বনপথে বনচরী

পরম হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পৌঁছে গিয়েছে। আরও কিছুটা গেলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। বনপথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। রেলস্টেশনে নেমেছে ভোরের আলো ফোটার আগেই।

ট্রেন থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। স্টেশনের পিছন থেকে একটা পথ বনের দিকে চলে গিয়েছে। মানুষের পায়ে পায়ে ক্ষয়ে কী দারুণ পথরেখা তৈরি হয়েছে। আর এই চেনা পথটা ধরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আপন ঘরে ফেরার অনাবিল আনন্দে চলতে থাকে সে। বহু বছর পর বাড়ি ফেরার একটা আনন্দ আছে বইকি!

শ্রাবণের ভরা বর্ষায় পথঘাট ভিজে। কচিসবুজ পাতা গাছের ডগায় ডগায়। পাখির কিচিরমিচির। বৃষ্টিভেজা পাখির ঝাঁক, ডানা ঝাপটাতে থাকে গাছের ডালে ডালে। সামনে একটা ভাঙা সাঁকো রয়েছে। কয়েকটা বাঁশ দিয়ে নদী পারাপার করা যায় এই পথে। সাঁকোটা পার হলেই একটা মেঠো পথ চলে গিয়েছে বনের দিকে।

ভোরের আলোয় এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। নিস্তব্ধতা চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টিতে পথ ধুয়ে গেছে। ধুলো মাটিতে বনের সর্বত্র পলির আস্তরণ পড়েছে। পরমের পায়ে ছাপ পড়ছে সেই নরম বনপথে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর হাঁপিয়ে গিয়েছে। তাই একটা আধশোয়া গাছের ডালে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। হয়তো গাছটা গত রাতের ঝড়ে নুইয়ে পড়েছে। আরও কয়েক কিলোমিটার পথ পার হলেই ছোটো নদী।

ভরা বর্ষায় জল থইথই নদী পার হওয়া খুব কঠিন। এই সময় স্রোতের প্রবল টান থাকে। আবার হড়পা বানে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। যখনই নদীর জলে পা রাখে পরম, স্রোতের টানে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। জলের গভীরতা খুব বেশি, আবার কোথাও হাঁটুজল। আবার কিছুটা পিছিয়ে নদী পার হতে যায়। কিন্তু পিছলে যায় বারবার। ভয় ভয় ভাব কাজ করছে। এবার কিছুটা হতাশ হয়ে বসে পড়ে। নদীর দিকে চেয়ে থাকে অপলক। আর ভাবতে থাকে অতীত দিনের কথা। বেলা গড়িয়ে এখন দুপুর। মধ্য-গগনে গনগন করছে সূর্য‌্য। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যেন আলোর রশ্মি চুঁইয়ে পড়ছে।

বনচরী রোজ নদীর তীরে আসে গরু চরাতে। বর্ষায় লকলকে ঘাস নদী অববাহিকায়। এখানেই গরুর বাথান। গরুর পাল আপন মনে চরতে থাকে। নদীর ওপারে তাদের বসতি। সাতসকালে যখন গরুর পাল নিয়ে এসেছিল তখন নদীতে স্রোত ছিল না। সহজেই পার হয়ে এপারে এসেছে। অতিবৃষ্টিতে বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠে নদী। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেই হড়পা বানে নদীর জল বেড়ে যায়। আর দুই পাড়ের মানুষ নদীর দিকে চেয়ে থাকে। বৃষ্টি কিছুটা ধরলে আবার নদী পারাপার করে।

শীতের সময়ে নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। নুড়িপাথর আর বালি বোঝাই হয় নদীগর্ভ। বনচরী সকালেই নদী পার হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে বৃষ্টি ছিল না। পরিষ্কার আবহাওয়া, কখন যে দিন গড়িয়ে গেছে! রোজ কিছু খাবার নিয়ে আসে বনচরী। গ্রামের আরও কয়েকজন এই বনাঞ্চলের ঘাস জমিতে গরু ছাগল নিয়ে আসে। শীতের মরশুমে এই নদী চরে পিকনিক পার্টির মোচ্ছব বসে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আবার। প্রচণ্ড বৃষ্টির ছাঁট। ছিটছিট রঙের প্রজাপতির মতো ছাতাটা মেলে নিজেকে আড়াল করছে বনচরী। গরুর পাল আর তার সঙ্গীরা বেশ কিছুটা দূরে। বনচরী ঘরের গাই-বাছুর সঙ্গে নিয়ে আসে। ছোট্ট চঞ্চল বাছুরটা হঠাৎ দলছুট হয়ে গিয়েছিল। আর সেই বাছুরের পিছনে ছুটতে ছুটতে নদীর তীরে এসে পৌঁছোয় বনচরী।

একটা দমকা হাওয়া আর সঙ্গে এলোমেলো বৃষ্টি শুরু হল। বনচরীর ছাতাটা উড়ে এক্কেবারে পরমের কাছে। পরম তখন বৃষ্টির থেকে রক্ষা পেতে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় রঙিন ছাতাটা তার পায়ে কাছে লাগে। সযত্নে তুলে নিয়ে বনচরীর হাতে দেয়। লাজুক মুখে ছাতাটা নিয়ে ঘুরছে সে অন্যপথে।

পরম সাহস করে জিজ্ঞাসা করে, তোমার গ্রাম কোথায়? নদীর ওপারের দিকে হাত তুলে দেখায় বনচরী। ছাতাটা মুঠোতে শক্ত করে ধরে বৃষ্টি আটকাতে থাকে। অচেনা দুজন একই ছাতার তলায়। এলোপাথাড়ি বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে বনচরীর শঙ্খশুভ্র হাতের কবজি। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে এখন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্য‌্যের রশ্মি। রামধনু ওঠার সম্ভবনা প্রবল।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে পরমকে ইশারায় বনচরী তার সঙ্গে যেতে বলে। ফিক ফিক করে মুচকি হেসে রাস্তার দিক নির্দেশ করে সে। বনপথে আরও কিছুটা গভীর অরণ্যে একটা বনদেবীর মন্দির। আর মন্দিরের চাতালে গবাদী পশু নিয়ে যারা রোজ আসে, তারা ঝড়-ঝঞ্ঝায় আশ্রয় নেয়। সকলেই অপেক্ষায় নদীর জল কমলে ওপারের বনবস্তিতে ফিরে যাবে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখনও। একই ছাতার তলায় হাঁটছে দুজন, পরম ও বনচরী।

পশুপালকরা মন্দির চত্বর ছেড়ে ফিরছে। নদীর হাঁটুজল বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। মাঝপথে ওদের দুজনকে দেখে বেশ হতবাক বনচরীর সঙ্গী-সাথিরা। সকলেই নদী পার হতে থাকে পশুর দল সঙ্গে নিয়ে পরম বহুদিন এই ভাবে নদী পার হয়নি। পা পিছলে যায়। বনচরী কখনও আলগোছে পরমকে ধরতে যায়। আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নেয়। মধ্যনদীর গর্ভে দুটো হাত যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ধরে ফেলে।

নদীর জল ছুঁই ছুঁই গাছের ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে। আঁধার নেমে আসছে রাতের গভীরে। হৃদয়ে উথলে ওঠে ভালোবাসার ফল্গুধারা। নদী পার করে এখন বনবস্তির পথ ধরেছে পরম। বাকিদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে যায় পরমের। গোধূলির রং মেখে এখন সবার ঘরে ফেরার পালা। বেশ টুকটুকে দেখতে বনচরী। পথ চলতে চলতে যেন ইশরায় কত কথা হয়। ভালোবাসা হয়ে যায় চোখে চোখে। আর কিছুটা গেলেই বনচরীরা সামনের বনবস্তিতে ঢুকবে। তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় হাসি ঠাট্টা চলছে।

এই অঞ্চলের উপজাতি মেয়েরা খুব প্রাণ চঞ্চল হয়। কোনও ভনিতা পছন্দ করে না। সহজ সরল জীবনবোধ আর পরকে আপন করে নেবার সহজাত প্রবৃত্তি এদের। কিছুটা গেলেই বনপথটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পরম হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে।

চেনাপথ পরমের যেন খুব অচেনা লাগছে। বহুবছর পর ঘরে ফিরছে। পথের সবুজ বনের পথের বাঁকে মোচড় দিয়ে ওঠে মন এক অনাবিল আনন্দে। দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যায় বনচরীদের দল। বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় সে। আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের ডাক।

মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছরের পুরোনো কথা। তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। সে ছিল এক বৃষ্টি বাদলের দিন। মনিবের ঘরে হাল চাষ করত বাবা সত্যাপির। হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোয় সব কিছু নিমেষে শেষ হয়ে যায়। চরম দারিদ্র নেমে আসে তাদের সংসারে।

দিনমজুর বাবার মৃত্যুতে মনিবের ঘরে মায়ে একটা কাজ জুটলেও, সংসারে টানাটানি অবস্থা। কয়েক মাস পর শহরের এক ঠিকাদারের অধীনে পরম কাজ পায়। এই সূত্রে দক্ষিণ ভারতে যাওয়া। বহুবছর পর বর্ষার মরশুমে কিছুদিন ছুটি নিয়ে তার ঘরে ফেরা। বহুদিন পর শাঁখ, ঝিঁঝিঁর শব্দ শুনতে শুনতে আলো-আঁধারি পথে গ্রামে ঢুকছে পরম।

পথ হাঁটতে হাঁটতে এখন কালো পিচ ঢালা রাস্তাটা সামনে এসে পড়ল। এই পথে শহর থেকে বাস এসে ঢুকছে বনাঞ্চলের শেষ ঠিকানায়। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি পথে বাসের হেড লাইটে বনপথটা আঁধারের বুক চিরে চলে গেছে।

গ্রামে ঢোকার মুখেই তাদের ঘর। টিমটিম করে পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। ছোট্ট বোন খুশি, বই পড়ছে। দাদাকে দেখে জাপটে ধরে। রান্নাঘর থেকে পরমের আসার খবর পেয়ে ছুটে আসে মা। বেশ কয়েক বছর বাইরে থাকায় একটা আধুনিকতার ছাপ পরমের চোখে মুখে। তবুও পরমকে যেন আনমনা লাগছে খুব। হাত মুখ ধুয়ে ছুটে যায় মনসা মন্দিরের সান্ধ্য আড্ডায়। বাল্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কিছুক্ষণ গল্প করে ফের বাড়ি ফেরা।

বনচরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকদিন। প্রথম দেখার পর থেকেই পরম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিল। সাতসকালে বনচরীকে দেখত গাঁয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। গ্রামের শেষে সেচ বাঁধের পাড় ঘেঁসে বনচরীদের বস্তি। যেন দুটো যমজ গ্রাম। রেশন থেকে মুদির দোকান সবই পরমদের ঘরের সামনে। দুবেলা এই গ্রামেই আসতে হয় তাদের।

লাজুক স্বভাবের পরম। ইচ্ছে থাকলেও সময় সুযোগ করে আর সেরকম কথা হয়নি। বিভিন্ন ছলে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। কখনও বনচরী হাতের তালুতে মুখ ঢেকে চলে গিয়েছে। একমুখ প্রাণোচ্ছ্বল হাসি, পরমের মনের গহীনে ভালোবাসার প্লাবন বইয়েছে। কয়েকটা মাস যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি।

নুন আনতে পান্তা ফুরায় বনচরীদের সংসারে। কোনও দিন একশো দিনের কাজ জুটলে তাতেও পরিবারের সঙ্গে হাত লাগায় বনচরী। কিংবা সাপ্তাহিক গ্রামীণ হাটে, মুরগীর ডিম নিয়ে বিক্রি করতে যায়। আর প্রতিদিন গাঁয়ে গরু, ছাগল নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে যেতে হয় বনবাথানে। নিজ ঘরের গাই-বাছুরটিও তখন তার সঙ্গী হয়। পরমদের ঘরের পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে চলে

গরু-ছাগলের পাল। কিছুটা ঢালু জমি, পগার পেরোলেই ঘন অরণ্য।

চঞ্চল ছটফটে বাছুরটা দৌড়োতে দৌড়োতে চলছে। কখনও রকেটের গতিতে গভীর বনাঞ্চলে ঢুকে যায়। আবার ফিরে আসে। বনচরীর সাথিরা বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে যায়। সে থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। জানে রোজকার মতো হারিয়ে যাওয়া বাছুরটা আবার ফিরে আসবে। এমনটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে। বনের পথের নির্জনতায় একাকী আকাশ কুসুম ভাবতে থাকে বনচরী।

কয়েকটা মাস গ্রামীণ শ্যামলিমায় কাটিয়ে এবার কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে পরমকে। ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে। হঠাৎ চেনা মানুষের মুখ দেখে হকচকিয়ে ওঠে বনচরী। মন ছুঁয়ে যাওয়া মানুষের মুখটা দেখেই যেন মন ভালো হয়ে যায়। নির্জন বনপথে আচমকা পরমকে দেখে অজানা উল্লাসে সারা মন ভরে ওঠে। কর্মস্থলে এই পথে আজ ফিরছে সে।

হাত নাড়তে নাড়তে খুব কাছে চলে এসেছে। লজ্জা ভেঙে গড়গড় করে না বলা অনেক কথা বলতে থাকে পরম। মাথা নুইয়ে মিহি মাটির বন্য উঠোনে একটা শুকনো কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি আঁকতে থাকে বনচরী। লজ্জায় বনচরীর চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

চোখ-মুখে একটা অব্যক্ত বেদনা। অনেক কিছুই তো বলতে চায় সে! বাছুরটা খুঁজতে খুঁজতে বনচরী তার চেনা বনপথে লাজুক হরিণীর মতো যেন হারিয়ে যায় সবুজ বনের বাঁকে।

পরমের বুঝতে মোটেই আর অসুবিধা হল না যে, কথা বলতে পারে না বনচরী। কয়েকটা মাসের বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, পরমের বুকে ভালোবাসার সিন্ধু তৈরি করেছে। কথা বলতে না পারা মেযো যে বহু কথা বলে দিয়েছে। মায়ার এক অদ্ভুত বাঁধনে বনচরী তাকে পিছন থেকে অহরহ টানে। বন্য সুবাসের মতো তার শরীরের গন্ধ বনাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

চক্র

এলএলবি পাস করল বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় হয়ে। বাবার ইচ্ছা, হয় বিচার বিভাগ নয় কোনও বাণিজ্য সংস্থায় চাকরি। প্র্যাকটিস করলেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেস। আদালতে ফৌজদারি মামলা লড়া যথেষ্ট ঝুঁকির। দিনরাত জঘন্য সব অপরাধ নিয়ে নাড়াঘাঁটা। প্রতারিত নির্যাতিতদের পাশাপাশি ভযংকর সব অপরাধীরাও আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। যথার্থ। ওদিকে সাধারণ দেওয়ানি মামলা অন্তরাকে এমনিতেই টানে না।

বিশ-পঁচিশ বছর পর রায় রেরোলে কেস জেতা ও হারার মধ্যে তফাত অনুভব করা মুশকিল। তাই বাবার পরামর্শ মেনে বিচারক হওয়ার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে টুকে পাস করা যায় না বলে দুর্নাম এবং সেইহেতু রাজ্যের জুডিশিয়ারি চাকরির সিংহভাগ দখল করার সুনাম, দুটোই আছে। অন্তরাও তাই আশাবাদী।

পরপর দু’বার দুর্ঘটনা! প্রথমবার হঠাৎ টাইফয়েড। অসুখ নিয়ে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল। যা প্রস্তুতি ছিল, হয়তো পেরেও যেত। কিন্তু মা বাবা দুজনেই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন, শরীর আগে, পরীক্ষা পরে। বাবা বলেছিলেন, পরের বারের জন্য প্রিপারেশন নে। বয়স পালাচ্ছে না। পরের বার বয়স না পালালেও ঠিক পরীক্ষার আগেটায় বাবা-ই চলে গেলেন।

ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। যে-চোখ দুটো কন্যাকে বিচারকের আসনে দেখবে বলে দিন গুনছিল, সেই দুটোই বুজে গেল চিরতরে। জুডিশিয়ারি পরীক্ষাটা কেমন যেন অপয়া মনে হতে লাগল। পরপর দুবার বাধা পড়ল। একবার মেয়ের জীবন সংশয়, আর একবার বাপের জীবনাবসান। এক জ্যোতিষীর ভাষায়, মহাগুরুর পতন যোগ। আইনের পেশা নাকি জাতিকার গ্রহ-নক্ষত্ররা অনুমোদন করছে না।

জীবন তবু থেমে থাকে না। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থায় আইন আধিকারিক পদের আবেদন করার পাশাপাশি, কর্পোরেট ল নিয়ে স্বাধীন প্র্যাকটিস করার পরিকল্পনা শুরু করল। বাড়িতে মিলি বা অন্তরার সিভিল না ক্রিমিনাল না কর্পোরেট তাই নিয়ে মাসাধিক কাল রোজই প্রায় প্রত্যহ টেবিল বসে যায়। শেষে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা কর্পোরেট আইনজীবিকাই লক্ষ্য হিসাবে স্থির হল।

এখন যে-দিকেই যাক, আনকোরা আইন পাস করা ছাত্রছাত্রীদের নিজে সরাসরি প্র্যাকটিস শুরুর আগে কোনও বড়ো উকিল বা আইনজীবীর অধীনে শিক্ষানবিশ থাকতে হয়, না হলে বাজারে কল্কে পাওয়া দুষ্কর। অনেকে তো নিজেরা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরেও সিনিয়রের সঙ্গে গাঁটছড়া খোলে না। অন্তরাও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে বিশ্বাসী।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তারা কেউই বিশেষ আমল দিল না। দ্বিতীয় বছর বিভাগীয় শিক্ষা ভ্রমণের অঙ্গ হিসাবে হাইকোর্ট ভিজ়িটের সময় রথীন ঘোষ বলে একজন উকিলের সঙ্গে পরিচয় হতে, সে নিজের কার্ড দিয়েছিল। তাকে ফোন করাতে সে নিজের সিনিয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেবে বলল।

নাগের বাজারের নাম করা উকিল পুলকেশ ঘোষাল। বাড়িতে মক্কেলদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা থাকলেও তাঁর চেম্বার হাইকোর্ট চত্বরে। বেশ কয়েকবার তদবিরের পর সাক্ষাৎকার হল। যেমনটা শুনেছিল, তেমন মোটেই মনে হল না। বেশ হাসিখুশি অমায়িক ভদ্রলোক। ব্যবহারে হুপো নয়, যথেষ্ট আন্তরিকতার ছাপ। অন্তরার আইনি জ্ঞানগম্যি পরখ করার বাইরেও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যাপারেও খুঁটিয়ে জানলেন। শেষে বললেন, শতদ্রুর কাছে কাজের সব ডিটেইলস জেনে নিন।

পাস করার পর আড়াই বছর অতিবাহিত। হতাশায় গ্রাস করা মনটা নেচে উঠল। তবে ভদ্রলোক শুধু কর্পোরেট কেস নয়, জমি সম্পত্তি সংক্রান্ত সবরকম মামলাই লড়েন। এই জাতীয় মামলার বিশেষজ্ঞ বলা যায়। বড়ো বড়ো বিল্ডারদের স্বার্থ যেমন দেখেন, তেমনি বিল্ডারের কাছ থেকে প্রতারিত গ্রাহককে মোটা ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার ইতিহাসও আছে। পুলকেশ ঘোষালের নিজের নামডাক তো আছেই, তাঁর দুজন জুনিয়রও স্বাধীন জমিজমা সংক্রান্ত কেস লড়ে ভালোই সফল। তারা স্যার বলতে অজ্ঞান।

ভদ্রলোক আধঘণ্টা কথা বলার জন্যও দেড় হাজার টাকা দক্ষিণা নেন, ওটাই সর্বনিম্ন। সাদা কাগজে একটা মামুলি চিঠি বা অভিযোগপত্র খসড়া করে দিতেই ন্যূনতম আঠাশশো টাকা নিয়ে থাকেন। পুরোদস্তুর উকিলের চিঠির দর তো অনেক বেশি। শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতে মক্কেল ছড়িয়ে তাদের তালিকা জানলে সমীহ হয়। সেই তুলনায় দক্ষিণা নাকি কমই নেন, যাতে সাধারণ মানুষও সাহায্য পেতে পারে। এমন একজনের অধীনে কাজ শুরু করতে চলেছে!

অন্তরার মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে নাগের বাজারে যাতায়াত তুলনায় সুবিধার হলেও কাজ করতে, শিখতে ও বেশি অভিজ্ঞতার খাতিরে যেতে হবে হাইকোর্ট পাড়ায়, সেই বাবুঘাটের কাছে।

কত টাকা স্টাইপেন্ড সেটা পুলকেশ ঘোষালের কাছে জানা হয়নি অবশ্য। তবে এমন রাঘব বোয়ালের জুনিয়র যখন, নেহাৎ কম হবে না। কাজের বিবরণ জানতে গিয়ে শতদ্রু মণ্ডলকে মৃদু গলায় প্রশ্নটা করায় উত্তর পেয়েছিল, স্যার জানেন।

মোটামুটি কী রকম হতে পারে?

সেটা স্যার-ই বলতে পারবেন। বাট ডোন্ট ওয়ারি। কাজ শুরু হলে এগুলো বলতে লাগে না। আগে তো শেখো ঠিক করে। বিভিন্ন কেসগুলোর ফাইল মেইনটেইন করা শিখতেই কতদিন কেটে যায়। তাহলে আগামী শুক্রবার থেকে এসো। যদিও রবিবার পয়লা, তবে সোমবার থেকে যাতে কাজে লাগতে পারো, তাই পরশু আই মিন শুক্রবার আসতে বলছি।

শতদ্রুর বয়স অন্তরার কাছাকাছি, বা ছোটোও হতে পারে। প্রথম আলাপেই তুমিটা কানে লাগল। কিন্তু বড়ো বটবৃক্ষের ছায়ায় এসে রোদে পোড়া মন এতদিনে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পেয়েছে। বাড়িতে বলায় মা ও ছোটো ভাইও নিশ্চিন্ত।

 

দু’মাস হয়ে গেছে। শিক্ষানবিশ ভাতা বা মাইনের কোনও উচ্চবাচ্য নেই। পুলকেশবাবুকে প্রশ্ন করেই ফেলল। উনি বললেন, শতদ্রুর সঙ্গে কথা বলো।

শতদ্রুর উত্তর, সে তো স্যার ডিসাইড করবেন।

স্যারের কাছে কথা পাড়লেই দেশের আর্থিক মন্দা, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক সমস্যা, নৈতিক অবক্ষয়, অপরাধের বাড়বাড়ন্ত, মহামারি ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসে পড়ে। আর সেই আলোচনায় জড়িয়ে অন্তরাও নিজের সমস্যা ভুলে দেশ দুনিয়ার জন্য বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

বিমলা মিশ্র নামে সেই বৃদ্ধা মহিলা এসেছেন চেম্বারে। নিজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি প্রোমোটরের কাছে বিক্রি করেছিলেন দুটি বহুতল টাওয়ার বিশিষ্ট ছোটো আবাসন করা হবে জেনে। লোকটা অনেকদিন ধরে লেগেছিল। নগদ টাকা নিয়েছেন যৎসামান্যই, মাত্র বিশ লাখ টাকা। বদলে তাঁর আবাসনের দুটি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা। কিন্তু আজ তিন বছর পর বোঝা গেল, যেটা তৈরি হচ্ছে সেটা একটা মাদ্রাসা এবং তার সংলগ্ন একটা ছাত্রাবাস।

বারাসাতে ময়গড়ার মতো জায়গায় একলপ্তে দু-বিঘে জমির বাজার দর কোটি টাকার ওপর। দুটো দুই কামরার পাশাপাশি ফ্ল্যাট জুড়ে সপরিবারে স্বপ্নের বাসা পাওয়ার কাগুজে প্রতিশ্রুতি নিয়ে কী করবেন ভেবে বৃদ্ধা দিশাহারা। এখন থাকছেন নিজেরই মাত্র এক কাটা জমিতে তৈরি করোগেটেড ছাউনি দেওয়া ঘরে। ভাগ্যিস ওইটুকু রেখেছিলেন নিজের সাময়িক মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে। ফ্ল্যাট পেলে ওটাও মূল ফটকের কাছে নিরাপত্তা গুমটি নির্মাণের জন্য প্রোমোটারকে দিতে হবে।

বহুতল টাওয়ারের চিহ্নই নেই। তাঁকে ফ্ল্যাট দেওয়ার বদলে উলটে প্রোমোটরের মাস্তান-বাহিনি এসে ওই কাটাখানেকও ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই কেসটা অন্তরাই দেখছে। দেওয়ানি মামলা হলেও গতিপ্রকৃতি ফৌজদারির দিকেও। কেসে প্রচুর মেরিট কিন্তু পুলিশ থাকলেও রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক নিরুত্তাপে সেই মেরিটের কদর হবে কিনা সন্দেহ। পুলিশ তো এফআইআর-ই নেয়নি। শতদ্রু তো ভাগিয়েই দিচ্ছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলার কাতর প্রার্থনা আর অন্তরার আগ্রহে পুলকেশ আশ্বাস দিয়েছিলেন জালিয়াতি কেসে জয় তো হয় যদিও প্রশ্ন কত দিনে?

ভদ্রমহিলার জীবদ্দশায় যেন নিস্পত্তি হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ কেসের যাবতীয় নথিপত্র রক্ষা ও অগ্রগতি দেখার দায়িত্ব অন্তরাকেই দিয়েছেন পুলকেশ ঘোষাল। ভদ্রমহিলাও চেম্বারে এলে অন্তরার সঙ্গেই কথা বলেন মূলত। বাকিরা পাত্তা দেয় না, যদিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ।

স্যার তাঁর নবীনতম সহকারীর প্রতি একটু বেশিই আস্থা দেখানোয় বাকিদের বোঝা যাচ্ছে একটু জ্বলুনি হচ্ছে। অথচ চার মাস পরেও এখনও পারিশ্রমিক পাওয়া শুরু করেনি। দু’বার মোবাইল রিচার্জ করা হয়েছে শুধু। কিন্তু সে কথা উঠলেই অন্যান্য সহযোগীদের উত্তর বাঁধা, এত ব্যাকুল হওয়ার কী আছে? ক’দিন হল? এর মধ্যেই কতটা ইম্পর্টেন্স পাচ্ছ স্যারের কাছে, ভেবে দেখেছ? আমাদের তো প্রথম মাস তিনেক ফাইল ঝাড়পোঁছ ছাড়া কোনও কাজই ছিল না।

রথীন মন্তব্য করে, আমার কিন্তু ডে ওয়ান থেকে মিটার ডাউন হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অন্তরাকেও দেবেন, একসাথে। এখনও অবজ়ার্ভেশনে রেখেছেন।

অবজ়ারভেশনে রাখা মানে পুরো ভরসা না করা। অথচ বিমলা মিশ্রের জটিল কেসটা ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল রক্ষণাবেক্ষণ, সেই মক্কেলদের সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করা, যথাস্থানে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, বাকিদের জানানো, কেসের গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুগুলোর নোট নেওয়া, এমনকী পুলকেশ ঘোষালের তিন থেকে পাঁচ হাজারি চিঠির প্রাথমিক খসড়াও তৈরি করতে হচ্ছে অন্তরাকে।

পুলকেশবাবুর ব্যবহার এমনিতে যথেষ্ট আন্তরিক। শুধু মাইনে বা স্টাইপেন্ড তো দূর, কাজের নিমিত্ত হওয়া খরচটুকু পর্যন্ত দিতে চান না। এমন ভাবখানা যেন এসব তুচ্ছ দুশো-পাঁচশোর কথা তোলা ভীষণ ছ্যাঁচড়ামি হয়ে যাচ্ছে। বাকিরা নিজেদের সঞ্চয় ও আয়কর নিয়ে আলোচনা করে, স্টেশনারির ভাউচার জমা দেয়। তাদের ছ্যাঁচড়ামির প্রয়োজন হয় না।

চেম্বারে সারাদিনে দু’বার বিনা দুধের লাল চা আর সস্তা বেকারির বিস্কুট ছাড়া আর কিছু দেওয়ার রেওয়াজ নেই। আগে তো লিকার চায়ে চিনি দেওয়ারও চল ছিল না। অন্তরা চিনি ছাড়া চা মুখে দিতে পারে না বলে সে কথা প্রায়ই উল্লেখ করে সিকি চামচ করে চিনি দেওয়া হয় তার কাপে। রথীন ঘোষও দুধ চিনির পক্ষপাতী বলে অনেক সময় ভাঁড়ের চা কিনে খেয়ে আসে। আর দুপুরের খাবার তো যার যার নিজের গাঁট থেকে। অন্তরাকে মাঝেমাঝে রথীন ভাঁড়ের চা খাওয়াতে গিয়ে বিস্কুট ও মুড়িও খাইয়েছে। কিন্তু অন্তরার রোজকার না থাকুক, রুচির বহর আছে।

বাড়ি থেকে খাবার না আনলে হাইকোর্ট চত্ত্বরের ফুডকোর্টে গিয়ে ভদ্রস্থ কিছু খেয়ে আসে। রথীনদাকে দু-এক দিন খাওয়ানোর ইচ্ছা থাকলেও নিজের পার্সের দিকে তাকিয়ে উপায় থাকে না। যাতায়াতেই প্রতিদিন পঞ্চাশ-ষাট টাকা বেরিয়ে যায়। সামনের ভাইফোঁটায় অবশ্যই ডাকবে। আর স্বযং মালিক প্রচুর উপদেশ, আলোচনা, কাজের পাহাড়ের সঙ্গে মুখের মিষ্টি ভাষা পরিবেশন করেই কাজ সারেন। আর তাতেই কেল্লা ফতে।

বাড়িতে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক আলো, পাখা ও এসি সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খরচ কত হয়, তার হিসাব রাখা সম্ভব নয়। ওগুলো নিয়োগকর্তার পরিবর্তে বাড়ির ওভার হেড খরচে ঢুকে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে এসিটা এসেছিল বাবার মৃত্যুর পর থোক টাকা সংসারে আসায়।

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাড়িতে এসে ভেঙে পড়েছে অন্তরা। বাবার পেনশন নেই। বাবার মৃত্যুতে জীবনবিমার টাকা আর তার আজীবন জমানো পুঁজির ওপর পাওয়া সুদের টাকায় সংসার চলছে। সেটাও ক্রমহ্রাসমান। ভাই পলিটেকনিকের ছাত্র। কিছু টিউশন করে নিজের হাতখরচ চালায়, বাড়িতেও দেয় মাঝেমধ্যে। ভাই তার রোজকার ঘ্যানঘানানিতে রেগে যায়, ছেড়ে দে না। আচ্ছা ছ্যাঁচড়া তো! সবাইকে দিচ্ছে আর তুই কি বন্ডেড লেবার? স্লেভ? নিজের টাকায় তো ছাতা পড়ছে। অথচ কাজ করিয়ে মাইনে দেবে না, খরচটুকু দেবে না। তোরই দোষ। গোড়াতেই কথা বলে নিসনি কেন?

মা বোঝান, মাথা গরম করিসনি। এই যে কাজ শিখছিস তারও তো একটা দাম আছে। আস্তে আস্তে নিজে প্র্যাকটিস শুরু কর। একটা বড়ো উকিলের অ্যাসোসিয়েশনটার তো একটা সুনাম আছে, অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তাহলেও মাইনে না দিক, অন্তত খরচটা তো পুষিয়ে দেবে। আসলে তুই নতুন তো!

মা, দিদি নতুন বলে কম টাকা দিতে পারে, তাও অন্যদের সঙ্গে একটা প্যারিটি রেখে। কিছুই দেব না, এ কেমন মেন্টালিটি? তুই ছেড়ে দিয়ে পরের বছর আবার জুডিশিয়ারি দে। নয়তো অন্য সিনিয়র দ্যাখ। ভাই চ্যাঁচায়।

আবার জুডিশিয়ারি? মা আঁতকে ওঠেন। দেখলি না দু-দু’বার কেমন অঘটন ঘটল? আবার অ্যাটেম্পট নিতে গেলে যদি আরও বড়ো কিছু হয়? তুই আর দিদিকে মাতাস না। রোজ কোর্টে গিয়ে বসলে দলিল লেখার কাজ বা টুকটাক কিছু করেও তো রোজগার হয়। কোম্পানির কেস ছাড়া লড়ব না, এমন ইগো রাখলে চলে না। সব রকম চেষ্টা করতে হয়। তোর তো ফাইনাল ইয়ার। ঠাকুরকে ডাক যাতে একটা চাকরি পাস। মিলির বিয়ের কথাও তো ভাবতে হবে।

মা, বাবু ভুল কিছু বলেনি। আমার নিজেরই তো তেড়ে গাল দিতে ইচ্ছে করছে পুলকেশ ঘোষাল আর তার চামচাদের। আর প্লিজ় মা, এলএলবি পাস করে মুহুরির কাজ করতে বোলো না। অন্তরা কেঁদে ফেলল।

বাবু জানিস তো, এই লোকটার কাজ করতে গিয়ে আমি নিজের পরীক্ষার প্রিপারেশনও নিতে পারছি না। যাতায়াতেই কতটা সময় নষ্ট হয়। তার ওপর ওখানে এতটুকু ফুরসত নেই, বাড়িতে এসেও কেসের চিন্তা। প্রথম দিকে ইম্পর্ট্যান্ট কাজগুলোর দায়িত্ব পেলে খুব ভালো লাগত। মনে হতো স্যার আমার মেধার কদর করছে, ভরসা করছে। যতগুলো আছে শাগরেদ, তাদের মধ্যে আমার ইংরেজি ড্রাফট সবচেয়ে ভালো হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিলে খুব ভালো লাগত, উৎসাহ পেতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার ট্যালেন্ট আছে কিন্তু কপাল নেই, তাই দেখে সিম্পলি এক্সপ্লয়েট করছে। একটু থেমে বলল, অবশ্য এটাও বলে, আশা কোরো না। যদি পাও তাহলে সেটা সারপ্রাইজ থাক। শতদ্রু, রথীনদাও তেমন হিন্ট দেয়।

নিজের ঘাম ঝরানো ন্যায্য পাওনা সারপ্রাইজ়? চমৎকার!

 

আজ জৈন বিল্ডারর্স-এর স্বয়ং একজন ডাইরেক্টর এসেছেন। পুলকেশের চেম্বারে যুদ্ধকালীন ব্যস্ততা। এদের ফাইল যদিও অনেক পুরোনো, রথীন ঘোষ আর সঙ্গে শতদ্রু মিলে দেখাশোনা করে। তবে রথীন না আসায় ডাক পড়ল অন্তরার। যে-কোনও মামলার গল্প শুনে সারাৎসার বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা অন্তরার আছে। আগে যে-ফাইল ওর স্পর্শ করার অধিকার ছিল না, আজ সেই ফাইল খুলে আট-ন’বছরের ধাঁধা আধ ঘণ্টার মধ্যে বুঝে ফেলতে বলে যেন ধন্য করে দিচ্ছে ওরা।

হাইকোর্ট চত্ত্বরে ফাইফরমাশ খাটা একটা ছোকরাকে দিয়ে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে নিরামিষ স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, পিৎজা ও নরম পানীয়ের বোতল আনানো হয়েছে। কৃপণ পুলকেশকে কোনও দিন জুনিয়রদের চায়ের সঙ্গে সিঙাড়া পর্যন্ত খাওয়াতে দেখেনি অন্তরা; অন্তত ও যে-কদিন এসেছে। অন্তরা দুধ ছাড়া চা পছন্দ করে না জেনেও চেম্বারের নিজস্ব বৈদ্যুতিক কেটলিতে কখনও দুধ চা হয়নি, বাইরে থেকেও আনানো হয়নি।

চায়ের বদলে কফি বেশি পছন্দ বলে এবং বস ও সহকর্মীদের আচরণে অভিমান করে মাসখানেক হল, অন্তরা চেম্বারের চা না খেয়ে হাইকোর্টের ফুড কোর্ট থেকে কফি খেয়ে আসছে। তাতেও কোনও হেলদোল নেই। বরং রসিকতা ভেসে এসেছে, আমি গরিব মানুষ, অত বিলাসিতা পোষায় না। চায়ের জলে চা পাতা ছাড়া আর যা কিছু অ্যাড করি না কেন, সেটাই লাক্সারি।

আজ সেই পুলকেশ ঘোষাল জিতেশ জৈন ঠান্ডা পানীয় নেবেন না শুনে বারবার প্রশ্ন করলেন তাহলে চা না কফি, দুধ দেওয়া হবে কিনা, নাকি ফুডকোর্ট থেকে ক্যাপুচিনো আনাবেন। জিতেশ বাইরের খাবার বিশেষত তৈলাক্ত মিষ্টি পেস্ট্রি খেতে আগ্রহী নয় বলার পরেও, আরে বহুত বঢ়িয়া হ্যায় হমারা হাইকোর্ট কা খানা। খা কর তো দেখিয়ে.. ইত্যাদি বলে খাবার প্যাকেট আনিয়েছেন।

জৈনসাহেব পুলকেশ ও শতদ্রুর সঙ্গে কাজের কথার ফাঁকে অনেক অনুরোধেও স্যান্ডউইচ ছাড়া আর কিছু মুখে দিলেন না। অন্তরাকে দূরের চেয়ারে বসে কিছু কিছু নোট নিতে হচ্ছিল। পুলকেশ বললেন, অন্তরা, জম্পেশ করে কফি করো দেখি। কাবার্ডের কোণায় গুঁড়ো দুধের প্যাকেট আছে, কেটে ঢালতে হবে।

অন্তরা অবাক চোখে তাকাল। দুধের প্যাকেট কাটতে হল না। জৈনের চাহিদা মতো কালো কফি করে দিল কোনও মতে। দাঁতে দাঁত চেপে বাকি তিনজনকে দিয়ে নিজে নিল না। এরা কেউ হয় না তার, তবু অসহায় অপমানবোধের পাশাপাশি একরাশ অভিমান গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে। অতিথির জন্য তার আপত্তি অগ্রাহ্য করেও এত আয়োজন। অথচ যাকে নিত্যদিন দপ্তরে ডেকে কাজ করাচ্ছে, এমনকী ছুটির দিনেও যখন তখন ফোনে এটা সেটা ফরমাশ করছে, তাকে তার ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকু দিতেও অসুবিধা হচ্ছে! আর সে কথা উল্লেখ করলেই চিনের চাল, পাকিস্তানের উদ্দেশ্য, ভারতের বিধেয় ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে কথা ঘোরানো! অন্তরার মুখচোখ দেখে শতদ্রু একবার ইশারায় কী হয়েছে জানতে চাইলেও, বাকিরা খেয়াল করেনি। কেনই বা করবে?

এই বিশেষ উপলক্ষে বিরল সৌজন্যবোধে পুলকেশ ঘোষাল ও তার জুনিয়রদের জন্যও একটা করে স্যান্ডউইচ আনিয়েছেন। উপরন্তু অতিথি দেবতা সব না খাওয়ায় উদবৃত্ত পিৎজা ও পেস্ট্রিও পড়ে আছে। ঠান্ডা পানীয়ের বোতলও খোলার অবকাশ হয়নি। পুলকেশ বললেন, অন্তরা তো ভালোবাসো এসব। নিজে রেস্টুরেন্টে গিয়ে একা একা খেয়ে আসো, আমাদের ভাগ দাও না। নাও তুমিই নাও। বয়সও কম।

শতদ্রু ভাগ করা শুরু করেছে। অন্তরা ভাবল বলে, শরীর ভালো নেই। যদিও আজ দুপুরে পেটে দানাপানি না পড়েই পেট চুঁই চুঁই করছে, বুকে গ্যাসের ব্যথা। এই অবস্থায় খাদ্য প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে হাউহাউ করে বলে উঠল, স্যার, অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করা ভদ্রতা। না করলেও দোষের কিছু না, বড়োজোর দৃষ্টিকটু। কিন্তু কাজের লোককে মাইনে দেওয়া কিন্তু আমাদের কর্তব্য। খাটিয়ে নিয়ে মজুরি না দেওয়াটা আইনের চোখেও অপরাধ।

বেরোজগার রোগা মেয়েটা পুলকেশদের হতভম্ব করে দিয়ে নিজের বোতল থেকে দু’ঢোক জল পান করে ছলছলে চোখে বেরিয়ে এল।

বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠতে লাগল। সব অর্থহীন! এতটা শূন্য বাবা চলে যেতেও লাগেনি। এত কষ্ট করে এত ভালো নম্বর নিয়ে আইন পাস করেও বেকার! পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়রা জানে খুব বড়ো উকিলের অধীনে সে নিযুক্ত। কিন্তু অন্তরার মনে হচ্ছে সব কিছু থেকেই নিজেকে বিযুক্ত করে নেয়; জীবন থেকেও। ভাই ঠিক নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। কিন্তু মা?

 

হ্যালো। অন্তরা ম্যাডাম, আমি বিমলা মিশ্র বলছি আপনার মক্কেল।

আমার মক্কেল? ইয়ে.. মাসিমা, আমি আসলে ওখানে দিন পনেরো হয়ে গেল, আর যাই না। আপনার কেসটা স্যার কাকে অ্যাসাইন করেছেন ঠিক জানি না। আপনি চেম্বারের কাউকে ফোন করুন।

অমন কথা বোলো না মা! আমি ধনে তো নিঃস্ব হয়েছি, এবার প্রাণেও মারা যাব। প্রোমোটারের গুন্ডারা আমাকে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু থেকেও উৎখাত করতে চাইছে। রীতিমতো হুমকি দিয়েছে, আমার মেয়ে আর নাতনিকে তুলে নিয়ে… ভদ্রমহিলা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

রাগ, দুঃখ, ভয়, অসহায়তা সব মিলিয়ে মাথাটা দপদপ করতে লাগল অন্তরার। ষাঠোর্ধ এই মহিলা তুমি বলার অনুমতি পেয়েও আপনি করেই বলেন। এই প্রথম অন্তরের আকুতিতে মা তুমি বেরিয়ে এসেছে।

নিম্ন আদালতে ফৌজদারি কেসগুলো তুলতে পারলে অন্তরা প্রথম প্লিড করার সুযোগ পাবে, কারণ পুলকেশ ঘোষাল হাইকোর্ট ছাড়া লড়েন না। যদি সদর্থক নিষ্পত্তি হয়, হয়তো সামান্য প্রসিদ্ধিও জুটতে পারে। কিন্তু এইসবের উত্তেজনার চেয়ে এখন যে-চিন্তাটা কাজ করছে তা হল, ও সরে গেলে কেস যতই পোক্ত হোক, পুলিশ বা পুলকেশ কেউই মাথা ঘামাবে না। শুধু এক পরিবারের তিন নারীর জীবনাশঙ্কা নয়, এক ভয়াবহ সর্বনাশের অশনিসংকেত!

 

মে আই কাম ইন স্যার?

তুমি? কী মনে করে?

স্যার, বিমলা মিশ্র ফোন করেছিল। খুব বিপদে আছেন। যে-কোনও দিন রেপ, খুন যা খুশি হতে পারে। ওনার কেসটা এখন পুরোপুরি ক্রিমিনাল হিসাবে সাজাতে হবে…

যাক, রাগ পড়ল? আমি তো কেসটা ছেড়ে দিইনি, তুমিই নিজের টু মাচ এক্সপেকটেশন থেকে ছেড়ে দিয়েছ। আমি তো ক্রিমিনাল কেস নিই-ই না। কিন্তু নিজের অন্তরাত্মার ডাকে আর তোমার ইন্টারেস্ট দেখেই নিয়েছি। তুমিও পরার্থে কিছু করে দেখো, তার চেয়ে বড়ো রেমুনারেশন আর কিছু হয় না।

অন্তরা অসহায় ভাবে মাথা নাড়ল।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব