রক্তের রাজনীতি

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির ধরনটাই একটু ভিন্ন। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা এখানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় গোড়া থেকেই। এখানে অঙ্কুরিত হয় বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে পদার্পণ করার স্বপ্ন। ক্ষমতা দখলের খেলায় খুব সহজেই মেতে ওঠে ইয়ং জেনারেশন। বদলে যায় তাদের জীবনদর্শন। জীবনযাপন আর সাদামাটা থাকে না তখন।

মণীশ যখন প্রথম এরকমই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র‌্যাজুয়েশন করতে এসেছিল, সে ভাবেনি জীবন তার জন্য ঠিক কী কী নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফার্স্ট ইয়ার-এ র‌্যাগিং-এর সময়টাতেই প্রথম সিনিয়রদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল মণীশকে। সেখানেই প্রথম সে দেখেছিল দেবেন্দ্র ওরফে দেব-কে। ইউনিয়নের জিএস হওয়ার দরুন সবাই চিনত দেব-কে। তার ব্যক্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কারও। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে বলেই সে এমএ-টাও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই করবে ঠিক করেছিল। দেব-এর পড়াশোনার ব্যাপারে যত না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল পাকাপাকি রাজনীতিতে চলে আসার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই সে নিজেকে চোখে পড়ার মতো জনপ্রিয়তার স্তরে তুলে এনেছিল।

র‌্যাগিং-এ খুব বেশি নাজেহাল হতে হয়নি মণীশ-কে। কারণ দেব-এর চোখে পড়ে গিয়েিল সে, ভালো টেবিল টেনিস খেলার জন্য। দেব বড়ো ভাইয়ে মতোই মণীশকে আগলাতে শুরু করেছিল, সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। তারপর থেকে নানা প্রযোজনে মণীশ, দেব ভাইয়া-কে পাশে পেয়েছে। কখনও তাকে সাহায্য না করে ফেরায়নি দেব। মণীশ যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সেখান থেকে তার বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। একটু মফস্সল বললেও ভুল হয় না। দেব-ই ব্যবস্থা করে দিয়েিল, যাতে কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরতে না পারলেও, সে হোস্টেলে দেব-এর ঘরে থেকে যেতে পারে।

গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর মণীশ বেশ কিছুটা মানসিক অবসাদে ভুগছিল। তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার পা কাটা গিয়েছিল। বোন-কে খুব কষ্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে বাবা, তাঁর শেষ সম্বল ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে। এই অবস্থায় মণীশ

এমএ-তে ভর্তি হবে, নাকি একটা চাকরি খুঁজবে সেটা নিয়ে সে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। টাকার খুব প্রযোজন তার। দু-একটা টিউশনি করে কিছু টাকা সে আয় করে ঠিকই কিন্তু পরিবারের প্রযোজন মেটাতে সেটা যথেষ্ট নয়। বোন রিঙ্কুর জন্য এখনই একটা ল্যাপটপ-এর প্রযোজন। কিন্তু সেই টাকাটাও জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মণীশকে। চাকরির চেষ্টা যে সে করছে না তা নয়, কিন্তু ভালো চাকরি পাওয়াও তো মুখের কথা নয়।

এসব ক্ষেত্রে তার একমাত্র ভরসা দেব ভাইয়া। দোনামোনা করে দেব-এর

হোস্টেল-এর দিকেই পা বাড়ায় মণীশ। হোস্টেলের ঘরে বসে দেব তখন তার চ্যালাচামুণ্ডাদের নিয়ে কলেজের ইলেকশনের ব্যাপারে আলোচনা করছে। ইশারায় মণীশকে বসতে বলে কাজের কথাগুলো সেরে নেয় ছেলেগুলোর সঙ্গে। তারপর ওরা চলে গেলে, মণীশকে বলে

বল ভাই, সকাল সকাল আজ কী মনে করে?

দেব ভাইয়া আর কী বলব তোমায়, তুমি তো সবই জানো।

আরে নির্দ্বিধায় বল। তুই আমার নিজের ভাইয়ে মতো। দাদাকে বলবি না তো কাকে বলবি?

আসলে তুমি তো জানোই, বোনের এটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেকেন্ড ইয়ার। ওকে এবার একটা ল্যাপটপ না কিনে দিলেই নয়। খুব মেধাবী আমার বোনটা। আমার মতো নয়।

হ্যাঁ জানি রে। তা রিঙ্কু তো আমারও বোন। তার জন্য কিছু করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।

আমি অল্প কিছু টাকা জমিয়েছি, কিন্তু…

ওই টাকাটা তুই রেখে দে। রাখিতে একটা মোবাইল কিনে দিস। আপাতত তোর দেব ভাইয়া ওর জন্য ল্যাপটপ-এর ব্যবস্থা করছে।

কথাটা বলে দেব সত্যি সত্যি পকেট থেকে ফোন বের করে মণীশের অ্যাকাউন্ট-এ পঁচিশ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিল। কৃতজ্ঞতায় প্রায় নুয়ে পড়েছে মণীশ। পায়ে হাত দিতে যায় দেব-এর। দেব তাড়াতাড়ি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

পাগল, তুই আমার ভাই।

সে জানি দেব ভাইয়া, কিন্তু এটা ধার হিসেবে নিচ্ছি আমি। টাকাটা আমি শোধ দিয়ে দেব যত তাড়াতাড়ি পারি।

ধুর বোকা। বললাম না রিঙ্কু আমারও বোন। এটা আমি আমার বোনকে উপহার দিলাম।

এরকম ভালোবাসা পেয়ে মণীশ সত্যিই অভিভত। প্রায়ই এমন হয়, দেব তাকে ভালো ভালো হোটেলে খাওয়ায়, মাঝে মাঝে পাঁচশো-হাজার এমনিই পকেটে গুঁজে দেয়। মণীশ বুঝতে পারে না, কী এমন দেখল দেব ভাইয়া তার মধ্যে, যে এত ভালোবাসে!

বোন ল্যাপটপ পেয়ে তো দারুণ খুশি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেই ফেলল। মা শুধু একবার অবাক হয়ে আড়ালে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ রে মণীশ, এত টাকা কীভাবে জোগাড় করলি?

সত্যি-মিথ্যের মাঝামাঝি একটা উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল মণীশ।

এর কিছুদিন পর দেব ভাইয়া কলেজে ডেকে পাঠাল মণীশকে।

বুঝলি মণীশ জোর ক্যাম্পেন করতে হবে তোকে আমার হয়ে এবারও ইলেকশনটা জিততেই হবে। দেখিস সব জায়গায় যেন ঠিকঠাক পোস্টার লাগানো হয়।

ইলেকশনে এবারও দেবের জয় নিশ্চিত ছিল। মণীশও দারুণ খুশি এই জয়ে দেবকে কাঁধে তুলে তারা গোটা ক্যাম্পাস ঘুরল, বিজয় মিছিলে।

এর কিছুদিন পর রাখি। মণীশ ঠিক করল রিঙ্কুকে রাখিতে একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনে উপহার দেবে। সেইমতো একটা ফোন কিনে বোনের কাছে রাখি পরতে বসল মণীশ। রিঙ্কু খুশিতে দিশেহারা হয়ে উঠল। বলল,

তোমার মতো দাদা যেন জন্ম জন্ম ধরে পাই।

এই আনন্দঘন ঘটনার দিনদুয়েক পরে, হঠাত্-ই দেবের ফোন।

মণীশ, ভাই একবার ক্যাম্পাসে আয় তো, একটু জরুরি কথা আছে।

হ্যাঁ ভাইয়া, এখুনি যাচ্ছি আমি।

ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখে সকলে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিধানসভা অভিযানের। দলের একটি ছেলেকে অপোনেন্ট পার্টির ছেলেরা মারধর করেছে। তাদের শাস্তি আর অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে এই অবস্থানের পরিকল্পনা। দেব, মণীশকে আলাদা করে একটু সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল এসব সিরিয়াস কিছু না, চল একটু স্লোগান দিবি, দুটো মিডিয়ার সামনে বাইট দেব, তারপর খাওয়া দাওয়া করে ফিরে আসব।

মণীশ এসব ব্যাপারে আগে কখনও থাকেনি। কিন্তু বিষয়টা যে এতটাই অন্যরকম, সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করার লোভ সে সামলাতে পারল না। এভাবেই দেবের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে সেও পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

মাস খানেক পরে ঘটল আরও এক অভাবনীয় ঘটনা। বাজারে সবজি কিনতে এসেছিল মণীশ। সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দেখে দেবের ফোন। ডান হাতে সবজির বোঝাটা নিয়ে বাঁ হাতে ফোনটা ধরতেই ওপাশে দেবের অস্থির কণ্ঠ ভেসে এল।

কোথায় আছিস? জরুরি দরকার। না, না ফোনে বলা যাবে না। হোস্টেলে চলে আয়।

হোস্টেলে পৌঁছে আজ একটু যেন অন্যরকম লাগল দেবকে। গোটা ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। আর তার খুব ক্লোজ, জনাদুয়েক ছেলে রয়েছে ঘরে। মণীশকে দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে দেব।

ভাই এসেছিস! বোস। খুব মন দিয়ে শোন যা বলছি।

হ্যাঁ বলো ভাইয়া

তুই আমার জন্য কী করতে পারিস?

আরে, এ কেমন প্রশ্ন ভাইয়া। তোমার জন্য জান হাজির।

একটা ছেলেকে তুলতে হবে। পারবি?

তুলতে মানে?

কথাটা বলার সময় একটু যেন ঘাবড়ে গেল মণীশ। কী বলছে দেব ভাইয়া, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না! দেব ভাইয়া তার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন শ্লেষের সঙ্গে বলে,

বড্ড সরল তুই মণীশ। আমি যে এই ছাত্র সংগঠনটা করছি, এটাই তো শেষ নয়। আমার একটা বড়ো ফোকাস আছে, তুই জানিস। এবার আমি যুব সংগঠনের সেক্রেটারি হতে চাই। কিন্তু এই পথে একটা বাধা আছে। আমার পথের কাঁটা। অপোনেন্ট পার্টির এই ছেলেটাকে তুই-ও এক-আধবার দেখেছিস। সুরজিত্। এই ছেলেটা ক্রমশ পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছে। শালাকে এমন শিক্ষা দেব, যাতে ও আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তোর হেল্প চাই, ভাই।

কাঁপা গলায় মণীশ বলে কী ভাবে সাহায্য করতে বলছ আমায়?

কিছু না। তুই যখন টেবল টেনিস খেলতিস কমন রুমে, আমি তোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করতাম, দারুণ রিফ্লেক্স তোর। পারলে তুই-ই পারবি। সুরজিত্ হালওয়াই সরাই-এ থাকে। রোজ ভোরবেলা জগিং করতে আসে দিলবাগ-এ। ঠিক পাঁচটায় রোজ ও দিলবাগ-এর গেট-এ পেঁছোয়। ওখানেই একটা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবি তুই আর এই দুজন।

ঘরে যেন পিনপতন নিস্তব্ধতা। দেব যে দুজনের কথা বলছে, তাদের দিকে এক বার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় মণীশ। তার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজটা যে দ্রুততর হচ্ছে, সে টের পায়। দেব পকেট থেকে একটা রামের নিপ বের করে ছোট্ট চুমুক দেয়। তারপর আবার মণীশকে বলে,

সুরজিত্ জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে এলেই, তুই ঝট করে বেরিয়ে ওর মুখে কাপড় বেঁধে তুলে নিবি গাড়িতে। তোর মুখে মাস্ক থাকবে। তোর ভয় নেই।

আমতা আমতা করে মণীশ বলার চেষ্টা করল,

কিন্তু দেব ভাইয়া, এটা তো অপহরণ।

তো?

না আমি এসব কখনও করিনি।

সব কিছুরই একটা প্রথমবার হয় মণীশ। তুই পারবি।

দরদর করে ঘামছে মণীশ। ঠিক তখনই একটা মোক্ষম কথা বলল দেব।

কাজটা করার পরই তোর

অ্যাকাউন্ট-এ পাঁচ হাজার টাকা ঢুকে যাবে। আর এখন পাঁচ। ভেবে দ্যাখ, কড়কড়ে দশ হাজার টাকা। ছেড়ে দিবি?

মণীশের অভাবের সংসারে দশ হাজার টাকার ভ্যালু সে জানে। মায়ে চোখের ছানিটা অপারেশন না করালেই নয়। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। খপ করে দেবের হাতটা ধরে নিয়ে বলে,

কবে করতে হবে কাজটা ভাইয়া?

মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায় দেবের। বলে,

কালই। বাকিটা তোকে আমার এই দুই শিষ্য বুঝিয়ে দেবে।

ঠিক পাঁচটার সময় একটা কালো রঙের অলটো পিক আপ করল দেব-কে। ভেতরে আগের দিনের দুজন, আছে। আর অপরিচিত একজন ড্রাইভার। ঠিক হয়ে আছে সুরজিত্-কে গাড়িতে তোলার পরই একজন ভালো ভাবে বেঁধে ফেলবে তার মুখ আর হাত দুটো। কিছুটা দূর গিয়ে একটা সিনেমা হলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়বে মণীশ। তার পরিবর্তে অন্য একজন গাড়িত উঠবে। ব্যস তার দাযিত্ব শেষ।

ভেতরে ভেতরে উত্কণ্ঠা টের পাচ্ছে মণীশ। এরকম কাজ আগে কোনওদিন করা তো দূরে থাক, ভাবেওনি যে সে করতে পারে। তাকে চিরকাল তার বাবা-মা একটু খাটো নজরেই দেখে এসেছে। পড়াশোনায় খুবই সাধারণ সে। নিজে হাতে এই প্রথম অনেকগুলো টাকা রোজগার করেছে একদিনের কাজে।

পাশের ছেলেটা সিগারেট খেতে খেতে গাড়ির সাইড মিরর দিয়ে খেয়াল রাখছিল জগিং করতে করতে সুরজিত্ আসছে কিনা। এবার সে মুখ দিয়ে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ আওয়াজ করতেই, সচকিত হয়ে উঠল মণীশ। একটা নেভি ব্লু ট্র‌্যাক সুট পরে ধীর পায়ে জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে আসতেই, তার মুখ চেপে ধরে সবলে তাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিল মণীশ। সুরজিত্ ঘটনার আকস্মিকতায় এবং মুখ বাঁধা অবস্থায় গোঙাতে লাগল। মাস্ক পরা আগন্তুকদের সে ভালো চিনতে পারছে না। শুধু মণীশের চোখের নীচে বড়ো আঁচিলটা খুব চেনা মনে হতে লাগল তার।

মণীশের বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটছে। সে অধীর হয়ে রইল সিনেমা হলটার সামনে গাড়িটা না পেঁছোনো অবধি। তারপর দরজা খুলে নেমে যেতেই অন্য একজন তার জায়গায় উঠে পড়ল। গাড়িটা একরাশ ধুলো উড়িয়ে গোমতী নদীর দিকে চলে গেল।

সবে সকাল হচ্ছে। একটা ফাঁকা চায়ে দোকানে বেঞ্চ-এ বসে চা-এর অর্ডার দিল মণীশ। তারপর খুব মৃদু গলায় ফোন করে দেবকে জানাল কাজটা হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্যাংক অ্যালার্ট এল। তার অ্যাকাউন্ট-এ এখন সদ্য উপার্জিত দশ হাজার টাকা।

আর অতটা খারাপ লাগছে না মণীশের। এটা জাস্ট একটা কাজ। ক্রাইম তো নয়। তাছাড়া ছেলেটাকে হয়তো ওরা একটু শাসানি দেবে, হুমকি দেবে, চড়চাপড় মেরে ছেড়ে দেবে। যাতে সে আর দেবের বিরুদ্ধে ফণা না তুলতে পারে। দেবের এখন অনেক ওপর লেভেল-এ চেনাজানা। যেভাবে রাজনীতির সোপানে সে তরতর করে উপরে উঠছে, ভবিষ্যতে তার বড়োসড়ো নেতা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

কিন্তু যতটা নিশ্চিন্তে থাকবে ভেবেছিল মণীশ, তা আর পারা গেল না। দিন দুয়ে পরে গোমতী নদীতে লাশ ভেসে উঠল সুরজিতের। মিডিয়া, পুলিশ, তোলপাড়। খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটতে ছুটতে দেবের কাছে গিয়ে পৌঁছোল মণীশ।

দেব ভাইয়া, এরকম তো হবার কথা ছিল না! দেব তখন তার ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে হোস্টেল-এর পেছনের মাঠের ঝুপসি অন্ধকারে মদের আসর বসিয়েে। লাইটার জ্বেলে সে মণীশের মুখের খুব কাছে ধরে বলল,

ন্যাকা আমার। জলে নামব আর চুল ভিজবে না। রাজনীতিতে এসব হয়?

কিন্তু ওকে মারার কথা তো বলোনি ভাইয়া! আমি… আমি কিছুতেই করতাম না এই কাজ, তুমি ওকে জানে মারবে জানলে।

চুব বে! শত্রুর শেষ রাখতে নেই। যা করেছিস বেশ করেছিস মেরা শের। আয় বুকে আয়। তোকে কত ভালোবাসি জানিস ভাই আমার। নে মদ খা। অ্যায়ে কর।

দেব নেশাগ্রস্ত। মণীশকেও বাকিরা প্রচুর মদ খাওয়াল সে রাতে। মদ খাওয়ার পর মণীশের খারাপ লাগাটা কমে গেল। দেবের হোস্টেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে সে জড়ানো গলায় বলল

মিডিয়া, পুলিশ, এসব কুত্তাদের চিত্কার কী করে সামলাবে ভাইয়া?

তুই কিছু ভাবিস না ভাই। ওসব আমার বাঁ হাতের খেল। তুই শুধু কটা দিন আন্ডারগ্রাউন্ড-এ চলে যা।

মাসখানেক কেটে গেছে। একটা কন্ট্রাক্টে কিছু কাজের অফার পেয়েছে, এই বলে কিছুদিন বাড়ির বাইরে রইল মণীশ। ঘরে নিয়মিত টাকা পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করেছে দেব। পরিবারের সবাই খুব খুশি মণীশ উপার্জন করছে শুনে। সুরজিত্-এর খবরটা ধামাচাপা পড়ার পর আবার যখন সব স্বাভাবিক, আবার প্রকাশ্যেই দেবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্ শুরু হল মণীশের।

একদিন কমনরুমে দেবের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলছিল মণীশ। ক্যাম্পাস এখন ফাঁকা। দেওয়ালির ছুটিতে বেশির ভাগ ছাত্ররাই যে-যার বাড়িতে গেছে। খেলতে খেলতে হালকা ভাবেই দেব বলল, এবার আর-একটা দাযিত্ব দেব তোকে ভাই। তুই ছাড়া আমার ভরসাযোগ্য কে আছে বল? খেলা থামিয়ে সরাসরি দেবের মুখের দিকে তাকায় মণীশ।

কী হয়েছে, আমায় বলো ভাইয়া। কী দায়িত্ব?

কিছু না, খুব সাধারণ একটা কাজ। একজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে ভাই। শুট করতে হবে।

এত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল দেব, যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল মণীশ। সে নার্ভাস হয়ে বলল, কী বলছ ভাইয়া, আমি কী করে… মানে মার্ডার!

হ্যাঁ ভাই। মার্ডার। শুট করতে হবে।

কঠিন হয়ে উঠেছে দেবের চোয়াল, তবু তার মুখে ঝুলে আছে একটা নিষ্ঠুর হাসি। সরাসরি মণীশের চোখের দিকে চোখ রেখে তাকে জরিপ করছে দেব।

মণীশ কোনও রকমে তোতলাতে তোতলাতে বলে,

আমি তো বন্দুক চালাতেই পারি না ভাইয়া। আমি পারব না।

দেবের পা দুটো ধরে বসে পড়ে মাটিতে মণীশ।

দেব তাকে তুলে দাঁড় করায় কাঁধ দুটো ধরে।

তোকে আমার লোক ট্রেনিং দিয়ে দেবে। তুই কাল থেকে দশ দিনের জন্য আমার ফার্ম হাউসে থাকবি। ওখানেই হবে তোর ট্রেনিং। টার্গেট যেন মিস না হয়।

আমি পারব না ভাইয়া। হাত জোড় করে মণীশ।

পারতে তো তোকে হবেই। আর পারলেই ৫০ হাজার টাকা সোজা ঢুকে যাবে তোর অ্যাকাউন্ট-এ।

না ভাইয়া। এ কোন অন্ধকারে তুমি আমায় টেনে নামাচ্ছ। ছেড়ে দাও আমায়।

একটা পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে দেব। তারপর বলে,

ভাই এটা এমনই একটা অন্ধকার, যেখানে ঢোকা সহজ, বেরোনোটাই কঠিন। এই দ্যাখ এটা।

বলার সঙ্গে সঙ্গে দেব তার মোবাইলটা অন করে একটা ভিডিয়ো প্লে করল মণীশের সামনে। সেদিনের গাড়ির অপহরণের ভিডিয়ো। মণীশের মুখে মাস্ক থাকলেও তাতে মুখের নীচের দিকটা ঢাকা পড়েছে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে তার চোখের নীচের বড়ো আঁচিলটা। মানুষের চোখও তার একটা আইডেন্টিফিকেশন। মণীশ পালাতে পারবে না। সে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে পাঁকে। যে-পাঁক থেকে তার নিস্তার নেই।

টার্গেট মিস যেন না হয়। এটাই মন্ত্রের মতো এই কদিনে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েে মণীশ। আজ সেই দিন। সেই গাড়ি। সেই একই সওয়ারি। স্থান কাল পাত্র শুধু আলাদা। পাত্র বলা ভুল হল। পাত্রী। দেবের গার্ল ফ্রেন্ড। গদ্দারি দেব সহ্য করতে পারে না। তাকে আর একটা অন্য লোকের সঙ্গে বিছানায় দেখে খুন চেপে গেছে দেবের মাথায়। মেয়েটি দেবের অনেক কুকীর্তি এবং প্ল্যান জেনে ফেলেছে। তাই, চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে তার প্রেমিকাকে। আর আজ তাকে মারার বরাতটাই পেয়েছে মণীশ।

প্ল্যান মাফিক নিখুঁত কাজ করল মণীশ॥ গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যওয়ার সময় পেছন থেকে শুট করল মেযোকে। গুলিটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল মেযোর শরীর। কিন্তু সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকের আওয়াজ কারও কানে গেল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত কবুতরির মতো ছটফট করছিল যখন মেযো, গাড়িটা তখন স্পিডে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার মুখে স্ট্রিট লাইটগুলো তখন সবে একটা একটা করে জ্বলতে শুরু করেছে।

আর কোনও অপরাধ বোধ হচ্ছে না মণীশের। দেবের হোস্টেলের ঘরে ঢুকে চিল্ড বিয়ার খেতে খেতে, সে গা এলিয়ে ভাবছিল ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কী কী করবে। বোনের মাস দুয়ে পর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল। খুব পরিশ্রম করছে রিঙ্কু। তাকে খুশি দেখলে বড্ড ভালো লাগে মণীশের।

কিন্তু সব ভালো বোধহয় চিরস্থায়ী হয় না। কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠল সিএএ অর্থাত্ নাগরিকত্ব প্রমাণের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার দুদলে ভাগ হয়ে গেল মানুষ মতাদর্শের নিরীখে। যুব ও ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ল। সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে ভাগ হয়ে মারামারি শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। এরকমই একদিন, গেট ক্র‌্যাশ করে নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্ল্যান করে ফেলল দেব। যড়যন্ত্রে সামিল করল মণীশকেও। টুকরো টুকরো দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ল নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে বলে। বিকেলের দিকে গেটের মুখে দেশনায়কের মতো পুলিশের জিপে ওঠার আগে, মিডিয়াকে বাইট দিল দেব, আমাদের লড়াই চলছে চলবে… ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিল পুলিশ। মণীশ বিপদ বুঝে বাড়িতে চলে এল।

এর কিছুক্ষণ পরই বাড়ির সামনে একটা শোরগোল শুরু হল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখে, একটা পুলিশের জিপ ও একটা অ্যাম্বুল্যান্স এসে হাজির। দরজা খুলে বেরোতেই মণীশের বাকরুদ্ধ অবস্থা। অ্যাম্বুল্যান্স-এর দরজা খুলে যাকে নামানো হল মাটিতে সে রিঙ্কু। তার চোখ দুটো বন্ধ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা দেহ। টুপি খুলে এসআই এগিয়ে এলেন।

হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মৃতু্য হয়েে ওনার। কলেজের বইখাতা ঘেঁটে ঠিকানা পেলাম। আজ একদল ছেলে চড়াও হয়েিল এদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। দুদলের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। ইটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইনি। তারপর আমরা রেসকিউ করে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই…

মণীশ হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে সে। মা-ও বেরিয়ে এসেছেন ঘরের ভিতর থেকে। বাবা ক্রাচটা ধরে থরথর করে কাঁপছেন। কাকে সামলাবে মণীশ। এ তো তারই পাপের শাস্তি পেল তার ফুলের মতো বোনটা! রিঙ্কুর নিথর রক্তাক্ত দেহটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সে। হাতে রক্ত লেগে যায় তার। এ রক্ত কি সারাজীবনেও ধুতে পারবে মণীশ!

লাভার্স মিট

একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তন্বী। বারান্দার রংচটা গ্রিলটা ধরে। বারান্দার গ্রিলটা যেন তন্বীর প্রাণের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বর্ষার দিনে মুঠোতে শক্ত করে ধরে, এক দৃষ্টিতে দ্যাখে কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে ঝরে মাটিতে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল ভূমির ঢাল ধরে ছোটো ড্রেন, হাইড্রেন হয়ে হু হু করে বইছে। হয়তো নদী হবে বলে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসমতো বারান্দায় গিয়ে এক মনে কী যে ভাবে তন্বী কে জানে? পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তন্বীর। ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবে। উঠোনের কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছটা সকাল-সন্ধে পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাখিদের সংসার যেন তন্বীর খুব চেনা হয়ে গিয়েছে। কাঁঠাল গাছটাকে বর্ষার আগাছা আর বিভিন্ন লতাগুল্ম আঁকড়ে ধরে থাকে। বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতায় জল গড়িয়ে পড়ে। গাছ-গাছালি বেশ ঝাঁকড়া হয়ে যায় এই সময়টায়। বিভিন্ন ঋতুতে গাছগুলোর বিভিন্ন রুপ দেখেছে। আর সকাল-সন্ধে পাখিদের সংসার, আনাগোনা সব এখন নখদর্পণে তন্বীর।

সকালের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙানিয়া পাখপাখালি সারাদিন কী ব্যস্ত থাকে। আবার কোথায় উড়ে চলে যায় দূর আকাশে। মন দিয়ে পাখিদের খুনসুটি দেখে। কখনও পাখি হতে ইচ্ছা করে তন্বীর। আবার সন্ধ্যায় আকাশ-পথ চিনে কীভাবে যে ওরা ফেরত আসে বাসায়, তার কূলকিনারা খোঁজার চেষ্টা করে। এই পাখিগুলোর ব্যস্ত আনাগোনা দেখতে দেখতে কখনও হিংসা হয়। ভাবতে থাকে এরা তো কেউ বেকার নয়।

বৃষ্টিভেজা কচি সবুজ পাতা তন্বীর খুব প্রিয়। রাতের খাবার সেরে প্রতিদিন ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। দৈত্যের মতো আবাসানগুলো শহরের আকাশ, মেঘ, সব যেন গিলে খাচ্ছে। তবুও একফালি আকাশ এখনও দেখা যায়। আর শীতের বেলায় ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। আগে তো হিমালয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই চড়াগুলো বারান্দা থেকে দেখা যেত স্পষ্ট। কয়েকটা বছরে কেমন যেন বদলে গেল শহরটা। জ্যোত্স্না রাতে চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ দেখা যায় এক টুকরো মেঘের ফাঁকে। রাত বাড়লে হারিয়ে যায়। শহরের নিয়ন আলোয় আকাশের তারাগুলো আত্মগোপন করে। আজ রোহনের কথা মনে পড়ছে খুব। চাঁদের মায়াবি আলো এসে পড়ে তন্বীর চোখেমুখে। সন্ধ্যার দিকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী টিউশন পড়তে আসত।

বেশ কিছু দিন আগে স্থানীয় একটি নার্সারি স্কুলে শিক্ষিকার পদে কাজ করত সে। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জেরবার হয়ে যায়। এক সময় সেই কাজটা ছেড়ে দেয়। ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখের ঘোর কাটাতে বাইরের আলোতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেয়। আবার রাতের খাবার সেরে বেশ কিছুক্ষণ একাগ্র চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলটা ধরে। শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে অপূর্ব কাঠের দ্বিতল ঘরে তন্বীদের বাস। এই শহরে কিছুদিন আগেও ছবির মতো কাঠের কারুকাজ করা সুন্দর ঘরগুলো শহরের অহংকার ছিল। তন্বীদের পুরোনো কাঠের ঘরটা এখনও প্রমোটারদের থাবা থেকে বেঁচে আছে।

বাবা বলাই চৌধুরী-রা তিন ভাই। তাদের মধ্যে বড়ো তন্বীর বাবা। আর দুই ভাইয়ে একজন থাকে বিদেশে। আর একজন দিল্লিতে কর্মরত। বহুদিন শিলিগুড়িতেই আসেনি কেউ। তন্বী কাকুদের চিনতেই পারবে না। তবে অ্যালবামে ছবি দেখেছে সবার।

বার্মা টিকের কাঠের দ্বিতল বাড়িটার অধিকাংশ রুম জরাজীর্ণ। নীচের ঘরগুলোর মধ্যে একটায় বইয়ের দোকানের গোডাউন। কিছু ভাড়া পাওয়া যায়। সেই টাকা দিয়ে মাঝেমধ্যে ঘর মেরামত করা হয়। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে এক সময় এই কাঠের ঘরটা ছিল দেখবার মতো। পঁক পঁক রিকশার হর্নের শব্দ শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েে তন্বীর। শিলিগুড়ি রিকশার শহর নামে খ্যাত।

উঠোন থেকে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে উপরের কাঠের বারন্দায় উঠতে হয়। তারপর সার-সার দুটি ঘর। বন বাংলোর মতো একটা অনুভূতি হয় রুমে ঢুকলে। এই দুটো ঘরেই তন্বীদের সংসার। বাকি ঘরগুলো ভাম, বিড়ালদের বাস, ব্যবহার হয় না। ফুল বাগিচায় সাজানো গোছানো উঠোন। লাল টুকটুকে জবা ফুল ফুটে থাকে উঠোনময়। নয়নতারা, টগর, বেলি আর রাতে রজনীগন্ধার সুবাসে মনটা ভরে ওঠে।

তন্বীর মা পুজো অর্চনা নিয়ে থাকেন। প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে আসেন। খুব সখের বাগান তাঁদের। একটা বাংলা শর্ট ফিল্মের শুটিংও হয়েছিল।

তন্বীর বাবা বলাই চৌধুরী যজমানি করে রোজগার করেন। তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে মানুষ করেছেন বহু কষ্টে। বড়ো সাধ ছিল মেয়ে একটা সরকারি চাকরি করবে। রোজ সকালে ফুলের সাজি আর সিঁদুরগোলা পাত্র নিয়ে পুজো করতে বার হয়ে যান তিনি। তন্বীর মা রুমা ফুলের সাজি আর একটা ছোটো বাটিতে সিঁদুর গুলে রাখেন পরিপাটি করে।

রেল লাইন পার হলেই লোকাল বাসস্ট্যান্ড। সকালের দিকে স্ট্যান্ডে থাকা বাসগুলোতে ফুল, ধূপ দিয়ে পুজো করেন বলাইবাবু। এছাড়াও বেশ কিছু বাঁধা দোকান, সেলুনে পুজো সেরে দুপুরে ঘরে ফেরেন। হাটবারে ওঁদের বাড়ির দেযাল লাগোয়া জায়গায় শাকসবজির পসরা নিয়ে বসে সবজি বিক্রেতারা। এক পা বাড়ালেই হাটবাজার, সবই হাতের মুঠোয়।

বৃষ্টির দিনে আজ মনটা কেমন করে উঠল তন্বীর। খুব রোহনের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেছে। রোহনের স্বপ্ন দেখেছে সে। বহুদিন রোহনের সঙ্গে দেখা হয় না। ছোটোবেলার প্রিয বন্ধু যেন স্বপ্নে ধরা দিল ভোর রাতে। বেশ কয়েক বছর হল রোহন আর এ শহরে আসেনি।

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কখনও মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক। গাছের শাখায় শাখায় কচিপাতা গজিযে উঠছে। বৃষ্টি ভেজা সবুজ গাছের পাতায় টলটলে বৃষ্টির ফোঁটা, দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনটার কথা। কলেজ পথে একদিন রোহনের চারচাকা গাড়িতে ফুলবাড়ি ক্যানাল ধরে গাজলডোবা গিয়েছিল।

টুকটুকে পুতুল পুতুল চেহারার তন্বী খুব আকর্ষণীয় ছিল। তাদের অজান্তে ভালোবাসার একটা অজানা স্রোত প্রবাহিত ছিল। দুটো পরিবার আসতে পেয়েছিল। তিস্তা ক্যানাল বর্ষার অতি বৃষ্টিতে টইটুম্বুর। দুপাশে ঘন লকলকে সবুজ ছুঁয়ে গাজোলডোবায় পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। ওদের মনের ভেতর বইত ভালোবাসার অন্তঃসলিলা। কলেজ লাইফ বেশ কেটেছে। কলেজ জীবনের স্মৃতি ফিল্মের রোলের মতো ভেসে আসছে। কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে রোজকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তন্বী।

ইতিহাসে মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করে ঘরে বসে আছে তন্বী। কোনও চাকরি জোটেনি। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে নজর রাখে। দরখাস্তও করে। সাফল্য আসেনি এখনও। আসলে শিক্ষকতার পেশায বিএড খুব জরুরি। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে তন্বী, লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া আকাশকুসুম কল্পনা।

এদিকে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দফতরে অ্যাপ্লাই করেই চলেছে। কিন্তু সুযোগ আসেনি একটাও। কিছুদিন আগে একটা নার্সারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিযেছিল। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

সামনের বড়ো রাস্তাটা পার হলেই রোহনদের বিশাল বাড়ি। প্রশস্ত উঠোন। যখন ছোটো ছিল ওরা একসঙ্গে খেলাধূলা করত। প্রাইমারি থেকে কলেজে পড়া পর‌্যন্ত ওরা দুজন দারুণ জুটি। রোহন পড়াশোনায খুব ভালো। উচ্চমাধ্যামিকে স্কুলের টপার হয়েছিল। তন্বীও মনযোগী ছাত্রী ছিল। ছোটোবেলার খেলার সাথি ওরা। কলেজেও একসঙ্গে পড়েছে। রোহনদের বাড়ির সহযোগিতা দারুণ ভাবে পেযেছে তন্বী। আসলে তন্বীর বাবা রোহনদের পরিবারের কূল-পুরোহিত। রোহনের বাবার বিয়েও পুরোহিত ছিলেন বলাইবাবু।

বেশিরভাগ সময় রোহনদের বাড়িতে কাটাত তন্বী। রোহনের মা মিতার খুব পছন্দের মেয়ে ছিল সে। রোজ স্কুল শেষে যখন রোহনদের বাড়িতে খেলতে আসত, মাথার ঘন কালো কোঁকড়া চুলে কৃষ্ণচড়ার ঝুঁটি বেঁধে দিতেন রোহনের মা। আত্মীয-কুটুমদের মধ্যে কানাঘুষো হত, তন্বীকে বউ করে নিয়ে আসবে ঘোষ পরিবার। কিন্তু তন্বীর মা আবার খুব গোঁড়া। ধর্মকর্ম পুজো নিয়ে থাকেন। বলবার সাহস হয় না মিতার।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষ শহরের নামজাদা ব্যবসাযী। কযেটা গোডাউন রযেে। বাদল ঘোষ ধনেমানে বড়ো হলে কী হবে, লেখাপড়া ছিটেফোঁটাও জানেন না। স্কুলছুট হয়ছিলেন। সে আর এক গল্প। পণ্ডিত স্যারের কানমলা খেযে নাকি আর স্কুলমুখো হননি। কিন্তু এখন এই শহরের বেশ ধনী ব্যবসায়ী। বাদল ঘোষের বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যাবসাটা ওদের পরিবারের মজ্জাগত। এখন বাদলবাবু ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ। এদিকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত।

রোহন কলেজে অনার্সে ভালো ফল করেছে। রোহনের বাবা খুব খুশি। এই আনন্দে ঠিক করেছেন রোহনকে কলকাতায হোস্টেলে রেখে পড়াবেন। ব্যাবসার সুত্রে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন ছিল রোহন। কিন্তু মন বসেনি। মাঝপথে সব ছেড়ে চলে আসে। সুযোগ পেলেই তন্বীকে নিয়ে শুকনার জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়ে। রংটঙের টযট্রেনের নির্জন ষ্টেশনে বসে চলে ওদের প্রেমালাপ। কখনও দিনের শেষে ধূমাযিত কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে, ভালোবাসায বুঁদ হয়ে যায দুজনে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মোমো শপে গরম মোমো খেযে বাড়ি ফেরে।

এদিকে তন্বী ইতিহাসে এমএ করছে বিশ্ববিদ্যালয থেকে। মাঝপথে রোহন সব ছেড়ে চলে আসায, রোহনের বাবা-মায়ের মন খুব খারাপ। তন্বীদের সঙ্গে রোহনদের একটা ঘরোযা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাড়াপড়শি, আত্মীযমহলে আলোচনা করে অনেকে। তন্বীও ফের ভর্তি হতে বলে রোহনকে। যাইহোক রোহন নেক্সট ইয়ার বেঙ্গালুরুতে বিজনেস ম্যনেজমেন্টে ভর্তি হয়। এখন ওখানেই থাকে। বেশ মন বসে গিয়েছে। চিরবসন্তের শহরে এক অন্য জগতের পড়াশোনা নিয়ে মজে গেছে। শিলিগুড়ি আর আসতেই চায় না রোহন। টাকা পযসার তো আর অভাব নেই। বাবা টাকা পাঠান।

এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বিজনেস ম্যনেজমেন্ট পাশ করে নামকরা বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে আসীন। বেকার বসে থাকতে হল না আর। প্রথম দিকে তন্বীর খোঁজ খবর নিত। ফোন করত নিয়ম করে। কিছুদিন হল সেসব পাট যেন চুকে গেছে।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষের বাড়িতে ঘটে গিয়েছে অঘটন। পুলিশ রেড হয়েছে। রেশন দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছেন বাদলবাবু। রাজনীতির কেউকেটা হয়ে নাকি পার পাওয়া যাচ্ছে না।

কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে গুদামে, বাড়িতে পুলিশ প্রশাসন রেড করে বেআইনি শস্য উদ্ধার করেছে। দুর্নীতির শিকড় নাকি বহুদূর। মন্ত্রী-আমলারাও যুক্ত। আসলে এদেশে শস্য নিয়ে দুর্নীতি মারাত্মক। আর এরাই আবার রাজনীতির হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। কাজেই বলাই ঘোষ গ্রেফতার হয়েছেন। তদন্তে কী হবে কেউ জানে না!

বিভিন্ন সংবাদপত্রে রেশন দুর্নীতি নিয়ে কযেকদিন ধারাবাহিক লেখাও বার হয়েছে। রোহনের কানে সব খবর গিয়েে। লজ্জায় ঘৃণায় রোহনের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর শিলিগুড়ির বাড়ি আসা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কীভাবে বন্ধু আত্মীয়দের মুখ দেখাবে রোহন! চায়ের দোকান থেকে ঘরে-বাইরে আড্ডায় এখন মুখরোচক খবর, বলাই ঘোষের দুর্নীতি।

এরকম বিপর্যয়ের মুখে একদিন রোহনের ফোন আসে। তন্বীর মুখে সে ঘটনার সত্যাসত্য জানতে চায়। তন্বী রোহনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর বহুদিন আর ফোন করা হয়নি। মনে হয় রোহন এড়িয়ে যাচ্ছে। তন্বী খুব বাস্তববাদী। মনে মনে ঘরের বারন্দার গ্রিলটা ধরে ভাবে কতো কী। আবার এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের আর এক নাম লড়াই। ছোটো থেকে দেখেছে বাবাকে, কী ভাবে জীবনসংগ্রাম করে তাকে মানুষ করেছেন।

সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তন্বীর। জীবন যন্ত্রণার বহু করুণ-কাহিনির সাক্ষী সে নিজে। হয়তো আরও পথ যেতে হবে তাকে। জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিতে চায় তন্বী। তাই হতাশার কোনও ঠাঁই নেই তন্বীর অভিধানে। সম্পর্কে এইভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। রোহন তন্বীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও সে রোহনকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

এদিকে বলাই ঘোষের জামিন হয়েে কিন্তু কেস চলছে। বলাই ঘোষ বিচারাধীন। তাঁর অনুগামীরা জামিনের দিন ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। সংবাদে সচিত্র এমন সংবাদ পড়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে তন্বী। ওদের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যায় মহকুমা শাসকের দফতরের জাতীয পতকাটা পতপত করে উড়ছে। আর ওইখানেই আদালত। তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে পতাকাটার দিকে। আনমনা হয়ে যায়।

তন্বীর বাবার বয়স হচ্ছে। সেদিন পুজো করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। মুখ দিয়ে ফেনা বার হচ্ছিল। পাতলা ছিপছিপে চেহারার মানুষ। লো-প্রেশারের রোগী। অনেকবার তন্বীর মা বলেছেন মেযোর জন্য পাত্র খুঁজতে। কিন্তু তন্বী নারাজ। মা যতবার বলেছেন, তন্বী তুই সব খুলে বল। তন্বী ততবার বলেছে, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, কিছু একটা করব।

এমন সময় একটা কলিং বেলের শব্দে তন্বী দরজা খুলে দেখে পিয়ন কাকু। বহুদিন পর দেখা। আসলে আজকাল চিঠিপত্তর তেমন আর আসে না। একটা বাদামি খাম তার হাতে ধরিয়ে দিল লোকটি। খামের মুখ খুলে দেখে ইন্টারভিউ লেটার। গ্যাংটকে ভেনু। সময় তারিখ সব দেওয়া আছে। মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। মাকে সব বলল। বাবাও ফিরেছেন পুজোর কাজ সেরে।

সপ্তাহে নিয়ম করে একটা খবরের কাগজ রাখে তারা। সাপ্তাহিক কাগজে দেশবিদেশের খবর থাকে। বেশ কিছুদিন আগে একটা ভালো মাইনের চাকরির বেসরকারি কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে অবেদন করেছিল। পদটি অফিস সহকারীর। এক নামকরা ওয়াটার পাম্প কোম্পানির অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট। সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরে এই কোম্পানির মূল অফিস। হিল এরিযায নতুন অফিস খুলবে। তরাই-ডুযার্স, অসম, সিকিম এলাকার চা-বাগিচায় ওয়াটার পাম্পের ডিমান্ড রযেছে।

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্টারভিউ-এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সেভক রোডের কাছে একটা টাটা সুমোতে চেপে বসে তন্বী। বেলা দশটার মধ্যে গ্যাংটকে পৌঁছে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হতে হবে। সাক্ষাত্ প্রার্থীরা একটা হোটেলের করিডরে অপেক্ষা করছে। এই হোটেলটা থেকে দূর পাহাড়ের উপত্যকার মাঝে তিস্তা নদী দেখা যায়। হোটেলের পিছনের দিকে কনফারেন্স রুমে বসবার ব্যবস্থা। কাগজপত্র ভেরিফিকেশন হবার পর ইন্টারভিউ-এর সময় হল। কযেজনের পর ডাক পড়ল তন্বীর।

শীতশীত আবহাওয়া। আজ যদিও আকাশে সূর‌্যের দেখা মিলেছে। ফাইল নিয়ে বোর্ডের সামনে চেযারে বসতেই, সারা শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করল সে। খুব চেনা মানুষ ইন্টারভিউ বোর্ডের হেড। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোলাপি হাফ সোয়েটার। চশমার ফাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো ঘুরছে। চোখ আর জোড়াভুরু দুটো খুব চেনা। পাশে বসে এক আধুনিকা। কাগজপত্র মিলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপের ছলে ভদ্রমহিলা অনেক কিছু প্রশ্ন করলেন। কিন্তু সেই চেনা মানুষটির যখন প্রশ্নের পালা এল কোনও প্রশ্ন না করে, ওকে বলে শেষ করলেন।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইন্টারভিউ কেমন হল তন্বী? তন্বী বাবার কথা এড়িয়ে বলল, হয়েছে চলো, দেরি হয়ে যাবে। লাস্ট বাসটা ধরতে হবে।

কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, বাবা সহজেই বুঝলেন। খানিকটা হেঁটে বাজারের বাসস্ট্যান্ডে কিছু শুকনো খাবার কিনে, বাসের জানলার দিকে সিট নিয়ে বসল তন্বী। মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্ট দেখা যায তিস্তার মূল স্রোতে কত অনামি জলধারা এসে মিশছে। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, সবুজ উপত্যকায ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গ্যাংটক ছাড়িয়ে বাসটা পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে ছুটছে। জানলার দিকে তাকিয়ে রোহনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, এক সমযে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিযে পড়েছে তন্বী। হঠাত্ বাসটা বাঁক নিয়ে ব্রেক কষলে এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে যায তন্বীর।

এখন রাস্তাটা তিস্তা নদী ঘেঁষে চলেছে। সামনেই তিস্তা বাজার জনবসতি। বাসের জানলা থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রধান নদী তিস্তায়, রঙ্গিত নদী মিশছে। সিকিম থেকে রঙ্গিত, তিস্তা বাজারে তিস্তার মূল প্রবাহে মেশে।

তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমস্থল লাভার্স মিট দেখতে দেখতে কেমন নস্টালজিক হয়ে যায তন্বী।

রোহনের আজকে না চেনার ভান নাকি কোম্পানির প্রোটোকল কোনটা সঠিক ভাবতে থাকে তন্বী। কখনও নিজেকে সান্ত্বনাও দেয়। ভাবতে থাকে এমনটাই কাঙ্খিত ছিল। অভিমানে গাল বেয়ে দুফোঁটা মুক্তো দানা ঝরে পড়ে। রোহনের সাথে হঠাত্ দেখা হওয়া যেন স্মৃতির দরজা ধরে এক ঝলক ফিরে দেখার অপেক্ষা। কে জানে যদি আবার সেই দিনগুলো ফিরে আসে!

সহমর্মিতা

খোলা হাওয়ায় শ্রীরাধা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। শহরের শেষপ্রান্তে থাকা ঝিলটায় পৌঁছোতে গেলে এই একটাই রাস্তা ধরতে হয়। এদিকটা বেশ নির্জন। চারিদিকে নিবিড় সবুজ গাছগাছালি তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। পিচ বাঁধানো ঢালাই মসৃণ রাস্তা। একটাই বেশ বড়ো হাসপাতাল রয়েছে এই চত্বরে, ঝিলের থেকে কিছুটা দূরত্বে। আর কোনও লোকবসতি নেই এই দিকটায়।

আজ অনেক দিন পর গৌতমের সঙ্গে বাইকে শ্রীরাধা বাড়ি ছাড়িয়ে এতটা দূরে এসেছে, একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে বলে। জায়গাটা বরাবরই তার বড়ো প্রিয়। চারপাশের নিসর্গ দেখতে দেখতেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই গৌতম যখন এখানে আসার কথা বলল, দ্বিধা করেনি শ্রীরাধা মুহূর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

ঝিলের চারপাশে কিছু কিছু আগাছার ভিড় থাকলেও একটু পরিষ্কার দেখে ওরা দুজনে একটা কাগজ বিছিয়ে ঘাসের উপর বসল। গৌতম একটু কাছে ঘেঁষে আসতে চাইলে, শ্রীরাধা কপট রাগ দেখিয়ে ওকে দূরত্ব রেখে বসতে বলল। দুজনেই পা মেলে বসল ঘাসের উপর। হঠাৎই ঝিলের জলে একটা মৃদু কম্পন আর তার সঙ্গে ঝুপ একটা শব্দ শুনে, শ্রীরাধা একটু সজাগ হয়ে উঠল।

মনে হচ্ছে জলে কেউ পাথর ফেলল। নিশ্চয়ই আশেপাশে কেউ আছে আর আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।

এখানে কেউ প্রায় আসে না। অনেক সময় জলের উপরে মাছ লাফিযে ওঠে। তারই আওয়াজ তুমি শুনে থাকবে। গৌতম নিশ্চিন্ত করতে চায় শ্রীরাধাকে।

শ্রীরাধার শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ এসে গৌতমের দেহ-মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েে। নিজেকে সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছিল গৌতমের। কিন্তু শ্রীরাধার যা ব্যক্তিত্ব তাতে কোনও ভাবেই ওর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া চলে না। তাই ধীরে ধীরে ওর চুলের লম্বা বিনুনিটা হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে হালকা করে জিজ্ঞেস করে, তোমার পারফিউম-টার নাম কী?

উত্তর দেয় না শ্রীরাধা। মৃদু হেসে গৌতমের কাঁধে মাথা রাখে সে। সুযোগ বুঝে গৌতমের চোখদুটো শ্রীরাধার রূপ-মাধুর‌্য পান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই কাটে কিছুটা সময়।

কী দেখছ এমন করে?

তোমার চোখ।

এতে দেখার কী আছে? তোমার সবেতেই বেশি বেশি।

ওই চোখে কী শুধু আমিই জানি।

থামো তো, বাড়িয়ে বলাটা তোমার স্বভাব। এবার চলো উঠি। আর একটু পরেই সন্ধে নামবে। বলে শ্রীরাধা উঠে পড়ল। শাড়িটা ঠিকঠাক করে গুছিযে নিল। সেই সময় দমকা একটা হাওয়ার বেগ ওর আঁচলটা উড়িয়ে নিয়ে গৌতমের মুখ ঢেকে দিল।

গৌতম আঁচলটা হাত দিয়ে ধরতেই শ্রীরাধা বলে উঠল, আঁচলটা প্লিজ ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে।

আজকের দিনটাই ভালোবাসার জন্য। আমারও প্রাণভরে তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।

প্লিজ ছাড়ো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক আছে ম্যাডাম আজ ছেড়ে দিচ্ছি, বলে শ্রীরাধার কোমরের খোলা অংশ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গৌতম গভীর চুম্বনে শ্রীরাধাকে সিক্ত করল।

ওদের এই ভালোবাসার সাক্ষী থাকে ঝিলের জল, আশেপাশের গাছপালা আর এক দম্পতি যুগল। ডক্টর সৌম্য বোস এবং ডক্টর শীলা বোস। ঝিলের অনতিদূরেই তাঁদের হাসপাতালটি। কখনও কখনও দুজনের কাজ একই সমযে শেষ হলে, নিজেদের ক্লান্তি দূর করতে, স্বামী-স্ত্রী এই ঝিলটির ধারে এসে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটিযে যান।

গৌতম-শ্রীরাধা ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর শীলা তাঁর স্বামীকে বললেন, এই ছেলেটিকে আমি চিনি। আমার বাপেরবাড়ির পাড়ায় থাকে। খুব বাজে ছেলে। এক কথায় বলা যায় ধনী বাপের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। পড়াশোনা কতদূর করেছে জানা নেই, তবে নিত্য নতুন মেয়েে ফাঁসাতে ওস্তাদ। একবার তো এই ছেলেটির দুশ্চরিত্র স্বভাবের কারণে, একটি মেয়ে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছিল।

ছাড়ো তো ছেলেটার কথা, ওদের সঙ্গে আমাদের তো কোনও লেনদেন নেই, ডা. সৌম্য স্ত্রীকে বলেন।

এই ঘটনার পর ছয়-সাত মাস কেটে গেছে। সৌম্য এবং শীলা দুজনেরই সেদিন নাইট ডিউটি। হঠাৎই একটা ট্যাক্সি এসে থামে হাসপাতালের সামনে। এক দম্পতি একটি মেয়েে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে হাসপাতালে ঢোকেন। দুজনে মেয়েটিকে ধরে, ধীরে ধীরে এমারজেন্সি-তে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডাক্তারবাবু দম্পতির দিকে চাইলে, মহিলা এগিয়ে আসেন।

ডাক্তারবাবু, এ আমার মেয়ে আজ দুপুর থেকে ওর পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আর সেই সঙ্গে খুব ব্লিডিং-ও হচ্ছে।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েির ব্লাড প্রেশার চেক করে একটা ফোন করলেন। ডক্টর শীলা, প্লিজ তাড়াতাড়ি একবার এমারজেন্সি-তে আসুন। একটা ক্রিটিক্যাল কেস এসেছে।

দুমিনিটের মধ্যেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শীলা এসে সেখানে পেঁছোলেন। ঝড়ের গতিতে মেয়েিকে বিছানায় শুইযে পর্দা টেনে দিলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এসে জানালেন, মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। এখুনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। সার্জারি করতে হবে।

অপারেশনের নাম শুনেই মেয়েটির মা-বাবা ঘাবড়ে গেলেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর, ভয়ে কোনও কারণ আছে নাকি?

এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা ফর্মালিটিজগুলো সেরে, ওটি-র সামনে অপেক্ষা করুন।

ওটি-তে সৌম্যও স্ত্রী-কে জয়েন করলেন। একটু পরেই একজন নার্স বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওটি-তে থাকা অসুস্থ মেয়েটির অভিভাবক কি আপনারা? নার্স একটি কাগজ এগিয়ে দিল ভদ্রলোকটির দিকে, তাড়াতাড়ি করে এটাতে সাইন করে দিন। অপারেশন করতে হবে। এখনই করুন।

কী হয়েে সিস্টার?

এখন কথা বলার সময় নেই। যা প্রশ্ন আছে অপারেশনের পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। মেয়েিকে ডিসচার্জ করার আগে এক বোতল রক্ত আমাদের ব্লাড ব্যাংক-এ জমা করতে হবে। এখন আমরা আমাদের স্টক থেকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

নার্স চলে গেলে একজন অ্যাটেনডেন্ট-এর সঙ্গে গিয়ে ভদ্রলোক এক বোতল নিজের রক্ত জমা দিয়ে আবার এসে স্ত্রীয়ের পাশে, ওটি-র সামনের বেঞ্চটাতে বসলেন।

হঠাৎ করে শ্রীরাধার কী হল? ভালোই তো ছিল। ভিতরের টেনশন কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলেন না শ্রীরাধার বাবা।

অপারেশন টেবিলে শ্রীরাধাকে শুইয়ে দিয়ে শীলা জিজ্ঞেস করলেন, যার সঙ্গে তুমি প্রায়শই ওই ঝিলটায় যাও এটা তারই কীর্তি, তাইতো?

চোখের জল বাধ মানে না শ্রীরাধার। হ্যাঁ ডক্টর, আমার একটা ভুলের জন্য এই পরিণতি হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাকে প্লিজ বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না। আমার মরে যাওয়াই উচিত।

আমি তোমার মতো বোকা এবং দাযিত্বজ্ঞানহীন নই। আমার কী কর্তব্য সেটা আমি ভালোই জানি।

কিন্তু এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে আমি কী করে বাঁচব? আপনি আমাকে এখন বাঁচিয়ে দিতে পারেন ঠিকই কিন্তু পরেও তো আবার আমি আত্মহত্যা করতেই পারি। দয়া করে আমাকে মরতে দিন।

ঘাবড়ে যেও না, আমি তোমার বদনাম হতে দেব না। এখান থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তুমি বাড়ি যাবে। নিজের পড়াশোনার ওপর বেশি ফোকাস রাখো। এখন থেকে মা-বাবার সম্মানের কথাটা মাথায় রেখো দয়া করে। সম্মতিসূচক মাথা হেলায় শ্রীরাধা। আর কথা বোলো না, এখনই অ্যানাস্থেশিযার প্রভাব ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যাবে। তার পরেই আমি অপারেশন শুরু করব।

প্রায় দুঘন্টা পর ওটি থেকে শীলা বাইরে বেরোতেই, শ্রীরাধার মা-বাবা দৌড়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের মেয়ে কেমন আছে?

ভালো আছে। আপনারা ঠিক সময়ে মেয়েটির হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, নয়তো বেশি ব্লিডিং হওয়ার ফলে প্রাণটাও যেতে পারত। অপারেশন সাকসেসফুল। এখন আর কোনও ভয় নেই আপনাদের মেয়ে।

কিন্তু ডক্টর, আমার মেয়ের কী হয়েছে ? শ্রীরাধার বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

আপনারা আমার কেবিনে আসুন।

শ্রীরাধার মা-বাবা ডা. শীলার সঙ্গে ওনার চেম্বারে গিয়ে বসলেন। শীলা, শ্রীরাধার ফাইলে দেওয়া বিবরণ চোখের সামনে খুলে ধরলেন। পেশেন্টের বাবার দিকে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি ফাইলে মেয়ে বয়স লিখিয়েেন সতেরো অর্থাৎ নাবালিকা। আপনারা কি জানতেন, শ্রীরাধা গর্ভবতী ছিল?

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব?

তার উত্তর তো একমাত্র শ্রীরাধাই দিতে পারবে। ওর একটি ফার্টিলাইজড এগ গর্ভাশয় অবধি পৌঁছোতে পারেনি। ফ্যালোপিয়ন টিউবেই আটকে ছিল। গর্ভের আকার বড়ো হতেই নালি ফেটে গিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়েছিল। আমরা নালির ওই অংশ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন আর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।

ডাক্তারের কথা শুনে শীলার মা-বাবার মুখে আশ্চর্য হওয়ার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে ওঁরা লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলেন।

সপ্তাহ খানিক পর শ্রীরাধার ডিসচার্জ হওয়ার কথা। শীলার অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে জিজ্ঞেস করল, ডিসচার্জ ফাইলে কী লিখব ম্যাডাম? আপনি বলেছিলেন ডিসচার্জ ফাইল তৈরি করার সময় আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করতে।

ওকে, পেশেন্টকে যে ডিসচার্জ স্লিপটা দেওয়া হবে, তুমি তাতে সব সত্যিটা লেখো। আর হাসপাতালের ফাইলে লেখো ডান দিকের ফ্যালোপিয়ন টিউব ফেটে যাওয়ার পরে, সেটা আপারেশন করে বার করে দেওয়া হয়েছে। একটা নোট লিখে দিও যে, সার্জারির ডিটেল রিপোর্ট গাইনিকোলজিস্টের ফাইলে রয়েছে। এই ডিটেল পেপার্স-এর ফাইল আমাকে দিয়ে দিও। এই পুরো ব্যাপারটা যেন আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকে। তুমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে নিশ্চয়ই এটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ।

কথোপকথনের মধ্যেই সৌম্য এসে স্ত্রীয়ের কেবিনে ঢুকেছিলেন। চুপচাপ বসে স্ত্রীয়ের কথা শুনছিলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শীলাকে বললেন, এটা তুমি কী করছ? হাসপাতালের ফাইলেই অপারেশন নোটস থাকতে দাও। এটা তোমার করা উচিত নয়। পেশেন্টের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে বলে, তুমি হাসপাতালের নিয়ম ভাঙতে পারো না।

সৌম্য তুমি যা বলছ, তা একদম ঠিক। কিন্তু ভেবে দ্যাখো মেয়েটি নাবালিকা, বাচ্চা মেয়ে বললেও ভুল হবে না। ওর এই অবৈধ প্রেগন্যান্সি যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মেয়েটির বদনামের শেষ থাকবে না। মেয়েটির ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী। আমি মেয়েটির ব্যথা খুব ভালো বুঝতে পারি।

শীলা, শ্রীরাধার মা-বাবাকে ডেকে পাঠালেন নিজের কেবিনে। হাসপাতালের নিয়মকানুন বুঝিয়ে বললেন, দেখুন আপনাদের ফাইলে আমাকে সত্যিটা লিখতেই হবে। ফাইল আপনাদের সুতরাং ওটা নিয়ে আপনারা যা খুশি করতে পারেন। চাইলে নষ্ট করেও দিতে পারেন। আপনাদের মেয়ে ভালোর জন্য আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি সেটা করেছি। এবার ওর ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, শ্রীরাধা ভবিষ্যতে আদৌ মা হতে পারবে কি?

হ্যাঁ, মা হতে পারবে। ওর একটা ফ্যালোপিয়ন টিউব সম্পূর্ণ ঠিক আছে।

কিন্তু অপারেশনের দাগ তো পেটে থেকেই যাবে। বিয়ের পর যদি ওর স্বামী দেখে কিছু সন্দেহ করে?

আমি ল্যাপ্রোস্কোপিক পদ্ধতিতে সার্জারি করেছি। ছোট্ট একটুখানি জায়গা কাটতে হয়েছে। সুতরাং পেটে কোনও বড়ো দাগ থাকবে না, তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। শ্রীরাধার বিয়ে এখনও অনেক দেরি আছে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি, ও এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। মাস্টার্স করে তবেই বিয়ে করবে আপনাদের মেয়ে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেওয়ার পর বাড়ি এসে শ্রীরাধা মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। লজ্জা যেন ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। মা, আমি আর কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না! বেঁচে থেকে আমি কী করব?

খবরদার রাধা এমন বোকার মতো কথা মাথাতেও আনবি না। একটা দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যা। এটা নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা করবি না। এমনকী বিয়ে পর স্বামীর সঙ্গেও না। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমরা খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেব, চিন্তা করিস না।

শ্রীরাধার মা স্বামীকেও বললেন, এই ব্যাপার নিয়ে রাধাকে তুমি কিচ্ছু বলবে না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি। এই পুরো ঘটনায় ও খুব লজ্জিত। ও এখন পড়াশোনা নিয়ে থাকতে চায়। ভাগ্য ভালো যে, এরকম একজন ভালো লেডি ডক্টর-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল। যিনি আমাদের সম্মান বাঁচাবার জন্য যতখানি সম্ভব সহযোগিতা করেছেন।

এই ঘটনার পর আট বছর কেটে গেছে। আজ শ্রীরাধা নিজের স্বামীর সঙ্গে আবার ডা. শীলার হাসপাতালে এসে হাজির হয়েে। আড়াই মাসের গর্ভবতী সে। ওর ডাক্তারই শ্রীরাধাকে, ডা. শীলা বোসের কাছে রেফার করেছেন।

শ্রীরাধা আর তার স্বামীর সঙ্গে কথার শেষে, শ্রীরাধার স্বামীকে কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ডা. শীলা চেক-আপের জন্য শ্রীরাধাকে বেডে শুইযে দিলেন। পরীক্ষা করে বললেন, পেটের দাগটা তো একেবারেই মিলিয়ে গেছে দেখছি। এখন ক’মাস চলছে?

আড়াই মাস চলছে ম্যাম।

বাচ্চা একদম ঠিক আছে। খাওয়া-দাওয়ার খেযাল রাখতে হবে আর অ্যাক্টিভ থাকবার চেষ্টা করবে সবসময়। এতে নর্মাল ডেলিভারি হতে সুবিধা হবে। কমপ্লিট রেস্টের কোনও দরকার নেই তোমার। তোমার স্বামী বাইরে বসে ছটফট করছেন, তোমাকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?

হ্যাঁ ম্যাম। আমার অতীতের ঘটনা ওনাকে কিছুই জানাইনি। আমি তো আত্মহত্যা করব বলেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, আপনিই আমাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনার জন্যই এত সুন্দর জীবন পেয়েছি। এই ঋণ কোনও দিন আমি শোধ করতে পারব না। শ্রীরাধার চোখ জলে ভরে আসে।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন শিগগির স্বামীর কাছে যাও। ও বেচারা উত্কণ্ঠায় ছটফট করে মরছে। হাসতে হাসতে শীলা বললেন।

চোখে জল নিয়ে শ্রীরাধা কেবিন থেকে বাইরে এল। ওকে দেখে স্বামী রথীন দৌড়ে এল, কী হল শ্রীরাধা, সব ঠিক আছে তো? তোমার চোখে জল কেন?

রথীন এটা হচ্ছে আনন্দের অশ্রু। শ্রীরাধার শরীর আর বাচ্চা দু-ই একদম ঠিক আছে। পরের বার মিষ্টি নিয়ে আসতে ভুলো না শ্রীরাধা। ওরা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি, কখন ডা. শীলাও শ্রীরাধার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওনার কথাতে দুজনের চমক ভাঙে। রথীন আর শ্রীরাধা হাসিমুখে শীলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে আসে। নবজাতকের আগমনের স্বপ্নে দুজনেই বিভোর হয়ে ওঠে।

শেষযাত্রা

তিনি একমনে ছবি আঁকছিলেন। ক্যানভাস জুড়ে শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্র মিশে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে একটা নৌকো চলছে। নৌকো না বলে কলার ভেলা বলাই ভালো। এই বিরাট সমুদ্রে তার কখন তলিয়ে যাবার কথা। তবু চলছে। তিনি নৌকোটার গায়ে বাদামি রঙের পোঁচ দিতে লাগলেন জোরে জোরে। না, না, নৗকোটাকে কিছুতেই ডুবতে দেওয়া যাবে না।

ক্যানভাসে যেমন, জানলার বাইরেও তেমন সমুদ্র, ঢেউয়ের পরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। দূরে দূরে নৌকো, জাহাজও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে মেলার মতো ভিড়। বড়া পাও, পাপড়ি চাট, কুলফির পসরা। ঘোড়া নিয়ে দর কষাকষি। বেলুন কিনে দেবার জন্যে বাচ্চাদের মার হাত ধরে ঝুলোঝুলি। জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে তাঁর হাত ক্যানভাসের ওপর থমকে গেল। ছোটোবেলায়, খুব ছোটোবেলায়, মা তাঁর হাত ধরে জুহু বিচে নিয়ে আসত। কিন্তু সেটা বিকেলে বা সন্ধেবেলা নয়, খুব ভোররাতে। কার কাছ থেকে শুনেছিল নামিদামি ফিল্ম স্টার আর প্রডিউসাররা একটু নির্জনতার জন্যে নাকি এই সময়টা হাঁটতে আসে বিচে। মা আসত তাদের এক ঝলক দেখার জন্য নয়, ফিলমে একটা ব্রেক পাওয়ার জন্য। মা তখনও ভাবত, আগের মতোই সুন্দরী আছে, একটা, জাস্ট একটা ব্রেক পেলেই মাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন জুহুতেই তাদের বিরাট বাংলো, বিদেশি গাড়ি, সুববু বিদেশে পড়াশোনা করবে। মা তাকে সুববু বলে ডাকত। বাবা-ই সুববু ডাকতে শুরু করেছিল প্রথম থেকে, বাবার দেখাদেখি মা। শুভলক্ষ্মী থেকে সুববু। শুভলক্ষ্মী নামটা অবশ্য সিনেমায় চলেনি। মেহেরা সাবের কথাটা এখনও কানে বাজে ‘ম্যায় কেয়া মইথোলজিকাল ফিল্ম বানাউঙ্গা যাঁহা হিরোইন কা নাম শুভলক্ষ্মী হোগা। আরে মেরে ফিল্ম মে তো তুমকো বিকিনি ভি পেহননা হোগা। বিকিনি অউর শুভলক্ষ্মী –নেহি চলেগা। তুমহারা নাম রাখা হু কায়রা, ভেরি সেক্সি নেম, তুমহারি তরহা’

এইভাবে শুভলক্ষ্মী নামটা হারিয়ে গেলেও সুববু রয়ে গেল সারাজীবন। বাবার ওই একটাই জিনিস মা ফেলে দেয়নি কখনও। শুধু সুববু নামটা নয়, সুববুও তো বাবারই দান। বাবা বলে যে লোকটাকে জানেন তিনি, ফর্ম ভরার সময় কতবার লিখতে হয়েছে, শিবদাস আয়েঙ্গার। সেই শিবদাস একটা নয়, দু দুটো সন্তান দিয়েছিল ললিতাকে। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে চলে গিয়েছিল প্রথম সন্তান, সুববুর দাদা। তার নাম রাখা হয়েছিল শিবললিত, শিবদাসের শিব আর ললিতার ললিত মিশিয়ে তৈরি সে নাম। শিবললিতকে সুববু দেখেনি, সে আসার আগেই চলে গিয়েছিল সেই ছেলে, আর সুববু হবার বছর খানেকের মধ্যে বাবা চলে গেল। মারা যায়নি, অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ভেগে গেল। মা বলত মরে গেলেই ভালো হতো এর চেয়ে। বাবা কিন্তু মরেনি। সেই শীলা বলে মেয়েটাকে ছেড়ে একটা কোংকনী মেয়ের সঙ্গে থিতু হয়েছিল শেষমেশ। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসত সুববুর সঙ্গে স্টুডিওয়। টাকা চাইত না, কিচ্ছু না। শুধু সুববু বলে ডেকে মাথায় হাত রাখত আর বলত নিজের টাকা পয়সার খেয়াল রাখতে, ললিতার ওপর সব ছেড়ে না দিতে।

সমুদ্রে আরও একটু নীল রং দিতে দিতে তাঁর আজ হঠাৎ মনে হল, বাবার বদলে মা যদি তাকে ছেড়ে চলে যেত, তাঁর জীবনটা একদম অন্যরকম হতো। পালিয়ে যাবার মতো আশিক তো কম ছিল না মা-র জীবনে। কিন্তু মা তাদের কাউকে চাইত কি আদৌ? ফিল্ম ছাড়া মার মাথায় কোনওদিন কিছু ছিল না। তাই অন্ধকার বিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত একটা ব্রেকের আশায়। সুববুকে একা রেখে যেতে হবে বলে সঙ্গে নিত। আর তাই অতো ছোটোবেলাতেও সুববু বুঝে গেছিল, সাধারণ চোখে যা সুন্দর লাগে, ফিল্ম লাইনে তার কোনও দাম নেই। শরীরের ধকটাই আসল এখানে আর কচ্চি কলি হলে তো কোনও কথাই নেই।  সুন্দরী হলেও তখন মা-র শরীরে এসব কোনওটাই ছিল না। দু দুটো বাচ্চার জন্ম, অভাব, নিত্য অশান্তি মা-র সব গ্ল্যামার কখন যে শুষে নিয়েছিল, মা বুঝতে পারেনি। অথচ সুববু, তখন মাত্র তিন-চার বছরের মেয়ে হলেও বুঝতে পেরেছিল মা কোনওদিন সিনেমায় চান্স পাবে না, বুঝে গিয়েছিল মার মুখের দিকে ছুড়ে দেওয়া লোকজনের উপেক্ষিত দৃষ্টি দেখে। ওইসময় কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যেত বলে এমনিই তার ভালো লাগত না। আরও খারাপ লাগত তখন কোনও বেলুনওলা থাকত না বলে। সে মনে মনে চাইত মা তাকে বিকেলে বা সন্ধের সময় বেড়াতে নিয়ে যাক, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সে যখন বেলুনের জন্য বায়না করতে পারে। বেলুন পায়নি সত্যি, কিন্তু সিনেমায় রোল পেয়েছিল। মার কোলে থাকা তার গাল টিপে একজন প্রডিউসার বলেছিল তার পরের ফিল্মে এইরকম একটা বাচ্চার রোল আছে, ললিতা কি দেবে তার বাচ্চাকে?

তুলি থামিয়ে তিনি বাইরের দিকে তাকালেন। মুম্বাইতে আটটার আগে সন্ধে নামে না। আকাশে এখনও অনেক আলো, সমুদ্র কি তীব্র নীল, হাওয়ায় একগোছা বেলুন উড়ছে। সব, সব আগের মতো আছে। শুধু তাঁর জীবনটাই এমন ঘেঁটে গেল কেন?

ফোনটা বাজছে। ঠিক বাজছে না, কাঁপছে। ভাইব্রেশনে দেওয়া আছে।  আওয়াজটা শুনবেন না বলে ভাইব্রেশনে দিয়ে রেখেছেন। খুব মৃদু সরোদ বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে। এ রাগটা তিনি চেনেন, মারুবেহাগ। ভালোবাসার রাগ। আগে চিনতেন না কোনটা মারুবেহাগ, কোনটা দেশ, কোনটা কেদার। অবিনাশ চিনিয়েছে। ভালোবাসার রাগ থেকে ভালবাসা –সব। ওই শিখিয়েছে কাজের সময় ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল চালিয়ে রাখতে, এতে নার্ভ ঠান্ডা থাকে, কাজে মন বসে, স্ট্রেস কমে। স্ট্রেসের কারণগুলো জীবন থেকে ছেঁটে ফেলবেন বলেই তো এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছেন, রং তুলি গান আর খুব দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে। এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে বুঝতে পারছেন, জীবনে কোন কোন জিনিসগুলো সত্যি দরকারি। সারাজীবন তো মা চালিয়েছে, মা ঠিক করে দিয়েছে সব। নিজের সত্যি কী দরকার, কাকে দরকার, বুঝতেই পারেননি।

মা যখন আর পারল না, প্যারালিসিসে শরীরের ডান দিকটা, এমনকী কথা বলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল, ততদিনে তো ভিকি মালহোত্রা তাঁর জীবনে এসে গেছে। মার বদলে ভিকি ঠিক করত সব তাঁর জন্য। ছবি সাইন করা থেকে পার্টির পোশাক, ডায়েট চার্ট থেকে জিম রেজিম– সব। ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, ভিকির জীবনটাই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হতে শুরু করেছিল। সেটা এতটাই যে ও নিজের ১৪ বছরের বিবাহিত বউ, ফুটফুটে দুই ছেলেমেয়ে সবাইকে ছেড়ে তাঁর সাথে লিভ ইন করতে শুরু করল।

মা তখন উঠতে পারে না, কথা বলতে পারে না কিন্তু বুঝতে তো পারে সব কিছু। নিজের মেয়ে এভাবে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছিল না। ওষুধ না খেয়ে, খাবার না খেয়ে, নানাভাবে জেদ অশান্তি করে সে প্রতিবাদ জারি রেখেছিল। বাধ্য হয়ে মাকে ছেড়ে অন্য একটা ফ্ল্যাটে, মার চোখের আড়ালে থাকতে শুরু করলেন ভিকির সঙ্গে। সমাজ, তারকাদেরও সমাজ থাকে একটা, সেখান থেকে চাপ আসছিল। সবাই ভাবছিল কায়রার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে কেউ ভিকি মালহোত্রার মতো ফ্লপ প্রডিউসারের সঙ্গে জড়ায়। ভিকি তো স্রেফ চেনে টাকা, আগের বউটাও তো রাইজিং স্টার ছিল, সনিয়া কপূর। ওর টাকা, শরীর, কেরিয়ার, সব ছিবড়ে করে এখন ভিকি কায়রার দিকে ঝুঁকেছে। এটাই ওর আসল ব্যাবসা, সুন্দরী নায়িকাদের সিঁড়ির মতো ব্যবহার করা। এমনিতে তো একটা সিনেমাও চলে না।

এসব বিষে মুম্বাইয়ের বাতাস ভারি হচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই তিনি ভিকিকে বিয়ে করলেন। আর বিয়ের দিন রাতে, মা চলে গেল। সেটাও নিঃশব্দে নয়, মেয়ের উপেক্ষার প্রতিশোধ মা নিল সুইসাইড করে। একজন প্যরালিসিস মহিলা কীভাবে এত স্লিপিং পিল জোগাড় করতে পারে– সেটা নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস চলতে চলতে পুলিশ পর্যন্ত পৗঁছোল। বলা হল পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য মাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে কায়রা আর ভিকি। খুন করার হলে মাকে তো অনেক আগেই খুন করা উচিত ছিল তাঁর। করতে পারলে জীবনটা অনেক সুন্দর করে বাঁচা যেত। তাঁর জীবনের প্রথম, হয়তো একমাত্র প্রেমকে ওভাবে গলা টিপে মারতে হতো না। শাওন কুমার, আসল নাম শ্রাবণ মুখার্জি, বাংলার ছেলে, তীব্র ভাবে চেয়েছিল তাঁকে। পুণের এক মন্দিরে গোপনে বিয়েও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের মালা বদল করে, মা ঠিক জেনে গেল। গুন্ডা বাহিনী নিয়ে হাজির হল মন্দিরে, শাওনকে খুনই করত, কায়রা মা-র হাতে পায়ে ধরে, বিয়ে ভাঙার প্রমিস করে শাওনকে বাঁচান। শাওন সেই নবলব্ধ জীবন নিয়ে আর তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি, তিনি নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। শাওন ফোন ধরেনি, দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এক, সব পুরুষ এক। মেয়েদের মন ওরা বোঝে না। ওরা জানে শুধু মেয়ে-শরীর আর নিজেদের ইগো। মার মৃত্যু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। নীচ থেকে ওপর সবার মুখ বন্ধ করতে অনেক টাকা খসল, অনেক টেনশন ছুটোছুটি। বিয়ের প্রথম বছরটা এইভাবেই কেটে গেল। যেই ভাবতে শুরু করলেন এবার একটু থিতু হয়েছেন, ভিকির ভালোবাসায় বাকি জীবনটা শান্তিতে কেটে যাবে, তখনই ভিকি স্বমূর্তি ধরল। মদ, উঠতি নায়িকাদের কাজের টোপ দিয়ে ফস্টিনস্টি, সবই তাঁর টাকায়। বাধা দিলে অকথ্য গালাগাল, এমনকী মারধোর।

কিন্তু এত ঝড়ঝাপটার কোনও প্রভাব কায়রার কাজে পড়েনি। মা তার চারপাশে কেমন একটা বায়ুনিরোধক বর্ম তৈরি করে গেছিল, সেটা খুব কাজে লেগেছে সারাজীবন। এই যে এখন কোলাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা রয়েছেন, এখান থেকেই শুটিং-এ যাচ্ছেন। এখন তো বেছে বেছে ছবি করা। খুব পাওয়ারফুল চরিত্র পেলে তবেই করেন। সেসব নিজেই সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু ভিকির সঙ্গে আর নয়।  এনাফ ইজ এনাফ। শুধু মেয়েটার জন্যে বুকের মধ্যে চিন চিনে ব্যথা। এই মেয়েকে আঁকড়েই তো ভিকির সঙ্গে কাটালেন এতগুলো বছর। কিন্তু আর নয়।

ফোনটা আবার কাঁপছে, চিংকি, তাঁর মেয়ে ফোন করছে। ওর ভালো নাম তিনিও রেখেছেন শুভলক্ষ্মী, তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া নামটা। নামটা যেন তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনও দামি গহনার মতো, যা কেবল একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে চলে যাবে, কিন্তু ব্যবহার হবে না। কারণ তিনি  জানেন এই নামটাও বদলে যাবে, চিংকিও সিনেমায় নামছে যে। ওর বাবারই বিশেষ আগ্রহ। এতদিন কায়রার পয়সায় খেয়েছে, এবার কায়রার মেয়ের পয়সায় খাবে।

চিংকিকে অনেক বুঝিয়েছেন তিনি, বলেছেন তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে। মেয়ে আসেনি। এখন কেন ফোন করছে? মাকে কীসের দরকার?

অবিনাশ বলেছিল আসবে দেখা করতে। তিনি বারণ করেছেন। অবিনাশকে দেখলে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আর এই বয়সে সে ধাক্বা সামলাতে পারবেন? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবিনাশকে ডেকে পাঠাবেন। ফোনটা তাঁকে খুব অস্থির করে দিয়েছে। অবিনাশকে সব বলা দরকার।

চিংকির ডেবিউ এ বছর শেষের দিকে, ওর অপোজিটে আছে শাওনকুমারের ছেলে অঙ্কিত। তাঁর আদৗ ইচ্ছে ছিল না চিংকি সিনেমায় নামুক। তিনি চেয়েছিলেন ও আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক। সেই ৪ বছর বয়স থেকে তিনি লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন শুনে আসছেন, এই ইন্ডাস্ট্রির হাড়ে হদ্দ জানেন। তাঁর কাছে খিদে একটা মোটিভেশন ছিল, কাজ না পেলে না খেয়ে মরতে হবে। চিংকির সামনে তো তা নেই, ওর মতো নরম আদুরে মেয়ে এই লাইনের ওঠাপড়া নিতে পারবে না। এই নিয়েই ভিকির সঙ্গে খিটিমিটি শুরু তাঁর। তাও হয়তো মেনে নিতেন, যদি না অঙ্কিতের অপোজিটে কাস্ট করা হতো চিংকিকে। নিউ কামার পেয়ারদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি নানা গসিপ বাজারে ছাড়ে ছবি হিট করাবার জন্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা সত্যি হয়ে যায়। রোমান্টিক সিন করতে করতে সত্যিকারের রোমান্সে জড়িয়ে পড়ে নতুন হিরো হিরোইন। হায় ভগবান! সেরকম যদি হয়! ওরা যে ভাইবোন!

মন্দিরে বিয়ের আগেই শাওনের সন্তান এসেছিল তাঁর গর্ভে। মা যখন সব শেষ করে দিল, তখন জেদ করে শাওনের সন্তানকে অ্যাবর্ট করেননি কায়রা, আর সেই খবরটা শাওনের  নিঃসন্তান স্ত্রী রিতার কানে পৌঁছোয়। এক দুপুরে রিতা এসে তাঁর কাছে প্রায় ভিক্ষে চায় অনাগত সন্তানকে। তাঁকে বোঝায় একে বড়ো করে তুলতে গেলে সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে থাকবে চিরকাল, তার থেকে শাওন আর রিতার বৈধ সন্তান হিসেবে বড়ো হোক সে। তিনি রাজি হয়ে যান, এর থেকে ভালো লালন তিনি কি দিতে পারতেন? সমস্ত পৃথিবী জানে অঙ্কিত শাওন আর রিতার ছেলে। শুধু তাঁরা তিনজন ছাড়া। আর মা জানত। ভিকিও না। জানলে হয়তো ওকে বোঝানো যেত।

চিংকি ফোন করে বলল ‘মা, আজ পার্টিতে কী পরে যাব?’ সেই আদুরে গলা। এমনভাবে বলছে যেন কিছুই ঘটেনি, তিনি চলে আসেননি বাড়ি ছেড়ে। শুনে গলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মন কু গাইল ‘কীসের পার্টি রে সপ্তার মাঝে?’

‘অঙ্কিত থ্রো করছে মা, প্রাইভেট পার্টি’

‘না’

‘কি না?’

‘ওখানে যেও না সোনা, আগে ছবি রিলিজ করুক, প্লিজ মার কথা শোনো, প্লিজ চিংকি’

‘কিন্তু মা’

‘কোনও কিন্তু না মা’।

‘আচ্ছা মা তুমি বারণ করলে যাব না কিন্তু একটা ফোন বারবার আসছে দুবাই থেকে, একটা ওয়েডিং রিসেপশনে এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স। হিউজ পে করবে’। থরথর করে কেঁপে উঠল শরীর। দুবাই, ওয়েডিং রিসেপশন, এক নাইট অ্যাপিয়ারেন্স– এই শব্দগুলো ভীষণ চেনা। সারাজীবন কতভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে এগুলোকে। ভীষণ মা-র অভাব বোধ করলেন এই মুহূর্তে। মা বাঘিনীর মতো আগলে রাখত তাঁকে। আর তিনি এই সময় কেন যে চলে এলেন মেয়েটার পাশ থেকে? আসলে ভিকিকে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ও মেয়েটাকে শেষ করে দেবে। কে জানে ওই হয়তো ডিল করছে। পিম্প!

তিনি শক্ত গলায় বললেন ‘সোনা, যা বলছি মাথা ঠান্ডা করে শোনো। এখন কোনও পার্টিতে যেও না, যেই ডাকুক। আর ওই নম্বরটা দাও। লিখে নিচ্ছি’ নম্বরটা লিখে অবিনাশকে ফোন করলেন কায়রা।

সাদা ফুলে ঢাকা গাড়িটা জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িতে কালো চশমায় চোখ ঢাকা চিংকি ভাবছিল মাকে এত লোক ভালোবাসত? মা তো সে হওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনও ছবি সাইন করেনি, কিন্তু বারো বছর পরে যখন করল, সে ছবি সুপার ডুপার হিট। কী একটা যেন ছিল মার মধ্যে। যেমন অভিনয়, তেমনি সৌন্দর্য। সেই মা মাত্র পঞ্চান্ন বছরে চলে গেল! মেনে নিতে পারেনি ফ্যানেরা। একজন নাকি সুইসাইড করেছে। আচ্ছা, মা কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? তাকে ঘিরে এই উন্মাদনা? এত লোকের ভালোবাসা? যাকে এত লোক ভালোবাসত, সে ভালোবাসত তাকে, শুধু তাকে?

কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, অথচ কথাটা সত্যি। তাকে বাঁচাতেই তো চলে গেল মা। ওই অদৃশ্য হাতের বিরুদ্ধে আঙুল যেই তুলবে, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হবে। অবিনাশ আংকল বলেছে সব তাকে। বাথটবে পড়ে থাকা নিস্পন্দ শরীর কাটাছেঁড়া করে কী পাওয়া গেছে, সেই তথ্য আর কখনও সামনে আসতে দেওয়া হবে না, চিংকি জানে। আর শুধু দুবাই কানেকশন নয়, তার বাবা লোকটা, মানে ভিকি মালহোত্রা এর মধ্যে আছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি ওরা মা-কে মেরে ফেলতে পারত না। অবিনাশ আংকল তাকে বলেছে ‘তোমার মার শেষ ইচ্ছে শুধু সাদা ফুল নয়। তুমি জানো কায়রা চায়নি তুমি সিনেমায় নামো। কিন্তু সে জানত একবার ঢুকলে এখান থেকে বেরনো অসম্ভব, অনেকটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। তাই সে বারবার বলেছে চিংকি যেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়, কারও হাতের পুতুল হয়ে না থাকে।’

চিংকি চোখের জল মুছে মোবাইলে একটা ফোন করে। যাকে ফোন করছে, সে ঠিক তার পেছনের গাড়িতে সাদা পাঞ্জাবি পাজামায় আপাদমস্তক শোকের প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছে। সমস্ত মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে চলেছে সে কতটা শোকার্ত কায়রাকে হারিয়ে। চিংকি ওর শোকের বুদবুদ এক লহমায় ফুটো করে দেয় একটা কথা বলে।

‘আপ মম কি ফিউনারেল মে না জায়ে তো আপকো  লিয়ে আচ্ছা হোগা। সবাই জেনে গেছে মম কীভাবে মারা গেছে। পাবলিক খুব ফিউরিয়াস হয়ে আছে। তোমাকে  ওরা ছাড়বে না।’

সেদিন চ্যানেলে চ্যানেলে চর্চার বিষয় ছিল কায়রার শেষযাত্রায় ভিকির অনুপস্থিতি। মুখাগ্নির সময় চিংকির সঙ্গে অঙ্কিতও কেন এগিয়ে এসেছিল, সেটা নিয়েও জল্পনা কল্পনা চলছে। এটাও কি নতুন ছবির প্রমোশানের মধ্যে পড়ে? খানিকটা দূরে বসে থাকা অবিনাশের মনে হচ্ছিল, কায়রাকে কি এতদিনে একটু শান্তি দিতে পারল? আর ওই জনসমুদ্র, কলরব থেকে অনেক অনেক দূরে সমুদ্রের ধারে এক বৃদ্ধ, একা একা, একটার পর একটা রঙিন বেলুন আকাশে উড়িয়ে চলেছিলেন, আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিলেন। কেউ যদি কান পাতত, তবে শুনতে পেত ‘সুববু, শুভলক্ষ্মী, মা আমার, তুই ছোটোবেলায় যে বেলুনগুলো ওড়াতে চেয়েছিলি– নীল লাল, হলুদ, ববি প্রিন্ট– সমস্ত বেলুন তোর সঙ্গে দিয়ে দিলাম। এদের সঙ্গে তুই  মনের আনন্দে  উড়ে যা।’

আপসনামা

কুড়ি পাতা দীর্ঘ আট পরিচ্ছদের গল্পটার ফোটোকপির বদলে হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ায় মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল। তবে আনন্দও হচ্ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন হলেও, এই প্রথম কেউ বাড়ি বয়ে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাও শারদ সংখ্যার জন্য। তখন কি ঘুণাক্ষরে আঁচ পেয়েছিল, এই অমল চক্রবর্তীই পুজোর পর শ্রীতমা ফোন করলে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাবে না এবং বিরাটাকার গল্পটা ‘পরিব্রাজক’-এর দফতরে না পৌঁছে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হতচ্ছাড়া নির্ঘাত অন্যত্র নিজের নামে ছাপিয়েছে।

আর একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুপ্রেম। অমলের পরম বান্ধব মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের সাথে শ্রীতমার একটা মনোমালিন্য হয়েছিল। এমন তস্করবৃত্তির প্রেরণা নিজের যশলোভ, না বন্ধুর প্রতিশোধস্পৃহা কে জানে। বন্ধুটি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সঞ্চালক, সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। সাড়ে ষাট হাজার শব্দের একটা স্বাস্থ্যকর সুপুষ্ট গল্প তার কাজে লাগবে বেশি। অবশ্য সবটাই অনুমান। হতেই পারে শ্রীতমাকে খানিকটা হয়রান করে মজা পাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। তারপর থেকে কাউকে লেখা দিলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু লেখা চাইলে দেবে না এত হুপো দেখানোর জায়গায় পৗঁছোয়নি শ্রীতমা। তাছাড়া বড়ো পত্রিকায় লেখাগুলো পড়া হয় কিনা, তাই নিয়েও সংশয় থাকে। তাই বিশ্বাস করতেই হয় কাউকে না কাউকে। যেমন এখন করছে গৌরব পাত্র নামে এক মাঝবয়সি লেখককে এবং দেবপ্রিয় দামকে।

দেবপ্রিয় দামের প্রযোজনা সংস্থায় শ্রীতমা যোগাযোগ করেছিল কন্যা ও নিজের মডেলিং-এর জন্য। সে সব কিছু না হলেও শ্রীতমার একটি কবিতার বই কিনেছিল দেবপ্রিয়। সেখান থেকেই বইটা পড়ে অমল চক্রবর্তী, শ্রীতমার কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়। সেই সূত্রেই অমলের পত্রিকা ‘পরিব্রাজক’এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু ছড়া ও কবিতা দিয়ে। অমলের বন্ধু হিসাবেই আলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। আলাপ থেকে প্রলাপ। প্রলাপের পর বিলাপ। এক সময় – শ্রীতমার তখন একুশ, কারও সাথে অ্যাফেয়ার আছে শুধু এই গুজবটুকুর জন্য ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা পূর্ণতা পায়নি। সঙ্কল্প সরে গিয়েছিল নীরবে। আজ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে সে বিবাহিতা এবং এক সন্তানের জননী – এগুলোও অধুনার প্রেমপ্রার্থীদের নিরস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এক নাছোড়বান্দা ছোকরাকে তো রুঢ়ভাবেই কাটাতে হয়েছে, কারণ ভালো ব্যবহার প্রশয় দেওয়ার সমার্থক হয়ে যাচ্ছিল। সমাজ এতটাই বদলেছে যে নিজেকে সেকেলে লাগে। অবশ্য তলিয়ে দেখলে আধুনিকতার বুলি আসলে আদিম রিপুর ছদ্মবেশ।

মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ ওর চেয়ে বছর দুই তিন বড়োই, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে পড়ে না। তবে আঁতেল সমাজে নাম লেখানো ব্যাটাছেলেদের ছোঁকছোঁকানির লাইসেন্স থাকে। প্রথম আলাপ অমল চক্রবর্তীর সাথে শ্রীতমার ফ্ল্যাটে ‘পরিব্রাজক’ সঙ্গে এনে। এক কাপ চা-ও স্পর্শ করেনি। দুর্দান্ত গরমে শরবত দিতে চাইলে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ওসব মেয়েলি ড্রিংক’। পরে শ্রীতমাও বার কয়েক রহড়ায় ওর বাড়ির আড্ডায় গিয়েছিল। ক্রমশ ফোনে কথা হলে শ্রীতমাকে মদ্যপান ও চুম্বনের ওপর থিসিস শোনানো শুরু করে।

ধরা যাক মৃত্যুঞ্জয় শ্রীতমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছে শুনে শ্রীতমা ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘তাহলে দেখা করে যান।’ প্রশ্ন এসেছে, ‘গেলে কী খাওয়াবেন?’

‘আগে খবর দিয়ে এলে আয়োজন রাখতাম। এখন না হয় চা পান করবেন টা সহযোগে। শরবত মেয়েলি পানীয় হতে পারে, কিন্তু চা তো দেখেছি আপনি ঘন ঘন খান।’

‘ধুর মশাই, আপনার কাছে গেলে চা খাব কেন? অন্য জিনিস চাই।’

বিব্রত করেই আনন্দ। সত্যি সত্যি এসে হানা দেয়নি কোনও দিন শ্রীতমাকে বাড়িতে একা পেতে।

শ্রীতমার কবিতার বই হাতে পেয়ে ক্যাটকেটে তির্যক মন্তব্য করলেও একটা দায়সারা প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দিয়েছিল। সেটা কোথাও ছাপেনি, শংসাপত্রের মতো নিজেরই সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। শ্রীতমার একখানা কবিতাও চেয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেটা চটপট ছেপে বেরোনোর পর ফোন করে বলে, ‘আপনার বইয়ের রিভিউ লেখা হল, কবিতা ছাপা হল, আমার তো কিছু প্রাপ্য হয়।’

চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠলেও ইঙ্গিতটা উপেক্ষা করতে হল, উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে।

‘আপনার লেখা তো আমার পাঠানোর অপেক্ষা রাখে না। তবে আপনার বইয়ের রিভিউ আমাকে দিয়ে করাতে চাইলে করতে পারি।’

‘আপনার ভাষায় বলি, আমি হালুম করলাম। পাওনাটাও সেই মতো হয়।’

আর ন্যাকা সেজে থাকা সম্ভব নয়। পরের দিন দুপুরে একটা বার্তা পাঠায় মুঠোফোন থেকে, ‘আপনার সহযোগিতার দাম দিতে না পারায় আমি দুঃখিত।’

সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি কল। ঝাড়া পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে বক্তৃতা উপদেশের বন্যা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ যা করে, মনে ধান্দা নিয়ে নয়। সে যে রসিকতা করেছে সেগুলো আদি রসাত্মক হতে পারে কিন্তু তাতে নাকি যৗনতা নেই। কথাটার মাথা-মুণ্ড বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নও করল না শ্রীতমা। লোকটা দর্পিত ভাবে নিজের চরিত্রের সাফাই দিয়ে গেল– ‘সঙ্গ পেলাম না বলে অন্যদের মতো আপনার লেখা প্রকাশে ব্যাগড়াও দেব না। আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতই বা দূর? সেরকম মতলব থাকলে তো বাড়িতেই যেতে পারতাম। আপনাকে একা পাওয়া কি অসুবিধার ছিল?’… ইত্যাদি। শেষে যোগ করল, ‘কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি যদি এটুকুও না নিতে পারেন, তা হলে লোকে আপনার জন্য করবে কেন?’

অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে সেদিন আমতা আমতা করে গিয়েছে শ্রীতমা। ঘণিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েও এমন কথা ঘোরাল যেন শ্রীতমার চিন্তাটাই অপরিচ্ছন্ন। জবাব খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কি এই ভয়টাও কাজ করেছিল, প্রভাব খাটিয়ে যদি শ্রীতমার সদ্য তৈরি হওয়া লেখার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেয়? ফোন রাখার পর জুতসই জবাবটা মনে মনে সাজানো গেল, ‘আপনার অশালীন রসিকতা বরদাস্ত করে আমায় এগোতে হবে না, নিজের কলমের জোরেই যত দূর পারি যাব।’ আগেও বলবে ভেবেছিল,বলেনি। এবারেও শুনেই গেল। একতরফা।

এর কদিন পরেই তার বন্ধুটি পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা নয়, ঐ বড়োসড়ো গল্পটা যাকে নভেলেটও বলা যায়, নিয়ে গিয়েছিল। পুজোর আগে পর্যন্ত ফোন করলে বলেছে, ‘আপনার কপি আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।’ কিন্তু পরে যখন অন্য সূত্রে শ্রীতমা পত্রিকাটির শারদ-সংখ্যা প্রকাশের খবর পেল, তখন অমল চক্রবর্তী ফোনের টাওয়ার পাওয়া ছেড়ে দিল।’ ‘হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছি না’ পরিব্রাজকের প্রধান সম্পাদককে ফোন করে প্রশ্ন করায় সে তো আকাশ থেকে পড়ল। এমন কোনও লেখা তাদের দফতরে জমাই পড়েনি। বিশুদ্ধ হাপিশ! অন্য কোথাও অন্য কোনও শিরোনামে, স্থান-কাল-পাত্র বদলে, লেখকের নাম বদলে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখা হয়নি। এর পেছনে তার চুম্বন রসিক বন্ধুর কোনও ইন্ধন ছিল কিনা সেটাও প্রমাণিত নয়।

তবে ব্যাপারটা শ্রীতমা, দেবপ্রিয়কে জানায়। মনে হয় দেবপ্রিয় একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। শ্রীতমাকে মডেল বা অভিনেত্রী হিসাবে না হলেও লেখিকা হিসাবে পথ খুলে দেওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তাগুলো দেখছিল। অন্তত ব্যাপারটা শ্রীতমার কাছে এমনই। সেই সাথে শ্রীতমার প্রতি মানুষটার একটা আলগা ভালোলাগা যে কাজ করছে, সেটা টের পেলেও তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয়নি। শ্রীতমাকে অপমান করেনি, ছুতোনাতায় গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেনি, রুঢ় ব্যবহারও করেনি। বস্তুত দেবপ্রিয় ফোন করলে শ্রীতমা খুশিই হয়। গলাটা বেশ আশ্বাস জাগানো।

‘হ্যালো। শ্রীতমা বলছি।’

‘আরে গুড মর্নিং। কী খবর বলুন?’

‘খবর নিতেই তো ফোন করা। ওই লেখাগুলোর কোনও গতি হয়েছে?’

‘সুখবরটা আমিই জানাতাম। তার আগেই আপনার ফোন এল। ‘পিঁপড়ের রানি’ গল্পটা বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিলাম। সুরেন্দ্র নস্কর নামে আমার এক বন্ধুরও লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওরা সুরেন্দ্রর কবিতাটা নিয়ে খুঁতখুঁত করছে, কিন্তু আপনার গল্পটা পড়েই পছন্দ করেছে। তা দেখা কবে হচ্ছে?’

‘যবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব।’

‘আরে, সুন্দরী নায়িকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটাই তো সৌভাগ্যের। কাল, না কাল একটা কাজ আছে, পরশু আসুন। আছেন কেমন বলুন। কেমন ঘুরলেন?’

‘আমার যে শনি-রবি ছাড়া বেরোনোর উপায় নেই। তাও চূর্ণীর বাবা অফিস গেলে হয়ে গেল। জানেন তো মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে হিপজয়েন্ট ভেঙে যায়। নড়াচড়া অসম্ভব। ট্রাভেল এজেন্টকে যা দেওয়া হয়েছে, তা তো ফেরত হলই না, কাশ্মীরের কোথাও কিছু না দেখে কাটরায় বাড়তি হোটেল ভাড়া গুণে ফেরার দিন পর্যন্ত বসে রইলাম। কী ভাবে যে একটা গাড়ি নিয়ে জম্মু এসে ফেরার ট্রেনে উঠেছি, তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে…!’

‘কেন, বিকেলে কী অসুবিধা?’ লোকটা মায়ের অত বড়ো দুর্ঘটনার কথা শুনেও গ্রাহ্য করল না। শ্রীতমার কথা শেষ করতে না দিয়ে এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বলছে দেখা করতে!

‘দুপুর সোয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে চূর্ণী স্কুল থেকে ফেরে। ওকে নাইয়ে খাইয়ে সব সারতে বিকেল সোয়া তিনটে ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে কার জিম্মা করে যাব? যাঁর দায়িত্বে রেখে বেরোতাম, তিনি তো নিজে পাশও ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ আয়া আছে, আছে। তারপর বাকি সময়টা আয়া তো আমিই। খড়দা থেকে বেহালা শখের বাজার– একটুখানি রাস্তা তো নয়। চূর্ণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারি, কিন্তু ও টায়ার্ড থাকে। ওর কোনও কাজ হলে না হয় কষ্ট দেওয়া যেত। তিন চারটে ট্রান্সপোর্ট চেঞ্জ করে বেহালা যেতেই হয়তো ছ’টা বেজে যাবে। ফিরতে–’

‘আরে, বাচ্চা আনলে আপনার সাথে অভিসারটা হয় কী করে? আজ পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেমালাপটাই তো হল না। চলে আসুন সময় করে।’

শ্রীতমা এবার হোঁচট খেল। ভদ্রলোক তাকে অনেকবার সুন্দরী বলেছে। চূর্ণী অর্থাৎ কাজু সম্পর্কেও প্রথম বার উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেখে যেহেতু কন্যার মডেলিং-এর উদ্দেশ্যেই যোগাযোগ, তাই রূপের প্রশংসাটা শংসাপত্র হিসাবেই নিয়েছে বরাবর। শ্রীতমাকে সংস্কার ত্যাগ করে তথাকথিত সাহসী হবার প্রস্তাব দিলেও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক মার্জিত ভাব থাকে, যে অসভ্যতা মনে হয় না। আসলে মনে হলে চলবেও না। আলগোছে এড়িয়ে না চটিয়ে যদি সখ্যতা বজায় রাখা যায়। রূপের জন্য দরাজ সার্টিফিকেট দিলেও এবং একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য অফিসে ডেকে বিস্তর আলাপ আলোচনা করলেও আজ পর্যন্ত মা মেয়ে কাউকেই কাজ করায়নি। কেবল শ্রীতমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাগ্রহে কিনে নিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই। সেই সূত্রেই পরিব্রাজক এবং জোচ্চুরি কাণ্ড।

চমক সামলে হেসে উঠল শ্রীতমা, ‘দূর মশাই, আমার প্রেমে পড়লে কি অমল চক্রবর্তীর মতো তস্করের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন? ভয়েস ওভার করার মতো মেল ভয়েস কি নেই বাজারে?’

‘অমলের সঙ্গে অনেকদিন পর কাল যোগাযোগ হল। ওই ফোন করেছিল।’

‘আমার গল্পটার খোঁজ নিয়েছেন?’

‘না, না। সেসব কথা হয়নি। সে এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ডক্যুমেন্ট্রিতে কমেন্ট্রি করে।’

‘বাঃ! চুরির পুরস্কার? ভালো। ওই যে ডোর বেল বাজছে। মেয়ে চলে এসেছে। দেখছেন, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে নীচেই নামা হয়নি। বেচারা ভারী ব্যাগ নিয়ে একাই উঠে এসেছে। ঠিক আছে…’

দরজা খুলে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিল শ্রীতমা। ‘রাখছি এখন। চূর্ণীর জন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে দেখুন না। মেয়েটাকে যে দেখে অটো-অটো করে। কিন্তু কোনও কাজই মেটিরিয়ালাইজ করছে না।’

‘ওকেও লাগবে আর একটা অ্যাডে। আগে আপনাকে কাস্ট করি। নেচার কিওরের অ্যাডে আপনাকে লাগতে পারে।’

‘আচ্ছা। ওকে খাওয়াতে হবে। পরে কথা হবে।’

‘আমি কল ব্যাক করব? ধরুন এক ঘণ্টা পরে?’

‘করুন। রাখছি। বাই।’

‘কার ফোন?’ মায়ের গলা। শোবার ঘর থেকে। এসি চালাতে হয়েছে বলে দরজা বন্ধ থাকার কথা। এখন দেখছে খোলা। বোধ হয় বাবা খুলে এসেছে।

সুন্দর মুখের জয় নাকি সর্বত্র। কিন্তু শ্রীতমার ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনা। ওর লেখা যারা পছন্দ করে অথবা যারা করে না, প্রায় সব পুরুষ কবি লেখকই, শ্রীতমা সৌন্দর্যের খাতিরে সুবিধা পাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। শ্রীতমার কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রায় নিঃশেষিত, সবটাই যদিও নিজে ফেরি করে। সেটা নাকি ওর মুখ দেখে, কবিতার গুণে নয়। এমন মন্তব্য কবি নির্মল সমাদ্দারের মতো বরিষ্ঠ মানুষেরও, যাঁর স্নেহ-ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক স্তাবক প্রতিপালিত। নির্মলকাকু যথেষ্ট সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গাত্রদাহ কীসের? ওঁর পারিষদবর্গ কুড়ি বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনে ঘষ্টেও বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে, নাকি শ্রীতমা কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখিয়ে হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বলে? কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় গল্প বার হওয়ার কথা জানলেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েও বেশির ভাগ কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বয়ং কবিতার বইয়ের প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তোমার বই বি ডাবল ও কে – বুক দেখে বিক্রি হয়নি, হয়েছে বয় হ্রস্ব-উ ক – দেখে।’ মাথাটার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও না বোঝার ভান করতে হয়।

শ্রীতমার হাবেভাবে মাঝেমাঝে একটু অপরিণত মনস্কতা ফুটে ওঠে। নিজেও বুঝতে পারে। কাউকে তোয়াজ করে না, বরং একটু অসহিষ্ণু, কিন্তু লেখার জন্য ব্যকুলতা গোপন থাকে না। এটাই কি অপমানের আমন্ত্রক? এ যাবৎ দেবপ্রিয় দামকে তো হিতৈষী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ কথাবার্তায় এমন লাগাম ছাড়া ভাবগতিক? এর সাথেও সম্পর্ক টিঁকলে হয়। দেবপ্রিয় চেয়েছিল বলেই কয়েকটা লেখার ফোটোকপি দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকেই একখানা ‘বাল্যবন্ধু’-তে প্রকাশিতব্য। গল্পটা সন্ধ্যাতারাতেও মনোনীত, কিন্তু কত বছর পরে ছাপবে কেউ জানে না। ‘বাল্যবন্ধু’ টাকা না দিলেও চটপট বার করে দেবে। এই অবস্থায় দেবপ্রিয়কে অসন্তুষ্ট না করাই মঙ্গল।

সারা দিন নানা কাজের ব্যস্ততা, রাতে আয়ার বদলে নাইট ডিউটি। ব্যস্ততার মধ্যেও খচ্খচানিটা বিঁধে রইল। রাত বারোটায় ফোন।

‘বলুন।’

‘বড্ড অসময়ে ফোন করলাম না? কথা বলা যাবে?’

‘এতক্ষণে আপনার এক ঘণ্টা হল? অসময় তো বটেই, বলুন।’

‘নাথিং স্পেসিফিক। ওই নেচার কিওরের অ্যাডটার ব্যাপারে আপনাকে একবার আসতে হবে। পেমেন্ট বেশি নয়। হাজার টাকা। ডাবিংও করতে হবে। ডায়ালগ আছে। ওরাই শিখিয়ে দেবে। এমন কিছু নয়। আপনার আবার উইক-ডে-তে প্রবলেম। একটু দুপুর করেও যদি আসতে পারতেন। ঠিক আছে শনিবারেই আসুন।’

‘বেশ কয়েকবার তো দেখলেন। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মেটিরিয়ালাইজ করল না। আবার বেকার দৌড়াদৗড়ি না হয়। তাছাড়া শনিবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কয়েকজনকে লেখা দিতে হবে।’

‘কখন যাবেন?’

‘বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোতে হবে।’

‘তার আগেই আমার সাথে দেখা করে যান না। কাজটা ফেলে রাখতে চাই না। আর আপনাকেও অনেক দিন দেখিনি।’

শ্রীতমা নিরুত্তর।

‘কিছু বলছেন না যে।’

‘শনিবার আসুক, দেখব।’

‘শনিবার তো কাজের কথা হবে। একটু অকাজের কথাও তো হওয়া দরকার। আমার তো আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা ইনোসেন্স আর সেক্স অ্যাপিলের দারুণ কম্বিনেশন। আর এখন কাশ্মীর থেকে ফিরে কাশ্মীর কি কলি হয়েছেন কিনা দেখতে আরও ইচ্ছা করছে।’

‘আপনার কি মনে নেই যে আমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কাশ্মীর ঘোরাই হয়নি? তাছাড়া শর্মিলার তখন বয়স ছিল ষোলো সতেরো। আমি এখন চল্লিশ। এই ভুঁড়িদার চেহারা আপনার ফ্যান্টাসির সাথে মিলবে না।’

শ্রীতমা ওপাশে কোমরতলি ভাঙা মায়ের দিকে তাকাল। এখনও ঘুমোয়নি। মেয়েটাও দিদা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে উশখুশ করছে। ওর গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েই বিপত্তি। জানলাহীন বসার ঘরে উদ্ভব মশা তাড়ানো তরল জ্বালিয়ে শুয়ে আছে। এমনিতে মশারি ছাড়া শুতেই চায় না। ফ্ল্যাটের একমাত্র বাতানুকুল ঘরখানা শাশুড়ির জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে কষ্ট করছে। মাকে গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়াও বাথরুম ইত্যাদির ব্যাপারেও যেভাবে শ্রীতমাকে সাহায্য করেছে, নিজের ছেলেও পারে না। কলকাতায় ফিরে অবধি তার বিশ্রাম নেই। গাড়ি অ্যাম্বুল্যান্স দৌড়াদৌড়ি তো আছেই, জটিল অপারেশনের অনেকটা খরচই আপাতত উদ্ভব দিয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসা বিমার টাকা না পেলে ফেরত নেবে না পণ করে আছে। সারা দিন অফিস ডাক্তার ওষুধ-পত্র করে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে বসে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই ঘরের বাতাস ওর নাকের গর্জনে মন্দ্রিত হতে থাকে। মেয়ে বাবাকে পাশে না পেয়ে ঘুমোবে না বলে একদিন এই গরমের মধ্যেই বসার ঘরের সরু ডিভানে পাশে শুয়ে উদ্ভবকে সারা রাত এক কাতে রেখেছিল। আর শ্রীতমা!  অসুস্থ মাকে আর মেয়েকে পাশে নিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে মাঝরাতে পরপুরুষের সঙ্গে হেজাচ্ছে? কীসের জন্য? ক্যামেরার সামনে আসার তাগিদটা তো মরেই গেছে, তবু সুযোগ এলে না করতে পারে না বলে? নাকি তার লেখা কবিতা গল্পগুলো যাতে মাঝপথে হারিয়ে না যায়, সেই দুর্ভাবনায়? ওর তো এক্ষুনি ফোন কেটে দেওয়া উচিত। মায়ের নাক বিরতি দিয়ে ডাকছে। কাজু চুপচাপ শুয়ে। উদ্ভবের নাকের শব্দ মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘর থেকে আসা সেই আওয়াজ শ্রীতমাকে কিছুটা আশ্বস্তর সাথে অনেকটা অপরাধবোধে বিক্ষত করছে।

‘কোথায় ভুঁড়ি? ওটুকু না থাকলে তো আইটেম গার্লদের বাজার পড়ে যেত। ওই পেটের নাভিতে চুমু খাওয়াতেই তো মজা।’

‘হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক?’ গলাটা চড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে গলা নামিয়ে আনল শ্রীতমা। ‘এরকম সর্বনেশে ইচ্ছা হলে তো আপনার সাথে দেখা করাই চলবে না। রাখছি।’

‘এতেই সর্বনাশ বললে কী করে হয়? একটু ইনহিবিশন ত্যাগ করে দেখুন, আপনারও ভালো লাগবে। আর আমি ড্রিংক করি না। যা বলছি পরিষ্কার মাথাতেই বলছি।’

‘পরে কথা হবে গুড নাইট।’

‘গুড নাইট। শনিবার আসার আগে ফোন করে নেবেন। দেখি বাল্যবন্ধু যদি ছাপায় তাহলে জানাব।’

বালিশের ফাঁকে চলভাষ ঢোকানোর পর মায়ের প্রশ্ন, ‘কার ফোন তপা?’

‘আমার কয়েকটা লেখা আছে এর কাছে। আসলে প্রযোজক। আবার হোটেলও আছে শঙ্করপুরে। এখনও পর্যন্ত তোমার নাতনিকে বা আমাকে কোনও কাজ দেয়নি। তবে কয়েকটা পত্রিকায় যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রে আমার একটা ছোটোদের গল্প বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিল। শুনছি এ মাসেই বেরোবে।’

‘এত রাতে ফোন করে কী এত বকছিল?’

‘আমার মতো বেকার তো নয়। সারা দিন ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত। শুটিং-ফুটিংও থাকে। কখনও কখনও সারা রাতই হয়তো জেগে থাকতে হয়।’

মনটা আবার খচ্খচ্ করছে। লোকটা বলল শনিবার যাওয়ার আগে ফোন করতে। তাছাড়া আগে বলেছিল ‘বাল্যবন্ধু’-তে গল্প বেরোচ্ছেই। এখন ‘যদি’ যোগ করল কেন? এভাবে ‘গুড নাইট’ বলে ফোন কেটে দেওয়া কি ঠিক হল? মৃত্যুঞ্জয়ের উপদেশ মনে পড়ল। সামান্য রসিকতাও যদি না নিতে পারে তাহলে লোকে আনস্পোর্টিং ভেবে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেবে। দেবপ্রিয়র মতো একজন হিতৈষীর রসিকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানানোটা কি ঠিক হল? নির্ঘাত রসিকতাই। লোকটার বউ আছে, ছেলে আছে। আর অমন ডাকসাইটে প্রযোজক চাইলেই অনেক অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে। হয়তো শ্রীতমার জন্য সত্যিই একটু কোমল জায়গা আছে, অমলের জোচ্চুরির জন্য একটা সংকোচবোধও আছে। কলকাতায় ফিরে এসে শ্রীতমাই তো ফোন করে জানল যে দেবপ্রিয় তার লেখা পাঠিয়েছে যেটা ছাপতেও চলেছে। লোকটা তো পাওনা গণ্ডার হিসাব বুঝে নিয়ে কাজটা করেনি। আজ সকালে শ্রীতমা ফোন না করলে এখন এতসব কথা হতোই না। প্রার্থী যদি তেজ দেখায়, তাহলে ‘নিশ্চিত’ প্রকাশিত হচ্ছেগুলো ‘যদি তবে’র গেরোয় পড়ে যাবে। মাথার বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একটা ‘স্পোর্টিং’ বার্তা পাঠাল, ‘সর্বনেশে কথা শুনতে মন্দ লাগে না, যদি সেগুলো কথার জায়গাতেই থাকে।’

মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরতি দুটো বার্তা। টুংটাং টুংটাং। ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে, আমার আঙুলের আর ঠোঁটের আদর রইল ওই বুকে আর নাভিতে। যদি এসএমএস করার থাকে এক্খুনি করুন। সকালে ফোন সুইচ অন করার পর আর কারও চোখে পড়লে অসুবিধা আছে।’

কান-মাথা গরম হয়ে গেল। শ্রীতমার চলভাষ সারা রাত জাগ্রত থাকে। যা কোনওদিন করে না, তাই করল আজ– সুইচ অফ।

‘কাকে মেসেজ করলে মা?’ কাজু জেগে আছে!

সত্যিই কি শ্রীতমার এই লোকটার সাহায্য দরকার? সে ‘সন্ধ্যাতারা’য় যেসব গল্প ও ছড়া দিয়ে এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো মনোনীত হবার চিঠি পেয়েছে জমা দেওয়ার এগারো মাস পরে। তার পরেও সাত মাস পেরোল। পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আরও অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পটাও মনোনীত জানল তখন, যখন সেটা অন্যত্র প্রকাশ পেতে চলেছে। এখন সন্ধ্যাতারার ভরসায় বাল্যবন্ধু থেকে গল্পটা তুলেও নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্য মাত্রা ছাড়ানো, মুখোশ খোলা পুরুষটাকে টুইয়ে চলা? ছিঃ!

কিন্তু কিছু প্রাপ্তির জন্য একটু উদার হওয়ার অভিনয় কি খুব দোষের? গত দু বছরে এইভাবে শ্রীতমা অনেককেই শত্রু করেছে। তাদের ক্ষেত্রে সরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তারা আগেই নিজেদের পাওনাটা আদায়ের তালে থাকত। দেবপ্রিয় কি একটু ব্যতিক্রম নয়? এই লোকটাকে যে ভালো মানুষ বলে শ্রীতমা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একটা নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। এই সময় সব কিছু একদিনের ফোনের বাচালতায় নষ্ট করে ফেলতে হবে? নিশ্চই দেবপ্রিয় দাম নিজের কাঁচা আবেগ দেখিয়ে ফেলার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো দেখা হলে ঘুণাক্ষরেও এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে না। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজা পুরুষ যেমন আছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার মতো ভদ্রলোক কি ও দেখেনি ট্রেনে বাসে? কিন্তু….?

মা বোধহয় এখনই বেডপ্যান চাইবে। নড়ছে। মেয়ে কচি হাতে গলায় বেড় দিয়ে গায়ে পা চাপিয়ে বলল, ‘মা, তুমি শুধু গল্প লিখে যাও। আমায় বলো না।’

সকাল বেলা আয়া আসার আগে যথারীতি মাকে বেডপ্যান দিতে হল। শ্রীতমা দু জোড়া একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাভস্ বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে। একটা ও নিজে পরে আর একটা যে আয়া আসে তাকে দেয়। আয়া থাকলে রান্নার মেয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। একটু হাতে হাতে সাহায্য করলে নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। তবু পুরোনো রান্নার মহিলা এসে টুকি দেওয়ায় হাতছাড়া করবে না বলে তাকেও বহাল করেছে এই বিপুল খরচের মধ্যে। উদ্ভবই বলেছে।

সকালে বর বেরিয়ে যেতে কম্পিউটারে বসেছে শ্রীতমা লেখা নিয়ে। মাঝে কয়েকদিন খুব উঠে পড়ে লেগেছিল মেয়ের মডেলিং কেরিয়ার গড়বে বলে। নিজেরও ছবি পাঠিয়েছে কয়েক জায়গায়। কেউ ঘরোয়া ছবি চায়, তো কেউ পোর্টফোলিও। বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এখন সে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। এখন ও লেখালিখি নিয়েই ভাবতে চায়। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদক্ষেপে আপোস। মাঝারি পত্রিকাও ভাব করে যেন বিশাল কিছু। তারা কেউ লেখার শিরোনাম বদলে দেয় তো কেউ কবিতার পিণ্ডি চটকে প্রকাশ করে। কেউকেটা নয় বলে অপছন্দসই সম্পাদনাও মাথা পেতে নেয়। আর শ্রীতমার গল্পের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েও গৗরবদার যা মেজাজ। খোঁজ নিলেই বলেন, তাড়া থাকলে লেখা তুলে নাও।

শ্যামের বাঁশি। দেবপ্রিয় ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে।

‘তাহলে শনিবার আসছেন তো।’

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ফোনটা ড্রিম শেয়ার করছে না দেবপ্রিয় করছে?’

‘দু জনেই। কাজ তো আছেই। প্রেমটাও আছে।’

‘….আসলে আমি একটা ট্রাভেলগ লিখছি। সিকিম ভ্রমণের ওপর। কাশ্মীর দর্শন তো রসাতলে গেল। লেখাটা রবিবারের মধ্যে শেষ করতে হবে, মানে শনিবার বেরোলে অসুবিধা–’

‘আচ্ছা, আপনি লেখার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, না? আমায় দেখতে ইচ্ছা করে না? আর আপনি কমিট করাতেই কিন্তু অ্যাডটা নিয়ে এগিয়েছি।’

লোকটা নিজের টপিক থেকে সরছে না। একটু চুপ করে থেকে শ্রীতমা বলল, ‘যেতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। কলেজ স্ট্রিটে যেতেই হবে।’

লেখার প্রবাহ ঝিমিয়ে গেল। যেচে বিপদ ডেকে আনছে না তো। উদ্ভবকে জানাতে হবে। একটা ছোটো পত্রিকায় শ্রীতমার খাতিরে দেবপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর উদ্ভব ঠাট্টা করেছিল, দেবপ্রিয় দামকে বিয়ে করলে তোমার বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু ইদানীং রাত বিরেতে ফোন এলে বিরক্তি চাপা থাকে না। এতদিন পরস্পরের অনুরাগী বা অনুরাগিনীদের নিয়ে দুজনে খোঁচাহীন নির্দোষ রসিকতাই করে এসেছে। মাঝে মাঝে শ্রীতমাই কপট সন্দহের ভান করে। বারো বছরের দাম্পত্যে কোনও দিন তৃতীয় ব্যক্তি বা সন্দেহের মতো বিষয় দানা বাঁধেনি। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি লিপ্সার অপরাধে কি সিনেমা সিরিয়ালে এই বহু ব্যবহূত ক্লিশে বিষয়টার অনুপ্রবেশ ঘটছে? শ্রীতমার একটাই জোরের জায়গা সে বরকে কিছুই গোপন করে না। নিজের পুরোনো কিছু একতরফা অন্ভুূতির কথা লুকোয়নি। কেউ বিরক্ত করলে তো নয়ই। কিন্তু কিছু পাবার আশায় এভাবে? ঠিক পাওয়ার আশাও নয়, যেহেতু একটু সহযোগিতা পেয়েছে তাই সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও ভদ্রতায় বাধছে। নাঃ! পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরার খেলা ওর জন্য নয়।

মা কিচ্ছু খাচ্ছে না। শরীর ভয়ানক দুর্বল। অন্যের হাতের রান্না পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই অনশনে শরীর আরও বিগড়োলে কে দায়িত্ব নেবে? বাবা? থাক, তার কথা না বলাই ভালো। একেই সারাটা দিন অস্বস্তি আর উশখুশানির মধ্যে কাটছে। দুপুরে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকাটা শ্রীতমার ভীষণ প্রিয় ব্যাপার। অনেক অশান্তি অতৃপ্তির উপশম ঘটে বুকের ওপর ছোট্ট হাতের স্পর্শে, পেটে তুলে দেওয়া আলতো পায়ের চাপে। আজ যে এতেও স্বস্তি হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আদর করল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ‘বুজকু-বুজকু, মাম্মাম্ মাম্মাম্’ গন্ধ নিল। তবুও না।

বাড়ির যা অবস্থা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বরের সঙ্গে দুটো কথা বলারও অবকাশ ঘটছে না। ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট-রিপোর্ট, মেডিক্লেম, আয়া, ঝি, রাঁধুনি এসবের ফাঁকে কাজুর পড়া, ইউনিট টেস্ট, উদ্ভবের অফিসে আবার ট্রান্সফারের গুঞ্জন। বেশ হয় কলকাতার বাইরে বদলি হলে। যে নগরটিকে নিজের কেরিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একদা গন্তব্য আর বর্তমানে আশ্রয় করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। লেখালিখির জগতে সেরা রাজনীতিকরা বিরাজমান। পৃষ্ঠ দংশন, লেঙ্গি মারা, ঈর্ষা, হরেক কিসিমের নোংরামি। এসবের মধ্যে টিঁকে থাকার চামড়া বা কৗশল কোনওটাই শ্রীতমার নেই। আবার এমন বিরাট মাপের প্রতিভাও ও নয়, যে পর্বত সরিয়ে জায়গা করে নেবে। আর এত দৌড়েই বা কী হবে? পারবে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রাদের মতো বছরে ডজন ডজন গল্প, সাত আটখানা করে উপন্যাস, ছোটোদের গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে, যদি তেমন বরাত পায়ও? আসলে পারবে না ভাবলেই কান্না পায়।

উদ্ভব আজকাল শ্রীতমার দেহের ভাষা খেয়াল করে না। একটা ভালো মতো চটকাই মটকাই দিলেই পাগলি বউটা শান্ত হয়ে যায়, ভালো করেই জানে। তবু কেন যে না দেখার ভান করছে? আগে বউয়ের সামান্যতম ভাবান্তরও ওর নজর এড়াত না। কোনও দিন কোনও কথায় আহত হলে শ্রীতমা যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, ও যে রাগ করে আছে এটা ইঙ্গিতেও প্রকাশ করতে হতো না। এখন ওর চূড়ান্ত অস্থিরতা, বিরক্তি কোনওটাই যেন চোখে পড়ছে না। উদ্ভবের মতো মানুষ বছরের পর বছর পারে নিস্পৃহ থাকতে। শ্রীতমা এগিয়ে না গেলে এমনটাই চলতে থাকবে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই। ঘুমের মধ্যে কখনও স্ত্রী-র ঘনিষ্ঠ হবার অনীহা প্রকাশ পেলে মাসের পর মাস আর কাছে আসে না। এখন তো বাড়ি ভর্তি মানুষ। পালানোর অনেক পরিসর। কিন্তু শ্রীতমার যে আদর ছাড়াও আশ্রয় দরকার এই সংকটে।

উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে আজকাল ডিভানে খানিকটা ঠেকের ব্যবস্থা করে দিলে সন্ধে বেলায় টিভি দেখতে পারে। বাবার দখলে রিমোট থাকে। তাই নিয়ে এক দিকে স্ত্রী আর এক দিকে নাতনিকে যুঝে চলে। গ্লোকোমা আক্রান্ত চোখ দিয়ে একটা মানুষ এত টিভিই বা দেখে কী করে, আর এত বই-ই বা পড়ে কী করে? শ্রীতমা বরকে ছোটো ঘরটায় ডাকল, ‘শোনো।’

‘কী?’

‘তুমি তো এখন আমার সাথে কথা বলার সময়ই পাও না। গলা ধরে এল।’

উদ্ভবের ভাবান্তর নেই।

‘ওই দেবপ্রিয় দাম। …এতদিন তো বেশ নিঃস্বার্থ হিতৈষীই মনে হচ্ছিল। এখন দুটো লেখা দুটো পত্রিকায় পাঠিয়েই গলার সুর বদলে গেছে। তাও তো রবিবারের ‘হট্টমেলা’ থেকে পরমার্থ সেনের কাছে ঠোক্বর খেয়ে তো ছড়াটা বাউন্সই করেছে। ‘বাল্যবন্ধু’-তে’ পাঠানো গল্পটাও এখন দেনা পাওনায় আটকে যেতে পারে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নেমে এল।

‘পৃথিবীতে একশো জনের মধ্যে নববইজন পুরুষ মেয়েদের একই রকম নজরে দেখে। তুমি যদি বোকা সেজে থাকো আমার কী করার আছে? তুমি কম্প্রোমাইজ করে লেখিকা হতে চাও না নিজের জোরে, সেটা নিজেই ঠিক করবে।’

‘একটা অ্যাডে কাস্ট করার কথাও বলছিল।’

‘তাহলে আর কী? যা ইচ্ছা করো। যে লোক রাত সাড়ে বারোটার সময় কোনও ভদ্রমহিলাকে ফোন করে গ্যাঁজায়, সে কী ধরনের মানুষ তা যদি তুমি এই চল্লিশ বছরেও না বোঝ, তাহলে কিছু বলার নেই।’

‘সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ফিল্ম লাইনের লোক। সারা রাত জেগে থাকাটাও স্বাভাবিক।’

‘তাহলে আমায় প্রশ্ন করছ কেন?’

‘আর কাকে করব?’

‘আমার উত্তর তো আমি দিয়েই দিয়েছি। জাস্ট যোগাযোগ রাখবে না। নম্বরটাই ডিলিট করে দাও। ফোন এলে রিসিভ কোরো না।’

‘বলছিল এই জুনেই বাল্যবন্ধু-তে বেরোবে। অন্য দিকে ‘সন্ধ্যাতারা’য় লেখা জমা দেওয়ার এক বছর পর চিঠিতে কনফার্ম করার পরেও সাত মাস পেরিয়ে গেল। শুনছি পুজো পর্যন্ত সব সংখ্যা তৈরি। তারপর ভূত-স্পেশাল। কবে আমার গল্প বেরোবে কোনও ঠিক নেই। লিটল ম্যাগগুলোতেও দলাদলি। ‘দিনকাল’-এ যে আমার গল্প ছাপল অজস্র ভুল করে, সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে গল্পের বারোটা বাজিয়ে। বড়ো পত্রিকা বলে ওরা চাইলেই আমি আবার লেখা দিতে এক পায়ে খাড়া– এটা কম্প্রোমাইজ নয়? তাই এই লোকটাকে চটাতে পারছি না। লেখার কয়েকটা জায়গা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েন্শিয়াল…’

উদ্ভব উত্তর না দিয়ে স্নানঘরে চলে গেল।

শনিবার কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বাস ধরল। ট্রেন জার্নিটা ভিড়ের জন্য এড়াতেই চায়। তাছাড়া স্টেশনগুলোর চত্তরে বড়ো কটু গন্ধ। শহর ও শহরতলির সমস্ত রাস্তা ঘাটই অবশ্য পুরুষ মানুষের জল বিয়োগ ক্ষেত্র। এই গন্ধের জন্য হাঁটতে চলতে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে প্রাণায়াম করে যেতে হয়। সময় অনেক বেশি লাগলেও তাই বাসটাই ধরতে চায়। বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। এখন বেহালা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফোন।

‘আসছেন তো?’

‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনের সপ্তাহে না হয় উইক ডে দেখেই সময় করে যাব।’

‘নেচার কিওয়ের অ্যাডটাও তো ফাইনাল করা দরকার। পরের শনি নয়তো রবি শ্যুটিং। আজই ফাইনাল করে নিতাম।’

‘আ..চ্ছা। আমার কিন্তু দেরি হবে। আর যখন পৌঁছোব, তখন বসার সময় বেশি থাকবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মিনিট পনেরো থেকে আধ ঘণ্টার ডিসকাশন।’

‘আপনার অ্যাড দেওয়া ‘ক্রমাগত’টাও অবশ্য সঙ্গে রয়েছে।’

‘ওটা এমন কিছু না। আপনি আসুন।’

দোনোমনো করে শ্যামবাজারে নেমে মেট্রো ধরল। কালীঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে বা টানা বাস পেলে বেহালা শখের বাজার। আজ কফি হাউসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। একটা পত্রিকা হাতে পাওয়ার কথা, আর দুটোতে লেখা দেওয়ার। আর শনিবার গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। লেখার পরিসর বাড়তে পারে। নিছক আড্ডা মারতে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাছাড়া ওই মাছের বাজারকে মাত দেওয়া শোরগোলে গলা তুলে কথা বলায় কোনও সুখ নেই। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য শ্রীতমাকে ধান্দাবাজ ইঙ্গিত করে।

শখের বাজারে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। জেমস্ লং সরণি পেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গলির ভেতর হাঁটলে, তবে মহাশয়ের বাড়ি তথা দফতর। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ পেল। মোবাইল কোম্পানির বা অন্য কোনও প্রমোশনাল মেসেজ হতে পারে। দেখা হল না। জৈষ্ঠের আকাশে আলো ম্লান হয়নি তখনও। আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিটটাও ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করবে।

গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দারোয়ানকে বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হয়। অফিসের রিসেপশনের মতো জায়গাটা ফাঁকাই দেখেছে এযাবত। ভেতরের ঘরে বসে মালিক। দারোয়ান দোতলার অফিসের বাইরের ঘরে শ্রীতমাকে বসিয়ে তিনতলা গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার চান করছেন। এক ঘণ্টা বসতে হবে।’

পাঁচবার ফোন করে ডেকে এনে এ কী রসিকতা! ফোন বার করে দেখল রাস্তায় আসা মেসেজটা দেবপ্রিয়ই করেছে। সেটা না পড়ে অসহিষ্ণু ভাবে ফোন করল। দূর! বাথরুমে গেলে কি মোবাইল ধরতে পারবে? অবশ্য বাড়ির লোক ধরতে পারে। কাটতে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে পরিচিত গলা, ‘হ্যালো। কোথায়?’

‘আপনার অফিসে। কিন্তু আমাকে ডেকে আপনি এখন কী করছেন?’

‘স্নান করছি। মিনিট পনেরো কুড়ি বসুন।’

‘আমার তাড়া আছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

লাইন কেটে মেসেজটা পড়ল। ‘আজ আমার আঙুল আর ঠোঁট– আদরে পাগল করে দেবে ঠিক তো?’

চড়াং! কাজের দোহাই দিয়ে ডেকে এনে বাথরুম থেকে পরনারীকে এই বার্তা? এরপর বসে থাকার একটাই অর্থ হয়। তরতর করে নীচে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রীতমা, ‘আমায় বেরিয়ে যেতে হবে। একটা বই আপনার স্যারের জন্য রেখে যাচ্ছি। এক টুকরো কাগজ দিতে পারবেন? চিঠি লিখে দিয়ে যাব।’

কাঁপা হাতে নোটপ্যাডের পাতায় লিখল, ‘দেবপ্রিয়বাবু, আজ আমার পক্ষে অপেক্ষা করা আর সম্ভব হল না। ‘ক্রমাগত’র কপি রেখে গেলাম। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এসএমএসটা আমার সঙ্গে রইল।’

এর আগের বার্তাগুলো মুছে ফেলেছে। এটাকে না মুছে একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখবে। ভাগ্যিস লোকটা স্নানে ঢুকেছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটল ডায়মন্ড হারবার রোডের দিকে। বড়ো রাস্তায় পৗঁছেই একটা ডাবের খোলায় হোঁচট খেয়ে সপাটে আছাড়। সর্বনাশ! বাড়ির এই অবস্থায় ওরও কিছু হলে আর দেখতে হবে না। বাঁ হাতের কবজির ষন্ত্রণায় প্রথমটায় খেয়াল করেনি তালুটাও সামান্য ছড়ে গেছে।

সাড়ে ছটা। এখন আর কফিহাউস নয়। সোজা বাড়ি। সামনে যে বাস এল তাতেই চড়ে পড়ল। শিয়ালদা যাচ্ছে। ভালোই।

বাসে পরের স্টপেই জায়গা পেল মহিলা সিটে। তবে জানলার দিকে নয়। বসতে না বসতেই আবার চলভাষে সুরধবনি। কাঁপা হাতে ফোন ধরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন।’

‘কী বলি বলুন তো। কীভাবে স্যরি বলব?’

‘বলতে হবে না। শুধু বুঝুন বেকারদের সময়ও দামি। আর স্যরি যদি বলতেই হয়, আপনার মেসেজটার জন্য বলুন।’

‘মেসেজ মানে? ওহ্! হো হো হো! এই ব্যাপার? হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন? এতদিন তো…’

‘এতদিন কী? আপনার রসিকতাকে রসিকতা হিসাবেই দেখেছি।…’

‘এভাবে পৃথিবীর সাথে মানাবেন কী করে? সুমনের একটা গান আছে, …। আমার নিজেরও একটা কবিতা আছে, শুনবেন…’

‘…নিজের ই-ইল্লিসিট ইচ্ছাকে …র-র্যাশনালাইজ করার জন্য হাজারটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। আর নেচার কিওর অ্যাডটার জন্য বোধহয় আমাকে আর দরকার লাগবে না।’

‘ওটার জন্য তো আপনার সিলেকশন হয়েই আছে। আপনি এখন নিজে রাজি না থাকলে–’

‘প্রফেশনালি কাজ তো হবার নয়।’

‘আপনি চাইলেই হতে পারে।’

ছিছিঃ! শ্রীতমা এখনও লোকটার মুখের ওপর উচিত কথা না শুনিয়ে নিজেকে খেলো করে যাচ্ছে? নিজের লেখায় যে এত আপসহীন, এত সাহসী, এত অকপট, লেখাগুলোর প্রতি অপত্যস্নেহে সেই মানুষ এত দুর্বল? দেবপ্রিয় দামের কত বড়ো হাত?

‘চুপ করে আছেন যে?’

‘আপনার সঙ্গে এখনও কথা বলছি, ইজন্ট ইট স্ট্রেঞ্জ? সুরেন্দ্র নস্করের কাছেও কি একই এক্সপেক্টেশন রাখেন?’

কী জবাব এল বোঝা গেল না বাসের আওয়াজে। বোধহয় সুরেন্দ্র আর শ্রীতমা এক নয় সেটাই বোঝাতে চাইল।

‘ওই ভদ্রলোক আপনার বন্ধু। তিনি ভাগ্যবান। বিকজ ইউ আর নট আ গে আই থিংক। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেন না। গিভ এ্যান্ড টেক চলে এল। আমি দেখতে ভালো, এটা কি আমার দোষ?’

‘ও হো হো হো। আচ্ছা, আপনি সুন্দর কে বলেছে? কতজন বলেছে?’

মনে হল সপাটে গালে চড় পড়ল। দাঁত চিপে বলল, ‘অনেকেই। আর একজন মিথ্যুক তো অনেকবার বলেছে।

আবার হাসি, উপদেশ। খেলো মেলোড্রামা ভরা স্থূল বার্তা পাঠিয়ে এখন এমন ভাবে হাসছে যেন শ্রীতমার মতো অপরিণত মেয়ে আর হয় না। এখনও কেন লোকটাকে বাজে বকার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে? কেন গল্প, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগা ঋজু চরিত্রের মানুষের মতো কড়া কথা বলে ফোন কেটে দিতে পারছে না? অ্যাড ফিল্ম না বাল্যবন্ধু পত্রিকা? দুটোই তো গেল। নাকি নিজের বোকার মতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার মরিয়া চেষ্টা, বন্ধুত্বের লোভ?

কথা যখন শেষ হল তখন খেয়াল করল, তার ডান কাঁধে ভর দিয়ে তার গোপন অঙ্গটিকে একরকম শ্রীতমার কাঁধে চেপে ধরে জুত করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীতমা ফোন কেটে সচকিত হতেই জানোয়ারটা ঝট্ করে সরে গেল।

‘ইতর কোথাকার! কেটে ফেলতে হয়! বাসে কী এমন ভিড় যে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যায় না?’

ঘেন্নায় অপমানে উদ্গত অশ্রু সামলাতে গিয়ে গলা কন্কন্ করে উঠল। শ্রীতমা সত্যিই অপরিণত। তার বয়সি মহিলাদের সাথে বাসে ট্রেনে এমন বজ্জাতি করার সাহস চট্ করে দেখানো যায় না। ও একাই চেঁচিয়ে গেল। বাসে কেউ কিছু বলল না। কন্ডাক্টর বোবা।

দেবপ্রিয়র প্রতি আর কোনও বিদ্বেষ নেই। বাসের এই নরকের কীটটা দেবপ্রিয়র মতো বুকে পেটে চুমু খাওয়ার আবেদন করেনি। সুযোগ বুঝে নিজের নোংরা প্রত্যঙ্গটা ওর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পোশাকের আবরণ সত্ত্বেও ঘেন্না আর রাগে গা রিরি করছে।

যে মানুষটা দু বছরের পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রীতমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো মতলবই করেছিল, সে তো স্নান করে পরিষ্কার হয়ে তৈরি হচ্ছিল অভিসারের জন্য। নৈতিকতার খাতিরে তার কাছ থেকে সব সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এসে ভাগ্যের কাছে কী প্রতিদান পেল?

অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসের জানলা দিয়ে ভেসে আসা উন্মুক্ত পুরুষ ইউরিনালের গা গোলানো দূষিত গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারছে অনুমতির তোয়াক্বা না করে।

সময়ের স্রোতে

অভিকে গেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে মানস গাড়িতে উঠতে যাবে, গেট খুলে দৌড়ে এসে অভি মানসের হাত জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি যেও না বাবা, প্লিজ এখানেই থেকে যাও… তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না…।’

‘আসছে রবিবার তো আবার আসব অভি। প্রতিবারই তো আসি’, মানস অভির গালে আলতো টোকা দেয়।

‘না, তুমি অনেকদিন পর পর আসো। তোমার কথা খুব মনে হয় বাবা, বন্ধুরাও সব সময় তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। তুমি আমার স্কুলেও কখনও আসো না। অন্য বন্ধুদের বাবারা তো সবাই আসে… তাহলে তুুমি কেন আস না বাবা?’

মানস ওর আট বছরের ছেলের অজস্র প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। যে প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজেই ঠিকমতো জানে না মানস। ছেলেকে সেগুলোর উত্তর কীভাবে দেবে? মানস বুঝতে পারে না এইভাবে আর কতদিন ও ছেলের কাছে সব চেপে যেতে পারবে?

‘আমি আবার আসব অভি। তুমি তো খুব ভালো ছেলে সবকিছুই বোঝো। এরকম জেদ কোরো না। এখন লক্ষ্মী হয়ে উপরে যাও। আমি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখব। তখন আমরা খুব মজা করব।’

‘কিন্তু মজা কী করে হবে? মা তো ওখানে থাকবে না।’

‘অভি, এখন তুমি উপরে যাও। পরে আবার তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানস গেট খুলে অভিকে লিফটে ঢুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। চাবি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসল। একই শহরে থাকলেও দুটো বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই। তা-সত্ত্বেও প্রতি রবিবার মানস অভিকে নিয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরোয়।

মানস একটা বড়ো কোম্পনিতে বড়ো পদে রয়েছে ওর উপরে বড়ো দায়িত্ব ফলে কাজের ব্যস্ততার সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরও করতে হয় ওকে। দশ বছর আগে মধুমিতার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। বিয়েটা লাভ ম্যারেজই ছিল। একসঙ্গেই দুজনে এমবিএ পড়েছিল এবং প্রেমটা ওদের সেখান থেকেই। মিশুখে, সুন্দরী এবং ফ্যাশনেবল মধুমিতাকে দেখেই মানস ওর প্রেমে পড়ে। এমবিএ কমপ্লিট করার আগেই ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে দুজনেই ভালো চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়েই দুজনে বাড়িতে পরস্পরের সম্পর্কে জানায়। দু’জনের বাড়ি থেকেই আনন্দের সঙ্গে বিয়েতে সম্মতি দিলে, কিছু দিনের মধ্যেই ওরা বিয়ে করে নেয়। দুজনেরই প্রথম পোস্টিং বেঙ্গালুরু। সুতরাং বিয়ের পর ওরা বেঙ্গালুরুতেই নতুন সংসার পাতে।

নতুন চাকরির ব্যস্ততা এবং নতুন বিয়ে, দিনগুলো যেন খুশির পাখায় ভর দিয়ে উড়তে থাকে। প্রথম বছরটা হইচই,আনন্দে কীভাবে কেটে যায় ওরা বুঝতেও পারে না। দ্বিতীয় বছরে না চাইতেও মধুমিতা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে যেটার জন্য ওরা স্বামী-স্ত্রী মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বাড়ির লোকেদের কাছে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে চাপে পড়ে ওরা পরিবার বাড়াতে রাজি হয়ে যায়।

মধুমিতাকে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় যেটার জন্য ও একেবারেই তৈরি ছিল না। মানস ওকে বোঝায় যে বাচ্চা একটু বড়ো হয়ে গেলেই ও আবার চাকরি জয়েন করতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা এবং বাড়ির দায়িত্ব এতটাই বেড়ে গেল যে, মধুমিতা চাকরি করতে যাওয়ার কথা চিন্তাতেই আনতে পারল না। এদিকে বাড়ির দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসেরও কোম্পানিতে পদোন্নতি হতে থাকল। ফলে কর্মক্ষেত্রে কাজের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেল।

দায়িত্ব বাড়তেই মানসের শুরু  হল দেরি করে বাড়ি ফেরা। মধুমিতার ধৈর্য প্রথম থেকেই একটু কম ছিল। তার উপর চাকরি ছাড়তে হয়েছিল বলে মনে মনে মানসের উপর একটা রাগও তৈরি হয়েছিল। সুতরাং মানসের অত্যধিক ব্যস্ততা মধুমিতার সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগল সে। কথায় কথায় মানসের সঙ্গে ঝগড়া, রাগারাগি –এটা ওদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়াল। রোজই প্রায় মানস রাত করে বাড়ি ফিরত।

‘এই ভাবে আর কতদিন চলবে? আমি, অভি কি তোমার কেউ হই না? সংসারে এতটুকু সময় তুমি দাও না। আমাদের প্রতি তোমার কি কোনও দায়িত্ব নেই?’ মধুমিতার এই প্রশ্নের উত্তরে মানসও রাগ না দেখিয়ে চুপ থাকতে পারে না, ‘আমি কি দায়িত্ব পালন করছি না? তোমাদের জন্য এবার কি তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব?’ ক্লান্তিতে মানস চেয়ারে বসে পড়ে। রেগে থাকাতে, ক্লান্ত মানসের চোখের অভিব্যক্তি মধুমিতার চোখ এড়িয়ে যায়। ঝাঁঝালো স্বরে বলে, ‘এমন কী চাকরি তুমি করো? কতদিন হয়ে গেলো অভির সঙ্গে খেলা তো দূরে থাক, ঠিকমতো কথাও বলোনি। রাত্রে যখন বাড়িতে আসো ও তখন ঘুমিয়ে থাকে। আর সকালে যখন ও স্কুলে যাচ্ছে তখন তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ট্যুর-এ যাও। ফিরে একদিন দুদিন শহরে থাকো আবার অন্য ট্যুর-এ বেরিয়ে যাও। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনও তুমি নরক বানিয়ে দিয়েছ।’

‘মধুমিতা, তুমিও তো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতে…! সুতরাং প্রাইভেট কোম্পানির ব্যস্ততা তুমি ভালো মতোই বোঝো, তাহলে এরকম অবুঝের মতো কথা বলছ কেন? এমনি, এমনি তো এত উঁচু পদে পৌঁছোইনি… পরিশ্রম এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি বলেই কোম্পানি আমাকে ওই পদে বসিয়েছে। তোমাদের টাকাপয়সা, আরামের কোনও অভাব আমি রাখিনি… এই সবই তো আমার প্ররিশ্রমেরই ফল।’

‘এই আরাম, টাকাপয়সা আমরা চাই না মানস। আমারা তোমাকে চাই। তোমাকে আমাদের সময় দিতে হবে।’ মধুমিতার গলা ভেঙে আসে, ‘বাড়িতে এসেও তুমি ফোনে ব্যস্ত থাকো।ঞ্জআমার সঙ্গে কথা বলারও তোমার সময় হয় না।’

‘অফিসের কাজের জন্যই তো ফোন আসে। তোমার জন্য কি সেগুলোও অ্যাটেন্ড করা বন্ধ করে দেব?’

মানসের রাগের পারদ চড়তে থাকে।

‘কতদিন হয়ে গেছে, তোমার অফিসের ব্যস্ততার জন্য, আমরা কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যেতে পারি না, কাউকে আমাদের এখানেও ডাকতে পারি না। কোথাও বাইরে যাই না ছুটির দিনে তুমি ক্লান্ত হয়ে থাকো।’

‘তাই বলে, আমি কি তোমাকে সোশ্যাল হতে বাধা দিয়েছি? তুমি নিজের মেলামেশা বাড়াও না, কে মানা করেছে? ব্যস্ত থাকলে আজেবাজে ব্যাপারগুলোয় মন দেবার সময় পাবে না’, এই বলে মানস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আহত সিংহীর মতো মধুমিতা নিজের মধ্যেই গুমরাতে থাকে।

এই কথাকাটাকাটি, ঝগড়ার পরিবেশই ধীরে-ধীরে মধুমিতা আর মানসের দাম্পত্যে বড়ো একটা ফাটল ধরাতে শুরু করল। বরং টুর থাকলেই মানস, মধুমিতার অনুপস্থিতিতে বাড়ির ঘটনাক্রমকে লজিক্যালি দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করত। মানস বুঝতে পারত, মধুমিতার তার প্রতি ক্ষোভ, নালিশ সম্পূর্ণ মিথ্যাও তো নয়। মনে মনে ঠিক করত, এবার বাড়ি ফিরে মধুমিতা আর অভিকে একটু বেশি সময় দেবে।

মানস শহরের বাইরে থাকলে মানসের অবস্থাটাও মধুমিতা বোঝার চেষ্টা করত। সত্যিই, লোকটা করবেটাই বা কী? কোম্পানির বড়ো পদ সামলাচ্ছে যখন, তখন সঙ্গে দায়িত্ব তো থাকবেই। সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে মানস…। কোথায় ওর ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করবে, তা নয়, উলটে ঝগড়া করেই সময় নষ্ট করে সে।

অথচ এই একই মানুষ দুটো যখন সামনাসামনি হয় তখন মনের এই ভাবনাগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। মানসের ব্যস্ততা স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কও প্রভাবিত ফেলতে শুরু করল। একে তো সময়ের অভাব, তার মধ্যে আবার ঝগড়া, কথাবন্ধ। মাস গড়িয়ে যেত, শারীরিক সম্পর্কটুকু রাখাও ওদের হয়ে উঠত না। দুজনেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে একাকিত্ব বোধ করতে শুরু করল।

এই সমস্যা শুধু মানস আর মধুমিতারই নয়, আজকের বহু দম্পতির এই একই সমস্যা। দুজনের চাকরির ব্যস্তস্তা সঙ্গে অফিস আর বাড়ির দূরত্ব এতটাই যে, রোজ যাতায়াত করার কষ্ট এবং ক্লান্তি দূর করতে করতেই ছুটি শেষ, সঙ্গে অন্যান্য জরুরি কাজগুলো তো আছেই। ফলে ছেলে বা মেয়ে কেউই এখন বিয়ের দায়িত্ব নিতে চাইছে না অথবা বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছে না। কারণ তারা জানে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর নিজের স্বাধীনতা এবং চাকরি ছাড়তে হতে পারে।

ধীরে ধীরে মানস আর মধুমিতার মৌখিক ঝগড়া ঠান্ডা লড়াইয়ে পরিণত হল। দুজনের মধ্যে কথা প্রায় হতো না বললেই হয়। হঠাৎ-ই একদিন মধুমিতা জানাল ও একটা চাকরি পেয়ে গেছে এবং অফিসের পাশেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়াও নিয়ে নিয়েছে। সেখানেই ও অভিকে সঙ্গে নিয়ে উঠে যাবে।

মানসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মধুমিতার প্রস্তাবে। মধুমিতাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর বলতে ইচ্ছে করছিল একলা চাকরি করে অভিকে ও কী করে মানুষ করবে, আর যদি একান্তই চাকরি করতে হয় তাহলে এখানে থেকেও তো অনায়াসেই সেটা করা যায়। কিন্তু মানসের আত্মাভিমান ওর গলা টিপে ধরল। যেখানে মধুমিতাকে নিয়ে ও এত চিন্তা করছে, সেখানে মানসকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ডিসিশন নিতে মধুমিতার তো এতটুকুও বাধল না। পরের দিনই অভিকে নিয়ে মধুমিতা ঘর ছাড়ল। দিনটা আজও মানস ভুলতে পারে না। দু’বছর প্রায় হতে চলল। ছয় বছরের অভি আজ আট বছরের হয়ে গেল। মানসের জীবন, চাকরি এবং এই দুটো বাড়ির দূরত্ব মাপতে মাপতেই বেশ কেটে যাচ্ছিল।

লাল বাতিতে গাড়ি ব্রেক কষতেই মানসের চিন্তা ভগ্ন হল। আর কত দিন এভাবে চালানো সম্ভব? মানস সব সময় চেষ্টা করত ওদের স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব যেন অভির উপর কোনওরকম প্রভাব না ফেলে। দুজনেরই ভালোবাসায় ও যেন বড়ো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু চাইলেও এটা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না।ঞ্জঅভির ব্যক্তিত্ব দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এটা মানস খুব ভালো বুঝতে পারছিল। অভির জীবনে একটা শূন্যতাবোধ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

রাস্তার ভিড় অতিক্রম করে বাড়ি পৌঁছোতে মানসের অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। মনটা ভারাক্রান্ত লাগছিল। অভির অগুনতি প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর কাছে ছিল না। মনে হল, অভি নিশ্চয়ই এই প্রশ্নগুলো ওর মা-কেও করে, মধুমিতার কাছে কি এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর আছে…? আর কতদিন এসব সহ্য করতে হবে?

মানস এবং মধুমিতার পরিবারের সকলে দুজনকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করে যাতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সরিয়ে দুজনে একসঙ্গে আবার জীবন শুরু করে। কিন্তু দুজনেই নিজের নিজের জেদে অটল, কেউ এক চুলও জেদ ছাড়তে রাজি নয়। বিরক্ত হয়েই মানসের মা-বাবা ছেলের কাছে প্রস্তাব রাখেন, ‘সঙ্গে যদি থাকতেই না চাস তাহলে ডিভোর্স নিয়ে নে। জীবন আবার নতুন করে শুরু করার চিন্তাভাবনা কর।’

মানসের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে যায়। সত্যিই কি জীবনের একটা অধ্যায় এত সহজে শেষ করে ফেলা যায়? নতুন শুরু করার কথা ভাবাই যায় না। আজ ও লাইফে ব্যস্ত কিন্তু কালও কি এতটাই ব্যস্ত থাকবে ও? আর অভি? ওর কী হবে? অভির করা প্রশ্নগুলো ওর মাথায় ভিড় করে আসে। কী করবে ও? অনেকবার মনে হয়েছে মধুমিতা যেমন নিজের ইচ্ছেয় ঘর ছেড়েছিল একদিন হঠাৎই আবার ফিরে আসবে কিন্তু অপেক্ষা করে করে দুই বছর কাটতে চলল। মধুমিতা নিজে থেকে কোনওদিন ওকে ডেকে পাঠাল না। আর এখন তো একা থাকারই অভ্যাস হয়ে গেছে।

অভি বাড়িতে ঢুকেই সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কিছু ভালো লাগছিল না ওর। এতটুকু বয়সেই মনটা ওর যেন ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিল। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কবে থেকে মা আর বাবা একসঙ্গে ওর সাথে থাকবে, এই অপেক্ষায় ও রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই রবিবার আসে। বাবাও আসে আর এসেই ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে চলে যায়। পছন্দের খাবার খাওয়ায়, জিনিসপত্রও কিনে দেয়। কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞেস করে এবং সন্ধেবেলায় আবার মা-র কাছে পৌঁছে দিয়ে, অন্য বাড়ি চলে যায়। সোমবার হলেই মায়ের অফিস আর ওর স্কুল। এইভাবেই সপ্তাহ কেটে গিয়ে আবার রবিবার আসে। এটাই অভির সারা সপ্তাহের রুটিন। ওর কিচ্ছু ভালো লাগে না। বাবার সঙ্গে থাকলে মায়ের জন্য মন খারাপ লাগে আর সারাটা সপ্তাহ বাবাকে অভি মিস করে খুব। সব সময়ই মনে হয় কেন মা-বাবা একসঙ্গে থাকতে পারে না?

মানসের সঙ্গে ঘুরে আসার পর এক ঝলক ছেলেকে দেখল মধুমিতা তারপর তার আর কোনও আওয়াজ না পেয়ে মধুমিতা রান্নাঘর থেকে ছেলের নাম ধরে হাঁক পাড়ল। না, কোনও শব্দ নেই! কী হল, চিন্তিত হল মধুমিতা। হাতটা মুছে নিয়ে অভির স্টাডিরুমে ঢুকল ও। ছেলেটা টেবিলে মাথা রেখে মুখটা ঢেকে রয়েছে। ঘরের আলোটা পর্যন্ত জ্বালায়নি।

ঘরের আলো জ্বালিয়ে মধুমিতা এসে অভির মাথায় হাত রাখল, ‘কী হল অভি? কেমন কাটল আজ সারাটা দিন?’

অভি উত্তর দিল না। টেবিল থেকে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

‘কী হল? মন খারাপ।’ ছেলের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে মধুমিতা জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু হয়নি’, বলে অভি মায়ের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল।

‘চুপচাপ কেন বসে আছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে?’

‘না’, বলেই মধুমিতার হাত আঁকড়ে ধরে অভি, ‘মা, আমরা কেন বাবার সঙ্গে গিয়ে থাকতে পারি না? বলো না, কবে আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকব? চলো না আমরা বাবার কাছে গিয়ে থাকি।’

‘বাজে কথা শুনতে ভালো লাগে না অভি’, মধুমিতার কোমল কণ্ঠস্বর হঠাৎই রুক্ষ হয়ে ওঠে, ‘রাত হয়েছে, ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল স্কুল রয়েছে।’

‘আমি খাব না। আগে তুমি আমার কথার উত্তর দাও,’ অভি জেদ করতে থাকে।

‘বললাম না, ফালতু কথা শোনার আমার সময় নেই। আমরা এখানেই থাকব, খেয়ে শুয়ে পড়ো’, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় মধুমিতা।

অভি বসেই থাকে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই দুজনের কেউই জবাব দেয় না, বরং বকে ওকে থামিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করে। অভি কী করবে বুঝে পায় না।

কাজ শেষ করে মধুমিতা শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল, অভি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর কচি মুখটা দেখে মধুমিতার মনে হল কোলে টেনে নিয়ে অজস্র চুম্বনে ভরে দেবে ওর ছোট্ট মুখটা। নিজেকে সংযত করল ও। ঘুম ভেঙে যাবে ছেলেটার। বড্ড প্রশ্ন করে আজকাল অভি। সেই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর ওর জানা নেই। অভির শৈশবটা সত্যিই হাজার সমস্যায় ভরা। মধুমিতা উদ্দেশ্যহীন ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছে, সিরিয়াসলি কখনও ও নিজেকে এবং অভিকে নিয়ে ভাবে না। জাস্ট এক একটা করে দিন কাটাচ্ছে? অভি ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। ওর শিশুসুলভ প্রশ্নগুলোই জেদের বশে কবে কঠোর হয়ে উঠবে কে বলতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মধুমিতা।

মানসের সঙ্গে জীবন কাটানো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল ওর কাছে, কিন্তু ওকে ছেড়ে এসেও কি ভালো আছে ও? মধুমিতা মনে মনে ভাবে। ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল মানসকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার যাতে ওর জীবনে স্ত্রী-র গুরুত্ব ও উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত চলে আসাটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম মধুমিতা মানসের আসার অপেক্ষা করে থেকেছে। ওর মনে হতো, মানস নিশ্চয়ই একদিন এসে ওর রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে যাবে। মধুমিতাও সব ভুলে গিয়ে মানসের সঙ্গে ফিরে যাবে। কিন্তু অপেক্ষা, অপেক্ষা হয়েই থেকে গেছে। মানসও আসেনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আর মধুমিতাও ফিরে যেতে পারেনি মানসের কাছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্বও বাড়তে থেকেছে। নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুজনেই। মাঝেমধ্যে শুধু অভির প্রশ্নগুলো মধুমিতাকে বাস্তবের সম্মুখীন হতে বাধ্য করত।

গতকালই মায়ের ফোন এসেছিল। সেই-ই একই কথা। মানসের কাছে ফিরে না গেলে ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু তো একটা ভাবা দরকার। মধুমিতা খুব ভালো করেই জানে মা, ভবিষ্যৎ মানে কী বোঝাতে চাইছেন। মানসকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসা। কিন্তু এটা বলা এবং করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এতই কি সোজা পুরো ব্যাপারটা? অভির কী হবে? ও আর মানস দুজনেই যদি আলাদা করে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবে তাহলে দুজনের কাছেই অভির প্রেজেন্সটা অবাঞ্ছিত হয়ে উঠবে না? চিন্তাটা আসাতেই মধুমিতা শিউরে উঠে অভিকে নিজের কোলের কাছে টেনে আনে।

মধুমিতা অভির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। সত্যিই, ছোটো থেকেই ছেলেটার জীবনে সমস্যার শেষ নেই, মা-বাবার যৗথ ভালোবাসা ওর কপালে আজ পর্যন্ত জুটল না। এর উপর মধুমিতা নিজে আর ওর সমস্যা বাড়াতে একেবারে চায় না। অভির শরীরের ওম ধীরে ধীরে মধুমিতার চোখে তন্দ্রা এনে দিতে সাহায্য করে। আজ কেন জানি না মধুমিতার মনে হল ওর মনের ভিতর জমে থাকা বরফটা সামান্য হলেও গলতে শুরু করেছে। যেগুলো মেনে নিতে আগে কিছুতেই মন চাইত না আজ সেগুলো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। সমস্যাগুলো রয়েই গেছে মধুমিতার জীবনে তবুও ওর মনে হল, সমস্যাগুলোকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে ওর। ও নিজের মন-কে বোঝার চেষ্টা করে। ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেই টের পায় না মধুমিতা।

সকালে অভি আবার স্বাভাবিক। কিছু কিছু জিনিস যে ওর জীবনে বদলাবার নয় সেটা ও ভালোমতোই এতদিনে বুঝে গিয়েছিল।

স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল অভি। অভিকে স্কুলে পাঠিয়ে মধুমিতাও নিজের অফিস এসে পৌঁছোল। রোজকার মতোই একটা দিন, কিন্তু মনের ভিতর সন্তুষ্টি অনুভব করছিল মধুমিতা। সারাটা সপ্তাহ ব্যস্ততার মধ্যেই ওদের কেটে গেল। আবার এসে গেল রবিবারের পালা।

মানস যথারীতি মধুমিতার ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে ফোন করে নিয়ম মতো অভিকে ডেকে পাঠাল। কিন্তু প্রতি রবিবরের মতো অভি একা নামল না, মধুমিতাও এল ওর সঙ্গে যেটাতে শুধু মানস-ই নয় অভিও খুবই অশ্চর্য হল।

মানস লক্ষ করল, মধুমিতার চেহারায় লাবণ্য যেন অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে। কঠোরতাটা অনেক কম। একলা লড়াই চালাতে চালাতে সৌন্দর্য কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে। তিনজন সামনাসামনি হলেও কারও মুখে কোনও শব্দ জোগাল না। মনের মধ্যে নানা কথা ভিড় করে আসছিল কিন্তু বলার ভাষা জোগাতে পারল না কেউই।

‘অভি চলো’, মানসই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। মধুমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মধুমিতা চোখ নামিয়ে নিল। মানসের মনে হল মধুমিতা কিছু বলতে চায় কিন্তু ওর দিক থেকে কোনও কথা না আসায় মানস অভির হাত ধরে গাড়িতে ওঠার উপক্রম করতেই পিছন থেকে মধুমিতার কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘মানস’। মানসের মনে হল একটা যুগ পার করে মধুমিতার গলায় নিজের নামটা ও শুনল। ‘কাল অভির স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং আছে। তুমি যদি একটু সময় বার করে আসতে পার অভির খুব ভালো লাগবে।’

মানসের ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু ও উত্তর দিল, ‘আমার সময় হবে না… কাল টুরে বেরিয়ে যাব আমি।’ উত্তর দিয়েই পালটা জবাবের জন্য প্রতীক্ষা না করে মানস ড্রাইভার সিটে উঠে বসল।

মধুমিতা নিজের জায়গায় পাথর  হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। মন চাইছিল মানসের নাম ধরে আর একবার ডাকার কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ততক্ষণে মানস গাড়ি স্টার্ট করে দিয়েছে। সম্পর্কের বরফ গলাবার চেষ্টা করাটা ব্যর্থ হয়ে গেল মধুমিতার। মানসের, মুখের উপর ‘না’ বলে দেওয়ার ভয়েই মধুমিতা সম্পর্কের এই বরফ গলাবার চেষ্টা করতেই বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে মধুমিতা লিফটের দিকে পা বাড়ায়।

সন্ধেবেলায় অভি বাড়ি আসতে প্রত্যেকবারের মতো মধুমিতা এবারে ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। অভিও সারাদিন  কী করল– না করল কিছুই মধুমিতাকে বলল না, কারণ বলার মতো কিছুই ছিল না। পুরোটা দিন দুজনের মধ্যে কথা প্রায়ই হয়নি। নিজের নিজের চিন্তাতেই দুজনে বিভোর ছিল। অভি একবারও মানসকে স্কুলে পেরেন্টটিচার মিটিং-এ আসার জন্য বায়না করেনি।

অভিকে ছেড়ে বাড়িতে আসার পর মধুমিতার মুখটাই মানসের খালি মনে পড়ছিল। স্কুলের জন্য ‘না’ বলে দেওয়াতে মধুমিতার চোখে যে ব্যথার ঝলক মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল, সেটা আর কেউ না হলেও মানসের চোখ এড়ায়নি। অভিও, একবার ওকে স্কুলে আসার জন্য বায়না করেনি। হয়তো অভিও ওর কাছ থেকে উত্তর আশা করাই ছেড়ে দিয়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাইরের পোশাক ছেড়ে মানস বিছানায় গা এলিয়ে দিল। খাওয়ার ইচ্ছে হল না কিছুতেই।

পরের দিন মধুমিতা অভিকে সঙ্গে নিয়ে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছে গেল। ক্লাসরুমের দিকে যেতে গিয়ে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। করিডরে মানস ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। অভি ছুট্টে গিয়ে মানসকে জড়িয়ে ধরল।

অভির আনন্দ দেখে মানস আর মধুমিতা দুজনেরই চোখে জল এসে গেল। মধুমিতা ওদের দুজনের কাছে আর একটু ঘন হয়ে সরে এল। ওর মুখও প্রসন্ন হাসিতে ভরে যায়। ‘থ্যাংকস, মানস… তোমাকে দেখে অভি প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আমরা ভাবতেই পারিনি তুমি…’

পেরেন্ট-টিচার মিটিং শেষ হতেই বাইরে এসে অভি বন্ধুদের সঙ্গে মানসের আলাপ করাতে শুরু করল। ওর আনন্দ দেখে মানসেরও মনে হল ও স্কুলে এসে ঠিক কাজই করেছে।ঞ্জঅভিকে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে ছেড়ে দিয়ে মানস স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়াল। মধুমিতাও ওর পিছন পিছন স্কুলের বাইরে বেরিয়ে আসে।

মধুমিতাই প্রথম কথা শুরু করে, ‘এত খুশি হতে অভিকে আমি অনেক দিন দেখিনি মানস।’

‘হ্যাঁ, অভি এখনও বাচ্চা… সুতরাং ছোটো ছোটো জিনিসেই ও খুশি হয়ে ওঠে’, বলে আবার মানস চুপ হয়ে যায়। মধুমিতাও কথা খুঁজে পায় না। ‘ঠিক আছে… এবার আমি যাব। অভিকে বলে দিও আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল… রবিবার ওকে নিতে আসব’, কথা শেষ করে মানস যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

‘মানস’, অনুশোচনায় মধুমিতার গলা বুজে আসে, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

‘হ্যাঁ, করো।  কী জিজ্ঞেস করতে চাও?’

মানসের কণ্ঠস্বরে প্রশ্রয় অনুভব করে মধুমিতার ইচ্ছে হচ্ছিল দুই বছরের জমে থাকা চোখের জল বইয়ে দেয় মানসের কাঁধে মাথা রেখে। নিজেকে সংযত করল ও, ‘আচ্ছা মানস, এই দুই বছরে কখনও আমার অভাব বোধ করেছ? আমাদের ছাড়া তুমি জীবনে খুশি হতে পেরেছ? মধুমিতার স্বর খুব ক্লান্ত শোনাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কথাগুলো বলার জন্য ওর নিজের সঙ্গেই নিজেকে লড়তে হচ্ছে। অথচ বলে দেওয়ার পর ওর মনে হচ্ছিল বলাটা এতটাও কঠিন ছিল না। আগে কেন তাহলে কথাগুলো বলতে পারেনি ও? কথাগুলো বলে মধুমিতা, মানসের দিকে তাকাল, চেষ্টা করল ওর মুখের অভিব্যক্তিগুলো পড়ার।

‘আমার অভাব তুমি কখনও ফিল করেছ?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মানস জিজ্ঞেস করল।

মধুমিতা উত্তর দিল না। উত্তর না পেয়ে মানস বলল, ‘ছাড়ো এসব কথা… এখন ও সব কথা বলে কী লাভ? অনেক দেরি করে ফেলেছি দুজনেই।’

‘এখন না হয় দেরি হয়ে গেছে, আগেও তো তুমি কখনও আমাকে একবারও ডাকোনি’, ভিজে স্বরে মধুমিতা বলে।

‘আমি তোমাকে ডাকিনি ঠিকই কিন্তু আমি তোমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলিনি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছেড়েছিলে, আবার নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ফিরেও আসতে পারতে, মানস বলে।

‘একবার তো ডাকতে পারতে। আমি ঠিক ফিরে আসতাম’, চোখের পাতা ভিজে আসে মধুমিতার।

‘তখন তোমাকে ডাকলেও তুমি ফিরতে না। ফেরারই যদি হতো তাহলে তুমি বাড়ি ছেড়ে যেতেই কেন? বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় শুধু নিজের কথা না ভেবে একবারও যদি অভির কথা চিন্তা করতে, তাহলে কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতে না। আমাদের দুজনের জেদের বলি হতে চলেছে অভি। ওর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে বড়োদের ঝগড়ার মাঝে। আমরা ওকে কী দিতে পেরেছি? না নিজেরা আনন্দে আছি না সন্তানকে আনন্দে রাখতে পেরেছি’, বলে মানস নিজের চোখের জল লুকোতে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করে।

মুহূর্তে মধুমিতার মনে হয়, গিয়ে মানসের রাস্তা আটকে দাঁড়ায়, ওকে জড়িয়ে ধরে বলে যে ওর কাছে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই মানস গাড়ি স্টার্ট করে ট্র্যাফিকের সঙ্গে মিশে যায়। নিজের মন ঠিক করে নেয় মধুমিতা। অনেক দেরি করে ফেলেছে ও আত্মসম্মান বজায় রাখার নাম করে। কিন্তু আর নয়, দোষ যখন নিজে করেছে, শুধরোতেও নিজেকেই হবে। অভিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ও।

পরের দিন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে মানস, নীচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। এত সকাল সকাল কে এল ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে নামল ও। দরজা খুলতেই দেখল, মধুমিতা আর অভি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

‘তোমরা!’ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না মানস।

‘ভেতরে আসতে বলবে না?’ মধুমিতা জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি নিজের বাড়ি এসেছ মধুমিতা আমি তোমার রাস্তা আটকাবার কে?’ মানস দরজার পাশে সরে দাঁড়াল। মধুমিতা আর অভি ভিতরে ঢুকে এল। মানস দরজা বন্ধ করতে করতে নিজের মনেই একটা প্রতিজ্ঞা করল, এবার আর ও নিজের খুশিকে দরজা দিয়ে কখনও বাইরে বার হয়ে যেতে দেবে না।

নতুন রাস্তা

অনেকদিন পরে সেদিন বাজারে হঠাৎই রেণুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুহাতে দুটো ভারী থলে। খুবই বিধবস্ত মুখচোখ। বাজার করার পরিশ্রম আর অফিসে যাওয়ার তাড়া– এই দুটো মিলেজুলেই নিশ্চয় মুখে অমন ঘর্মাক্ত ও পর্যুদস্ত ছাপটা পড়েছে।

রেণু আমাদেরই প্রতিবেশী। একই পাড়ায় আমাদের দীর্ঘকালের বসবাস। আমাদের উত্তর কলকাতার এই পাড়াগুলোয় পারস্পরিক সম্পর্কগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়ে পড়েনি। দেখা হলে কেবল সৌজন্যের হাসি হেসে আমরা সরে পড়ি না, বরং দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে মনের ভার হালকা করি।

রেণুর সঙ্গে আমার চেনাজানা, এ পাড়ার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই। আমরা প্রায় সমবয়সি। তবে আমারও বছর দুই আগে ওর বিয়ে হয়। মফস্সলের মেয়ে। আমার মতোই। তবে খাস কলকাতায় এসেও দিব্যি মানিয়েগুছিয়ে নিয়েছে। মনে আছে, আমার বিয়ের সময় স্বেচ্ছাসেবা দেওয়ার জন্য পাড়ার যে ব্যাটেলিয়ান তৈরি ছিল, তার পুরোভাগে ছিল রেণু। হালকা পাখির মতো পায়ে কতবার তাকে একতলা-দোতলা করতে দেখেছি। খলবল করে গোটা অনুষ্ঠানবাড়িটা যেন মাতিয়ে রেখেছিল।

অতএব, প্রাণোচ্ছ্বল রেণুকে যথেষ্ট বিষণ্ণ দেখে আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে গো?’

আমার প্রশ্নটাও শেষ হতে পায়নি, রেণু যেন উছলে পড়ল, ‘আর বোলো না কল্পনা। আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি।’

‘কী ঝামেলা?’ আমি এবার সত্যি অবাক হই।

‘কী ঝামেলা, কী বলব! আমার শাশুড়ি একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন ভাই। হাড়মাস কয়লা হয়ে গেল। এখন অফিস করব, নাকি এইসব ঝামেলা সামলাব, তাই বুঝতে পারছি না!’

রেণুর শাশুড়ির ছবিটা তক্ষুণি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভদ্রমহিলা বিধবা। কিন্তু ষাটের কোঠা পেরিয়ে গিয়েও বেশ সুস্থ, সুঠাম। আর ভদ্রমহিলার ব্যাপারে সেটাই প্রথমে নজর কাড়ে।

বছরপাঁচেক আগে রেণুর স্বামী রজতদা হঠাৎ-ই তার মাকে বর্ধমানে দেশের বাড়ি থেকে শহরে নিয়ে আসেন। তখন একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল আসলে। তার কিছুদিন আগেই রজতদার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ফলে দেশের বাড়িতে তার মা একেবারেই একা হয়ে পড়েছেন। আবার এদিকেও দুই ছেলে সামান্য বড়ো হয়ে যেতে রেণু চাকরি করার তাল ঠুকছে। অর্থাৎ উভয়েরই তখন পরস্পরকে প্রয়োজন।

সেই থেকে রজতদার মা এই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। বর্ধমানে সকলে ওকে বড়োমা বলে ডাকত। আগেকার যৌথ পরিবারে এ ধরনের প্রথা ছিল। পাড়াতেও সেই নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল। অন্তত দুটো ভিন্ন প্রজন্ম এখন রজতদার মাকে ওই নামেই ডাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথা বলছ? বড়ো-মা কী করেছে?’

‘সেসব নিজের চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না কল্পনা,’ রেণু বলল, ‘বরং নিজেই এসে একদিন দেখে যাও। সমীরদাকেও সঙ্গে এনো। আমি চলি, আমার আবার ওদিকে অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব দিকেই তো বিপদ–!’

নিজের মনে গজগজ করতে করতে লম্বা পা ফেলে বাজারের বাইরে চলে গেল রেণু। আমি ওর থলে হাতে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়া শরীরের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম।

সংসার থাকলে তার নিজস্ব এক ব্যস্ততা থাকবেই। সেই জীবনে আমিও ব্যস্ত। ব্যস্ততা শুরু হয় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই। মাথার পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। কেবল আমারটাতেই নয়, সমীরেরটাতেও। পাছে একবারের অ্যালার্মে পাকা ঘুম না ভাঙে, তাই এই ব্যবস্থা।

অ্যালার্ম বেজে উঠলে আমিও ধড়ফড় করে উঠে বসি। সমীর অবশ্য তারপরও আধঘণ্টা বিছানা ছাড়ে না। ওর চাই জ্যান্ত এবং প্রহারকারী অ্যালার্ম। অর্থাৎ আমি। কিচেনে সকালের ভাতটা চাপিয়ে, আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আমি যতক্ষণ না মশারি তুলে গলা ঝাঁঝিয়ে দুহাতে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাব, ততক্ষণ ওঠার নামও নেবে না সে। আমাদের ছেলেকে তামিলনাড়ুর এক আবাসিক স্কুলে দিয়েছি। ফলে কাউকে স্কুলের বাসে উঠিয়ে দেওয়ার ঝঞ্ছাট থেকে আমরা মুক্ত। কিন্তু দুজনেই অফিস যাই। ফলে সেজন্য প্রস্তুতিও নিতে সময় লাগে। শুধু সকালের খাবার তৈরি করলেই তো কাজ ফুরিয়ে যায় না। দুজনের লাঞ্চ তৈরি করে টিফিন বক্সে ভরার ব্যাপার আছে। তারই মধ্যে সবজিওলা এসে দরজায় হাঁকডাক করবে। ছুটির দিন ছাড়া বাজারে যাওয়া হয় না, ফলে এরাই ভরসা। প্রায় একই সময়ে চলে আসবে টুনির মা। সে প্রায় দশহাতে গোটা বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ায় পরবর্তী পৌনে একঘণ্টা। একটা সাইক্লোন যেন ফোঁসফোঁস করে তোলপাড় তুলে দরজা খুলে অন্য কোনও বাড়ির দিকে উড়ে যায়। সকালটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকে।

এতকিছু সামলে বড়ো-মার কথাটা মন থেকে বেমালুম যেন উবে গেছিল। কোনও কোনও ছুটির দিনে বা সন্ধের অবসরে, টেলিভিশনে কোনও একঘেয়ে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলেও শরীর জোড়া ক্লান্তি দূরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়াত।

রেণুদের বাড়ি আমাদের গলিটার ঠিক মুখে। খুব বেশি হলে হেঁটে আমাদের বাড়ি থেকে দু-মিনিটের রাস্তা। তবু আলস্য যেন দু-পা চেপে ধরত, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর। রেণুকেও তারপর অনেকদিন বাজারে দেখিনি। আগে মাঝেমধ্যে সকালে অফিসযাত্রীদের বাসে ওকে দেখতে পেতাম। এখন বোধহয় রেণু অন্য কোনও ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কাজেই রুট বদল হয়ে গেছে তার।

পাকেচক্রে রেণুর কথাগুলো আমি হয়তো ভুলেই যেতাম। কিন্তু এক সন্ধ্যাবেলার একটা ঘটনা আমাকে আবার রেণু ও বড়ো-মার প্রসঙ্গ মনে পড়িয়ে দিল।

আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে সোহিনীরা। পাশের পাড়ার মেয়ে। বিয়ে হয়ে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা হয়। ছোটো ছোটো দুটি বাচ্চা আছে। ইংরেজিতে এমএ করার পর বাড়িতেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে টিউশন দিত। কিন্তু দেখা হলেই বলত, ‘আমার চাকরি করার কী ভীষণ ইচ্ছা, জানো কল্পনাদি! কত অফার পাচ্ছি, ভাবতে পারবে না। কিন্তু নিতে সাহস হচ্ছে না। বাচ্চাদুটো তো ছোটো! কী করি বলো তো?’

ওর আগ্রহ আর হতাশার কথা শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকত না। মেয়েদের জীবনটাই যে একছাঁচে গড়া। যেখানে আমার জীবন, সোহিনীর জীবন, আর-একটা মেয়ের জীবন মিলেমিশে একাকার।

শেষে সোহিনী নিজেই বলত, ‘ভাবছি কত তাড়াতাড়ি ছেলেদুটো একটু বড়ো হয়ে যাবে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম, সে কি শুধু

সংসারের হেঁসেল ঠেলা আর বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য? তুমিই বলো কল্পনাদি!’

আমি ম্লান হেসে ওকে স্ত্বান্না দিতাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস!’

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। বাচ্চাদুটি এতদিনে নিশ্চয় একটু বড়ো হয়েছে। যদিও এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ওদের। এইসময় হঠাৎ একদিন দুপুরে সোহিনী আমাদের বাড়িতে এল।

বেশ খুশি-খুশি দেখাচ্ছে ওকে। হাতের বড়ো ঝোলায় একটা কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত কোনও বাক্স। আমাকে ধরে, ‘কল্পনাদি, ও কল্পনাদি, সুখবর আছে’ বলে একপাক নেচে নিল সোহিনী। তারপর ঝোলা থেকে বেশ বড়োসড়ো একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে ঢাকনা খুলে আমার সামনে ধরে বলল, ‘নাও মিষ্টি খাও–!’

আমি নিচ্ছি না দেখে ও ফের বলল, ‘কী হল কী, নাও–!

ইতস্তত করে একটা হাতে নিই, কিন্তু আমার ভুরুর ভাঁজ মেলায় না। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যাপারটা কী’ আমায় খুলে বল তো! তোরা কত্তা-গিন্নিতে মিলে আবার কোনও তৃতীয় জনকে পৃথিবীতে আনার মতলব কষেছিস নাকি? পরিবার পরিকল্পনার এ যুগেও? তোদের তো সাহস খুব!’

সেইসঙ্গে আমার মেয়েলি সন্ধানী চোখ সোহিনীর শরীরে হেঁটে বেড়ায়। এখনও গর্ভধারণের কোনও চিহ্ন ওর শরীরে দৃশ্যমান নয়।

ডাইনিং টেবিলের উপর মিষ্টির প্যাকেটটা সযত্নে রেখে দিয়ে সোহিনী ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘দেখেছ? এই হচ্ছে তোমাদের মতো নিপাট হাউসওয়াইফের দোষ। ওইটা ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারো না। হরাইজনটা আসলে ছোটো হয়ে আসে।’

বিরক্ত মুখে বললাম, ‘যা, যা, মেলা বকিসনি। কী খবর, সেটাই খোলসা করে বল ঢং না করে–!’

আমার দু-কাঁধে চাপ দিয়ে সোফায় বসিয়ে সোহিনী আদুরে গলায় বলল, ‘বলছি, বলছি দাঁড়াও।’

তারপর আমার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘তুমি তো জানো, আমার একটাই স্বপ্ন ছিল। চাকরি করব।’

‘ও, চাকরি পেয়েছিস বুঝি?’

‘আলবত। হেঁজিপেঁজি চাকরি নয় গো। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি। ভালো মাইনে দেবে। এবার আমিও সকালবেলা নাকেমুখে কোনওরকমে গুঁজে বড়োরাস্তার দিকে ছুটব। ঠিক নটায় বাসস্ট্যান্ডে কোম্পানির বাস এসে দাঁড়াবে। এসি বাস। আমায় তুলে নিয়ে হুস করে…!’

হাতের মুদ্রায় সোহিনী ‘হুস’ করে চলে যাওয়াটা কেমন, সেটা দেখায়। নতুন প্রাণস্ফূর্তিতে ও যেন মত্ত হয়ে আছে। দু-চোখ জুড়ে স্বপ্নপূরণের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে।

হঠাৎ-ই বলল, ‘জানো কল্পনাদি, চাকরিটা হয়ে যাবে বলে কনফার্মেশনটা যে-মুহূর্তে পেয়েছি, অমনি শপিং মলে গিয়ে এক্বেবারে নতুন ডিজাইনের পাঁচটা চুড়িদার-কামিজ কিনে এনেছি। শাড়ি পরে তো আর এত দৌড়ঝাঁপ করা যায় না। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরব। অফিসের কোনও অনুষ্ঠানে। কিংবা ধরো চুড়িদার পরতে পরতে একঘেয়ে লাগলে তখন। স্বাদবদলের জন্য।’

আমি কী বলি তা শোনার জন্য একগাল হিরের টুকরো ছড়ানো হাসি নিয়ে সোহিনী আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চারা? ওদের কি প্রেপ স্কুলে ভর্তি করে দিলি, নাকি কোনও ক্রেশ?’

সোহিনী হাসি ধরে রেখে বলল, ‘ক্রেশ কেন? বড়ো-মা আছে তো!’

নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ‘বড়ো-মা? বড়ো-মা এর মধ্যে আসছে কী করে?’

সোহিনীর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল এইবার। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওমা, তুমি জানো না?’

আমি অবাক হওয়া মুখ দুপাশে নেড়ে জবাব দিলাম, ‘না!’

সোহিনী বোধহয় আমার চেয়েও বেশি অবাক হল।

অবিশ্বাসীর হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই জানো না? তুমি কী গো? তুমি কি এ পাড়ায় থাকো?’

আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। অনেকদিন আগে বাজারে দেখা রেণুর উদভ্রান্ত মুখটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত রেণুদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি ব্যস্ততার জন্য। আমি কৌতূহল দমন করে বললাম, ‘হ্যাঁ, বাজারে একদিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তাড়ায় ছিল। সবটা খুলে বলতে পারল না। আমিও আর পরে জানতে চাইনি। মনে হল, বড়ো-মাকে নিয়ে ওরা খুবই ব্যতিব্যস্ত।’

‘দূর! রেণুদির কথা ছাড়ো তো! ওদের বড্ড বাড়াবাড়ি! আরে বড়ো-মা যা করছেন তাতে, আমাদের মতো মেয়েরা ওর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। রেণুদি এত কথা বলছে তো! রেণুদির নিজের কত সুবিধা হয়েছে বড়ো-মা এখানে থাকায়, সে-কথা কি একবারও রেণুদি স্বীকার করে?’

সোহিনী রীতিমতো ফোঁস করে ওঠে। মনে হল যেন, বড়ো-মার বিরুদ্ধে রেণুর অভিযোগ, সরাসরি সোহিনীর গায়ে গিয়েই লেগেছে। ফলে বেরিয়ে পড়েছে পাড়াতুতো রাজনীতির দাঁত-নখ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথাটাই বল। উনি তোকে কীভাবে…!’

সোহিনী আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘রেণুদিদের বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে সারাদিন। ওরা তো কত্তাগিন্নি দুজনেই অফিসে যায়। বড়ো-মা পাড়ার বাচ্চাদের সে সময়টা সামলান। সকলেই এ-পাড়ার বা পাশের পাড়ার চাকরি করা মহিলাদের সন্তান। শুনেছি, বাচ্চাদের পাল্সটা উনি খুব ভালো বোঝেন। প্রচুর যত্নআত্যি করেন। এখন তো সকলেই বাচ্চাদের রাখার জন্য ওঁর কাছে দৌড়োচ্ছে।’

বড়ো-মার কীর্তিকলাপের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠেছে। রেণুর অভিযোগটা তাহলে নিতান্ত অন্যায্য নয়।

সোহিনীর কথা তখনও শেষ হয়নি। সে খুব রুষ্ট মুখে বলল, ‘বড়ো-মা আর নতুন কাউকে নিচ্ছে না জানো! ডিমান্ড তো খুব! আমি নেহাত পাড়ার বউ। তাই না করতে পারল না।’

সোহিনী বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে চলে গেল। কিন্তু আমার ভাবনায় বড়ো-মা ঢুকে পড়লেন। রেণু এবং ওর স্বামী রজত– দুজনেই ভালো চাকরি করে। বড়ো-মাকেও যে তারা অবহেলা করে, এমন নয়। তাহলে বড়ো-মার কী উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে এহেন কার্যকলাপের মাধ্যমে? কী প্রমাণ করতে চান উনি? ছেলে আর বউমাকে সকলের চোখে এমন খাটো করে দেখানোর ভাবনাই বা তার মাথায় চেপে বসল কেন হঠাৎ?

সন্ধেয় সমীর বাড়ি ফিরতে ওকে প্রথমেই সোহিনীর জানানো কথাগুলো বলেছি। শুনে প্রথমে সে অবাক হল। তারপর মুখটা বিকৃত করল একটু। শেষে ভুরুতে সেই যে ভাঁজ পড়ল, সে ভাঁজ আর সিধে হল না।

খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে সমীর বলল, ‘আমায় তুমি তো খুব চিন্তায় ফেলে দিলে কল্পনা। ছোটোবেলায় আমি আর রজত হরিহর আত্মা ছিলাম। এখনও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। তাই ওর ব্যথাটা আমার বুকে বড়ো লাগছে!’

আমি চুপ করে আছি দেখে, সমীর আমাকেই পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী দরকার ছিল বলো তো বড়ো-মার এমন সব পাগলামো করার? এতে সমাজের সমালোচনার আঙুল যে ওরই ছেলে-বউমার দিকে উঠবে, একথা কি একবারও উনি ভাবলেন না?’

‘আমার কী মনে হয় জানো?’ আমি বলি, ‘আমাদের দুজনের একবার ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত। বড়ো-মাকে বোঝানো উচিত। উনি যেটা করছেন, সেটা ঠিক করছেন না। তুমি বোঝালে হয়তো উনি তার মূল্য দেবেন!’

সমীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’

সেই সপ্তাহেই একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সমীর অন্য কোনও কারণে। সম্ভবত শরীরটা তার ভালো ছিল না সেদিন। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বলল, ‘চলো বড়ো-মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।’

দুপুর দুটো বাজে। সদর দরজা খোলাই ছিল। আমরা দোতলায় উঠতেই বাচ্চাদের নানারকম গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। রেণুদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়তেই একঝলকে গোটা ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘর জুড়ে দশটি প্রায় একই বয়সি বাচ্চা। কেউ ঘুমোচ্ছে। কেউ বা দুষ্টুমি করছে। খেলনা নিয়ে খেলছে কেউ। খোদ বড়ো-মা একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, দুধের বোতল থেকে দুধ পান করাচ্ছেন। আর-এক মধ্যবয়সিনি অন্য বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত।

বড়ো-মাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। মুখ থেকে যেন একটা জ্যোতি বের হচ্ছে। স্নেহের বিভা। আমরা থতোমতো খেয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই বড়ো-মা উদার আমন্ত্রণ জানালেন।

‘আরে, সমীর? বউমা? এসো, এসো ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মালতী একে ধর। দেখিস দুধটা যেন পুরোটা খায়।’

মালতীর হাতে কোলের বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে বড়ো-মা উঠে দাঁড়ালেন।

‘ও হল মালতী। সাতকুলে কেউ নেই ওর। তাই জুটে গেল। একা একা এতগুলো বাচ্চাকে সামলানোর বয়স কি আর আছে?’

বড়ো-মা আমাদের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। সমীর সোফায় বসে বলল, ‘আপনি তো রীতিমতো ক্রেশ চালু করে দিয়েছেন দেখছি বড়ো-মা!’

বড়ো-মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মালতীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার হাত খালি হলে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো তো মালতী!’ তারপরই আমাদের দিকে ফিরলেন, ‘খুব ভালো লাগে জানো। মনটা পবিত্র হয়ে যায়। বয়স তো হল। পরমার্থের সন্ধান করার এখনই তো প্রকৃষ্ট সময়।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনি হাঁফিয়ে পড়েন না? এতগুলো বাচ্চাকে সামলানো তো মুখের কথা নয়। তাই না?’

‘দ্যাখো, নিজের নাতি-নাতনিদের জন্যও কি কম দৗড়ঝাঁপ করেছি? এক-একটার আবদার শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখন তবু মালতী আছে। তখন তো আমি একা। ওরা দুজন চলে যেত অফিসে, সারাদিনের মতো। এখন নিজের নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে গেছে। তাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করছি আর কী! এদেরকেই নাতি-নাতনি বানিয়ে ফেলেছি। জানো, ওদের মায়েরা বলে, বাচ্চাদের অনেকে নাকি রাতেও বায়না ধরে, বড়ো-মার কাছে শোবো। বোঝো অবস্থা!’

বড়ো-মার মুখটা একথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সমীর জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা-মায়েরা এদের নিয়ে যায় কখন?’

‘সন্ধে ছটার মধ্যে গোটা তল্লাট ফাঁকা হয়ে যায়। মালতী সব গুছিয়ে নীচে ওর ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। রেণু আর রজতও ফিরে আসে আধঘণ্টার মধ্যে। বাচ্চারা অবশ্য তার অনেক আগেই স্কুল থেকে ফেরে।’

আমি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম এরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শুনে। ভাবছিলাম, কেন এতক্ষণেও আসল বক্তব্যে আসতে পারছে না সমীর। অফিসে সে সপ্তাহে দশটা মিটিং করে। তার তো মূল বক্তব্যে আসতে এত সময় লাগারই কথা নয়।

আমিই শেষে অসহিষ্ণুতাটা প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘কিন্তু বড়ো-মা… আপনার তো এখন বিশ্রাম নেওয়ার বয়স। কী দরকার ছিল বলুন তো এসব ঝামেলা নেওয়ার? পৃথিবীতে আপনার বয়সি অনেক দুর্ভাগা নারী আছেন। যাদের ছেলেমেয়ে, বউমারা তাদের দেখে না। তারা যদি এরকম ক্রেশ খোলেন, তবু মানা যায়। তাই বলে আপনি?’

আমি একটানা ক্ষোভ উগরে দিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ি।

তাকিয়ে দেখি, বড়ো-মার মুখ থেকে তখনও হাসি লোপ পায়নি। হ্যাঁ, ভুুরুদুটো একটু বেঁকেছে। কিন্তু ওটুকুই।

শেষে বললেন, ‘এবার তাহলে তোমায় একটা প্রশ্ন করি মা?’

আমি বিরক্ত মুখে বললাম, ‘করুন।’

‘তোমার বাবা-মা তো তোমার দাদা-বউদির সঙ্গে থাকেন। ওঁরা সুখী?’

একটা ধাক্বা লাগল ওর প্রশ্নে। মনটা নিমেষে বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। ‘মা কেমন আছো’, জিজ্ঞেস করলে মা করুণ মুখটা তুলে যেভাবে বলে ‘ভালো আছি’, সেই স্তোক দেওয়ার ছবিটা মনে পড়ল। আমি জানি, মা-বাবা ভালো নেই দাদা-বউদির সংসারে। দুজনেই প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছেন বাস্তবের সঙ্গে আপস করার। আমি বুঝতে পারি ওরা ভালো নেই। আমরা কখনও গেলে বউদি ওদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা চেষ্টাই। কোনও কোনও প্রসঙ্গে, ছিটকে বের হয় বাবা-মায়ের প্রতি বউদির অশ্রদ্ধা আর নৈরাশ্য। আমরা সামনে আছি বলে বউদি দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে, কিন্তু বাবা ও মায়ের বেদনাটা তাতে চাপা পড়ে না। বিয়ের পর সব মেয়েই বাপের বাড়ির অতিথি। অসহায় হয়ে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না তখন আমার।

বাপের বাড়িতে মেয়েরা আনন্দ করতে যায়। আমি ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদি।

এই মুহূর্তে বিষণ্ণতায় আমার মনটা দ্রব হয়ে যায়। চোখদুটিও নত হয়ে আসে। মনের গভীরে কোনওমতে কান্না সামলাই।

বড়ো-মা হয়তো বোঝেন। মৃদু হেসে মাথায় হাত রাখেন। চমকে উঠে তাকাই বড়ো-মার দিকে।

শান্ত গলায় বড়ো-মা বললেন, ‘যতই লুকোনোর চেষ্টা করো, চোখের জলকে লুকোবে কী করে? বয়স্ক মানুষদের অবস্থাটা এখন এরকমই। একটা কথা বলি। তোমার নিজের উপরে যখন এরকম বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দায় পড়বে, তখন এই চোখের জলের কথা মনে রেখো মা!’

সমীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বড়ো-মা তখনই তার দিকে ফিরে বললেন, ‘আসলে কী জানো বাবা, স্বামীর উপার্জন কিংবা তার মনের উপর স্ত্রীর যতটা অধিকার, ততটা অধিকার মায়ের আর থাকে না। সেইজন্যেই আমার মনে হয়, তাদের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। আর, পরিশ্রমের কথাই যদি বলো, সেটাও অতটা গায়ে লাগে না। বাড়িতে বসে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো– এই তো কাজ! অথচ দ্যাখো, আমার বউমা কত খাটাখাটনি করে–!’

বড়ো করে শ্বাস নিলেন বড়ো-মা।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কেউ ভর্তি করতে চাইছে না বাচ্চাদের?’ ‘চাইছে তো! রোজই কত মানুষ আসে। অনেককে তো চিনিই না। এসে বলে, বড়ো-মা আমাদের বাচ্চাকেও রাখুন। মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডে বড়ো-মার ক্রেশে যাব বললেই, রিকশাওলা নাকি পৗঁছে দেয় এ বাড়িতে। কিন্তু আমি আর অন্য কাউকে নিতে পারব না কল্পনা। আমার তো অর্থের খুব চাহিদা নেই!’

আমরা দুজনেই প্লেট থেকে একটা করে সন্দেশ তুলে মুখে ফেলেছিলাম। মালতী দু-গ্লাস ঠান্ডা জল এনে দিল।

বড়ো-মা বললেন, ‘এবার শীতের ছুটিতে আমরা ক’জন বেড়াতে যাচ্ছি। একটা টুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে। তোমার বাবা-মাকেও বলো না কল্পনা। যদি ওরা আমাদের সঙ্গে যান, খুব ভালো লাগবে।’

আমি বিব্রত হওয়ার মতো চোখ করে সমীরের দিকে তাকাই। দাদা-বউদি যে মা-বাবাকে ছাড়তে রাজি হবেন না, সেকথা আমি যেমন জানি, সমীরও জানে।

তবু ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি কথা দিচ্ছি। ওরা যাবেন। আমি শিগগিরি ওদের সঙ্গে কথা বলব বড়ো-মা। আপনি পুরোনো যুগের মানুষ। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’

সমীর আবেগে আমার হাত চেপে ধরল।

——-

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব