ভোরে উঠে পড়ার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি সুজাতা। ওঠার তেমন দরকার পড়ে না, তবুও। অনির্বাণ অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। অফিসের রান্না করে দেবার তাড়া নেই আর। রুমকি যতদিন এ বাড়িতে ছিল, ওকে ঘিরে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ছিল। স্কুল-কলেজের পাট চুকলে, রুমকির নাচ, নাচের দলের দেশ-বিদেশ সফর, সেইসব সফরের প্রস্তুতিপর্ব– সব মিলিয়ে বাড়িটা গমগম করত। ছাত্রী, ছাত্রীর মায়েরা, অনুষ্ঠানের আয়োজক, মিডিয়ার লোকজন আসার বিরাম ছিল না। সেসব অবশ্য এখনও আছে। তবে দুটো বাড়ির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে জনস্রোত। শুধু রুমকিকে ভোরে উঠে তুলে দেওয়ার কাজটা আর নেই। সেদিনও পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর মস্ত দায়িত্ব। ভোরে উঠে এক-দেড় ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করত রুমকি। ভোরের এই সময়টা যে-কোনও সাধনার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ– একথা তো তিনিই ছোটোবেলা থেকেই রুমকির কানে ঢুকিয়ে এসেছেন।
রুমকি এখন এখানে থাকে না। তাই ওকে ঘুম থেকে তুলে নাচে জুতে দেবার কাজও নেই তাঁর। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাই। অবসর নেওয়ার পর প্রথম ক’দিন খুব উৎসাহে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছিলেন অনির্বাণ। তাঁকেও টেনে নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে ছাদের টেরেসে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, কাগজ পড়া তারপর দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট বানানো। মর্নিং ওয়াকারদের একটা দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘সাতসকাল’ নামে লেটারহেড ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, রক্তদান– এমন দু-চারটে কর্মকাণ্ডও হয়েছিল তাঁদের গোষ্ঠীর। তারপর তাঁরা কীভাবে যেন খসে পড়লেন সেই গোষ্ঠী থেকে।
তারপরও অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অবসরজীবনে সুজাতাকে জড়িয়ে নিতে। সারাজীবন সময় দিতে পারেননি। সুজাতার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ওভারটাইম করে গিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে নাচ চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। দামি দামি কস্টিউম, মিডিয়ার সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ, ছাত্রী ধরে রাখার জন্যে বছরে শহরের নামি-দামি হলে দু-তিনটে প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ– আরও কত কী। পাশাপাশি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। তারপর ইউনিভার্সিটি। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ চাকুরিজীবী অনির্বাণকে সেসবের খরচ জুগিয়ে যেতে হয়েছে। রুমকি কীভাবে বড়ো হল, সুজাতা কখন যে যৌবন পেরিয়ে গেলেন– দেখা হয়নি অনির্বাণের।