বেলাশেষের বাসনা

সত্যি, পাণ্ডুলিপিটা যে কোথায় গেল!

শুভায়ু বারবার চিন্তা করে। ওর চেন-আঁটা শান্তিনিকেতন ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সবমিলে পনেরোটা গল্পের পাণ্ডুলিপি ছিল একসঙ্গে।

সবগুলোই জেরক্স কপি। শুধুমাত্র একটাই হাতে লেখা… আর সেটাই হারিয়ে গেছে।

আসলে একটা ফাইল নেওয়া হয়নি সেটাই ভুল হয়ে গেছে। বড়ো একটা বাদামি রঙের প্যাকেট বা বড়ো খাম, তাতে ঠাসাঠাসি করে কাগজগুলি ছিল। প্যাকেটের মুখ একটা জেমস্ ক্লিপ দিয়ে আঁটা ছিল।

অথচ কী করে যে পড়ে গেল— আশ্চর্য!

শুভায়ুর একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ পুরোনো ইচ্ছা। সেটা হল একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করা। এটা ও অনেকদিন থেকে ভেবে আসছে।

শুভায়ু যে একজন নামকরা সাহিত্যিক, তা নয়। লেখক হিসেবে মফসসল শহরে দু-চারটে পত্রপত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে আর আসরে এক-আধটা গল্প পাঠ করে যে বিরাট কিছু হওয়া যায় না— তা সে জানে।

তবে যাচ্ছ কেন বই ছাপাতে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসে শুভায়ু। আর উত্তরগুলো একইসঙ্গে আউড়ে যায়। আসলে ছড়ানো ছিটানো গল্পগুলোকে একত্রিত করে পাঁচজনের হাতে দেওয়া। আর এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে একটু কর্পূর সুবাসিত করা।

এছাড়া গতানুগতিক আটপৌরে জীবনে আর কী-ই বা করার আছে?

আরে— আসল কথাটাই বলতে ভুলেছে ও। সেটা হল ও’র অবসরপ্রাপ্ত জীবনে— জীবনবিমার সামান্য কিছু টাকা ম্যাচিওর করেছে। যেটাকে ও সংগোপনে বাড়ির খরচা থেকে খুব কৌশলে সরিয়ে রেখেছে। টাকার অঙ্কটাও সামান্য। ওই সংকলন বের করার মতোই— হাজার ষোলো টাকা। সেটাকেই ও ইদানীং ব্যাঙের আধুলির মতো সম্বল করে প্রকাশনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

এতক্ষণে শুভায়ুর মনে পড়ল – কাল ভোরে ও যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল কলকাতা যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে, তখনই তৃষা মন্তব্য করেছিল, ‘দ্যাখো বাপু, সব ঠিকঠাক গোছগাছ করে নিলে তো? তোমার আবার রাস্তাঘাটে মাথার ঠিক থাকে না।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সেদিন গোছগাছ করে ও হাওড়া লোকাল ধরেছিল… উদ্দেশ্য কলেজ স্ট্রিট-এ কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়া।

নতুন লেখকদের বেশিরভাগ বই-ই গ্যাঁটের পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। এটাই প্রায় দস্তুর হয়ে গেছে। তবু কত রকমের বাহানা – ‘লেখাগুলোর জেরক্স কপি দিয়ে যান— পড়াব, এক্সপার্ট-দের দেখাব।’

শুভায়ু বলেছিল ‘টাকাটা তো আমার। তবে আপনাদের অতশত বাহানা বা খুঁতখুঁতানি কেন?’ প্রকাশকের গদিতে বসে ওর ছোটো ছেলে — যে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছে, সে বিজ্ঞের মতো উত্তর করে, ‘খুঁতখুঁত করি কি সাধে? মালটা তো আমাদের ব্যানার-এ বেরোচ্ছে। আমাদের গুডউইল ওর সঙ্গে জড়িত থাকছে যে। তাই আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয় বই-কি!’

শুভায়ু মনে মনে বলে তোমাদের আবার গুডউইল বলে কিছু আছে নাকি? পয়সা— আসলে পয়সা হলেই হল। বড়ো বড়ো প্রকাশকরা পর্যন্ত নামিদামি লেখকদের সঙ্গে দু’চারটে অনামি লেখককেও এক আসনে বসাচ্ছে।

যাকগে ওসব কথা। ওর সব লেখাগুলোই রয়েছে কেবল শেষেরটা নেই— তার কোনও কপিও নেই— । বেশ ঝঞ্ঝাট হল বই-কি!

কী ব্যাপার তবে কি ফেরার পথে ট্রেনেই মিস করল? ওই ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’ গল্পটাই হারিয়ে গেছে…

বড়ো টেন্সড ফিল করে শুভায়ু। গুনে গুনে লেখাগুলো নিয়ে গেল অথচ…

আচ্ছা প্রকাশককে ফোন করে জানলে হয় না? যদি সেখানে পড়ে থেকে থাকে—।

ব্যাপারটা প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল আর নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যাবে না। ওটা তাহলে গেল? ওই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা যেতে পারে কিন্তু তেমনটি হবে কি?

এরই মাঝে তৃষা মন্তব্য করে, ‘অত মনমরা হলে চলবে! আবার নতুন করে লিখতে কি তোমার গায়ে জ্বর আসছে নাকি?’

শুভায়ু বলে, ‘থামো তো তুমি! হাজার হোক লেখা তো আমার সৃষ্টি। লেখা খোয়া গেলে শোক হতেই পারে। লেখা হচ্ছে আত্মজ। সন্তানের মতো… ও সব তুমি বুঝবে না!’

তৃষা উত্তর করে, ‘কী জানি ওসব বাতিক আমার নেই—তাই বুঝি না।’

এবার শুভায়ু রেগে যায়— ‘যা বোঝো না তা নিয়ে তক্বো কোরো না চুপ থাকো!’

পরের শনিবার আবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। প্রকাশক বললেন— ‘নাহ এখানে কোনও পাণ্ডুলিপি ফেলে যাননি। কী আশ্চর্য কোথায় গেল!’

ফেরার পথে বাস থেকে তাড়াতাড়ি নেমে— সাবওয়ের মুখে পৌঁছল। কিন্তু হঠাৎ একি দেখছে ও! সামনের মেয়েটি অমন করে তাকাচ্ছে কেন? একদম কাছাকাছি এসেই মেয়েটি থমকে যায়।

‘স্যার একটু দাঁড়াবেন…’ শুভায়ু থমকে যায়।

‘মনে করতে পারেন স্যার? চিনতে পারেন…’ তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

শুভায়ু হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি শ্রাবণী। আপনার ছাত্রী ছিলাম দেউলগ্রাম হাইস্কুলে। আর আপনার সঙ্গে ছিটেফোঁটা আত্মীয়তাও ছিল। আপনার মা বীণাপানি দেবী আমার দূর সম্পর্কের মাসি… আপনি কেমন আছেন?’

শুভায়ু লেন্স-এর ফাঁকে ওকে ভালো করে দেখে।

‘ভালো আছি… ওহ্ সেই শ্রাবণী!… কোথায় চলেছ? আমি কিন্তু বর্ধমান যাব।’

‘হ্যাঁ… দাদা। মানে স্যার…’

‘অত ইতস্তত করছ কেন? আমাকে দাদা বলেই ডেকো… তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ। দেউলগ্রাম স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী হিসাবে শেষ দেখেছিলাম কিন্তু তোমার সেই চেহারা একদম ভেঙে গেছে… আমি তো চিনিয়ে না দিলে ধরতেই পারতাম না। তারপর সব কেমন আছ? কী করছ? তোমার সেই ভাই সুপ্রকাশ কী করে?’

শ্রাবণী মাথা চুলকোয়।

‘বাব্বা! আপনার সব মনে আছে দেখছি— খবর ভালোই… আমি তো বড়ো… আমার পরে সুপ্রকাশ। আমি অনার্স পাশ করে ট্রেনিং নিয়ে বসে আছি… এমএসসি দিচ্ছি। ভাইও বেকার, ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বাবার সেই প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি উঠে গেছে। স্টাফ-দের কিছু কিছু পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’

একটু থেমে আবার শুরু করে…

‘কিন্তু দাদা সত্যি বলতে কী, বেশ দুর্দিন যাচ্ছে আমাদের। সে কথা আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই… বরং চলুন না কর্ড লাইনে এই সামনেই বেলানগরে নেমে শিউলিবাগান কলোনি। যাবেন দাদা? বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আর দেউলগ্রামের লোকজন তো আসে না। তার কারণও আছে, গেলে সবকিছু জানবেন।’

একটু যেন বিমনা হয়ে যায় শুভায়ু।

‘চলুন না দাদা— অসুবিধে হবে না।’ অনুরোধটা বারবার আসতে থাকাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও—

‘কিন্তু আমার তো রিটার্ন কাটা আছে।’

শ্রাবণী বেশ গুছিয়ে বলতে থাকে। ‘টিকিটটা সামান্য, তবে যদি বাড়িতে অসুবিধে থাকে, বউদি চিন্তাভাবনা করে— সে কথা আলাদা।’

হঠাৎই শুভায়ু মনস্থির করে ফেলে।

‘চলো তাই যাই… তোমাদের আস্তানাটা চিনে আসি, কলকাতা আসা যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। বুথ থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলেই চলবে।’

‘ভালোই হল কাল তো রবিবার, সকালেই ফেরার তাড়া নেই।’

ট্রেনে চড়ে সামান্য রাস্তা। যাত্রাপথে নানান চিন্তা… এসে পড়ে।

লেখাটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন খচখচ করে মনটা। গল্পটার নায়িকা ছিল অতসী… ভ্যান চালাত সুবলসখা। তার সঙ্গে অতসীর ঘনিষ্ঠতা… শেষে বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়। মা-বাবা ক্ষুণ্ণ হয়, সুবল-রা অন্য জাত। অতসীদের তুলনায় ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।

এরমধ্যে অতসীর মা মারা যেতে বাড়ির একটা ছন্নছাড়া হাল হয়ে যায়। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীহারা হয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। অতসী তার স্বামীকে বারবার কাছে এসে থাকতে বলে। ওরা একদিন এসেও যায়। কিন্তু পরস্থিতি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। এক প্রত্যুষে ওদের খামারবাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এক নারী মূর্তিকে ওরা বের হতে দেখে… তবে কি ওটা ওর মার অশরীরী আত্মা?

শেষ পর্যন্ত রহস্যের কিনারা হয়। আত্মা আর অশরীরী থাকে না, তার শরীরী রূপ ধরা পড়ে। সে অতসীর ছোটো মাসি… অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে থাকত। সে ছুটে আসে কীসের টানে। সেও এক বাসনার শিকার। বাসনার এক বিসর্পিল নদী ওকে টানে।

যাক এটা শুধুমাত্র কাঠামোটা…।

রক্তমাংসের গল্পটা তো নেই। শুভায়ু কী করে শুধু মুখের কথায় বাসনার বিসর্পিল রূপটা বিশ্বাস্য করে তুলবে…!

স্টেশন থেকে শিউলিবাগান কলোনি সামান্যই রাস্তা। সেখানে শ্রাবণীদের একতলা ঘর— মাত্র দুটো কুঠরি। ছাদের সিঁড়ি, চিলেকোঠা। সুপ্রকাশ কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছে, রাতে বিকম পড়ে।

ওদের বাবা সরকারবাবু কথা শুরু করেন।

‘তাহলে শুভবাবু আমাকে চিনতে পারছেন তো… দেউল গ্রামে থাকতে মাত্র একবারই গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি… সে তো আটবছর আগে।’

শুভায়ু তাকিয়ে দেখে সরকারবাবুর দোহারা চেহারা সামনের দিকে কিছু পাকা চুল, কেমন যেন পোড়খাওয়া।

‘আরে দেখুন না শ্রাবণী ধরে নিয়ে এল। আর আমাকে নতুন জায়গা দেখার নেশায় কেমন যেন পেয়ে বসল।’

সরকারবাবু বলেন, ‘আরে মশাই এসে অন্যায় কিছু করেননি।’

‘অন্যায় আর কী, এসেছি এই বোনটির টানে। সত্যি শ্রাবণী মেয়েটি বড়োই ভালো। আর মেশোমশাই আমাকে আর ‘আপনি’ সম্বোধনে লজ্জা দেবেন না। আমি তো আর এখন দেউল গ্রামের প্রধান শিক্ষক পদে নেই… তাছাড়া আপনি বয়সে বড়োই হবেন।’

‘তাই হবে বাবা! শ্রাবণী মাঝেমধ্যে এখনও তোমার কথা বলে। ওই তো সবকিছু দেখাশোনা করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ সামলায়। ওরাই তো ভাই-বোনে ঠেলা গোঁজা দিয়ে চালাচ্ছে সংসারটাকে। নিজেরা পড়ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে। আমি তো যেটুকু ছাঁটাইয়ের আগে পেলাম সেটা— সেই সঙ্গে কিছু দেনা করে মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করতে পেরেছি।’

সুবর্ণা মাসি মানে শ্রাবণীর মা’র প্রসঙ্গ উঠতে সবাই মুখে তালা এঁটে দিল। কেউ কোনও কথা বলে না।

একটা থমথমে গুমোট ভাব হঠাৎ যবনিকাপতনের মতো ঝুলে রইল…

শেষে শ্রাবণী নীরবতা ভঙ্গ করল। ‘দাদা খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর রাতে ধীরেসুস্থে সব কথা বলব। না বললে আমাদের চলবে না। আর আপনিও ঠিক বুঝবেন না। এই বলে আশ্বস্ত করল শুভায়ুকে।

সুবর্ণা মাসির সঙ্গে শুভায়ু’র মা’র একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। খানিকটা লতায়-পাতায় গোছের। শুভায়ু সেটা সঠিক বুঝত না। থাক সে কথা।

রাতে শ্রাবণীর কথা শুরু হল।

‘দাদা! আপনাকে সবকথা খুলে বলতে আমার লজ্জা ছাড়াও— কেমন একটা তিক্ত বিস্বাদ ভাব এসে যাচ্ছে। কথা বলতে যাচ্ছি, না আকাশে থুতু ছুড়তে যাচ্ছি, সেটাই ভাববার বিষয়। মাকে নিয়ে কথা বলা বা মা’র কেচ্ছা আলোচনা করা সন্তানের পক্ষে কতখানি নির্লজ্জতার নজির তা নিশ্চয়ই উল্লেখের দরকার নেই। একজনের ভুলের মাশুল গুনছে গোটা সংসার…। সমস্ত সংসারটাতে যেন অলক্ষ্মীর ছায়া। বাবা এখন আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভরসা স্থল। তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। তবু ভালো শিউলিবাগান কলোনির লোকজন সব কিছু স্পষ্ট করে জানে না। কারণ ঘটনাটা এখানে ঘটেনি।’

একটু থেমে আবার বলতে থাকে শ্রাবণী, আমরা তখন ডানলপের দিকে ভাড়া ছিলাম। নতুন বাড়িতে শিফট করার পর মা’র সম্পর্কে সবরকম কৌতূহল মেটাতে তৎপর হলাম। মা’র একটা পুরোনো নেগেটিভ-কে কায়দা করে এনলার্জ করা হল— সেটাকেই বাঁধিয়ে ফুলের মালা দিয়ে দেয়ালে টাঙানো হল। বলা হল— সুদূর দেশের বাড়িতে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেখানেই মারা যান। এখানকার লোক আমাদের সম্পর্কে তত উৎসাহী নয় যে বাঁকুড়ার দেউল গ্রামের খবর নিতে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল কলকাতার শহরতলিতে ছাপোষা এক সরকারবাবুর স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা, সে নিয়ে গবেষণা করতে কারও বয়ে গেছে। তাদের ভাববার জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে।’

শুভায়ু মাঝখানে শ্রাবণীকে থামিয়ে দেয়।

‘শ্রাবণী, আমার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা হয়ে রইল। আচ্ছা বলো তো, সুবর্ণা মাসি কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে কে ছিলেন?’

শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বিরতির পর কথা বলতে থাকে।

‘শুভদাদা! কিছু মনে করবেন না… আমি এতখানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে কথাসূত্রর ঠিকঠিক সঙ্গতি রাখতে পারছি না। তাই কোথায় এ কাহিনি শুরু করতে হবে তাই ভুলে বসে আছি। আমাদের দুঃখকষ্ট, মনের জ্বালাযন্ত্রণা আজ পর্যন্ত কাউকে স্পষ্টভাবে বলতেই পারলাম না। আসলে সেরকম পারিবারিক বন্ধুই পেলাম না – যার কাছে নিজেদের কথা বলে হালকা হতে পারি। আপনাকে টেনে এনেছি মনের কথা শোনাব বলে। এবার শুনুন –

মা’র বাপের বাড়ির অবস্থা যাইহোক, ওঁর মধ্যে একটা বিলাসী সুখস্বপ্নে বিভোর সত্তা ছিল। আমার জন্মের পর থেকেই নানানভাবে আঘাত পেতে থাকেন। বাবা সামান্য চাকরি করতেন প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি-তে। তাও সেটা বড়ো প্রতিষ্ঠান ছিল না। মায়ের মতো সুন্দরী একটা মেয়ের এমন একটা দৈন্যপীড়িত সংসারে কেন যে বিয়ে হল – সেটাই বিরাট রহস্য। যাক ওসব প্রসঙ্গ। তবু মাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য বাবার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু মা’র কাছে, এই সংসার… ভাড়া বাড়ি… বাবার আর্থিক টানাটানিগুলো বড়োই ঘৃণা ও বিরক্তির বিষয় ছিল…।

‘আমরা কত কষ্ট করেছি পড়াশোনা করতে গিয়ে। অন্যের বাড়ি থেকে নোটবই চেয়ে এনেছি, রাত জেগে নোটকপি কিংবা ছুটোছুটি করে অথবা জেরক্স সংগ্রহ করে বহু কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করেছি। মা’র কাছে এসব মূল্যহীন ছিল! মা-কে বলতে শুনেছি, জানো বইপত্র কিনতে হয়, ওরকম চেয়েমেগে বিরাট কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

সে তো অনেক পয়সার দরকার— আমার উত্তর। মা ভ্রূকুটি করে হেসেছে – হ্যাঁ টাকাপয়সার দরকার বই-কি! আর বেশি দাম দিয়ে সেই বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা বা সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বচ্ছলতা আনতে যে যোগ্যতা দরকার তা তোমার বাবার নেই।

ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক বাবার আর্থিক দৈন্যকে ব্যঙ্গ করাই মার লক্ষ্য ছিল।

– কী বলছ তুমি! তুমি তো সবই জানো বাবার অবস্থা।

– জানি বই-কি। আর এও জানি তোমার বাবা নানা অজুহাত যাই দেখান, তিনি আর্থিক সাফল্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলেই প্রতিপন্ন।

শ্রাবণী বড়োই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এ ক’টি কথা বলতে পারল।

আমার মা’র কথাবার্তা শুনলে মনে হতো, মার ভাগ্যে এক সচ্ছল সুন্দর গোছালো সংসার অপেক্ষা করছিল, আমার বাবা হঠাৎ তাঁর জীবনে এসে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে চেষ্টা করতাম – মায়ের সেই ঈপ্সিত পুরুষ কি সুরঞ্জন মামা? কে জানে!

তবে সুরঞ্জন সান্যালকে দু’একবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। ছোটোবেলায় তাঁর দেওয়া মুঠোমুঠো টফি আমরা ভাইবোনে ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি মা’র মামার বাড়ির দেশে ওঁর বাড়ি ছিল। মানুষ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের কোথায় যেন! প্রথম যখন আমাদের বাড়ি আসেন তখন উনি বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হয়ে স্কুল-কলেজে চাকরির ধান্দায় ঘুরছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে একটা কলেজে সাক্ষাৎকারে এসে হঠাৎই মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমার বাবা শিবতোষ সরকারকে বলেন, শিব জামাইবাবু, এদিকে একটা চাকরি পেলে দিব্যি থেকে যাব। সুবর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে…

চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় দেউল গ্রামের বাড়িতে এসেছেন সুরঞ্জন মামা। দু’চারদিন বেশ হইচই করেছেন। আমাদের সঙ্গে হালকা হাসিমস্করা হুটোপাটি করেছেন, এসব বেশ মনে পড়ে। আমাকে খুবই আদর করতেন। মা-কে বলতেন সুবর্ণা! তোমার এই মেয়েটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিও, বেশ বুদ্ধিমতী হবে। ওর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় স্পোর্টস-এ বেশ ভালো করবে। ওর কোন নামটা ফাইনাল করলে, শ্রাবণী?

শুনে মা’র মুখে হাসির ছ’টা। মা বলেই ফেলল, আর সব নাম তো চাপা পড়ে গেল। তোমার দেওয়া ওই নামটাই রীতিমতো চালু হয়ে গেল দেখছি। কার দেওয়া নাম দেখতে হবে তো?

মা’র মুখে সুরঞ্জন মামার নাম তখন সব সময় শোনা যেত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনিতর একটা প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাঁকুড়া জেলার একটা সামান্য কলেজে চাকরি করছে। সেটাই মা’র আপশোশের কারণ। অবশ্য তখন সোনামুখি কলেজ ছোট্ট কলেজই ছিল…

দেউল গ্রামের দিনগুলি এমনিভাবেই পার হচ্ছিল। মাসে অন্তত একবার সুরঞ্জন মামা এসে যেতেন। জুলজি বোটানি-র লোক যে কবি-শিল্পী মনের হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

একবার দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে শীতের সময় আমরা ‘পৌষলা’ করেছিলাম। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তখন সুরঞ্জন মামার ভরাট গলায় শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত – ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… আসিতে তোমার দ্বারে…’

মা-ও ভালো গাইত, একটু চাপা গলায় গেয়েছিল—‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’

তখন ভালো বুঝতাম না। মনে হতো কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার, তারই মধ্য দিয়ে আমাদের সংসারটা চলেছে।

এইচএস পড়ার সময় থেকে আমার মনে হল— কোথায় যেন একটা অন্য স্রোত বইছে। চোরাস্রোত ফল্গুধারার মতো। সে ছুটে চলেছে হয়তো বা কোনও অজানা সর্বনাশা পথে। সুপ্রকাশ-এর চোখ ছেলেদের চোখ আর তরুণের চোখ। ওর তখন বয়স অল্প। ও ঠিক ধরতে পারেনি। ধোঁয়াটে হলেও আমি অনেকটা বুঝতাম। দেখতাম, সুরঞ্জন মামা এলে মা’র চোখে একটা খুশি চিকচিক করে উঠত।

ওদিকে বাবা, সুরঞ্জন মামা সম্পর্কে কোনও না কোনও মন্তব্য করলেই মা রেগে যেত।

একদিন বাবা বললেন, সে কি সুবর্ণা তুমি ওঁর সঙ্গে সোনামুখি যাবে?

– কেন তোমার আপত্তি আছে?

– না মানে সুরঞ্জনবাবু মেসে থাকেন তাই বলছিলাম।

মা ব্যঙ্গ হাসি হেসেছে, তুমি তো অমনি বলবে জানতাম। ওদের অধ্যক্ষ ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আমি সেখানে থাকব। এখন সুরঞ্জনদা ওখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল জানো তো!

বাবা চুপ করে যেতেন বাধ্য হয়ে। মা বলেছিল, দুটো দিন রান্নাবান্না শ্রাবণীই সামলে নিতে পারবে।

কলেজে সুরঞ্জন মামার নামডাক ছিল। ওঁর দু’চারটে বই ডিগ্রি কোর্স-এ চালু ছিল। এরপর বেশ কিছুদিন সুরঞ্জন মামা আর আসছিলেন না। দেউল গ্রামে যে ঢিঢি পড়ে গেছিল শিবতোষ সরকারের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে, তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে বাবাকে সঞ্চয়ন ফিন্যান্স বদলি করল হাওড়ার দিকে। বাবা সবকিছু গুটিয়ে ডানলপের দিকে চলে গেলেন। সেখানে নানান টানাটানির মধ্যে দিয়ে সুপ্রকাশ আর আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

শেষের ঘটনাটা ঘটল বছর দুই আগে। ইতিমধ্যে মা’র নামে চিঠিপত্র আসত, কিন্তু সুরঞ্জন মামা আর আসেননি। মাঝ্যেমধে মা’র মুখটা দেখতাম বেশ থমথমে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যেত বেশি প্রশ্ন করলে।

– চালাও তোমাদের সংসার, আমি আর পারছি না। শুধু নাই নাই রব। এত অভাব আর দেখতে পারছি না। আমারই কপাল দোষে জুটেছে ক’টা দুষ্টগ্রহ।

শুভদা। এরপর গল্প শেষ হয়ে আসছে। আমরা ঘটনায় যাচ্ছি। একদিন ভোরে বাবা উঠেছেন। অনেক খোঁজাখুজি করে মাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি, ভাই অনেক খুঁজলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা একদিন সুপ্রকাশকে সোনামুখি পাঠালেন। পরের দিন সুপ্রকাশ খবর আনল, সুরঞ্জন সান্যাল প্রায় ছ’মাস আগে সোনামুখি ছেড়ে অসমের দিকে কোনও কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।

এরপর থেকে আমরা তিনজন সমানে লড়াই করে যাচ্ছি। ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল তবুও…’

শুভায়ু শ্রাবণীর পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘সোজা হয়ে হাঁটবে— এতটুকু ভেঙে পড়বে না। ভয় কী? তোমরা তো কিছু অন্যায় করোনি। শুধু ফটোতে নয় বাস্তবে সুবর্ণা মাসি মৃত বই-কি! অন্তত তোমাদের কাছে। শক্ত হও, তোমার কাছ থেকেই তো সুপ্রকাশ জীবন সংগ্রামের ভাষা আয়ত্ব করবে।’

অনেক দেরিতে শুভায়ু কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গড়াতে যায়। আর মনে মনে ভাবে ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’র পাণ্ডুলিপিটা হারিয়েছে বটে কিন্তু গল্পটা তো হারিয়ে যায়নি।

 

চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

নাটক

সবিতা একটা বড়ো থলে কাঁধে করে ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠলাম। ‘হ্যাঁরে, তোর কাঁধে ওটা কী? ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘আজ্ঞে, দিদি আমার বাপের বাড়ির দেশের আম। তুমি তো খেতে ভালোবাসো তাই।’

সবিতার ঠোঁট উলটে কথা বলার কায়দা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু সবিতা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং স্বমহিমায় তার নিজের ছন্দেই গড়গড় করে বলে চলল, ‘দেশ থেকে ছোটো ভাই আর ভাইপো এসেছে কিনা। মা ওদের হাত দিয়ে অনেক কিছু পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আর তনুদিদি আম পছন্দ করো তো, তাই খানিক নিয়ে এলুম।’

‘হ্যাঁরে এটা খানিক?’ মনে মনে হাসি পেলেও, থলে ভর্তি আম নিয়ে আসার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না। আসলে খুব কাছের লোক ছাড়া এইভাবে কারওর থেকে কিছু নেওয়ার অভ্যাস কোনওদিনই আমার ছিল না।

‘খানিক নয় তো কি গো দিদি! দু-তিন বস্তা ভর্তি করে নিয়ে এসেছে যে। তোমাদের খাওয়া শেষ হলে আমকে বোলো, আবার আনব।’ গর্বের সঙ্গে সবিতা এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে, আমি আর সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলাম না।

‘না না এটাই অনেক। আর আনিস না বাবা।’ ঠিক সেই সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। ‘সবিতা দ্যাখ তো বাবা কে এসেছে।’

দরজা খুলতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি ফলের ঝুড়ি আর ড্রাই ফ্রুটের কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখে দিল। তাদের আচরণ দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

‘এসব কী? আর আপনারাই বা কে?’

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আগন্তুক জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, ম্যাডাম, ব্যস একটু খাবার জিনিস আর কী। প্লিজ এটাকে অন্যভাবে নেবেন না। বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে, ‘রাজ দাঁড়িয়ে  আছিস কেন? তোর ডকুমেন্টস-টা ম্যাডাম-কে দে।’

ছেলেটি আমার অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘এক মিনিট, আগে আমার কথা শুনুন। কলেজের কাজ আমি বাড়িতে করি না। আপনারা কলেজে দেখা করুন, আর হ্যাঁ এইসমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যান।’

‘প্লিজ, ম্যাডাম দু-মিনিট সময় দিন।’ বলেই ছেলের হাত থেকে মার্কশিট-টা নিয়ে ‘এই দেখুন মাত্র ১ নম্বরের জন্য ছেলেটার অ্যাডমিশন আটকে গেছে। এখন আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলেটার ভবিষ্যৎ…।’

ওদের স্পর্ধা দেখে মাথাটা ভীষণ ভাবে গরম হয়ে উঠল। কিন্তু বাড়ির মধ্যে কোনওরকম সিনক্রিয়েট হোক, এটা চাইছিলাম না, তাই তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘দেখুন আমি আগেই বলেছি কলেজের ব্যাপার আমি কলেজেই মেটাই। আর একটা কথা, এক নম্বরের জন্য অ্যাডমিশন হয়নি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমি যদি সুপারিশ করে আপনার ছেলেকে অ্যাডমিশন দিই, তাহলে কি অন্যদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে না? আপনার ছেলের ভালোর জন্যই বলছি, যে কলেজে চান্স পেয়েছে, সেখানেই অ্যাডমিশন করিয়ে নিন।’

‘এরকম করার হলে তো কবেই করিয়ে নিতাম ম্যাডাম। তাহলে আর আপনার কাছে আসা কেন? আসলে আপনার কলেজের একটা সুনাম রয়েছে, সঙ্গে প্রিন্সিপাল হিসাবে আপনারও। সেইজন্যই আমি চাই, আমার ছেলেটা আপনার ছত্রছায়ায় থেকে সঠিক পথে পরিচালিত হোক। তাহলে ওর ভবিষ্যৎ নিয়েও আমার কোনও চিন্তা থাকবে না।’

‘প্লিজ, এভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবেন না। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবিতা, আমি তৈরি হতে যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিস।’

ওদের যেতে বলার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ঢুকতে ঢুকতে দু-তিনবার ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকও কানে এল শেষে একটা হুমকিও শুনতে পেলাম। ‘এর ফল কিন্তু ভালো হবে না ম্যাডাম।’ ইচ্ছা করেই সেটা না শোনার ভান করলাম।

বাবা ছোটোবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির আজও ভুলিনি, মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অন্তরে। স্নান করে বেরোনোর পর মুডটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবিতা তখন ঘর ঝাড়পোঁছে ব্যস্ত। কিন্তু ওর মুখটা কেমন যেন একটা…। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘কী হল? ওরা চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ গেছে। একটু যদি সাহায্যই করতে দিদি, তাহলে কী আর এমন হতো শুনি? বেচারা! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। সঙ্গে যেসব জিনিসপত্র এনেছিল, সেগুলোও দিয়ে দিতে হল।’

সবিতার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। সবিতাকে আমি কোনওদিনই কাজের লোক হিসাবে দেখিনি। বরং ছোটোবোনের মতোই দেখে এসেছি। তাই ওর জোরটাও আমার উপর একটু বেশিই।

‘ওহ তাই বল! সব জিনিসপত্র ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে তোর গোঁসা হচ্ছে।’

‘তামাশা কোরো না তো দিদি। সত্যিই তুমি যদি ওই বেচারাদের মুখটা দেখতে।’

শোন, বেচারা-টেচারা কেউ নয়। জাস্ট নিজের কাজ হাসিল করার জন্য ঘুষ দিতে এসেছিল বুঝেছিস। তুই খুব বোকা, এসব বুঝবি না। জানিস ওই উপহারগুলোর বদলে আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চাইছিল। দ্যাখ, তুইও তো আমার জন্য ফল এনেছিস। কিন্তু তোর আনার মধ্যে কোথাও কি…’

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেলটা আবার বেজে উঠল। সবিতা দরজা খুলতে গেল বটে, কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ নজরও দরজার দিকে আটকে রইল। দরজা খুলতেই সামনে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় লোক। একজনকে অবশ্য লোক বললে ভুল হবে। তাকে দেখে মনে হল বছর উনিশ-কুড়ির বেশি হবে না। কিন্তু দুজনেরই পোশাকআশাক কেমন যেন একটু প্রত্যন্ত গাঁ ঘেঁষা। ভাবলাম এরা আবার কারা রে বাবা!

‘সাবু দি, এটাই ম্যাডাম না?’

‘ম…ম… ম্যাডাম’ দূর থেকে দাঁড়িয়েই হাতজোড় করে প্রণাম সারল তারা।

এ পর্যন্ত এইটুকুই বোধগম্য হল যে সবিতার ডাক নাম সাবু আর এরা তারই পরিচিত কেউ।

‘ওহ্ দিদি আমার ভাই আর ভাইপো, তোমাকে বলেছিলাম না দেশ থেকে এসেছে।’

‘ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলি বটে’ বলে সম্মতি জানাতে ঘাড় নাড়ালাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এদের এখানে আসার কারণটা কী!

ততক্ষণে সবিতার ভাই ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে, ‘আম খেয়েছেন ম্যাডাম? আমাদেরই বাগানের।’

ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল সবিতা আমার সাইডে দাঁড়িয়ে ইশারা করে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। না তারা কিছু বুঝতে পারছে, না আমি। উত্তরে আমের বেশ তারিফ করে, বেশিমাত্রায় পাঠানোর কথাও জানালাম।

‘আরে না না ম্যাডাম, চাষেরই তো জিনিস। সিজনে জাম আর পেয়ারার ফলনও বেশ ভালো। পরের বার ১-২ ঝুড়ি পাঠিয়ে দেব’খন। চাইলে বাড়িতে বানানো খাঁটি ঘিও পাঠাতে পারি।’

‘না না। ধন্যবাদ। এই যথেষ্ট।’ ঘড়ি দেখতে দেখতে আলগোছে বলি, ‘সবিতার সঙ্গে কিছু দরকার আছে তাই তো? ঠিক আছে, বসে ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। আমি আসছি।’

বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়াব এমন সময় সবিতার ভাই হাতজোড় করে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘দরকারটা আপনার সঙ্গেই ছিল ম্যাডাম। আপনি কৃপা করলে মা-মরা এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যেত। দয়া করে যদি এই গরিবের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি করেন। ছেলেটা আমার পড়াশোনায় একটু কমজোর বটে, কিন্তু খুব ভালো মনের।’ বলে একটু থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘দিদি বলেছিল আপনি নাকি কলেজের প্রিন্সিপাল।’

‘আপনারা কলেজে গিয়েছিলেন? ওনারা কী বললেন?’

‘বললেন লিস্টে নাম নেই।’

‘রিজার্ভেশন কোটায় দেখেছিলেন।’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। একদম শেষের দিকে। আপনি সব পারেন ম্যাডাম। শুধু বাচ্চার মাথায় একটু হাত রেখে দিন। তাহলেই…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আমার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ছেলের মাথায় রাখার চেষ্টা করে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার।

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা?’

‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। গাঁয়ের লোক তো, তাই শহুরে আদবকায়দা ঠিক জানি না। সাবুদি কিছু বলো না। সাবুদি আপনার খুব সুনাম করে, বলে দিদি খুব দয়ালু, উপকারী। কিগো দিদি বলো।’ বলতে বলতে চোখভরা আশা নিয়ে সবিতার দিকে তাকাতেই, সবিতা কিন্তু কিন্তু করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দিদি তোমার কলেজে ওর একটা ব্যবস্থা করে দাও না দিদি। সারাজীবন আমরা তোমার খেদমত খাটব দিদি। দাও না দিদি।’ বলতে বলতেই ভাইপোকে একেবারে আমার পায়ে ঝুঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

পরিস্থিতি দেখে একপ্রকার লাফিয়েই দু-পা পিছিয়ে এলাম। ‘কী করছিসটা কী সবিতা? তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’ এরকম অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে এর আগে কোনওদিন পড়িনি।

‘রাস্তা ছাড়। আগে কলেজে যাই। পৌঁছে লিস্টটা চেয়ে একবার চেক করে দেখব। তবে আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারে খুব একটা কিছু হবে বলে। হয় ভাইপোকে অন্যত্র ভর্তি করিয়ে দে, নয়তো ভালো করে পড়াশোনা করে আবার পরীক্ষায় বসতে বল। এক্ষেত্রে সত্যিই আমার কিছু করণীয় নেই।

বেশ রূঢ় ভাবেই কথাগুলো বলে কোনওদিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আজ বলে নয়, বরাবরই আমি একটু আদর্শবাদী। নিয়মনীতি মেনেই চলি। সেসবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কাজ করা আমার পক্ষে সত্যিই বোধহয় অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কাছে ভীষণ ভাবে অপ্রিয় হয়ে উঠি।

বিশ্বাস করুন, ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে, পরের দিনই তার থেকে অনেক বেশি চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভেবেছিলাম সবিতা হয়তো আর কাজেই আসবে না। কিন্তু উলটোটাই হল। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটাতেই হাজির হল সে। ব্যাতিক্রম বলতে শুধু মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া। যেটা সবিতার একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওর চুপ থাকাটা একসময় বেশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বুঝতে হয়তো পারছিলাম ওর মনের মধ্যে কী উথালপাথাল চলছে। আমারও মনের অবস্থা খানিকটা সেইরকমই।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রশান্ত মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে কী জানি না, আমি অনেক শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছি। বলতে পারেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তনু তখন খুব ছোটো। মনের মধ্যে কষ্ট থাকলেও তা চেপে রেখে সর্বদা ওর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমিই যদি ভেঙে পড়ি, তাহলে ওকে দেখবে কে, এই ভাবনাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে চিরটাকাল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে ওর পরিধিও। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার পৃথিবী কেবলমাত্র ওকে ঘিরেই। কিন্তু ওর দিন-প্রতিদিনের বিস্তৃত হওয়া পৃথিবীতে, আমার জায়গাটা যে কোথায়, তা অনুমান করা খুব কঠিন।

বন্ধু হিসাবে কারওর কাছে যে নিজের দুটো মনের কথা বলব, জীবনে তেমন সঙ্গী আর পাইনি। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে এভাবে খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। তবে শুধু আমার চেনা-পরিচিতরা কেন, আমার মেয়েটাই যে আমাকে কতটা জানে, বোঝে, বলা মুশকিল।

পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি, ঠিক সেই সময় তনু ফোনে কথা বলতে বলতে নীচে নেমে এল। আমাকে দেখামাত্রই ফোনটা কেটে এগিয়ে এল, ‘ও মাম্মা, পরশুদিন আমার উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বটানিতে লেকচারারশিপে ভ্যাকেন্সি ছিল। রিয়া, পূজা, মুন সবাই অ্যাপ্লাই করেছে বলে, আমিও করলাম। যদিও টিচিং ব্যাপারটাতে আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই, তবুও যতদিন না মনের মতো একটা কিছু হচ্ছে, ততদিন অন্তত। প্লিজ, তুমি একটু বিসি আঙ্কলকে ব্যাপারটা জানিয়ে রেখো।’

‘আবার বিসি সাহেব কেন তনু? এই পদটির জন্য তুমি যথেষ্ট যোগ্য। কনফিডেন্স লেভেল হারিয়ে ফেলছ কেন? আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইন্টারভিউ দাও। তুমি এমনিই সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

‘আমার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে মাম্মা। কিন্তু তুমি জানো না, এখন ছোটো ছোটো চাকরির জন্যও বিশাল কম্পিটিশন। তার উপর এদের পে-প্যাকেজটাও তো বেশ ভালো। সুতরাং কম্পিটিটরও অনেক থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে মাম্মা। আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না। তুমি শুধু আঙ্কলকে একটু বলে রেখো। আমি যাচ্ছি। বাই মাম্মা।’ বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল তনু। আজ ওদের পিকনিক না কি যেন একটা আছে।

‘তনু শোন তো… আমি…’ বাকি কথাগুলো গলার মধ্যেই কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। এক তো কিছু শোনার আগেই তনু বেরিয়ে গেল, দ্বিতীয়ত রান্নাঘর থেকে দুটো জাজ্জ্বল্যমান সন্দিগ্ধ চোখ আমাকে যেন বিঁধতে থাকল। মনের মধ্যে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল চলল। দু-ঠোঁট আর এক করতে পারলাম না। কোনও অপরাধ না করেই, অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা হল আমার।

কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একদিকে একমাত্র মেয়ে, অন্যদিকে আমার আদর্শবাদী নিয়মনীতি। যদি মেয়ের পক্ষে যাই, তাহলে বাকি জীবনটা আদর্শচ্যুত হওয়ার অপরাধবোধে ভুগতে হবে, আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে, বাড়িতে অশান্তির পারদ চড়তেই থাকবে। যা হবে হবে। স্থির করলাম, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়ব না।

এইভাবেই কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। এই ক’দিনের আত্মসংঘর্ষই আমাকে বয়েসের তুলনায় আরও বৃদ্ধা বানিয়ে তুলেছিল। বাড়িতে একটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হয়তো সুনামির আগের পরিস্থিতির মতোই। পাঁচদিনের দিন কলেজ থেকে ফিরে টিভিটা খুলে বসতেই, সবিতাও চা দেওয়ার বাহানায় মাটিতে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় তনু ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ও যে কখন দরজা খুলে ঘরে এসেছে কিছুই টের পাইনি।

‘ওহ্ মাম্মা, আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি, কালই জয়েন করতে হবে। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলে কারওরই হয়নি। আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে জবরদস্ত কম্পিটিশন হবে। তুমি হেল্প না করলে চাকরিটা আমি পেতাম না। লভ ইউ মাম্মা।’

আনন্দে আটখানা হয়ে গলা জড়িয়ে আমাকে আদর করতে থাকে তনু। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ানো সবিতার তির্যক চোখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি সত্যিই অসহ্যকর। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে কেউ ফেলে দিয়ে গেল আমাকে।

‘কী হল চুপ করে আছ কেন মা, কিছু বলো। তুমি না থাকলে তো…।’

‘তুই চাকরি পেয়েছিস তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না তনু। তোর চাকরির জন্য আমি কোনও তদবির করিনি। তুই তোর নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিস।’

কথাটা শুনেই তনু গলাটা ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় একেবারে একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী, তার মানে তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে কথাই বলোনি।’ তনু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কিন্তু, কেন মাম্মা? তুমি তোমার মেয়ের জন্য এইটুকুও করতে পারলে না। আজ আমার চাকরিটা হয়েছে তাই, নাহলে! তোমার কাছে তোমার মেয়ের খুশি, ভবিষ্যৎ কিছু নয়? আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোমার আছেটাই বা কে?’

‘শোন্ তনু’

‘কী শুনব?’

‘আমি বরাবরই চেয়ে এসেছি আমার মেয়েও আমার মতো আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক। সারাজীবন আমাকে যেমন কারও কাছে মাথা নত করতে হয়নি, তেমনি আমার মেয়েও যেন জীবনে কারওর দ্বারস্থ না হয়। তাছাড়া, আমি যেখানে জানি, আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। তার কারও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না, তখন কেন?’

‘মেধা? সেটা তো পরের কথা মাম্মা। এখানে তো নিজের সবথেকে কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠতে বসেছে। সত্যিটা স্বীকার করো না, যে তুমি তোমার আদর্শবাদী নীতির জন্য তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিনিমিনি খেলতে রাজি। ছিঃ মাম্মা! তুমি এত স্বার্থপর? নিজের সন্তুষ্টির জন্য…’

‘আমি স্বার্থপর?’

‘এটা স্বার্থপরতা ছাড়া আর কী বলতে পারো? আমি এতদিন ভাবতাম পাপা নেই তো কী হয়েছে, আমার মা-ই আমার সব। কিন্তু আজ তোমার আদর্শের এই নাটুকেপনায় আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।’ রেগেমেগে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কোনওরকমে সোফাটা ধরে বসে পড়লাম।

মিনিট পাঁচেক পরে একটু ধাতস্থ হলাম। চোখ খুলেই দেখি সবিতা কোমর বেঁধে একেবারে রেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে থাকে, ‘আমি অশিক্ষিত, গাঁয়ের লোক আছি বটে, কিন্তু তোমাদের মা-মেয়ের এই নাটক খুব বুঝতে পারছি। আমরা ছোটো জাতের গরিব লোক বলে, সবাই আমাদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করে। আমারই বোঝা উচিত ছিল! মেয়ের জন্য সুপারিশ করতে একটুও বাধল না তোমার? রক্তের সম্পর্ক যে! যত আদর্শ, সিদ্ধান্ত সবই আমাদের মতো গরিব লোকেদের জন্য। বেচারা ভাই আমার, কোন মুখে যে গাঁয়ে ফিরবে! এসব তোমাকেই বা বলছি কেন, এসবে তোমার কী-ই বা যায় আসে। তোমরা তো আনন্দেই আছ না।’

এই অতর্কিত ঘটনায় উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এক কল্পিত নাটকের চরিত্র হয়ে গেলাম আমি। আমার আত্মজ থেকে পরিচারিকা, সবার কাছেই অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠেছি। ‘ঘুষ নেওয়া, তদবির করা অর্থাৎ যা কিছু-কে চরম অসম্মানের বলে যেনে এসেছি এতকাল, তা-ই আজ আমার জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তনু, সবিতা, ওই অচেনা লোকগুলো আঙুল তুলে কী যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে। কোনও কিছু কানে ঢুকছে না আমার। বাবার উদাত্ত গলায় ফিরে ফিরে আসছে কবিতার লাইনগুলো… চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর…’।

 

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

মাতৃরূপেণ

ভোরে উঠে পড়ার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি সুজাতা। ওঠার তেমন দরকার পড়ে না, তবুও। অনির্বাণ অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। অফিসের রান্না করে দেবার তাড়া নেই আর। রুমকি যতদিন এ বাড়িতে ছিল, ওকে ঘিরে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ছিল। স্কুল-কলেজের পাট চুকলে, রুমকির নাচ, নাচের দলের দেশ-বিদেশ সফর, সেইসব সফরের প্রস্তুতিপর্ব– সব মিলিয়ে বাড়িটা গমগম করত। ছাত্রী, ছাত্রীর মায়েরা, অনুষ্ঠানের আয়োজক, মিডিয়ার লোকজন আসার বিরাম ছিল না। সেসব অবশ্য এখনও আছে। তবে দুটো বাড়ির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে জনস্রোত। শুধু রুমকিকে ভোরে উঠে তুলে দেওয়ার কাজটা আর নেই। সেদিনও পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর মস্ত দায়িত্ব। ভোরে উঠে এক-দেড় ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করত রুমকি। ভোরের এই সময়টা যে-কোনও সাধনার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ– একথা তো তিনিই ছোটোবেলা থেকেই রুমকির কানে ঢুকিয়ে এসেছেন।

রুমকি এখন এখানে থাকে না। তাই ওকে ঘুম থেকে তুলে নাচে জুতে দেবার কাজও নেই তাঁর। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাই। অবসর নেওয়ার পর প্রথম ক’দিন খুব উৎসাহে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছিলেন অনির্বাণ। তাঁকেও টেনে নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে ছাদের টেরেসে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, কাগজ পড়া তারপর দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট বানানো। মর্নিং ওয়াকারদের একটা দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘সাতসকাল’ নামে লেটারহেড ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, রক্তদান– এমন দু-চারটে কর্মকাণ্ডও হয়েছিল তাঁদের গোষ্ঠীর। তারপর তাঁরা কীভাবে যেন খসে পড়লেন সেই গোষ্ঠী থেকে।

তারপরও অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অবসরজীবনে সুজাতাকে জড়িয়ে নিতে। সারাজীবন সময় দিতে পারেননি। সুজাতার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ওভারটাইম করে গিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে নাচ চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। দামি দামি কস্টিউম, মিডিয়ার সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ, ছাত্রী ধরে রাখার জন্যে বছরে শহরের নামি-দামি হলে দু-তিনটে প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ– আরও কত কী। পাশাপাশি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। তারপর ইউনিভার্সিটি। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ চাকুরিজীবী অনির্বাণকে সেসবের খরচ জুগিয়ে যেতে হয়েছে। রুমকি কীভাবে বড়ো হল, সুজাতা কখন যে যৌবন পেরিয়ে গেলেন– দেখা হয়নি অনির্বাণের।

এতদিন, এতগুলো বছর পরে সুজাতার সঙ্গে আবার সেতু গড়ে তুলতে গিয়ে দেখলেন, কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। সুজাতার সমস্ত জীবনের একটিই অভিমুখ– মেয়ে রুমকি, রুমকির নাচ। তাঁর সব ভাবনা, স্বপ্ন, গল্পের বিষয়, নাচকে ঘিরে রুমকির কেরিয়ার। মেয়েকে প্রাণাধিক ভালোবাসলেও অনির্বাণ সুজাতার মতো মেয়েসর্বস্ব হয়ে উঠতে পারেননি। আর পাঁচটা বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহ। তিনি নিয়মিত খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েন, মেয়ের নাচ ছাড়াও নাটক, সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, বিভিন্ন খবরের চ্যানেলগুলো তাঁর দেখা চাই, ছোটো হলেও তাঁর নিজস্ব একটি বন্ধুবৃত্ত আছে। এসব কিছু নিয়ে তিনি সুজাতাকে নতুন করে পেতে চেয়েছিলেন, পাননি। এখন তিনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, নিজস্ব ছন্দে কেটে যায় সকাল থেকে সন্ধে, নিজের ছোটো ছোটো ভালো লাগাগুলোর সঙ্গে। বেলায় একবার নীচেরতলায় মেয়ের নাচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন মেয়ে নাচে মগ্ন, সুজাতা চায়ের কাপ হাতে জগৎ-ভুলে মেয়ের নৃত্যরতা রূপ দেখছে। কিংবা, মা-মেয়ে মিলে ভবিষ্যৎ কোনও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। এক ঝলক দেখে সরে আসেন তিনি। মেয়ে অবশ্য যাওয়া-আসার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা না করে যায় না।

আসলে রুমকি আর সুনন্দন যে-ফ্ল্যাটটায় থাকে, সেটায় জায়গা বড়ো কম। তাই প্রতিদিনই দশটার মধ্যে ও চলে আসে এখানে। সুজাতার তিল তিল পরিশ্রম, স্বপ্ন ও সাধে গড়ে উঠেছে যে বাড়ি– ‘ভঙ্গিমা’। পুরো বাড়িটা যেন নাচের একটি মুদ্রার মতো দাঁড়িয়ে। একতলার গোটাটাই প্রায় হলঘর। রুমকির প্র্যাকটিস, ক্লাস, অনুষ্ঠানের মহড়া সবই চলে সেখানে। ছোটোখাটো অনুষ্ঠানও হতে পারে হেসে খেলে। হয়ও। তার জন্যে লাগোয়া একটা ড্রেসিং রুমও আছে। এছাড়া দুটো টয়লেট, একটা শুধু রুমকির, অন্যটি ছাত্রীদের। আর আছে একটা ছোট্ট কিচেন। প্র্যাকটিসের ফাঁকে ফাঁকে কফি বা হেলথ ড্রিংক, স্যান্ডউইচ– টুকিটাকি সবই জোগানো যায় প্রয়োজনমতো। রুমকি যতক্ষণ থাকে, সুজাতা পারতপক্ষে দোতলায় আসতে চান না। তাঁর নিজের হাতে লাগানো বীজ কীভাবে আস্তে আস্তে মহিরুহ হয়ে উঠছে তার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উপভোগ করতে চান তারিয়ে তারিয়ে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে সুনন্দন তুলে নিয়ে যায় রুমকিকে। কখনও-কখনও ওর নাইট-শিফট থাকলে রুমকি তাঁর কাছেই থেকে যায়। দুই সখীর মতো গল্পে গল্পে কেটে যায় রাত, বলা বাহুল্য, যে গল্পের পুরোটাই নাচ নিয়ে। আরও, আরও ভালো হতে হবে, আরও আয়ত্ত করতে হবে মুদ্রাগুলি– একথা আজও পাখিপড়ার মতো করে তিনি বুঝিয়ে চলেন মেয়েকে।

রুমকি যখন প্রথম তাঁকে জানাল, সে সুনন্দনের প্রেমে পড়েছে, মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন সুজাতা। বিয়ে, সংসার, সন্তানপালন– এসব সাধারণ মেয়েদের জন্যে। এসবে জড়িয়ে পড়লে ওর এই ঝকঝকে কেরিয়ার একদম বরবাদ হয়ে যাবে। রুমকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হেঁশেল আর বাচ্চা সামলাচ্ছে– এ দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় পান সুজাতা। সুনন্দন আইটি-তে বড়ো চাকরি করে, লাখ দেড়েক মাইনে, প্রায়ই বিদেশ যেতে হয়– এসব শুনেও মন গলেনি তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুমকির জেদ আর অনির্বাণের প্রবল আগ্রহের কাছে মাথা নোয়াতে হল তাঁকে। তবে, ঠাকুর বাঁচিয়েছেন, সুনন্দন আর-পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো ঘরকুনো নয়। বউকে জড়িয়ে বসে থাকার সময় নেই তার। সবসময়ই ছুটছে। ভালোই হয়েছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি টাটানগরে থাকে। তাই ওসব ঝামেলাও নেই। সেন্টার থেকে ডেলি রোজের আয়া রেখে নিয়েছে। সে-ই সংসার সামলায়। কামাইয়ের ভয় নেই। রুমকি পুরোপুরি নাচে মন দিতে পারছে। আর কী চান সুজাতা।

তবু কেন যে এতটা খালি-খালি লাগে। একটা শূন্যতা, হাহাকার সোফার তলায় লুকোনো বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে থেকে থেকে। কী যেন একটা নেই। সুনন্দন যখন রুমকিকে নিতে আসে, গাড়ি থেকে নামে না, ঘনঘন হর্ন বাজায়। ওই শব্দটা বুকে এসে ধাক্বা মারে যেন। মনে হয়, রুমকির ওপর সব অধিকার সুনন্দনেরই, তিনি কেউ নন। যেন পরের ধন চুরি করে এনেছেন, সে এসেছে নিজের জিনিস ফেরত নিতে। রুমকিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়, মাকে বিদায় জানাতেও মনে থাকে না কোনও-কোনও দিন। কেমন যেন সুর কেটে যায় সারাদিনের।

পরের দিন আবার সব তিক্ততা মুছে নতুন করে শুরু করতে চান সুজাতা। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিদিন একটা নতুন দিন। কিন্তু রুমকি না আসা পর্যন্ত কেমন যেন একটা ছটফটানি তাঁর মধ্যে, খালি খালি লাগে সমস্ত সকাল।

চা শেষ করে আজ নীচের ঘরে এসে ফার্নিচারের ধুলো ঝাড়ছিলেন সুজাতা। ধুলো থাকার কথা নয়, তাঁর বহু বছরের কাজের লোক কমলা অনেক যত্ন নিয়েই ঘরদোর ঝাড়ামোছা করে। বিশেষত দিদির এই নাচের ঘরটিকে মন্দিরের মতো ধুয়েমুছে রাখার নির্দেশ আছে তার ওপর। তবু রোজ সকালে কায়াহীন ধুলোই ঝাড়েন সুজাতা, ঝাড়তে ঝাড়তে তাঁর মনও পরিষ্কার হয়ে আসে।

আজ ঝাড়তে ঝাড়তে, কী মনে হল, আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ত্বকের সে মসৃণতা আর নেই, চুলের রুপোর ঢল লুকোতে নিয়মিত কালার করতে হয়, তবু শরীরের মাপজোকে তিনি এখনও তরুণী। তাঁর স্তন, কোমর এখনও টানটান। ঘাড়ের ভঙ্গিমায় উদ্ধত ঘোটকীর আভাস আসে। পেটের ওপর আনমনে হাত রাখেন সুজাতা। রুমকির পর কাউকে আনতে পারেননি সাহস করে। অবস্থা তেমন ছিল না। আজকাল বড্ড একা লাগে। রুমকি যখন তাঁর গর্ভে ছিল, সেই অপেক্ষায় উদ্বেল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নতুন কাউকে পৃথিবীতে আনার আনন্দ… বুক দুটো টনটন করে ওঠে, দুধের ভারে যেমন হতো সে সময়।

হঠাৎ আয়নায় রুমকির নির্মেদ, সুঠাম শরীরটা ভেসে ওঠে। কখন এল! কই, গাড়ির শব্দ পাননি তো? এত ডুবে ছিলেন নাকি নিজের ভাবনায়! লজ্জা পেয়ে যান সুজাতা। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ান মেয়ের মুখোমুখি। লাল টপ, ব্লু জিন্স আর অক্সিডাইজড দুলে ওকে কী দারুণ দেখাচ্ছে। ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক আর চোখে ঘন কালো কাজল। ব্যাস, আর কোনও মেক-আপ নেই। কিন্তু ওর মুখ তো অন্যদিনের মতো ঝলমল করছে না? চিন্তার ছাপ স্পষ্ট মুখেচোখে।

‘কী রে? কফি করে নিয়ে আসি?

‘না মা, বোসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে সুজাতার।

‘কী কথা? তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।’

‘মা আমরা কদিন ধরেই আলোচনা করছি, ইনফ্যাক্ট ইচ্ছেটা আমারই, মানে মা হবার এই এক্সপেরিয়েন্সটা– মানে আমি বাচ্চা চাই মা।’

ধপ করে একটা মোড়ায় বসে পড়েন সুজাতা। ঠিক এই ভয়টাই তিনি করে আসছেন রুমকির বিয়ের পর থেকে। বাচ্চা, ন্যাপি পালটানো, রাত জাগা– একেবারে শেষ হয়ে যাবে কেরিয়ারটা। মিনিমাম দু-তিন বছর স্টেজ থেকে সরে থাকতে হবে। এই ঈর্ষণীয় ফিগারটাই কি আর ধরে রাখতে পারবে? ওঃ, বোকা, কী বোকা মেয়ে! আবার বলে কিনা ওর ইচ্ছে, সুনন্দন যে সুকৌশলে ওর কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাইছে, বুঝতেও পারছে না। মা হবার এক্সপেরিয়েন্স, হুঁ! বিয়ের আগে ঠিক এমনই বলেছিল, বিয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা নাকি ওর নাচের জন্যে জরুরি। মা হতে চাই! হায় ঈশ্বর! মা হওয়ার মানে বুঝিস? মা হওয়া মানে নিজের সবকিছু সন্তানের জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া, যেমন তিনি করে চলেছেন সারা জীবন ধরে। রাগে, দুঃখে কথা বেরোয় না সুজাতার মুখ দিয়ে।

মায়ের এই ভাবান্তর খেয়াল করে না রুমকি। যেন কোনও ড্রিম প্রোজেক্টের প্ল্যান বলছে, এমন তদ্গত ভাবে বলে যায় অনর্গল, ‘কিন্তু, আমি তো জানি, কেরিয়ারের এই পিক পয়েন্টে বাচ্চা নেওয়া মানে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া। এবছরেই কলামন্ডলমের স্কলারশিপটা পাওয়ার কথা চলছে, পেলে তো চেন্নাইতে চলে যেতে হবে। সুনন্দনও দু-তিন মাসের মধ্যে স্টেটস-এ চলে যাবে। তিন বছর তো থাকবেই। তার মানে এখনই বাচ্চা না নিলে… সামনের বছর আমিও তিরিশ পেরিয়ে যাব। তার মানে আরও কমপ্লিকেশন।’

সুজাতা এর পরেও কোনও মন্তব্য করেন না। ওর মুখ থেকে পুরোটা শুনে নিতে চান আগে।

‘তো সুনন্দন একটা ওয়ে আউট বার করেছে। যাতে বাচ্চাও আসে, আমাদের কেরিয়ারেরও কোনও ক্ষতি না হয়।’

অ্যাডপ্ট করবে নাকি? সুজাতা একটু বুকে বল পান, উদগ্রীব হয়ে ওঠেন মেয়ে এবার কী বলে শোনার জন্য।

‘সারোগেট মাদার জানো তো, যারা কিছু টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেন। মানে সবকিছু আমাদেরই রইল, শুধু বাচ্চা বেড়ে উঠবে এক ভাড়া করা মহিলার পেটে, জন্মের পর বাচ্চাটাকে আমরা নিয়ে নেব, আফটার অল আমাদেরই বাচ্চা।’

সুজাতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন। এবার রুমকি অস্থির হয়ে ওঠে, ‘কী হল মা? তোমার মত নেই? তুমি কি বেবির কেয়ার নিয়ে ভাবছ? আয়া রাখব, তাছাড়া তুমি তো আছোই।’

‘হ্যাঁ, আমি তো আছিই। সেইজন্যেই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। আমি থাকতে, তোমরা কী করে ভাবলে এসব?’

‘ওঃ কাম অন মা, তুমি তো কখনও এত ব্যাকডেটেড ছিলে না। এসব খবর তো কাগজেই হামেশা বেরোচ্ছে। কলকাতাতেই কত হচ্ছে। আচ্ছা, যারা খুব ব্যস্ত, তারা কী করবে বলো? তোমাদের দিন একরকম কেটে গেছে। তুমি যেমন শুধু আমাকে নিয়ে লেগে ছিলে, আমার পক্ষে কি তা সম্ভব?’

‘না সম্ভব নয় রুমকি। সুনন্দন খুব ম্যাচিওর্ড ছেলে, ও ঠিকই ভেবেছে। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, আমি থাকতে অন্য ভাড়া করা মহিলার কথা তোমরা কী করে ভাবলে? হাইজিনের ব্যাপার আছে, পরিবেশ আছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির তফাত আছে। তাছাড়া আইনি প্যাঁচপয়জার কতরকম হয় বোঝো তোমরা? সে যদি দাবি করে বসে বাচ্চাটা তারই? এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে।’

রুমকি বিভ্রান্তের মতো মার দিকে তাকায়। সারাজীবন সমস্ত সংকট মুহূর্তে যেভাবে তাকিয়েছে।

‘শোন রুমকি, বাইরের আজেবাজে কোনও মহিলা নয়, তোর সন্তান বেড়ে উঠবে আমার শরীরে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে, বুঝলি?’

রুমকির সব কেমন গুলিয়ে যায়। তার সন্তান থাকবে মায়ের গর্ভে! সে কী হবে তার তাহলে? দিদি না মা? মার মাথার ঠিক আছে তো? বাবা শুনে কী বলবে? আর সুনন্দন? একবার সুনন্দন বলেছিল, ‘তোমার মা কিন্তু এখনও বেশ অ্যাট্রাকটিভ।’ সেই নিরীহ কথাটাও কেমন কুৎসিত লাগে এই মুহূর্তে। অসহায়ের মতো সেও ধপ করে বসে পড়ে আর একটা সোফায়।

‘তুই কেন এত চিন্তা করছিস রুমকি? তোর বাচ্চা হলে এমনিতে তো তাকে আমাকেই মানুষ করতে হবে। তুই কি তাকে সময় দিতে পারবি? তার চেয়ে এই ভালো হল না? গোড়া থেকেই সে আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেল আষ্টেপৃষ্ঠে, ওকে মানুষ করতে গেলে কখনও মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি। তোর মতো ওকেও গোড়া থেকে গাইড করতে পারব, ছকে দিতে পারব ভবিষ্যৎ।’

স্বপ্নে টলটল করে সুজাতার দুচোখ। খালি-খালি ভাবটা উধাও হয়ে যায় বুক থেকে। আবার যেন পুরোনো উদ্যম ফিরে পেয়েছে তাঁর শরীর। সামনে এখন অনেক কাজ, আবার তাঁর হাতে গড়ে উঠতে চলেছে এক নবজীবনের রূপরেখা।

‘মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি।’ মার এই কথাটা কেমন যেন কানে লাগে, রুমকি কেঁপে ওঠে একটু, পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিকই তো বলেছে মা। তার সামনে অনেক কাজ। সে একজন শিল্পী, শুধুই শিল্পী, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো জীবনের ছোটো-ছোটো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার চলবে? সমাজ, সংসার, চরাচর মুছে যায় তার চোখের সামনে থেকে, শুধু ভেসে ওঠে একটি মঞ্চ, দুটি নৃত্যপরা পা, তারই ওপর সমস্ত আলো। পা দুটি নেচে যাচ্ছেই, নেচেই যাচ্ছে নিজের ছন্দে। মাকে জড়িয়ে ধরে রুমকি।

সুজাতা অবশ্য বাস্তববোধ হারাননি। সিদ্ধান্তটা তো শুধু আবেগের নয়। অবশ্যই ডাক্তারের মতামত নিতে হবে, জেনে নিতে হবে এই গুরুভারের জন্যে তাঁর শরীর কতটা প্রস্তুত। আর অনির্বাণ, তার মতটাও…

রুমকি কি তাঁর মনের কথাটা পড়েই বলে, ‘বাবা কী বলবে মা?’

‘বাবার ব্যাপারটা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। মানুষটা কোনোওদিন আমার কথা ফেলেনি। আর সুনন্দন, সত্যি কত আধুনিক মনের ছেলে। আমরা খুব লাকি রে রুমকি!’

গভীর প্রশান্তিতে রুমকিকে বুকে টেনে নেন সুজাতা। তাঁর গর্ভের ওম উষ্ণ পৃথিবীকে উষ্ণতর করে তোলে।

 

আগুনের মুখোমুখি

পরিচিত এক গানের সুরে কলিংবেল-টা বেজে উঠতেই সংবিৎ ফিরে পায় নীপা। গত দু’দিন যাবৎ সে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। দুপুরে এই অসময়ে কে আসতে পারে? ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে লিলির রাত হয়ে যায়। আর ও তো সাড়ে দশটা– এগারোটার আগে কোনও দিন…

ফের বেজে ওঠে বেলটা, তবে এবারে ভিন্ন সুরে।

বাধ্য হয়ে নীপা বিছানা ছেড়ে ওঠে। কাজের মেয়েটি দেশে গেছে তো গেছেই, ফেরার নাম নেই। বেল বাজলে দরজা খুলতে যাবার বিষয়টা তার বিরক্তিকর লাগে। নাইটিটা পাতলা, হাত বাড়িয়ে হাউসকোট টেনে নেয় নীপা। সেটা গায়ে চাপিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলে একটি অচেনা মুখ নজরে পড়ে। ছেলেটির হাতে একগোছা কাগজপত্র।

নীপা নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে, ‘কে? কাকে চাই?’

‘কুরিয়ার। চিঠি আছে,’ উত্তর আসে সঙ্গে সঙ্গে।

দরজা খুলে চিঠি হাতে নেয় নীপা। নির্দিষ্ট কাগজে সই করে ফেরত দেয়। ভেবেছিল, স্বামীরই কোনও চিঠিপত্র হবে। কিন্তু খামের উপর জ্বলজ্বল করছে তার নাম। চিঠি নিয়ে দরজা বন্ধ করে নীপা। প্রেরকের নাম নেই, আশ্চর্য! তবে কী? ধক করে ওঠে বুক।

দারুণ উত্তেজিত লাগে নিজেকে। হাতের লেখাটা চেনা-চেনা ঠেকছে। খামের একটি দিক ছিঁড়ে সে চিঠিটি বের করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে, ‘প্রিয় নীপা’। উত্তেজনা দমন করতে পারে না সে, দ্রুত চিঠির নীচে চোখ বোলায়– ‘উফ্, যা ভেবেছি, আঁতকে ওঠে নীপা, তলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘তোমার আর্যদা’। অজানা আতঙ্কে বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় নীপার, চিঠিটি আর পড়ে না। সামনের জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাড়িয়ে দেয় দূরে– আশ্বিনের মিষ্টি রোদে ভাসা আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ যেন অন্যমনস্ক একটি ঈগল পাক খাচ্ছে মন্থর গতিতে।

নীপার মনটা পিছিয়ে যায় একুশ বছর। ভবানীপুরে নীপাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। সে বাড়িতে নীপার বাবা তার দুই ভাই এবং তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন। নীপারা ছিল দু’ভাই, এক বোন। কাকার দুই মেয়ে, এক ছেলে। আর জেঠুর ছিল দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সবার ওপরে ছিলেন ঠাকুমা। এতগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে গোটা বাড়িটা সব সময় গমগম করত। হইহুল্লোড় লেগেই থাকত।

নীপার বাবা ছিলেন সংগীত পাগল মানুষ। শনি-রোববার হলে বাড়িতে গানের আসর বসত। কত যে লোকজন আসত, আসত ভাই-বোনদের বন্ধুবান্ধবরা। নির্ভেজাল আড্ডা জমত ছুটির দিনগুলিতে। উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। আজ এর জন্মদিন তো কাল ওর।

এরকমই একদিন খুড়তুতো দাদা নীল বলল, ‘এই নীপা, এদিকে আয়, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হল আমার বন্ধু, আর্য। আর্য কাশ্যপ। দুর্দান্ত ছবি আঁকে।’

নীপা কোনও মতে হাতজোড় করে বলেছিল, ‘নমস্কার’।

মৃদু হেসে আর্য বলেছিল, ‘তোর বোন যতটা লাজুক ঠিক ততটাই মিষ্টি।’

নীপার চোখমুখ এক অপার্থিব মায়াবী আলোয় ভরে উঠেছিল সেদিন। ‘আমি যাই’, বলে দ্রুত পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু এর দিন কয়েক পর কলেজ যাবার সময় আচমকা সিগারেট হাতে এগিয়ে এসেছিল আর্যদা, ‘কী নীপা চিনতে পারছ?’

নীপার বুক ঢিপঢিপ শুরু হল। আশেপাশে সামান্য তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, ‘কেউ দেখতে পাবে। এখানে না, কলেজে।’

ফিক করে হেসে সরে গিয়েছিল আর্যদা। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পায়ে পায়ে আশুতোষ কলেজ আর কতটুকু? দু’জনের প্রেম জমে উঠতে দেরি হয়নি।

তারপর কলেজ বাংক করে অসংখ্য দিন সিনেমা, রেস্টুরেন্ট, গঙ্গার পাড়, ভিক্টোরিয়া, সদন– দিনগুলোর কথা ভাবলে নীপার বুকটা হুহু করে ওঠে আজও। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত দু’জনের কথা বলে।

নীপা প্রায়ই বলত, ‘তুমি আমাকে কী দেখে ভালোবাসলে আর্যদা? তোমার কাছে আমি যে কিছুই না।’

উত্তরে আর্যদা হেসে বলত, ‘তুমি জানোই না তুমি কতটা সুন্দর। জানলে এ কথা বলতে না।’

বাস্তবিকই কন্দর্পের মতন রূপবান ছিল আর্য। উজ্জ্বল ফর্সা রং, টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ। লম্বা সুঠাম চেহারার যুবকটির চমকপ্রদ কথাবার্তায় চুম্বকীয় আকর্ষণ। তার কাছে নীপা নিজেকে বড়ো অসহায়বোধ করত। পক্ষান্তরে নীপা মোটের ওপর সুশ্রী হলেও তাকে সুন্দরী বলা চলে না। থাকার মধ্যে ছিল কেবল সুগঠিত নারীসুলভ দেহ, আর মার্জিত ব্যবহার।

প্রতিদিনই শরীর চাইত আর্য। আর তা না পেলেই তার মুখ ভার হয়ে উঠত। অবশ্য সেই রাগ নীপাকেই ভাঙাতে হতো ফের শরীর দিয়েই। আর আদর করতেও জানে বটে ছেলেটা। কোথায়, কখন, কীভাবে ছুঁলে যে নারীদেহ অবশ হয়ে আসে, এলিয়ে পড়ে প্রতিরোধ বিহীন হয়ে, ভেসে যায় অনন্ত স্রোতে– তা বুঝি কেবল ওরই জানা। অমন করে আর ছুঁতে পারল কে? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নীপার বুক থেকে।

চিঠি হাতে ধরাই থাকে, পড়া হয় না। নীপা ভাবতে থাকে, কী লেখা থাকতে পারে এতে? আজ একুশ বছর পর আমার কাছ থেকে আর কী পাওয়ার আছে আর্যদার? বয়স তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ হতে চলল। এ চিঠি আমার স্বামী কিংবা লিলির হাতে পড়লে কী সর্বনাশ হতো! শিউরে ওঠে সে। এরকম একটা ঘটনা যে আর্যদা ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কাই হচ্ছিল। গত পরশু দিন পার্টিতে যখন মি. চাওলা আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘মিট মাই ফ্রেন্ড আর্য কাশ্যপ। দ্য মোস্ট ডিসকাস্ড পেইন্টার অফ দিস আওয়ার। অ্যান্ড হিয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ড মি. চ্যাটার্জী অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, মুহূর্তের জন্য পায়ের তলা থেকে মাটি বুঝি সরে গিয়েছিল নীপার, ‘আ-র্য-দা’, অস্ফুটে উচ্চারণ করতে পেরেছিল কেবল।

জুলফিতে পাক ধরেছে ভালোই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও কী অপূর্ব সুন্দর মানুষটি! কিছু কিছু মানুষকে বুঝি বয়স তেমন ভাবে ছুঁতে পারে না। কত বয়স হবে আর্যদার? আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়ো ছিল, তার মানে ফিফটি প্লাস। আশ্চর্য! এক মাথা ঝাঁকড়াচুল, রিমলেস চশমা, পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর চমৎকার একটি শাল কাঁধে ভাঁজ করে ফেলা। প্রাথমিক নমস্কার সেরে ওদেরকে কথা বলতে দিয়ে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সরে এসেছিল নীপা। পার্টিতে ওদের আর কথাবার্তা হয়নি।

গত দুদিন যাবৎ বারবারই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল নীপার। বুঝতে পারে না, আর্যদার সামনে নিজেকে এত অসহায় লাগে কেন? মনে হয় বুঝি পায়ের তলায় মাটি নেই, কেবল বালি, তাও দ্রুত সরে যাচ্ছে। অথচ ওই মানুষটি এক দিন আমাকে চরম সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও কেঁপে ওঠে শরীর–

আর্যদার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছিল মিলি, জ্যাঠতুতো বোন। বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো হলেও ওরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। একদিন মিলি ওকে ডেকে বলল, ‘শোন নীপা, তোকে একটা কথা বলার ছিল।’

‘কী বলবি বল না।’

‘কথাটা শুনতে তোর একটুও ভালো লাগবে না, মন খারাপ হয়ে যাবে। হয়তো আমাকে ভুল বুঝবি’, বলল মিলি।

‘যা বোঝার বুঝব, তুই আর ঢং না করে বলেই ফেল কথাটা।’

‘না, মানে কথাটা আর্যদার সম্বন্ধে,’ ইতস্তত করে মিলি।

‘কী হয়েছে আর্যদার?’ উৎকণ্ঠা জাগে ওর গলায়।

‘না ওর খারাপ কিছু হয়নি’, মিলি বলে, ‘দ্যাখ আমার কানে ওর সম্বন্ধে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য এসেছে যার অর্থ ছেলেটি মোটেও সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে আরও একাধিক মেয়ের সম্পর্ক আছে। তুই সাবধানে থাকিস।’

‘তোর কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই প্রশ্ন করে নীপা।

‘না, আমার কাছে ওসব থাকবে কী করে? কানে এল, তাই তোকে সাবধান করলাম, এই আর কী।’

রাগে সেদিন ধুপধাপ করে হেঁটে নীপা চলে এসেছিল মিলির ঘর ছেড়ে। তবে কথাটা যে কতদূর সত্যি তা জানা গেল মাস ছয়েক পরই। নীপার প্রেমের বয়স তখন দু’বছর। সে তখন পার্ট টু দিয়েছে।

একদিন আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় বাড়িতে ডাক্তার এল। মুহূর্তে মারাত্মক সংবাদটা পৌঁছে গেল বাবা-দাদাদের কানে। প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠতে খানিকটা সময় লাগল সকলের। তারপরই সকলে হামলে পড়ল, ‘এ কর্মটি কার?’ উত্তর পেতে দেরি হল না। বড়দা ফোন করল আর্যদের বাড়ি।

আর্য-র মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগেই। বাবা বেঙ্গালুরুতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন উঁচু পোস্টে। বাড়ির কাজের লোক জানাল, ‘আর্ট এগ্জিবিশন উপলক্ষ্যে আর্য ফ্রান্স গেছে, কবে ফিরবে জানা নেই।’

নীপা অবাক। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও তো দেখা হল আর্যদার সঙ্গে, একটিবার জানাল না যে ও ফ্রান্স যাচ্ছে। আমাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে গেল আর্যদা! শরীরী গল্পে যদিও ওরা যথেষ্ট সাবধানতা নিত, তবে মাঝে মাঝে বড়ো বেপরোয়া হয়ে উঠত আর্যদা। কিন্তু তার পরিণাম যে এমন বিষময় হয়ে উঠতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। দুশ্চিন্তায় মা-বাবার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা পাচ্ছিল না নীপা। কানাকানিতে গোটা বাড়ি জেনে ফেলল ঘটনা। মা-বাবা-দাদাদের মুখ ভার। কেউ কোনও কথা বলছে না, বললেও একটা দুটো। দিনরাত ফিসফাস, গুজগুজ, ছিঃ ছিঃ-তে কান পাতা দায়। উফ্, কী ভাবে যে সে দিনগুলো কেটেছে!

সে যাত্রা উদ্ধার করেছিলেন কাকা। কাকার পরামর্শ অনুযায়ী বাবা-জ্যাঠা দু’জনেই মত দিয়েছিলেন উপযুক্ত পাত্র দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীপার বিয়ে দিতে হবে। তবে তার আগে একবার নার্সিংহোম ঘুরিয়ে আনতে হবে ওকে।

কিন্তু নীপার কপালে আরও কষ্ট লেখা ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন, মাত্র দু’মাস বয়স হলেও কী এক জটিল কারণে এক্ষেত্রে নীপার উদ্ধার পাওয়া কঠিন। তা করতে গেলে পেশেন্ট জীবনে আর মা হতে পারবে না। একেই বুঝি বলে, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি।

তড়িঘড়ি খোঁজা হতে লাগল পাত্র। আশ্চর্যজনক ভাবে জুটেও গেল একজন। পাত্র বিদেশে চাকরি করে এক নামি কোম্পানিতে। বাড়ি বালিগঞ্জে। মা-বাবা এখানে থাকলেও তাকে বরাবর বাইরেই থাকতে হবে। মাত্র এক মাসের ছুটিতে এসেছে দেশে বিয়ে করবে বলে। তার জন্য পাত্রী ঠিক করাই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাত্রী জানিয়েছে যে তার অমতে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে এবং যেহেতু সে একজনকে ভালোবাসে তাই তার পক্ষে তাকে বিয়ে করা সম্ভব হবে না।

কী করে কে জানে যোগাযোগ ঘটে গেল দু’পক্ষে! দু-চারদিনের মধ্যে কথাবার্তা পাকা। পাত্র অবিনাশ বলল, ‘আমি একবার পাত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।’

প্রস্তাব শুনে প্রমাদ গুনল সকলে, এই বুঝি কেঁচিয়ে যায় বিয়ে। ততদিনে নীপা অনেকটাই পরিণত। সেও চাইছিল এমন একটা কিছু হোক। নির্দিষ্ট দিনে সে আর মিলি এসে দেখা করল অবিনাশের সঙ্গে। ওর সঙ্গেও ছিল এক বন্ধু। প্রাথমিক পরিচয় সেরে এসপ্ল্যানেডে এক রেস্তোরাঁতে ঢুকে রিজার্ভড সিটে বসে অবিনাশ বলল, ‘বলুন ম্যাডাম, স্বামী হিসাবে আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারবেন? অনেক বদগুণ আছে কিন্তু আমার।’

অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নীপা জবাব দিয়েছিল, ‘তার আগে আপনার জানা উচিত স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে গ্রহণ করতে পারবেন কি না?’

‘কী ব্যাপার, এনি প্রবলেম?’ কপাল কুঁচকে ওঠে অবিনাশের।

ভনিতা না করে নীপা সরাসরি বলে, ‘আমি একজনকে ভালোবাসতাম।’

‘এখন ভালোবাসেন না?’

‘না, সম্ভবত না,’ একটু থেমে থেমে জবাব দেয় নীপা।

‘ব্যস, তা হলে তো প্রবলেম মিটেই গেল। এখন আমাদের লাইফ পার্টনার হতে বাধা কোথায়?’ সহজ কণ্ঠে বলে অবিনাশ।

মাথা নীচু করে থাকে নীপা, উত্তর দেয় না। হঠাৎ হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। অবিনাশ ঘাবড়ে যায়, উঠে এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে শান্ত করতে চেষ্টা করে, ‘রিল্যাক্স, রিল্যাক্স নীপা, কাঁদছ কেন? এভাবে কাঁদার কোনও মানে হয়? কী হয়েছে খুলেই বলো না আমাকে।’

‘পারব না, কিছুতেই পারব না। একজন আমাকে ঠকিয়েছে, তাই বলে আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না,’ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় নীপা।

‘এখানে ঠকাবার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? দ্যাখো, ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। তুমি যাকে ভালোবেসেছ হয়তো সে তোমাকে তার মর্যাদা দেয়নি। সব কথা তুমি আমাকে জানিয়ে দিলে, এরপরও ঠকাবার প্রশ্ন থাকছে কোথায়?’

‘থাকছে। এরপরও থাকছে, বিকজ…’

‘বিকজ?’

‘বিকজ, আয়াম ক্যারিং’, রুমালে মুখ চাপা দেয় নীপা। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় অবিনাশ দারুণ আহত হয়। বুঝে উঠতে পারে না এক্ষেত্রে তার কী বলা উচিত। কেবল নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।

খানিক পর বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার রাখতে মাথা তোলে নীপা। চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। অবিনাশ ওর প্লেটে খানিক খাবার তুলে দেয়। বলে, ‘নাও, খেতে শুরু করো।’

নীপা আঙুলে চামচ ধরে নাড়াচাড়া করে, খেতে মন চায় না তার। মুখ থেকে কোনও কথা বেরোয় না। দু’চোখে ভরা জল। মিলি ওর পিঠে হাত বোলায়।

অবিনাশ বলে, ‘ব্যাপারটা মেডিক্যালি কিছু করা যায় না?’

নীপা বুঝতে পারে ও কী মিন করছে। বলে, ‘সম্ভব নয়। ডাক্তার বলেছেন, সেক্ষেত্রে ইন ফিউচার আমার মা হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলে অবিনাশ। ওর বন্ধুর দিকে তাকায়। তাকেও অসম্ভব বিস্মিত দেখায়। এরপর ওরা অসম্ভব ব্যস্ততায় কাঁটাচামচ হাতে খাবারে মনঃসংযোগ করে। একটাও কথা বলে না। একসময় খাওয়া শেষ হয়। তারপর অবিনাশ হাত মুছতে মুছতে বলে, ‘নীপা, আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি– আমি তোমাকে বিয়ে করব।’

নীপা অবাক চোখে তাকায়, ‘কী বলছেন! এত সব জানার পরও আপনি!’

‘এসব আমাকে না জানালেও পারতে তুমি, সেক্ষেত্রে আমি চিটেড হলেও কিছু করার ছিল না। কিন্তু তা তুমি করোনি, বিকজ ইয়্যু আর অনেস্ট। অ্যান্ড অনেস্টি ইজ দ্য রেয়ারেস্ট কোয়ালিটি, ইয়্যু নো? তোমার সততাকে সম্মান জানাতেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই আমি, অবশ্য তুমি যদি আমাকে পছন্দ করে থাক।’

নীপার কাছে গোটা দুনিয়া তখন অন্ধকার। সেখানে অবিনাশ একমাত্র আশার তরি। তাতে চড়ে বসা ছাড়া তার আর উপায় কী? যত শিগগির সম্ভব রেজিস্ট্রি ম্যারেজ সেরে অবিনাশ ওকে নিয়ে উড়ে গেল কানাডা। সেখানেই জন্ম হল লিলির। বছর দশেক কানাডায় থাকার পর ওদের ফিরতে হল দেশে। কারণ অবিনাশের কোম্পানি কলকাতায় ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছে। অবিনাশ উদার মনের মানুষ। আপন মহত্ত্বে সে লিলিকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছে। লিলি তো বাবা বলতে অজ্ঞান। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল এতদিন। নীপা আর কোনও দিন কারও কাছে আর্য সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো এড়িয়ে থেকেছে বরাবর। আর ভাবতে পর্যন্ত চায়নি এব্যাপারে। সেদিন পার্টিতে দেখা মাত্র এড়িয়ে গেছে, প্রশ্রয় দেয়নি দুর্বলতাকে। কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক তীব্র আবেগের উৎরোল। আজ এই চিঠি, কী লিখেছে দেখাই যাক–

‘প্রিয় নীপা,

নিশ্চয়ই অনেক মান-অভিমান বুকে জমে আছে। অনেক অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু বলি, আমারও বলার কিছু ছিল। সব শোনার পর আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণা বদলাবে কী না জানি না, তবে আমার মধ্যে যে অপরাধবোধ নিয়ত কাজ করে তা কিছুটা হালকা হবে। দীর্ঘকাল ধরে যে যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি তা থেকে মুক্তি পাবার একটা সুযোগ অন্তত দাও। চিঠির তলায় আমার মোবাইল নাম্বার আছে, ফোনে জানিও, কোথায় কীভাবে দেখা হওয়া সম্ভব। প্লিজ নীপা, একটি বার, মাত্র একটি বার মাত্র কিছু সময়ের জন্য দেখা কোরো তুমি।

তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি,

তোমার আর্য ’

পড়া শেষ হলে চিঠিটা হাতের মুঠোতে মুচড়ে ধরে নীপা। অস্ফুটে বলে, ‘না না, কখনওই না। আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা নেই। কোনও কথা থাকতে পারে না। আর কোনও সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। একদিন আমার সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে ভালোবেসেছিলাম, উজাড় করে দিয়েছিলাম আমার অনাঘ্রাতা শরীর। দস্যুর মতো লুঠ করেছ তুমি আমাকে, যা খুশি করেছ, প্রতিবাদ করিনি। সেই তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে, অমর্যাদা করলে আমার ভালোবাসার? তোমাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে কঠিন। না না, কিছুতেই দেখা করব না আমি তোমার সঙ্গে।’

আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। ঘড়ির দিকে তাকায় নীপা, সাড়ে চারটে। মানুর মা এল বোধহয়। ‘যা-ই’, বলে সাড়া দেয়। বিছানা ছেড়ে উঠে যায় দরজা খুলতে।

মানুর মা ঘরে ঢুকলে নীপা বলে, ‘আগে ভালো করে একটু চা করো তো, তারপর বাসনপত্র মেজো।’

ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে নীপা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে মোটেও আর্যদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে না। কারণ আর্যদার মুখোমুখি হলেই সে ফের দুর্বল হয়ে পড়বে। তার ভরাট সংসার ছারখার হয়ে যাবে।

সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে হঠাৎ একটা কোকিল ডেকে ওঠে, কু…হু।

নীপা গাছটির দিকে তাকায়। অজান্তেই ভালো লাগার একটা আবেশ তাকে জড়িয়ে ধরে।

দিনতিনেক পর দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছিল নীপা। খানিক চোখও লেগে গিয়েছিল। এমন অসময়ে হঠাৎই বেলটা বেজে উঠতে এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে নীপার।

এই ক’দিন নীপা মনে মনে কামনা করছিল আর্যদা এ বাড়িতে আসুক। না না, অতটা সাহস হবে না নিশ্চয়ই। গায়ে একটা ওড়না দিয়ে এসে দরজা খোলে নীপা।

‘আর্যদা!’ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। হাত-পা বুঝি অবশ হয়ে আসে, মুখ থেকে কথা বেরোয় না।

‘ভিতরে আসতে বলবে না?’ মুখে সেই দেবদূতের মতো হাসি।

‘এসো’, বলে দরজা ছেড়ে এগিয়ে যায় নীপা বসার ঘরের দিকে। একসময় সোফায় দুজন মুখোমুখি বসে দুদিকে।

আর্যর চোখ যায় টেবিলে একটা ফোটোস্ট্যান্ডের দিকে, চোখে প্রশ্নচিহ্ন জাগে।

নীপা বলে, ‘আমার মেয়ে।’

‘শুধুই তোমার?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আর্য।

নীপা উত্তর দেয় না, মাথা নীচু করে।

‘আমার চিঠি পেয়েছিলে নিশ্চয়ই?’

ইতিবাচক মাথা নাড়ে নীপা।

‘তাহলে ফোন করোনি কেন? বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে আসতে হল আমাকে। অবশ্য আমি জেনেই এসেছি যে তোমার হাজব্যান্ড এখন অফিসে।’

‘কী করে জানলে?’

‘কেন, ওর অফিসে ফোন করে দু’চারটে কথাবার্তা বললাম, তারপর সোজা চলে এলাম এখানে।’

‘এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে? চিঠি পাঠালে কী করে?’

‘সেদিন পার্টিতে আলাপের সময় আমার কার্ডটা দিতে সৌজন্য বশত মি. চ্যাটার্জিও ওর কার্ডখানা আমাকে দেন। তাতে ওর ফোন নাম্বার, অফিস, বাড়ি ইত্যাদির অ্যাড্রেস ছিল। ছিল না কেবল রেসিডেন্সের ফোন নাম্বার।’ জবাব দিল আর্য।

‘থাকলে ফোন করতে বাড়িতে?’ প্রশ্ন করে নীপা

‘হয়তো করতাম।’

‘কী লাভ? আর কী চাও তুমি আমার কাছে?’

‘কিছুই না, শুধু ক’টা কথা বলতে আসা। বুকটা বড়ো ভারী হয়ে আছে,’ বলে আর্য।

‘কী বলতে চাও তুমি বলো,’ নীপার কণ্ঠস্বর নিস্পৃহ শোনায়।

‘বলার হয়তো অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না,’ বলল আর্য। ‘ঠিক মতো বলতে পারব কি না, তাও জানি না। মাত্র তিন দিনের নোটিশে ছবি নিয়ে ফ্রান্সে যেতে হয়েছিল আমাকে প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে। সে যে কী ঝকমারির ব্যাপার তা বলে বোঝানো যাবে না। তাড়াহুড়োয় তোমাকে খবর দিতে পারিনি। ফ্রান্সে আমাদের পনেরো দিনের প্রোগ্রাম ছিল। এগ্জিবিশনটা আমার জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছিল, বলতে পারো আমার শিল্পী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম শক্ত সোপান। ওই পনেরো দিনেই বহু ইলাস্ট্রেটার, পেইন্টারদের সঙ্গে আলাপ হয়। আমার ছবি ওদের ভালো লেগেছিল। এক ছবি ব্যবসায়ী আমার ছবিগুলি ভাড়া নিতে চায় ছ’মাসের জন্য। সে ওগুলি পারীর বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শন করতে চায়। প্রচুর টাকা অফার দেয়। চুক্তি ছিল, ছবি বিক্রির লাভ ফিফটি – ফিফটি, তবে আমাকে ওই ছ’মাস ওদেশেই থাকতে হবে। সব ব্যবস্থা ওরাই করবে।

আমি রাজি হয়ে যাই ওদের প্রস্তাবে। ছ’মাসে আমার প্রায় সব ছবিই বিক্রি হয়ে যায় চড়া দামে। কাগজে কাগজে আমার নামে লেখা হয় ফলাও করে। ছবির প্রতি প্যাশন তো আমার ছিলই, অর্থ আর খ্যাতির মোহে ডুবে রইলাম আরও ছ’মাস। তারপর ফিরে এলাম দেশে। ততদিনে আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। চড়া দামে বিকোয় আমার ছবি।’

আর্য থামে কিছু সময়ের জন্য, বোঝার চেষ্টা করে নীপার হাবভাব। তারপর ফের বলতে থাকে, ‘কলকাতা ফিরেই আমি তোমার খোঁজ করি। জানতে পারি, আমি চলে যাবার পরই নাকি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি পাড়ি দিয়েছ কানাডা। ফ্রান্স থেকে বার কয়েক তোমাদের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কথা শুনে বুঝেছিলাম তোমাদের বাড়ির কেউই চায় না আমি ফোন করি তোমাকে। একদিন মিলির সঙ্গে দেখা করে তোমার সম্পর্কে জানতে পারি সব কথা। বুঝতে পারি, কী চরম দুর্যোগের মধ্যে তোমাকে ফেলে সেদিন চলে গেছিলাম আমি। আমার জন্য কত ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তোমাকে। নীপা বিশ্বাস করো তুমি,’ আর্য উঠে আসে সোফা থেকে, নীপার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, ‘সেদিনের সে ভুলের জন্য সত্যিই অনুতপ্ত আমি। আমাকে ক্ষমা করো তুমি, প্লিজ ক্ষমা করো নীপা।’

নীপার চোখ থেকে জল ঝরতে থাকে। কোনও অভিযোগ সে করতে পারে না আর্যকে।

‘কেঁদো না নীপা, প্লিজ কেঁদো না, আমাকে ক্ষমা করো তুমি’, সোফায় উঠে বসে আর্য।

হাত ছাড়িয়ে নেয় নীপা, নিজের দু’হাতের তালুতে মুখ ঢাকে। এত বছরের জমাটবাঁধা বরফ বুঝি আজ গলে জল হয়ে নেমে আসছে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো, নীপা বারবার চোখ মোছে। আর্য ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ সব ভুলে নীপা দু’হাতে আর্যর বুকে দুমদুম করে কিল মারতে থাকে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ডাকাত, ডাকাত একটা। আমার সব লুটেপুটে ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছে। শয়তান, আর কী চাও? আর কী নিতে এসেছ এখানে?’ সে পাগলের মতন আঘাত করতে থাকে আর্যকে।

‘শান্ত হও নীপা, প্লিজ শান্ত হও’, ওকে কোনও মতে নিরস্ত করার চেষ্টা করে আর্য। একহাতে নীপাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ওর ওড়না দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুমু খায় ওর কপালে বারবার।

ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে নীপা। চোখের জল থামে। প্রশ্রয় প্রাপ্ত চুম্বনেরা অবাধ্য হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে। নীপা অসহায় ভাবে কেবল বলে, ‘আর্যদা, না না, এভাবে আমার সব ভাসিয়ে দিও না।’

কিন্তু ততক্ষণে দুটি শরীর জেগে গেছে…

দীর্ঘ সময় পর উঠে দাঁড়ায় আর্য। নীপা তার বিশ্রস্ত বেশবাস ঠিক করে। কিন্তু এরপরই এক তীব্র অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে নীপাকে। কোনও কথা না বলে সে উঠে চলে যায় টয়লেটের দিকে।

কফি নিয়ে নীপা যখন ঘরে ঢোকে দেখতে পায়, আর্য টেবিল থেকে লিলির ফোটোস্ট্যান্ডটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নীপার পায়ের শব্দে বলে, ‘কত বড়ো হল ও?’

‘এমএ পড়ছে’, মৃদু স্বরে জবাব দেয় নীপা, ট্রে থেকে একটা কাপ আর্যর দিকে এগিয়ে দেয়। অপর কাপটি নিজে নিয়ে বিস্কিট সমেত ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখে।

‘এখন কেমন হয়েছে দেখতে?’

‘ভালো’, সংক্ষেপে উত্তর দেয় নীপা।

‘এ কী গো দিদিমণি, দরজা খোলা কেন?’ বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে মানুর মা।

চমকে ওঠে নীপা, ‘সে কী! সদর দরজা এতক্ষণ খোলা ছিল!’

নীপাদের বসার ঘরটা একতলার কোণার দিকে, বাকি তিনটে ঘর সাধারণত বন্ধই থাকে।

নীপা ভাবে, যদি কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ত, আর ওই অবস্থায় দেখে ফেলত? সর্বনাশ ঘটে যেত। নীপা বলে, ‘তুই দরজা বন্ধ করে আয়।’

প্রকৃতপক্ষে সর্বনাশ যা ঘটার তা আগেই ঘটে গেছিল।

মানুর-মা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে রান্নাঘরে ঢোকে। মিনিট পাঁচেক পর সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘লিলিদি বেরোচ্ছ? কিছু খেয়েছ?’

‘সে কী! লিলি ঘরে? সর্বনাশ! কখন এল ও? ওর তো এখন ফেরার কথা নয়!’ নীপার মাথায় বুঝি বাজ পড়ে। মনে হয় মাথাটা ঘুরছে। ওদিকে দুমদাম শব্দে লিলির পদক্ষেপ এগিয়ে আসছে। ওকে এভাবে যেতে দেওয়া যাবে না, ভাবে নীপা। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নীপা ওকে আটকায়, ‘দাঁড়া লিলি, কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

হিংস্র মার্জারিনির মতো ফুঁসে ওঠে লিলি, তীব্র ঘৃণা ওর দু’চোখে। বলে, ‘ছিঃ! এই তোমার পরিচয়? হঠাৎ বাড়ি ফিরে না আসলে জানতেই পারতাম না। অমন দেবতার মতো স্বামীকে এভাবে চিট করছ তুমি, তোমার লজ্জা করে না?’

নীপা বলে, ‘শোন লিলি, তোকে সব খুলে বলছি আমি। ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ ওর হাত দুটি ধরে মিনতি জানায় নীপা।

ততক্ষণে আর্য এগিয়ে এসেছে, ‘লিলি, বি কাম লিলি। শান্ত হও।’

‘শাট আপ ইয়্যু স্কাউন্ড্রেল,’ চেঁচিয়ে ওঠে লিলি। ‘এ বাড়িটা আমার হলে আপনাকে আমি জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।’

আর্যর মুখে বুঝি সপাটে থাপ্পড় মারে কেউ, এভাবে জীবনে তাকে অপমান করেনি কোনও মানুষ। লেডিকিলার হিসাবে নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তার। আজ তারই সন্তান কী না… মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে ওর।

লিলির কথাবার্তায় দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে নীপা, চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘লিলি! তুই কাকে কী বলছিস, জানিস, ও তোর কে হয়?’

দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস শব্দে লিলি বলে, ‘আজই জানতে পারলাম। এরকম দুশ্চরিত্র লম্পট পুরুষ আমার ‘বাবা’ জেনে লজ্জা হচ্ছে। আর তোমার মতো অসংযমী নোংরা মহিলাও ‘মা’ সম্বোধনের পক্ষে অযোগ্যা। আই হেট ইউ, ইয়েস, বোথ অফ ইউ।’

‘বাবা’ যদি বলতেই হয় তো বলব অবিনাশ চ্যাটার্জিকে। যিনি সব কিছু জানার পরও আমাকে নিজের সন্তান হিসাবে বুকে তুলে নিয়েছেন, উজাড় করে ভালোবেসেছেন, তোমার প্রতি স্বামীর সমস্ত কর্তব্য করেছেন।’

আর্য বলে, ‘শোন মা শোন, তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর…’

‘চুপ, একদম চুপ, আমাকে একদম ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেন না। আই অ্যাম নট আ সেন্টিমেন্টাল ফুল লাইক নীপা, আন্ডারস্ট্যান্ড?’ জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে লিলি সরাসরি তাকায় আর্য কাশ্যপের দিকে।

সেই আগুনঝরা দৃষ্টির সামনে কেমন কুঁকড়ে যায় আর্য। এই প্রথম বুঝি সে সত্যের মুখোমুখি হয়। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নেয়, অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, কোনও কথা বেরোয় না তার মুখ থেকে।

ঠকঠক ঠকঠক দ্রুত শব্দ তুলে হেঁটে এগিয়ে গেল লিলি, দরজা খোলার আওয়াজ হল সজোরে।

——-

ভুঁইফোঁড়

তাইদাদা, ও নিতাইদাদা, আজও তুমি কাজে বের হবে না গো?

অনেক ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে জবাব আসে– বললাম তো না। আর এভাবে রোজ রোজ ডাকাডাকি করবি না।

নিতাই-য়ের যেন ধনুকভাঙা পণ। টলাতে পারে কার সাধ্যি! নিতাই-য়ের মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া। মাটি গোবরে লেপা। মেঝে দাওয়া টানটান। শান বাঁধানো মেঝেকেও হার মানায়। উঠোনের এক পাশে ধানের গোলা। আর একপাশে ছোট্ট ঢেঁকিঘর। মাঝখানে মাটির বেদিতে তুলসী গাছ। অনেকটা দূরে বাড়ির এক্বেবারে পেছনে গোয়াল ঘর। হাঁস মুরগির খোঁয়াড়। সীমানা, বাঁশের কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ।

কিছুদিন আগেও এই বাড়ি, উঠোন, ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর– সব কিছুর মধ্যে ছুটোছুটি করে বেড়াত মনোরমা। নিতাই-য়ের বউ। তখন নিতাই-য়ের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আর বুক ভরা ছিল স্বাদ-আহ্লাদ আর ভালোবাসা। কিন্তু এখন? সব শুকিয়ে, পোড়া কাঠ। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘন্টা দুই। তারপর মাইল দেড়েক হাঁটা। গ্রামের পথ ধুলোয় ভরা। চলাচলের পথে হাঁটু অবধি ধুলোর মোজা। খাটো ধুতিতেও বসে যায় ধুলোর পাড়। এ’ভাবেই পুজোর মরশুমে অন্তত হপ্তায় একদিন বাড়ি আসত নিতাই এবং তার বাপ-ঠাকুরদা। কিন্তু বছর পাঁচেক হ’ল নিতাই আর…। এখন সে কলকাতায় যায় না, বাড়ির বাইরেও বেশি বেরোয় না। বাড়িতেই থাকে। আগে কয়েকজন মিলে শোভাবাজারের ভিতর দিকে মাটির বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সে সব পাট এখন চুকে-বুকে গেছে।

এই মুহূর্তে সংসার চলেছে শামুকের গতিতে। নিতাই-ও নির্বিকার। জুটলে খায়। না জুটলে খায় না। বৃদ্ধা মা, কোটরাগত চোখদুটো তুলে ছেলেকে দেখে আর ভাবে– হায় রে কী ছেলে, কী হয়ে গেল! অমন শক্তসামর্থ্য ছেলে আমার, সুতোর মতো পাকিয়ে গেল গা। কী কুক্ষণে ওর কাঁধে সংসারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম…। হায় হায় রে…। প্রতিদিনই এভাবে বুক চাপড়ে বিলাপ করে মা।

চোখ বুজলে এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। ভয়ে শিউরে ওঠে নিতাই। নিতাই মণ্ডল। সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই আর তার দশপুরুষের কাজে হাত দেয় না। একসময় তাদের এই কাজে খুব নামডাক ছিল। মূর্তি গড়ার কাজ। তখন এদের তৈরি মাটির প্রতিমা বিভিন্ন বড়ো বড়ো প্যান্ডেলে শোভা পেত। যেমন বাগবাজার, শোভাবাজার, কুমোরটুলি– এসব জায়গায়। কিন্তু সেবারের সেই ঘটনার পর থেকে নিতাই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যে যা বলে, এক কান দিয়ে শুনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। পরিবার পরিজনের পীড়াপীড়িও গ্রাহ্য করে না।

এদিকে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই অবস্থাতেও দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাকে। এখন বেশীরভাগ দিনই তাদের উপোস করে বা অর্ধাহারে কাটে। বৃদ্ধা মা, বিধবা বউদি, তার ছেলেপুলে– এসব নিয়ে নিতাই-য়ের সংসার। নিতাই এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একমাত্র হোতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কারও কান্নাকাটিতেই তার মন ভেজে না। সে যেন ‘পিছে বেঁধেছে কুলো আর কানে গুঁজেছে তুলো’। এক্বেবারে নীরেট এক পাথর।

নিতাই-য়ের সব স্পষ্ট মনে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা। দিনের আলো পশ্চিমে যখন ঢলে পড়ে, তখন ঢেঁকিঘরে চলে আলোছায়ার খেলা। সে সময় দু’হাত ওপরে বাঁশের আড় ধরা। এক পা ঢেঁকিতে আর এক পা মাটিতে রেখে ধানের পাড় দেয় মনো। আর ঢেঁকিতে ধান তোলানামা করে বিন্তিখুড়ি। নিতাই-য়ের মা, কোনও এক কালে তাঁর পুরো নাম ছিল বিনোদিনী মণ্ডল। বয়স যত বাড়ছে ততই গ্রামের লোকদের মুখে মুখে বিনোদিনী একসময়, বিন্তিখুড়ি হয়ে ওঠে। বিন্তিখুড়ির একটাই সন্তান। এই নিতাই। টিয়েরঙের শাড়ি আর কপালে বড়ো সিঁদুরের টিপে বেশ দেখাত মনোরমাকে।

অনেক সাধ করে পাঁচ-সাতটা গ্রাম খুঁজে পেতে মনোকেই মনে ধরল বিন্তিখুড়ির। দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল তা হ’ল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। গুনে গুনে চব্বিশটা মেয়ে বাতিল করে, মনোরমাকে নিয়ে এল ঘরে। নিতাই-য়ের কোনও মতামত ছিল না। মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। মায়ের সায়ে সায় মিলিয়ে দিব্যি ছিল নিতাই। ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। এখন মা-ই তার সব। কোনওভাবেই মাকে কষ্ট দিতে চায় না সে। বাড়িতে মা ছেলে ছাড়াও আছে জ্যাঠতুতো দাদার বিধবা স্ত্রী, তার ছেলেমেয়ে নিয়ে। মোট পাঁচ-পাঁচটা সদস্য। সংসারে একটু টানাটানি থাকলেও ছিল না তেমন কোনও অভাব অভিযোগ। তখনকার সময়ে হেসেখেলে দিনগুলো কেটে যেত।

এভাবে বছর তিনেক কাটতে না কাটতেই একটা বড়ো অভাব বিন্তিখুড়িকে অস্থির করে তুলল। নাতিনাতনির অভাব। বিন্তিখুড়ি নানা জনের সঙ্গে নানা কথা বলে এ ব্যাপারে। এই তো সেদিন চড়া সুরে বিন্তিখুড়ির পাশের দুটো বাড়ির পরে ষষ্ঠীপদ ঘোষের বউকে বলে– দ্যাখো বউমা, ছেলেপুলে ছাড়া সংসার আবার সংসার নাকি! এমন সংসারে কখনও লক্ষ্মীশ্রী থাকে?

– অমন করে বলছেন কেন খুড়িমা, সবে তো বছর তিনেক বিয়ে হয়েছে। সময় হলে নিশ্চয়ই হবে।

আপনমনেই বিড়বিড় করে বিন্তিখুড়ি– পরে হলে তো চলবে না। সময় যে ফুরিয়ে এল। আমাকে তো দেখে যেতে হবে। নাতিনাতনির মুখ দেখার বড়ো সাধ আমার। না দেখতে পেলে ওপারে গিয়েও শান্তি পাব নে। দেখি কী করা যায়! এখন তো আমাকেই হাল ধরতে হবে।

শুরু হ’ল বিন্তিখুড়ির প্রচেষ্টা। অমাবস্যা পূর্ণিমা একাদশী মেনে মেনে ঝাড়ফুঁক তাবিজ কবজ। মাঝে মধ্যে আবার মাসের শেষ অমাবস্যায় মাঝরাতে চৌরাস্তার মোড়ে কালো দিঘির জলে স্নান করিয়ে ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সাধুবাবার ভেষজ ওষুধ সেবন, মাদুলি ধারণ– এসবও চলে।

মনো খুব মিষ্টি মেয়ে। শাশুড়িমা যা করান তা-ই করে। কিন্তু নিতাই-য়ের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এ’ভাবে চলতে চলতে গড়িয়ে গেল আরও দু-দুটো বছর। পাঁচ বছরের মাথায় বিন্তিখুড়ি তো দিশাহারা! কী করলে কী হবে মালুম পায় না! এক রাতে নিতাইকে ডেকে বলে– খোকা এক কাজ কর, তুই তো কামকাজে কলকাতা যাস, এবার সঙ্গে করে বউমাকেও নিয়ে যা। ওখানকার ডাক্তার দেখিয়ে আনবি।

– কেন মা, তোমার জড়িবুটি, মাদুলি, তাবিজ-কবজে আস্থা চলে গেল?

– না রে বাবা, কে বলতে পারে কীসে কী হয়?

অগত্যা মনোরমাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। কিছুদিন পিসির বাড়ি রাখে। চিকিৎসা চলে। এমনকী দুটো দিন সরকারি হাসপাতালেও থাকতে হয়। ছোট্ট একটা কাটাছেঁড়াও নাকি হয়। অবশেষে গ্রামে ফেরে।

এসবের পর বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই…। আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দিনটা। কাজ সেরে নিতাই সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ ঠেলে ঢোকার সময় শুনতে পায়, মনোর কলকল করে কথা। আর খিল খিল করা হাসি। বুকটা যেন জুড়িয়ে যেত। মা, বউ-তে খুব মিল। কত কথাই না হতো। মনোরমা দূরের গ্রামের নয়। পাশের কলাবতী গ্রামের মেয়ে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ি-বউ একসঙ্গে কলাবতী গ্রামে বেড়াতে যেত। নিতাই বাড়ি ফিরলেই মনো যেখানেই থাকত ছুটে আসত। জল গামছা এগিয়ে দিয়ে একডালা মুড়ি বাতাসা নিয়ে উঠোনে মাদুর পেতে বসত। তারপর হাতপাখা নেড়ে বাতাস করতে করতে কত কথা! এক সপ্তাহ না তো, মনে হতো যেন একবছর বাদে নিতাই বাড়ি এসেছে।

অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়। কোনও রাতে বেশিক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। কালের নিয়মে বা কালের স্রোতে একসময় মনোরমার স্মৃতিও ধুয়েমুছে সাফ হয়। কিন্তু…! নাহ্, আর ভাবতে পারে না। বুকটা ব্যথায় যন্ত্রণা করে। মাথাটা খালি হয়ে যায়।

হঠাৎ এক রাতে ভেতর ঘর থেকে মার গোঙানি কানে আসে। অনেকক্ষণ ধরে। একটানা। অগত্যা উঠতেই হয় নিতাইকে।

পায়ে পায়ে কাছে যায়। খাটো গলায় বলে– কী হয়েছে মা? কোনও সাড়া নেই। মাঝে মাঝে শুধু খকখক কাশির শব্দ। হ্যারিকেনের সলতে বাড়িয়ে, কপালে হাত রাখতেই চমকে ওঠে– এত তাপ! এ যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! এমন গভীর রাতে ডাক্তার – ওষুধ কোথায় পাব! তাছাড়া পয়সা! একটা সিকি পয়সাও নেই বাড়িতে। তাড়াতাড়ি জল ন্যাকড়া ভিজিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করে। প্রায় তিন দিন যাবৎ কলমি শাক সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। যতক্ষণ পুকুরে শাক আছে, ততক্ষণ না খেয়ে মরতে হবে না– গজ গজ করতে করতে বউদি বলছিল। একসময় ওর দিকে চোখ রেখে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে বউদি– এমন মদ্দা মানুষ থাকাও যা, না থাকাও তা। আচমকা কাশতে কাশতে মায়ের গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসে। খুব ভয় পায় নিতাই। মা-ও কি তবে মনোরমার মতো…! শীর্ণ মায়ের জীর্ণ শরীরটা মুহূর্তে অতীত ভোলায়। রুগ্ন মায়ের কপালে হাত রেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে– না, আর নয়। এভাবে মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না সে। কিছু একটা করতেই হবে।

এভাবে বসে বসে দুঃখ করলে, যারা গেছে, তারা তো ফিরে আসবে না। না আসবে মনোরমা, আর না আসবে…। পাশের ঘর থেকে বউদিকে ডেকে দিয়ে, রাতেই বেরিয়ে পড়ে নিতাই। যেতে যেতে বউদির চড়া সুর কানে আসে– ক্ষয়রোগ গো ক্ষয়রোগ। ভালোমন্দ না খাতি খাতি এই রোগ দেহে বাসা বাঁধে।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথম এতদিনের চেষ্টায় নিতাই ধীরে ধীরে মূর্তি গড়ায় হাত দেয়। পুজো প্রায় এসে গেছে। বর্ষাও তেমন হয়নি। কেমন যেন গুমোট চারদিকটা। এবারের অকাল কালবোশেখিতে নিতাইয়ের ঘরের চালার কিছুটা অংশ উড়ে গেছে। তাই এবারের প্রথম সামান্য বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে এক হাঁটু জল। তাই নিতাইকে যেভাবেই হোক ঘরের চালাটা সারাতে হবে। আগে মায়ের চিকিৎসা, না আগে ঘর সারানো– কোনটা আগে করবে? ভেবে পায় না। দুটো চাপ মাথায় নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায় কাজে। মনে মনে ভাবে নিতাই, আগে মা। তারপর সব। এখন তো তার নিজের বলতে, একান্ত আপন বলতে, আছে কেবলমাত্র মা।

প্রায় রাতেই সে আসে। বিশেষত শেষ রাতে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে গলা জড়িয়ে, খিল খিল করে হেসে বলে– বাবা, ও বাবা, এই যে আমি। এই তো তোমার কাছে। এ মা দেখতে পায় না! বাবা আমাকে ছোঁও তো দেখি, ইস্ ছুঁতে পারে না। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে নিতাই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কাকে যেন ছুঁতে চায়। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধাতস্ত হয়। তখন শুধুই বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যেদিন মুন্নি এল তার কোলে, সেদিন-ই মনোরমা ফাঁকি দিল। মুন্নিকে পেয়ে মনোর দুঃখ ভুলে ছিল নিতাই। মুন্নির কচি কলাপাতার মতো, নরম মোলায়েম মনের স্পর্শে, দেহের ছোঁয়ায় একটু একটু করে নিতাই-য়ের দগ্ধ মনের ক্ষতে প্রলেপ পড়ে। নিতাই অতীত ভবিষ্যৎকে ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে।

মেয়ে তো নয়, যেন এক ডানা কাটা পরি। গরিবের ঘর আলো করে মা লক্ষ্মী যেন স্বয়ং এসেছেন। একটু বড়ো হতে না হতেই রূপের ছটায় চারদিক আলোকিত। সাত পেরোতেই ভ্রমরকালো ডাগর চোখদুটো তুলে বাবাকে শাসন করে– এত দেরি হয় কেন বাবা? আরও তাড়াতাড়ি আসতে পার না? কাজে বেরোলে তুমি আমায় ভুলে যাও, তাই না বাবা?

– ওরে মা, থাম থাম। সবে তো এলাম, এখনও হাত-পাও ধুইনি। এরই মধ্যে তোর একসঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর দিই কী করে বলতো? ঠাম্মা ছুটে এসে বলে

– আয় দিদিভাই, আমার কাছে আয়। বাবা হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিক, তারপর তোর সব কথা শুনবে। কেমন? আয় না দিদিভাই, আয়…। ঠাম্মা যত জোর করে মুন্নির তত জেদ বাড়ে।

– না আমার কথার জবাব না দিয়ে বাবা কোথাও যাবে না।

অগত্যা নিতাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন শুনিয়ে তবে নিজের কাজে যেতে হয়। দিন দিন নিতাই অনেক বেশি বাড়িতে আসে। এমনকী পুজোর মরশুমেও একদিনের বদলে হপ্তায় দু’তিনদিন করে বাড়ি আসে। এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। কিন্তু নিতাই-য়ের স্পষ্ট জবাব– ওরে তোরা বুঝবি না, আমার ছোট্ট মা-টা যে সারাক্ষণ আমার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে।

সারাটা দিন মুন্নি গোটা পাড়ায় খেলে বেড়ায়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এর-তার বাড়ি ঘোরাঘুরি করে। গাঁয়ের সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসে। যার বাড়ি যা কিছু হোক, বিয়ে পৈতে পুজোআচ্চা ইত্যাদি, মুন্নি থাকা চাই-ই চাই-ই। মুন্নি না এলেও জোর করে ধরে আনে সবাই। নইলে সব আনন্দই যে মাটি। দু’গালে টোল ফেলে, গলা ছেড়ে খিলখিল করা মুন্নির হাসি, গাঁয়ের ঘরে ঘরে উলুধবনি শঙ্খধবনির চেয়েও বেশি পয়া, বেশি আদরণীয়।

প্রতি রাতে মুন্নি ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে, কল কল করে সারাটা দিনের গল্প বলে। কত জ্যাঠা, কাকা, মাসি, পিসির বাড়ি আজকে গিয়েছে। কতজন, কুলের আচার, আমের মোরোব্বা খাইয়েছে, বিল্টু, নেপু, তিন্নি ওদের সঙ্গে চু কিত কিত খেলতে খেলতে কতবার পড়ে গেছে। কতবার ডাংগুলিতে বল্টু পিন্টুকে হারিয়েছে– নানান দস্যিপনার গল্প ঠাম্মাকে শুনতে হয়। ঠাম্মারও মন ভরে ওঠে। একসময় বকবক করতে করতে মুন্নি ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মুন্নিকে দু’হাতে জড়িয়ে, আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে ঠাম্মা। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। নাতনি বলে কোনও ক্ষোভ নেই বিন্তিখুড়ির। বরং বেশ গর্ব। অমন রূপ ক’জন পায়! মনে মনে ভাবে– দু’হাত তুলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলে, এ যে দেবে ধর্মে তুষ্ট হওয়ার ফল গো। মেয়ের শখ তার বহুদিনের। নিজের তো ছিল না। এমনকী তাদের বংশেও মেয়ের সংখ্যা খুব কম। অবশেষে মুন্নি এল। তার ষোলোকলা সাধও পূর্ণ হল।

গরিবের ঘরে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। কিন্তু ঘাটতি নেই ভালোবাসার। তাই সবার অফুরন্ত আদর ভালোবাসায় তিল তিল করে বেড়ে উঠছিল মুন্নি। গোলগাল ফরসা টুকটুকে মেয়েটা ঘরে বাইরে সবার মন কেড়ে নিয়েছে। নিতাই-য়ের ছিল নয়নের মণি। বাঁচার একমাত্র প্রেরণা। অন্ধের যষ্টি।

সূর্য ডুবে যেতেই হালকা অন্ধকার নামে চারধারে। বছর আটেকের মুন্নি। তখনও উঠোনে এক্বাদোক্বা খেলছিল। হঠাৎ জেঠির ডাক– খুকি ও খুকি যা তো মা, গোয়াল ঘরের ধোঁয়াটা দিয়ে আয় তো মা। তোর ঠাকুমার আবার জ্বর এসেছে। দেখি গিয়ে কী করা যায়!

– যাই জেঠি, বলতে বলতে মুন্নি লাফাতে লাফাতে আসে। ধোঁয়াটা নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যায়। সেটাই বোধ হয়…।

নিতাই মণ্ডলের গোয়ালঘর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। মুন্নি মাঝে মাঝেই গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে আসে। ওটা ষষ্ঠীপদ জানে। কিছুদিন যাবৎ তার মাথায় একটা মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে। নাদুসনুদুস মেয়েটার দিকে চোখ পড়লেই ষষ্ঠীপদর বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। দুশ্চরিত্র, লম্পট ষষ্ঠীপদ তক্বে তক্বেই ছিল। সুযোগের অপেক্ষায়। গোয়ালঘরের সামনে যেতেই মুন্নি একটা খসখস শব্দ শুনতে পায়। ঘুরে তাকায়। কিন্তু কারুকে নজরে পড়ে না। তাই সে অনায়াসে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তখনও পাশের বাড়ির রামতনুদাদা গরু নিয়ে ফেরেনি। আজ হাটবার। তাই হাট সেরে রামতনুদাদার গরু নিয়ে ফিরতে আজ বেশ দেরি হবে। আগে ওদের অনেক গরু ছিল, এখন একটাই গরু। সে-ই দেখাশোনা করে। কিন্তু রামতনুদাদা যে এখনও ফেরেনি, মুন্নি তা জানত না।

রামতনুদাদার সঙ্গে মুন্নির খুব বন্ধুত্ব। অসম বয়সের বন্ধুত্ব। কিন্তু মাঝখানে কোনও ফাটল ছিল না। এতটাই গভীর ছিল যে, একদিন তাকে না দেখলে মুন্নি অস্থির হয়ে উঠত। ঠাম্মা ছাড়া আর যে মুন্নির বকম বকম ধৈর্যসহকারে শুনত, সে হল একমাত্র রামতনুদাদা। কিন্তু আজ যে হাটবার, সেটা মুন্নির মাথা থেকে বেমালুম উড়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগেই শিয়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীপদটা। সব দিক আটঘাট বেঁধে। আজই সুবর্ণ সুযোগ। নিঃশব্দে সে মুন্নির দিকে এগিয়ে আসে। নেকড়ে যেন মাংসের গন্ধ পেয়েছে। লোকটার বয়স বছর পঞ্চাশ। শক্তসমর্থ্য শরীর। খালি গা। খাটো ধুতি। চুপিচুপি তাকে ঢুকতে দেখে বছর আটেকের মুন্নি বিস্ময়ে হতবাক। কোনওমতে টেনে টেনে বলে– জ্যাঠা তুমি এখানে! হাতে ধরা কেরোসিনের কুপিটা, সামনে এনে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।

এক ফুঁ-য়ে কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে ষষ্ঠীপদ মেয়েটার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে কষে। তারপর পাঁজাকোলা করে খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দেয়। নেকড়ের হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচি মেয়েটার ওপর। লালসায় এক্বেবারে পশু হয়ে ওঠে মুন্নির ষষ্ঠীজ্যাঠা। একটানে খুলে ফেলে মুন্নির বেশবাস। সেই উন্মাদ নরপশু ফুলের মতো ছোট্ট মুন্নির অচৈতন্য দেহটার ওপর একবার নয় বারবার চালায় হিংস্র তাণ্ডব। নিষ্পাপ ফুলটিকে এক্বেবারে দলে পিষে নারকীয় খেলা শেষ করে।

মুন্নির জেঠি বার দুই খুকি খুকি করে ডেকে, মনে মনে ভাবে পাশের ঘরে তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলছে বোধ হয়। সে-ও নিশ্চিন্তে পুজোর ঘরে বসে যায়। নিতাই তখন বাড়ি ছিল না। সে গিয়েছিল কলকাতায়। বাড়িতে শুধু জেঠি, আর বিছানায় মুন্নির ঠাম্মা।

ঘন্টা দুই পর রামতনু যখন গরু নিয়ে গোয়ালঘরে আসে, তখন খুব ক্ষীণ কণ্ঠে গোঙানি কানে আসে। হাতের কাজ ফেলে, কোঁচর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালায়। রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া অচৈতন্য মুন্নিকে দেখে চমকে ওঠে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে পাড়ার সবাইকে ডেকে নিয়ে, ভ্যান ঠিক করে মুন্নিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোয়। কিন্তু এসব করতে করতে বেশ সময় লেগে যায়। সেই সময়টুকু দিতে পারে না ছোট্ট মুন্নি। অনেকক্ষণ রক্তক্ষরণ হতে হতে অসাড় হয়ে পড়ে মেয়েটা… পথেই মুন্নি…। একসময় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিভে যায় ওর জীবনপ্রদীপ।

ছোট্ট প্রাণ-পাখিটা চিরতরে ছটফট করতে করতে খাঁচা ছাড়ার আগে, কোনওমতে ক্লান্তস্বরে ঠাম্মাকে বলে যায়– কমলিদিদির বাবা, জ্যা…। আর বলতে পারে না সে।

শহর থেকে ফিরে প্রবল আক্রোশে দপ করে জ্বলে ওঠে নিতাই। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাঁপতে কাঁপতে বলে– আজই আমি কুপিয়ে শয়তানটার মুণ্ডু নামিয়ে দেব। শালা! কোথায় যায় দেখছি! তাতে আমার যা শাস্তি হয় হবে। ছিঃ ছিঃ নিজের নাতনির থেকে ছোটো, ওইটুকু এক দুধের শিশু! ছুটে যায় নিতাই। হাত থেকে শহরে কেনা মুন্নির লাল কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন টিপ, লাল ছোট্ট ফ্রকটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়।

মুন্নি মারা যাবে এটা বোধহয় ষষ্ঠীপদ ভাবতে পারেনি। তাই চমকে ওঠে! নিতাই আসার আগেই বেগতিক দেখে চটপট গ্রাম ছাড়ে ষষ্ঠীপদ।

একসময় নিতাই জ্ঞান হারায়। দিন তিনেক পর নিতাই-য়ের হুঁশ আসে। কথায় কথায় গ্রামের ছেলে গৌরাঙ্গ, মহাদেবকে বলে– শয়তান ষষ্ঠীটাকে খুঁজে পাসনি এখনও?

ওরা কাঁচুমাচু মুখে মাথা নাড়ে। নিতাই আবার চিৎকার করে ওঠে– শয়তান লম্পট ষষ্ঠীটা যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ঠিক ধরতে পারবই পারব। আর ধরতে পারলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে, এক্বেবারে টুঁটি চেপে মেরে ফেলব। শোন আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ হল সোনার দেশ। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমি এমন লম্পটের জন্ম দিতে পারে না। এই সোনার গাঁয়ের আলো বাতাসে ওরকম জানোয়ারের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। ও একটা ভুঁইফোঁড় লম্পট জানোয়ার– বলতে বলতে পাগলের মতো নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। নীচের চোয়াল দাঁত দিয়ে চেপে কী সব বিড়বিড় করে।

আজন্ম চেনা গৌরাঙ্গ, মহাদেব, মদনের মতো গাঁয়ের ছেলেরা ক্রোধে উন্মত্ত, রক্তচক্ষু, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য নিতাইকে যেন সেই মুহূর্তে চিনতে পারে না। তারপর থেকে বেশ ক’টা বছর অচেনা নিতাই ভয়ংকর মূর্তিতে খুঁজে বেড়ায় ষষ্ঠীকে। কিন্তু কোথাও পায় না। শয়তান ষষ্ঠীটা জানে, সময় সব ক্ষতের প্রলেপ দেয়। তাই সে ঘাপটি মেরে থাকে। মনে মনে ভাবে একসময় না একসময় নিতাইকে হাল ছাড়তে হবে।

কিন্তু নিতাই-য়ের বুকে ক্রমশ তুষের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে জ্বলবে… শুধু একটু বারুদের অপেক্ষা। নিতাই মুন্নিকে হারিয়ে উন্মাদের মতো থানা-পুলিশ করতেও ছাড়েনি। সব্বাই শুধু ওকে আশ্বস্ত করছে একদিন না একদিন এর শাস্তি হবেই হবে। জানোয়ার ষষ্ঠীটা জানোয়ারের সাজা-ই পাবে।

এ মুহূর্তে প্রতিমা প্রায় শেষের দিকে। মায়ের জন্যই নিতাই-য়ের মূর্তি গড়ায় হাত। কয়েকদিন আগে খড়ের ওপর পড়েছে মাটির প্রলেপ। পাশের বাড়ির গৌরাঙ্গ সেদিন কথায় কথায় বলে– হ্যাঁগো নিতাইদাদা, তোমার প্রতিমা তো এবার শেষের দিকে, তাই না গো? গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে নিতাই বলে– নারে এখনও অনেক দেরি। কত কিছু বাদ আছে।

– তা এবার-ই প্রথম বাড়িতে মূর্তি গড়ছ, তাই তো?

– হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। প্রতিবার তো কলকাতাতে-ই…।

এ ভাবেই কাটে আরও কিছুকাল। ক’দিন বাদেই পুজো, প্রতিমা প্রায় শেষ। প্রতিমার মুখের আদল যে দেখে, সে-ই কেমন যেন আঁতকে ওঠে। নিতাই-য়ের তুলি ধরা হাতটা থমকে যায়। নিজে নিজেই বলে– এ কী! এ কার মুখ!

সেদিন গৌরাঙ্গ হঠাৎ বলে ওঠে– নিতাইদাদা, এ তুমি কার মুখ আঁকলে গো? বড়ো চেনা চেনা যে। সকালের উজ্জ্বল আলোয় গাঁয়ের অনেকেই সেখানে জড়ো হয়। নিতাই-ও চমকে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকায়। সবার ফিসফিস কথাবার্তা কানে যায়। গৌরাঙ্গ আবার বলে ওঠে– এ যে আমাদের মুন্নি গো! আচমকা ঘুরে তাকায় নিতাই। হাত থেকে তুলিটা পড়ে যায়। সারা শরীরে শিহরণ জাগে! কাঁপতে কাঁপতে বলে– দাঁড়া অসুরটাকে একটু অদলবদল করে দিই। ধীরে ধীরে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে শয়তান ষষ্ঠীটাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের আড়ালে এ কার মুখ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। গাঁয়ের সব্বাই দেখে নিতাই-য়ের চোখে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন।

ধীরে ধীরে সেই আগুনের ছোঁয়ায় সমবেত জনতা জ্বলে ওঠে। আর সেই সম্মিলিত দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা ভস্মীভূত করে, শয়তান লম্পট ভুঁইফোঁড় ষষ্ঠীটার মতো আরও অনেক অনেক অনেক…।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব