পিঙ্গলার প্রেম

বুনো বিড়ালটা এক মোক্ষম শিকার ধরেছে। ঠিক ধরেনি। হদিশ পেয়েছে। পাহাড়ের গর্তে মুখ ঢোকাচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। দু’পা এগোচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। শিকার যে একটা জবরদস্ত পেয়েছে সেটা বোঝা যায়, লেজ নাড়ানোর বহর দেখে। তিড়িক তিড়িক করে লেজ নাড়িয়েই চলেছে। এটা তার শিকার ধরার আক্রমনাত্বক শানিত অস্ত্র। শিকার রেঞ্জে এলে তবেই সিওর শট। শিকার পিঙ্গলাও পেয়েছে। তিনটে ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো বসিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। একটা ভাঙা কড়াইয়ের ভিতরে উই পোকার ডিম ফ্রাই হচ্ছে। পিঙ্গলার দৃষ্টি এড়ায়নি। ঘরের থেকে বর্শাটা এনে উনুনে লাল করতে থাকে। ঘর বলতে পাহাড়ের গুহা। গুহাটা বেশি বড়ো নয়। একটু বড়ো সাইজের ফোকর। তারই মধ্যে জঙ্গলের কাঠ দিয়ে তক্তপোশ বানানো। বুড়া বাপটার জন্য। বুড়া বাপটা একটানা কেশেই চলেছে। সূর্যের উদয় অস্ত আছে। বুড়ার কাশিতে উদয় আছে, অস্তটা নেই। থেকে থেকে চ্যাঁচায়– এ বিটিয়া ভুখ লাইগছে রে।

গর্তের মধ্যে মুরগিটা ঘাপটি মেরে বসেছিল। বেচারা মুরগি! পালাবার বিকল্প পথও নেই। দেহটা মুরগির মতো। মুখটা মুরগির মতো নয়। মুখটা থ্যাবড়ানো। প্যাঁচার মতো। বনবিড়ালটা তাক করেছে মুরগিটাকে। পিঙ্গলা ভাবছে, আর বিড়ালটার গতিবিধি নজর করছে। পাহাড়টা সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। যত উন্নাসিকতা মানুষ নামক জীবগুলোর খাদ্যের বেলায়। বিড়ালটা এক কিম্ভূত কিমাকার আওয়াজ করে লেজটা সটান বীর বিক্রমে খাড়া করে মুরগির মাথাটা কামড়ে ধরে। হতভাগা মুরগি। মরণ যন্ত্রণার আর্তনাদটুকু করার পর্যন্ত সময়ও পেল না। ততক্ষণে পুরো মাথাটাই বিড়ালের মুখের ভিতর। পিঙ্গলার মনে এক অদ্ভুত রকমের জিঘাংসার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন ছিটকে বেরোতে চায়। দু’দুটো দিন অনাহারে থাকতে থাকতে তারই সামনে বনবিড়ালটা খাবারটা চিবোচ্চে। পিঙ্গলা ঠিক থাকতে পারে না। আগুনের ভেতর থেকে তপ্ত বর্ষাটা বার করে হিংস্র বাঘিনীর মতো বিড়ালটার পুচ্ছদেশে সেদিয়ে দেয়। হত্যার উন্মত্ত আনন্দে পিঙ্গলার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে।

দেবার মেজাজ আজ বেশ রিলাক্সড মুডে। গতকাল ত্রিদেবের মেয়ের বিয়ের ভূরিভোজনে শরীর মন দু’টোই বেশ চাঙ্গা। ভুরিভোজনের চাইতেও বড়ো, খাবারের পুঁটুলি লাঠির ডগায় নিয়ে পরমানন্দে পাহাড়ের বেষ্টনী ডিঙিয়ে চলেছে কুঠুরির দিকে। উদরস্থ খাদ্যবস্তুর পঁচাত্তর শতাংশ পথেই খরচ করেছে। বাকিটা এখনও পেটে গজগজ করছে। এসব অনায়াসে হয়নি। আমদানি করা খাসি কেটে মাংস থেকে জ্বালানি জোগাড় করা ছাড়াও নানা রকম ফাইফরমাসের বিনিময়ে হয়েছে।

পিঙ্গলা বসেছে বর্শার ফলা দিয়ে মৃত বিড়ালটার চামড়া ছাড়াতে। থেকে থেকে গুহার ভিতর থেকে বুড়ার সেই ফাটা কাশির আওয়াজ– পিংলা, ভুক্ষ লাইগছে রে। পিঙ্গলা সাড়া দেয় না। আপন মনে কাজ করে আর গজগজ করে। বুড়ার অভিভাবক পিঙ্গলা। অভিভাবকের ক্ষুদা তৃষ্ণা থাকতে নেই। পেছন দিক থেকে দেবা লম্বা লাঠির মাথায় পুটুলি নিয়ে পিঙ্গলার পিছনে দাঁড়ায়।

– এ পিংলা, এ-তু কি করছিস বটেক? পিঙ্গলা ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর দেখে নিয়ে বলে– কেনে, দিখতে লাইরছিস? জ্বলন, পেডের জ্বলন। ঘরকে দ্যাখ, বুড়ার মরণ ভুক্ষ লাইগছে। আবার সেই আওয়াজ– কুছ খেতে দে নারে। দেবা এক পলক দেখে নিয়ে বলে– তুয়ার ভুক্ষ লাগে নাই?

– হুঃ, মুয়ের ভুক্ষ লাইগতে নাই রে, দেবা। দেবা লাঠির মাথায় বাঁধা পুটুলিটা খুলে নিয়ে বলে– পিংলা, এ কামডা মু করছি। তু ঘরকে যা। এ খাবারডা তু খা, আর বুড়াকে দে।

– তু খাবেক নাই কেনে? মু তো খাইছি বটেক।

তিলাবনী পাহাড়। ছোটো নাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের এক মিনি সদস্য। দৈত্যাকার নয়। শান্তস্নিগ্ধ। শীতের কুয়াশায় অলসতায় আকাশের বুকে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভৌগোলিক অক্ষরেখায় নামটা আছে। বাহ্যিক দাম্ভিকতা নেই। অন্তরে আছে। কোলে কোলে অজস্র গ্রাম। শ্রাবণের ধারা কৃষি জমিকে উর্বর করে। তিলাবনী বুক চিরে লোকালয়ের সঙ্গে রাস্তা তৈরি করেছে। জীবনযাত্রা বর্ণময় না হলেও দুর্বিষহ নয়। তারই অপর প্রান্তে বেজম্মার মতো জন্ম নিয়েছে জিয়ারা গ্রাম। বঞ্চিত। অবহেলিত। পদদলিত। শ্রাবণের রক্তরস নিংড়ে ছিবড়ে করে সমৃদ্ধ করেছে পাশেই পিচুলা গ্রাম। কোল দিয়ে অবারিত জলধারা সমতলে নদীর চেহারা নিয়েছে। পোশাকি নাম দ্বারকেশ্বর। জিয়ারা তার অবাঞ্ছিত বেয়ারা জারজ সন্তান। জিয়ারা অপভ্রংশ নাম।

রুক্ষ শুষ্ক। বছরের পর বছর ধরণে (খরা) বাঁজা মরুভূমিতে পরিণত। আর্তনাদ নেই। কলরব নেই। শক্তি নেই বলে। তিলাবনীর রুক্ষ পাথরের দেয়ালে সেঁদিয়ে থাকা মৃতদেহের দুর্গন্ধ চিল-শকুনের নাকে বিরিয়ানির স্বাদ এনে দিচ্ছে। নীল আকাশ কবে দেখা গেছিল কে জানে। গোটা আকাশ চিল-শকুন দখল করে নিয়েছে। ভাবলেশহীন তিলাবনী নীরব দর্শক। নীরব দর্শক সরকারি ত্রাণ দফতরও। ত্রাণ নিয়ে এ গ্রামে কেউ পা মাড়ায় না। ভোটও নেই। রাস্তাও নেই। বেজম্মা গ্রামে কারও মমত্ববোধ কাজ করে না।

শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। গ্রীষ্মে সূর্যের অগ্নিবৃষ্টি। এসবে তিলাবনী ভাগ বসায়নি। কেড়ে নিয়েছে শুধু শ্রাবণের ধারা। দেবা বসেছে উনুনের পাশে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া দেহটাকে সেঁকে নিতে। ঠিক সেঁকে নিতে নয়। বিড়ালের ঠ্যাংটাকে আগুনে ঝলসে নিতে। আলকাতরার পোঁচ লাগানো মুখে কোটরগত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অনাহারে শীর্ণ হয়ে যাওয়া হাত দুটো দিয়ে বিরানির মাংস খেতে খেতে পিঙ্গলা বলে– বেসাম খাবারডা ভালাই আনছিস বটেক। ইতে হরদিন কুছু খিতে লাইরবেক। দেবা, ই খাবার তু কুথা থেকে আনছিস? কেনে, পিচলার তিদেব বাবুয়ার মিয়ার বিয়া লাইগছে যে।

– ওহঃ, তা তু চোরি করিছ নাই ত?

– কেনে? বাবুয়ার ডেড়াতে কাম করলাম যে। উস লাইগা খাবারডা দিল ত। দেবা আগুনে লাকড়িটা খানিক ঠেলে দিয়ে বলে– বুড়া খাবারডা খাইছে? পিঙ্গলা ক্ষিপ্রতা নয়, অনুযোগের সুরে বলে– মুর বাপকে বুড়া বলবিক নাই। দেবা অনুযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারপর রান্নার রসদ যুগিয়ে বলে– গুস্সা করছিস কেনে পিংলা। তুয়ার বাপ ত মুয়ার বাপ আইনছে বটেক।

পেটে মা লক্ষ্মী গিয়ে পিঙ্গলার খিটখিটে মেজাজ এখন শান্ত। বুড়া বাপটা ফাটা কাশি বন্ধ করে শীতের আড়ষ্টতায় দুই হাঁটু মাথা এক করে তিন মাথার বুড়া। মন বুঝে দেবা সুপ্ত ইচ্ছাটা বলেই বসে।

– পিংলা মিলায় যাবি কেনে?

– মিলা! কোন মিলা?

– শবর মিলা

– কুথা সে?

– রাজনা গাড়ে।

– আরে বা প! সে তো বহত দূর আছে বটেক। টঙ্কা লাগবেক তো।

– মুয়ের আছে। চলনা কেনে?

– ডাকাইতি করলি না-কি রে?

– কেনে কাম জুটাইছি যে। উ বাবুয়ার ডেড়ায়। হপ্তায় শ-টংকা দিবে। একশো টাকার একটা নোট বের করে বলে– ই দেখ না কেনে।

ত্রিশংকর হালদার এখানকার আদিবাসী নয়। বহুদিন আগে পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল ছেলেটা জীবিকার সন্ধানে ভাসতে ভাসতে তিলাবনীর পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। পেশায় কোয়াক ডাক্তার। কুমিরের সাথে সখ্যতা না করলে জলে বাস করা যায় না। শ্রম দিয়ে চিকিৎসায়, সেবায়, ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ শবর জাতিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। হয়ে ওঠে শবর জাতির দেবতা। কতকটা বেঁচে থাকার তাগিদ কতকটা মানবিকতা, মূল্যবোধের তাগিদে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাবার মরিয়া চেষ্টা। ত্রিশংকর এখন দেবতা ত্রিদেব। তিলাবনীর কোলে মাথা গুঁজেই ত্রিশংকর জীবনের ধারাটা বদলে ফেলেছে। এরা বড়ো অসহায়। অশিক্ষা অজ্ঞতা যাদের একমাত্র অবলম্বন, হিংস্রতা ছাড়া বেঁচে থাকার পথ থাকে না। কাজটা যে সহজ, অনায়াসলভ্য তাও নয়। অনেক অত্যাচার, লাঞ্ছনা সহ্য করেও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে জীবনের মধ্যগগনে বসে ভাবছে– সভ্যতার বিকাশ, উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া স্পর্শ করাতে পারলাম কই? অশিক্ষা, নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর দল বারে বারে কাজে লাগাচ্ছে। একদম বিফলে গেছে ঠিক তাও নয়। একজনকে অন্তত পেরেছে। দেবা। কাক কাকের মাংস খাওয়ার অনাবিল আনন্দে নয়। ধবংস নয়। দেবা আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত।

দীর্ঘ অনাহারে গুরু ভোজনের গুরু ভার বুড়া বহন করতে পারেনি। চিল শকুনের দল পজিসন নিচ্ছে। একটু একটু করে রাতের আঁধার নেমে আসছে। চিল-শকুনদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। গুটি গুটি পায়ে সরে যাচ্ছে। জায়গা নিল তিলাবনীর ফোকরে। হিমেল হাওয়ায় উনুনের পাশে বসে পিঙ্গলা আর দেবা উষ্ণতার নির্যাস নিচ্ছে। দেবা বলছে

– ভোর রাইতে এক স্বপন দিখলাম বটেক। পিঙ্গলার তর সয় না।

– কি স্বপন দিখলি? দিখলাম, জিয়ারা থিকা রাস্তা বানায়ছি পিচলাতক। কোতো গাড়ি আইছে। কোতো গাড়ি যাইছে। তিলাবনীর বুক ফাটায়ে জলের তোড় আনছি। মাঠ ডোবা জলে টইটম্বুর হইছে। মাঠ সবুজ। সগগলে কাম লইছে। পিঙ্গলা উদাস মনে দেবার স্বপ্নের বাসনা গিলছিল। এ বাসনা পিঙ্গলারও ছিল। সুপ্ত রেখেছে। প্রতিদিন যাদের মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়, এ স্বপ্ন পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভৈরবী রেওয়াজের মতো। বাস্তবে ফিরেছে পিঙ্গলা।

– তিলাবনীর বুক ফাটায়ে রাস্তা বানায়ছিস?

– হ।

– জল আনছিস?

– হ।

– কোতো দিন সিনান করিস না বল না কেনে? তুয়ার মাথাডা গরম হইছে।

– কেনে?

– তু পাগল হইছিস বটেক।

– পাগল হই নাইরে পিংলা। উ রাস্তা হামি বানাবই। দিখে লিবি। উ চিল-শকুনের দল মু তাড়াবই। সগ্গলে জমিনে কাম করবেক। বাবুয়া কইছে– তু-ই পারবিক দেবা। আরও কইছে– হামাদের ভদ্দর হইতে হবেক। ভদ্দর সমাজ তৈয়ার কইরতে হবেক।

– তু থাম দেবা। উ বাবুয়া তোর মাথাডা খাইছে। উয়ারা ভদ্দরলোক বাবুয়া আছে। পেটে দানা পানি আইনছে। তাই উসব কতা কইছে। মু-দের পেটে দানা পানি নাই।

– উ সব কুথা মুদের মানাইছে না।

– চুপ যা পিংলা। উ বাবুয়া দেব্তা আইনছে রে। পাশে রাখা পুঁটুলিটার ভিতর থেকে একটা নাইটি বার করে বলে– ই দেখ্ না কেনে। ইটাকে মিয়াদের ডেরেস বলে।

– পর। পর না কেনে। দাঁড়া মু পড়ায় দিছি। দেখ্, দেখ্ মুকেও দিছে। প্রথম। এই প্রথম পিংলাকে নতুন রূপে, নতুন ভাবে দেখল। চোখ ফেরায় না। শরীরে, মনে এক অদ্ভুত শিহরণ। কি অপরূপ শোভা! গুছিয়ে ভাবতে পারে না। সদ্য উত্থিত যৌবনের চিহ্নগুলো শুকিয়ে ফলন্ত লাউগাছ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ভাবছে মিয়াটা পেট পুরে দুটো খিতে পাইরত! উঠে দাঁড়ায়– নাঃ ঘরকে যাই।

ত্রিশংকর হালদারের বাজার আজ বড়ো খারাপ। সকাল থেকে টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে চুপচাপ বসে। কোনও পেশেন্ট নেই। মেয়েটার বিয়ের পর ঘরটা একেবারে শুন্সান। বউ মরেছে মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়েই। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে স্মৃতি আজ ঝাপসা হয়ে আসছে। পেশেন্ট যে একেবারে হয়নি ঠিক তাও নয়। বউনি খদ্দের। একটি কচি মেয়ে গণশাকে ধরতে ধরতে চেম্বারের বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। কচি বউটা রাগে গরগর করতে করতে বলে– দ্যাখ্ কেনে বাবুয়া, ডেড়ায় চাউল নাই। বাচ্চা দুটো খিতে লাইরছে। আর উ কাম করবেক নাই। শুধু হাড়িয়া গিলবে। হর রাইত ঘরকে যায় নাই। সক্বালবেলা দিখি জমিনে শুইয়া ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ কইরছে। সারা শরীল থিকে খুন ঝইরছে। উ মুয়ার শরীলে জ্বলন ধরায় দিল। ত্রিশংকর ডেটল জল দিয়ে ধুয়ে, বেটাডিন তুলায় লাগাতেই গণশার আর্ত চিৎকার।

জ্বলন ধইরচে রে ডাক্তার বাবুয়া। ত্রিশংকর ওর চিৎকারে কান দেয় না। ব্যান্ডেজটা ভালো করে বেঁধে দেয়। তারপর টক্সাইড ইঞ্জেকশান প্রস্তুত করতেই আবার চিৎকার– বাবুয়া জ্বলন ধইরছে। তু আবার সূঁচ লাগাইছিস? মরে যাবেক বাবুয়া। উটা তু দিস না বাবুয়া। ত্রিশংকর ডাক্তার মিচকি মিচকি হাসছে। ডাক্তার আদিবাসীদের ভাষা বোঝে। বলতে পারে না। এরাও ডাক্তারের ভাষা বোঝে। ভাব বিনিময়ের বোঝাপড়াটা এরকমই। ডাক্তার বলছে– জ্বলন ধরছে? মরে যাবি? জখমটা তো বেশি হয়নি। তা সারারাত জমিনে পড়েছিলি যখন জ্বলনটা কোথায় ছিল? ছাইপাঁশ গিলবার সময় জ্বলনের কথাটা মাথায় ছিল না? এভাবে বেঘোরে প্রাণটা দিচ্ছ কেন বাপু? এসব ছাড়। বেঘোরে মরবি। মন দিয়ে কাজ কর।

সংসারে অভাব থাকবে। কষ্ট থাকবে। বউ বাচ্চা নিয়ে দুঃখ কষ্টে সংসারটা চালা। এর মধ্যেই শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাবি। বুঝলি তো। বাধ্য ছাত্রের মতো গণশা ঘাড় নাড়ে। পকেট থেকে ত্রিশংকর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে বউটাকে দিয়ে বলে– নাও, আজকের মতো বাচ্চাগুলোকে কিছু খাওয়াও। বউটা কোঁচড়ে টাকাটা গুঁজে নিয়ে পা দুটো ধরে প্রণাম করে বলে– বাবুয়া, তু দেবতা আছিস বটেক। গণশা কিছু বলল না।

বউ-এর ঘাড়ে হাত রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে এক ঝলক দেখে নিল। মনের অভিব্যক্তি। হে মহামানব, তুমি আছ বলেই শবর জাতি আছে। অবহেলিত, ঘৃণিত মানুষগুলো এখনও অতল তিমিরে চলে যায়নি। সকালবেলা বউনি দক্ষিণাটা এভাবেই হ’ল ত্রিশংকর হালদারের।

নিকম্মা দিন। কাজ না থাকলে ত্রিশংকর ভাবে। টেবিলের উপর বাঁ কনুইটা রেখে গালে হাত রেখে অনাবিল ভাবনার নদীতে ডুব দেয়। কতটুকু সামর্থ্য আমার। ভাবে জিয়ারা গ্রামের কথা। সেখানে শবর আদিবাসীদের কথা। বছরের পর বছর খরা। পাহাড়ের ঝরনা ধারা নামে না। অনাহার অপুষ্টিতে ক্রমশ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ। শিক্ষিত সমাজ গায়ে অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠীর লেবেল সেঁটে দেয়। কালেভদ্রে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতে যা ফসল হয়, সেখানেও সম্পদ লুঠেরা অতি বিপ্লবীর মুখোশ পরে চালায় নিরীহ মানুষের উপর তাণ্ডব। কাজে লাগায় এই অশিক্ষিত অজ্ঞ বুভুক্ষু শবর জাতিদের। ভাবনার শ্বাস সীমিত। সেই ভাবনার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসলে আর এগোতে পারে না।

দেবার ঘরটা বেশ মজবুত। এখানটা তিলাবনীর ঢালটা নেমে এসে লম্বা একটা ছাদের আকার নিয়েছে। দেবা বেশ খানিকটা জায়গা বুনো জঙ্গলের ডালপালা দিয়ে বেড়া দিয়ে নিয়েছে। ঝড় বৃষ্টি রোদের তাপ নেই। বেশ নিরাপদ। দেবা বসেছে ছেনি ঘষে ঘষে ধার দিতে। মনে দিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। তিলাবনী যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে পিচুলা আর জিয়ারা গ্রামকে বিভক্ত করে রেখেছে। পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা তৈরি করবে। দুটি গ্রাম থাকবে একই মায়ের সহোদরের মতো। দেবা অশিক্ষিত। তথাকথিত মূর্খ। প্রযুক্তিটা জানে। মনে মনে রাস্তার ব্লু প্রিন্ট ছকে নিয়েছে। তিলাবনী দেবার কাছে মায়ের মতো। শুধু দেবা কেন সমস্ত শবর, কুর্মী আদিবাসীদের কাছেই মাতৃতুল্য। তবু কেন জানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে জিয়ারা গ্রামের উপর তার এই বৈমাত্রেয় আচরণ। অভিমানে, ক্ষোভে চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। তবু মা-তো! ধরিত্রীর উপর সুবিস্তৃত এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভারসাম্য বজায় রাখার দায়ভার তো সন্তানকেই নিতে হয়। দেবা মনে মনে ভাবছে কীভাবে রাস্তাটা সেপ্টিপিনের মতো ঘুরে ঘুরে পিচুলা গ্রামে মিশবে। দু’টো গ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। পরিকল্পিত সৃষ্টির আনন্দে আরও একবার চোখ দুটো চিক্ চিক্ করে ওঠে।

কার্তিকে চলেছে দুর্ভেদ্য পাহাড় ডিঙিয়ে এঁকেবেঁকে এবড়োখেবড়ো পাথরের খাঁজে খাঁজে পা চালিয়ে। কাঁধে দু’হাত দিয়ে ধরা একটা ছাগল। দেবা দেখেছে। ছেনিতে শান দিতে দিতে হাঁক পাড়ে– এ কার্তিকে, এ কার্তিকে। সাড়া দেয় না, আরও তরতর করে পা চালায়। ছেনিটা রেখে পিছু নেয় দেবা। কার্তিকে দাঁড়ায় না। আরও তাড়াতাড়ি পা চালায়। দেবা এবার দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়ায়।

– ছাগলটা তু কুথা থিকা আনছিস বটেক? কার্তিকে নিরুত্তর। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে গল্পটা তৈরি করতে পারেনি। সত্যিটা বলতেও মনের সাহস জোগায় না। দেবার কাছে গোটা গ্রাম ঋণী। বিপদে আপদে সবসময় পাশে দাঁড়ায়। শরীরের রক্তরস নিঃশেষিত করে অপরাধপ্রবণ লেবেলটা মোছার চেষ্টা করছে। ভদ্র সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এ শিক্ষাটা পেয়েছে ত্রিদেব বাবুয়ার কাছ থেকে।

– তু চোরি করলি বটেক?

ছাগলটা ছেড়ে দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। তারপর বলে

– ছিনায়ে আনছি বটেক।

– ছিনায়ে আনছিস? ভদ্দর হবিক নাই? ভদ্দর সমাজ মুদের ঘৃণা কইরছে। উ দাগ মুছতে দিবিক নাই?

– হ হ ভদ্দর সমাজ! পেডের জ্বলন ভদ্দর সমাজ মুছে নাই রে, দেবা। বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।

– তুয়ার খাওন হয় নাই তো মুকে জানালি না কেনে? চল্, চাড়ে চাড়ে চল।

– কুথা?

– কেনে মুয়ার ঘরকে। মুয়ার খাবারডা যা আছে ভাগ করে লিবেক। যেতে যেতে দেবা বলে– মুয়ের স্বপনডা মুই একা পূরণ কইরতে লারবেক। এ গিরামের সগ্গলে কাম কইরতে হবেক। স্মরণে রাইখবি, তুয়ের খতরা তো মুয়ের খত্রা। সগ্গলের খত্রা।

বুদ্ধিটা ত্রিশংকরই দিয়েছিল। বলেছিল

– শোন দেবা, রাস্তাটা প্রথমে বেশি চওড়া করবি না। একজন যাতায়াত করার মতো। মনে রাখবি তিলাবনী তোদের মা-বাপ। পাহাড়ের আড় দেখে দেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তাটা হবে? জনপ্রতি দু’টাকা করে নিবি। তারপর বড়ো রাস্তা। পেটে লক্ষ্মী-নারায়ণ ঢুকে গেলে কার্তিকের ভোঁতা বুদ্ধির খোলসটা থেকে খানিকটা সতেজ হয়েছে। তা ইখন পেড চালাইছি কি করে? ঘরে ইকটা বাচ্চা। বউ-ডার আবার পেড হইছে। হব হব কইরছে। চইলতে লাইরছে।

– তু এক কাম কর। মুয়ের লগে বাবুয়ার ডেড়াই যাবেক। উ দেবতা একটা কাম জুটাই দিবেক। ই নে, পিরানডা পর। ছাগল ডা লিয়ে যা, কাল মালকিনকে ফিরায়ে দিবেক। একটা পুঁটুলিতে কিছু চাল দিয়ে বলে– ইটা লিয়ে যা। বউ-ডা, বাচ্চা খাবেক কি? মনের ক্ষিপ্ততার, ঝাঁঝ কেটে গিয়ে এখন লাউডগা সাপ। শুধু মনে মনে ভাবে। বয়সে দেবা আমারই মতো। অথচ আমাদের মতো এই জংলা মানুষটার মধ্যে মহামানবের মহা-প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল কে? শান্ত, অবনত মস্তকে বলে– ইকটা কুথা বলবেক দেবা? বল্ না কেনে? কার্তিকে ছাগলটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে– ইটা তুয়ার কাছে রাইখ রাইতডা। কাল দু’য়ে দু’য়ে ফিরায়ে দিবে।

মহাপ্রাণটা প্রতিষ্ঠা করেছিল ত্রিশংকর। প্রতিষ্ঠা করেনি। দেবার মধ্যে উন্নত সভ্যতার চেতনা জাগিয়েছিল। দিয়েছিল বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মন্ত্রণা। সেই মন্ত্রণার বীজ দেবা একটু একটু করে শবরদের মধ্যে রোপন করেছে। সবটা পারেনি। কিছুটা পেরেছে। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে কার্তিকে, পিঙ্গলার মধ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে। ত্রিশংকর শবরদের দিয়েছে অনেক কিছুই। ত্রিশংকর পরামর্শ দিয়েছে। হেমন্ত চলে গিয়ে শীত আসব আসব করছে।

– দেখ দেবা, ধানপাকার সময় হয়েছে। পিচুলার গ্রামে এখন অনেক কাজ। প্রতিষ্ঠিত পরিবারে পুরোনো লেপ কম্বল কিছুটা মজুরির বিনিময়ে চেয়ে নে। আর একটা কথা মনে রাখবি। যেখানেই সম্পদ, সেখানেই লুঠেরা। যত সম্পদ। তত লুঠেরা। সেই সম্পদ লুঠ করার চেষ্টা চলে অবিরত। স্বনামে। বেনামে। কখনও অতি বিপ্লবী মুখোশ পরে তাণ্ডব চালায়। ভণ্ড সাধুর দল আড়াল থেকে সাহায্য করে। হিংস্র পশু গেরস্থের সংসারে এসে পোষ মেনেছে। সব কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে, মনের ভিতর ঘুমন্ত সৈনিকটা জাগিয়ে তুলতে হবে। আসন্ন শীতে রাতের আকাশটা মেঘমুক্ত। খোলামেলা জায়গায় তারাগুলো কিত কিত খেলছে। দেবা সেই আকাশে চোখ রেখে একান্তে ভেবে চলেছে। দেবা ডেরায় বসে জংলি কাঠ বিছানো শুকনো জঙ্গলে একসময় শ্রান্ত দেহটাকে নিদ্রার কোলে ছেড়ে দেয়।

মানবিক মূল্যবোধ, চেতনা কম দামে পাওয়া যায় না। মূল্য দিতে হয়। অনেক মূল্য। হয়তো বা জীবন দিয়েও। মনের দিক থেকে ত্রিশংকর প্রস্তুতই ছিল। জীবনের সুখ, দুঃখ, বাঁচা মরা সব কিছুই ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে যারা নির্লিপ্ত থাকে, ত্রিশংকর সে ধাতুতে গড়া নয়। রাতের আকাশ। এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। ওই এক মুঠো আকাশটার ভাগীদার তো সবাই। অথচ তারাগুলো অনাবিল আনন্দে যখন খেলে বেড়াচ্ছে, পিছন থেকে লম্পট মার্কা মেঘগুলো চুপিচুপি গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। মেঘ না মেছো চিল! জীবনটা আসলে সবলের জন্য। কৌশলবাজদের জন্য। সবলেরা গিলতে চায় দুর্বলকে। কৌশলবাজ ক্যারাটে প্যাঁচ মারে সরল নির্ভেজাল মানুষগুলোকে। এটা আদি অকৃত্রিম।

ত্রিশংকর এখন অনেক বস্তুনিষ্ঠ। জীবনদর্শনটা খুব কাছ থেকে দেখেছে। ত্রিশংকর ঘরে ঢুকে দরজার খিলটা এঁটে দেয়। শুয়ে শুয়ে ভাবছে। সময় বেশি নেই। আক্রমণটা আসবে। প্রথম আঘাতটা তার উপরই। অনেক ঘুরপথে অস্ত্রটা দেবার হাতে তুলে দিলাম। আগ্নেয়াস্ত্রের ভারটা বইতে পারবে তো? এলোমেলো ভাবনা। সেই ভাবনাগুলি মনে ক্লান্তি এনে দেয়। সেই ক্লান্তিতেই ত্রিশংকর ঘুমিয়ে পড়ে। পাতলা ঘুম। হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। একঝাঁক বুটের আওয়াজ। এগিয়ে আসছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলির ভুষ্টিনাশ করে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলছে। পালাবার পথ নেই। দরজায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গোটাকতক হায়েনা। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। সারা মাথা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। শুধু হায়েনার দাঁতগুলো চিক্ চিক্ করছে। মত্ত উল্লাসে বলছে। ই বাবুয়া, তু ডাইকলি না। মুয়েরা আইছি। তুয়ার ব্যামো সারাইতে। পাশ থেকে আর এক হায়েনা বলছে– তু কে সূঁচ ফুটাইছিল না? তুয়ার ব্যামো সারাইবার লিগা। তু এক কাম কর। উয়ার ব্যামো সারাই দে বটেক। সূঁচ ফুটাই দে না কেনে? উয়ার ব্যামো সারবেক। অনেকক্ষণ থেকে গলার আওয়াজটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। ‘ব্যামো’র কথাতে ত্রিশংকরের চিনতে অসুবিধা হয় না।

– তুই গণশা না? তু-ই আমাকে মারতে এসেছিস? গণশা মুখে কথা নেই। শুধু মনে মনে বলে

– তুমি দেবতা। যদি পারো ক্ষমা করে দাও প্রভু। তুমিই তো পারো অধমকে ক্ষমা করতে। যে জালে আমি জড়িয়েছি। এছাড়া আমার যে আর পথ খোলা ছিল না। হায়েনার দল সাংকেতিক নামে কথা বলছে। ‘র’ ‘গ’ ‘শ’ নামে। পাশ থেকে বলছে

– ‘গ’ মশিনডা চলা কেনে?

‘গ’ বলছে,

– মশিনডা কাম কইরতে লাইরছে। সময় নষ্ট করে না। দুম দুম করে দুটো আওয়াজ। বার্ধক্যে শক্তি বেশি ধরে না। ত্রিশংকরও মৃত্যু যন্ত্রণায় বেশি সময় নষ্ট করেনি। অল্প ক্ষণেই ঘরের কড়িকাঠে চোখ দুটো স্থির করে শান্ত হয়ে যায়। প্রস্তাবটা গণশাই দিল। বলে – ইকটা কাম করি। ডেড়ায় আগ লাগাই দি কেনে?

– লগই দে। গণশা সাইকেলের টায়ারগুলি সারা ঘরে ছড়িয়ে দেয়। সদর থেকে বাতিল টায়ার কাঁধে করে নিয়ে আসে। আগুন লাগাতে এগুলি উপাদেয় পদার্থ। আগুন লাগায়। মনে মনে বলে– দেওতার সৎকারডা ত হউক বুটেক।

অমাবস্যার রাত। বাইরে মিশকালো ঘন অন্ধকার তিলাবনীকে গ্রাস করেছে। আবার দুম দুম করে আওয়াজ। ‘র’ ‘শ’ ইত্যাদি পিছন ফিরে তাকায়। টর্চ মারে। গণশা পড়ে আছে। তখনও ঠোঁটটা থর থর করে কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছে। নব আগন্তুকেরা সে ভাষা বোঝে না। তিলাবনী বুঝেছে। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। দেব্তা তুয়ার মরণ হয় নাই। মরণ হইছে মুয়ের। মরণ হইছে শবরদের। সেই অন্ধকারে হিংস্র দানবের দল মিলিয়ে গেল।

বসন্ত আসতে ঢের দেরি। হোলি খেলাও শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে রক্তের হোলি খেলা। ত্রিশংকরের রক্ত দিয়ে। গল্পটা এখানেই শেষ হলে হয়তো ভালো হতো। সব গল্প তো শেষ হয়েও হয় না। কারণ ত্রিশংকরের রক্তের বীজ দিয়ে জন্ম নিয়েছে আগামীদিনের লড়াইয়ের বুনিয়াদ। শবরদের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।

শীতকাল না এলেও শীত এসে পড়েছে। গ্রীষ্মেও অনাহুতে দল আগে ভাগে ঢুকে পড়ে। তিলাবনী শত সহস্র হাত প্রসারিত করে চারিদিক বেষ্টন করে রেখেছে। তিলাবনীর অবাঞ্ছিত জিয়ারা গ্রামের জলবায়ুর বন্দোবস্তটা এরকমই। দেবার কাঁধে লম্বা লাঠির মাথায় এক পুঁটুলি। পুঁটুলি ঠিক নয়। একটা বস্তা। গা দিয়ে তখনও গলগল করে ঘাম ঝরছে। বস্তাটা পিঙ্গলার ডেরার সামনে ধপাস্ করে ফেলে। একটা বিরাট কম্বল বার করে ললিত মোহনের বুকে চাপিয়ে দেয়। মনের ভিতর এক আনন্দের ঝিলিক মারে।

– ই বাপ, শরীলডা গরম হইছে না বটেক? জারে বহুত কষ্ট পাইছিস বটেক। আর কইরতে লাইরবেক। আর একটা কম্বল পিঙ্গলার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে– পিঙ্গলা কিমন লাইগছে বটেক।

ভিন্ গাঁয়ে ভিন্ মজুরিতে দেবার পকেট ভারী। আচমকাই পিঙ্গলার পিঠে হাত পড়ে যায়। মুহূর্তে পিঙ্গলার সমস্ত শরীরটা চনমন করে ওঠে। চোখে চোখ রেখে দুটি হৃদয় ভালোবাসাময় হয়ে ওঠে। পিঙ্গলা মনে মনে বলে– মু ত তুয়ার পরানে হারায়ে গিছি বুটেক। যৌবনের বুকে ফুটে ওঠে নব পত্রিকার জৌলুস। দেবার বুকে তখন দহনীয় বৈশাখ। মনের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে রং মশালের আলো। দু’টি হূদয় ভালোবাসার গাঙে হারিয়ে, সময়কে বয়ে যেতে দেয়। বাধা দেয় না। ডেরার বাইরে আগাছার মতো বেড়ে ওঠে পাহাড়ি ফুলের ঝাড়। দেবা এক গোছা ফুল নিয়ে বলে– চুলডা জড়ায়ে নে না কেনে? বসন্ত আসতে ঢের দেরি। এলেও এ গাঁয়ে উঁকি মারে না। না এলেও পিঙ্গলার মনে এসেছে। সেই বসন্ত পিঙ্গলাকে করেছে লজ্জাবতী ফুল। লাজুক চোখে তাকিয়ে বলে– কেনে?

– জড়াই দেনা কেনে। পিঙ্গলা অবাধ্য হয় না। জড়িয়ে দেয়। দেবা সেই চুলে পাহাড়ি ফুল গুঁজে দিয়ে বলে,

– বড়ো বাহারি লাইগছে বুটেক। শীতের হিমেল বাতাস চুপিসারে বলছে দেখেছি, দেখেছি। সব দেখেছি। সাক্ষী আছে হিমেল বাতাস। সাক্ষী আছে তিলাবনী। সমাজে ফিরেছে দেবা। বলছে– পিংলা, একটা কথা বইলবার মন চাইছে বুটেক। পিঙ্গলার কালো গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে। লাজুক গলায় বলে

– বল্ না কেনে।

শরম লাইগছে বুটেক। দু’টো চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের জাল বোনে। দেবার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। সময়ের দণ্ড পলের তর সয় না। অবশেষে অমৃত স্বাদের গন্ধ ঝরে পড়ে।

গুসসা করবিক নাইন ত বুটেক? মু তুকে বিহ করবারে মন চাইছে। দুয়ে দুয়ে ঘর করবেক। বাপটা থাইকবে মুদের মালিক। তু নারাজ নাইন ত বটেক?

সরম পিঙ্গলারও লাগছে। এক ছুটে ডেড়ার বাইরে গিয়ে মাথা নীচু করে নখ খুটতে থাকে। কিছু ত বল্ না বুটেক? পিঙ্গলা ফিস্ফিস করে বলে– পিরিতডা ত করি বুটেক।

– তা হইলে শুন্ না কেনে।

– ই অগ্রানে টুসু পরবে ঠাকুর মশাইকে স্মরণ দিবে। উ ঠাকুর মুদের বিহডা করাই দিবেক।

– উ কানুনডা মুদের ত নাইন বটে।

– নাইন থাক। ছাড়ান দে জংলি কানুন। ভদ্দর সমাজের কানুডাই বিহ করবেক।

ভালোবাসার রংমশালের আলোটা আচমকাই দপ করে নিভে গেল। ললিত মোহনের বুক থেকে অদ্ভুত একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ। দেবা এক লাফে বুড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এক ভয়ংকর শ্বাস টান উঠছে। দেবা উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত। চিৎকার করে বলে– পিংলা, চাড়ে চাড়ে আয় কেনে। দ্যাখ বাপ কিমন কইরছে বটে। তবু অশক্ত কম্পিত হাতটা দিয়ে দেবার হাতটা খপ্ করে ধরে। দেবা মরিয়া চেষ্টা করে। বলে– পিংলা, বাপকে মু লিয়ে যাব।

– কুথা?

– সদরে।

– আর সময় লাইরে দেবা। বাপটাকে থিরে যাইত দে। শেষবারের মতো পিংগলার হাতটা টেনে নিয়ে দেবার হাতে মেলাবার চেষ্টা করে। পারে না। শুধু অপূর্ণ স্বপ্নের বার্তাটা থরথর করে কেঁপে ঠোঁটটা স্তব্ধ হয়ে যায়।

চঞ্চলতা, অস্থিরতা, ব্যস্ততা কাঠবেড়ালির আছে। সে ব্যস্ততার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। উদভ্রান্ত, অস্থিরতা ব্যস্ততার কারণ কার্তিকের আছে। কার্তিকে ছুটছে। পাগলের মতো। হোঁচট খাচ্ছে। পড়ছে। আবার ছুটছে। তিলাবনীর পাঁজরে আঘাত লেগে সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত ঝরছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। মুখে শুধু আকাশ ফাটা আর্তনাদ। এই মুহূর্তে দেবাই সর্বনাশের আসান। পিঙ্গলার মনটা বিষাদগ্রস্ত। অসহায়ের মতো গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাপটা চলে গেল। এইমাত্র দাহ করে ফিরেছে। মাথার উপর থেকে অশক্ত ছাদটুকু চলে গেল। সমস্ত অভিভাবকত্ব, অনুশাসন, শাসনের অবসান ঘটিয়ে ঘরে ফিরেছে। দেবা স্ত্বান্না দেয় না। ভাষা নেই যে। বসে আছে হাঁটু মুড়ে মাথা নীচু করে। পিঙ্গলার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে কার্তিকে। বয়ে আনছে আরও এক ভয়ংকর বিপর্যয়ের ঝোড়ো হাওয়া। মনটা আরও উতলা হয়ে ওঠে।

– দেবা, উ আইছে কার্তিকে না? দেখ্ না কেনে উ আঙ্গাস ফাটা চেচাইছে। মাথা নীচু করে দেবা চলে গেছে ভিন জগতে। পিঙ্গলার উত্তেজনায় সম্বিত ফিরেছে।

– হ, লাইগছে বটে। কার্তিকে আরও কিছুটা সামনে এলে দেবা উঠে দাঁড়ায়।

– কার্তিকে, চেঁচাইছিস কেনে? কী হইছে বল্ না বটে? তিলাবনীর পাজরে আরও একবার আছাড় খেয়ে দেবার সামনে ছিটকে পড়ে। উত্তেজিত দেবা সস্নেহে বসিয়ে বলে

– চাড়ে চাড়ে বল্। কি হইছে বটেক?

– দেব্তা নাইরে দেবা। উ শয়তানরা দেব্তাকে মারি দিলা। উয়ার ঘর জ্বালাইন দিছে। গণশাও ছিল বটেক। আকস্মিক বজ্রপাতে দেবা দিশেহারা। উন্মাদ। শুধু আর্তনাদে একটা কথাই শোনা গেল। দেব্তা মু আইছি বটেক। সব শয়তান মু নিধন করবেক। পিতৃহীন, অভিভাবকবিহীন পিঙ্গলা এখন বড়ো অসহায়। পাশে আছে দেবা। বলিষ্ঠ অবলম্বন। ভালোবাসার রঙিন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুটে চলেছে ভয়ংকর দুর্যোগের অকুস্থলে। অসহায় পিঙ্গলা স্বপ্নকে ধরে রাখতে ছুটতে থাকে। মুখে শুধু আকুল আর্তি – দেবা, মুয়ার ডর লাগিছে বটেক। ইখন তু নাইন যাইছ। দুপহর গড়াইছে। রাইত নাইমছে। পথের বিপদ আইনছে। তু নাইন যাইছ। পিঙ্গলার সেই আকুল আর্তি তিলাবনীর পাঁজরে প্রতিধবনিত হতে থাকে। দেবার কানে সেই আর্তি পৌঁছোল কি না, কে জানে! দূর থেকে একটাই প্রতিশ্রুতি ভেসে আসল।

– ডরাইস না পিংলা। মু আসবেই। মু চাড়ে চাড়ে যাব আর আসব। পাথরের চড়াই উৎরাই পার করে মুহূর্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর দেখা গেল না।

ত্রিদেবের চিতা নিভে গেছে অনেক আগেই। শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে তিলাবনীর চূড়া ছুঁয়ে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। ত্রিদেবের চিতার পাশে বসে দেবা নিস্পলক দৃষ্টিতে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে চেয়ে আছে। দেবা শুধু ভাবছে। পিঙ্গলাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন, রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা, সুস্থ সামাজিক মানুষ গড়ার কারিগর সব কিছুই দলা পাকিয়ে তিলাবনীর চূড়া ছাড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নীল নীলিমায়। ঘোর দুঃস্বপ্নের মধ্যেই ভেসে আসে অমোঘ বার্তা। ভয় পাস না দেবা। আমার দেহটা নেই। আছি তোদের মাথার উপর। লড়াইটা চালিয়ে যা। ভয় কি? তোর সঙ্গে আছে পিঙ্গলা, কার্তিকে। জিয়ারা গ্রামের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যা। দেবা উঠে দাঁড়ায়। জীবন যুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক। জিয়ারাকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে হবে। জিয়ারা হবে সভ্য সমাজের মডেল গ্রাম। সে যুদ্ধ হবে পিঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়েই।

তিলাবনী রাস্তা দেয়নি। দেয়নি জল। কিন্তু সব কেড়ে নেয়নি। দিয়েছে অসংখ্য গাছ। সেই গাছের অসংখ্য প্রসারিত ডালের ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে। ত্রিশংকরের আশীর্বাদপুষ্ট দেবার বুক ভরা আর্তনাদ। আর একদিকে আন্দোলিত হচ্ছে অপরাজিত সংকল্প। এগিয়ে চলেছে দেবা। সামনে বিশাল রাক্ষুসে খাদ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিলাবনীর বুক চিরে বিশাল জলধারা দড়ির মতো পাক দিয়ে। এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অসংখ্য গাছের ডাল। অগণিত ঝুরি নেমে গেছে খাদের দিকে। দেবার মনোবল এখন অনেক মজবুত। মজবুত মনের শক্তি যুগিয়ে গেছে ত্রিশংকর। সেই মনোবলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গাছের ঝুরি ধরে। একটার পর একটা। রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকার।

তিলাবনীর বুকে রাতের আঁধার বড়ো তাড়াতাড়ি নামে। পায়ের নীচে মরণখাদ। শ্রান্তিহীন, ক্লান্তি বিহীন অকুতোভয় ছেলেটা এখন মৃত্যুঞ্জয়ী। হাত ফসকালেই চলে যেতে হবে মৃত্যুর কোলে। প্রান্তিক ঝুরি। তারপরই সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর। জিয়ারা আর পিচুলা গ্রামকে বিভাজন করে রেখেছে। আচমকাই দুর্ঘটনা। চড়চড় করে একটা শব্দ। নিভে গেল দেবার মনের সব আলো। গড়িয়ে চলে গেল দেবার নিথর দেহটা গহিন খাদে। সেই ঘন অন্ধকারে আর দেখা গেল না। জিয়ারার স্বপ্ন, পিঙ্গলার চোখে রংমশালের আলো, রাস্তা তৈরির কারিগর, সব কিছুই চলে গেল অনন্ত তিমির লোকে।

দেবার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সমস্ত গ্রাম আজ শোকের হাট। সুখ চায়নি। বাঁচতে চেয়েছিল। সভ্য সমাজে মাথা উঁচু করে। তিলাবনী কেড়ে নিয়েছে তাদের ন্যূনতম স্বপ্ন। দেবা যে তাদের লড়াইয়ের সেনাপতি। সামনে দেবার চিতা। পিঙ্গলার চোখে মুখে আগুনের ঝলকানি। চোখ দুটো হিংস্র বাঘের মতো জ্বলছে। রোদের ঝাঁঝ কমে আসছে। তবু সেই আলোয় পরিষ্কার বোঝা যায়, তিলাবনী ভয় পেয়েছে। কোনও দাম্ভিকতা নেই। নেই কোনও বিদ্বেষ। ঈশান কোণে জমে ওঠা জমাট বাঁধা মেঘটা ঘনীভূত হচ্ছে। ধেয়ে আসছে এক প্রবল ঝড়। সে ঝড়ে তিলাবনী তার অস্তিত্ব কতটুকু ধরে রাখতে পারবে? কে জানে।

এই বিয়োগান্তক গল্পের পরিসমাপ্তিটা এখানেই হলে হয়তো ভালো হতো। আসলে লড়াইয়ের পাটিগণিত কোনও সূত্র ধরে চলে না। আসলে লড়াইটা যে এখান থেকেই শুরু। পিঙ্গলা এক দৌড়ে দেবার আস্তানা থেকে ছেনি হাতুড়িটা নিয়ে আসে। ঘৃণা, ক্ষোভে সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। চিতার লেলিহান অগ্নিশিখা পিঙ্গলার মনেও আগুন ধরিয়েছে। এক বজ্র হুংকারে তিলাবনীর পাথরে প্রতিধবনিত হতে থাকে।

– এ তিলাবনী, তুয়ার বহুত দিমাক হইছে না রে? মুয়াদের রাস্তা নাইন দিলি। কোল গড়ায়ে জল দিছিস নাই। কষ্ট করছি। কুছু বলি নাইন। মুয়াদের ভুক্ষা মারবি? ইখন মুয়ার ভাবী মরদকে ছিনায় নিলি? তুয়ার ইত জ্বলন কেনে রে? ত দেখ কেনে, মু কি কইরতে লাইরছি? কোনও ভূমিকা নেই। কোনও গৌরচন্দ্রিকা নেই। ছেনির উপর হাতুড়ির এক একটা আঘাত আগুনের ফুলকি হয়ে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাস্তার নক্সাটা পেয়েছিল দেবার কাছ থেকেই। অবিরত ছেনির উপর হাতুড়ির আঘাত। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

সতেরোটা বছর ধরে

– ছেনি হাতুড়ির আঘাতে পাথরের এক একটা চাঙ্গড় ধসে পড়ছে। অনিদ্রা অনাহারে শরীরটা ক্লান্ত। মনের জোরটা অটুট। সেই জোরেই সেফটিপিনের মতো রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎই কানে আসে একটা অজানা সোঁ সোঁ শব্দ। বুঝতে পারে না। উৎসে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। পাথরের গায়ে মাথা ঠেকায়। একটা বিশাল জলের গর্জন। পিঙ্গলা সময় নষ্ট করে না। শুরু হয় ছেনি হাতুড়ির আঘাত। আঘাতের পর আঘাত। তারপরই কুল কুল শব্দে জলের ধারা। আসন্ন বিপদ বুঝতে দেরি হয় না। পিঙ্গলা ছুটে বেরিয়ে আসে। মুহূর্তে বিশাল আওয়াজ। বিরাট পাথরের চাঙড় খসে পড়ে। তারপরই ভয়ংকর গর্জনে আছড়ে পড়ে জলের ধারা জিয়ারা গ্রামে। অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণ মাঠ, পুকুর, ডোবা হয়ে ওঠে কল্লোলিনী গর্ভবতী। শরীরের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মনের অনাবিল আনন্দে পিঙ্গলা নাচতে থাকে। আত্মহারা জিয়ারা শবরবাসী।

রাস্তা ফিনিশিং-এর কাজ চলছে। কাশিটা ধরেছে অনেকদিন ধরেই। পালা করে জ্বরও আসছে প্রতিদিন। তবু তিলাবনীর পাঁজরে সেই আওয়াজ। ঠন্ ঠন্ ঠন্। কার্তিকে বুঝতে পারছে, পিঙ্গলার শরীরের অবস্থা ভালো না। বলছে– পিংলা, রাইত হইছে বুটেক। ঘরকে চল। তুয়ার শরীলডা অর দিছে নাই। ছলকে যাবি বুটেক। কাশির সঙ্গে গলগল করে খানিক রক্ত। হাঁপাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাত দিয়ে রক্ত মুছে পিঙ্গলা বলে

– তু ঘরকে যা। তুয়ার গরে বহু, বাল-বাচ্ছা আইনছে। তুয়ার অনেক দায় আইনছে। ই রাস্তাডা মুয়ার পরান। ইটাই মুয়ার দেবা আইনছে রে, কার্তিকে। তু ঘরকে যা।

সদর থেকে মাল বোঝাই ট্রাকগুলো ধুলো উড়িয়ে পিচুলা ছুঁয়ে জিয়ারা দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিয়ারাবাসী আজ অপরাধপ্রবণ অসভ্য লেবেলটা মুছে ফেলেছে। সে শিক্ষাটা দিয়ে গেছে দেবা পিঙ্গলা। কালের নিয়মে, সময়ের মলিনতায় নব প্রজন্মের স্মৃতির অতলে তারা তলিয়ে গেছে। সাক্ষী আছে তিলাবনী। জিয়ারা পিচুলা যে একই মায়ের গর্ভজাত। তবু তিলাবনীর পাঁজরে কান পাতলে আজও শোনা যায় পিঙ্গলার ছেনি-হাতুড়ির শব্দ। ঠন্ ঠন্ ঠন্।

দেবীজন্ম

ঘুসঘুসে জ্বরটা কিছুতেই ছাড়ছে না সনাতনের। প্যারাসিটামল দিয়েই চালাচ্ছে, খেলে জ্বর নেমে যায়, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগে, মাথাটা হালকা আর ফাঁকা ফাঁকা। মনে হয় যেন অনেক দিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আবার সে আগের মতো ঝাঁপিয়ে কাজ করতে পারবে। আর কাজ তো মেলা। পুজোর মুখে এ পাড়ায় কেই বা বসে থাকে। সবাই একগাদা বায়না নিয়ে গলা অবধি ডুবে আছে। যেটুকু পয়সা ঘরে আসে তা তো এই বড়োপুজোতেই। সারা বছর পুজো লেগে আছে যদিও। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী বিশ্বকর্মা যতই জুলুস করে হোক, সে যেন পাড়ার ম্যাচ খেলা, দুর্গাপ্রতিমা না গড়লে কোনও পটুয়াই জাতে ওঠে না। তবে টাকাও নয়, জাতে ওঠাও নয়, আরও একটা কিছু থাকে যার জন্যে রাত জাগে কুমোরটুলি। শরীরের কোশে কোশে কী উত্তেজনা, ঝমঝম করে আনন্দ, সারা শরীরে যেন আবার নবযৌবন অনুভব, পার্টি যেদিন ঠাকুর ডেলিভারি নিয়ে যায়, সেদিন মনে হয় ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে যেন প্রসাদ খাওয়ার আনন্দ পাচ্ছে।

কিন্তু এ বছর একটা ঠাকুরও কি গড়ে শেষ করতে পারবে? তার প্রতিমা কি আলো করে থাকবে কোনও পুজোমণ্ডপ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয় সনাতন, জানলা দিয়ে চোখে পড়ে তার কাজের ঘর, এখনকার ছেলেরা বলে স্টুডিও, কিন্তু সনাতনের কাছে এটা মন্দির। একটাই ভালো কথা যে তার কাজের ঘর তার বাড়ির সঙ্গেই, বাইরে যেতে হয় না, কিন্তু আজ সেটুকু উঠে যাবার ক্ষমতাও সনাতনের নেই। তার একটা ছেলেও নেই যে হাতে হাতে কাজ করবে, দুটোই মেয়ে। বড়োটার বিয়ে হয়ে গেছে, গলায় ঝুলছে ছোটোটা, এগারো ক্লাসের পর তাকে আর পড়াতে পারেনি সনাতন। জানলা দিয়ে সনাতন দেখল কাজের ঘর শূন্য, আধগড়া এক মেটে প্রতিমার খণ্ড খণ্ড পড়ে রয়েছে এদিক ওদিক, রঙের বাটি, তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ঘরটা যতটা লক্ষ্মীছাড়া থাকার কথা ছিল, তত তো লাগছে না। বরং সনাতন কাজ করার সময় যতটা অগোছালো থাকে, তার তুলনায় এখন অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কে করল? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল সনাতন ভালো করে দেখবে বলে। যা দেখল তাতে সে অবাক হয়ে গেল। শুয়ে ঘরের ওই কোণটা দেখতে পাচ্ছিল না। এখন আধবসা হয়ে সে দেখল কাজঘরের একেবারে ওই কোণটায় তার মেয়ে শংকরী খুব মন দিয়ে মাটি ছানছে, তার সামনে একটা ছোট্ট, একহাত ঠাকুর, অর্ধেক বানানো হলেও ওটা যে মায়ের প্রতিমা তা এখান থেকেই বুঝতে পারল সনাতন। বিস্ময়ে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। শংকরী বানিয়েছে ওই ঠাকুর? কে শিখিয়েছে? কখন শিখল সে? বরাবর সে একাই কাজ করে, একটা ফাইফরমাশের ছোড়া আছে, অর্ধেকদিন তার টিকি দেখা যায় না, রংটা এগিয়ে দেওয়া, মাটি ছানা সব সনাতনকে একা হাতেই করতে হয়। শংকরী আসে মাঝে মাঝে চা টিফিন দিতে। সনাতন টের পায় সে পেছনে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টের পেলেই সে খেদিয়ে দেয় ‘যা যা মেয়েমানুষের এখানে কী? দেখ মা কী করছে? আজ ভাতের মধ্যে কটা কাঁঠাল বিচি ফেলে দিস তো। নুন তেল কাঁচালংকা দিয়ে ভলো করে মাখবি’ শংকরী তবু যেত না এক তাড়ায়, দাঁড়িয়েই থাকত। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, যার মানে একটাই ভবিষ্যৎ তার। বিয়ে। বিয়ের কথা খুব একটা ভাবতে চায় না সনাতন। এক তো তার টাকার জোর নেই। দুই, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সংসার অচল হয়ে পড়বে। তিন, হ্যাঁ বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা তিন নম্বর কারণটা। আসলে শংকরীর মুখশ্রী যেমনই হোক চোহারাটা বড্ড দাম্বালে গোছের। যেমন লম্বা, তেমন চওড়া, খাটতে পারে সে কারণেই প্রচুর, শরীরে যেন বুনো মোষের তাকত, কিন্তু একটু নরমসরম মেয়েলি চেহারা না হলে বিয়ের বাজারে চালানো যাবে ও মেয়েকে?

বড়োটার চেহারাটা মেয়েলি ছিল, টুকটুকে ফরসা, পাতলা পাতলা গড়ন। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে পলতা গেছিল, সেখানেই পছন্দ করে ছেলের দিদি, শাঁখা সিঁদুরেই পার হয়ে গেছে বড়ো মেয়ে, এখন দিব্যি সংসার করছে। আর এ মেয়ের কপালে কী যে আছে। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে ওঘরে যায় সনাতন। শংকরী টের পায় না বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। মাটি রং দিয়ে সে তখন আস্ত একটা পৃথিবী গড়তে ব্যস্ত। সনাতন মুগ্ধ হয়ে দেখে তার কাজ। একটা অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে, কখনও তো হাতে ধরে শেখায়নি মেয়েটাকে, সারাজীবন খেদিয়েছে শুধু। জ্বর বলেই নাকি অন্য কোনও কারণে তার চোখে জল এসে যায়। সে শংকরীর মাথায় হাত ছুঁয়ে ডাকে ‘মাগো, তুই নিজে, একা একা’ আর সে বলতে পারে না, গলা বুজে যায়। শংকরী চমকে উঠে দাঁড়ায়, ধরা পড়ে যাবার লজ্জা ও ভয়ে সে মাথা নিচু করে ঘামতে থাকে। তার দিকে না তাকিয়ে সনাতন ভালো করে তার গড়া ঠাকুরটি নিরীক্ষণ করে। প্রতিমার আসল জিনিস অঙ্গসংস্থান, সেটা যে আয়ত্ত করতে পারে, তার কাছে ছোটো বড়ো প্রতিমা কোনও ব্যাপার নয়। পারবে, শংকরী পারবে, এই তো তার উত্তরসূরি। কথাটা মনে হতেই সনাতনের ম্যাজমেজে ভাব কেটে যায়, শরীরে যেন তাজা রক্তস্রোত বয়ে যায়। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা আসে। মেয়েমানুষের তো হাজারটা ফ্যাকড়া। সে গলা ঝেড়ে মেয়েকে বলে, ‘হ্যাঁ মা, তোর কাচা কাপড় তো? শরীর ঠিক আছে তো, মানে ওই ঋতুস্রাব…’

পরদিন তেড়েফুঁড়ে উঠল সনাতন। এতবছরের অপরাধ ও একদিনে স্খালন করবে এমন যেন সংকল্প তার। তার বউ অষ্টমী, বাতের ব্যথা আর নানা মেয়েলি অসুখে বারো মাস বিছানায় শোয়া, তার কানে গেল কথাটা। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করল।

‘ভীমরতি হয়েছে এই বয়সেই? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েকে ঠাকুর গড়া শেখাবে? মেয়েমানুষ পটুয়া হবে? একে ওইরকম হিড়িম্বা রাক্ষুসীর মতো চেহারা, ওর ওপর পটুয়া রটে গেলে ও মেয়ের আর বর জুটবে?’

সনাতন কান দেয় না ও কথায়। মেয়েমানুষ নাকি চাঁদে যাচ্ছে, তা আকাশের মাথায় উঠতে যদি পারে মাটি ঘেঁটে ঠাকুর বানাতে পারবে না? আরে মাটি মানে তো স্বয়ং জননী বসুন্ধরা। তা তিনি নিজেই তো মেয়েমানুষ। এসব কথা নিজের মধ্যেই রাখে সনাতন। এত কথা বলেই কি লাভ? অষ্টমী ওসব শোনার লোকই নয়। তাছাড়া সনাতনের সময় নষ্ট করার সময় নেই মোটে। পুজো এবার আগে পড়েছে। এতগুলো বায়না। চকগড়িয়া বারোয়ারি পুজো, টালিগঞ্জের সেভেন ফাইটার্স ক্লাব, সবচেয়ে চাপের ওই বেহালার মন্ত্রীর পুজোটা, দুম করে কোনদিন যে বলে বসবে ডেলিভারি নেব। তবু বুকের মধ্যে ভরসা টের পায় সনাতন। এবছর তার সঙ্গে শংকরী আছে। ভোর থেকে উঠেই কাজে লেগে পড়ে সনাতন, রান্নাবান্না সেরে সংসারের কাজ গুছিয়ে শংকরী আসে একটু পরে। সনাতনের কড়া নির্দেশ স্নান সেরে আসতে হবে আর মাসের ওই চারটে দিন সে কাজে হাত দিতে পারবে না। শংকরী এমনিতে কম কথা বলে। শক্ত চেহারার ঠোঁটটেপা মেয়ে সে। কিন্তু চারদিন কাজে হাত দিতে পারবে না শুনে সে আস্তে করে বলেছিল ‘মা দুগ্গাও তো মেয়েমানুষ বাবা, মহিষাসুরকে মারার সময় যে তাঁর মাসিক হচ্ছিল না, এ কথা কে বলতে পারে?’

সনাতনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল শুনে। আজকালকার মেয়েদের মুখে কিছুই আটকায় না। সে ঢোঁক গিয়ে বলেছিল ‘শোন ঠাকুর গড়া অত হতচ্ছেদ্দার কাজ নয় বুঝেছিস। জি পালের নাম শুনেছিস?’

জি পালের নাম বলার সময় কপালে হাত ঠেকায় সনাতন।

শংকরী হাঁ করে শোনে সে গল্প।

‘জি পাল মানে গোপেশ্বর পাল। বিলেতে গিয়ে সাহেবদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।’ সনাতন বলে যায় গোপেশ্বর পালের জন্ম ১৮৯৫ সালে, তিন বছরে মা মারা যায়, মামার বাড়িতে মানুষ, কৃষ্ণনগরে মাটির কাজে হাতেখড়ি। সেখানে একবার ঘূর্নিতে এলেন স্বয়ং ছোটোলাট কারমাইকেল, তাঁর চোখে পড়ল গোপেশ্বরের প্রতিভা। সেটা ১৯১৫ সাল, গোপেশ্বর তখন কুড়ি বছরের যুবক। তারপর সে চলে এল কলকাতা। আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। ১৯২৮ সালে গোপেশ্বর পাল বিলেতে যায়। সেখানে পঞ্চম জর্জের ভাই ডিউক অব কনটের মূর্তি পাঁচ মিনিটে বানিয়ে ধন্য ধন্য ফেলে দেয়। সাহেবদের কাগজেও ছাপা হয়েছিল সে খবর।

‘জি পালের সঙ্গে জাহাজে চেপে বিলেতে আর কী গেছিল জানিস?’

এই অবধি বলে সনাতন খানিকটা কুইজমাস্টারের ঢঙে শংকরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওর জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে ‘মাটি রে মাটি। বড়ো বড়ো দু-ব্যারেল ভর্তি বাংলার মাটি। তাহলে বুঝলি তো মাটি কত পবিত্র জিনিস। সবসময় এই মাটিকে প্রণাম করে কাজ শুরু করবি।’

শংকরী বলে ‘আমাদের নিজেদের লোক বিলেত গেলেন, সে তো কত আগে। কিন্তু আমাদের অবস্থা কি কিছু পালটাল? এই নোংরা গলি, প্যাচপ্যাচে রাস্তা, অন্ধকার ঘরে কাজ – এই চলছে।’

সনাতন একটু থমকে যায়, তারপর বলে ‘মা যদি তাঁর সন্তানের কপালে দুঃখ লিখে রাখেন, খন্ডাবে কার বাপের সাধ্যি? নে নে কার্তিকটা ধরে ফেল।’

‘কার্তিক?’ কেমন ধন্দে পড়ে যায় শংকরী। ‘আমি কার্তিক করব?’

‘কেন? পারবি না? খুব পারবি’ বলে সনাতনের খেয়াল হয় মেয়ের কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সে শংকরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ‘ওরে দেবতার যেমন নারী পুরুষ হয় না, শিল্পীরও নারী পুরুষ হয় না। মনে রাখবি, সব মূর্তিই তোর কাছে সমান।’

সনাতন আরো কিছু বলত হয়তো। কিন্তু কে যেন ডাকে তাকে বাইরে থেকে। বাইরে এসে দেখে নাড়ু। কারুভান্ডার দোকানটা ওদের। প্রতিমার চুল, চাঁদমালা, চুমকি, কিরণ, গোখরী, জামীর ভুরো, পাট, অস্ত্র সব ওরা সাপ্লাই দেয়। নাড়ু জানতে এসেছে কটা কী লাগবে। সনাতন ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে তখন বাবার অর্ধেক গড়া কার্তিক মূর্তির সামনে অচঞ্চল হয়ে বসে থাকে শংকরী। পরম রূপবান পুরুষ তার সামনে। মূর্তির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় শংকরী, ওর আঙুল আস্তে আস্তে মূর্তির শরীরময় ঘুরে বেড়াতে থাকে। আপাদমস্তক এক পুরুষশরীর প্রথমবার ছুঁয়ে শরীর-মনে কেমন এক জোয়ার অনুভব করে শংকরী। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলায়। চোখ বুজে কী যেন ভাবে একটুক্ষণ। তারপর যখন চোখ খোলে, তখন সে দেখে কার্তিক কোনও পুরুষ নয়, সে শংকরীর সামনে একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে এটুকুই জানে শংকরী।

পটুয়াপাড়ায় বছরের এই ক’টা মাস কখন সকাল সন্ধেয় গড়ায়, সন্ধে গভীর রাতে কেউ জানতেও পারে না। এ বছর তার সঙ্গে লেগেছে বৃষ্টি। প্রতিমাশিল্পীদের মাথায় হাত, মাটি শুকোচ্ছে না। রং লাগানো হবে কখন? গলি ভেসে যাচ্ছে সকাল থেকে। কী একটা দম বন্ধ করা গন্ধ উঠেছে। কাজ করতে করতে নাড়ুর গলা পেয়ে রাগ ওঠে শংকরীর। নাড়ু আজকাল বড্ড ঘন ঘন আসছে আর লাগাতার আনসান বকুনি। আজ ভিজে জাব হয়ে এসেছে। আর এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে নাড়ু বলে, ‘ও কাকা, কী শুনে এলাম শোনো। রেনবো চ্যানেল থেকে আসবে শংকরীর ইন্টারভিউ নিতে!’

সনাতনের হাত থেমে যায়।

‘হ্যাঁ গো কাকা, মেয়েছেলে মূর্তি গড়ছে, চাউর হয়ে গেছে তো। ওরা দেখাবে টিভিতে।’

সনাতনের বুকে ধক্ করে লাগে কথাটা। এত বছর সে মাটিতে মুখ ঘষছে কেউ ফিরেও তাকায়নি, টিভি দূরের কথা কাগজেও ছবি ওঠেনি তার, আর তার মেয়ে দুদিন কাজ করেই এত মাতব্বর হয়ে গেল!

সে শক্ত মুখে বলে ‘না না, ওসব মাতনে মাতলে কাজবাজ মাথায় উঠবে। পুজো তো দোরগোড়ায় এসে গেল। মন্ত্রীর পুজো নিয়েই বেশি চিন্তা। কবে যে ফিতে কাটার দিন ফেলে।’

নাড়ু বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘আরে কাকা, এসব এখন দরকার। প্রচার হবে, তাও ফ্রিতে। টিভিতে মুখ দেখাবার জন্যে সবাই হন্যে হয়ে ঘুরছে।’

সনাতন এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘নাড়ু, তুই এখন যা দিকিনি। এই তো ঘরের ছিরি, চারদিকে সব থইথই করছে, কোথায় বসতে দেব ওদের? আর আমাকে তুই টিভি শেখাচ্ছিস? আমি দেখিনি, বাবু পালের বাড়ি কতবার এল ওরা। একেবারে একগাড়ি লোক। কাজ নষ্ট সারাদিনের।’

‘হ্যাঁ, তা একটু হবে, তবে এই ঘরটাই তো তুলতে চাইছে ওরা। আবার বলছে একদিন শংকরীকে নিয়ে যাবে, রিয়েলিটি শো হয় না, লাগ ভেলকি লাগ? সেখানে পার্টিসিপেট করতে হবে ওকে। কত প্রাইজ আছে জানো?’

‘না না ওসব হবে না। মেয়েমানুষ একবার ঘরের বার হলে রক্ষে আছে? এই কাজ কি ও বারোমাস করবে নাকি? এবছর আমার শরীরটা যুতে নেই, ও বাড়ি বসে আছে, বিয়ের পর বাচ্চার কাঁথা কাচবে, না ঠাকুর গড়বে? যত পাগলের কাণ্ড। ভাগ তুই।’

‘দাঁড়া নাড়ু’ হঠাৎ কার গলা? চমকে তাকায় সনাতন, শংকরী এতক্ষণ মুখ নীচু করে কাজে মন বসাবার চেষ্টা করছিল, একটা রা-ও কাটেনি, মুখ তুলে অষ্টমীকে দেখতে পায়। অষ্টমী, বারোমাস বিছানায় পড়া মানুষটা উঠে এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সনাতন অবাক গলায় বলে ‘তুমি রুগি মানুষ উঠে এলে যে বড়ো? মেয়েমানুষ এসবের মধ্যে কেন আবার?’

‘মেয়েমানুষের মূর্তি গড়ে ভাত খাও আর ঘরের মেয়েমানুষদের দাবিয়ে রাখো, আমি বলছি আমার মেয়ে যাবে।’ অষ্টমী চ্যাঁচায় না, অদ্ভুত শান্তগলায় বলে ‘বিয়ে দিলেই সব মিটে গেল? ওর ভবিষ্যৎ নেই? দরজায় সুযোগ হেঁটে আসছে, উনি বলছেন যাবে না। বড্ড জ্বলুনি না? কেমন বাপ তুমি? মেয়েকে হিংসে করো?’

সনাতন রাগে থরথর করে কাঁপে। হাতের কাছে থাকা একটা মাটির খুরি ছুড়ে মারে, অষ্টমী মাথা সরিয়ে নেয় চট করে, দরজায় লেগে ভেঙে যায় খুরিটা। পা বাঁচিয়ে গিয়ে মাকে ধরে শংকরী।

দরজার পাশে ডাঁই করা অস্ত্র, নাড়ু রেখে গিয়েছিল কাল। সেখান থেকে একটা ত্রিশূল তুলে নিয়ে খুরির টুকরোগুলো একপাশে ঝেঁটিয়ে আনে শংকরী, তারপর সেই ত্রিশূল হাতে মার পাশে যখন দাঁড়ায়, সনাতনের তাক লেগে যায় দেখে। তার ভাঙা ঘরের নড়বড়ে দরজার চালচিত্রে তার অসুন্দর মেয়েটাকে অবিকল গর্জনতেল মাখা দুর্গাপ্রতিমার মতো দেখায়…

 

অরুণিমা

‘সাগ্নিক, আজ দিদি আর জামাইবাবু আসছে খেয়াল আছে তো? ট্রেনের সময়টা নেট-এ চেক করে স্টেশনে পৌঁছে যেও। দেখো দিদিদের যেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করতে হয়। আমি আজ কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না। বাইরে থেকে ডেলিগেট্স আসছে। ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর হবে না’, অরুণিমার কথাগুলো সাগ্নিকের কানে ঢুকল। কাজের থেকে চোখ না তুলেই স্ত্রীকে উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। ফোন করে দাও, ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে।’

‘বিয়ের পর প্রথমবার ওরা আমাদের বাড়ি আসছে। এখান থেকে কেউ না গেলে ওরা খারাপ মনে করবে। তোমার দিদি যখন এখানে এসেছিল তখন তুমি এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে কাজ করেছিলে। এখন একটা দিন তুমি করতে পারছ না?’ বিরক্তি চাপতে পারে না অরুণিমা।

নিরুত্তাপ গলায় সাগ্নিক উত্তর দেয়, ‘দিদি আমাদের সুখের সংসার দেখতে এসেছিল। আমরা যে অত্যন্ত সুখে রয়েছি সেটা দিদিকে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় দিদিকে খুব নিরাশ মনে হল। বিয়ের পরেই ভেবে নিয়েছিলাম যখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, নিজের টাকাপয়সাও যার যার নিজের, বন্ধুবান্ধবও দুজনের আলাদা তখন তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার হয় কী করে? এটাই বেশ ভালো ব্যবস্থা। তুমিই বলো না?’

অরুণিমার নিজের করা ব্যবস্থাই আজ হঠাৎ করে মোড় ঘুরে ওকেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।

ছয় বছরের প্রেমপর্ব শেষ করে সাগ্নিক আর অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বিয়ের আগের গভীর প্রেম ওদের দুজনের সংসারের চৌকাঠ পার করে বাইরে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। একে অপরকে অপমান করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করত না। মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ওদের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে হোটেল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হোটেলের ম্যানেজার। অগত্যা হোটেল ছাড়তে ওরা বাধ্য হয়েছিল।

অথচ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল ছ’দিনের জন্য। ম্যানেজারের কথা শুনেই অরুণিমা তাই রেগে ওঠে, ‘আমরা আগে থেকে পুরো টাকা দিয়ে রুম বুক করেছি। আপনি আমাদের চলে যেতে কীভাবে বলছেন?’

‘আপনি ঠিকই বলছেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনাদের জন্য হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের আমি অসুবিধায় ফেলতে পারি না। আর আপনি অ্যাডভান্স টাকা দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাগের মাথায় আপনারা স্বামী-স্ত্রী হোটেলের সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করেছেন। কাপ, কাচের বাসন ভেঙেছেন। সুতরাং সেগুলোর টাকা তো আপনাদেরই চুকোতে হবে। এই সব টাকা কেটে নিয়ে যে-টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ ম্যানেজারের উত্তরে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারে সাগ্নিক আর অরুণিমা।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসে ওরা। হোটেল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে স্থির করে নেয় পরের দিনই ওরা হোটেল ছেড়ে দেবে। ব্যস, আর কোনও কথা হয় না ওদের মধ্যে।

পরের দিন হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খুঁজে নেয় সাগ্নিক। কারণ ফেরার টিকিট কাটা ছিল চারদিন পরের তারিখে। সুতরাং দু’জনেরই আগে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় ছিল না ওদের কাছে।

‘হ্যাঁ রে কেমন কাটল তোদের ওখানে?’ সাগ্নিকের মায়ের কণ্ঠস্বরে অরুণিমা মোবাইল থেকে মুখ তোলে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরার আগে সাগ্নিকের বাবা-মায়ের অনুরোধে তিনদিনের জন্য ওরা এখানে এসেছে। সাগ্নিকের বাবা, মা দুজনেরই বয়স হয়েছে তারপর ওই একমাত্র ছেলে। সুতরাং ছেলে-ছেলে বউয়ের কাছেই ওদের যা কিছু আশা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও মেয়েকে কাছে পাওয়া হয় না। আর অরুণিমাও মেয়েই হয়ে উঠেছিল ওদের কাছে কারণ পাঁচ বছরেরও বেশি দেখছেন ওনারা ওকে।

‘হ্যাঁ জায়গাটা তো বেশ ভালোই, খারাপ কাটেনি কয়েকটা দিন’, কম কথায় সারবার চেষ্টা করে অরুণিমা কিন্তু ওর নিষ্প্রভ চেহারা সাগ্নিকের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

‘কী ব্যাপার বল তো? তোকে আর বাপ্পাকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। মনেই হচ্ছে না এই কদিন আগে তোদের বিয়ে হয়েছে। কোনও সমস্যা?’

‘মা, তোমাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল করে ফেলেছি। সাগ্নিক আর আমার একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।’

‘কী বলছিস তুই? ছয় বছর তো একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারতিস না। বাপ্পাকে কত বলেছিলাম, দিদির বিয়েটা হয়ে যেতে দে, তারপর বিয়ে করিস কিন্তু তোরা দুজন আমার কথাই শুনিসনি।’

‘তুমি ঠিকই বলছ। সত্যি বলতে কি এই কয়দিনে সাগ্নিকের আসল রূপটা আমার সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। মনেই হচ্ছে না এই মানুষটার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম,’ গলা বুজে আসে অরুণিমার।

‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। ভেবেছিলাম তোরা দুজন সুখী হলে আমরাও আনন্দে থাকব। এখন তো সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমার এটাই দুঃখ যে ছয় বছরের পরিচয়েও তোরা একে অপরকে চিনতে পারলি না।’

‘মা, এটা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। কয়েকটা দিন আরও দেখি। সাগ্নিক বলছিল একান্তই যদি কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব।’

‘খবরদার, ভবিষ্যতে কখনও এই কথা মুখে আনবি না। বাপ্পার সাহস তো কম নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনও ডিভোর্সের কথা উচ্চারণই করেনি আর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চারদিন বিয়ে হয়েছে তোদের আর এখনই ডিভোর্স নেওয়ার কথা ভাবছিস!’ অরুণিমা বেশ বুঝতে পারে সাগ্নিকের মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

‘মা, এখনই এতটা উত্তেজিত হয়ে পোড়ো না। ছয় মাসের মধ্যে কিছু করব না। তবে সব ফ্যামিলিতেই কোনও কাজ কখনও না কখনও প্রথমবারই করা হয়। বিয়ে করার অর্থ এও তো নয় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেও বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে,’ অন্যমনস্কভাবে অরুণিমা কথাগুলো বললেও, সাগ্নিকের মায়ের ছায়াঘন অন্ধকার মুখখানা তিরের মতো অরুণিমার বুকে গিয়ে বিঁধল।

দিদিকে স্টেশন থেকে আনা নিয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সাগ্নিকের মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছিল। ভাবল মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু শান্ত হবে, এই ভেবে বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল সাগ্নিক।

‘কী রে, ব্যাপার কী তোর? আজ হঠাৎ মায়ের কথা কী করে মনে পড়ল?’ সাগ্নিকের গলা শুনেই মা অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন।

‘তুমি কী যে বলো মা! কাউকে ভুলে গেলে তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন আসে। আর তুমি তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছ।’

‘ভালো লাগল বাপ্পা তোর কথা শুনে। আর বল, কেমন সংসার করছিস?’

‘আজ অরুণিমার দিদি, জামাইবাবু আমাদের এখানে আসছেন। অরুণিমা খুব খুশি। আমাকে বলেছে ওদের স্টেশন থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার কাজ আছে, যেতে পারব না,’ বলে হালকা হবার চেষ্টা করে সাগ্নিক।

‘তোর কী হয়েছে বাপ্পা? পাড়ার মধ্যে কারও দরকার হলে, সাহায্যের জন্য তুই ঝাঁপিয়ে পড়তিস…অতিথি আমার তোমার হয় না, সকলেরই তার জন্য করা উচিত,’ মা বোঝাবার চেষ্টা করেন।

‘দিদিও তো এসেছিল। অরুণিমা দিদির সঙ্গে অপরিচিতের মতোই ব্যবহার করেছে। এটা আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।’

‘সংসারে নানা কথা হয় কিন্তু তাই বলে অশান্তি বাড়ালে বাড়তেই থাকে। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে সুতরাং একটু বুঝে চললে পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’

‘মা, তুমি সবসময় আমারই দোষ ধরো। আমি যদি ঠিকমতো উত্তর না দিতে পারি তাহলে সেটা আমার হার হবে। তুমি তো জানো হার স্বীকার করা আমার ধাতে নেই।’

‘সব কিছুকেই হার-জিত হিসেবে ধরছিসই কেন? বিবেক বলেও তো মানুষের কিছু থাকে। বিবেক যা বলে তাই সকলের করা উচিত। যাই হোক, তোদের খবরাখবর বল।’

‘এমনি সব ঠিকঠাকই আছে। তুমি আর বাবা কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে দেখছি। এখন ফোন রাখি। অরুণিমাকে বলিস পরে ওর সঙ্গে কথা বলব কারণ এখন ওর অফিস বেরোনোর সময়।’ এই বলে ফোন রেখে দেন সাগ্নিকের মা।

ছোটো থেকেই অরুণিমার উপর ওর মায়ের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। বাবা বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন তাই মায়ের সঙ্গেই সময় কেটেছে বেশি অরুণিমা ও ওর দিদি অমৃতার। বয়সে ছোটো বলেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, অরুণিমা একপ্রকার মায়ের ন্যাওটাই ছিল। ছোটো থেকেই মায়ের কাছে অরুণিমা শিখেছে, নিজের ভালোর জন্য সবসময় সজাগ থাকাটা এবং ব্যক্তিত্ব রাখাটা খুব দরকার যাতে অপর পক্ষ দেখে ভয় পায়। এমনকী কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের ভয় দেখাতে হবে এমনটাও অরুণিমার, মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা সবসময় বলতেন, ‘সবরকম বিপদ থেকে আমি তোদের বুক দিয়ে আগলেছি। তোদের বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার পরিবারের লোকজন আমার জীবন প্রায় নরক করে তুলেছিল। ওরা তখন বুঝতে পারেনি যে আমি নরম মাটি দিয়ে তৈরি হইনি, রুখে দাঁড়িয়েছি ওদের বিরুদ্ধে।’

অরুণিমার কাছে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল অটল সত্যি। এমনকী মায়ের অনুমতিতেই সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা এগোতে পেরেছিল।

বিয়ের পরেও নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সাগ্নিক এবং ওর মা-বাবা-দিদির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল অরুণিমা।

সংসারে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে সাগ্নিকের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। সাগ্নিকের প্রতিশোধপ্রবণতার প্রমাণ হাতেনাতে পেল যখন সাগ্নিক অরুণিমার দিদিকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে অস্বীকার করে মুখের উপরে ওকে জানিয়ে দিল। অরুণিমারও স্টেশন যাবার উপায় ছিল না অফিসের কাজের জন্য। অগত্যা ফোন করে অরুণিমা দিদিকে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি করে ওদের বাড়ি চলে আসতে। বাড়িতেও কাজের লোককে অতিথিদের ঠিক করে অভ্যর্থনা করার কথা বুঝিয়ে অফিসের জন্য রওনা হল অরুণিমা। কিন্তু মন পড়ে রইল বাড়িতে।

‘জানিনা, দিদি কী ভাবছে আমাদের সম্পর্কে। বিয়ের পর প্রথমবার আমাদের বাড়ি আসছে তাও জামাইবাবু মানে কৃষ্ণেন্দুদা-র সঙ্গে। মুম্বই যখন পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম তখন প্রায়ই হস্টেল থেকে দিদির ওখানে পালিয়ে যেতাম। দিদির যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না। আর রান্না করতে দিদি প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং সেই সঙ্গে খাওয়াতেও। রোজই নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াত। আর আজ যখন দিদিরা আসছে তখন আমরা কেউই বাড়িতে রিসিভ করার জন্য থাকছি না,’ অফিসের সহকর্মীর কাছে মনের অস্থিরতাটা চেপে রাখতে পারে না অরুণিমা।

অরুণিমা নিজে রান্নাঘরে ঢুকতে পছন্দ না করলেও দিদির কাছে শুনেছিল, কৃষ্ণেন্দুদা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আগে থেকেই সব রকমের ফল, সবজি, খাবার কিনে ফ্রিজ ভরে রেখেছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলায় অফিস থেকে যখন বাড়ি পৌঁছোল, ভিতরে পা দিতেই হাসির শব্দ ভেসে এল অন্য ঘর থেকে। নিজের অজান্তেই অরুণিমার ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল। ঘরের দিকে পা বাড়াল অরুণিমা।

‘কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কীসের জন্য? আমাকেও তো কিছু বল দিদি।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে অরুণিমা বলল, ‘ভেরি সরি, কৃষ্ণেন্দুদা। কিছুতেই স্টেশন যেতে পারলাম না, অফিসে ছুটি পেলাম না। নিজের লোকেদের জন্যই চাকরি করা অথচ দেখুন তাদের দরকারেই ছুটি পাওয়া যায় না।’

‘নিমি, এত দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাগ্নিক, অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বরং বলতে পারো, তোমার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই হয়নি,’ কথাটা বলেই কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে।

‘আঃ! তুমি রাখবে। নিমিকে দেখলেই হল। ওর পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চাও না। বেচারা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে,’ অমৃতা কৃষ্ণেন্দুকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘আমি তোমার বোনকে কেন খ্যাপাব? আমাদের জন্য বেচারা শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগবে কেন? আমরা তো দিব্যি আরামেই সময় কাটাচ্ছিলাম,’ কৃষ্ণেন্দু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি কৃষ্ণেন্দুদা। আমি না থাকলেই সবাই বেশি খুশি থাকে,’ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে অরুণিমা।

‘দ্যাখো ভাই, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাগ্নিকই দিতে পারে। আমরা তো মাত্র কয়েক ঘন্টাই এসেছি। আমার তো আবার শালির সঙ্গ বেশি ভালো লাগে।’ কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে অরুণিমাও হেসে ফেলে।

সাগ্নিক শান্তস্বরে বলে ওঠে, ‘কৃষ্ণেন্দুদা, আপনি ভুল করছেন। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিই।’

‘বাঃ, ভায়া! কৌশলটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেছ দেখছি। এত বছর বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এটা এখনও আমি রপ্ত করতে পারলাম না,’ কৃষ্ণেন্দু আবার হেসে ফেলে।

‘দেখছিস দিদি, যে আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তার কাছে আমার কী আর এক্সপেকটেশন থাকতে পারে?’ অরুণিমার স্বরে কথার ঝাঁঝ স্পষ্ট ধরা পড়ে।

‘তুই শুধু শুধু সিরিয়াস হয়ে পড়ছিস। সাগ্নিক তোর সঙ্গে মজা করছে। সব কথার কি মানে ধরতে আছে?’ অমৃতা বোনকে বোঝাবার চেষ্ট করে।

‘আমি তো বলা, শোনা সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি দিদি। মা তো প্রথমেই সাবধান করেছিল যে আমাদের আর সাগ্নিকদের বাড়ির কালচারে আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু আমিই তখন কথা শুনিনি।’

‘বুঝেছি। আজকাল বুঝি মায়ের কথাতেই উঠছিস বসছিস?’ গম্ভীর হয় অমৃতা।

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, আর এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মায়ের থেকে ভালো আমার ভালো-মন্দের কথা আর কে ভাববে বল? মা আমাদের দু’জনের বন্ধুও তো বটে। কেন, তোর এটা মনে হয় না দিদি?’

‘মায়ের কথায় সংসার চালাচ্ছিস? সংসারটা তোর আর সাগ্নিকের না আমাদের মায়ের যে, মা তোর সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে চাইছে?’ সাগ্নিক আর অরুণিমা দুজনের মধ্যে একটা টেনশন চলছে এমন আাঁচ পেয়ে, রাগত গলায় অমৃতা বোনকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।

দুই বোনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণই সাগ্নিককে নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসে। অমৃতা ঠিকই করে নেয় বোনকে বোঝানো দরকার কারণ কথাবার্তার মাঝেই বুদ্ধিমতী অমৃতা বুঝে নিয়েছিল সাগ্নিক আর ওর বোনের সম্পর্কটা একটু শুধরোনো দরকার।

‘দিদি, আমি জানি সংসারটা আমাদের, কিন্তু মায়েরও আমাকে বলার অধিকার আছে। মা-কে আমি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। প্রয়োজনে আমি মায়ের জন্য সবকিছু করতে পারি। এখন আমাদের বিয়েটা বাঁচাবার জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছে। তুই বিশ্বাস করবি না দিদি, বিয়ের পর সাগ্নিক কতটা বদলে গেছে। সব সময় নিজের মত আমার উপর চাপাবার চেষ্টা করে। আমার যে আলাদা একটা আইডেনটিটি আছে সেটা ও মানতে চায় না। মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল শক্ত হাতে সাগ্নিকের এই অভ্যাসটা দমন করতে, নয়তো আমাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ফেলতে ও এক মুহূর্তও দেরি করবে না। সুতরাং সাগ্নিক যাই করুক না কেন আমি সাবধান হয়ে গেছি।’

‘কী বলছিস তুই?’ অমৃতা বিস্ময় চাপতে পারে না। ‘সাগ্নিকের নিন্দে করাটা মায়ের কাছে কি খুব দরকার ছিল? আমাদের জন্য মায়ের চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও একটা সংযমের সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। তুই এখন বাচ্চা নোস যে সব কথায় মা-কে টেনে আনতে হবে। নিজের ডিসিশন নিজেকেই নিতে হবে।’

‘আচ্ছা ছাড় দিদি, এসব কথা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে তোদের কষ্ট হয়নি তো?’

‘কষ্ট কেন হবে? সাগ্নিক তো স্টেশনেই ছিল। বাড়ি নিয়ে আসা থেকে খাওয়াদাওয়া যত্নের কোনও ত্রুটি রাখেনি।’

‘আর একটা দিন দিদি কষ্ট কর। এর পর পাঁচদিনের ছুটি রোববার নিয়ে। খুব মজা করব। বাইরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। বাড়িতে ওসব ঝঞ্ঝাটই রাখব না,’ অরুণিমা দিদির গলা জড়িয়ে ধরে।

‘না রে সে হবে না। কৃষ্ণেন্দু বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, আমিই নতুন নতুন রান্না করে তোদের খাওয়াব। সাগ্নিক রান্না করে?’

‘হ্যাঁ। আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেরাই আলাদা করে খাবার বানিয়ে নিই। মায়ের কথামতো রান্না করে খাইয়ে সাগ্নিকের অভ্যাস আমি খারাপ করতে চাই না। রান্না করাটা কি খালি মেয়েদেরই কাজ, তুই বল না দিদি?’ দিদির কাছে সব কথা বলতে পেরে, এখন কিছুটা হালকা অরুণিমা। প্রায় জড়তাহীনভাবে বলল, ‘সংসার করবার প্রথমেই মা সাবধান করে দিয়েছিল যে, রান্না না করার সবথেকে ভালো দিক হল, বাড়িতে ভালো রান্না হলে খেয়েদেয়ে বাড়ির পুরুষ-মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হবে। অযথা মেদ বাড়বে। এই ভালো, এতে চেহারাও ভালো থাকবে, বাড়িঘর নোংরাও হবে না।’

‘হ্যাঁ। তাই জন্যই মা, বাবাকেও নিজের জীবন এবং সংসার থেকে দূরে রেখেছিল,’ অমৃতার গলায় মায়ের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ে।

‘কী বলছিস তুই দিদি?’ অরুণিমার স্বরে অবিশ্বাস।

‘না, না কিছু না। আমার মুখ থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।’

‘না, দিদি। তুই আমার থেকে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিস। তোকে বলতেই হবে,’ অরুণিমা জেদ ধরে।

‘লুকোবার মতো কিছু নয়। মা তোকে যেটা শেখাচ্ছে নিজের জীবনেও ওই একই জিনিস করেছে। তুই তখন খুব ছোটো ছিলি। কিন্তু আমার সব মনে আছে। বাড়িতে রান্নার লোক ছিল কিন্তু মা ওকেও রান্না করতে দিত না আর নিজেও করত না। বাবা অফিস যেত চা পাউরুটি খেয়ে, বাড়ি এসেও কপালে কিছু জুটত না। মা বদারও করত না। বাবা নিজেই রাতে কিছু বানিয়ে নিত, আমার বাবার জন্য কষ্ট হতো, তাই বাবাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতাম। রান্না করার শখটা হয়তো আমি বাবার থেকেই পেয়েছি,’ অমৃতা বলে।

‘কিন্তু বাবা তো শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে বদলি নেয় বাবা। রান্নার লোকটাকে বাবা ছাড়িয়ে দেয় মায়ের জেদের কাছে হার মেনে। ছোটোবেলায় আমরা মানুষ হয়েছি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে।’

‘বাবার মুখটাই আমার ঠিক করে মনে পড়ে না,’ স্মৃতি হাতড়াতে থাকে অরুণিমা।

‘তোর মনে থাকার কথাও নয়। আমারই তখন দশ বছর বয়স। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য শহরে চলে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলে স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, গিফ্টও নিয়ে আসত আমাদের জন্য। মা জানতে পেরে, স্কুলকর্তৃপক্ষকে বলে, বাবার স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার মায়ের ওপর রাগ বাড়তে থাকে। মায়ের স্বার্থপরতার জন্য মা-কে আমি ভালোবাসতে পারিনি। মা-ও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তাই আমাকেও হস্টেলে পাঠিয়ে নিজের কর্তব্যে ইতি টেনে দিয়েছিল মা,’ না চাইতেও অমৃতার চোখ চলে ভরে যায়।

‘মনে আছে দিদি, তুই শুধু ছুটিতে বাড়ি আসতিস। তখন আমরা দুই বোন খুব মজা করতাম।’

‘তোর জন্যই তো বাড়িতে আসতাম। মা-র কোথায় সময় ছিল আমাদের জন্য?’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। পরে মা আমাকেও তো হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। সুমন কাকু সেসময় খুব বড়িতে যাতায়াত করত। আমাদের ফ্যামিলিটা ভেঙে দেওয়ার পিছনে ওনারও বিশাল ভূমিকা রয়েছে।’ অমৃতা বুঝতে পারে সুমন কাকুর উপর অরুণিমার রাগ আজও এতটুকু কমেনি।

‘নিজের সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ করিস না নিমি। এই অভ্যাস ছাড় দেখবি তোরই ভালো হবে। এখন নিজের সংসার সামলা। তোর সংসার ভেঙে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব।’

‘তোর কি মনে হয় সব দোষ আমার?’

‘আমি তোর দিদি হই। তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। দোষ কার সেটা বিচার করার আমি কে? কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, তোর নিজের সংসার তুই নিজেই একমাত্র বাঁচাতে পারিস,’ অমৃতা স্পষ্ট কথাটা বোনকে বলেই ফেলে।

‘কী হল? দুই বোনের না হয় অনেকদিন বাদে একসঙ্গে দেখা হয়েছে মানছি কিন্তু তাই বলে খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ নাকি?’ কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্যে দু’জনকে প্রশ্নটা করে।

‘ওঃ সরি কৃষ্ণেন্দুদা। কথা বলতে বলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না। আমাকে দশ মিনিট দিন, ফ্রেশ হয়ে সোজা ডিনার টেবিলে পৌঁছোচ্ছি,’ জিভ কেটে অরুণিমা উত্তর দেয়।

অরুণিমার সংসারে অমৃতা আর কৃষ্ণেন্দুর আসাটা একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে এসেছিল, যেটা অরুণিমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতে পেরেছিল। একটা সপ্তাহ হইচই, ঘোরাফেরা করে অমৃতারা চলে যেতেই আবার বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল।

দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন অরুণিমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। অফিসেও কাজে মন দিতে পারত না অরুণিমা।

একদিন রোজকার মতো সাগ্নিক নিজের ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। অরুণিমা এসে পিছন থেকে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। সাগ্নিক অবাক হয়, কারণ এই স্পর্শ ও প্রায় ভুলতেই বসেছিল।

‘চলো খাবে চলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ অরুণিমার গলায় সেই প্রথম অন্তরঙ্গতা অনুভব করল সাগ্নিক। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আনালে?’

‘আনাইনি, নিজে বানিয়েছি। রেস্টুরেন্টে এই খাবার পাওয়া যায়?’ অরুণিমা হাসে। সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে দেয় অরুণিমা। সুরভিত গন্ধের আবেশে সাগ্নিকের অরুণিমাকে যেন নতুন লাগে। অরুণিমা সাগ্নিকের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মনের কথাগুলো ঠোঁটে এসে পড়ে সাগ্নিকের, ‘ইশ, দিদি যদি আরও কয়েকদিন আগে আসত!’ অরুণিমা কিছু বলে না মুখে। পরম নিশ্চিন্তে সাগ্নিকের বুকে মাথা রাখে। মোমবাতির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা শুধু সাক্ষ্য থাকে বিরল এই মিলন দৃশ্যের।

 

টান

সবুজ ঘাসের ওপর চাপ চাপ রক্তের দাগ। জানোয়ারও সহ্য করতে করতে একসময় ফুঁসে ওঠে। আর এরা তো মানুষ! দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার লাভা স্রোত তো এরকম হবেই!

ডুয়ার্সের লাবডুঙ চা-বাগান। ছোট্ট চা-বাগান। তাই চা পাতার উৎপাদনও কম। মালিকের অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশা প্রায় অনাহারে থাকা শ্রমিকদের বঞ্চনার আগুনে পুড়িয়েছে দীর্ঘদিন। পরিণাম মালিক রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার থ্যাঁতলানো রক্তাক্ত শরীর ঘিরে জেগে থাকা একরাশ প্রশ্ন ও হতাশা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেই, ইউপিএসসি-র চাকরিটা জুটে গেল অভীকের। স্ট্যাটিসটিকাল ইনভেস্টিগেটর কাম অফিসার। অনেক পরিশ্রম ছিল তার জন্য। মেধাবী অভীক পেরেকটা ঠিক জায়গাতেই পুঁততে পেরেছিল। বেশ মোটা মাইনে। কাঁটাকলের আরও দুজন পেল। অর্ক ও দেবারতি। দেবারতি কিছুদিন পরেই বার্কলে ইউনিভার্সিটি-তে গবেষণা করতে চলে গেল। অর্করও পালাই পালাই ভাব। কলেজ সার্ভিস কমিশনের দিকে তাকিয়ে বসে।

প্রথম দিন থেকেই চা-বাগানের এতো সমস্যার মাঝেও, অভীক আস্তে আস্তে মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে কোথায় যেন ও একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছিল। মায়ের কথাটা মনে ছিল, ফেস দ্য ব্রুট। চোখে চোখ রেখে সমস্যার মোকাবিলা করো। শেষ সাক্ষাতে বিদ্যামন্দিরের দীপংকর মহারাজের কথাটা যেন কানে বাজে ওর, মানুষের জন্যও কিছু করিস!

আলিপুরদুয়ার স্টেশন রোডের শেষে ওর অফিস। ডিএম অফিস লাগোয়া। ওর থাকার জায়গা কিন্তু কাছাকাছি চা-বাগান কোরাঙ্গিনির বাংলোয়। ভারি মনোরম পরিবেশ। আলিপুরদুয়ারের বারোটা চা-বাগানের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র, শ্রমিকদের অবস্থা, অনুন্নয়নের কারণ থাকলে তার খোঁজ ও উন্নয়নের নকশা বানানো তবে সব কিছুর মূলে যেন থাকে শ্রমিকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এক কথায়, মানব মূলধনের রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। আর মাথার ওপর ডিএম, অশোক ভুটিয়া।

ডিএম ভালো বাংলা বলতে পারেন। শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। প্রচন্ড মেধাবী। হাই পাওয়ার গ্লাসের নীচে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রশাসনটা দারুণ বোঝেন। খুব বড়ো মনের মানুষ। কর্মীদের বিপদতারণ তিনি। এক মন ভালো করা পরিবেশ ওনার অফিসে।

প্রথম দিন থেকেই অভীকের সাথে ভালোলাগার সম্পর্ক ডিএম-এর। ওনার স্ত্রী বাঙালি। ভালো গানের গলা। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। অশোকবাবু আবার কবি মানুষ। লেখালেখি করেন অবসরে। অভীকের কবিতা পড়ে একদম আপ্লুত। তবে ও অন্য একটা কারণও বুঝতে পেরেছে। ওনার মৃত ছেলে আকাশের সাথে নাকি ওর অনেক মিল। তাই ভালো লাগায় অপত্যস্নেহের ভাগই বেশি পায় সে।

সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য সে একটা টান অনুভব করে এখন। সত্যিই এরা যেন প্রকৃতির সন্তান। সবুজের মাঝে যেন এক একটা সবুজ মানুষ। বঞ্চনা, অবজ্ঞা এদের দিনলিপি। ওর বাবার কথা মনে পড়ে খুব। সমাজবিজ্ঞানী বাবা বলতেন, রাষ্ট্র সব মানুষের সমস্যার কাছে সব সময় পৌঁছোতে পারবে না। ট্রিকল ডাউন থিওরি থাকবেই। মানে গাছের ওপরের পাতা বেশি জল পাবে আর নীচের পাতায় জল চুঁইয়ে পড়বে। সরকারি সুবিধা কিছু মানুষের কাছে বেশি মাত্রায় যাবে। তাই বেশি-পাওয়া মানুষগুলো যখন কম-পাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, তখনই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। তখনই বাস্তব হবে ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ প্রতি ঘরে।

আলিপুরদুয়ারের চা-বাগানগুলোতে, চা পাতার উৎপাদন অন্যান্য বাগানের তুলনায় অনেক কম। মালিকরা উৎপাদন বেশি করতে চায়। চা-বাগান ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠকে অভীক বেশ কয়েবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বহু পুরোনো চা গাছগুলো থেকে বেশি উৎপাদন আশা করা বৃথা। কচিপাতা উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে গাছগুলো। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেও বিপুল আর্থিক চাপের কারণে, পিছিয়ে আসছে অধিকাংশ চা-বাগানের মালিকরা।

আর কথায় আছে, সুস্থ শরীরে বাস করে সুস্থ মন। অপুষ্টি যেখানে যাপন চিত্র, সেখানে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা সর্বাধিক আশা করা যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব! উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রথম প্রযোজন। দিনপ্রতি একশো টাকায় অন্তত চারজনের একটা পরিবারের ভালো ভাবে চলা এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে খুবই কষ্টকর। তাই লাভের অঙ্ক কষার সাথে, শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে বাঁচার হিসাবটাও কষা দরকার।

চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের বাঁচা সত্যিই নিম্নমানের। হাজারো না পাওয়ার মাঝে বেঁচে থাকা ওদের। এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। সাহসী অভীক একটা কাণ্ড করে বসল। বেশ কয়েবার চা-বাগান শ্রমিকদের অবস্থা জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে কিছু করার আর্জি মেল করেছে সে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! হঠাৎ সুযোগটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে গেল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েজন সদস্যকে নিয়ে চা-বাগান উন্নয়নমন্ত্রী, আলিপুরদুয়ার চা-বাগান পরিদর্শনে আসেন। ডিএম, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার, অভীক এবং অবস্থা খারাপ এমন চা-বাগানের মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী। আশোকবাবুকে বার বার অনুরোধ করে অভীক আলোচনার স্থান কোরাঙ্গিনি চা-বাগানের অডিটোরিয়ামে করতে বলে।

উদ্দেশ্য একটাই ছিল এর পিছনে। অন্য বাগানগুলোর থেকে কোরাঙ্গিনি অনেকটাই পিছিয়ে। উৎপাদন কম এখানে। এটাকে মালিকরা ঢাল করে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজের চোখে দেখে যাক শ্রমিকদের অবস্থাটা।

আশানুরূপ কাজই হল। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে চা-বাগানের মালিকরা, শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে ভুল তথ্য দিতে থাকল। মন্ত্রী তাকে শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থাটা বোঝানোর কথা বলতেই, অভীক কাণ্ডটা করে বসে। সামনে থাকা জল ভর্তি গেলাসের মধ্যে নিজের পেনটা ডুবিয়ে দিয়ে মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে বসে, পেনটা ঠিক কী দেখছেন? বাঁকা না সোজা? বাকরহিত মন্ত্রী ও অন্যরা। এরকম উপস্থাপনা তাঁরা আশাই করেননি। মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে অভীক বুঝল, কেল্লা ফতে! জল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দেখলে, পেন তো বাঁকা দেখাবেই। অর্থাৎ ম্যানেজারদের চোখে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে গেলে তা সত্য হবে না। অবস্থার অসদ বিম্বটাই ধরা পড়বে এবং তাতে মালিকদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

এর পর সব কিছু তার পরিকল্পনা মাফিকই হল। শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে তাদের ঘর, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা দেখে আবেগতাড়িত মন্ত্রী। বাগানের ম্যানেজারকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব কিছু ঠিকঠাক করতে নির্দেশ দিলেন। দেখভালের দাযিত্ব দিলেন ডিএম-কে। শ্রমিকদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে বললেন অভীককে। ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী মাসে দিল্লি আসার প্রস্তাব দিলেন। অশোকবাবুর উৎফুল্ল মুখ বলে দিল ওনার খুশির কথা।

অভীক মনে মনে এটাই চাইছিল। শ্রমিকদের বাঁচার অযোগ্য পরিবেশের কথা প্রচার করতে হবে ব্যাপক ভাবে। লজ্জায় ফেলতে হবে সভ্য সমাজকে। বোঝাতে হবে, পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে এদের ব্রাত্য করা যাবে না। তবে যদি কাজ হয়। কদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী চা-বাগান শ্রমিকদের, বিনা পয়সায় চাল-ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অবস্থা কতটা শোধরাবে!

সারা চা-বাগানে এখন শুধু দিন বদলের স্বপ্ন। অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোর কাছে অভীক এখন নয়নের মণি। সে প্রত্যাশার চাপটা বোঝে। দিল্লি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। পুরো দাযিত্ব ডিএম নিজে নিয়েছেন। সসস্ত সময় ধরে উন্নয়নের রূপরেখা বানিয়ে চলেছে অভীক। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে টি টুরিজমের প্রস্তাব রাখছে। টি টুরিজম হলে বাগানের পুরুষগুলো হোটেল, দোকান, রিকশা বা ভ্যান চালানো অথবা গাইডের কাজ করতে পারবে। সহায়ক অর্থনীতি। মহিলাদের চা পাতা তোলার সাথে সাথে, পুরুষগুলোও কিছু আয় করলে বাঁচার পরিবেশ, পদ্ধতি আস্তে আস্তে বদলাবে নিশ্চিত। বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে শুরু করবে। দিনের শেষে মাতাল মরদগুলো ভূমিকা বদলে তখন হয়ে উঠবে প্রেমিক সোয়ামি!

সারা রাত প্রজেক্টটারে কাজ করে শুতে অনেক দেরি হয়েছে অভীকের। সঞ্চিতাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছে অনেক বার। পায়নি। মেযেটা বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে তাকে। প্রতি মুহূর্তে তার ভালোবাসা অনুভব করে অভীক। কতদিন দেখা হয়নি! একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুতে গেল সে।

পরদিন সকালে চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল অভীকের। কী হল আবার! বাইরে বেরিয়ে চমক। ও কি স্বপ্ন দেখছে? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? কাল যার কথা মনে করেছে বারবার সে-ই এখন সামনে। মূর্তিমান বর্তমান। আনন্দে উত্তেজনায় নীচে নেমে দেখল, চা-বাগানের মেয়েদের মাঝে সঞ্চিতা। অভীকের মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে আনন্দ-ঝরনা হয়ে সঞ্চিতা সকলকে জানিয়ে দিল, দুদিন থাকবে সে এখানে। ওইদিন সকলের জোরাজুরিতে রাত্রে খাওয়াদাওয়া, ক্যাম্প ফায়ারের আযোজন, অনেক রাত অবধি চলল নাচ গান। সারা চা-বাগান যেন নতুন প্রাণের উৎসবে মেতেছে। সঞ্চিতা যেন বঞ্চিত মানুষগুলোর মনে রাশি রাশি আনন্দ উল্লাসের জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিল।

পরদিন সকালে খুশির খবর আবার। অশোকবাবু সকালের খবরের কাগজটা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরের হাত দিয়ে, মন্ত্রী কথা রেখেছেন। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। মালিকপক্ষের সংগঠনও মেনে নিয়েছে। বাগানের সকলেই এই খুশির খবর, সঞ্চিতা আসার কারণ হিসেবে দেখছে। হাসি মুখে সঞ্চিতার সাথে অভীকও একরাশ টাটকা বাতাস ভরে নিল আগামীর জন্য।

দুটো দিন যেন সত্যিই আনন্দ ভৈরবী তার জীবনে। সঞ্চিতার মুখে শুনেছে শিলিগুড়িতে ব্যাংক অফিসারদের ট্রেনিং ছিল। সে ম্যানেজ করে চলে এসেছে অভীকের কাছে। দুদিন পরেই তাকে আবার ফিরতে হবে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে তার অফিস মালদায়। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে।

দুটো দিন হইচই করে কেটেছে ওদের। চা-বাগান ঘুরে দেখেছে। প্ল্যান্ট-এ গিয়ে চা পাতা তৈরি দেখেছে। অভীক ওকে ফার্স্ট চা তৈরি করে খাইয়েছে। মালদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাকও করে দিয়েছে। সঞ্চিতা বাগানের বাচ্চাদের চকোলেট বিলিয়েছে। সঙ্গে আনা জামা-কাপড় চা তুলতে আসা মেয়েদের দিয়েছে। সাজের জিনিসের অবস্থাও তাই। অভীকের মুখে চা-বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনে, সত্যিই ও মানুষগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। শুধু সঞ্চিতার সারপ্রাইজ ভিজিটের খবর মাকে জানাতে পারেনি অভীক। দিন পাঁচেক আগে ঝড়ের তাণ্ডবে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। শত যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ঠিক হতে কতদিন লাগবে কে জানে!

অশোকবাবু ও বউদিকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে সঞ্চিতা চলে যাবার আগের রাত্রে। গান আড্ডা গল্প মাউথ অরগানে ভালো লাগা যেন টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওদের ঘিরে। সেই সময়ে বিদায়বেলায় চোখের জলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বউদিকে। সারা রাত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওদের দুটো শরীর চাঁদের আলো গায়ে মেখে ভালোবেসেছে, আগামীর স্বপ্ন এঁকেছে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকালের প্রতীক্ষা করেছে।

তবে এ সকাল বড়ো মন খারাপ করা সকাল কোরাঙ্গিনি চা-বাগান জুড়ে। ফোনে ওর মুখে বাগানের মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের কথা শুনে সঞ্চিতা বলেছিল, একদিন আসবে এখানে। কথা রেখেছে সে। এক সমুদ্র ভালোবাসায় সকলকে ভাসিয়েছে। চা পাতা তুলতে এসে মেযেরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। অশোকবাবু ও তনিমা বউদিরও মন ভালো নেই। সত্যিই যেন জাদু জানে মেযেটা! সকলের মতো অভীকও চেয়েছে, আর কদিন থেকে যাক। কিন্তু মুখে বলতে পারেনি। সঞ্চিতা ম্যানেজার হয়ে বছর খানেক আগে জয়েন করেছে মালদা হেড অফিসে। ওর তাই কাজের বেজায় চাপ, জানে অভীক। শুধু নির্বাক সাক্ষী থেকেছে বিদায়বেলায় চোখের জল নিয়ে। কাল সারারাত যেন শেষের কবিতা-র অনুভব ছিল অভীকের কাছে। তারাদের মিটিমিটি সঙ্গে করে সঞ্চিতার স্মৃতির কোলাজ বানিয়েছে সে রাতজাগা হয়ে কখন আকাশ আলোর খেলায় মেতেছে সে খেয়ালই করেনি। ছোট্ট পাখিটার ডাকে যেন জেগে উঠল মানসঘুম থেকে। জানলায় বসে ল্যাজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে গেয়ে তাকে সুপ্রভাত জানাল পাখিটা। তার মনের দুঃখের খবর পেয়েছে বোধহয়!

 

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। তাহলে লাইন ঠিক হল এতদিনে! ফোনের ওপাশে মায়ের গলা। ও হ্যালো বলতেই, মায়ের কান্নার আওয়াজ।

এও কী সম্ভব! শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের পাশে ট্রেনিং সেরে সেবক রোড ধরে, হোটেলে আসার পথে পিছন থেকে একটা লরি ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে অটোর পিছনে। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পাস থেকে একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়ে চলে যায় সঞ্চিতাকে। থ্যাঁতলানো দেহটা আইসিসিইউতে লড়েছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সে আর নেই! সঞ্চিতা আর নেই!

অভীক মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাটে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। তাহলে দুদিন চা-বাগানের মানুষগুলোর মাঝে কাটিয়ে গেল, সে কে? অভীককে ভালোবাসার আবিরে যে রাঙিয়ে গেল, সে কে?

 

বিকৃতি

আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বারবার রজত ওই অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজের চ্যাট বক্সটা খুলছে, ডিপিটা দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে।

ভদ্রমহিলার মুখটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড় বেয়ে কোমর অবধি নেমে এসেছে। সুঠাম দেহের গঠন, চুলের পাশ থেকে প্রসারিত হয়েছে ফরসা দুটো হাত যেন কোনও চিত্রকরের অঙ্কিত দুটি বঙ্কিমরেখা। বয়স বড়োজোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। প্রথম মেসেজটা ওপার থেকেই এসেছিল, ছোট্ট একটা, হাই!

রজত প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কোনও উড়ো মেসেজ। তাই অফিসিয়ালি রিপ্লাই দিয়েছিল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

একসাথে অনেকগুলো স্মাইলি এসেছিল। রজত একটু অবাক হয়। এত রাতে সচরাচর এরকম রিপ্লাই কে দেবে?

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল,

কে আপনি?

ধরুন, আপনার কোনও বান্ধবী।

মানে?

কেন আপত্তি আছে? ছবি না দেখে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায় না?

রজতের আকর্ষণটা বেড়ে গেছিল। এরকম প্রত্যুত্তর সে অনেক দিন পায়নি।

আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

এই মহাবিশ্বের কোনও একটি ক্ষুদ্র শহরের বাসিন্দা।

হেঁয়ালি করছেন?

সরকারি আধিকারিকের সাথে হেঁয়ালি? না, অত সাহস নেই।

ভদ্রমহিলার চমকপ্রদ জবাবগুলো রজতের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন প্রায় সারাদিনই ও ফোন কাছে কাছে রাখে। কিন্তু সেই রহস্যময়ী সারাদিনে একবারও অনলাইন আসে না। শুধুমাত্র একবার। রাত বারোটার পর।

অতএব, রজতও সেই সময়টাই বেছে নিয়েছে। মনে মনে একবার কল্পনা করে অবয়বটাকে। আজ সে ঠিক করেছে, ভদ্রমহিলার নাম জানতে চাইবে।

তাই প্রথমেই বলে, এতদিন কথা বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি কি?

লোকে মধুরিমা বলে!

বেশ, আমিও ওই নামেই ডাকব।

যা ইচ্ছা!

একবার দেখা করা যায় কি?

এই প্রশ্নের পর টানা কুড়ি মিনিট কোনও রিপ্লাই আসেনি। ইতিবাচক কোনও কিছুর আশা নিয়ে রজত ফোনের দিকে তাকিয়েছিল। চার্জটা ক্রমশ কমে আসছে। প্লাগে চার্জারটা কানেক্ট করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল। অবশেষে রিপ্লাই এল, সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই

অবশ্যই, আগে চিনি, জানি..

রজত নিরাশ হয়নি। বরং আশার একটা ক্ষীণ আলেয়া জ্বলে উঠেছিল। ওর পুরো মনটা আলোকিত করে তুলেছিল। মুখভঙ্গি না দেখেও শুধু কয়েটা রিপ্লাই যে, কোনও মানুষকে এতটা সম্মোহিত করতে পারে সেটা জানা ছিল না রজতের।

আজকাল আর তার কাজে মন নেই। সে এখন শুধু বারবার ওই নম্বরটাতে কল করে।

সুইচ অফ! ট্রু কলারে দেখেও কোনও লাভ হয়নি।

তাই শুধু রাতের গহিন অপেক্ষা। এখন রাত হলেই কেমন নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সে। অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বলেই ফেলে, মধুরিমা, মধুরিমা, আমি তোমায় ভালো…

কী?

ভালোবেসে ফেলেছি!

তাই বুঝি! এত তাড়াতাড়ি?

দেরির কী আছে শুনি? তোমার কি আমাকে পছন্দ না?

তুমি যে বিবাহিত!

হ্যাঁ, রজত তো বিবাহিত। দীর্ঘ সংসারজীবন অতিক্রম করে এসেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথক ভাবে। একই বাড়িতে থাকলেও রজতের স্ত্রী মল্লিকা থাকে নীচের তলায়, রজত উপরতলায়। এখনও মল্লিকা সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুর ছোঁয়ায়।

 

রজতের আজকের চাকরির পদটা একদা মল্লিকার বাবারই দেওয়া। বিয়ে পর বেকার জামাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া শ্বশুরের দাযিত্ব! সেই দাযিত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন মল্লিকার বাবা পরিমলবাবু। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে জামাইকে সরকারি অফিসে পার্মানেন্ট পদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে জমি কিনে ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বদলে চেয়েছিলেন, মেয়ে কাছে বাকি জীবনটা কাটাতে। সেটাই কাল হয়েছিল। মরতে হয়েছিল জামাইয়ে হাতে। তাও সুখ। মরেও সুখ। মেয়ে তো ভালো আছে। কিন্তু সত্যিই কি ভালো ছিল মল্লিকা?

রজতের এনে দেওয়া ওষুধগুলো খেতে খেতে দিন দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছিল মল্লিকা। শুধু ঘুম পেত, অনিচ্ছাকৃত কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত না। ক্রমে নীরবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করাই ওর ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। রজত বলত, ওগুলো নাকি বাতের ব্য়থার ওষুধ, খেলে বার্ধক্য আসবে না কোনও দিন।

মল্লিকাও সরল বিশ্বাসে দিনের পর দিন নিঃশব্দে জলের তোড়ে গিলত সেগুলো। কখনও কোনও প্রশ্ন করত না। আসলে বাঙালি মেযো কখনওই স্বামীর সামনে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে না। দৃঢ় গলায় কোনও কিছুর সদর্থক কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এই চিরকালীন ব্যর্থতাই হয়তো কালের নিষ্ঠুর নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে।

এই অনাড়ম্বর জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই রজতের। তাই সে আবারও প্রেমে পড়েছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যবারের থেকে একটু অন্যরকম। কথা বলতে বলতে সেই সুতোর জটে সে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার থেকে বেরোনোর উপায় পাচ্ছে না। সে বেরোতে চায়ও না। বরং আরও প্রবল ভাবে নিজেকে সেই জটের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চায়। সংসার সুতোয় গিঁট দিতে চায়। অতঃপর, মধুরিমার সম্মতি চাই। তাই আবারও মুষ্টিভিক্ষা করে, তুমি কি আমার হবে মধুরিমা?

সম্ভব?

জীবনটা বড়ো বিষাদ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস।

বেশ, তবে দেখা কোরো।

বলো। কোথায় আসতে হবে?

কাল, পার্ক হোটেলে। বাকি ডিটেলস কাল সকালে আমি তোমাকে সেন্ড করে দেব।

ওকে!

মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সবকিছুই যেন নিমেষে রঙিন হয়ে গেছে রজতের কাছে। পাথুরে মাটিতে আবার জলীয় স্পর্শে ঘাস গজিয়েছে। কাল সে অনেকগুলো গোলাপ নিয়ে যাবে মধুরিমার জন্য। ভালো করে দেখতে পাবে ওর মুখটা। না জানি, সে কতই না সুন্দর হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে রজতের।

পরদিন সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে, প্রায় দশটা বাজতে যায়। চটপট করে ব্রেকফাস্ট সেরে মোবাইল খুলে দেখে, মধুরিমা অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে। দেরি না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।

আজ রজত অনেকটা পারফিউম দিয়েছে। তার এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। কোনও দিনও খুলে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ প্রয়োজন পড়ল।

এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল পার্ক হোটেলে। তারপর রিসেপশনে ফরম্যালিটিস কমপ্লিট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দুশো বাহাত্তর নম্বর রুম। সেখানেই অপেক্ষা করছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত সুন্দরী।

ঘরের সামনে এসে আলতো করে নক করে রজত। আপাদমস্তক কালো ওড়নাতে ঢাকা একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। সম্মোহিতের মতো কোনও অজানা স্নায়বিক নির্দেশনায় ঘরে ঢুকে আসে রজত। বসে পড়ে সোফার উপর। প্রশ্ন করে, তুমিই মধুরিমা?

ইঙ্গিতে উত্তর আসে, হ্যাঁ!

এখনও কি নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে?

ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে একটা মদের গেলাস বাড়িয়ে দেয় রজতের দিকে। বশীভূতের মতো সেটা হাতে নিয়ে একচুমুকে শেষ করে ফেলে সে। এভাবে পরপর তিনবার। রজতের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সোফার উপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, কালো ওড়নাটা সরিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা। বিস্ফারিত দৃষ্টি, যেন আগুন ঝরছে সমস্ত দেহটা থেকে!

চিত্কার করে বলে ওঠে, কেন এরকম করলে তুমি বলো? আমাকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন একের পর এক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে গেলে? একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না? কত সম্মান করেছিলাম তোমাকে। আমার ভগবান ভাবতাম।

সেদিন যখন তুমি ফোনটা ভুল করে আমার ঘরে রেখে চলে গেছিলে, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তুমি আমায় এতদিন যে-ওষুধগুলো খাইয়ে, ওগুলো কোনও সুস্থ মানুষের সেবনযোগ্য নয়। ওই ড্রাগসগুলো নিলে যে-কোনও সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে।

অ্যাকচুয়ালি, তুমি আমাকে বদ্ধ পাগল বানিয়ে রাখতেই চেয়েছিলে! যাতে বাইরের দুনিয়ার সামনে কখনও আমাকে না নিয়ে যেতে হয়, আর তুমি নিজের মতো করে স্বেচ্ছাধীন জীবনযাপন করতে পারো, ইচ্ছামতো নারীসঙ্গে বুঁদ হতে পারো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেব না মি. রজত সান্যাল! কারণ আসল মনের অসুখ তো তোমার, অসুস্থ তুমি! উন্মাদ তুমি, নাহলে এভাবে একের পর এক নারীসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারো না। বিকৃত মানসিকতাও একপ্রকার ভয়ংকর অসুখ, যার একমাত্র ওষুধ মৃত্যু!

রজত মল্লিকার হাত দুটো আটকাতে যায়। কিন্তু পারে না। শরীর ইতিমধ্যেই অবশ হয়ে গেছে। মল্লিকা হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সেই শেষের মুহূর্তটা আসতে আর কিছুক্ষণ মাত্র বাকি!

যে যেখানে দাঁড়িয়ে

সরাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সহেলি। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা কাক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে। আজ যে সহেলির কী হল কে জানে। শুধু কি আজ? নাকি প্রতিদিন?

মা, ও মা। আজ তো পঞ্চমী। আজই ঠাকুর চলে আসবে। কাল বিকেল থেকে নো এন্ট্রি। তাহলে কিন্তু এগারোটার পর বাবার স্কুটারে… তুমি তো ধ্যারধ্যারে স্কুটারে যেতে চাও না। উঁহু যেতে হবে কিন্তু।

আহা, তোমার পড়া নেই নাকি বিট্টু? পড়াশোনা না করলে বাবার তবু সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটার জুটেছে, তোমার ভাঙা সাইকেলও জুটবে না। যাও পড়তে বসো।

ও মা তুমি যাবে না, তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে রিইউনিয়নে?

যাব না, পড়তে বসো। (বেশ জোর গলায় বলে)

পাশের ঘর থেকে সহেলির শাশুড়ি বলে উঠলেন, আহা বউমা কতবার বলেছি না, আমার দাদুভাইকে সকাল সকাল উঠেই বকবে না। যাও না একটু ঘুরেই এসো। দুপুরে তো সব হয়ে যায়। আমি, নিরু আছি তো নাকি।

বউমার বিছানায় বসে নলিনীদেবী বলতে থাকেন, বউমা ভাত-কাপড়ের শাড়িটা পরে যেও। ওটা তোমায় খুব মানায়।

সহেলি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, তাইতো আমার বন্ধুদের আর অত ভালো শাড়ি আছে নাকি? ওরা এত ভালো শাড়ি তো চোখেই দেখেনি। নলিনীদেবী খানিকটা সংকুচিত হয়ে বেরিয়ে যান।

 

বর্তমানে সুনীলের ব্যাবসাটা পড়তির দিকে। অভাবের সংসারে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় হাড়ভাঙা খাটুনি। সন্ধ্যার দিকে আবার সহেলির টিউশন ব্যাচ আসতে শুরু করবে। অলস ভাবে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তেই তোশকের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছোটো ছোটো দুটো ডেয়ারি মিল্ক। একটা চিরকুটে জড়ানো। তাতে লেখা একটা বিট্টুর আরেকটা বিট্টুর মায়ের জন্য। হ্যাপি বার্থডে।

চকোলেট দুটো নিস্পৃহ ভাবে টেবিলের পাশে তুলে রাখে। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটাতে পিক পিক শব্দে একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। কালই সুনীল নেট প্যাক ভরে দিয়েছে। অভাবের সংসার হলেও সহেলির জন্য এসব ছোটোখাটো বিলাসিতা করেই ফেলে সুনীল।

 

তৃণা: সহেলি আর শ্রুতকীর্তি আসবে তো রে।

মেঘনা: শ্রুতি তো আসবে। আর সহেলির বর সুনীলের দোকানটা তো আমাদের পাড়াতেই। ও বলেছে, বউকে পাঠাবে।

তৃণা: এখান থেকে কিন্তু সোজা টক-ঝাল-মিষ্টি-তে যাব। তারপর সিনেম্যাক্স।

ওই তো সহেলি আসছে। কি সুন্দর ছিল বল! আমাদের ফার্স্ট গার্ল। তেমন নাচ করত। গ্র‌্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট না করে, মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে, নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারল।

মলি: মুদির দোকান তো কি? আমার বর তো স্কুল টিচার ছিল। মার সহ্য করতে না পেরে তো মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

মেঘনা: ও ভাবে বলিস না। ওর বরকে আমি চিনি। খুব কেয়ারিং। খুব ভালো। আমার কর্তার থেকে তো শতগুনে ভালো।

আরে, আয় আয় সহেলি। কতদিন পর দেখলাম, একই আছিস। আমরা তো মুটিয়ে গেছি। সেই যে কাকুর বাৎসরিকে দেখেছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাকিমাও চলে গেলেন।

সহেলি: সবই আমার ভাগ্য। আমার উপর রাগ করেই… হয়তো!

মেঘনা: ছাড় তো। জানিস শ্রুতকীর্তি আসবে। কি যে সুন্দরী হয়েছে না। ওয়েল মেইনটেইন্ড। রেডিও জকি, নিউজ রিডার কত কিছু যে করছে। অর্ঘ্যদা তো মাথায় করে রেখেছে। কাল বার্থডে পার্টির পিকগুলো দেখছিলাম। যা একটা ডায়মন্ড রিং দিয়েছে না ওর বর।

তৃণা: গতবার একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট। আর আমার বর? চাকরি করি বলে, একটা পুঁতির মালাও দেয় না। এই সহেলি কিছু বল। চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ নাকি?

সহেলি: মাথাটা খুব ধরেছে রে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

 

রাজস্থানি কারুকার্য মণ্ডিত সদর দরজাটা খুলে যায়। সহেলি ঢুকে পড়ে ১৬০০ স্কোয়ার ফিটের অন্দরমহলে। এল আকৃতির বিশাল বৈঠকখানা। তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রযিংরুম, লিভিংরুম, কিচেন, বাথরুম আর ছোট্ট ব্যালকনি। পুরো ফ্ল্যাটটার ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচুর্য আর শৌখিনতা।

দুধ সাদা মার্বেল ফ্লোর, পারসি কাজের কার্পেটে মোড়ানো। বেইজ রঙের গা ডোবানো নরম গদি আঁটা সোফা। আর তাতে রয়েছে নানা রঙের কুশন। টেক্সচার ফিনিশড দেয়ালে কোথাও যামিনী রায় কোথাও বা রাজা রবিবর্মার পেইন্টিং। একটা বিশাল ওপেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। তাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক শো-পিস।

ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড়ো, সুদৃশ্য কাটলারি সেট সাজানো, মাঝখানে একটা সুদৃশ্য ঝুড়িতে রয়েছে অনেকগুলি সতেজ ফল। সহেলি একঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে বেড়ায়। শৌখিন মডিউলার কিচেন ক্যাবিনেটে সাজানো কিচেনটা দেখে, নিজের স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরটা মনে পড়ে সহেলির। বেডশিট, পর্দা, কুশনকভার, পিলোকভার এমনকী সেন্টার টেবিলের সদ্য ধোঁয়া ওঠা টি পট-এর টি কোজি… সমগ্র আপহলোস্ট্রি জুড়ে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। লাল, নীল, ফুশিয়া, গ্রাসগ্রিন, লেমন-ইযেলো।

এক একটা রং যেন মনের সব মেঘ কাটিয়ে একরাশ রোদ্দুর নিয়ে এসেছে। বাথরুম থেকে শাওয়ার-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গুনগুন করে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠের গান। সহেলি ধীরে ধীরে বেডরুমের দিকে এগোয়। বিশাল খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিংটেবিল সাজানো। খাটের পাশে ছোট্ট বেডসাইড টেবিল। তাতে একটা ফটোস্ট্যান্ড-এ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। সুখী সুখী আদুরে ছবি। সহেলি এগিয়ে আসে। ফটোর মেযেটা খুব চেনা চেনা। তারই প্রিয় বান্ধবী শ্রুতি, ওর ছেলে ও বর।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়িটা ঢং ঢং করে ওঠে। হয়তো এক্ষুনি শ্রুতি বেরিয়ে আসবে। আর নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হবে। কোথা থেকে শুরু করবে কে জানে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে যায়। একি! এই মলিন বেশে সে কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে! কী বলবে নিজের কথা সে? না না, সে এক্ষুনি চলে যাবে। ছুটে বেরিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। হঠাৎ কে যেন পিঠে এসে হাত রাখে…

 

একি, এত বেলা অবধি শুয়ে আছো যে? তোমার শরীর কি খারাপ? সহেলি চোখ খুলে সুনীলকে দেখতে পায়। চারদিকে একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারে সে শ্রুতকীর্তির লেকটাউনের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ইন্দিরা কলোনির জীর্ণ ঘরে শুয়ে আছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সহেলি। সুনীল বলে, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো। আমি ম্যানেজ করছি। সারাদিন তো অনেক পরিশ্রম হয়।

সহেলি সুনীলের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, ঠিক আছে শরীর। সুনীল উজ্জ্বল মুখে বলে যায়, আজ পাঁঠার মাংস আনলাম বহুদিন পরে, জমিয়ে রান্না করো তো। সহেলি মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সুনীল একটু দমে যায়। মনে মনে তার সহেলিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। কোথায় রাজরানি হয়ে থাকবে, তা নয়। সুনীল ওর মুখে হাসি দেখার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে কিন্তু সামর্থ্যই বা কতটুকু? সহেলির ফেলে যাওয়া স্মার্ট ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ে, শ্রুতকীর্তি সেনের ঝাঁ চকচকে প্রোফাইল।

 

আজ বারোটা থেকে আড্ডা উইথ শ্রুতকীর্তির সম্প্রচার। রেডিও মিষ্টির অন্যতম সঞ্চালিকা সে। স্বামী অর্ঘ্য সেন একটা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের উচ্চপদে আসীন। আয়নায় নিজেকে দেখে শ্রুতকীর্তি। তার গলা শুনেই কত মানুষের দিন শুরু হয়।

টিভির চ্যানেলে যখন আজ সকালের আমন্ত্রণে সঞ্চালনা করে তখন অগুনতি মানুষের কাছে ফ্যাশন ডিভা হয়ে ওঠে। বান্ধবীরা তার মতো কেরিয়ার আর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। চোখ দুটো এখনও ফোলা, তাতেই বা কি। এখনই চড়া আইলাইনার আর চড়া কাজল দিয়ে নিপুণ ভাবে ঢেকে ফেলবে, কাল রাতের সব যন্ত্রণার, সব অশ্রুর ইতিহাস। বালিশের কভারে কেউ এক ফোঁটা চোখের জলের দাগ পাবে না।

কালকের প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকী ছোট্ট রনিকেও না, ছুটে গেছে ওয়াশরুমে। চোখের জল আর শাওয়ারের জল কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে… দেয়ালে কান পাতলেও কেউ শুনতে পায়নি, এতটুকু হাহাকার! প্রতিটা দিন জলভরা চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢেকে, মেকি হাসি মেখে, মিশে গেছে হাজার হাজার স্রোতে।

 

গাড়িতে এসে এসি-টা অফ করে জানলাটা খুলে দেয় শ্রুতকীর্তি। দমকা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সামনে ফ্রিঞ্জ করে কাটা লকসগুলো উড়ছে। না আজ যেতেই হবে জল শহর। সব কাজ বাতিল হয় হোক। তিস্তা পার্কে তাদের স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন যে।

শ্রুতকীর্তি জানে, কালকের পার্টির জের চলবে আজকের তিস্তা পার্কের বন্ধুদের সমাবেশেও। তৃণা, মেঘনা ছুটে এসে বলবে, অর্ঘ্যদা কি কেয়ারিং রে। শ্রুতকীর্তিকে মিষ্টি হেসে বলতে হবে, কী যে বলিস…। বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে, তোরা কিচ্ছু জানিস না… কিচ্ছু না। অর্ঘ্য তার প্রতি কোনও দিনও কেয়ারিং নয়, ওপেন রিলেশনশিপে বিশ্বাসী তার স্বামী অর্ঘ্য।

বিয়ের পরদিনই সে জেনে গেছে, স্বামীর জীবনে তার শুধু সামাজিক অস্তিত্বটুকুই আছে। এই বিশেষ দিনটা যে, কত বঞ্চনার… কত উপেক্ষার… তা সে-ই শুধু জানে। দীর্ঘ ছয় বছরে কোনও জন্মদিনকে অর্ঘ্য উষ্ণ শুভেচ্ছা আর সান্নিধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং অর্ঘ্যের বস আর বিজনেস পার্টনারদের হই-হুল্লোড় আর উল্লাসে শ্রুতকীর্তির বিশেষ অনুভূতিগুলো দম আটকে মরেছে।

প্রতি বছরই অর্ঘ্য রিমাইন্ডারের দৌলতে অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে এটিএম কার্ড ছুড়ে দিয়েছে। আর সে-ও কলের পুতুলের মতো স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ণ রেখে একের পর এক ঈর্ষণীয় উপহার কিনেছে। প্রাচুর্য আর নিপুণ অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সব উপেক্ষাকে। বছরের পর বছর এভাবেই ব্লটিং পেপারের মতো সব অপমান শুষে নিতে নিতে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

ছন্দপতন ঘটল সেদিন, যখন সে ছুটে গিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে দ্বিতীয় মাতৃত্ব লাভের সুখবর জানাতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণী তথা নারী মুক্তির ধ্বজাধারী শাশুড়ি-মা, গর্ভপাত করার প্রস্তাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, বংশের প্রদীপ রনি যখন আছেই তখন দ্বিতীয় সন্তান তাদের কাছে বাহুল্য আর দুর্ঘটনা বৈ তো নয়!

প্রথম সন্তান কন্যা হলে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রশ্ন আসত। এত বড়ো আঘাত সহ্য করতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রুতকীর্তি, আর তাতেই হিংস্র হয়ে ওঠে অমাযিক, প্রোগ্রেসিভ মুখোশের অর্ঘ্য।

মাঝে মাঝে সহেলির কথা খুব মনে পড়ে। আজ মেয়েটার জন্মদিন কেমন আছে কে জানে। তবে তার থেকে ভালো নিশ্চয়ই। মাঝে মাঝে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছে। স্বাধীন, চাকুরীরতা সে। কিন্তু পারেনি, ছোট্ট রনির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে যে ওর যে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে। আর নিজের সুখী সুখী ইমেজটা যে আজকাল বড্ড প্রিয় হয়ে উঠেছে। পৈতৃক বাড়িতে শয্যাশাযী, স্থবির মা। প্রোমোটারের উৎপাত। আর অন্যদিকে সেন পরিবারের অসীম পেশি শক্তি। লড়াইটা বেশ কঠিন। কারও সহানুভূতির পাত্রী সে হতে পারবে না, কোনও দিন।

 

সই, আমি শ্রুতি, চিনতে পারছিস?

তোর গলা চিনব না। তুই আমার নম্বর পেলি কোথায়?

আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলি? পার্স ফেলে এসেছিস? শরীর ঠিক আছে? আমি আসছি। ঠিকানাটা বল।

ইয়ে মানে… থাম থাম। তুই কোথায় বল? আমি তো বেরোবই, কাজ আছে একটা। আমিই যাচ্ছি। হ্যাঁ যাচ্ছি, কদমতলায় তো?

 

বাহ শ্রুতি, তোর ডায়মন্ড রিং-টা কি দারুণ রে। বার্থডে স্পেশাল?

বাঁ হাতের কনুই-এর কাছটা ভীষণ জ্বলছে শ্রুতকীর্তির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্ঘ্যর টাকায় কেনা আংটিটা দেখতে থাকে সহেলি। ধীরে ধীরে কুর্তির আস্তিনটা গোটায় শ্রুতকীর্তি। বেরিয়ে আসে দগদগে ক্ষতটা। মনে হয় ক্ষতটা যেন জ্বলজ্বলে হিরের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এ ক্ষত চিনেছে সহেলি। ননদ নিরু যখন ওর মাতাল স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্স কেস ফাইল করে ফিরে এল, তখন থেকেই খুব চেনা এই ক্ষত। এত কষ্ট শ্রুতিটার?

চোখের জল লুকিয়ে জোর করে হেসে বলে, শ্রুতি তোর কান্নার অভ্যাস নেই তো? কিছুক্ষণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্রুতকীর্তি বলে, প্লিজ সই কাঁদিস না আমার জন্য। আমার চোখের জল একবার বেরোলে আর থামে না রে। অনেক কষ্টে আটকে রাখি। আমি তোকে কত হিংসে করেছি জানিস। তোর সব কিছুই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলো করতাম। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকোযে্ট পাঠাইনি।

 

কোর্ট মোড়ের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে রাকেশকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে শ্রুতকীর্তি। এদের স্যানট্রোতে আর নয়।

খোলা আকাশের নীচে একবার বুকভরে শ্বাস নিতে পেরে অদ্ভুত আরাম লাগছে। নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর ডাকের সাজের প্রতিমা দেখল সে। মা দুর্গা তো শক্তিরূপিণী।

যদি নিরু পারে, মলি পারে, তবে সেও পারবে। এখন সোজা বসু ক্লিনিক। তারপর দেশবন্ধু পাড়ায় মায়ের কাছে। মা যতই স্থবির হয়ে যাক আজ তাকে গিয়ে বলতেই হবে, সে তার সন্তানদের নিয়ে নতুন পৃথিবী গড়বে।

 

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে-বাড়ির কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সহেলি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। রাজবাড়ির মোড়ের সামনে ঠাকুর চলে এসেছে। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন মনেই বলে ওঠে, ক্ষমা করে দাও মা। আমি শ্রুতিকে হিংসে করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কখনও চাইনি। আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকতে পারি যেন। বিট্টুকে মানুষ করো আর শ্রুতিকে ভালো রেখো। ওকে শান্তি দিও।

সামনে বিডিও অফিসের দোকানে ছোট্ট সিঙ্গাড়াগুলো সুনীল খুব ভালোবাসে। দাঁড়িয়ে পড়ে সহেলি। মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে…

সেই সুরে, বাঁধন খুলে

অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে, অকারণে

ভুলে যাওয়া গানের বাণী,

ভোলা দিনের কাঁদন হাসি

ভালোবাসি, ভালোবাসি।

চলতি হওয়ার স্রোতে অনেক অবহেলা করেছে সুনীলকে! আর না। ফেরার পথে নীলিমাদেবীর মিষ্টি পান নিয়ে যেতেই হবে। আজ ওনার যে বড্ড অভিমান হয়েছে।

দীনানাথের শেষ উইল

কাকভোরে রাজপালের ঘুমটা ভেঙে গেল। কী কারণে সেটা প্রথমে ঠাউর করতে করতে কিছুটা সময় গেল। তারপরেই খেয়াল হল তাকের উপর সযত্নে তুলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙেছে। মালিকের ফোন। মালিক হচ্ছেন বড়ো হাভেলির দেওয়ান সাহেব। আজ তো শনিবার ওর ছুটির দিন। তাহলে সকাল সকাল ফোন, কী ব্যাপার!

চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাজপালের কপালে। আজকের দিনে ওকে দেওয়ান সাহেবের জঙ্গলের দেখাশোনা করতে যেতে হয়। জঙ্গলের পুরো দাযিত্বই রাজপালের ওপর ছেড়ে রেখেছেন মালিক। অত বড়ো হাভেলিতে দেওয়ান সাহেব একাই থাকেন। দু’-দু’বার বিয়ে করেছেন। কোনওটাই স্থায়ী হয়নি।

প্রথম স্ত্রী ছেলের সঙ্গে বিদেশে থাকেন। মালিকের এক ছেলে এক মেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীও আলাদাই থাকেন, তবে যাওয়ার আগে দেওয়ানজির অনেক টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মালিকের বিরাট ব্যাবসা।

হ্যালো, রাজপাল ফোনটা হাতে নিল। দেওয়ানজির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রাজপাল, কাল ঠিক এগারোটার সময় হাভেলি আসতে হবে।

মনে মনে আশ্চর্য হল রাজপাল। মালিক ভালো করেই জানেন, শনি আর রবিবারটা জঙ্গলে কাটিয়ে সোমবার রাজপাল ফেরে। কী আর করা? মালিকের আদেশ অমান্য করা চলবে না। হয়তো মালিকের শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়েছে। বেশ কয়েদিন ধরে ওনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। একা একা থাকা। শুধুমাত্র একজন গুজ্জর মহিলা নুরা মালিকের দেখাশোনা করে।

প্রথম প্রথম নুরা হাভেলির দোতলাটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দাযিত্বে ছিল। কিন্তু ওর কাজ দেখে খুশি হয়ে দীনানাথ পুরো বাড়ির দায়িত্ব ওকে সঁপে দিয়েছিলেন। অত বড়ো হাভেলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে বাবলু, নুরাকে সাহায্য করত আর রাত্রে দীনানাথের কাছে শুত।

দীনানাথের মেয়ে মুম্বইয়ে থাকত। তার দুটি সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে স্বামীর জুতোর ব্যাবসা ছিল যার অবস্থা তখন প্রায় পড়ন্ত। অবশ্য মেয়ে উপাসনার স্বামীর সঙ্গে তখন বনিবনাও ছিল না। উপাসনার মদ্যপানে আসক্তির অভ্যাস স্বামী আনন্দকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র স্ত্রীকে বরদাস্ত করত এই আশায় যে, শ্বশুরের মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তির মালকিন হবে উপাসনা। যেনতেন প্রকারেণ ওই সম্পত্তি স্ত্রীকে ঠকিয়ে কী করে নিজের করা যায়, তারই নানা ফন্দিফিকির মাথায় আনাগোনা করত সবসময়। উপাসনার সঙ্গে ভালোবাসার বিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সম্পর্কটা তিক্ততার দিকে মোড় নিয়েছিল। আনন্দ দেনায় আকণ্ঠ ডুবে ছিল।

দীনানাথের ছেলে অতুল একেবারে নিষ্কর্মা বলতে যা বোঝায় তাই। আজ পর্যন্ত কোনও কাজই ঠিক ভাবে করে উঠতে পারেনি। অতুলেরও এক ছেলে। সবাই বিদেশেই থাকত। অতুলের যত ফুটানি সবই মায়ের টাকায়। কিন্তু মায়ের প্রতি কোনও দায়িত্বই ও পালন করত না। এই নিয়ে নিত্যদিন বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত।

দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই দীনানাথের বনিবনা একেবারেই হতো না। মাঝেমধ্যে কখনও কখনও দেখাসাক্ষাৎ হতো। মা-কে ডিভোর্স করার জন্য উপাসনা বাবাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারেনি। যদিও সে জানত তার মা খুবই ঝগড়ুটে, স্বার্থপর একজন মহিলা। দুই-তিন বছরে একবার ভাইবোন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাও কিছু টাকা আদায় করার ধান্দায়।

নাতি-নাতনিদেরও কোনও খবর দীনানাথের কাছেও ছিল না। উনি কোনও দিন তাদের চোখেই দেখেননি। এই হল দীনানাথের পুরো পরিবারের চিত্র যা আজকের পটভূমিকাতেও অদ্ভুত বলেই সকলে গণ্য করবে।

ঠিক এগারোটায় হাভেলি পৌঁছোতেই রাজপাল দেখল সদরে বহু মানুষ ভিড় করেছে। ঘাবড়ে গেল সে। গাড়ি রাস্তাতেই দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। দেখল পুলিশের কিছু লোক রয়েছে। একটা চৌকির উপর দীনানাথের নিষ্প্রাণ শরীরটা শোয়ানো আছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে নুরা, মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি করেই এমন অবস্থা হয়েছে।

রাজপালকে দেখেই ইন্সপেক্টর রমন এগিয়ে এলেন ওর দিকে, আপনি কি দেওয়ানজি মারা যাওয়ার খবরটা আগেই পেয়েছিলেন?

রাজপাল সংযত হয়ে উত্তর দিল না, ইন্সপেক্টর। আমার জন্য এটা একটা বিরাট শক্। আমাকে তো স্যার নিজেই ফোন করে বলেছিলেন, আজ ঠিক এগারোটায় হাভেলি পেঁছে যেতে।

নুরা আর রাজপালকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ইন্সপেক্টর রমন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে, এটা আত্মহত্যার কেস। শুধুমাত্র এই দুজনই জানত মালিক ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। দুই ছেলে-মেয়ে সম্প্রতি জানতে পেরেছিল, বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে তারা নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, বাবার কাছে আসার কারওরই সময় হয়নি।

ইন্সপেক্টর রমন পকেট থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বার করে রাজপালকে জিজ্ঞেস করলেন, এই খামটা অ্যাডভোকেট লোকেশ বক্সির নামে। আপনি একে চেনেন নাকি?

হ্যাঁ, উনি, দেওয়ানজির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই হাভেলির চার-পাঁচটা বাড়ি পরেই উনি থাকেন।

আপনি কি দেওয়ান সাহেবের ছেলেমেয়ে আর আত্মীয়স্বজনদের খবর পাঠিয়েছেন? রমন রাজপালকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করলেন।

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎই অ্যাডভোকেট বক্সি উদভ্রান্তের মতো ভিতরে প্রবেশ করলেন। একনজর দেখেই ওনার তীক্ষ্ম দৃষ্টি বুঝে ফেলেছিল, বন্ধু আর নেই। ওনার হাতেও একটা বাদামি রঙের খোলা খাম ধরা। ইন্সপেক্টর, মিস্টার বক্সিকে আগে থেকেই চিনতেন। নানা কেসের সুবাদে আদালতে দেখাসাক্ষাৎ হতেই থাকত। দীনানাথ, বক্সি আর রমন তিনজনেই জম্মুর পুরোনো বাসিন্দা।

চিঠি আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, বক্সি সাহেব খামটা ইন্সপেক্টরের হাতে ধরাল। দুটো খামেই চিঠির বর্ণনা হুবহু একই। রমন লক্ষ্য করলেন একই ব্যক্তির লেখা। পরিষ্কার তাতে লেখা আছে, আমি দীনানাথ, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে নিজের জীবন শেষ করছি। আজ চার-পাঁচ বছর হল ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য অসুখে ভুগছি। হয়তো আর বেশীদিন বাঁচব না। এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কাছে যারা কাজ করে তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত। সুতরাং তাদেরও আমি আর কষ্ট দিতে চাই না। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তে পেঁছেছি।

আমার মৃত্যুর পর আমার গোটা সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ অর্থাৎ এই বাড়ি, আমার গ্রামের আমবাগান আর নগদ ধনরাশিরও অর্ধেক ভাগ নুরা পাবে। রাজপাল যে-কিনা কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, সে আমার কুদ-এর জমি বাড়ি সব পাবে। এছাড়া আমার নগদ অর্থের কুড়ি শতাংশ ওকে যেন দেওয়া হয়।

বাকি যা অর্থ পরে থাকবে তা আমি আমার বাড়ির পাশের মন্দিরের ট্রাস্ট-কে দিয়ে যাচ্ছি। বাকি যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে খালি ব্যবহার করে গেছে, তাদের জন্য আমার কাছে দেওয়ার কিছুই নেই। বেঁচে থাকতে আমি যা কষ্ট পেয়েছি, আমি চাই ওরাও এই কষ্ট ভোগ করুক। যদি এর থেকে ওরা কোনও শিক্ষা নিতে পারে।

আমার কাজ ধুমধাম করে করার কোনও দরকার নেই। যে-মন্দিরে আমি প্রতি মঙ্গল আর রবিবার যেতাম সেখানেই যেন আমার শ্রাদ্ধশান্তি সম্পন্ন করা হয়। আর লোকেশ, তোমার দাযিত্ব হচ্ছে আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করা। আর নুরা আর রাজপাল যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা দেখা। নয়তো মৃত্যুর পরেও আমি শান্তি পাব না।

রমনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতেই বক্সি বললেন, হাতে লেখা উইল কোনও কোর্ট অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সবথেকে আশ্চর‌্যের বিষয় হল দীনানাথ নিজের সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে গেলেন না।

ইন্সপেক্টর রমন বললেন, বাচ্চারা তো এই উইল-টাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে।

হ্যাঁ পারে, কিন্তু সেটা খুবই দীর্ঘ প্রসেস। কত বছর যে লাগবে কিছুই বলা যায় না, তার উপর আলাদা করে খরচও আছে।

আপনি তো দীনানাথের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি নিশ্চই সব জানেন? প্রশ্ন করেন রমন।

হ্যাঁ, জানি তো সব। রোজ সন্ধেবেলায় দেখা করতে যেতাম। রবিবারও বাদ যেত না। তবে দুই বছরের বেশি হল, ওর শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে। খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও মনের কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল, উত্তর দেন বক্সি।

আপনি নুরা সম্পর্কে কী জানেন?

বক্সি আর রমন কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে এসেছিলেন। বাড়িতে লোকজন আসতে আরম্ভ করছিল। সন্ধের মধ্যে

দাহ-সংস্কার করার কথা ঠিক করা হয়েছিল কারণ ছেলে-মেয়ে দূর থেকে আসতে সময় লাগবে।

নুরা প্রায় দশ বছর ধরে দীনানাথের কাছে কাজ করছে। নুরার বাবা ও তার গোটা পরিবারকে দীনানাথ চিনতেন। প্রথম প্রথম নুরা ঘরদোর পরিষ্কার করে বাড়ি চলে যেত। কিন্তু যখন থেকে দীনানাথ অসুস্থ হলেন, নুরা সারা বাড়ির দাযিত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। শেষ দুবছর তো ও-ই প্রায় সব কাজ করত। ওদের বাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ। মদ খেয়ে খেয়ে স্বামীটা মরে গেছে, ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তবে মেযো ভালো। মেযো নার্সিং পড়া সবে শেষ করেছে, বক্সিবাবু জানালেন রমনকে।

নুরার মেয়ে এখন কোথায়? রমন আগ্রহ প্রকাশ করল।

লুধিয়ানায় চাকরি করছে। নুরার বুড়ি মা নাতনির সঙ্গে থাকে।

দাহ-সংস্কার হয়ে যাওয়ার পর উইলের দুটো কপি বানানো হল। একটা রমন নিজে রাখল, অন্য অরিজিনাল কপিটা বক্সির কাছে থাকল। ঠিক করা হল, দীনানাথের সন্তানরা এলে ওনার পারিবারিক উকিল হিসেবে বক্সিবাবু ছেলে-মেয়েে উইল-এর বিষয়ে জানাবে।

মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা ও তার স্বামী আনন্দ রাতেই পেঁছে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল দাদা অতুলের পৌঁছোনোর। সে-ও দুদিন বাদেই বিদেশ থেকে এসে পৌঁছোল।

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা অনুশোচনার আগুনে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছিল। সারা জীবন মায়ের কথা শুনে এসেছে। বাবার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ শুনতে শুনতে বাবার প্রতি ঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল উপসনার। কিন্তু আজ বাবা না থাকাতে মনের মধ্যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।

আনন্দর এই পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছিল। ওর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, টাকা আত্মসাৎ করার। ওল্ড ম্যান-এর মৃত্যুতে ওর কোনওরকম আপশোশ ছিল না।

বাবার মৃত্যুতে অতুলের মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। বারবার শেষবারের আসার কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথমবার দীনানাথ ওর সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বাবা-ছেলের মধ্যে মতের মিল ছিল কোথায়, যে দুজনে কোনও বিষয় নিয়ে বসে আলোচনা করবে এবং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে!

অত দূর কানাডা থেকে এসে মাত্র পাঁচদিন থেকেই অতুল ফিরে গিয়েছিল। বাবার মৃতু্য়র পর বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, চলো একটা অধ্যায় তো শেষ হল। এখন বাবা তার জন্য যে-সম্পত্তি, টাকাপয়সা রেখে গেছেন তাই দিয়ে সে নতুন করে নিজের ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে।

নুরা অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। হাভেলির প্রত্যেকটা ঘর পরিষ্কার করে সকলের থাকার ভালো ভাবে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

দীনানাথের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হলে অতুল আর উপাসনা মিলে ঠিক করল, এবার নুরা আর রাজপালকে ওদের দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়ার সময় হয়েছে। এদের বদলে নতুন লোক রাখা হবে বাড়ির কাজের আর রান্নাবান্না করার জন্য। রাজপালের জায়গায় একজন স্মার্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখা দরকার, যে-কিনা ব্যাবসা থেকে শুরু করে জঙ্গলের সব কাজকর্ম একাই সামলাতে পারবে। অতুল জানাল, এখন থেকে সে মাঝেমাঝেই দেশে আসবে সবকিছু দেখাশোনা করার জন্য।

ভাইবোনের আলোচনার মাঝেই ইন্সপেক্টর রমন এবং বক্সি সাহেব হাভেলি এসে পৌঁছোলেন। ওনাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল অতুল আর উপাসনা। কারণ তারা জানত আজ বাবার উইল পড়া হবে। নুরাকে অতিথিদের জন্য চা আনতে বলে দুজনে এসে বসল।

অতুল, অ্যাডভোকেট বক্সিকে লক্ষ্য করে বলল, আংকেল, আমি ভাবছি এবার বাড়ির হাল নিজের হাতে ধরব। বাবার পর আমারই দাযিত্ব সবকিছু দেখাশোনা করার। আমরা ঠিক করেছি নুরা আর রাজপালকে আর রাখব না। এমনিতেও ওদের দু’জনকে আমরা কেউ পছন্দ করি না। নুরাকে দেখলে তো মনে হয়, ওই এ বাড়ির মালকিন।

রমন আর বক্সির চোখাচোখি হল, যেন ওরা বলতে চাইছে, এরা বেচারারা কী করে জানবে, যে কী হতে চলেছে ওদের সঙ্গে।

আংকেল আপনি কিছু বলবেন না এই ব্যাপারে? উপাসনা জিজ্ঞেস করল।

উত্তর দিল রমন, তোমাদের যা বলা হচ্ছে মন দিয়ে শোনো। তোমার বাবার লেখা চিঠি যেটা ওনার কাছ থেকে পাওয়া গেছে, সেটা পড়ে তোমাদের শোনানো হচ্ছে এখন।

বাবার এত বড়ো সম্পত্তি পেতে চলেছে এই ভেবে উপাসনা আর অতুল মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও, চোখেমুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে রেখে দু’জনেই সাগ্রহে রমনের দিকে তাকাল।

রমন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দীনানাথের পত্রটা পড়ে দুই ভাইবোনের দিকে তাকাল।

কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। ওদের দুজনের মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ওরা রীতিমতো শকড। এমনটা কেউ আশা করেনি।

এ কী করে সম্ভব? উপাসনাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

আমরা দুজন ওনার সন্তান। নুরা, রাজপাল ওনার কে? কোথা থেকে ওরা এসেছে কেউ জানে না। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল কোথাও একটা রহস্য আছে…। নুরাটা এক নম্বরের চরিত্রহীন, বাবাকে ফাঁসিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

সেই মুহূর্তে উপাসনার স্বামী আনন্দ ঘরে ঢুকে ওদের কথাবার্তায় যোগ দিল। উপসনার কথা শেষ হতেই বলে উঠল, আমার তো প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল, বাড়িতে যেভাবে গৃহকত্রী হয়ে ঘুরে বেড়াত, তাতে যে কেউই ভাবতে পারে বাড়িটা ওরই।

অতুল কোনও কথাই বলতে পারল না। রাগে ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। দীনানাথ কোনও দিন বাবা হিসেবে কোনও কর্তব্য পালন করেননি। শুধু খরচ দিয়ে গেছেন। কখনও ওর স্কুলে যাননি। স্পোর্টস-এ এত ভালো ছিল অতুল কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোনও দিন একটা বাহবাও ওর কপালে জোটেনি। মায়ে সঙ্গেও দীনানাথ মানিয়ে নিতে পারেননি এবং বহু অর্থ নিয়ে তবেই দীনানাথের থেকে আলাদা হয়েছিলেন মা ঠিকই কিন্তু তাতে অতুলের দোষটা কোথায় ছিল! অতুল তো দীনানাথের নিজের সন্তান। তাহলে বাবা হয়ে সন্তানের এত বড়ো সর্বনাশ কী করে করতে পারলেন, অতুল কিছুতেই সেটা ভেবে পেল না।

নুরা নুরা উপাসনা গলার জোর বাড়াল।

জি বিবিজি, নুরা মুহূর্তে সামনে এসে হাজির হল।

নুরা, এসব কী শুনছি! তুই জানতিস বাবা এত সম্পত্তি তোর নামে করে গেছেন? জানতিস তো নিশ্চয়ই নয়তো কোনও সম্পর্ক ছাড়াই দিনরাত কেন এখানে পড়ে থাকতিস? তিক্ততা ফুটে ওঠে উপাসনার গলায়।

না বিবিজি, আমি কিছুই জানতাম না, চোখে জল ভরে যায় নুরার।

আপনি এসব কী বলছেন? আমি তো এখনই আপনার মুখ থেকে শুনছি। আমি তো স্বপ্নেও এসব ভাবতে পারি না।

নুরা, তুমি যাও নিজের কাজ করো, অ্যাডভোকেট বক্সি এতক্ষণে মুখ খুললেন।

এটা কী করে সম্ভব আংকেল। আমি তো রাজপাল আর নুরাকে ছাড়ব না। এটা এদের বাপের সম্পত্তি নয় যে, এগুলো নিয়ে নেবে। প্রযোজনে আদালতে যাব, ওখানেই মীমাংসা হবে। রাগের মাথায় বলে ওঠে আনন্দ। শুনে সকলের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বক্সি উত্তরে বলেন, হাতে লেখা উইলকে চ্যালেঞ্জ করাটা খুবই ঝুঁকির কাজ। বছর গড়িয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর কী হবে হয়তো কোনও জজ সাহেব হাতের লেখার পরীক্ষা করাতে পাঠাবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত দুটো চিঠিই দীনানাথ নিজের হাতেই লিখেছেন।

কিন্তু এদের কেন? আমরা কেন নই? এতক্ষণে অতুল কথা বলে।

ইন্সপেক্টর রমন এবার বলেন, এটা তো নিজের নিজের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। ওনার একাকিত্বটা একটু ভাবার চেষ্টা করো যেটার মধ্যে দিয়ে ওনাকে একাই যেতে হয়েছে। তার উপর ক্যান্সারের মতো রোগ, তোমরা তো কেউ খোঁজও রাখোনি। এই দুজনই তোমাদের বাবার সেবা করেছে।

শেষের এক দেড় বছর তো অসম্ভব মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। কখনও খুশি তো কখনও ডিপ্রেশনের শিকার হত। আমি ওর এই মুড সুইং দেখেছি আর এও দেখেছি নুরার কি অসীম ধৈর‌্য আর সহনশীলতা। নিজের কাজ নিয়ে থাকত ও। অত্যন্ত প্রভুভক্ত এবং বিশ্বাসী। শেষের বেশ কিছুদিন দীনানাথ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে কাপড়চোপড় বদলানো, পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়া সব নুরাই সামলাত। অ্যাডভোকেট বক্সি বললেন।

ইন্সপেক্টর রমনের আর কিছু করার ছিল না। উনি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মনে মনে জানতেনই নতুন কিছু ঘটলে, সেটা বক্সি সাহেবের কাছেই জানতে পেরে যাবেন।

রমন চলে যেতেই বক্সি বললেন, তোমরা জানতে চাও, এরকম কেন করেছে দীনানাথ। আমি জানি এটার সম্পর্ক তোমাদের পরিবারের সঙ্গে। সেজন্য রমনের সামনে আমি কিছু বলতে চাইছিলাম না।

শ্লেষ মিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে উঠল আনন্দের ঠোঁটে, কী এমন কথা আছে যে বাড়ির লোকেরা কিছু জানে না অথচ আপনি জানেন? আবার নুরার সাপোর্টে নতুন গল্প নয় তো?

ভদ্র ভাবে কথা বলো। তুমি এ বাড়ির জামাই। তাই তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার মাথার সাদা চুলের সম্মানটুকু করো। বক্সি রাগত স্বরে আনন্দকে বললেন।

অতুল বলে উঠল, আংকেল আপনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

বক্সি বলতে আরম্ভ করলেন, তোমরা সকলেই আশ্চর‌্য হয়ে গেছ, দীনানাথ কেন এরকম করল এই ভেবে! ১৯৪৬-৪৭ সালের কথা হবে। তোমাদের ঠাকুরদা নতুন নতুন ব্যাবসা আরম্ভ করেছেন। ব্যাবসা বাড়াবার জন্য তিনি কুদ-এ বেশ কিছু জমি নিয়ে রেখেছিলেন। ওখানে ওনার ছোটো একটা বাড়ি ছিল। সেখানে পাশেই এক গুজ্জর পরিবার থাকত। ওদের অনেক জমিজমা ছিল।

অশিক্ষিত গুজ্জরের কাছে অত জমি দেখে তোমাদের ঠাকুরদার মনে লোভ জন্ম নেয়। উনি সেগুলো হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। যখন কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেন না, তখন একদিন রাতের অন্ধকারে ওদেরকে মেরে ফেলা হয়, সেটা তোমাদের বাবা দেখে ফেলে। ওর বয়স তখন মাত্র সাত। গুজ্জরের বউ একমাত্র মেয়ে নুরাকে নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে জম্মু চলে আসে। নুরা তখন খুব ছোটো।

কিন্তু বাবা ওদেরকে কী করে খুঁজে পেল? উপাসনা জানতে চাইল।

আমি এটুকুই জানি, দীনানাথ ওদেরকে অনেক খুঁজেছিল, হয়তো পরিচিত কাউকে একাজে বহাল করেছিল। নুরা যখন এই বাড়িতে কাজে লেগেছে তখন হয়তো দীনানাথ ওদের ঠিকানাও খুঁজে বার করে ফেলেছে। হ্যাঁ, তবে নুরাকে ও কখনও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ সবসময় কাজ করত ওর। হয়তো সেই থেকেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীনানাথ।

তোমাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা

না-হওয়া, দীনানাথের দুরারোগ্য ব্যাধি এই সবই হয়তো ওকে নতুন করে চিন্তা করতে প্ররোচিত করেছে। রক্তের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসা দিয়ে যখন দীনানাথ ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করত, তখন নুরাই ওর দেখাশোনা করত, ওষুধ এগিয়ে দিত।

আনন্দ বলে ওঠে, তবুও নিজের সন্তানের জায়গা কেউ নিতে পারে না। সে কাছেই থাকুক বা দূরেই থাকুক।

উপাসনা আর অতুল একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা এর বিরুদ্ধে কোর্টে অ্যাপিল করব।

বক্সি সাহেব মৃদু হেসে বললেন, অতুল তোমাকে কানাডা থেকে বারবার আসা-যাওয়া করতে হবে। উপাসনা তুমিও ভেবে দেখ এটা কিন্তু সহজ নয়. বেশ কিছু বছর হয়তো লেগে যেতে পারে। কিন্তু হাতে লেখা উইল কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

এমন একটা মিছিল হোক…

তিতলি শেষমেশ তুই…! আমি ভাবতে পারছি না। কেন…? কেন এসব? তিস্তার কথাগুলো অনেকটা আর্তনাদের মতোন শোনাচ্ছিল।

সিরিয়াসলি আমিও ভাবিনি বউদি। তুমি এতটা রিঅ্যাক্ট করবে। নিজের মনের ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রেখে লোকজন যে ঘরে ঘরে ক্রাইম করছে তার থেকে এটা হাজার গুন বেটার। আমি যা করি সামনাসামনি। বুঝলে? আমার কোনও কিছুই যেমন লোকদেখানো নয়, তেমন কোনও কিছুই আড়াল নয়। আমি যা, আমি তাই-ই। প্লিজ তোমাকে একটাই রিকোয়েসট তুমি কথাটা বাবা-মার কানে তুলো না। সবার প্রশ্নের গাদা গাদা উত্তর দিতে দিতে সত্যি সত্যিই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি জানো! মুখ ঘুরিয়ে বলে যাচ্ছিল তিতলি।

ওর হাতে তখনও ধরা ছিল আধপোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ছাদের ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে তিতলি সিগারেট টানছিল। আর ঠাকুরঘরে সন্ধে দিতে এসেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে তিস্তার।

ল্যাম্পপোস্ট আর ছাদের ঠাকুরঘর থেকে যে-হলুদ টিমটিমে আলোর রেখাগুলো ত্যারছা ভাবে পড়ছিল দেয়ালের অন্ধকার কোণায়, তাতে ধোঁয়া, আলো, অন্ধকার মেশামেশি করে একটা আলতো জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার নিচ্ছিল।

প্রশ্ন চিহ্ন তো বটেই। তিতলি আজ এতটা ফেরোশাস হয়ে উঠেছে ভাবতে তখনও কোথায় একটা বাধছিল তিস্তার। এমনটা কী সত্যি হবার ছিল? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।

মনে হচ্ছিল এইতো সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম মজুমদার বাড়িতে পা রেখেছিল তিস্তা। ওদের প্রেমের বিয়ে ঠিকই কিন্তু বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি আসা, আর বিয়ের পরে প্রথমবার সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে বউ হিসেবে মেলে ধরার দিনটার মধ্যে যে কতটা ফারাক, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তিস্তা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিয়ের পাত্রী হিসেবে তিস্তার সাতাশ বছর এমন কিছু ছোটো নয়। অনেকে তো এই বয়সে প্রথম মা-ই হয়ে যায়। সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়লে আজও একটা চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধে বুকের ভীতু তুলতুলে জায়গাটায়।

চৌকাঠে পা দিতে না দিতেই বরেরবাড়ি সমেত গোটা পাড়া অন্ধকার হয়ে গেছিল; হুলুস্থুল কাণ্ড। অপয়া অপবাদের অদৃশ্য খাঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়কের খুড়তুতো, পিসতুতো সবকটা বোন ওই অন্ধকারেই যারপরনাই টাকাপয়সার ক্লেম করতে শুরু করে দিয়েছিল। গুরুজনদের বাঁকা চোখে নতুন বউয়ের দিকে তাকানো আর বোনদের ঠিকঠাক টাকা না পাওয়ায় মন কষাকষির তেমনই একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে তিস্তার চোখের জল মুছিয়েছিল তিতলি। ঠিক যেন ছোট্ট একটা প্রজাপতিই বটে; কত বয়স হবে তখন ওর। এই তেরো-চোদ্দো বছর। দিব্যি হেসেখেলে গল্প করে মন ভুলিয়ে দিয়েছিল তিস্তার। মামাতো একমাত্র বোন হলেও সায়কের বাকি বোনেদের সঙ্গে জোট বেঁধে দাদার পকেট কাটার দিকে যায়নি সে। বরং বউদির দুঃখু দুঃখু মুখ দেখে হাসিমুখে ম্যানেজ করেছিল সবটা।

পাড়াপড়শির, ঘরের লোকের কথার খোঁচা, এমনকী সায়কের সামান্য বেসরকারি অফিসে চাকরি জানা সত্ত্বেও বাকি বোনেদের জোরাজুরিকে বিরক্তির চোখেই দেখেছিল ছোট্ট ননদ তিতলি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই ননদকে দিনে দিনে নিজের বোন বলেই মনে হয়েছিল তিস্তার। একটু একটু করে হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজবে জেনেও ছিল তিতলি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরি করতে চায়। পড়তে চায় ওর প্রিয় বউদির মতো সাহিত্য নিয়ে। মিষ্টি একটা ভালোলাগা ডানা ঝাপটে উঠেছিল তিস্তার বুকের মধ্যেও। মন বলেছিল, কেউ তো এখনও আছে, যে অন্তত বাংলা বিষয় নিয়ে পড়াকে কোনও উপায় নেই তাই পড়ছে, এমনটা মনে করে না।

কী গো তুমি এখনও ছাদে? করছটা কী? কখন থেকে পিসাই এসে বসে। তোমার হাতের চা চাইছে। সায়কের গলায় চমকে উঠে তিস্তা সিঁড়ির দরজার কাছে সরে গেছিল। না দেখলেও বুঝতে পারছিল ছাদের কার্নিশ টপকে একটা হলুদ আগুন পাশের জঙ্গুলে জমিটায় ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

যাচ্ছি যাচ্ছি। তুমি হঠাৎ ওপরে উঠে এলে কেন? আমি নামছি।

তিতলি কোথায়? ছাদে না? একটা হরর মুভি ডাউনলোড করেছি। কখন থেকে একসঙ্গে দেখব ভাবছি। ম্যাডামের দেখাই নেই।

তিতলি তাড়াতাড়ি নীচে আয়। মুভি দেখবি। বলে তিস্তা প্রায় জোর করেই সায়ককে নিয়ে নীচে একতলায় চলে আসে। বলা যায় না যা রাগ সায়কের। একেই কলকাতায় ওই দলবাজির কলেজটা দুচক্ষে দেখতে পারে না সায়ক। তার ওপর তার নিজের বোন এসব নেশা করছে বিন্দুমাত্র জানতে পারলে, হয়তো সারাজীবনের জন্যই কথা বন্ধ করে দেবে তিতলির সঙ্গে। জানে সব রাগটা গিয়ে পড়বে তিতলির ওপর। কারণ নিজের বাড়ি শক্তিনগরের মতো মফস্সলে রীতিমতো ভালো গভর্নমেন্ট কলেজে চান্স পেয়ে, তিতলি একটা বছর নষ্ট করে অনেকটা নিজের জেদেই কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছে। এখানে নিজের পিসির বাড়ি থাকলেও রয়েছে কলেজেরই কাছাকাছি কোনও একটা মেস-এ। তাছাড়া রয়েছে আরও নানা কারণ।

চোখে আঙুল দিয়ে যেটা দেখা যায় সেটা হল তিতলির স্বাধীনতা। তার অবাধ বাঁধনছাড়া অগ্রাহ্য করার একটা ইমম্যাচিওর মন।

 

তোর দাদা কিন্তু গন্ধটা পেয়েছে তিতলি। এখানে এলে…।

সেটাই করতে হবে। এখানে আসাটাই বন্ধ করে দিতে হবে।

আমি কি তাই বলেছি তিতলি? তোর দাদা কিছু একটা আন্দাজ করেছে, মানুষটাকে তো আমি চিনি। আমাকে কী বলছিল জানিস রাতে? বলছিল, ঠিক মনে পড়ছে না দাদু মারা যাওয়ার আগে তিতলিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিল জানো? কিছু না হলেও কবিতার শেষ একটা লাইন আজও মনে আছে আমার, জানলা দিয়ে তিতলিটা ওই খিলখিলিয়ে হাসে। আর ডায়ারির পাতা থেকে সেটাকে বেছেই সবাই ওর এই নাম দিয়েছিল।

উফ্ বউদি তুমি না সাংঘাতিক সেন্টু দাও। সত্যি এত ইমোশন রাখো কোথায়? আমি যতদূর জানি পিছন ফিরলেই সবাই তোমার সেন্টুর গাঁ…। উপ্স সরি সরি…। চোখ মুটকে তিস্তার সামনে ছদ্ম লজ্জার অভিনয় করে তিতলি।

এসব ছাড়। যেটা বলব বলব করেও তোকে বলা হচ্ছিল না, শক্তিনগর থাকতে ওই যে ছেলেটা কী নাম যেন…।

বিতান…।

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা করিস এখন? কথা হয়?

অত ঘুরিয়ে বলার কী আছে? পোঁদে লাথ মেরেছি। বড্ড ঘ্যানঘ্যান করত। একটু কাছাকাছি ছিলাম বলেই ওর সম্পত্তি আমি? তা তো নয়। তাছাড়া কলকাতায় এসে পড়াটা, চাকরি করাটা, আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যেখানে আমার বাবা-মা সায় দিয়েছে সেখানে এলিতেলি হায়দার আলি, ও কে…?

কিন্তু তুই যে তখন বলেছিলিস ও তোকে…।

চু চু চু মুখ দিয়ে আওয়াজ করে তিতলি। তুমিও না বউদি…। সবাইকেই নিজের মতো ইমোশনের ফুল ট্যাংকার ভাবো। ছাড়ো তো। শোনো তবে কেউ পার করে দেবে না আমায়,

সময় আছে এখনও

চলো নতুন করে কাঁটাঝোপে পা ফেলি একবার…।

কবিতার লাইন বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা সিগারেটের প্যাকেট পকেটে পুরে তিতলি মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়!

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তিস্তা। একদম… একদম পালটে গেছে তিতলি। ওর ইনোসেন্সগুলো কোথায় যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। তিতলির এখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই বাংলা সেই সাহিত্য ভালোবেসে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখা মেযেরা এখন নাকি কলেজের ছাত্র সংগঠনের মিছিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। মিছিলে হাঁটছে। অনশন করছে।

রাজনীতি কী? রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? জানে না তিস্তা। সত্যি কথা বলতে কী জানতেও চায় না। তবে এটা জানে রাজনীতির রং দলভেদে পালটায় না; রাজনীতির একটাই রং স্বার্থ।

কেন জানে না আপনা আপনি মনটায় একটা খারাপ লাগার বুড়বুড়ি কাটছিল।

নিজের বোনের মতো ওর মাথায় হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করছিল, এই স্বার্থপর সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে তিতলির একটা পরিচয় হোক। আর কিছু না।

 

খবরটা এত তাড়াতাড়ি এভাবে আসবে ভাবতেই পারেনি তিস্তা। তখনই ওলা বুক করে ছুটে গেছিল মামা শ্বশুরের বাড়িতে। সারাজীবনের সেই চরম অপবাদ অপয়া মাথায় করে নিয়ে নেহাত নির্লজ্জের মতো উস্কোখুস্কো চুলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিতলিদের বাড়িতে। নাহ্ কেউ কোনও আপ্যায়ন করেনি। সেটা যে তার প্রাপ্য হবে না, সেটাও জানত। কারণ শ্বশুরবাড়ির প্রথম দিনে সে পা রাখতেই আলো নেভা, সায়কের হাজার একটা পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও, সরকারি চাকরি না পাওয়া আর শেষমেশ তিতলির…।

প্লিজ প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও। একদম ভালো লাগছে না।

কিন্তু তিতলি…।

তোমাদের কোনও ঝামেলা হবে না বলছি তো! আমি তো সবটা মিটিয়ে এসেছি।

তোর শরীরটা …।

আমার শরীর ঠিক আছে বউদি। এত কষ্ট পেও না। আমি ঠিকই আছি। আজ নতুন কিছু না। আমরা প্রায়ই মেলামেশা করতাম। কোনও কিছুই জোর করে হয়নি।

তিতলি তোর এখন সবে ২৪, আর এই বয়সে বাচ্চা নষ্ট?

আচ্ছা বউদি এটা ধরে নিতে বাধা কোথায়? আমি ছেলেতেও খুশি নই, মেয়েতেও নই, আর যদি বা হিজড়া হতো তাকে সমাজছাড়া করার আগেই সাহস দেখিয়ে তড়িঘড়ি শরীর থেকেই খসিয়ে দিলাম। হ্যাঁ তোমরা অবশ্য এর নাম নষ্টা, বেশ্যা দিতেই পার। তোমরা বড়ো। এসবের লাইসেন্স তোমাদের আছে।

তবে আমি কিনা একটু অন্য ধাঁচের, এসব গায়ে মাখি না। আবার তোমার মতো লুকিয়ে কাঁদবও না। বরং সমাজের পাঁক থেকে তুলে আনব পদ্মফুল। সেই সময় এসে গেছে বউদি। সবার যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালটা উত্তর তো দিতেই হবে। তাই না?

তুই ওই ছেলেটাকে বিয়ে করবি? ওর বাড়ি রাজি হবে তো? তোরা যে…।

হাসালে বউদি। এমন খান্ডারনি মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না। আর আমিও চাই না। এগারো মিনিটের সুখের জন্য বিয়ে করতে লাগে না। তারপর ভালো না লাগলেই কোর্ট কাছারি হ্যানা-ত্যানা। ধুত্তোরি…।

কিন্তু মামা যে বলছিল…?

ওসব ভাটের কথা। সেদিন ক্লিনিক থেকে ফিরে একটু টান্টু খেয়ে কীসব বকেছিলাম বলে ভয় পেয়ে তোমাদের জানাল। আর তুমিও… মাইরি পারও বটে…! পরশু দুপুরে আমাদের ব্রিগেডে একটা মিটিং…

তিতলি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। কিছু কথা কানে আসছিল, কিছু আসছিল না।

তিস্তা দেখছিল শেষ বিকেলের রোদ মাখা কমলা আলোটা পর্দার পাশ দিয়ে তিতলির মুখ, বুক, চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর সদ্য মা হওয়ার অস্বীকার করা অস্তিত্বকে। তিতলির স্বপ্ন অন্য রকম। অন্য রঙের। সেই স্বপ্নের রং তিস্তা চেনে না, সেই পথের বাঁকেও কোনও দিন আটকা পড়েনি সে।

তবু দিনশেষে সায়কের কাছে ফিরে যেতে যেতে ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, সমাজের যে-অন্ধকারকে আলোর পরিচয় দিতে আজ তিতলি বা তার সমবয়সিরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, গলা ফাটাচ্ছে, পুলিশের লাঠি না মেনে দিনে দিনে আরও আরও বেশি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, পাঁক ঘেঁটে গল্প খুঁজে পত্রিকা সাজাচ্ছে তারা নিজেরাও কি সেই একই অন্ধকারের দোষে দোষী নয়? নাহলে তিতলির শরীরে ছোট্ট একটা ভ্রূণকে এভাবে দুহাতে অগ্রাহ্য করার…। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। আচ্ছা, চলে আসবার সময় তিতলির চোখের কোলটা কেমন যেন চিকচিকিয়ে উঠেছিল কি! নাকি সবটাই মনের ভুল…?

ওলা ক্যাবটা তিস্তার বাড়ির পথ ধরেছে। দমকা একটা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা। ঝড় উঠবে…। অন্ধকার করে এসেছে। একটা ভোঁতা শব্দ হতেই পাশ ফিরে তাকায় তিস্তা। বাইরে থেকে মথ বা প্রজাপতি জাতীয় কিছু ওলার জানলার গায়ে ক্রমাগত ফরফর করে আঘাত করছে। ও কি ভেতরে ঢুকতে চাইছে?

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। তিস্তা গাড়ির হাতল ঘুরিয়ে কাচটা নামাতে চায়। পারে না, লকটা খুব শক্ত।

কালোমেঘ চিরে শেষবারের মতো একফালি আলো আছড়ে পড়ছে শহরের রাস্তায়। নাহ্ সে আলোর কোনও রং নেই। তিস্তার মন বলছে, এ শহরের বুকে একদিন ঠিক, একদিন এমন একটা মিছিল হবে যে-মিছিলের নির্দিষ্ট কোনও রং থাকবে না, থাকবে না নির্দিষ্ট মত, মতাদর্শ। সব রং তখন মিলেমিশে যাবে। মিলেমিশে যাবে কেবল একটা… একটা মিছিলে। হাজার মানুষের সে মিছিলে একটাই জয়গান হবে। জয়গান হবে মানবতার।

 

দূরত্ব

পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু ‘পূর্ণিমা, পূর্ণিমা’। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। ‘দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

‘আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত।’ পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে।’ বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন ‘কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর ক’দিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে, পেনশনের মোটা টাকা– তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?’

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন ‘এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক।’ পূর্ণিমা চমকে উঠলেন ‘কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দু’দিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে। আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।’ ‘ব্যস– চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না।’ পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

short story
Bengali story Durotwo

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, তারা চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’কামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রী-র অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায়রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে ঞ্জবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন ‘টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর’, সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন। গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, ‘বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা’র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন ‘কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ?’ পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য।’ অবাক পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! কি হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা– টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘দাদা চুপ কর।’

‘চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?’

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো।’ পিকলু মাথা হেঁট করে পাউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।’ পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, ‘আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।’

‘মা, বাবার আজকাল কী হয়েছে?’ পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। ‘জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন ‘পূর্ণিমা, আর টাকাপয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের,’ বলে শুয়ে পড়লেন।

‘কি! আমরা বাবার টাকা নেব? ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সঙ্গে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না’, পাপু উঠে চলে গেল। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর– সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগি মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।’

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়েও হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো।’ পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, ‘কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে,’ পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, ‘বেশি আয়োজন কোরো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে।’ মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তাঁর ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। আপনি টাকা-পয়সার কথা কী যেন বলছিলেন?’ প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’ ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘কী ভেবেছ তুমি, এ ভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!’

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা কোরো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বলল ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাডাতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ঞ্জকজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ ভোরবেলায় মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দু’চোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে

নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

বাবা

কী যেন নাম বললে তোমার বাবার? ইন্দ্রনাথ মুখার্জী? স্মিত হেসে মাথা নাড়াল পত্রালি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবা মুখোপাধ্যায় লিখতেন।

ভদ্রলোক দ্রুত হাতে স্টেপল করা কাগজগুলো উলটে যাচ্ছেন। প্রায় না দেখেই খসখস খসখস করে সই করছেন প্রত্যেকটায়। দুটো ভুরুর মধ্যিখানে গভীর ভাঁজ। মনক্ষুণ্ণ হচ্ছিল পত্রালির। তার মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কশিট, অত অত নম্বর একবারও চোখ পেতে দেখছেন না এই জ্ঞানী ব্যক্তি! জীবনের প্রথম দুটো বড়ো পরীক্ষায় এলাকা এবং স্কুলের নাম খবরের কাগজে তুলেছিল পত্রালি। একটি স্থানীয় চ্যানেল তাকে নিয়ে খবরও করেছিল। লাজুক মুখে বাইট দিয়েছিলেন পত্রালির মা। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া জড়িয়ে হাসি মুখে তার বাবা বলেছিলেন, আমার মেয়ে সত্যিই আমার গর্ব! আমি নিজে শিক্ষক কিন্তু ওকে আর কতটুকু সময় পড়িয়েছি আমি?

যাক, এখন অবশ্য সবই অতীত। এইসব রেজাল্ট দেখে যদি কেউ সত্যি সত্যিই একটা চাকরি দিত পত্রালিকে! প্রতিবার চাকরির পরীক্ষায় বসার আগে এই এক ফর্মালিটি! গেজেটেড অফিসারের সই চাই। আগে দুতিনবার সুকুমারকাকুই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো তিনি না ফেরার দেশে। অগত্যা স্টেশন রোডের এই আদিত্য সাহার অ্যাপযে্টমেন্ট নিতে হয়েছে পত্রালিকে। পত্রালি এনাকে চিনত না। ভাগ্যিস তৃপ্তি যোগাযোগটা করিয়ে দিয়েছিল!

সই শেষ করে আদিত্যবাবু কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের উলটো প্রান্তে ঠেলে দিলেন। নাও, তোমার কাজ শেষ। এইবার আমি অফিসের জন্য তৈরি হই।

হাতজোড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পত্রালি বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। সকাল সকাল আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। মাফ করবেন।

আদিত্য সাহার বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রঙ্গন, জবা, নয়নতারা আরও কিছু নাম না-জানা ফুলের গাছ রয়েছে। মূল দরজা থেকে বেরিয়ে বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে একটা ফুটফুটে ছোট্ট ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেল পত্রালি।

আহা রে! দেখি দেখি, তোমার লাগেনি তো বাবু?

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে ঘরের দিকে দৌড় দিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে আদিত্যবাবুর ডাক শুনতে পেল পত্রালি। এই যে শুনছ, একটু দাঁড়াও তো।

বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। চোখদুটো ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মানে প্রভাতসখা হাইস্কুলের শিক্ষক, সাড়ে তিন বছর আগে যাঁর নামে মিটু অভিযোগ উঠেছিল?

মুহূর্তেই পত্রালির মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। মনে হল তার পায়ে নীচের মাটি দুলছে। চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবী এখন আবছা। দুটো কান তরল লাভার মতো তেতে উঠেছে। যে-কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পেটের ভেতর কী যেন পাক খাচ্ছে সরীসৃপের মতো। জ্ঞান হারাতে হারাতেও মায়ে মুখটা মনে করে, আদিত্যবাবুর বাড়ির কারুকাজ করা লোহার গেটটা ধরে নিজেকে সামলে নিল পত্রালি। শান্ত আর নির্লিপ্ত সুরে বলল, হ্যাঁ, একটা সাজানো অভিযোগ।

বিশ্বাস করো কাকিমা, আমি এক বর্ণ মিথ্যে বলছি না। তুমি যখন মামকে নিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতে যেতে, স্যার আমাকে…! একদিন নয়, দুদিন নয়, চার-পাঁচবার এই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছি আমি। তাও স্যারের সম্মানার্থে আমি মুখ খুলিনি।

ইন্দ্রনাথবাবু কোনও কথার প্রতিবাদ করেননি। একবারও কনফ্রন্ট করার চেষ্টা করেননি। পাথরের মতো শীতল আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খোলা জানলার সামনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পত্রালির মা তখন ঘেমে নেয়ে কেঁদেকেটে একশা। মহিলা সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে হাই-প্রেশারের রোগী। থাইরয়ে, কোলেস্টেরলে আধমরা। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই ছোটাছুটি করছিলেন। বেসিনের সামনে গিয়ে ওয়াক তুলছিলেন। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের ড্রাম টেনে আনতে যাচ্ছিলেন। চেঁচামেচি আর উত্তপ্ত আবহ দেখে পত্রালিদের পাশের বাড়ির লোকেরা উঁকি মারছিল। মিঠু কিন্তু এসব দেখেও দেখেনি। সে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছিল এক সুরে। পত্রালিদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত বিকাশকাকুর মেয়ে মিঠু। মা নেই। বাবা মদ্যপ। মুদি দোকান চালাতে গিয়ে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে প্রতি মাসে ক্লাবের ছেলেদের হাতে মারধোর খায়।

হাই স্কুল পেরিয়ে মিঠু, ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর পায়ে এসে পড়েছিল। আমাকে আপনি পড়াবেন স্যার? বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আমার। কিন্তু আমি পড়তে চাই।

পত্রালি অবাক হয়ে মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এই কি সেই মেয়ে যে, দিনের পর দিন ওদের বাড়িতে এসে না খেয়ে থাকার অজুহাত দিয়ে গোগ্রাসে লুচি, তরকারি, পরোটা, আলু কষা গিলেছে। ইন্দ্রনাথ মুখার্জীর টাকায় কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর‌্যন্ত পৌঁছেছে? বাজারে বেরোলেই যার জন্য একটা চুড়িদার, একটা শাড়ি শখ করে কিনে এনে পত্রালির মা এতদিন ধরে বলে এসেছেন, থাক না। মা নেই। বাবাটা অসভ্য। ও তো আমাদের মেয়ে মতোই!

এসব যখন হচ্ছে, পত্রালি তখন কলেজের শেষ বর্ষে। তার কাছে সবটা জলের মতো পরিষ্কার। তাই মুখ লুকোনোর জায়গাটুকুও পায়নি সে। অবোধ সেজে না বোঝার ভান করতেও পারেনি। তার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েের বড়ো একটা মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে তার বাবাকে ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত করে দিচ্ছে! তাদের সাজানো-গোছানো সংসারটা চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর পত্রালির কানে তখন ভাসছে পাড়া-বেপাড়া, দুবেলা যাতায়াতের পথে ট্রেনের চার-পাঁচ নম্বর বগিতে কলেজের ছাত্রদের মুখে শোনা, মিঠুর দুষ্কর্মের কাহিনি। নোংরা মেয়েছেলে শব্দবন্ধ না জুড়ে সাধারণত ওই মেযোর নাম নেয় না কেউই।

মিঠুর শরীরের ভাষা লক্ষ লক্ষ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল পত্রালিকে। মিথ্যে বলতে গিয়ে অতি দক্ষ মানুষও কিন্তু ভাবার জন্য, বানানোর জন্য একবার থমকায়। পত্রালি একবারও বাবার সামনে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ায়নি। তার মনের কোণে কোথাও সেই ইচ্ছেটাই আসেনি। কারণ সে জানত, ওই জঘন্য কাজ ইন্দ্রনাথবাবু কিছুতেই করেননি। তার বাবা কোনও দিন কোনও ছাত্রছাত্রীকে তার থেকে আলাদা চোখে দেখেননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পত্রালি দেখেছে, ইন্দ্রনাথবাবু সন্তানজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগলাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ মুখার্জী একজন আদর্শ শিক্ষক। আজও পত্রালি সে কথা মানে।

রিটায়ারমেন্টের তিনদিন আগের ওই প্রবল ধাক্কাটা ইন্দ্রনাথবাবু সামলাতে পারেননি। অসৎ হয়তো চাপে পড়ে আত্মহত্যা করে, কিন্তু সৎ তো মহাকালের কাছ থেকে করুণার বদলে মৃতু্য চেয়ে নিতে পারে। মিঠু চলে যেতে তিনি পড়ার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিয়েছিলেন। পত্রালির মায়ে তখন পাগলপারা অবস্থা। বুকের বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়েছে। বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলেন। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন পত্রালির মাকে। মহিলার মানসিক দিকটা সেই থেকেই ক্ষতবিক্ষত। পত্রালির মা এখন একটা কচি শিশুর মতো হয়ে গিয়েছেন। খাইয়ে না দিলে খাবেন না। চান করবেন না। সারাদিন গুম মেরে বসে থাকবেন। মাঝে মাঝে কাঁদবেন। পত্রালি যখন আদর করে দুহাত বাড়িয়ে ডাকবে, তখন এমন করে স্থূল শরীর নিয়ে থপথপিয়ে ছুটে আসবেন, যেন প্রাইমারি স্কুলের কোনও ছোট্ট বাচ্চা!

মিঠুর ওই কাণ্ডের পরদিন সকালেও ইন্দ্রনাথবাবু নিজে থেকে বাইরে বেরোননি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হব হব। সন্দেহ তখন শীর্ষে। ঘরের দরজায় একের পর ধাক্কা মেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছিল পত্রালি। একদিকে অসুস্থ মা। আর একদিকে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে যাওয়া একটা শরীর, ভালোবাসার ভালো লাগার ছোঁওয়া, শখানেক ডাকনাম, হাত ধরে ধরে হাঁটতে শেখানো লম্বাটে আঙুল আর অসীম স্নেহধারার অধিকারী তার বাবা। মামা, মামি, দূর সম্পর্কের দাদারা বুড়ি ছোঁওয়ার মতো ছুঁয়ে গিয়েছিল পত্রালিকে। অবশ্য মামার আবেগ বরাবরই একটু বেশি। তাই হয়তো দাদুর উইল অনুযাযী কিছু চাষ জমির ভাগ পেয়েছেন পত্রালির মা।

ইন্দ্রনাথবাবুর কর্মস্থল খালি করে ছুটে এসেছিলেন সহকর্মীরা। স্কুলের খোলা ময়দানে বাবার মরদেহ আগলে মাথা নীচু করে বসতে হয়েছিল পত্রালিকে। কারণ বেলা বাড়তে মিটু ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল যত্রতত্র, মফস্সলের আনাচে-কানাচে। তবে ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে ইমেজ নষ্ট হয়নি। মাস ছয়ে যেতে না যেতেই আবার এক মাঝবয়সি লোককে ফাঁসাতে গিয়ে মিঠু নিজেই একটা ঘূর্ণির ভেতর তলিয়ে যায়।

আপনার সঙ্গে কথা বলে আমরা সত্যিই ইমপ্রেসড। আপনার রিটেন পরীক্ষার মার্কসও তো বেশ ভালো।

বেশ প্রশংসা নিয়ে পত্রালির মুখের দিকে তাকালেন ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখ্য প্রশ্নকর্তা। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিহিত চারজন জাঁদরেল অফিসার সামনেই বসে রয়েছেন। পত্রালি নম্র ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাল, অনেক ধন্যবাদ স্যার, থ্যাংক ইউ।

তবে একটা শেষ জিজ্ঞাস্য আছে আমাদের। আপনার বয়স তো খুবই কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। প্রশাসনিক পদের চারপাশে লোভ কীভাবে ধূর্ত শ্বাপদের মতো ওঁত পেতে থাকে জানেন তো? যদি কোনও দিন পা পিছলে যায়, ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন, কী করবেন?

একে অন্যের সঙ্গে চোখ চাওয়াচায়ি করছেন অফিসাররা। স্মিত হাসল পত্রালি। তারপর সরাসরি প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক অথচ সৌম্য গলায় জবাব দিল, আদর্শ আর প্রলোভনের মধ্যে থেকে আমি আদর্শকেই বেছে নেব স্যার। কারণ আমার আদর্শ হলেন আমার বাবা। কোনও মূল্যে আমি তাঁকে হারতে দিতে পারব না।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব