এল বলে।

আমার এখন অদ্ভুত দশা! কয়েকহাত দূরে পড়ে রয়েছে গল্পের প্লট, পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু এক লাইনও লেখা যাবে না। জবাকে নিয়ে লেখা আগের গল্পের আফটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরকম হেনস্থা আগেও আর একজনের বেলায় হয়েছে, তার নাম সাধন। আসলে আমাদের এই মফসসলে সাধন, জবার মতো বিচিত্র চরিত্ররাই আমার লেখার রসদ। পুরোটা বানিয়ে লিখতে পারি না। এই বিচিত্রদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাদের নিয়ে সমস্যা কম। আমাকে খুব একটা বিব্রত করে না। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে অর্থপূর্ণ হেসে হয়তো বলল, অমুক পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম (মানে যে গল্পটা তাকে নিয়ে লেখা)। আমার চোখে পড়েনি লেখাটা, দু’চারজন পড়ে আমাকে পড়তে বলল। কেউ হয়তো আর একটু এগিয়ে বলল, সবই তো বোঝা যাচ্ছে, আমার নাম পালটে দিয়েও তুমি কিছু আড়াল করতে পারোনি। তবে ভালোই হয়েছে গল্পটা।

যে সব শিক্ষিত চরিত্রদের অবলম্বনে গল্প লিখি আমি, তারা জানে গল্পে সত্যির মিশেল না থাকলে লেখা প্রাণ পায় না। তাছাড়া চরিত্রের নাম, ঘটনাস্থল সবই তো পালটে দিই, সরাসরি অভিযোগ করারও সুযোগ থাকে না তাদের। কিন্তু সে দলে তো সাধন, জবারা পড়ে না। বই বা সাহিত্য থেকে যোজন দূরত্ব দু’জনের। সাধন তবু খানিকটা স্কুলবেলা কাটিয়েছে। জবা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি। সাধনের মা হসপিটালের আয়া। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে। দোকানে নিয়ম করে বসে না সাধন। তার নেশা নাচ। পাতি হিন্দি সিনেমার নাচ। কলোনি এলাকার জলসায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে মিউজিক সহযোগে নাচে। সাধনের বিয়ে দিয়েও ঘরমুখী করতে পারল না মা। বউটির স্বভাবগুণ ভালো, বরকেও ভীষণ ভালোবাসে।

সাধন একদিন স্টেজে নাচতে উঠেছে, খবর এল অন্তঃসত্ত্বা বউ ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাচ বন্ধ করল না সাধন। পারফর্মেন্স শেষ করে ছুটল হাসপাতালে। বউ চোখ বুজে শুয়ে আছে, যেন মরেই গেছে! আকুল আশায় সাধন কান রাখে বউয়ের বুকে। হার্টবিট শুনতে পায়। খুশি ছড়িয়ে পড়ে সাধনের মুখে। নিজের অজান্তেই বউয়ের হার্টবিটের সঙ্গে আলতো করে তাল দিতে থাকে পায়ে। …মোটামুটি এই রকম ছিল গল্পটা। নামি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাদের এলাকার পাঠকদের সাধনকে আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হয়নি। সাধনের মতো অখ্যাতর জীবনের গল্প বেরিয়েছে বিখ্যাত কাগজে! এই আবেগের উত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে জনৈক পাঠক খবরটা তুলে দিল সাধনের কানে, লেখক পরিচয়সহ।

একদিন সাধনের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সে। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, গুরু, তুমি শুনলাম আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখেছ বইয়ে! চট করে ব্যাপারটা স্বীকার করিনি। গম্ভীর মুখে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি গল্পটা পড়েছ? এমনটা জিজ্ঞেস করার কারণ, সাধন যদি অভিযোগ তোলে গল্পে ওকে ছোটো করা হয়েছে, তখন বলতে হবে, ও গল্প তোমাকে নিয়ে নয়। দেখছ না, ছেলেটার নাম আলাদা, থাকেও অন্য জায়গায়। ওই রাস্তায় গেল না সাধন। সে তখন আনন্দে আত্মহারা। বলেছিল, না, আমি পড়িনি। একজন দিদিমণি আমাকে বলল। স্কুলে পড়ায়, সে তো আর ঢপ দেবে না। তুমি মাইরি ‘সাজন’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তর মতো। আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতে, কত গল্প করেছি, ধরতেই পারিনি তুমি রাইটার। চলো চলো, চা খাবে চলো।

সেই যে আমাকে খাতির করা শুরু করল সাধন, আজও উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে পেলেই হাঁকডাক করে এগিয়ে আসে। চকরাবকরা ড্রেস, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায় ফিল্মি স্টাইল। আশপাশের মানুষজন বেশ অবাক হয়। বিশেষ করে যারা আমার লেখক পরিচয় জানে। ভাবে, লুচ্চা টাইপের ছেলেটার কী করে এই সাহস হয়, এরকম একজন মানী ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে? সাধনের অবশ্য সে সবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেখানেই দেখা হোক, গল্প জুড়ে দেয়। নিজের জীবনের গল্প। জোরজার করে চা, সিগারেট খাওয়ায়। আমি টের পাই ওর মনোবাসনা, সাধন চায় ওকে নিয়ে আরও একটা গল্প লিখি আমি। ওর তুচ্ছ জীবন নিয়ে অসাধারণ কোনও গল্প। একজন দিদিমণি এসে সেই গল্পের খোঁজ দেবে ওকে। বেচারি জানে না ওর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটা আগের গল্পে লেখা হয়ে গেছে আমার। বাকি যা পড়ে আছে, সমস্তটাই বোরিং। পরিচিত। পাঠক ওই গল্প জানে। সাধনকে ইদানীং এড়িয়ে চলি। দূর থেকে যদি দেখতে পাই, ধরে নিই অন্য রাস্তা।

জবাকে নিয়ে আমার সমস্যা আরও মারত্মক। মেয়েটা তিনবার সরকারি হোম থেকে পালিয়ে এসেছে। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের দেবনগর জায়গাটাই জবার পছন্দ। শেষবার হোমের কর্মচারীরা ওকে নিতে আসেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল জবার ওপর। প্রথমদিকে এই প্ল্যাটফর্মই ছিল জবার স্থায়ী ঠিকানা। ট্রেন থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার হয়তো কুলি খুঁজে পাচ্ছে না, জবা লাগেজ তুলে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডে দিয়ে আসে। বিনিময়ে টাকা নেয়। কখনও এর বাগানের ফল, ওর পুকুরের মাছ, খেত থেকে চুরি করে আনা সবজি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে স্টেশন লাগোয়া বাজারে। কখনও আবার কেটারিং-এর কাজে যায়। দোকান পরিষ্কার কিংবা রং করাতেও ওকে হাত লাগাতে দেখা গেছে। এভাবেই নিজের পেট চালায়। তবে যেটাকে ‘চুরি’ বললাম, সেটা ‘ডাকাতি’ বলাই বোধহয় ভালো। চুরিতে বাধা দিতে এলে এমন খিস্তি খেউড় করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, মালিক ভয়ে চুপ করে যায়।

ওকে নিয়ে যে-গল্পটা লিখেছিলাম, তাতে একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা ছিল। সত্যিই ঘটেছিল জবার জীবনে। লাস্ট লোকাল থেকে কিছু ছেলে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত জবাকে রেপ করতে গিয়েছিল। ছেলেগুলো জানত না জবা রেললাইনের পাথর থলেতে পুরে তার ওপর কাপড় জড়িয়ে মাথার বালিশ করে শোয়। পাথর ভরা থলে দিয়ে এইসান মার মেরেছিল ছেলেগুলোকে, একজন হসপিটালে, বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছিল। এই ঘটনা সম্বলিত গল্পটা পড়ে সাধনের দিদিমণির মতো কোনও এক পাঠক জবাকে জানায়, চিনিয়ে দেয় লেখককে। এক সকালে বাজার করছি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জবা। কোমরে গিঁট বেঁধে উঁচু করা পরা রংজ্বলা ম্যাক্সি, গামছাও বাঁধা কোমরে, চুলে চিরুনির চলাচল নেই বহুদিন। এটাই রোজকারের ড্রেস। সেদিন একমুখ হেসে বলেছিল, তুই নাকি কাগজে আমার নামে খবর লিখেছিস!

আমি ‘হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, আসলে’ বলে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিলাম। জবা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কাকে বলে জানে না। ছাপার অক্ষরে যা কিছু বেরোয়, ‘খবর’ বলেই মনে করে। আরও একটা বড়ো সমস্যা, জবার ভোকাবুলারিতে ‘তুমি’ সম্বোধন প্রয়োগ হয় না। যেসব রাশভারী কাস্টমারকে চুরি করে আনা মাছ, সবজি বিক্রি করে, তাদের আর মালিকশ্রেণির লোককে ‘আপনি’ ডাকে। বাকি সবাইকে তুই। যেহেতু ওকে নিয়ে লিখেছি, জবা ধরেই নিয়েছে আমি আপনজন। ‘তুই’ বলে তো ডাকবেই।

আপনজন হওয়ার যে কত ঝক্বি, বুঝতে পারলাম তারপর থেকে। দু’টো দশটার ডিউটি থাকলে সকালের বাজারটা আমি করি। একবার যদি জবার চোখে পড়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে। মুঠোতে বা গামছার কোঁচড়ে যা থাকে, মাছ, পেয়ারা, লেবু, ধনেপাতা, কলমি শাক… যেদিন যেমন চুরি করতে পারে, আমাকে অন্যদের তুলনায় সস্তায় দিতে চায়। বলে, নে না বাবু, পুরোটাই নে। কুড়িটাকা দিবি। তুই আমার চেনা লোক বলেই এত কমে দিচ্ছি।

‘বাবু’ সম্বোধনটা সম্মান জানানোর জন্য করছে, নাকি আমার নতুন নামকরণ করেছে জবা, বলার ধরন দেখে বুঝতে পারি না। জবার জিনিস না নেওয়ার থাকলেও, অনেক সময় নিতে হয়। একগাদা অদরকারি সবজিপাতি নিয়ে এলে মা রাগ করে। নিজের অসহায়তার কথা বলতে পারি না। বললেও বুঝবে না মা। কখনও দেখা যায় নিজের জিনিসপত্র সব বেচে ফেলে বাজারে এমনিই ঘুরঘুর করছে জবা, অথবা কোনও মাছওলা, সবজিওলাকে হেল্প করছে কাজে। আমাকে দেখতে পেলে মাঝে মাঝে উঠে আসে। পাশে হাঁটতে থাকে ডিঙি মেরে মেরে। এটাই ওর হাঁটার স্টাইল। নানা রাজ্যের গল্প বলে। সাধনের মতো ওকে নিয়ে আর একটা গল্প লিখিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় বলে না। জবার সেই বোধ নেই। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছও মনে করে না। আমাকে নিজের লোক মনে করে গল্পগুলো বলে। বেশিরভাগ চুরির গল্প। মালিক বাধা দেওয়াতে কী কী খিস্তি করেছে সেগুলো শোনায়। আমি আতঙ্কে মরি, এই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ওর কথাগুলো শুনে ফেলল! আমাদের একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায়। সাধনের সঙ্গে হাঁটতে দেখলে যতটা অবাক হয়, জবার বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, জবার পোশাক-আশাক পাগলির মতো তো বটেই, ডিঙি মেরে হাঁটাটাও পিকিউলিয়ার, রাস্তায় যারা হাঁটছে, সবার থেকে আলাদা। পায়ে আবার চটি পরে না।

ওর চুরির বিবরণের মধ্যেই আমাকে একদিন জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মে আর থাকছে না। ঘর ভাড়া নিয়েছে স্টেশন ধারে। আমি বলেছিলাম, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। লজ্জা পেয়ে হেসেছিল জবা, ভঙ্গিটা আর-পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই। পাগলামির ছিঁটেফোটা নেই তাতে। মাঝে কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করি বাজারে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, আশপাশের কোনও এলাকাতেই জবাকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটা? প্রশ্নটা বাজারের কাউকে করিনি। এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচা যায়। বেশ কয়েক মাস বাদে দেখি জবা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। চেহারায় বিয়ের কোনও সাক্ষর নেই, মানে সিঁদুর, শাঁখা, পলা… আমি সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম, খেয়ালই করল না। বাচ্চাটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ!

মাছওলা রবিনের কাছে মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করলাম, জবা কার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে? কেন, ওর নিজের? বলেছিল রবিন।

জানতে চেয়েছিলাম, বিয়ে করল কবে? বাচ্চার জন্য ওদের আবার বিয়ে করতে লাগে নাকি! তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল রবিন। ব্যাপারটা কিন্তু তুচ্ছ মনে হয়নি আমার। হাইফাই সোসাইটিতে আজকাল ‘সিঙ্গল মাদার’ প্রায়ই শোনা যায়। সেলিব্রিটিরা ‘সিঙ্গল মাদার’ হলে লেখালিখি হয় কত! সাহসিনীর সম্মান পায় নারীটি। এর উলটো দিকে, সমাজের প্রান্তসীমায় থাকা জবা একই রকম কাজ করে ফেলল, কোনও শাবাশি নেই! শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা! রবিনের থেকে মাছ নিয়ে রাস্তায় এসে দেখি, জবা বসে আছে রেলের ইলেকট্রিক পোস্টের বেদিতে। ওর সামনে গিয়ে বলি, কী রে, তোর বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে?

একগাল হেসে জবা বলেছিল, ছেলে।

ওর বাবা কোথায়? একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেঁচিয়ে উঠতেই পারত। কেন-না, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকেই ওকে করেছে। ক্ষেপে যায়নি। শান্ত গলায় বলেছিল, ওর বাবা নেই। বাবার কী দরকার!

দরকার নেই কেন বলছিস? আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি জবা। মুখে নানারকম আওয়াজ করে বাচ্চাটাকে আদর করতে লেগেছিল।

দিন যায়। জবাকে আর আগের মতো বাজারের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করতে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে, কোলে সবসময় বাচ্চা। একদিন একদম সামনে থেকে দেখলাম, জবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শরীরে ঝিমানো ভাব। হাঁটাচলায় আগের সেই চনমনে ব্যাপারটা নেই। কোলে বাচ্চাটা ঠিক আছে। একটু বড়োও লাগছে। মা কিন্তু অতীব শীর্ণ।

ফের রবিনকেই জিজ্ঞেস করলাম, জবার কোনও রোগভোগ হল নাকি? চেহারা তো বেশ ভেঙে গেছে দেখছি। আর বোলো না, অতিরিক্ত আদরে পাগলিটা বোধহয় বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে। এক মুহূর্ত কাছছাড়া করে না। নিজের কাজ কারবারও বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওকে দেখতে পাও বাজারে কিছু বিক্রি করতে?

মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিলাম আমি। রবিন ফের বলেছিল, নিজে কী খায়, কতটুকু খেতে পায়, কে জানে? ও না খেলে বুকের দুধও তো হবে না। বাচ্চাটা খাবে কী? এ নিয়ে তুমি যদি কিছু বলতে যাও, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাও, তক্ষুনি তেড়ে আসবে। টাকাপয়সার জন্য কোনওদিনই কারুর কাছে হাত পাতে না জবা, বিরাট প্রেস্টিজ জ্ঞান! বাচ্চাটার ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলে গালাগাল শুনতে হবে। ইতিমধ্যেই শুনেছে অনেকে। ও বোঝে উলটো। মনে করে বাচ্চার ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। নজর কাটাতে নানান ঠাকুরের থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদুলি, তাবিজ পরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে। …রবিন আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। মাছবাজার থেকে উঠে এসে ফের রেলের পোস্টের নীচে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছিলাম উশকোখুশকো চুলের জবাকে। একেবারে প্রেতিনীর চেহারা! মুখের ‘মা মা’ হাসিতে অবশ্য কোনও অন্ধকার লেগে নেই। বাচ্চাটার সঙ্গে আদরের খুনশুটি করে যাচ্ছে। সেদিন আর ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সরে গিয়েছিলাম সামনে থেকে।

দিন দুয়েক বাদে ছ’টা দু’টোর ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছি, স্টেশনরাস্তায় দেখি আমার সামনে হাঁটছে জবা। মন্থর হাঁটা। বাচ্চাটা তো কোলে আছেই। পা চালিয়ে ওর পাশে চলে গিয়েছিলাম। জবাকে বলেছিলাম, কী রে, কেমন আছিস? বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে চেহারাটা তো একেবারেই গেছে দেখছি! ওর বাবা খোঁজটোজ নেয়?

কেন নেবে? সে তো বাবা হতে চায়নি। আমি মা হতে চেয়েছিলাম। বলেছিল জবা।

আমি বললাম, তবু সে লোকটা তো বাবা। তার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তুই বাচ্চাটাকে মানুষ করতে গিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাবি! নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?

ও সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেলেই কাজে নেমে পড়ব। এখন তো কোথাও রেখে যেতে পারি না। কারুর কাছে দিতেও পারি না, সবাই নজর দেয়।

বাচ্চার প্রতি জবার যা অন্ধ বাৎসল্য, ওকে বোঝালেও বুঝবে না, বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার আগেই জবা মরে যেতে পারে। ও কথায় না গিয়ে জবাকে বলেছিলাম, মা হওয়ার যখন ইচ্ছেই হয়েছিল তোর, বিয়েটা করে নিতে পারতিস। তাহলে লোকটা এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে পারত না। বাচ্চা মানুষ করতে মা-বাবা দু’জনকেই লাগে। উত্তরে জবা বলেছিল, বিয়ে ফিয়ে বহুত ঝামেলার ব্যাপার, আমার মা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে গেছি ব্যস। মা হওয়ার ইচ্ছেটা কখন, কীভাবে এল তোর মনে? জিজ্ঞেস করেছিলাম জবাকে। আসলে অশিক্ষিত মেয়েটা মাতৃত্বের আকাঙক্ষাটা কীভাবে প্রকাশ করে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম। শিক্ষিতরা তো অনেক গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু জবা যা বলল, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল আমার।

একটা ঘটনার কথা বলেছিল জবা, মহাদেবের কেটারিং-এর হয়ে কাজে গিয়েছিল চাপাডাঙায়। বিয়ের কাজ। রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে, পেটে ভালোমন্দ খাবার, ম্যাটাডোরে বাসনপত্রের মাঝে বসে ঢুলছিল জবা। মাকালতলায় এসে বিগড়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার চেষ্টা করছিল সারানোর। জবা ম্যাটাডোর থেকে নেমে মাঠের ধারে শিরীষগাছের নীচে গিয়ে বসেছিল। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে স্বপ্ন দেখে, গাছটা তাকে যেন বলছে জবা রে, এবার মা হ। মা হয়ে যা জবা। মেয়েমানুষ যখন হয়েছিস, মা হবি না কেন? মা হওয়ায় দারুণ সুখ, খুব আনন্দ… ঘুম ভাঙতে জবা দেখেছিল ভোর হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে কেটারিং কোম্পানির গাড়ি। তাতে রাগ হয়নি জবার, মা হওয়ার ইচ্ছেতে মন তখন টইটুম্বুর। গাছটাকে প্রণাম করে পায়ে হেঁটে মাকালতলা থেকে ফিরেছিল দেবনগরে।

জবার ভাষায়, কিছু হারামি সবসময় ওঁত পেতে বসে থাকে ওকে পাওয়ার জন্য, তাদেরই একটাকে ঘরে তুলেছিল জবা। কিছুদিন পর যখন বুঝল বাচ্চা এসে গেছে পেটে, হারামিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। …ঘটনাটা অবান্তর, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। বিষয়টাকে নিয়ে গল্প লেখাই যায়। দ্রুত বাসনাটাকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। সাধন, জবা এদের নিয়ে দ্বিতীয় গল্প লিখে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। একটা করে লেখাতেই রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে মারে। দু’টো লিখলে আমাকে এতটাই আপনজন ভাববে, চলে আসতে পারে বাড়িতে।

নাঃ, এবার কিন্তু বেশ চিন্তাই হচ্ছে। এখনও কেন ফিরছে না জবা? আকাশে যা মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামল বলে। তবু ভালো, বাচ্চাটা এখনও কেঁদে ওঠেনি। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওর দিকে, দেখছি, মুখে নানারকম আওয়াজ তুলে নিজের মনে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে। …বৃষ্টি এসেই গেল। জোর কদমে শুরু হয়েছে। শেডের শেষের দিকে আছি বলে প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি পড়ে ছিটকে আসছে জল। একটু বাদে প্ল্যাটফর্মও ভাসবে। শেডে অনেক ফুটোফাটা আছে, ওপর থেকে জল নামার পাইপও ভাঙা। বাচ্চাটাকে এবার তুলে আনতেই হবে, নয়তো ভিজে যাবে পুরোপুরি। বেঞ্চ থেকে নেমে বাচ্চাটাকে দু’হাতে তুলে ধরি, উৎকট গন্ধটা আছে ঠিকই, তবে শিশুর গায়ের সেই অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধটা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়নি।

আমাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল জবা। ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। খুব হাসছে, নুয়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখেই ওর হাসি। বলে ওঠে, তোকেই তো ওর বাপের মতো লাগছে! জবা যেন একদলা কাদা ছুড়ে মারল আমার গায়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ওকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। কাকে কী বলতে হয় জানে না। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, কোথায় থাকিস? বাচ্চাটা তো এক্ষুনি ভিজে যেত।

বাচ্চাকে কোলে নিল জবা। বলতে থাকল, আর বলিস না মাইরি, বাচ্চাটাকে রেখে একটা প্যাসেঞ্জারের মাল তুলে দিতে গেছি রিকশায়, পুলিশ আটকে রেখে দিল। বাজারে হারানদার সোনার দোকানে চুরি হয়েছে, আমার কাছে এটা ওটা জানতে চাইছে পুলিশ। বলছি, বাচ্চাকে রেখে এসেছি স্টেশনে, কথা কানেই নিচ্ছে না!

অঝোরে বৃষ্টি সত্ত্বেও শেড থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম জবার ছোড়া কাদাটা আলকাতরার মতোন নাছোড়! এত বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাচ্ছে না।

পরের দিন ঘুম ভাঙল একদম ভোরে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। মাকালতলার যে শিরীষ গাছটার কথা বলেছিল জবা, গাছটা আমি চিনি। পিছনে মাঠ। অল্প বয়সে ম্যাচ খেলতে গেছি। স্বপ্নে দেখছি, সেই গাছতলায় শুয়ে আছি আমি। গাছটা বলছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে গল্প লেখ। গল্পটা তো এসে গেছে মাথায়। কেন দেরি করছিস? গল্পটা যে মাথাতেই মরে যাবে…

ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। হাতে মাত্র চারটে দিন। পুজোসংখ্যায় গল্পটা দিতে হবে। বাথরুম ঘুরে এসে বসে পড়েছি লেখার টেবিলে। প্রথম লাইনটা লিখলাম, বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে…

 

রাজবাড়ির রহস্য

গিয়ার একটু উপরে তুলে প্রবীর বলল, আসল মজা আসত মামার বাড়িতে। পাশেই ছিল সীতা কুণ্ড, সবাই মিলে হুল্লোড় করে ঝাঁপ দিতাম তার স্নিগ্ধ শীতল জলে। সারাদিন সাঁতার কেটেও জ্বর-সর্দি কিচ্ছু হতো না।

পাশেই অরিন্দম বসেছিল, সে হই হই করে উঠল। থাম তো তোর সীতা কুণ্ড। আমার গ্রামে চল। পাশেই দ্বারকেশ্বর নদী আর বিশাল ধানের খেত। গেলে বুঝবি পাড়াগ্রামে কত আনন্দ।

দুজনে বেশ তুমুল বিতর্ক শুরু করেছে দেখে অতনু চুপ থাকে কেন? সেও যোগ দিল, তোরা নদী আর কুণ্ড নিয়ে রইলি আর আমার মাসির বাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার-এর মধ্যে পাহাড়, নদী, রাজবাড়ি, খেত, পুকুর সবকিছুই পাবি।

রাজবাড়ির নাম শুনে অনন্ত আর প্রবীরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অরিন্দম বলল, চল তাহলে পুজোর ছুটিতে তোদের মাসি বাড়ি ঘুরে আসা যাক। সবাই রাজি হয়ে গেল।

পুজোর ছুটিটা বেশ জমিয়ে উপভোগ করতে চায় সবাই। তাই শহরের পুজো নয়, এবার গ্রামে গিয়ে একটু অন্য ভাবে পুজো উপভোগ করার জন্যে সবাই অনন্তর কথামতো হাজির হল গিয়ে ওর মাসির বাড়ি। দারুণ জায়গা, মন প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানো যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আর মাসিমণির বরাতে বেশ জম্পেস খাওয়াদাওয়া চলছে।

সারাদিন পাহাড় নদী ঘুরে এসে ভীষণ ক্লান্ত চারমূর্তি। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আর নিজেদের মধ্যে নিয়মমাফিক তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সকলেই। ইতিমধ্যে মাসিমা মুড়ি আর তেলেভাজা দিয়ে গেছেন, ওটাকেই চটকানো হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে অতনু বলে উঠল, তোরা রাজবাড়ি কবে যাবি? আমি বাপু পাহাড় নদী দেখতে আসিনি। আমার মামারবাড়িতে এইসব ঢের দেখেছি।

প্রবীর বললে, চুপ কর তো। শুধু ঘ্যান ঘ্যান করতে হবে না। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে প্রায় সাড়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বললে, জানিস রাজবাড়ি মানে অনেক কিছু থাকতে পারে, এই ধর গুপ্তধন!

অরিন্দম বললে, হ্যাঁ তোর জন্য গেড়ে রেখে গেছে। তুই যাবি আর তুলে নিয়ে আসবি।

গল্প শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে গেল রাজবংশের কেউ এখনও আছে কি না। ওদের সাথে দেখা করে সব জানতে হবে।

অতনুর যেন এখানে আসার একটাই কারণ। রাজবাড়ি গিয়ে লুকোনো গুপ্তধন আবিষ্কার করা। ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পাশের ঘরে মাসিমা ছিলেন, তিনিও চারমূর্তির কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি এসে বললেন, একবার ঘুরেই এসো। তবে সন্ধে কোরো না। জায়গাটা ভালো নয়।

সকালে উঠেই সবাই তৈরি রাজবাড়ি দর্শন করতে যাবার জন্যে। মাইল খানেকের পথ। একটা টোটো করে সবাই উঠে বসল। মনের মধ্যে অনেক কথা লুকোচুরি খেলছে, অতনুর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সেই সবার আগে বসেছে। আর ক্রমাগত টোটো চালককে একটু তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যে খোঁচাতে শুরু করেছে। টোটোওয়ালা ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলেই ফেলল, দাদাবাবু আপনি এরোপ্লেন ভাড়া করে নিন। আমার টোটো এই স্পিড-এর বেশি চলে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রাজবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। টোটো থেকে নেমে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল, প্রায় ভগ্নদশা তবু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রাজবাড়ি। হুট করে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দুজন প্রহরী। রাজবাড়ি এখন সরকার অধিগ্রহণ করেছে, তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পাওয়া যাবে। ভেতরে যেতে গেলে সরকারি অনুমতি লাগবে।

একটু নিরাশ হলেও সেই দিনের মতো ওরা আশেপাশেই ঘুরে দেখে নিতে লাগল। কোথায় হাতিশাল, কোথায় সিপাহিদের থাকার জন্য ঘর ছিল। সামনেই একটা বড়ো পুকুর আছে। টোটোচালক সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। ওরা ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে এসে দেখতে পেল কিছু ভগ্ন মন্দিরের স্তূপ। সেখানে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে যখন ফিরে এল তখন বেশ খিদে পেয়েছে।

অরিন্দম বলল, চল রে আগে পেটে কিছু দিয়ে আসি, তার পর দেখা যাবে। এই কথা শুনে সবাই এসে হাজির হল একটা হোটেলে। হোটেলের বেয়ারা বেশ মিশুকে ছেলে। ওদের দেখেই বলল, বাবুরা নতুন নাকি? গ্রাম দেখতে এসেছেন। একটুর মধ্যেই বেশ ভাব জমে উঠল তার সাথে।

প্রবীর বললে, তোমাদের গ্রামে কী আছে দেখার জন্য।

ছেলেটি সব কিছুই বলতে লাগল। শেষে এল রাজবাড়ির কথা। অতনুর এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল। সে জিজ্ঞেস করে বসল, এখানে গুপ্তধন নেই?

ছেলেটি হো হো করে হেসে উঠল। তা তো জানিনে বাবু, তবে লোকে বলে রাজবাড়ির ভেতরে ভূতের উপদ্রব আছে। তাই রাতে পুলিশেও পাহারায় থাকে না।

নতুন খবর পেয়ে চারমূর্তি নড়ে চড়ে বসল। আরও কিছু কথা হল কিন্তু খাওয়া হয়ে গেছে আর বেলা বেড়ে চলেছে তাই ওরা বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। সবাই বেশ উত্তেজিত! একটা ভালো তথ্য মিলল রাজবাড়ি নিয়ে, এই সময় সুযোগ রয়েছে ভূতের দর্শন পাওয়ার। যদিও ভূত বলে কিছু আছে সেটা কেউ বিশ্বাস না করলেও, নাম শুনলেই একটা শিহরণ জাগে বুকের ভিতর।

মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন খেলা করতে লাগল। পুজোর বাজার। একটা সাজো সাজো রব চারিদিকে। কলকাতার মতো এখানে সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা হয় না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। বাড়িতে জানিয়ে গেলে মাসিমা বাধা দেবে। তাই বাড়িতে না জানিয়ে চারমূর্তি রাজবাড়িতে রাত কাটাবে প্ল্যান করল। এখন শুধু অপেক্ষা নির্দিষ্ট দিনের।

 

এক সময় সেই দিন এসেও গেল। সবাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হল রাজবাড়ির পেছনে। ওখানে একটা প্রাচীর ভেঙে আছে আগেই দেখে এসেছিল তারা। ভীষণ উত্তেজিত চারমূর্তি। এই কয়েকদিন শুধু এই নিয়ে আলোচনা চলেছে। অতনু গুপ্তধন-এর নেশা কবেই ভুলে গেছে। যদিও অরিন্দম বলেছে, ভাগ্যে থাকলে গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারিস।

একটা রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে ভাবলেই শিউরে উঠছে অতনু। যাই হোক, পিছনের রাস্তা দিয়ে ওরা রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল চারিদিকে অন্ধকার। একটাও আলোর ব্যবস্থা নেই। পকেট থেকে মোবাইল-এর আলো জ্বালিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে একটা ফাঁকা মতো জায়গা দেখে ওরা বসে পড়ল। চারদিকে শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।

হঠাৎ পাশে সড়সড় করে একটা শব্দ আসতেই প্রবীর মোবাইল-এর আলো জ্বেলে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। একটা সাপ নিশব্দে এগিয়ে চলেছে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল। অনেক রাত অবধি যখন কিছুই হল না, বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল চারজনেই। এভাবে ভূতের দেখা না মিললেও সাপ আর বিছের দেখা প্রতি মুহূর্তে মিলতে পারে। আর ভুল করে যদি কেউ পা দিয়ে ফেলে একবার কামড় খায়, তাহলে আর কথাই নেই!

প্রবীর বলল, চল একবার রাজবাড়ির ভেতর থেকে ঘুরে আসি তারপর ফিরে যাব। এই ভাবে রাত জেগে কোনও লাভ নেই। ভূতের দেখা মিলবে না। শুধু শুধু মশার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। সবাই রাজি হয়ে গেল। আসলে কৌতূহলী হয়ে সবাই এলেও এখন অনুভব করছে, কী ভুলই না করেছে! এ ভাবে বাড়িতে না জানিয়ে এখানে এসে। যে-কোনও মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধরা পড়লে পুলিশও চোর বলে লক-আপ-এ ঢুকিয়ে দেবে। তাই মোবাইলের আলো জ্বেলে এবড়ো খেবড়ো ভাঙা রাজবাড়ির ভেতরে কিছুক্ষণ ঘুরে এবার ফিরে আসবে ভেবেই পিছনের দরজার কাছে উপস্থিত হয়েছে। এমন সময় অতনু সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে আঁতকে উঠল! ওই দ্যাখ…

সবাই চমকে উঠল। অরিন্দম সেখানেই হুঁশ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। প্রবীর ওকে ধরে ফেলল। অতনুর মুখে রা নেই। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দোতলার একটা ভাঙা ঘরের ভেতর লাল রঙের আলো জ্বলছে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অরিন্দম নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল। হঠাৎ প্রবীরের হাত ঝাঁকিয়ে একটা দৌড় লাগাল। অতনুও দেখাদেখি দৌড়োতে গেল।

প্রবীর বলল, দাঁড়া আগে ব্যাপারখানা দেখতে হচ্ছে। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী এত রাতে লাল আলো জ্বেলে দোতলায় কী হচ্ছে! নির্ঘাত ভুতুড়ে কাণ্ড। চল পালাই। প্রবীর ওকে শান্ত করে বলল, এত দূর ভূত দেখতে এসে এখন এভাবে পালিয়ে গেলে চলবে না। আগে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে। একপ্রকার জোর করেই অতনুকে টেনে নিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল প্রবীর।

ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে কোনও ভাবে দোতলায় উঠে দেখল, সে রকম কিছুই নেই। বেশ কয়েকটা ধংসস্তূপ আর ছাদহীন ঘর। ঘরের শ্রী দেখলে ভয় লাগে, কখন হুড়মুড় করে নীচে ধসে পড়বে। খুব সন্তর্পণে ওরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

হঠাৎ করে মুখের উপর জোরালো আলো এসে পড়ল দুজনের উপর। কে তোমরা? এত রাতে এখানে কেন মরতে এসেছ? বেশ রাশভারী গলায় কেউ প্রশ্ন করেছে। এই রকম অবস্থায় যে কেউ হলে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু প্রবীর বেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবে একটু সবুর করো, তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ লাফিয়ে সামনে যে-আলো ধরেছিল তার বুকে একটা জম্পেস লাথি মেরে বসল প্রবীর। আলোটা কোথায় পড়ে নিভে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে আবার অন্ধকার।

অতনু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কারও দুমদাম করে নীচে নেমে যাওয়ার শব্দ হতে লাগল। প্রবীর বলল, অতনু চল ওদের তাড়া কর। পালিয়ে যেন না যায়। অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে গেছে। আবার বাইরে হালকা চাঁদের আলোও আছে, তাই বেশ দেখা যাচ্ছে। দুতিন জন পালিয়ে পিছনের ভাঙা প্রাচীরের কাছে এসে গেছে।

প্রবীর আর অতনুও নীচে নেমে এসেছে। এমন সময় একটা কাণ্ড হল, ওপাশ দিয়ে পুলিশের একটা দল ভেতরে ঢুকছে। যারা পালাচ্ছিল তারা ধরা পড়ে গেল। বড়োবাবু প্রবীর আর অতনুর হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ বাহাদুর ছোকরা তো তোমরা। এই দলটাকে আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে খুঁজছিলাম। লোকাল চুরি ডাকাতির অনেক কেস আছে এদের নামে।

অতনু অবাক হয়ে সব কিছুই দেখছিল। সব কিছু যেন একটা স্বপ্ন। এতক্ষণে বলল, কিন্তু স্যার আপনি ঠিক সময় এখানে কী করে হাজির হলেন? একটু দেরি হলেই তো ওরা পালিয়ে যেত।

পুলিশকর্তা এবার হাসতে হাসতে বললেন, এর জন্যে তোমার এই বন্ধুটি দাযী। আমরা নিয়মমাফিক পেট্রলিং-এ বেরিয়েছিলাম। এমন সময় তোমার এই বন্ধুটি আমাদের দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। এখানে এসে দেখি এই কাণ্ড।

প্রবীর বলল, আমাদের বন্ধুটিকে দেখতে পাচ্ছি না?

সবার পিছন থেকে শুকনো গলায় অরিন্দমের আওয়াজ ভেসে এল, আমি আছি!

 

 

নাটক

সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

কাঠগোলাপের গন্ধ

‘আমি সাইকেলে চেপে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব, বুঝলে।’

উদয়কাকার মুখোমুখি সোফায় বসে আছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা বুঝতে পারছি না। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা। তার পুরু কাচে মণিদুটো ভেসে রয়েছে। শার্টের নীচে ধুতি জড়িয়েছেন লুঙ্গির মতো করে। এক পা মেঝেয়, অন্য পা তার ওপরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। ফোকলা মুখের দু’পাশে গাল বসে গিয়েছে। সেই গালে কয়েক দিনের সাদা কুচো দাড়ি।

আমার চোখ চলে গেল তার কাঁধ পেরিয়ে দরজার দিকে। সেখানে সাগ্নিক এসে দাঁড়িয়েছে। কাকা আমার দিকে ফিরে বসে আছেন বলে ছেলেকে দেখতে পেলেন না। সাগ্নিকও কথাটা শুনেছে। কেন-না আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। ভাবখানা এমন– শুনলেন তো বাবার কথা!

আমি বললাম, ‘বয়স কত হল আপনার? সত্তর তো পেরিয়ে গেছেন। এখনও সাইকেল চালাতে পারেন আপনি?’

‘সেভেন্টি সিক্স। এখনও পারি তো। কিন্তু ওরা চালাতে দেয় না।’

বুঝলাম ওরা বলতে বাড়ির লোক। বলতেই হল, ‘সে আপনার কথা চিন্তা করে বলেই বলে, বারণ করে। এই বয়সে আর সাইকেল না-ই বা চালালেন। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা।’

উদয়কাকা বললেন, ‘হ্যাঁ, রোজই তো কত লোক মারা যাচ্ছে অ্যাক্সিডেন্টে। খবরের কাগজে পড়ি। আমারও তো কতকাল বেঁচে থাকা হয়ে গেল। এখন থাকলেই বা কী, গেলেই বা কী। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়াটা খুব দরকার।’

‘কী দরকার আমাদের বলা যাবে কি?’ বলতে বলতে সাগ্নিক এবার ঘরে ঢুকে এল।

উদয়কাকা ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন। ছেলে এসে সোফার পাশের চেয়ারে বসল। তিনি বললেন, ‘বলে তোদের বোঝানো যাবে না।’

‘কেন? যাবে না কেন? আমরা কি মূর্খ?’

ছেলে ও বউমাকে নিয়ে উদয়কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু কথা আমি আগেই শুনেছি। প্রশংসার কথা নয় সেসব। গোলমাল আঁচ করে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার চোখের অবস্থা তো ভালো নয়। সাইকেল চালাবেন কী করে?’

এবার বুঝলাম কাকার চোখের মণিদুটো ছেলের দিক থেকে আমার দিকে ঘুরল। ‘হ্যাঁ, দুটো চোখেই গ্লুকোমা। দুটোতেই অপারেশন হয়েছে। কিছু তো হল না। ওষুধ দিয়ে দিয়ে ঠিক রাখতে হয়। তবে সাইকেল তো চালাব দিনেরবেলায়। রাতে তো চালাব না।’

‘চোখ সারিয়ে নিন না। তারপর না হয় দেখা যাবে।’

‘নাঃ, আর কত দিন বসে থাকব? আর সময় পাব কিনা তা তো জানি না।’

আমি হেসে ফেললাম। ‘তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন, সাইকেলেই যেতে হবে কেন? ট্রেনে যাবেন। রাজধানীতে উঠে সোজা রাজধানী।’

মাথা নাড়তে থাকলেন উদয়কাকা। ‘না, তা হবে না। আমি যা বলতে চাই, সাইকেলে গেলে তার গুরুত্বটা বোঝানো যাবে। কথাগুলো বলা দরকার। তুমি আমায় উৎসাহ দাও অত্রি। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।’

এ তো আচ্ছা লোক। আমাকেও জড়িয়ে নিচ্ছে। এ কি কোনও সাইকেল চালানোর কম্পিটিশন যে উৎসাহ দেব!

আমার এখন পঁয়তাল্লিশ। উদয়কাকার ছেলে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটোই হবে। বছর পঁচিশ-তিরিশ কি তারও আগে দেখতাম পাড়ার মাঠে একজন সাইকেল নিয়ে এসেছে। ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে সে একটা ব্যানার টাঙিয়ে দিত। সেখানে লেখা থাকত– কাহারও কোনওরূপ সাহায্য না লইয়া বাহাত্তর ঘণ্টা অবিরাম সাইকিলিং। দিনরাত সেই লোক সাইকেল চালিয়ে যেত। তার বুকে-পিঠে সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা থাকত কয়েকখানা সার্টিফিকেট। আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট। সে সাইকেলেই খেত, তার ওপর বসেই নীচে থেকে কায়দা করে বালতি তুলে মাথায় জল ঢেলে স্নান সারত। পেচ্ছাপ করার সময় মাঠের ধারে কাপড় ঘেরা একটা জায়গায় চলে যেত। সাইকেলে বসেই ঘুমোত কিনা জানি না। কারণ সেটা দেখার জন্য অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করে আমরা বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হতাম। শুধু পাড়ায় নয়। বেপাড়ার মাঠে কিংবা রাস্তার ধারেও এ জিনিস দেখেছি। একবার সাইকেল না চালানোও দেখেছিলাম। মানে একজন সাইকেল নিয়ে একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে সামান্য প্যাডেল করত। বোধহয় তার মেয়াদ কম ছিল। চব্বিশ ঘণ্টা হবে। সবই তখন বিস্ময়। আমরা গিয়ে দাঁড়ানোয় ওরা নিশ্চয়ই উৎসাহ পেত। কিন্তু ছিয়াত্তর বছরের এক বুড়ো মানুষকে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাওয়ার ব্যাপারে এই রবিবারের সকালবেলায় আমি কী বলব! উঠে পড়লাম।

উদয়ভানু পালের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল বছর তিনেক আগে এলাহাবাদের কুম্ভমেলায়। আমি থাকি বেহালা থানার পিছনে বারিকপাড়ায়। আর উনি ঠাকুরপুকুরের কাছে গৌরনগরে। যদিও দেখা হল কুম্ভে। এরকম তো হয়। বেহালার কত লোক হয়তো ওই কুম্ভেই গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি।

বাবা-মাকে নিয়ে যাব। মেয়ের পরীক্ষা বলে বউয়েরও যাওয়ার উপায় ছিল না। যাব কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। এক সাংবাদিক বন্ধুকে ধরলাম। সে এক আশ্রমের কথা বলে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। সেখানে ওই উদয়ভানু পালের নাম লেখা। বন্ধু বলল, ‘আমি আশ্রমে কথা বলে নিয়েছি। তোরা এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি আর বাবা এক তাঁবুতে। মা মেয়েদের জায়গায়। উদয়কাকা বাবার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। দেখলাম দু’দিনেই দুজনের বেশ জমে গিয়েছে। আমার সঙ্গেও গল্প করতেন। রান্নার ঠাকুর থেকে বাজার করার লোক অবধি সকলকে ডেকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন দেখলাম কয়লা কিনতে যাচ্ছেন। আর একদিন দেখলাম টেম্পোরারি পায়খানার দরজা খুলে গিয়েছে বলে নিজে হাতে সারাচ্ছেন। খাওয়ার সময় মাটিতে পাত পড়ত। তার আগেই উদয়কাকা এসে আমাদের বলে যেতেন। বিকেলের চা আর বিস্কুট নিয়ে আসতেন নিজের হাতে করে। তখনও দেখেছি সময় সময় চোখের ড্রপ নিতে। পরে জেনে অবাক হলাম উনি ওই আশ্রমের কেউ নন। এক মাস জমাদার আর অন্য কাজের লোকদের কাজকম্ম দেখাশোনার জন্য এসেছেন। ফ্রি সার্ভিস। নিজে নিজে তো আসতে পারতেন না তাই আশ্রমের মারফত হয়ে আসা। হেলথে চাকরি করতেন। জিবি রায়-তে ছিলেন, আরজি কর-এও।

তখনই জানতে চেয়েছিলাম, ‘এসব করতে কুম্ভে এলেন আপনি!’

উনি বললেন, ‘কেন, কী হয়েছে। সবাই তীর্থ করতে আসে, আমি কাজ করতে এসেছি। ভালো লাগলে এই আশ্রমেরই দীক্ষিত হয়ে যাব। যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। রিটায়ারের পর থেকে তো আমি বেকার।’

ফিরে আসার পর উদয়কাকার যাতায়াত শুরু হয়েছিল আমাদের বাড়ি। একলাই আসতেন বেশিরভাগ। বারদুয়েক কাকি এসেছিলেন। বাবা-মাও গিয়েছে কয়েকবার। আমিও। দেড় বছর হল বাবা মারা গিয়েছে। উদয়কাকার আসাও কমেছে। আমারও অফিস আছে। সংসার আছে। জ্বর-পেটখারাপ আছে। মেয়ের টিউশনি আছে। মায়ের ডাক্তার আছে। পুজোর বাজার আছে। এরমধ্যেই একদিন সাগ্নিকের ফোন। ‘বাবার মনে হয় মাথাখারাপ হয়ে গেছে। আপনি একদিন আসতে পারবেন অত্রিদা?’

মাথাখারাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম সাংসারিক কোনও গোলমাল হয়েছে। এসে দেখি সাইকেল ও রাষ্ট্রপতি।

সপ্তাহ তিনেক পরেই উদয়কাকা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। শুধু এসেছেন বললে ভুল হবে। সাইকেলে সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমার বউ নবীনা দরজা খুলতেই তিনি বললেন, ‘অত্রিকে একবার বাইরে আসতে বলবে বউমা?’

বেরোতেই তিনি সাইকেলের সিটে এমনভাবে চাপড় মারলেন যেন ঘোড়ার পিঠ থাবড়াচ্ছেন। ‘কেমন দেখছ? হারকিউলিস। এ জিনিস আর এখন পাবে না। তুমি চালিয়েও দেখতে পারো। এখনও যথেষ্ট মজবুত।’

জিনিসটা কতটা শক্তপোক্ত রয়েছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ দিতে উনি সাইকেল চালিয়ে এতটা চলে এলেন! বললাম, ‘ভেতরে আসুন। সাইকেলটা সিঁড়ির নীচে রাখুন।’

উদয়কাকা ঢুকতে ঢুকতে বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমাদের দেশ ছিল ময়মনসিংহ। কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশন। গ্রাম জঙ্গলবাড়ি। তোমার বাবা জানতেন। বলেছিলাম।’

আমিও জানি। এখন আবার সে কথা তুললেন কেন কে জানে। নবীনাকে চা করতে বললাম। মা দোতলায়। অস্টিও আর্থ্রাইটিসে কাবু। উদয়কাকা ডাইনিং রুমের চেয়ারেই বসে পড়লেন। হাঁফাচ্ছেন। চিবুকের তলা দিয়ে নেমে যাওয়া শিরাদুটো কাঁপছে।

বললাম, ‘আপনার সাইকেলটা সত্যি ভালো আছে দেখলাম। অত পুরোনো বলে মনেই হয় না।’

উদয়কাকা ছেলেমানুষের মতো খুশি হলেন। ‘আছেই তো। সিক্সটি থ্রি-তে কেনা। তখন আমরা মানকুন্ডুতে থাকি। বাবা ওখানেই তখন প্র্যাকটিস করতেন তো। আমি সবে চাকরি পেয়েছি আরজি কর-এ। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি। বাবা মারা যাওয়ার পরে যখন কলকাতায় চলে এলাম তখন অনেকদিন সাইকেলটা বস্তাবন্দি ছিল। তারপর ঝেড়েমুছে, তেলটেল দিয়ে দাঁড় করালাম। পিছনের চাকার টায়ারটিউব নষ্ট হয়ে গেছিল। সারালাম। ছেলেকে এই সাইকেলেই চালানো শিখিয়েছিলাম।’

এইসময় আমার মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এল। তাকে দেখেই উদয়কাকা কাছে ডাকলেন। ‘এসো দিদিভাই, কেমন আছ তুমি? লেখাপড়া কেমন চলছে?’

সঞ্জনা মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘ভালো।’

‘কোন ক্লাস হল তোমার?’

‘এইট।’

‘বেশ বেশ। তা তুমি তো দেখছি মাথায় অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছ। বাবাকে ধরে ফেলো এবার।’

মেয়ে আমার দিকে তাকাল। ‘ধরে ফেলতাম তো। বললাম আমাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। দিচ্ছে না।’

‘অ্যাঁ, সে কী! এ তো ভারি অন্যায়। কেন দিচ্ছে না?’

নবীনা বলল, ‘দেব যে, চালাবে কোথায়? রাস্তায় ছাড়া জায়গা তো নেই। যেভাবে গাড়ি চলে, ভয় করে। তাছাড়া ও এখন বড়ো হচ্ছে কাকা। একা একা এই বয়েসের মেয়েকে ছাড়া যায়, বলুন? দেখছেন তো চারদিকে কী অবস্থা!’

উদয়কাকার মুখ ভারী হয়ে এল। ‘শুধু এই বয়েসের কেন? কোন বয়েসের মেয়েই বা নিরাপদে থাকতে পারছে বউমা? আমাদের সব দাঁত নখ বেরিয়ে পড়েছে।’

সঞ্জনা এখন সবই বুঝতে পারে। সে কোনও কথা না বলে সরে যেতে চাইছিল। উদয়কাকা বললেন, ‘তোকে একটা মজার কথা বলি শুনে যা মা। এই একটু আগে তোর বাবাকে বলছিলাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ। তোর ঠাকুমারও কিন্তু তাই।’

‘জানি তো। বাংলাদেশে।’

‘ঠিক বলেছিস। তা বুঝলি, আমার বাবা ইংরাজি শেখাতেন– আমার মানুষরা গান গায়। মাই মেন সিং। মানে কী হল? ময়মনসিং।’ হা হা করে নিজেই হেসে উঠলেন উদয়কাকা। তারপর থেমে বললেন, ‘জগদীশচন্দ্র বসু, আলাউদ্দিন খাঁ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, নীহাররঞ্জন রায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়নাল আবেদিন– সব ময়মনসিংহ। আরও কতজন আছেন। গর্ব হয় না, বল? কী সব মানুষ!’

সঞ্জনা চলে যেতে আমি বললাম, ‘আপনার বাবা তো ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন, না কাকা?’

চা শেষ করে কাপ নামিয়ে উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তখন যে তোমায় বলছিলাম না দেশের কথা, কেন জানো? সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে, এই তোমাদের বাড়ির কাছেই, হঠাৎ কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম। দেখি এক বাড়ির পাঁচিলের ওপাশে গাছটা মাথা তুলেছে। মোটা মোটা পাতা হাওয়ায় দুলছে। এর আগে যে তোমাদের বাড়ি এসেছি, তখন বোধহয় ফুল ফোটেনি গাছটায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঠগোলাপের গাছ ছিল। হলুদ-সাদা, গোলাপি-সাদা ফুল। তার গন্ধ এত সুন্দর। হঠাৎ কোথাও কাঠগোলাপের গন্ধ পেলে ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। বাবার কথাও মনে পড়ে গেল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাশ করে বাবা এখানে এসে সুরেন্দ্রনাথে ভর্তি হন। এসেই খেলা। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্লেয়ারদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। তাতে আমার বাবাও আছেন। বাবার নাম ছিল দেবেন্দ্র পাল। সবাই বলত ডি পাল। গ্রিয়ার স্পোর্টিংয়ে খেলতেন। গ্রিয়ার স্পোর্টিং ছিল মিত্তিরদের। পুরো নামটা মনে পড়ছে না। ওই যাদের লক্ষ্মীবিলাস তেল গো–।’

লক্ষ্মীবিলাস বলতে এবার আমার নাকে কবেকার একটা গন্ধ ভেসে এল। মাকে মাখতে দেখেছি ছোটোবেলায়। ঘন, খয়েরি রং। কবিরাজি দোকানের ভেতরে গেলে ওই গন্ধটা পাওয়া যায়। সেসব দোকান আর নেই বললেই চলে। লক্ষ্মীবিলাসও ধুয়ে গিয়েছে।

উদয়কাকা তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘খেলতে খেলতে বাবা পরে যান ইস্টবেঙ্গলে। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন। নাইন্টিন টোয়েন্টি থ্রি কী ফোর হবে, মোহনবাগানকে হারান এক গোলে। বাবাই গোল করেছিলেন। পরে যদিও ব্ল্যাকওয়াচ টিমের কাছে হেরে যান।

সে যাই হোক। বাবা পরে ডাক্তারিও পড়েছিলেন। জাহাজের ডাক্তার ছিলেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মায়। যশোরে যখন ছিলেন তখন বিধানচন্দ্র রায় গেছিলেন সেই হাসপাতালে। বাবা রোজ ব্যায়াম করতেন। ভালো স্বাস্থ্য ছিল। বলতেন, দ্যাখ, আমি খেলেওছি, আবার ডাক্তারিও করেছি। মনের জোর থাকলে মানুষ কী না করতে পারে। এক জায়গায় নিজেকে বদ্ধ রাখলেই মুশকিল। কোনও কাজ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা করে ফেলার দিকেই যেতে হবে তোমায়। আর আমায় দ্যাখো অত্রি, জীবনের বেশিটাই চাকরিতে চলে গেল। এক এই সাইকেল চালানো ছাড়া আর কোনও যোগ্যতা আছে আমার, বলো?’

কাকাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছিলাম। উনি সাইকেল নিয়ে পাশে পাশে। বললাম, ‘এই যে আপনি বেরিয়ে পড়তে চাইছেন, আপনার বাড়ির লোকেদের তাতে দুশ্চিন্তা হবে না? তারা কখনও আপনাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে?’

উদয়কাকা বললেন, ‘ছেলে-বউমা দুজনেই চাকরি করে। তাদের সন্তান হয়নি, তাতে নিশ্চয়ই দুঃখ আছে। তা নিয়ে আমি বা তোমার কাকিমা কোনও কথা বলি না। কিন্তু বউমা রান্নাবান্না, বাজারহাট, ঘর সাজানো গোছানো– সব নিয়ে তার শাশুড়ির সঙ্গে খিটখিট করে। মশারি টাঙানো নিয়ে পর্যন্ত ছেলে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। একদিন বলল, তোমাদের জঙ্গলে রেখে আসা উচিত।’

আমি বললাম, ‘সব সংসারেই এরকম কিছু না কিছু হয় উদয়কাকা।’

উনি মানলেন না। বললেন, ‘একসঙ্গে থাকতে গেলে ভাব ভালোবাসা রেখে থাকতে হবে তো। সে কি তারা বোঝে? ছেলে দারুণ সেতার বাজাত। আমি সেতার বয়ে নিয়ে নিয়ে যেতাম তাকে শেখাতে। ভেবেছিলাম সে বড়ো শিল্পী হবে। হয়নি। বাজনা ছেড়েই দিয়েছে। ডালহৌসিতে একটা চাটার্ড ফার্মে কাজ করে। এই চাকরির কী মানে? ওই অর্থের মানে কী? ছেড়ে দিলেই বা কী আসে যায়? আবার শুরু করতে পারে না নতুন করে? বেঁচে থাকার কারণটা কী? আমি বেরিয়ে পড়লে প্রভা হয়তো চিন্তা করবে। কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি চিন্তা করবে আমার জন্য? বিশ্বাস হয় না। ওই যে আশ্রমের হয়ে আমি কাজ করতাম– কত জায়গায় তো গেছি– গয়ায়, হরিদ্বারে, উজ্জ্বয়িনীতে, নৈমিষ্যারণ্যে– কখনও খোঁজ নিয়েছে আমার? জানতে চেয়েছে বাবা কেমন আছ? গয়ার রাস্তায় দেখেছিলাম একটা ছেলে চিরুনি বাজাচ্ছে মুখ দিয়ে, আর একজন মাটির হাঁড়ি। রাগ যোগিয়া বাজাচ্ছে বুঝলে! যে যা পয়সা দেয়। ভেবেছিলাম ওদের বাড়ি নিয়ে আসব তুলে। তা তো হওয়ার নয়। কিন্তু ওরা রাস্তার ধারে বসেও পারছে তো! একবার বালামৌ স্টেশনে আটকে পড়েছিলাম। পরদিন সকালের ট্রেনে নৈমিষ্যারণ্যে যাব। সেখানে যিনি স্টেশনমাস্টার ছিলেন তিনি রিটায়ারের পরও পাশেই থাকেন। জমি কিনেছেন। নিজে হাতে ধান চাষ করেন। আমাদের সেই চালের ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। ইচ্ছে থাকলে পারে না লোকে?’

জানতে চাইলাম, ‘সাগ্নিক বলছিল আপনি এখন আর আশ্রমের কাজেও যান না, সত্যি?’

‘নাঃ, যাই না আর। রিটায়ারমেন্ট-এর পর অনেকগুলো বছর শুধু শুধুই কেটে গেছে। তারপর ওই আশ্রমে গেলাম। কাজ করতে চেয়েছিলাম। বলে বটে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস কিন্তু মানুষকেও দ্যাখে না, ঈশ্বরকেও দ্যাখে না। শুধুই আড়ম্বর। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাও খুব শক্ত। যে কৃষ্ণ ভজনা করে সে চতুর। যে জানে সে ভজনা করে তার আবার ভজনা কীসের?’

কাকার কথা শুনে বুঝলাম ওখানেও কোথাও একটা কাঁটা আছে। আমি আর খোঁচালাম না। কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘আপনি যে সাইকেল চালিয়ে দিল্লি যাবেন ভাবছেন, কতটা রাস্তা জানেন?’

‘জানি তো। বাই রোড এক হাজার চারশো ঊনআশি কিলোমিটার। নিরামিষ খাই। হাতে-পায়ে যা জোর আছে তাতে করে দিনে কুড়ি কিলোমিটার চালাতে পারব মনে হয়। আমি মিস্ত্রির সাথে কথাও বলেছি। একটা ছাতা লাগাতে হবে সিটের সঙ্গে। কিছু জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্সট্রা ক্যারিয়ার লাগবে।’

সেরেছে। ইনি তো দেখছি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। বললাম, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে চাইছেন কেন? কারণটা কী?’

উদয়কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘শোনো, আমার এক বন্ধু ছিল– সত্য গুপ্ত। একসঙ্গেই চাকরি করতাম জিবি রায়-তে। সে ব্যাচেলার লোক। ছবি কেনার নেশা ছিল শুধু। তাই দিয়ে ঘর সাজাত। ভীষণ মুখ খারাপ করত, সোজা কথা সোজা বলে দিত। মানে কোনও সত্যই তার মুখে গুপ্ত থাকত না। একবার ইনজেকশনের স্টকে একটা গরমিল ধরা পড়ল। সত্য তো যা তা বলতে শুরু করল। কয়েকজন ধরা পড়ে পড়ে। তাকে বদলি করে দিল দূরে। সে যাবে না। মাইনে বন্ধ। কাউকে ধরাকরাও করবে না। ওর হয়ে আমি রাইটার্সে ধরনা দিলাম। তখন হেল্থ মিনিস্টার ননী ভট্টাচার্য। রাইটার্স থেকে আমায় বলল, উদয়বাবু আপনার বন্ধুকে ঠোঁট সেলাই করতে বলুন। আপনি এত হাঁটাহাঁটি করেছেন বলে দূরের বদলি ক্যানসেল করে ওকে মেডিকেলে দেওয়া হল।’

একটু থামলেন উদয়কাকা। তারপর আবার বললেন, ‘কত তো দেখলাম। সবাই চায় অন্যের ঠোঁট যেন বন্ধ থাকে। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না অত্রি। এই আমাদের দেশ! রোজ কাগজে, টিভিতে দেখছি আর শিউরে উঠছি। রোজ ধর্ষণ আর খুন, দাঙ্গাও হচ্ছে– সে খবর লুকিয়ে যাচ্ছে– কিন্তু হচ্ছে তো। চারপাশ একেবারে দুর্নীতিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। ঘুষ ছাড়া কেউ নড়ে না। যে যাকে পারছে ঠকাচ্ছে। টাকার লোভে মানুষ পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে। টেকনোলজির যে এত উন্নতি, তা দিয়ে গরিব মানুষের কিছু হচ্ছে কি? কারা ফল পাচ্ছে তার?’

আমার কেমন রাগ হয়ে গেল। বললাম, ‘এসব তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। আপনাদের সময় সবাই কি সাধুপুরুষ ছিল?’

‘না, মোটেও নয়। কিন্তু এত নোংরামি ছিল না। তুমি হিসেব নিয়ে দ্যাখো। এত পাবে না। যত দিন যাচ্ছে, সব দিকেই মানুষের বিকৃতি বেড়েই চলেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই কারও। ধর্মেও নয়। এখন পাপ করেঞ্জভাবে ভগবানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব মাফ। কাল আবার নতুন পাপ করা যাবে। আর ঠোঁট সেলাই করে রাখা যাচ্ছে না অত্রি।’

‘আপনি কি এসব কথা বলতে যাবেন রাষ্ট্রপতিকে?’

‘হ্যাঁ। বলব– কী হচ্ছে এসব?’

‘কী লাভ হবে বলে? উনি তো হাত ধরে সকলকে আইনের পথে, সততার পথে, ন্যায়ের পথে নিয়ে আসতে পারবেন না।’

‘জানি পারবেন না। কিন্তু আমার উদ্বেগ আমি জানাতে পারব না?’

আমি মানুষটাকে ভালো করে দেখলাম। ওর কি সত্যিই মাথায় গোলমাল দেখা দিচ্ছে? না কি নিজের বিশ্বাসের এতটাই জোর যে অনায়াসে এসব কথা বলে যাচ্ছেন?

তখন উনি বললেন, ‘শোনো অত্রি, আমি এখনকার ছেলেমেয়েদের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝি না। গরিব-বড়োলোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– সবার রুচি একইরকম লাগে। তারা ভবিষ্যতে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি এখনই এসব কথা বলতে চাই। আর বললে রাষ্ট্রপতিকেই বলব।’

‘রাষ্ট্রপতি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কেন?’

উদয়কাকা যেন খুব অবাক হওয়ার মতো একটা কথা শুনছেন, এভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, ‘কেন দেখা করবেন না? একজন সিনিয়র সিটিজেন আরেকজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে দেখা করবেন না?’

আমার কথা এবার বন্ধই হয়ে গেল। এই লোককে আর কী বলা যেতে পারে! ফিরে যাব ভাবছি, তখন উদয়কাকা নাক টেনে বলে উঠলেন, ‘আহা! আবার সেই গন্ধ। পাচ্ছ তুমি? কাঠগোলাপের গন্ধ। ওই যে গাছটা। এখন আর এ গাছ দেখাই যায় না। রেয়ার হয়ে গেছে। এক একটা শব্দ, গান, গন্ধ– কী যে করে দেয়।’

আমি কোনও গন্ধ পাইনি। সে কথা ওকে বলা গেল না। উদয়কাকা চলে যাওয়ার পর আমি তার কথাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। উনি যা নিয়ে বলছেন তা তো আমরাও জানি। কিন্তু কিছু বলতে পারি কই? আর সাইকেল ও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারটাকে তো লোকে খ্যাপামিই বলবে।

মাস খানেক পর একদিন সকাল ন’টায় সাগ্নিকের ফোন। ‘অত্রিদা, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইকেলটাও নেই। আসবেন প্লিজ?’

স্কুটার বের করে পৌঁছলাম উদয়কাকার বাড়ি। সাগ্নিক বলল, ওরা ভেবেছিল কাছেই কোথাও গেছে। সাইকেলটা নেই দেখে সন্দেহ বেড়েছে।

আমি বললাম, ‘এত আগ বাড়িয়ে ভাবছ কেন? হয়তো এদিক-ওদিকেই গেছেন সত্যি। এর আগে তো একদিন আমার বাড়িতেই গেছিলেন সাইকেলে।’

সাগ্নিক তখন বলল, ‘না, এবার তা নয়। একটা ব্যাগে জামাকাপড় ভরে নিয়ে গেছেন। চোখের ড্রপটাও।’

চুপ করে রইলাম। উদয়কাকা এভাবে সবাইকে বিপদে ফেলল? সাগ্নিককে বললাম, ‘স্কুটার তো রয়েইছে, একবার বেরিয়ে দেখি চলো।’

বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই মনে হতে লাগল– কোথায় খুঁজব? বিশেষ করে যদি কেউ ইচ্ছে করেই হারায়। কোন রাস্তায় গিয়েছেন তা কি বোঝা যাবে? সাগ্নিক মাঝে মাঝে মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন করছিল। ওদিক থেকেও কোনও খবর নেই। আশপাশের তল্লাট হাঁটকেও উদয়কাকার দেখা মিলল না। ঘুরতে ঘুরতে ডায়মন্ডহারবার রোডের অনেকখানি চলে গেলাম। আচমকা সাগ্নিক চেঁচিয়ে উঠল– ওই বাঁদিকে চলুন তো। ওই যে, ওই সাইকেলটা।’

স্পিড বাড়িয়ে কাছাকছি পৌঁছে দুজনেই হতাশ। নাঃ, দূর থেকে দেখে ভুল হয়েছিল। চুলটা ওইরকমই খোঁচা খোঁচা, গড়নটাও লম্বাটে ধাঁচের, বয়েসও কাছাকাছিই হবে, কিন্তু ইনি উদয়ভানু পাল নন।

সাগ্নিক বলল, ‘ঘুরিয়ে নিন। আপনাকে আর কষ্ট দেব না। দেখি অপেক্ষা করে। না হলে সেই থানাপুলিশ করতে হবে।’

ফিরে আসছিলাম। কেন জানি মনে হল, ওই বুড়ো লোকটা না হয় উদয়কাকা নন, কিন্তু উনিই বা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? কোনও কাজে বেরিয়েছেন? না কি উনিও দিল্লি যাচ্ছেন? এরা কি এক এক করে বেরিয়ে পড়ছে না কি? এই রাস্তায়? তা হলে কি অন্য কোথাও? অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে?

থানায় খবর দিতেই হয়েছিল সাগ্নিককে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। হাসপাতাল। মর্গ। সেই আশ্রমেও গিয়েছিল। তাদের শাখাপ্রশাখাকেও জানানো হয়েছিল। উদয়কাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকী চার-পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও খবর পাওয়া গেল না।

এ সময়ের মধ্যে কোথাও কিছু বদলায়নি। দিন ও রাত নিজেদের নিয়মেই আসাযাওয়া চালু রেখেছে। কত অয়েলক্লথ কেনা হয়েছে, কত শবযাত্রা গিয়েছে। সরু গলি ও বড়োরাস্তায় কত উৎসব হয়েছে। এখন শুধু আমি মাঝে মাঝেই কাগজ পড়ার সময় রাষ্ট্রপতির ছবি দেখলেই বাড়তি ঝুঁকে পড়ি। কোনওদিন হয়তো দেখব ছবি ছাপা হয়েছে– হাস্যমুখ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফোকলা গালে হাসছেন উদয়কাকা। সাইকেল বুড়োর গালে সাদা কুচো কুচো দাড়ি। চোখে পুরু কাচের চশমা।

তেমন কিছু দেখতে পাই না। কে জানে। এত বড়ো দেশ। হয়তো উদয়কাকা ঘুরতে ঘুরতে যাচ্ছেন সাইকেল নিয়ে। আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করবেন। কথা বলবেন। একদম শেষে পৌঁছবেন রাইসিনা হিলে। বলেছেন যখন, তখন যাবেন নিশ্চয়ই। অপেক্ষায় থাকি।

 

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

মাতৃরূপেণ

ভোরে উঠে পড়ার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি সুজাতা। ওঠার তেমন দরকার পড়ে না, তবুও। অনির্বাণ অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। অফিসের রান্না করে দেবার তাড়া নেই আর। রুমকি যতদিন এ বাড়িতে ছিল, ওকে ঘিরে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ছিল। স্কুল-কলেজের পাট চুকলে, রুমকির নাচ, নাচের দলের দেশ-বিদেশ সফর, সেইসব সফরের প্রস্তুতিপর্ব– সব মিলিয়ে বাড়িটা গমগম করত। ছাত্রী, ছাত্রীর মায়েরা, অনুষ্ঠানের আয়োজক, মিডিয়ার লোকজন আসার বিরাম ছিল না। সেসব অবশ্য এখনও আছে। তবে দুটো বাড়ির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে জনস্রোত। শুধু রুমকিকে ভোরে উঠে তুলে দেওয়ার কাজটা আর নেই। সেদিনও পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর মস্ত দায়িত্ব। ভোরে উঠে এক-দেড় ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করত রুমকি। ভোরের এই সময়টা যে-কোনও সাধনার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ– একথা তো তিনিই ছোটোবেলা থেকেই রুমকির কানে ঢুকিয়ে এসেছেন।

রুমকি এখন এখানে থাকে না। তাই ওকে ঘুম থেকে তুলে নাচে জুতে দেবার কাজও নেই তাঁর। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাই। অবসর নেওয়ার পর প্রথম ক’দিন খুব উৎসাহে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছিলেন অনির্বাণ। তাঁকেও টেনে নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে ছাদের টেরেসে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, কাগজ পড়া তারপর দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট বানানো। মর্নিং ওয়াকারদের একটা দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘সাতসকাল’ নামে লেটারহেড ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, রক্তদান– এমন দু-চারটে কর্মকাণ্ডও হয়েছিল তাঁদের গোষ্ঠীর। তারপর তাঁরা কীভাবে যেন খসে পড়লেন সেই গোষ্ঠী থেকে।

তারপরও অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অবসরজীবনে সুজাতাকে জড়িয়ে নিতে। সারাজীবন সময় দিতে পারেননি। সুজাতার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ওভারটাইম করে গিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে নাচ চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। দামি দামি কস্টিউম, মিডিয়ার সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ, ছাত্রী ধরে রাখার জন্যে বছরে শহরের নামি-দামি হলে দু-তিনটে প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ– আরও কত কী। পাশাপাশি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। তারপর ইউনিভার্সিটি। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ চাকুরিজীবী অনির্বাণকে সেসবের খরচ জুগিয়ে যেতে হয়েছে। রুমকি কীভাবে বড়ো হল, সুজাতা কখন যে যৌবন পেরিয়ে গেলেন– দেখা হয়নি অনির্বাণের।

এতদিন, এতগুলো বছর পরে সুজাতার সঙ্গে আবার সেতু গড়ে তুলতে গিয়ে দেখলেন, কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। সুজাতার সমস্ত জীবনের একটিই অভিমুখ– মেয়ে রুমকি, রুমকির নাচ। তাঁর সব ভাবনা, স্বপ্ন, গল্পের বিষয়, নাচকে ঘিরে রুমকির কেরিয়ার। মেয়েকে প্রাণাধিক ভালোবাসলেও অনির্বাণ সুজাতার মতো মেয়েসর্বস্ব হয়ে উঠতে পারেননি। আর পাঁচটা বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহ। তিনি নিয়মিত খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েন, মেয়ের নাচ ছাড়াও নাটক, সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, বিভিন্ন খবরের চ্যানেলগুলো তাঁর দেখা চাই, ছোটো হলেও তাঁর নিজস্ব একটি বন্ধুবৃত্ত আছে। এসব কিছু নিয়ে তিনি সুজাতাকে নতুন করে পেতে চেয়েছিলেন, পাননি। এখন তিনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, নিজস্ব ছন্দে কেটে যায় সকাল থেকে সন্ধে, নিজের ছোটো ছোটো ভালো লাগাগুলোর সঙ্গে। বেলায় একবার নীচেরতলায় মেয়ের নাচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন মেয়ে নাচে মগ্ন, সুজাতা চায়ের কাপ হাতে জগৎ-ভুলে মেয়ের নৃত্যরতা রূপ দেখছে। কিংবা, মা-মেয়ে মিলে ভবিষ্যৎ কোনও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। এক ঝলক দেখে সরে আসেন তিনি। মেয়ে অবশ্য যাওয়া-আসার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা না করে যায় না।

আসলে রুমকি আর সুনন্দন যে-ফ্ল্যাটটায় থাকে, সেটায় জায়গা বড়ো কম। তাই প্রতিদিনই দশটার মধ্যে ও চলে আসে এখানে। সুজাতার তিল তিল পরিশ্রম, স্বপ্ন ও সাধে গড়ে উঠেছে যে বাড়ি– ‘ভঙ্গিমা’। পুরো বাড়িটা যেন নাচের একটি মুদ্রার মতো দাঁড়িয়ে। একতলার গোটাটাই প্রায় হলঘর। রুমকির প্র্যাকটিস, ক্লাস, অনুষ্ঠানের মহড়া সবই চলে সেখানে। ছোটোখাটো অনুষ্ঠানও হতে পারে হেসে খেলে। হয়ও। তার জন্যে লাগোয়া একটা ড্রেসিং রুমও আছে। এছাড়া দুটো টয়লেট, একটা শুধু রুমকির, অন্যটি ছাত্রীদের। আর আছে একটা ছোট্ট কিচেন। প্র্যাকটিসের ফাঁকে ফাঁকে কফি বা হেলথ ড্রিংক, স্যান্ডউইচ– টুকিটাকি সবই জোগানো যায় প্রয়োজনমতো। রুমকি যতক্ষণ থাকে, সুজাতা পারতপক্ষে দোতলায় আসতে চান না। তাঁর নিজের হাতে লাগানো বীজ কীভাবে আস্তে আস্তে মহিরুহ হয়ে উঠছে তার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উপভোগ করতে চান তারিয়ে তারিয়ে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে সুনন্দন তুলে নিয়ে যায় রুমকিকে। কখনও-কখনও ওর নাইট-শিফট থাকলে রুমকি তাঁর কাছেই থেকে যায়। দুই সখীর মতো গল্পে গল্পে কেটে যায় রাত, বলা বাহুল্য, যে গল্পের পুরোটাই নাচ নিয়ে। আরও, আরও ভালো হতে হবে, আরও আয়ত্ত করতে হবে মুদ্রাগুলি– একথা আজও পাখিপড়ার মতো করে তিনি বুঝিয়ে চলেন মেয়েকে।

রুমকি যখন প্রথম তাঁকে জানাল, সে সুনন্দনের প্রেমে পড়েছে, মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন সুজাতা। বিয়ে, সংসার, সন্তানপালন– এসব সাধারণ মেয়েদের জন্যে। এসবে জড়িয়ে পড়লে ওর এই ঝকঝকে কেরিয়ার একদম বরবাদ হয়ে যাবে। রুমকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হেঁশেল আর বাচ্চা সামলাচ্ছে– এ দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় পান সুজাতা। সুনন্দন আইটি-তে বড়ো চাকরি করে, লাখ দেড়েক মাইনে, প্রায়ই বিদেশ যেতে হয়– এসব শুনেও মন গলেনি তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুমকির জেদ আর অনির্বাণের প্রবল আগ্রহের কাছে মাথা নোয়াতে হল তাঁকে। তবে, ঠাকুর বাঁচিয়েছেন, সুনন্দন আর-পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো ঘরকুনো নয়। বউকে জড়িয়ে বসে থাকার সময় নেই তার। সবসময়ই ছুটছে। ভালোই হয়েছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি টাটানগরে থাকে। তাই ওসব ঝামেলাও নেই। সেন্টার থেকে ডেলি রোজের আয়া রেখে নিয়েছে। সে-ই সংসার সামলায়। কামাইয়ের ভয় নেই। রুমকি পুরোপুরি নাচে মন দিতে পারছে। আর কী চান সুজাতা।

তবু কেন যে এতটা খালি-খালি লাগে। একটা শূন্যতা, হাহাকার সোফার তলায় লুকোনো বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে থেকে থেকে। কী যেন একটা নেই। সুনন্দন যখন রুমকিকে নিতে আসে, গাড়ি থেকে নামে না, ঘনঘন হর্ন বাজায়। ওই শব্দটা বুকে এসে ধাক্বা মারে যেন। মনে হয়, রুমকির ওপর সব অধিকার সুনন্দনেরই, তিনি কেউ নন। যেন পরের ধন চুরি করে এনেছেন, সে এসেছে নিজের জিনিস ফেরত নিতে। রুমকিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়, মাকে বিদায় জানাতেও মনে থাকে না কোনও-কোনও দিন। কেমন যেন সুর কেটে যায় সারাদিনের।

পরের দিন আবার সব তিক্ততা মুছে নতুন করে শুরু করতে চান সুজাতা। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিদিন একটা নতুন দিন। কিন্তু রুমকি না আসা পর্যন্ত কেমন যেন একটা ছটফটানি তাঁর মধ্যে, খালি খালি লাগে সমস্ত সকাল।

চা শেষ করে আজ নীচের ঘরে এসে ফার্নিচারের ধুলো ঝাড়ছিলেন সুজাতা। ধুলো থাকার কথা নয়, তাঁর বহু বছরের কাজের লোক কমলা অনেক যত্ন নিয়েই ঘরদোর ঝাড়ামোছা করে। বিশেষত দিদির এই নাচের ঘরটিকে মন্দিরের মতো ধুয়েমুছে রাখার নির্দেশ আছে তার ওপর। তবু রোজ সকালে কায়াহীন ধুলোই ঝাড়েন সুজাতা, ঝাড়তে ঝাড়তে তাঁর মনও পরিষ্কার হয়ে আসে।

আজ ঝাড়তে ঝাড়তে, কী মনে হল, আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ত্বকের সে মসৃণতা আর নেই, চুলের রুপোর ঢল লুকোতে নিয়মিত কালার করতে হয়, তবু শরীরের মাপজোকে তিনি এখনও তরুণী। তাঁর স্তন, কোমর এখনও টানটান। ঘাড়ের ভঙ্গিমায় উদ্ধত ঘোটকীর আভাস আসে। পেটের ওপর আনমনে হাত রাখেন সুজাতা। রুমকির পর কাউকে আনতে পারেননি সাহস করে। অবস্থা তেমন ছিল না। আজকাল বড্ড একা লাগে। রুমকি যখন তাঁর গর্ভে ছিল, সেই অপেক্ষায় উদ্বেল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নতুন কাউকে পৃথিবীতে আনার আনন্দ… বুক দুটো টনটন করে ওঠে, দুধের ভারে যেমন হতো সে সময়।

হঠাৎ আয়নায় রুমকির নির্মেদ, সুঠাম শরীরটা ভেসে ওঠে। কখন এল! কই, গাড়ির শব্দ পাননি তো? এত ডুবে ছিলেন নাকি নিজের ভাবনায়! লজ্জা পেয়ে যান সুজাতা। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ান মেয়ের মুখোমুখি। লাল টপ, ব্লু জিন্স আর অক্সিডাইজড দুলে ওকে কী দারুণ দেখাচ্ছে। ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক আর চোখে ঘন কালো কাজল। ব্যাস, আর কোনও মেক-আপ নেই। কিন্তু ওর মুখ তো অন্যদিনের মতো ঝলমল করছে না? চিন্তার ছাপ স্পষ্ট মুখেচোখে।

‘কী রে? কফি করে নিয়ে আসি?

‘না মা, বোসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে সুজাতার।

‘কী কথা? তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।’

‘মা আমরা কদিন ধরেই আলোচনা করছি, ইনফ্যাক্ট ইচ্ছেটা আমারই, মানে মা হবার এই এক্সপেরিয়েন্সটা– মানে আমি বাচ্চা চাই মা।’

ধপ করে একটা মোড়ায় বসে পড়েন সুজাতা। ঠিক এই ভয়টাই তিনি করে আসছেন রুমকির বিয়ের পর থেকে। বাচ্চা, ন্যাপি পালটানো, রাত জাগা– একেবারে শেষ হয়ে যাবে কেরিয়ারটা। মিনিমাম দু-তিন বছর স্টেজ থেকে সরে থাকতে হবে। এই ঈর্ষণীয় ফিগারটাই কি আর ধরে রাখতে পারবে? ওঃ, বোকা, কী বোকা মেয়ে! আবার বলে কিনা ওর ইচ্ছে, সুনন্দন যে সুকৌশলে ওর কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাইছে, বুঝতেও পারছে না। মা হবার এক্সপেরিয়েন্স, হুঁ! বিয়ের আগে ঠিক এমনই বলেছিল, বিয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা নাকি ওর নাচের জন্যে জরুরি। মা হতে চাই! হায় ঈশ্বর! মা হওয়ার মানে বুঝিস? মা হওয়া মানে নিজের সবকিছু সন্তানের জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া, যেমন তিনি করে চলেছেন সারা জীবন ধরে। রাগে, দুঃখে কথা বেরোয় না সুজাতার মুখ দিয়ে।

মায়ের এই ভাবান্তর খেয়াল করে না রুমকি। যেন কোনও ড্রিম প্রোজেক্টের প্ল্যান বলছে, এমন তদ্গত ভাবে বলে যায় অনর্গল, ‘কিন্তু, আমি তো জানি, কেরিয়ারের এই পিক পয়েন্টে বাচ্চা নেওয়া মানে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া। এবছরেই কলামন্ডলমের স্কলারশিপটা পাওয়ার কথা চলছে, পেলে তো চেন্নাইতে চলে যেতে হবে। সুনন্দনও দু-তিন মাসের মধ্যে স্টেটস-এ চলে যাবে। তিন বছর তো থাকবেই। তার মানে এখনই বাচ্চা না নিলে… সামনের বছর আমিও তিরিশ পেরিয়ে যাব। তার মানে আরও কমপ্লিকেশন।’

সুজাতা এর পরেও কোনও মন্তব্য করেন না। ওর মুখ থেকে পুরোটা শুনে নিতে চান আগে।

‘তো সুনন্দন একটা ওয়ে আউট বার করেছে। যাতে বাচ্চাও আসে, আমাদের কেরিয়ারেরও কোনও ক্ষতি না হয়।’

অ্যাডপ্ট করবে নাকি? সুজাতা একটু বুকে বল পান, উদগ্রীব হয়ে ওঠেন মেয়ে এবার কী বলে শোনার জন্য।

‘সারোগেট মাদার জানো তো, যারা কিছু টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেন। মানে সবকিছু আমাদেরই রইল, শুধু বাচ্চা বেড়ে উঠবে এক ভাড়া করা মহিলার পেটে, জন্মের পর বাচ্চাটাকে আমরা নিয়ে নেব, আফটার অল আমাদেরই বাচ্চা।’

সুজাতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন। এবার রুমকি অস্থির হয়ে ওঠে, ‘কী হল মা? তোমার মত নেই? তুমি কি বেবির কেয়ার নিয়ে ভাবছ? আয়া রাখব, তাছাড়া তুমি তো আছোই।’

‘হ্যাঁ, আমি তো আছিই। সেইজন্যেই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। আমি থাকতে, তোমরা কী করে ভাবলে এসব?’

‘ওঃ কাম অন মা, তুমি তো কখনও এত ব্যাকডেটেড ছিলে না। এসব খবর তো কাগজেই হামেশা বেরোচ্ছে। কলকাতাতেই কত হচ্ছে। আচ্ছা, যারা খুব ব্যস্ত, তারা কী করবে বলো? তোমাদের দিন একরকম কেটে গেছে। তুমি যেমন শুধু আমাকে নিয়ে লেগে ছিলে, আমার পক্ষে কি তা সম্ভব?’

‘না সম্ভব নয় রুমকি। সুনন্দন খুব ম্যাচিওর্ড ছেলে, ও ঠিকই ভেবেছে। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, আমি থাকতে অন্য ভাড়া করা মহিলার কথা তোমরা কী করে ভাবলে? হাইজিনের ব্যাপার আছে, পরিবেশ আছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির তফাত আছে। তাছাড়া আইনি প্যাঁচপয়জার কতরকম হয় বোঝো তোমরা? সে যদি দাবি করে বসে বাচ্চাটা তারই? এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে।’

রুমকি বিভ্রান্তের মতো মার দিকে তাকায়। সারাজীবন সমস্ত সংকট মুহূর্তে যেভাবে তাকিয়েছে।

‘শোন রুমকি, বাইরের আজেবাজে কোনও মহিলা নয়, তোর সন্তান বেড়ে উঠবে আমার শরীরে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে, বুঝলি?’

রুমকির সব কেমন গুলিয়ে যায়। তার সন্তান থাকবে মায়ের গর্ভে! সে কী হবে তার তাহলে? দিদি না মা? মার মাথার ঠিক আছে তো? বাবা শুনে কী বলবে? আর সুনন্দন? একবার সুনন্দন বলেছিল, ‘তোমার মা কিন্তু এখনও বেশ অ্যাট্রাকটিভ।’ সেই নিরীহ কথাটাও কেমন কুৎসিত লাগে এই মুহূর্তে। অসহায়ের মতো সেও ধপ করে বসে পড়ে আর একটা সোফায়।

‘তুই কেন এত চিন্তা করছিস রুমকি? তোর বাচ্চা হলে এমনিতে তো তাকে আমাকেই মানুষ করতে হবে। তুই কি তাকে সময় দিতে পারবি? তার চেয়ে এই ভালো হল না? গোড়া থেকেই সে আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেল আষ্টেপৃষ্ঠে, ওকে মানুষ করতে গেলে কখনও মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি। তোর মতো ওকেও গোড়া থেকে গাইড করতে পারব, ছকে দিতে পারব ভবিষ্যৎ।’

স্বপ্নে টলটল করে সুজাতার দুচোখ। খালি-খালি ভাবটা উধাও হয়ে যায় বুক থেকে। আবার যেন পুরোনো উদ্যম ফিরে পেয়েছে তাঁর শরীর। সামনে এখন অনেক কাজ, আবার তাঁর হাতে গড়ে উঠতে চলেছে এক নবজীবনের রূপরেখা।

‘মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি।’ মার এই কথাটা কেমন যেন কানে লাগে, রুমকি কেঁপে ওঠে একটু, পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিকই তো বলেছে মা। তার সামনে অনেক কাজ। সে একজন শিল্পী, শুধুই শিল্পী, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো জীবনের ছোটো-ছোটো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার চলবে? সমাজ, সংসার, চরাচর মুছে যায় তার চোখের সামনে থেকে, শুধু ভেসে ওঠে একটি মঞ্চ, দুটি নৃত্যপরা পা, তারই ওপর সমস্ত আলো। পা দুটি নেচে যাচ্ছেই, নেচেই যাচ্ছে নিজের ছন্দে। মাকে জড়িয়ে ধরে রুমকি।

সুজাতা অবশ্য বাস্তববোধ হারাননি। সিদ্ধান্তটা তো শুধু আবেগের নয়। অবশ্যই ডাক্তারের মতামত নিতে হবে, জেনে নিতে হবে এই গুরুভারের জন্যে তাঁর শরীর কতটা প্রস্তুত। আর অনির্বাণ, তার মতটাও…

রুমকি কি তাঁর মনের কথাটা পড়েই বলে, ‘বাবা কী বলবে মা?’

‘বাবার ব্যাপারটা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। মানুষটা কোনোওদিন আমার কথা ফেলেনি। আর সুনন্দন, সত্যি কত আধুনিক মনের ছেলে। আমরা খুব লাকি রে রুমকি!’

গভীর প্রশান্তিতে রুমকিকে বুকে টেনে নেন সুজাতা। তাঁর গর্ভের ওম উষ্ণ পৃথিবীকে উষ্ণতর করে তোলে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব