আগুনের মুখোমুখি

পরিচিত এক গানের সুরে কলিংবেল-টা বেজে উঠতেই সংবিৎ ফিরে পায় নীপা। গত দু’দিন যাবৎ সে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। দুপুরে এই অসময়ে কে আসতে পারে? ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে লিলির রাত হয়ে যায়। আর ও তো সাড়ে দশটা– এগারোটার আগে কোনও দিন…

ফের বেজে ওঠে বেলটা, তবে এবারে ভিন্ন সুরে।

বাধ্য হয়ে নীপা বিছানা ছেড়ে ওঠে। কাজের মেয়েটি দেশে গেছে তো গেছেই, ফেরার নাম নেই। বেল বাজলে দরজা খুলতে যাবার বিষয়টা তার বিরক্তিকর লাগে। নাইটিটা পাতলা, হাত বাড়িয়ে হাউসকোট টেনে নেয় নীপা। সেটা গায়ে চাপিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলে একটি অচেনা মুখ নজরে পড়ে। ছেলেটির হাতে একগোছা কাগজপত্র।

নীপা নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে, ‘কে? কাকে চাই?’

‘কুরিয়ার। চিঠি আছে,’ উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে।

দরজা খুলে চিঠি হাতে নেয় নীপা। নির্দিষ্ট কাগজে সই করে ফেরত দেয়। ভেবেছিল, স্বামীরই কোনও চিঠিপত্র হবে। কিন্তু খামের উপর জ্বলজ্বল করছে তার নাম। চিঠি নিয়ে দরজা বন্ধ করে নীপা। প্রেরকের নাম নেই, আশ্চর্য! তবে কী? ধক করে ওঠে বুক।

দারুণ উত্তেজিত লাগে নিজেকে। হাতের লেখাটা চেনা-চেনা ঠেকছে। খামের একটি দিক ছিঁড়ে সে চিঠিটি বের করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে, ‘প্রিয় নীপা’। উত্তেজনা দমন করতে পারে না সে, দ্রুত চিঠির নীচে চোখ বোলায়– ‘উফ্, যা ভেবেছি, আঁতকে ওঠে নীপা, তলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘তোমার আর্যদা’। অজানা আতঙ্কে বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় নীপার, চিঠিটি আর পড়ে না। সামনের জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাড়িয়ে দেয় দূরে– আশ্বিনের মিষ্টি রোদে ভাসা আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ যেন অন্যমনস্ক একটি ঈগল পাক খাচ্ছে মন্থর গতিতে।

নীপার মনটা পিছিয়ে যায় একুশ বছর। ভবানীপুরে নীপাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। সে বাড়িতে নীপার বাবা তার দুই ভাই এবং তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন। নীপারা ছিল দু’ভাই, এক বোন। কাকার দুই মেয়ে, এক ছেলে। আর জেঠুর ছিল দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সবার ওপরে ছিলেন ঠাকুমা। এতগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে গোটা বাড়িটা সব সময় গমগম করত। হইহুল্লোড় লেগেই থাকত।

নীপার বাবা ছিলেন সংগীত পাগল মানুষ। শনি-রোববার হলে বাড়িতে গানের আসর বসত। কত যে লোকজন আসত, আসত ভাই-বোনদের বন্ধুবান্ধবরা। নির্ভেজাল আড্ডা জমত ছুটির দিনগুলিতে। উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। আজ এর জন্মদিন তো কাল ওর।

এরকমই একদিন খুড়তুতো দাদা নীল বলল, ‘এই নীপা, এদিকে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হল আমার বন্ধু, আর্য। আর্য কাশ্যপ। দুর্দান্ত ছবি আঁকে।’

নীপা কোনও মতে হাতজোড় করে বলেছিল, ‘নমস্কার’।

মৃদু হেসে আর্য বলেছিল, ‘তোর বোন যতটা লাজুক ঠিক ততটাই মিষ্টি।’

নীপার চোখমুখ এক অপার্থিব মায়াবী আলোয় ভরে উঠেছিল সেদিন। ‘আমি যাই’, বলে দ্রুত পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু এর দিন কয়েক পর কলেজ যাবার সময় আচমকা সিগারেট হাতে এগিয়ে এসেছিল আর্যদা, ‘কী নীপা চিনতে পারছ?’

নীপার বুক ঢিপঢিপ শুরু হল। আশেপাশে সামান্য তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, ‘কেউ দেখতে পাবে। এখানে না, কলেজে।’

ফিক করে হেসে সরে গিয়েছিল আর্যদা। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পায়ে পায়ে আশুতোষ কলেজ আর কতটুকু? দু’জনের প্রেম জমে উঠতে দেরি হয়নি।

তারপর কলেজ বাংক করে অসংখ্য দিন সিনেমা, রেস্টুরেন্ট, গঙ্গার পাড়, ভিক্টোরিয়া, সদন– দিনগুলোর কথা ভাবলে নীপার বুকটা হুহু করে ওঠে আজও। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত দু’জনের কথা বলে।

নীপা প্রায়ই বলত, ‘তুমি আমাকে কী দেখে ভালোবাসলে আর্যদা? তোমার কাছে আমি যে কিছুই না।’

উত্তরে আর্যদা হেসে বলত, ‘তুমি জানোই না তুমি কতটা সুন্দর। জানলে এ কথা বলতে না।’

বাস্তবিকই কন্দর্পের মতন রূপবান ছিল আর্য। উজ্জ্বল ফর্সা রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ। লম্বা সুঠাম চেহারার যুবকটির চমকপ্রদ কথাবার্তায় চুম্বকীয় আকর্ষণ। তার কাছে নীপা নিজেকে বড়ো অসহায়বোধ করত। পক্ষান্তরে নীপা মোটের ওপর সুশ্রী হলেও তাকে সুন্দরী বলা চলে না। থাকার মধ্যে ছিল কেবল সুগঠিত নারীসুলভ দেহ, আর মার্জিত ব্যবহার।

প্রতিদিনই শরীর চাইত আর্য। আর তা না পেলেই তার মুখ ভার হয়ে উঠত। অবশ্য সেই রাগ নীপাকেই ভাঙাতে হতো ফের শরীর দিয়েই। আর আদর করতেও জানে বটে ছেলেটা। কোথায়, কখন, কীভাবে ছুঁলে যে নারীদেহ অবশ হয়ে আসে, এলিয়ে পড়ে প্রতিরোধ বিহীন হয়ে, ভেসে যায় অনন্ত স্রোতে– তা বুঝি কেবল ওরই জানা। অমন করে আর ছুঁতে পারল কে? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নীপার বুক থেকে।

চিঠি হাতে ধরাই থাকে, পড়া হয় না। নীপা ভাবতে থাকে, কী লেখা থাকতে পারে এতে? আজ একুশ বছর পর আমার কাছ থেকে আর কী পাওয়ার আছে আর্যদার? বয়স তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। এ চিঠি আমার স্বামী কিংবা লিলির হাতে পড়লে কী সর্বনাশ হতো! শিউরে ওঠে সে। এরকম একটা ঘটনা যে আর্যদা ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কাই হচ্ছিল। গত পরশু দিন পার্টিতে যখন মি. চাওলা আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড আর্য কাশ্যপ। দ্য মোস্ট ডিসকাস্ড পেইন্টার অফ দিস আওয়ার। অ্যান্ড হিয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ড মি. চ্যাটার্জী অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, মুহূর্তের জন্য পায়ের তলা থেকে মাটি বুঝি সরে গিয়েছিল নীপার, ‘আ-র্য-দা’, অস্ফুটে উচ্চারণ করতে পেরেছিল কেবল।

জুলফিতে পাক ধরেছে ভালোই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও কী অপূর্ব সুন্দর মানুষটি! কিছু কিছু মানুষকে বুঝি বয়স তেমন ভাবে ছুঁতে পারে না। কত বয়স হবে আর্যদার? আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়ো ছিল, তার মানে ফিফটি প্লাস। আশ্চর্য! এক মাথা ঝাঁকড়াচুল, রিমলেস চশমা, পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর চমৎকার একটি শাল কাঁধে ভাঁজ করে ফেলা। প্রাথমিক নমস্কার সেরে ওদেরকে কথা বলতে দিয়ে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সরে এসেছিল নীপা। পার্টিতে ওদের আর কথাবার্তা হয়নি।

গত দুদিন যাবৎ বারবারই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল নীপার। বুঝতে পারে না, আর্যদার সামনে নিজেকে এত অসহায় লাগে কেন? মনে হয় বুঝি পায়ের তলায় মাটি নেই, কেবল বালি, তাও দ্রুত সরে যাচ্ছে। অথচ ওই মানুষটি এক দিন আমাকে চরম সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও কেঁপে ওঠে শরীর–

আর্যদার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল মিলি, জ্যাঠতুতো বোন। বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও ওরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। একদিন মিলি ওকে ডেকে বলল, ‘শোন নীপা, তোকে একটা কথা বলার ছিল।’

‘কী বলবি বল না।’

‘কথাটা শুনতে তোর একটুও ভালো লাগবে না, মন খারাপ হয়ে যাবে। হয়তো আমাকে ভুল বুঝবি’, বলল মিলি।

‘যা বোঝার বুঝব, তুই আর ঢং না করে বলেই ফেল কথাটা।’

‘না, মানে কথাটা আর্যদার সম্বন্ধে,’ ইতস্তত করে মিলি।

‘কী হয়েছে আর্যদার?’ উৎকণ্ঠা জাগে ওর গলায়।

‘না ওর খারাপ কিছু হয়নি’, মিলি বলে, ‘দ্যাখ আমার কানে ওর সম্বন্ধে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য এসেছে যার অর্থ ছেলেটি মোটেও সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে আরও একাধিক মেয়ের সম্পর্ক আছে। তুই সাবধানে থাকিস।’

‘তোর কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই প্রশ্ন করে নীপা।

‘না, আমার কাছে ওসব থাকবে কী করে? কানে এল, তাই তোকে সাবধান করলাম, এই আর কী।’

রাগে সেদিন ধুপধাপ করে হেঁটে নীপা চলে এসেছিল মিলির ঘর ছেড়ে। তবে কথাটা যে কতদূর সত্যি তা জানা গেল মাস ছয়েক পরই। নীপার প্রেমের বয়স তখন দু’বছর। সে তখন পার্ট টু দিয়েছে।

একদিন আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় বাড়িতে ডাক্তার এল। মুহূর্তে মারাত্মক সংবাদটা পৌঁছে গেল বাবা-দাদাদের কানে। প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠতে খানিকটা সময় লাগল সকলের। তারপরই সকলে হামলে পড়ল, ‘এ কর্মটি কার?’ উত্তর পেতে দেরি হল না। বড়দা ফোন করল আর্যদের বাড়ি।

আর্য-র মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগেই। বাবা বেঙ্গালুরুতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন উঁচু পোস্টে। বাড়ির কাজের লোক জানাল, ‘আর্ট এগ্জিবিশন উপলক্ষ্যে আর্য ফ্রান্স গেছে, কবে ফিরবে জানা নেই।’

নীপা অবাক। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও তো দেখা হল আর্যদার সঙ্গে, একটিবার জানাল না যে ও ফ্রান্স যাচ্ছে। আমাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে গেল আর্যদা! শরীরী গল্পে যদিও ওরা যথেষ্ট সাবধানতা নিত, তবে মাঝে মাঝে বড়ো বেপরোয়া হয়ে উঠত আর্যদা। কিন্তু তার পরিণাম যে এমন বিষময় হয়ে উঠতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। দুশ্চিন্তায় মা-বাবার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা পাচ্ছিল না নীপা। কানাকানিতে গোটা বাড়ি জেনে ফেলল ঘটনা। মা-বাবা-দাদাদের মুখ ভার। কেউ কোনও কথা বলছে না, বললেও একটা দুটো। দিনরাত ফিসফাস, গুজগুজ, ছিঃ ছিঃ-তে কান পাতা দায়। উফ্, কী ভাবে যে সে দিনগুলো কেটেছে!

সে যাত্রা উদ্ধার করেছিলেন কাকা। কাকার পরামর্শ অনুযায়ী বাবা-জ্যাঠা দু’জনেই মত দিয়েছিলেন উপযুক্ত পাত্র দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীপার বিয়ে দিতে হবে। তবে তার আগে একবার নার্সিংহোম ঘুরিয়ে আনতে হবে ওকে।

কিন্তু নীপার কপালে আরও কষ্ট লেখা ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন, মাত্র দু’মাস বয়স হলেও কী এক জটিল কারণে এক্ষেত্রে নীপার উদ্ধার পাওয়া কঠিন। তা করতে গেলে পেশেন্ট জীবনে আর মা হতে পারবে না। একেই বুঝি বলে, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।

তড়িঘড়ি খোঁজা হতে লাগল পাত্র। আশ্চর্যজনক ভাবে জুটেও গেল একজন। পাত্র বিদেশে চাকরি করে এক নামি কোম্পানিতে। বাড়ি বালিগঞ্জে। মা-বাবা এখানে থাকলেও তাকে বরাবর বাইরেই থাকতে হবে। মাত্র এক মাসের ছুটিতে এসেছে দেশে বিয়ে করবে বলে। তার জন্য পাত্রী ঠিক করাই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাত্রী জানিয়েছে যে তার অমতে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে এবং যেহেতু সে একজনকে ভালোবাসে তাই তার পক্ষে তাকে বিয়ে করা সম্ভব হবে না।

কী করে কে জানে যোগাযোগ ঘটে গেল দু’পক্ষে! দু-চারদিনের মধ্যে কথাবার্তা পাকা। পাত্র অবিনাশ বলল, ‘আমি একবার পাত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।’

প্রস্তাব শুনে প্রমাদ গুনল সকলে, এই বুঝি কেঁচিয়ে যায় বিয়ে। ততদিনে নীপা অনেকটাই পরিণত। সেও চাইছিল এমন একটা কিছু হোক। নির্দিষ্ট দিনে সে আর মিলি এসে দেখা করল অবিনাশের সঙ্গে। ওর সঙ্গেও ছিল এক বন্ধু। প্রাথমিক পরিচয় সেরে এসপ্ল্যানেডে এক রেস্তোরাঁতে ঢুকে রিজার্ভড সিটে বসে অবিনাশ বলল, ‘বলুন ম্যাডাম, স্বামী হিসাবে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবেন? অনেক বদগুণ আছে কিন্তু আমার।’

অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নীপা জবাব দিয়েছিল, ‘তার আগে আপনার জানা উচিত স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে গ্রহণ করতে পারবেন কি না?’

‘কী ব্যাপার, এনি প্রবলেম?’ কপাল কুঁচকে ওঠে অবিনাশের।

ভনিতা না করে নীপা সরাসরি বলে, ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

‘এখন ভালোবাসেন না?’

‘না, সম্ভবত না,’ একটু থেমে থেমে জবাব দেয় নীপা।

‘ব্যস, তা হলে তো প্রবলেম মিটেই গেল। এখন আমাদের লাইফ পার্টনার হতে বাধা কোথায়?’ সহজ কণ্ঠে বলে অবিনাশ।

মাথা নীচু করে থাকে নীপা, উত্তর দেয় না। হঠাৎ হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। অবিনাশ ঘাবড়ে যায়, উঠে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে শান্ত করতে চেষ্টা করে, ‘রিল্যাক্স, রিল্যাক্স নীপা, কাঁদছ কেন? এভাবে কাঁদার কোনও মানে হয়? কী হয়েছে খুলেই বলো না আমাকে।’

‘পারব না, কিছুতেই পারব না। একজন আমাকে ঠকিয়েছে, তাই বলে আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না,’ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় নীপা।

‘এখানে ঠকাবার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? দ্যাখো, ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। তুমি যাকে ভালোবেসেছ হয়তো সে তোমাকে তার মর্যাদা দেয়নি। সব কথা তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে, এরপরও ঠকাবার প্রশ্ন থাকছে কোথায়?’

‘থাকছে। এরপরও থাকছে, বিকজ…’

‘বিকজ?’

‘বিকজ, আয়াম ক্যারিং’, রুমালে মুখ চাপা দেয় নীপা। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় অবিনাশ দারুণ আহত হয়। বুঝে উঠতে পারে না এক্ষেত্রে তার কী বলা উচিত। কেবল নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।

খানিক পর বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার রাখতে মাথা তোলে নীপা। চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। অবিনাশ ওর প্লেটে খানিক খাবার তুলে দেয়। বলে, ‘নাও, খেতে শুরু করো।’

নীপা আঙুলে চামচ ধরে নাড়াচাড়া করে, খেতে মন চায় না তার। মুখ থেকে কোনও কথা বেরোয় না। দু’চোখে ভরা জল। মিলি ওর পিঠে হাত বোলায়।

অবিনাশ বলে, ‘ব্যাপারটা মেডিক্যালি কিছু করা যায় না?’

নীপা বুঝতে পারে ও কী মিন করছে। বলে, ‘সম্ভব নয়। ডাক্তার বলেছেন, সেক্ষেত্রে ইন ফিউচার আমার মা হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলে অবিনাশ। ওর বন্ধুর দিকে তাকায়। তাকেও অসম্ভব বিস্মিত দেখায়। এরপর ওরা অসম্ভব ব্যস্ততায় কাঁটাচামচ হাতে খাবারে মনঃসংযোগ করে। একটাও কথা বলে না। একসময় খাওয়া শেষ হয়। তারপর অবিনাশ হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘নীপা, আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি– আমি তোমাকে বিয়ে করব।’

নীপা অবাক চোখে তাকায়, ‘কী বলছেন! এত সব জানার পরও আপনি!’

‘এসব আমাকে না জানালেও পারতে তুমি, সেক্ষেত্রে আমি চিটেড হলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু তা তুমি করোনি, বিকজ ইয়্যু আর অনেস্ট। অ্যান্ড অনেস্টি ইজ দ্য রেয়ারেস্ট কোয়ালিটি, ইয়্যু নো? তোমার সততাকে সম্মান জানাতেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই আমি, অবশ্য তুমি যদি আমাকে পছন্দ করে থাক।’

নীপার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অন্ধকার। সেখানে অবিনাশ একমাত্র আশার তরি। তাতে চড়ে বসা ছাড়া তার আর উপায় কী? যত শিগগির সম্ভব রেজিস্ট্রি ম্যারেজ সেরে অবিনাশ ওকে নিয়ে উড়ে গেল কানাডা। সেখানেই জন্ম হল লিলির। বছর দশেক কানাডায় থাকার পর ওদের ফিরতে হল দেশে। কারণ অবিনাশের কোম্পানি কলকাতায় ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছে। অবিনাশ উদার মনের মানুষ। আপন মহত্ত্বে সে লিলিকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছে। লিলি তো বাবা বলতে অজ্ঞান। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এতদিন। নীপা আর কোনও দিন কারও কাছে আর্য সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো এড়িয়ে থেকেছে বরাবর। আর ভাবতে পর্যন্ত চায়নি এব্যাপারে। সেদিন পার্টিতে দেখা মাত্র এড়িয়ে গেছে, প্রশ্রয় দেয়নি দুর্বলতাকে। কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক তীব্র আবেগের উৎরোল। আজ এই চিঠি, কী লিখেছে দেখাই যাক–

‘প্রিয় নীপা,

নিশ্চয়ই অনেক মান-অভিমান বুকে জমে আছে। অনেক অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু বলি, আমারও বলার কিছু ছিল। সব শোনার পর আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণা বদলাবে কী না জানি না, তবে আমার মধ্যে যে অপরাধবোধ নিয়ত কাজ করে তা কিছুটা হালকা হবে। দীর্ঘকাল ধরে যে যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি তা থেকে মুক্তি পাবার একটা সুযোগ অন্তত দাও। চিঠির তলায় আমার মোবাইল নাম্বার আছে, ফোনে জানিও, কোথায় কীভাবে দেখা হওয়া সম্ভব। প্লিজ নীপা, একটি বার, মাত্র একটি বার মাত্র কিছু সময়ের জন্য দেখা কোরো তুমি।

তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি,

তোমার আর্য ’

পড়া শেষ হলে চিঠিটা হাতের মুঠোতে মুচড়ে ধরে নীপা। অস্ফুটে বলে, ‘না না, কখনওই না। আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা নেই। কোনও কথা থাকতে পারে না। আর কোনও সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। একদিন আমার সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে ভালোবেসেছিলাম, উজাড় করে দিয়েছিলাম আমার অনাঘ্রাতা শরীর। দস্যুর মতো লুঠ করেছ তুমি আমাকে, যা খুশি করেছ, প্রতিবাদ করিনি। সেই তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, অমর্যাদা করলে আমার ভালোবাসার? তোমাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন। না না, কিছুতেই দেখা করব না আমি তোমার সঙ্গে।’

আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। ঘড়ির দিকে তাকায় নীপা, সাড়ে চারটে। মানুর মা এল বোধহয়। ‘যা-ই’, বলে সাড়া দেয়। বিছানা ছেড়ে উঠে যায় দরজা খুলতে।

মানুর মা ঘরে ঢুকলে নীপা বলে, ‘আগে ভালো করে একটু চা করো তো, তারপর বাসনপত্র মেজো।’

ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে নীপা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে মোটেও আর্যদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে না। কারণ আর্যদার মুখোমুখি হলেই সে ফের দুর্বল হয়ে পড়বে। তার ভরাট সংসার ছারখার হয়ে যাবে।

সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে হঠাৎ একটা কোকিল ডেকে ওঠে, কু…হু।

নীপা গাছটির দিকে তাকায়। অজান্তেই ভালো লাগার একটা আবেশ তাকে জড়িয়ে ধরে।

দিনতিনেক পর দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছিল নীপা। খানিক চোখও লেগে গিয়েছিল। এমন অসময়ে হঠাৎই বেলটা বেজে উঠতে এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে নীপার।

এই ক’দিন নীপা মনে মনে কামনা করছিল আর্যদা এ বাড়িতে আসুক। না না, অতটা সাহস হবে না নিশ্চয়ই। গায়ে একটা ওড়না দিয়ে এসে দরজা খোলে নীপা।

‘আর্যদা!’ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। হাত-পা বুঝি অবশ হয়ে আসে, মুখ থেকে কথা বেরোয় না।

‘ভিতরে আসতে বলবে না?’ মুখে সেই দেবদূতের মতো হাসি।

‘এসো’, বলে দরজা ছেড়ে এগিয়ে যায় নীপা বসার ঘরের দিকে। একসময় সোফায় দুজন মুখোমুখি বসে দুদিকে।

আর্যর চোখ যায় টেবিলে একটা ফোটোস্ট্যান্ডের দিকে, চোখে প্রশ্নচিহ্ন জাগে।

নীপা বলে, ‘আমার মেয়ে।’

‘শুধুই তোমার?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আর্য।

নীপা উত্তর দেয় না, মাথা নীচু করে।

‘আমার চিঠি পেয়েছিলে নিশ্চয়ই?’

ইতিবাচক মাথা নাড়ে নীপা।

‘তাহলে ফোন করোনি কেন? বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে আসতে হল আমাকে। অবশ্য আমি জেনেই এসেছি যে তোমার হাজব্যান্ড এখন অফিসে।’

‘কী করে জানলে?’

‘কেন, ওর অফিসে ফোন করে দু’চারটে কথাবার্তা বললাম, তারপর সোজা চলে এলাম এখানে।’

‘এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে? চিঠি পাঠালে কী করে?’

‘সেদিন পার্টিতে আলাপের সময় আমার কার্ডটা দিতে সৌজন্য বশত মি. চ্যাটার্জিও ওর কার্ডখানা আমাকে দেন। তাতে ওর ফোন নাম্বার, অফিস, বাড়ি ইত্যাদির অ্যাড্রেস ছিল। ছিল না কেবল রেসিডেন্সের ফোন নাম্বার।’ জবাব দিল আর্য।

‘থাকলে ফোন করতে বাড়িতে?’ প্রশ্ন করে নীপা

‘হয়তো করতাম।’

‘কী লাভ? আর কী চাও তুমি আমার কাছে?’

‘কিছুই না, শুধু ক’টা কথা বলতে আসা। বুকটা বড়ো ভারী হয়ে আছে,’ বলে আর্য।

‘কী বলতে চাও তুমি বলো,’ নীপার কণ্ঠস্বর নিস্পৃহ শোনায়।

‘বলার হয়তো অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না,’ বলল আর্য। ‘ঠিক মতো বলতে পারব কি না, তাও জানি না। মাত্র তিন দিনের নোটিশে ছবি নিয়ে ফ্রান্সে যেতে হয়েছিল আমাকে প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে। সে যে কী ঝকমারির ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না। তাড়াহুড়োয় তোমাকে খবর দিতে পারিনি। ফ্রান্সে আমাদের পনেরো দিনের প্রোগ্রাম ছিল। এগ্জিবিশনটা আমার জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছিল, বলতে পারো আমার শিল্পী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম শক্ত সোপান। ওই পনেরো দিনেই বহু ইলাস্ট্রেটার, পেইন্টারদের সঙ্গে আলাপ হয়। আমার ছবি ওদের ভালো লেগেছিল। এক ছবি ব্যবসায়ী আমার ছবিগুলি ভাড়া নিতে চায় ছ’মাসের জন্য। সে ওগুলি পারীর বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শন করতে চায়। প্রচুর টাকা অফার দেয়। চুক্তি ছিল, ছবি বিক্রির লাভ ফিফটি – ফিফটি, তবে আমাকে ওই ছ’মাস ওদেশেই থাকতে হবে। সব ব্যবস্থা ওরাই করবে।

আমি রাজি হয়ে যাই ওদের প্রস্তাবে। ছ’মাসে আমার প্রায় সব ছবিই বিক্রি হয়ে যায় চড়া দামে। কাগজে কাগজে আমার নামে লেখা হয় ফলাও করে। ছবির প্রতি প্যাশন তো আমার ছিলই, অর্থ আর খ্যাতির মোহে ডুবে রইলাম আরও ছ’মাস। তারপর ফিরে এলাম দেশে। ততদিনে আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। চড়া দামে বিকোয় আমার ছবি।’

আর্য থামে কিছু সময়ের জন্য, বোঝার চেষ্টা করে নীপার হাবভাব। তারপর ফের বলতে থাকে, ‘কলকাতা ফিরেই আমি তোমার খোঁজ করি। জানতে পারি, আমি চলে যাবার পরই নাকি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি পাড়ি দিয়েছ কানাডা। ফ্রান্স থেকে বার কয়েক তোমাদের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কথা শুনে বুঝেছিলাম তোমাদের বাড়ির কেউই চায় না আমি ফোন করি তোমাকে। একদিন মিলির সঙ্গে দেখা করে তোমার সম্পর্কে জানতে পারি সব কথা। বুঝতে পারি, কী চরম দুর্যোগের মধ্যে তোমাকে ফেলে সেদিন চলে গেছিলাম আমি। আমার জন্য কত ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তোমাকে। নীপা বিশ্বাস করো তুমি,’ আর্য উঠে আসে সোফা থেকে, নীপার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, ‘সেদিনের সে ভুলের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত আমি। আমাকে ক্ষমা করো তুমি, প্লিজ ক্ষমা করো নীপা।’

নীপার চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে। কোনও অভিযোগ সে করতে পারে না আর্যকে।

‘কেঁদো না নীপা, প্লিজ কেঁদো না, আমাকে ক্ষমা করো তুমি’, সোফায় উঠে বসে আর্য।

হাত ছাড়িয়ে নেয় নীপা, নিজের দু’হাতের তালুতে মুখ ঢাকে। এত বছরের জমাটবাঁধা বরফ বুঝি আজ গলে জল হয়ে নেমে আসছে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো, নীপা বারবার চোখ মোছে। আর্য ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ সব ভুলে নীপা দু’হাতে আর্যর বুকে দুমদুম করে কিল মারতে থাকে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ডাকাত, ডাকাত একটা। আমার সব লুটেপুটে ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছে। শয়তান, আর কী চাও? আর কী নিতে এসেছ এখানে?’ সে পাগলের মতন আঘাত করতে থাকে আর্যকে।

‘শান্ত হও নীপা, প্লিজ শান্ত হও’, ওকে কোনও মতে নিরস্ত করার চেষ্টা করে আর্য। একহাতে নীপাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ওর ওড়না দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুমু খায় ওর কপালে বারবার।

ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে নীপা। চোখের জল থামে। প্রশ্রয় প্রাপ্ত চুম্বনেরা অবাধ্য হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে। নীপা অসহায় ভাবে কেবল বলে, ‘আর্যদা, না না, এভাবে আমার সব ভাসিয়ে দিও না।’

কিন্তু ততক্ষণে দুটি শরীর জেগে গেছে…

দীর্ঘ সময় পর উঠে দাঁড়ায় আর্য। নীপা তার বিশ্রস্ত বেশবাস ঠিক করে। কিন্তু এরপরই এক তীব্র অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে নীপাকে। কোনও কথা না বলে সে উঠে চলে যায় টয়লেটের দিকে।

কফি নিয়ে নীপা যখন ঘরে ঢোকে দেখতে পায়, আর্য টেবিল থেকে লিলির ফোটোস্ট্যান্ডটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নীপার পায়ের শব্দে বলে, ‘কত বড়ো হল ও?’

‘এমএ পড়ছে’, মৃদু স্বরে জবাব দেয় নীপা, ট্রে থেকে একটা কাপ আর্যর দিকে এগিয়ে দেয়। অপর কাপটি নিজে নিয়ে বিস্কিট সমেত ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখে।

‘এখন কেমন হয়েছে দেখতে?’

‘ভালো’, সংক্ষেপে উত্তর দেয় নীপা।

‘এ কী গো দিদিমণি, দরজা খোলা কেন?’ বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে মানুর মা।

চমকে ওঠে নীপা, ‘সে কী! সদর দরজা এতক্ষণ খোলা ছিল!’

নীপাদের বসার ঘরটা একতলার কোণার দিকে, বাকি তিনটে ঘর সাধারণত বন্ধই থাকে।

নীপা ভাবে, যদি কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ত, আর ওই অবস্থায় দেখে ফেলত? সর্বনাশ ঘটে যেত। নীপা বলে, ‘তুই দরজা বন্ধ করে আয়।’

প্রকৃতপক্ষে সর্বনাশ যা ঘটার তা আগেই ঘটে গেছিল।

মানুর-মা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে রান্নাঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেক পর সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘লিলিদি বেরোচ্ছ? কিছু খেয়েছ?’

‘সে কী! লিলি ঘরে? সর্বনাশ! কখন এল ও? ওর তো এখন ফেরার কথা নয়!’ নীপার মাথায় বুঝি বাজ পড়ে। মনে হয় মাথাটা ঘুরছে। ওদিকে দুমদাম শব্দে লিলির পদক্ষেপ এগিয়ে আসছে। ওকে এভাবে যেতে দেওয়া যাবে না, ভাবে নীপা। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নীপা ওকে আটকায়, ‘দাঁড়া লিলি, কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

হিংস্র মার্জারিনির মতো ফুঁসে ওঠে লিলি, তীব্র ঘৃণা ওর দু’চোখে। বলে, ‘ছিঃ! এই তোমার পরিচয়? হঠাৎ বাড়ি ফিরে না আসলে জানতেই পারতাম না। অমন দেবতার মতো স্বামীকে এভাবে চিট করছ তুমি, তোমার লজ্জা করে না?’

নীপা বলে, ‘শোন লিলি, তোকে সব খুলে বলছি আমি। ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ ওর হাত দুটি ধরে মিনতি জানায় নীপা।

ততক্ষণে আর্য এগিয়ে এসেছে, ‘লিলি, বি কাম লিলি। শান্ত হও।’

‘শাট আপ ইয়্যু স্কাউন্ড্রেল,’ চেঁচিয়ে ওঠে লিলি। ‘এ বাড়িটা আমার হলে আপনাকে আমি জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।’

আর্যর মুখে বুঝি সপাটে থাপ্পড় মারে কেউ, এভাবে জীবনে তাকে অপমান করেনি কোনও মানুষ। লেডিকিলার হিসাবে নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তার। আজ তারই সন্তান কী না… মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে ওর।

লিলির কথাবার্তায় দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে নীপা, চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘লিলি! তুই কাকে কী বলছিস, জানিস, ও তোর কে হয়?’

দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস শব্দে লিলি বলে, ‘আজই জানতে পারলাম। এরকম দুশ্চরিত্র লম্পট পুরুষ আমার ‘বাবা’ জেনে লজ্জা হচ্ছে। আর তোমার মতো অসংযমী নোংরা মহিলাও ‘মা’ সম্বোধনের পক্ষে অযোগ্যা। আই হেট ইউ, ইয়েস, বোথ অফ ইউ।’

‘বাবা’ যদি বলতেই হয় তো বলব অবিনাশ চ্যাটার্জিকে। যিনি সব কিছু জানার পরও আমাকে নিজের সন্তান হিসাবে বুকে তুলে নিয়েছেন, উজাড় করে ভালোবেসেছেন, তোমার প্রতি স্বামীর সমস্ত কর্তব্য করেছেন।’

আর্য বলে, ‘শোন মা শোন, তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর…’

‘চুপ, একদম চুপ, আমাকে একদম ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। আই অ্যাম নট আ সেন্টিমেন্টাল ফুল লাইক নীপা, আন্ডারস্ট্যান্ড?’ জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে লিলি সরাসরি তাকায় আর্য কাশ্যপের দিকে।

সেই আগুনঝরা দৃষ্টির সামনে কেমন কুঁকড়ে যায় আর্য। এই প্রথম বুঝি সে সত্যের মুখোমুখি হয়। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নেয়, অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, কোনও কথা বেরোয় না তার মুখ থেকে।

ঠকঠক ঠকঠক দ্রুত শব্দ তুলে হেঁটে এগিয়ে গেল লিলি, দরজা খোলার আওয়াজ হল সজোরে।

——-

কার্তিকের বনলতা

রবিবার। সন্ধ্যায় চা-দোকানে জমজমাট আড্ডা। ছুটির দিন হওয়ায় উপস্থিতির সংখ্যাও বেশি। সেই কলেজ লাইফে শুরু, দেড়যুগ পেরিয়ে আজও চলছে। সারাদিনের কাজকর্মের শেষে এখানে মিলিত হওয়াটা এখন অভ্যাস। কর্মসূত্রে যাদের বাইরে থাকতে হয়, সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে তারা মিলিত হয়। সুখ-দুঃখের কথা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, এমনকী বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হয়। আজকের বিতর্কের বিষয় যেমন পুরসভা নির্বাচন। অর্থাৎ শাসকদল-কে সমর্থন করা উচিত কি না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। সমস্ত বিতর্কে জল ঢেলে দিয়েছে কার্তিকের হাসি হাসি মুখে আবির্ভাব।

বন্ধুদের মধ্যে কার্তিক একমাত্র আইবুড়ো। এখনও হাল ছাড়েনি। গত পাঁচ বছরে কত মেয়ে দেখেছে তার হিসেব নেই। এক জনকেও মনে ধরেনি। অথচ তাদের অনেকেই রূপে-গুণে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সব দিক থেকেই ঈর্ষণীয়। আমাদের অনেকেই ওরকম কোনও মহিলাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে রীতিমতো গর্ব অনুভব করতাম। কার্তিক অপছন্দ করছে।

– কেন রে? এর থেকে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

– সে কথা বলিনি তো।

– তবে অপছন্দ কেন?

– ঠিক জানি না। তবে যেমন চাইছি ঠিক তেমনটা নয়।

– কেমন চাইছিস?

– তাও জানি না। মানে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ধর এরকম হবে, যাকে দেখলে মনটা ভরে যাবে। মনে হবে এতদিন তো একেই খুঁজছিলাম। এর কাছেই গচ্ছিত আছে আমার সুখের ঘরের চাবি। সে দেখতে সুন্দরী হতে পারে আবার নাও হতে পারে, কালো হতে পারে আবার ফরসাও হতে পারে, বেঁটে হতে পারে আবার লম্বাও হতে পারে, রোগা হতে পারে আবার মোটাও হতে পারে।

– এই থাম। কার্তিককে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, নেশাটেশা করে এসেছিস নাকি! ভাট বকতে শুরু করলি…

বন্ধুদের মধ্যে কবিরত্ন হিসাবে খ্যাত সপ্তর্ষি হোড় কথার জের টেনে নিয়ে বলেছিল, তোরা থাম। কার্তিকের সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি। ও বনলতা সেন খুঁজছে। ‘আমাদের দু’দণ্ডের শান্তি দিয়েছিল নাটোরের…’

– তো কোথায় সে নাটোর, ঠিকানাটা দে, খুঁজে আনছি। প্রয়োজন হলে পাতাল ফুঁড়ে পৃথিবীর ওপ্রান্ত থেকেও তাকে তুলে আনব। কার্তিকের জন্য আমরা সব করতে পারি।

কার্তিক গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। সব বিষয়ে ঠাট্টা তার অপছন্দ। ইদানীং একটা জিনিস সে লক্ষ্য করছে, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা বন্ধুদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সেদিন থেকেই এ বিষয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলা সে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মনের মানুষ খোঁজার উৎসাহে কোনওরকম ছেদ পড়েনি। প্রতি রবিবারই নিয়ম করে কোথাও না কোথাও মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।

আজই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল। কার্তিকের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ভ্যানিস হয়ে গেল নির্বাচন। বদলে গেল আলোচনার বিষয়। কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে একটাই প্রসঙ্গ

– মেয়ে পছন্দ হল?

– মেয়ে দেখতে কেমন রে?

– পড়াশোনা?

– বাড়ি কোথায়?

– হাইট?

– ছবি এনেছিস?

একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের মুখে পড়েও কার্তিক আজ বিব্রত হল না। বরং মুখের হাসিটি আরও চওড়া হল। বসতে বসতে বলল, বউদি এককাপ চা। তারপর ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। না না বিড়ি নয়, সিগারেটই। দেখতে একটুও ভুল হচ্ছে না আমাদের। মৌজ করে একটা টান দিয়ে বলল, তোদেরকে কিছু বলাও বিপদ। সব বিষয়ে ইয়ার্কি মারাটা তোদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার না বলেও থাকা যায় না। হ্যাঁ, মেয়ে পছন্দ হয়েছে। অনেকটা সেই মেয়ের মতো। শান্তনু জানে, সেই যে কাকদ্বীপ পাঁচ মাইল…

একটু থমকাই। মুহূর্তমাত্র। মনে পড়ে যায়, জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটা। কার্তিকের জীবনে তো বটেই।

প্রায় দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। তিন বন্ধু মিলে বকখালি বেড়াতে গিয়েছি। তিন জনই কাঠ বেকার। একমাত্র টিউশনি ভরসা। সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণের জন্য তাই কাছেপিঠে ভ্রমণের পরিকল্পনা। তাও মাত্র দু’দিনের টুর। পরের দিন হোটেল ভাড়া বাঁচানোর জন্য বারোটার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়েছি। ফুটপাথের হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে একটায় কলকাতাগামী বাসে।

পাশাপাশি তিনটে সিটে আমরা তিনজন। বাস ছাড়তেই জুতো-মোজা খুলে আরাম করে বসলাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছি। শান্তনু একটু বেশি কথা বলে, মূলত সেই বকছে। মাঝে মধ্যে আমি। কার্তিক একেবারে চুপচাপ। হঠাৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম। অথচ বাস চলছে স্পিডে। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে।

– কী ব্যাপার কার্তিক, এত ঘামছিস?

– ও কিছু না, এমনিই।

– জানলায় বসবি?

– না, ঠিক আছে।

বাস ছুটে চলে। আমরা ফিরে আসি পুরোনো প্রসঙ্গে। বকবক করি। কিছুক্ষণ পর আবার তাকাই কার্তিকের দিকে। চোখ মুখ লাল। দর দর করে ঘামছে। কেমন একটা অস্বাভাবিক দৃষ্টি।

– শরীর খারাপ লাগছে?

– না। কার্তিক মাথা নাড়ে।

– চোখ মুখ লাল কেন?

– গরমে বোধহয়।

– দেখিস, লুকাসনে। শরীর খারাপ লাগলে বলিস। সঙ্গে ওষুধপত্র আছে।

বাস ততক্ষণে কাকদ্বীপ পার হয়েছে। ভালোই চলছে। এভাবে চললে ঠিক সময়েই ধর্মতলা পৌঁছে যাব। পরবর্তী স্টপেজ পাঁচ মাইল। খুব ছোটো জায়গা। হাতে গোনা গুটি কয় দোকান নিয়ে গ্রাম্য বাজার। বাস এসে স্টপেজে থামতেই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় কার্তিক। এক ছুটে বাসের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, আর পারছি না। জোর চেপেছে।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নেমে যায়, ব্যাগপত্র ফেলে। হাতে কেবল জলের বোতলটা। তড়িঘড়ি আমরাও এগিয়ে যাই মালপত্র নিয়ে। এক হাতে লাগেজ, অন্যহাতে জুতো। কিন্তু নামতে পারি না, তার আগেই বাস ছেড়ে দেয়। কনডাক্টরকে বলি বাস থামাতে। সে রাজি হয় না। এটা লোকাল বাস নয়। তারপর সরকারি। নিয়মের বাইরে সে বেরোবে না। অনেক কাকুতিমিনতির পর এবং অন্যান্য প্যাসেঞ্জারের আবেদনে যদিও বা বাস থামে, ততক্ষণে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি।

হাঁটু অবধি গোটানো প্যান্ট, হাতে জুতো এবং লাগেজ– এমন কিম্ভুত অবস্থায় নামতে দেখে লোকজন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অন্যগ্রহের জীব দেখছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে দু’একজন এগিয়ে আসে। জানতে চায়। সমস্ত শোনার পর তারাই একটা ভ্যান-রিকশার ব্যবস্থা করে দেয়।

মিনিট কুড়ি-পঁচিশের ব্যবধানে ‘পাঁচমাইল’ স্টপেজ। স্টপেজ লাগোয়া একটা পান গুমটিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করি, দাদা এখানে ল্যাট্রিন কোথায়?

– বলতে পারব না। আমার কাছে নেই।

– না না, আমরা কিছু কিনতে আসিনি। জানতে চাইছি বাজারে পায়খানা ঘর কোথায়?

দোকানি লোকটা আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, কী ব্যাপার বলেন তো? একটু আগে একজন পায়খানা খুঁজতে এসেছিল, এখন আপনারা…

– আমরা তাকেই খুঁজতে এসেছি।

– তা এখেনে কেন, দ্যাখেন না মাঠে গিয়ে। চারপাশে অনেক মাঠ আছে। তাকেও মাঠে পাঠিয়েছি।

বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে ছোট্ট বাজার। বাজার পেরোলেই মাঠ। যে-কোনও দিকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই আদিগন্ত চাষের জমি। আন্দাজে কোন দিকে খুঁজতে যাব? বরং এখানেই অপেক্ষা করি। যে দিকেই যাক কাজকম্ম মিটিয়ে এখানেই ফিরে আসবে। বাজার চত্বরেই ঘোরাফেরা করি আমরা।

বেশ অনেকক্ষণ বাদে বাবু এলেন হাসতে হাসতে। চোখ মুখ স্বাভাবিক।

– হয়েছে? জিজ্ঞাসা করলাম।

কার্তিক ঘাড় নাড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে… বাপরে, কী জায়গা! জীবনে ভুলব না। উফ্!

– কেন কী হয়েছে?

– সে অনেক কথা, কার্তিক কোনওরকম রাখঢাক না করেই বলে, বাস থেকে নেমে প্রথমেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখতেই পাচ্ছিস এটা একটা বাজার। এমন জায়গায় বারোয়ারি ল্যাট্রিন থাকা স্বাভাবিক। দু’জন লোক ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা এখানে পায়খানাটা কোথায়? আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য লোক দুটো মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, বাইরের মানুষ?

– আজ্ঞে হ্যাঁ।

– কোথায় বাড়ি?

– কোলকাতা।

– এখানে কার বাড়িতে আসা হয়েছে?

– আজ্ঞে, কারও নয়।

– তবে বুঝি কাজে এসেছেন?

– তাও না।

– তবে?

– পায়খানা করতে।

– কোলকাতা থেকে পাঁচমাইল এসেছেন হাগতে! ঠাট্টা করছেন আমার সাথে। জানেন আমি কোন গাঁয়ের মানুষ? লোকটা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। এই মারে তো সেই মারে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি সামলে নিই, সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে অনুরোধ করি, যদি একটু সাহায্য করেন।

লোকটা শান্ত হয়। বিশ্বাস করে আমার কথা। বলে, দ্যাখেন আমরা ভীন গাঁয়ের মানুষ। কইখালির বাসিন্দা। এখান থেকে তিন মাইল। পঞ্চাত পোধান রফিকুল মোল্লার নাম শুনেচেন তো? আমরা সেই রফিকুল মোল্লার গাঁয়ের লোক। পাঁচমাইল এসেছি বাজার করতে। ছোটো ভাইয়ের সম্বন্ধি এয়েছে তো! নতুন কুটুম, বুঝতেই পারছেন… ডালভাত তো দেয়া যায় না। তাই কেজি খানিক পাখির মাংস নিলাম। এ দিগরের খবর আমরা বিশেষ জানিনে।

বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। প্রায় প্যান্টে হব হব। আর উনি লাগলেন মহাভারত শোনাতে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে অথচ কিছু বলতে পারছি না। লোকটার কথা শেষ হতেই বললাম, ধন্যবাদ। মানে কেটে পড়লাম। ওই যে পান-বিড়ির গুমটিটা দেখছিস না, ওখানে গেলাম। ভেতরে একটা লোক বসে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছিল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে সেও এক দৃষ্টিতে তাকাল। ভ্রান্তি মেটাতে বললাম, আমি বাইরের মানুষ। জোর চাপায় বাস থেকে নেমে পড়েছি। বাজারে কোথাও পায়খানা নেই?

– না নেই। কী করে থাকবে শুনি। বাজার কমিটি তো করতে চেয়েছিল, পঞ্চাত পোধান বাধা দিল। আলাদা পার্টি বলে এমন কাঠি নাড়ল যে…

– আপনারা কোথায় করেন হঠাৎ চাপলে?

– রাজনীতির মুখে।

– প্লিজ দাদা, সত্যি বলছি জোর চেপেছে…

– জোর চেপেছে তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন, জান না, চারদিকে এত মাঠ চোখে দেখছেন না?

পরামর্শটা মনে ধরে গেল। লোকালয় থেকে বেরোতে পারলেই ফাঁকা মতো একটা জায়গা দেখে বসে পড়া যাবে। আগে তো হালকা হই, পরের কথা পরে। হনহন করে হাঁটতে শুরু করি। বাজার ছাড়িয়ে মিনিট দু’য়েক হাঁটতেই আদিগন্ত মাঠ। নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় রাস্তা থেকে নেমে পড়ি। আলপথ ধরে কিছুদূর এগোতেই দু’পাশে হাঁটু সমান উঁচু ধানের খেত। অনেকটা দূরের একটা জমিতে কিছু লোক কাজ করছিল। অনেকটাই দূরে, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পটাপট প্যান্টের হুক, জিপ সব খুলে ফেললাম। কোমর থেকে নামিয়ে সবে বসতে যাব, দূরের ওই জমি থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, ও দাদা কী করছেন? কী করছেন?

বলতে বলতে লোকটা ছুটে আসে, পেছন পেছন আরও একজন।

তাড়াতাড়ি প্যান্টটা কোমরের উপর তুলে নিই। মারমুখী ভঙ্গিতে লোকদুটোকে ছুটে আসতে দেখে তখন আমার অবস্থা আরও খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না। পালাতে গেলে যদি চোর ডাকাত কিছু ভেবে বসে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়লে গণপিটুনি অনিবার্য। তাছাড়া তল পেটের যা অবস্থা, দৌড়ানোর মতো পরিস্থিতিও ছিল না। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকাটাই ঠিক মনে হল।

লোকদুটি ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, জানেন না এটা নিম্মল গ্রাম। সরকার নিম্মল গ্রাম ঘোষণা করেছে। এখানে বাহ্য ফিরতে কেউ আর মাঠে আসে না।

– তবে যে এত ময়লা দেখছি। চারপাশেই তো…

– সেইজন্যই তো আমাদের সন্দেহ। কারা এসব করে! অনেকদিন ধরেই তক্বে তক্বে আছি, আজ হাতে নাতে ধরেছি। এসব তাহলে আপনারই কাজ?

– কী বলছেন! আমি কী করে হব! আমি তো বাইরের মানুষ।

পুরো ঘটনাটা আরও একবার রিপিট করতে হল। লোক দুটো বিশ্বাস করল। একটু বোধহয় মায়াও হল আমার উপর। বলল, বাইরের লোক বলে ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে আর এমুখো হবেন না।

– হব না, কথা দিচ্ছি। কিন্তু এখন কোথায় যাব? আমার অবস্থা তো…

– গ্রামে যান। কারও বাড়িতে ঢুকে বলুন, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। এখানকার মানুষ ভালো। আপনাদের শহরের মতো না।

গ্রামে ঢোকার পথ বলে দেয় লোকটি। তলপেটে অসহ্য চাপ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। তা মিনিট পাঁচেকের পথ তো হবেই।

– এক মিনিট, কার্তিককে থামিয়ে দিই, বাস আসছে না?

– হ্যাঁ, বাসই তো। শান্তনু বলে।

আমরা তৈরি হই। বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। কোলকাতা পৌঁছোতে মাঝরাত হয়ে যাবে। সে হোক, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গা থেকে আগে পালাই। বাস না পেলে সারারাত রাস্তায় বসে কাটাতে হবে।

দেখতে দেখতে বাসটা সামনে এসে দাঁড়ায়। অল্প কিছু মানুষ নামে। ওঠার আমরা তিনজনই। বিশেষ ভিড় ছিল না। বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। কার্তিককে বললাম তারপর?

– গ্রামে তো ঢুকলাম। প্রথম দু-তিনটে বাড়ি ছেড়ে একটা পছন্দ হল। পছন্দ বলতে, প্রথম বাড়িগুলি বড়ো বড়ো, অবস্থাপন্ন পরিবার। ঢুকতে সাহস হল না। তুলনামূলক একটা একটু কমা। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনি, টালির চাল, পাশাপাশি তিনটে ঘর, অনেকটা স্কুল বাড়ির মতো। সামনে টানা বারান্দা। বারান্দার এক কোণে দুটি অল্প বয়সি বউ বসে গল্প করছিল। বাড়িতে অচেনা মানুষ ঢুকতে দেখে গল্প থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের কাছেই আর্জি জানালাম, আমি বাইরের মানুষ। এখানে কেউ চেনাজানা নেই। হঠাৎ খুব পায়খানা পেয়েছে। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। আপনাদের বাড়িতে যদি একটু ব্যবস্থা হয়…

বউ দুটি বিস্মিত। যেন এমন আজব আবদার তারা জীবনে শোনেনি। আমার মত উজবুকও এই প্রথম দেখছে, এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।

– পায়খানাটা কোনদিকে বলবেন?

আমার তখন এখন-তখন অবস্থা। এতটা হাঁটাহাটির পর শরীরের উপর আর কন্ট্রোল নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই কাঙ্খিত জায়গাটা।

উত্তরে তাদের একজন গলা ছেড়ে ডাক দিল, ওমা মা, দ্যাখেন তো কী বলছে। একটা অচেনা লোক…

– কে! বাড়ির পেছন থেকে উত্তর এল বাজখাই গলায়। মা অর্থাৎ শাশুড়ি, ভারিক্বি চেহারার রাশভারি একজন মহিলা, মুখের কথা শেষ করেই সামনে এসে দাঁড়াল।

– কাকে চাই?

– আজ্ঞে, একটু ঢোক গিলে বললাম, একটু পায়খানায় যেতাম।

– তা এখেনে কেন? এপাড়ায় কী আর কোনও বাড়ি পায়খানা নেই!

– আমি তো বাইরের লোক, এখানকার কাউকে চিনি না।

– তাই বুঝি কচি বউ দুটোকে দেখে এ বাড়িতেই ঢুকতে ইচ্ছা হল! তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না বাছা।

– বিশ্বাস করুন, মা কালীর দিব্যি…

আমার অবস্থা তখন কেঁদে ফেলার মতো। পারলে মহিলার পায়ে পড়ি। বিধি বাম, সেক্ষেত্রে নীচু হতে হবে। আর নীচু হলেই… মা গো! মাঝেমধ্যে পেটের মধ্যে এমন মোচড় মারছিল না… বউটির বোধহয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মায়া হয়েছিল। এতক্ষণে সে মুখ খুলল, মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ না, সত্যি কথাই বলছে…

– তুমি থামো তো বাছা, আর ওকালতি কোরো না।

বউটি থতোমতো খেয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রমহিলা আবার গর্জে উঠলেন, পরপুরুষের কষ্ট দেখে দরদ উথলে উঠছে না? আজ আসুক বাড়িতে… আর তুমিও বলিহারি! এখনও দাঁড়িয়ে আছো! বললাম না এখানে ওসব হবে না। পায়খানায় তালা মারা আছে। বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। শাশুড়ি বউমার ঝগড়া শোনার মতো অবস্থা তখন নেই। কিন্তু তালা মারা শুনে আপনা থেকে পা আটকে গেল। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললাম, তালা মারা কেন?

– এখানে সব বাড়িতেই তালা মারা থাকে। সরকার বানিয়ে দিয়েছে তো।

– সে তো ব্যবহার করার জন্যে।

– কে বলেছে আমরা ব্যবহার করি না? বাড়ির মেয়েরা যায়, রাতবেরাতে আমিও যাই। মাঠে কেবল পুরুষ মানুষগুলো…

– ছিঃ ছিঃ মাঠে যায়! আপনাদের গ্রাম না নির্মল গ্রাম?

– অতশত জানি না, সবাই যায়। আমরাও যাই। তা তুমি এত কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি কি সরকারের লোক?

– না, আমি কার্তিক সরকার।

– ঠিক সন্দেহ করেছি। তা বাবা ভেব না আমি মিথ্যা বলছি। পায়খানা আমাদের আছে, অন্যদের মতো ভাড়ার ঘর বানাইনি। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখে যাও।

– বেশ তো তালাটা খুলে দিন।

– চাবি তো নেই।

– হারিয়ে গেছে?

– না ছেলের কাছে। ছেলে বাজারে। মাছের দোকানে। ডেকে আনব?

– থাক, দরকার নেই।

আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অত সময় অপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। ভেতর-ভর্তি আবর্জনা একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। যে-কোনও মুহূর্তে বাঁধ ভাঙবে। দুপুরে সস্তার হোটেলে খাওয়া উচিত হয়নি। যা হোক, মহিলার খপ্পর থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে ঢুকি।

রাস্তামুখো বাড়ি। বারান্দায় বসে একজন বয়স্কা, অন্যজন কিশোরী। মেয়েটি বৃদ্ধার পিঠের ঘামাচি মারছিল। দুজনের মুখই রাস্তার দিকে। আমাকে ঢুকতে দেখে বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, কে বাবা?

– আমাকে চিনবেন না, বাইরের মানুষ।

এক নিশ্বাসে এখানে আসার কারণ জানিয়ে আসল কথাটা পেড়ে ফেললাম।

– এসেছ ঠিক করেছ। কথায় বলে হাগা চাপলে বাঘের ভয় থাকে না। আমাদের মানুষটাও ওই রকম ছিল, এক মিনিটও দেরি করতে পারত না। বছর ভোর আমাশায় ভুগত তো…

– আঃ ঠাকমা! আবার তুমি শুরু করলে! মানুষটা বলে কষ্ট পাচ্ছে।

মেয়েটার দিকে চোখ যায়। শ্যামলা রং, দোহারা গড়ন, চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো। মনে হল মায়াদয়া আছে। করুণ চোখে তাকালাম তার দিকে। গলায় আকুতি এনে বললাম যদি একটু সাহায্য করেন, সত্যিই আর পারছি না।

– তা বাবা, নাতনির হয়ে বৃদ্ধাই উত্তর দিলেন। সাহায্য যে করব সে উপায় নেই। পায়খানায় তালা মারা। চাবি কোথায় থাকে আমি জানি নে।

– আমি জানি, এনে দেব? মেয়েটি বলে উঠল।

– তা দে না, জানিস যখন বসে আছিস কেন! দেখছিস মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। আহারে! তোর দাদুও…

মেয়েটি ততক্ষণে চাবি এনে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিই। সেইসঙ্গে বেগটাও বেড়ে যায়। যাকে বলে মরণকামড়। সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাই পায়খানার দিকে।

– গামছা নিলেন না? মেয়েটি পেছন থেকে চিৎকার করে।

ধুত্তোর গামছা। আমার হাতে তখন সুখের ঘরের চাবি। স্বর্গের চাবি বললেও বেশি বলা হবে না। পোশাক বদলাবার মতো ধৈর্য বা পরিস্থিতি কোনওটাই আমার তখন নেই। জলের বোতল হাতেই ছিল। জামাপ্যান্ট পরা অবস্থাতেই ভিতরে ঢুকে গেলাম।

– শান্তি?

– হ্যাঁ, শান্তি।

– তারপর?

– তারপর আর কী! হালকা হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় মিটমিট হাসি। মুখের দিকে তাকাতে একটু লজ্জা করছিল ঠিকই। কী আর করা যাবে। অন্যদিকে তাকিয়ে চাবিটা মেয়েটির হাতে দিলাম।

– কিছু বললি না?

– কী বলব! ধন্যবাদ জানালাম। মেয়েটা আড়চোখে একবার ওর ঠাকমাকে দেখে নিয়ে নীচু গলায় বলল, আবার আসবেন।

– হাগতে না প্রেম করতে?

– কে জানে!

– যাবি তো?

– পাগল!

ফিরে আসার পর যখন বেড়ানোর প্রসঙ্গ উঠেছে, অবধারিত ভাবেই কার্তিকের নাম এসে পড়েছে। কার্তিকের সঙ্গে সঙ্গে সে মেয়েটিও, যে তাকে পায়খানার, থুড়ি সুখের ঘরের চাবি এনে দিয়েছিল। কার্তিককেও দেখেছি মেয়েটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে। আমরা ওর পেছনে লেগেছি। কার্তিক কখনও খুশি হয়েছে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে মুখ, আবার কখনও রেগে গেছে। বলেছে, সবকিছু নিয়ে আড্ডা ঠিক না।

তারপর যা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই ফিকে হয়ে আসে। বয়স বাড়ে, সঙ্গে দায়িত্বও। এক সময় ভুলে যাই আমরা। কার্তিক বাদে এখন সকলে সংসারি। সংসারের চাপে বদলে গেছে জীবনের রুটিন। কেবল সন্ধ্যার আড্ডাটাই এখনও অপরিবর্তিত।

তবে আমরা ভুললেও, কার্তিক যে ভোলেনি, মনের গভীরে বাঁধিয়ে রেখেছে সযত্নে, এতদিনে সেটা পরিষ্কার হল। মেয়ে দেখার নামে এতবছর ধরে সে তার কাছেই ফিরতে চেয়েছে, এভাবেই মেটাতে চেয়েছে ঋণ, সেটা আমরা কীভাবে বুঝব!

এখন শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয় ততই মঙ্গল।

প্রতিজ্ঞা

জীবনের চল্লিশটা বছর পেরিয়ে এসেছি। কত ওঠা-পড়া দেখেছি। এখন আর কোনওকিছুই মনকে সেভাবে ছুঁয়ে যায় না। দিন আসে দিন বয়ে যায়। ঝরা, শুষ্ক গাছের মতো কেবলই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। জানান দেওয়া যে, এপৃথিবীতে আমিও আছি, আমারও অস্তিত্ব রয়েছে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন যেন আরও গ্রাস করে ফেলেছে আমাকে। নিজেকে খানিক গুটিয়েও ফেলেছি আমি। তাই ভিড়ভাট্টা, হইহুল্লোড় একটু এড়িয়েই চলি।

স্বাতীলেখা। বন্ধু বলা যায় কী না জানি না, একমাত্র ও-ই একটু জোর খাটায় আমার উপর। মাঝেমধ্যে আসে আমার ফ্ল্যাটে। কখনও কখনও ওর কাছেই মনের দু-এক কথা প্রকাশ করে ফেলি। আজ ওর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। শ-দুয়েক লোক নিমন্ত্রণ করেছে। আমার যাওয়া নিয়ে ভীষণ নাছোড়। কাজেই আর না করতে পারলাম না।

আটটা নাগাদ যখন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছোলাম তখন আমন্ত্রিতদের বেশ কয়েকজন এসে গেছে। আমাকে দেখামাত্রই টেনে নিয়ে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিল স্বাতী। আমার পরিচয় দিতেই তাদের মধ্যে এক অপরিচিত মহিলা কেমন যেন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলে উঠল, ‘ওহ্, তাহলে আপনিই সেই ঋত্বিকা।’

একজন অচেনা-অজানা মহিলার মুখে নিজের নামটা এভাবে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওনাকে ভালো করে দেখলাম। ‘না এর আগে কখনও দেখিনি। তাহলে? উনি কি আমাকে চেনেন? নাকি স্বাতী আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে? কিন্তু এমন কী বলেছে যে, মহিলা এভাবে রিঅ্যাক্ট করলেন!’ ভাবতে ভাবতে বোকার মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন মনে হল, না জানা দরকার, ততক্ষণে উনি সেখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে সোফায় বসে পড়েছেন। হাতে কফি। ওনাকে লক্ষ্য করে আমিও সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।

ওনার নামটাও ঠিক করে মনে পড়ছিল না। স্বাতী পরিচয় করানোর সময় কী যেন বলেছিল একটা? মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না।

বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে শুরু করব, আমি কিছু বলার আগে উনিই বলে উঠলেন, ‘জানতাম আপনি আসবেন। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম। চলুন বারান্দায় গিয়ে বসি।’ আমাকে ওনার দিকে এগোতে দেখেই হয়তো উনি বুঝে গিয়েছিলেন তীর লক্ষ্যভেদ করেছে। যেটা আমার চোখেমুখেও প্রকাশ পাচ্ছিল।

অদ্ভুতভাবে দুজনের কারওর ঠোঁটের কোণায় হাসির লেশমাত্র ছিল না। প্রথম সাক্ষাতেই যে কারও প্রতি কারওর এতটা তিক্ততা থাকতে পারে, সেটাই আমার বিশ্বাসযোগ্যতার বাইরে। সত্যিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও আমাকে জানতেই হবে আমার প্রতি মহিলার এত বিদ্বেষ কেন? কী করেছি আমি! বারান্দায় রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম দুজনে।

সব অতিথি আসতে শুরু করেছে। ওয়েটারগুলো স্ন্যাক্স আর ড্রিংক্স সার্ভ করছে। খাওয়ার এখন অনেক দেরি। স্বাতীও আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত। এখানে উপস্থিত সকলকে সেভাবে চিনিও না। কাজেই ডিসটার্ব করারও কেউ নেই।

খুব ভদ্রভাবে, বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘মাফ করবেন, আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। এর আগে কি আমাদের কখনও দেখা হয়েছে?’

‘নাহ্। সেই সৌভগ্য এর আগে না হলেও আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি।’ এখনও সেই রুঢ় গলাতেই উত্তর দিলেন মহিলা। মনে হল গলায় যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। কেমন যেন একটা ইরিটেশন হচ্ছিল। দেখা হওয়া পর্যন্ত মহিলার খোঁচা দেওয়া ব্যবহার আর নিতে পারছিলাম না। একটু উগ্রভাবেই বলে বসলাম, ‘আপনার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।’

‘না ম্যাডাম, একটুও না। আমরা মুখোমুখি না হলেও একে-অপরকে খুব ভালো করেই চিনি।’

হতভম্বের মতো ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শত চেষ্টা করেও স্মৃতি সঙ্গ দিল না। মিনিট খানেক চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার স্বামী ঈপ্সিত-কে নিশ্চয়ই চেনেন, নাকি তাও বলবেন…।’

ঈপ্সিতের নাম শোনামাত্রই মাথায় কে যেন হাতুড়ির ঘা দিল। কিন্তু ওই কষ্টের জায়গাটা তো আমি বহু আগেই কাটিয়ে উঠেছি। প্রায় পনেরো বছর ওই মানুষটার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। আর আজ এত বছর পরে মহিলা সেই সম্পর্কে রসদ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হায় ভগবান! আমার প্রতি ওনার তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ সেই কারণেই। অনেকদিন পর এই নামটা শুনে প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে বেড়াতে থাকল।

আমারই অফিস কলিগ ছিল ঈপ্সিত। বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সব মহিলারাই ওর সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করত। যাকে বলে একেবারে টল, ডার্ক আর হ্যান্ডসাম। সবথেকে বড়ো কথা ছিল ওর মিষ্টি ব্যবহার আর ওর কথাবার্তা, সময়ে-অসময়ে, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, যার কারণে ডিরেক্টর থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্টের সমস্ত লোক ভীষণ ভালোবাসত ওকে। সকলের মাঝে কখন যে আমি ওর পছন্দের পাত্রী হয়ে উঠেছিলাম, সত্যিই জানি না।

এদিকে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই আমাকে পাত্রস্থ করার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা মা-বাবার ছিলই। ইতিমধ্যে এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের খোঁজ পাওয়া গেল। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সুদর্শন, উচ্চ আয়, বাড়ি-গাড়ি– এমন পাত্র কী আর হাতছাড়া করা চলে। তড়িঘড়ি বিয়ের দিনটাও ঠিক হয়ে গেল।

বিয়ের কথা শুনে সবাই খুশি হয়ে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। কেবলমাত্র ঈপ্সিত ছাড়া। খবরটা শুনে ও যে একেবারেই খুশি হয়নি তা ওর বডিল্যাঙ্গোয়েজে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ জানানোর সময় কী যেন অস্ফুটে বলল। শুনে যেটুকু বোধগম্য হল, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলেই চলছিল না?’

সেইদিন প্রথম বুঝেছিলাম, ঈপ্সিত কেন আমার এত খেয়াল রাখত। আমাকে চিন্তিত দেখলে ও-ও কেন চিন্তান্বিত হয়ে পড়ত। সহকর্মীদের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, অফিস পলিটিক্স– সব কিছু থেকে আগলে রাখত আমাকে। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দিনদুয়েক মনটা একটু খচখচ করলেও, পরে বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে হাজারো ব্যস্ততায় সব ভুলেও গেলাম। তারপর তো একমাস ছুটিতে। বিয়ে, হনিমুন, সব কিছু নতুন নতুন। নতুন এক নেশায় কীভাবে যে দিনগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না।

প্রথম যেদিন অফিস জয়েন করলাম, সেদিন একেবারে হইচই পড়ে গেল। যারা বিয়েতে যেতে পারেনি, তারা সবাই এক-এক করে এসে দুঃখপ্রকাশ করে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। আর কয়েকটি কৌতুহলী কান নাছোড়বান্দা হয়ে রইল, আদ্যোপান্ত শোনার জন্য। কিন্তু ঈপ্সিত এল না।

এতদিন নির্দ্বিধায় ওর সাথে কত বকবক করেছি, কিন্তু এখন ওর কাছে যেতেও কেমন যেন সংকোচ হল। ওর টেবিলের দিকে দু-পা বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে এলাম। সত্যি বলতে কী ওর কাছে গিয়ে আমি ওর কষ্ট বাড়াতে চাই না। এখন আমার একটা সংসার আছে।

সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। আর সেখানে তৃতীয় ব্যক্তির কোনও জায়গা নেই। সেই সময় নতুন সংসার, নতুন সম্পর্কই আমার কাছে সবচেয়ে দামি। কিন্তু আন্দাজ করতে পারতাম তখনও ঈপ্সিতের মনজুড়ে আমি এবং শুধুই আমি। ওর আচার-ব্যবহার প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিত ওর মনের কথা। তখন সবকিছু জেনেও না-জানার ভান করে থাকতাম। আর করারই বা কী ছিল। ভেবেছিলাম সময়, পরিস্থিতি মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়, ঈস্পিতও একদিন সব ভুলে যাবে।

দিন সাতেক পরে ও-ই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চলো, আমরা পরস্পরের জীবনসঙ্গী না হতে পারি, অন্তত আগের মতো বন্ধু তো হতেই পারি।’ সেদিন আমিই মেনে নিতে পারিনি। মন যেন সায় দেয়নি কিছুতেই– সবকিছু জানার পরেও আবার আগের মতো বন্ধুত্ব! একেবারেই সম্ভব নয়।

ওদিকে দিনের পর দিন ছেলেকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দেখে বাড়ির লোকেরা একপ্রকার জোর করেই ঈপ্সিতের বিয়ে দিয়ে দিল। ওর বিয়ের কার্ড হাতে পেয়ে সবথেকে খুশি বোধহয় আমিই হয়েছিলাম। কারণ ওর এই অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে হয়তো আমিই দায়ী ছিলাম। ভীষণ গিলটি ফিলিং হতো। মনে মনে আশ্বস্ত হলাম।

কিন্তু কথায় বলে না– কপালে নেই কো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী। কপালে আমারও সুখ সইল না। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই একদিন মাঝরাতে আবিষ্কার করলাম কার যেন ফিসফিসানি আওয়াজ। পাশে প্রতুল নেই। মনে হল আমারই ঘর সংলগ্ন বারান্দা থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখি বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে প্রতুল কাকে যেন ফোনে ফিসফিসিয়ে বলছে, ‘প্লিজ আগে আমার কথাটা তো শোনো, তারপর না হয়…’। কথা শেষ হওয়ার আগেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামে প্রতুল। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, বাড়িতে কী বলতাম, যে আমি একজন পুরুষকে ভালোবাসি, ওর সাথেই আমি আমার সারাটা জীবন কাটাতে চাই! সেটা কি সবাই মেনে নিত?’

এক ঝটকায় যেন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল। এসব কী বলছে প্রতুল! চোখের সামনেটা হঠাৎই যেন ঝাপসা বোধ হল। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে সরে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলাম, ‘না, এর শিকড় পর্যন্ত আমাকে পৌঁছোতেই হবে। মন শক্ত করতেই হবে। দিনের পর দিন কেউ আমার বিশ্বাসে আঘাত হানবে, তা তো মেনে নেওয়া যায় না।’

যাইহোক, তখনও প্রতুল তার প্রেমিকের মান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। ‘একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো, আমাদের সমাজ তো এখনও এত দরাজ হয়নি যে সমকাম ব্যাপারটাকে মেনে নেবে। সমাজে থাকতে গেলে সমাজের কিছু রীতি তো মেনে চলতেই হবে। তাছাড়া তুমিও খুব ভালো করেই জানো, আমার যা কিছু ভালোলাগা, আনন্দ সব তোমার সঙ্গেই জড়িয়ে। তোমার সাথে যে-সুখ পাই ঋত্বিকার সঙ্গে সেই সুখ কোথায়? এমনকী চরম মুহূর্তেও…।’

আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে প্রতুলও চুপচাপ এসে শুয়ে পড়েছিল। সারারাত তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। কিন্তু সেদিন ওকে কিছু বুঝতে দিইনি। একবার মনে হয়েছিল, সরাসরি প্রশ্ন করি, কেন আমাকে এভাবে ঠকাল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে, যে ছেলে সমাজে নিজের সত্যিটা ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারে, সেখানে নিজের মান বাঁচাতে একটা প্রাণ নিতেও হাত কাঁপবে না তার। একপ্রকার ভয়েই চুপ থাকলাম সেই রাতটা। পরের দিন কাকভোরে পালিয়ে গেলাম বাবার কাছে। সেখান থেকেই ডিভোর্স ফাইল। ডির্ভোসটাও মিউচুয়াল ভাবেই হয়েছিল। পাছে যদি ওনার কু-কীর্তির কথা লোকে জেনে ফেলে সেই ভয়েই সাত-তাড়াতাড়ি সম্পর্কের ইতি টানা গেল।

জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। এই এক মাসের মানসিক টানাপোড়েন অনেক পরিণত করে তুলেছিল আমাকে। কাজেই ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিলাম, এজন্মে আর ওপথ (বিয়ে) মাড়াব না। এখন আমার সংসার বলতে মা-বাবা-আমি। অতএব সবকিছু ভুলতে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে।

এসব খবর তো আর চেপে থাকে না। অফিসে জানাজানি হওয়া মাত্রই কানাঘুষো শুরু। হাজারো সহানুভূতি, আশ্বাস আর ব্যঙ্গের মাঝে মর্মাহত একজোড়া চোখ সর্বদা যেন খুঁজে বেড়ায় আমাকে। ওই চোখের দিকে তাকালে হয়তো পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ব, সেই ভয় থেকেই ঈপ্সিতকে এড়িয়ে চলতে থাকি। বারংবারই ও চেষ্টা করেছে আমার দুঃখ ভাগ করে নিতে। সর্বক্ষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে উপেক্ষা করে গেছি। ওর আর আমার মাঝে থাকা সুক্ষ্ম প্রাচীর কোনওদিনই ভেদ করতে চাইনি। আমার সীমা সম্পর্কে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নিজের সংসার সুখের হয়নি বলে ওর সংসারের দিকে হাত বাড়ানোর মতিভ্রম কোনওদিনই হয়নি। কিন্তু ঈপ্সিতকে বোঝায় কে! নিজের সাংসারিক চিন্তা ছেড়ে ও সর্বদা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাতেই জড়িয়ে থাকে।

তখন কিন্তু আমি চাইলে একাকীত্ব কাটাতে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই পারতাম। শুধু মাত্র সামনে বসা এই অচেনা মহিলার কথা ভেবেই সেদিন আমি এগোইনি। আমি চাইনি আমার মতো উনিও কষ্টের সম্মুখীন হোন। অথচ এই মহিলাই আমাকে দোষী মনে করে বসে আছেন। জানি কোনও মহিলাই তার স্বামীকে অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। কিন্তু আমি তো তা নই। তাহলে এত ঘৃণা কেন? বরং সেদিন এই অপরিচিত মহিলার কারণেই ঈপ্সিতকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আমাদের দুজনের পথ আলাদা। কাজেই ভবিষ্যতে আমাকে সে যেন আর বিরক্ত না করে। তাহলেই আমি খুশি হব।

একই অফিসে কাজ করে অপরিচিতের মতো থাকাটাও তো সম্ভব নয়। আমাকে দেওয়া কথা রাখতে ঈপ্সিত চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ এত বছর পর ঈপ্সিতের নাম শুনে মনটা কেমন যেন হু-হু করে উঠল। অনুভব করলাম আজও মনের কোণে কোথায় যেন লুকিয়ে বসে রয়েছে। এই মহিলাও তো পনেরোটা বছর ধরে ঘৃণার সাথেই আমাকে মনে রেখেছে। তাহলে ঈপ্সিতও কি…?

কিন্তু আজ এত বছর পরে এসবের অর্থ কী? তাও আবার এই বয়সে! সবকিছু অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছি। আমার এই মহিলার জন্য খারাপই লাগছিল, আমার কারণেই এত বছর ধরে ভয়ে ভয়ে থেকে এসেছেন, এই বুঝি ওনার সংসার ভেঙে গেল! ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘দেখুন, কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। বহু বছর হয়ে গেল আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই। ইভেন আপনারা যে কোথায় থাকেন আমি সেটাও জানি না।’

‘আমার কোনও কিছু অজানা নেই। একদিন নেশায় বুঁদ হয়ে ঈপ্সিত আমাকে সবকিছু বলে ফেলেছে।’

‘বিশ্বাস করুন, একজন অফিস কলিগের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত, আমরাও ঠিক তেমনই ছিলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।’ বুঝতে পারছিলাম না কী প্রমাণ দিলে ওনার সন্দেহ দূর হবে।

‘সেটাই তো জানতে চাই, কেন এরকম একজন মানুষের থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে থেকেছ? কীভাবে পারলে তুমি? ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে তো সবাই মুখিয়ে থাকত।’ বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল ঈপ্সিতর অর্ধাঙ্গিনী।

‘কিন্তু আমি তো শুধুমাত্র তোমার জন্য…’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার জন্য… আমার জন্য তুমি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছ? এত বছরে একবারও জানার চেষ্টা করেছ তোমার এই সিদ্ধান্তে আমি কী পেয়েছি? আমার কী লাভ হয়েছে।’ দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল মেয়েটার।

বুঝতে পারছিলাম না ও কী চায়। ওর স্বামী ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। তবুও এত অভিযোগ। এরই মাঝে খেয়াল হল অভিমানই হোক বা অভিযোগ কখন যে দুজনেই আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছি, বুঝতে পারিনি। শ্যামলারঙা পানপাতা মুখের মেয়েটির নামটা এখন হঠাৎ করে মনে পড়ল আমার। আলো। হ্যাঁ, বিয়ের কার্ডে ওই নামই দেখেছিলাম।

‘কোনওদিন ওই মানুষটার কথা ভেবেছ যাকে তুমি নিজের করে নাওনি, আর আমারও হতে দাওনি।’ চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিল আলো।

‘কী বলছ, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

‘আমাদের মাঝে সবসময় তুমি থেকেছ। ঈপ্সিতের ভালোবাসার আর আমার ঘৃণার পাত্রী হয়ে।’

‘কীভাবে বললে বিশ্বাস করবে, আমি তোমাদের মাঝে আসতে চাইনি। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ তোমাদের বিয়ের আগেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।’ সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

প্রত্যুত্তরে বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল আলো। ‘আমি বললাম না, আমি সব জানি। শুধু তোমার কাছে একটাই প্রশ্ন, ঈপ্সিত কী এমন চেয়েছিল তোমার থেকে। শুধু একটু বন্ধুত্বই তো। কীসের এত অহঙ্কার তোমার? তোমার জন্য একটা মানুষ তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সারাটা দিন নেশায় ডুবে থাকে মানুষটা।’

‘কী?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। সত্যি বলতে কী ভাবতে অবাকই হচ্ছিলাম, যে মানুষটাকে বিশ্বাস করে সংসার বাঁধলাম, আর যাকে কোনও সুযোগই দিলাম না, দুটো মানুষের মধ্যে কতটা ফারাক। একজনের থেকে উপেক্ষা পেয়েছি, আর একজন পাগলের মতো ভালোবেসেছে অথচ বদলে সে আমার থেকে নির্লিপ্তি ছাড়া কিছুই পায়নি।

ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। খানিক পরে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে ধরা গলায় বলে উঠলাম, ‘তুমি কেন বাধা দাওনি?’

‘কেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছ!’

আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম, এ কী পাগল? এই মহিলা আমাকে ঘৃণা করে কারণ, আমি ওর বরের বন্ধুত্ব অ্যাকসেপ্ট করিনি। ভাবনায় বাধ সাধল আলো। ‘দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে না কেন?’

শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল, ‘প্লিজ স্টপ। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি জবাবদিহি করতে বাধ্যও নই।’ সবকিছু জেনেশুনে এমনভাবে বলে বসল যেন বিয়েটা কোনও খেলা। ভাগ্যের পরিহাস দ্যাখো যার থেকে ভালোবাসা চেয়েছিলাম, সে অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষিত আর যে আমাকে ভালোবাসল সেও ততদিনে অন্য কারওর হয়ে গেছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। হাউহাউ করে কেঁদে উঠলাম।

আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা স্বাতীর পার্টিতে এসেছি। ততক্ষণে সমস্ত অতিথিরাই চলে এসেছে।

আমাকে কাঁদতে দেখে আলো কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। তখন গলার স্বর নামিয়ে খানিক বোঝানোর ভঙ্গিমায় আলো বলতে থাকে ‘পৃথিবীতে এত লোকের ভিড়ে একজন মানুষকে কেন ভালো লাগে জানো? জানো না তো? এরকম কত প্রশ্নের উত্তরই তো জানা নেই আমাদের? না হয় ঈপ্সিত আর তোমার সম্পর্কটা কী সেটাও একটা প্রশ্ন হয়েই থাকত!’

‘ঈপ্সিতের বউ হয়ে তুমি একথা বলছ?’

‘কেন? নিজের ঘর-সংসার, স্বামীর কথা ভাবাটা কী অন্যায়? প্রয়োজনে আমি ডিভোর্সও দিয়ে দিতাম। তিনটে মানুষ সারাজীবন কষ্ট পাওয়ার থেকে অন্তত দুটে মানুষতো সুখি হতো।’

আলোর কথা শুনে মনে হল, কত বড়ো হূদয় ওর। স্বামীর খুশির জন্য নিজের খুশিও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ও। সব বাঁধ যেন মুহূর্তে কে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। এতদিন পর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সেই ভালোবাসা গাল বেয়ে বয়ে যেতে থাকল। চোখ মুছতে মুছতে বোকার মতো বলেই বসলাম, ‘এতই যদি ভালোবাসত, ফিরে এলো না কেন আমার কাছে?’

‘কীভাবে ফিরত? তুমি-ই তো সব পথ বেঁধে রেখে দিয়েছিলে। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলে যেন কোনওদিনও ও তোমার পথে না আসে।’

‘উহ্, শুধুমাত্র একটা প্রতিজ্ঞা রাখতে সারাজীবন–’ আর কোনও শব্দ বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে। আজ অনুভব করতে পারছি ঈপ্সিত আমার, সত্যিই আমার। ওকে দেখার অদম্য ইচ্ছে, জানার ইচ্ছে ও কি এখনও আমাকে এতটাই ভালোবাসে? আমাকে নিজের করে পেতে চায়? বোধহয় এখন আর…। ভালোবাসার জন্য তো মানুষ কত কী করে! এতো সামান্য একটা প্রতিজ্ঞা। সেটা ভাঙা গেল না? ছুটে এসে বলা গেল না ‘ঋত্বিকা আমি তোমাকেই ভালোবাসি। শুধু তোমাকে…’

 

ভুঁইফোঁড়

তাইদাদা, ও নিতাইদাদা, আজও তুমি কাজে বের হবে না গো?

অনেক ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে জবাব আসে– বললাম তো না। আর এভাবে রোজ রোজ ডাকাডাকি করবি না।

নিতাই-য়ের যেন ধনুকভাঙা পণ। টলাতে পারে কার সাধ্যি! নিতাই-য়ের মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া। মাটি গোবরে লেপা। মেঝে দাওয়া টানটান। শান বাঁধানো মেঝেকেও হার মানায়। উঠোনের এক পাশে ধানের গোলা। আর একপাশে ছোট্ট ঢেঁকিঘর। মাঝখানে মাটির বেদিতে তুলসী গাছ। অনেকটা দূরে বাড়ির এক্বেবারে পেছনে গোয়াল ঘর। হাঁস মুরগির খোঁয়াড়। সীমানা, বাঁশের কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ।

কিছুদিন আগেও এই বাড়ি, উঠোন, ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর– সব কিছুর মধ্যে ছুটোছুটি করে বেড়াত মনোরমা। নিতাই-য়ের বউ। তখন নিতাই-য়ের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আর বুক ভরা ছিল স্বাদ-আহ্লাদ আর ভালোবাসা। কিন্তু এখন? সব শুকিয়ে, পোড়া কাঠ। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘন্টা দুই। তারপর মাইল দেড়েক হাঁটা। গ্রামের পথ ধুলোয় ভরা। চলাচলের পথে হাঁটু অবধি ধুলোর মোজা। খাটো ধুতিতেও বসে যায় ধুলোর পাড়। এ’ভাবেই পুজোর মরশুমে অন্তত হপ্তায় একদিন বাড়ি আসত নিতাই এবং তার বাপ-ঠাকুরদা। কিন্তু বছর পাঁচেক হ’ল নিতাই আর…। এখন সে কলকাতায় যায় না, বাড়ির বাইরেও বেশি বেরোয় না। বাড়িতেই থাকে। আগে কয়েকজন মিলে শোভাবাজারের ভিতর দিকে মাটির বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সে সব পাট এখন চুকে-বুকে গেছে।

এই মুহূর্তে সংসার চলেছে শামুকের গতিতে। নিতাই-ও নির্বিকার। জুটলে খায়। না জুটলে খায় না। বৃদ্ধা মা, কোটরাগত চোখদুটো তুলে ছেলেকে দেখে আর ভাবে– হায় রে কী ছেলে, কী হয়ে গেল! অমন শক্তসামর্থ্য ছেলে আমার, সুতোর মতো পাকিয়ে গেল গা। কী কুক্ষণে ওর কাঁধে সংসারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম…। হায় হায় রে…। প্রতিদিনই এভাবে বুক চাপড়ে বিলাপ করে মা।

চোখ বুজলে এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। ভয়ে শিউরে ওঠে নিতাই। নিতাই মণ্ডল। সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই আর তার দশপুরুষের কাজে হাত দেয় না। একসময় তাদের এই কাজে খুব নামডাক ছিল। মূর্তি গড়ার কাজ। তখন এদের তৈরি মাটির প্রতিমা বিভিন্ন বড়ো বড়ো প্যান্ডেলে শোভা পেত। যেমন বাগবাজার, শোভাবাজার, কুমোরটুলি– এসব জায়গায়। কিন্তু সেবারের সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যে যা বলে, এক কান দিয়ে শুনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। পরিবার পরিজনের পীড়াপীড়িও গ্রাহ্য করে না।

এদিকে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই অবস্থাতেও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাকে। এখন বেশীরভাগ দিনই তাদের উপোস করে বা অর্ধাহারে কাটে। বৃদ্ধা মা, বিধবা বউদি, তার ছেলেপুলে– এসব নিয়ে নিতাই-য়ের সংসার। নিতাই এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একমাত্র হোতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কান্নাকাটিতেই তার মন ভেজে না। সে যেন ‘পিছে বেঁধেছে কুলো আর কানে গুঁজেছে তুলো’। এক্বেবারে নীরেট এক পাথর।

নিতাই-য়ের সব স্পষ্ট মনে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা। দিনের আলো পশ্চিমে যখন ঢলে পড়ে, তখন ঢেঁকিঘরে চলে আলোছায়ার খেলা। সে সময় দু’হাত ওপরে বাঁশের আড় ধরা। এক পা ঢেঁকিতে আর এক পা মাটিতে রেখে ধানের পাড় দেয় মনো। আর ঢেঁকিতে ধান তোলানামা করে বিন্তিখুড়ি। নিতাই-য়ের মা, কোনও এক কালে তাঁর পুরো নাম ছিল বিনোদিনী মণ্ডল। বয়স যত বাড়ছে ততই গ্রামের লোকদের মুখে মুখে বিনোদিনী একসময়, বিন্তিখুড়ি হয়ে ওঠে। বিন্তিখুড়ির একটাই সন্তান। এই নিতাই। টিয়েরঙের শাড়ি আর কপালে বড়ো সিঁদুরের টিপে বেশ দেখাত মনোরমাকে।

অনেক সাধ করে পাঁচ-সাতটা গ্রাম খুঁজে পেতে মনোকেই মনে ধরল বিন্তিখুড়ির। দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল তা হ’ল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। গুনে গুনে চব্বিশটা মেয়ে বাতিল করে, মনোরমাকে নিয়ে এল ঘরে। নিতাই-য়ের কোনও মতামত ছিল না। মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। মায়ের সায়ে সায় মিলিয়ে দিব্যি ছিল নিতাই। ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। এখন মা-ই তার সব। কোনওভাবেই মাকে কষ্ট দিতে চায় না সে। বাড়িতে মা ছেলে ছাড়াও আছে জ্যাঠতুতো দাদার বিধবা স্ত্রী, তার ছেলেমেয়ে নিয়ে। মোট পাঁচ-পাঁচটা সদস্য। সংসারে একটু টানাটানি থাকলেও ছিল না তেমন কোনও অভাব অভিযোগ। তখনকার সময়ে হেসেখেলে দিনগুলো কেটে যেত।

এভাবে বছর তিনেক কাটতে না কাটতেই একটা বড়ো অভাব বিন্তিখুড়িকে অস্থির করে তুলল। নাতিনাতনির অভাব। বিন্তিখুড়ি নানা জনের সঙ্গে নানা কথা বলে এ ব্যাপারে। এই তো সেদিন চড়া সুরে বিন্তিখুড়ির পাশের দুটো বাড়ির পরে ষষ্ঠীপদ ঘোষের বউকে বলে– দ্যাখো বউমা, ছেলেপুলে ছাড়া সংসার আবার সংসার নাকি! এমন সংসারে কখনও লক্ষ্মীশ্রী থাকে?

– অমন করে বলছেন কেন খুড়িমা, সবে তো বছর তিনেক বিয়ে হয়েছে। সময় হলে নিশ্চয়ই হবে।

আপনমনেই বিড়বিড় করে বিন্তিখুড়ি– পরে হলে তো চলবে না। সময় যে ফুরিয়ে এল। আমাকে তো দেখে যেতে হবে। নাতিনাতনির মুখ দেখার বড়ো সাধ আমার। না দেখতে পেলে ওপারে গিয়েও শান্তি পাব নে। দেখি কী করা যায়! এখন তো আমাকেই হাল ধরতে হবে।

শুরু হ’ল বিন্তিখুড়ির প্রচেষ্টা। অমাবস্যা পূর্ণিমা একাদশী মেনে মেনে ঝাড়ফুঁক তাবিজ কবজ। মাঝে মধ্যে আবার মাসের শেষ অমাবস্যায় মাঝরাতে চৌরাস্তার মোড়ে কালো দিঘির জলে স্নান করিয়ে ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সাধুবাবার ভেষজ ওষুধ সেবন, মাদুলি ধারণ– এসবও চলে।

মনো খুব মিষ্টি মেয়ে। শাশুড়িমা যা করান তা-ই করে। কিন্তু নিতাই-য়ের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এ’ভাবে চলতে চলতে গড়িয়ে গেল আরও দু-দুটো বছর। পাঁচ বছরের মাথায় বিন্তিখুড়ি তো দিশাহারা! কী করলে কী হবে মালুম পায় না! এক রাতে নিতাইকে ডেকে বলে– খোকা এক কাজ কর, তুই তো কামকাজে কলকাতা যাস, এবার সঙ্গে করে বউমাকেও নিয়ে যা। ওখানকার ডাক্তার দেখিয়ে আনবি।

– কেন মা, তোমার জড়িবুটি, মাদুলি, তাবিজ-কবজে আস্থা চলে গেল?

– না রে বাবা, কে বলতে পারে কীসে কী হয়?

অগত্যা মনোরমাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। কিছুদিন পিসির বাড়ি রাখে। চিকিৎসা চলে। এমনকী দুটো দিন সরকারি হাসপাতালেও থাকতে হয়। ছোট্ট একটা কাটাছেঁড়াও নাকি হয়। অবশেষে গ্রামে ফেরে।

এসবের পর বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই…। আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দিনটা। কাজ সেরে নিতাই সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ ঠেলে ঢোকার সময় শুনতে পায়, মনোর কলকল করে কথা। আর খিল খিল করা হাসি। বুকটা যেন জুড়িয়ে যেত। মা, বউ-তে খুব মিল। কত কথাই না হতো। মনোরমা দূরের গ্রামের নয়। পাশের কলাবতী গ্রামের মেয়ে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ি-বউ একসঙ্গে কলাবতী গ্রামে বেড়াতে যেত। নিতাই বাড়ি ফিরলেই মনো যেখানেই থাকত ছুটে আসত। জল গামছা এগিয়ে দিয়ে একডালা মুড়ি বাতাসা নিয়ে উঠোনে মাদুর পেতে বসত। তারপর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতে করতে কত কথা! এক সপ্তাহ না তো, মনে হতো যেন একবছর বাদে নিতাই বাড়ি এসেছে।

অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়। কোনও রাতে বেশিক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। কালের নিয়মে বা কালের স্রোতে একসময় মনোরমার স্মৃতিও ধুয়েমুছে সাফ হয়। কিন্তু…! নাহ্, আর ভাবতে পারে না। বুকটা ব্যথায় যন্ত্রণা করে। মাথাটা খালি হয়ে যায়।

হঠাৎ এক রাতে ভেতর ঘর থেকে মার গোঙানি কানে আসে। অনেকক্ষণ ধরে। একটানা। অগত্যা উঠতেই হয় নিতাইকে।

পায়ে পায়ে কাছে যায়। খাটো গলায় বলে– কী হয়েছে মা? কোনও সাড়া নেই। মাঝে মাঝে শুধু খকখক কাশির শব্দ। হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে, কপালে হাত রাখতেই চমকে ওঠে– এত তাপ! এ যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! এমন গভীর রাতে ডাক্তার – ওষুধ কোথায় পাব! তাছাড়া পয়সা! একটা সিকি পয়সাও নেই বাড়িতে। তাড়াতাড়ি জল ন্যাকড়া ভিজিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করে। প্রায় তিন দিন যাবৎ কলমি শাক সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। যতক্ষণ পুকুরে শাক আছে, ততক্ষণ না খেয়ে মরতে হবে না– গজ গজ করতে করতে বউদি বলছিল। একসময় ওর দিকে চোখ রেখে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে বউদি– এমন মদ্দা মানুষ থাকাও যা, না থাকাও তা। আচমকা কাশতে কাশতে মায়ের গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসে। খুব ভয় পায় নিতাই। মা-ও কি তবে মনোরমার মতো…! শীর্ণ মায়ের জীর্ণ শরীরটা মুহূর্তে অতীত ভোলায়। রুগ্ন মায়ের কপালে হাত রেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে– না, আর নয়। এভাবে মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না সে। কিছু একটা করতেই হবে।

এভাবে বসে বসে দুঃখ করলে, যারা গেছে, তারা তো ফিরে আসবে না। না আসবে মনোরমা, আর না আসবে…। পাশের ঘর থেকে বউদিকে ডেকে দিয়ে, রাতেই বেরিয়ে পড়ে নিতাই। যেতে যেতে বউদির চড়া সুর কানে আসে– ক্ষয়রোগ গো ক্ষয়রোগ। ভালোমন্দ না খাতি খাতি এই রোগ দেহে বাসা বাঁধে।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথম এতদিনের চেষ্টায় নিতাই ধীরে ধীরে মূর্তি গড়ায় হাত দেয়। পুজো প্রায় এসে গেছে। বর্ষাও তেমন হয়নি। কেমন যেন গুমোট চারদিকটা। এবারের অকাল কালবোশেখিতে নিতাইয়ের ঘরের চালার কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। তাই এবারের প্রথম সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে এক হাঁটু জল। তাই নিতাইকে যেভাবেই হোক ঘরের চালাটা সারাতে হবে। আগে মায়ের চিকিৎসা, না আগে ঘর সারানো– কোনটা আগে করবে? ভেবে পায় না। দুটো চাপ মাথায় নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায় কাজে। মনে মনে ভাবে নিতাই, আগে মা। তারপর সব। এখন তো তার নিজের বলতে, একান্ত আপন বলতে, আছে কেবলমাত্র মা।

প্রায় রাতেই সে আসে। বিশেষত শেষ রাতে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে গলা জড়িয়ে, খিল খিল করে হেসে বলে– বাবা, ও বাবা, এই যে আমি। এই তো তোমার কাছে। এ মা দেখতে পায় না! বাবা আমাকে ছোঁও তো দেখি, ইস্ ছুঁতে পারে না। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে নিতাই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাকে যেন ছুঁতে চায়। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধাতস্ত হয়। তখন শুধুই বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যেদিন মুন্নি এল তার কোলে, সেদিন-ই মনোরমা ফাঁকি দিল। মুন্নিকে পেয়ে মনোর দুঃখ ভুলে ছিল নিতাই। মুন্নির কচি কলাপাতার মতো, নরম মোলায়েম মনের স্পর্শে, দেহের ছোঁয়ায় একটু একটু করে নিতাই-য়ের দগ্ধ মনের ক্ষতে প্রলেপ পড়ে। নিতাই অতীত ভবিষ্যৎকে ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে।

মেয়ে তো নয়, যেন এক ডানা কাটা পরি। গরিবের ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী যেন স্বয়ং এসেছেন। একটু বড়ো হতে না হতেই রূপের ছটায় চারদিক আলোকিত। সাত পেরোতেই ভ্রমরকালো ডাগর চোখদুটো তুলে বাবাকে শাসন করে– এত দেরি হয় কেন বাবা? আরও তাড়াতাড়ি আসতে পার না? কাজে বেরোলে তুমি আমায় ভুলে যাও, তাই না বাবা?

– ওরে মা, থাম থাম। সবে তো এলাম, এখনও হাত-পাও ধুইনি। এরই মধ্যে তোর একসঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর দিই কী করে বলতো? ঠাম্মা ছুটে এসে বলে

– আয় দিদিভাই, আমার কাছে আয়। বাবা হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিক, তারপর তোর সব কথা শুনবে। কেমন? আয় না দিদিভাই, আয়…। ঠাম্মা যত জোর করে মুন্নির তত জেদ বাড়ে।

– না আমার কথার জবাব না দিয়ে বাবা কোথাও যাবে না।

অগত্যা নিতাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন শুনিয়ে তবে নিজের কাজে যেতে হয়। দিন দিন নিতাই অনেক বেশি বাড়িতে আসে। এমনকী পুজোর মরশুমেও একদিনের বদলে হপ্তায় দু’তিনদিন করে বাড়ি আসে। এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। কিন্তু নিতাই-য়ের স্পষ্ট জবাব– ওরে তোরা বুঝবি না, আমার ছোট্ট মা-টা যে সারাক্ষণ আমার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে।

সারাটা দিন মুন্নি গোটা পাড়ায় খেলে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এর-তার বাড়ি ঘোরাঘুরি করে। গাঁয়ের সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসে। যার বাড়ি যা কিছু হোক, বিয়ে পৈতে পুজোআচ্চা ইত্যাদি, মুন্নি থাকা চাই-ই চাই-ই। মুন্নি না এলেও জোর করে ধরে আনে সবাই। নইলে সব আনন্দই যে মাটি। দু’গালে টোল ফেলে, গলা ছেড়ে খিলখিল করা মুন্নির হাসি, গাঁয়ের ঘরে ঘরে উলুধবনি শঙ্খধবনির চেয়েও বেশি পয়া, বেশি আদরণীয়।

প্রতি রাতে মুন্নি ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে, কল কল করে সারাটা দিনের গল্প বলে। কত জ্যাঠা, কাকা, মাসি, পিসির বাড়ি আজকে গিয়েছে। কতজন, কুলের আচার, আমের মোরোব্বা খাইয়েছে, বিল্টু, নেপু, তিন্নি ওদের সঙ্গে চু কিত কিত খেলতে খেলতে কতবার পড়ে গেছে। কতবার ডাংগুলিতে বল্টু পিন্টুকে হারিয়েছে– নানান দস্যিপনার গল্প ঠাম্মাকে শুনতে হয়। ঠাম্মারও মন ভরে ওঠে। একসময় বকবক করতে করতে মুন্নি ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মুন্নিকে দু’হাতে জড়িয়ে, আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে ঠাম্মা। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। নাতনি বলে কোনও ক্ষোভ নেই বিন্তিখুড়ির। বরং বেশ গর্ব। অমন রূপ ক’জন পায়! মনে মনে ভাবে– দু’হাত তুলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলে, এ যে দেবে ধর্মে তুষ্ট হওয়ার ফল গো। মেয়ের শখ তার বহুদিনের। নিজের তো ছিল না। এমনকী তাদের বংশেও মেয়ের সংখ্যা খুব কম। অবশেষে মুন্নি এল। তার ষোলোকলা সাধও পূর্ণ হল।

গরিবের ঘরে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। কিন্তু ঘাটতি নেই ভালোবাসার। তাই সবার অফুরন্ত আদর ভালোবাসায় তিল তিল করে বেড়ে উঠছিল মুন্নি। গোলগাল ফরসা টুকটুকে মেয়েটা ঘরে বাইরে সবার মন কেড়ে নিয়েছে। নিতাই-য়ের ছিল নয়নের মণি। বাঁচার একমাত্র প্রেরণা। অন্ধের যষ্টি।

সূর্য ডুবে যেতেই হালকা অন্ধকার নামে চারধারে। বছর আটেকের মুন্নি। তখনও উঠোনে এক্বাদোক্বা খেলছিল। হঠাৎ জেঠির ডাক– খুকি ও খুকি যা তো মা, গোয়াল ঘরের ধোঁয়াটা দিয়ে আয় তো মা। তোর ঠাকুমার আবার জ্বর এসেছে। দেখি গিয়ে কী করা যায়!

– যাই জেঠি, বলতে বলতে মুন্নি লাফাতে লাফাতে আসে। ধোঁয়াটা নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যায়। সেটাই বোধ হয়…।

নিতাই মণ্ডলের গোয়ালঘর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। মুন্নি মাঝে মাঝেই গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে আসে। ওটা ষষ্ঠীপদ জানে। কিছুদিন যাবৎ তার মাথায় একটা মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে। নাদুসনুদুস মেয়েটার দিকে চোখ পড়লেই ষষ্ঠীপদর বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। দুশ্চরিত্র, লম্পট ষষ্ঠীপদ তক্বে তক্বেই ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। গোয়ালঘরের সামনে যেতেই মুন্নি একটা খসখস শব্দ শুনতে পায়। ঘুরে তাকায়। কিন্তু কারুকে নজরে পড়ে না। তাই সে অনায়াসে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তখনও পাশের বাড়ির রামতনুদাদা গরু নিয়ে ফেরেনি। আজ হাটবার। তাই হাট সেরে রামতনুদাদার গরু নিয়ে ফিরতে আজ বেশ দেরি হবে। আগে ওদের অনেক গরু ছিল, এখন একটাই গরু। সে-ই দেখাশোনা করে। কিন্তু রামতনুদাদা যে এখনও ফেরেনি, মুন্নি তা জানত না।

রামতনুদাদার সঙ্গে মুন্নির খুব বন্ধুত্ব। অসম বয়সের বন্ধুত্ব। কিন্তু মাঝখানে কোনও ফাটল ছিল না। এতটাই গভীর ছিল যে, একদিন তাকে না দেখলে মুন্নি অস্থির হয়ে উঠত। ঠাম্মা ছাড়া আর যে মুন্নির বকম বকম ধৈর্যসহকারে শুনত, সে হল একমাত্র রামতনুদাদা। কিন্তু আজ যে হাটবার, সেটা মুন্নির মাথা থেকে বেমালুম উড়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগেই শিয়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীপদটা। সব দিক আটঘাট বেঁধে। আজই সুবর্ণ সুযোগ। নিঃশব্দে সে মুন্নির দিকে এগিয়ে আসে। নেকড়ে যেন মাংসের গন্ধ পেয়েছে। লোকটার বয়স বছর পঞ্চাশ। শক্তসমর্থ্য শরীর। খালি গা। খাটো ধুতি। চুপিচুপি তাকে ঢুকতে দেখে বছর আটেকের মুন্নি বিস্ময়ে হতবাক। কোনওমতে টেনে টেনে বলে– জ্যাঠা তুমি এখানে! হাতে ধরা কেরোসিনের কুপিটা, সামনে এনে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।

এক ফুঁ-য়ে কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে ষষ্ঠীপদ মেয়েটার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে কষে। তারপর পাঁজাকোলা করে খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দেয়। নেকড়ের হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচি মেয়েটার ওপর। লালসায় এক্বেবারে পশু হয়ে ওঠে মুন্নির ষষ্ঠীজ্যাঠা। একটানে খুলে ফেলে মুন্নির বেশবাস। সেই উন্মাদ নরপশু ফুলের মতো ছোট্ট মুন্নির অচৈতন্য দেহটার ওপর একবার নয় বারবার চালায় হিংস্র তাণ্ডব। নিষ্পাপ ফুলটিকে এক্বেবারে দলে পিষে নারকীয় খেলা শেষ করে।

মুন্নির জেঠি বার দুই খুকি খুকি করে ডেকে, মনে মনে ভাবে পাশের ঘরে তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলছে বোধ হয়। সে-ও নিশ্চিন্তে পুজোর ঘরে বসে যায়। নিতাই তখন বাড়ি ছিল না। সে গিয়েছিল কলকাতায়। বাড়িতে শুধু জেঠি, আর বিছানায় মুন্নির ঠাম্মা।

ঘন্টা দুই পর রামতনু যখন গরু নিয়ে গোয়ালঘরে আসে, তখন খুব ক্ষীণ কণ্ঠে গোঙানি কানে আসে। হাতের কাজ ফেলে, কোঁচর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালায়। রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া অচৈতন্য মুন্নিকে দেখে চমকে ওঠে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পাড়ার সবাইকে ডেকে নিয়ে, ভ্যান ঠিক করে মুন্নিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। কিন্তু এসব করতে করতে বেশ সময় লেগে যায়। সেই সময়টুকু দিতে পারে না ছোট্ট মুন্নি। অনেকক্ষণ রক্তক্ষরণ হতে হতে অসাড় হয়ে পড়ে মেয়েটা… পথেই মুন্নি…। একসময় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিভে যায় ওর জীবনপ্রদীপ।

ছোট্ট প্রাণ-পাখিটা চিরতরে ছটফট করতে করতে খাঁচা ছাড়ার আগে, কোনওমতে ক্লান্তস্বরে ঠাম্মাকে বলে যায়– কমলিদিদির বাবা, জ্যা…। আর বলতে পারে না সে।

শহর থেকে ফিরে প্রবল আক্রোশে দপ করে জ্বলে ওঠে নিতাই। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাঁপতে কাঁপতে বলে– আজই আমি কুপিয়ে শয়তানটার মুণ্ডু নামিয়ে দেব। শালা! কোথায় যায় দেখছি! তাতে আমার যা শাস্তি হয় হবে। ছিঃ ছিঃ নিজের নাতনির থেকে ছোটো, ওইটুকু এক দুধের শিশু! ছুটে যায় নিতাই। হাত থেকে শহরে কেনা মুন্নির লাল কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন টিপ, লাল ছোট্ট ফ্রকটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়।

মুন্নি মারা যাবে এটা বোধহয় ষষ্ঠীপদ ভাবতে পারেনি। তাই চমকে ওঠে! নিতাই আসার আগেই বেগতিক দেখে চটপট গ্রাম ছাড়ে ষষ্ঠীপদ।

একসময় নিতাই জ্ঞান হারায়। দিন তিনেক পর নিতাই-য়ের হুঁশ আসে। কথায় কথায় গ্রামের ছেলে গৌরাঙ্গ, মহাদেবকে বলে– শয়তান ষষ্ঠীটাকে খুঁজে পাসনি এখনও?

ওরা কাঁচুমাচু মুখে মাথা নাড়ে। নিতাই আবার চিৎকার করে ওঠে– শয়তান লম্পট ষষ্ঠীটা যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ঠিক ধরতে পারবই পারব। আর ধরতে পারলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে, এক্বেবারে টুঁটি চেপে মেরে ফেলব। শোন আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ হল সোনার দেশ। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি এমন লম্পটের জন্ম দিতে পারে না। এই সোনার গাঁয়ের আলো বাতাসে ওরকম জানোয়ারের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। ও একটা ভুঁইফোঁড় লম্পট জানোয়ার– বলতে বলতে পাগলের মতো নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। নীচের চোয়াল দাঁত দিয়ে চেপে কী সব বিড়বিড় করে।

আজন্ম চেনা গৌরাঙ্গ, মহাদেব, মদনের মতো গাঁয়ের ছেলেরা ক্রোধে উন্মত্ত, রক্তচক্ষু, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য নিতাইকে যেন সেই মুহূর্তে চিনতে পারে না। তারপর থেকে বেশ ক’টা বছর অচেনা নিতাই ভয়ংকর মূর্তিতে খুঁজে বেড়ায় ষষ্ঠীকে। কিন্তু কোথাও পায় না। শয়তান ষষ্ঠীটা জানে, সময় সব ক্ষতের প্রলেপ দেয়। তাই সে ঘাপটি মেরে থাকে। মনে মনে ভাবে একসময় না একসময় নিতাইকে হাল ছাড়তে হবে।

কিন্তু নিতাই-য়ের বুকে ক্রমশ তুষের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে জ্বলবে… শুধু একটু বারুদের অপেক্ষা। নিতাই মুন্নিকে হারিয়ে উন্মাদের মতো থানা-পুলিশ করতেও ছাড়েনি। সব্বাই শুধু ওকে আশ্বস্ত করছে একদিন না একদিন এর শাস্তি হবেই হবে। জানোয়ার ষষ্ঠীটা জানোয়ারের সাজা-ই পাবে।

এ মুহূর্তে প্রতিমা প্রায় শেষের দিকে। মায়ের জন্যই নিতাই-য়ের মূর্তি গড়ায় হাত। কয়েকদিন আগে খড়ের ওপর পড়েছে মাটির প্রলেপ। পাশের বাড়ির গৌরাঙ্গ সেদিন কথায় কথায় বলে– হ্যাঁগো নিতাইদাদা, তোমার প্রতিমা তো এবার শেষের দিকে, তাই না গো? গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে নিতাই বলে– নারে এখনও অনেক দেরি। কত কিছু বাদ আছে।

– তা এবার-ই প্রথম বাড়িতে মূর্তি গড়ছ, তাই তো?

– হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। প্রতিবার তো কলকাতাতে-ই…।

এ ভাবেই কাটে আরও কিছুকাল। ক’দিন বাদেই পুজো, প্রতিমা প্রায় শেষ। প্রতিমার মুখের আদল যে দেখে, সে-ই কেমন যেন আঁতকে ওঠে। নিতাই-য়ের তুলি ধরা হাতটা থমকে যায়। নিজে নিজেই বলে– এ কী! এ কার মুখ!

সেদিন গৌরাঙ্গ হঠাৎ বলে ওঠে– নিতাইদাদা, এ তুমি কার মুখ আঁকলে গো? বড়ো চেনা চেনা যে। সকালের উজ্জ্বল আলোয় গাঁয়ের অনেকেই সেখানে জড়ো হয়। নিতাই-ও চমকে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকায়। সবার ফিসফিস কথাবার্তা কানে যায়। গৌরাঙ্গ আবার বলে ওঠে– এ যে আমাদের মুন্নি গো! আচমকা ঘুরে তাকায় নিতাই। হাত থেকে তুলিটা পড়ে যায়। সারা শরীরে শিহরণ জাগে! কাঁপতে কাঁপতে বলে– দাঁড়া অসুরটাকে একটু অদলবদল করে দিই। ধীরে ধীরে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে শয়তান ষষ্ঠীটাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের আড়ালে এ কার মুখ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। গাঁয়ের সব্বাই দেখে নিতাই-য়ের চোখে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন।

ধীরে ধীরে সেই আগুনের ছোঁয়ায় সমবেত জনতা জ্বলে ওঠে। আর সেই সম্মিলিত দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা ভস্মীভূত করে, শয়তান লম্পট ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীটার মতো আরও অনেক অনেক অনেক…।

ছলনা

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বারান্দায়। তারপর চা-সহযোগে একটু জলখাবার খাওয়ার পর, ফুরফুরে বাতাসে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দেওয়া নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে আকাশের। একফালি বারান্দা থেকে যে প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ দেখা সম্ভব, তা বোধকরি নতুন বাড়িতে শিফট না করলে বোধগম্য হতো না তাঁর। দখিনা বাতাস আর মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রকৃতি সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে কখন যে তাঁর চোখে আচ্ছন্নের ভাব এনে দেয়, তিনি নিজেও বুঝতে পারতেন না। সেদিনও একটু তন্দ্রাভাব এসেছে কী আসেনি, পাশের বাড়ি থেকে এক নারীকন্ঠ ও জনৈক পুরুষের তুমুল চিৎকার-চ্যাঁচামেচি কানে এল। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থাকার পরেও এই মহাভারতের অবসান নেই বুঝে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘রমা, দ্যাখো তো এত হাঙ্গামা কীসের!’

কাজের মেয়ে পারুলের পেছনে খিটখিট করা রমার স্বভাব। তাকে দিয়ে ঘর মোছাতে মোছাতে এটা সেটা গজগজ করছিল রমা। আকাশের দেওয়া এই বাড়তি কাজে সে তেমন উৎসাহ পেল বলে মনে হল না। দিল্লির দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল আকাশের। শ্বশুরবাড়ির জ্বালায়, একটু শান্তির খোঁজে দিল্লি থেকে তার কলকাতা চলে আসা। অনেক ছোটাছুটির পর তবেই এই ট্রান্সফার। দিল্লিতে তো সর্বদা রমার বাড়ির লোকের আনাগোনা। অফিস যাওয়ার আগে, ফেরার পরে কেবলই কথাবার্তা আর হুল্লোড়। নিরিবিলি বলে যেন কিছুই ছিল না সংসারে।

পঁয়ত্রিশ বর্ষীয় আকাশ বরাবরই একটু রিজার্ভ প্রকৃতির। তেমন হইহল্লা কোনওদিনই পছন্দ করেন না  বরং একান্তে থাকতেই ভালোবাসেন। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকের জ্বালায় জীবনটা তাঁর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। লোকে বোধহয় ঠিকই বলে– মনের শান্তি, বড়ো শান্তি।

ভাবনায় বাধা পড়ে রমার গলার আওয়াজে। কিছুক্ষণ পর কাজের ঝিকে বিদায় করে রমা এসে দাঁড়ায় আকাশের সামনে। তীর্যক হাসি হাসতে হাসতে বলে, ‘তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে পতিদেব। কয়েকদিন ধরে বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। শুনলে খুব খুশি হবে। পাশের বাড়িতে আমার পাতানো বোন মালারা ভাড়া এসেছে। দুবছর আগেই ওর বিয়ে হয়েছে।’

কথাটা শোনামাত্রই আকাশের মুখ একেবারে শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। শুধু একটা অস্পষ্ট আওয়াজ রমার কানে এল, ‘এখানেও?’

রমা বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল, ‘আরে শোনো শোনো, এইটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে? শালি বলে কথা। তাও আবার তোমার একমাত্র শাশুড়ির বান্ধবীর মেয়ে। তখন না হয় কাজের জন্য শালির বিয়েতে যেতে পারোনি, এখন তো বাড়িতে ডেকে আতিথেয়তা করতেই হবে।’

আর সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না আকাশের। বউয়ের কথার মাঝখানে কথা কেটে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘ওহ্, তাহলে অমন নির্লজ্জের মতো ঝগড়াটা তারাই করছিল, তাই তো?’

বড়ো বড়ো চোখ করে স্বামীর দিকে তাকায় রমা, ‘সহানুভূতি না দেখাতে পারো, অন্তত তাদের নিয়ে পরিহাস কোরো না। কার যে কখন কেমন সময় আসে, কে বলতে পারে!’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমা। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করে, ‘দুজনেই ভালো চাকরি করত। মালার কল সেন্টারের চাকরিটা ছাড়তে হল নাইট শিফ্টের কারণে। আর তার কয়েকদিন পরেই সৌরভ যে-কোম্পানিতে চাকরি করত, সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানিটাও বিনা নোটিশে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। তাও প্রায় দুমাস হয়ে গেল। সংসার খরচ, ঘরভাড়া– কী করে যে সংসারটা চলবে! তাই আপাতত হাজার কুড়ি টাকা দেব…।’

টাকার কথা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় আকাশের।

‘আমার থেকে অনুমতি না নিয়েই যাকে-তাকে…।’

‘যাকে-তাকে কাকে বলছ। আফটার অল আমার মাসির মেয়ে।’

মেজাজ চড়েই ছিল আকাশের। ‘মাসির মেয়ে, মাসি! তবু যদি জানতাম নিজের কেউ। বলা নেই কওয়া নেই, উনি একেবারে কথা দিয়ে চলে এলেন। আমাদের গাছ আছে নাড়া দেব, আর তুই টাকা নিয়ে চলে আসবি। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটলে তবে দুটো পয়সা পাওয়া যায় বুঝেছ।’ কথাগুলি বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যান আকাশ। দরজার সামনেই অত্যন্ত সুন্দর, আকর্ষক এক মহিলা এবং একজন পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মতো হাইটের সুপুরুষ। বোকার মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন আকাশ। চিরকালই মহিলাদের উপর একটা আলাদা টান ছিল তাঁর। তাও আবার এমন আকর্ষণীয়া সুন্দরী।

ঠিক তখনই রমা বেশ উঁচু স্বরে বলে ওঠে, ‘আয়, আয় মালা। সৌরভ এসো। আরে দাঁড়িয়ে গেলি কেন তোরা।’

নিজের শান্ত জীবনে দুই আগন্তুকের অতর্কিত প্রবেশ সত্ত্বেও আর কিছু বলতে পারলেন না আকাশ। খানিক আলাপচারিতা আর চা-জলখাবার খাওয়ার পর দিদিকে আলাদা ঘরে নিয়ে যায় মালা, ‘দিদি টাকাটা!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ আনছি।’ বলেই কুড়ি হাজার টাকা আলমারি থেকে বার করে মালার হাতে ধরিয়ে দেয় রমা।

টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই খুশি মনে কপোতকপোতী গেট থেকে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা চারেক আর দুজনের টিকিটি পাওয়া গেল না। রাতে ফিরে, ফের রমার বাড়িতে হাজির দুজনে। মালা ঘরে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে বলে, ‘রমাদি ডিনারটা কিন্তু এখানেই সারব। আর রান্না করার মতো শক্তি নেই আমার। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।’

‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি তোরা দুজন?’ প্রশ্ন করে রমা।

‘বেশিরভাগ সময়টাই তো চলে গেল পার্লারে।’ চমকে ওঠে রমা। মালা কোনও দিকে না তাকিয়ে কলকলিয়ে ওঠে, ‘পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ফেসিয়াল, হেয়ার কাটিং।’

‘তুই তো এমনিই সুন্দর। তাহলে এসবের কী দরকার ছিল বলতো? খামোকা এই সময়ে কতগুলো টাকা নষ্ট হল।’ বিমর্ষতার ভাব ঝরে পড়ছিল রমার স্বরে।

‘কতগুলো আর কোথায়, মোটে পনেরোশো টাকাই তো লেগেছে।’ নিজের এলো চুলগুলো নাড়তে নাড়তে মালা কেমন অকপটে বলে গেল, ‘মেনটেন না করলে কী আর সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় রমাদি। নিজের দিকেই দ্যাখো না, এমন চাঁদপানা মুখটার কী অবস্থা করে রেখেছ। ভাই, হয় পয়সা বাঁচাও, না-হয় রূপ… টাকা তো হাতের ময়লা, আজ আছে কাল নেই।’

আকাশের সহ্যশক্তির বাঁধ প্রায় ভাঙতেই বসেছিল। নিজেকে কিছুটা সংযত করে তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে ফেললেন, ‘সৌরভ কি তাহলে মেন্স স্যালন-এ গিয়েছিল নাকি?’

‘আরে না না। ওর এত সময় কোথায় যে ও পার্লারে যাবে। রাজ্যের বিল জমা দিতে দিতেই তো ওর সময় চলে গেল, ঘরের ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল। না হলে হয়তো ও-ও…।’

শিউরে ওঠে রমা, ‘তাহলে তো অনেকটাই গেল!’

‘হ্যাঁ, বেশিরভাগটাই। এখনও দুধের বিল বাকি আছে। সঙ্গে নিত্যদিনের খরচাপাতি।’

মনে মনে আকাশ বলতে থাকেন, ‘পকেটে কড়ি নেই, অথচ ফুটানি দ্যাখো, যেন একেবারে জমিদারের ব্যাটা।’

স্বামীর চোখমুখ দেখামাত্রই ঘাবড়ে যায় রমা। ‘মালা তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তোরা বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

মালা আর সৌরভ যাওয়া মাত্রই আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়লেন আকাশ, ‘কোথাও যাবে না তুমি। লাটসাহেব সব একেবারে। দু-পয়সা উপায় করার মুরোদ নেই, অথচ ঠাটবাট দ্যাখো। ভগবান একটু সুখশান্তি আর আমার কপালে লেখেনি। সেই কথায় বলে না, তুমি যাবে বঙ্গে, তোমার কপাল যাবে সঙ্গে।’ গজগজ করতে থাকেন আকাশ।

খাটোগলায় রমা বলার চেষ্টা করে ‘না না ওটা ধার হিসাবে নিয়েছে…’ কিন্তু তাতে আরও রেগে ওঠে আকাশ।

প্রায় মাস-দুয়েক হতে চলল আকাশ আর রমা বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসেছে। আস্তে আস্তে পাড়াপড়শির সাথে পরিচিতি বেড়েছে। সেখান থেকেই খবর পাওয়া। মালা-সৌরভ আশেপাশের অনেক লোকের থেকেই টাকাপয়সা ধার করে বসে আছে। যখন তাদের হাতে টাকা থাকে তখন মনে হয় এরা একে অপরের জন্যই তৈরি। আর পকেট ফাঁকা হলেই দুজনের চ্যাঁচামেচির জ্বালায় পাড়ায় কাকপক্ষীও বসতে সাহস দেখায় না।

এমনভাবেই কেটে গেল আরও ছটা মাস। ততদিনে পাড়াপড়শিরাও এই জুটির স্বভাব সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তাই তারাও ধার দেওয়ার ঝাঁপি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। ওদিকে ছ’মাসের ভাড়াও বাকি পড়ে গেছে। বাড়িওয়ালা রোজই আসে আর খালি হাতে ফিরে যায়। ক্রোধের বশে একদিন বাড়িওয়ালা সৌরভকে না পেয়ে ঘরের সমস্ত মালপত্র তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। মালার সঙ্গে বাড়িওয়ালার তুমুল বচসা বেধে যায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।

ঘটনাচক্রে সেদিন সৌরভ কোনও কাজে কলকাতার বাইরে ছিল। তার ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত। ওদিকে রমাও সেদিন পাড়ার এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত কারওর বাড়িতে ঠাকুরের নামগান শুনতে গেছে। তারও বাড়ি ফিরতে রাত গড়াবে। এমতবস্থায় আস্তানা হিসাবে কেবলমাত্র তার রমাদির গেটকেই বেছে নেয় মালা।

রোজের অশান্তির কারণে কলকাতার প্রতিও মোহভঙ্গ হতে বসেছিল আকাশের। সেই জন্যই অন্যত্র বদলির জন্য কোম্পানিতে আবেদনপত্র জমাও দিয়েছিল। কিন্তু ওই ভাগ্য। অফিস থেকে ফিরে গেটের দরজাটা খুলতে যাবে কী, সামনে আলুথালু ভাবে বসে মালা। মালাকে দেখামাত্রই হকচকিয়ে ওঠেন আকাশ। খানিক পরে ধাতস্ত হয়ে মালাকে ঘরে বসার জন্য বলেন। ঘরে ঢোকামাত্রই জামাইবাবুকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মালা। সৌরভ আর মালার প্রতি তিতিবিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও মালাকে সরিয়ে দিতে পারেন না আকাশ। মালার শরীরের মদির স্পর্শে আকাশের শরীরে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে যায়। মালার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর ঘন চুলের আবর্তে আরও আকর্ষিত হতে থাকেন আকাশ। হূৎস্পন্দন বাড়ার সাথে সাথে কেঁপে ওঠে শরীরও। কয়েক মুহূর্তের লাবণ্যে বশীভূত হয়ে যান তিনি। সেইসময় হঠাৎই বেজে ওঠে আকাশের ফোনটা। সম্বিত ফেরে আকাশের। এ-কী করতে বসেছিল সে! সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরিয়ে দেন মালাকে। পাশের সোফায় বসায় তাকে। ‘শান্ত হও। যাই হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

চোখ মুছতে মুছতে মালা জবাব দেয়, ‘ঠিক হওয়ার জন্য টাকাই তো আমাদের কাছে নেই। নাহলে কী আর বাড়িওয়ালা জোর করে এভাবে তুলে দেয়। কী করে সব ঠিক হবে?’

‘ঠিক আছে দেখছি কী করতে পারি। তুমি একটু বোসো, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমি আসছি।’ বলে পকেট থেকে এটিএম কার্ডটা বার করে গাড়ি নিয়ে চলে যান আকাশ।

মিনিট সাতেক পরে ফিরে ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ মালার হাতে হাজার তিরিশেক টাকা দিতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মালা। কায়দা করে শাড়ির আঁচলটা খসিয়ে দিয়ে আকাশের একদম কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘থ্যাংক ইউ আকাশদা, থ্যাংক ইউ।’

জুতো খোলার জন্য সোফায় বসা আকাশের চোখ আটকে যায় যৌবনে ভরা মালার সুডৌল স্তন যুগলের উপর। মুখ থেকে কোনও কথা সরে না তার। কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

সেদিনের পর থেকে মালা-সৌরভের প্রতি আকাশের ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। এই পরিবর্তনটা যে রমার চোখে পড়েনি, তা নয়। অবাক যেমন হয়েছে, খুশিও হয়েছে তার দ্বিগুণ। মনে মনে ভেবেছে, যাক রোজকার ঝঞ্ঝাট থেকে তো অন্তত মুক্তি পাওয়া গেল। আকাশ রমাকে বলব বলব করে মালাকে টাকা দেওয়ার কথাটা শেষ পর্যন্ত আর বলে উঠতে পারেননি।

ওদিকে মালাও বুঝে গিয়েছিল আকাশ ক্রমশ তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাকে নিজের মোহজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করল সে।

সহজসরল রমা যখনই কোনও কাজে বাইরে যায়, এমনকী বাপের বাড়ি গেলেও সংসারের দায়িত্ব মালার উপরেই দিয়ে নিশ্চিত থাকে সে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় মালা। বিভিন্ন অছিলায় নিজের রূপযৌবনকে হাতিয়ার করে আকাশের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করা। আজ এটা চাই, কাল সেটা চাই– তৎপর আকাশও মোহের বশে উড়িয়ে যায় টাকা। বাদ যায়নি রমাও। তার কাছ থেকেও কুমিরের কান্না কেঁদে টাকা হাতাতে থাকে মালা।

সহজসরল স্বভাবের অনুরাগী স্বামীর, হঠাৎই তার প্রতি উদাসীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিল না রমা। খটকা একটা লাগছিলই। কিন্তু কোথায় যে এর গোড়া, অনেক চিন্তাভাবনার পরেও সেটা কোনওভাবেই অনুসন্ধান করতে পারল না রমা।

কেবলমাত্র পয়সার জন্যই মালার যত ছলাকলা। আকাশের প্রতি বিন্দুমাত্রও দায়বদ্ধতা ছিল না তার। একদিন রমার অনুপস্থিতিতে সংযম হারিয়ে আকাশ মালাকে বিছানায় টেনে নেয়। সব বাধা পেরিয়ে মালার শরীরী সান্নিধ্য পেতে চায় একান্তভাবে। বাধ সাধে মালা। রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘ভেবেছেনটা কি টাকা দিচ্ছেন বলে কি নিজেকে উৎসর্গ করব আপনার কাছে? এতটা সহজলভ্য বস্তু বোধহয় আমি নই। আরে আপনার মতো বোকা লোকেরও তো অভাব নেই পৃথিবীতে, শরীরের একটু হালকা স্পর্শ পেলেন কী না পেলেন সবকিছু লোটাতে শুরু করলেন। যাক অনেক হয়েছে, হাজার কুড়ি ছাড়ুন তো।’

হতবাক আকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। মালা বলতে থাকে, ‘ছাড়ুন, ছাড়ুন, নয়তো আপনার আসল চেহারাটা আর কারওর জানতে বাকি থাকবে না।’ বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে, অগত্যা মালাকে দিতেই হয় সেই টাকা। এইভাবেই মালার লোভ আরও বেড়ে চলে।

কলশির জলও গড়াতে গড়াতে একদিন শেষ হয়ে যায়। রমা আর আকাশের সংসারেও অভাবের ছাপ পড়তে শুরু করে। তাই একদিন বাধ্য হয়েই মালাকে দেওয়া পাওনা টাকার কিছুটাও যদি মালার মায়ের থেকে পাওয়া যায়, সেই আশায় অনুভামাসিকে ফোন করে রমা। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ছোটোবোনকে কটা টাকা দিয়েছিস বলে সেটাও চাইছিস। এত নীচ তোকে কখনও ভাবিনি।’

পরে রমা তার মাকে সব কথা জানালে, তিনিও ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মেয়ের উপরে, ‘মালা যে দিনের পর দিন তোর সরলতার সুযোগ নিয়ে এভাবে টাকা নিচ্ছে কই আগে বলিসনি তো? সবকিছু খুইয়ে দিয়ে এখন বলছিস। অনুভা আর ওর পরিবারের ওই দোষের জন্য আমরা ওদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ছেদ করে দিয়েছি।’

এতদিনে বাপের বাড়ির লোকেদের থেকে মোহভঙ্গ হয়েছে রমার। ওদিকে মালার প্রতিও ঘেন্না জন্মে গিয়েছিল আকাশের মনে। তৎসত্ত্বেও তিনি না পারছিলেন রমাকে সত্যিটা বলতে, না পারছিলেন মালার দিনদিন বেড়ে যাওয়া চাহিদা মেটাতে। সংসারের চাপ আর মালার চাহিদায় আকাশ রীতিমতো নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন। রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল তাঁর। অন্যত্র বদলির জন্য আবেদন জমা দিয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি।

এরই মাঝে মালা আবার কলসেন্টারে জয়েন করেছে। সৌরভও একপ্রকার চাপে পড়েই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেছে। পাড়াপড়শির কাছে প্রচুর দেনা, তারাও তো আর ছেড়ে কথা বলছে না। সেই চাপেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু উপায় তেমন বিশেষ নয়। বরং খরচা অনেক বেশি।

দিন পনেরো এভাবে চলার পর হঠাৎই একদিন মালা উধাও হয়ে গেল। অফিসে গিয়ে আর ফেরেনি। পুলিশ এদিক-সেদিক খুঁজলেও কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র এটুকুই খবর পাওয়া গিয়েছিল মালা সেইদিন কলসেন্টার যায়ইনি। সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে বেড়াল তাকে। তারপর একদিন সেও নিরুদ্দেশ।

ঠিক তখনই মালার মা অনুভাদেবী, আকাশ আর রমার বিরূদ্ধে রিপোর্ট দায়ের করলেন। তাদের নিখোঁজের পিছনে নাকি রমা আর আকাশের-ই হাত রয়েছে। পাড়াপড়শির হস্তক্ষেপ এবং উপরমহলের কিছু বন্ধুর জন্য জেলে যেতে হয়নি তাদের। বড়ো বাঁচা বেঁচেছে তারা।

মাসদুয়েক পর হঠাৎই একদিন দেরাদুন থেকে ট্রান্সফার লেটার এসে উপস্থিত হল। এই পরিবেশে দুজনেই বেশ হাঁফিয়ে উঠেছিল তাই পাকাপাকি ভাবে দেরাদুনে সেটল করার আগে একবার সেখানে তদারকি করতে ও কয়েকদিন ছুটি কাটাতে রমাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল আকাশ।

প্রথমদিনটা অফিসেই কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন টুরিস্ট বাসে চড়ে পুরো শহর ঘোরার পালা। সেইমতো সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া। যেতে যেতে পথের মাঝে শুটিং হচ্ছে দেখে গাড়ি থামিয়ে সকলে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। কোনও এক হিন্দি ছবির নাচের শুটিং চলছিল। নায়ক-নায়িকার পিছনে বেশ কয়েকজন রংবেরঙের পোশাক পরে তালে তালে নাচছে।

আচমকা রমা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ওটা মালা না?’

আকাশেরও বিন্দুমাত্র চিনতে অসুবিধা হল না। মালাকে দেখে রমা আকাশকে বলল, ‘এবার অনুভামাসির হাতে ওকে তুলে দিয়ে আমাদের বদনাম ঘোচাব। একবার যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ার প্রশ্নই নেই।’

রমার কথায় ঘোর আপত্তি তোলে আকাশ। বলে, ‘খবরদার, একবার যখন এই ধান্দাবাজগুলোর হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি তখন আর এসবের মধ্যে ঢুকতে যেও না। ফালতু ফালতু জল ঘোলা করে লাভ কী। চলো ফিরে যাই।’

কিন্তু রমাকে বোঝাবে কে? তার মাথায় জেদ চেপে বসেছে, এই কলঙ্ক থেকে তাদের মুক্তি পেতেই হবে। তাই স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে, শুটিং শেষ হওয়ার পরেই মালার পিছু পিছু একটা ট্যাক্সি নিয়ে পিছনে ধাওয়া করল। একটি নিম্নবিত্ত পাড়ায় একখানা অপরিসর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল মালা। অপ্রত্যাশিত ভাবে আকাশ আর রমাকে দেখে, মালা এমন ভান করল যেন তাদের কোনওদিন দেখেইনি। রীতিমতো চিনতে অস্বীকার করল তাদের। সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় রমার। রাগে চিৎকার করে ওঠে, ‘তুই এখানে আয়েশে আছিস, আর তোর মা তোর কারণে আমাদের দুজনকে জেলে পাঠাবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত প্রায় সেরেই ফেলেছিল। তোকে নাকি আমরা গায়েব করেছি। এখুনি আমাদের সাথে চল। তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব তোকে।’

একটা কথাও বলল না মালা। কোনও সদুত্তর না পেয়ে রাগের বশে মালার গালে একটি সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে রমা বলে, ‘যে তার নিজের স্বামীর হতে পারেনি, সে অন্যের কী হবে! তুই এখানে আনন্দে বেলেল্লাপনা করছিস, আর তোর বর সৌরভ পাগলের মতো খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে তোকে। ভগবান জানে সে এখন কোথায়।’ হ্যাঁচকা টানে মালাকে ঘর থেকে বাইরে আনার উপক্রম করতেই, মালা রীতিমতো জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’

আওয়াজ শুনে আশপাশের বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হতেই ঘাবড়ে গিয়ে রমা, মালার হাত ছেড়ে দিল। সেখানকার গতিক ভালো নয় বুঝে আকাশ একপ্রকার জোর করেই রমাকে টেনে নিয়ে ট্যাক্সিতে এনে বসালেন।

খানিক যাওয়ার পরেই আকাশ বলে উঠলেন, ‘আমাদের এখানে কোনও গন্ডগোল না পাকিয়ে ওদের ঠিকানাটা কলকাতার পাওনাদারদের দিয়ে দিলেই হতো, তারাই যা করার করত।’ আকাশের কথাতে সম্মতি জানাতে গিয়ে হঠাৎই রমার মনে পড়ে গেল, তাইতো ঠিকানাটাও তো ঠিক করে দেখা হল না। গাড়ি থামিয়ে রমা বলে, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি লুকিয়ে জেনে আসছি।’

জায়গাটায় ফেরত আসতেই, রমা হকচকিয়ে গেল। গলায় জয়ের উল্লাস নিয়ে মালা বলছে, ‘কি মা, কেমন অ্যাক্টিংটা করলাম বলোতো? রমাদিকে একেবারে আউট করে দিলাম কেমন। দ্বিতীয়বার আর এখানে আসার ভুলটা করবে না।’

অনুভাদেবীও মেয়ের কাজে খুশি হয়ে শাবাশ শাবাশ করতে লাগলেন।

‘মানছি বাবা মানছি। তুই তো আচ্ছা আচ্ছা নায়িকাদেরও কাত করে দিবি রে! কী দারুণ অভিনয়টাই না করলি। তোর হিরোইন হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না দেখিস।’

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মালার বর সৌরভও মালার তারিফ না করে পারল না।

সবকিছু দেখে হতবাক রমা, বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। নতুন করে আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না তার। গাড়িতে ফিরে স্বামীকে সমস্ত বৃত্তান্ত শোনাতে শোনাতে কেঁদে ফেলল সে, ‘আমরা ঠকে গেছি আকাশ, একেবারে ঠকে গেছি। সবাই প্লান মাফিকই টাকা হাতানোর এই ফাঁদটা পেতেছিল। আমাদের সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মালা-সৌরভ দিনের পর দিন ছলনা করে গেছে। ছলনা।’

 

লাইটহাউস

সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি চোখের উপর টেনে নিল কুমকুম। সে তার চোখের জল, এমনকী সমুদ্রকেও দেখাতে চায় না। ঢেউগুলো তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, পরমুহূর্তেই আবার একটা ঢেউ। তার মনে হল, অনুপম তাকে এইটাই দেখাতে এনেছে। একটা ঢেউয়ের ব্যর্থতা, পরবর্তী ঢেউয়ের নাছোড় উদ্যম। এভাবেই তাকে বাঁচতে শিখতে হবে।

এত ভেবেও সে ফোনটা না করে পারল না।

‘কি করছিস বেটা?’

ওপারে উত্তজিত গলায় মিষ্টি বলল, ‘মা, পায়েস করছি। জাস্ট ইমাজিন। লাইফে প্রথম। তোমার জামাইয়ের জন্মদিন তো। একটু পরে তোমায় সঙ্গে কথা বলছি। দুধটা নাকি ননস্টপ নেড়ে যেতে হবে, ও বলে গেল।’

কুমকুম দেখতে পেল তার মেয়ে হাতা দিয়ে সমানে দুধ নেড়ে যাচ্ছে। সে বলল, ‘রজত বেরিয়ে গেছে? কী বানিয়ে দিলি? তুই ব্রেকফাস্ট করেছিস বেটা?’

‘ওঃ মা, ছোলে চাউল, ছোলে চাউল। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।’ ব্যস্ত গলায় ফোন ছেড়ে দেয় মিষ্টি।

আবার সেই অবিশ্রান্ত ঢেউ। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে হবে না। এখুনি পরের স্পটে যেতে হবে। তারপর আর একটা স্পট, তারপরও একটা। অনুপম আক্ষরিক অর্থেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে তাদের। দাদাভাই, দিদিভাই তো অনেক স্পটে নামছেই না ভয়ে।

‘না রে, তোরা যা। আমরা এখানেই বসি। ওই তো চায়ের দোকান একটা। দেখি লাল চা পাওয়া যায় কিনা।’ এইসব বলে কাটিয়ে দিচ্ছে।

কুমকুম পারছে না ওরকম। সে কোথাও হাঁটু ব্যথা, বুক ধড়ফড়ের অজুহাতে নামতে না চাইলে অনুপম হই হই করে উঠছে, ‘আরে তোমার জন্যেই তো আসা। নইলে আমি তো অফিস টুরে তিন বছর আগেই…।’

সবাই ভাবছে কুমকুমকে ভোলানোর জন্যেই এই ভ্রমণের ললিপপ ধরিয়ে দিয়েছে অনুপম। অথচ ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।

দাদাভাই আর দিদিভাই যাচ্ছিল চোখ দেখাতে চেন্নাই। ফেরার পথে ওদের ইচ্ছে আরাকু ঘুরে আসে। দক্ষিণের এইটুকু বাকি আছে ওদের। ফেরার পথে দমদমে ওদের ফ্ল্যাটে কয়েকদিন থেকে শিলিগুড়ি ফিরবে। অনেক আগে থেকেই ঠিকঠাক এসব। টিকিটও কাটা। হঠাৎ এক রাতে দাদাভাইয়ের ফোন। ‘তোরাও চল ভাইজাগ, আমরা চেন্নাই থেকে চলে আসব। পাশাপাশি দুটো ডাবল রুম বুক করে ফেল।’

অনুপম ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। টিকিট পাওয়া অসম্ভব, কুমকুম আজকাল কোথাও বেরোতেই চায় না, মিষ্টিদের আসার কথা সামনে। দাদাভাইয়ের জোরের কাছে কোনও আপত্তিই টেকেনি।

যাদের জোরাজুরিতে এখানে আসা, তারা অনেক জায়গা স্রেফ গাড়িতে বসেই দেখে নিচ্ছে। কুমকুমের মন ভালো করার পাশাপাশি অনুপম আর কুমকুমকে খানিকক্ষণ একলা ছেড়ে দেওয়ার এক কৌতুকও কি কাজ করছে না ওদের মধ্যে?

অথচ অনুপম এখন তার ধারেকাছেও নেই। খটখটে রোদ্দুরে, শুনসান ইরাডা বিচে সে একরকম একাই দাঁড়িয়ে, অনুপম সেই কোথায় পাহাড় ঘেঁষে বড়ো বড়ো পাথর টপকে টপকে চলেছে। ওখানে নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া আছে। থাক, কুমকুম যাবে না। ওই পাথর সে টপকাতে পারবে না। তাছাড়া কাঁকড়ার জ্বালা সে কি কম বুঝছে? বুকের মধ্যেটা সবসময় জ্বলে যাচ্ছে। মিষ্টিকে ছেড়ে থাকতে এত কষ্ট হবে আগে বুঝতে পারেনি তো।

সানগ্লাসটা খোলে কুমকুম। একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। চোখ মোছে। এই এত বড়ো একটা তটে সে প্রায় একা– যেমন একা ওই আকাশ, দুপুরের পড়ন্ত রোদ। অনুপম দূরে যেতে যেতে একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে গেছে। এত ছোট্ট, যেন আঙুল দিয়ে মুছে ফেলা যায়।

কুমকুমের মনে পড়ল তার কাঁধের ব্যাগে একটা বায়নোকুলার আছে, বার করলেই হয়। এটা মিষ্টির খুব আদরের জিনিস। বাবার কাছে বায়না করে আদায় করেছিল। অনুপম তাই বলে বায়নোকুলার নয়, বায়নাকুলার। এত প্রিয়, তবু নিয়ে যায়নি মিষ্টি যাবার সময়। এখন আরও কত নতুন মডেল বেরিয়েছে। কত পাওয়ারফুল। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মিষ্টি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট ছিল। মেয়েটা কখনও সাধ্যাতীত জিনিসের বায়না করেনি। জানত, বাবার মাপা রোজগার। মা কত হিসেব করে চলে।

সেবার পুজোয় কত দ্বিধা করে একটা আনারকলি চুড়িদার চাইল। তাও অর্ধেক টাকা নিজের জমানো ফান্ড থেকে দিল। সেই সাধের চুড়িদারও নিয়ে যায়নি মেয়ে।

‘আরে এখানে থাক। আমি আসব তো মাঝে মাঝে। এসে থাকব। তখন কি সব বয়ে বয়ে আনব? নাকি ভাবছ একেবারে বিদায় করে দিচ্ছ?’

কত দূরে বিয়ে হল, তাও বায়না ধরেনি কাছে দাও বলে। হয়তো দিল্লি বলেই করেনি। বছর আটেক তো ওখানেই কেটেছে। এখানেই বরং ওর ভালো লাগত না। দমদমের ঘিঞ্জি রাস্তা, নোংরা, জ্যাম কোনওদিনই মানিয়ে নিতে পারেনি।

যতই চেনা জায়গা হোক, তবু কুমকুমের বুক কাঁপে। কী যে সব হচ্ছে। সেদিন বাসের মধ্যে ২০-২১ বছরের মেয়েটা, মিষ্টিরই বয়সি…! বায়নোকুলার চোখে লাগায় কুমকুম। অনুপমকে খোঁজে। কোথায় অনুপম? তার কোনও চিহ্ন নেই। সে খানিকটা আনমনে সমুদ্র, আকাশ, নারকেলের সারি দেখে যায়। হঠাৎ তার বায়নোকুলার থমকে যায় একটা বিন্দুতে। এই ইরাডা বিচে সে তাহলে একা নয়। ওই তো গোলাপি ফ্রক পরা দস্যি মেয়েটা দৌড়োচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে তার মা। মোটাসোটা চেহারার, সে দৌড়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। কুমকুমের চোখে হাসি খেলে যায়।

ওই তো দশ-পনেরো বছর আগের কুমকুম। সে অমনিই মোটা চিরকাল, আর মিষ্টি বরাবরই রোগা-পাতলা। তার খুব কৌতুহল, বিয়ের জল মিষ্টির গায়ে লাগে কিনা। রজতরা প্রবাসী বাঙালি, ভিলাইয়ের। ওদের খাবার ধরনটাও অবাঙালিদের মতো হয়ে গেছে। ছোলে, রাজমা, কালি ডাল, পনির মশলা। গাদাগুচ্ছের ঘি আর প্যাকেটের মশলা ঢাললেই রান্না হয়ে গেল। মাছ প্রায় খেতেই পায় না মেয়েটা। রজত রুই ছাড়া মাছ চেনেও না কিছু। তাতেও মেয়ের কোনও অভিযোগ নেই। যখনই ফোন করে কুমকুম, তখনই মেয়ে ওইসব আগড়ম-বাগড়ম রাঁধছে। কী রেঁধেছে যেন বলল সকালে, ‘ছোলে চাউল!’ ইস্! পারশের ঝাল খেতে কি যে ভালোবাসত!

দাদাভাই আর দিদিভাই তাদের সঙ্গেই ফিরবে। কুমকুম ভালো করেই জানে, ফেরার পথে ট্যাক্সি থেকে বাজারমোড়েই নেমে যাবে অনুপম, একরাশ বাজার করে ফিরবে। এমন নয় যে এখানে এসে তারা দক্ষিণী তেঁতুলগোলা খাবার খেয়েছে। বাঙালি হোটেল, ভাত-মাছ চলেছে দুবেলাই। কিন্তু ওই যে– বাই। আর আনবেও সেই মিষ্টির প্রিয় মাছগুলোই, পারশে, পমফ্রেট, ভেটকি– সেগুলো ধুতে ধুতে, হলুদ মাখাতে মাখাতে, তেলে ছাড়তে ছাড়তে খানিকটা কেঁদে নেবে কুমকুম। দুপুরে একা ঘরে খেতে বসে সে মাছ কিছুতেই মুখে তুলতে পারবে না, শুধু নাড়াচাড়া করবে। দুপুরে তো একবার ফোন করবেই মিষ্টি। খেয়ে উঠতে উঠতে আসবেই ওর ফোন।

‘খেয়েছ তো? নাকি শুধু কেঁদেছ?’

‘খেয়েছি রে বেটা খেয়েছি। আজ সব তোর ফেভারিট ডিশ। কলমি শাক, পোস্ত আর পারশের ঝাল।’

‘পারশে! সরষে দিয়ে করেছ তো?’ প্রায় লাফিয়ে ওঠে মিষ্টি। এত কষ্ট হয় তখন। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

‘জানো মা, আমি কী খেলাম?’ শোনার কোনও উৎসাহ থাকে না কুমকুমের। সেই তো ঘি জবজবে ডাল, নয় পনির, বড়ো জোর আন্ডা কারি। রাতে ধরাবাঁধা চিকেন। তবে মঙ্গলবার বাধ্যতামূলক নিরামিষ। ওখানে গিয়ে হনুমানের পুজো ধরেছে মিষ্টি, পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ের দেখাদেখি। হনুমানচালিশা না পড়ে মেয়ে জল খায় না। ভাবো! মাছ তো পনেরো দিনে একবার আসে, তাও রুই। কুমকুম তবু ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করে, ‘কী খেলি বেটা?’

‘ভাপা ইলিশ।’

‘ভাপা ইলিশ!’ চমকে ওঠে কুমকুম। কে আনল আর কেই বা রাঁধল!

‘তুমি ভাবছ রজত ইলিশ কিনেছে? চিনলে তো। ওই যে পাশের ফ্ল্যাটে শম্পা আছে না, ওরা খুব মাছ খায় মা। আর কি মুশকিল জানো, প্রায় দুপুরেই আমাকে দিয়ে যাবে। আমি ওকে একদিন ভালো করে খাওয়াব ভাবছি।’

‘খাওয়াস।’

‘জানো মা, ও আসা থেকে একদিনও বাপের বাড়ি যায়নি। তিন বছর! জাস্ট ভাবো। খুব কাঁদে জানো মা। মাকে ছেড়ে থাকেনি তো কখনও। একটা ভাই আছে। ক্লাস এইটে পড়ে।’

কুমকুম অস্ফুটে বলে ‘আমার যে তাও নেই বেটা। আমি কি নিয়ে থাকি বলত?’

রোজ দুপুরেই এভাবে ভাতে অনেকখানি অশ্রু মিশে যায়। ওখানে মিষ্টি কেমন থাকে, সত্যি কেমন আছে কে জানে। যা চাপা মেয়ে। সারাক্ষণই অন্যদের কথা বলে যায়। রজতের কথা, শম্পার কথা। আর কি উত্তেজিত গলা, যেন কি দারুণ একটা খবর দিচ্ছে মাকে।

কুমকুমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। মিষ্টি আসলে এখনও ছেলেমানুষই থেকে গেছে। সাত তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা না দিলে যেন চলত না। অনুপমের যত বাড়াবাড়ি। কি, না ইন্টারনেটে ম্যাচিং, একেবারে রাজযোটক।

ইন্টারনেট কি ঠিকুজিকুষ্ঠি– এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই কুমকুমের। সে শুধু চেয়েছিল মেয়েটা কাছাকাছি থাক। একটাই তো সন্তান। একদম বাড়ির পাশে চায়নি। দু-তিন ঘন্টায় পৌঁছে গিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে আবার ফিরে আসা যাবে– এমনটা হলে কি ক্ষতি হতো! তা নয়, একেবারে দিল্লি! কথায় বলে, ‘কোনওকালে নেই ষষ্টীপুজো, একেবারে দশভুজো!’

অবশ্য দিল্লি একেবারে অচেনা জায়গা নয় তাদের, বছর আষ্টেক ছিল তারা ওখানে, আর্মি কোয়ার্টারে। মিষ্টি তো ওখানেই বড়ো হল। স্কুলে পড়ল বছর চারেক। যদিও কুমকুম কলকাতায় ফেরার জন্যে ছটফট করত। অনুপমদের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলে সেই বৃত্তের পরিসীমার মধ্যেই তার সব আত্মজন– বাপের বাড়ি, দিদি, বোন, দুই ননদ। অনুপমের অবশ্য সেরকম টান ছিল না ফেরার। ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। হস্টেলে মানুষ। অল্প বয়সেই মিলিটারিতে ঢুকেছে। লোকটার যেন কোনও শেকড় নেই। নইলে একমাত্র মেয়েকে কেউ অতদূরে বিয়ে দেয়? রজতকে নাকি আবার কানাডায় পাঠাবে অফিস থেকে। মিষ্টিকে না নিয়ে কি ও যাবে? আর একবার ওখানে গেলে কেউ ফেরে না, জানে কুমকুম। এই তো তার মাসতুতো দাদা, বাবুলদা, তার ছেলে-বউ মন্ট্রিয়েল-এ চলে গেল। যাবার সময় বলল, দু’বছরের বন্ড, শেষ হলেই চলে আসবে। তারপর কত দু’বছর কেটে গেল। ফিরল না। এমনকী বাবুলদা যখন চলে গেল, তখনও আসতে পারল না। এল তিনমাস পরে শীতে। ওদের আর এ দেশের সামার সহ্য হয় না। তার মিষ্টিও যদি… বুকটা ধড়াস করে ওঠে কুমকুমের।

ধুৎ! কত বাড়িয়ে ভেবে ফেলছে সে। অনুপম বলে ফালতু চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিতে। তার হার্ট একটু কমজোরি। ইদানীং একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। গ্যাসের ব্যথা ভেবে এতদিন পাত্তা দেয়নি সে। এবার ভাবছে ফিরে গিয়ে কার্ডিওলজিস্ট দেখাবে। দিদিদের পাড়ায় বসে ডা. মনোজিৎ জানা। দেবতুল্য ডাক্তার।

বায়নোকুলারটা আবার চোখে লাগিয়ে চমকে ওঠে কুমকুম। একি! বাচ্চা মেয়েটা যে ক্রমশ জলে নেমে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই বেটা, বেটা, যায় না, ঢেউ টেনে নিয়ে যাবে।’

মা ছাড়া অন্য কারও স্বরে থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। দুটো বিনুনি, চুলে বার্বি ক্লিপ, গোলাপি রিবনে ওকে অবিকল প্রজাপতির মতো দেখায়। অনুপম এই প্রজাপতিটাকে না দেখে লাল কাঁকড়ার খোঁজে গেছে। পারেও বাবা!

সে আবার বলে ‘এসো বেটা, চকোলেট দেব, এসো।’ মিষ্টির জন্যে ব্যাগে চকোলেট রাখার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে কুমকুমের। এই সব জার্নিতে চকোলেট খুব কাজে দেয়। আরাকু ভ্যালির ওই লম্বা রাস্তায় চকোলেট খেয়ে খেয়েই তো সে খিদে সামলেছে। বুকের ব্যথাটার জন্যে সে বোরা কেভ-এ নামেনি। দাদাভাই, দিদিভাই তো নয়ই। অতগুলো সিঁড়ি ভাঙা ওদের পক্ষে অসম্ভব। ওরা দুজনে কফি খেল আর সে বসে বসে চকোলেট। দাদাভাই কিনে দিয়েছিলেন কফি চকোলেটের অনেকগুলো স্ল্যাব আরাকু থেকে। তারই একটা বার করে মেয়েটাকে দেখাল কুমকুম। চকোলেটের টানেই হোক কিংবা অচেনা মানুষের আকর্ষণে– মেয়েটা ছুটে ছুটে তীরের দিকে আসছিল। ওর মা-ও এসে পড়ল থপথপ করে। ‘দেখছেন তো? এই মেয়ে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় বলুন?’

কুমকুম হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মেয়েটা এসে ততক্ষণে ওর বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

‘তুমি ব্যাগে চকোলেট রাখো কার জন্যে?’ কুমকুমের আবার চোখে জল আসছিল। সেটা সামলে সে চকোলেটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে বেটা।’

‘মা দ্যাখো, আন্টি আমাকে বেটা বলছে!’

‘আপনারা ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে থাকেন বুঝি?’

কুমকুম জবাব দেবার আগেই অনুপম ডাকল ‘চলে এসো, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।’

অনুপম কখন লাল কাঁকড়া ছেড়ে এদিকে চলে এসেছে খেয়াল করেনি কুমকুম। দেখতে পেয়ে সে বলল ‘এদিকে শোনো না। দ্যাখো এই নান্হি পরিটাকে। ছোটোবেলায় মিষ্টি ঠিক এইরকম ছিল না?’

অনুপম রুক্ষস্বরে বলল ‘চলে এসো, এরপর লাইটহাউস বন্ধ হয়ে যাবে।’

কুমকুম অপ্রস্তুত হেসে বলল ‘চলি ভাই, এই ড্রাইভারগুলো সব ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে। চলি রে বেটা।’ মেয়েটার গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না কুমকুম। বালির ওপর দিয়ে ওর দ্রুত হাঁটার চেষ্টা দেখে ফ্যাকাশে হাসল মা। মেয়ে তার হাত টেনে বলল ‘রান। আমাদেরও তো লাইটহাউস চড়তে হবে।’

কুমকুমের মুড অফ হয়ে গেছিল। অনুপমটা মাঝে মাঝে এত অভদ্র হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছিল দাদাভাই, দিদিভাইয়ের সঙ্গে বসে থাকতে। কিন্তু অনুপম তাকে বসতে দিলে তো? লাইটহাউস নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।

কুমকুমের বুকে আবার ব্যথা করছিল। সে আর কিছু বলল না। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বহু কষ্টে ওপরে উঠে সে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেল। সমুদ্রটা কি অপূর্ব লাগছে এখান থেকে! পড়ন্ত আলোর আভা জলের ওপর। কিন্তু কি হাওয়া, বাব্বা! তার মতো মোটা মানুষকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হয়। ভয়ে সে বসে পড়ল রেলিং ধরে। বসে বসে আরও ভালো লাগছিল সব কিছু। এই প্রথম বেড়ানোটা সে এনজয় করছিল। মিষ্টির কথা মনে পড়ে কোনও কষ্ট হচ্ছিল না তার। মনে হচ্ছিল, সব মানুষেরই মাঝে মাঝে এতটা উঁচু থেকে পৃথিবীটাকে দেখা দরকার। দু-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল ওপাশে। মেয়েটা তার সাদা ওড়না ধরে আছে। ওড়নাটা পতপত করে উড়ছে, ছেলেটা ছবি তুলছে। কুমকুম কৌতুকের সঙ্গে দেখছিল। এমন সময় একটা দুষ্টু-দুষ্টু মুখ লাইটহাউসের দরজা দিয়ে উঁকি দিল।

‘আন্টি!’

কুমকুমের বুক ধড়াস করে উঠল ‘বেটা! তুই একা এসেছিস?’

মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে বলল ‘মা উঠতেই পারছে না। যা মোটা! তোমার থেকেও মোটা!’

কুমকুম ভয় পেয়ে বলল ‘বসে পড় বেটা, তুই যা রোগা, হাওয়ায় উড়ে যাবি!’

মেয়েটা কোনও কথাই শোনার পাত্রী নয়। সে পুরোটা ঘুরে দেখবে। নীচ থেকে ওর মা’র কাতর গলা শোনা গেল।

‘একটু দেখবেন প্লিজ মেয়েটাকে। আমি হাফ উঠে আর উঠতে পারছি না।’

অনুপম এক মনে ছবি তুলছিল। হঠাৎ সে ঘুরে মেয়েটার হাত চেপে ধরল। কুমকুমের বুক ঢিপঢিপ করছিল। আবার না কড়া কড়া কথা বলে অনুপম। অনুপমের হাতে বন্দি মেয়েটা ছটফট করছিল যেন দৈত্যের হাতের মুঠোয় একটা পাখি। হঠাৎ অনুপম হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ল। এখন ওর আর বাচ্চাটার মাথা সমান সমান। মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। কুমকুম শুনল অনুপম বলছে ‘লাইটহাউস কাকে বলে জানিস?’

‘ওই যে আলো দেখায়।’

‘কাদের?’

‘শিপগুলো যখন নাইটে কিছু দেখতে পায় না।’

‘দেখবি, লাইটহাউস কী করে কাজ করে?’

অমনি মেয়েটার চোখ চকচক করে উঠল। সে কুমকুমের দিকে চেয়ে হাসল। জয়ের হাসি। তারপর অনুপমের হাত ধরে দরজা গলে কলকব্জা বুঝতে গেল। কুমকুমের দু’পা টনটন করছিল। সে দু’পা ছড়িয়ে বসল। মেয়েটার ওড়না উড়ে গেছে। সেই নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি ওদের। অচেনা ভাষা, তবু ওদের কথাগুলো ছুঁতে পারছিল কুমকুম। দূরে তখন সূর্য ডুবছে। তবু চারপাশে যথেষ্ট আলো।

 

সার্কাসের দুর্গা

লোহার জালের বেড়াটা আট-দশ ফুট মতো হবে। এইটুকু ডিঙোনো কোনও ব্যাপার নয়। এখনও হাত-পা নিশপিশ করে। ঝুলন্ত গাছের ডাল দেখলে এই আটষট্টি বছর বয়সেও ওরাংওটাং হ’তে ইচ্ছে করে কৃষ্ণলাল বোসের। রেললাইন দেখলে দুপাশে দুহাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে একটা লাইনের উপর দিয়ে ব্যালান্সের খেলা দেখাতে দেখাতে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হলেও আজকাল উপায় থাকে না। প্রথমত রেললাইন পাওয়া যায় না, দ্বিতীয়ত পাবলিক এই স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের মর্যাদা দেয় না।

কিছুদিন আগেই তো কলকাতার বাবুঘাটে চক্ররেলের লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে একবার একটু পড়ে গেলেন, রেলের পাথরে হাত-পা ছড়েও গেল। পাঁচ পাবলিক এল, ধরে তুলল, আর বলল – এই বুড়ো বয়সে এমন কম্ম করতে গেলেন কেন মশাই? মাথাটা ঠিক আছে তো? কেউ বলল– পাগলদের দেখে বোঝা যায় না, পাগল নানারকম হয়। ভদ্র পোশাকেরও পাগল হতে পারে। কৃষ্ণলাল কী করে বোঝাবেন ওদের, ওর রক্তের মধ্যে সার্কাস মিশে আছে, সার্কাস। ট্রাপিজ, টানটান তার, এক চাকার সাইকেল। বয়ে যাওয়া রেল লাইন মানে দিগন্ত বিস্তারিত ব্যালান্সের খেলা।

এই লোকগুলোকে কি তখন বলা যেত– মাননীয়গণ, আমি উড়ন্ত মানুষের খেলা দেখাচ্ছি। এই সরু লোহার রেললাইন হ’ল একটা রানওয়ে। দু-হাত ছড়িয়ে দিলাম আমার দু-দিকে, ঈগলের মতো, ঈগল কেন, এরোপ্লেনের মতো। শো…শো…শো… মিউজিক, বিউগল, ট্রাম্পেট, ডানদিকে বাঁদিকে দু-টো জোকার, ওরাও ওড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে, আমি প্রফেসর কেএল বোস। এবারে শোঁ করে আকাশে উড়ব। মানে লাফ দিয়ে ধরে নেব ঝুলন্ত দোলনা। দিস ইজ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। পড়ে যাবার পর গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তো আর বলা যায় না, আমিই ছিলাম প্রোপ্রাইটার অফ গ্রেট প্যারাডাইস সার্কাস। বাংলা-বিহার-ওড়িশা দাপিয়ে শো করেছি এককালে। অসমে, ত্রিপুরায়। মানুষ অপেক্ষা করে বসে থাকত প্রফেসর বোসের সার্কাস কবে আসবে। উড়ন্ত চাকির খেলা অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র, অভিমন্যুর যুদ্ধ অথবা তির আর ঢালের খেলা… চারিদিক থেকে তির মারা হচ্ছে আর সার্কাসম্যান ঢাল দিয়ে তির ঠেকাচ্ছে। মহিষাসুরমর্দিনীও ছিল। বিজয় মাহাতো ছিল অসুর। ও ছৌ নাচ জানত। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে শো করতে গিয়ে ওকে পাওয়া গিয়েছিল। কী দারুণ ডিগবাজি খেত। দলের লোকেরা বলত মিস্টার তিড়িং। আর দেবী দুর্গা করত দুগ্গি। ওর ভালো নাম কিন্তু দুর্গা-ই। গোল মুখের মেয়ে। দুগ্গি ছিল তিড়িং-এর বউ।

বিজয় মাহাতোর ছৌ নাচ দেখে যখন সার্কাসে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল কৃষ্ণলাল, বিজয় বলেছিল– আমার বিহা করা পরিবার আছে, আমি সার্কাসে গেলে উ মেয়াটা থাকবে কী করে? কৃষ্ণলাল বলেছিল বউকেও নিয়ে এসো। তাঁবুতে অনেক কাজ আছে। কাজ তো ছিলই। রান্না ঘরে কাজ ছিল, পাখিদের দানা খাওয়ানো, ঘোড়ার ঘাস কাটা, কত কী। পরে দেখা গেল দুগ্গি নাচতেও পারে। দুগ্গি ঝুমুর নাচত। ওর শরীরটা খুব আঁট ছিল। চিতাবাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্গার কথা মনে হয় কৃষ্ণলালের। লম্বা গড়ন, সরু কোমর, টানা চোখ, ভরাট বুক। দলের লোকেরা বলত কালোবাবু একটা ডাঁসা মেয়েছেলে আমদানি করেছে গো…।

কৃষ্ণলাল বোস মানে তো কেএলবি। তিনি কেলোবাবু বলেই খ্যাতিমান হলেন। রংটা কালোই, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, চওড়া কাঁধ। ভদ্রঘরের ছেলে। বাবা ছিলেন সাহেবি অফিসের বড়োবাবু। শীতকালে ধুতির উপর কোট চড়াতেন। সে সময় মুড়ি চিঁড়ে দুধকলার যুগে মাখন পাউরুটি জ্যাম জেলিতে ব্রেকফাস্ট হতো। বউবাজারের বক্সিং ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণলালের জিমনাস্টিক আর জাগলিং-এ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। নানা ধরনের জাগলিং-এ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। বলের খেলা, বোতলের খেলা, আস্তে আস্তে ধারালো ছুরির খেলা, নানারকম ব্যালান্সের খেলা…। বিএ পাশটাও করে ফেললেন। ওর বাবা চেয়েছিল সাহেবকে বলে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবেন, কিন্তু কৃষ্ণলাল বলল চাকরি করব না, জাগলিং করব। গ্রেট এশিয়ান সার্কাসে ঢুকে পড়লেন। তারপর নিজেই সার্কাসের দল করে ফেললেন। সে অনেক কথা, অন্য ইতিহাস।

আসলে সার্কাস ছিল কৃষ্ণলালের রক্তে। ওর পিতামহ ছিলেন প্রিয়নাথ বোস। গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালির নিজস্ব সার্কাস। সাহেবদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ঝামাপুকুরের প্রিয়নাথ বোস কলকাতার ময়দানে হই হই করে সার্কাস দেখালেন ১৯১১ সালে, কিছু দিন আগেই বাঙালির বাচ্চারা খালি পায়ে ফুটবল খেলে সাহেবদের ইস্টইয়র্ক দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছিল। মোহনবাগান ক্লাব। আর প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাস বাঙালির ছেলেদের নিয়ে সার্কাস করিয়ে দেখিয়ে দিল বাঙালির ছেলেরা বাঘ নিয়েও খেলতে পারে। হ্যাঁ, সত্যেন দত্তর কবিতাটা ময়দানে প্রমাণ করে দিল, ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি’। প্রিয়নাথ বোসের বেঙ্গল সার্কাসকে বলা হতো প্রফেসর বোসের সার্কাস।

প্রিয়নাথ বোস গোয়ালিয়রে খেলা দেখাতে গিয়ে গোয়ালিয়রের রাজার কাছ থেকে এক জোড়া বাঘ উপহার পেয়েছিলেন তার কিছুদিন আগেই। বাঘ দুটোর নাম রেখেছিলেন লক্ষ্মী আর নারায়ণ। লক্ষ্মী-নারায়ণকে কী করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ সেটা কৃষ্ণলাল জানেন না, তবে বাবার কাছে শুনেছেন বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে বাঘকে ঘুম পাড়াতেন প্রিয়নাথ। বাঘদের গল্প শোনাতেন, গান শোনাতেন। কী গান? কৃষ্ণলাল কল্পনা করেছেন বাঘের সামনে মাথা দুলিয়ে ওর পিতামহ গাইছেন, ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো…’। নাকি ঝিঁঝিট আড়া তেতালাতে – ‘নয়নের মায়াজালে সই মজালে আমারে’। বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় আসতেন প্রফেসর বোস– দু-হাতে সাতখানা বল লোফালুফি করতে করতে। বাঘের মুখে হাত ঢুকিয়ে দিলে লকলকে জিভ দিয়ে হাত চেটে দিত বাঘ। এই সার্কাসেই যোগ দিয়েছিলেন ভীম ভবানী। ভীম ভবানী শুয়ে পড়লে, বুকের উপর তক্তা চাপিয়ে দেয়া হতো একটা, সেই তক্তার উপর দিয়ে হাতি চলে যেত। ভীম ভবানী উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করত। সেই হাততালি, বহুযুগ আগেকার মানুষের আনন্দ-বিস্ময় মাখানো হাততালির শব্দ এই কৃষ্ণলাল ওরফে কালোবাবুও শুনেছেন তার নিজের সার্কাসে।

প্রিয়নাথ বোস মারা গেলেন ১৯২০ সালে। সার্কাসের দলটাও ভেঙে গেল। প্রিয়নাথের পুত্র, মানে কৃষ্ণলালের বাবা তখন বালক মাত্র। কৃষ্ণলালের বাবা সার্কাসে ছিলেন না, আগেই বলেছি, সাহেবি অফিসে চাকরি করেছেন, কিন্তু গর্ব ছিল। বাঙালির সার্কাস ছিল বাঙালির মাথা তুলে দাঁড়ানো অহংকার। রক্তের গভীরে গোপনে বেঁচে থাকা সার্কাসকে জাগিয়ে তুলেছিলেন– এই কালোবাবু। রায়বেশে নাচের দল থেকে টেনে এনেছিলেন নকুল বাগদিকে, রণপায়ের খেলা দেখাত। ডুয়ার্সের চা বাগানে অবিরাম সাইকেল চালানোর আসর থেকে জোগাড় করেছিলেন বাচ্চু গুরুংকে, আর ওখানেই কৃষ্ণলাল পেয়ে গিয়েছিল একটি চিতাবাঘকে। হ্যাঁ, সারা গায়ে ছিট ছিট ছবি আঁকা চিতাবাঘ। চিতাবাঘটা ছিল কালোবাবুর প্যারাডাইস সার্কাসের সম্পদ। ওর পিতামহের মতো বাঘের পিঠে চেপে সার্কাসের এরিনায় প্রবেশ করতে পারেননি কালোবাবু কিন্তু চিতাবাঘের পিঠে চেপে ঢুকেছেন, যার অন্য নাম লেপার্ড।

কালোবাবু নারী শরীরের রহস্য কিছুটা জানেন, শরীরের কোন জায়গায় কী ধরনের স্পর্শ দিলে শরীর তার কী উত্তর দেবে কালোবাবু বোঝেন, কিন্তু আরও বেশি বোঝেন জানোয়ারের শরীর। কুকুরের মতো বাঘও লেজ নাড়ায়। জানতে হয় কী ধরনের স্পর্শে লেজ নড়ে উঠবে। কী ধরনের স্পর্শে বাঘ হুংকার দেবে, সেটাও জানেন। চিতাবাঘ তো বাঘই। এরিনায় নামছেন কালোবাবু, চিতার পিঠে চেপে। চিতা হুংকার দিল, আর বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল…।

লোহার খাঁচাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষ্ণলাল। নতুন রং হয়েছে খাঁচার লোহায়। একটা গন্ধ আসছে। এখন রোদ্দুরটাও বেশ কড়া। দলের সবাই মূর্তিনদী দেখতে গেছে। কৃষ্ণলাল যাননি। উনি একাই এসেছেন এখানে। এক ঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে আছেন। যদি মধুবালা আসে, একবারটি দেখা দেয়। এটা খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্র।

কৃষ্ণলালের প্যারাডাইস সার্কাসটাও ভেঙে গেছে বহুদিন হয়ে গেল। ওর বাবা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, মিত্র বংশের মেয়ে। সে বিয়েও ভেঙে গেছে সার্কাসটা ভাঙার আগেই। ভাঙবেই তো। কে-না ভালোবাসা চায়। চিতাবাঘটাও চেয়েছিল। একটা মেয়ে বাঘকে যদি বউয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে কোনও পুরুষ– সহ্য হয়? কেবল মধুবালা আর মধুবালা। চিতাবাঘিনির নাম রাখা হয়েছে মধুবালা– আদিখ্যেতা নয়? কৃষ্ণলালের বউ তো এমনই ভেবেছিল। তা ছাড়া বাড়িতে তো থাকতই না। প্যারাডাইস সার্কাস নিয়ে ঘুরে বেড়াত বাইরে বাইরে। নেশাও করত। সার্কাসের দলে মেয়েরাও তো ছিল। এক ঝুমুর নাচা মেয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টির গল্পও কানে এসেছিল কৃষ্ণলালের স্ত্রীর। কৃষ্ণলালের স্ত্রী অন্নপূর্ণা চেয়েছিল সার্কাস-টার্কাস অনেক হয়েছে। টাকাপয়সা যা আছে তা দিয়ে কিছু একটা ব্যাবসাপাতি করে এবার সংসারে থিতু হোন কৃষ্ণলাল। ছেলেটাও বড়ো হয়েছে। কৃষ্ণলাল স্ত্রী-র কথায় কান দেননি। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন– হয় তোমার মধুবালা নয় আমি। কৃষ্ণলাল মধুবালাকেই বেছেছিলেন। অন্নপূর্ণা বলেছিলেন মধুবালা তোমার ভড়ং। তোমার আসল আঠা হ’ল দুর্গা নামের ওই নাচুনে মেয়েটা। সংসারটা ভাঙল। ভাঙা বউটাও পৃথিবীতে নেই আর। ছেলেটা লেখাপড়া শিখেছে। ভালো চাকরিবাকরি করে। বাপকে ফেলে দেয়নি ও। মনে রেখেছে। বিয়ে-থা করেছে। ওর মামার বাড়ির ন্যাওটা। কলেজের লেখাপড়া তো ওর মামার বাড়িতে থেকেই করেছে।

প্যারাডাইস সার্কাসটা তেমন কোনও বড়ো সার্কাস দল ছিল না। তত বড়ো করতে পারেনি। বিরাট তাঁবু ফেলে, কাগজে বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনওদিনই শো করতে পারেনি কেএল বোস। জেলা শহরগুলিতেই শো করেছে। যেমন সিউড়ি, দুবরাজপুর, বসিরহাট, রায়গঞ্জ, বীরপাড়া, মালবাজার…। সবাই বলত কালোবাবুর সার্কাস। হ্যান্ডবিল বিলি হতো, জোকার রামদাস চোঙা ফুঁকে বলে বেড়াত– প্লাস্টিক গার্ল অঙ্গ বেঁকাবে যেখানে খুশি, বাঁদর সাইকেল চালাবে, দক্ষযজ্ঞ আর সীতার দেহত্যাগ, মহিষাসুরমর্দিনী…।

মহিষাসুরমর্দিনী খেলার অসুর তিড়িং মানে বিজয় মাহাতো, ছৌ নাচের অসুরের মুখোশ পরে কী ডিগবাজিটাই না দিত। আহা। দুগ্গি, মানে দুর্গা হাতে ত্রিশূল নিয়ে নাচত। ওর খ্যামটা নাচটাও ফ্যালনা নয়। সারা অঙ্গের কাজ আছে। নাচতে নাচতে, ত্রিশূল দোলাতে দোলাতে মুখ দিয়ে আগুন বের করত। মুখ দিয়ে আগুন বের করার খেলাটা শিখতে হয়েছিল মুখে কেরোসিন রেখে। শেষ কালে তিড়িং-এর কাঁধের উপর পা তুলে দিত দুগ্গি, ত্রিশূল বুকে বিঁধিয়ে দিত, উপর থেকে রঙিন কাগজের কুচি ঝরে পড়ত, যেন পুষ্পবৃষ্টি। তারপর তুমুল হাততালির মধ্যে দুগ্গি তিড়িং এর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলত, ইনি আমার স্বামী। গায়ে পা দিয়েছি বলে পেন্নাম করে নিলাম। তারপর আর এক প্রস্থ হাততালি।

আবার দক্ষযজ্ঞ খেলায় মহাদেব সেজে ডিগবাজি খেত তিড়িং, লম্বা করে লাফ মারত, আর কৃষ্ণলাল নিজে পাগড়িতে ময়ূরের পালক গুঁজে চাকতির জাগলিং দেখাত, যেন সুদর্শন চক্র ছোড়া হচ্ছে। এই ভাবে সার্কাসের সাহেবিয়ানাকে দেশি, লৌকিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণলাল। মহিষাসুরমর্দিনী খেলাটা একেবারে অন্য মাত্রা পেয়ে গেল যখন সার্কাসে বাঘটা এল। শ্রী শ্রী দুর্গা হলেন সিংহবাহনা। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও ব্যাঘ্রবাহনা দুর্গাও দেখা গেছে। পটচিত্রে আছে, মন্দিরেও। আমাদের দুগ্গি চিতাটার পিঠে করেই ঢুকত এরিনায়। চিতার গলায় পরানো থাকত পাটের ঝালর। সিংহের কেশর যেমন থাকে।

বেশ অদ্ভুত ভাবে চিতাটাকে পাওয়া গিয়েছিল। ডুয়ার্সের মালবাজারে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল। চা-বাগানের কুলি-কামিনরা সারা বছর কোনও আমোদ আহ্লাদ পায় না। ওরা দলে দলে ভিড় জমাত সার্কাসে। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে হাতির পাল যেমন নেমে আসত, মাঝে মাঝে চলে আসত চিতাও। চিতাবাঘ এসে গোয়ালের গরুটা, বাছুরটা, ছাগলটা, হাঁস, মুরগি, ভেড়াকে মেরে টেনে নিয়ে যেত। গাঁয়ের লোকজন সার্কাস দেখতে এলে চিতাদের সুবিধে হতো। গাঁয়ে লোক কম থাকত বলে গেরস্ত ঘরের পালিত পশু শিকার করতে সুবিধে হতো। মানুষজন চিতাকে বাগে পেলে ছেড়ে দেবে কেন? চিতার দেখা পেলে তিরধনুক, কোদাল-কুড়ুল, শাবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। কখনও মেরেই ফেলত। একবার হ’ল কি, সার্কাস চলার সময় খবর এল চিতা বেরিয়েছে। শুনে সার্কাস ছেড়ে অনেকে চলে গেল। বাইরে হইচই হট্টগোল। সার্কাস বন্ধ করেনি কৃষ্ণলাল। দশটা লোক থাকলেও শো চলবে। বাইরে পটকা বাজির শব্দ। শো শেষ হ’ল। শোনা গেল একটা চিতা একটা ছাগলছানাকে খেয়ে ফেলেছে। ওর গায়ে তির লেগেছে, হেঁসো-কোদালের কোপও পড়েছে। কিন্তু পালিয়েছে।

আরও রাত্তিরে জলত্যাগ করার জন্য তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে কৃষ্ণলাল দেখতে পেলেন, আধা চাঁদের আলোছায়ায় তাঁবুর পিছনের জারুল গাছটার তলায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে একটা জানোয়ার। টর্চের আলো পড়ল। চিতা…! রক্তমাখা। নিজের গায়ের রক্ত চেটে পরিষ্কার করছে ও। লেজের দিকে মুখ দিচ্ছে বার বার। লেজের শেষ দিকটা নেই। যেন কুড়ুলের ঘায়ে খাবলে নেওয়া। চিতার চোখে টর্চের আলো পড়লে কৃষ্ণলাল দেখেন ওর চোখে ভিক্ষা লেগে আছে। জীবন ভিক্ষা চাইছে চিতাবাঘটা। এক মগ জল সামনে রাখে। জলটা চেটে খায়। কৃষ্ণলালের দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। একটা চেন এনে গলায় পরায়। চিতা প্রতিবাদ করে না। জীবনের বিনিময়ে শিকল মেনে নেয়।

জীবন বড়ো না শিকল… এই প্রশ্নের উত্তর আজও কালোবাবুর কাছে পরিষ্কার নয়। জীবন বড়ো রহস্যময়, আর শিকলও। কে কখন কী ভাবে শিকল পরে তা বোঝা যায় না। আর শেকল প্রায়শই অদৃশ্যই থাকে।

কৃষ্ণলাল জানতেন গাঁয়ের মানুষ যদি খোঁজ পায়, সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকে চিতাটাকে খুঁচিয়ে মারবে। তাই প্রথমেই চিতাটার মুখে একটা জাল পরিয়ে দিলেন, যাতে আওয়াজ করতে না পারে। গর্জন-ই হ’ল নির্দেশক। চিতাটার লেজের কিছুটা নেই। টাঙ্গি জাতীয় কিছুর আঘাতে লেজের শেষ অংশ খোয়া গেছে। রক্ত ঝরছে। ভালো করে পট্টি বেঁধে দেয় কৃষ্ণলাল। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়… ঘাড়ের কাছটায়। ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেজটা নড়ে ওঠে। সেদিন রাতের খাবারে ছিল মুরগি। দু-টুকরো নিয়ে আসে কৃষ্ণলাল। চিতার মুখের জালিটা খুলে ওর মুখের সামনে ধরে। দু-বার গন্ধ শোঁকে চিতা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রান্না মাংস ওর অচেনা। হলুদ-লংকা-গরম মশলা দেওয়া মাংস কি কখনও খেয়েছে নাকি সে?

কিন্তু খিদে সব পারে। অনর্থ ঘটাতে পারে খিদে, আর এটা তো সামান্য খাওয়া।

ওদের সার্কাসে আগে শুধু ছাগল আর বাঁদর ছিল। চিতা ঢুকল। সে তো বহুদিন আগেকার কথা।

এই খাঁচাটার সামনে কৃষ্ণলাল। গতকাল দেখতে পেয়েছিলেন একটা মাংস ভক্ষণরত চিতা। খাবার সময় এই প্রজাতি লেজটা একটু বেঁকিয়ে রাখে। এই চিতাটার লেজের শেষদিকটা ছিল না। কিন্তু

মাংস দ্রুত শেষ করে ভিতরে চলে যায় সে। আর দেখেনি। তাই আজ আবার এখানে, অপেক্ষা। এখনও আসেনি সে…

বেশ কিছুক্ষণ খাঁচার বাইরে অপেক্ষার পর বাঘটির দেখা পেলেন কৃষ্ণলাল। কয়েকবার পায়চারি করার পর ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গেল। ঠিকই দেখেছিলেন গতকাল। লেজের শেষের দিকটা নেই। জোরে চিৎকার করলেন কৃষ্ণলাল– মধুবালা কাম হিয়ার। কই এল না তো…।

এই খয়েরবাড়ির বন্যপ্রাণী সুরক্ষা কেন্দ্রে সার্কাস থেকে ছিনিয়ে আনা বাঘ, চিতা, হাতিদের রেখে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন সার্কাসে থাকা বনের পশুদের ফের বনের ভিতরে ছেড়ে দিলে ওরা বেশিদিন বাঁচে না। কারণ বন্দিদশায় ওরা শিকার ভুলে যায়। খাবারের জোগান থাকে না, জোগাড়ও হয় না। তাই খাঁচাঘেরা বনে ছেড়ে রাখা হয়। এই খাঁচা, চিড়িয়াখানার খাঁচার মতো ছোটো নয়। প্রাকৃতিক বনের অনেকটা জায়গা লোহার জালে ঘিরে তার ভিতরে পশুদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চিতাদের জন্য আলাদা অঞ্চল, বাঘেদের আলাদা, হাতিদের আলাদা। ঘেরা জায়গায় ঘাস জঙ্গল থাকে, ঝোপঝাড় থাকে, থাকে বড়ো গাছও। খরগোশ, শুয়োর-ও ছাড়া থাকে। যদি পারে বাঘেরা টুকটাক শিকার ধরে। নইলে সময়মতো খাবার তো আছেই। বেলা একটা নাগাদ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মাংস রেখে দেওয়া হয়। সেই যে একটা আইন হ’ল না, মানেকা গান্ধির সময়ে– সার্কাসে জন্তু-জানোয়ারের খেলা বেআইনি করে দিল, কেন? জন্তুদের কষ্ট হয়। তারপর থেকেই সার্কাসে জানোয়ারের খেলা দেখানো বন্ধ হতে লাগল। কালোবাবুর সার্কাসটা সেরকম বড়ো মাপের ছিল না, তাই বেশ কিছুদিন দেখাতে পেরেছিল। পানামা, অলিম্পিক, ইম্পিরিয়াল এসব সার্কাস থেকে আগেই হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওর প্যারাডাইস সার্কাসের মধুবালাকে ওরা নিয়ে গেল আরও পরে। তা-ও আঠারো বছর হয়ে গেল। আর আঠারো বছর, মানে দেড় যুগ পরে মধুবালার সঙ্গে দেখা।

এই আঠারো বছরে কত কী হয়ে গেল। দু-তিন রকম সরকার হ’ল, মঙ্গল গ্রহে মানুষ গেল, ব্যাটাছেলেরা অপারেশন করে মেয়ে হল, প্যারাডাইস সার্কাস ভেঙে গেল, বিয়ে করা স্ত্রী মরে গেল, তার নিজের ক্যান্সার ধরা পড়ল।

হ্যাঁ। কালো রঙের বাহ্য হচ্ছিল, জ্বর, শেষ অবধি ধরা পড়ল ক্যান্সার। ছেলেকে জানিয়েছিল। ছেলে মুম্বই নিয়ে গিয়েছিল। অপারেশন হয়েছে, কেমো থেরাপি। মাত্র দু’বছর আগেকার কথা। এর আগে একা একাই থাকতেন কৃষ্ণলাল। হ্যারিসন রোডের একটা মেস-এ। সম্পদ বলতে একটা অ্যালবাম। ওখানে প্যারাডাইস সার্কাসের নানারকম ছবি। দক্ষযজ্ঞ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, মহিষাসুরমর্দিনী…। যে টাকাটা সার্কাসের কল্যাণে জমিয়েছিলেন, তা থেকে যা ব্যাংকের সুদ পেতেন, তাতেই কোনওরকমে চলে যাচ্ছিল। অসুখটাই বিপত্তি বাধাল। ছেলেকে জানাতে বাধ্য হলেন কৃষ্ণলাল। ছেলে চিকিৎসা করিয়ে দিল। খরচাপাতি কী লেগেছে কৃষ্ণলালের জানা নেই। হতে পারে চিকিৎসার খরচ অফিস থেকেই পেয়েছে। ওর সার্টিফিকেটে বাপের নাম তো কৃষ্ণলাল বোসই লেখা আছে। এরপর ছেলে বলেছে মেস-এ থেকে কোনও কাজ নেই। একটা বৃদ্ধাশ্রম ঠিক করে দিয়েছে। চন্দননগরে গঙ্গার ধারে। মাসিক খরচটা ওর সুদের টাকাতেই হয়ে যায়, তবে এককালীন একটা মোটা টাকা জমা রাখতে হয়েছিল। সেটা ছেলেই দিয়েছে। মরে গেলে ফেরত পেয়ে যাবে। মরে যাওয়াটা খুব বেশি দূরে নেই। ও জানে যখন-তখন ফিরে আসতে পারে রোগটা, শরীরের অন্য কোথাও, অন্য কোনও খানে। বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটা জানে। ওরাও বলে দিয়েছে– এখন ভালো আছে, থাকা যাবে, কিন্তু রোগব্যাধি বাড়লে এখানে রাখা যাবে না। তবে লোকটাকে ফিরিয়ে দিলে জমা রাখা টাকাও ফিরিয়ে দেবে।

বৃদ্ধাশ্রমটা ভালোই। আলো হাওয়া খেলা করে। গঙ্গাটা দেখা যায়। বোর্ডাররা গল্প করে। সার্কাসের গল্প বলেন কৃষ্ণলাল। বৃদ্ধরা গল্প শোনে। মাঝে মাঝে বলে– আবার একটু সার্কাস হয়ে যাক-না প্রফেসর বোস।

এই বৃদ্ধাশ্রম মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন করে। একবার পুরী নিয়ে গিয়েছিল। এবার ডুয়ার্স। আশ্বিনের মাঝামাঝি। জঙ্গলে সদ্যস্নান সেরে আসা শ্যামলি। নদীজল কলকল, কাশফুল দুলছে। এই ডুয়ার্স পরিক্রমার মধ্যেই ছিল খয়েরবাড়ি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণশালা দর্শন। গতকাল এসে এক ঝলক চিতাটিকে দেখে মনে হয়েছিল এই সেই মধুবালা। তাই আজ আবার। অন্যরা অন্যত্র বেড়াতে গেছে। গেস্টহাউসে ফিরে আসবে বিকেলে। শরীর খারাপের নাম করে গেস্টহাউসেই রয়ে গিয়েছিলেন, তারপর হাঁটি হাঁটি করে আবার এখানে। মধুবালার টানে।

সেই রাত্রের কথা মনে পড়ে। রক্তমাখা জবুথবু চিতাবাঘটি। সারা গায়ে কী সুন্দর ছোপছোপ। বড়ো কাঠের বাক্সে ঢোকানো হ’ল। উপরে চাপা দেওয়া। গোপনে রাখা। স্থানীয় মানুষদের চোখের আড়ালে রাখা। জানতে পারলে পিটিয়ে মেরে দিত। বাক্সের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই গাঁক-গাঁক করে উঠছিল। যন্ত্রণার কাতরানির শব্দের সঙ্গে ক্ষোভ মেশানো ছিল, ক্রোধও।

মালবাজারের পাট গুটিয়ে এরপর অসমের বড়পেটা। ওর জন্য খাঁচা বানানো হ’ল। খাঁচায় খাবার দেওয়া হল। খাঁচার ভিতরে আস্ফালন। কৃষ্ণলাল ওকে সোনামনি ডেকেছে, এমন দুষ্টুমি করে না সোনা বলেছে, খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর পিতামহের মতো গানও শুনিয়েছে, ‘এক পলকের একটু দেখা– আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?’ খাঁচার ভিতরে থেকে ও হালুম করেছে, গাঁক-গাঁক করেছে। মধুবালার জন্য একটুকরো লেজও গড়িয়ে দিয়েছিল। সার্কাসে যখন আসত, নকল লেজের টুকরোটা জোড়া দিয়ে দিত। কৃষ্ণলাল তো ট্রেনিং জানে না, অন্য সার্কাস থেকে একজন ট্রেনার আনিয়েছে। সেই ট্রেনার বলেছিল– এই চিতার বয়স একবছরও হয়নি। শিশু চিতা। কৃষ্ণলাল ওর নাম রেখেছিল মধুবালা।

ট্রেনার বলেছিল– এদের ঠিক মতো খাবার দিতে নেই। ক্ষুধার্ত রাখতে হয়। ক্ষুধার্তদেরই বশে রাখা যায়। হালুম করলেই চাবুক। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। হুকুম পালন করলেই খাবার দেওয়া হবে। এটাই নিয়ম। এটাই ফর্মুলা।

এভাবেই পোষ মেনেছিল মধুবালা। বশ্য থাকার বিনিময়ে খাদ্য। তারপর ক্রমশ বনের চিতাবাঘ মানুষের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। চাবুককে ভয় পেতে শিখল। নখ গুটিয়ে নিল থাবার ভিতর। নখ গোটানো থাবায় হ্যান্ডশেক শিখল। পিঠে চাপলেন প্রফেসর বোস। গলায় পাটের কেশর চাপল, সং সাজল বনের চিতা। সিংহের অভিনয় করল। প্যারাডাইস সার্কাসের নামযশ হল। মাইকে ফোঁকা হতে লাগল ‘চিতাবাঘের আশ্চর্য খেলা’।

খাঁচার লোহার বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণলাল, মানে প্রফেসর বোস হেঁকে চলেছেন মধুবালা… হ্যালো মধুবালা, মাই ডার্লিং… কাম হিয়ার… কাম হিয়ার।

এবং কী আশ্চর্য। মধুবালা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। ওর অবশিষ্ট লেজটুকু নড়ে উঠল। খাঁচার ওধারে মধুবালা। হ্যাঁ, মধুবালাই তো। চিতাও কি মনে রাখে? বেড়ার ওধারে মধুবালা। ও কি এখন প্রৌঢ়া? ওর চোখ চিকচিক করছে কেন? জল? চোখে জল?

এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি।

মাঝে লোহার খাঁচা।

কেমন আছিস রে মধুবালা?

মধুবালা একবার তাকায়। প্রফেসর বোসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়।

মধুবালা একটা আওয়াজ করে… গররর…।

প্রফেসর বোঝেন– তুমি ভালো আছো তো বোস?

প্রফেসর বলেন– কী করে ভালো থাকব বল। তোকেও ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল, বাঁদর, কাকাতুয়াকেও নিয়ে গেল, তিড়িংটাও মরে গেল ঝপ করে, বড্ড মদ খেত। দলের আর রইল কী? মহিষাসুরমর্দিনীর আইটেমটাই বন্ধ হয়ে গেল। দলটাই উঠে গেল। দুর্গা, মানে দুগ্গি রে, ও বলল– এবার আমার কী হবে। কেউ তো আমার রইল না। আমার একটা উপায় করেন। ওকে কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় দিলাম। অন্যরা কেউ কেউ অন্য সার্কাসে চলে গেল। আমিও এখন তোর মতোই একটা বৃদ্ধাশ্রমে। তুই নিশ্চই এখানে আমার সার্কাসের চাইতে ভালো আছিস। কত গাছ। মাথার উপর আকাশ। ছোটো খাঁচার ভিতরে তো থাকতে হয় না আর। তোর মুক্তি হয়েছে। আমারও মুক্তি হয়ে যাবে মধুবালা। ক্যান্সার। এখন ঠিকই আছি, তবে আবার চলে আসতে পারে। খুব ভালো হল, যাবার আগে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আবার।

মধুবালা পিছন ফিরল। চলে যাচ্ছে কেন? ও কি চিনতে পারেনি তবে? আবার ডাকল, পুরোনো কায়দায়। হুকুম যেমন। কাম হিয়ার। কাম হিয়ার মধুবালা।

মধুবালা ফিরে এল। হুকুমের শব্দ মনে রেখেছে ও। দাঁড়িয়েছে।

প্রফেসর সত্যি সত্যি গান গায়। ‘আরও ভালো হতো। যদি তুমি আর আমি, পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিতাম যদি কিছুটা সময়…’।

এবার জঙ্গলের কেয়ারটেকার হাঁক দেয়। হাতে বস্তা। ও বেড়ার ওধারে। হু…উ..ই, হুক, হুক।

একটা পাথরের উপর মাংসখন্ড ফেলে দেয়।

গানের চেয়ে খাদ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই জ্ঞানে মধুবালা খাদ্যের দিকেই মুখ ফেরায়।

কৃষ্ণলাল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। দূর থেকে মধুবালার খাওয়া দেখে। খাওয়া শেষ হলে কৃষ্ণলাল আবার ডাকে। হুকুমের স্বরেই ডাকে। কেয়ারটেকারটি এগিয়ে আসে। বলে, চ্যাঁচামেচি করছেন কেন! কৃষ্ণলাল বলে এই বাঘটি আমার পুরোনো বন্ধু। বহুদিনের চেনা।

কেয়ারটেকার বলে, যত পাগলের কারবার। চলে যান এক্ষুনি। জঙ্গলে জোরে কথা বলা বারণ। ওই দেখুন বোর্ড।

বোর্ডে লেখা– জঙ্গলের শান্তি ও নীরবতা বজায় রাখুন।

কৃষ্ণলাল গুটিগুটি পায়ে চলে যায়। গেট পেরিয়ে, ছায়াছায়া পথে এবার পিচ রাস্তায়। এখানে কয়েকটা হোটেল। আর মিনিট পনেরো হেঁটে গেলেই গেস্টহাউস। কৃষ্ণলাল ভবেন এখানকার একটা হোটেলেই খেয়ে নেবেন। তৃপ্তি হোটেল। আজকের স্পেশাল বোরালি মাছ। ডুয়ার্সে শো করতে এলে এই মাছ খেয়েছেন কত।

ডুয়ার্সের নদীগুলোতেই এই মাছ পাওয়া যায়। হোটেলে ঢুকতেই বাঁদিকে একটা বাঁশের মাচা। সেই মাচায় শুয়ে আছে এক মহিলা। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। মুখটা চেনা-চেনা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন কৃষ্ণলাল। বেজে ওঠে বেসুরো ট্রাম্পেট। দুর্গা? দুর্গাই তো। দুগ্গি। কৃষ্ণলাল চেঁচিয়ে ওঠেন। দুগ্গি, তুই?

দুর্গা চোখ খোলে। অপলক কিছুক্ষণ। ঠোঁট নড়ে ওঠে। হাল্কা শব্দে শোনে– পফেছর…।

পাশের কাশফুল ঝোপ নড়ে ওঠে। একটা নাম না জানা পাখির ডাক। কী আশ্চর্য। এখানে দুর্গা। এখানেই মধুবালা। কী করে হয়। পৃথিবী কী বিচিত্র। কোণায় কোণায় কত রহস্য কত সুখ পড়ে থাকে।

কৃষ্ণলাল বলেন– দুর্গা, তুই কি করে এখানে?

দুর্গা কিছু বলার চেষ্টা করে হয়তো, ঠোঁট নড়ে। কথা আসে না। তৃষ্ণা এগোয়, জল এগোয় না। হোটেল মালিক হাফপ্যান্ট আর জঙ্গলছাপ গেঞ্জি পরা। বলে– চেনেন এই মাসিকে?

কৃষ্ণলাল বলেন– খুব চিনি। এখানে কি করে ইনি?

হোটেল মালিক যা বলে তার সার কথা হল– এই মহিলা এই হোটেলে বাসন মাজা, তরকারি কোটা, ধোয়াধুয়ির কাজ করছে ওর বাবার আমল থেকে। টুকটাক রান্নাও। জঙ্গল থেকে ঢেঁকিশাক কুড়িয়ে আনতে গিয়ে পাথরে পা পিছলে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসে। জ্ঞান আসে, কিন্তু অঙ্গ পড়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হাসপাতালে দেখিয়েছে। আলিপুরদুয়ারে। ওরা বলেছে শিরদাঁড়ায় চোট লেগেছে। অপারেশন দরকার। কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। কে নিয়ে যাবে কলকাতায়! এতদিনের পুরোনো মাসি। ফেলেও দেওয়া যায় না। শুয়েই থাকে।

কৃষ্ণলাল ওর পাশে বসে। নিজের কথা বলে।

এই দুগ্গিই দুঃখের কথা বলত প্রফেসরকে। বলত ওর স্বামী মদ খায়, মদটাই ওর আসল আনন্দ। বলত স্বামীর সোহাগ পায় না। বলত ও বাঁজা। বলত ও আদর চায়। কৃষ্ণলাল সেটাও দিয়েছিল।

কৃষ্ণলাল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মধুবালার কথা বলে। বলে কী আশ্চর্য, এত কাছে তোমরা দু’জনে থাকো, অথচ তোমাদের দেখা হয়নি। দুগ্গির মুখে হাসির রেখা আঁকা হয়ে যায়। ওর ঠোঁট নড়ে। প্রফেসর ঠিক বুঝতে পারছে ও বলছে, ওসব জায়গায় তো টুরিস্ট বাবুরা যায়। আমি কী করতে যাব?

প্রফেসর বলে– দেখবি দুগ্গি, দেখতে যাবি তোর মধুবালাকে? আবার চড়বি নাকি ওর পিঠে? ওর মুখে শিউলি ফোটে। কাশফুল নড়ে। আকাশে সাদা মেঘ ডানা মেলে।

দুগ্গিকে একটা ভ্যান রিকশায় শুইয়ে দেয়। পাশে প্রফেসর। মনে মনে বলে দুগ্গি, তোকে এই অবস্থায় ফেলে আমি চলে যেতে পারি? এখান থেকেও নয়, পৃথিবী থেকেও নয়। এখন আমার মরে যাওয়া চলবে না। ক্যান্সারের নিকুচি করেছে। তোকে কলকাতা নিয়ে যাব।

তার আগে ওই পুরোনো বন্ধুর কাছে।

সেই লোহার বেড়ার কাছে ভ্যান রিকশা থামে। কৃষ্ণলাল প্রফেসর বোস হয়ে হাঁকেন– মধুবালা… কাম, কাম হিয়ার। ইউ সি হু ইজ শি। কাম অন, কাম অন…। মধুবালা গুটি গুটি পায়ে বেড়ার কাছাকাছি চলে আসে। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। চিতার গায়ে বিকেলের সোনা রোদ। দুগ্গি পাশ ফেরে। মধুবালাকে চিনতে পারে যেন। ওর মুখে শিউলি-কাশফুল-সাদা মেঘ মেশানো শরৎ। মধুবালা শব্দ করে। বলে, চিনতে পারছ দিদি? বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীরা ধরনির বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধবনি। দুগ্গি কনুইয়ে ঠেস দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। প্রফেসর বাড়িয়ে দেয় হাত। দুগ্গি বসে। পিঠে হাত দিয়ে রাখে প্রফেসর। দুগ্গি ক্রমশ দুর্গা হয়ে যায়। লোহার খাঁচা আঁকড়ে ধরে দু’হাতের আঙুলে। প্রফেসর কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুর্গা বেড়া ধরে এক’পা – দু’পা। মধুবালা গররগরর করে বলে হ্যাঁ-হ্যাঁ, এভাবেই। সার্কাস দেখাচ্ছে দুর্গা। আবার। হয়। ভালোবাসায় হয়। বেজে উঠল ট্রাম্পেট, বিউগল। বাজল। ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন…’

 

প্রতীক্ষাপ্রান্তর

অসীম টুরে গেছে পাঁচ দিনের জন্য, তিতির কলেজে। কারেন্টও নেই। একা বাড়িতে লম্বা দুপুরটা কাটতে চাইছিল না। আজকের কাগজটা নিয়ে বিছানায় গড়াচ্ছিল নন্দিনী। এ পাতা থেকে ও পাতায় এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই চোখটা পার্সোনাল কলামে আটকে গেল। ডান দিকের কোণে একদম তলার দিকে ছোটো ছোটো কয়েকটা অক্ষর। আলাদা করে সেইভাবে চোখে পড়ার কথাই নয়। তবু পড়ল। হয়তো পড়ার ছিল বলেই। ‘জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন অফ হ্যাপি নুক, জোরহাট– পাসড অ্যাওয়ে পিসফুলি, অ্যাট হার রেসিডেন্স। ফিউনারেল মাস অন’…

জেনিফার ম্যাকলেন? জোরহাটের জেনিফার ম্যাকলেন? এই নামে অনেকদিন আগে একজনকে চিনত না নন্দিনী? হ্যাপি নুকের জেনিফার ম্যাকলেন বলতে তো একজনের কথাই মনে পড়ে। মিস ম্যাকলেন তাহলে এতদিনে মারা গেলেন। কে দিল নোটিসটি? চার্চ থেকেই হবে নিশ্চয়ই। নন্দিনী অন্যমনস্কভাবে হাতের কাগজটা ভাঁজ করে। আশ্চর্য, একেবারে ভুলেই গিয়েছিল মহিলার কথা।

অসীমের পোস্টিং তখন ছিল অসমের জোরহাটে। জোরহাট টাউন থেকে একটু দূরে কিছুটা ভেতরের দিকে ছিল ওদের বাড়িটা। বেশ নির্জনই ছিল পাড়াটা সেই সময়। প্রচুর জায়গা, বাগান, ফলের গাছ-টাছ নিয়ে এক একটা বাড়ি। এরকমই একটা বাড়ির একতলাটা অসীমের অফিস থেকে তাদের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।

কলকাতায় ও রকম বাড়ি স্বপ্নের অতীত। বিরাট বড়ো বড়ো চারখানা ঘর, আলো ভরা বাথরুম, বাদশাহি রান্নাঘর, সঙ্গে আলাদা প্যান্ট্রি, চারদিক ঘুরিয়ে কাঠের জাফরি ঝোলানো টানা বারান্দা, মানে এককথায় এলাহি ব্যাপার। কিন্তু এত বড়ো বাড়িতে সারাদিন একা একা কাটাতে নন্দিনীর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাদের মানিকতলার বাড়িও যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু সেখানে ছিল কাকা-কাকি, জ্যেঠা-জেঠি তুতো ভাইবোন সবাইকে নিয়ে বিশাল যৌথ পরিবার। চেষ্টা করলেও ওবাড়িতে একা থাকা যেত না।

সেই হট্টমালার দেশ থেকে বিয়ে হয়ে এসে পড়ল এই ভূতবাংলোয়। ঘর মোছা, বাসন মাজার জন্য একজন আর কাপড়চোপড় কাচার জন্য একজন, এই দু’জন স্থানীয় আদিবাসী কাজের মেয়ে ছিল, কিন্তু সারাদিনের জন্য নয়। সকাল সকাল এসে দশটার মধ্যে সব কাজ সেরে তারা চলে যেত। কতটুকুই বা কাজ থাকত দুজনের সংসারে। তাদের ওদিককার ভাষাও নন্দিনী সবটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারত না। ফলে সঙ্গী হিসেবে তারা খুব একটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি।

তিতির হয়নি তখনও। অসীম অফিসে বেরিয়ে গেলে এত বড়ো বাড়িতে একলা নন্দিনী। শূন্যতা যেন বিশাল হাঁ করে তাকে গিলে খেতে এগিয়ে আসত। উপরতলায় কোনও ভাড়াটেও ছিল না যে গল্প করে সময় কাটাবে। পাড়াটাও এত চুপচাপ। লোকজন বাস করে বলে বোঝাই মুশকিল। কলকাতার শোরগোলের একেবারে বিপরীত। কী করে যে দিনগুলো কাটত এখন ভাবলেও অবাক লাগে। তখনই কোনও এক সময় মিস ম্যাকলেনের সঙ্গে নন্দিনীর পরিচয়।

নন্দিনীদের বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটো বাড়ি ছিল। রংচটা, ধুলোটে। চওড়া কাঠের গেটের রং এককালে হয়তো সাদাই ছিল, বা অন্য কিছুও হতে পারে, বলা মুশকিল, কারণ বহুদিনের অযত্নে অবহেলায় সেটা একটা অবর্ণনীয় শেড ধরে নিয়েছিল। কার্নিশে যেখানে সেখানে বেয়াড়া বট অশ্বত্থের চারার যথেচ্ছ জবরদখল অভিযান। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টি গড়ানো শ্যাওলাটে সবুজ দাগ। গেটের পাশে বহু বছরের ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া ফলকে কষ্ট করে পড়া যায় ‘হ্যাপি নুক’। বাগান হয়তো কোনওকালে একটা ছিল, নন্দিনীর চোখে যেটা পড়েছিল তাকে বাগানের অপভ্রংশও বলা চলে না।

এই বাড়িতেই থাকতেন জেনিফার ম্যাকলেন। একাই। কাজের লোকটোকও কেউ ছিল না। অন্তত নন্দিনী তো কোনওদিন কাউকে থাকতেও দেখেনি, আসতে যেতেও দেখেনি। সঙ্গী বলতে একটি বৃদ্ধ পমেরিয়ান কুকুর। এত দিন পরে হঠাৎ তার নামটাও আজ নন্দিনীর মনে পড়ে গেল। পিক্সি। তাকে নিয়ে রোজ সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোতেন। চুপচাপ মাথা নীচু করে কোনও দিকে না তাকিয়ে একটু ঝুঁকে হেঁটে যেতেন, আবার ওই ভাবেই বাড়ি ফিরে আসতেন। যতদিন নন্দিনী ছিল ওখানে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওই রুটিনে কোনওদিন ছেদ পড়তে দেখেনি।

মিস ম্যাকলেনের মতো নিরুত্তাপ মানুষ নন্দিনী আজ পর্যন্ত আর দ্বিতীয় একজন দেখল না। কোনও মানুষ যে তার চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে এতটাই নিরাসক্ত হতে পারে ভাবা যায় না। কারমেল কনভেন্টে ইংরেজি পড়াতেন। শোনা কথা, ছাত্রীরা নাকি আড়ালে বলত ‘আইসবার্গ’। স্বভাবের জন্য না চেহারার জন্য সেটা জানা যায়নি। তবে দুদিক থেকেই নামটা মানানসই।

রোগাপাতলা ছোটোখাটো চেহারা। গায়ের রং পুরোনো খবরের কাগজের মতো। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ। পাতলা ফ্যাকাশে ঠোঁট। ফ্যাকাশে সবজেটে চোখের মণি। ফ্যাকাশে বাদামি চুল। চিরটাকাল পরনে হালকা রঙের ছাঁটকাটহীন ঢোল্লা হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ফ্রক। সব মিলিয়ে একজন ফ্যাকাশে মানুষ। কেউ ডেকে কথা বললে উত্তরে বাধ্য হয়ে ভদ্রতাসূচক দু-চারটে কথা যা বলার বলতেন, নইলে চুপচাপ। গলার আওয়াজও চেহারার মতোই নিষ্প্রভ, নিরুত্তেজ। কোনও ওঠাপড়া নেই। স্কুল, বাড়ি আর পিক্সির মধ্যেই ওঁর জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি রবিবার অবশ্য নিয়ম করে চার্চে যেতেন। আর প্রতি মাসে দিন দুয়েক বাড়ি তালা বন্ধ রেখে সম্ভবত গৃহস্থালির টুকটাক কেনাকাটার জন্য টাউনেও যেতেন। কারণ এবং গন্তব্যস্থলটা লোকের ধরে নেওয়া। কোনওটাই কারও সঠিক জানা ছিল না, কারণ উনিও কোনওদিন কাউকে ডেকে বলেননি, আর ওঁর কাছে কোনওদিন কেউ জানতেও চায়নি। কাকেই বা বলবেন, কেই বা জানতে চাইবে। কুকুরটি ছাড়া তো তিন কুলে কোথাও কেউ ছিলও না। অন্তত আছে বলে কেউ জানত না। উনি যে দিনগুলো বাড়ির বাইরে থাকতেন সেই কটা দিনের জন্য পিক্সি চার্চের ফাদার অ্যান্টনির কাছে থাকতে যেত।

নন্দিনী বলতে গেলে সেধেই আলাপ করেছিল। ওঁর বাড়িতেও গিয়েছিল কয়েকবার। উনি অবশ্য বিশেষ আসতেন না। দেখা হলে বেড়ার পাশে বা গেটের ওধারে দাঁড়িয়েই সামান্য দুচারটে সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে যেতেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে স্পষ্টই অনীহা ছিল। তবে পরের দিকে মাঝেমধ্যে কেক বা বিস্কিট গোছের কিছু ভালোমন্দ বানালে ডাক দিতেন। নন্দিনী খেয়েও আসত, নিয়েও আসত। জিজ্ঞাসা করে করে শিখেও নিয়েছিল ওঁর কাছ থেকে নানারকম।

একদিন, শুধু একদিনই মিস জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেনকে অন্যরকম দেখেছিল নন্দিনী। একটা পুরো দিন।

সেদিন সকালে একটু বেলার দিকে মিস ম্যাকলেনের গেটের লেটারবক্সে পিওন চিঠি ফেলে গিয়েছিল একটা। নন্দিনী নিজের শোবার ঘরে কী যেন করছিল। জানালা দিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে মনে মনে একটু অবাকই হয়েছিল। এতদিনের মধ্যে কোনও দিনও ওবাড়িতে কোনও চিঠিপত্র আসতে দেখেনি সে। পিক্সির ডাকাডাকির আওয়াজ পেয়েই আসলে তার চোখ বাইরের দিকে গিয়েছিল। সে বেচারাও পিওন নামক খাকি পোশাকধারী অপরিচিত জীবটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পাহারাদারির সহজাত সারমেয় প্রবৃত্তি পালনের তাগিদে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরে মিস ম্যাকলেনের ভাবভঙ্গি দেখে নন্দিনীর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল যেন। পিক্সির চিৎকারে উনিও বেরিয়ে এসেছিলেন। পিওন চলে যেতে যেতে হাতের ইশারা করে বুঝিয়ে দিল চিঠি দিয়ে গেছে। উনি খানিকক্ষণ যেন কিছু না বুঝে পিওনের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলেন। তারপরে পায়ে পায়ে গেটের দিকে এগোলেন।

নন্দিনী ঘটনাটা কী ঘটছে দেখার জন্য জানালার পাশ থেকে সরেনি, ওখান থেকেই তাকিয়ে ছিল। মিস ম্যাকলেন লেটারবক্স থেকে চিঠিটা বার করে একটু হতবুদ্ধি ভাবে প্রথমটা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাদামি কাগজের খামটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে উলটেপালটে দেখছিলেন, বোঝার চেষ্টাই করছিলেন হয়তো তাঁকে কে চিঠি লিখতে পারে। তারপরে ওখানে দাঁড়িয়েই খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলেন। নন্দিনী আশ্চর্য হয়ে দেখল চিঠিটা পড়তে পড়তেই ওঁর হাবভাব কেমন যেন পালটে গেল। দূর থেকেও সে বুঝতে পারছিল মহিলা থরথর করে কাঁপছেন। হাত বাড়িয়ে একবার গেটটা ধরারও চেষ্টা করলেন। নন্দিনীর ভয় হচ্ছিল উনি পড়ে-টড়ে না যান। হয়তো কোনও খারাপ খবর আছে চিঠিতে। তারপরে আরও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল উনি ওদের বাড়ির দিকেই আসছেন।

মিস ম্যাকলেন বেল বাজানোর আগেই নন্দিনী বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন উনি। মুখচোখ যেন কেমন কেমন। নাকের তলায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। কিছু না বলে অকস্মাৎ নন্দিনীর দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন। নন্দিনীও কিছু না বুঝেই ওঁর হাত থেকে ওটা নিয়ে নিল। পড়তে ইশারা করছিলেন মিস ম্যাকলেন। তখনও কথা বলতে পারছিলেন না। নন্দিনী আগে ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসাল। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস খাবার জল এনে দিল। উনি এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলেন। তারপরে কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়ে সোফার পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। নন্দিনী নজর ফেরাল হাতে ধরা চিঠিটার দিকে।

চিঠিটা লিখেছেন কোনও এক ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। ইংরেজিতে লেখা চিঠির বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়–

‘ডিয়ার জেনিফার,

আশা করি ভালোই আছ। তোমার জন্য সুখবর আছে একটা। তুমি হয়তো জেনে খুশি হবে যে ফ্র্যাংকলিনের মধ্যে আজকাল আগের থেকে অনেক বেশি উন্নতি দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ওর ঘরে রাখা তোমার ছবিটা দেখে তোমাকে চিনতে পেরেছিল। কাল নিজে থেকেই বলল, জেনি খুব ভালো চকোলেট কেক বানায়। আমার মনে হচ্ছে নতুন ওষুধটায় বোধহয় কাজ হচ্ছে।

যে জন্য তোমাকে চিঠিটা লেখা। আমি ভাবছিলাম এ মাসে তুমি না এসে যদি আমিই ফ্র্যাংকলিনকে নিয়ে তোমার কাছে যাই তাহলে কেমন হয়? একটা চেঞ্জও হবে ওর। তাই এই বৃহস্পতিবার বিকেলে তোমার বাড়ি আসছি আমরা। তৈরি থেকো।’ তারপরে আবার পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন– ‘খুব বেশি কিছু আশা কোরো না। এই রিঅ্যাকশনগুলো প্রায়ই খুব একটা পার্মানেন্ট হয় না। তবুও লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

বৃহস্পতিবার? বৃহস্পতিবার তো আজকেই। কিন্তু কে এই ডাক্তার বড়ুয়া? যে ফ্র্যাংকলিনের কথা চিঠিতে আছে সে-ই বা কে? আর এই চিঠি পেয়ে মিস ম্যাকলেনেরই বা অমন অবস্থা কেন হল? নন্দিনী সত্যি কিছুই বুঝতে পারে না। এ প্রহেলিকার উত্তর একমাত্র মিস ম্যাকলেনই জানেন। ধাঁধায় পড়ে সে মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায়। আর অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেনও, আবার নেইও। ওঁর ওই ফ্যাকাশে সবুজ চোখের দৃষ্টি যেন নন্দিনীকে ভেদ করে, এ ঘর ছাড়িয়ে কোথায় কতদূরে উধাও হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে একটি দুটি করে কথা বলতে আরম্ভ করেন জেনিফার ম্যাকলেন। তারপরে বাঁধভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক দিনের অনেক জমে থাকা কথা। গলার আওয়াজ থরথর করে কাঁপে। আর নন্দিনী স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে এক আশ্চর্য কাহিনি। যাকে কাহিনি না বলে রূপকথা বলাই বোধহয় উচিত।

আসাম চা বাগিচার দেশ। আর চা বাগিচা মানেই প্ল্যান্টার। প্রথম দিকে খাঁটি সাহেবরাই বাগান চালাত। পরে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। সে জায়গায় আসতে শুরু করে দেশি সাহেবরা। এ কাহিনির যখন শুরু তখন সবে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিছু কিছু বাগানে দু-একজন সাদাচামড়া সাহেব তখনও ছিল। তাদেরই একজন রঙালি টি এস্টেটের ছোটো সাহেব প্যাট্রিক ম্যাকলেন। প্যাডি সাহেব। প্যাডি সাহেবকে সবাই চিনত দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ তার দিলদরিয়া স্বভাব। গায়ের রংটা তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত ঠিকই, তা নইলে এদেশের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশায় সে, সাহেব আর নেটিভের কোনও ফারাকই রাখত না। কত প্ল্যান্টারদের কত অত্যাচারের কাহিনি সে সময় বাগানের কুলি কামিনদের মুখে মুখে ফিরত, কিন্তু প্যাডি সাহেব সম্বন্ধে কেউ কোনওদিনও অমন কথা ভাবতেও পারত না।

আর দু-নম্বর কারণ তার মা-মরা একমাত্র মেয়ে জেনি মেমসাহেব। জেনিফার ক্যাথারিন ম্যাকলেন। বলতে গেলে সেটাই তখন সাহেবকে চেনার প্রধান কারণ। বিশেষ করে উঠতি যুবকদের মধ্যে। পাহাড়ি ঝরনার মতো চঞ্চল, পরিদের মতো সুন্দর উনিশ বছরের জেনি মেমসাহেবকে দেখলে অতি বড়ো গোমড়ামুখোদেরও মন ভালো হয়ে যায়। সেই সময় আশপাশের ছোটোবড়ো যত গার্ডেনের সব ইয়ং ম্যানদের জীবনের একটাই লক্ষ্য, কে জেনিকে একটু খুশি করতে পারে। পিকনিক, টি-পার্টি, ক্রিসমাস ড্যান্স– সবের মধ্যমণি জেনি ম্যাকলেন। মিস স্টুয়ার্ট, মিস ব্রাউনদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। জেনির সঙ্গে একটা ড্যান্স মানে জীবন সার্থক। জেনি কারও দিকে চেয়ে একটু হাসলে সে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ভাবতে একটুও দ্বিধা করে না।

জেনি কাউকে নিরাশ করে না। কিন্তু কাউকে আশাও দেয় না। আজ ব্রিজ পার্টিতে ডিকি রবার্টসনকে পার্টনার করলে পরের দিন নাচের ফ্লোরে তার সঙ্গী হয় জেরি উইলিয়ামস। কেউ তার কাছে বিশেষ নয়। সবাই তার ভালো বন্ধু, ব্যাস।

বিশেষ তার একজনই। সেই ছেলেবেলা থেকেই। ফ্র্যাংকি। তখন ছিল শুধুই ফ্র্যাংকি। বড়ো হয়ে হল টগবগে তরুণ আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন। প্যাডি সাহেবের বন্ধু ফ্রেডি ক্লিফটনের একমাত্র ছেলে। খাঁটি সাহেব ছিল না অবশ্য সে।

ফ্রেডি ক্লিফটন এদেশে আসার আগে ছিল বার্মায়। আজকাল যে দেশের নাম হয়েছে মায়ানমার। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডি ক্লিফটন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই বার্মারই এক সুন্দরী মেয়েকে। ফ্র্যাংকি ছিল তাদের ভালোবাসার ফসল। মিশ্র রক্তের সন্তান।

তাতে অবশ্য বাগানের কারও কিছু আসত যেত না। ওখানে অনেকেরই জন্মের ইতিহাস ফ্র্যাংকির মতোই। তাও তো তার মা, পাতা তোলা কামিন ছিল না। যথেষ্ট শিক্ষিত, ধনী ঘরের মেয়ে ছিল তার মা। কেবল বিজাতীয়, বিধর্মীকে বিয়ে করার অপরাধে সে মেয়ের পরিবার তাকে ত্যাগ করে।

ফ্র্যাংকির যখন বারো বছর বয়স তখন তার মা বাবা দুজনেই এক সাংঘাতিক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। এ-দেশে তার আর কেউ ছিল না। বহু দূর আয়ারল্যান্ডে, কখনও-না-দেখা তার এক কাকা ছিল বটে, সে ভাইপোকে নিয়ে যেতে চাইছিল না। ঝুটঝামেলায় না গিয়ে প্যাডি সাহেব ফিউনারেল হয়ে যাবার পর সটান ফ্র্যাংকিকে নিজের কাছে রঙালিতে নিয়ে চলে এসেছিল। জেনির বয়স তখন আট। সেই থেকে জেনি আর ফ্র্যাংকি একসঙ্গেই বড়ো হয়েছে।

দশ বছর বয়স থেকেই জেনি জানত সে ফ্র্যাংকির। কী করে জানত জানে না। কিন্তু জানত। ফ্র্যাংকিও যেমন জানত জেনি তার। একমাত্র তার। তারা দুজন একে-অপরের জন্যই তৈরি। আর কেউ কখনও তাদের মধ্যে আসবে না, আসতে পারে না। এই ধ্রুব সত্যিটা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেই জেনি দশ থেকে উনিশ হয়েছে, ফ্র্যাংকি হয়েছে তেইশ।

‘হি ওয়াজ সাচ আ হ্যান্ডসাম ডেভিল য়ু নো। অ্যান্ড ডেয়ারিং। আর্মি জয়েন করল। ইউনিফর্ম পরে আমার সামনে দাঁড়াত। নানডিনি, বিলিভ মি, আমি মেল্ট করে যেতাম। আমাকে পেছনে বসিয়ে স্পিডে মোটরবাইক চালাত, ভাবতে পারবে না। আই থট মাইসেল্ফ দ্য লাকিয়েস্ট গার্ল অ্যালাইভ।’

নন্দিনী রূপকথা শুনছে। এই মিস ম্যাকলেনকে সে দেখেনি কোনওদিন। মিস ম্যাকলেনের গলায় উনিশের জেনি কথা বলে চলে। গলার আওয়াজ আর কাঁপছে না এখন। সেই কণ্ঠস্বরের সম্মোহনী ওঠাপড়া নন্দিনীকে আবিষ্ট করে ফেলে। রূপকথার নায়িকা স্মৃতিমগ্ন হয়ে নিজের কাহিনি শোনাতে থাকে।

‘সেদিন সানডে ছিল, জানো। আমাদের ফর্মাল এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। ফ্র্যাংকি আমাকে আংটি পরাল। আমি পরালাম ফ্র্যাংকিকে। চার্চে বিয়ের নোটিস পড়ল। তিন মাস পরে আমাদের বিয়ে। উই ওয়্যার সো হ্যাপি দ্যাট ডে।’ হালকা হাসির রেখা জেনিফার ম্যাকলেনের ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

নন্দিনী অবাক বিস্ময়ে মিস ম্যাকলেনের দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। তার চোখের সামনে মধ্য চল্লিশের বর্ণহীন মিস ম্যাকলেন আস্তে আস্তে খোলস ঝরিয়ে আদ্যন্ত জেনি হয়ে ওঠে। পুরোনো কাগজের মতো গালে গোলাপি রক্তোচ্ছ্বাস, চোখে পান্নার দ্যুতি।

গুনগুন করে কত দিনের কথা বলে যান মিস ম্যাকলেন। আর নন্দিনীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে রঙালি টি এস্টেট, জেনি মেমসাহেব আর সুদর্শন, ডাকাবুকো

ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

আর তার পরে সেই রাতের কথা। জেনি আর প্যাডি সাহেবের সঙ্গে ডিনার সেরে ইউনিটে ফিরছিল ক্যাপ্টেন ক্লিফটন। ঠিক কী যে সে রাতে হয়েছিল কেউই জানে না, কিন্তু পরের দিন সকালে রাস্তার পাশে দোমড়ানো মোচড়ানো মোটরবাইকটা ও তার থেকে অনেকটা দূরে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটনের রক্তাক্ত অচৈতন্য শরীরটা দেখেছিল ভোরের পথচলতি বাগানশ্রমিকরা। খুব সম্ভবত কোনও মাতাল লরির ধাক্বায় বাইক শুদ্ধু রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়েছিল ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন।

‘ওরাই ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। পকেটে ডায়ারি ছিল, তাতে আমার ছবি, ঠিকানা ছিল। হাসপাতাল থেকে আমাদের খবর দেয়।’

মাথায় সাংঘাতিক আঘাত লেগেছিল ফ্র্যাংকির। বাঁচার আশাই ছিল না। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ দিন কোমায় অচেতন ছিল সে। তারপরে জ্ঞান যখন ফিরল তখন ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকলিন ক্লিফটন নিজের নামটুকুও মনে করতে পারে না আর। হাসপাতালের বিছানায় ফ্র্যাংকি তখন শুধুই স্মৃতিহীন, ভাষাহীন এক মানবশরীর মাত্র।

প্যাডি সাহেব অনেক করেছে তখন। মিলিটারির ডাক্তার ছাড়াও আরও বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছে। সবারই এক কথা। আশা ছাড়লে চলবে না। সময়, সময়ই করতে পারে যা করবার। ফ্র্যাংকির খুব ভালো বন্ধু ছিল ডাক্তার বড়ুয়া। সে-ও তাই বলে গেছে অহর্নিশ। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো।

ধৈর্য ধরেছে জেনি। প্যাডি সাহেবের ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে একদিন, কিন্তু জেনির ভরসা ভাঙেনি। প্যাডি সাহেব অনেক বুঝিয়েছে মেয়েকে, মন পালটাবার অনেক চেষ্টা করেছে, তারপরে একদিন বোধহয় মনের দুঃখেই ফট করে মাথার শিরা ছিঁড়ে ওপরে চলে গেছে।

এই হ্যাপি নুক বাড়িটা অনেকদিন আগে কিনেছিল প্যাডি সাহেব। কখনও কোনও দরকারে বাগান থেকে টাউনে এসে রাত হয়ে গেলে এখানেই থেকে যেত। সাহেব মারা যাবার পর জেনিরও বাগানের পাট চুকে গিয়েছিল। সেই তখন থেকেই জেনি এখানে। সেও আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। এখান থেকে মাসে মাসে হাসপাতাল যেতেও সুবিধে। ধৈর্য ধরে থাকতে থাকতে ফ্র্যাংকির মুখে ধীরে ধীরে একটা দুটো কথা ফুটল। আর দিনে দিনে কখন যেন রঙালির চুলবুলি জেনি মেমসাহেব আস্তে আস্তে সব রং ঝরিয়ে ফ্যাকাশে মিস ম্যাকলেন হয়ে গেল।

সেই ফ্র্যাংকি আজ ডাক্তার বড়ুয়ার সঙ্গে আসছে, জেনির বাড়িতে।

‘তুমি বিকেলে একটু থাকবে আমার সঙ্গে, নানডিনি, প্লিজ? আয়্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। ফ্র্যাংকি এতদিন পরে আসছে আমায় মিট করতে।’ নন্দিনী খুব অবাক হয়ে দেখে মিস ম্যাকলেন সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো টুকটুকে গোলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

বিকেলে মিস ম্যাকলেনকে চেনা যাচ্ছিল না। ঘন সবুজ সিল্কের একটা অপূর্ব ফ্রক পরেছেন। পুরোনো কাটের জামা, কিন্তু কী যে সুন্দর মানিয়েছে ওঁকে। ঝলমল করছেন যেন। নন্দিনী কখনও লক্ষ্যই করেনি, মিস ম্যাকলেনের হাত পায়ের পাতা কী অদ্ভুত সুন্দর। ঝিনুকের মতো পাতলা, শাঁখের মতো মসৃণ। লম্বা আঙুলের ডগায় বাদাম শেপের হালকা গোলাপি নখ। চোখ মুখ চেপে রাখা উত্তেজনার আঁচে গনগন করছে। এই অপরূপা মিস ম্যাকলেন কোথায় ছিলেন এতদিন? নন্দিনী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন জেনিফার। বারবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। লজ্জাও পাচ্ছিলেন, নন্দিনী তাঁর অস্থিরতা বুঝতে পারছে বলে। টেবিলে একটা ট্রে আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছেন। চায়ের যাবতীয় সরঞ্জাম, আর একটা বড়ো প্লেটে নিজের হাতে তৈরি চকোলেট কেক। এত উত্তেজনার মধ্যেও কখন যেন ঠিক সময় করে বানিয়ে ফেলেছেন।

গাড়ির শব্দটা একই সঙ্গে দুজনের কানেই আসে। নন্দিনী মিস ম্যাকলেনের দিকে তাকায় একঝলক। যেখানে ছিলেন সেখানেই একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন উনি। মুখ থেকে সব রক্ত নেমে গিয়ে বরফের মতো সাদা দেখাচ্ছে। এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা এত জোরে আঁকড়ে ধরেছেন যে আঙুলের গাঁটগুলো চামড়ার নীচে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বন্ধ দরজাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন জেনিফার। নন্দিনীই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলে।

দুজন মানুষ। একজনকে স্পষ্টই বোঝা যায় এদিককার অধিবাসী বলে। খুব সম্ভব ইনিই ডাক্তার এসপি বড়ুয়া। এক হাত দিয়ে আরেকটি মানুষের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছেন। সে মানুষটি এক বিশাল বৃক্ষের বাজ পড়া শুকনো কাণ্ড। ঝুঁকে পড়া লম্বা শরীর, পোড়া তামাটে গায়ের রং। নীল হাওয়াই শার্ট তার গায়ে ঢলঢল করছে। গাল ভাঙা, চোখের কোলে গভীর ক্লান্তি। কানের দু-পাশে কিছু পিঙ্গলে সাদায় মেশানো চুল। বাকি মাথা ফাঁকা। বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। পঞ্চাশও হতে পারে, পঁচাত্তরও হতে পারে। পিঠে ডাক্তার বড়ুয়ার হাতের চাপ অনুসরণ করে পা ঘষে ঘষে সে এগিয়ে আসতে থাকে নন্দিনীর দিকে।

‘হ্যালো জেনি।’ নন্দিনী ডাক্তার বড়ুয়ার কথায় সচেতন হয়ে পিছনে তাকায়। কখন যেন মিস ম্যাকলেন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমরা এসে গেছি।’

কথার জবাব দেন না জেনিফার। তাঁর দৃষ্টি শুধু দ্বিতীয় মানুষটির দিকে। ডাক্তার বড়ুয়া তার পিঠে চাপ দেন। ‘চিনতে পারছ ফ্র্যাংক? তোমার জেনিকে?’

ফ্র্যাংক নীরব থাকে। চোখে কোনও ভাষাই ফোটে না। মিস ম্যাকলেন নিজের হাতদুটো শক্ত করে মুঠি করেন। মুখ একবার লাল একবার সাদা হয়। নন্দিনীর ভেতরে কী একটা ভাঙতে থাকে, ভেঙে ভেঙে যায়।

ডাক্তার বড়ুয়া আস্তে আস্তে ফ্র্যাংককে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসান। সামনে টেবিলে মিস ম্যাকলেনের সাজানো ট্রে।

‘দেখছ ফ্র্যাংক, চকোলেট কেক। তুমি তো ভালোবাসো। দ্যাখো, জেনি নিজে বানিয়েছে, তোমার জন্য।’

ফ্র্যাংকি দুহাতে দুটো কেকের টুকরো তুলে নেয়। বাচ্চাদের মতো একবার এ-হাত একবার ও-হাত থেকে কামড়ায়। থুতনিতে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়া কেক মাখামাখি হয়ে যায়। শব্দ করে চিবোয় ফ্র্যাংকি। অথচ কী আশ্চর্য, মুখে কোনও অভিব্যক্তি ফোটে না।

‘আর এক পিস কেক নেবে ফ্র্যাংকি?’ জেনিফার খুব নরম গলায় বলে।

ফ্রাংকি কোনও উত্তর দেয় না। শুনতে পেল কী না তাও বোঝা যায় না। তাকিয়ে থাকে সোজা নির্বিকার। ফাঁকা দৃষ্টি জেনিফারকে ভেদ করে চলে যায়। তার হাতে মুখে আইসিঙের ক্রিম আর কেকের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে বুঝতেও পারে না, বসে থাকে স্থির। জেনিফার ফ্রাংকির সোফার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। অসীম মমতায় পরিষ্কার নরম ন্যাপকিন দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়, হাত মুছিয়ে দেয়।

গোধূলির রং আস্তে আস্তে সন্ধ্যায় পালটে যেতে থাকে। আগে থেকে সাজিয়ে রাখা ট্রে-র কাপ ভর্তি চায়ে সর পড়ে যায়। ঘরের কোণায় কোণায় অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। টেবিলবাতিটা জ্বেলে দেয় নন্দিনী।

জেনিফার ফ্র্যাংকির দুটি হাত মুঠিতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেই থাকে। হাতদুটি অল্প অল্প কাঁপে, পাতলা দুটি ঠোঁট কত কিছু বলতে চেয়ে থিরথির করে। কিন্তু কোনও কথাই বেরোয় না। বোধহীন, ভাষাহীন ফ্রাংকির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের পলকও বুঝি পড়ে না তার।

ঘরের মধ্যে ক্রমশ ভারী হয়ে জমতে থাকা একরাশ নৈঃশব্দ্য নন্দিনীকে চেয়ারে গেঁথে রাখে। নড়াচড়া করলেই যেন কী একটা ঘটে যাবে। সে শুধু দুচোখ মেলে এই ট্র্যাজিক মূকাভিনয় দেখতেই থাকে। গলার কাছে কী যে ভীষণ কষ্ট শক্ত হয়ে ডেলা পাকায়, সে জোর করে করে গিলে গিলে সেই ডেলাকে নীচে পাঠায়। কতক্ষণ যেন কেটে যায় এমনি করেই।

ডাক্তার বড়ুয়াই শেষে উঠে দাঁড়ান। শব্দ করে গলা পরিষ্কার করেন। ‘সরি জেনিফার।’ নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পরে ওঁর কথাটা যেন ভীষণই জোরে বেজে ওঠে মনে হয়। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। গলা নামিয়ে আবার বলেন, ‘এবার যেতে হবে আমাদের।’

ডাক্তারের গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙে জেনিফারের। ‘ফ্র্যাংকি আমার কাছে থাকতে পারে না? প্লিজ ডাক্তার? ও তো অনেক ভালো আছে আগের থেকে। ওকে তো এখন তোমরা এখানেই রাখতে পারো।’ জেনিফারের কণ্ঠস্বরে একরাশ আকুল আর্তি। অসহায় আশা ভরা দুটি চোখ ডাক্তার বড়ুয়ার দিকে চেয়ে থাকে।

জ্বলন্ত টেবিলবাতিটার চারপাশে একটা মথ অবিশ্রাম পাক খাচ্ছিল। ডাক্তার বড়ুয়া সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ এমন ভাবে চুপ করে থাকেন যেন কানেই যায়নি। তারপর চোখ না সরিয়েই খুব নরম গলায় বলেন, ‘এইরকম সোবার কোয়ায়েট মোমেন্টগুলো ফ্র্যাংকির লাইফে খুবই রেয়ার, জেনিফার। তুমি পারবে না। পারবে না ম্যানেজ করতে তুমি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হবে…’ জেনিফারের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ না করেই থেমে যান ডাক্তার।

এতক্ষণে বাঁধ ভাঙে। কী অসহ্য এক আক্ষেপে জেনির মুখ দুমড়ে দুমড়ে যায়। শব্দহীন কান্নায় বিকৃত মুখ দু-হাতে ঢেকে ফেলে সে। কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে শরীরটা। ডাক্তার বড়ুয়া আর নন্দিনী দুজনেই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। গতে বাঁধা সান্ত্বনাবাক্য এখানে এত অর্থহীন।

অস্বস্তি কাটানোর জন্য নন্দিনী চায়ের সরঞ্জামগুলো সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বড়ুয়া ফ্র্যাংকির দিকে তাকান। এ ঘরের চারজন মানুষের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাংকিরই কোনও বিকার নেই।

গেটের বাইরে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ানো গাড়িটা এই সময়ে একবার জোরে হর্ন বাজায়। চমকে তাকিয়ে নন্দিনী এতক্ষণে দেখতে পায় গাড়িটার গায়ে বড়ো বড়ো সাদা অক্ষরে লেখা ‘সেন্ট জর্জেস অ্যাসাইলাম’।

পরের দিন সকালেও মিস ম্যাকলেনকে দেখেছিল নন্দিনী। রোজকার মতোই হালকা রঙের হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ঢোল্লা ফ্রক পরে পিক্সিকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাথা নীচু, চোখ রাস্তার দিকে। বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাশে এক প্রৌঢ়া।

টিউব লাইটটা হঠাৎ দপদপ করে জ্বলে উঠে নন্দিনীর চোখটা ধাঁধিয়ে দিল। যাক, এতক্ষণে কারেন্ট এল তাহলে। বাবা, পাঁচটা বাজে। তিতিরের কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এল। সবিতা বিকেলের কাজ করতে এসে যাবে আর একটু পরেই। নন্দিনী দ্রুত হাতে খোলা চুল গোছাতে গোছাতে বিছানা থেকে নামে। আলস্যমন্থর স্মৃতিমেদুর দুপুরের ভার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার আবার সংসারের অভ্যস্ত ছন্দ তার আপাদমস্তক অধিকার করে নিতে শুরু করে।

মিস ম্যাকলেনের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কাগজটা দলামোচড়া হয়ে খাটের উপরেই পড়ে থাকে।

 

লিভ-ইন রিলেশন

ঘন্টা তিনেক পর কনফারেন্স রুম থেকে মিটিং শেষ করে বের হয় আদিত্য। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ঘাবড়ে যায়। মায়ের মোবাইল থেকে এগারোটা মিসড্ কল। তড়িঘড়ি ফোন করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে পরমা-র কণ্ঠস্বর। পরমা আদিত্যর ছোটোপিসি। ‘আদিত্য, ছোটোপিসি বলছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। তোর মায়ের অবস্থা একেবারেই ভালো না।’ মায়ের ফোনে পিসির গলা শুনেই বুঝতে পেরেছিল আদিত্য, কিছু একটা হয়েছে। তার আশঙ্কাই ঠিক হল।

‘কী  বলছ পিসি! কী এমন হল? সব তো ঠিকই ছিল?’

‘সকালে সবে ঠাকুরঘরে ঢুকেছি, ঠিক সেই সময়তেই কাজলের ফোন.. পিসিমা তাড়াতাড়ি চলে আসুন, জেঠিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমরা পৌঁছোনোর আগেই ক্লাব থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে গ্রিনল্যান্ড নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে।’

একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে পরমা। ‘দিনকয়েক সময় নিয়ে আসিস। কখন যে কী হয়।’ বলতে বলতে আবার থেমে যায় পরমা।

‘ঠিক আছে। জানি বলতে হবে না, তবু আমি না যাওয়া অবধি মায়ের একটু খেয়াল রেখো। আর টাকাপয়সার জন্য যেন কোনওরকম ভাবে চিকিৎসা না আটকে থাকে সেটা একটু দেখে নিও। আমি গিয়ে সমস্ত ক্লিয়ার করে দেব। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি।’ বলে ফোনটা কেটে দেয় আদিত্য। আর একটা ১০ ডিজিটের নাম্বার প্রেস করে ফোনটা কানে দেয় আদিত্য। ‘শ্রী, অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল আমার নামে একটা কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট বুক করে আমাকে মেসেজ করে দাও। আমি ছুটির জন্য বসের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।’

‘আরে হঠাৎ কী হল সেটা তো বলবে।’ চিন্তিত শোনায় শ্রীয়ের স্বর।

‘মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার-রা প্রেডিক্ট করছেন, ইট্স অ্যা ব্রেন হেমারেজ।’ বলতে বলতেই চোখে জল চলে আসে আদিত্যর। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয়। ‘শ্রী প্লিজ, পরে সব বলব। তুমি টিকিট-টা কেটে আমাকে একটা কল করে দিও।’ আদিত্যর কষ্টটা ফিল করতে পারে শ্রী। মনে মনে ভাবে এ-অবস্থায় আদিকে কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না। তার মা যে তার মনের কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সেটা শ্রী ভালোমতোই জানে। আদিত্যকে সে ভালোমতো জানে ও বোঝে। আর কারও কাছে নিজেকে ধরা না দিলেও শ্রী-কে ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রী-য়ের কাছে ধরা তাকে পড়তেই হবে। ভালোবাসার বন্ধনটা বোধকরি এমনই হয়। জেদ ধরে বসে, ‘আমিও সঙ্গে যাব।’ ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিল আদিত্য। শ্রীয়ের কথা শুনে থমকে গেল।

‘সব কিছু জেনেও তুমি একথা বলছ? ভুলে গেছ সবকিছু? তুমি জানো না, মা আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটা আপসেট? যদি তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সেটাও তো মায়ের শরীরের জন্য ঠিক নয়, না। তাছাড়া আমি চাই না তোমাকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখুক।’

আদিত্যর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নেয় শ্রী। ‘কী যাতা বলছ বলো তো? উনি পছন্দ করেন না বলে কি এই বিপদের সময়তেও আমি ওনার কাছে থাকতে পারি না? তাছাড়া এখন এসব ভাববার সময় নয় আদি।’

‘ভেবে দ্যাখো কী করবে।’

‘ভাবার কিছু নেই। আমি যাচ্ছি এটা ফাইনাল।’

‘ঠিক আছে তাহলে তোমার যা নেওয়ার নিয়ে নিও। আমারও কয়েকটা জামাকাপড় প্যাক করে নিও। থ্যাংকস্ শ্রী, তুমি সাথে থাকলে একটু মনের জোর পাব।’

বসের সাথে কথা বলার পর সোজা এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আদিত্য। পূর্বনির্ধারিত সময় মতো শ্রী-ও লাগেজ নিয়ে পৌঁছে যায় এয়ারপোর্টে। পথে যাবতীয় ফোনাফুনি সেরে নেয় আদিত্য। দিদি অন্বেষাকে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো থেকে শুরু করে ঘন্টায় ঘন্টায় পিসির থেকে মায়ের শরীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া চলতে থাকে।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই শ্রী-কে দেখতে পায় আদিত্য। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা কোণে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শ্রী-কে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। লাগেজটা নিয়ে নেয় শ্রী-র থেকে। আদিত্যর চোখেমুখে তখন বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ। চোখটা টকটকে লাল। আদি কাঁদলেই ওর চোখ-মুখের অবস্থা ঠিক এমনটাই হয় সেটা জানে শ্রী।

সান্ত্বনা দিতে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘চিন্তা করছ কেন, আন্টি ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেঙে পোড়ো না।’

একটু মনোবল সঞ্চয় করতে শ্রীয়ের হাতটা চেপে ধরে আদিত্য। ‘চলো চলো ঘন্টা দেড়েক পরেই ফ্লাইট। চেক-ইন করতে হবে তো।’

শ্রীয়ের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে দুজনেই ঢুকে পড়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে। সমস্ত ফর্মালিটির পর পাশাপাশি সিটে বসে দুজনে। আদিত্য-র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে শ্রী। আদিত্য চোখ বুঝে ফেলে। মুহূর্তেই পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করে। মা অসুস্থ এটা যেন সে ভাবতেই পারে না। মা-কে তো কোনওদিন এভাবে দেখেনি সে। বরং মায়ের দৃঢ়চেতা স্বভাবই দেখে এসেছে সে। যেমন ভালোবাসা, মমত্ব উজাড় করে দিয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে পিঠে বেত কষাতেও বাকি রাখেনি। চিরকাল মাকে এভাবেই দেখে এসেছে সে। শত বাধা-বিপত্তিতেও মায়ের চোখে জল দেখেনি। শুধু একবার বাবার মৃত্যুর সময় মাকে ভেঙে পড়তে দেখেছে সে। ব্যস সেই দিনকতক। তারপর আরও নানা স্মৃতি আনাগোনা করতে থাকে।

আদিত্য আর শ্রী লিভ-ইন করছে প্রায় বছর তিনেক। এর মাঝে বার-চারেক শ্রী-কে নিয়ে কলকাতাতে মায়ের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছে আদিত্য। বার বার উনি ছেলেকে বুঝিয়েছেন শ্রী-কে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য।

‘একসাথে যখন থাকছ। সংসার করছ, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধেটা কোথায়? কীসের ভয় তোমাদের? বাঁধা পড়ার?’ প্রত্যেক বার এই নিয়ে মায়ের সাথে বচসা বেধে যেত আদিত্যর। এবার সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। অশান্তি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, আদিত্য মুম্বই ফিরে যাবার সময় মাকে বলে যায়, এরকম করলে মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখা নাকি তার পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তার লাইফ, সে কীভাবে লিড করবে এটা একান্ত ভাবেই তার সিদ্ধান্ত। তারপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এই ঘটনা ঘটে গেল। কোথাও গিয়ে তার মনে হয়েছে, মায়ের অসুস্থতার জন্য সে-ই দায়ী। অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। ঘন্টা তিনেকের পথ এভাবেই কেটে যায়। ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা পৌঁছে যায়

নার্সিংহোমে। রাত তখন এগারোটা। নার্সিংহোমে ঢুকেই চোখে পড়ে বেঞ্চের এককোণে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে ছোটো পিসি। আর পিসেমশাই পায়চারি করে চলেছে। তাদের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। সঙ্গে শ্রী-ও এগিয়ে আসে।

‘মা,  এখন কেমন আছেন পিসেমশাই?’

‘ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রেন হেমারেজ হয়েছে। ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। ডাক্তাররা তো এমনটাই বলছেন।’

আইসিইউ-তে ঢোকার পারমিশন না মেলায় দরজার কাচ দিয়েই মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আদিত্য। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, হাতে কতগুলো চ্যানেল করা, একটা মেশিনে কী-সব আকিঁবুঁকি রেখা ছুটে চলেছে, অথচ সাদা বিছানায় মা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। সহ্য করতে পারে না সে। পরমাকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

‘ছোটোপিসি,  মা ঠিক হয়ে যাবে তো, বলো না?’

‘নিজেকে শক্ত কর আদি।’

পাশ থেকে পিসেমশাই বলে ওঠেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমাদের, যাও বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের দেখেই মনে হচ্ছে তোমরা দুটিতে সারাদিন কিচ্ছুটি খাওনি। যাও যাও। আর দেরি কোরো না, সঙ্গে পিসিকেও নিয়ে যাও। সারাদিন ওইভাবেই বসে আছে, আর টেনশন করছে। ওকেও কিছু খাইয়ে দিও।’ বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখেন, ‘যাও মা যাও, তুমিও যাও।’

আদিত্যর পিসেমশাই বরাবরই একটু দাপুটে স্বভাবের। ওনার কাছে কোনওকিছুই ধোপে টেকে না। আদিত্য নার্সিংহোমে থাকার জন্য  জেদ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু পিসেমশাইয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হল।

‘যা বলছি তাই শোনো। এমনিতেই আজ আর কাউকে বউদির কাছে যেতে দেবে না। যদি কিছু লাগেও তার জন্য তো আমি

রইলাম-ই। বরং কাল সকাল থেকে মায়ের কাছে থেকো। ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নিও।’

‘কিন্তু..’ নার্সিংহোমে থাকার জন্য পিসেমশাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে আদিত্য।

‘আর কোনও কিন্তু নেই। যাও, কাল সকাল সকালই চলে এসো।’

ইচ্ছে না থাকলেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বেরিয়ে যেতে হল তিনজনকে। নার্সিংহোম থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে মিনিট দশেকের। ট্যাক্সিতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায় তারা। দরজা খুলেই সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে যায় আদিত্য। ঘরের আলমারি, বিছানা, আলনা, সব জায়গাতেই মায়ের পরশ অনুভব করে সে। একটু করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। হঠাৎই চোখ আটকে যায় দেয়ালে টাঙানো মায়ের ফোটোফ্রেমটার দিকে। যেটা সে একদিন নিজে হাতে রঙ-তুলির টানে সৃষ্টি করেছিল। আর ছেলের আঁকা বলে তার মা সেটা সযত্নে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটা আদ্যোপান্ত ধুলোয় ঢেকে গেছে। ঠিক করে মায়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সেটাকেই নামানের চেষ্টা করতে থাকে আদিত্য। দেয়ালে পেরেকের সঙ্গে ফ্রেমের পিছন দিকে আটকানো তারটা এমনভাবে জড়িয়ে বাঁধা রয়েছে যে, সহজে নামিয়ে আনতে পারে না সে। খুলে আনার জন্য টান দিতে থাকে।

খাবার জন্য ডাকতে আসা ছোটোপিসির চোখ এড়ায় না পুরো ঘটনাটা। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরমা।

‘ওটা  কী করছিস আদিত্য?’

‘এই যে মায়ের ছবিটা পিসি। একেবারে ধুলো পড়ে গেছে।’

একটা বাঁকা হাসি হাসে পরমা। ‘এরকমই বোধহয় হয় রে আদি, লোক দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। পড়ে গেলে তবেই বোঝে।’

পিসির খোঁচাটা বুঝতে পেরে বিরক্ত লাগে আদিত্যর।

‘কী যা-তা বলছ পিসি।’ মুহূর্তেই চোখ লাল হয়ে যায় তার।

‘খুব  কি কিছু ভুল বলছি? কী পেয়েছে বল তো মানুষটা? আজ তোদের জন্যই তো বৃন্দা বউদির এই হাল। এর জন্য তোরাই দায়ী।’ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে আদিত্য।ঠোঁটে রা কাড়ে না সে।

পরমা তার মতো করে বলে চলে, ‘নিজের দাদা বলে বলছি না, তিনি তো সমস্ত দায়ভার তোমার মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। খুব যে কিছু রেখে গেছেন তাও তো বলতে পারব না। তৎসত্বেও তো তোমাদের কোনও অভাব রাখেনি তোমার মা। এক এক করে সব গয়না খুইয়েছে তোমাদের পড়াশোনার জন্য। এমনকী তোমার দিদিকে সিম্বায়োসিসে ল’ পড়ানোর জন্য বাড়িটা পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। বদলে তোমরা কী করেছ, শুধু মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়েছ। তোমার দিদি পড়াশোনা চলাকালীন তার থেকে বাইশ বছরের বড়ো একটা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে বসল। আর এখন তুমি  লিভ ইন করে ওর মুখে কালি লেপছ।  একসাথে থাকবে অথচ বিয়ে করতেই যত ওজর-আপত্তি। আর কত সইবে সে। ওর কি মান-সম্মান বলে কিছু নেই? ঠিকই আছে, বউদির মরে যাওয়াই ভালো।’

কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিত্য। পিসির হাত দুটো চেপে ধরে বলে ‘প্লিজ ছোটোপিসি, এভাবে বোলো না।’

‘কেন বলব না, বলতে  পারো। সমাজে মুখ দেখানোর বাকিটা কী রেখেছ তোমরা। লজ্জায় মানুষটা একেবারে একঘরে করে ফেলেছিল নিজেকে। সে-সব যাবে কোথায়? কাঁহাতক একটা মানুষ একলা থাকতে পারে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে? চোখ বুজলে যদি একটু শান্তি পায়।’

পিসির গলার আওয়াজ পেয়ে এক-পা এক-পা করে আদিত্যর মায়ের ঘরের সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রী। পিসি-ভাইপোর মাঝে কথা বলার দুঃসাহস সে দেখায় না। সেই শিক্ষাও তার নেই। তাকে একঝলক আপাদমস্তক দেখে নেয় পরমা। তারপরে আবার বলতে শুরু করে ‘বৃন্দা তো তোদের খুশিতেই খুশি থাকতে চেয়েছিল। ও চেয়েছিল তোদের চারহাত এক করে দিতে। কিন্তু তোদের মাথায় কী ওই লিভ-ইনের ভূত চেপে বসে রয়েছে। শিক্ষিত হয়েছিস, ভালো চাকরি করছিস, এখন আর মায়ের কথা শুনবি কেন? এখন যেভাবে খুশি থাক, আর কেউ বলতে আসবে না। এটা মনে রাখিস আমাদের সমাজ এখনও এতটা উদার মানসিকতার হয়নি যে, এটাকে ভালো ভাবে নেবে। কর, যা মন চায় কর।’ আদিত্য তখন পিসির হাত দুটো ধরে একেবারে মাটিতে বসে পড়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।

‘আমার ভুল হয়ে গেছে পিসি, মা যে এভাবে নেবে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু ভগবান আমার মাকে সুস্থ করে দিক, মা যা বলবে আমি তাই করব। শুধু একটা সুযোগ।’

আশ মিটিয়ে বলার পর খানিকটা নরম হয় পরমা। ভাইপোর হাতটা ধরে বলে, ‘আরে ওঠ ওঠ। চল রাগের মাথায় কত কী-ই না শোনালাম তোকে। আসলে কী জানিস তো, সেই তোর মায়ের বিয়ে হয়ে আসা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। সারাজীবন ওকে শুধু কষ্ট পেতেই দেখলাম। আমি চাই ও একটু ভালো থাকুক রে।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় পরমার। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নেয়। ‘আরে যা যা, অনেক রাত হল, তোরা দুটিতে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আয়। কিচ্ছু ভালো লাগছে না-রে, কী যে দেখব কাল…।’

চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। পরমা-ও ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে, ‘চল, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। মুখে কিছু দিয়ে নিবি চল।’

কারওর-ই গলা দিয়ে খাবার নামল না। শুধু প্রয়োজনের তাগিদে কোনওরকমে দু-এক গাল মুখে দিয়েই যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। সকলের একটাই চিন্তা, কীভাবে বৃন্দা ভালো হয়ে উঠবেন।

দিনের আলো ফোটার আগেই আদিত্য তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে, ছোটোপিসিও রেডি। পিসেমশাইকে নিয়েও খানিক চিন্তায় ছিলেন, ওনার যে আবার হাই-ব্লাডপ্রেশার। সারারাত জাগা। শ্রী-ও তাদের সাথে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। বাধ সাধে আদিত্য।

‘শ্রী, তুমি দুপুরে এসো। তোমাকে দেখে যদি আবার মা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘ঠিক আছে। তাহলে আন্টিকে কী খাবার দিতে হবে ডাক্তারের থেকে জেনে নিয়ে আমায় বোলো। সেইমতো বানিয়ে নেব।’

‘যা লাগে কাজলকে দিয়ে তাহলে আনিয়ে নিও।’

‘ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব।’

‘ওকে’, বলে বেরিয়ে যায় তারা।

দিনতিনেক পর আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হল বৃন্দাকে। এখন আউট অফ ডেঞ্জার, তবে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেটা এতটাই ক্ষীণ আর অস্পষ্ট যে বোঝার উপায় নেই। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন বৃন্দা। তারপর ইশারায় শ্রীয়ের কথা জানতে চান। আদিত্য আঙুল দিয়ে দরজার বাইরের দিকে দেখিয়ে দেয়। বৃন্দার চোখ চলে যায় দরজার বাইরে থাকা শ্রীয়ের দিকে। জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখের ইশারায় ডেকে নেয় শ্রীকে। আদিত্য একটু ভয় পেয়েছিল বটে, তবে মায়ের আচরণ দেখে সে খানিকটা আশ্বস্তই হয়। বুঝতে পারে শ্রীয়ের উপস্থিতিতে মা খুশিই হয়েছে।

তবে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল আদিত্যকে। মা-কে সবসময় কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে, সেই মায়ের এই অবস্থা মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক তো বটেই। এর আগে সে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। বুঝে উঠতে পারছিল না কী করলে তার মা আবার আগের মতো হেঁটেচলে বেড়াবে।

বৃন্দার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রী। খাবার বানানো থেকে শুরু করে খাওয়ানো পর্যন্ত খুব যত্নের সঙ্গে সামলাচ্ছিল সে। কখন কী লাগে এই ভেবে সবসময় তাঁর পাশে পাশে থাকত শ্রী। বৃন্দাও আস্তে আস্তে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাকেই খুঁজে বেড়াত বৃন্দার চোখ। পিসি, পিসেমশাই মাঝে মাঝে এসে শ্রীয়ের যত্ন দেখে খুশিই হতেন।

বিপত্তির মাঝে আর এক বিপত্তি। অফিস থেকে পত্রাঘাত। কোম্পানি তাকে ইউএসএ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটা আদিত্যর অনেক দিনের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ গড়ার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর সে কোনওদিনও পাবে না। এত আনন্দের খবরটাও তার কাছে আজ নিরানন্দের-ই সমান। কী করবে সে? এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বারবার দিদি অন্বেষাকে ফোন করছে আসার জন্য, কিন্তু তার ওই এক কথা, মা তাকে পছন্দ করে না। তাকে দেখলে মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবু সে চেষ্টা করে দেখবে।

অবশেষে আরও দু-দিন পর পুনে থেকে আদিত্যর দিদি অন্বেষা উপস্থিত। তাকে দেখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল আদিত্য। ‘তোকে দেখে খানিক স্বস্তি পেলাম রে দিদি। যদিও মা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছে, অ্যাটেনডেন্টও রয়েছে, তবুও দেখাশোনার জন্য নিজেদের লোকজন পাশে থাকাটাও জরুরি। এতে মা-ও খানিক ভরসা পায়। তা কয়েকদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস তো?’

‘না, না।  তুই তো জানিস আমার জব-টা কী? এখন আবার এক্সাম চলছে। হুট করে এভাবে বিনা নোটিশে ছুটি নেওয়া যায় নাকি? তবুও তো প্রিন্সিপাল-কে বলে কয়ে দিন দুয়েকের ছুটি পেয়েছি।’

বেশ হতাশ হয়ে যায় আদিত্য।

‘এবাবা আমি তো ভেবেছিলাম তুই থেকে একটু মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবি।’

‘জানিস-ই তো, হাসপাতালের নাম শুনলে বরাবরই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার। এই গন্ধটা কিছুতেই নিতে পারি না।’

অন্বেষার কথা শুনে আদিত্য রীতিমতো শকড হয়ে যায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কেমন অচেনা লাগে নিজের দিদিকে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। এদিকে ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। উনি বলেছেন, ‘এবারে আপনারা আপনার মা-কে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন নিয়মিত ফিজিয়োথেরাপি-টা মাস্ট। এখন ওনার সুস্থ হওয়াটা পুরোটাই ওনার সেরে ওঠার ইচ্ছাশক্তি আর আপনাদের সেবা শুশ্রুষা-র উপরই নির্ভর করবে।’

‘কিন্তু ডাক্তারবাবু ওনার কথাগুলোও তো এখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে এত তাড়াতাড়ি…’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘আপনাকে তো আগেই বললাম, আমাদের যা করার আমরা করে দিয়েছি। এখন যা ওষুধ চলবে তাতে ধীরে ধীরে কাজ হবে। জেনারেলি এসব কেসগুলোতে দীর্ঘকালীন ট্রিটমেন্ট চলে। পেশেন্টের মনোবল থাকলে অনেকে কিওর হয়ে যায় আবার অনেকের…। থাক ওসব কথা।’ বলে ডাক্তারবাবু রাউন্ডে চলে যান।

সেসব নিয়েই আদিত্যর মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই কারণেই অন্বেষাদিকে দেখে একটু চিন্তামুক্ত হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু উলটোটাই হল। দিদিকে আরও একবার কনভিন্স করার চেষ্টা করল আদিত্য।  ‘কোনওভাবেই কি কয়েকটা দিন ম্যানেজ করা যায় না? কয়েকটা দিন? এই মুহূর্তে আমার ইউএস যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। আমি ওখানে জয়েন করার পরে পরেই এসে মাকে নিয়ে চলে যাব। মা-কে নিয়ে যাব তার জন্য তো আমাকে কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। জাস্ট কয়েকটা দিন।’

‘না, কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এক্সামের ডিউটি না থাকলে…। তাছাড়া কালই আমার ফ্লাইটের টিকিট।’ দিদির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিত্য। অন্বেষা কী একটা ভাবে। তারপর হুঠ করে কথা প্রসঙ্গে বলে বসে, ‘তুই তো একটা অ্যাটেনডেন্ট রাখলেই পারিস।

সে-ই তো মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।’ অন্বেষার ভাবটা এমন যেন সে ভাইয়ের কাঁধ থেকে দায়িত্ব অনেকটা কমিয়ে দিতে পেরেছে।

‘একজন অচেনা মানুষের দায়িত্বে পুরো বাড়িতে মা একা?’ ভাবতে পারে না আদিত্য।

‘কেন সঙ্গে কাজলদিকে থাকতে বল। ও-তো বিশস্ত। অনেকদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে।’

‘নিজের কেউ একজন পাশে থাকাটাও জরুরি দিদি। ওসব তুই বুঝবি না। স্পর্শ- চিকিৎসা বলেও একটা ব্যাপার আছে জানিস তো।’

‘ছাড় তো, যত সব ফালতু ব্যাপারস্যাপার। তোর যদি এতই সমস্যা তাহলে ভালো কোনও ওল্ড এজ হোমে রেখে যা। কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার।’

‘বাঃ দিদি বাহ্, এটা তোর পক্ষেই সম্ভব। একটু বাধল না, না রে? সব ভুলে গেছিস, মা সারাজীবন আমাদের দুই ভাইবোনের জন্য কী করেছে। আর এখন যখন তার আমাদেরকে প্রয়োজন, আমরা পিঠ বাঁচাচ্ছি।’

‘আমাকে  কর্তব্য শেখাতে আসিস না। যেটা বাস্তব সেটাই বলেছি। আর কী বলছিস মা এই করেছে, সেই করেছে। হোস্টেলে রেখেছে, ফিজ দিয়েছে এই তো। এগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে? প্রত্যেকটা বাবা-মা-ই তাই করে। আমার মা-ও তাই করেছে।’

দিদির কথাগুলো সহ্য করতে পারে না আদিত্য। ভাইবোনের মধ্যে রীতিমতো তর্কাতর্কি চলতে থাকে। রাগে ফুঁসতে থাকে আদিত্য। সে ভুলে যায় যে তার মায়ের ঘরে মায়ের চোখের সামনে এই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। কথার মাঝে শ্রী  মায়ের কেবিনে ঢুকে পড়ে। তখন আদিত্যর সম্বিৎ ফেরে। শ্রীয়ের দৃষ্টি মায়ের দিকে, কিন্তু বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শ্রী৷ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে আদিত্য । মা ওঠার চেষ্টা করছে। ডান হাতটা নাড়াচাড়া করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। দু-চোখ জলে ভেজা। মায়ের কাছে ছুটে যায় শ্রী। শান্ত করার চেষ্টা করে ওনাকে। আদিত্য বোকার মতো একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে কত বড়ো ভুল সে করেছে।

‘তোমাদের  মুখগুলো এরকম লাগছে কেন? আমি কি তোমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম? মা-ই বা হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন?’, জানতে চায় শ্রী৷ কোনও উত্তর দিতে পারে না আদিত্য। ফ্যালফ্যাল করে কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্রী, আদিত্য আর অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত যে আন্টি কাল বাড়ি ফিরছে। উলটে তোমাদের মুখগুলো কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।’

এইবার উত্তর দেয় আদিত্য। ‘ভাবছি মাকে কে দেখবে। ২২ তারিখে আমার ফ্লাইট। তার আগে দিল্লির অফিসের সমস্ত কাজ আমাকে মিটিয়ে নিতে হবে। সেইজন্য দুদিন আগে যাওয়াটা জরুরি। দিদিও থাকতে পারবে না বলছে।ওর ফ্লাইট কাল ।’

‘এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে? আমি থেকে যাচ্ছি আন্টির কাছে। আমি দেখাশোনা করব ওনার। আমি তো একটু আগেই একজন ফিজিয়োথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বললাম। একটা অ্যাটেনডেন্ট-এর ব্যবস্থা করে নেব, সে আমার হাতে হাতে সাহায্য করবে, তাহলেই হবে। তাছাড়া কাজলও রইল। ও-ও সাহায্য করবে।

‘আর  তোমার অফিস?’

‘আমার অসুস্থতা দেখিয়ে একটা মেল করে দিচ্ছি। মানলে ভালো, না মানলে আর কী করা যাবে। চাকরি চলে যাবার ভয়ে তো আর আন্টিকে একা ছাড়তে পারি না।’

আদিত্যর কপালে চিন্তার ভাঁজ মুহূর্তেই পরিস্কার হয়ে গেল। শ্রীয়ের এই সিদ্ধান্তে সে-যে খুব কিছু অবাক হয়েছে তা-ও নয়। কারণ সে শ্রী-কে চেনে। জানে, ও এইরকমই একটা পাগলি মেয়ে। কিন্তু অন্বেষার চোখে-মুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে।

পরদিন কাউন্টারে বিল মিটিয়ে ডিসচার্জ পেপার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আদিত্য। সেই ফাঁকে শ্রী, বৃন্দার সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে নিল। বৃন্দার জামাকাপড় গোছানো থেকে শুরু করে তার চুল বেঁধে দেওয়া পর্যন্ত, সমস্ত নিজে হাতে মনের মতো করে সেরে নিল। সমস্ত ফর্মালিটি পূরণের পর ওয়ার্ডবয় আর নার্সের সাহায্যে মা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল তারা।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই অন্বেষাকে ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগছিল। সবার থেকে দূরে ঘরের এক কোণে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসেছিল সে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ঘরে ঢুকে, অন্বেষাকে ওই অবস্থায় দেখে প্রশ্ন করে বসে শ্রী– ‘দিদি তোমার কি মাথাব্যথা করছে নাকি? বাম দেব?’

মাথাটা তুলে জবাব দেয় অন্বেষা, ‘নারে, ঠিক আছি আমি।’ অন্বেষার চোখ দেখে ঘাবড়ে যায় শ্রী। রক্তজবার মতো লাল টকটক করছে চোখদুটো।

‘এমা  তুমি কাঁদছ? কিছু যদি মনে না করো, তোমার মনের কথা আমায় খুলে বলতে পারো। জল দেব, একটু জল খাবে?’

‘না রে, লাগবে না।’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অন্বেষা।

‘জানিস আজ তোকে সব বলতে ইচ্ছে করছে। তুই ভেবে অবাক হচ্ছিস না, মেয়ে হয়ে আমি কীভাবে মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছি। ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না রে। মাকে দেখলেই না আমার ছোটোবেলার খারাপ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে।’

‘খারাপ স্মৃতি’! একটু অবাক হয় শ্রী।

অন্বেষা তার মতো করে বলে চলে ‘মায়ের সাথে আমার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ হল, রমেশ কাকা আর মায়ের সম্পর্ক। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওনার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। বাবার জায়গায় অন্য কেউ, এটা আমি কখনওই মানতে পারিনি। ভাবলেই এখনও গা-টা কেমন যেন রি-রি করে ওঠে। আদি তো ছোটো ছিল, সেই কারণে ও কিছু বুঝত না। আমি বুঝতাম বলে সবসময় আমাকে বকাঝকা করত। সেই কারণেই আমি পুনেতে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলাম। থাকতে চাইনি এই পরিবেশে, বিশ্বাস কর।’

অন্বেষার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা  দেওয়ার চেষ্টা করে শ্রী। দু-চোখ দিয়ে অঝোরে জল নেমে আসে তার। কাঁদতে কাঁদতেই শ্রী-র হাতটা চেপে ধরে সে। ‘বিশ্বাস কর, শ্রী, আমি চেষ্টা করি মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। যখন দুরে থাকি ভাবি মায়ের সাথে আর এরকম ব্যবহার করব না, কিন্তু সামনাসামনি দেখলেই সব ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারি না।’

অন্বেষার কষ্টটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারে শ্রী। তার দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘দিদি তোমার কষ্টটা আমি ফিল করতে পারছি। কিন্তু একটা জিনিস কখনও ভেবে দেখেছ কি? সারাজীবন কাঁহাতক একটা মানুষ একা থাকতে পারে? ওনারও তো একটা লাইফ আছে। উনি তো চাইলে আবার বিয়েও করতে পারতেন, কিন্তু তোমাদের কথা ভেবে সেটা তো করেননি। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাদের মানুষ করেছেন। পরিবর্তে তিনি যদি কোনও কিছু নিয়ে একটু খুশি থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? তোমায় শিক্ষা দিয়েছেন, ভালোভাবে মানুষ করেছেন, কোথাও কোনও খামতি রাখেননি। তাহলে তোমরা মায়ের খুশির জন্য এইটুকু কেন মানতে পারছ না। ভেবে দেখেছ কখনও? যদিও এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। আমি যতদূর জানি বছর দুয়েক হল রমেশকাকা নিরুদ্দেশ।’ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে শ্রী।

শ্রী-র মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অন্বেষা। অবলীলায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘কী বলছিস? এসবের তো আমি কিছুই জানি না। অবশ্য কোনওদিন জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে এসেছি। মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে।’ বলে চুপ করে যায় অন্বেষা।

শ্রী আবার বোঝায়, ‘দিদি, আজ রাতেই তো তোমার ফ্লাইট। এই যে যাবে, আবার কবে আসবে জানি না। যাও না, একটু মায়ের পাশে গিয়ে বসো না। দেখবে তোমারও ভালো লাগবে আর মায়েরও ভালো লাগবে।’

এরপর বেরোনোর আগে পর্যন্ত অন্বেষা মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের অনেক কথা বলেছে। যাওয়ার আগে খুব শিগ্গির আসার ইচ্ছাও প্রকাশ করে গেছে।

দিনদুয়েক পরে আদিত্যও মাকে শ্রীয়ের ভরসায় রেখে ইউএস রওনা দিল। এখন বাড়ির সদস্য বলতে বৃন্দা আর শ্রী। মানসিকভাবে দৃঢ় হলেও বৃন্দা আন্টিকে নিয়ে একটু চিন্তাতেই ছিল শ্রী। কীভাবে সুস্থ হবে? কতদিন লাগবে? আদিত্য থাকতে মনের একরকম জোর ছিল, কিন্তু ও চলে যাওয়াতে এখন একটু নার্ভাস বোধ করছে। নিজের বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পক্ষাঘাতে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। কী যে কষ্টের আর যন্ত্রণার তা সে চাক্ষুস করেছে। তাই সে যে ভাবেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার আন্টিকে আবার আগের মতো হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখতে চায়। তার জন্য যা করতে হয় তাই করতে সে রাজি।

নার্সের জন্যও অপেক্ষা করত না শ্রী। আদিত্যর মাকে পট বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, কোনও কিছুতেই তার কোনও দ্বিধা নেই, ঘেন্না নেই। অবলীলায় হাসতে হাসতে সেইসব কাজ করে সে। টাইমে ওষুধ খাওয়ানো, মাসাজ করা, এক্সারসাইজ করানো সবকিছুর মধ্যেই ভীষণ আন্তরিক ভাব।

বৃন্দা আন্টিকে সারিয়ে তোলার জন্য শ্রীর আপ্রাণ চেষ্টা সত্যিই কাজে দিয়েছিল। মাত্র দিন কুড়ির মাথাতেই হঠাৎই আন্টির বাঁ-হাতের আঙুলগুলো নড়ছে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল শ্রী। আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিল আদিত্য এবং দিদির সঙ্গে। বাড়িতে রুটিন চেক-আপে এসে ডাক্তারও রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছেন। ছোটোপিসি তো হাত উজাড় করে আশীর্বাদ করে গেছে তাকে।

এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। এখন বৃন্দা ডান হাতে ভর দিয়ে নিজেই বসতে পারেন। শ্রী ধরে ধরে দু-এক পা হাঁটায়ও। মাঝে মাঝে একা থাকলে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে তাঁর। স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরেই তাঁকে বিজনেস জয়েন করতে হয়েছিল। যদিও তখন ব্যাবসার সাতপাঁচ বুঝতেন না বৃন্দা। এক অর্থে প্রথম প্রথম পুরো বিজনেসটাই দেখাশোনা করতেন রমেশ।  প্রায় ভরাডুবি অবস্থা ছিল তখন ব্যাবসার৷ আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নিতে সময় লেগেছিল বৃন্দার। নির্ভরতার মাঝে  কখন যে রমেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তিনিও বোধকরি নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে বরাবরই ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন বৃন্দা। তাদের কখন কী লাগবে, কীসে ভালো থাকবে, চিরকাল এটাই তাঁর ভাবনা ছিল। এমনকী যখন ব্যাবসায় রীতিমতো টালমাটাল অবস্থা তখন যেমন জলের দরে কোম্পানি বেচে দিয়ে কর্মীদের পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও কমপ্রোমাইজ করেননি। মেয়েকে পুনেতে সিম্বায়োসিস-এ ভর্তি করানোর জন্য বাড়িটাকে পর্যন্ত বন্ধক রেখেছেন। অথচ এই দুঃসময়ে ছেলে-মেয়ে কেউ নেই তার পাশে। জীবিকার প্রয়োজনে হলেও, আছে তো দূরেই।

মনে মনে হাজারো রকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকে তাঁর। ভাবতে বাধ্য হন তাঁর রক্তের সম্পর্ক কার সাথে– আদিত্য, অন্বেষা নাকি শ্রী-য়ের সাথে। কত আন্তরিক ভাবে তাঁর সমস্ত কাজ করে দেয় শ্রী, একটুও বিরক্ত হয় না। শ্রীয়ের জন্যই তো আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অথচ এই মেয়েকেই একদিন সে কতই না অপমান করেছে।

ভাবনায় বাধ সাধে পরমা। প্রায় রোজই একবার করে ঘুরে যায় সে। একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে– ‘কী রে, শুনলাম দৌড়োচ্ছিস।’ কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় পরমা বরাবরই বৃন্দাকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করে।

‘হ্যাঁ, সবই শ্রী-র দৌলতে। আজও কয়েক পা হাঁটিয়েছে আমাকে।’ হেসে জবাব দেন বৃন্দা।

‘হাসপাতালে তোর অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে। ভেবেছিলাম তুই বোধহয় আর…’ চোখ জলে ভরে আসে পরমার।

পরমাকে দেখে বৃন্দারও চোখ ভিজে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝেছ। এখন ছেলের বিয়ে দেব। নাতি-নাতনির মুখ দেখব। তবেই আমার যাবার পালা।’ হেসে ফেলে পরমাও।

‘যাও তো, আলমারিটা খুলে মায়ের দেওয়া বালাগুলো এনে দাও।’

‘ওটা  তো তুই তোর বউয়ের জন্য রেখেছিলিস?’

‘আরে হ্যাঁ, আগে আনো তো।’ বলে চাবির গোছাটা পরমাদির দিকে বাড়িয়ে দেন বৃন্দা।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বালাজোড়াটা এনে বৃন্দার হাতে দেয় পরমা। ঠিক সেই সময়তেই শ্রী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকে।

‘এদিকে শোন তো। কাছে বস।’ আদর করে শ্রী-কে পাশে বসান বৃন্দা।

‘এখনও তোমার খাবার বানানো হয়নি। তারপর আবার অতগুলো ওষুধ।’ বকবক করে চলে শ্রী।

বকবকানি থামাতে ধমকে দেন বৃন্দা। ‘বস তো তুই। সারাদিন শুধু কাজ। হাতটা বাড়া।’

‘কেন?’

‘আবার প্রশ্ন করে। যা বলছি তাই শোন।’

কথা মতো হাতটা বাড়াতেই বৃন্দা শ্রীয়ের হাতে বালাজোড়া পরিয়ে দেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রী। একটাও কথা বলতে পারে না।

শ্রী-র হাত দুটো তুলে ধরে বৃন্দা বলেন– ‘কী দিদি দারুণ মানিয়েছে না?’

‘খুব মানিয়েছে। আমাদের আদিত্যর জন্য ও-ই যথার্থ।’

শ্রীয়ের চোখ জলে ভিজে আসে। তাকে বুকে টেনে নেন বৃন্দা। আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ওরে এখনই কেঁদে ভাসাচ্ছিস, জানিস তো শাশুড়িরা বউদের খুব জ্বালায়। আমি ট্র্যাডিশনের বাইরে কী করে যাব বল! আমি তো একটু হলেও জ্বালাব, তখনকার জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখ। সামনের সপ্তাহে বাবু এসে তো আমাদের নিয়ে চলে যাবে।

তখন থেকে তো একসাথেই থাকতে হবে বল।’ বলে একসঙ্গে হেসে ওঠে সকলে।

রূপান্তর

আজ থেকে প্রায় আট মাস আগে বিয়ের দিন মৃন্ময়ীদেবীর সঙ্গে ঐশীর প্রথম দেখা। মৃন্ময়ীদেবী শতদ্রুর পিসিমা। থাকেন মেদিনীপুরে। বিয়ের শতব্যস্ততায় তখন ওনার সঙ্গে ঠিকমতো পরিচয় ঘটেনি ঐশীর। আজ আট মাস পর ওনার পদধূলি পড়তে চলেছে এ-বাড়িতে। থাকবেনও প্রায় মাসখানেক। খবরটা পাওয়া মাত্রই বাড়িতে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল।

ওনার দাপুটে স্বভাব সম্পর্কে কমবেশি শ্বশুর, শাশুড়ি, বরের কাছে গল্প শুনেছে সে। যদিও কিয়দংশ তারও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিয়ের সময়তেই পুরোহিতের ভুল মন্ত্রোচ্চারণে একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিলেন, পুরোহিতকে এই মারতে যান তো সেই মারতে যান… তারপর ঐশীর বাবা আর মৃন্ময়ীদেবীর ছোটোভাই রমাকান্তবাবুর মধ্যস্থতায় তিনি খানিক শান্ত হয়েছিলেন।

সেই কোন ছোটোবয়সে তিনি বিধবা হয়ে বাবার ভিটেতে গিয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই ভিটেই যক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। বাবা সংস্কৃতের টোল চালাতেন, ফলে মেয়েও তাতে বেশ চৌকশ। বাবা গত হয়েছেন, ছোটোভাই তো পড়াশোনা চলাকালীন-ই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তারপর আর ওমুখো হননি। কালেভদ্রে বেড়াতে বা প্রয়োজনে গেছেন কখনও সখনও। গ্রামের ওই প্রাসাদোপম বাড়ির বাসিন্দা বলতে বড়োভাই, ভাই বউ, আর তিনি। ভাইয়ের এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে। আর এক ছেলে ছিল বটে, তবে সে আর বেঁচে নেই। বছর সাতেক আগে বিনা নোটিশে দু-দিনের জ্বরে সব শেষ। সেই থেকেই বড়োভাই শয্যাশায়ী। বিঘের পর বিঘে জমিজমা, চাষবাস সবই এখন মৃন্ময়ীদেবীর রক্ষণাবেক্ষণে।

ছুটির দিন। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে ঐশী। রোজই তো সেই ১০টা – ৬টার ডিউটি। সকালে উঠে কাকচান সেরে কোনওরকমে নাকেমুখে গুঁজে ছোটা। একদিন এর অন্যথা হলে বেশ ভালোই লাগে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আজ সোয়া নটা বেজে গেছে তার। তারপর বাড়তি মেদ ঝরাতে ট্রেড মিলে মিনিট কুড়ি হাঁটা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিনেই একটু স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ে আর কী! হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক প্রৌঢ়ার গলা। এ গলা সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায়?… উৎসাহবশত বসার ঘরে আসতেই দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, শতদ্রু সবাই মিলে সেই পিসিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীপ্তিময়ের সেই টানা চোখ। বয়সের কারণে ত্বকে খানিক শিথিল ভাব এলেও, এককালে যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমনি লম্বা দীর্ঘকায়া তেমনি রংও যেন ফেটে পড়ছে। হাঁ করে তাকিয়েছিল ঐশী। হুঁশ ফিরল তাঁর রাশভারী গলার আওয়াজে। ভারী গলায় তিনি কাদের যেন দুষছেন। ‘বেআদব সব ছেলেপুলে। একটু শিক্ষেদীক্ষে নেই গো, বড়োদের সম্মান পর্যন্ত করতে জানেনে সব। সক্বাল না হতে হতে বেহায়াদের মতো হাত ধরাধরি করে… ছি ছি ছি…।’

পিসিশাশুড়ির কথায় হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ঐশী। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন পিসিমা?’

এই নাকি তাঁর নাতবউ! পরনে ট্রাউজার আর ঢলা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। দেখেই মৃন্ময়ীদেবীর চক্ষু চড়কগাছ।

‘থাক থাক। আর প্রণাম করতে হবে না।’ বলেই কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলি বেলা তো কম হল না, এখনও নাওয়া-খাওয়া হয়নি বুঝি?’

‘না আসলে একটু ব্যায়াম করছিলাম। আপনার আওয়াজ শুনে চলে এলাম। এবার…’

‘তা বেশ করেছ, এবার নেয়ে এসো দিকি।’

‘যাচ্ছি পিসিমা। তার আগে আপনার পছন্দের এককাপ চা বানিয়ে আনি। মার কাছ থেকে শিখেছি দেড় চামচ চিনি আর কড়া লিকার, তাইতো?’ বলেই হাসল ঐশী।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই চা বসা, আমি আসছি।’ সুমিত্রাদেবী বউমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সফল হন না। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই গলা ভারী করে ভাজের দিকে তাকিয়ে, ‘ও তুমিও বুঝি এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে শহুরে আদবকায়দা রপ্ত করেছ। ম্লেচ্ছদের মতো নাওয়া-ধোওয়া না করেই রান্নাঘরে ঢুকছ?’

‘না-না দিদি একদমই তা নয়। আমিই চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।

‘আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার আছে পিসিমা, আমি চটপট স্নান সেরে আসছি’, বলেই পিসিমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ঐশী ছুটে পালাল স্নানঘরের দিকে।

‘কী মেয়েরে বাপু! বাপের বাড়ি থেকে কি কোনও রীতিনীতিই শিখে আসেনি? তা রমা তোরাও তো দেখছি আশকারা দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছিস। সংসারের আচার-ব্যবহার কিছু শেখা, নয়তো পরে তোদেরই ভুগতে হবে এই বলে দিচ্ছি।’ চা-আসা পর্যন্ত রমাকান্তবাবু আর শতদ্রুর এইভাবেই ক্লাস নিতে থাকলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবীর বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা দুজনের কারওরই ছিল না। দিদির কথার প্রেক্ষিতে রমাকান্তবাবু শুধু এটুকুই বললেন, ‘তুমি যখন এসেই গেছ, তুমিই ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিও। আচ্ছা দিদি তুমি বোসো, আমি একবার বাজারটা ঘুরে আসছি’, বলে উঠতে যাবেন এমন সময় সুমিত্রাকে দেখে, ‘ওই তো সুমিত্রা এসে গেছে। তুমি চা খাও, আমি এক্ষুনি আসছি’, বলেই রমাকান্তবাবু বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শতদ্রুও পিসিমার ব্যাগ-পত্র গেস্টরুমে রাখার বাহানায় ঘর থেকে সরে পড়ল। অগত্যা সুমিত্রাদেবী-ই বসে রইলেন ননদের উপদেশাবলি শোনার জন্য।

সন্ধেবেলা সকলে একসঙ্গে বসে চা-জলখাবার খেতে খেতে নানান আলোচনা চলছে। গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে। গ্রামের নগেনখুড়ো থেকে শীতের নলেন গুড়– কোনওকিছুই বাদ নেই। খাওয়াদাওয়ার কথা উঠতেই ঐশী হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা মনে আছে চিন্নাস্বামী আর তার পরিবারের কথা, সেই দিল্লি যাওয়ার সময় ট্রেনে?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না! চিন্নাস্বামীর হাতির মতো চেহারার ছেলেটিকে বলে কিনা দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। একদম নাকি খায় না। অথচ ট্রেন ছাড়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত মুখ থেমে থাকেনি তার। বোধহয় দশজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।’ বলেই শ্বশুর, বউ মিলে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকল।

হাসিতে রাশ টানলেন পিসিমা। ‘আহ্ ঐশী একটু আস্তে। ভুলে যেও না এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে কেউ তোমার বন্ধু নয়।’

কেউ কিছু বলার আগেই ঐশী অকপটভাবে বলে বসল, ‘মা-বাবার থেকে বড়ো বন্ধু আবার কেউ হয় নাকি পিসিমা? বাপি ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু আর এখানে বাবা-মা। কী বলো বাবা?’

উত্তর দেওয়া দূরস্থান, ঐশীর কথাতেই বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে শ্বাস ফুলে উঠল রমাকান্তবাবুর। এই বুঝি দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ল বেচারির উপর। হলও তাই।

‘বড়োদের মুখে মুখে কথা বলাটা মোটেই শোভনীয় নয় ঐশী। তাদের সম্মান করতে না পারো, অন্তত অনাদর কোরো না।’ বেচারিকে এমন ধমক দিলেন যে বাড়ির সকলের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

ঐশী জিভ কাটল, ‘ছি ছি পিসিমা, এমন বলবেন না। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি, আসলে দোষটা আমার বাপির। আপনার সঙ্গে যখন আমার বাপির দেখা হবে, আপনি খুব করে শাসন করে দেবেন তো। ওনার অপত্যস্নেহেই আমি বিগড়ে গেছি। ছোটো থেকে উনি-ই আমাকে শিখিয়েছেন, সবকিছু বন্ধুর মতো ওনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে। সেই অভ্যাসটাই থেকে গেছে। এখানেও তাই বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভুলেই যাই যে উনি আমার শ্বশুরমশাই। ওনার সামনে বেশি কথা বলা সাজে না আমার।’ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। ঐশীর মাথা নীচু করার ভঙ্গি দেখে শ্বশুর, শাশুড়ি, শতদ্রু – সকলেই হেসে ফেলল।

‘এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে তোমাদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।’ সকলকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলেন মৃন্ময়ীদেবী।

মৃন্ময়ীদেবী আসার পর থেকে এ-বাড়িতে বেশ একটা অদ্ভুতরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ওনার কাজই যেন ঐশীর দোষত্রুটি খুঁজে বার করা। তারপর তাকে ভৎসনা করা। বাড়ির অন্য সদস্যরা তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালেই মুখ ব্যাজার করে সেই একই সাবধানবাণীর পুনরাবৃত্তি, ‘প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে মেয়েটাকে।’

দিন দশেক এইভাবেই কেটে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়াপুর থেকে খবর এল সুমিত্রাদেবীর ছোটোকাকা মারা গেছেন। দাহ হওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখতে হলে এখুনি রওনা দিতে হবে। তখুনি শতদ্রু বাবা-মাকে নিয়ে গাড়িতে রওনা দিল মায়াপুরের উদ্দেশে। ফিরতে ফিরতে কাল সন্ধে হয়ে যাবে। বাড়িতে এখন ঐশী আর পিসিমা।

ভাই-ভাজ-ভাইপো রওনা দেওয়ার ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ওনার মনে হল সময়টা ভালো যাচ্ছে না, তাই একবার মন্দিরে ঘুরে আসা দরকার। ফিরে আর কিছু খেলেনও না। ঐশী বারবার অনুরোধ করাতে জানালেন, ভোগ খেয়ে ফিরেছেন।

বিকেল থেকেই পিসি বারবার বাথরুম যাওয়া-আসা করছেন। সন্ধ্যার পর সেই আনাগোনার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সঙ্গে যোগ হল বমি। ঠিক করে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই ওনার। সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে চলল। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়াবাড়ি হলে ঐশীর একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে এনে পিসিমাকে নিয়ে সোজা চলে গেল ডাক্তারখানায়।

চেম্বারে বেশ ভিড়। সকলেই অপেক্ষা করছেন তাদের পালা কখন আসবে। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করলে পিসির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না ভেবে, সোজা পিসিমাকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেল ঐশী। পাশ থেকে অপেক্ষারত অন্যান্য পেশেন্টদের বাড়ির লোকের দু-এক কথা কানে গেল বটে, ‘এভাবে হয় না, সিরিয়াল অনুযায়ী দেখাতে হয়। সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। আমরাও তো রোগী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

তাদের দিকে না তাকিয়েই ঐশী জবাব দিল, ‘নিয়ম-ই সিরিয়াস পেশেন্টদের আগে চেক-আপ করা।’ বলে পিসিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সে। ডাক্তারবাবু পেশেন্ট-এর অবস্থা দেখে আর দ্বিমত করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেক-আপ করে প্রয়োজনানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধপত্র লিখে দিলেন।

বাড়িতে ফেরার পর প্রেসক্রিপশন মাফিক তিনটে ট্যাবলেট খাওয়ানোর পরে খানিক স্বস্তি পেলেন মৃন্ময়ীদেবী। ওআরএস জলে গুলে বারেবারে একটু একটু করে পিসিমাকে খাওয়াতে থাকল ঐশী। ঘন্টা দুয়েক পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলে মৃন্ময়ীদেবী ঐশীর দিকে তাকালেন, ‘যদি রাতবিরেতে আবার বাড়াবাড়ি হয় তাহলে…’ মৃন্ময়ীদেবীর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।

‘আমি তো আছি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? কিছু হবে না। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন’, বলে পিসিমার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ঐশী। বউমার আত্মবিশ্বাসে মৃন্ময়ীদেবীর সমস্ত টেনশন দূর হয়ে গেল। শিশুর মতো ঐশীর কোলের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি।

মায়াপুর থেকে ফোন এলে তাদেরও সকলকে ভরসা দিল ঐশী, ‘চিন্তার কিছু নেই, এদিকটা আমি সামলে নেব।’

রাত্রে মৃন্ময়ীদেবী যতবারই চোখ খুলেছেন, বিছানার পাশে ঐশীকে পেয়েছেন। সারারাত জেগে মেয়েটা সেবা করেছে পিসিশাশুড়ির। মাঝে মাঝে চামচে করে নুন-চিনির জল দিয়েছে, খেতে না চাইলে ধমক দিয়েও খাইয়েছে। রাত দেড়টা নাগাদ ওনার শরীরটা বোধকরি আবার গুলিয়ে উঠেছিল, সামলাতে না পেরে বিছানাতেই কাপড়েচোপড়ে বমি করে ফেলেছিলেন তিনি। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন তিনি। পিসিমাকে ইতস্তত বোধ করতে দেখে ঐশী সামান্য হাসে, ‘কেন এত সংকোচ করছেন। ঠিক আছে হয়ে গেছে। বরং উঠে গিয়ে ভালোই হয়েছে, এইবার একটু হালকা বোধ করবেন।’

এক এক করে ওনার কাপড় ছাড়ানো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা পরিষ্কার করা, ফ্রেশ কাপড় পরানো, বিছানার চাদর বদলানো সব হাসিমুখে সেরে ফেলল ঐশী। তারপর ওনার মাথায় এমন ভাবে হাত বুলিয়ে দিল যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল সাতটায় মৃন্ময়ীদেবী ঘুম ভাঙতে দেখলেন ঐশী তার মাথার পাশে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘাড়টা কাত হয়ে গেছে। স্নেহের হাত মাথায় রাখতেই চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে উঠল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো পিসিমা? শরীর কেমন? আর বমি হয়নি তো?’ যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে এক বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে, সেই অস্বস্তিতে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ফেলল ঐশী।

‘ওরে থাম থাম, আমি একদম ঠিক আছি। শেষবার বমি হওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও কষ্ট নেই। দ্যাখ একদম ফিট। আমার কথা ছাড়, তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল, এবার আরাম করগে যা তো। একটু ঘুমিয়ে নে। সারারাত ঠায় মাথার সামনে বসে ছিলি। আমি সব দেখেছি।’

‘আগে স্নান সেরে তোমার জন্য কিছু খাবার বানাই, তারপর না হয়…’

‘না না তোকে কিছু করতে হবে না। আমি সব করে নেব। তুই ঘুমুতে যা দিখি।’

‘কিন্তু’,

ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে মৃন্ময়ীদেবী আদেশ দেবার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু-টিন্তু কিছু নয়, তোকে বলছি না তুই শুতে যা।’

এই এক রাতেই ঐশী আর মৃন্ময়ীদেবীর সম্পর্ক এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। স্নেহপরবশ হয়ে ঐশী যে কখন তার পিসিমার কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছে, তা বোধকরি তিনিও টের পাননি। সত্যিই সময়ই পারে সবকিছু বদলাতে।

আদেশ অমান্য না করে পিসিমার খাটেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ঐশী। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বউমাকে ওভাবে শুতে দেখে একখানা চাদর চাপিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

ঐশীর উঠতে উঠতে মৃন্ময়ীদেবীর ভাত-ডাল-আলু-পোস্ত সমস্ত কিছু কমপ্লিট। দুপুরে দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে দেদার গল্পে মেতেছে।

‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কি? যদি দাও তা হলে বলি। আসলে তুমি আসার পর থেকেই প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘ভণিতা না করে কী বলবি বল দিকি?’

‘না দ্যাখো, আমরা প্রতিমাসে পার্লার ঘুরে আসছি, কত কত টাকা গচ্ছা দিয়ে আসছি, তবুও ত্বকে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। আর তোমার এই বয়সেও এত গ্ল্যামার, রহস্যটা কী বলোতো?’ হাসতে হাসতে বলল ঐশী।

ঐশীর কানটা ধরে বলেন, ‘পিসিশাশুড়ির পিছনে লাগা হচ্ছে অ্যাঁ? ওরে মুখপুড়ি আমাদের সময় ওসব পার্লার ফার্লার ছিল না বটে, কিন্তু মা ঘষে ঘষে সর-বেসন মাখাতেন, বুঝলি।’

‘সত্যি বলছি তোমাকে দেখলে কেউ বলবেই না যে, তুমি বাবার থেকেও বড়ো। কী সুন্দর দেখতে তোমায়।’ মুগ্ধ চোখে তাকায় ঐশী।

‘নে আর আমড়াগাছি করতে হবে না।’ বলে মৃন্ময়ীদেবীও তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন।

মায়াপুর থেকে ফেরার পর দুজনকে পাশাপাশি বসে এভাবে হাসিঠাট্টা করতে দেখে সকলেই হতবাক। পরিবেশ হালকা বুঝে রমাকান্তবাবু তো বলেই বসলেন, ‘একি রে বাবা, কোনও ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়লাম না তো? নয়তো এমন মিরাকেল – ভাবাই যায় না!’

পাশে বসে থাকা বউমার গলা জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘দ্যাখ রমা তুই আর তাচ্ছিল্য করিসনি বাপু। এমনিই আমি মরমে মরে আছি। আমার সত্যিই চিনতে ভুল হয়েছিল রে – এ যে একেবারে খাঁটি হিরে।’ বলেই চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে বলেন, ‘জানিস কাল সারারাত ঠায় মেয়েটা মাথার কাছে বসে সেবা করেছে আমার। খাব না বলেছি বলে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার জন্য ডাক্তারখানায় কম রাগারাগি করেনি, ডাক্তারও বাধ্য হয়েছে আমাকে দেখতে। খুব বুঝেছি তোরা কেন এই পাগলিটাকে এত ভালোবাসিস।’ বলতে বলতে চোখের কোণায় জল ভরে আসে মৃন্ময়ীদেবীর। ‘মেয়েটাকে তো অকথা-কুকথা কম বলিনি, হাসিমুখে সব সয়েছে। আজকালকার দিনে এমন বউ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের রে। সত্যিই ভাগ্যের!’ আবেগবিহ্বল হয়ে চোখ মুছলেন পিসিমা। মৃন্ময়ীর এই রূপান্তরে সকলেই বেশ হতবাক। পাষাণের ভেতরেও যে এত টলটলে জলের এক হ্রদ ছিল তা কে জানত!

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব