রবিবার। সন্ধ্যায় চা-দোকানে জমজমাট আড্ডা। ছুটির দিন হওয়ায় উপস্থিতির সংখ্যাও বেশি। সেই কলেজ লাইফে শুরু, দেড়যুগ পেরিয়ে আজও চলছে। সারাদিনের কাজকর্মের শেষে এখানে মিলিত হওয়াটা এখন অভ্যাস। কর্মসূত্রে যাদের বাইরে থাকতে হয়, সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে তারা মিলিত হয়। সুখ-দুঃখের কথা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, এমনকী বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হয়। আজকের বিতর্কের বিষয় যেমন পুরসভা নির্বাচন। অর্থাৎ শাসকদল-কে সমর্থন করা উচিত কি না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। সমস্ত বিতর্কে জল ঢেলে দিয়েছে কার্তিকের হাসি হাসি মুখে আবির্ভাব।
বন্ধুদের মধ্যে কার্তিক একমাত্র আইবুড়ো। এখনও হাল ছাড়েনি। গত পাঁচ বছরে কত মেয়ে দেখেছে তার হিসেব নেই। এক জনকেও মনে ধরেনি। অথচ তাদের অনেকেই রূপে-গুণে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সব দিক থেকেই ঈর্ষণীয়। আমাদের অনেকেই ওরকম কোনও মহিলাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে রীতিমতো গর্ব অনুভব করতাম। কার্তিক অপছন্দ করছে।
– কেন রে? এর থেকে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
– সে কথা বলিনি তো।
– তবে অপছন্দ কেন?
– ঠিক জানি না। তবে যেমন চাইছি ঠিক তেমনটা নয়।
– কেমন চাইছিস?
– তাও জানি না। মানে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ধর এরকম হবে, যাকে দেখলে মনটা ভরে যাবে। মনে হবে এতদিন তো একেই খুঁজছিলাম। এর কাছেই গচ্ছিত আছে আমার সুখের ঘরের চাবি। সে দেখতে সুন্দরী হতে পারে আবার নাও হতে পারে, কালো হতে পারে আবার ফরসাও হতে পারে, বেঁটে হতে পারে আবার লম্বাও হতে পারে, রোগা হতে পারে আবার মোটাও হতে পারে।
– এই থাম। কার্তিককে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, নেশাটেশা করে এসেছিস নাকি! ভাট বকতে শুরু করলি…
বন্ধুদের মধ্যে কবিরত্ন হিসাবে খ্যাত সপ্তর্ষি হোড় কথার জের টেনে নিয়ে বলেছিল, তোরা থাম। কার্তিকের সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি। ও বনলতা সেন খুঁজছে। ‘আমাদের দু’দণ্ডের শান্তি দিয়েছিল নাটোরের…’
– তো কোথায় সে নাটোর, ঠিকানাটা দে, খুঁজে আনছি। প্রয়োজন হলে পাতাল ফুঁড়ে পৃথিবীর ওপ্রান্ত থেকেও তাকে তুলে আনব। কার্তিকের জন্য আমরা সব করতে পারি।
কার্তিক গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। সব বিষয়ে ঠাট্টা তার অপছন্দ। ইদানীং একটা জিনিস সে লক্ষ্য করছে, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা বন্ধুদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সেদিন থেকেই এ বিষয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলা সে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মনের মানুষ খোঁজার উৎসাহে কোনওরকম ছেদ পড়েনি। প্রতি রবিবারই নিয়ম করে কোথাও না কোথাও মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।
আজই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল। কার্তিকের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ভ্যানিস হয়ে গেল নির্বাচন। বদলে গেল আলোচনার বিষয়। কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে একটাই প্রসঙ্গ
– মেয়ে পছন্দ হল?
– মেয়ে দেখতে কেমন রে?
– পড়াশোনা?
– বাড়ি কোথায়?
– হাইট?
– ছবি এনেছিস?
একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের মুখে পড়েও কার্তিক আজ বিব্রত হল না। বরং মুখের হাসিটি আরও চওড়া হল। বসতে বসতে বলল, বউদি এককাপ চা। তারপর ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। না না বিড়ি নয়, সিগারেটই। দেখতে একটুও ভুল হচ্ছে না আমাদের। মৌজ করে একটা টান দিয়ে বলল, তোদেরকে কিছু বলাও বিপদ। সব বিষয়ে ইয়ার্কি মারাটা তোদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার না বলেও থাকা যায় না। হ্যাঁ, মেয়ে পছন্দ হয়েছে। অনেকটা সেই মেয়ের মতো। শান্তনু জানে, সেই যে কাকদ্বীপ পাঁচ মাইল…
একটু থমকাই। মুহূর্তমাত্র। মনে পড়ে যায়, জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটা। কার্তিকের জীবনে তো বটেই।
প্রায় দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। তিন বন্ধু মিলে বকখালি বেড়াতে গিয়েছি। তিন জনই কাঠ বেকার। একমাত্র টিউশনি ভরসা। সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণের জন্য তাই কাছেপিঠে ভ্রমণের পরিকল্পনা। তাও মাত্র দু’দিনের টুর। পরের দিন হোটেল ভাড়া বাঁচানোর জন্য বারোটার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়েছি। ফুটপাথের হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে একটায় কলকাতাগামী বাসে।
পাশাপাশি তিনটে সিটে আমরা তিনজন। বাস ছাড়তেই জুতো-মোজা খুলে আরাম করে বসলাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছি। শান্তনু একটু বেশি কথা বলে, মূলত সেই বকছে। মাঝে মধ্যে আমি। কার্তিক একেবারে চুপচাপ। হঠাৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম। অথচ বাস চলছে স্পিডে। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে।
– কী ব্যাপার কার্তিক, এত ঘামছিস?
– ও কিছু না, এমনিই।
– জানলায় বসবি?
– না, ঠিক আছে।
বাস ছুটে চলে। আমরা ফিরে আসি পুরোনো প্রসঙ্গে। বকবক করি। কিছুক্ষণ পর আবার তাকাই কার্তিকের দিকে। চোখ মুখ লাল। দর দর করে ঘামছে। কেমন একটা অস্বাভাবিক দৃষ্টি।
– শরীর খারাপ লাগছে?
– না। কার্তিক মাথা নাড়ে।
– চোখ মুখ লাল কেন?
– গরমে বোধহয়।
– দেখিস, লুকাসনে। শরীর খারাপ লাগলে বলিস। সঙ্গে ওষুধপত্র আছে।
বাস ততক্ষণে কাকদ্বীপ পার হয়েছে। ভালোই চলছে। এভাবে চললে ঠিক সময়েই ধর্মতলা পৌঁছে যাব। পরবর্তী স্টপেজ পাঁচ মাইল। খুব ছোটো জায়গা। হাতে গোনা গুটি কয় দোকান নিয়ে গ্রাম্য বাজার। বাস এসে স্টপেজে থামতেই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় কার্তিক। এক ছুটে বাসের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, আর পারছি না। জোর চেপেছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নেমে যায়, ব্যাগপত্র ফেলে। হাতে কেবল জলের বোতলটা। তড়িঘড়ি আমরাও এগিয়ে যাই মালপত্র নিয়ে। এক হাতে লাগেজ, অন্যহাতে জুতো। কিন্তু নামতে পারি না, তার আগেই বাস ছেড়ে দেয়। কনডাক্টরকে বলি বাস থামাতে। সে রাজি হয় না। এটা লোকাল বাস নয়। তারপর সরকারি। নিয়মের বাইরে সে বেরোবে না। অনেক কাকুতিমিনতির পর এবং অন্যান্য প্যাসেঞ্জারের আবেদনে যদিও বা বাস থামে, ততক্ষণে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি।
হাঁটু অবধি গোটানো প্যান্ট, হাতে জুতো এবং লাগেজ– এমন কিম্ভুত অবস্থায় নামতে দেখে লোকজন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অন্যগ্রহের জীব দেখছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে দু’একজন এগিয়ে আসে। জানতে চায়। সমস্ত শোনার পর তারাই একটা ভ্যান-রিকশার ব্যবস্থা করে দেয়।
মিনিট কুড়ি-পঁচিশের ব্যবধানে ‘পাঁচমাইল’ স্টপেজ। স্টপেজ লাগোয়া একটা পান গুমটিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করি, দাদা এখানে ল্যাট্রিন কোথায়?
– বলতে পারব না। আমার কাছে নেই।
– না না, আমরা কিছু কিনতে আসিনি। জানতে চাইছি বাজারে পায়খানা ঘর কোথায়?
দোকানি লোকটা আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, কী ব্যাপার বলেন তো? একটু আগে একজন পায়খানা খুঁজতে এসেছিল, এখন আপনারা…
– আমরা তাকেই খুঁজতে এসেছি।
– তা এখেনে কেন, দ্যাখেন না মাঠে গিয়ে। চারপাশে অনেক মাঠ আছে। তাকেও মাঠে পাঠিয়েছি।
বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে ছোট্ট বাজার। বাজার পেরোলেই মাঠ। যে-কোনও দিকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই আদিগন্ত চাষের জমি। আন্দাজে কোন দিকে খুঁজতে যাব? বরং এখানেই অপেক্ষা করি। যে দিকেই যাক কাজকম্ম মিটিয়ে এখানেই ফিরে আসবে। বাজার চত্বরেই ঘোরাফেরা করি আমরা।
বেশ অনেকক্ষণ বাদে বাবু এলেন হাসতে হাসতে। চোখ মুখ স্বাভাবিক।
– হয়েছে? জিজ্ঞাসা করলাম।
কার্তিক ঘাড় নাড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে… বাপরে, কী জায়গা! জীবনে ভুলব না। উফ্!
– কেন কী হয়েছে?
– সে অনেক কথা, কার্তিক কোনওরকম রাখঢাক না করেই বলে, বাস থেকে নেমে প্রথমেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখতেই পাচ্ছিস এটা একটা বাজার। এমন জায়গায় বারোয়ারি ল্যাট্রিন থাকা স্বাভাবিক। দু’জন লোক ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা এখানে পায়খানাটা কোথায়? আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য লোক দুটো মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, বাইরের মানুষ?
– আজ্ঞে হ্যাঁ।
– কোথায় বাড়ি?
– কোলকাতা।
– এখানে কার বাড়িতে আসা হয়েছে?
– আজ্ঞে, কারও নয়।
– তবে বুঝি কাজে এসেছেন?
– তাও না।
– তবে?
– পায়খানা করতে।
– কোলকাতা থেকে পাঁচমাইল এসেছেন হাগতে! ঠাট্টা করছেন আমার সাথে। জানেন আমি কোন গাঁয়ের মানুষ? লোকটা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। এই মারে তো সেই মারে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি সামলে নিই, সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে অনুরোধ করি, যদি একটু সাহায্য করেন।
লোকটা শান্ত হয়। বিশ্বাস করে আমার কথা। বলে, দ্যাখেন আমরা ভীন গাঁয়ের মানুষ। কইখালির বাসিন্দা। এখান থেকে তিন মাইল। পঞ্চাত পোধান রফিকুল মোল্লার নাম শুনেচেন তো? আমরা সেই রফিকুল মোল্লার গাঁয়ের লোক। পাঁচমাইল এসেছি বাজার করতে। ছোটো ভাইয়ের সম্বন্ধি এয়েছে তো! নতুন কুটুম, বুঝতেই পারছেন… ডালভাত তো দেয়া যায় না। তাই কেজি খানিক পাখির মাংস নিলাম। এ দিগরের খবর আমরা বিশেষ জানিনে।
বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। প্রায় প্যান্টে হব হব। আর উনি লাগলেন মহাভারত শোনাতে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে অথচ কিছু বলতে পারছি না। লোকটার কথা শেষ হতেই বললাম, ধন্যবাদ। মানে কেটে পড়লাম। ওই যে পান-বিড়ির গুমটিটা দেখছিস না, ওখানে গেলাম। ভেতরে একটা লোক বসে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছিল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে সেও এক দৃষ্টিতে তাকাল। ভ্রান্তি মেটাতে বললাম, আমি বাইরের মানুষ। জোর চাপায় বাস থেকে নেমে পড়েছি। বাজারে কোথাও পায়খানা নেই?
– না নেই। কী করে থাকবে শুনি। বাজার কমিটি তো করতে চেয়েছিল, পঞ্চাত পোধান বাধা দিল। আলাদা পার্টি বলে এমন কাঠি নাড়ল যে…
– আপনারা কোথায় করেন হঠাৎ চাপলে?
– রাজনীতির মুখে।
– প্লিজ দাদা, সত্যি বলছি জোর চেপেছে…
– জোর চেপেছে তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন, জান না, চারদিকে এত মাঠ চোখে দেখছেন না?
পরামর্শটা মনে ধরে গেল। লোকালয় থেকে বেরোতে পারলেই ফাঁকা মতো একটা জায়গা দেখে বসে পড়া যাবে। আগে তো হালকা হই, পরের কথা পরে। হনহন করে হাঁটতে শুরু করি। বাজার ছাড়িয়ে মিনিট দু’য়েক হাঁটতেই আদিগন্ত মাঠ। নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় রাস্তা থেকে নেমে পড়ি। আলপথ ধরে কিছুদূর এগোতেই দু’পাশে হাঁটু সমান উঁচু ধানের খেত। অনেকটা দূরের একটা জমিতে কিছু লোক কাজ করছিল। অনেকটাই দূরে, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পটাপট প্যান্টের হুক, জিপ সব খুলে ফেললাম। কোমর থেকে নামিয়ে সবে বসতে যাব, দূরের ওই জমি থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, ও দাদা কী করছেন? কী করছেন?
বলতে বলতে লোকটা ছুটে আসে, পেছন পেছন আরও একজন।
তাড়াতাড়ি প্যান্টটা কোমরের উপর তুলে নিই। মারমুখী ভঙ্গিতে লোকদুটোকে ছুটে আসতে দেখে তখন আমার অবস্থা আরও খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না। পালাতে গেলে যদি চোর ডাকাত কিছু ভেবে বসে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়লে গণপিটুনি অনিবার্য। তাছাড়া তল পেটের যা অবস্থা, দৌড়ানোর মতো পরিস্থিতিও ছিল না। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকাটাই ঠিক মনে হল।
লোকদুটি ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, জানেন না এটা নিম্মল গ্রাম। সরকার নিম্মল গ্রাম ঘোষণা করেছে। এখানে বাহ্য ফিরতে কেউ আর মাঠে আসে না।
– তবে যে এত ময়লা দেখছি। চারপাশেই তো…
– সেইজন্যই তো আমাদের সন্দেহ। কারা এসব করে! অনেকদিন ধরেই তক্বে তক্বে আছি, আজ হাতে নাতে ধরেছি। এসব তাহলে আপনারই কাজ?
– কী বলছেন! আমি কী করে হব! আমি তো বাইরের মানুষ।
পুরো ঘটনাটা আরও একবার রিপিট করতে হল। লোক দুটো বিশ্বাস করল। একটু বোধহয় মায়াও হল আমার উপর। বলল, বাইরের লোক বলে ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে আর এমুখো হবেন না।
– হব না, কথা দিচ্ছি। কিন্তু এখন কোথায় যাব? আমার অবস্থা তো…
– গ্রামে যান। কারও বাড়িতে ঢুকে বলুন, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। এখানকার মানুষ ভালো। আপনাদের শহরের মতো না।
গ্রামে ঢোকার পথ বলে দেয় লোকটি। তলপেটে অসহ্য চাপ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। তা মিনিট পাঁচেকের পথ তো হবেই।
– এক মিনিট, কার্তিককে থামিয়ে দিই, বাস আসছে না?
– হ্যাঁ, বাসই তো। শান্তনু বলে।
আমরা তৈরি হই। বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। কোলকাতা পৌঁছোতে মাঝরাত হয়ে যাবে। সে হোক, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গা থেকে আগে পালাই। বাস না পেলে সারারাত রাস্তায় বসে কাটাতে হবে।
দেখতে দেখতে বাসটা সামনে এসে দাঁড়ায়। অল্প কিছু মানুষ নামে। ওঠার আমরা তিনজনই। বিশেষ ভিড় ছিল না। বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। কার্তিককে বললাম তারপর?
– গ্রামে তো ঢুকলাম। প্রথম দু-তিনটে বাড়ি ছেড়ে একটা পছন্দ হল। পছন্দ বলতে, প্রথম বাড়িগুলি বড়ো বড়ো, অবস্থাপন্ন পরিবার। ঢুকতে সাহস হল না। তুলনামূলক একটা একটু কমা। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনি, টালির চাল, পাশাপাশি তিনটে ঘর, অনেকটা স্কুল বাড়ির মতো। সামনে টানা বারান্দা। বারান্দার এক কোণে দুটি অল্প বয়সি বউ বসে গল্প করছিল। বাড়িতে অচেনা মানুষ ঢুকতে দেখে গল্প থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের কাছেই আর্জি জানালাম, আমি বাইরের মানুষ। এখানে কেউ চেনাজানা নেই। হঠাৎ খুব পায়খানা পেয়েছে। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। আপনাদের বাড়িতে যদি একটু ব্যবস্থা হয়…
বউ দুটি বিস্মিত। যেন এমন আজব আবদার তারা জীবনে শোনেনি। আমার মত উজবুকও এই প্রথম দেখছে, এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।
– পায়খানাটা কোনদিকে বলবেন?
আমার তখন এখন-তখন অবস্থা। এতটা হাঁটাহাটির পর শরীরের উপর আর কন্ট্রোল নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই কাঙ্খিত জায়গাটা।
উত্তরে তাদের একজন গলা ছেড়ে ডাক দিল, ওমা মা, দ্যাখেন তো কী বলছে। একটা অচেনা লোক…
– কে! বাড়ির পেছন থেকে উত্তর এল বাজখাই গলায়। মা অর্থাৎ শাশুড়ি, ভারিক্বি চেহারার রাশভারি একজন মহিলা, মুখের কথা শেষ করেই সামনে এসে দাঁড়াল।
– কাকে চাই?
– আজ্ঞে, একটু ঢোক গিলে বললাম, একটু পায়খানায় যেতাম।
– তা এখেনে কেন? এপাড়ায় কী আর কোনও বাড়ি পায়খানা নেই!
– আমি তো বাইরের লোক, এখানকার কাউকে চিনি না।
– তাই বুঝি কচি বউ দুটোকে দেখে এ বাড়িতেই ঢুকতে ইচ্ছা হল! তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না বাছা।
– বিশ্বাস করুন, মা কালীর দিব্যি…
আমার অবস্থা তখন কেঁদে ফেলার মতো। পারলে মহিলার পায়ে পড়ি। বিধি বাম, সেক্ষেত্রে নীচু হতে হবে। আর নীচু হলেই… মা গো! মাঝেমধ্যে পেটের মধ্যে এমন মোচড় মারছিল না… বউটির বোধহয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মায়া হয়েছিল। এতক্ষণে সে মুখ খুলল, মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ না, সত্যি কথাই বলছে…
– তুমি থামো তো বাছা, আর ওকালতি কোরো না।
বউটি থতোমতো খেয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রমহিলা আবার গর্জে উঠলেন, পরপুরুষের কষ্ট দেখে দরদ উথলে উঠছে না? আজ আসুক বাড়িতে… আর তুমিও বলিহারি! এখনও দাঁড়িয়ে আছো! বললাম না এখানে ওসব হবে না। পায়খানায় তালা মারা আছে। বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। শাশুড়ি বউমার ঝগড়া শোনার মতো অবস্থা তখন নেই। কিন্তু তালা মারা শুনে আপনা থেকে পা আটকে গেল। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললাম, তালা মারা কেন?
– এখানে সব বাড়িতেই তালা মারা থাকে। সরকার বানিয়ে দিয়েছে তো।
– সে তো ব্যবহার করার জন্যে।
– কে বলেছে আমরা ব্যবহার করি না? বাড়ির মেয়েরা যায়, রাতবেরাতে আমিও যাই। মাঠে কেবল পুরুষ মানুষগুলো…
– ছিঃ ছিঃ মাঠে যায়! আপনাদের গ্রাম না নির্মল গ্রাম?
– অতশত জানি না, সবাই যায়। আমরাও যাই। তা তুমি এত কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি কি সরকারের লোক?
– না, আমি কার্তিক সরকার।
– ঠিক সন্দেহ করেছি। তা বাবা ভেব না আমি মিথ্যা বলছি। পায়খানা আমাদের আছে, অন্যদের মতো ভাড়ার ঘর বানাইনি। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখে যাও।
– বেশ তো তালাটা খুলে দিন।
– চাবি তো নেই।
– হারিয়ে গেছে?
– না ছেলের কাছে। ছেলে বাজারে। মাছের দোকানে। ডেকে আনব?
– থাক, দরকার নেই।
আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অত সময় অপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। ভেতর-ভর্তি আবর্জনা একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। যে-কোনও মুহূর্তে বাঁধ ভাঙবে। দুপুরে সস্তার হোটেলে খাওয়া উচিত হয়নি। যা হোক, মহিলার খপ্পর থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে ঢুকি।
রাস্তামুখো বাড়ি। বারান্দায় বসে একজন বয়স্কা, অন্যজন কিশোরী। মেয়েটি বৃদ্ধার পিঠের ঘামাচি মারছিল। দুজনের মুখই রাস্তার দিকে। আমাকে ঢুকতে দেখে বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, কে বাবা?
– আমাকে চিনবেন না, বাইরের মানুষ।
এক নিশ্বাসে এখানে আসার কারণ জানিয়ে আসল কথাটা পেড়ে ফেললাম।
– এসেছ ঠিক করেছ। কথায় বলে হাগা চাপলে বাঘের ভয় থাকে না। আমাদের মানুষটাও ওই রকম ছিল, এক মিনিটও দেরি করতে পারত না। বছর ভোর আমাশায় ভুগত তো…
– আঃ ঠাকমা! আবার তুমি শুরু করলে! মানুষটা বলে কষ্ট পাচ্ছে।
মেয়েটার দিকে চোখ যায়। শ্যামলা রং, দোহারা গড়ন, চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো। মনে হল মায়াদয়া আছে। করুণ চোখে তাকালাম তার দিকে। গলায় আকুতি এনে বললাম যদি একটু সাহায্য করেন, সত্যিই আর পারছি না।
– তা বাবা, নাতনির হয়ে বৃদ্ধাই উত্তর দিলেন। সাহায্য যে করব সে উপায় নেই। পায়খানায় তালা মারা। চাবি কোথায় থাকে আমি জানি নে।
– আমি জানি, এনে দেব? মেয়েটি বলে উঠল।
– তা দে না, জানিস যখন বসে আছিস কেন! দেখছিস মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। আহারে! তোর দাদুও…
মেয়েটি ততক্ষণে চাবি এনে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিই। সেইসঙ্গে বেগটাও বেড়ে যায়। যাকে বলে মরণকামড়। সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাই পায়খানার দিকে।
– গামছা নিলেন না? মেয়েটি পেছন থেকে চিৎকার করে।
ধুত্তোর গামছা। আমার হাতে তখন সুখের ঘরের চাবি। স্বর্গের চাবি বললেও বেশি বলা হবে না। পোশাক বদলাবার মতো ধৈর্য বা পরিস্থিতি কোনওটাই আমার তখন নেই। জলের বোতল হাতেই ছিল। জামাপ্যান্ট পরা অবস্থাতেই ভিতরে ঢুকে গেলাম।
– শান্তি?
– হ্যাঁ, শান্তি।
– তারপর?
– তারপর আর কী! হালকা হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় মিটমিট হাসি। মুখের দিকে তাকাতে একটু লজ্জা করছিল ঠিকই। কী আর করা যাবে। অন্যদিকে তাকিয়ে চাবিটা মেয়েটির হাতে দিলাম।
– কিছু বললি না?
– কী বলব! ধন্যবাদ জানালাম। মেয়েটা আড়চোখে একবার ওর ঠাকমাকে দেখে নিয়ে নীচু গলায় বলল, আবার আসবেন।
– হাগতে না প্রেম করতে?
– কে জানে!
– যাবি তো?
– পাগল!
ফিরে আসার পর যখন বেড়ানোর প্রসঙ্গ উঠেছে, অবধারিত ভাবেই কার্তিকের নাম এসে পড়েছে। কার্তিকের সঙ্গে সঙ্গে সে মেয়েটিও, যে তাকে পায়খানার, থুড়ি সুখের ঘরের চাবি এনে দিয়েছিল। কার্তিককেও দেখেছি মেয়েটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে। আমরা ওর পেছনে লেগেছি। কার্তিক কখনও খুশি হয়েছে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে মুখ, আবার কখনও রেগে গেছে। বলেছে, সবকিছু নিয়ে আড্ডা ঠিক না।
তারপর যা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই ফিকে হয়ে আসে। বয়স বাড়ে, সঙ্গে দায়িত্বও। এক সময় ভুলে যাই আমরা। কার্তিক বাদে এখন সকলে সংসারি। সংসারের চাপে বদলে গেছে জীবনের রুটিন। কেবল সন্ধ্যার আড্ডাটাই এখনও অপরিবর্তিত।
তবে আমরা ভুললেও, কার্তিক যে ভোলেনি, মনের গভীরে বাঁধিয়ে রেখেছে সযত্নে, এতদিনে সেটা পরিষ্কার হল। মেয়ে দেখার নামে এতবছর ধরে সে তার কাছেই ফিরতে চেয়েছে, এভাবেই মেটাতে চেয়েছে ঋণ, সেটা আমরা কীভাবে বুঝব!
এখন শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয় ততই মঙ্গল।