পিরামিড (প্রথম পর্ব)

অঘটন বিভিন্ন রকমের হয়। সবই যে শরীর ধ্বংস করে বা হাত পা মাথা কাটে এমন নয়, মাঝে মাঝে এই অঘটন একটা অদ্ভুত আনন্দও দেয়। আনন্দের ধারণাটাও আপেক্ষিক, তাই একই ঘটনা এক পরিবারের একজনকে আনন্দিত করলেও অন্য আরেকজনকে দুঃখিত করে। সমস্যা হল এই দুঃখ আবার প্রকাশ করা যায় না, ঠিক যেমন রূপার হল।

ক্লাস টুয়েলভে পড়বার সময় একদিন রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বাবার গুজুরফুসুর কানে এল। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনওদিন এইভাবে বাবা-মা আড়ালে ফিসফাস করেছে বলে কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আর পড়বেই বা কী করে— তিনজনের সংসারে ঝামেলা বলতে শুধুমাত্র স্কুল আর অফিসের ভাত দেওয়া নিয়ে। তাও তো অর্ধেক দিন বাবাকে আগের দিনের রান্নাই গরম করে দেয়। বাবা অম্লান মুখে খেয়ে নেয়। মায়ের টুকটাক ঠুসঠাস যা হয়, তা রূপার সঙ্গে।

সরাসরি মা বা বাবাকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমরা কী সব চুপিচুপি আলোচনা করছিলে? বাবা চুপ থাকলেও মা হয়তো রেগে যাবে। তাই জানার ইচ্ছে থাকলেও চুপ করেই থাকতে হল। কয়েকদিন পরেই অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

স্কুল থেকে ফেরবার সময় কমার্স সেকশনের অমৃতা বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী রে খবরটা দিসনি তো?

কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল রূপা। চয়ন মানে চাঙ্কির সঙ্গে ঘোরাঘুরি নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করে। রূপা উত্তরও দেয় আবার দেয়ও না। তবে অমৃতাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে, কোন খবরটা রে?

—সে কী রে, তোর নাকি ভাই বা বোন হবে? বেশ ভালো, তবে এজ গ্যাপটা একটু বেশি হয়ে যাবে।

রূপা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, কী বাজে বকছিস?

—বাজে নয় কাজের কথাই বলছি, তুই খবর না দিলেই বা কী! আমি ঠিক খবর পেয়ে গেছি। কবে ট্রিট দিবি বল?

আকাশ থেকে পড়ল রূপা, চারপাশটা দেখে গম্ভীর ভাবেই বলে উঠল, তোকে কে বলল?

—মা-বাবা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। তোর মা আমার মাকে বলেছে।

সব শুনেও রূপা কিছু সময় কোনও কথা বলতে পারল না। রাস্তার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তাহলে গুজুরফুসুর মানে এইসব। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবা অফিস কামাই করে মা-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিল, তার মানে ভিতরে ভিতরে এতদূর সবকিছু হয়ে গেল, আর কিছুই জানা গেল না। নিজের ওপরেই রাগ হল রূপার। অমৃতাকে বলল, আমার একটু তাড়া আছে। তারপরেই তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।

বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরে ঢুকতেই চোখ ফেটে জল এল। কারওর সঙ্গে কোনও কথা না বলে দরজা বন্ধ করে সন্ধে পর্যন্ত বসে রইল। মাঝে মা কয়েকবার এসে, কী হয়েছে? কেন এমন করছিস? এসব জিজ্ঞেস করল। স্কুলে বা টিউশনে কোনও কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল। রূপম নামের সেই ছেলেটা আর বিরক্ত করছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করল।

সব প্রশ্নেরই এক উত্তর, না, কিছু হয়নি। কেউ কিছু করেনি। তুমি যাও। সন্ধের পর বাবা এসেও জিজ্ঞেস করল কিন্তু এবারেও উত্তর পেল না।

সমস্যা আরও বাড়ল। খেতে বসবার সময়। রূপা প্রথমে তো আসতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে বাবার কথা শুনে খাবার টেবিলে এলেও খাবার নিয়ে বসে রইল। বাবা-মা দুজনে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, রূপার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এল।

কিছুসময় পর রূপা কাঁদতে কঁদতেই বলে উঠল, আমার নাকি ভাই-বোন কিছু একটা হবে?

—কে বলল তোকে? কথাটা মা কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর বলল।

—কে বলল জানতে হবে না। সত্যি না মিথ্যা সেটা বলো।

বাবা এবার লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, চারমাস চলছে।

—আর ইউ ম্যাড, অর স্যাভেজ ইললিটারেট?

মা কোনও উত্তর না দিয়ে গালে এক চড় কষিয়ে দিল। আচমকা আসা এই আঘাতে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কিছুসময় পরেই গালে হাত বোলাতে বোলাতে রূপা বলে উঠল, আমাকে চড় মারলে কিন্তু পাড়ার সবাই, ফ্ল্যাটের সবাই? ছিঃ ছিঃ করছে তোমাদের। কজনকে চড় মেরে মুখ বন্ধ করবে।

সেই রাতে আর কারওরই খাওয়া হল না। পরেরদিন সকালে উঠেই বাবা রূপাকে চায়ের টেবিলে ডেকে বলল, দেখ তুই বড়ো হয়ে গেছিস। আজকের যুগের মেয়ে তুই, আসলে ঘটনাটা খুবই সাডেন। এমনকী তোর মা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি।

—বোকা বোকা কথা বোলো না বাবা। তুমি বুঝতে পারোনি দ্যাটস ওকে, বাট মা!

—তোর মায়ের একটা প্রবলেম আছে সেটা তো জানিস। তোর সঙ্গে ডাক্তারও দেখাতে গেছিল।

—আমি বুঝতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা তোকে বলব না। তোর আমি ইয়ার দোস্ত না। আমরা মা-কাকিমাদের কখনও এইসব কথা বলবার সাহস পেতাম না। কথাগুলো একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল মা।

—তোমাদের কথা আলাদা মা।

—আলাদা মানে কি? মা-বাবার সঙ্গে এইসব কথা বলা?

—তোমরা কি এইসব কথা বলবার জন্য আমাকে ডাকলে, তাহলে আমি আসছি, কাজ আছে।

—কাজ মানে তো ফোনে ফটর ফটর করা।

—আমার এটাই বয়স। যে-বয়সে যেটা মানায়, সেটাই করতে হয়।

বাবা কিছুসময় চুপ থেকে মা-মেয়ের কথা শুনছিল। রূপার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠল, ঠিক আছে, এবার বল তোর মতামত কী?

—হোয়াই শুড আই বাবা? ইউ হ্যাভ নট আস্কড মি বিফোর ডুইং দ্যাট।

—তা না, আমরা তো, মানে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

—দুর্ঘটনা! হাউ ফানি বাবা, দুর্ঘটনা মেড মাই মাদার প্রেগন্যান্ট।

—শোন ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম নয়। আসলে আর বছর তিন পরে তোকে বিয়ে দিতে হবে, তার পরে তো আমরা একা।

—ইজ ইট এনি এক্সকিউজ? আমার বিয়ের পরে তোমার জামাই আসবে। কোথাও তো লেখা নেই বিয়ের পর মেয়েরা বাবা-মা-কে দেখবে না। তাছাড়া আমি বিয়ে করব কিনা সেটাও ঠিক নেই। তোমরা এত কিছু ভেবে এই বয়সে এরকম করে ফেললে?

—শোনো, মেয়ের কথা শোনো, তোমার প্রশ্রয়ে আজ এইরকম অবস্থা। আমার না হয় ভাই বোন নেই কিন্তু তোমার তো আছে। বুগি তোমার থেকে কত ছোটো?

—মা, ননসেন্সের মতো কথা বলো না। বুগি বাবার থেকে এগারো বছরের ছোটো, না জ্যাঠা বাবার থেকে বারো বছরের বড়ো, এটা নিয়ে কোনও কমপ্যারিজন হয় কি?

—ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে বলে কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবার বহর শোনো।

—মা, আমার শিক্ষা আমাকে তোমাদের সামনে এইভাবে কথা বলতে শিখিয়েছে। আর পৃথিবীর কোথাও লেখা নেই সন্তান হলে বাবা-মায়ের ভুল বলা যাবে না।

শেষের কথাগুলো বলেই ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রূপা। বাবা একভাবে দরজার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার একটা জোরালো শ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়ে গেল বলো তো?

—তুমি বলো। তখন বারবার বারণ করেছিলাম, এখন সামলাও।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (২য় পর্ব)

(৩)

সাতসকালেই ঝিলমিলের এসএমএস— আই নিড এ মাঙ্কি ক্যাপ ইমিডিয়েটলি। ইমন মেসেজ পড়ে বিস্মিত হয়। ঝিলমিলের হনুমান টুপির আবার কি দরকার? ক’দিন আগেও দেখা হয়েছে। সকালবেলায় আরকেটি-র বাড়িতে লাইফ সায়েন্স পড়তে গিয়ে। কিছু তো বলেনি। মাফলার দিয়ে মাথা গলা ঢেকে ছিল। তেমন অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। অবশ্য ওপর থেকে বোঝা যায় না ভিতরে কী হয়েছে? কী ধরনের অসুবিধা? তবে এবারের হাড় হিম করা কনকনে শীত সত্যিই অসহনীয়। ঝিলমিলের কি তাহলে এক্সট্রা লার্জ প্রোটেকশনের দরকার এখন?

ইমনও এসএমএস পাঠাল— এক্সকিউজ মি। আই হ্যাভ ওনলি ওয়ান।

ঝিলমিলের চট্‌জলদি মেসেজ— ইফ ইউ লাভ মি, শেয়ার ইট। এতো ভারি বিপদ! নো ডাউট ঝিলমিলকে ইমন ভালোবাসে। কিন্তু তাদের বংশপরম্পরাগত মাঙ্কি ক্যাপ ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করলে বাড়িতে তাণ্ডব থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। টুপিদাদু জানতে পারলে ইমনকে আর আস্ত রাখবে না। তার বাবাও কি তাকে মার্সি করবে? যে টুপি পরিয়ে ইমনের বাবা তার মা-কে হাসিল করেছে ইমনও কি পারবে এই সুযোগে ঝিলমিলকে টুপি পরাতে?

ঝিলমিলের তবু বেপরোয়া আবদার— টুপি আমায় দিতেই হবে।

—টুপি ছাড়া আমি তোমায় সব দিতে পারি। প্লিজ মাইরি টুপি চেয়ো না।

—আমার টুপিই চাই।

—কী করে সম্ভব? টুপি আমাদের বাড়িতে একটাই। দাদু থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি গসাগু-র মতো ব্যবহার করছি।

—গসাগু মানে?

—গরিষ্ঠ সাধারণ গুননীয়ক অর্থাৎ বড়ো থেকে ছোটো। এক্কেবারে কেসি নাগের ফর্মুলা।

—ওসব গ.সা.গু. ল.সা.গু. ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো চাঁদু। টুপি দেবে কি না?

—একি মামার বাড়ির আবদার নাকি?

—সামান্য টুপি দিতে পারো না, তুমি বাসবে ভালো?

—কি বলছ ঝিলমিল? ভালোবাসার জন্য আমার প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু টুপি দিতে পারব না। তুমি অন্য কিছু চাও, আমার আই ফোন, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ…..

—আমার টুপিই চাই।

—বাজার থেকে কিনে নিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

—তুমি হয়তো জানো না এবারের কনকনে শীতে আলু পেঁয়াজের মতো বাজার থেকে মাঙ্কি ক্যাপও ভ্যানিশ। হাতে-গোনা দু-একটা যাও পাওয়া যাচ্ছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। পঞ্চাশের হনু ব্ল্যাকে পাঁচশো হাঁকছে।

—কি বলছ?

—যা বলছি মার্কেট স্টাডি করেই বলছি। ভাবলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। টুপি ছাড়া আমি বাঁচব না। আমার মান- সম্মান লাজ-লজ্জা সব ওই হনুমান টুপির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইমন বোকার মতো জানতে চায়— এসব তুমি কী বলছ? আমি তোমার মাথামুণ্ডু কিছুই ছাই বুঝতে পারছি না।

—তোমায় অতশত বুঝতে হবে না। যা বলছি সেটা করতে পারবে কিনা বলো?

—আমি চেষ্টা করব ঝিলমিল। কিন্তু যদি না পারি? ঝিলমিলের সটান জবাব— আমাদের ভালোবাসার —দি এন্ড।

(8)

ইমনের দাদু স্বদেশ হালদার বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলেন— চোর শেষপর্যন্ত আর কিছু না নিয়ে মাঙ্কি ক্যাপ নিয়ে চম্পট দিল?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— আপদ গেছে। এখন ক’দিন শান্তিমতো ঘুমোতে পারব। বাব্বা কয়েক রাত্তির যা ধকল গেল।

—মহিম তুই একথা বলতে পারলি?

—আগের গান্ধিটা ট্রাই করছ না কেন?

—হনুমানটা বেশ সেট হয়ে গিয়েছিল। দারুণ গরম হতো। শরীরে মনে বেশ চাঙ্গা বোধ করতাম। গান্ধি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। আধুনিক ছেলেছোকরার দল যেন মানতেই চায় না। আমাকে টুপি দাদু বলে খেপাত— তোর মনে নেই?

—না পাওয়া গেলে কী করবে? ক’দিন পুরোনোটা দিয়ে চালাও। তারপর সময়মতো পেলে কিনে দেব। অন্তত মাথাটা তো বাঁচবে। সঙ্গে মাফলার, শাল জড়িয়ে নিলে দিব্যি ক’দিন কেটে যাবে। বরং বলি কি তুমি ক’দিন রেস্ট নাও। মর্নিং ওয়াকে না গেলেই নয়?

—আমায় জ্ঞান দিস না মহিম। আমি বিপ্লবী, চুটিয়ে স্বদেশি করেছি। আমাদের অভিধানে রেস্ট বলে কোনও শব্দ লেখা নেই। কিন্তু আমি ভাবছি এত সাধের মাঙ্কি ক্যাপটা মিসিং হল কী করে? চোর, সোনাদানা-টিভি-ফ্রিজ-ল্যাপটপ চুরি না করে শেষপর্যন্ত হনুমান টুপি? ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—এই প্রচণ্ড শীতে মনে হয় চোরের কাছে ওটাই মস্ত জরুরি, মহা মূল্যবান। আরে বাবা চোরও তো মানুষ নাকি? চোরেরও ঠান্ডা লাগে।

—ডোন্ট টক ননসেন্স, মহিম। এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে লঘু করে দেখা উচিত না।

—তুমিও পারো বাবা। সামান্য একটা টুপি নিয়ে কি কাণ্ডটাই না তুমি করছ।

—এটা সামান্য নয়। আমার কাছে বেশ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। প্রেস্টিজ ইস্যুও বলতে পারিস।

ক’দিন বাদে দাদুই আবিষ্কার করলেন ইমনদের পারিবারিক ঐতিহ্যশালী মিসিং লিংক মাঙ্কি ক্যাপটি। দাদু ইমনকে জরুরি তলব করলেন, পার্ক থেকে মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসার পর। দাদু কি শেষ পর্যন্ত ইমনকে সন্দেহ করছেন? ইমন কি ধরা পড়ে গেল? ইমনের বুকের ভিতর হাজারটা অশ্বখুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঝিলমিলকে ইমনই যে টুপিটা দিয়েছিল, দাদু জানল কী করে?

তার দাদু গলার মাফলার আলগা করে চাদরটা গা থেকে খুলে মায়ের দেওয়া এক কাপ গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে বললেন— জানিস দাদুভাই হনুমানটাকে খুঁজে পেয়েছি।

ইমন অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল— কোথায়?

—পার্কে রংগন গাছের ঝোপের আড়ালে। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। হালকা হলুদ রঙের, মাথায় কালো উলের বল।

ইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– ধ্যাৎ দাদু কী যে বলো না। তোমার চোখে নির্ঘাত ছানি পড়েছে। এরকম কালার কম্বিনেশন অনেক টুপির হতে পারে।

—আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমার বিপ্লবীর চোখ। দূর থেকে দেখেই কত ইংরেজের দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিয়েছি। ঝোপের আড়ালে টুপিতে মুখ ঢেকে মেয়েটা এমনভাবে বসেছিল যাতে কেউ চিনতে না পারে আর তার গা ঘেঁষে ছেলেটি অশোভন অবস্থায়…। পার্কটা ক্রমশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে রে দাদুভাই। আর বোধহয় মর্নিং ওয়াকে যাওয়া যাবে না।

ইমন দারুণ বিস্ময়ে হতবাক। তার চোখের সামনে সবকিছু এখন জলের মতো পরিষ্কার। আসলে ঝিলমিল তাকে ঠকিয়েছে। তাকেই মস্ত টুপি পরিয়েছে।

 

মাঙ্কি ক্যাপ (১ম পর্ব)

শীত এলেই সবার নজরে পড়ে মাঙ্কি ক্যাপটির উপর। প্রথমে ইমনের দাদু এক্স বিপ্লবী স্বদেশ হালদারের। একসময় চুটিয়ে স্বদেশি করেছেন। সার্থক তাঁর নাম আর কাম। মাথায় গান্ধি ক্যাপ। মনে হতো তিনিই মহাত্মা। স্বাধীনতার পরও টুপি মাথায়। গান্ধি যেন তাঁর তেলা নি-কেশ মাথায় চেপে বসেছে। পাড়ার উঠতি ছেলেছোকরার কাছে তিনি টুপিদাদু। কিন্তু দাদুরও বয়স বাড়ছে। সঙ্গে জাঁকিয়ে পড়ছে শীত। গান্ধি টাক মাথা সামলালেও কান আর নাকের ফুটোয় গোঁজ মারা তার কম্মো নয়। ফলত হিমেল হাওয়ার দাপটে ইমনের টুপি দাদু একেবারে কুপোকাত। গলায় ঘর্ঘর, নাকে সরসর আর কানের ভিতর কড়কড় অনবরত বেজেই চলেছে। তবু দাদু টুপি খুলবেন না। ডাক্তার সনাতন হাজরা ইমনের মাকে উপদেশ দিলেন— এমনটা কখনওই বরদাস্ত করা যাবে না। আরে বাবা বয়স তো হচ্ছে নাকি? কত চলছে?

ইমনের মা আঙুলের কড় গুনে বলেন— আশি ছুঁই ছুঁই।

ডাক্তার হাজরা চমকে উঠে বলেন— এই ভয়ংকর শীতে এখনও হাফ নেকেড ফকির হয়ে থাকতে চান। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

—বাবা তো সচিনের মতো সেঞ্চুরির পাহাড় গড়বেন বলে শপথ করেছেন।

—বলবেন, ওসব গান্ধিগিরি চলবে না। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভিমরতি। নিউমোনিয়ায় একেবারে টেসে যাবে।

—তাহলে উপায় ডাক্তারবাবু?

—হনুমান ডট কমের যুগ। ছবিতে দেখেছেন বিশুর ছেলেটা মাথায় কী পরে আছে? ইমনের মা মাথা নাড়ে।

ডাক্তার হাজরা বিজ্ঞের মতো বলেন— আইসল্যান্ডে ওসব গান্ধি-টান্ধি এক্কেবারে অচল। হনুমানই পারে ওরকম রাবণের মতো ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে।

—তার মানে, আপনি বলছেন মাঙ্কি ক্যাপ।

—গান্ধির বদলে হনুমান। ঠিক ধরেছেন।

—কিন্তু হনুমান টুপি যদি মাথায় না পরতে চান? আমার শ্বশুরমশাইয়ের যা জেদ।

ডাক্তার হাজরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে কিসব চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন— কুছ পরোয়া নেই। যে রোগের যেমন ওষুধ।

ইমনের মা বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন— সেটা আবার কী?

—কথা না শুনলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।

—আপনি কী করবেন?

—ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে গান্ধি খুলিয়ে হনুমান পরিয়ে দেব।

—কতক্ষণ লাগবে?

—মাত্র সাড়ে সতেরো মিনিট।

—বলেন কী টুপি পরানো এত সোজা? এত তাড়াতাড়ি?

—আমার নাম…।

ইমনের মা সামান্য রসিকতা করে বলে— মুন্না ভাই এমবিবিএস। তাই না?

—ধ্যাৎ, কী যে বলেন। আমার নাম সনাতন হাজরা। রোগীদের টুপি পরানোই আমার কাজ। বিফলে মূল্য ফেরত।

ইমনের মা বিড়বিড় করে বলে— মুন্নার বদলে সনাতন। গান্ধির বদলে হনুমান। দুয়ে দুয়ে চার।   ভালোই মিলেছে।

ডাক্তার হাজরার চেম্বার পর্যটন করে ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপের স্বাদ টের পেয়েছেন এখন হাড়ে হাড়ে। তাঁর মুখে দিনরাত হনুমান চালিশা। হনুমান ভক্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। টুপির এত গুণ, আগে জানা ছিল না। শীত এলেই তিনি বাহুবলী হয়ে যান। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে যখন সবাই লেপের ভিতর জবুথবু, ঘুম আর ভাঙতেই চায় না, তখন ইমনের দাদু মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে স্বপ্নবীথি পার্কের ভিতর তিন রাউন্ড মর্নিং-ওয়াক সেরে অবলীলায় বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর সোজা ইমনের বাবার ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় লেপ সরিয়ে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলেন— যা আর দেরি করিস না। পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। ইমনের বাবার মুখে বিরক্তির সুর— আঃ আমাকে আবার টুপি পরাতে এলে কেন? দাদু নাছোড়বান্দা। টুপি পরানোয় তিনি জেনারেশন ধরে অভ্যস্ত করাবেনই। সবশেষে যে ইমনের পালা, তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। সে জানে লেপের তলায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকলেও রেহাই নেই। দাদু ইমনের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন – শোন মহিম, মাঙ্কি ক্যাপ পরে শীতের সকালে মর্নিং ওয়াকের মজাই আলাদা। ইমনের বাবা যেন তার দাদুর কথা শুনতেই পায় না। লেপের ভিতর শামুক হয়ে থাকতে চায়। দাদু তবু ছাড়ে না ইমনের বাবাকে। বলেন— কিরে উঠবি নাকি বউমাকে বলব গায়ে জল ঢেলে দিতে। ইমনের বাবা মুখ বিকৃত করে বলে— আঃ কি জ্বালাতন! শান্তিমতো ঘুমোতেও দেবে না নাকি?

—ব্যাটা কুম্ভকৰ্ণ। এত ঘুম আসে কী করে? রাতে ঘুমোসনি? হঠাৎ দাদু বাজখাই গলায় ইমনের মাকে চিৎকার করে ডেকে বলেন— বউমা, মহিম কি রাতে ঘুমায় না? তোমরা করো কী? মা আমতা আমতা করে বলে— আপনার গুণধর ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি পই পই করে বলি, যা ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর…। দাদু মাকে সমর্থন করে বলেন— ইউ আর রাইট বউমা। বাট মহিম…।

—সাত তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকলে ওর নাকি জ্বর আসে।

—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জ্বর?

—মানে গরম হয়ে গেলে আর ঘুম আসে না। —কই আমি তো এসবের বিন্দুবিসর্গ জানি না।

—আপনি গুরুজন। আপনাকে কি সব খুলে বলা যায়?

—তুমি কাছে থাকো না?

—আমি থাকলে জ্বর আরও বাড়ে।

—সে কি কথা! কেমন ব্যাধি?

—আপনার ছেলেই ভালো বলতে পারবে।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—আপনার ছেলে না যেতে চাইলে আমি কি আর করতে পারি?

—আঃ বউমা হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার হাতেই ওর কলকব্জা।

—শীত এলেই ও এরকম বিগড়ে যায়। মেশিন ঠিক থাকে না।

—না না এতো ভালো কথা নয়। এর একটা আশু বিহিত প্রয়োজন।

—দেখুন চেষ্টা করে। আপনার মধ্যস্থতায় যদি কাজ হয়। আমি তো অলরেডি ফেড-আপ।

এইবার দাদু ইমনের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন— কী’রে বউমা যা বলছে সত্যি?

ইমনের বাবা লেপের ভিতর থেকেই জবাব দেয়— হুম।

—রাতে ঘুমোস না?

—হুম।

—বউমার কথা শুনিস না?

—হুম।

—কী তখন থেকে হুম হুম করছিস?

—আঃ বিরক্ত কোরো না তো। লেট মি হ্যাভ এ সাউন্ড স্লিপ।

—রাতে না ঘুমিয়ে সকালে কেন ঘুমোচ্ছিস মহিম?

—ক’দিন ধরে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল রাতে দেখতে হচ্ছে। তাই শুতে দেরি হচ্ছে। আর কোনও গল্প নেই।

ইমনের মার দিকে তাকিয়ে দাদু বলেন— ও তাই বল। আমরা তো অন্য কিছু সন্দেহ করছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন -ওরে বাবা সাতটা বেজে গেল। নে আর দেরি না করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা চাপিয়ে পার্কে দু-রাউন্ড মেরে আয়। দেখবি মন-মেজাজ একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।

ইমনের বাবার সেই এক বিরক্তিকর জবাব— আজ টুপি না পরলেই নয়?

— টুপি না পরলে ইউ মাস্ট ক্যাচ কাফ্ অ্যান্ড কোল্ড। আজকের টেম্পারেচার কত জানিস? অলমোস্ট এইট ডিগ্রি। ‘জয় হনুমান’ বলে বেরিয়ে পড়।

—আজ আমি টুপি পরব না।

—ছেলেমানুষি করিস না মহিম। টুপি তোকে পরতেই হবে।

—কিছুতেই না।

—অবাধ্য হোস না। তুই ভালো করেই জানিস। আমি এক সময় স্বদেশি করেছি। কতজন গোরাকে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলেছি। গান্ধি ছেড়ে এখন আমি হনু হয়েছি। আমার এখন মহাবলী শক্তি।

হঠাৎ ‘জয় বজরংবলী’ বলে একলাফে ইমনের টুপিদাদু তার বাবাকে চ্যাংদোলা করে তুলে বাইরে এনে ফেলে। তারপর মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে বলেন— মহিম তুই এখনও আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু রে।

(২)

সেদিনটাও ছিল এমনই এক ভয়ংকর শীতের সকাল। হনুমান টুপি মাথায় ইমনের বাবা বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে তখন পড়ত বাবা। সঙ্গে চাকরির পরীক্ষা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বডি ফিট। বাইসেপস, ট্রাইসেপস, সিক্স প্যাকস সবই তার স্বাস্থ্যবান শরীরে সুসজ্জিত ও সুশোভিত। কিন্তু শীতকাল এলেই কেমন জবুথবু হয়ে যায় ইমনের বাবা। সামান্য ঠান্ডা যেন সহ্য হয় না। হাঁচি একবার শুরু হলে তিন কুড়িতে গিয়ে থামত। নাকের ট্যাপ কলে প্যাঁচ বিকল। অনবরত জল পড়েই চলেছে। ইমনের ঠাম্মা বুকে গরম তেল মালিশ করে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ চাপিয়ে বলত— যা মর্নিং ওয়াকটা সেরে আয়। তোর বাবা আগেই বেরিয়েছে। আমি গরম জল চাপাচ্ছি। চা খেয়ে বাজারে যাবি। ইমনের বাবা ঠাম্মার কথা শিরোধার্য করে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।

আড়াই রাউন্ড মারার পর হঠাৎ ইমনের বাবার বোধোদয় হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। একেই ভয়ংকর ঠান্ডা। তার উপর পার্ক প্রায় জনমানবশূন্য। যে দু-চারজন সিনিয়র সিটিজেন হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করছিল তারাও একবার কোনওক্রমে রাউন্ড মেরেই সটকেছে। কেবল ইমনের নির্ভীক স্বাস্থ্যবান বাবা একা শীতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

পিছনে না তাকিয়েই জোরে পা চালায় তার বাবা। ভাবে, নির্ঘাৎ কোনও চোর-ডাকাত। তার পকেটে বাজারের টাকা। আঙুলে জন্মদিনের সোনার আংটি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সব কেড়ে নিলে, খুলে নিলে তার যাবতীয় বীরত্ব ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। ওর হাতে নিশ্চয়ই অস্ত্র আছে।

এরকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পিছু-নেওয়া আগন্তুকের সঙ্গে ছোটাছুটি লুকোচুরি খেলার পর অকস্মাৎ এক মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইমনের বাবার সম্বিৎ ফেরে। তার বাবা শুনতে পায়— প্লিজ হেল্প মি…. আর পারছি না… ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি… আমাকে বাঁচান।

মেয়েলি কেসে তার বাবা কোনওদিনই পাশ করতে পারেনি। বরাবরই শূন্য পেয়েছে মেয়ে পটানোর পরীক্ষায়। অথচ কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুরা ক্যান্টিনে বাথরুমে-সিঁড়িতে- ব্যালকনিতে— যত্রতত্র নির্ভয়ে টুকলি করে পাশ করে যাচ্ছে। ইমনের বাবার কানে ফের সেই করুণ আর্ত কন্ঠস্বর — আমাকে বাঁচান… আমি জমে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি। ইমনের বাবা মনে মনে ভাবে— কেসটা জন্ডিস নয় তো? বাঁচাতে গিয়ে যদি ফেঁসে যায়? মেয়েরা সব পারে। ইমনের বাবা তবু সাহস সঞ্চয় করে ‘জয় বজরং বলী’ বলে একলাফে মেয়েটির সম্মুখীন হয়— আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান বলুন তো? মেয়েটি তার কথার জবাব না দিয়ে ইমনের বাবার মুখের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বাবা থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে বলে— কী মেয়েরে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই। প্রথম সাক্ষাতেই মুখ দেখাচ্ছে। এরপর না জানি কী করতে বলবে। এদিকে মেয়েটি প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রায় বাকরুদ্ধ। আঙুল দেখিয়ে কোনওক্রমে বলে — টুপি। ইমনের বাবা চমকে উঠে বলে— টুপি কেন?

—বাইটিং কোল্ড। বুঝিনি বাইরে এতটা ঠান্ডা। টুপি না জড়ালে কানের যন্ত্রণায়…।

—কিন্তু আমার টুপি আপনাকে জড়ালে আমার হাঁচি, কাশি, নাকের জল…।

—আপনি কি চান না একটা অসহায় মেয়েকে এই নিষ্ঠুর আবহাওয়া থেকে বাঁচাতে, উদ্ধার করতে। আপনি সু-পুরুষ স্বাস্থ্যবান। আপনি নিশ্চয়ই চান না চোখের সামনে অসহায় মেয়েটি শীতের প্রচন্ড কামড়ে ফালাফালা হোক। ইমনের বাবার মনে হল, কে যেন তার জামা-প্যান্ট-মাফলার-সোয়েটার-হনুমান টুপি সব খুলে নিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেহে এক বালতি জল ঢেলে দিল।

মাথার মাঙ্কি ক্যাপটা একটানে খুলে ইমনের বাবা মেয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল। উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু টুপি খসিয়ে হাড়-কামড়ানো কনকনে শীতে ইমনের বাবা টানা এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছিল। মেয়েটি এর মধ্যে বার কয়েক এসে তার বাবাকে উষ্ণ করে দিয়ে গেছে। এরপর তার বাবার চাকরি, তার বাবার বিয়ে সবই সম্ভব হয়েছে মেয়েটির চিরস্থায়ী সঙ্গলাভ এবং ভালোবাসার হাতের-গরম স্পর্শে। মাঙ্কি ক্যাপের আড়ালে সুজাতা সরকার নামের সেই মেয়েটি এইভাবেই ইমনের বাবার অর্ধাঙ্গিনি এবং ইমনের গর্ভধারিণীরূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

রঘু

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি। একদম দুয়ে নিয়ে ছাড়ে। রোজ রোজ অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয় খুব। তাই ‘স্লিপ ডেট’ কাটাতে রবিবারই ভরসা। সেখানেও জ্বালা। ন’টা বাজলেই গামলা মুখে বউয়ের গর্জন। চলো বাজার, বাজার চলো! এপাশ ওপাশ করে যে আরও আধঘন্টা ল্যাদ খাবো তার উপায় নেই। আজ যেমন গরম চায়ের কাপে আমার আঙ্গুল দিল ডুবিয়ে। ড্যাশের নাম খগেন। একলাফে বাথরুম গজগজ করতে করতে।

রবিবার বাজার সেরে আমাদের বন্ধুদের একটা আড্ডা হয় কাকার চায়ের দোকানে। জনা পনেরো থাকি। বাজার ফেলেই দে দৌড়। প্রথমে মাছ মাংস কিনে তারপর সবজি বাজার সারি। ক’দিন ধরেই চিংড়ি চিংড়ি করছে ছেলেটা। একটু বড়ো সাইজের কয়েকটা নিলাম। বাটা মাছ বাবার জন্য। কাতলা কিছুটা নিলাম বাড়ির বাকিদের জন্য। চিকেন নিয়ে সবজি বাজারে ঢুকতেই দেখি পল্টুর ফলের দোকানের সামনে খুব ভিড়। পল্টু জুতো খুলে কাউকে মারছে আর “চোর চোর” বলে চিৎকার করছে। উৎসাহী কয়েকজন বেশ সোচ্চার। তাদের হুলোর মতো মুখগুলো, যেন এখনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকিয়ে দেখলাম সব মুখগুলোয় অপরের রাগ অন্যকে ঝাড়ার চেষ্টা।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম পল্টু জুতো নিয়ে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চাকে মারছে। ছেলেটার জামা ছিঁড়ে গেছে। সারা মুখ লাল মারের চোটে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব মায়া হলো। এইটুকু বাচ্চাকে কেউ ওভাবে মারে! ছুটে গিয়ে পল্টুর হাতটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম, “মেরে ফেলবি নাকি বাচ্চাটাকে”। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। নাটকের যবনিকা এতো তাড়াতাড়ি হবে ওরা ভাবতে পারেনি। এর মধ্যে তাপসদা হাজির।

তাপসদা অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার। বিশাল চেহারা ও মোটা পাকানো গোঁফ ভয় ধরায়। তাপসদা পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। পল্টুর হাতে একটা আপেল। মারার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “ছেলেটা আপেল চুরি করে ছুটে পালাচ্ছিল”। এর মধ্যে বাচ্চা ছেলেটা উঠে বসেছে। সারা শরীরে লাল লাল মারের দাগ।

হঠাৎ তাপসদা গম্ভীর গলায় বাচ্চাটাকে জিঞ্জাসা করল, “কি করেছিলিস সত্যি করে বল।”

তাপসদার চেহারা দেখেই ছেলেটা ভয় পেয়েছে খুব বোঝা গেল। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘একটা আপেল কিনতে চেয়েছিলাম। পাঁচ টাকা আমার কাছে ছিল। দোকানদার বলল, দশটাকা দাম। আমি একটা ছোট আপেল দেখিয়ে বলি, এটা পাঁচ টাকায় দাও না। ও তখন আমাকে গালাগাল করে। বলে অতো কম দামে আপেল হয় না। তারপরও একটা নোংরা কথা বলে।’

‘আমি বলি ‘ওরকম খারাপ কথা কেন বলছো?’ বলতেই ও চিৎকার করতে থাকে আর বলে চোর চোর। আমি ভয় পেয়ে ছুটতেই ও ধরে মারতে শুরু করে। আরও কয়েকজন মারতে থাকে। আমি আপেল চুরি করিনি। আপেলে হাতই দিইনি।’ রিক্সা চালায় হারু সব দেখেছে। সে বলল, ‘বাচ্চাটা ঠিকই বলছে।’ পল্টু এমনি এমনি মারছে বাচ্চাটাকে। ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল যেন।

তাপসদা পল্টুকে শূন্যে তুলে ধরে ছুড়ে ফেলল দূরে রাস্তার ওপর। তারপর আগুন চোখে মিলিটারি মার শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলে দেখছে। যারা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে পল্টুর সঙ্গ দিচ্ছিল তারা পগারপার। তাপসদাকে থামানো যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর নিজের পায়ের জুতো খুলে বাচ্চাটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই মার এবার ওর মুখে তোকে যেমন মারছিল।’

সকলকে অবাক করে বাচ্চাটা বলে উঠল, ‘মা বলে, বড়োদের অসম্মান করতে নেই। গায়ে হাত দিতে নেই’। স্তম্ভিত সকলে। বাচ্চার কথাটা সকলের হৃদয় ছুঁয়ে গেল যেন। পল্টুকে ছেড়ে হাসিমুখে তাপসদা বাচ্চাটাকে কাকার চায়ের দোকানে নিয়ে গেল।

বাচ্চাটার নাম রঘু। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। ওর মা এক বাড়িতে কাজ করে। তারা সকালে চা আর বাসি রুটি দেয়। ওর মা ওই রুটি নিয়ে এলে ওরা সকলে খাবে। বাড়িতে ওরা তিনজন। মা, বোন আর ও। বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। চা আর বিস্কুট হাতে চুপ করে বসে রইল রঘু। খেতে বলতেই কেঁদে ফেলল। বলল, ওর বোনের ক’দিন ধরে জ্বর। ও না খেয়ে আছে। এক বাবুর গাড়ি ধুয়ে পাঁচ টাকা পেয়েছিল কাল। ওই টাকা নিয়ে বোনের জন্য আপেল কিনতে এসেছিল। ক’দিন ধরেই রঘুর কাছে আপেল খাবার বায়না করছিল বোন। বোন না খেয়ে আছে, তাই ও চা বিস্কুট খেতে পারবে না!

তাপসদা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রঘুর দিকে। বোনের জন্য ওর ভালোবাসায় মুগ্ধ সকলে। তাপসদা হঠাৎ চিৎকার করে পল্টুকে ডাক দিল। মাথা নিচু করে পল্টু হাজির। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে তাপসদার দিকে। তাপসদা হাসতে হাসতে পল্টুকে কাছে ডাকল। বলল, এক কেজি আপেল আর এক ছড়া কলা নিয়ে আয়। দৌড়ে গেল পল্টু দোকানে। আপেল আর কলা আনতেই একটা পাঁচশো টাকার নোট রঘুকে দিয়ে বলল, টাকাটা দে কাকুর হাতে। তুই তোর বোনের জন্য আপেল আর কলা কিনলি।

রঘু কিছুতেই নেবে না। ওর মা বলেছে, ‘এভাবে কেউ দয়া করলে নিবি না’। হো হো করে হেসে উঠল তাপসদা।

পল্টুকে বলল, ‘দেখলি এই ছেলেটাকে তুই চোর বলে মারলি। তোর ছেলেকে কখনও তুই এই শিক্ষা দিয়েছিস? এ ছেলে অনেক দূর যাবে, দেখে নিস।’ তাপসদা জোর করতেই রঘু বলে উঠল, তাহলে আমি বড়ো হয়ে চাকরি করলে তখন ফেরত নিতে হবে কিন্তু। উপস্থিত সকলে রঘুর কথায় হেসে উঠল। কয়েকটা কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট আমি দিয়ে দিলাম ফলের ব্যাগে।

আনন্দে রঘু দে দৌড়। আমিও রঘুর মতো দৌড় লাগালাম সবজি বাজারের দিকে। দেরিতে বাজার নিয়ে ঢুকলেই বৌয়ের গামলা মুখের অগ্নিবান কল্পনা করতে করতে।

 

আজি ঝড়ের রাতে…

আঠারো বছর বয়সের সময় যখন আমি কলকাতায় পালিয়ে যাই, তখন নন্দিনীর বয়স ছিল পনেরো। আজ তিন বছর পর আমি বাড়ি ফিরলাম। এখন আমার বয়স একুশ আর নন্দিনীর আঠারো। মা বললেন, দুজনের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে এবার চারহাত এক করতে হবে।

ওই যে কথায় আছে না, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। কেউ জানে না কার ভাগ্য কার সঙ্গে লেখা হয়ে আছে। কিন্তু শুরুটা তো এমন ভাবে হয়নি, হয়েছিল এক প্রাণবন্ত ছন্দে। নন্দিনী যে কখনও অন্য কারও হয়ে যাবে সে কথা তো কোনওদিন ভেবেই দেখিনি।

নন্দিনীর সঙ্গে ছোটোবেলায় স্কুলে গেছি। পুতুল খেলেছি। পুতুলের বাবা মা সাজার সময় আমি বাবা হয়েছি ও মা হয়েছে। কখনও আবার বর-বউ খেলেছি। ওদের বাড়িতে গেলে নন্দিনীর মা আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরবেলা প্রায়ই ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন এবং দস্তুর মতো দুজনকে পাশে বসিয়ে হাত দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন। আবার আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে আপনা-আপনি বলাবলি করতেন, আহা, বেশ মানিয়েছে দুটিকে।

তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। অনেক ছোটো ছিলাম তাই হয়তো কথাটার মানে বুঝতে পারতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম আমাদের দুজনকে ওনারা খুব পছন্দ করতেন। নন্দিনীর প্রতি আমার একটু বেশিই দাবি ছিল অন্যান্য বন্ধুবান্ধব বা ওর আত্মীয়স্বজনের থেকে এবং সেই ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিল আমার মনের মধ্যে। সেই অধিকারে আমি কখনও তাকে শাসন করতাম এবং সেও আমার সব শাসন মাথা পেতে নিত সহিষ্ণু ভাবে।

মাঝে মাঝে তাকে উপদ্রব করতাম, শাস্তি দিতাম কিন্তু কোনওদিন টুঁ-শব্দটি করেনি। নির্দ্বিধায় সব মাথা পেতে নিত। খুব সুন্দরী বলব না তবে বেশ ভালোই দেখতে ছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের কাছে সে সৌন্দর্যের কোনও দাবি ছিল না। তবে আমি জানতাম আমার আদেশ পালন করার জন্যেই তার জন্ম এবং হয়তো সেই কারণে আমি অনেকটাই তাকে অবহেলা করতাম।

বাবাকে হারিয়েছি বছর দুই আগে। শুনেছি বাবা বলতেন, বাড়ুজ্জ্যে মশাই ওর হাত দেখে বলেছেন আমার রাজা একদিন সত্যি-সত্যিই দেশের রাজা হবে। বাবার ইচ্ছা আমি পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হই। তাঁর মতো কলমপেশার চাকরি যেন না করি। ছোটোবেলায় আমি কিন্তু মনে মনে তা, কোনওদিন চাইতাম না। আমি চাইতাম সারাদিন ধরে শুধু খেলাধুলা করব। তাই জীবনে আমি হয়তো কোনও খেলাই বাদ দিইনি।

মার্বেলগুলি, ডাংগুলি, সিগারেট-এর প্যাকেট কেটে তাস, পিট্টু ছাড়াও মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট, আরও কত বলব। ফুটবল, ক্রিকেট তো একটা ইতিহাস। দুপুর রোদে ঘর থেকে পালিয়ে যেতাম ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্যে। মা আবার আমাকে খোঁজ করে ঘরে এনে বেঁধে রাখতেন। কখনও মার সবে একটু তন্দ্রা এসেছে, সেই ফাঁকে বাঁধন খুলে, দরজার খিল খুলে আবার পালিয়ে গিয়েছি। পরে দাদাদের হাতে মার খেয়েছি কিন্তু খেলা থেকে কখনও পিছপা হইনি।

প্রতিদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনওমতে নাকেমুখে গুঁজে সোজা অরবিন্দ স্কুলের মাঠে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এদিকে মা ছাতা নিয়ে যখন আমাকে মাঠে খুঁজতে গেছে তখন আমি স্ট্রাইকার রোলে সররা খাচ্ছি।

যাইহোক ধীরে ধীরে খেলাধুলার জগৎ থেকে ইতি টানলাম। শৈশব থেকে কৈশোরে পা বাড়াতেই দেখলাম আমার বন্ধু রঞ্জন ডাক্তার হওয়ার বাসনায় তেড়েফুঁড়ে লেগেছে। হঠাৎ একদিন এও শুনলাম যে, সে কলকাতায় পালিয়ে গেছে। উঠেছে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে থেকে সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সফল করবে।

আমার জীবনেও সেরকম অনেক উচ্চাশা ছিল। ওর মতো ডাক্তার না হতে পারি (যদিও মনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনা ছিল) নিদেনপক্ষে একটা সরকারি চাকুরে অর্থাৎ সরকারি অফিসের বড়োবাবু হওয়ার জন্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।

ছোটোবেলার কথা আবছা মনে পড়ে। বাবাকে দেখতাম হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতি কত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। তাছাড়া বাবার আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই উঁচু পোস্টের ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে তাঁরা এলে বাবা তাঁদের অনেক সম্মান করতেন। সেদিন যেন বাড়িতে উৎসব আনন্দের ঢেউ উঠত। কত পদ যে-মাকে রান্না করতে হতো তার হিসাব নেই।

আমিও শিশুকাল থেকে সেই ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয়দের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে সম্ভ্রমের আসন দিয়েছিলাম। যেন আমার ভারতবর্ষের পূজ্য দেবতা। তেত্রিশ কোটি দেবতার ছোটো ছোটো সংস্করণ। যেন বাবা বিশ্বকর্মার সন্তান, নাতি, পুতি এঁরা। বাবা বিশ্বকর্মা কী কী খেতে ভালোবাসতেন জানি না, তবে এদের খাতির আরও বেশি ছিল।

আমিও রঞ্জনের মতো একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম কলকাতায়। যাই হোক বালিগঞ্জে একটা চেনা লোক পেয়ে গেলাম। তার বাড়িতেই উঠলাম। ভদ্রলোকের নাম বীরেন দাস। তাঁর আবার তিন মেয়ে, বড়োজন ভালো গান গাইতে পারে অনেক মেডেলও পেয়েছে। সে আমার চেয়ে বছর দু-তিনেক বড়ো। আবার প্রেমও করে। ছেলে সাধারণ কারখানায় কাজ করে।

বীরেনবাবুর আপত্তি ওই ছেলের সঙ্গে বড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে। সেই দুঃখে বড়ো মেয়ে কন্টিনিউয়াস সাতদিন অনশনে। বীরেনবাবু অনেক কষ্টে বিয়েতে রাজি হলেন এবং তারপর বড়ো মেয়ে অনশন ভঙ্গ হল। মেজটার বিয়ে হবে হবে করছে। ছেলে আর্মিতে চাকরি করে। ছোটোটা স্কুলে পড়ে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ছোটোটাকে পড়ানোর।

মাথায় গোবর আছে বললেও বেশি বলা হবে। আমি পড়াব কী, সে উলটে আমায় পড়িয়ে দেয়। জানি না ওনারা কী ভেবেছিলেন বা আমার ছাত্রীর মনে কী মনোভাব ছিল। তবে ওদের পাড়ায় কানাঘুষো চলত আমি ওই বাড়ির ছোটো জামাই। যাই হোক মা কেঁদেকেটে যখন খবর পেলেন যে, আমি কোথায় আছি তখন দাদাদের হাত দিয়ে পড়াশোনার জন্য কিছু কিছু দক্ষিণা পাঠাতে লাগলেন।

পড়াশোনাও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। আর টিউশানির পয়সা আমি নিতাম না, ওটা বীরেনবাবুর কাছে জমা থাকত। ওনার রেফারেন্সে গ্রাজুয়েশনের পরে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেলাম। কারণ উনি বলেছিলেন সাধারণ গ্রাজুয়েট হয়ে কিচ্ছু হবে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই শুধু বাড়বে। খরচা ম্যানেজ করেছিলাম ওই জমা টিউশানির পয়সা আর ওনার সামান্য কিছু সাহায্য দিয়ে। বীরেনবাবুকে কোনওদিন ভুলব না!

মাঝে মাঝে কলকাতার মিছিল-মিটিং-এ যোগ দিতাম। সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভযংকর ছিল। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা অবিলম্বে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং সে সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সেই দুঃসাধ্য কাজটা কীভাবে করব, লোকে উপদেশ দিত কিন্তু দৃষ্টান্ত কেউ দেখাত না।

সেই শহরে তখন নীলুদা, রূপকদার পাল্লায় পড়ে দেশের কাজে লেগে পড়লাম। বদমাস ছিলাম ঠিকই, তবে সেই কাজে উৎসাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে হতে পারি, কলকাতার ওই ইঁচড়ে-পাকা ছেলেদের মতো সব জিনিস নিয়ে পরিহাস করতে শিখিনি। সুতরাং আমাদের নিষ্ঠা অত্যন্ত দৃঢ় ছিল।

আমাদের সভায় নেতা-নেত্রীরা বক্তৃতা দিতেন, আর আমরা চাঁদার বই হাতে নিয়ে না-খেয়ে দুপুর-রৌদ্রে টো-টো করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াতাম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লিফলেট-পত্রিকা বিলি করতাম। সভার জন্য চেয়ার-বেঞ্চি সাজাতাম। আমাদের নেতার নামে কেউ একটা খারাপ মন্তব্য করলে মারামারি পর্যন্ত করতে এগিয়ে যেতাম। শহরের ছেলেরা এসব দেখে আমাদের নিয়ে মজা করত।

আসলে পার্টির লোকেরা যে আমার ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছে। দেশের এখন দুরবস্থা, তাই দেশের জন্য লড়তে হবে। মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, আজীবন বিয়ে না করে দেশের জন্য লড়ে যাব। মাকেও তাই বললাম, পড়াশোনা শেষ না করে আমি বিয়ে করব না।

এসব ভাবনা যখন চলছিল, তার ঠিক ছমাস পরেই খবর পেলাম, এলআইসি-তে কর্মরত অবিনাশবাবুর সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে অসহায় ভারতের চাঁদা-আদায়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম, নন্দিনীর বিয়ের খবর তখন অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম দুজনের বয়সের অনেকটাই পার্থক্য, বছর পনেরো তো হবেই।

বন্ধুরা বলেছিল বিয়ের দিন নন্দিনী নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিল। বারবার বলছিল রাজা আমাকে ভীষণ ঠকাল। সেই ছোটোবেলা থেকে ওকে আমি ভালোবাসি। সে কথা শুনে আমার চোখের কোণাটা একটু ভিজেছিল ঠিকই আর ঠিক সেই সময়ে রবিঠাকুরের কবিতাটা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে আমার দিকে বুকের মধ্যে তার তির নিক্ষেপ করে বলতে চাইল, যে আছে অপেক্ষা করে তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

ম্যানেজমেন্ট পড়া সবে শুরু করেছি এমন সময় দাদা বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। সংসারে আমি আর মা। কলেজ থেকে ফিরে রাত্রে দুটো টিউশানি ধরলাম। এর ফাঁকে চাকরির সন্ধানও চলতে লাগল। ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাঠ অনেক লড়াই ও কষ্টে শেষ হল। রেজাল্ট ভালোই করলাম। অনেক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর একটা বিদেশি কোম্পানিতে ট্রেনিং অফিসার-এর কাজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম মাঠে-ঘাটে পার্টির জন্য লেকচার দেওয়াটা এখন বেশ কাজে লাগবে। কাজও যেমন শেখাতে পারব, উপদেশ আর উৎসাহ দিয়ে এক একটা ছাত্রকে আগামী ভারতবর্ষের সৈনিক করে গড়ে তুলতে পারব।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। দেখলাম আগামী ভারতবর্ষের চেয়ে প্রোজেক্ট-এর কাজের ধারণা ও প্রোগ্রেস নিয়ে তাদের তাড়া বেশি। প্রোজেক্ট-এর সিলেবাসের বাইরে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে ম্যানেজারবাবু রাগ করেন। ধীরে ধীরে আমারও উৎসাহ নিস্তেজ হতে লাগল।

আমাদের বেশির ভাগ লোকেদেরই বোকা বুদ্ধি বেশি, আর কাজের বুদ্ধি কম। তাছাড়া বেশির ভাগই প্রতিভাহীন। ঘরে বসে নানান কল্পনা করতেই ব্যস্ত। কার্যক্ষেত্রে নেমে ঘাড়ে লাঙল নিয়ে পশ্চাত্দেশে ল্যাজমলা খেয়ে নতশিরে সহিষ্ণু ভাবে প্রত্যেকদিন মাটি-ভাঙার কাজ করে, সন্ধ্যাবেলায় একপেট জাবনা খেতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকে। লম্ফেঝম্ফে আর উৎসাহ থাকে না।

যাই হোক প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ট্রান্সফার হয়ে গেলাম ভুবনেশ্বর। যে-গ্রামের মধ্যে আমাদের প্রোজেক্ট শুরু হবে তার প্রায় কাছাকাছিই সমুদ্র। ওখানেই একটা গ্রামে মেস ভাড়া করে থাকলাম। চারিদিকে সুপুরি, নারকেল এবং মাদারের গাছ। মেস-বাড়িটার প্রায় গায়ে দুটো প্রকাণ্ড বৃদ্ধ নিমগাছ গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে ছায়া দান করছে।

অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি নিজেই সেই কথাটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে রাজি ছিলাম না। সেই যে অবিনাশবাবু, এলআইসি-তে চাকরি করেন, যার সঙ্গে আমার ছোটোবেলার বান্ধবী নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল তিনিও এই সুদূরে ভুবনেশ্বরে আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকেন।

অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল। আসলে আমরা দুই বাঙালি কলকাতা থেকে এসেছি। আশেপাশের বাড়িতে উড়িষ্যাবাসীরাই বেশি থাকেন। ভাষার অজ্ঞানতায় তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হয়। নন্দিনীর সাথে ছোটোবেলায় আমার যে জানাশোনা ছিল সেটা অবিনাশবাবু জানতেন কি না জানি না, তবে আমিও নতুন পরিচয়ে সে সম্বন্ধে কোনও কথা বলা উচিত হবে বলে মনে করলাম না। এবং নন্দিনী যে কোনওদিন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, সে কথাগুলোও আমি ভাবতে চাইছিলাম না। যাই হোক উনি সস্ত্রীক এখানে আছেন আমাকে বললেন, নিমন্ত্রণও জানালেন ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

এক রবিবার প্রোজেক্টে না গিয়ে অবিনাশবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। অনেকরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনার ইতি টানা হল বর্তমান ভারতবর্ষের দুরবস্থা প্রসঙ্গে। তিনি যে সেজন্য বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মান সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু বিষয়টা এমন যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এ সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক অনর্গল শখের দুঃখ করা যেতেই পারে।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শুনতে পাই পাশের ঘরে অত্যন্ত হালকা বাসন পড়ার আওয়াজ, দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ, আর হাওয়াই চটির খসখস। বুঝতে দেরি হল না, জানলার ফাঁক দিয়ে কোনও কৌতূহলী চোখ আমার দিকে ইশারা করছে।

সেই মুহুর্তে চোখে চোখ পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল সেই সরলতা, সেই নিবেদিত প্রাণ এবং শৈশবের প্রেমের ঢলঢল দুটো বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। হঠাৎ আমার হৃদপিণ্ডটাকে কে যেন তার ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল আর অব্যক্ত বেদনায় বুকের ভিতরটা টন টন করে উঠল।

সেই বুকের ব্যথা সঙ্গে নিয়ে অবশেষে মেসে ফিরলাম। রাত্রে যখন লিখতে বসি কিংবা কোনও ম্যাগাজিন পড়তে বসি সেই চিন চিন ব্যথাটা শরীরটাকে কেমন যেন অবসন্ন করে রাখে। মনের মধ্যে একটা ভারী বোঝার সঙ্গে শিরা-উপশিরার রক্তগুলো দ্রুতলয়ে ছুটতে থাকে। গভীর রাতে একটু স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম এমনটা কেন হল? বিবেক যেন জিজ্ঞেস করল, তোমার নন্দিনী কোথায় গেল?

বিবেকের প্রশ্নে আমার মনের ভেতর থেকে উত্তর এল, কই তাকে তো আমি ভালোবাসিনি। কবেই তো তাকে মন থেকে মুছে দিয়েছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? বিবেক আবার প্রত্যুত্তরে বলল, নন্দিনীকে তুমি ইচ্ছা করলেই পেতে পারতে। আজ শত চেষ্টা করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

সেই ছোটোবেলার নন্দিনী যতই তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াক, আজ হয়তো তুমি দূর থেকে তার পায়ের নুপূরের ধ্বনি শুনতে পাবে, দূর থেকে তার শরীর থেকে মিষ্টি সুগন্ধ অনুভব করতে পারবে কিন্তু মাঝখানে চিনের প্রাচীরের মতো একটা দেয়াল থাকবে বরাবর।

মনের অব্যক্ত বেদনাকে চেপে রেখে বিবেককে উত্তর দিলাম, তা থাক না, নন্দিনী আমার কে? প্রত্যুত্তরে বিবেক বলল, নন্দিনী আজ হয়তো তোমার কেউ নয়, কিন্তু এই নন্দিনী তোমার মনের অনেক কিছু হতে পারত।

কথাটা হয়তো সে সত্যি বলেছে। নন্দিনী আমার জীবনে, মননে অনেক কিছুই হতে পারত। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী, আমার সমস্ত জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার ছিল সে। আজ অনেক দূরে, কত আপন ছিল, আজ পর হয়ে গেছে, আজ তাকে দেখার অবকাশ নেই। একটু দেখার চেষ্টা করলে লোকে পরকীয়ার বদনাম দেবে। সেটা হয়তো নন্দিনীর শান্তির জীবনে অশান্তি ডেকে আনবে। আর আমিও সেটা চাই না। তার সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ। আর ওই ভদ্রলোক, কোথা থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসল, শুধু কটা মন্ত্র উচ্চারণ করে নন্দিনীকে আমার কাছ থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে গেল।

তবু স্বামীর সুখের সংসারে যে-নন্দিনী বিরাজ করছিল সে যে ওই মানুষটার চেয়ে বেশি করে আমার, এ কথা আমি কিছুতেই মন থেকে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। জানি এরকম চিন্তা করা নিতান্ত অন্যায় এবং সেটা আমি স্বীকার করি। তবে নিজের মনের কাছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তারপর থেকে আর কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। লাঞ্চের পরে যখন সুপারভাইজাররা ট্রেনিং-এর ক্লাসে বসে সোরগোল করতে থাকত, বাইরে প্রখর রোদ ঝাঁ ঝাঁ করত, গরম বাতাস নিমগাছের ফুলের গন্ধ বহন করে আনত, তখন ইচ্ছা করত… জানি না কী ইচ্ছা করত! এই পর্যন্ত বলতে পারি, ভারতবর্ষের শিল্পের এই সমস্ত ভাবী অফিসারদের প্রযুক্তিগত উপদেশ দিয়ে এই ইট-কাঠ-বালির জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করত না।

অফিসের ছুটি হয়ে গেলে আমার ছোট্ট ওই মেসবাড়িতে একলা থাকতে মন টিকত না, অথচ কোনও অফিসের স্টাফ দেখা করতে এলেও অসহ্য লাগত। রাত্রে যখন পাশের একটা পুকুর ধার দিয়ে হাঁটতাম, তখন সুপারি-নারকেলের হেলেদুলে ওঠা অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনতে শুনতে ভাবতাম, মানুষ জাতটা মাকড়সার জালের মতো ভুলগুলিকে বুনতে থাকে। আবার ঘুরে ঘুরে ফিরে এসে কবে যে তাকে শোধরাবে সে নিজেই জানে না। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে মনে পড়ে না, তার পরে প্রয়োজনে মনের বাসনা চরিতার্থ করতে টেনশন নিয়ে মরে।

অবচেতন মনে বিবেকের খোঁচা মারা ভাষণ শুনতে পাই, তুমি নন্দিনীর স্বামী হয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকতে পারতে, আর তুমি কিনা প্রথমে হতে গেলে দেশপ্রেমী এবং শেষে ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। আর, অবিনাশবাবু একজন অফিসার, আর তার কি বিশেষ করে নন্দিনীর স্বামী হবার কোনও জরুরি আবশ্যকতা ছিল? বিয়ের আগে পর্যন্ত তার কাছে নন্দিনীও যেমন, রানী লক্ষ্মীবাঈও তেমন। সে কিনা কিছু না ভেবে না চিন্তা করে বিয়ে করে বসলেন আর সরকারি কর্মচারী হয়ে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন। যেদিন তরকারিতে বেশি নুন পড়ে যায় সেদিন তিনি নন্দিনীকে গালিগালাজ করেন, আর যেদিন মন প্রসন্ন থাকে সেদিন নন্দিনীর জন্য উপহার কিনে আনেন। গোলগাল শরীর, সু্ট-টাই পরেন, মনের মধ্যে কোনও টেনশন নেই। যাকে পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের তারা গুনতে গুনতে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবসর সময় কাটাতে হয় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক অফিসের কাজে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় গেছেন। অবশ্য যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছেন। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, এই মেসবাড়িতে আজ আমি যেরকম একা আছি নন্দিনীও সেরকম বোধহয় তার ঘরে একাই আছে।

মনে পড়ে, সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। সকাল থেকেই আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। সকাল আটটা থেকেই টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিভির খবরে বলছে ভযংকর এক ঘুর্ণিঝড় ফণী, উড়িষ্যার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে। আকাশের ভাবগতিক দেখে আশেপাশের সব স্কুল ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রোজেক্টের কাজও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। খণ্ড খণ্ড কালো কালো মেঘগুলো যেন আকাশের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হল। যত রাত বাড়ছে বৃষ্টি আর ঝড়ের বেগ ভযংকর ভাবে বাড়তে লাগল। প্রথমে পূর্ব দিক থেকে বাতাস বইছিল, ক্রমে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বইতে লাগল।

ওই দুর্যোগের রাতে ঘুমোবার চেষ্টা করা বৃথা। মনে পড়ল, এই দুর্যোগে নন্দিনীও ঘরে একলা আছে। আমাদের মেসবাড়ি তাদের একতলা ঘরের থেকে অনেক মজবুত। কতবার মনে করলাম, তাকে মেসবাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি না হয় পুকুর পাড়ে গ্রামের কোনও চালাঘরের নীচে দাঁড়িয়ে বিধ্বংসী ঝড়ের রূপ উপভোগ করব। কিন্তু কিছুতেই মন স্থির করে উঠতে পারলাম না। অনেকটা মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আটকে গেলাম।

রাত যখন একটা-দেড়টা হবে হঠাৎ আরও প্রবল বেগে ঝড়ের সোঁ সোঁ ডাক শোনা গেল। সমুদ্র যেন উথাল পাতাল হয়ে ছুটে আসছে। ঘর থেকে ছাতা হাতে বাইরে বেরোলাম। দেখি একটা রক্তকরবী গাছ ঝড়ের দাপটে একদম শিকড় থেকে উপড়ে পড়েছে। আমার খুব পছন্দের ফুল। মনে পড়ে কতদিন নন্দিনী তার ওড়নায় বেঁধে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। সে কথা মনে পড়তেই কটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। নন্দিনীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথে যে-পুকুরের পাড়, সে পর্যন্ত যেতে না যেতেই দেখি হাঁটুজল হয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ের উপর যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দ্বিতীয় আর একটা জলের স্রোত এসে আছড়ে পড়ল।

পুকুর পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উঁচু। পাড়ের উপর আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম, বিপরীত দিক থেকে আরেকজন লোকও উঠে দাঁড়াল। লোকটা যে কে সেটা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমার সমস্ত শরীর অনুভব করতে পারল। এবং সেও যে আমাকে চিনতে পারল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম রাজা, তুমিও এখানে?

সমস্ত জলমগ্ন হয়ে গেছে কেবল হাত-পাঁচ-ছয় দূরত্বে দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী এসে দাঁড়ালাম। তখন প্রলয় চলছে, আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ যেন নিভে গেছে। তখন একটা কথা বললেও বলতে পারতাম। হাতে ধরা সিক্ত রক্তকরবী ওর পায়ের কাছে পড়ে গেল কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেউ কাউকেও একটা কুশল প্রশ্নও করল না। শুধু দুজনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে রবিঠাকুরের গান গেয়ে উঠলাম, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।

আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছেড়ে নন্দিনী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ এই বিপদের দিনে আমি ছাড়া নন্দিনীর পাশে কেউ নেই। সেই কবে শৈশবে, কোন এক জন্মান্তর, কোন এক পুরোনো রহস্য অন্ধকার থেকে ভেসে, এই সূর্য‌্য আর চন্দ্রের আলোকে আলোকিত হয়ে এই পৃথিবীর কোলে আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল; আর, আজ বহুদিন পরে সেই আলোকিত পৃথিবী ছেড়ে এই ভযংকর জনশূন্য প্রলয় অন্ধকারের মধ্যে নন্দিনী একাকিনী আমারই পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। জন্মের পরে সেই ফুলের কলিকে যেমন বিধাতা আমার হাতে সমর্পণ করেছিল, আজও প্রকৃতির তাণ্ডবে জীবনমৃত্যুর মাঝখানে সেই বিকশিত পুষ্পকে আমারই কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে আর একটা ঢেউ আসলেই পৃথিবীর এই সীমানা থেকে বিচ্ছেদের শেষ বৃন্তটুকু ছিঁড়ে, আবার আমরা দুজনে এক হয়ে যেতে পারি।

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে ঢেউ যেন আর না আসে। স্বামী সংসার নিয়ে নন্দিনী যেন বাকি জীবন সুখে থাকে। ওই রাতে ফণীর তাণ্ডবে হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তবু এই মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে ফিরে পেয়ে এক অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছি।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। ঝড় থামল, জলও নেমে গেল। নন্দিনী কোনও কথা না বলে বাড়ির পথে পা বাড়াল। তার পায়ের সামনে পড়ে থাকা রক্তকরবী ফুলগুলো কি বলল জানি না, তবে আমিও কোনও কথা না বলে মেসবাড়ির দিকে রওনা হলাম। কোনওদিন কবিতা লিখিনি, কিন্তু আজ বিবেকের দংশন খেয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে কয়েকটা লাইন লিখে ফেললাম,

আজ এই প্রলয়ে দিনে,

মেঘে মেঘে গুরু গর্জনে

ধেয়ে আসে ঘুর্ণিঝড় ফণী,

তুমি এসে দাঁড়ালে নন্দিনী।

নূপুর ছিল না ওই পায়,

এভাবে কেউ অভিসারে যায়?

পায়ে পায়ে বাজে না কিঙ্কিণী,

কেন এসে দাঁড়ালে নন্দিনী?

এলে যদি কেন গেলে একা?

আর কি হবে না তবে দেখা?

শৈশবের কৈশোরের রানি

সব ভুলে গেলে নন্দিনী?

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেসে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আমি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমীও হতে পারলাম না, ইঞ্জিনিয়ারও হতে পারলাম না, আমি সামান্য এক ইট-বালি-চুন-সুরকি কোম্পানির ট্রেনিং অফিসার। সাধারণ মেস বাড়িতে থাকি। শুধু ক্ষণিকের অবকাশে এক প্রলয়রাত্রির উদয় হয়েছিল আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে। সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে, একমাত্র সেই প্রলয়রাত্রিতে আমার তুচ্ছ জীবনে নন্দিনীকে ফিরে পাওয়াই আমার জীবনের চরম সার্থকতা।

 

জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

মুনিয়া

ঘটনার সূত্রপাত মাস দশেক আগে। সেদিন বৈশাখ মাসের সতেরো তারিখ। দিনটা এখনও মনে আছে পালকের। বোধহয় সারাজীবন-ই মনে থেকে যাবে। মারাত্মক গরম পড়েছিল সেদিন। এর আগে এপ্রিল মাসে এত গরম পালক দেখেনি কখনও। সেদিন-ই সে মোক্ষম জবাব দিয়েছিল কেয়াকে।

প্রায় বছর দুয়ে হল এই ফ্ল্যাটে এসেছে পালক। কেয়া অবশ্য তার-ও আগে থেকেই এখানে থাকে। এই ফ্ল্যাটটার পজিশন সবচাইতে ভালো বলে দামটাও তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি-ই ছিল। দামে-দরে ঠিকঠাক পোষাচ্ছিল না বলে প্রোমোটার ফ্ল্যাটটা নিজের হাতেই রেখেছিল। নীচের তলায় ডানপাশে ফ্ল্যাট। পালকের ফ্ল্যাটটা পছন্দ হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তার ফ্ল্যাটের সামনে পুর্বমুখী এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। এই অঞ্চলে এরকম ফ্ল্যাট আর একটাও তার চোখে পড়েনি। তাই এক দেখাতেই পালকের পছন্দ হয়ে যায় ফ্ল্যাটটা।

পালকের হাজব্যান্ড সায়ন্তন ভোলাভালা গোবেচারা টাইপের মানুষ। বউ-এর পছন্দের ওপর ভরসা রেখে চলা পুরুষদের মধ্যে একজন। তাই ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে কোনও দ্বিমত বা দ্বিরুক্তি করার মতো কেউ না থাকায়, পালক ফ্ল্যাটটা খুব সহজেই কিনে নিতে পেরেছিল। যদিও ওদের একমাত্র সন্তান জুলির স্কুলটা এই ফ্ল্যাট থেকে একটু বেশি দূর হয়ে গেল। তা হোক সামনের এত সুন্দর জায়গাটাতে বেশ কয়েকটা টব বসানো যাবে।

ফুলে ফলে ভরে যাবে তার ঘরের সামনের জমি। একি কম আনন্দের কথা! আর তাছাড়া পালক তো হাউস ওয়াইফ। জুলিকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া সে-ই তো করে। বাড়ি থেকে একটু আগে বেরোতে হবে এই যা। দামটা একটু বেশি দিতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পছন্দসই জিনিসের জন্য দাম নিয়ে ভাবলে চলে না। তাই মানে মানে নিয়ে ফেলেছিল ফ্ল্যাটটা।

পালকের পাশের ফ্ল্যাটে প্রায় পালকের-ই বয়সের আর একটি বউ থাকে। সে-ই হল কেয়া। প্রথম থেকেই পালক কেয়াদের এড়িয়ে চলে। যদিও কেয়া ভীষণই মিশুকে এবং হেল্পফুল। এই তো ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপর-ই পালকদের পুরোনো ওয়াটার পিউরিফায়ারটা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। সেই সময় কেয়াই ওদের ঘর থেকে ফিলটার্ড জল বোতলে করে দিয়ে সমস্যা মিটিয়েছিল। তারপর যখন ফ্ল্যাটে কাজ চলছিল তখন মইটা দাও তো, এটা দাও তো সেটা দাও তো এসব তো লেগেই ছিল। কেয়া কিন্তু সবকিছুই হাসিমুখে করেছে। কখনও মনে হয়নি যে, সে বিরক্ত।

তবুও পালক ওদের এড়িয়ে চলত। কারণ, নিঃসন্তান কেয়ার ঘরে ওর পোষ্য মুনিয়া থাকত। মুনিয়া ফটফটে সাদা রঙের একটা বজ্জাত বেড়াল। কেয়াদের ঘরের দরজা খোলা পেলেই সে বেরিয়ে আসে। আর ঢুকবি তো ঢোক ঢুকে পড়ে পালকদের ঘরে। পালকের জাস্ট গা ঘিনঘিন করে বেড়াল দেখে। কুকুর ওর যদি-বা একটু সহ্য হয়, বিড়াল জাতটাকে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না।

ফ্ল্যাট কেনার আগে পালক দুবার এসেছিল ফ্ল্যাটটা দেখতে। কিন্তু সেই সময় কেয়ার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় ওরা সপরিবারে মেদিনীপুর ছিল। ফ্ল্যাট কেনার আগের :  পর্যন্ত পালক জানতেই পারেনি যে, তার পাশের ফ্ল্যাটেই অমন একটা ইরিটেটিং অ্যানিম্যাল থাকবে আর যখন তখন তার ঘরে ঢুকে দুধ, মাছে মুখ লাগাবে।

এর আগে কেয়াকে বেশ কয়েকবার বলেওছে পালক, তোমার মুনিয়াকে গলায় চেন দিয়ে বেঁধে রাখো কেয়া। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না জাস্ট।

কিন্তু কেয়া একই কথা বলেছে প্রত্যেকবারেই, পালক, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড প্লিজ। ওরা জাতে বিড়াল হলেও আসলে মানুষের-ই মতো। তোমার গলায় যদি সারাক্ষণ দড়ি বেঁধে রাখা হয়, ভালো লাগবে তোমার?

কী কথার কী উত্তর! একটা বিড়ালের সঙ্গে মানুষের তুলনা! জাস্ট ডিসগাস্টিং। সেই বাদানুবাদের ঠিক দশ দিনের মাথায় দুই কেজি মাছ সবে ধুয়ে রেখেছে পালক। সায়ন্তন রোজ বাজারে যেতে পারে না বলে যেদিন-ই মাছ আনে বেশি করেই আনে। যেন দু-তিনদিন ফ্রিজে রেখে চালিয়ে নেওয়া যায়।

পালক ফ্রিজের পাশে মাছের গামলা রেখে কিচেনে ঢুকেছে, তিনটে বাটিতে তিন দিনের জন্য মাছ আলাদা আলাদা করে ফ্রিজে ঢোকাবে বলে। সে সময় কেন জানি না জুলি কি একটা কারণে দরজাটা খুলে রেখেছিল। ঠিক সেই সময় কেয়াদের বিড়াল মুনিয়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পালকের রান্নাঘরে ঢুকেই বসে পড়ল মাছ খেতে। যেন মাছগুলো ওর জন্যেই গামলায় যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে পালক। ব্যস। পালক দেখেই জোরে চিত্কার করে উঠল। পুরো দু-কেজি মাছ ফেলে দিতে হয় সেই দিন।

জুলির পছন্দের পাবদা আর ভেটকি মাছ ফেলে দিতে পালকের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বারো-তেরোশো টাকার মাছ জুলিকে না খাইয়ে নিজেরা না খেয়ে এভাবে ফেলে দিতে মন চায় কারও! সায়ন্তন তবু মিনমিন করে বলেছিল বটে, যেদিক থেকে মুনিয়া খেয়েছে সেদিক থেকে ফেলে দিয়ে বাদবাকিটা নেওয়া যায় না পালক! কিন্তু না। বিড়ালের মুখের জিনিস খেয়ে অন্য কোনও বড়ো অসুখ বাধাবে! পালক কি পাগল হয়েছে নাকি!

তারপর থেকেই ভেতরে ভেতরে ফুটছে পালক। মুনিয়ার একটা চরম এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে করবে তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপরেই তনয়াকে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ জরুরি আলোচনা সেরে নেয় সে।

তনয়া হচ্ছে পালকের সেই ছোটোবেলার স্কুল ফ্রেন্ড। মনের গঠনগত দিক থেকে দুজনেই প্রায় একই রকম। দুজনেই ভীষণ ভাবে ঘেন্না করে এই বিড়াল জাতটাকে। দুজনেই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। দুজনের-ই প্রিয় রং ম্যাজেন্টা। দুজনেই বাগান করতে ভালোবাসে। এরকম আরও কত কী! তনয়ার মাথা থেকেই আইডিয়াটা বের হয়। ব্যস। তারপর আর কি! দেখেশুনে একটা দিন ঠিক করল পালক।

পরের সপ্তাহে মঙ্গলবার সায়ন্তন অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে জিনিসটা কিনে নিয়ে ফিরল পালক। তারপর একটা বাটিতে মাছ আর একটা বাটিতে দুধ রেখে তার মধ্যে বিষটা বেশ যত্ন করে মাখিয়ে দিল সে। শত হলেও শেষ খাওয়া খাবে মুনিয়া। একটু ভালো করে দেওয়াই ভালো। এরপর সে গ্রিলটা টেনে দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে ফ্রিজের পাশে বাটি দুটো সাজিয়ে রেখে আরাম করে স্নান করতে লাগল।

ওয়াশরুমের দরজা ফাঁক করে একবার দেখে নিল পালক। হ্যাঁ। প্ল্যান মতোই সবকিছু এগোচ্ছে। মুনিয়া আরাম করে দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পর পালক বেরিয়ে দেখল দুটো বাটিই সাফ করে মুনিয়া পালিয়ে গেছে। যাক বাবা! এতদিন পর একটা কাজের কাজ করেছে পালক। এরকম একটা কিছুর ভীষণ-ই দরকার ছিল। সবকিছুর-ই একটা সীমা থাকা উচিত। একেই তো বিড়ালের পশমকে দারুণ ভয় পায় পালক, তার ওপর আবার যখন তখন ঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দিয়ে দেওয়া। উফ! অসহ্য!

দুপুর পর্যন্ত মুনিয়ার আর কোনও সাড়াশব্দ পায়নি পালক। একবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেরকম কিছুই বুঝতে পারেনি সে। জুলিকে আনতে যেতে হবে। হাতে এই মুহূর্তে প্রচুর কাজ পালকের। রান্না করতে করতে একরকম ভুলেই গেছিল মুনিয়ার কথা, ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠল। কে এল! কেয়া নাকি! ও কিছু সন্দেহ করছে না তো!

দু-বার ঢোঁক গিলে পালক দরজা খুলল। সাথে সাথেই কেয়া চিত্কার করে বলল, কী করে এরকম একটা নোংরা কাজ করতে পারলে পালক! আমার মুনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল। এই অবস্থায় নিজে একজন মা হয়ে আরেকটা মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে একটুও হাত কাঁপল না তোমার! ছিঃ।

—বিষ! এসব তুমি কী বলছ কেয়া! না বোঝার ভান করল পালক।

—ন্যাকামো না করে তোমার বাগানে গিয়ে দেখে আসো মুনিয়ার কী অবস্থা!

বাগানের নাম শুনেই এক লাফে সিঁড়ির প্যাসেজ পার হয়ে মেন গেটের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল পালক। বেরিয়ে ডান হাতে তার বাগান। বাগানের বেশিরভাগ-ই সব ছোটো ছোটো টব। তাতে কোনটা তুলসী, কোনটাতে ধনেপাতা, আবার কোনওটাতে গোলাপ। একটাই শুধু বড়ো গামলার মতো টব। গামলায় একটা বনসাই আম গাছ। গাছটা বেশ সুন্দর ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গরমে মাঝে মাঝেই মুনিয়া আম গাছটার তলায় এসে বসে থাকে। এখনও যেমন শুয়ে আছে। তবে এই শোয়ার সঙ্গে আগের শোয়ার বেশ পার্থক্য রয়েছে, সেটা ভালো মতোই বুঝতে পারল পালক। মুখে সেসব কিছুই প্রকাশ না করে পালক বলল, ও মা! মুনিয়া এভাবে শুয়ে আছে কেন!

—এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে চাই পালক। মুনিয়া একটা ছোট্ট প্রাণী তার ওপর সে মা হতে চলেছিল। তাকে এভাবে খুন করলে কেন পালক?

তার মধ্যেই পালক দেখে নিয়েছে মুনিয়ার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে জিভ বের করে সে ঠিক আমগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে।

—উফ! দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এখানে এসেই মরতে হল! মরেও শান্তি দেবে না দেখছি মুনিয়া!

মুনিয়াকে বুকের মধ্যে নিয়ে কেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই গর্ভবতী মাকে মারার শাস্তি ভগবান তোমায় দেবে না ভেবেছ! এর শাস্তি তুমি পাবেই পালক। আমার মুনিয়া এত বড়ো অন্যায় কিছুতেই সহ্য করবে না। তুমি মিলিয়ে নিও।

পালক এরকম অভিশাপ শুনে একটু থমকে গেছিল প্রথমে। কেয়ার কান্না দেখেও বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে পালকের। কেয়া মুনিয়াকেই যে তার নিজের সন্তান ভাবত তা সে মরমে মরমে বুঝতে পারছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পালক দেখল আম গাছটাও গর্ভবতী। ডালে ডালে মুকুল এসেছে। কদিন বাদেই ফল ধরবে। কিন্তু না। ফল ধরার আগেই বিনা নোটিশে গাছটা মরে গেল। কিছুদিন ধরেই গাছের গোড়ায় জল দিলেও জল শুষে নিচ্ছিল না আমগাছটা। তার দিন কয়েক পরে মুকুলগুলোও হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

পালকের মনে কু ডাকতে লাগল। তাহলে মুনিয়ার আত্মা-ই কি গাছটাকে মেরে ফেলল! ভগবান কি এভাবেই শাস্তি দিল পালককে! এরপর আম গাছের জায়গায় খুব ভালো জাতের একটা বনসাই বাতাবি লেবুর গাছ লাগাল পালক। রোজ পালকের হাতের পরিচর‌্যা পেয়ে গাছটা বাড়তে লাগল দ্রুত। কিছুদিন পরে ফুল ধরল তাতে। ততদিনে পালকও বুঝতে পেরে গেছে ওসব আত্মা-টাত্মা পুরো ফালতু ব্যাপার।

তনয়াও এই ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে পালককে। নিজের হাতে লাগানো গাছের বাতাবি লেবু জুলি খাবে। এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে পালকের। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না। বরং ঘটল ঠিক তার উলটোটা। ফুল আসার কদিন পর থেকেই গাছটা শুকোতে আরম্ভ করল। এবার সত্যি সত্যি ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম ভয় পেতে শুরু করেছে পালক।

আম গাছটা না হয় এমনিই মরে গেছিল। কিন্তু বাতাবি লেবুগাছ! সেটা কোন কারণে মারা গেল! গাছগুলোর যদি মরার-ই ইচ্ছে হয় তাহলে আগে বা পরে নয় কেন! ঠিক মুকুল এলেই গাছগুলো মরে যায় কেন! এবারে আর কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিকেও মানতে নারাজ পালক। তনয়ার নানারকম যুক্তি শুনতে ইচ্ছে করে না তার। তার মনের মধ্যে ভয়, দুশ্চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আজ অনেক দিন যাবত ঘুমাতে পারছে না পালক। কখনও যদি বা একটু ঘুমিয়ে পড়ে তাহলেই স্বপ্নের মধ্যে মুনিয়াকে দেখতে পায় সে।

মুনিয়া যেন মিহি সুরে বলছে, আমার বাচ্চাদের মেরেছিস কেন পালক! আমাকেই বা মারলি কেন পালক!

যখন তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে পালক। দুই চোখের তলায় জমাটবাঁধা কালি। পেলব মসৃণ ত্বক জৌলুস হারিয়ে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর ভেঙে আধখানা হয়ে গেছে। সায়ন্তন কোনও কিছুই বুঝতে না পেরে পাড়ার নার্সারি থেকে আবার একটা বনসাই আম গাছ এনে ফাঁকা টবে লাগিয়ে দিয়েছে।

পালক আর কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সায়ন্তনকে না। জুলিকে না। কাউকে না। বহু রাত সে ঘুমোতে পারছে না ঠিকমতো। ঘুম এলেও একটু পরেই ভেঙে যায়। বারেবারে মুনিয়ার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কেয়ার দেওয়া অভিশাপ সবসময়-ই যেন শুনতে পায় সে। তবে কি পালক পাগল হয়ে যাচ্ছে!

সকালে উঠতেই সায়ন্তন পালকের হাতটা ধরে বলল, পালক, আমগাছে মুকুল এসেছে। এবার আর কিছুই হবে না। এবারে তোমার গাছে আম ধরবে দেখো!

মুকুল ধরেছে! আবার মুকুল ধরেছে! উফ! আবারও আসবে মুনিয়া। এই গাছটাকেও বাঁচতে দেবে না ও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না মুনিয়া।

পাশের কোনও একটা ফ্ল্যাট থেকে রাত দুটোর ঘন্টা বাজল। ঘুম আসছে না পালকের। এভাবে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বরং ওয়াশরুমে গিয়ে একটু মুখে জল দিয়ে আসি। ভাবতে ভাবতেই খুব আস্তে করে শোবার ঘরের দরজা খুলল পালক। নাহ! জুলিদের ঘুম ভাঙেনি। ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে বারান্দার দিকে চোখ পড়ে গেল হঠাত্। আমগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমগাছের পাশে ওটা কে দাঁড়িয়েছিল মনে হল! বসে পড়ল নাকি! আর দেখা যাচ্ছে না তো! পা টিপে টিপে বারান্দার কাছে এসে দেখল, কেকা একটা মগে একটা নুনের প্যাকেট থেকে নুন ঢেলে জলে গুলছে আর আম গাছের গোড়ায় ঢেলে দিচ্ছে।

ওহ মাই গড! গাছে মুকুল এলেই গাছগুলো তাহলে এভাবেই মরে যায়! হায় রে কেয়া! পালক প্রেগন্যান্ট মুনিয়াকে মেরেছে বলে তুমি আমার ফলবতী গাছগুলোকে এভাবে মেরে ফেলছ! মুনিয়ার মতো যে গাছগুলিও নিষ্পাপ গো কেয়া! আমি তো মহাপাপ করেছিলাম কেয়া। সেটা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। কত বড়ো ভুল আর অন্যায় যে সেদিন করেছিলাম এক গর্ভবতী মাকে খুন করে, সেটা ভেবে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। সেই একই ভুল তুমিও করলে কেয়া! ভুল দিয়ে ভুলকে কি উপড়ে ফেলা যায় কেয়া!

আজ বহু দিন পর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে পালকের। আজ থেকে আবার ঘুমোবে সে।

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল, কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডার্লিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ সবই বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না, ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়নও নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের মন অশান্ত হয়ে উঠল।

 

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল রোমার। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেয়েটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যের সাগরে তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

ইঁদুরের গর্ত

আমি করব। মা বাবার কনসেন্ট জোগাড় করাটা আমার ব্যাপার।

র-এর চাকরির সাক্ষাৎকারে বলেছিল কস্তুরী, যদিও ব্যাপারটা ওর হাতে ছিল না, পারিবারিক বিষয় হয়ে গিয়েছিল। র-এর প্রাথমিক মনোনয়নপত্র বা অফার লেটার আসতেই বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ভিন দেশে গুপ্ত মিশনে মারা গেলে শরীরটা ভারত সরকার ফেরত নেওয়া তো দূর, নিজের নাগরিক হিসাবে স্বীকার নাও করতে পারে। এই জাতীয় শর্ত দেখার পর মা তো নাওয়া-খাওয়া ও সেইসঙ্গে রান্না করা ছাড়লেন।

ট্রেকিং-এর স্বপ্ন কোন ছোটোবেলায় দুচোখে ও মস্তিষ্কে আঁকা হয়ে গেছে পাকাপাকি। কিন্তু শখ থাকলেই সাধ্য থাকতে হবে, এই আপ্তবাক্য বা প্রবাদ সবার জীবনে মেলে না। কস্তুরীরও জেদ, কিছুতেই আর-পাঁচজন বিজ্ঞানের ছাত্রীর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হবে না। সে বিশেষ কিছু করবে, মানে ভেতো বাঙালি মার্কা নয়, রোমাঞ্চকর কিছু।

তবে রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তেমন কিছু একটা চাকরি লাগিয়ে ফেলা যায়। সবাই যখন আইএএস দেয়, কিছু ছেলেমেয়ে শুধু একটা লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে বস হবে বলে আইপিএস পেতে চায়। অন্যরা যখন ব্যাংক প্রবেশনারি অফিসার হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়াশোনা করে, তখন খুশিমনে কস্তুরী দাশগুপ্ত সিবিআই, র, ফরেনসিক বা নিদেনপক্ষে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ় তথা আইবি-র পরীক্ষা দিয়ে গেছে।

বাড়ির সবার চাপে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে মন নেই। ভর্তি হয়েছে মায়ের মন রাখতে। যদি ফরেন্সিকে যেতে পারে, তো এই লাইনে থাকবে, নয়তো শুধু শুধু মরা-পচা কাটার কোনও বাসনা নেই। যে-কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সেই গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।

এই সময় কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ-এর ইন্টারভিউ কল পেল। চাকরিটা যে তিন বছর করে কাস্টমস আর তিন বছর করে সেন্ট্রাল এক্সাইজ় পোস্টিং আগে জানা ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে দুরূহ অবস্থার মোকাবিলা, আত্মগোপন করা, ছদ্মবেশ ধারণ করার শিক্ষানবিশি সব নিতে হবে। শুনেই কস্তুরীর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রোমাঞ্চে, আর মা-বাবার কাঁটা দিচ্ছিল উদ্বেগে। উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, পাগলির কথা শোনো। ডাক্তারির সুযোগ ছেড়ে কেউ চোর ডাকাত স্মাগলারদের পিছু ঘোরে?

মনে মনে মরিয়া হয়ে সাক্ষাৎকার দিল এবং পেয়ে গেল কস্তুরী। প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম পোস্টিং মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অসম সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই, মা-বাবা তাতেও খুঁতখুঁত করছিলেন। ওখানে বাঙালিরা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ থেকে যেহেতু অবাধে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পরিয়াযী মানুষ অসম ও মেঘালয়ে প্রাণ বাঁচাতে বা জীবিকার সন্ধানে আসে, তাই সাত প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালির প্রতিও যেন শরণার্থী জবরদখলকারীর মনোভাব স্থানীয়দের। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হ্যাংলার মতো শিলং, বড়া পানি, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম দেখতে ছোটা চাই। স্বজাতির কী হল না হল সেসব ভেবে নিজেদের সীমিত পরিসরের আনন্দ মাটি করতে চায় না কেউ। কিন্তু এখন যে, নিজের কন্যার প্রশ্ন। মাথা ঘামাতেই হচ্ছে।

কিন্তু আজকের দিনে সরকারি চাকরি বলে কথা, কোটার পাত্রী নয়, কটাকে হেলাফেলা করবে? ডাক্তারি পড়তে লাগবে কম পক্ষে পাঁচ বছর। তারপর হাউস স্টাফ থাকতে হবে। স্বাধীন রোজগেরে হতে গেলে অন্তত ছয় সাত বছরের ধাক্কা। আর এটা শুরুতেই মোটা মাইনে, দুবছর পর পাকা চাকরি। সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা-সহ নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ্য ভাতা, এলটিসি সব। অগত্যা মা কালী মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে শেষে লোকনাথ বাবার কাছে নিরাপত্তার জিম্মা দিয়ে মেয়েকে এয়ারপোর্টে এসে মেঘালয়ের উদ্দেশে রওনা করতেই হল।

বিমানে ওঠার আগে খুশির হাসি হেসে খুশিমনে কস্তুরী বলল, মা দুই বাংলার বাইরে লোকনাথ বাবাকে কেউ চেনে না, যদিও বলা হয় উনি সুমেরু পর্যন্ত নাকি ঘুরে এসেছেন, তবে নর্থ-ইস্টে যাননি। উনি না মানচিত্র গোলমাল করে ফেলেন। ঠাকুরের আসনে সেভেন সিস্টার সমেত ভারতের ম্যাপটাও রেখে দিও।

উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনার বিশেষ অধিকার, তার অপব্যবহার, ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নবাদী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধা। তার মধ্যে কস্তুরীর কাজ পড়েছে কয়লা চোরাচালান আটকানোর বিভাগে। যদিও প্রশিক্ষণ পর্যায়, তবু এমন বিপজ্জনক কাজের ট্রেনিং-ও বিপন্মুক্ত হওয়া সহজ নয়।

ওদিকে দক্ষিণ মিজ়োরামে ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার, কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আযোজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম সবকিছু নিয়ে ঝামেলা। কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে মেলে না।

ষাটের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নিজেদের জুমিয়া জাতি বলে বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চেনে ও কড়া হাতে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর গোড়ায় সত্যিই চাকমা সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী বা চাকমা আর্মড ফোর্স তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি বাহিনী। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। আবার উচ্ছেদ, আবার ভারতের অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া। কেউ কেউ পরিব্রাজন করে লাগোয়া অসম মেঘালয়ে চলে আসে। তাদের পুনরায় আগমণ নিয়ে মিজ়োরাম তো বটেই, মেঘালয়ে এই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার ওপর বসতভিটে ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের উৎপাত তো আছেই।

নাক ও চোখের গড়নের সাদৃশ্যের খাতিরে স্থানীয়দের চোখে চাকমারা যদিও ওদের মধ্যে কিছুটা আত্মগোপন করতে পারে, কিন্তু বাঙালি মানেই বাংলাদেশী আর বাঙালি দেখলেই সবার দ্যাখো মার ভঙ্গি। মেয়ও তবু একটু দয়া দাক্ষিণ্য করে, কিন্তু মেঘালয়ে গারো খাসি জয়ন্তিয়া জনজাতিরা এবং মিজ়ো ছেলেরা বাঙালি পুরুষ নারী বাচ্চা কাউকেই রেহাই দিতে চায় না।

বাঙালি ও চাকমা খেদানো নিয়ে সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কট পর্যন্ত হয়ে গেছে। জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পুনর্বাসন ও অভিবাসন হবে না কথা দিয়ে শান্তি নেই। বাঙালি মানেই মেরে ফ্যাল শালা, রিফিউজির জাত। নামেই মাতৃপ্রধান সমাজ। কোনও মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও বড়ো পদে দেখাও বিরল ব্যাপার। অথচ ঘর-সংসার থেকে ব্যাবসাপত্র, সম্পত্তি সবকিছুর দেখভাল মেয়েরাই করে।

আরেক পক্ষের দাবি, অভিবাসন দিলে সবাইকে দিতে হবে। জাতি ধর্মের বিভেদ করলে চলবে না। যারা আসছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে আসছে, সুতরাং কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে সেই ভেদাভেদ করা চলবে না। রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিক পরিস্থিতি সব সময় উত্তপ্ত, যে-আগুনে পুড়তে হয় মূলত সব হারানো বাঙালি পরিবারগুলোকেই।

নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্র সরকার একটু আংশিক উদারতা দেখাতেই মেঘালয়ে বাঙালি খেদানোর ও মারার নতুন হিড়িক পড়ে যায়। রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়, বাঙালি মেঘালয় পাহাড় না ছাড়লে রক্তের স্রোত বইবে। ভারতের দেশজ হোক বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালির জন্য ক্রমশ আরেক বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে মিজ়োরাম ও মেঘালয়। বাঙালিরা যেখানেই যায়, নিজেদের বুদ্ধির জোরে বড়ো বড়ো চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি সম্মানজনক পেশাগুলো হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের থিতু হয়ে বসতে না দিলে জীবনরক্ষায় দিনানিপাতেই কেটে যাবে কাল।

আরও একটা ভয়, এই পুরো অঞ্চল জুড়ে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সেগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনজাতি ছাড়া আর কারও হাতে যাওয়া পছন্দ নয় মিজো, খাসি, গারোদের। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি ও অনেক বেআইনি কোলিয়ারি আছে। বেশ কয়েকটির মালিক মাড়োয়ারিরা। স্থানীয়দের ভাষায় ইন্ডিয়ান। তাদের বেসরকারি কোলিয়ারি আইনানুগ নথিভুক্ত। কিন্তু তাতেও বেআইনি কাজ করতে বাধা নেই। চুক্তিমতো ন্যুনতম পারিশ্রমিক না দেওয়া, দৈনিক রোজ বাকি রাখা, বিমা ছাড়া কন্দরে প্রবেশ করানো কত আর বলা যায়?

কোথাও কোথাও খনির মুখ এত সরু, যে বড়ো মানুষ ঢুকতে পারে না। তাই বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও বেআইনি ভাবে নামানো হয় সেই সব গভীর ইঁদুর গর্তে। বাস্তবিকই ওগুলোর নামকরণ সার্থক র‌্যাট হোল মাইন। সেখানে অস্ত্র হাতে গুঁড়ি মেরে কয়লা কেটে আনতে হয়। দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। সেই ভ্যান গখের জীবনীতে পড়েছিল কস্তুরী এই অবিশ্বাস্য শোষণের কাহিনি। এ যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। এখানে তো গরিব মানুষের নগণ্য পারিশ্রমিকও বাকি রেখে তা পুরোটা চোকানোর টোপ দিয়ে তাদের আবার নামতে বাধ্য করা হয় ওই মরণ গহ্বরে। এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সব হারানো বাঙালির বাচ্চারাই। দুটো খেতে পাওয়ার জন্য মানুষ কী না পারে? বাংলাদেশ থেকে খেদানি খেয়ে এখন অসম থেকেও খাচ্ছে, আর কোলিয়ারি মালিকদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

মা আমি নাই যাব ঐহানে। ডর লাগে। হাত পা ছিলা যায়। বাবা গো! আমারে পাঠায়ও না।

আজ কাম করে নে, টাকাটা পেলে পরদিন আর যাবি না উহেনে।

কিন্তু সেই পরদিন আর আসে না। পেট চালাতে মহাজনের কাছে দেনা। শুধতে গেলে আবার কাজ, আর কাজ মানে ইঁদুরের গর্তের অতলে তলিয়ে কয়লা তুলে আনা। পারিশ্রমিক যা পায়, গালাগাল পায় তার বেশি। তবু এই চক্র থেকে রেহাই নেই। ২০১৮-র ডিসেম্বরে একসাথে পনেরো জন শ্রমিক আটকে পড়ায় খবর হয়েছিল। তাদের উদ্ধারে বাযুসেনা পর্যন্ত নেমেছিল, নেমেছিল ডুবুরি বাহিনী। তবু শেষটায় ছয় জনকে বাঁচানো যায়নি। আরও কত খুচরো সংখ্যক প্রাণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে চলে যায়, তার গোনা-গুনতি নেই!

আবার শোনা যাচ্ছে লিটন নদীর জল ইঁদুর গর্তে ঢুকে পঞ্চাশজন শ্রমিক আবদ্ধ। ৩৬০ ফুট গভীরে তাদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে খবরটা ধামাচাপা দেওয়া যায়, তাতে সচেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজের উদ্ধার বাহিনী নামিয়েছেন। কিন্তু সেনা ডাকা মানে সর্বভারতীয় খবর হওয়া। একই ব্যক্তির রাজত্বে দু-দুবার এমন দুর্ঘটনা ভালো প্রশাসনের পরিচয় নয়। গতবারেই কোল ইন্ডিয়া স্বীকার করেছিল, এই তল্লাটে প্রচুর চোরা খাদান আছে। পাহাড় গাত্র ফুঁড়ে চলা এই র‌্যাট হোল, শুধু শ্রমিক কেন, সাধারণ মেঘালয়বাসীর পক্ষেও ধস নেমে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মেনেছিল আইন অমান্য করে খনিতে নাবালক নাবালিকাদের নামানো হচ্ছে। কিছুদিন কাগজে হইচই হল, দু-একজন গ্রেফতার হয়ে জামিনে খালাস। তারপর আবার যেই কে সেই। এবারেও মনে হচ্ছে আধা সেনা ও সেনা ডাকতে হবে, নতুবা পরে জানাজানি হলে আরও হাঙ্গামা, যদিও মন্ত্রীদের পদ তাতে টলে না।

র‌্যাট হোল খনি শুনলেই গা ছমছম করে কস্তুরীর মতো ডাকাবুকো মেয়েও। তার মধ্যে স্থানীয়রা সবাই এটাকে সবচেয়ে ভয় করে। ওখানে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। যাদের জীবন নরকের চেয়ে দুর্বিষহ, তাদেরও বাঁচার এত সাধ, আর অজানা অন্ধকারকে এত ভয়?

কস্তুরী সীমান্তে চোরাচালান ধরার দাযিত্বে। যদিও তার ট্রেনিং চলছে, কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের জন্য ওকে মাঝে মাঝে ভয়াল জায়গাতেও ঠেলে দেওয়া হয়। এবার রেস্কিউ টিমে ওকেও রাখা হয়েছে। খনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ ও চার্জশিট গঠনে সহায়তা করলেই তার দায় মেটে। আটকা পড়া মানুষগুলোকে জীবন্ত উদ্ধার করা গেলে একরকম, আর মারা গেলে আরও কড়া প্রকৃতির। তাদের বাঁচানোর দায় মোটেই তার নয়। তবু বাঁচাতে পারলে নাকি চোর ধরতে কাজে লাগবে।

এটা কাস্টমস্-এর কাজ নয়। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভাঙে। আসলে কাজটা কস্তুরীর ছেলেমানুষি আবেগে নিজের শখের ডুবুরি ট্রেনিং নেওয়ার কথা ফাঁস করে দেওয়ার ফলশ্রুতি। নাও এখন মরণ গহ্বরে ডুবে মানুষ উদ্ধার করো। এক সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চায়নি কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মুখোমুখি।

ঘটনাচক্রে শ্রমিক ছেলেমেয়ে ও বয়স্করাও জলের শব্দ পেয়ে ১৬০ ফুট গভীরে একটা চাতালে উঠে এসেছে। ওখানকার ছাত বা সিলিং-এ একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। ভাগ্যক্রমে তার লাইনে এখনও গোলযোগ হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে। বস্তুত এর গভীরে নামা নিয়মও নয়। একজন মাত্র নিখোঁজ। ওই একজন কে, ওপরে কেউ জানে না, নীচ থেকেও স্পষ্ট খবর আসছে না। সম্ভবত কোনও মহিলা। কিন্তু মানুষজনের হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চাশের মধ্যে একটি প্রাণ যেন কিছুই না।

চাতালের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু পর্বতগাত্রের সঙ্গে ত্যারছাভাবে একটা সুড়ঙ্গ সাবধানে খোঁড়া হচ্ছে সমান্তরাল উদ্ধারকার‌্যের জন্য, ঠিক যেমন রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে করা হয়েছিল। সেবারেও ছয় সাতজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির গভীরে অন্ধকারে জলের তলায় তারা জলে ইঁদুর চোবা হয়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইসব অঞ্চলে ওপেন কাস্ট খনির সংখ্যা বাড়ানো হলেও চোরা খাদানকে আটকানো যায়নি। আটকানো যাচ্ছে না ধস, অগ্নুৎপাতকেও।

বৃষ্টি শুরু হল। সর্বনাশ! বৃষ্টি পড়লেই বিপত্তি। তখন আর কোনও আশা থাকবে বা। বড়ো বড়ো ত্রিপলে খনিমুখ ঢাকার ব্যবস্থা হল। আধা সেনাবাহিনীর ট্রুপ এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তবে শোনা মাত্র স্থানীয় মানুষরা কয়েকটা ত্রিপল ও প্লাস্টিক জোগাড় করেছে। কারণ তাদেরই আপনজনেরা কেউ কেউ যে নীচে আটকে আছে।

প্রথমেই জলে ডুবতে হয়নি, কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথে উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ত্রিশজন চেন বাঁধা ডুলিতে চেপে উঠে এসেছে। এবার শ্রমিকদের আশ্রয় নেওয়া শুকনো চাতাল পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। শুকনো বললেও ভেতরটা অসম্ভব গুমোট ও ভ্যাপসা। ওই একজন তরুণী ছাড়া মনে হচ্ছে সবাইকে তোলা যাবে।

একজনের পা ফেঁসে গেছে পাথরের বা কয়লার খাঁজে। জল উঠে এসেছে তার বুক পর্যন্ত। নিজের পা-টা ছাড়ানোর জন্য যত টানাটানি করে তত যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যায়, কিন্তু পা যে আরও ফেঁসে যায়।

কস্তুরী বলল, ওর পা কেটে বার করে আনা হোক। পা যাবে কিন্তু প্রাণটা বাঁচবে।

মাথা খারাপ? জলের মধ্যে পা কাটলে ব্লিডিং বন্ধ করা যাবে? ও দমবন্ধ হয়ে না মরলেও রক্তপাতেই শেষ হয়ে যাবে…

ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তে ছেড়ে এসেছি। স্কুলে এনসিসি করেছি। সবরকম স্মল আর্মস চালাতে পারি। এ ছাড়া উপায় নেই। কোনও সার্জেন থাকলে প্লিজ় দেখুন। তেমন কেউ দাযিত্ব নিলে আমি নামব না।

বাধা ব্যাগড়া দেওয়ার জন্য যত লোক তৎপর হয়, আসল কাজে তার এক শতাংশকেও দেখা যায় না। কেউ রাজি নয় দেখে কস্তুরী নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নাকে নল গুঁজে বলল, আমি যাব। যদি ওর পা কাটতে হয়, আইনত কোলিয়ারি তার দাযিত্ব নেবে। কিন্তু যদি মারা যায়, আমি সব দায় মাথায় করে নেব। শাস্তি ভোগ করতে রাজি। দেখুন জল ওর গলা, টাচ করেছে। আর সময় নেই। আর এক ফুট জল উঠলেই সিসি টিভি অকেজো হয়ে যাবে। এখনও হয়নি সেটাই পরম বিস্ময়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না।…

কাউকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে মাথায় টর্চ হেডলাইট নিয়ে আর হাতে ধারালো চপার নিয়ে কস্তুরী নেমে পড়ল গহ্বরে। সবাই হতবাক। তারপর মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তুমুল হইহল্লা শুরু হল। যদিও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে নাকি মেয়েদের সম্মান আছে। পরিবার প্রধান হয়, পদবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদেই প্রায় পুরুষ। আর বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মন্তব্য ভেসে এল মেয়ে মানুষের বেশি বাড়। ট্রেনিং পিরিয়ডে এত সাহস পায় কী করে? কাস্টমস অফিসাররা কি হাতে চুড়ি পরে আছে? আর্মি তো আসছেই। আটচল্লিশজনকে উদ্ধার করা গেছে, একজন নিখোঁজ, আরেকজন মরলে কী ক্ষতি ছিল?… ইত্যাদি।

আধ ঘণ্টা পরে মাইন শ্যাফট এলিভেটরে টান পড়ায় টেনে তোলা হল। ডুবুরির সরঞ্জাম না থাকলে কস্তুরীকে চেনা যেত না। সারা গায়ে কয়লা ও কাদার আস্তরণ। ও ডুলিতে চেপে ধরে আছে এক তরুণকে। তার গায়ে জল কাদা কালি। তার মধ্যেও রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কাটা পায়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। সেখানে তার নিজের শার্টখানাই বাঁধা রক্তক্ষরণ যতটুকু কম করা যায়।

তবে আরও আশ্চর্য, কস্তুরীর দু পায়ের মাঝখানে কিছু একটা কাদাকালি মাখা জিনিস ধরা। সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে ও চ্যাঁচাল, সেই কাটা পাটা নিয়ে এসেছি। শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করলে ছেলেটাকে আর তার পা, দুটোই বাঁচানো যাবে। কুইক।

দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সিংগ্রাম নামের ছেলেটার প্রাণ বাঁচলেও তার থ্যাঁতলানো এলোমেলো করে কাটা পাখানা জোড়া লাগানো যায়নি। তবু কস্তুরী তার ও তার পরিবারের কাছে সাক্ষাৎ দেবী।

হাসপাতালে শুয়ে কস্তুরী খবর পেল, খনি মালিককে পুলিশ ধরেছে। তিনি আপাতত পুলিশ হেফাজতে হাজতে। সেটাও ওদের কাস্টমস দলের দলবদ্ধ সাফল্য। মনটা হালকা হয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে একজনের মোবাইল চেয়ে বাড়িতে ফোন করল কস্তুরী, মা, খুশি বলছি। কেমন আছো?

আর কেমন আছো? যেখানে গেছিস সব সময় চিন্তায় থাকি। তুই কেমন আছিস?

ভালো। ইয়ে মা… একটু খোঁজ নিতে পারবে, মেডিকেলটা আবার শুরু করা যায় কিনা? জানি জেনারেল ক্যান্ডিডেটের সিট ফাঁকা থাকে না, তবু যদি আমার স্কোর কনসিডার করে…। ডিপার্টমেন্ট যদি পারমিশন দেয়, তাহলে ভাবছি মা, এমবিবিএস-টা কমপ্লিট করে সার্জারিতে মাস্টার্স করব। দেখলাম চোর ডাকাত ধরার চাইতেও কারও প্রাণ বাঁচাতে পারাটা আরও বেশি স্যাটিসফ্যাকশন দেয়।

 

 

মুক্তি

॥ ১ ॥

ভোরের কুয়াশা সরিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নম্রতার পুরোনো শহর। বাসটা ক্রমশ পাহাড়পুরের দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন ভোরেও, যেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন বছরের রাইকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল নম্রতা। একরত্তি মেয়েটা কোল আঁকড়ে চুপ করে বসেছিল। এতটুকু কাঁদেনি। বরং যেন আগলে রেখেছিল নম্রতাকে। দেখতে দেখতে সতেরোটা বছর কেটে গেল।

এই তো দেবী চৌধুরানির মন্দির! যেদিন প্রথম টকটকে লাল সিঁদুর আর লাল বেনারসি পরে প্রথম পা রেখেছিল এই শহরটায়, সেদিনই এসেছিল এখানে প্রণাম করে নতুন জীবনের আশীর্বাদ নিতে। ভেজা ভেজা মায়া চোখে লেপটে যাওয়া কাজল আর একরাশ স্বপ্ন ছিল সেদিন। তারপর তো কত হেরে যাওয়া বিকেলে সে এসেছে!

সেই পাকুড় গাছটা! চার বছরে যতবার এদিকে এসেছে, ততবার খুঁজেছে গাছটাকে। রঙিন থেকে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জীবনের নীরব সাক্ষী তো এই গাছটাই!

বাসের হর্ন আর স্মৃতির মেদুরতায় কখন যে ব্যাগে মোবাইলটা বাজছে খেয়ালই করেনি নম্রতা। ফোনটা রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ রে রাই এক্ষুনি ও বাড়ি পৌঁছোব। সন্ধের আগে ব্যাক করব কোচবিহারে দিদির কাছে। দিদান কে দে তো একটু…

—মা চিন্তা কোরো না যেটা আমার রাইয়ের প্রাপ্য সেটা আমি নেবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না।

নেতাজি বাস টার্মিনাস থেকে কয়েক পা এগোলেই চৌমাথার মোড়টা। ডান পাশে সরু কানাগলিতে ঢুকতেই ওই তো দোতলা হলদে বাড়িটা। সামনের বেগনভেলিয়া গাছটা নেই বলে কেমন যেন ন্যাড়ান্যাড়া লাগছে। আশপাশের ছাদ থেকে দু-একটা উৎসুক, পরিচিত মুখ চোখে পড়ল নম্রতার। এই তো আর কপা এগোলেই বিশাল ফটক। কিন্তু পাগুলো কেন অসাড় হয়ে আসছে নম্রতার? অবশেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে কলিংবেল বাজাতেই বেরিয়ে এল এ বাড়ির জামাই দেবেশ। কেস চলাকালীন দেখেছিল নম্রতা দুএকবার।

—আরে আসুন! একা কেন, রাই কোথায়?

—ওর ক্যাম্পাসিং আছে।

—তা বাপের ভিটে, ঠাকুমা এদের প্রতি অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের তেমন সেন্টিমেন্ট নেই। কী বলে যে ডাকি! বউদিই বলি, কি বলেন? আপনি তো এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন। ইস্কুলটা কোথায়? আর পেপারে ফিচার টিচার তো লিখছেন খুব।

—ওই একটু আধটু!

—স্কুল ব্যান্ডেলের কাছে। থাকি উত্তরপাড়া, প্রপার কলকাতা নয়। ফ্ল্যাট না, দিদির ননদের বাড়ির নীচতলায় ভাড়া আছি।

—একাই তো থাকা হয় নাকি? বলেই ফিচেল হাসি হাসে দেবেশ।

—একা কেন? রাই আর মা থাকে। দৃঢ় ভাবে বলে নম্রতা।

ইতিমধ্যেই দোতলায় এসে পৌঁছেছে নম্রতা। বড়ো বৈঠকখানাটা এখন রোগিণীর শয্যা। বিছানার একপাশে পড়ে আছে এককালের দাপুটে বিভা দত্ত। চারদিকে চোখ বোলাতেই নজরে এল দেয়ালে ঝুল আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে ঝুলছে শুকনো ফুলের মালা জড়ানো দীপকের ছবি।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এল সোনা। এখন বেশ গিন্নিবান্নি।

—ও তুমি? এসেছ? মা তো ঘুমোচ্ছে। একটু বসো, বলেই ইশারায় স্বামীকে ডেকে নিয়ে গেল। আয়া মাসি বলে চলে, তুমি বুঝি বাবুদার প্রথম বউ! বুড়ি খুব তোমার নাম করছে গো!

তার নাম করছে? আশ্চর্য! কয়েক মুহূর্তের জন্য নম্রতা পিছিয়ে গেল একুশ বছর আগে। তখন সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী। রাত প্রায় বারোটা। সব কাজ সেরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীপক অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বিচলিত। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়ে বিচলিত আর উত্তেজিত হওয়াটাই প্রকৃতি ছিল দীপকের। নম্রতা বেশি ঘাঁটাত না। হঠাৎই রণংদেহী হয়ে ছেলের ঘরে কড়া নেড়ে উত্তেজিত হয়ে উপস্থিত হলেন বিভাদেবী।

—ও বাবু দেখ দেখ তোর বউ আজও হলুদের বয়মের মুখ আলগা রেখে এসেছে। আগে একদিন এভাবে চিনি নষ্ট করেছিল, আমি না দেখলে এখনি সব ছিটিয়ে চিত্তির হতো! বলি বিয়ে বাড়িতে দেখে কী মেয়ে পছন্দ করে আনলি? আমার সংসারটা তো গোল্লায় গেল!

—নম্রতা কী শুনছি এসব?

—আসলে মা বললেন শেষ পাতে সোনা বেগুন ভাজা খাবে, তাই তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি।

—হলুদ কি তোমার বাবা জোগায় নাকি?

—বাবার নাম একদম তুলবে না। উনি নেই।

—একদম চুপ! মুখে মুখে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।

—আহ লাগছে! চুলটা ছাড়ো!

—চল হারামজাদি! মা আর সোনার কাছে ক্ষমা চেয়ে বল, তোর মাস্টারবাবা তোকে শিক্ষা দেয়নি! বল!

—আহ লাগছে! ক্ষমা কেন চাইব? ভুল করে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে তো…

—একদম চুপ! আই! সোনা নিয়ে আয় ওর খাতাগুলো! দেখাচ্ছি মজা! লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে ফিচার পাঠানো? মন সবসময় উড়ু উড়ু! এক্ষুনি সব ছিঁড়ে দেব।

—হায় হায় গো! কী মেয়ে মানুষ! ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে অসুস্থ করা! যা বাবা চোখে মুখে জল দে আমাদের ভদ্দর লোকের বাড়িতে চ্যাঁচামেচি! পাঁচজনে শুনলে বলবে কী?

॥ ২ ॥

—ও বউদি চা খাবে গো! ও বউদি! চারু মাসির ডাকে সম্বিত ফেরে নম্রতার। ধীরে ধীরে চশমাটা খুলে ব্যাগে রাখে। একবার শীর্ণ বিভাদেবীর দিকে তাকায়। এই মৃত্যুপথযাত্রীনির শেষইচ্ছে পূরণ করতেই তো আসা!

পাশের লাল সিমেন্টের ঘরটা ছিটকিনি দেওয়া। চারুর অনুমতি নিয়ে ঢুকল নম্রতা। এখানেই তার খাট, আলমারি ছিল এককালে! পরে হয়তো রুম্পাও এখানে থাকত! এখন বাতিল জিনিসের আখড়া হয়েছে। হয়তো বাতিল হওয়া সম্পর্কও? ঘর? না সেভাবে নম্রতা কোনও বরাদ্দ ঘর পায়নি এ বাড়িতে।

বিয়ের পরপরই উঠেছিল নীচতলার আলো, বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে ঘরে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাই এল। বাচ্চার ঠান্ডার ধাত থাকায় উপরের লাল সিমেন্টের ঘর বরাদ্দ হল। কিন্তু সোনার পড়ার সমস্যা হওয়ায় শেষমেশ রাই আর নম্রতার ঠাঁই হল একদম ডাইনিং ঘরের এককোণে কাঠের চৌকিতে।

দরজাগুলোর একটাতেও কোনও পাল্লা ছিল না। শ্বশুরমশাই নগেন দত্ত তখন জীবিত ছিলেন। একে অ্যালজাইমার তার ওপর ডায়াবেটিস। যতবার তিনি ঘরের ওপর দিয়ে টয়লেটে যেতেন ততবার ছোট্ট রাইকে ফিডিং করাতে নম্রতাকে অস্বস্তিতে পড়তে হতো। হাজার বুঝিয়ে সুরাহা হয়নি। আসলে বিভাদেবী চাননি দীপক আর নম্রতার কোনও ব্যক্তিগত পরিসর থাকুক। জিনিসপত্র অবশ্যি নীচতলার ঘরেই থাকত।

একদিন এটাই তার সংসার ছিল! কই এতটুকু টান আসছে না তো? নম্রতার ঠাকুমা বলতেন দিনহাটার বাড়িটা ঠাকুমার স্বামীর ভিটে। পরপারে যাবার আগে তিনি ভিটে ছাড়বেন না! সেই ঠাকুমার সংস্কারেই তো বড়ো হয়েছে সে! স্বামীর ঘর, সিঁদুর, শাখা, পলা, নোয়া— এসব ভাবলেই ছোটোবেলায় প্রতিটা রোমকূপে যে-শিহরণ জাগত সেসব যে কোথায় উবে গেল কবে?

ধীরে ধীরে জানলার শিকগুলোতে হাত বোলায় নম্রতা। কত বুক ফাটা কান্নায় এই শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ খোঁজার চেষ্টা করেছে! কতদিন! ডানদিকের সরু দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ে বাঁকানো সিঁড়িটা। ধীরে ধীরে খানিকটা ঘোরের মধ্যেই ছাদে চলে আসে নম্রতা। এই ছাদটার মধ্যেই মরূদ্যান খুঁজে পেত এক সময় সে! গাছগুলো সব শুকিয়ে মরে আছে। চারদিকে পরিত্যক্ত টব। ওই তো নম্রতার ফেব্রিক দিয়ে রং করা ছোট্ট টবটা রং চটে পড়ে আছে।

আজও মনে পড়ছে তখন সবে দুদিন বিয়ে হয়েছে, একদিন আপন মনে গাছে জল দিতে দিতেই পাশের বাড়ির ক্যাসেট থেকে ভেসে আসা শ্রাবণী সেনের আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কী-র সুরে গুনগুন করছিল হঠাৎ পেছন থেকে দীপকের ধুপধাপ চটির শব্দ এগিয়ে আসছিল। কাঁধে দীপকের স্পর্শে চোখ বুজে রোমান্টিকতার কাব্য লিখছিল নম্রতা। না কোনও আবেশেই আবিষ্ট হতে পারেনি সেদিন।

দীপক জানিয়ে দিল তাদের সবার বাটি, চামচ, থালা, গেলাস আলাদা। দেখে বুঝে নিতে হবে। গুলিয়ে যেন না যায়। আর সোনার ঘরে বিছানায় ভুলেও নম্রতা যেন না বসে। সোনার এসব পছন্দ নয়। মুহূর্তেই শ্রাবণী সেন এর গানটা কলেজের পি ডি স্যারের হ্যাকের থিওরির মতো লাগতে শুরু করেছিল!

আজও চোখে জল এসে গেল নম্রতার? এখনও জল বেরোয় চোখ দিয়ে দীপকের জন্য? ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য? নাকি স্বামী নামক অদেখা ব্যক্তিটির জন্য আশৈশব তিল তিল করে জমানো এক বুক ভালোবাসার এক কণাও দিতে না পারার জন্য? সত্যি কোথায় গেল ভালোবাসাগুলো যার এক কণাও এই পরিবারের একটি মানুষকেও সে দিতে পারল না।

॥ ৩ ॥

—ও বউদি নীচে চলো গো সবাই ডাকছে!

—তুমি চারু? কতদিন আছ?

—আমি অনেকদিন বউদি। আগে ঠিকা কাজ করতাম। এখন বুড়ির ডিউটি। তোমার কথা শুনছি অনেকের মুখেই।

—কী? আমি খুব খারাপ?

—ধুর! মানুষ দেইখে চুল পাকল! রুম্পা বউদিও খারাপ না গো! একটু ইসস্টরং! বাবুন দাদা যে কী করল! বেরেনশর্টের অতগুলা ওষুধ! তুমি আসো শিগগির, আমি যাই। নাহলে ভাববে চুকলি কাটতেছি।

ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নম্রতা। চিলেকোঠার কাছে এসে পুরোনো কাচের বই রাখার আলমারিটা চোখে পড়ে। এটা আগে তার ঘরেই ছিল। এখানেই হয়তো ছড়িয়ে আছে পুরোনো যাপনের কোনও চিহ্ন। ওই তো সেই ফটো স্ট্যান্ডটা! ধুলোয় ধূসরিত। ওর মধ্যেই অযত্নে অস্পষ্ট হয়ে গেছে ছোট্ট রাই আর দীপকের ছবি! ধীরে ধীরে ছবিটা বের করে নেয়। পুরো নষ্ট হয়নি এখনও। সেই লাল কভার ফাইলটা না? তাতে কোচবিহার থেকে নম্রতার লেখা প্রথম আর শেষ বোকা বোকা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি। ফাইলটা হাতে নিতেই আঠেরো বছর আগের সব স্মৃতি হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।

সেদিন দীপকের বন্ধুর বিয়ে ছিল। দীপক অবশ্য কোথাও তেমন যেত না। কথা ছিল নম্রতা সন্ধের আগেই রাইকে নিয়ে যাবে। হরিদার রিকশা বলে রেখেছিল। খুব একটা বেরোনোর ভাগ্য ছিল না বলেই ছোটো ছোটো জিনিসে সুখ খুঁজে নিত। দীপক অফিসে বেরিয়ে গেছে। আলমারি থেকে লাল সিল্কটা বের করে আয়রন করতে গিয়ে দেখে দীপকের কভার ফাইলটা ছিটিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে নম্রতা। এমনিতে দীপকের সব জিনিস কখনওই ঘাঁটার অভ্যাস তার ছিল না।

বিকেলে সব কাজ এগিয়ে তৈরি হতে গিয়ে দেখে আলমারি থেকে সব বের করে স্তূপ হয়ে আছে। নম্রতার ভালো শাড়িগুলো সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া। দীপকের চোখগুলো টকটকে লাল আর ফর্সা গালগুলো লাল হয়ে আছে। নিজেকে সংযত রেখে কি ঘটেছে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে শুরু হয়ে গেল এলোপাতাড়ি কিল, চড়, লাথি। এক ধাক্কায় আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংটায়।

অভ্যাসবশত চেষ্টা করেছিল শান্ত ভাবে অপরাধ জানতে আর পাঁচ কান না করে চার দেয়ালে মিটিয়ে নিতে! কিন্তু সেই সময় পাশবিকবলে বলীয়ান হয়ে দীপক এমন ধাক্কা দিল যে, সে আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংয়ে ওপর! তারপর কতক্ষণ যে পড়েছিল নম্রতা সিঁড়ির নীচে আজ আর মনে করতে পারে না।

হাতটা ফ্র‌্যাকচার হয়েছিল। ওই অবস্থায় মেয়েটাকে খাইয়ে হাতব্যাগে বাবার দেওয়া গয়নাগুলো, ৫০০ টাকা আর রাই-এর দু একটা জিনিস ভরে, ভোর হবার আগেই উঠে বসেছিল কোচবিহারের বাসে। তারপর তো জামাইবাবু সব সামলাল। পুলিশ কেসের ভয়ে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা হয়ে গেল।

এরাও ততদিনে ছেলের মানসিক সমস্যা দেখিয়ে গা বাঁচাল। তখনও দীপক দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। ফোনে, চিঠিতে মেরে ফেলার হুমকি দিত। সেই জন্যই দিদি পাঠিয়ে দিল উত্তরপাড়া। সেখানে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি, টিউশনি, আর একের পর এক লড়াই।

আজও ভাবে সেদিন ফাইল থেকে একটা কাগজ খাটের নীচে পড়ে যাওয়ার মাশুল তাকে কীভাবে যে দিতে হয়েছে? সেটা কতটা দরকারি ছিল সেটাই তো আর জানা হল না।

॥ ৪ ॥

ইতিমধ্যে অনেকেই হাজির। বিভাদেবী বালিশে হেলান দিয়ে বসে। ছোটো কাকিমণি বললেন, কত দিন পর দেখলাম নম্রতা! জেল্লা বেড়েছে তো? একদম কোনও খোঁজখবর নেই। বাবুন চলে যাবার পরও এলে না? এলেম আছে তোমার, বর ছেড়ে, কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিলে, ফিচার লেখালেখি! বলি এ বাড়ির ছেলেদের মেজাজ তো বরাবরই তিরিক্ষি। আমরা আর পারলাম কই?

—আপনারাও তো কাকিমা রাইয়ের বাবার খবর যতদিনে জানালেন তখন আসা না আসা এক। কী হয়েছিল সেটা স্পষ্ট করে বলেননি।

—কি আর জানাব বাছা! তুমি মাথা বিগড়িয়ে দিয়ে গেলে, ওষুধ ধরল। পরের বউ এসে কোথায় বুঝিয়ে ওষুধ খাওয়াবে তা না, আরও বাড়িয়ে দিল, শেষমেশ সেই ওষুধগুলো একবারে খেয়ে..

—ও সোনা কাঁদিস না মা!

—কী করব বলো কাকিমা! দাদাটা এত সৎ ছিল না! আমার মায়ের মতো। অন্যায় বরদাস্ত করত না। বউগুলো এমন জুটল…

নম্রতার হাসি পাচ্ছিল তবু সংযত হয়ে বলল, এতটাই সৎ যে না জানিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ ছেলের দুবার বিয়ে দিলে!

হঠাৎই বিভাদেবী বলে ওঠেন, বউমা তুমি রাই দিদিকে আনলে না? ক্যান্সার রোগীটা ফোন করেছিল তাও রাখলে না কথাটা।

—পরে আসবে। এখন ক্যাম্পাসিং।

—আর পরে কি আমি থাকব?

—এই বালাটা রাখো। রাইদিদুর বিয়েতে দিও। আর এই শিবলিঙ্গটা রাখো মা। সে মেয়েকে আমি বলতে পারব না আর সোনা তো এসব পারবে না… তাই তুমি এর দায়িত্ব নাও। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রতা।

দেবেশ ইতিমধ্যে দলিল আর জমি-বাড়ির ম্যাপ নিয়ে হাজির। উকিলি কেতায় বলে চলে,

—বউদি পুরো বাড়ি আর ফাঁকা জায়গা নিয়ে ৫ কাঠা ৩ ছটাক। শ্বশুরমশাই নগেন দত্তের নামে বাড়ি। ওয়ারিশ হচ্ছে, বিভা দত্ত, সোনালি রায়, রুম্পা দত্ত, ছেলে রাতুল দত্ত, আর আপনার মেয়ে রাই দত্ত। আপনি তো ডিভোর্সি। এবার আমি রুম্পা বউদিকে বুঝিয়েছি সরকারি রেটে আমাকে বিক্রি করতে, রাজি হচ্ছেন না। আমি অবশ্য এমন কেস ঠুকে দিয়েছি ও কাউকে বেচতেও পারবে না। এবার থাকে আপনার মেয়ে। আমরা ভদ্র ফ্যামিলি। রাইকে বঞ্চিত করব না। আপনি দানপত্রে কোনও দাবি নেই বলে সই করে দিন। রাই-এর বিয়েতে আমরা থোক অ্যামাউন্ট কিছু দেব। এখন হাতটা খালি!

মাঝখান থেকে সোনা বলে, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমাদের ফ্যামিলিতে এসেছিলে!

আপন মনেই হেসে ওঠে নম্রতা। দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এখন ডিভোর্সি মহিলারও প্রপার্টিতে লিগ্যালি অনেক দাবি আছে। আপনি বোধহয় আপ টু ডেট নন।

—মানে আপনি সহজে মেটাবেন না তাই তো? অত দুর থেকে সব পারবেন?

—থামুন! আমার কথা শেষ হয়নি। বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, রাই এখন বড়ো হয়েছে। কিছু না কিছু করবেই। ওর বিয়ে নিয়ে আমার কোনও তাড়া নেই। আপনি বালাটা রাখুন। আর শিবঠাকুর আমায় দিচ্ছেন? ভরসা পাচ্ছেন? একদিন তো ঠাকুরঘরে ঢুকতে দিতেন না। যাইহোক ওটা দিতে চাইলে আমি নেব। এই চেকটা রাখুন সই করা। আপনার ছেলের একটা মাত্র পিএলআই-এর নমিনি ছিলাম আমি। বাদ বাকি তো আপনি আর সোনা। যখন সব বন্ধন ছেড়ে গেছি তখন এটার জন্য ঋণী থাকতে চাই না, আপনার কাছে রাখুন। ৫০ হাজার আছে।

সবাই একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে নম্রতা বলে চলে, আশা করি বুঝেছেন সম্পত্তির প্রতি আমার আর রাই-এর কোনও আগ্রহ নেই। সম্পর্ক যখন ছিঁড়ে গেছে প্রপার্টি দিয়ে কি হবে? এ বাড়িতে চারবছরে একটাই সম্পদ পেয়েছি সেটা আমার রাই। যা যা সই সাবুদ একটু গিয়ে করিয়ে আনবেন আবার কবে আসব জানি না, ভালো থাকবেন।

অনেকদিন ধরেই ওই চেকটা গলার কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। আজ ফেরত দিতে পেরে নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। ভেবেছে রাইয়ের কথা। তার অধিকারের কথা। কিন্তু না, সে রাইকে যোগ্য করে গড়তে পেরেছে। সে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যা পড়ে রইল তা তো আর্থিক লাভ আর ক্ষতি। পুরো জীবনটাই যার ক্ষতির খাতে চলে গেল এ টাকাগুলো তার আর কী সৌভাগ্য আনবে।

সোজা অসম মোড়ে না গিয়ে একটু ঘুর পথেই গৌড়িয় মঠের সামনে আসে নম্রতা। এখন সুন্দর ব্রিজ হয়েছে। শহরের মাঝ বরাবর তির তির করে বয়ে যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ করলা নদী। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে দীপককে লেখা নিজের চিঠিটা বের করে। তারপর টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় করলার জলে। ভেসে যাক সব অতীত, গ্লানি। আজ নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনকেমন করা মুহূর্তে আসত সে।

এই শহরটা বড়ো মায়াবি। না তার জন্মভূমি নয়। স্বামীর ভিটের অনুভূতি নেই তার। তবে বড়ো আপন। অনেক মন কেমন করা মুহূর্তে এই জলশহরের রাস্তা, নদী, গাছ, মন্দির তাকে বলেছে তুমি কেঁদো না আমরা আছি! এগিয়ে যাও। বাঁচো। হেরো না। আজ শহরটা আরও ঝকঝকে হয়েছে। কিন্তু আনাচে কানাচে জুড়ে সেই আন্তরিকতার ছাপ আজও আছে! ভালো থেকো জলশহর! জানি না আবার আসব কিনা! কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না। এই তোমরা আমার কেউ না হয়ে যে অনেক কিছু!

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব