দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

নাটক

সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

মাতৃরূপেণ

ভোরে উঠে পড়ার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি সুজাতা। ওঠার তেমন দরকার পড়ে না, তবুও। অনির্বাণ অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। অফিসের রান্না করে দেবার তাড়া নেই আর। রুমকি যতদিন এ বাড়িতে ছিল, ওকে ঘিরে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ছিল। স্কুল-কলেজের পাট চুকলে, রুমকির নাচ, নাচের দলের দেশ-বিদেশ সফর, সেইসব সফরের প্রস্তুতিপর্ব– সব মিলিয়ে বাড়িটা গমগম করত। ছাত্রী, ছাত্রীর মায়েরা, অনুষ্ঠানের আয়োজক, মিডিয়ার লোকজন আসার বিরাম ছিল না। সেসব অবশ্য এখনও আছে। তবে দুটো বাড়ির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে জনস্রোত। শুধু রুমকিকে ভোরে উঠে তুলে দেওয়ার কাজটা আর নেই। সেদিনও পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর মস্ত দায়িত্ব। ভোরে উঠে এক-দেড় ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করত রুমকি। ভোরের এই সময়টা যে-কোনও সাধনার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ– একথা তো তিনিই ছোটোবেলা থেকেই রুমকির কানে ঢুকিয়ে এসেছেন।

রুমকি এখন এখানে থাকে না। তাই ওকে ঘুম থেকে তুলে নাচে জুতে দেবার কাজও নেই তাঁর। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাই। অবসর নেওয়ার পর প্রথম ক’দিন খুব উৎসাহে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছিলেন অনির্বাণ। তাঁকেও টেনে নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে ছাদের টেরেসে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, কাগজ পড়া তারপর দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট বানানো। মর্নিং ওয়াকারদের একটা দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘সাতসকাল’ নামে লেটারহেড ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, রক্তদান– এমন দু-চারটে কর্মকাণ্ডও হয়েছিল তাঁদের গোষ্ঠীর। তারপর তাঁরা কীভাবে যেন খসে পড়লেন সেই গোষ্ঠী থেকে।

তারপরও অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অবসরজীবনে সুজাতাকে জড়িয়ে নিতে। সারাজীবন সময় দিতে পারেননি। সুজাতার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ওভারটাইম করে গিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে নাচ চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। দামি দামি কস্টিউম, মিডিয়ার সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ, ছাত্রী ধরে রাখার জন্যে বছরে শহরের নামি-দামি হলে দু-তিনটে প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ– আরও কত কী। পাশাপাশি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। তারপর ইউনিভার্সিটি। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ চাকুরিজীবী অনির্বাণকে সেসবের খরচ জুগিয়ে যেতে হয়েছে। রুমকি কীভাবে বড়ো হল, সুজাতা কখন যে যৌবন পেরিয়ে গেলেন– দেখা হয়নি অনির্বাণের।

এতদিন, এতগুলো বছর পরে সুজাতার সঙ্গে আবার সেতু গড়ে তুলতে গিয়ে দেখলেন, কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। সুজাতার সমস্ত জীবনের একটিই অভিমুখ– মেয়ে রুমকি, রুমকির নাচ। তাঁর সব ভাবনা, স্বপ্ন, গল্পের বিষয়, নাচকে ঘিরে রুমকির কেরিয়ার। মেয়েকে প্রাণাধিক ভালোবাসলেও অনির্বাণ সুজাতার মতো মেয়েসর্বস্ব হয়ে উঠতে পারেননি। আর পাঁচটা বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহ। তিনি নিয়মিত খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েন, মেয়ের নাচ ছাড়াও নাটক, সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, বিভিন্ন খবরের চ্যানেলগুলো তাঁর দেখা চাই, ছোটো হলেও তাঁর নিজস্ব একটি বন্ধুবৃত্ত আছে। এসব কিছু নিয়ে তিনি সুজাতাকে নতুন করে পেতে চেয়েছিলেন, পাননি। এখন তিনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, নিজস্ব ছন্দে কেটে যায় সকাল থেকে সন্ধে, নিজের ছোটো ছোটো ভালো লাগাগুলোর সঙ্গে। বেলায় একবার নীচেরতলায় মেয়ের নাচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন মেয়ে নাচে মগ্ন, সুজাতা চায়ের কাপ হাতে জগৎ-ভুলে মেয়ের নৃত্যরতা রূপ দেখছে। কিংবা, মা-মেয়ে মিলে ভবিষ্যৎ কোনও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। এক ঝলক দেখে সরে আসেন তিনি। মেয়ে অবশ্য যাওয়া-আসার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা না করে যায় না।

আসলে রুমকি আর সুনন্দন যে-ফ্ল্যাটটায় থাকে, সেটায় জায়গা বড়ো কম। তাই প্রতিদিনই দশটার মধ্যে ও চলে আসে এখানে। সুজাতার তিল তিল পরিশ্রম, স্বপ্ন ও সাধে গড়ে উঠেছে যে বাড়ি– ‘ভঙ্গিমা’। পুরো বাড়িটা যেন নাচের একটি মুদ্রার মতো দাঁড়িয়ে। একতলার গোটাটাই প্রায় হলঘর। রুমকির প্র্যাকটিস, ক্লাস, অনুষ্ঠানের মহড়া সবই চলে সেখানে। ছোটোখাটো অনুষ্ঠানও হতে পারে হেসে খেলে। হয়ও। তার জন্যে লাগোয়া একটা ড্রেসিং রুমও আছে। এছাড়া দুটো টয়লেট, একটা শুধু রুমকির, অন্যটি ছাত্রীদের। আর আছে একটা ছোট্ট কিচেন। প্র্যাকটিসের ফাঁকে ফাঁকে কফি বা হেলথ ড্রিংক, স্যান্ডউইচ– টুকিটাকি সবই জোগানো যায় প্রয়োজনমতো। রুমকি যতক্ষণ থাকে, সুজাতা পারতপক্ষে দোতলায় আসতে চান না। তাঁর নিজের হাতে লাগানো বীজ কীভাবে আস্তে আস্তে মহিরুহ হয়ে উঠছে তার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উপভোগ করতে চান তারিয়ে তারিয়ে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে সুনন্দন তুলে নিয়ে যায় রুমকিকে। কখনও-কখনও ওর নাইট-শিফট থাকলে রুমকি তাঁর কাছেই থেকে যায়। দুই সখীর মতো গল্পে গল্পে কেটে যায় রাত, বলা বাহুল্য, যে গল্পের পুরোটাই নাচ নিয়ে। আরও, আরও ভালো হতে হবে, আরও আয়ত্ত করতে হবে মুদ্রাগুলি– একথা আজও পাখিপড়ার মতো করে তিনি বুঝিয়ে চলেন মেয়েকে।

রুমকি যখন প্রথম তাঁকে জানাল, সে সুনন্দনের প্রেমে পড়েছে, মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন সুজাতা। বিয়ে, সংসার, সন্তানপালন– এসব সাধারণ মেয়েদের জন্যে। এসবে জড়িয়ে পড়লে ওর এই ঝকঝকে কেরিয়ার একদম বরবাদ হয়ে যাবে। রুমকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হেঁশেল আর বাচ্চা সামলাচ্ছে– এ দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় পান সুজাতা। সুনন্দন আইটি-তে বড়ো চাকরি করে, লাখ দেড়েক মাইনে, প্রায়ই বিদেশ যেতে হয়– এসব শুনেও মন গলেনি তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুমকির জেদ আর অনির্বাণের প্রবল আগ্রহের কাছে মাথা নোয়াতে হল তাঁকে। তবে, ঠাকুর বাঁচিয়েছেন, সুনন্দন আর-পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো ঘরকুনো নয়। বউকে জড়িয়ে বসে থাকার সময় নেই তার। সবসময়ই ছুটছে। ভালোই হয়েছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি টাটানগরে থাকে। তাই ওসব ঝামেলাও নেই। সেন্টার থেকে ডেলি রোজের আয়া রেখে নিয়েছে। সে-ই সংসার সামলায়। কামাইয়ের ভয় নেই। রুমকি পুরোপুরি নাচে মন দিতে পারছে। আর কী চান সুজাতা।

তবু কেন যে এতটা খালি-খালি লাগে। একটা শূন্যতা, হাহাকার সোফার তলায় লুকোনো বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে থেকে থেকে। কী যেন একটা নেই। সুনন্দন যখন রুমকিকে নিতে আসে, গাড়ি থেকে নামে না, ঘনঘন হর্ন বাজায়। ওই শব্দটা বুকে এসে ধাক্বা মারে যেন। মনে হয়, রুমকির ওপর সব অধিকার সুনন্দনেরই, তিনি কেউ নন। যেন পরের ধন চুরি করে এনেছেন, সে এসেছে নিজের জিনিস ফেরত নিতে। রুমকিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়, মাকে বিদায় জানাতেও মনে থাকে না কোনও-কোনও দিন। কেমন যেন সুর কেটে যায় সারাদিনের।

পরের দিন আবার সব তিক্ততা মুছে নতুন করে শুরু করতে চান সুজাতা। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিদিন একটা নতুন দিন। কিন্তু রুমকি না আসা পর্যন্ত কেমন যেন একটা ছটফটানি তাঁর মধ্যে, খালি খালি লাগে সমস্ত সকাল।

চা শেষ করে আজ নীচের ঘরে এসে ফার্নিচারের ধুলো ঝাড়ছিলেন সুজাতা। ধুলো থাকার কথা নয়, তাঁর বহু বছরের কাজের লোক কমলা অনেক যত্ন নিয়েই ঘরদোর ঝাড়ামোছা করে। বিশেষত দিদির এই নাচের ঘরটিকে মন্দিরের মতো ধুয়েমুছে রাখার নির্দেশ আছে তার ওপর। তবু রোজ সকালে কায়াহীন ধুলোই ঝাড়েন সুজাতা, ঝাড়তে ঝাড়তে তাঁর মনও পরিষ্কার হয়ে আসে।

আজ ঝাড়তে ঝাড়তে, কী মনে হল, আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ত্বকের সে মসৃণতা আর নেই, চুলের রুপোর ঢল লুকোতে নিয়মিত কালার করতে হয়, তবু শরীরের মাপজোকে তিনি এখনও তরুণী। তাঁর স্তন, কোমর এখনও টানটান। ঘাড়ের ভঙ্গিমায় উদ্ধত ঘোটকীর আভাস আসে। পেটের ওপর আনমনে হাত রাখেন সুজাতা। রুমকির পর কাউকে আনতে পারেননি সাহস করে। অবস্থা তেমন ছিল না। আজকাল বড্ড একা লাগে। রুমকি যখন তাঁর গর্ভে ছিল, সেই অপেক্ষায় উদ্বেল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নতুন কাউকে পৃথিবীতে আনার আনন্দ… বুক দুটো টনটন করে ওঠে, দুধের ভারে যেমন হতো সে সময়।

হঠাৎ আয়নায় রুমকির নির্মেদ, সুঠাম শরীরটা ভেসে ওঠে। কখন এল! কই, গাড়ির শব্দ পাননি তো? এত ডুবে ছিলেন নাকি নিজের ভাবনায়! লজ্জা পেয়ে যান সুজাতা। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ান মেয়ের মুখোমুখি। লাল টপ, ব্লু জিন্স আর অক্সিডাইজড দুলে ওকে কী দারুণ দেখাচ্ছে। ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক আর চোখে ঘন কালো কাজল। ব্যাস, আর কোনও মেক-আপ নেই। কিন্তু ওর মুখ তো অন্যদিনের মতো ঝলমল করছে না? চিন্তার ছাপ স্পষ্ট মুখেচোখে।

‘কী রে? কফি করে নিয়ে আসি?

‘না মা, বোসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে সুজাতার।

‘কী কথা? তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।’

‘মা আমরা কদিন ধরেই আলোচনা করছি, ইনফ্যাক্ট ইচ্ছেটা আমারই, মানে মা হবার এই এক্সপেরিয়েন্সটা– মানে আমি বাচ্চা চাই মা।’

ধপ করে একটা মোড়ায় বসে পড়েন সুজাতা। ঠিক এই ভয়টাই তিনি করে আসছেন রুমকির বিয়ের পর থেকে। বাচ্চা, ন্যাপি পালটানো, রাত জাগা– একেবারে শেষ হয়ে যাবে কেরিয়ারটা। মিনিমাম দু-তিন বছর স্টেজ থেকে সরে থাকতে হবে। এই ঈর্ষণীয় ফিগারটাই কি আর ধরে রাখতে পারবে? ওঃ, বোকা, কী বোকা মেয়ে! আবার বলে কিনা ওর ইচ্ছে, সুনন্দন যে সুকৌশলে ওর কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাইছে, বুঝতেও পারছে না। মা হবার এক্সপেরিয়েন্স, হুঁ! বিয়ের আগে ঠিক এমনই বলেছিল, বিয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা নাকি ওর নাচের জন্যে জরুরি। মা হতে চাই! হায় ঈশ্বর! মা হওয়ার মানে বুঝিস? মা হওয়া মানে নিজের সবকিছু সন্তানের জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া, যেমন তিনি করে চলেছেন সারা জীবন ধরে। রাগে, দুঃখে কথা বেরোয় না সুজাতার মুখ দিয়ে।

মায়ের এই ভাবান্তর খেয়াল করে না রুমকি। যেন কোনও ড্রিম প্রোজেক্টের প্ল্যান বলছে, এমন তদ্গত ভাবে বলে যায় অনর্গল, ‘কিন্তু, আমি তো জানি, কেরিয়ারের এই পিক পয়েন্টে বাচ্চা নেওয়া মানে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া। এবছরেই কলামন্ডলমের স্কলারশিপটা পাওয়ার কথা চলছে, পেলে তো চেন্নাইতে চলে যেতে হবে। সুনন্দনও দু-তিন মাসের মধ্যে স্টেটস-এ চলে যাবে। তিন বছর তো থাকবেই। তার মানে এখনই বাচ্চা না নিলে… সামনের বছর আমিও তিরিশ পেরিয়ে যাব। তার মানে আরও কমপ্লিকেশন।’

সুজাতা এর পরেও কোনও মন্তব্য করেন না। ওর মুখ থেকে পুরোটা শুনে নিতে চান আগে।

‘তো সুনন্দন একটা ওয়ে আউট বার করেছে। যাতে বাচ্চাও আসে, আমাদের কেরিয়ারেরও কোনও ক্ষতি না হয়।’

অ্যাডপ্ট করবে নাকি? সুজাতা একটু বুকে বল পান, উদগ্রীব হয়ে ওঠেন মেয়ে এবার কী বলে শোনার জন্য।

‘সারোগেট মাদার জানো তো, যারা কিছু টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেন। মানে সবকিছু আমাদেরই রইল, শুধু বাচ্চা বেড়ে উঠবে এক ভাড়া করা মহিলার পেটে, জন্মের পর বাচ্চাটাকে আমরা নিয়ে নেব, আফটার অল আমাদেরই বাচ্চা।’

সুজাতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন। এবার রুমকি অস্থির হয়ে ওঠে, ‘কী হল মা? তোমার মত নেই? তুমি কি বেবির কেয়ার নিয়ে ভাবছ? আয়া রাখব, তাছাড়া তুমি তো আছোই।’

‘হ্যাঁ, আমি তো আছিই। সেইজন্যেই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। আমি থাকতে, তোমরা কী করে ভাবলে এসব?’

‘ওঃ কাম অন মা, তুমি তো কখনও এত ব্যাকডেটেড ছিলে না। এসব খবর তো কাগজেই হামেশা বেরোচ্ছে। কলকাতাতেই কত হচ্ছে। আচ্ছা, যারা খুব ব্যস্ত, তারা কী করবে বলো? তোমাদের দিন একরকম কেটে গেছে। তুমি যেমন শুধু আমাকে নিয়ে লেগে ছিলে, আমার পক্ষে কি তা সম্ভব?’

‘না সম্ভব নয় রুমকি। সুনন্দন খুব ম্যাচিওর্ড ছেলে, ও ঠিকই ভেবেছে। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, আমি থাকতে অন্য ভাড়া করা মহিলার কথা তোমরা কী করে ভাবলে? হাইজিনের ব্যাপার আছে, পরিবেশ আছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির তফাত আছে। তাছাড়া আইনি প্যাঁচপয়জার কতরকম হয় বোঝো তোমরা? সে যদি দাবি করে বসে বাচ্চাটা তারই? এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে।’

রুমকি বিভ্রান্তের মতো মার দিকে তাকায়। সারাজীবন সমস্ত সংকট মুহূর্তে যেভাবে তাকিয়েছে।

‘শোন রুমকি, বাইরের আজেবাজে কোনও মহিলা নয়, তোর সন্তান বেড়ে উঠবে আমার শরীরে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে, বুঝলি?’

রুমকির সব কেমন গুলিয়ে যায়। তার সন্তান থাকবে মায়ের গর্ভে! সে কী হবে তার তাহলে? দিদি না মা? মার মাথার ঠিক আছে তো? বাবা শুনে কী বলবে? আর সুনন্দন? একবার সুনন্দন বলেছিল, ‘তোমার মা কিন্তু এখনও বেশ অ্যাট্রাকটিভ।’ সেই নিরীহ কথাটাও কেমন কুৎসিত লাগে এই মুহূর্তে। অসহায়ের মতো সেও ধপ করে বসে পড়ে আর একটা সোফায়।

‘তুই কেন এত চিন্তা করছিস রুমকি? তোর বাচ্চা হলে এমনিতে তো তাকে আমাকেই মানুষ করতে হবে। তুই কি তাকে সময় দিতে পারবি? তার চেয়ে এই ভালো হল না? গোড়া থেকেই সে আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেল আষ্টেপৃষ্ঠে, ওকে মানুষ করতে গেলে কখনও মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি। তোর মতো ওকেও গোড়া থেকে গাইড করতে পারব, ছকে দিতে পারব ভবিষ্যৎ।’

স্বপ্নে টলটল করে সুজাতার দুচোখ। খালি-খালি ভাবটা উধাও হয়ে যায় বুক থেকে। আবার যেন পুরোনো উদ্যম ফিরে পেয়েছে তাঁর শরীর। সামনে এখন অনেক কাজ, আবার তাঁর হাতে গড়ে উঠতে চলেছে এক নবজীবনের রূপরেখা।

‘মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি।’ মার এই কথাটা কেমন যেন কানে লাগে, রুমকি কেঁপে ওঠে একটু, পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিকই তো বলেছে মা। তার সামনে অনেক কাজ। সে একজন শিল্পী, শুধুই শিল্পী, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো জীবনের ছোটো-ছোটো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার চলবে? সমাজ, সংসার, চরাচর মুছে যায় তার চোখের সামনে থেকে, শুধু ভেসে ওঠে একটি মঞ্চ, দুটি নৃত্যপরা পা, তারই ওপর সমস্ত আলো। পা দুটি নেচে যাচ্ছেই, নেচেই যাচ্ছে নিজের ছন্দে। মাকে জড়িয়ে ধরে রুমকি।

সুজাতা অবশ্য বাস্তববোধ হারাননি। সিদ্ধান্তটা তো শুধু আবেগের নয়। অবশ্যই ডাক্তারের মতামত নিতে হবে, জেনে নিতে হবে এই গুরুভারের জন্যে তাঁর শরীর কতটা প্রস্তুত। আর অনির্বাণ, তার মতটাও…

রুমকি কি তাঁর মনের কথাটা পড়েই বলে, ‘বাবা কী বলবে মা?’

‘বাবার ব্যাপারটা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। মানুষটা কোনোওদিন আমার কথা ফেলেনি। আর সুনন্দন, সত্যি কত আধুনিক মনের ছেলে। আমরা খুব লাকি রে রুমকি!’

গভীর প্রশান্তিতে রুমকিকে বুকে টেনে নেন সুজাতা। তাঁর গর্ভের ওম উষ্ণ পৃথিবীকে উষ্ণতর করে তোলে।

 

আগুনের মুখোমুখি

পরিচিত এক গানের সুরে কলিংবেল-টা বেজে উঠতেই সংবিৎ ফিরে পায় নীপা। গত দু’দিন যাবৎ সে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। দুপুরে এই অসময়ে কে আসতে পারে? ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে লিলির রাত হয়ে যায়। আর ও তো সাড়ে দশটা– এগারোটার আগে কোনও দিন…

ফের বেজে ওঠে বেলটা, তবে এবারে ভিন্ন সুরে।

বাধ্য হয়ে নীপা বিছানা ছেড়ে ওঠে। কাজের মেয়েটি দেশে গেছে তো গেছেই, ফেরার নাম নেই। বেল বাজলে দরজা খুলতে যাবার বিষয়টা তার বিরক্তিকর লাগে। নাইটিটা পাতলা, হাত বাড়িয়ে হাউসকোট টেনে নেয় নীপা। সেটা গায়ে চাপিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলে একটি অচেনা মুখ নজরে পড়ে। ছেলেটির হাতে একগোছা কাগজপত্র।

নীপা নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে, ‘কে? কাকে চাই?’

‘কুরিয়ার। চিঠি আছে,’ উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে।

দরজা খুলে চিঠি হাতে নেয় নীপা। নির্দিষ্ট কাগজে সই করে ফেরত দেয়। ভেবেছিল, স্বামীরই কোনও চিঠিপত্র হবে। কিন্তু খামের উপর জ্বলজ্বল করছে তার নাম। চিঠি নিয়ে দরজা বন্ধ করে নীপা। প্রেরকের নাম নেই, আশ্চর্য! তবে কী? ধক করে ওঠে বুক।

দারুণ উত্তেজিত লাগে নিজেকে। হাতের লেখাটা চেনা-চেনা ঠেকছে। খামের একটি দিক ছিঁড়ে সে চিঠিটি বের করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে, ‘প্রিয় নীপা’। উত্তেজনা দমন করতে পারে না সে, দ্রুত চিঠির নীচে চোখ বোলায়– ‘উফ্, যা ভেবেছি, আঁতকে ওঠে নীপা, তলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘তোমার আর্যদা’। অজানা আতঙ্কে বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় নীপার, চিঠিটি আর পড়ে না। সামনের জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাড়িয়ে দেয় দূরে– আশ্বিনের মিষ্টি রোদে ভাসা আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ যেন অন্যমনস্ক একটি ঈগল পাক খাচ্ছে মন্থর গতিতে।

নীপার মনটা পিছিয়ে যায় একুশ বছর। ভবানীপুরে নীপাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। সে বাড়িতে নীপার বাবা তার দুই ভাই এবং তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন। নীপারা ছিল দু’ভাই, এক বোন। কাকার দুই মেয়ে, এক ছেলে। আর জেঠুর ছিল দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সবার ওপরে ছিলেন ঠাকুমা। এতগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে গোটা বাড়িটা সব সময় গমগম করত। হইহুল্লোড় লেগেই থাকত।

নীপার বাবা ছিলেন সংগীত পাগল মানুষ। শনি-রোববার হলে বাড়িতে গানের আসর বসত। কত যে লোকজন আসত, আসত ভাই-বোনদের বন্ধুবান্ধবরা। নির্ভেজাল আড্ডা জমত ছুটির দিনগুলিতে। উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। আজ এর জন্মদিন তো কাল ওর।

এরকমই একদিন খুড়তুতো দাদা নীল বলল, ‘এই নীপা, এদিকে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হল আমার বন্ধু, আর্য। আর্য কাশ্যপ। দুর্দান্ত ছবি আঁকে।’

নীপা কোনও মতে হাতজোড় করে বলেছিল, ‘নমস্কার’।

মৃদু হেসে আর্য বলেছিল, ‘তোর বোন যতটা লাজুক ঠিক ততটাই মিষ্টি।’

নীপার চোখমুখ এক অপার্থিব মায়াবী আলোয় ভরে উঠেছিল সেদিন। ‘আমি যাই’, বলে দ্রুত পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু এর দিন কয়েক পর কলেজ যাবার সময় আচমকা সিগারেট হাতে এগিয়ে এসেছিল আর্যদা, ‘কী নীপা চিনতে পারছ?’

নীপার বুক ঢিপঢিপ শুরু হল। আশেপাশে সামান্য তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, ‘কেউ দেখতে পাবে। এখানে না, কলেজে।’

ফিক করে হেসে সরে গিয়েছিল আর্যদা। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পায়ে পায়ে আশুতোষ কলেজ আর কতটুকু? দু’জনের প্রেম জমে উঠতে দেরি হয়নি।

তারপর কলেজ বাংক করে অসংখ্য দিন সিনেমা, রেস্টুরেন্ট, গঙ্গার পাড়, ভিক্টোরিয়া, সদন– দিনগুলোর কথা ভাবলে নীপার বুকটা হুহু করে ওঠে আজও। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত দু’জনের কথা বলে।

নীপা প্রায়ই বলত, ‘তুমি আমাকে কী দেখে ভালোবাসলে আর্যদা? তোমার কাছে আমি যে কিছুই না।’

উত্তরে আর্যদা হেসে বলত, ‘তুমি জানোই না তুমি কতটা সুন্দর। জানলে এ কথা বলতে না।’

বাস্তবিকই কন্দর্পের মতন রূপবান ছিল আর্য। উজ্জ্বল ফর্সা রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ। লম্বা সুঠাম চেহারার যুবকটির চমকপ্রদ কথাবার্তায় চুম্বকীয় আকর্ষণ। তার কাছে নীপা নিজেকে বড়ো অসহায়বোধ করত। পক্ষান্তরে নীপা মোটের ওপর সুশ্রী হলেও তাকে সুন্দরী বলা চলে না। থাকার মধ্যে ছিল কেবল সুগঠিত নারীসুলভ দেহ, আর মার্জিত ব্যবহার।

প্রতিদিনই শরীর চাইত আর্য। আর তা না পেলেই তার মুখ ভার হয়ে উঠত। অবশ্য সেই রাগ নীপাকেই ভাঙাতে হতো ফের শরীর দিয়েই। আর আদর করতেও জানে বটে ছেলেটা। কোথায়, কখন, কীভাবে ছুঁলে যে নারীদেহ অবশ হয়ে আসে, এলিয়ে পড়ে প্রতিরোধ বিহীন হয়ে, ভেসে যায় অনন্ত স্রোতে– তা বুঝি কেবল ওরই জানা। অমন করে আর ছুঁতে পারল কে? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নীপার বুক থেকে।

চিঠি হাতে ধরাই থাকে, পড়া হয় না। নীপা ভাবতে থাকে, কী লেখা থাকতে পারে এতে? আজ একুশ বছর পর আমার কাছ থেকে আর কী পাওয়ার আছে আর্যদার? বয়স তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। এ চিঠি আমার স্বামী কিংবা লিলির হাতে পড়লে কী সর্বনাশ হতো! শিউরে ওঠে সে। এরকম একটা ঘটনা যে আর্যদা ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কাই হচ্ছিল। গত পরশু দিন পার্টিতে যখন মি. চাওলা আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড আর্য কাশ্যপ। দ্য মোস্ট ডিসকাস্ড পেইন্টার অফ দিস আওয়ার। অ্যান্ড হিয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ড মি. চ্যাটার্জী অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, মুহূর্তের জন্য পায়ের তলা থেকে মাটি বুঝি সরে গিয়েছিল নীপার, ‘আ-র্য-দা’, অস্ফুটে উচ্চারণ করতে পেরেছিল কেবল।

জুলফিতে পাক ধরেছে ভালোই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও কী অপূর্ব সুন্দর মানুষটি! কিছু কিছু মানুষকে বুঝি বয়স তেমন ভাবে ছুঁতে পারে না। কত বয়স হবে আর্যদার? আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়ো ছিল, তার মানে ফিফটি প্লাস। আশ্চর্য! এক মাথা ঝাঁকড়াচুল, রিমলেস চশমা, পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর চমৎকার একটি শাল কাঁধে ভাঁজ করে ফেলা। প্রাথমিক নমস্কার সেরে ওদেরকে কথা বলতে দিয়ে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সরে এসেছিল নীপা। পার্টিতে ওদের আর কথাবার্তা হয়নি।

গত দুদিন যাবৎ বারবারই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল নীপার। বুঝতে পারে না, আর্যদার সামনে নিজেকে এত অসহায় লাগে কেন? মনে হয় বুঝি পায়ের তলায় মাটি নেই, কেবল বালি, তাও দ্রুত সরে যাচ্ছে। অথচ ওই মানুষটি এক দিন আমাকে চরম সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও কেঁপে ওঠে শরীর–

আর্যদার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল মিলি, জ্যাঠতুতো বোন। বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও ওরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। একদিন মিলি ওকে ডেকে বলল, ‘শোন নীপা, তোকে একটা কথা বলার ছিল।’

‘কী বলবি বল না।’

‘কথাটা শুনতে তোর একটুও ভালো লাগবে না, মন খারাপ হয়ে যাবে। হয়তো আমাকে ভুল বুঝবি’, বলল মিলি।

‘যা বোঝার বুঝব, তুই আর ঢং না করে বলেই ফেল কথাটা।’

‘না, মানে কথাটা আর্যদার সম্বন্ধে,’ ইতস্তত করে মিলি।

‘কী হয়েছে আর্যদার?’ উৎকণ্ঠা জাগে ওর গলায়।

‘না ওর খারাপ কিছু হয়নি’, মিলি বলে, ‘দ্যাখ আমার কানে ওর সম্বন্ধে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য এসেছে যার অর্থ ছেলেটি মোটেও সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে আরও একাধিক মেয়ের সম্পর্ক আছে। তুই সাবধানে থাকিস।’

‘তোর কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই প্রশ্ন করে নীপা।

‘না, আমার কাছে ওসব থাকবে কী করে? কানে এল, তাই তোকে সাবধান করলাম, এই আর কী।’

রাগে সেদিন ধুপধাপ করে হেঁটে নীপা চলে এসেছিল মিলির ঘর ছেড়ে। তবে কথাটা যে কতদূর সত্যি তা জানা গেল মাস ছয়েক পরই। নীপার প্রেমের বয়স তখন দু’বছর। সে তখন পার্ট টু দিয়েছে।

একদিন আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় বাড়িতে ডাক্তার এল। মুহূর্তে মারাত্মক সংবাদটা পৌঁছে গেল বাবা-দাদাদের কানে। প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠতে খানিকটা সময় লাগল সকলের। তারপরই সকলে হামলে পড়ল, ‘এ কর্মটি কার?’ উত্তর পেতে দেরি হল না। বড়দা ফোন করল আর্যদের বাড়ি।

আর্য-র মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগেই। বাবা বেঙ্গালুরুতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন উঁচু পোস্টে। বাড়ির কাজের লোক জানাল, ‘আর্ট এগ্জিবিশন উপলক্ষ্যে আর্য ফ্রান্স গেছে, কবে ফিরবে জানা নেই।’

নীপা অবাক। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও তো দেখা হল আর্যদার সঙ্গে, একটিবার জানাল না যে ও ফ্রান্স যাচ্ছে। আমাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে গেল আর্যদা! শরীরী গল্পে যদিও ওরা যথেষ্ট সাবধানতা নিত, তবে মাঝে মাঝে বড়ো বেপরোয়া হয়ে উঠত আর্যদা। কিন্তু তার পরিণাম যে এমন বিষময় হয়ে উঠতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। দুশ্চিন্তায় মা-বাবার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা পাচ্ছিল না নীপা। কানাকানিতে গোটা বাড়ি জেনে ফেলল ঘটনা। মা-বাবা-দাদাদের মুখ ভার। কেউ কোনও কথা বলছে না, বললেও একটা দুটো। দিনরাত ফিসফাস, গুজগুজ, ছিঃ ছিঃ-তে কান পাতা দায়। উফ্, কী ভাবে যে সে দিনগুলো কেটেছে!

সে যাত্রা উদ্ধার করেছিলেন কাকা। কাকার পরামর্শ অনুযায়ী বাবা-জ্যাঠা দু’জনেই মত দিয়েছিলেন উপযুক্ত পাত্র দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীপার বিয়ে দিতে হবে। তবে তার আগে একবার নার্সিংহোম ঘুরিয়ে আনতে হবে ওকে।

কিন্তু নীপার কপালে আরও কষ্ট লেখা ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন, মাত্র দু’মাস বয়স হলেও কী এক জটিল কারণে এক্ষেত্রে নীপার উদ্ধার পাওয়া কঠিন। তা করতে গেলে পেশেন্ট জীবনে আর মা হতে পারবে না। একেই বুঝি বলে, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।

তড়িঘড়ি খোঁজা হতে লাগল পাত্র। আশ্চর্যজনক ভাবে জুটেও গেল একজন। পাত্র বিদেশে চাকরি করে এক নামি কোম্পানিতে। বাড়ি বালিগঞ্জে। মা-বাবা এখানে থাকলেও তাকে বরাবর বাইরেই থাকতে হবে। মাত্র এক মাসের ছুটিতে এসেছে দেশে বিয়ে করবে বলে। তার জন্য পাত্রী ঠিক করাই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাত্রী জানিয়েছে যে তার অমতে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে এবং যেহেতু সে একজনকে ভালোবাসে তাই তার পক্ষে তাকে বিয়ে করা সম্ভব হবে না।

কী করে কে জানে যোগাযোগ ঘটে গেল দু’পক্ষে! দু-চারদিনের মধ্যে কথাবার্তা পাকা। পাত্র অবিনাশ বলল, ‘আমি একবার পাত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।’

প্রস্তাব শুনে প্রমাদ গুনল সকলে, এই বুঝি কেঁচিয়ে যায় বিয়ে। ততদিনে নীপা অনেকটাই পরিণত। সেও চাইছিল এমন একটা কিছু হোক। নির্দিষ্ট দিনে সে আর মিলি এসে দেখা করল অবিনাশের সঙ্গে। ওর সঙ্গেও ছিল এক বন্ধু। প্রাথমিক পরিচয় সেরে এসপ্ল্যানেডে এক রেস্তোরাঁতে ঢুকে রিজার্ভড সিটে বসে অবিনাশ বলল, ‘বলুন ম্যাডাম, স্বামী হিসাবে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবেন? অনেক বদগুণ আছে কিন্তু আমার।’

অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নীপা জবাব দিয়েছিল, ‘তার আগে আপনার জানা উচিত স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে গ্রহণ করতে পারবেন কি না?’

‘কী ব্যাপার, এনি প্রবলেম?’ কপাল কুঁচকে ওঠে অবিনাশের।

ভনিতা না করে নীপা সরাসরি বলে, ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

‘এখন ভালোবাসেন না?’

‘না, সম্ভবত না,’ একটু থেমে থেমে জবাব দেয় নীপা।

‘ব্যস, তা হলে তো প্রবলেম মিটেই গেল। এখন আমাদের লাইফ পার্টনার হতে বাধা কোথায়?’ সহজ কণ্ঠে বলে অবিনাশ।

মাথা নীচু করে থাকে নীপা, উত্তর দেয় না। হঠাৎ হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। অবিনাশ ঘাবড়ে যায়, উঠে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে শান্ত করতে চেষ্টা করে, ‘রিল্যাক্স, রিল্যাক্স নীপা, কাঁদছ কেন? এভাবে কাঁদার কোনও মানে হয়? কী হয়েছে খুলেই বলো না আমাকে।’

‘পারব না, কিছুতেই পারব না। একজন আমাকে ঠকিয়েছে, তাই বলে আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না,’ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় নীপা।

‘এখানে ঠকাবার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? দ্যাখো, ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। তুমি যাকে ভালোবেসেছ হয়তো সে তোমাকে তার মর্যাদা দেয়নি। সব কথা তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে, এরপরও ঠকাবার প্রশ্ন থাকছে কোথায়?’

‘থাকছে। এরপরও থাকছে, বিকজ…’

‘বিকজ?’

‘বিকজ, আয়াম ক্যারিং’, রুমালে মুখ চাপা দেয় নীপা। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় অবিনাশ দারুণ আহত হয়। বুঝে উঠতে পারে না এক্ষেত্রে তার কী বলা উচিত। কেবল নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।

খানিক পর বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার রাখতে মাথা তোলে নীপা। চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। অবিনাশ ওর প্লেটে খানিক খাবার তুলে দেয়। বলে, ‘নাও, খেতে শুরু করো।’

নীপা আঙুলে চামচ ধরে নাড়াচাড়া করে, খেতে মন চায় না তার। মুখ থেকে কোনও কথা বেরোয় না। দু’চোখে ভরা জল। মিলি ওর পিঠে হাত বোলায়।

অবিনাশ বলে, ‘ব্যাপারটা মেডিক্যালি কিছু করা যায় না?’

নীপা বুঝতে পারে ও কী মিন করছে। বলে, ‘সম্ভব নয়। ডাক্তার বলেছেন, সেক্ষেত্রে ইন ফিউচার আমার মা হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলে অবিনাশ। ওর বন্ধুর দিকে তাকায়। তাকেও অসম্ভব বিস্মিত দেখায়। এরপর ওরা অসম্ভব ব্যস্ততায় কাঁটাচামচ হাতে খাবারে মনঃসংযোগ করে। একটাও কথা বলে না। একসময় খাওয়া শেষ হয়। তারপর অবিনাশ হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘নীপা, আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি– আমি তোমাকে বিয়ে করব।’

নীপা অবাক চোখে তাকায়, ‘কী বলছেন! এত সব জানার পরও আপনি!’

‘এসব আমাকে না জানালেও পারতে তুমি, সেক্ষেত্রে আমি চিটেড হলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু তা তুমি করোনি, বিকজ ইয়্যু আর অনেস্ট। অ্যান্ড অনেস্টি ইজ দ্য রেয়ারেস্ট কোয়ালিটি, ইয়্যু নো? তোমার সততাকে সম্মান জানাতেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই আমি, অবশ্য তুমি যদি আমাকে পছন্দ করে থাক।’

নীপার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অন্ধকার। সেখানে অবিনাশ একমাত্র আশার তরি। তাতে চড়ে বসা ছাড়া তার আর উপায় কী? যত শিগগির সম্ভব রেজিস্ট্রি ম্যারেজ সেরে অবিনাশ ওকে নিয়ে উড়ে গেল কানাডা। সেখানেই জন্ম হল লিলির। বছর দশেক কানাডায় থাকার পর ওদের ফিরতে হল দেশে। কারণ অবিনাশের কোম্পানি কলকাতায় ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছে। অবিনাশ উদার মনের মানুষ। আপন মহত্ত্বে সে লিলিকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছে। লিলি তো বাবা বলতে অজ্ঞান। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এতদিন। নীপা আর কোনও দিন কারও কাছে আর্য সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো এড়িয়ে থেকেছে বরাবর। আর ভাবতে পর্যন্ত চায়নি এব্যাপারে। সেদিন পার্টিতে দেখা মাত্র এড়িয়ে গেছে, প্রশ্রয় দেয়নি দুর্বলতাকে। কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক তীব্র আবেগের উৎরোল। আজ এই চিঠি, কী লিখেছে দেখাই যাক–

‘প্রিয় নীপা,

নিশ্চয়ই অনেক মান-অভিমান বুকে জমে আছে। অনেক অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু বলি, আমারও বলার কিছু ছিল। সব শোনার পর আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণা বদলাবে কী না জানি না, তবে আমার মধ্যে যে অপরাধবোধ নিয়ত কাজ করে তা কিছুটা হালকা হবে। দীর্ঘকাল ধরে যে যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি তা থেকে মুক্তি পাবার একটা সুযোগ অন্তত দাও। চিঠির তলায় আমার মোবাইল নাম্বার আছে, ফোনে জানিও, কোথায় কীভাবে দেখা হওয়া সম্ভব। প্লিজ নীপা, একটি বার, মাত্র একটি বার মাত্র কিছু সময়ের জন্য দেখা কোরো তুমি।

তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি,

তোমার আর্য ’

পড়া শেষ হলে চিঠিটা হাতের মুঠোতে মুচড়ে ধরে নীপা। অস্ফুটে বলে, ‘না না, কখনওই না। আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা নেই। কোনও কথা থাকতে পারে না। আর কোনও সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। একদিন আমার সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে ভালোবেসেছিলাম, উজাড় করে দিয়েছিলাম আমার অনাঘ্রাতা শরীর। দস্যুর মতো লুঠ করেছ তুমি আমাকে, যা খুশি করেছ, প্রতিবাদ করিনি। সেই তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, অমর্যাদা করলে আমার ভালোবাসার? তোমাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন। না না, কিছুতেই দেখা করব না আমি তোমার সঙ্গে।’

আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। ঘড়ির দিকে তাকায় নীপা, সাড়ে চারটে। মানুর মা এল বোধহয়। ‘যা-ই’, বলে সাড়া দেয়। বিছানা ছেড়ে উঠে যায় দরজা খুলতে।

মানুর মা ঘরে ঢুকলে নীপা বলে, ‘আগে ভালো করে একটু চা করো তো, তারপর বাসনপত্র মেজো।’

ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে নীপা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে মোটেও আর্যদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে না। কারণ আর্যদার মুখোমুখি হলেই সে ফের দুর্বল হয়ে পড়বে। তার ভরাট সংসার ছারখার হয়ে যাবে।

সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে হঠাৎ একটা কোকিল ডেকে ওঠে, কু…হু।

নীপা গাছটির দিকে তাকায়। অজান্তেই ভালো লাগার একটা আবেশ তাকে জড়িয়ে ধরে।

দিনতিনেক পর দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছিল নীপা। খানিক চোখও লেগে গিয়েছিল। এমন অসময়ে হঠাৎই বেলটা বেজে উঠতে এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে নীপার।

এই ক’দিন নীপা মনে মনে কামনা করছিল আর্যদা এ বাড়িতে আসুক। না না, অতটা সাহস হবে না নিশ্চয়ই। গায়ে একটা ওড়না দিয়ে এসে দরজা খোলে নীপা।

‘আর্যদা!’ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। হাত-পা বুঝি অবশ হয়ে আসে, মুখ থেকে কথা বেরোয় না।

‘ভিতরে আসতে বলবে না?’ মুখে সেই দেবদূতের মতো হাসি।

‘এসো’, বলে দরজা ছেড়ে এগিয়ে যায় নীপা বসার ঘরের দিকে। একসময় সোফায় দুজন মুখোমুখি বসে দুদিকে।

আর্যর চোখ যায় টেবিলে একটা ফোটোস্ট্যান্ডের দিকে, চোখে প্রশ্নচিহ্ন জাগে।

নীপা বলে, ‘আমার মেয়ে।’

‘শুধুই তোমার?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আর্য।

নীপা উত্তর দেয় না, মাথা নীচু করে।

‘আমার চিঠি পেয়েছিলে নিশ্চয়ই?’

ইতিবাচক মাথা নাড়ে নীপা।

‘তাহলে ফোন করোনি কেন? বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে আসতে হল আমাকে। অবশ্য আমি জেনেই এসেছি যে তোমার হাজব্যান্ড এখন অফিসে।’

‘কী করে জানলে?’

‘কেন, ওর অফিসে ফোন করে দু’চারটে কথাবার্তা বললাম, তারপর সোজা চলে এলাম এখানে।’

‘এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে? চিঠি পাঠালে কী করে?’

‘সেদিন পার্টিতে আলাপের সময় আমার কার্ডটা দিতে সৌজন্য বশত মি. চ্যাটার্জিও ওর কার্ডখানা আমাকে দেন। তাতে ওর ফোন নাম্বার, অফিস, বাড়ি ইত্যাদির অ্যাড্রেস ছিল। ছিল না কেবল রেসিডেন্সের ফোন নাম্বার।’ জবাব দিল আর্য।

‘থাকলে ফোন করতে বাড়িতে?’ প্রশ্ন করে নীপা

‘হয়তো করতাম।’

‘কী লাভ? আর কী চাও তুমি আমার কাছে?’

‘কিছুই না, শুধু ক’টা কথা বলতে আসা। বুকটা বড়ো ভারী হয়ে আছে,’ বলে আর্য।

‘কী বলতে চাও তুমি বলো,’ নীপার কণ্ঠস্বর নিস্পৃহ শোনায়।

‘বলার হয়তো অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না,’ বলল আর্য। ‘ঠিক মতো বলতে পারব কি না, তাও জানি না। মাত্র তিন দিনের নোটিশে ছবি নিয়ে ফ্রান্সে যেতে হয়েছিল আমাকে প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে। সে যে কী ঝকমারির ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না। তাড়াহুড়োয় তোমাকে খবর দিতে পারিনি। ফ্রান্সে আমাদের পনেরো দিনের প্রোগ্রাম ছিল। এগ্জিবিশনটা আমার জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছিল, বলতে পারো আমার শিল্পী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম শক্ত সোপান। ওই পনেরো দিনেই বহু ইলাস্ট্রেটার, পেইন্টারদের সঙ্গে আলাপ হয়। আমার ছবি ওদের ভালো লেগেছিল। এক ছবি ব্যবসায়ী আমার ছবিগুলি ভাড়া নিতে চায় ছ’মাসের জন্য। সে ওগুলি পারীর বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শন করতে চায়। প্রচুর টাকা অফার দেয়। চুক্তি ছিল, ছবি বিক্রির লাভ ফিফটি – ফিফটি, তবে আমাকে ওই ছ’মাস ওদেশেই থাকতে হবে। সব ব্যবস্থা ওরাই করবে।

আমি রাজি হয়ে যাই ওদের প্রস্তাবে। ছ’মাসে আমার প্রায় সব ছবিই বিক্রি হয়ে যায় চড়া দামে। কাগজে কাগজে আমার নামে লেখা হয় ফলাও করে। ছবির প্রতি প্যাশন তো আমার ছিলই, অর্থ আর খ্যাতির মোহে ডুবে রইলাম আরও ছ’মাস। তারপর ফিরে এলাম দেশে। ততদিনে আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। চড়া দামে বিকোয় আমার ছবি।’

আর্য থামে কিছু সময়ের জন্য, বোঝার চেষ্টা করে নীপার হাবভাব। তারপর ফের বলতে থাকে, ‘কলকাতা ফিরেই আমি তোমার খোঁজ করি। জানতে পারি, আমি চলে যাবার পরই নাকি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি পাড়ি দিয়েছ কানাডা। ফ্রান্স থেকে বার কয়েক তোমাদের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কথা শুনে বুঝেছিলাম তোমাদের বাড়ির কেউই চায় না আমি ফোন করি তোমাকে। একদিন মিলির সঙ্গে দেখা করে তোমার সম্পর্কে জানতে পারি সব কথা। বুঝতে পারি, কী চরম দুর্যোগের মধ্যে তোমাকে ফেলে সেদিন চলে গেছিলাম আমি। আমার জন্য কত ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তোমাকে। নীপা বিশ্বাস করো তুমি,’ আর্য উঠে আসে সোফা থেকে, নীপার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, ‘সেদিনের সে ভুলের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত আমি। আমাকে ক্ষমা করো তুমি, প্লিজ ক্ষমা করো নীপা।’

নীপার চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে। কোনও অভিযোগ সে করতে পারে না আর্যকে।

‘কেঁদো না নীপা, প্লিজ কেঁদো না, আমাকে ক্ষমা করো তুমি’, সোফায় উঠে বসে আর্য।

হাত ছাড়িয়ে নেয় নীপা, নিজের দু’হাতের তালুতে মুখ ঢাকে। এত বছরের জমাটবাঁধা বরফ বুঝি আজ গলে জল হয়ে নেমে আসছে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো, নীপা বারবার চোখ মোছে। আর্য ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ সব ভুলে নীপা দু’হাতে আর্যর বুকে দুমদুম করে কিল মারতে থাকে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ডাকাত, ডাকাত একটা। আমার সব লুটেপুটে ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছে। শয়তান, আর কী চাও? আর কী নিতে এসেছ এখানে?’ সে পাগলের মতন আঘাত করতে থাকে আর্যকে।

‘শান্ত হও নীপা, প্লিজ শান্ত হও’, ওকে কোনও মতে নিরস্ত করার চেষ্টা করে আর্য। একহাতে নীপাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ওর ওড়না দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুমু খায় ওর কপালে বারবার।

ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে নীপা। চোখের জল থামে। প্রশ্রয় প্রাপ্ত চুম্বনেরা অবাধ্য হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে। নীপা অসহায় ভাবে কেবল বলে, ‘আর্যদা, না না, এভাবে আমার সব ভাসিয়ে দিও না।’

কিন্তু ততক্ষণে দুটি শরীর জেগে গেছে…

দীর্ঘ সময় পর উঠে দাঁড়ায় আর্য। নীপা তার বিশ্রস্ত বেশবাস ঠিক করে। কিন্তু এরপরই এক তীব্র অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে নীপাকে। কোনও কথা না বলে সে উঠে চলে যায় টয়লেটের দিকে।

কফি নিয়ে নীপা যখন ঘরে ঢোকে দেখতে পায়, আর্য টেবিল থেকে লিলির ফোটোস্ট্যান্ডটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নীপার পায়ের শব্দে বলে, ‘কত বড়ো হল ও?’

‘এমএ পড়ছে’, মৃদু স্বরে জবাব দেয় নীপা, ট্রে থেকে একটা কাপ আর্যর দিকে এগিয়ে দেয়। অপর কাপটি নিজে নিয়ে বিস্কিট সমেত ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখে।

‘এখন কেমন হয়েছে দেখতে?’

‘ভালো’, সংক্ষেপে উত্তর দেয় নীপা।

‘এ কী গো দিদিমণি, দরজা খোলা কেন?’ বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে মানুর মা।

চমকে ওঠে নীপা, ‘সে কী! সদর দরজা এতক্ষণ খোলা ছিল!’

নীপাদের বসার ঘরটা একতলার কোণার দিকে, বাকি তিনটে ঘর সাধারণত বন্ধই থাকে।

নীপা ভাবে, যদি কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ত, আর ওই অবস্থায় দেখে ফেলত? সর্বনাশ ঘটে যেত। নীপা বলে, ‘তুই দরজা বন্ধ করে আয়।’

প্রকৃতপক্ষে সর্বনাশ যা ঘটার তা আগেই ঘটে গেছিল।

মানুর-মা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে রান্নাঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেক পর সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘লিলিদি বেরোচ্ছ? কিছু খেয়েছ?’

‘সে কী! লিলি ঘরে? সর্বনাশ! কখন এল ও? ওর তো এখন ফেরার কথা নয়!’ নীপার মাথায় বুঝি বাজ পড়ে। মনে হয় মাথাটা ঘুরছে। ওদিকে দুমদাম শব্দে লিলির পদক্ষেপ এগিয়ে আসছে। ওকে এভাবে যেতে দেওয়া যাবে না, ভাবে নীপা। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নীপা ওকে আটকায়, ‘দাঁড়া লিলি, কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

হিংস্র মার্জারিনির মতো ফুঁসে ওঠে লিলি, তীব্র ঘৃণা ওর দু’চোখে। বলে, ‘ছিঃ! এই তোমার পরিচয়? হঠাৎ বাড়ি ফিরে না আসলে জানতেই পারতাম না। অমন দেবতার মতো স্বামীকে এভাবে চিট করছ তুমি, তোমার লজ্জা করে না?’

নীপা বলে, ‘শোন লিলি, তোকে সব খুলে বলছি আমি। ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ ওর হাত দুটি ধরে মিনতি জানায় নীপা।

ততক্ষণে আর্য এগিয়ে এসেছে, ‘লিলি, বি কাম লিলি। শান্ত হও।’

‘শাট আপ ইয়্যু স্কাউন্ড্রেল,’ চেঁচিয়ে ওঠে লিলি। ‘এ বাড়িটা আমার হলে আপনাকে আমি জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।’

আর্যর মুখে বুঝি সপাটে থাপ্পড় মারে কেউ, এভাবে জীবনে তাকে অপমান করেনি কোনও মানুষ। লেডিকিলার হিসাবে নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তার। আজ তারই সন্তান কী না… মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে ওর।

লিলির কথাবার্তায় দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে নীপা, চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘লিলি! তুই কাকে কী বলছিস, জানিস, ও তোর কে হয়?’

দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস শব্দে লিলি বলে, ‘আজই জানতে পারলাম। এরকম দুশ্চরিত্র লম্পট পুরুষ আমার ‘বাবা’ জেনে লজ্জা হচ্ছে। আর তোমার মতো অসংযমী নোংরা মহিলাও ‘মা’ সম্বোধনের পক্ষে অযোগ্যা। আই হেট ইউ, ইয়েস, বোথ অফ ইউ।’

‘বাবা’ যদি বলতেই হয় তো বলব অবিনাশ চ্যাটার্জিকে। যিনি সব কিছু জানার পরও আমাকে নিজের সন্তান হিসাবে বুকে তুলে নিয়েছেন, উজাড় করে ভালোবেসেছেন, তোমার প্রতি স্বামীর সমস্ত কর্তব্য করেছেন।’

আর্য বলে, ‘শোন মা শোন, তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর…’

‘চুপ, একদম চুপ, আমাকে একদম ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। আই অ্যাম নট আ সেন্টিমেন্টাল ফুল লাইক নীপা, আন্ডারস্ট্যান্ড?’ জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে লিলি সরাসরি তাকায় আর্য কাশ্যপের দিকে।

সেই আগুনঝরা দৃষ্টির সামনে কেমন কুঁকড়ে যায় আর্য। এই প্রথম বুঝি সে সত্যের মুখোমুখি হয়। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নেয়, অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, কোনও কথা বেরোয় না তার মুখ থেকে।

ঠকঠক ঠকঠক দ্রুত শব্দ তুলে হেঁটে এগিয়ে গেল লিলি, দরজা খোলার আওয়াজ হল সজোরে।

——-

ভুঁইফোঁড়

তাইদাদা, ও নিতাইদাদা, আজও তুমি কাজে বের হবে না গো?

অনেক ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে জবাব আসে– বললাম তো না। আর এভাবে রোজ রোজ ডাকাডাকি করবি না।

নিতাই-য়ের যেন ধনুকভাঙা পণ। টলাতে পারে কার সাধ্যি! নিতাই-য়ের মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া। মাটি গোবরে লেপা। মেঝে দাওয়া টানটান। শান বাঁধানো মেঝেকেও হার মানায়। উঠোনের এক পাশে ধানের গোলা। আর একপাশে ছোট্ট ঢেঁকিঘর। মাঝখানে মাটির বেদিতে তুলসী গাছ। অনেকটা দূরে বাড়ির এক্বেবারে পেছনে গোয়াল ঘর। হাঁস মুরগির খোঁয়াড়। সীমানা, বাঁশের কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ।

কিছুদিন আগেও এই বাড়ি, উঠোন, ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর– সব কিছুর মধ্যে ছুটোছুটি করে বেড়াত মনোরমা। নিতাই-য়ের বউ। তখন নিতাই-য়ের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আর বুক ভরা ছিল স্বাদ-আহ্লাদ আর ভালোবাসা। কিন্তু এখন? সব শুকিয়ে, পোড়া কাঠ। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘন্টা দুই। তারপর মাইল দেড়েক হাঁটা। গ্রামের পথ ধুলোয় ভরা। চলাচলের পথে হাঁটু অবধি ধুলোর মোজা। খাটো ধুতিতেও বসে যায় ধুলোর পাড়। এ’ভাবেই পুজোর মরশুমে অন্তত হপ্তায় একদিন বাড়ি আসত নিতাই এবং তার বাপ-ঠাকুরদা। কিন্তু বছর পাঁচেক হ’ল নিতাই আর…। এখন সে কলকাতায় যায় না, বাড়ির বাইরেও বেশি বেরোয় না। বাড়িতেই থাকে। আগে কয়েকজন মিলে শোভাবাজারের ভিতর দিকে মাটির বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সে সব পাট এখন চুকে-বুকে গেছে।

এই মুহূর্তে সংসার চলেছে শামুকের গতিতে। নিতাই-ও নির্বিকার। জুটলে খায়। না জুটলে খায় না। বৃদ্ধা মা, কোটরাগত চোখদুটো তুলে ছেলেকে দেখে আর ভাবে– হায় রে কী ছেলে, কী হয়ে গেল! অমন শক্তসামর্থ্য ছেলে আমার, সুতোর মতো পাকিয়ে গেল গা। কী কুক্ষণে ওর কাঁধে সংসারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম…। হায় হায় রে…। প্রতিদিনই এভাবে বুক চাপড়ে বিলাপ করে মা।

চোখ বুজলে এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। ভয়ে শিউরে ওঠে নিতাই। নিতাই মণ্ডল। সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই আর তার দশপুরুষের কাজে হাত দেয় না। একসময় তাদের এই কাজে খুব নামডাক ছিল। মূর্তি গড়ার কাজ। তখন এদের তৈরি মাটির প্রতিমা বিভিন্ন বড়ো বড়ো প্যান্ডেলে শোভা পেত। যেমন বাগবাজার, শোভাবাজার, কুমোরটুলি– এসব জায়গায়। কিন্তু সেবারের সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যে যা বলে, এক কান দিয়ে শুনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। পরিবার পরিজনের পীড়াপীড়িও গ্রাহ্য করে না।

এদিকে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই অবস্থাতেও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাকে। এখন বেশীরভাগ দিনই তাদের উপোস করে বা অর্ধাহারে কাটে। বৃদ্ধা মা, বিধবা বউদি, তার ছেলেপুলে– এসব নিয়ে নিতাই-য়ের সংসার। নিতাই এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একমাত্র হোতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কান্নাকাটিতেই তার মন ভেজে না। সে যেন ‘পিছে বেঁধেছে কুলো আর কানে গুঁজেছে তুলো’। এক্বেবারে নীরেট এক পাথর।

নিতাই-য়ের সব স্পষ্ট মনে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা। দিনের আলো পশ্চিমে যখন ঢলে পড়ে, তখন ঢেঁকিঘরে চলে আলোছায়ার খেলা। সে সময় দু’হাত ওপরে বাঁশের আড় ধরা। এক পা ঢেঁকিতে আর এক পা মাটিতে রেখে ধানের পাড় দেয় মনো। আর ঢেঁকিতে ধান তোলানামা করে বিন্তিখুড়ি। নিতাই-য়ের মা, কোনও এক কালে তাঁর পুরো নাম ছিল বিনোদিনী মণ্ডল। বয়স যত বাড়ছে ততই গ্রামের লোকদের মুখে মুখে বিনোদিনী একসময়, বিন্তিখুড়ি হয়ে ওঠে। বিন্তিখুড়ির একটাই সন্তান। এই নিতাই। টিয়েরঙের শাড়ি আর কপালে বড়ো সিঁদুরের টিপে বেশ দেখাত মনোরমাকে।

অনেক সাধ করে পাঁচ-সাতটা গ্রাম খুঁজে পেতে মনোকেই মনে ধরল বিন্তিখুড়ির। দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল তা হ’ল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। গুনে গুনে চব্বিশটা মেয়ে বাতিল করে, মনোরমাকে নিয়ে এল ঘরে। নিতাই-য়ের কোনও মতামত ছিল না। মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। মায়ের সায়ে সায় মিলিয়ে দিব্যি ছিল নিতাই। ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। এখন মা-ই তার সব। কোনওভাবেই মাকে কষ্ট দিতে চায় না সে। বাড়িতে মা ছেলে ছাড়াও আছে জ্যাঠতুতো দাদার বিধবা স্ত্রী, তার ছেলেমেয়ে নিয়ে। মোট পাঁচ-পাঁচটা সদস্য। সংসারে একটু টানাটানি থাকলেও ছিল না তেমন কোনও অভাব অভিযোগ। তখনকার সময়ে হেসেখেলে দিনগুলো কেটে যেত।

এভাবে বছর তিনেক কাটতে না কাটতেই একটা বড়ো অভাব বিন্তিখুড়িকে অস্থির করে তুলল। নাতিনাতনির অভাব। বিন্তিখুড়ি নানা জনের সঙ্গে নানা কথা বলে এ ব্যাপারে। এই তো সেদিন চড়া সুরে বিন্তিখুড়ির পাশের দুটো বাড়ির পরে ষষ্ঠীপদ ঘোষের বউকে বলে– দ্যাখো বউমা, ছেলেপুলে ছাড়া সংসার আবার সংসার নাকি! এমন সংসারে কখনও লক্ষ্মীশ্রী থাকে?

– অমন করে বলছেন কেন খুড়িমা, সবে তো বছর তিনেক বিয়ে হয়েছে। সময় হলে নিশ্চয়ই হবে।

আপনমনেই বিড়বিড় করে বিন্তিখুড়ি– পরে হলে তো চলবে না। সময় যে ফুরিয়ে এল। আমাকে তো দেখে যেতে হবে। নাতিনাতনির মুখ দেখার বড়ো সাধ আমার। না দেখতে পেলে ওপারে গিয়েও শান্তি পাব নে। দেখি কী করা যায়! এখন তো আমাকেই হাল ধরতে হবে।

শুরু হ’ল বিন্তিখুড়ির প্রচেষ্টা। অমাবস্যা পূর্ণিমা একাদশী মেনে মেনে ঝাড়ফুঁক তাবিজ কবজ। মাঝে মধ্যে আবার মাসের শেষ অমাবস্যায় মাঝরাতে চৌরাস্তার মোড়ে কালো দিঘির জলে স্নান করিয়ে ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সাধুবাবার ভেষজ ওষুধ সেবন, মাদুলি ধারণ– এসবও চলে।

মনো খুব মিষ্টি মেয়ে। শাশুড়িমা যা করান তা-ই করে। কিন্তু নিতাই-য়ের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এ’ভাবে চলতে চলতে গড়িয়ে গেল আরও দু-দুটো বছর। পাঁচ বছরের মাথায় বিন্তিখুড়ি তো দিশাহারা! কী করলে কী হবে মালুম পায় না! এক রাতে নিতাইকে ডেকে বলে– খোকা এক কাজ কর, তুই তো কামকাজে কলকাতা যাস, এবার সঙ্গে করে বউমাকেও নিয়ে যা। ওখানকার ডাক্তার দেখিয়ে আনবি।

– কেন মা, তোমার জড়িবুটি, মাদুলি, তাবিজ-কবজে আস্থা চলে গেল?

– না রে বাবা, কে বলতে পারে কীসে কী হয়?

অগত্যা মনোরমাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। কিছুদিন পিসির বাড়ি রাখে। চিকিৎসা চলে। এমনকী দুটো দিন সরকারি হাসপাতালেও থাকতে হয়। ছোট্ট একটা কাটাছেঁড়াও নাকি হয়। অবশেষে গ্রামে ফেরে।

এসবের পর বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই…। আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দিনটা। কাজ সেরে নিতাই সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ ঠেলে ঢোকার সময় শুনতে পায়, মনোর কলকল করে কথা। আর খিল খিল করা হাসি। বুকটা যেন জুড়িয়ে যেত। মা, বউ-তে খুব মিল। কত কথাই না হতো। মনোরমা দূরের গ্রামের নয়। পাশের কলাবতী গ্রামের মেয়ে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ি-বউ একসঙ্গে কলাবতী গ্রামে বেড়াতে যেত। নিতাই বাড়ি ফিরলেই মনো যেখানেই থাকত ছুটে আসত। জল গামছা এগিয়ে দিয়ে একডালা মুড়ি বাতাসা নিয়ে উঠোনে মাদুর পেতে বসত। তারপর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতে করতে কত কথা! এক সপ্তাহ না তো, মনে হতো যেন একবছর বাদে নিতাই বাড়ি এসেছে।

অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়। কোনও রাতে বেশিক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। কালের নিয়মে বা কালের স্রোতে একসময় মনোরমার স্মৃতিও ধুয়েমুছে সাফ হয়। কিন্তু…! নাহ্, আর ভাবতে পারে না। বুকটা ব্যথায় যন্ত্রণা করে। মাথাটা খালি হয়ে যায়।

হঠাৎ এক রাতে ভেতর ঘর থেকে মার গোঙানি কানে আসে। অনেকক্ষণ ধরে। একটানা। অগত্যা উঠতেই হয় নিতাইকে।

পায়ে পায়ে কাছে যায়। খাটো গলায় বলে– কী হয়েছে মা? কোনও সাড়া নেই। মাঝে মাঝে শুধু খকখক কাশির শব্দ। হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে, কপালে হাত রাখতেই চমকে ওঠে– এত তাপ! এ যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! এমন গভীর রাতে ডাক্তার – ওষুধ কোথায় পাব! তাছাড়া পয়সা! একটা সিকি পয়সাও নেই বাড়িতে। তাড়াতাড়ি জল ন্যাকড়া ভিজিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করে। প্রায় তিন দিন যাবৎ কলমি শাক সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। যতক্ষণ পুকুরে শাক আছে, ততক্ষণ না খেয়ে মরতে হবে না– গজ গজ করতে করতে বউদি বলছিল। একসময় ওর দিকে চোখ রেখে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে বউদি– এমন মদ্দা মানুষ থাকাও যা, না থাকাও তা। আচমকা কাশতে কাশতে মায়ের গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসে। খুব ভয় পায় নিতাই। মা-ও কি তবে মনোরমার মতো…! শীর্ণ মায়ের জীর্ণ শরীরটা মুহূর্তে অতীত ভোলায়। রুগ্ন মায়ের কপালে হাত রেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে– না, আর নয়। এভাবে মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না সে। কিছু একটা করতেই হবে।

এভাবে বসে বসে দুঃখ করলে, যারা গেছে, তারা তো ফিরে আসবে না। না আসবে মনোরমা, আর না আসবে…। পাশের ঘর থেকে বউদিকে ডেকে দিয়ে, রাতেই বেরিয়ে পড়ে নিতাই। যেতে যেতে বউদির চড়া সুর কানে আসে– ক্ষয়রোগ গো ক্ষয়রোগ। ভালোমন্দ না খাতি খাতি এই রোগ দেহে বাসা বাঁধে।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথম এতদিনের চেষ্টায় নিতাই ধীরে ধীরে মূর্তি গড়ায় হাত দেয়। পুজো প্রায় এসে গেছে। বর্ষাও তেমন হয়নি। কেমন যেন গুমোট চারদিকটা। এবারের অকাল কালবোশেখিতে নিতাইয়ের ঘরের চালার কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। তাই এবারের প্রথম সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে এক হাঁটু জল। তাই নিতাইকে যেভাবেই হোক ঘরের চালাটা সারাতে হবে। আগে মায়ের চিকিৎসা, না আগে ঘর সারানো– কোনটা আগে করবে? ভেবে পায় না। দুটো চাপ মাথায় নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায় কাজে। মনে মনে ভাবে নিতাই, আগে মা। তারপর সব। এখন তো তার নিজের বলতে, একান্ত আপন বলতে, আছে কেবলমাত্র মা।

প্রায় রাতেই সে আসে। বিশেষত শেষ রাতে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে গলা জড়িয়ে, খিল খিল করে হেসে বলে– বাবা, ও বাবা, এই যে আমি। এই তো তোমার কাছে। এ মা দেখতে পায় না! বাবা আমাকে ছোঁও তো দেখি, ইস্ ছুঁতে পারে না। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে নিতাই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাকে যেন ছুঁতে চায়। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধাতস্ত হয়। তখন শুধুই বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যেদিন মুন্নি এল তার কোলে, সেদিন-ই মনোরমা ফাঁকি দিল। মুন্নিকে পেয়ে মনোর দুঃখ ভুলে ছিল নিতাই। মুন্নির কচি কলাপাতার মতো, নরম মোলায়েম মনের স্পর্শে, দেহের ছোঁয়ায় একটু একটু করে নিতাই-য়ের দগ্ধ মনের ক্ষতে প্রলেপ পড়ে। নিতাই অতীত ভবিষ্যৎকে ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে।

মেয়ে তো নয়, যেন এক ডানা কাটা পরি। গরিবের ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী যেন স্বয়ং এসেছেন। একটু বড়ো হতে না হতেই রূপের ছটায় চারদিক আলোকিত। সাত পেরোতেই ভ্রমরকালো ডাগর চোখদুটো তুলে বাবাকে শাসন করে– এত দেরি হয় কেন বাবা? আরও তাড়াতাড়ি আসতে পার না? কাজে বেরোলে তুমি আমায় ভুলে যাও, তাই না বাবা?

– ওরে মা, থাম থাম। সবে তো এলাম, এখনও হাত-পাও ধুইনি। এরই মধ্যে তোর একসঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর দিই কী করে বলতো? ঠাম্মা ছুটে এসে বলে

– আয় দিদিভাই, আমার কাছে আয়। বাবা হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিক, তারপর তোর সব কথা শুনবে। কেমন? আয় না দিদিভাই, আয়…। ঠাম্মা যত জোর করে মুন্নির তত জেদ বাড়ে।

– না আমার কথার জবাব না দিয়ে বাবা কোথাও যাবে না।

অগত্যা নিতাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন শুনিয়ে তবে নিজের কাজে যেতে হয়। দিন দিন নিতাই অনেক বেশি বাড়িতে আসে। এমনকী পুজোর মরশুমেও একদিনের বদলে হপ্তায় দু’তিনদিন করে বাড়ি আসে। এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। কিন্তু নিতাই-য়ের স্পষ্ট জবাব– ওরে তোরা বুঝবি না, আমার ছোট্ট মা-টা যে সারাক্ষণ আমার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে।

সারাটা দিন মুন্নি গোটা পাড়ায় খেলে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এর-তার বাড়ি ঘোরাঘুরি করে। গাঁয়ের সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসে। যার বাড়ি যা কিছু হোক, বিয়ে পৈতে পুজোআচ্চা ইত্যাদি, মুন্নি থাকা চাই-ই চাই-ই। মুন্নি না এলেও জোর করে ধরে আনে সবাই। নইলে সব আনন্দই যে মাটি। দু’গালে টোল ফেলে, গলা ছেড়ে খিলখিল করা মুন্নির হাসি, গাঁয়ের ঘরে ঘরে উলুধবনি শঙ্খধবনির চেয়েও বেশি পয়া, বেশি আদরণীয়।

প্রতি রাতে মুন্নি ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে, কল কল করে সারাটা দিনের গল্প বলে। কত জ্যাঠা, কাকা, মাসি, পিসির বাড়ি আজকে গিয়েছে। কতজন, কুলের আচার, আমের মোরোব্বা খাইয়েছে, বিল্টু, নেপু, তিন্নি ওদের সঙ্গে চু কিত কিত খেলতে খেলতে কতবার পড়ে গেছে। কতবার ডাংগুলিতে বল্টু পিন্টুকে হারিয়েছে– নানান দস্যিপনার গল্প ঠাম্মাকে শুনতে হয়। ঠাম্মারও মন ভরে ওঠে। একসময় বকবক করতে করতে মুন্নি ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মুন্নিকে দু’হাতে জড়িয়ে, আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে ঠাম্মা। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। নাতনি বলে কোনও ক্ষোভ নেই বিন্তিখুড়ির। বরং বেশ গর্ব। অমন রূপ ক’জন পায়! মনে মনে ভাবে– দু’হাত তুলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলে, এ যে দেবে ধর্মে তুষ্ট হওয়ার ফল গো। মেয়ের শখ তার বহুদিনের। নিজের তো ছিল না। এমনকী তাদের বংশেও মেয়ের সংখ্যা খুব কম। অবশেষে মুন্নি এল। তার ষোলোকলা সাধও পূর্ণ হল।

গরিবের ঘরে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। কিন্তু ঘাটতি নেই ভালোবাসার। তাই সবার অফুরন্ত আদর ভালোবাসায় তিল তিল করে বেড়ে উঠছিল মুন্নি। গোলগাল ফরসা টুকটুকে মেয়েটা ঘরে বাইরে সবার মন কেড়ে নিয়েছে। নিতাই-য়ের ছিল নয়নের মণি। বাঁচার একমাত্র প্রেরণা। অন্ধের যষ্টি।

সূর্য ডুবে যেতেই হালকা অন্ধকার নামে চারধারে। বছর আটেকের মুন্নি। তখনও উঠোনে এক্বাদোক্বা খেলছিল। হঠাৎ জেঠির ডাক– খুকি ও খুকি যা তো মা, গোয়াল ঘরের ধোঁয়াটা দিয়ে আয় তো মা। তোর ঠাকুমার আবার জ্বর এসেছে। দেখি গিয়ে কী করা যায়!

– যাই জেঠি, বলতে বলতে মুন্নি লাফাতে লাফাতে আসে। ধোঁয়াটা নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যায়। সেটাই বোধ হয়…।

নিতাই মণ্ডলের গোয়ালঘর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। মুন্নি মাঝে মাঝেই গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে আসে। ওটা ষষ্ঠীপদ জানে। কিছুদিন যাবৎ তার মাথায় একটা মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে। নাদুসনুদুস মেয়েটার দিকে চোখ পড়লেই ষষ্ঠীপদর বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। দুশ্চরিত্র, লম্পট ষষ্ঠীপদ তক্বে তক্বেই ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। গোয়ালঘরের সামনে যেতেই মুন্নি একটা খসখস শব্দ শুনতে পায়। ঘুরে তাকায়। কিন্তু কারুকে নজরে পড়ে না। তাই সে অনায়াসে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তখনও পাশের বাড়ির রামতনুদাদা গরু নিয়ে ফেরেনি। আজ হাটবার। তাই হাট সেরে রামতনুদাদার গরু নিয়ে ফিরতে আজ বেশ দেরি হবে। আগে ওদের অনেক গরু ছিল, এখন একটাই গরু। সে-ই দেখাশোনা করে। কিন্তু রামতনুদাদা যে এখনও ফেরেনি, মুন্নি তা জানত না।

রামতনুদাদার সঙ্গে মুন্নির খুব বন্ধুত্ব। অসম বয়সের বন্ধুত্ব। কিন্তু মাঝখানে কোনও ফাটল ছিল না। এতটাই গভীর ছিল যে, একদিন তাকে না দেখলে মুন্নি অস্থির হয়ে উঠত। ঠাম্মা ছাড়া আর যে মুন্নির বকম বকম ধৈর্যসহকারে শুনত, সে হল একমাত্র রামতনুদাদা। কিন্তু আজ যে হাটবার, সেটা মুন্নির মাথা থেকে বেমালুম উড়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগেই শিয়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীপদটা। সব দিক আটঘাট বেঁধে। আজই সুবর্ণ সুযোগ। নিঃশব্দে সে মুন্নির দিকে এগিয়ে আসে। নেকড়ে যেন মাংসের গন্ধ পেয়েছে। লোকটার বয়স বছর পঞ্চাশ। শক্তসমর্থ্য শরীর। খালি গা। খাটো ধুতি। চুপিচুপি তাকে ঢুকতে দেখে বছর আটেকের মুন্নি বিস্ময়ে হতবাক। কোনওমতে টেনে টেনে বলে– জ্যাঠা তুমি এখানে! হাতে ধরা কেরোসিনের কুপিটা, সামনে এনে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।

এক ফুঁ-য়ে কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে ষষ্ঠীপদ মেয়েটার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে কষে। তারপর পাঁজাকোলা করে খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দেয়। নেকড়ের হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচি মেয়েটার ওপর। লালসায় এক্বেবারে পশু হয়ে ওঠে মুন্নির ষষ্ঠীজ্যাঠা। একটানে খুলে ফেলে মুন্নির বেশবাস। সেই উন্মাদ নরপশু ফুলের মতো ছোট্ট মুন্নির অচৈতন্য দেহটার ওপর একবার নয় বারবার চালায় হিংস্র তাণ্ডব। নিষ্পাপ ফুলটিকে এক্বেবারে দলে পিষে নারকীয় খেলা শেষ করে।

মুন্নির জেঠি বার দুই খুকি খুকি করে ডেকে, মনে মনে ভাবে পাশের ঘরে তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলছে বোধ হয়। সে-ও নিশ্চিন্তে পুজোর ঘরে বসে যায়। নিতাই তখন বাড়ি ছিল না। সে গিয়েছিল কলকাতায়। বাড়িতে শুধু জেঠি, আর বিছানায় মুন্নির ঠাম্মা।

ঘন্টা দুই পর রামতনু যখন গরু নিয়ে গোয়ালঘরে আসে, তখন খুব ক্ষীণ কণ্ঠে গোঙানি কানে আসে। হাতের কাজ ফেলে, কোঁচর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালায়। রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া অচৈতন্য মুন্নিকে দেখে চমকে ওঠে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পাড়ার সবাইকে ডেকে নিয়ে, ভ্যান ঠিক করে মুন্নিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। কিন্তু এসব করতে করতে বেশ সময় লেগে যায়। সেই সময়টুকু দিতে পারে না ছোট্ট মুন্নি। অনেকক্ষণ রক্তক্ষরণ হতে হতে অসাড় হয়ে পড়ে মেয়েটা… পথেই মুন্নি…। একসময় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিভে যায় ওর জীবনপ্রদীপ।

ছোট্ট প্রাণ-পাখিটা চিরতরে ছটফট করতে করতে খাঁচা ছাড়ার আগে, কোনওমতে ক্লান্তস্বরে ঠাম্মাকে বলে যায়– কমলিদিদির বাবা, জ্যা…। আর বলতে পারে না সে।

শহর থেকে ফিরে প্রবল আক্রোশে দপ করে জ্বলে ওঠে নিতাই। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাঁপতে কাঁপতে বলে– আজই আমি কুপিয়ে শয়তানটার মুণ্ডু নামিয়ে দেব। শালা! কোথায় যায় দেখছি! তাতে আমার যা শাস্তি হয় হবে। ছিঃ ছিঃ নিজের নাতনির থেকে ছোটো, ওইটুকু এক দুধের শিশু! ছুটে যায় নিতাই। হাত থেকে শহরে কেনা মুন্নির লাল কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন টিপ, লাল ছোট্ট ফ্রকটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়।

মুন্নি মারা যাবে এটা বোধহয় ষষ্ঠীপদ ভাবতে পারেনি। তাই চমকে ওঠে! নিতাই আসার আগেই বেগতিক দেখে চটপট গ্রাম ছাড়ে ষষ্ঠীপদ।

একসময় নিতাই জ্ঞান হারায়। দিন তিনেক পর নিতাই-য়ের হুঁশ আসে। কথায় কথায় গ্রামের ছেলে গৌরাঙ্গ, মহাদেবকে বলে– শয়তান ষষ্ঠীটাকে খুঁজে পাসনি এখনও?

ওরা কাঁচুমাচু মুখে মাথা নাড়ে। নিতাই আবার চিৎকার করে ওঠে– শয়তান লম্পট ষষ্ঠীটা যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ঠিক ধরতে পারবই পারব। আর ধরতে পারলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে, এক্বেবারে টুঁটি চেপে মেরে ফেলব। শোন আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ হল সোনার দেশ। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি এমন লম্পটের জন্ম দিতে পারে না। এই সোনার গাঁয়ের আলো বাতাসে ওরকম জানোয়ারের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। ও একটা ভুঁইফোঁড় লম্পট জানোয়ার– বলতে বলতে পাগলের মতো নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। নীচের চোয়াল দাঁত দিয়ে চেপে কী সব বিড়বিড় করে।

আজন্ম চেনা গৌরাঙ্গ, মহাদেব, মদনের মতো গাঁয়ের ছেলেরা ক্রোধে উন্মত্ত, রক্তচক্ষু, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য নিতাইকে যেন সেই মুহূর্তে চিনতে পারে না। তারপর থেকে বেশ ক’টা বছর অচেনা নিতাই ভয়ংকর মূর্তিতে খুঁজে বেড়ায় ষষ্ঠীকে। কিন্তু কোথাও পায় না। শয়তান ষষ্ঠীটা জানে, সময় সব ক্ষতের প্রলেপ দেয়। তাই সে ঘাপটি মেরে থাকে। মনে মনে ভাবে একসময় না একসময় নিতাইকে হাল ছাড়তে হবে।

কিন্তু নিতাই-য়ের বুকে ক্রমশ তুষের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে জ্বলবে… শুধু একটু বারুদের অপেক্ষা। নিতাই মুন্নিকে হারিয়ে উন্মাদের মতো থানা-পুলিশ করতেও ছাড়েনি। সব্বাই শুধু ওকে আশ্বস্ত করছে একদিন না একদিন এর শাস্তি হবেই হবে। জানোয়ার ষষ্ঠীটা জানোয়ারের সাজা-ই পাবে।

এ মুহূর্তে প্রতিমা প্রায় শেষের দিকে। মায়ের জন্যই নিতাই-য়ের মূর্তি গড়ায় হাত। কয়েকদিন আগে খড়ের ওপর পড়েছে মাটির প্রলেপ। পাশের বাড়ির গৌরাঙ্গ সেদিন কথায় কথায় বলে– হ্যাঁগো নিতাইদাদা, তোমার প্রতিমা তো এবার শেষের দিকে, তাই না গো? গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে নিতাই বলে– নারে এখনও অনেক দেরি। কত কিছু বাদ আছে।

– তা এবার-ই প্রথম বাড়িতে মূর্তি গড়ছ, তাই তো?

– হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। প্রতিবার তো কলকাতাতে-ই…।

এ ভাবেই কাটে আরও কিছুকাল। ক’দিন বাদেই পুজো, প্রতিমা প্রায় শেষ। প্রতিমার মুখের আদল যে দেখে, সে-ই কেমন যেন আঁতকে ওঠে। নিতাই-য়ের তুলি ধরা হাতটা থমকে যায়। নিজে নিজেই বলে– এ কী! এ কার মুখ!

সেদিন গৌরাঙ্গ হঠাৎ বলে ওঠে– নিতাইদাদা, এ তুমি কার মুখ আঁকলে গো? বড়ো চেনা চেনা যে। সকালের উজ্জ্বল আলোয় গাঁয়ের অনেকেই সেখানে জড়ো হয়। নিতাই-ও চমকে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকায়। সবার ফিসফিস কথাবার্তা কানে যায়। গৌরাঙ্গ আবার বলে ওঠে– এ যে আমাদের মুন্নি গো! আচমকা ঘুরে তাকায় নিতাই। হাত থেকে তুলিটা পড়ে যায়। সারা শরীরে শিহরণ জাগে! কাঁপতে কাঁপতে বলে– দাঁড়া অসুরটাকে একটু অদলবদল করে দিই। ধীরে ধীরে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে শয়তান ষষ্ঠীটাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের আড়ালে এ কার মুখ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। গাঁয়ের সব্বাই দেখে নিতাই-য়ের চোখে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন।

ধীরে ধীরে সেই আগুনের ছোঁয়ায় সমবেত জনতা জ্বলে ওঠে। আর সেই সম্মিলিত দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা ভস্মীভূত করে, শয়তান লম্পট ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীটার মতো আরও অনেক অনেক অনেক…।

দুরন্ত ঘোড়া

এই সমাজে ছোটাটাই দস্তুর। কেউ কেউ পরিকল্পনা করেই ছোটে। মিশনটা ভোগ সাগরে ডুব দেওয়া। অনেকে শক্তি হারিয়ে সেই সাগরে অতল গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আবার কেউ সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসে। জীবনের মূল্যবোধ, পরম্পরা দায়দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ সব খুইয়ে সে রিক্ত। ভোগ সাম্রাজ্যের মাঝে বসে নিরেট ভোগ সামগ্রী তাকে গিলে খেতে চায়। প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরেরা শিকারিকে নিয়ে প্রথমে খেলা করে, তারপর একটু একটু করে ছিঁড়ে খায়। সেই ছিন্নভিন্ন মনের যন্ত্রণায় প্রলেপ দিতে কেউ আসে না।

সে আজ বড়ো একা। মিঠু যন্ত্রমানবে পরিণত হতে চায় না। ছোটোবেলা থেকে অতি মেধাবী মিঠুর স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। জীবনবিমার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আজীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে পর্যুদস্ত। নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মিঠু আলোর দিশারি। মিঠুর হাত ধরে আদিত্য আকাশ ছুঁতে চায়। অফিস কলিগরা ইন্ধন দেয়– আদিত্যবাবু, মিঠুর মতো অসাধারণ মেধাবী মেয়েকে স্টেট লেভেলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে পাতি ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন? ওর জন্য পড়ে রয়েছে তো গোটা জগৎ। ওকে তো আরও বড়ো জায়গায় পরীক্ষা দেওয়াতে পারতেন? ওর আসল জায়গা আইআইটি।

ভাগ্য খোলে তরুণ কর্মকারের লটারি ব্যাবসায়। ফুটপাথে চেয়ার টেবিল পেতে লটারি বিক্রিতে যা কমিশন হতো, সংসারের হাঁড়িতে তেমন একটা কালি পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। মোড় ঘুরল এই কাউন্টার থেকে প্রথম পুরস্কার লেগে যাওয়ায়। প্রথম পুরস্কার পেয়ে ট্যারা গোবিন্দ কত নম্বর বিত্তশালীদের খাতায় নাম লিখিয়েছিল জানা যায়নি। তরুণ ফুলে ফেঁপে ঢোল। খদ্দেরের মন বুঝে মা কালীর ফটোতে প্রতিদিন তাজা জবার মালা, সিঁদুর পরিয়ে, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে বসে। সামনে থাকে বড়ো প্লাইবোর্ডে কাগজ লাগানো বিজ্ঞাপন, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি প্রথম পুরস্কার এই কাউন্টার থেকে উঠেছে, ইত্যাদি। আওয়াজটা বহুদূর পেৌঁছে দেওয়ার তাগিদে রাখা আছে একটি সাউন্ড বক্স। চটুল হিন্দি গানের পাশে চলতে থাকে আনন্দ সংবাদ। খদ্দেররাও হঠাৎ বিত্তশালী হওয়ার বাসনায় পিল পিল করে টিকিট সংগ্রহ করে। প্রাচুর্য তরুণকে নিয়ে যায় নরক দর্শনে। অন্ধকার জগতে। সেই জগতে সে এখন মাফিয়া। জীবনের মূল্যবোধ দায়িত্ব কর্তব্যবোধ সব কিছুরই প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

বাচ্চা হওয়ার সময়ই রূপাঞ্জনার মা সমস্ত দায়দায়িত্ব সন্তান বাৎসল্য সমস্ত কিছুই তরুণের হাতে সঁপে দিয়ে জগতের মায়া ছেড়ে কেটে পড়ে। এত দায়ভার বহনের ক্ষমতা হয়তো তরুণের ছিল না। ছোট্ট শিশুর মিষ্টি হাসি সন্তান বাৎসল্য উসকে দেয়। বিরক্ত হয় না। ক্লান্তি আসে না। তিল তিল করে হারিয়ে যাওয়া মায়ের সাহচর্য দিয়ে বড়ো করতে থাকে। দাম্পত্য জীবনের আশা আকাঙক্ষা স্বপ্ন সব কিছুরই মূর্ত প্রতীক রূপাঞ্জনা। সে আজ আকাশের বুকে লেপটে থাকা নক্ষত্র। কম্পিটিশনটা ছিল মিঠুর সাথে। মিঠু ফোন করে –– হ্যালো রূপাঞ্জনা পড়তে যাবি তো?

– না রে আজকে শরীরটা ভালো নেই।

– সে কি, আজ যে ফিজিক্সের ক্লাস।

– থাক আজ ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন ঘুরছে।

হঠাৎই মেয়ের এই পড়াশোনার উদাসীনতার উৎস বুঝতে পারে না। টিচাররাও মিঠু, রূপাঞ্জনার অগ্রগতিতে উৎসাহিত। শ্যামলবাবু তো প্রথমেই ডেকে বললেন– তোমরা আমার কাছে ফিজিক্স পড়বে। আর শোনো তোমাদের কোনও ফি দিতে হবে না। কোচিং দেওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কম্পিটিশন ওঠে তুঙ্গে। ফোন ছাড়তেই তরুণ উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে– কিরে, পড়তে যাবি না কেন? শরীর খারাপ? কি হয়েছে?

– না তেমন কিছু না।

– তবে? শেষ সময়ে এসে এই ফাঁকি কতবড়ো সর্বনাশ ডেকে আনবে বুঝতে পারছিস না। তোকে যে বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তোর মা যে হাঁ করে বসে আছে। তাকে কি কৈফিয়ত দেব?

রূপাঞ্জনা চুপ করে থাকে। বাবার এই উৎকন্ঠা, আবেগ প্রলেপ দেওয়ার রসদ জমা নেই। শরীরের মধ্যে এক অজানা অস্থিরতা যন্ত্রণা। সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনা যেন ক্রমশ নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তরুণের মনে হয় মেয়েটা কোনও বয়ফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়েনি তো? সেক্ষেত্রে এই উদাসীনতা স্বাভাবিক। তরুণ ভিন গ্রহে হ্যারিকেন নিয়ে বয়ফ্রেন্ডের তল্লাশি চালাতে থাকে।

বাড়ির সামনে লোকের ভিড় দেখে তরুণের বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। পা যেন আর চলতেই চায় না। সামনে এসে অতি কষ্টে জিজ্ঞাসা করে– কি হয়েছে? পুলকের মা একটু বকে বেশি। নাম কিনতে চায়। লোকজন ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলে– আর বলো কেন। তুমি সাত সকালেই বেরিয়ে যাও। মেয়েটা মনে হয়, না খেয়েই পড়তে গিয়েছিল। তাই বোধ হয় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। জ্ঞান ছিল না। এখন এসেছে। তরুণ ঘরে ঢুকতেই বুলটির মাকে ঠেলা দিয়ে বলে– কি জানি বাবা। আজকাল ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে যা শুনি, কোথায় কি করে এসেছে কি জানি। বুলটির মা সায় দিয়ে বলে– মা মরা মেয়ে। শাসন নেই। হতেও পারে। উৎকন্ঠিত তরুণ জিজ্ঞাসা করে– কিরে মা, কি হয়েছে? রূপাঞ্জনা ধীরে ধীরে উত্তর দেয় – শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকে একটা যন্ত্রণা।

তবে চল কাছাকাছি কোনও নার্সিং হোমে, বলেই তরুণ উর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে যায় গাড়ির খোঁজে। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর ডাক্তার পাল জানিয়ে দেয়– পেশেন্ট ইজ ভেরি সিরিয়াস। হার্টের দুটো ভালভ্ই প্রায় ব্লক। একটি হান্ড্রেড অপরটি সিক্সটি পারসেন্ট। ইমিডিয়েট অপারেশন করতে হবে। ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যান। সব বলে দেবে।

তরুণ দিশেহারা। উদ্ভ্রান্ত, এসব ব্যাপারে মুরারীপুকুরের ক্লাবের ছেলেরা হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। টাকার সংস্থান হল। সেই টাকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে নার্সিংহোমে তরুণ যখন পৌঁছোয় সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। অনেক আশা-আকাঙক্ষা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার চোখ দুটি স্থির। নিস্পন্দ নিথর দেহখানি। সার্জন জানিয়ে দিলেন– সরি, মেয়েটি কোনও সুযোগই দিল না। ওটি-তে নেওয়ার আগেই সব শেষ।

আদিত্য অফিস থেকে ফিরেই আইআইটি-র ফর্মটা মেয়েকে দিয়ে বলে– নে এটা ফিল আপ কর। মিঠু দেখেই বলে এটা কী?

পড়ে দেখ। ফর্মের পাতা ওলটাতে ওলটাতে মিঠু খানিকটা ভীত হয়ে প্রশ্ন করে– বাবা, এ কি আমি পারব? আদিত্য নিজেই মনোবল উসকে নিয়ে সাহস জোগায়– পারবি মানে, তোর টিউটররা কি তাহলে ভুল মূল্যায়ন করেছে। আর ছিল রূপাঞ্জনা। সে তো আজ অতীত। তোর টিচাররা তো তোদের দুজনের ব্যাপারে হাই অ্যামবিশনের এক্সপেক্ট করছে।

– কিন্তু বাবা আমি চেয়েছিলাম, স্টেট লেভেলে ইঞ্জিনিয়ারিংটা দিতে। লোকালই কোনও একটা চাকরি নিয়ে তোমাদের কাছে থাকতে। আমি তো তোমাদের একমাত্র সন্তান। এটাতে পড়াশোনা করলে চাকরি নিয়ে তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে।

– তা হোক। আমাদের কথা তোর ভাবতে হবে না। চোখ উপর দিকে রাখ, তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে। তুই আমাদের গর্ব। পাড়ার গর্ব। মিঠু তর্ক বাড়ায় না। চুপ করে যায়। যে কথাটা বলতে পারল না, এই যে বাবা উঁচুতে স্বপ্ন দেখছে, অর্থের প্রাচুর্য হয়তো একদিন গিলে খাবে। দায়িত্ব, কর্তব্য মূল্যবোধ সবই হয়তো একদিন পরিত্যাজ্য হবে।

তরুণ যাচ্ছিল আদিত্য মুখার্জীর বাড়ির পাশ দিয়ে। একটা চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে বাড়িতে প্রবেশ করে। তার চাইতেও বড়ো, কারণে অকারণে মিঠুকে দেখার অভিলাষ। সে যে তার রূপাঞ্জনারই প্রতিরূপ। রাঘব আগরওয়ালার কর্মচারী সুজন অধিকারীর কঞ্চির আস্ফালনে আদিত্য কুঁকড়ে ঢোঁড়া সাপ। মুখে ভাষা নেই। প্রতিশ্রুতির বাক্যবাণী নেই। অবনত মস্তকে চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে থাকে। সুজনের অশ্রাব্য ভাষায় দরজা নেই। অবিশ্রান্ত আস্ফালন করেই চলেছে– বুড়ো ভাম, ভাড়া চুকোতে অসুবিধা কোথায়? ছিপলিটা দিয়ে দিলেই তো সব চুকে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে তরুণ বেকায়দায় পড়ল। আশা ছিল মেয়েটার সাথে দু-দণ্ড কথা বলে মনটা জুড়োবে। মেজাজটা হিঁচড়ে দিল। পকেট থেকে কানপুরি ছুরিটা বের করে সুজনের পেটের সামনে ঠেকিয়ে বলে– আবে এ কাঞ্চা, কি বললি? আবার বল। একদম পেট কামিয়ে দেব। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সুজন ছুরি দেখে নীচের কাপড় আর শুকনো রাখতে পারে না, দুর্বল পরিবারে তড়পানোর শক্তি হারিয়েছে। তরুণের পা দুটি জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে বলে– দাদা আমার কি দোষ? মালিকের অর্ডার ছিল কড়া ভাষায় থ্রেট করতে।

– নে ওঠ শালা, তাই বলে আমার মাকে বেইজ্জত করবি। কত ভাড়া পাবি? সুজন করুন সুরে বলে– পাঁচশো টাকা করে ছয় মাস তিন হাজার টাকা।

পকেটের থেকে এক গোছা টাকা বের করে ছুড়ে দিয়ে বলে– নে এতে তোর তিনহাজার টাকার বেশি আছে। এর পরে যে টাকা বাকি পড়বে আমার মা চাকরি করে শুধবে। তার আগে যদি এ মহল্লায় পা দিয়েছিস তো, আসার সময় দত্তদের পুকুরটা দেখেছিস, একদম খাল্লাস করে ওখানে চালান করে দেব। চল হট শালা। মিঠুর দিকে তাকিয়ে বলে– মা-রে ও মালটার সাথে এভাবে কথা না বললে হল্লা করেই চলত। বারবার ঝামেলা করত। তোর সামনে লোকটার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করায় আমারও সংকোচ হচ্ছে। এছাড়া আমার যে আর কোনও পথও খোলা ছিল না। সংকোচ মিঠু করে না। শ্রদ্ধার পরিমাণটা অন্তরস্থলে আরও একটু জায়গা করে নেয়। আমি উঠি রে, তোর পড়াশোনার অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল। বলে তরুণ দাঁড়ায় না।

পরিণতি তরুণকে নিয়ে যায় নরক দর্শনে। সে জাত বজ্জাত নয়। বেপরোয়া ঔদাসীন্যের সঙ্গে যারা পাপের পথে হাঁটে, কোয়ালিস হাঁকায়, সে ধাতুতে তরুণ গড়া নয়। পাপ তার পেশা নয়, নেশা। দারিদ্র্যকে বড়ো কাছের থেকে দেখেছে। সেই দারিদ্র্য নিয়ে স্ত্রী কন্যার সংসার সামলেছে। সব হারানোর যন্ত্রণা বিষাক্ত ভয়ানক নেশার মতোই তার মতো ইস্পাতে গড়া মানুষটাকে ধবংসের পথে নিয়ে যায়। বিদ্যার কারণেই হোক আর মস্তিষ্কের উর্বরা শক্তির প্রয়োগে বন্ধ কারখানায় মাল সরানোর কাজে সে এলাকার মাফিয়া ডন। তরুণের সমগোত্রীয় কেউ ধৃষ্টতা দেখানোর স্পর্ধা দেখায় না।

শ্রীজীবের আর এক দশা। বাপটা এক মেয়েছেলের খপ্পরে পড়ে তাকে নিয়ে ভেগেছে। দারিদ্র্য অনেক কিছু দেয়। দায়িত্ব কর্তব্য সুস্থ রুচিবোধের রসদ যোগায়। ক্ষিদের তাড়না মেটায় না। সেই তাড়নাতেই বাবুর বাড়িতে কাজ ধরে। শরীরে খাদ্য যোগানের বিনিময়ে পরিশ্রমের মাত্রা বেশি হলে শরীর তা সহ্য করে না। প্রতিদিন জ্বর হয়। বুকে কফের ভাব তৈরি হয়। সবসময় শুধু কাশে। শ্রীজীবটার কোনও কাজ জোটেনি। সব কারখানায় বড়ো বড়ো তালা ঝুলছে। তরুণের ফাইফরমাশ খাটে। তরুণ কিছু দেয়। শ্রীজীবটা কদিন তরুণের কাছে যায় না। মা টার শরীরটা বাড়াবাড়ি হয়েছে।

শ্রীজীব ধূর্ত নয়। সে পরিস্থিতির দাস। সেই দাসত্বের শৃঙ্খল মোচন করার শক্তি তার নেই। অকৃতজ্ঞতা, বিবেকদংশন মনকে কুরে কুরে খায়। যথাসম্ভব সেই যন্ত্রণাকে চাপা দিয়ে কৃত্রিম উত্তেজনা তৈরি করে হাঁপাতে হাঁপাতে তরুণকে গিয়ে বলে– তরুণদা, কোরা শিবুকে পুলিশ কৃষ্ণা রেপ কেসে সকালে তুলে নিয়ে গেছে। তরুণের মালের নেশাটা বেশ চড়েছে। চেয়ারে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ব্যালেন্স রাখছে। শ্রীজীবের কথা শুনে চমকে ওঠে– কি, কোরা শিবুকে পুলিশ পেল কোথায়? ওকে তো ঘোড়াডাঙায় পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে ফেরার কথা। ফোন করেছিল তো কাল রাত্রে।

– তা জানি না, হয়তো সকালেই এসেছিল। পুলিশ বাগে পেয়েই অ্যারেস্ট করেছে।

– ও কেসে শিবুকে ধরবে কেন। ওটা তো কাঁকুরগাছির কেস। ঘাপলা কেস নয়তো?

– কি জানি, একবার গিয়ে দেখলে হতো না?

– চল তবে দেখেই আসি। শীতের পড়ন্ত বেলায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মালের ধুনকিটা অনেকটা কেটে এসেছে। প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে অজস্র এঁদো গলি। নদীর শাখা নদী। স্রোত কম থাকায় এসব নদীতে পাঁক প্রজাতির মাছের উৎপাদন ঘটে। এই এঁদো গলিতে সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে। চাঁদ এ গলিতে উঁকি মারে না। এদের দৈন্যদশা খোঁজ নেওয়ার তাগিদ নেই। পাঁচ ফুট রাস্তার দুই পাশে সরু নর্দমার পাঁক চলকে চলকে সমস্ত রাস্তাটা পাঁকময় করে রেখেছে। হাবু ডাবু গলি থেকে বেরিয়েই তরুণের সাথে দেখা।

– আরে তরুণদা কোথায় চললে?

– আর বলিস না, আমাদের কোরা শিবুটাকে রেপ কেসে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

– হ্যাঁ তাই তো শুনলাম, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। চলো তো যাই। কেসটা কি? তরুণ আপত্তি করে না। মনে মনে দু-একজন সঙ্গী তরুণ খুঁজছিল। শ্রীজীব অনেকক্ষণ ধরে কেটে পড়ার ধান্ধা করছিল। তরুণকে বলে– তরুণদা মা টার শরীরের অবস্থা ভালো না। আমি তবে চলে যাব? আয় তবে। প্রশস্ত রাস্তা ছেড়ে এঁদো গলিতে কিছুটা পথ যেতেই তরুণের নেশার ঘোরটা কাটতে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে– ইস, এ নোংরা গলিতে ঢুকলি কেন?

– আরে ইয়ার, এখান থেকে একটু তাড়াতাড়ি হবে।

– কেস দিয়ে দিলে সব লুচ্চা হয়ে যাবে না? মস্তিষ্কের উর্বরা শক্তি তরুণের কম নেই। সেই শক্তিতেই এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়।

এখান থেকে পালাবার আর কোনও রাস্তা নেই, মৃত্যুর বদ্ধভূমিতে ঢুকে পড়েছে।

– আরে ইয়ার থোড়া রুক, একটু খালাস করে নিই। হাবু ডাবু বাধা দেয় না। একটু এগিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করে। পরস্পরের সঙ্গে শলা পর্ব সেরে নেয়। শালা এখান থেকে ভাগবে কোথায়? নে খালাস করে নে। একটু পরে তুই খালাস হবি। মতলবটা নরখাদক বাটপাড়েরা বুঝতে পারেনি। মিশকালো ঘন অন্ধকারে পকেট থেকে মেশিনটা বার করে। অত্যন্ত সন্তর্পণে লক্ষ্য স্থির রেখে পর পর শুট। আওয়াজটা বজ্রগর্ভ নয়। সাইলেন্সার লাগানো ছিল। হাবুটা ছিটকে এঁদো নর্দমায় পড়ে। বিষধর সাপ শেষবারের মতো ফণা তোলার চেষ্টা করে। পারে না। নর্দমার পাঁক মাথা ঠান্ডা করে। পাঁকেই সমস্ত শক্তি নিঃসৃত হতে হতে নিথর হয়ে যায়। ডাবু তলপেটে দানা খেয়ে বজ্রগর্ভে হুংকার দিতে দিতে বড়ো রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে। তরুণ পাঁকে দেহটাতে পাড়া দিয়ে বিজয়ের মুকুট চাপিয়ে দাম্ভিক শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলে– শালা মারনেওয়ালা মর গই। পথের কাঁটা তরুণ উপড়ে, দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে। নির্মূল হয় না। পশ্চিম আকাশে লাল দিগন্তে মৃত্যুর বলিরেখা অঙ্কিত হয়ে রইল, তাতে তরুণের পরোয়া নেই। আত্মরক্ষার কোনও দায় নেই। সে আজ পালহীন, উদ্দেশ্যবিহীন উত্তলিত জোয়ারে বয়ে যাওয়া নৌকা। সে নৌকায় সওয়ারী সে নিজেই।

মিঠু প্রথম প্রথম বাবাকে ফোন করত। সুদূর কেনটনে বসে মায়ের যত্ন, বাবার সাহচর্যের অভাবে মনটা শূন্যতায় ভরে উঠত। ট্রেনিং পিরিয়ডে তখনও, বৃহৎ কর্ম জগতে প্রবেশ করেনি। মা-বাবার মায়া মমতার তুচ্ছ মোড়কটার অভাবে জীবনীশক্তি কেমন স্তিমিত হয়ে যায়। মেয়ের সাফল্যের চূড়ার মসনদে আসীন হওয়ার মোহে মেয়ের শূন্যতা আদিত্যকে ভারাক্রান্ত করে না। সেটা ক্ষণিকের মোহজাল। অবসর গ্রহণের পর আদিত্যের একমাত্র ঠিকানা রাধিকারঞ্জনের দাবার ঠেক। দাবার ঘুটিতে চাল দেওয়ায় আদিত্যের অপরূপ কৌশল। সেই কৌশলেই রাধিকারঞ্জন কুপোকাত। একটার পর একটা চালে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, কখন যে জগৎটাকে ঘন অন্ধকার গ্রাস করেছে আদিত্য বুঝতে পারে না। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ফিরতে হয়। সেই যাওয়া আর আসা। এরমধ্যে সবসময় যে সদর্থ ব্যাখ্যা থাকে তা নয়। তবু যেতে হয়।

ঘরে ফিরেই আদিত্য মৃন্ময়ীকে সুধোয়– মেয়েটা ফোন করেছিল? মৃন্ময়ী উত্তর দেয় না। ফুঁসতে থাকে। মৃত আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের রসদ সঞ্চয় করে। তারপর একসময় বজ্রনিনাদে বিস্ফোরিত হয়। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরিত হতে থাকে– রোজ রোজ একই কথা বলো কেন। নিজে তো দাবার আড্ডায় সারা দিন কাটিয়ে, গভীর রাতে মেয়ের কথা মনে পড়ে। মা হয়ে আমার মন টেকে কি করে। ভেবে দেখেছ? টাকার লোভে মেয়েটাকে পরবাসী করে ছাড়লে। এখন লোক দেখানো হাপিত্যেস করে লাভ কি? লোভ আদিত্যের ছিল। লোভটা সহজাত নয়। দারিদ্রের অপমান লাঞ্ছনা তাকে লোভাতুর করে তোলে। মিঠুর নাম্বারটা ডায়াল করতেই অল লাইনস আর বিজি। কথাগুলো ফাটা কাঁসির মতো লাগে। আদিত্য ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হতাশা অবসাদে ফোন আর ধরে না। অবসর সময়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

ভয়, আতঙ্ক, সংকোচ এগুলি অপরাধী মনের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তিতে শ্রীজীব নিজেকে আত্মগোপন করে রাখে। তরুণদাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। মরেছে জল্লাদেরা। জল্লাদের হাতে দেবতাদের মৃত্যু হয় না। ইচ্ছা মৃত্যুতেই তাদের পরিণতি ঘটে। তরুণদার প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি শ্রীজীবের মনের দৃঢ়তা আনে। সেই দৃঢ়তায় মনের সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তরুণের পায়ে মাথা নীচু করে বসে। তরুণদা আমাকে শাস্তি দাও। আমি মাফ চাই না। যে অপরাধ আমি করেছি তার ক্ষমা হয় না। তরুণের শান্ত স্নিগ্ধ মমতা যেন শ্রীজীবের উপর বর্ষিত হয়, বাইরে কৃত্রিম ক্ষিপ্রতায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে– ওঠ শালা মাকড়া, ঘাপলা করে এসে ন্যাকামি মারাচ্ছে। কি এমন দরকার পড়ল, কত টাকা নিয়েছিস? ওদের তুই চিনিস? এবারে তো তোকে সরিয়ে দেওয়ার ছক করছে, সে খবর রাখিস?

– না না বস, টাকা নিইনি। মানে ওরা বলেছিল কাজ হলে টাকা দেবে।

– যাক, খাওয়াদাওয়া করেছিস? শ্রীজীবের মুখে ভাষা নেই। অপরাধীর মতো মাথা নত করে বসে থাকে।

– যা টেবিলের উপর পাউরুটি কলা আছে। খেয়ে নে। শ্রীজীব দুটো থালায় পাউরুটি কলা নিয়ে আসে। একটি তরুণদাকে দেয়, একটি নিজে নেয়।

– তোর মা কেমন আছে?

– ভালো না, সেই জন্যই ওরা বলল, তরুণকে আমাদের হাতে তুলে দে, তোর সব চিকিৎসার খরচ আমাদের।

– গর্ধব, সেটা তো আমাকে বলতে পারতিস।

– তোমার ঋণ আর কত বাড়াব। আমার যে আর মুখ ছিল না।

– তাই বলে আমাকে খরচা করে ঋণ শোধ করবি? এখন তোর বিপদটা ভেবে দেখছিস? তোকে যে ওরা খরচা করে দেবে। শোন, বিলাসপুরে আমার এক বন্ধু আছে। কাল দুপুরের মুম্বই মেলের টিকিট কেটে দিচ্ছি। মাকে নিয়ে ওখানে চলে যা। ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে। আমার সঙ্গে ঋত্বিকের কথা হয়ে আছে। ওখানকার চিরিমিরি কোলিয়ারিতে তোর একটা কাজেরও ব্যবস্থা করে দেবে। আর ড্রয়ারটা খোল, ওখানে লাখ খানেক টাকা আছে। ওই টাকা নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করাবি। এটুকু সময় তোর বাড়ির চারদিকে আমার লোক থাকবে। এখানে তোকে রক্ষা করতে পারব না।

শ্রীজীব যে দেবতাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে গিয়েছিল সেই তাকে মারন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই মহান দায়ভার গ্রহণ করছে। বিপদ যে তার অন্তরস্থলের দেবতাকেও গ্রাস করতে চলেছে। দেবতার নাম সে শুনেছে। চোখে দেখেনি। শুখা নদীতে বান এসেছে। কৃতজ্ঞতার বানে উত্তলিত হয়ে তরুণের পা জড়িয়ে ধরে– তরুণদা, ঠাকুর আমি দেখিনি। তুমিই আমার ঠাকুর। তোমাকে এই বিপদের মধ্যে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারব না। যা হবার হোক। আমি তোমার সাথেই থাকব।

– অনেক ভাট বকেছিস। এবার ওঠ। তোর যে সংসারে অনেক কাজ। আমার সংসারে প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

– কি বলছ, তরুণদা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

– বুঝতে হবে না। অনেক মেগাসিরিয়াল হয়েছে। এবার কেটে পড়। বাড়িতে গিয়ে গোছগাছ কর।

কতদিন ধরে মৃন্ময়ীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পেটে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা সমস্ত শরীরটা নাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই যন্ত্রণা প্রবল হলে আদিত্য কাছাকাছি এক হাসপাতালে মৃন্ময়ীকে নিয়ে যায়। পেশেন্টকে দেখেই ডা. রায়ের সন্দেহ হয়। বায়োপসির রিপোর্ট হাতে আসতেই ডা. রায়ের সন্দেহের অন্ধকার কেটে যায়। রিপোর্ট পজিটিভ। লিভারে ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার। অন্ধকারটা নেমে আসে আদিত্যর জীবনে।

ব্যাংকে যে ক’টা টাকা ছিল প্রাথমিক চিকিৎসাতেই শেষ। মৃন্ময়ীর আয়ুষ্কাল আর কতদিন, সেটা বলবে ভবিষ্যৎ। চিকিৎসার পরবর্তী ব্যয়ভার মেটাবে কীভাবে। সেটা তো গন্ধমাদন পর্বত।

যাদুকরের কেরামতিতে পুতুল নাচে। অর্থের যাদুকর দুর্বল হলে পেশেন্টও অচল হতে থাকে। মৃন্ময়ী ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ে থাকে। দৃষ্টি আবছা হতে থাকে। গলাতে আওয়াজে আর সেই ঝাঁঝ নেই। থেকে থেকে আদিত্যকে প্রশ্ন করে– মেয়েটা ফোন করেছিল গো? আদিত্যের দীর্ঘনিঃশ্বাসের আঁচ মৃন্ময়ী করতে পারেনি। বাইরে কৃত্রিম স্বাচ্ছ্যন্দে উত্তর দেয়– হ্যাঁ করেছিল তো। নানান ঝামেলায় বলা হয়নি। এই তো রাধিকার বাড়ি থেকে আসার পথে হঠাৎই মিঠুর ফোন। তোমার কথা, আমার কথা। পাড়ার সবার কথা। বলছে অফিসে খুব কাজের চাপ। তবে পুজোর সময় আসবে বলেছে। মৃন্ময়ী বাধা দিয়ে বলে– আমার শরীর খারাপের কথা বলোনি তো?– না না ওসব বলিনি। মেয়েটা ওখানে বসে ছটফট করবে। এতগুলি মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে আদিত্যেরও মনটা হিঁচড়ে যাচ্ছিল। বাস্তবটা যে বড়ো নিষ্ঠুর। মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে এই মিথ্যেটাই যে বাঁচার রসদ। কিছুটা হলেও শরীর, মন চাঙ্গা হয়।

বিকেল হলেই রাধিকারঞ্জনের মনটা ছুকছুক করে। চোখ পড়ে দাবার বোর্ডের দিকে। ঘুটি সাজিয়ে বসে থাকে আদিত্যের অপেক্ষায়। আজ কতদিন হল আদিত্য এমুখো হয় না। দাবার নেশা তাকে আদিত্যমুখী করে তোলে। সদর দরজা হাট করা খোলা। মধ্য খাটালে একটা বিড়াল উচ্ছিষ্ঠ যা কিছু ছিল সাবড়ে দিয়ে মৌতাত করছে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। ম্যাও করে নবাগত অতিথির আগমনি বার্তা জানান দিয়ে খাটের তলায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। খাটের উপর গোটা তিনেক বালিশে হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। যে চাউনিতে আলোর রেখা নেই। অন্ধকারের করাল গ্রাস একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে। ভাঙা হাটে প্রেম ভালোবাসা স্নেহের খদ্দেররা এক এক করে সরে যাচ্ছে। এখন আদিত্য শুধুই একা। অকর্মণ্য স্বামী মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর শেষ চিকিৎসাটুকু করতে অপারগ। অসহায় মানুষের চিন্তাটাই একমাত্র অবলম্বন।

দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে হাঁক পাড়ে রাধিকারঞ্জন – আদিত্য, ও আদিত্য ঘরে আছ নাকি? নিস্তব্ধ নিঃস্পন্দ একটা মাত্র অল্প পাওয়ারের ল্যাম্পের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। প্রাণহীন ইটের পাঁজরে চারদেয়ালে আদিত্য যেন বন্দিদশা কাটাচ্ছে। মুখমণ্ডল মনের আরসি। কোটরাগত চোখ, অসংখ্য চিন্তার ভাঁজ জানান দিচ্ছে আদিত্য ভালো নেই। – কি ব্যাপার? কত দিন তোমার দেখা নেই। আদিত্যর সাড়া মেলে না। গায়ে হাত পড়তেই ধড়মড় করে ওঠে। স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। সবটা পারে না। উদ্বিগ্ন অশান্ত মন স্বাভাবিক হতে দেয় না। বয়সের ভারে রাধিকারঞ্জনেরও চেতনার পরিপক্বতা এসেছে। সেই পরিপক্বতায় তার বুঝতে দেরি হয় না।

– কি ব্যাপার, মনে হচ্ছে কোনও গভীর সমস্যায় পড়েছ?– হ্যাঁ ভাই, ভালো নেই। মিঠুর মা হাসপাতালে ভর্তি। উদ্বিগ্ন রাধিকা প্রশ্ন করে– কেন কী হয়েছে? অকারণ গৌরচন্দ্রিকা বাড়ায় না। আর সে মানসিকতাও নেই। সরাসরি বলে– লিভার ক্যান্সার। রাধিকা হতবাক স্তম্ভিত। সে জানে অশান্ত, উদ্বিগ্ন মনকে শান্ত করা যায় না। রাধিকা সে পথে হাঁটেও না। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে। তা চিকিৎসা ঠিকঠাক চলছে তো?

– চলছে, তবে প্রাথমিক পর্বটা মিটেছে। এখন দরকার পরের ধাপ। অপারেশন, কেমো এদিক সেদিক আরও খরচ। এ রাশ তো আমি আর টানতে পারছি না। এখন আমি সর্বশান্ত।

– তা এখনও খরচ কত কিছু জানতে পেরেছ?

– কি জানি, বোধহয় লাখখানেক হবে।

– মিঠুকে খবর দিয়েছ?

এক দীর্ঘনিশ্বাসে বলে– না, আসলে অতদূরে থাকে। তাছাড়া ওখানে ওর কাজের চাপও খুব বেশি। শুধু শুধু ব্যতিব্যস্ত করে লাভ কি বলো ভায়া।

এই দীর্ঘনিশ্বাসই রাধিকাকে জানান দেয় শেষোক্ত মনগড়া মন্তব্য অন্তরস্থলের হতাশার গভীরতা। বড়ো অজান্তে আদিত্যের দগদগে ঘায়ে খোঁচা দিয়ে বসেছে। রাধিকা কথা বাড়ায় না। আজ আসি– বলে রাধিকারঞ্জন রাস্তায় বেরিয়ে আসে।

বৃদ্ধ বয়সের দোসর বড়ো অবলম্বন। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সঙ্গীহীন হতে থাকে মানুষ। সে হতে থাকে নিঃসঙ্গ, একা। এই দোসর তখন পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরতে চায়। এতগুলো টাকার দায়ভার সে বইবে কী ভাবে। ক্লাবের ছেলেদের বলবে? মন সায় দেয় না। আদিত্য তো তাকে দায়িত্ব দেয়ওনি। দিশাহীন, উদভ্রান্তের মতো চলতে চলতে হঠাৎই তরুণের সাথে দেখা হয়।

– পাশে এসো। একটা ভয়ংকর সমস্যায় পড়েছি।

সেটা তো দূর থেকে আসতে দেখেই বুঝতে পারছি। কি হয়েছে?

– আদিত্যের স্ত্রীর শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি। এখন ওর যা অবস্থা, তাতে চিকিৎসাটাও করতে পারছে না। ভাবছিলাম ক্লাবকে জানাব কিনা। মেয়েকে খবর দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই মনগড়া কতগুলো কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল।

– মিঠুর নাম্বারটা, আচ্ছা দেখি বাড়িতে যাই।

– কি মিঠুর নাম্বার। দাঁড়াও। বলে বুক পকেট থেকে একতাড়া চিরকুট বের করে খুঁজে খুঁজে নাম্বারটা দিয়ে বলে– দ্যাখো, নবাব নন্দিনীর নাগাল পাও কিনা।

নাম্বারটা পকেটে গুঁজেই বলে– আমাকে দুটো দিন সময় দিন। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি রাধিকাবাবু, এ চিকিৎসার খরচ আমিই দিতে পারতাম। আপনি তো জানেন আমার রোজগার সবই পাপের টাকা। বউদি বাঁচবেন কিনা জানি না, পাঁক তাঁর গায়ে লাগাতে চাইছি না।

তরুণ সময় নষ্ট করে না। মিঠুকে ফোন লাগায়। সেই ফাটা ক্যাসেট– অল লাইনস আর বিজি। তরুণ নাছোড়। হতাশায় শ্রান্ত হওয়ার ধাতুতে সে গড়া নয়। অবিশ্রান্ত ডায়াল করতেই থাকে। আচমকাই রিং বাজতে থাকে। শুখা নদীতে যেন জলের সঞ্চার ঘটে। প্রাচুর্যের মসনদে আসীন হলে কণ্ঠস্বরে আলাদা গাম্ভীর্য আসে। রুচি, চালচলনে সর্বত্র লেগে থাকে পরিবর্তনের ছোঁয়া।

– হ্যালো, তরুণ ভীত নয়। মনের দৃঢ়তাই শক্তি যোগায়। অথচ স্নেহশীল বাপের মতোই আর্জি জানায়– হ্যালো মিঠু? আমাকে চিনতে পারছিস মা, আমি তোর তরুণ কাকা।

– ও হ্যাঁ, বলো, বাবা-মা কেমন আছে, তুমি কেমন আছ? পাড়ায় সবাই? দাঁড়া দাঁড়া একবারে এত প্রশ্ন করিস না, সব গুলিয়ে যাবে। ফোনটা ছাড়িস না। আমার কথা, পাড়ার কথা ছাড়, তোর বাপ মায়ের খবরটা নিস। তারা কেমন আছে?

– কাকু, এখন আর আপশোশ করে কি হবে বলো? বাবা যে আমায় এই জায়গায় আসতে বাধ্য করেছে। এটা তো আমি চাইনি। প্রচুর টাকার বিনিময়ে কোম্পানি আমার চব্বিশ ঘণ্টাই কিনে নিয়েছে। আমার পার্সোনাল লাইফ বলে যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। যাক মা-বাবা এখন কেমন আছে?

– ভালো নেই। তোর মায়ের শরীর খুব খারাপ। লিভার ক্যান্সার। চিকিৎসার সামর্থ্যও তোর বাবার নেই। বলিস তো চাঁদা তুলে তোর মায়ের চিকিৎসা করাই।

– সে কি? বাবা একটু আমাকে জানাতে পারত।

– তোর বাবা ফোন করে করে হতাশ হয়ে অভিমানে ফোন করা ছেড়ে দিয়েছে।

– কাকু বাবার অ্যাকাউন্ট নাম্বার আমার জানা আছে। আজকেই আমি দশ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তুমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসা করাও। লাগলে আরও পাঠাব। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি দেশে ফিরব।

টাকা এল। চিকিৎসাও হল। পেল না অন্তরাত্মার পদধ্বনি। সেই অন্তরাত্মার অভাবে শেষ জীবনীশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। এ রোগের শেষ পরিণতি বড়ো মর্মান্তিক। সেই মর্মান্তিকতার চরম মুহূর্তের আগে পর্যন্ত ঝাপসা স্থির দৃষ্টিতে শুধু একটাই প্রলাপ

– মিঠুর ফোন পেলে গো? আমার শরীর খারাপের কথা বলোনি তো। ও যে বড়ো কষ্ট পাবে। মিথ্যে আশ্বাস পাথেয় করে মৃন্ময়ী ভোরবেলা চলে গেল।

আজ সতেরোই শ্রাবণ। ঘন কালো মেঘে আকাশটা নীচে নেমে এসেছে। প্রকৃতির অশ্রুধারা দু’কূল প্লাবিত করছে। সে অশ্রু মোছাবার কেউ নেই। এই কালান্তক দিনটি তরুণের বড়ো একার। একা কাঁদবার দিন। মালা, ফুল, চন্দনে অপরূপ সাজে সেজেছে। আজ যে মা-মেয়ের জন্ম মৃত্যু দিন। ভরপেট্টা মাল টেনেছে এই উৎসবে। বেসামাল তরুণ মা-মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অবুঝ বালকের মতো প্রশ্ন করে– আমাকে এভাবে ঠকালি কেন বল তো? এখানে ফেলে রেখে তোরা সুখে আছিস তো? এবার তরুণ আর সামলাতে পারে না। দু-চোখ বেয়ে অবিরত ধারা বেয়ে আসে। একটু থেমে বায়না করে– আমাকে তোরা নিবি? এ শরীরের বোঝা আর যে টানতে পারছি না। রূপাঞ্জনার প্রতিকৃতি জীবন্ত মূর্ত প্রতীক হয়ে আর্জি মঞ্জুর করে– চলে এস বাবা। ওখানে যে তুমি পাঁকে তলিয়ে যাচ্ছ। তিনদিন পর বাড়িটার ভেতর থেকে পচা দুর্গন্ধ এলাকা ভারী করে তুলল।

মালতিটা কাজ করে ভালো। বাসন মাজা, রান্না করা, কাপড় কাচা, দাদুর স্নানের জল তোলা। এসব কাজে খুঁত রাখে না। তবে একটু টকেটিভ। চান্স পেলেই ডিভিডি চালাবে। আদিত্যর অসুবিধা হয় না। বোবা ঘরে তবু একটা কথা বলার লোক তো আছে। যতক্ষণ থাকে ঘরটা কথাময় করে রাখে। আদিত্য খাটে শুয়ে খবরের কাগজটা সামনে নিয়ে পুরু লেন্সের চশমাটা নাকের ডগায় রেখে রাজনীতির দুবৃত্তায়ন হজম করছিল। মালতি বাইরে থেকে ছুটতে ছুটতে এসে আদিত্যকে সংবাদটা দেয়– দাদু বাইরে বিশুর চায়ের দোকানে চ্যাঁচামেচি হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ না?

আদিত্য ভাবলেশহীন কৌতুক প্রকাশ করে বলে– কই না তো।

– সে কি, কত লোক জড়ো হয়েছে, তুমি শুনতে পাচ্ছ না?

– তাহলে চ্যাঁচামেচিটা বোধহয় আস্তে আস্তে হচ্ছে। একরকম জোর করে মালতি আদিত্যকে বাইরে টেনে আনে।

দিশেহারা ভীত সন্ত্রস্ত চান্দ্রেয়ী কোলের ছেলেটাকে বিশুর চায়ের দোকানে বসায়। বাচ্চাটা ক্ষিদের ক্লান্তিতে কেমন নেতিয়ে পড়ে। চান্দ্রেয়ী এ ব্যাগ সে ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট দলা পাকানো বিস্কুট বের করে। বিশুর দিকে তাকিয়ে করুণ ভাবে বলে– দাদা এক গেলাস দুধ দেবেন? বিশু না করে না। দুধ বিস্কুট খেয়ে শক্তি ফিরে পায়। স্বভাবসিদ্ধ চরিত্রে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। উদ্দেশ্যবিহীন চান্দ্রেয়ীকে বাঁশের খুটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বিশুর কৌতুহলী মন জিজ্ঞাসা করে– এই মেয়ে তোমার নাম কি? চান্দ্রেয়ী নির্বাক। তুমি কোথায় থাকো? মনের বিভ্রান্তি তাকে আড়ষ্ট করে রাখে।

– আরে এ মেয়ে তো কোনও কথার উত্তর দেয় না। তোমার স্বামীর নাম কি? কোনও উত্তর না পেয়ে বিশুর মেজাজ এবার সপ্তমে।

– দুধ চাইবার বেলা তো বেশ কথা ফুটছিল। দাও তো বাপু, পয়সাটা দাও। লেডিস ব্যাগটা খুলে এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে করুণভাবে চান্দ্রেয়ী বলে,

– দাদা পয়সা যে নেই।

– সেটা তো আগে বলতে হয়। আগে বললে বাচ্চাটার জন্য বিশু দুধ দিত কি আদৌ দিত না সে প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু পাড়ার চায়ের দোকানে তার বচনে লোক সমাগমের সূত্রপাত এখানেই। আদিত্য কাছে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে– বাপু তোমরা একটু সরো তো। মেয়েটা আসলে ঘাবড়ে গেছে। আদিত্যকে এ পাড়ার লোকজন কতকটা বয়সের কারণে কতকটা সজ্জন ব্যক্তিত্বের কারণে মান্য করে। তারা একে একে সরে যায়। বেশি দূর যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে।

– এ-ই মেয়ে তোমার নাম কী? স্নেহমাখা এই প্রশ্নে পিতৃমাতৃহীন মেয়েটা বাপের অজস্র স্নেহ ধারা বইতে থাকে। মেয়েটার মুখে কথা ফোটে– চান্দ্রেয়ী মিত্র।

– বাড়ি কোথায়?

– রায়গঞ্জ, বকুলপুর।

– থানা পোস্টঅফিস জানা আছে?

– না তা তো জানি না।

– তোমার স্বামীর নাম কি?

রজতশুভ্র মিত্র।

– মোবাইল নাম্বার আছে

– না, আমার মোবাইলটাও তো ফেলে এসেছি।

– তাহলে এভাবে তো কারও হোয়্যার এবাউটস জানা যাবে না। তুমি চাইলে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো। আমার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েমানুষ এখন কোথায় যাবে? তারপর দেখছি কী করা যায়। স্বামীর সাথে মান-অভিমানের পালা চলছে? পাগলি মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান মনোমালিন্য এসব হয়ই। তাই বলে এভাবে নিরুদ্দেশের পথে কেউ পা বাড়ায়? আর দেরি কোরো না, চলে এস। পালহীন নৌকো তীর খুঁজে পেয়েছে। দেবদূতের মতো সন্তানস্নেহে যে মানুষটা তাকে আশ্রয় দিতে চাইছে, সে যে তার বাবারই সমগোত্রীয়।

আদিত্য বুড়োর একাকিত্ব ঘুচেছে। চান্দ্রেয়ী, মালতির সেবাযত্নে নিভে যাওয়া প্রদীপের সলতে আবার তিরতির করে জ্বলে উঠেছে। আর ছোট্ট শিশুটির আধো আধো বুলিতে গোটা বাড়িটা বর্ণময় করে তুলছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে

– দাদুভাই তোমার নাম কি?

– ছিচন মিত্ত।

চান্দ্রেয়ী শুধরে দেয়– বলো দাদুভাইকে সিঞ্চন মিত্র। ছোট্ট কথাকলির দস্যিপনায় বুড়ার হাড়গোড়ের মরচেগুলো ছাড়তে শুরু করেছে। কখন যে সকাল গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে আসছে, সে হিসেবের খাতা খোলার বুড়োর সময় নেই। হঠাৎই কাগজে নিরুদ্দেশের প্রতি, এক বিজ্ঞাপনে আদিতের নজর পড়ে। আদিত্যের বুঝতে অসুবিধা হয় না। পোস্টআফিসে চিঠিখানা ড্রপ করে দিন গুনতে থাকে। প্রদীপের তেল একটু একটু করে নিঃশেষিত হচ্ছে। জেগে ওঠা দীপ্তিময় জীবনে রাতের আঁধার নেমে আসছে।

সিঞ্চন বাইরের বারান্দায় খেলা করছিল। বলে ওঠে– বাবা বাবা। বাসন মাজতে মাজতে মালতি ঘরে ঢুকে বলে– দাদু, বাইরে কে একজন তোমার কাছে এসেছে।

– ও এসে গেছে। ঘরে আসতে বল। রজত ঘরে ঢুকেই আদিত্যকে প্রণাম করে। আদিত্যর অনুমতিতে বসে। এদিক-ওদিক তাকায়।

– তাহলে তুমিই রজতশুভ্র মিত্র।

– আজ্ঞে হ্যাঁ

– বেশ। মালতিকে উদ্দেশ্য করে বলে। – মালতি, চান্দ্রেয়ীকে ডেকে দে তো মা। রজতকে দেখে তার দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে। এ অশ্রুবর্ষণের গভীরতা বহুদূর বিস্তৃত। স্বামী দর্শনের ভিতর থেকে নির্দিষ্ট হয়ে যায়, যে সংসারের প্রদীপ সে তুচ্ছ অভিমানে নিভিয়ে এসেছিল, সেই প্রদীপ আবার জ্বেলে সংসারকে সে আলোকিত করবে। এক চোখে বইছে অনাবিল আনন্দের অশ্রুধারা, আর ওই যে অসহায় বৃদ্ধ মানুষটা সন্তান বাৎসল্যে, সস্নেহে এই কটাদিন লালিত করেছে, নাতিকে পেয়ে জীবনের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল, রজতের হাত ধরে বেরিয়ে যেতেই তার প্রদীপের শিখা যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। সে চোখের জল সম্বরণ করা যায় না। আবেগ মানুষের চিরন্তন ধর্ম। সেই আবেগ হাসায়। সেই আবেগ চোখের জলে বুক ভাসায়। আবেগে ছেদ পড়ে আদিত্যের ডাকে– মা রজতকে খেতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করো। ছেলেটা কতদূর থেকে এসেছে। রজতের দিকে তাকিয়ে বলে– তা বাবা আজ রাতটা থেকে কালকে না হয় সকালেই যেও, অতদূরের পথ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রজত বাধা দেয় না।

সেই রাতে আদিত্য বুড়োর প্রবল জ্বর আসে। প্রলাপ বকতে থাকে– দাদু ভাই, আমার ঘোড়াটা দিয়ে যা। আমি যে হেরে যাচ্ছি। খবরটা মালতিই রাধিকারঞ্জনকে দেয়। রাধিকারঞ্জন দেরি করে না। হাসপাতালে ভর্তি করে বাইরে বেরিয়েই মিঠুকে ফোন লাগায়। রিং বাজতেই মিঠু ফোনটা ধরে– হ্যাঁ জেঠু বলো, বাবা, তোমরা কেমন আছ?

– হ্যাঁ মা, এখনও তোর আসার সময় হল না– এবার যে তোর বাবাও চলেছে রে। এক ভয়ংকর অজানা জ্বরে সঙ্গাহীন। জেঠু ফোনটা রাখ, আমি আসছি।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। উদভ্রান্ত উন্মাদের মতো ছুটতে ছুটতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে– বাবা আমি এসেছি। এই দেখো তোমার মিঠু। আর তোমাকে ফেলে যাব না। আদিত্য আবছা প্রলেপে তখনও প্রলাপ বকেই চলেছে– দাদুভাই এলি? ঘোড়াটা দিয়ে যা। আমি যে মাত হয়ে যাচ্ছি। আমাকে যে জিততেই হবে।

দুরন্ত ঘোড়া একসময় শান্ত হয়। প্রাচুর্যের ঢক্বানিনাদে বসে দায়িত্ব, কর্তব্য, মূল্যবোধ, জীবনের সার্থকতার তাৎপর্য সে বুঝতে পারে না। সে তখন ফিরতে চায়। অবহেলায় ফেলে যাওয়া সেই রত্নভাণ্ডারকে সংসারের ধ্বংসস্তূপের ভিতর খুঁজতে থাকে। পায় না। কোনওদিন পাবে কিনা, কে জানে।

কয়েদি

আজকাল শব্দটা সারা দিনরাত মাথার ভিতর বাজতে থাকে। ধুপ ধুপ ধুপ… আওয়াজটা ঘুমের মধ্যেও শুনতে পায় সরতাজ। রাত যত গভীর হয়, চারপাশের ক্রমবর্ধমান নৈঃশব্দের সাথে সাথে শব্দটার তীব্রতাও বাড়তে থাকে। মাথার ভিতরকার স্নায়ুগুলি যেন সব জট পাকিয়ে গেছে, মুক্তির আশায় প্রাণপণ টানছে, ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে মাথার খুলি ভেদ করে। একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে সরতাজ। একটা ঘোরতর বিস্ফোরণ প্রয়োজন, যেটা তার নামের জায়গায় সেঁটে থাকা নম্বরটাকে ধ্বংস করে দেবে।

সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব প্রদেশ। শব্দবন্ধগুলো মনে হয় যেন গত জন্মের কোনও বিস্মৃতপ্রায় অতীতের ছায়া। এখন সরতাজ শুধুই কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ। দিনের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা জেলের কমিউনিটি কিচেনের রাবণের চিতার মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে পাহাড়প্রমাণ ডেকচিতে ডাল সবজির জাউ রাঁধে সরতাজ। গনগনে ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে সরতাজ সিং-এর। সেই ধোঁয়ার ভিতরে কখনও কখনও একটা চেনা মুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়।

বড়ো আবছা সে মুখ, এখন আর মনে পড়ে না স্পষ্ট। শুধু সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে ঝিকিয়ে ওঠা নাকছাবিটা স্পষ্ট দেখতে পায় সরতাজ। লম্বা ভারী হাতাটা ডালের ভিতর চালাতে চালাতে মাথার ভিতরটা প্রাণপণে হাতড়াতে থাকে সে। দরদর করে লবণাক্ত ঘাম গড়ায় তার মাথা, গলা, বুক, পিঠ বেয়ে জিভে ঠেকে নোনতা স্বাদ। সরতাজ এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির তন্ত্রী ঘেঁটে চলে। কবে কোথায় পথের কোন বাঁকে দেখা হয়েছিল সেই চেনা মুখের সাথে, কিছুতেই মনে পড়ে না।

এগারো বছর কম সময় নয়। সরতাজ সিং এগারোটা বছর এই জেলের উঁচু দেয়ালের ও-প্রান্তের পৃথিবীকে দেখেনি। আজকাল আর মনে পড়ে না বাইরের পৃথিবীর কথা। মাথার ভিতরে সব যেন ধোঁয়াটে লাগে। বেশি ভাবতে গেলে মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। দীর্ঘদিন ধরে জেলের ভেতরে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চলেছে তার উপরে।

জেলের ডাক্তারসাহেব বলেছেন, সরতাজ সিং-এর মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্মৃতিশক্তির উপর ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার অস্বচ্ছ আবরণ। আজকাল মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তখন। বয়স বাড়ছে সরতাজ সিং-এর। তার পাহাড়ের মতো বিশাল দেহটা দেখে নতুন কয়েদিরা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকায়, পুরোনোরা মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে মাথা নাড়ে। আহা, এই সরতাজ সিং-এর নামে একদিন গোটা ফিরোজপুর জেলা কাঁপত। কত যে খুন জখম তোলাবাজির কেস ছিল তার নামে, সে হিসাব বোধ করি সে নিজেও রাখত না। ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল সকলেই সমীহ করে চলত এই সরতাজ সিংকে।

সরতাজ সিং-এর কোনও দলের দরকার হতো না, দলেদের দরকার হতো তাকে। সে নিজেই ছিল একটা প্রতিষ্ঠান। সেসবও দিন ছিল, যখন সরতাজ সিং ছিল ফিরোজপুরের মুকুটহীন সম্রাট।

আজ আর সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। সরতাজ সিং-এর সিংহের কেশরের মতো দাড়িতে পাক ধরেছে। কালোর মাঝে মাঝে রূপোলি রেখা ভেসে উঠেছে। তার সেই আগেকার রুক্ষ কঠোর দৃষ্টি আজকাল কেমন যেন ক্লান্ত, করুণ দেখায়। কখনও কোনও অলস বিকেলে জেলের হেঁশেলের বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করে চলে সরতাজ। কী যে বলে, কাকে দোষারোপ করে কে জানে!

নিজের হাতের তালু উলটেপালটে দেখে। কী যেন খুঁজে চলে খাঁজে কড়া পড়া দুই হাতের রেখায়। কখনও আবার গলা ছেড়ে গান ধরে পঞ্জাবের মাটির সুরে। অন্য কয়েদিরা আসা যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়ায় কিছু মুহূর্তের জন্য। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেই গান কান পেতে শোনেন আরেকজন, তিনি জেলর গগনজিত কপূর। মাথার ভিতরে সেই সুর গুমরে মরে তাঁরও। সরতাজ সিং-এর গান শুনে তিনিও ফিরে যান তাঁর ফেলে আসা অতীতে।

ভাতিন্ডা থেকে ফিরোজপুরে বদলি হয়ে এসে সরতাজ সিং-এর নাম কানে আসতে দেরি হয়নি গগনজিত কপূরের। তাঁকে এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জলে বাস করে কুমীরের সাথে শত্রুতা চলে না। সরতাজ সিংকে ভয় পায় না, এমন লোক ফিরোজপুরে নেই। সুতরাং নবাগত অফিসারকে যে সরতাজকে ভয় হোক বা সমীহ, কিছু একটা করতেই হবে তা তো বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

গগনজিত কপূরও শুরু শুরুতে সরতাজ সিংকে সমঝে চলার চেষ্টাই করেছিলেন। দেশি কাট্টা, ম্যাগাজিনের অবৈধ চোরাচালানের বিশাল রমরমা ব্যাবসা ছিল সরতাজ সিং-এর। পুলিশ, প্রশাসন সবাই ছিল তার হাতের মুঠোয়। ভোটের আগে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, দুই দলের ফান্ডেই সরতাজ সিং-এর অনুদান জমা হতো। সাথে তাদের হাতে হাতে ঘুরত সরতাজ সিং-এর কারখানায় তৈরি দেশি অস্ত্র। দুই হাতে জলের মতো টাকা ছড়াত সরতাজ। নেতা মন্ত্রীরাও ছিল তার কৃপাধন্য। সরতাজ সিং-এর হাত যার মাথার উপর, গদিও তারই খাতে বরাদ্দ হতো।

কিন্তু দিন কারও একরকম যায় না। কোন ছিদ্রপথে সরতাজ সিং-এর ইস্পাত-দৃঢ় হৃদয়ে ভিতর এক চিলতে তুলতুলে নরম দুর্বলতা গোপনে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছিল, তা সে বোধ করি নিজেও জানতে পারেনি। নইলে সরতাজ সিং-এর কি নারীর অভাব? এতদিন যারা তার বিছানা গরম করেছে, তারা তো সরতাজ সিং-এর সামান্য ইশারার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। প্রেম ভালোবাসার মতো দুর্বলতা তার ছিল না কোনও দিন। আর ঠিক সেই কারণেই সে ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু তারপর একদিন সব ওলোট পালট হয়ে গেল হঠাৎই। সরতাজ সিং প্রেমে পড়ল।

গগনজিত কপূর উঠে গিয়ে খোলা জানলার সামনে দাঁড়ালেন। বাইরে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। বৃষ্টির ছাঁট সূচের মতন এসে বিঁধছে তাঁর চোখেমুখে। তবু জানলাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না। সরতাজ সিং আজ আবার গাইছে। বুকের ভিতরকার কোন চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা তীব্র যন্ত্রণা গলে গলে মিশছে সেই সুরে। জেলখানার উঁচু প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে সেই সুর, অনুরণিত হচ্ছে এক সুতীব্র হাহাকার। গগনজিত বেশ শব্দ করে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। ঠিক যতটা জোরে শব্দ হলে সংগীতের শব্দ ভেঙে চুরে যায়, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করলেন তিনি। বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছে। চেয়ারে বসে দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরলেন জেলরসাহেব।

চাঁদনি মেয়েটা চাঁদের মতোই সুন্দর ছিল। সহজ সরল পঞ্জাবি মেয়ের মদ-মাতাল হাড়বজ্জাত বাপটা মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মেয়ের বিয়ে দিয়ে কিছু আদায় উশুল করে নেবার ধান্দায় ছিল বুড়ো। অন্তত এমন চটকদার মেয়ের পরিবর্তে কয়েক মাসের মতো পাঁইটের ব্যবস্থা তো হয়ে যেত।

বস্তিতে লুকোনো চোরাই মালের রেড করতে গিয়ে চাঁদনির দেখা পেয়েছিলেন গগনজিত কপূর। কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি স্থির হয়েছিল মেয়েটার মুখে। অভিজ্ঞ দৃষ্টি বুলিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন, একে দিয়ে তাঁর কাজ হবে। এই মেয়ে হবে তাঁর টোপ। সরতাজ সিংকে বঁড়শিতে গাঁথতে পারলে প্রোমোশন তাঁর পাকা, কেউ আটকাতে পারবে না। শুধু প্রোমোশনের লোভ নয়, সরতাজ সিং-এর মতন সাক্ষাৎ শয়তানকে শিক্ষা দেওয়ার একটা সুতীব্র ইচ্ছে পেয়ে বসেছিল তাঁকে।

পুলিশের উর্দি গায়ে চাপিয়ে শয়তানটাকে সেলাম ঠোকার অসহায়তা আর সহ্য হচ্ছিল না। চাঁদনির বাপটাকে টোপ গেলাতে অসুবিধে হয়নি। টাকা আর মদের বোতল পেয়ে বুড়ো খুশি মনে কন্যেকে জবাই হতে পাঠিয়েছিল। চাঁদনি বুড়ো বাপের হাতে পায়ে ধরেছিল, বুড়োটা দুবার হ্যাট হ্যাট করে লাথি মেরে টলতে টলতে গুনগুন করে গান ধরে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল সেদিন। একবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি মেয়ের দিকে।

সরতাজ সিং-এর মতো পাক্কা খেলুড়েও চাল চিনতে ভুল করেছিল। চাঁদনিকে নিজে হাতে করে ট্রেনিং দিয়েছিলেন গগনজিত কপূর। একটা সোজা সরল বস্তির মেয়েকে ঘষে মেজে পুলিশের চর হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু কপূরসাহেব সেই অসাধ্যই সাধন করেছিলেন। সরতাজ সিংকে প্রেমের জালে জড়িয়ে তার সব গোপন খবর তুলে দিতে হবে পুলিশের হাতে। খুব অল্প সময়ে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি, হয়ে উঠেছিল পুলিশের শিক্ষিত চর। সে তখনও জানত না, কোন কাজের জন্য তৈরি করা হচ্ছে তাকে। নির্মোহ, বীতস্পৃহ মন নিয়ে খুব অল্প সময়ে মধ্যে সব শিখে নিয়েছিল চাঁদনি।

সময় থেমে থাকে না। সরতাজ সিং-এর দিকে চাঁদনিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা নাটকের দরকার ছিল, সেটাও মসৃণ ভাবে উতরে গেছিল। মাঝরাত্তিরে কোনও অনাথিনী যদি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে পালিয়ে সরতাজ সিং-এর আশ্রয় ভিক্ষা করে, সর্বশক্তিমান সরতাজ কি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? সরতাজ সেই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারেনি, ত্রস্ত চড়ুই পাখির মতো তিরতির করে প্রাণভয়ে কাঁপতে থাকা মেযেটা শুধুই অভিনয় করছে। কিংবা হয়তো সত্যিই সে অভিনয় করছিল না। সরতাজ সিং-এর মতো ভয়ংকর মানুষের হাতে নিজেকে তুলে দেওয়ার মুহূর্তে নরম মেযেটা হয়তো সত্যিই শঙ্কা, লজ্জায় কেঁপে উঠেছিল।

হায় মোহ! মোহের কারাগার থেকে নিজেকে রক্ষা করা কি আর এতই সহজ? ইতিহাস সাক্ষী, এই রিপুর কারণে বারবার রক্তক্ষয় হয়েছে, বদলে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র। দুটি মানুষের বুকেও মোহের প্লাবন উত্তাল হয়ে উঠছিল সেই দিনগুলোয়। ভযংকর সরতাজ, কুখ্যাত সমাজবিরোধী সরতাজ, যার ভয়ে সারা ফিরোজপুর কাঁপে, শিশুর মতো হৃদয়ে আশ্রয় খুঁজে চলেছিল আরেকটি হৃদয়ে একটা সাধারণ মেয়ের প্রতি অন্ধ মোহ ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছিল তাকে। আর আরেকজন, যিনি নিজের হাতে চাঁদনিকে তুলে দিয়েছিলেন শয়তানের হাতে, তাঁরও বুকের ভিতর যে কী ভীষণ ঝড় চলছিল, তা সেদিন আর কেউ জানতে পারেনি।

একদিকে চাঁদনির প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ, অপরদিকে তাঁর কর্তব্য, প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় করছিল তাঁকে। কখনও মনে হতো, থাক আর দরকার নেই, ফিরিয়ে নিয়ে আসি তাকে। আবার মনে হতো আর তো মাত্র কটা দিন। চাঁদনি তার দায়িত্ব সুচারুরূপেই পালন করে চলেছে। গত দুই মাসে সরতাজের একখানা বড়ো কনসাইনমেন্ট ধরা পড়েছে। আরও কিছু মালপত্র উদ্ধার হয়েছে সীমান্তের গ্রামগুলি থেকে। সরতাজ সিং-এর ব্যাবসায় একটা বড়োসড়ো ধাক্কা দেওয়া গেছে। এইখান থেকে ফিরে আসা যায় না।

হায়, যদি সেদিন তিনি ফিরিয়ে আনতেন চাঁদনিকে। গত এগারো বছর ধরে এই প্রশ্নটাই নিজেকে বারবার করেছেন গগনজিত কপূর। কেন? কীসের পেছনে ছুটছিলেন তিনি? কী পেতে চেয়েছিলেন? সরতাজ সিং-এর মতন পাষণ্ডের দিকে সব জেনেশুনে কেন ঠেলে দিয়েছিলেন চাঁদনিকে? আর চাঁদনি? তাকে তো তিনি নিজের হাতে দক্ষ চর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের হাতে যত্ন করে শিখিয়েছিলেন চরবৃত্তির প্রথম আবশ্যিক পাঠ, একজন সুদক্ষ চরের হৃদয় থাকতে নেই। প্রেম, দয়া-মায়ার মতন হৃদয়াবেগের কোনও জায়গা নেই সেই কাজে। সে কী করে এত বড়ো ভুল করল? বোকা মেয়েটা কী করে সরতাজ সিং-এর মতো একটা পাষণ্ডের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল?

এরকমই ভাবেন গগনজিত কপূর, ভাবতে ও বিশ্বাস করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। হয়তো নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার এই চেষ্টাটাই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন গত এগারোটা বছর ধরে। ভেবে শান্তি পান যে, চাঁদনি সত্যিই ভালোবাসেনি সরতাজকে। শুধু ক্ষণিকের জন্য আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। সরতাজ ওকে মিথ্যে প্রেমের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল, বোকা মেয়েটা একটা ভুল করেছিল। নইলে সরতাজের প্রেমে পড়তে পারে না সে। চাঁদনি শুধু তাঁর, গগনজিত কপূরের। নিষ্ফল আক্রোশে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন গগনজিত।

চাঁদনির তরফ থেকে সবরকম খবরের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছিল। নরম কোমল মেযেটা নাগিনির মতো ফোঁস করে মাথা তুলেছিল। তেজোদৃপ্ত স্বরে গগনজিত কপূরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জানিয়েছিল, আর কোনও ভাবেই সরতাজের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করা যাবে না। সরতাজকে সে ভালোবাসে।

ভালোবাসে! এত বড়ো কথা? চাঁদনি সরতাজ সিংকে ভালোবাসে? একটা সমাজবিরোধী, দাগি অপরাধী, সাক্ষাৎ শয়তানের দূত, চাঁদনি নাকি ভালোবাসে তাকে! সারা শরীরের রক্ত প্রবল বেগে মস্তিষ্কের দিকে ছুটতে থাকে গগনজিত কপূরের। প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠেন তিনি। চাঁদনিকে যে-নরক থেকে তুলে এনেছিলেন তিনি, সেখানকারই যোগ্য সে। নইলে স্বেচ্ছায় কেউ সরতাজ সিং-এর কণ্ঠলগ্না হতে চায়?

ছি ছি, একটা নরকের কীট, সে কি না দংশন করবে গগনজিত সিং-এর বাগানের ফুলকে! সেই মুহূর্তে তিনি ভুলে যান, তিনি নিজেই তো সেই উদ্দেশ্যে চাঁদনিকে পাঠিয়েছিলেন সরতাজ সিং-এর কাছে। ভুলে যান, তখন চাঁদনি তাঁর কাছে ছিল শুধু তাঁর উদ্দেশ্যপূরণের, উপরে ওঠার সিঁড়ি। নিস্ফল আক্রোশে নিজের হাত কামড়াতে থাকেন গগনজিত কপূর।

সরতাজ সিং তার জীবনে মেয়েমানুষ কম দেখেনি। তবে এতদিন নারীদেহ তার কাছে শুধুই ছিল ভোগের উপকরণ, রাত শেষ হলে উচ্ছিষ্টের মতন যাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা যায়। কিন্তু চাঁদনি মেযেটা অন্যরকম। আজকাল সরতাজের একটা সুস্থ জীবন পেতে খুব ইচ্ছে করে। একটা সুখী গৃহকোণ, চাঁদনিকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতি বড়ো লোভ হয় সরতাজের। প্রথমবার কোনও নারীকে তার শুধু শরীর নয়, আস্ত একটা মানুষ বলে মনে হয়। যার নরম চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা জীবন।

চাঁদনিকে নিয়ে এই ফিরোজপুর, এই অপরাধের জগৎ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে সরতাজ। এখানে থাকলে তার অপরাধ, তার কলঙ্কিত অতীত, তার পিছু ছাড়বে না। চাঁদনিও তাই চায়। অর্থের অভাব নেই তার। দুজনে মিলে নতুন কোনও জায়গায় তাদের সুখের নীড় গড়ে তুলবে। ভাবতে ভাবতে তৃপ্তিতে সরতাজ সিং-এর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়। বক্ষলগ্না প্রেয়সীর কপালে চুমু খায় স্নেহভরে।

 

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। দীর্ঘ জ্যৈষ্ঠদিনের শেষের এই বৈকালিক বর্ষণ শীতলতার পরশ বুলিয়ে গেছে তাপদগ্ধ মৃত্তিকার বুকে। কিন্তু দীর্ঘ এগারো বছর ধরে যে-প্রচণ্ড দাহ চলছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর, তা নিভবে কোন শান্তিজলে?

সন্ধ্যা নেমেছে। সরতাজ সিং-এর গান থেমে গেছে কখন। কয়েদিদের নম্বর মিলিয়ে একে একে সেল-এ ঢোকানো হচ্ছে। সেদিনও এমনই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা ছিল। দিন শেষে আজকের মতোই বৃষ্টি হয়েছিল সেদিনও। গোটা ফিরোজপুর শহরটা সেদিন সেজেছে আলোর মালায়। সরতাজ সিং-এর বিয়ে বলে কথা, উত্সবই হবে বই কি।

পুলিশ চৌকির নিঃসঙ্গ কেবিনে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করে চলেছিলেন গগনজিত কপূর। আহ্, অপেক্ষার প্রহর কী দীর্ঘ! আজ চাঁদনি ফিরে আসবে, বিয়েবাড়ির আলো নিভে যাবে, বাজনা থেমে যাবে। সরতাজ সিং-এর মোহজাল ছিন্ন করে চাঁদনি ছুটে আসবে গগনজিতের কাছে, তাঁর বাহুডোরে ধরা দেবে তাঁর প্রেয়সী।

এতক্ষণে তো সরতাজ সিং-এর কাছে খবর পৌঁছে যাওয়ার কথা। যাকে ভালোবেসে সরতাজ সিং জীবনসঙ্গী বানাতে চলেছে, সে শুধুমাত্র একজন পুলিশের চর। আগাগোড়াই মিথ্যে দিয়ে সাজানো, পুরোটাই তার অভিনয়। নিজের মনেই একা বসে মিটিমিটি হাসতে থাকেন কপূরসাহেব।

জলদি চলুন স্যার, সরতাজ সিং তার হবু স্ত্রীকে বিয়ে মণ্ডপ থেকে তুলে টানতে টানতে জিপে বসিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে। মেয়েটাকে কিছু করে না ফেলে।

খবরটা পেয়ে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছিল গগনজিত কপূরের। প্রাণপণ দ্রুতগতিতে গাড়ি ছুটিয়েছিলেন তিনি। তবু দেরি হয়ে গেছিল, খুব দেরি হয়ে গেছিল সেদিন। গিয়ে কী দেখেছিলেন তিনি? চাঁদনির রক্তাক্ত নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। সরতাজ সিং একটা ভারী কাঠের বাটাম দিয়ে তার গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে, ভোঁতা শব্দ হচ্ছে, ধুপ ধুপ ধুপ…।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সরতাজ সিং-এর চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আট দশজন সেপাই মিলেও ধরে রাখতে পারছিল না তাকে। পাগলের মতো চিত্কার করে চলেছিল সরতাজ সিং, কেন? কেন? কেন? সেই চিত্কার কপূরসাহেবের কানে সেদিন হাহাকারের মতো শোনাচ্ছিল। দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছিলেন তিনি।

এগারো বছর কেটে গেছে। ফিরোজপুর ছেড়ে আর যাওয়া হয়নি গগনজিত সিং-এর। ওপরতলায় সমস্ত যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে এই জেলেই রয়ে গেছেন তিনি। পদটা হয়তো জেলার কিন্তু তিনি নিজে জানেন, সরতাজের মতন তিনিও কয়েদি এখানে! চাঁদনি এক অদৃশ্য সম্পর্কে বেঁধে দিয়ে গেছে তাঁদের দুজনকে। এই তাঁদের শাস্তি। সরতাজকে ঘৃণা করেন তিনি, প্রবল ঘৃণা। আর সেই ঘৃণাই এগারো বছর ধরে চাঁদনিকে বাঁচিয়ে রেখেছে গগনজিত কপূরের বুকের ভিতর।

স্যারজি, জলদি আসুন, জেলের নিরাপত্তারক্ষীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন জেলরসাহেব। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তার দিকে।

কী হয়েছে?

স্যার, কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ…, বলে থেমে যায় নিরাপত্তারক্ষী।

কয়েদি নম্বর একশো সাইত্রিশ, সরতাজ সিং, গাঁও সুলহানি, জেলা ফিরোজপুর, পঞ্জাব, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে জেলের হেঁশেলের বারান্দায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। যেন অনেকদিন পরে স্মৃতির আস্তর সরিয়ে দেখা মিলেছে সেই নাকছাবি ঝিকিয়ে ওঠা নরম মুখের। সরতাজ সিং-এর চোখের দৃষ্টি আজ স্থির, শান্ত। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি মিলেছে এতদিনে।

মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন জেলর গগনজিত কপূর, নিস্পন্দ নিশ্চল। জেলের দেয়ালগুলো যেন কাছে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে, ঘিরে ধরছে তাঁকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন গগনজিত। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু বাতাস চাই তাঁর, একটু বাতাস…

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব