জীবন-নদী

অদিতি এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অদিতি এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে তাও অকল্পনীয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এত রূপ রস, সব আমার জন্য!

‘আমি তোমার সাথে দেখা করব।’ অচেনা স্বর, কিন্তু আওয়াজে বোঝা যায় কিশোরী কণ্ঠ। দ্বিধাহীন ভাবে ‘তুমি’ সম্বোধনে সে কথা বলল।

‘কে কথা বলছ?’

‘নয়না।’

ভেবে পেলাম না এমন নামে আমি কাউকে চিনি কি না। গম্ভীর হয়ে তাই জবাব দিলাম, ‘আমার কোনও আগ্রহ নেই তোমার সাথে দেখা করায়।’ ওধার থেকে ধীরে জবাব এল, ‘আপনি আমায় মানে নয়নাকে চেনেন না কিন্তু আমার মাকে চেনেন।’ মেয়েটা হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’তে উঠে এল। বোধহয় আমার বলাটা একটু বেশিই রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা একটা উটকো ফোন। চা খাওয়া হয়নি এখনও। বাসি মুখেই এমন ঝামেলা। দিনটা কেমন যাবে কে জানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না,’ বলেই রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও দিশা খুঁজে পেলাম না। কার মেয়ে! আমার কাছে কী চায়? ‘মেয়ে’ শব্দটাই আমার কাছে অতীত মাত্র। সেই স্মৃতি– যা আমায় রুক্ষ, একা করে দিয়েছে। জীবনবোধে বিতৃষ্ণা এলেও জীবনকে ছাড়তে পারিনি। মেয়েটা কে? অদিতির চলে যাওয়া, আমার মাথার উপর ছাদ উড়ে যাওয়ার সমান। আমি ফিরে গেলাম চল্লিশ বছর আগের স্মৃতির পাতায়।

মফসসলের ছেলে আমি। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় বাবা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়, কাকার বাড়ি। ভর্তি হলাম আশুতোষ কলেজে। কাকার বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটা পথ। একদিন এমনই একা একা হেঁটে ফিরছি রবীন্দ্রসরোবর লেকের ভিতর দিয়ে হঠাৎ কেউ ডাকল ‘হাই অলোক।’ তাকিয়ে দেখি আমাদেরই সাইকোলজি ক্লাসের একটি মেয়ে। অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। বেশ ভালো লাগল কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে? ওই বয়েসে বেশ গর্ব-ও হল ক্লাসমেট আমার নাম জানে বলে। আমি হেসে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার নাম অলক, অলোক নয়।’ ও পরিচয় দিল, ‘আমি অদিতি। তুমি কোথায় থাকো? আমি কি তোমার সাথে একটু হাঁটতে পারি? আমার বাড়ি কাঁকুলিয়া রোড। বাড়িতে…।’ বেশ অনেকক্ষণ একা একাই বকবক করে গেল। হঠাৎ কী মনে হতে নিজেই চুপ করে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই কথার জবাব দিলে না তো?’ আমি ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম– ‘সময় দিলে কোথায় কথা বলার?’ এইভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব। অদিতি কবে যে আমার কাছে ‘দিতি’ হয়ে গেল তা নিজেই জানি না। এই আমার দিতি। অদিতি।

সামাজিকতার ধার আমি কোনওদিন ধারিনি। নিজের ইচ্ছেতেই চলেছি।

আমি এই বয়েসে নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ আনন্দে আছি। জীবনে তেমন উচ্চাশা নেই, কেউকেটা হতেও চাইনি। তাই কলেজ জীবনে যখন, কলেজের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী, মেধাবী মেয়েটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল, আমার সহপাঠীরা বেশ ঈর্ষান্বিতই হয়েছিল। আমার কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। অদিতিও বেশ স্বাভাবিক। আমাদের মেলামেশা দিনের আলোর মতো সহজই ছিল কিন্তু অদিতি ধীরে ধীরে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে এল। আমি বারণ করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম ‘দিতি তোমার সমাজ আর আমার সমাজে অনেক তফাত। প্লিজ, তুমি এমন কোরো না, পরে কষ্ট পাবে।’ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। অদিতি আমার কোনও কথাই শুনল না। ও দুর্দম, আমিও ভেসে গেলাম ওর সাথে। জানতাম অদিতির জীবনে আমি প্রথম পুরুষ নয়, তবু নিজের মধ্যে একটু দোটানা থাকলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমরা স্বপ্নে ভেসে গেলাম– ছোট্ট সংসার, টলোমলো পা।

সত্যি আমরা ভেসে গেলাম। যেদিন দিতি জানাল তার শরীরের নতুন অনুভবের, সেদিন আমি আনন্দের পরিবর্তে বেশ ভীত হয়ে উঠলাম। মুখে হাসলেও দিতি ঠিক বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। দুজনের বাড়িতে কে কী বলবে? কীভাবে সামলাব? আমার শুকনো মুখ দেখে অদিতি কি বুঝল, কে জানে! বারবার একই কথা জোরের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করতে থাকল, ‘আমাদের ভালোবাসার ফসল, নতুন মানুষ আসবেই। আমাদের উত্তাপ ওর মধ্যেই। আমি পারবই।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। খটকা লাগল ওর কথায় ‘আমি পারবই,’ তবে কী ‘আমরা’ নয়? হঠাৎ অনুভব করলাম আমি ঘেমে উঠেছি। এমনই হয়েছিল যেদিন প্রথম অদিতিকে আমি চুমু খেয়েছিলাম, ফাঁকা কলেজ করিডোর-এ। ভুল বললাম, আমি নয়, ও এগিয়ে এসে সপাটে জাপটে ধরে…। আমি ছটফট করে ওকে ঠেলে দিতেই ওর বাঁধভাঙা হাসি। ভয়, ভালোলাগা মিলেমিশে… এমনটাই হয়। হয়তো বা সকলের জীবন-সন্ধিক্ষণে। সেই শুরু। এতদিন পরে অদিতির সন্তানসম্ভাবনার কথা শুনে আবার তেমন ভয় আমায় চেপে ধরল।

সময় এগিয়ে চলে। অদিতির আড়ষ্টতাহীন চলাফেরা আমায় আবার স্বাভাবিক করে তুলল। আমি প্রায় ভুলেই গেলাম ওর শরীরের নতুন অঙ্কুরোগদ্মের কথা। আমি মেতে উঠলাম ওকে নিয়ে। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, হইচই করা, ঘুরে বেড়ানো সব আগের মতোই। ধীরে ধীরে আমি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। দুজনের আনন্দের জীবনে শুধু নিস্তরঙ্গ জোয়ারের খেলা। অদিতি কিছু বুঝতে দেয়নি।

জোয়ারের পর ভাটা অনিবার্য। তা এল, কিন্তু এমনভাবে যা আমার কল্পনার অতীত। দিতি একদিন এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘আজ আমার লাঞ্চ আছে, স্পেশাল ব্যাপার।’ আমি শান্ত চোখ তুলে তাকালাম। কোনও প্রশ্ন নেই মুখে। শুধুই তাকিয়ে থাকলাম। ও আশা করেছিল আমি কিছু জিজ্ঞাসা করব। দিতিই নীরবতা ভাঙল, ‘আমার পুরোনো প্রেমিক। লন্ডন থেকে এসেই যোগাযোগ করেছে। সোহম সেন।’ আমি জানতাম, অদিতি বলেছিল, দুম করে সোহমের লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ চান্স পেয়ে যাওয়ার কথা। অদিতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে ওর মতন হুল্লোড়বাজ মেয়ের সব কিছু ভুলে যেতে সময় লাগেনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় অদিতি খুবই ক্যাজুয়াল। জামাকাপড় বদলানোর মতো বয়ফ্রেন্ড বদল করে। ভাবতেও ভালো লাগে না এভাবে। আসলে ও তো ধনী পরিবারের দুলালি। আমারও কখনও কখনও সংশয় হয়। সত্যি ভালোবাসে তো মেয়েটা আমায়! আচ্ছা ও কি সত্যিই প্রেগন্যান্ট! তাই ওর সাথে দেখা করা। আমার মনের মধ্যে যাই-ই হোক, আমি ‘না’ বলতে পারিনি ওর মুখ দেখে।

সেদিন দিতি কলেজে এলেও ক্লাস করল না, তারপর দিনও এল না। পরপর চারদিন এল না। ওর ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। যেখানে যেখানে খোঁজ নেওয়া যায় নিলাম, কিন্তু কোথাও দিতির খোঁজ পেলাম না। হতাশা কেমন যেন আমায় গ্রাস করে নিল। আমি কলেজে আসতাম, শুধু আমার শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে। মনটা সারাক্ষণ অদিতি-অদিতি করে ওকেই খুঁজে চলত।

গাছতলায় মাথা হেঁট করে বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছি, মাটি খুঁটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম সামনে একটা ছায়া। মুখ তুলে দেখি অদিতি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে, ঝলমল করছে ও। আমি বুঝলাম না, কারণটা কী? আমি রাগে-দুঃখে ওকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম ‘কী ব্যাপার তোমার? তুমি বোঝো না, তোমার সাথে একদিন দেখা না হলে আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই। কোথায় ছিলে? এত দায়িত্বজ্ঞানের অভাব কেন?’ অন্য সময় আমি চিৎকার করলেই দিতিও সমানতালে ঝগড়া করত। সব সময় আমিই পরাজিত হতাম এবং হেসে সারেন্ডার করতাম। আজ এ কোন দিতি, আমার সামনে? আমি চিৎকার করছি, ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকল। আমি হতভম্ব। দিতি চুপ করেই থাকল, তারপর যেন বহু কষ্টে নীরবতা ভেঙে অস্ফূটে বলল, ‘সরি অলক, এই ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। আমার মতামত নিয়ে, সোহমের সাথে।’ অর্থাৎ অদিতির প্রাক্তন প্রেমিক, লন্ডন ফেরত, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় পূর্ণ সেই সোহম সেনই দিতির মনোনীত পাত্র। দিতির কথা শুনে আমি প্রায় হিংস্র বাঘের মতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি হিস হিস করে বলে উঠলাম, ‘অসম্ভব, আমার দিতি অন্যের হতে পারে না। আমি তোমার বাড়িতে যাব, মা-বাবার সাথে কথা বলব, তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে…।’

‘চুপ অলক’, আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দিতির শানিত স্বর আমায় থামিয়ে দিল। ‘কত উপার্জন তোমার? তোমার স্ট্যাটাস কী? কী খাওয়াবে? সবার আগে বলো, আজ বিয়ে করলে কোথায় রাখবে আমায়?’ আমি ঝড়ে ধাক্বা খাওয়া পাখির মতন যেন কিছুটা টাল খেয়ে গেলাম ওর কথায়, একটু সামলে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। সত্যিই তো, অদিতির কথাগুলো বাস্তব-যুক্তিপূর্ণ। আমার কী আছে?

অদিতি সত্যিই চলে গেল আমায় ছেড়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, করার ছিল। কিন্তু আমি পারলাম না। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম শামুকের মতন। দিতির শেষ কথাগুলো ‘তোমার স্ট্যাটাস কী? কোথায় রাখবে?…’ আমায় যেন এক নতুন আমি-তে রূপান্তরিত করল। আমি নিজেকে নিয়ে একটা ব্যূহ রচনা করে ফেললাম। নিজেরই অজান্তে। দিতি-সোহম, চলে গেল গোয়ায়। ও বিয়েতে নিমন্ত্রণও করে গিয়েছিল। কলেজ সহপাঠীরা জোরজবরদস্তি করে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব কিছু জানত, তবুও। পরে শুনেছি অদিতি ওদের বারবার বলেছিল আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের বাড়ি গিয়েও আমি অদিতির সামনে দাঁড়াতে চাইনি। ঢুকেই কোল্ড-ড্রিংকস নিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। অদিতি খুঁজে পেতে ঠিক আমার সামনে হাজির। অদিতি– না স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরি! আমার চোখের পলক পড়ে না। আমি মূর্তির মতো নিথর। নিজের না পাওয়া আকাঙ্খাগুলো, ক্ষোভ-যন্ত্রণা আবার যেন সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। অদিতি আমার। কেন অন্যের বিছানায় ও শোবে! কেন? কেন? একটা কথাও অদিতিকে বলতে পারলাম না। অথবা ওই অবস্থাতেও সে আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘অলক আমি তোমারই থাকব।’

মেয়েদের প্রতি আমার এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা সেই থেকে। আমি নিজের লেখাপড়ার মধ্যেই পুরোপুরি ডুবে গেলাম। নিজের শরীর, খাওয়াদাওয়া, কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। বাবা-মা এসেছিলেন, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি নারাজ। এভাবে মাস গড়াল, ফুরোল বছর।

স্মৃতির জালে যেন খাবি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেল শুনে আমার চমক ভাঙল। আমি স্খলিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। আবার বেল, ভাবার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে? মাথা কাজ করল না। প্রায় অবশ হাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এ কে! প্রায় কুড়ি বছর আগের দিতি এতটুকুও বদলায়নি! এ কী করে সম্ভব! আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েই রইলাম। দিতি না, দিতির প্রতিচ্ছবি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমারই ঘরে বিনা অনুমতিতে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। বিছানায় ছড়ানো আমার পুজো সংখ্যার উপন্যাসের খসড়া। দিতি নয়, নয়না মেয়েটি আমার কোনও পরোয়া না করেই ঘরের মধ্যে এটা ওটা ঘুরে দেখতে শুরু করল। বইয়ের তাক, টেবিলে ছড়ানো বই, ঢাকনা না লাগানো পেন, পেনসিল, ফাইল-ক্লিপ সব এলোমেলো। ও শুধু দেখেই গেল। যেমন দিতিকে আমি কখনও বারণ করতে পারতাম না, নয়নাকেও আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখজোড়া ওকে অনুসরণ করে গেল। একসময় ও থামল, আবার চেয়ারে এসে বসল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন এসেছ?’ নয়না তক্ষুণি কোনও প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আপনি আর মা মেড ফর ইচ আদার ছিলেন। সমাজ, পরিবার আপনাদের এক হতে দেয়নি। আমার মা পারেনি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে। তাই আপনাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়ে সে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যে-বীজ বপন হয়েছিল তার শরীরে, তাকে সে বিনষ্ট হতে দেয়নি। ডালপালা মেলে তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছে। সোহম সেন সামাজিক দায়িত্ববোধে অবশ্যই আমার বাবা। কিন্তু আমার মা, মানে আপনার অদিতি, দিতি আমায় সব বলেছে অকপটে। আমার স্কুল-গণ্ডি পার হয়ে যাবার পরেই। আমি দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম, কবে আপনার সাথে দেখা হবে।’

আমি স্থবির, নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম। একি শুনছি। দিতি এখানেও তুমি আমায় হারিয়ে দিলে! তোমার প্রতি আমার যে ধারণা তা চুরচুর করে ভেঙে তুমি সোহমের সঙ্গে চলে গিয়েছিলে। সেটা যে তোমার অভিনয় ছিল তা বিন্দুমাত্র আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমানিত হতে দাওনি, দিতি। মেয়েদের প্রতি আমার যত বিষ সব আমি উগরে দিয়েছি, ঘৃণা, জ্বালা সব মিলিয়ে মেয়েরা যে বিশ্বাসঘাতকতার নজির তৈরি করেছিল আমার জীবনে, তা একমুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আজ নয়না আমায় সম্পূর্ণরূপে এলোমেলো করে দিল। দিতি আমায় তুমি ক্ষমা করো। নিজেকে অবহেলা অযত্নে শেষ করে দিয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর নেশা ধরলাম। কিছুদিন বাদে বুঝলাম আমি নেশা না করতে চাইলেও মদ আমার পিছু ছাড়ে না। আমার শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এই মধ্যচল্লিশে আমায় দেখতে লাগে ষাট বছরের বুড়োর মতো। আজ আমার সামনে আমার আত্মজ– নয়না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

মা জানত, বাড়িতে জানাজানি হলে দাদু আপনাকে খুন করিয়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। আপনিও জানেন আমার মামার বাড়ির অর্থনৈতিক ক্ষমতা-প্রতিপত্তির কথা। তাই মা নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল। মায়ের জেদ ছিল আমায় পৃথিবীতে আনার। সোহম সেনের প্রতি তার কর্তব্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু এতগুলো বছর মা অপেক্ষায় ছিল, আপনাকে দেখানোর জন্য মা ও আপনার ভালোবাসায় ফাঁকি ছিল না।’

এ কোনও স্বপ্ন নয়, বড়ো নির্দয় কঠিন বাস্তব, নয়না, নয়নমণি।

 

মুনিয়া

ঘটনার সূত্রপাত মাস দশেক আগে। সেদিন বৈশাখ মাসের সতেরো তারিখ। দিনটা এখনও মনে আছে পালকের। বোধহয় সারাজীবন-ই মনে থেকে যাবে। মারাত্মক গরম পড়েছিল সেদিন। এর আগে এপ্রিল মাসে এত গরম পালক দেখেনি কখনও। সেদিন-ই সে মোক্ষম জবাব দিয়েছিল কেয়াকে।

প্রায় বছর দুয়ে হল এই ফ্ল্যাটে এসেছে পালক। কেয়া অবশ্য তার-ও আগে থেকেই এখানে থাকে। এই ফ্ল্যাটটার পজিশন সবচাইতে ভালো বলে দামটাও তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি-ই ছিল। দামে-দরে ঠিকঠাক পোষাচ্ছিল না বলে প্রোমোটার ফ্ল্যাটটা নিজের হাতেই রেখেছিল। নীচের তলায় ডানপাশে ফ্ল্যাট। পালকের ফ্ল্যাটটা পছন্দ হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তার ফ্ল্যাটের সামনে পুর্বমুখী এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। এই অঞ্চলে এরকম ফ্ল্যাট আর একটাও তার চোখে পড়েনি। তাই এক দেখাতেই পালকের পছন্দ হয়ে যায় ফ্ল্যাটটা।

পালকের হাজব্যান্ড সায়ন্তন ভোলাভালা গোবেচারা টাইপের মানুষ। বউ-এর পছন্দের ওপর ভরসা রেখে চলা পুরুষদের মধ্যে একজন। তাই ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে কোনও দ্বিমত বা দ্বিরুক্তি করার মতো কেউ না থাকায়, পালক ফ্ল্যাটটা খুব সহজেই কিনে নিতে পেরেছিল। যদিও ওদের একমাত্র সন্তান জুলির স্কুলটা এই ফ্ল্যাট থেকে একটু বেশি দূর হয়ে গেল। তা হোক সামনের এত সুন্দর জায়গাটাতে বেশ কয়েকটা টব বসানো যাবে।

ফুলে ফলে ভরে যাবে তার ঘরের সামনের জমি। একি কম আনন্দের কথা! আর তাছাড়া পালক তো হাউস ওয়াইফ। জুলিকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া সে-ই তো করে। বাড়ি থেকে একটু আগে বেরোতে হবে এই যা। দামটা একটু বেশি দিতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পছন্দসই জিনিসের জন্য দাম নিয়ে ভাবলে চলে না। তাই মানে মানে নিয়ে ফেলেছিল ফ্ল্যাটটা।

পালকের পাশের ফ্ল্যাটে প্রায় পালকের-ই বয়সের আর একটি বউ থাকে। সে-ই হল কেয়া। প্রথম থেকেই পালক কেয়াদের এড়িয়ে চলে। যদিও কেয়া ভীষণই মিশুকে এবং হেল্পফুল। এই তো ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপর-ই পালকদের পুরোনো ওয়াটার পিউরিফায়ারটা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। সেই সময় কেয়াই ওদের ঘর থেকে ফিলটার্ড জল বোতলে করে দিয়ে সমস্যা মিটিয়েছিল। তারপর যখন ফ্ল্যাটে কাজ চলছিল তখন মইটা দাও তো, এটা দাও তো সেটা দাও তো এসব তো লেগেই ছিল। কেয়া কিন্তু সবকিছুই হাসিমুখে করেছে। কখনও মনে হয়নি যে, সে বিরক্ত।

তবুও পালক ওদের এড়িয়ে চলত। কারণ, নিঃসন্তান কেয়ার ঘরে ওর পোষ্য মুনিয়া থাকত। মুনিয়া ফটফটে সাদা রঙের একটা বজ্জাত বেড়াল। কেয়াদের ঘরের দরজা খোলা পেলেই সে বেরিয়ে আসে। আর ঢুকবি তো ঢোক ঢুকে পড়ে পালকদের ঘরে। পালকের জাস্ট গা ঘিনঘিন করে বেড়াল দেখে। কুকুর ওর যদি-বা একটু সহ্য হয়, বিড়াল জাতটাকে সে মোটেই সহ্য করতে পারে না।

ফ্ল্যাট কেনার আগে পালক দুবার এসেছিল ফ্ল্যাটটা দেখতে। কিন্তু সেই সময় কেয়ার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় ওরা সপরিবারে মেদিনীপুর ছিল। ফ্ল্যাট কেনার আগের :  পর্যন্ত পালক জানতেই পারেনি যে, তার পাশের ফ্ল্যাটেই অমন একটা ইরিটেটিং অ্যানিম্যাল থাকবে আর যখন তখন তার ঘরে ঢুকে দুধ, মাছে মুখ লাগাবে।

এর আগে কেয়াকে বেশ কয়েকবার বলেওছে পালক, তোমার মুনিয়াকে গলায় চেন দিয়ে বেঁধে রাখো কেয়া। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না জাস্ট।

কিন্তু কেয়া একই কথা বলেছে প্রত্যেকবারেই, পালক, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড প্লিজ। ওরা জাতে বিড়াল হলেও আসলে মানুষের-ই মতো। তোমার গলায় যদি সারাক্ষণ দড়ি বেঁধে রাখা হয়, ভালো লাগবে তোমার?

কী কথার কী উত্তর! একটা বিড়ালের সঙ্গে মানুষের তুলনা! জাস্ট ডিসগাস্টিং। সেই বাদানুবাদের ঠিক দশ দিনের মাথায় দুই কেজি মাছ সবে ধুয়ে রেখেছে পালক। সায়ন্তন রোজ বাজারে যেতে পারে না বলে যেদিন-ই মাছ আনে বেশি করেই আনে। যেন দু-তিনদিন ফ্রিজে রেখে চালিয়ে নেওয়া যায়।

পালক ফ্রিজের পাশে মাছের গামলা রেখে কিচেনে ঢুকেছে, তিনটে বাটিতে তিন দিনের জন্য মাছ আলাদা আলাদা করে ফ্রিজে ঢোকাবে বলে। সে সময় কেন জানি না জুলি কি একটা কারণে দরজাটা খুলে রেখেছিল। ঠিক সেই সময় কেয়াদের বিড়াল মুনিয়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পালকের রান্নাঘরে ঢুকেই বসে পড়ল মাছ খেতে। যেন মাছগুলো ওর জন্যেই গামলায় যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে পালক। ব্যস। পালক দেখেই জোরে চিত্কার করে উঠল। পুরো দু-কেজি মাছ ফেলে দিতে হয় সেই দিন।

জুলির পছন্দের পাবদা আর ভেটকি মাছ ফেলে দিতে পালকের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বারো-তেরোশো টাকার মাছ জুলিকে না খাইয়ে নিজেরা না খেয়ে এভাবে ফেলে দিতে মন চায় কারও! সায়ন্তন তবু মিনমিন করে বলেছিল বটে, যেদিক থেকে মুনিয়া খেয়েছে সেদিক থেকে ফেলে দিয়ে বাদবাকিটা নেওয়া যায় না পালক! কিন্তু না। বিড়ালের মুখের জিনিস খেয়ে অন্য কোনও বড়ো অসুখ বাধাবে! পালক কি পাগল হয়েছে নাকি!

তারপর থেকেই ভেতরে ভেতরে ফুটছে পালক। মুনিয়ার একটা চরম এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কীভাবে করবে তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপরেই তনয়াকে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ জরুরি আলোচনা সেরে নেয় সে।

তনয়া হচ্ছে পালকের সেই ছোটোবেলার স্কুল ফ্রেন্ড। মনের গঠনগত দিক থেকে দুজনেই প্রায় একই রকম। দুজনেই ভীষণ ভাবে ঘেন্না করে এই বিড়াল জাতটাকে। দুজনেই ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। দুজনের-ই প্রিয় রং ম্যাজেন্টা। দুজনেই বাগান করতে ভালোবাসে। এরকম আরও কত কী! তনয়ার মাথা থেকেই আইডিয়াটা বের হয়। ব্যস। তারপর আর কি! দেখেশুনে একটা দিন ঠিক করল পালক।

পরের সপ্তাহে মঙ্গলবার সায়ন্তন অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে জিনিসটা কিনে নিয়ে ফিরল পালক। তারপর একটা বাটিতে মাছ আর একটা বাটিতে দুধ রেখে তার মধ্যে বিষটা বেশ যত্ন করে মাখিয়ে দিল সে। শত হলেও শেষ খাওয়া খাবে মুনিয়া। একটু ভালো করে দেওয়াই ভালো। এরপর সে গ্রিলটা টেনে দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে ফ্রিজের পাশে বাটি দুটো সাজিয়ে রেখে আরাম করে স্নান করতে লাগল।

ওয়াশরুমের দরজা ফাঁক করে একবার দেখে নিল পালক। হ্যাঁ। প্ল্যান মতোই সবকিছু এগোচ্ছে। মুনিয়া আরাম করে দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পর পালক বেরিয়ে দেখল দুটো বাটিই সাফ করে মুনিয়া পালিয়ে গেছে। যাক বাবা! এতদিন পর একটা কাজের কাজ করেছে পালক। এরকম একটা কিছুর ভীষণ-ই দরকার ছিল। সবকিছুর-ই একটা সীমা থাকা উচিত। একেই তো বিড়ালের পশমকে দারুণ ভয় পায় পালক, তার ওপর আবার যখন তখন ঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দিয়ে দেওয়া। উফ! অসহ্য!

দুপুর পর্যন্ত মুনিয়ার আর কোনও সাড়াশব্দ পায়নি পালক। একবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেরকম কিছুই বুঝতে পারেনি সে। জুলিকে আনতে যেতে হবে। হাতে এই মুহূর্তে প্রচুর কাজ পালকের। রান্না করতে করতে একরকম ভুলেই গেছিল মুনিয়ার কথা, ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা সশব্দে বেজে উঠল। কে এল! কেয়া নাকি! ও কিছু সন্দেহ করছে না তো!

দু-বার ঢোঁক গিলে পালক দরজা খুলল। সাথে সাথেই কেয়া চিত্কার করে বলল, কী করে এরকম একটা নোংরা কাজ করতে পারলে পালক! আমার মুনিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল। এই অবস্থায় নিজে একজন মা হয়ে আরেকটা মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে একটুও হাত কাঁপল না তোমার! ছিঃ।

—বিষ! এসব তুমি কী বলছ কেয়া! না বোঝার ভান করল পালক।

—ন্যাকামো না করে তোমার বাগানে গিয়ে দেখে আসো মুনিয়ার কী অবস্থা!

বাগানের নাম শুনেই এক লাফে সিঁড়ির প্যাসেজ পার হয়ে মেন গেটের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল পালক। বেরিয়ে ডান হাতে তার বাগান। বাগানের বেশিরভাগ-ই সব ছোটো ছোটো টব। তাতে কোনটা তুলসী, কোনটাতে ধনেপাতা, আবার কোনওটাতে গোলাপ। একটাই শুধু বড়ো গামলার মতো টব। গামলায় একটা বনসাই আম গাছ। গাছটা বেশ সুন্দর ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গরমে মাঝে মাঝেই মুনিয়া আম গাছটার তলায় এসে বসে থাকে। এখনও যেমন শুয়ে আছে। তবে এই শোয়ার সঙ্গে আগের শোয়ার বেশ পার্থক্য রয়েছে, সেটা ভালো মতোই বুঝতে পারল পালক। মুখে সেসব কিছুই প্রকাশ না করে পালক বলল, ও মা! মুনিয়া এভাবে শুয়ে আছে কেন!

—এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে চাই পালক। মুনিয়া একটা ছোট্ট প্রাণী তার ওপর সে মা হতে চলেছিল। তাকে এভাবে খুন করলে কেন পালক?

তার মধ্যেই পালক দেখে নিয়েছে মুনিয়ার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে জিভ বের করে সে ঠিক আমগাছের গোড়ায় পড়ে রয়েছে।

—উফ! দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এখানে এসেই মরতে হল! মরেও শান্তি দেবে না দেখছি মুনিয়া!

মুনিয়াকে বুকের মধ্যে নিয়ে কেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই গর্ভবতী মাকে মারার শাস্তি ভগবান তোমায় দেবে না ভেবেছ! এর শাস্তি তুমি পাবেই পালক। আমার মুনিয়া এত বড়ো অন্যায় কিছুতেই সহ্য করবে না। তুমি মিলিয়ে নিও।

পালক এরকম অভিশাপ শুনে একটু থমকে গেছিল প্রথমে। কেয়ার কান্না দেখেও বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে পালকের। কেয়া মুনিয়াকেই যে তার নিজের সন্তান ভাবত তা সে মরমে মরমে বুঝতে পারছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পালক দেখল আম গাছটাও গর্ভবতী। ডালে ডালে মুকুল এসেছে। কদিন বাদেই ফল ধরবে। কিন্তু না। ফল ধরার আগেই বিনা নোটিশে গাছটা মরে গেল। কিছুদিন ধরেই গাছের গোড়ায় জল দিলেও জল শুষে নিচ্ছিল না আমগাছটা। তার দিন কয়েক পরে মুকুলগুলোও হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

পালকের মনে কু ডাকতে লাগল। তাহলে মুনিয়ার আত্মা-ই কি গাছটাকে মেরে ফেলল! ভগবান কি এভাবেই শাস্তি দিল পালককে! এরপর আম গাছের জায়গায় খুব ভালো জাতের একটা বনসাই বাতাবি লেবুর গাছ লাগাল পালক। রোজ পালকের হাতের পরিচর‌্যা পেয়ে গাছটা বাড়তে লাগল দ্রুত। কিছুদিন পরে ফুল ধরল তাতে। ততদিনে পালকও বুঝতে পেরে গেছে ওসব আত্মা-টাত্মা পুরো ফালতু ব্যাপার।

তনয়াও এই ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে পালককে। নিজের হাতে লাগানো গাছের বাতাবি লেবু জুলি খাবে। এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে পালকের। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না। বরং ঘটল ঠিক তার উলটোটা। ফুল আসার কদিন পর থেকেই গাছটা শুকোতে আরম্ভ করল। এবার সত্যি সত্যি ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম ভয় পেতে শুরু করেছে পালক।

আম গাছটা না হয় এমনিই মরে গেছিল। কিন্তু বাতাবি লেবুগাছ! সেটা কোন কারণে মারা গেল! গাছগুলোর যদি মরার-ই ইচ্ছে হয় তাহলে আগে বা পরে নয় কেন! ঠিক মুকুল এলেই গাছগুলো মরে যায় কেন! এবারে আর কোনও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিকেও মানতে নারাজ পালক। তনয়ার নানারকম যুক্তি শুনতে ইচ্ছে করে না তার। তার মনের মধ্যে ভয়, দুশ্চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আজ অনেক দিন যাবত ঘুমাতে পারছে না পালক। কখনও যদি বা একটু ঘুমিয়ে পড়ে তাহলেই স্বপ্নের মধ্যে মুনিয়াকে দেখতে পায় সে।

মুনিয়া যেন মিহি সুরে বলছে, আমার বাচ্চাদের মেরেছিস কেন পালক! আমাকেই বা মারলি কেন পালক!

যখন তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে পালক। দুই চোখের তলায় জমাটবাঁধা কালি। পেলব মসৃণ ত্বক জৌলুস হারিয়ে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর ভেঙে আধখানা হয়ে গেছে। সায়ন্তন কোনও কিছুই বুঝতে না পেরে পাড়ার নার্সারি থেকে আবার একটা বনসাই আম গাছ এনে ফাঁকা টবে লাগিয়ে দিয়েছে।

পালক আর কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সায়ন্তনকে না। জুলিকে না। কাউকে না। বহু রাত সে ঘুমোতে পারছে না ঠিকমতো। ঘুম এলেও একটু পরেই ভেঙে যায়। বারেবারে মুনিয়ার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কেয়ার দেওয়া অভিশাপ সবসময়-ই যেন শুনতে পায় সে। তবে কি পালক পাগল হয়ে যাচ্ছে!

সকালে উঠতেই সায়ন্তন পালকের হাতটা ধরে বলল, পালক, আমগাছে মুকুল এসেছে। এবার আর কিছুই হবে না। এবারে তোমার গাছে আম ধরবে দেখো!

মুকুল ধরেছে! আবার মুকুল ধরেছে! উফ! আবারও আসবে মুনিয়া। এই গাছটাকেও বাঁচতে দেবে না ও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না মুনিয়া।

পাশের কোনও একটা ফ্ল্যাট থেকে রাত দুটোর ঘন্টা বাজল। ঘুম আসছে না পালকের। এভাবে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বরং ওয়াশরুমে গিয়ে একটু মুখে জল দিয়ে আসি। ভাবতে ভাবতেই খুব আস্তে করে শোবার ঘরের দরজা খুলল পালক। নাহ! জুলিদের ঘুম ভাঙেনি। ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে বারান্দার দিকে চোখ পড়ে গেল হঠাত্। আমগাছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমগাছের পাশে ওটা কে দাঁড়িয়েছিল মনে হল! বসে পড়ল নাকি! আর দেখা যাচ্ছে না তো! পা টিপে টিপে বারান্দার কাছে এসে দেখল, কেকা একটা মগে একটা নুনের প্যাকেট থেকে নুন ঢেলে জলে গুলছে আর আম গাছের গোড়ায় ঢেলে দিচ্ছে।

ওহ মাই গড! গাছে মুকুল এলেই গাছগুলো তাহলে এভাবেই মরে যায়! হায় রে কেয়া! পালক প্রেগন্যান্ট মুনিয়াকে মেরেছে বলে তুমি আমার ফলবতী গাছগুলোকে এভাবে মেরে ফেলছ! মুনিয়ার মতো যে গাছগুলিও নিষ্পাপ গো কেয়া! আমি তো মহাপাপ করেছিলাম কেয়া। সেটা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। কত বড়ো ভুল আর অন্যায় যে সেদিন করেছিলাম এক গর্ভবতী মাকে খুন করে, সেটা ভেবে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। সেই একই ভুল তুমিও করলে কেয়া! ভুল দিয়ে ভুলকে কি উপড়ে ফেলা যায় কেয়া!

আজ বহু দিন পর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে পালকের। আজ থেকে আবার ঘুমোবে সে।

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল, কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডার্লিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ সবই বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না, ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়নও নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের মন অশান্ত হয়ে উঠল।

 

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল রোমার। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিয়েছ। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেয়েটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয়ে নৈঃশব্দ্যের সাগরে তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

ইঁদুরের গর্ত

আমি করব। মা বাবার কনসেন্ট জোগাড় করাটা আমার ব্যাপার।

র-এর চাকরির সাক্ষাৎকারে বলেছিল কস্তুরী, যদিও ব্যাপারটা ওর হাতে ছিল না, পারিবারিক বিষয় হয়ে গিয়েছিল। র-এর প্রাথমিক মনোনয়নপত্র বা অফার লেটার আসতেই বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কারণ ভিন দেশে গুপ্ত মিশনে মারা গেলে শরীরটা ভারত সরকার ফেরত নেওয়া তো দূর, নিজের নাগরিক হিসাবে স্বীকার নাও করতে পারে। এই জাতীয় শর্ত দেখার পর মা তো নাওয়া-খাওয়া ও সেইসঙ্গে রান্না করা ছাড়লেন।

ট্রেকিং-এর স্বপ্ন কোন ছোটোবেলায় দুচোখে ও মস্তিষ্কে আঁকা হয়ে গেছে পাকাপাকি। কিন্তু শখ থাকলেই সাধ্য থাকতে হবে, এই আপ্তবাক্য বা প্রবাদ সবার জীবনে মেলে না। কস্তুরীরও জেদ, কিছুতেই আর-পাঁচজন বিজ্ঞানের ছাত্রীর মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হবে না। সে বিশেষ কিছু করবে, মানে ভেতো বাঙালি মার্কা নয়, রোমাঞ্চকর কিছু।

তবে রক্তে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তেমন কিছু একটা চাকরি লাগিয়ে ফেলা যায়। সবাই যখন আইএএস দেয়, কিছু ছেলেমেয়ে শুধু একটা লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে বস হবে বলে আইপিএস পেতে চায়। অন্যরা যখন ব্যাংক প্রবেশনারি অফিসার হওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়াশোনা করে, তখন খুশিমনে কস্তুরী দাশগুপ্ত সিবিআই, র, ফরেনসিক বা নিদেনপক্ষে কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ় তথা আইবি-র পরীক্ষা দিয়ে গেছে।

বাড়ির সবার চাপে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে মন নেই। ভর্তি হয়েছে মায়ের মন রাখতে। যদি ফরেন্সিকে যেতে পারে, তো এই লাইনে থাকবে, নয়তো শুধু শুধু মরা-পচা কাটার কোনও বাসনা নেই। যে-কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সেই গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।

এই সময় কাস্টমস ও সেন্ট্রাল এক্সাইজ-এর ইন্টারভিউ কল পেল। চাকরিটা যে তিন বছর করে কাস্টমস আর তিন বছর করে সেন্ট্রাল এক্সাইজ় পোস্টিং আগে জানা ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে দুরূহ অবস্থার মোকাবিলা, আত্মগোপন করা, ছদ্মবেশ ধারণ করার শিক্ষানবিশি সব নিতে হবে। শুনেই কস্তুরীর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রোমাঞ্চে, আর মা-বাবার কাঁটা দিচ্ছিল উদ্বেগে। উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, পাগলির কথা শোনো। ডাক্তারির সুযোগ ছেড়ে কেউ চোর ডাকাত স্মাগলারদের পিছু ঘোরে?

মনে মনে মরিয়া হয়ে সাক্ষাৎকার দিল এবং পেয়ে গেল কস্তুরী। প্রশিক্ষণের জন্য প্রথম পোস্টিং মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অসম সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই, মা-বাবা তাতেও খুঁতখুঁত করছিলেন। ওখানে বাঙালিরা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ থেকে যেহেতু অবাধে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পরিয়াযী মানুষ অসম ও মেঘালয়ে প্রাণ বাঁচাতে বা জীবিকার সন্ধানে আসে, তাই সাত প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী বাঙালির প্রতিও যেন শরণার্থী জবরদখলকারীর মনোভাব স্থানীয়দের। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হ্যাংলার মতো শিলং, বড়া পানি, চেরাপুঞ্জি, মৌসিনরাম দেখতে ছোটা চাই। স্বজাতির কী হল না হল সেসব ভেবে নিজেদের সীমিত পরিসরের আনন্দ মাটি করতে চায় না কেউ। কিন্তু এখন যে, নিজের কন্যার প্রশ্ন। মাথা ঘামাতেই হচ্ছে।

কিন্তু আজকের দিনে সরকারি চাকরি বলে কথা, কোটার পাত্রী নয়, কটাকে হেলাফেলা করবে? ডাক্তারি পড়তে লাগবে কম পক্ষে পাঁচ বছর। তারপর হাউস স্টাফ থাকতে হবে। স্বাধীন রোজগেরে হতে গেলে অন্তত ছয় সাত বছরের ধাক্কা। আর এটা শুরুতেই মোটা মাইনে, দুবছর পর পাকা চাকরি। সবরকম সরকারি সুযোগসুবিধা-সহ নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ্য ভাতা, এলটিসি সব। অগত্যা মা কালী মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে শেষে লোকনাথ বাবার কাছে নিরাপত্তার জিম্মা দিয়ে মেয়েকে এয়ারপোর্টে এসে মেঘালয়ের উদ্দেশে রওনা করতেই হল।

বিমানে ওঠার আগে খুশির হাসি হেসে খুশিমনে কস্তুরী বলল, মা দুই বাংলার বাইরে লোকনাথ বাবাকে কেউ চেনে না, যদিও বলা হয় উনি সুমেরু পর্যন্ত নাকি ঘুরে এসেছেন, তবে নর্থ-ইস্টে যাননি। উনি না মানচিত্র গোলমাল করে ফেলেন। ঠাকুরের আসনে সেভেন সিস্টার সমেত ভারতের ম্যাপটাও রেখে দিও।

উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনার বিশেষ অধিকার, তার অপব্যবহার, ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নবাদী কার্যকলাপ সব মিলিয়ে জটিল গোলকধাঁধা। তার মধ্যে কস্তুরীর কাজ পড়েছে কয়লা চোরাচালান আটকানোর বিভাগে। যদিও প্রশিক্ষণ পর্যায়, তবু এমন বিপজ্জনক কাজের ট্রেনিং-ও বিপন্মুক্ত হওয়া সহজ নয়।

ওদিকে দক্ষিণ মিজ়োরামে ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার, কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আযোজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম সবকিছু নিয়ে ঝামেলা। কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে মেলে না।

ষাটের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। নিজেদের জুমিয়া জাতি বলে বাংলাদেশ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চেনে ও কড়া হাতে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর গোড়ায় সত্যিই চাকমা সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী বা চাকমা আর্মড ফোর্স তৈরি করে নাম দেওয়া হয় শান্তি বাহিনী। তাই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। আবার উচ্ছেদ, আবার ভারতের অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়া। কেউ কেউ পরিব্রাজন করে লাগোয়া অসম মেঘালয়ে চলে আসে। তাদের পুনরায় আগমণ নিয়ে মিজ়োরাম তো বটেই, মেঘালয়ে এই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার ওপর বসতভিটে ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের উৎপাত তো আছেই।

নাক ও চোখের গড়নের সাদৃশ্যের খাতিরে স্থানীয়দের চোখে চাকমারা যদিও ওদের মধ্যে কিছুটা আত্মগোপন করতে পারে, কিন্তু বাঙালি মানেই বাংলাদেশী আর বাঙালি দেখলেই সবার দ্যাখো মার ভঙ্গি। মেয়ও তবু একটু দয়া দাক্ষিণ্য করে, কিন্তু মেঘালয়ে গারো খাসি জয়ন্তিয়া জনজাতিরা এবং মিজ়ো ছেলেরা বাঙালি পুরুষ নারী বাচ্চা কাউকেই রেহাই দিতে চায় না।

বাঙালি ও চাকমা খেদানো নিয়ে সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কট পর্যন্ত হয়ে গেছে। জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পুনর্বাসন ও অভিবাসন হবে না কথা দিয়ে শান্তি নেই। বাঙালি মানেই মেরে ফ্যাল শালা, রিফিউজির জাত। নামেই মাতৃপ্রধান সমাজ। কোনও মহিলাকে মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও বড়ো পদে দেখাও বিরল ব্যাপার। অথচ ঘর-সংসার থেকে ব্যাবসাপত্র, সম্পত্তি সবকিছুর দেখভাল মেয়েরাই করে।

আরেক পক্ষের দাবি, অভিবাসন দিলে সবাইকে দিতে হবে। জাতি ধর্মের বিভেদ করলে চলবে না। যারা আসছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে আসছে, সুতরাং কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে সেই ভেদাভেদ করা চলবে না। রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিক পরিস্থিতি সব সময় উত্তপ্ত, যে-আগুনে পুড়তে হয় মূলত সব হারানো বাঙালি পরিবারগুলোকেই।

নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্র সরকার একটু আংশিক উদারতা দেখাতেই মেঘালয়ে বাঙালি খেদানোর ও মারার নতুন হিড়িক পড়ে যায়। রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়, বাঙালি মেঘালয় পাহাড় না ছাড়লে রক্তের স্রোত বইবে। ভারতের দেশজ হোক বা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালির জন্য ক্রমশ আরেক বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে মিজ়োরাম ও মেঘালয়। বাঙালিরা যেখানেই যায়, নিজেদের বুদ্ধির জোরে বড়ো বড়ো চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি ইত্যাদি সম্মানজনক পেশাগুলো হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের থিতু হয়ে বসতে না দিলে জীবনরক্ষায় দিনানিপাতেই কেটে যাবে কাল।

আরও একটা ভয়, এই পুরো অঞ্চল জুড়ে নানা খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। সেগুলোর মালিকানা স্থানীয় জনজাতি ছাড়া আর কারও হাতে যাওয়া পছন্দ নয় মিজো, খাসি, গারোদের। কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি ও অনেক বেআইনি কোলিয়ারি আছে। বেশ কয়েকটির মালিক মাড়োয়ারিরা। স্থানীয়দের ভাষায় ইন্ডিয়ান। তাদের বেসরকারি কোলিয়ারি আইনানুগ নথিভুক্ত। কিন্তু তাতেও বেআইনি কাজ করতে বাধা নেই। চুক্তিমতো ন্যুনতম পারিশ্রমিক না দেওয়া, দৈনিক রোজ বাকি রাখা, বিমা ছাড়া কন্দরে প্রবেশ করানো কত আর বলা যায়?

কোথাও কোথাও খনির মুখ এত সরু, যে বড়ো মানুষ ঢুকতে পারে না। তাই বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও বেআইনি ভাবে নামানো হয় সেই সব গভীর ইঁদুর গর্তে। বাস্তবিকই ওগুলোর নামকরণ সার্থক র‌্যাট হোল মাইন। সেখানে অস্ত্র হাতে গুঁড়ি মেরে কয়লা কেটে আনতে হয়। দুর্ঘটনা নিত্যসঙ্গী। সেই ভ্যান গখের জীবনীতে পড়েছিল কস্তুরী এই অবিশ্বাস্য শোষণের কাহিনি। এ যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। এখানে তো গরিব মানুষের নগণ্য পারিশ্রমিকও বাকি রেখে তা পুরোটা চোকানোর টোপ দিয়ে তাদের আবার নামতে বাধ্য করা হয় ওই মরণ গহ্বরে। এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সব হারানো বাঙালির বাচ্চারাই। দুটো খেতে পাওয়ার জন্য মানুষ কী না পারে? বাংলাদেশ থেকে খেদানি খেয়ে এখন অসম থেকেও খাচ্ছে, আর কোলিয়ারি মালিকদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে।

মা আমি নাই যাব ঐহানে। ডর লাগে। হাত পা ছিলা যায়। বাবা গো! আমারে পাঠায়ও না।

আজ কাম করে নে, টাকাটা পেলে পরদিন আর যাবি না উহেনে।

কিন্তু সেই পরদিন আর আসে না। পেট চালাতে মহাজনের কাছে দেনা। শুধতে গেলে আবার কাজ, আর কাজ মানে ইঁদুরের গর্তের অতলে তলিয়ে কয়লা তুলে আনা। পারিশ্রমিক যা পায়, গালাগাল পায় তার বেশি। তবু এই চক্র থেকে রেহাই নেই। ২০১৮-র ডিসেম্বরে একসাথে পনেরো জন শ্রমিক আটকে পড়ায় খবর হয়েছিল। তাদের উদ্ধারে বাযুসেনা পর্যন্ত নেমেছিল, নেমেছিল ডুবুরি বাহিনী। তবু শেষটায় ছয় জনকে বাঁচানো যায়নি। আরও কত খুচরো সংখ্যক প্রাণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে চলে যায়, তার গোনা-গুনতি নেই!

আবার শোনা যাচ্ছে লিটন নদীর জল ইঁদুর গর্তে ঢুকে পঞ্চাশজন শ্রমিক আবদ্ধ। ৩৬০ ফুট গভীরে তাদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে খবরটা ধামাচাপা দেওয়া যায়, তাতে সচেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজের উদ্ধার বাহিনী নামিয়েছেন। কিন্তু সেনা ডাকা মানে সর্বভারতীয় খবর হওয়া। একই ব্যক্তির রাজত্বে দু-দুবার এমন দুর্ঘটনা ভালো প্রশাসনের পরিচয় নয়। গতবারেই কোল ইন্ডিয়া স্বীকার করেছিল, এই তল্লাটে প্রচুর চোরা খাদান আছে। পাহাড় গাত্র ফুঁড়ে চলা এই র‌্যাট হোল, শুধু শ্রমিক কেন, সাধারণ মেঘালয়বাসীর পক্ষেও ধস নেমে বিপজ্জনক হতে পারে। তারা মেনেছিল আইন অমান্য করে খনিতে নাবালক নাবালিকাদের নামানো হচ্ছে। কিছুদিন কাগজে হইচই হল, দু-একজন গ্রেফতার হয়ে জামিনে খালাস। তারপর আবার যেই কে সেই। এবারেও মনে হচ্ছে আধা সেনা ও সেনা ডাকতে হবে, নতুবা পরে জানাজানি হলে আরও হাঙ্গামা, যদিও মন্ত্রীদের পদ তাতে টলে না।

র‌্যাট হোল খনি শুনলেই গা ছমছম করে কস্তুরীর মতো ডাকাবুকো মেয়েও। তার মধ্যে স্থানীয়রা সবাই এটাকে সবচেয়ে ভয় করে। ওখানে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। যাদের জীবন নরকের চেয়ে দুর্বিষহ, তাদেরও বাঁচার এত সাধ, আর অজানা অন্ধকারকে এত ভয়?

কস্তুরী সীমান্তে চোরাচালান ধরার দাযিত্বে। যদিও তার ট্রেনিং চলছে, কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের জন্য ওকে মাঝে মাঝে ভয়াল জায়গাতেও ঠেলে দেওয়া হয়। এবার রেস্কিউ টিমে ওকেও রাখা হয়েছে। খনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ ও চার্জশিট গঠনে সহায়তা করলেই তার দায় মেটে। আটকা পড়া মানুষগুলোকে জীবন্ত উদ্ধার করা গেলে একরকম, আর মারা গেলে আরও কড়া প্রকৃতির। তাদের বাঁচানোর দায় মোটেই তার নয়। তবু বাঁচাতে পারলে নাকি চোর ধরতে কাজে লাগবে।

এটা কাস্টমস্-এর কাজ নয়। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়ে ধান ভাঙে। আসলে কাজটা কস্তুরীর ছেলেমানুষি আবেগে নিজের শখের ডুবুরি ট্রেনিং নেওয়ার কথা ফাঁস করে দেওয়ার ফলশ্রুতি। নাও এখন মরণ গহ্বরে ডুবে মানুষ উদ্ধার করো। এক সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চায়নি কিন্তু এখন আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মুখোমুখি।

ঘটনাচক্রে শ্রমিক ছেলেমেয়ে ও বয়স্করাও জলের শব্দ পেয়ে ১৬০ ফুট গভীরে একটা চাতালে উঠে এসেছে। ওখানকার ছাত বা সিলিং-এ একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। ভাগ্যক্রমে তার লাইনে এখনও গোলযোগ হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে। বস্তুত এর গভীরে নামা নিয়মও নয়। একজন মাত্র নিখোঁজ। ওই একজন কে, ওপরে কেউ জানে না, নীচ থেকেও স্পষ্ট খবর আসছে না। সম্ভবত কোনও মহিলা। কিন্তু মানুষজনের হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চাশের মধ্যে একটি প্রাণ যেন কিছুই না।

চাতালের সঙ্গে সোজাসুজি কিন্তু পর্বতগাত্রের সঙ্গে ত্যারছাভাবে একটা সুড়ঙ্গ সাবধানে খোঁড়া হচ্ছে সমান্তরাল উদ্ধারকার‌্যের জন্য, ঠিক যেমন রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে করা হয়েছিল। সেবারেও ছয় সাতজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির গভীরে অন্ধকারে জলের তলায় তারা জলে ইঁদুর চোবা হয়ে মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ওইসব অঞ্চলে ওপেন কাস্ট খনির সংখ্যা বাড়ানো হলেও চোরা খাদানকে আটকানো যায়নি। আটকানো যাচ্ছে না ধস, অগ্নুৎপাতকেও।

বৃষ্টি শুরু হল। সর্বনাশ! বৃষ্টি পড়লেই বিপত্তি। তখন আর কোনও আশা থাকবে বা। বড়ো বড়ো ত্রিপলে খনিমুখ ঢাকার ব্যবস্থা হল। আধা সেনাবাহিনীর ট্রুপ এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তবে শোনা মাত্র স্থানীয় মানুষরা কয়েকটা ত্রিপল ও প্লাস্টিক জোগাড় করেছে। কারণ তাদেরই আপনজনেরা কেউ কেউ যে নীচে আটকে আছে।

প্রথমেই জলে ডুবতে হয়নি, কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথে উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ত্রিশজন চেন বাঁধা ডুলিতে চেপে উঠে এসেছে। এবার শ্রমিকদের আশ্রয় নেওয়া শুকনো চাতাল পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। শুকনো বললেও ভেতরটা অসম্ভব গুমোট ও ভ্যাপসা। ওই একজন তরুণী ছাড়া মনে হচ্ছে সবাইকে তোলা যাবে।

একজনের পা ফেঁসে গেছে পাথরের বা কয়লার খাঁজে। জল উঠে এসেছে তার বুক পর্যন্ত। নিজের পা-টা ছাড়ানোর জন্য যত টানাটানি করে তত যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যায়, কিন্তু পা যে আরও ফেঁসে যায়।

কস্তুরী বলল, ওর পা কেটে বার করে আনা হোক। পা যাবে কিন্তু প্রাণটা বাঁচবে।

মাথা খারাপ? জলের মধ্যে পা কাটলে ব্লিডিং বন্ধ করা যাবে? ও দমবন্ধ হয়ে না মরলেও রক্তপাতেই শেষ হয়ে যাবে…

ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তে ছেড়ে এসেছি। স্কুলে এনসিসি করেছি। সবরকম স্মল আর্মস চালাতে পারি। এ ছাড়া উপায় নেই। কোনও সার্জেন থাকলে প্লিজ় দেখুন। তেমন কেউ দাযিত্ব নিলে আমি নামব না।

বাধা ব্যাগড়া দেওয়ার জন্য যত লোক তৎপর হয়, আসল কাজে তার এক শতাংশকেও দেখা যায় না। কেউ রাজি নয় দেখে কস্তুরী নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার আর নাকে নল গুঁজে বলল, আমি যাব। যদি ওর পা কাটতে হয়, আইনত কোলিয়ারি তার দাযিত্ব নেবে। কিন্তু যদি মারা যায়, আমি সব দায় মাথায় করে নেব। শাস্তি ভোগ করতে রাজি। দেখুন জল ওর গলা, টাচ করেছে। আর সময় নেই। আর এক ফুট জল উঠলেই সিসি টিভি অকেজো হয়ে যাবে। এখনও হয়নি সেটাই পরম বিস্ময়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিচ্ছু করা যাবে না।…

কাউকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে মাথায় টর্চ হেডলাইট নিয়ে আর হাতে ধারালো চপার নিয়ে কস্তুরী নেমে পড়ল গহ্বরে। সবাই হতবাক। তারপর মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তুমুল হইহল্লা শুরু হল। যদিও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে নাকি মেয়েদের সম্মান আছে। পরিবার প্রধান হয়, পদবি ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদেই প্রায় পুরুষ। আর বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মন্তব্য ভেসে এল মেয়ে মানুষের বেশি বাড়। ট্রেনিং পিরিয়ডে এত সাহস পায় কী করে? কাস্টমস অফিসাররা কি হাতে চুড়ি পরে আছে? আর্মি তো আসছেই। আটচল্লিশজনকে উদ্ধার করা গেছে, একজন নিখোঁজ, আরেকজন মরলে কী ক্ষতি ছিল?… ইত্যাদি।

আধ ঘণ্টা পরে মাইন শ্যাফট এলিভেটরে টান পড়ায় টেনে তোলা হল। ডুবুরির সরঞ্জাম না থাকলে কস্তুরীকে চেনা যেত না। সারা গায়ে কয়লা ও কাদার আস্তরণ। ও ডুলিতে চেপে ধরে আছে এক তরুণকে। তার গায়ে জল কাদা কালি। তার মধ্যেও রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কাটা পায়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। সেখানে তার নিজের শার্টখানাই বাঁধা রক্তক্ষরণ যতটুকু কম করা যায়।

তবে আরও আশ্চর্য, কস্তুরীর দু পায়ের মাঝখানে কিছু একটা কাদাকালি মাখা জিনিস ধরা। সেটা মাথার ওপর তুলে ধরে ও চ্যাঁচাল, সেই কাটা পাটা নিয়ে এসেছি। শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করলে ছেলেটাকে আর তার পা, দুটোই বাঁচানো যাবে। কুইক।

দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সিংগ্রাম নামের ছেলেটার প্রাণ বাঁচলেও তার থ্যাঁতলানো এলোমেলো করে কাটা পাখানা জোড়া লাগানো যায়নি। তবু কস্তুরী তার ও তার পরিবারের কাছে সাক্ষাৎ দেবী।

হাসপাতালে শুয়ে কস্তুরী খবর পেল, খনি মালিককে পুলিশ ধরেছে। তিনি আপাতত পুলিশ হেফাজতে হাজতে। সেটাও ওদের কাস্টমস দলের দলবদ্ধ সাফল্য। মনটা হালকা হয়ে এল।

অন্যমনস্ক হয়ে একজনের মোবাইল চেয়ে বাড়িতে ফোন করল কস্তুরী, মা, খুশি বলছি। কেমন আছো?

আর কেমন আছো? যেখানে গেছিস সব সময় চিন্তায় থাকি। তুই কেমন আছিস?

ভালো। ইয়ে মা… একটু খোঁজ নিতে পারবে, মেডিকেলটা আবার শুরু করা যায় কিনা? জানি জেনারেল ক্যান্ডিডেটের সিট ফাঁকা থাকে না, তবু যদি আমার স্কোর কনসিডার করে…। ডিপার্টমেন্ট যদি পারমিশন দেয়, তাহলে ভাবছি মা, এমবিবিএস-টা কমপ্লিট করে সার্জারিতে মাস্টার্স করব। দেখলাম চোর ডাকাত ধরার চাইতেও কারও প্রাণ বাঁচাতে পারাটা আরও বেশি স্যাটিসফ্যাকশন দেয়।

 

 

মুক্তি

॥ ১ ॥

ভোরের কুয়াশা সরিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে নম্রতার পুরোনো শহর। বাসটা ক্রমশ পাহাড়পুরের দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন ভোরেও, যেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন বছরের রাইকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল নম্রতা। একরত্তি মেয়েটা কোল আঁকড়ে চুপ করে বসেছিল। এতটুকু কাঁদেনি। বরং যেন আগলে রেখেছিল নম্রতাকে। দেখতে দেখতে সতেরোটা বছর কেটে গেল।

এই তো দেবী চৌধুরানির মন্দির! যেদিন প্রথম টকটকে লাল সিঁদুর আর লাল বেনারসি পরে প্রথম পা রেখেছিল এই শহরটায়, সেদিনই এসেছিল এখানে প্রণাম করে নতুন জীবনের আশীর্বাদ নিতে। ভেজা ভেজা মায়া চোখে লেপটে যাওয়া কাজল আর একরাশ স্বপ্ন ছিল সেদিন। তারপর তো কত হেরে যাওয়া বিকেলে সে এসেছে!

সেই পাকুড় গাছটা! চার বছরে যতবার এদিকে এসেছে, ততবার খুঁজেছে গাছটাকে। রঙিন থেকে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জীবনের নীরব সাক্ষী তো এই গাছটাই!

বাসের হর্ন আর স্মৃতির মেদুরতায় কখন যে ব্যাগে মোবাইলটা বাজছে খেয়ালই করেনি নম্রতা। ফোনটা রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ রে রাই এক্ষুনি ও বাড়ি পৌঁছোব। সন্ধের আগে ব্যাক করব কোচবিহারে দিদির কাছে। দিদান কে দে তো একটু…

—মা চিন্তা কোরো না যেটা আমার রাইয়ের প্রাপ্য সেটা আমি নেবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না।

নেতাজি বাস টার্মিনাস থেকে কয়েক পা এগোলেই চৌমাথার মোড়টা। ডান পাশে সরু কানাগলিতে ঢুকতেই ওই তো দোতলা হলদে বাড়িটা। সামনের বেগনভেলিয়া গাছটা নেই বলে কেমন যেন ন্যাড়ান্যাড়া লাগছে। আশপাশের ছাদ থেকে দু-একটা উৎসুক, পরিচিত মুখ চোখে পড়ল নম্রতার। এই তো আর কপা এগোলেই বিশাল ফটক। কিন্তু পাগুলো কেন অসাড় হয়ে আসছে নম্রতার? অবশেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে কলিংবেল বাজাতেই বেরিয়ে এল এ বাড়ির জামাই দেবেশ। কেস চলাকালীন দেখেছিল নম্রতা দুএকবার।

—আরে আসুন! একা কেন, রাই কোথায়?

—ওর ক্যাম্পাসিং আছে।

—তা বাপের ভিটে, ঠাকুমা এদের প্রতি অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের তেমন সেন্টিমেন্ট নেই। কী বলে যে ডাকি! বউদিই বলি, কি বলেন? আপনি তো এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন। ইস্কুলটা কোথায়? আর পেপারে ফিচার টিচার তো লিখছেন খুব।

—ওই একটু আধটু!

—স্কুল ব্যান্ডেলের কাছে। থাকি উত্তরপাড়া, প্রপার কলকাতা নয়। ফ্ল্যাট না, দিদির ননদের বাড়ির নীচতলায় ভাড়া আছি।

—একাই তো থাকা হয় নাকি? বলেই ফিচেল হাসি হাসে দেবেশ।

—একা কেন? রাই আর মা থাকে। দৃঢ় ভাবে বলে নম্রতা।

ইতিমধ্যেই দোতলায় এসে পৌঁছেছে নম্রতা। বড়ো বৈঠকখানাটা এখন রোগিণীর শয্যা। বিছানার একপাশে পড়ে আছে এককালের দাপুটে বিভা দত্ত। চারদিকে চোখ বোলাতেই নজরে এল দেয়ালে ঝুল আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে ঝুলছে শুকনো ফুলের মালা জড়ানো দীপকের ছবি।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এল সোনা। এখন বেশ গিন্নিবান্নি।

—ও তুমি? এসেছ? মা তো ঘুমোচ্ছে। একটু বসো, বলেই ইশারায় স্বামীকে ডেকে নিয়ে গেল। আয়া মাসি বলে চলে, তুমি বুঝি বাবুদার প্রথম বউ! বুড়ি খুব তোমার নাম করছে গো!

তার নাম করছে? আশ্চর্য! কয়েক মুহূর্তের জন্য নম্রতা পিছিয়ে গেল একুশ বছর আগে। তখন সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী। রাত প্রায় বারোটা। সব কাজ সেরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীপক অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বিচলিত। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়ে বিচলিত আর উত্তেজিত হওয়াটাই প্রকৃতি ছিল দীপকের। নম্রতা বেশি ঘাঁটাত না। হঠাৎই রণংদেহী হয়ে ছেলের ঘরে কড়া নেড়ে উত্তেজিত হয়ে উপস্থিত হলেন বিভাদেবী।

—ও বাবু দেখ দেখ তোর বউ আজও হলুদের বয়মের মুখ আলগা রেখে এসেছে। আগে একদিন এভাবে চিনি নষ্ট করেছিল, আমি না দেখলে এখনি সব ছিটিয়ে চিত্তির হতো! বলি বিয়ে বাড়িতে দেখে কী মেয়ে পছন্দ করে আনলি? আমার সংসারটা তো গোল্লায় গেল!

—নম্রতা কী শুনছি এসব?

—আসলে মা বললেন শেষ পাতে সোনা বেগুন ভাজা খাবে, তাই তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি।

—হলুদ কি তোমার বাবা জোগায় নাকি?

—বাবার নাম একদম তুলবে না। উনি নেই।

—একদম চুপ! মুখে মুখে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।

—আহ লাগছে! চুলটা ছাড়ো!

—চল হারামজাদি! মা আর সোনার কাছে ক্ষমা চেয়ে বল, তোর মাস্টারবাবা তোকে শিক্ষা দেয়নি! বল!

—আহ লাগছে! ক্ষমা কেন চাইব? ভুল করে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে তো…

—একদম চুপ! আই! সোনা নিয়ে আয় ওর খাতাগুলো! দেখাচ্ছি মজা! লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে ফিচার পাঠানো? মন সবসময় উড়ু উড়ু! এক্ষুনি সব ছিঁড়ে দেব।

—হায় হায় গো! কী মেয়ে মানুষ! ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে অসুস্থ করা! যা বাবা চোখে মুখে জল দে আমাদের ভদ্দর লোকের বাড়িতে চ্যাঁচামেচি! পাঁচজনে শুনলে বলবে কী?

॥ ২ ॥

—ও বউদি চা খাবে গো! ও বউদি! চারু মাসির ডাকে সম্বিত ফেরে নম্রতার। ধীরে ধীরে চশমাটা খুলে ব্যাগে রাখে। একবার শীর্ণ বিভাদেবীর দিকে তাকায়। এই মৃত্যুপথযাত্রীনির শেষইচ্ছে পূরণ করতেই তো আসা!

পাশের লাল সিমেন্টের ঘরটা ছিটকিনি দেওয়া। চারুর অনুমতি নিয়ে ঢুকল নম্রতা। এখানেই তার খাট, আলমারি ছিল এককালে! পরে হয়তো রুম্পাও এখানে থাকত! এখন বাতিল জিনিসের আখড়া হয়েছে। হয়তো বাতিল হওয়া সম্পর্কও? ঘর? না সেভাবে নম্রতা কোনও বরাদ্দ ঘর পায়নি এ বাড়িতে।

বিয়ের পরপরই উঠেছিল নীচতলার আলো, বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে ঘরে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাই এল। বাচ্চার ঠান্ডার ধাত থাকায় উপরের লাল সিমেন্টের ঘর বরাদ্দ হল। কিন্তু সোনার পড়ার সমস্যা হওয়ায় শেষমেশ রাই আর নম্রতার ঠাঁই হল একদম ডাইনিং ঘরের এককোণে কাঠের চৌকিতে।

দরজাগুলোর একটাতেও কোনও পাল্লা ছিল না। শ্বশুরমশাই নগেন দত্ত তখন জীবিত ছিলেন। একে অ্যালজাইমার তার ওপর ডায়াবেটিস। যতবার তিনি ঘরের ওপর দিয়ে টয়লেটে যেতেন ততবার ছোট্ট রাইকে ফিডিং করাতে নম্রতাকে অস্বস্তিতে পড়তে হতো। হাজার বুঝিয়ে সুরাহা হয়নি। আসলে বিভাদেবী চাননি দীপক আর নম্রতার কোনও ব্যক্তিগত পরিসর থাকুক। জিনিসপত্র অবশ্যি নীচতলার ঘরেই থাকত।

একদিন এটাই তার সংসার ছিল! কই এতটুকু টান আসছে না তো? নম্রতার ঠাকুমা বলতেন দিনহাটার বাড়িটা ঠাকুমার স্বামীর ভিটে। পরপারে যাবার আগে তিনি ভিটে ছাড়বেন না! সেই ঠাকুমার সংস্কারেই তো বড়ো হয়েছে সে! স্বামীর ঘর, সিঁদুর, শাখা, পলা, নোয়া— এসব ভাবলেই ছোটোবেলায় প্রতিটা রোমকূপে যে-শিহরণ জাগত সেসব যে কোথায় উবে গেল কবে?

ধীরে ধীরে জানলার শিকগুলোতে হাত বোলায় নম্রতা। কত বুক ফাটা কান্নায় এই শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ খোঁজার চেষ্টা করেছে! কতদিন! ডানদিকের সরু দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ে বাঁকানো সিঁড়িটা। ধীরে ধীরে খানিকটা ঘোরের মধ্যেই ছাদে চলে আসে নম্রতা। এই ছাদটার মধ্যেই মরূদ্যান খুঁজে পেত এক সময় সে! গাছগুলো সব শুকিয়ে মরে আছে। চারদিকে পরিত্যক্ত টব। ওই তো নম্রতার ফেব্রিক দিয়ে রং করা ছোট্ট টবটা রং চটে পড়ে আছে।

আজও মনে পড়ছে তখন সবে দুদিন বিয়ে হয়েছে, একদিন আপন মনে গাছে জল দিতে দিতেই পাশের বাড়ির ক্যাসেট থেকে ভেসে আসা শ্রাবণী সেনের আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কী-র সুরে গুনগুন করছিল হঠাৎ পেছন থেকে দীপকের ধুপধাপ চটির শব্দ এগিয়ে আসছিল। কাঁধে দীপকের স্পর্শে চোখ বুজে রোমান্টিকতার কাব্য লিখছিল নম্রতা। না কোনও আবেশেই আবিষ্ট হতে পারেনি সেদিন।

দীপক জানিয়ে দিল তাদের সবার বাটি, চামচ, থালা, গেলাস আলাদা। দেখে বুঝে নিতে হবে। গুলিয়ে যেন না যায়। আর সোনার ঘরে বিছানায় ভুলেও নম্রতা যেন না বসে। সোনার এসব পছন্দ নয়। মুহূর্তেই শ্রাবণী সেন এর গানটা কলেজের পি ডি স্যারের হ্যাকের থিওরির মতো লাগতে শুরু করেছিল!

আজও চোখে জল এসে গেল নম্রতার? এখনও জল বেরোয় চোখ দিয়ে দীপকের জন্য? ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য? নাকি স্বামী নামক অদেখা ব্যক্তিটির জন্য আশৈশব তিল তিল করে জমানো এক বুক ভালোবাসার এক কণাও দিতে না পারার জন্য? সত্যি কোথায় গেল ভালোবাসাগুলো যার এক কণাও এই পরিবারের একটি মানুষকেও সে দিতে পারল না।

॥ ৩ ॥

—ও বউদি নীচে চলো গো সবাই ডাকছে!

—তুমি চারু? কতদিন আছ?

—আমি অনেকদিন বউদি। আগে ঠিকা কাজ করতাম। এখন বুড়ির ডিউটি। তোমার কথা শুনছি অনেকের মুখেই।

—কী? আমি খুব খারাপ?

—ধুর! মানুষ দেইখে চুল পাকল! রুম্পা বউদিও খারাপ না গো! একটু ইসস্টরং! বাবুন দাদা যে কী করল! বেরেনশর্টের অতগুলা ওষুধ! তুমি আসো শিগগির, আমি যাই। নাহলে ভাববে চুকলি কাটতেছি।

ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নম্রতা। চিলেকোঠার কাছে এসে পুরোনো কাচের বই রাখার আলমারিটা চোখে পড়ে। এটা আগে তার ঘরেই ছিল। এখানেই হয়তো ছড়িয়ে আছে পুরোনো যাপনের কোনও চিহ্ন। ওই তো সেই ফটো স্ট্যান্ডটা! ধুলোয় ধূসরিত। ওর মধ্যেই অযত্নে অস্পষ্ট হয়ে গেছে ছোট্ট রাই আর দীপকের ছবি! ধীরে ধীরে ছবিটা বের করে নেয়। পুরো নষ্ট হয়নি এখনও। সেই লাল কভার ফাইলটা না? তাতে কোচবিহার থেকে নম্রতার লেখা প্রথম আর শেষ বোকা বোকা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি। ফাইলটা হাতে নিতেই আঠেরো বছর আগের সব স্মৃতি হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।

সেদিন দীপকের বন্ধুর বিয়ে ছিল। দীপক অবশ্য কোথাও তেমন যেত না। কথা ছিল নম্রতা সন্ধের আগেই রাইকে নিয়ে যাবে। হরিদার রিকশা বলে রেখেছিল। খুব একটা বেরোনোর ভাগ্য ছিল না বলেই ছোটো ছোটো জিনিসে সুখ খুঁজে নিত। দীপক অফিসে বেরিয়ে গেছে। আলমারি থেকে লাল সিল্কটা বের করে আয়রন করতে গিয়ে দেখে দীপকের কভার ফাইলটা ছিটিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে নম্রতা। এমনিতে দীপকের সব জিনিস কখনওই ঘাঁটার অভ্যাস তার ছিল না।

বিকেলে সব কাজ এগিয়ে তৈরি হতে গিয়ে দেখে আলমারি থেকে সব বের করে স্তূপ হয়ে আছে। নম্রতার ভালো শাড়িগুলো সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া। দীপকের চোখগুলো টকটকে লাল আর ফর্সা গালগুলো লাল হয়ে আছে। নিজেকে সংযত রেখে কি ঘটেছে জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে শুরু হয়ে গেল এলোপাতাড়ি কিল, চড়, লাথি। এক ধাক্কায় আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংটায়।

অভ্যাসবশত চেষ্টা করেছিল শান্ত ভাবে অপরাধ জানতে আর পাঁচ কান না করে চার দেয়ালে মিটিয়ে নিতে! কিন্তু সেই সময় পাশবিকবলে বলীয়ান হয়ে দীপক এমন ধাক্কা দিল যে, সে আছড়ে পড়ল লোহার রেলিংয়ে ওপর! তারপর কতক্ষণ যে পড়েছিল নম্রতা সিঁড়ির নীচে আজ আর মনে করতে পারে না।

হাতটা ফ্র‌্যাকচার হয়েছিল। ওই অবস্থায় মেয়েটাকে খাইয়ে হাতব্যাগে বাবার দেওয়া গয়নাগুলো, ৫০০ টাকা আর রাই-এর দু একটা জিনিস ভরে, ভোর হবার আগেই উঠে বসেছিল কোচবিহারের বাসে। তারপর তো জামাইবাবু সব সামলাল। পুলিশ কেসের ভয়ে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা হয়ে গেল।

এরাও ততদিনে ছেলের মানসিক সমস্যা দেখিয়ে গা বাঁচাল। তখনও দীপক দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। ফোনে, চিঠিতে মেরে ফেলার হুমকি দিত। সেই জন্যই দিদি পাঠিয়ে দিল উত্তরপাড়া। সেখানে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি, টিউশনি, আর একের পর এক লড়াই।

আজও ভাবে সেদিন ফাইল থেকে একটা কাগজ খাটের নীচে পড়ে যাওয়ার মাশুল তাকে কীভাবে যে দিতে হয়েছে? সেটা কতটা দরকারি ছিল সেটাই তো আর জানা হল না।

॥ ৪ ॥

ইতিমধ্যে অনেকেই হাজির। বিভাদেবী বালিশে হেলান দিয়ে বসে। ছোটো কাকিমণি বললেন, কত দিন পর দেখলাম নম্রতা! জেল্লা বেড়েছে তো? একদম কোনও খোঁজখবর নেই। বাবুন চলে যাবার পরও এলে না? এলেম আছে তোমার, বর ছেড়ে, কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিলে, ফিচার লেখালেখি! বলি এ বাড়ির ছেলেদের মেজাজ তো বরাবরই তিরিক্ষি। আমরা আর পারলাম কই?

—আপনারাও তো কাকিমা রাইয়ের বাবার খবর যতদিনে জানালেন তখন আসা না আসা এক। কী হয়েছিল সেটা স্পষ্ট করে বলেননি।

—কি আর জানাব বাছা! তুমি মাথা বিগড়িয়ে দিয়ে গেলে, ওষুধ ধরল। পরের বউ এসে কোথায় বুঝিয়ে ওষুধ খাওয়াবে তা না, আরও বাড়িয়ে দিল, শেষমেশ সেই ওষুধগুলো একবারে খেয়ে..

—ও সোনা কাঁদিস না মা!

—কী করব বলো কাকিমা! দাদাটা এত সৎ ছিল না! আমার মায়ের মতো। অন্যায় বরদাস্ত করত না। বউগুলো এমন জুটল…

নম্রতার হাসি পাচ্ছিল তবু সংযত হয়ে বলল, এতটাই সৎ যে না জানিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ ছেলের দুবার বিয়ে দিলে!

হঠাৎই বিভাদেবী বলে ওঠেন, বউমা তুমি রাই দিদিকে আনলে না? ক্যান্সার রোগীটা ফোন করেছিল তাও রাখলে না কথাটা।

—পরে আসবে। এখন ক্যাম্পাসিং।

—আর পরে কি আমি থাকব?

—এই বালাটা রাখো। রাইদিদুর বিয়েতে দিও। আর এই শিবলিঙ্গটা রাখো মা। সে মেয়েকে আমি বলতে পারব না আর সোনা তো এসব পারবে না… তাই তুমি এর দায়িত্ব নাও। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রতা।

দেবেশ ইতিমধ্যে দলিল আর জমি-বাড়ির ম্যাপ নিয়ে হাজির। উকিলি কেতায় বলে চলে,

—বউদি পুরো বাড়ি আর ফাঁকা জায়গা নিয়ে ৫ কাঠা ৩ ছটাক। শ্বশুরমশাই নগেন দত্তের নামে বাড়ি। ওয়ারিশ হচ্ছে, বিভা দত্ত, সোনালি রায়, রুম্পা দত্ত, ছেলে রাতুল দত্ত, আর আপনার মেয়ে রাই দত্ত। আপনি তো ডিভোর্সি। এবার আমি রুম্পা বউদিকে বুঝিয়েছি সরকারি রেটে আমাকে বিক্রি করতে, রাজি হচ্ছেন না। আমি অবশ্য এমন কেস ঠুকে দিয়েছি ও কাউকে বেচতেও পারবে না। এবার থাকে আপনার মেয়ে। আমরা ভদ্র ফ্যামিলি। রাইকে বঞ্চিত করব না। আপনি দানপত্রে কোনও দাবি নেই বলে সই করে দিন। রাই-এর বিয়েতে আমরা থোক অ্যামাউন্ট কিছু দেব। এখন হাতটা খালি!

মাঝখান থেকে সোনা বলে, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমাদের ফ্যামিলিতে এসেছিলে!

আপন মনেই হেসে ওঠে নম্রতা। দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এখন ডিভোর্সি মহিলারও প্রপার্টিতে লিগ্যালি অনেক দাবি আছে। আপনি বোধহয় আপ টু ডেট নন।

—মানে আপনি সহজে মেটাবেন না তাই তো? অত দুর থেকে সব পারবেন?

—থামুন! আমার কথা শেষ হয়নি। বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, রাই এখন বড়ো হয়েছে। কিছু না কিছু করবেই। ওর বিয়ে নিয়ে আমার কোনও তাড়া নেই। আপনি বালাটা রাখুন। আর শিবঠাকুর আমায় দিচ্ছেন? ভরসা পাচ্ছেন? একদিন তো ঠাকুরঘরে ঢুকতে দিতেন না। যাইহোক ওটা দিতে চাইলে আমি নেব। এই চেকটা রাখুন সই করা। আপনার ছেলের একটা মাত্র পিএলআই-এর নমিনি ছিলাম আমি। বাদ বাকি তো আপনি আর সোনা। যখন সব বন্ধন ছেড়ে গেছি তখন এটার জন্য ঋণী থাকতে চাই না, আপনার কাছে রাখুন। ৫০ হাজার আছে।

সবাই একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে নম্রতা বলে চলে, আশা করি বুঝেছেন সম্পত্তির প্রতি আমার আর রাই-এর কোনও আগ্রহ নেই। সম্পর্ক যখন ছিঁড়ে গেছে প্রপার্টি দিয়ে কি হবে? এ বাড়িতে চারবছরে একটাই সম্পদ পেয়েছি সেটা আমার রাই। যা যা সই সাবুদ একটু গিয়ে করিয়ে আনবেন আবার কবে আসব জানি না, ভালো থাকবেন।

অনেকদিন ধরেই ওই চেকটা গলার কাঁটার মতো বিঁধে ছিল। আজ ফেরত দিতে পেরে নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। ভেবেছে রাইয়ের কথা। তার অধিকারের কথা। কিন্তু না, সে রাইকে যোগ্য করে গড়তে পেরেছে। সে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আর যা পড়ে রইল তা তো আর্থিক লাভ আর ক্ষতি। পুরো জীবনটাই যার ক্ষতির খাতে চলে গেল এ টাকাগুলো তার আর কী সৌভাগ্য আনবে।

সোজা অসম মোড়ে না গিয়ে একটু ঘুর পথেই গৌড়িয় মঠের সামনে আসে নম্রতা। এখন সুন্দর ব্রিজ হয়েছে। শহরের মাঝ বরাবর তির তির করে বয়ে যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ করলা নদী। ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে দীপককে লেখা নিজের চিঠিটা বের করে। তারপর টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় করলার জলে। ভেসে যাক সব অতীত, গ্লানি। আজ নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনকেমন করা মুহূর্তে আসত সে।

এই শহরটা বড়ো মায়াবি। না তার জন্মভূমি নয়। স্বামীর ভিটের অনুভূতি নেই তার। তবে বড়ো আপন। অনেক মন কেমন করা মুহূর্তে এই জলশহরের রাস্তা, নদী, গাছ, মন্দির তাকে বলেছে তুমি কেঁদো না আমরা আছি! এগিয়ে যাও। বাঁচো। হেরো না। আজ শহরটা আরও ঝকঝকে হয়েছে। কিন্তু আনাচে কানাচে জুড়ে সেই আন্তরিকতার ছাপ আজও আছে! ভালো থেকো জলশহর! জানি না আবার আসব কিনা! কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না। এই তোমরা আমার কেউ না হয়ে যে অনেক কিছু!

 

পরিতোষের সিদ্ধান্ত শেষ পর্ব

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা করো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বললো, ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দুচোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

পরিতোষের সিদ্ধান্ত পর্ব-১

পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু ‘পূর্ণিমা, পূর্ণিমা’। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। ‘দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

‘আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত।’ পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে।’ বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন ‘কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর ক’দিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে, পেনশনের মোটা টাকা— তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?’

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন ‘এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক।’ পূর্ণিমা চমকে উঠলেন ‘কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দু’দিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে। আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।’ ‘ব্যস— চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না।’ পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, তারা চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’কামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রী-র অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায়রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে এবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন ‘টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর’, সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন। গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, ‘বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা’র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন ‘কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিঁকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ?’ পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য।’ অবাক পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এ মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! কি হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা— টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘দাদা চুপ কর।’

‘চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?’

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো।’ পিকলু মাথা হেঁট করে পাউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।’ পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।’

‘মা, বাবার আজকাল কী হয়েছে?’ পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। ‘জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন ‘পূর্ণিমা, আর টাকাপয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের,’ বলে শুয়ে পড়লেন।

‘কি! আমরা বাবার টাকা নেব? ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সাথে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না’, পাপু উঠে চলে গেল। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর– সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগি মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।’

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়েও হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো।’ পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, ‘কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে,’ পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, ‘বেশি আয়োজন করো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে। মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তাঁর ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। আপনি টাকা-পয়সার কথা কী যেন বলছিলেন?’ প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’ ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একলা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘কী ভেবেছ তুমি, এভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!’

দার্জিলিং

দুপুর একটা পঞ্চান্নর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চেপে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে দার্জিলিং। এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ট্রেনটা ওরা মিস করল।

তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুবিমল। ঘুম ভেঙেছিল মোবাইলের রিংটোনে। ফোন ধরতেই মায়ার গলা, কোথায় আছেন? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, ফোন ধরছেন না কেন?

এই আসছি, ট্রেন তো এখনি ঢুকবে!

ব্যাগ গোছানোই ছিল। তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা দিয়ে বেরোয় সুবিমল। টোটো ধরে স্টেশন। মায়া তার মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কোনওমতে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ওরা দেখে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। একা থাকলে লাফিয়ে উঠে পড়ত সুবিমল। কিন্তু মায়া আর দিয়াকে নিয়ে তো সেটা সম্ভব নয়।

এবার কী হবে? মায়ার গলা কাঁদো কাঁদো শোনায়।

এনকোয়ারিতে গিয়ে ওরা জানল চারটের আগে আর শিলিগুড়ির দিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই। তার মানে আরও দুঘন্টা স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সুবিমল বলল, চলো ফিরেই যাই। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। বলে, আমায় নিয়ে আপনি দার্জিলিং যেতে চান না তাই তো?

এরকম ভাবছ কেন? আসলে ট্রেন পেতে দেরি হলে শিলিগুড়ি যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আর তখন হোটেল-টোটেল পাব কিনা…

হোটেল না পেলে স্টেশনে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব। কিন্তু বেরিয়েছি যখন যাবই! সুবিমলকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল মায়া, দার্জিলিং নিয়ে কত কথা বললেন। কম্পিউটারে ছবি দেখালেন। আর এখন যেতে চাইছেন না?

দার্জিলিং-এর কথাটা বলতেই মায়ার মুখটা কেমন নরম হয়ে গেল আর চোখদুটো চকচক করে ওঠে, একটা কষ্ট অনুভব করল সুবিমল। বেচারি! কখনও দূরে কোথাও যায়নি। কিছু দেখেনি। পাহাড়, সমুদ্র কিছু না। কেউ নিয়ে যাবার নেই!

আচ্ছা মা, দার্জিলিং-এ তো এখন খুব ঠান্ডা তাই না? পাশ থেকে দিয়া বলে।

সেটা তোর কাকুকেই জিজ্ঞেস কর না।

আঃ তুমিই বলো না। ওখানে কি এখন বরফ পড়ছে? কী মজা!

মেলা বকিস না তো। এখন যাওয়া হবে কিনা তারই ঠিক নেই, আর ইনি চোখে বরফ দেখছেন।

বকুনি খেয়ে একটু চুপ করে যায় মেয়েটা। একটু পরেই আবার বলে, আমি কিন্তু দার্জিলিং গিয়ে টয়ট্রেনে চড়ব।

হ্যাঁ, তুমি টয়ট্রেন চাপবে! কত টাকা টিকিট লাগবে জানিস? তুই দিবি?

টয়ট্রেনের ছবি দেখিয়েছিল সুবিমল কিন্তু তার টিকিট-ফেয়ার নিয়ে কিছু বলেনি। সে নিজেও ঠিক জানে না। তবে মায়া হয়তো ধরেই নিয়েছে, এত সুন্দর দেখতে একটা ট্রেনে উঠতে অনেক টাকা লেগে যাবে। এসব কথা হতে হতেই একটা ট্রেন চলে এল।

পুরি-কামাখ্যা এক্সপ্রেস।

মায়া তড়িঘড়ি বলল, দেখুন না, এই ট্রেনটা শিলিগুড়ি যাচ্ছে কিনা?

এখন তো ওদিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই, শুনলে না?

আঃ দেখুনই না একবার।

কী মনে করে সুবিমল সিট ছেড়ে এগোয়। ট্রেনের জানলার ধারে বসে থাকা একজন প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে। লোকটা হিন্দিতে জবাব দেয়, শিলিগুড়ি যায়েগে কেয়া নহি জানতে, পর ইয়ে এনজিপি যায়েগা।

এনজেপি মানে নিউ জলপাইগুড়ি। শিলিগুড়ির আগের স্টেশন। ওখান থেকেও তো দার্জিলিং যাওয়া যায়! মায়া ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুবিমল ব্যস্ত হয়ে বলে, চলো চলো এটা যাবে। মালপত্র নিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা সামনের কামরাটাতে উঠে পড়তেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

এনকোয়ারির লোকটা এই ট্রেনটার কথা বললই না। ভাবো এরা কি জন্যে যে চাকরি করে, সুবিমল সিটে বসতে বসতেই বলে।

দেখলেন তো, আমার কথা শুনলেন বলেই… মায়ার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। জানলার পাশে দিয়াকে বসিয়ে সে নিজেও বসেছে। কামরা একদম ফাঁকা। রিজার্ভেশন হয়নি বলে আসতে চাইছিলেন না। এখন দেখুন শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। আমার বেড়াবার ভাগ্য কী ভালো।

সুবিমল ঘর থেকে তিনটে বড়ো বড়ো ক্ষীরসাপাতি আম আর লিচু নিয়ে এসেছে। বার করল সেগুলো। ট্রেনে উঠলেই তার খিদে পায়, কেন কে জানে!

নাও আমগুলো কাটো। লিচু খাও।

আম কেটে, টিফিনবাটির ঢাকনায় তুলে প্রথমেই সুবিমলের দিকে এগিয়ে দেয় মায়া। তারপর মেয়েকে দিয়ে নিজেও নেয়। সিটের ওপর পা তুলে গুছিয়ে বসে, আম খায়।

আঃ পাটা নামিয়ে বসো না, সুবিমল বলে।

কেন, কী হয়েছে?

সুবিমল আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। কেন যে আসতে গেল এদের সাথে। নোংরা পা দুটো একেবারে সিটের ওপর তুলে বসল। যেন ঘরের বিছানা! কম শিক্ষিত হলে যা হয়। এই যে, আবার পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলা হচ্ছে জানলা দিয়ে। এত থুতু আসে কী করে মুখে ও বুঝে পায় না!  দিয়ার ওপর চোখ পড়তেই মাথা আবার গরম হয় সুবিমলের। কালো মুখে রং মেখেছে!

দার্জিলিং-এর ছবিগুলো আবার দেখান না, আবদারের সুরে বলে মায়া।

সুবিমল বিরস মুখে ব্যাগ খুলে তার ল্যাপটপটা বার করে, সুউচ অন করে। মোডেম লাগায়। ইউ টিউব চালায়।

ওই তো টয়ট্রেন, লাফিয়ে ওঠে দিয়া।

চিৎকার করছিস কেন? মেয়ের দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া। দিয়ার মুখ শুকনো হয়ে যায়।

টয়ট্রেন ততক্ষণে ঘুম স্টেশনে এসে থেমেছে। কুয়াশায় আবছা দেখা যাচ্ছে। এবার দার্জিলিং-এর বাজার দেখাচ্ছে নেপালি মেয়েটা, রংবেরং-এর উলের পোশাক বিক্রি করছে। দোকানে দোকানে কত জিনিস সাজানো, নীল সবুজ পাথরের মূর্তি। বাজার ছেড়ে পথ ওপরে উঠছে। এবার ম্যালে এসে থামল।

কী চমৎকার জায়গাটা। এটাই তো বলেছিলেন মল। তাই না?

মল নয়, ম্যাল সুবিমল হাসে।

ওঃ ম্যাল। লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকায় মায়া। তারপর বলে, আপনি বলেছিলেন না, ম্যালে গেলে কোনও না কোনও পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যাবেই।

হ্যাঁ, লোকে তো সেরকমই বলে, একটু অন্যমনস্ক হয় সুবিমল। আমি যখন খুব ছোটোবেলায় মা বাবার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, ম্যালে গিয়ে মনে আছে একজন দূর সম্পর্কের রিলেটিভ মানে আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেছিল। পরে আর কখনও ওনাকে দেখিনি। এখনও মনে আছে, উনি আমাকে গাল টিপে আদর করেছিলেন, ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন।

আমিও ম্যালে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ব।

সুবিমলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত হয়ে সে দিয়ার দিকে তাকায়।

আঃ কতবার তোকে বলেছি, কথার মাঝখানে কথা বলবি না। দেব কানপাট্টিতে এক থাপ্পড়। তারপর বলুন না কী হয়েছিল?

সুবিমলের মনে তখন অন্য একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে। ম্যালে গিয়ে যদি… ম্যালে তো যেতেই হবে। গিয়ে যদি আবার কোনও আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় অথবা তারই স্কুলের কোনও কলিগের সাথে! তখন সে কী করবে। কী পরিচয় দেবে মায়ার আর মায়ার মেয়ে। কী বলবে সে?

কী হল, কী ভাবছেন?

কিছু না লিচুর খোসা ছাড়ায় সুবিমল।

এসব কথা বলতে বলতে ওরা যখন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোল তখন রাত আটটা বাজে।

ট্রেন থেকে নেমেই দিয়া বলল, মা দেখেছ, কত্ত বড়ো স্টেশন! সঙ্গে বেশি টাকা আনেনি সুবিমল। স্টেশনের পাশে একটা ছোটো দেখে হোটেলেই ওঠে।

হোটেল মালিক টাকা নিয়ে খাতা খুলে সুবিমলকে সই করাল। তারপর বলল, আপনাদের আধার কার্ডটা দেখাবেন। মায়ার কার্ডটা দেখে বলল, আপনার পদবি তো দেখছি দাস আর ওনার ভট্টাচার্জি।

সুবিমল বুঝতে পারল না লোকটা কি বলতে চাইছে। কিন্তু মায়া একবার সুবিমলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা বাবার নামে করেছিলাম তো। বিয়ে পর আর পালটানো হয়নি।

আপনারা সত্যিই ম্যারেড তো?

কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?

সুবিমল বলল, রেজিস্ট্রি পেপার দেখাতে হবে?

না, না, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনারা ঘরে যান।

ঘরে গিয়ে ওরা আর বসল না। মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল যত সকাল সকাল বেরোনো যায় ততই ভালো।

ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছেই অনেকগুলো খাবার হোটেল। তারই একটায় ঢুকে ওরা বসে। সুবিমল মাছ ভাত বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়া বলল ডিম ভাত নিতে। খরচ যেটুকু বাঁচানো যায়।

রাতে বিছানায় শুয়ে ওদের চোখে ঘুম আসে না। মায়া আর সুবিমলের মাঝে দিয়া শুয়েছে। সে বলে, মা ঘুম পাচ্ছে না। একটা গল্প বলো না। ওই দুষ্টু শেয়ালের গল্পটা।

হ্যাঁ, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তোকে এখন গল্প বলব। চুপ করে ঘুমো। ভোর ভোর উঠতে হবে।

না, বলো না একটা।

মায়া কী ভেবে বলে, তোর কাকুকে বল। কাকু অনেক ভালো ভালো গল্প জানে।

অন্ধকারের মধ্যেই সুবিমলকে উদ্দ্যেশ্যে করে সে বলে, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে? নাহলে ওকে একটা গল্প বলুন না। আমিও শুনব।

সুবিমল ভাবছিল, দিয়া এখন সঙ্গে না থাকলে কত ভালো হতো। মায়াকে এখন সে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারত। বদমাইস মেয়েটা একেবারে তাদের মাঝখানে এসে শুয়েছে। মায়া বলেছিল একপাশে শুতে। কিন্তু শুনলে তো! তবে এটাও মনে হয়েছে ওর, দিয়া সঙ্গে না থাকলে হয়তো হোটেলে ঘর পেতে অসুবিধে হতো। ও আছে বলেই সবাই ওদের একটা পরিবার বলে ধরে নিচ্ছে। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের মেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মনটা হঠাৎই জ্বালা করে ওঠে সুবিমলের। পরিবার! সত্যিই কি কোনও দিন তার নিজস্ব পরিবার হবে? তার নিজের সন্তান, তার নিজের বউ। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। আর কবে সে বিয়ে করবে?

বলবেন একটা গল্প, বলুন না। মায়ার গলায় আবদারের সুর।

মায়ার সাথে প্রথম পরিচয়টা একটু অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল। বাউল মেলা দেখতে গিয়েছিল সুবিমল। দিয়াকে একটা এগরোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দ্যাখে। ভিড়ের মধ্যে ওর হাত ছুটে নাকি ওর মা হারিয়ে গেছে। সুবিমলই শেষপর্যন্ত দিয়ার হাত ধরে মায়াকে খুঁজে বার করে। সেদিন মনে আছে একটা চুমকি বসানো জংলা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল মায়া। বেশ লাগছিল। বিশেষ করে ওর ফিগারটা। এক মেয়ের মা বলে ওকে বোঝাই যায় না! মেলাতেই ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। তারপর কীভাবে যে ওরা দুজন কাছে চলে এল। স্বামী নেই বলে মায়ার দিক থেকেও নিশ্চয়ই একটা শারীরিক চাহিদা ছিল!

ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

হঠাৎ করেই মায়ার কথা ভেবে মনটা কেমন নরম হয়ে যায় সুবিমলের। বেচারি। বিয়ে হতে না হতেই বর মারা গেছে। শুধু একটা ছোটো দোকান রেখে গেছে, পান-বিড়ি-সিগারেটের, আর এই মেয়েটা। ওকে বোনের বাড়ি রেখে বেড়াতে আসবার কথা মায়া বলেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত পারেনি। মায়ের মন। বলল, আমি ঘুরব আর ও পাহাড় দেখবে না?

সুবিমল পাশ ফিরে বলে, আচ্ছা শোনো। এই দিয়া শোন, একটা গল্প বলছি। হ্যাপি প্রিন্স ও সোয়ালো পাখির গল্প। এক দেশে এক রাজার ছেলে ছিল। দুঃখ কাকে বলে সে জানত না, তারপর একদিন সে মারা গেল।

এত তাড়াতাড়ি মারা গেল?

কথা বলছিস কেন? ধমকে ওঠে মায়া চুপ করে শোন।

সুবিমল বলতে থাকে, দিয়া চুপ করে শুনছে। কতটা বুঝছে বলা মুশকিল কিন্তু সুবিমল যখন যখন বলল সোয়ালো, সোয়ালো, ও লিটল সোয়ালো। দিয়াও সুর করে বলল, সোয়ালো সোয়ালো ও লিটল সোয়ালো…

গল্প শেষ হলে মায়া বলল, ওরা দুজন দুজনকে কত ভালোবেসেছিল। সত্যিই কি কেউ কাউকে এত ভালোবাসতে পারে? তারপর তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ার ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাঙল সুবিমলের।

আর কত ঘুমোবেন?

উঠে বসে সুবিমল। এঃ, পৌনে ছটা বাজে। রোদ উঠে গেলে তো পাহাড়ে ওঠার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি বাথরুমে যায় সুবিমল। হাত মুখ ধুয়ে বেরোয়। দিয়াও এইমাত্র উঠল। ঘুমচোখে বিছানার ওপর বসে আছে। মায়া ওকে টেনে হিঁচড়ে নামায়।

শিলিগুড়ি সদর মোড়ে এসে ওরা ট্রেকার থেকে নামে। একটু দূরেই দুটো বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একটা গাড়ির চালক হাঁক দিচ্ছে দার্জিলিং দার্জিলিং। মায়া সুবিমলের হাত চেপে ধরে, একটু তাড়াতাড়ি চলুন, গাড়িটা বোধহয় ছেড়ে দেবে এক্ষুনি কিন্তু সুবিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কী হল চলুন,

সুবিমল এবার এগোয়। গাড়ির চালককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। কালিম্পং যাবার কোনও গাড়ি নেই?

এই তো পাশের গাড়িটাই যাবে, যান উঠে পড়ুন। মায়া অবাক হয়ে সুবিমলের দিকে তাকায়।

কী হল? আমরা তো দার্জিলিং যাব।

না মায়া। একটু ইতস্তত করে সুবিমল বলে, সাত হাজার টাকায় দার্জিলিং ঘোরা যাবে না। ওখানে হোটেল ভাড়াই অনেক হবে।

কেন, আমার কাছেও তো কিছু টাকা আছে, এতে হবে না?

না, তোমার টাকায় আমি হাত দেব না। কালিম্পং কাছে। খরচ কম পড়বে। চলো ওখানেই ঘুরে আসি। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

দার্জিলিং যাব বলে এলাম আর এখন বলছেন…

না মায়া, দার্জিলিং-এ খুব ঠান্ডা পড়ে। তুমি তো জানো আমার বেশি ঠান্ডা সহ্য হয় না।

কেন, গরম কাপড় তো সঙ্গে এনেছেন। এতে হবে না?

না।

ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। ওর জন্য কষ্ট হয় সুবিমলের। বেচারি কত আশা করে এসেছিল!

গাড়ি সমতল ছেড়ে সেবকের কাছে এসে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরতেই মায়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দিয়া জানলার পাশে বসেছে। বাইরে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, মা দ্যাখো নদী কত নীচে। মায়া জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। সুবিমলকে ডেকে বলে, দেখুন পাহাড়ি নদী।

কী নাম নদীটার? জলটা কেমন সবুজ। দেখবে কী করে সুবিমল। সে বসেছে মাঝখানে।

বাঃ, বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে সে, আর সে-ই কিছু দেখতে পাবে না! একটু রাগ রাগ মুখ করেই বসে থাকে সুবিমল। থাক, ওরাই দেখুক। একটু পরে অবশ্য সে নিজেও সরে এসে মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকায়। আর কী আনন্দই যে হয়। দিয়ার মতো বয়সে সে এই পথ দিয়ে গিয়েছিল। এই সুবিস্তীর্ণ পাহাড়, পাহাড়ের খাদ থেকে উঠে আসা এই লম্বা লম্বা গাছ, আর গাছের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ওই রূপসি রঙ্গীত এরা কি তাকে চিনতে পারছে! দার্জিলিং যাওয়া হল না!

কাকু তোমার কাছে স্মার্ট ফোন নেই? তাহলে ছবি তুলব, দিয়া বলে।

মাথা নেড়ে না বলে সুবিমল। অন্য যাত্রীরা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছে। দিয়া মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট কমদামি মোবাইলটা নিয়ে তাতেই ছবি তুলতে থাকে। দেড় ঘন্টা বাদেই ওরা মেঘের রাজ্যে পৌঁছে যায়। পাহাড়ের বুকে শুয়ে থাকা মেঘগুলো সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে।

কী সুন্দর! মায়া অস্ফুটে বলে, এরকম জিনিস দেখতে পাব কখনও ভাবিইনি।

মেঘ দেখা ভুলে গিয়ে সুবিমল চেয়ে থাকে মায়ার ঝলমলে খুশিভরা মুখের দিকে।

 

কালিম্পং গাড়ি স্ট্যান্ডে এসে নামার পর মায়া অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। পাহাড়ের এত ওপরে এত বড়ো সুন্দর শহর! ওরা প্রথমেই একটা দোকানে ঢুকে লুচি মিষ্টি খেয়ে নেয়। তারপর হোটেল খুঁজতে বার হয়। বেশি খুঁজতে হয় না। স্ট্যান্ডের পাশেই প্রচুর হোটেল। শেষপর্যন্ত হোটেল প্যারাডাইস বলে একটা দোতলা ঝকঝকে সুন্দর হোটেলে ওরা সাহস করে ঢোকে। আর এমনই ভাগ্য, মাত্র হাজার টাকায় একটা বড়ো ঘর পেয়ে যায়। ঘরে দুটো সিংগল বেড, টিভি সেট আছে, বড়ো আয়না আছে, জানলায় শৌখিন পর্দা ঝুলছে, টাইলস বসানো বাথরুমের সাইজটাই শিলিগুড়ির হোটেল ঘরটার থেকে বড়ো।

ওরা আরও অবাক হল যখন হোটেল ম্যানেজার ওদের কাছে আধার কার্ড দেখতে চাইল না, এমনকী আগাম ভাড়াও চাইল না। শুধু খাতায় নাম তুলে নিল। তারপর বলল, যান, মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নিন। সাইট সিযিং করবেন তো? আমার চেনা ভালো ড্রাইভার আছে। বারোশো টাকা নেবে, সেভেন পয়েন্টস ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

সেভেন পয়েন্টসটা কী? প্রশ্ন করে সুবিমল।

কালিম্পং-এ মেইন দেখার জায়গা সাতটা। নতুন আসছেন বুঝি?

হ্যাঁ।

মায়া বলল, আমরা স্নান খাওয়া সেরেই বেরোব। আপনি ড্রাইভারকে বলে দিন।

ঠিক বারোটা বাজতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হোটেলের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা তখন সবে ভাত খেয়ে হোটেলে ঢুকছে। তড়িঘড়ি ওপরে উঠে ওরা ড্রেস চেঞ্জ করে। মায়া বলে, দেখুন না কোন শাড়িটা পরব?

শাড়ি কেন, যে-সবুজ সালোয়ারটা এনেছ ওটা পরো।

ওটা পরব? একটু ছোটো হয় আমার। গায়ে চেপে বসে।

পরোই না।

সালোয়ার গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মায়া। পেছন থেকে সুবিমল বলে, তোমায় দেখতে সেই হট লাগছে।

যাঃ, মায়ার মুখে লজ্জা। তারপরেই জিভ কেটে বলে, ওড়নাটাই আনতে ভুলে গেছি। ওড়না না পরে বেরোব?

ভালোই হল, সুবিমল হাসে। বলে আরও বেশি সেক্সি লাগবে।

মা, সেক্সি মানে কি? দিয়া বলে।

গাড়ির ড্রাইভারের চেহারা একেবারে সিনেমার হিরোর মতো। লম্বা, ফরসা, ধারালো চোখ মুখ। ওরা আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

ডেলো আর দুরপিন, এই দুটো উঁচু পাহাড়ের মাঝে কালিম্পং। ড্রাইভারটা প্রথম ওদের ডেলো পিকে নিয়ে যায়। পিকের ওপরে একটা খুব বড়ো হনুমানজির মূর্তি। পাশে ফুলের বাগান। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে দিয়া, হনুমানজির পায়ে কাছে রেলিং ঘেরা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে বলে, মা দ্যাখো মেঘ। সত্যিই, একেবারে হাতের কাছ দিয়ে শরীরের ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে।

সুবিমল মায়াকে বলে, দ্যাখো এই মেঘগুলো যেন আমাদের স্বপ্নের মতো তাই না? মনে হচ্ছে ধরা যায় কিন্তু হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

মায়া হেসে বলে, আপনার আবার কী স্বপ্ন আছে? দার্জিলিং, মনে মনে বলে সুবিমল। একদিন আমি দার্জিলিং যাব।

সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামছে, পাশেই দুহাত উঁচুতে পাথরের খাঁজে খাঁজে অদ্ভুত সুন্দর এক ধরনের জংলি ফুল ফুটে আছে দেখতে পায় সুবিমল। জুতো খুলে রেখে, ওপরে ওঠবার চেষ্টা করে। একবার পা পিছলে পড়ে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ফুলগুলোর কাছে হাত পৌঁছোয়। কয়েটা তুলে এনে দিয়াকে দেয় আর একটা মায়ার চুলে গুঁজে দেয়। মায়া সলজ্জ মুখে হাসে, কী যে ছেলেমানুষি করেন, পায়ে লাগল তো?

ডেলো পার্কটাও চমৎকার জায়গা। সেখানে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ার বায়না ধরে দিয়া। কিন্তু দশ মিনিট ঘোরাতে দুশো টাকা নেবে শুনেই না করে দেয় মায়া। এরপর মর্গান হাউস, নেচার মিউজিয়াম ইত্যাদি আরও কয়েটা ভালো ভালো জায়গা দেখে সন্ধের সময় ওরা হোটেলে ফেরে।

বিছানায় বসে মায়া বলে, ড্রাইভারটা কী ভালো বলুন। আমরা যেখান থেকেই ঘুরে বেরোচ্ছি, একেবারে সামনে গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াচ্ছে, একটুও হাঁটতে হয়নি। অন্যদের গাড়িগুলো কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। কত সামান্য জিনিসও মেয়েদের চোখে পড়ে, ভাবে সুবিমল।

একটু তাড়াতাড়িই বাইরে বেরিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা। ফেরার পথে ওপরে তাকায় সুবিমল। এই আকাশ সমতলে দেখা যাবে না। তারাগুলো কী ঝকঝক করছে, যেন কাছে নেমে এসেছে। তারপরেই দূরের পাহাড়ে চোখ পড়তে চমকে ওঠে সুবিমল। মায়ারাও দেখেছে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ওরা। যেন হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলছে! তারপর ভালো করে দেখে বুঝল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি বসতবাড়ি। তার আলো।

দুটো সিংগল বেড পাশাপাশি এনে ওরা শুতে যায়। দিয়া সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়াও। সুবিমল জেগে থাকে। আর একটু রাত হলে মায়া এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কখন ঘুম ভাঙল ওর!

মায়া ফিসফিসিয়ে বলে, চলুন, আপনার খাটটা ওই পাশে সরিয়ে নিই।

এর আগেও তো কতবার ওরা মিলিত হয়েছে। কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। মাটি থেকে চার হাজার ফিটের ওপরে, মেঘের রাজ্যে। অনেকটা সময় পার করতে করতে এই ঠান্ডা রাতেও তারা ঘেমে গেল। তারপর, সেই ভিজে ভিজে সুখ মেখেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙে ওদের।

দিয়া উঠেই বলে, কাকুর খাটটা ওখানে কেন? সুবিমল মায়ার দিকে তাকায়।

মায়া মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, রাতে তোর কাকুর একা শুতে ইচ্ছে হল, তাই খাটটা সরিয়ে নিল।

সত্যি কাকু? দিয়া সুবিমলকে দ্যাখে।

মুখ-টুখ ধোওয়া হলে সুবিমল বলে, বেল টিপে ম্যানেজারকে ডাকব? চা দিতে বলি আর সঙ্গে কিছু খাবার।

ডাকবেন? ঘরে এসে দিলে হয়তো বেশি দাম চাইবে।

তা হোক।

চা, লুচি-তরকারি এল। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে খেতে খেতে মায়া বলল, এটা আমার মনে থাকবে। একেবারে হাতের কাছে এসে দিয়ে গেল, হোটেলের বিছানায় বসে খাচ্ছি।

কালিম্পং দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। নীচে এসে হোটেলের খাতায় সই করার সময় ম্যানেজার বলল, ফিরে যাচ্ছেন? এখানে এলেন যখন লাভা ঘুরে যান। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। খুব শান্ত। একটা গুম্ফা আছে, ভালো লাগবে আপনাদের। লাভার নাম আগে শুনেছে সুবিমল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কীরকম সে জানত না।

বাইরে বেরোতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ভিজতে ভিজতেই ওরা গাড়ি স্ট্যান্ডে এল। ওযেদার খারাপ, শিলিগুড়ি ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে লাভায় যাবার গাড়িই ধরল সুবিমল। মায়া আর দিয়া খুব খুশি। গাড়ি যখন ছাড়ল তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ড্রাইভার যদিও বলল, পাহাড়ের এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। আর হলও তাই। মিনিট কুড়ি পরেই আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ।

যেতে যেতে কম্পিউটার বার করল সুবিমল। লাভা সম্বন্ধে একটু জেনে নিলে ভালো হয়। আর যা জানল তাতে সে অবাকই হল। লাভার উচ্চতা সাত হাজার ফিটের বেশি। দার্জিলিং-এর চেয়ে কয়েকশো ফিট ওপরে। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিমল, মায়া, আমরা দার্জিলিং-এর চেয়ে বেশি উঁচুতে উঠছি।

আধঘন্টা পর থেকেই ওদের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। আর এই প্রথম ওদের ব্যাগ থেকে গরম পোশাক বার করতে হল। সোয়েটার পরেও সুবিমল কাঁপছে। মায়া ওর হাতে নিজের শালটা দিয়ে বলল, কানে জড়িয়ে নিন। আপনার তো আবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।

একদম সরু পথ দিয়ে গাড়ি ওপরে উঠছে। ভাঙাচোরা রাস্তা। বেশি টুরিস্ট বোধহয় এদিকে আসে না। ডানপাশে খাদের তলা থেকে অতিকায় লম্বা লম্বা গাছ আকাশে উঠে গেছে। কুয়াশায় ভিজে ভিজে তাদের গুঁড়ির রং কালো। তাদের গা থেকে মোটা মোটা দড়ির মতো সবুজ শ্যাওলা ঝুলছে। কি সুবিপুল গাম্ভীর্যে পূর্ণ চারিদিক। একটা অদ্ভুত অনুভতি হল সুবিমলের। এই অমর্তলোকে ওরা যেন অনধিকার প্রবেশকারী!

লাভা পৌঁছোতে দুঘন্টার বেশি লাগল। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই একটা সরু পথ নীচে নেমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানল, গুম্ফা দেখতে এই রাস্তাটা ধরেই যেতে হবে। খাড়াই পথটা ধরে ভারি ব্যাগ হাতে নিয়ে তরতরিয়ে নামতে থাকে মায়া। সুবিমল পিছিয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে, একটু আস্তে হাঁটো না। মায়ার হাসি শোনা যায়, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন।

বহুদূর থেকেই গুম্ফাটা দেখা যায়। রাস্তার দুপাশে ছোটো বড়ো দোকান। সবজির বাজার। লোকজন কম। গাড়ি চলছে না। দুএকজন সাইকেল চেপে যাচ্ছে। পথ ঘেঁষে রঙিন কাঠের বাড়ি। বড়ো বড়ো কিছু হোটেলও অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

দূর থেকে যা মনে হয়েছিল গুম্ফাটা তার থেকেও অনেক বড়ো। কালিম্পং-এও গুম্ফা দেখেছে ওরা। কিন্তু সেগুলো আয়তনে এর অর্ধেকও হবে না। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে প্রায় আধ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিল চলে গেছে। তার ওপরে সারি সারি রঙিন নিশান উড়ছে। ভেতরে ঢুকে ওরা একটুক্ষণ পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ায়। নীচেই কুয়াশা ঢাকা গভীর খাদ। দিয়া হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে যায়। আশপাশে কেউ নেই।

সুবিমল বলে, এখান থেকে লাফ দিতে পারবে মায়া? মায়া ভুরু কুঁচকে তাকায়।

যত অদ্ভুত কথা আপনার।

না বলছি, ওই কুয়াশার মধ্যে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না?

বাজে কথা রাখুন, চলুন দিয়া কোথায় গেল দেখি।

একটা বাঙালি পরিবারের সাথে দেখা হয়। স্বামি-স্ত্রী আর তাদের মেয়ে। বউটি ফরসা ও সুন্দরী। মেয়ে কিন্তু দিয়ার মতোই কালো তবে খুব স্মার্ট। কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। ওরাও কালিম্পং ঘুরে এসেছে শুনে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করেন, ডেলো পার্ক তো গিয়েছিলেন, ওখানে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলেন?

প্যারাগ্লাইডিং, কাঁধে নকল ডানা বেঁধে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া, ডেলোতে ছিল বটে। না ওটা হয়নি।

করেননি! সাচ্ আ প্লেজন্ট এক্সপেরিযে্নস। একেবারে কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে উড়তে এসে নীচে নামলাম। কিন্তু রেটটা একটু হাই। তিনজনের সাতহাজার টাকা পড়ে গেল।

সাত হাজার! একটা লাফের জন্য! তিনহাজার টাকায় ওদের কালিম্পং ঘোরা হয়ে গেল।

মহিলা ও তার মেয়ে সাথে গল্প করতে করতেই সুবিমল এগোয়। মায়ারা পিছিয়ে যায়। একবার মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে সুবিমল, বউটির হাজব্যান্ড মায়ার পাশে পাশে আসছে। এক ঘন্টার বেশি লাগল পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে। একটা জপযন্ত্র দেখল, দুমানুষ সমান উঁচু। তার চাকা ঘুরিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। ওরাও একটু ঘোরাল।

লাল জোব্বা পরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এদিক ওদিক ঘুরছে। নিজেদের ভাষায় কিসব কথা বলছে। প্রত্যেকেই খুব হাসিখুশি। এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতির কোলে, ভগবান বুদ্ধের অর্চনায় এরা যেন সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। একজন সন্ন্যাসীকে দেখল, মেঝেতেই বসে বসে খাচ্ছে। সাধারণ ডাল ভাত একটা তরকারি তাতেই মুখে ওনার কি অপরূপ আনন্দের ছাপ।

কী পিসফুল জায়গাটা বলুন। ভদ্রমহিলা বল্লেন, মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে এখানেই থেকে যাই।

ভালোই হয় তাহলে! সুবিমল ভাবে। সেও এর সাথে থেকে যেতে রাজি আছে।

প্রার্থনা ঘরটা বিশাল। দেয়ালে কী সুন্দর রঙিন কারুকাজ। উঁচু আসনের ওপর নিমীলিতচোখ বোধিসত্ত্বের মূর্তির সামনে এসে একটু দাঁড়ায় সুবিমল। হাজার বছর বা তারও আগে, রাজার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল যেই রাজার কুমার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে বলে। সেই বিশাল-হৃদয় পুরুষের জন্য হঠাৎ করেই এক অপরিমেয় শ্রদ্ধায় সুবিমলের মন অভিভত হল, কেন যেন হ্যাপি প্রিন্সের গল্পটা মনে পড়ে গেল। চোখ বুজে মনে মনে উচ্চারণ করল সে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি হে অমিতাভ, হে তথাগত বুদ্ধ আমার প্রণাম নাও।

প্রার্থনা ঘর থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আসুন আপনাদের নিয়ে একটা ছবি তুলি। তাঁর হাতে বড়ো লেন্সওয়ালা দামি ক্যামেরা। বললেন, আপনার কি কম্পিউটার আছে? তাহলে মেইল করে ছবি পাঠিয়ে দেব। মায়া খুব খুশি। লাভার একটা তো স্মৃতি থাকল। চলে যাবার সময়ে বউটা দিয়ার গাল টিপে একটা ক্যাডবেরি দিয়ে যায়।

ওরা যেতেই মায়া হাসতে হাসতে বলে, ভদ্রলোক আমার ফোন নম্বর চাইছিলেন।

দিলে?

না। দিলে বুঝি খুশি হতেন?

হতাম, সুবিমল হাসে।

ভদ্রলোক কিন্তু বুঝতে পেরেছেন আমরা বিবাহিত নই।

কী করে বুঝলেন?

ছবি তোলবার সময় আপনি আমার থেকে দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছিলেন।

ওঃ!

আপনি তো ওই বউটা আর তার মেয়ে সাথেই সারাক্ষণ গল্প করে গেলেন। একটু থেমে মৃদু গলায় বলে মায়া, মা-মেয়ে দুজনেই কী সুন্দর ইংরেজি বলছিল। আপনার তো ভালো লাগবেই।

দিয়ার দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া, আর এই ভ্যাবলা মেয়েটা সারাক্ষণ চুপ করেই থাকল। আন্টি যখন চকোলেট দিলেন একটা থ্যাংক ইউ বলতে পারলি না?

আঃ ছাড়ো। ছোটোদের অত থ্যাংক্স বলতে হয় না।

গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ওরা সেই রাস্তাটা ধরে উঠছে। মায়া আর দিয়া একটু এগিয়ে ছিল। হঠাৎ করেই ওরা হারিয়ে গেল! একঝাঁক মেঘ এসে ওদের ঢেকে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ওদের দেখতে পেল না সুবিমল। তারপরেই মেঘ সরে গেল। ওই তো মায়া। আবার নতুন একদল মেঘ এসে তাদের আড়াল করে দাঁড়াল। মায়া নেমে এসে সুবিমলের হাত ধরল। বলল, কী দারুণ না? সুবিমল মায়ার হাতটা চেপে ধরে। মেঘের ভেতর সাঁতার কাটতে কাটতেই ওরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মায়া বলে, চলুন এটায় ঢুকি। দিয়ার খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টটা পুরোই ফাঁকা। দরজার কাছের টেবিলটায় এসে ওরা বসে। এখান থেকে রাস্তায় উড়ে যাওয়া মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মায়া আর দিয়ার জন্য দু-প্লেট চিকেন চাউমিন আর নিজের জন্য থুপ্পা চাইল সুবিমল। থুপ্পা সেই মনে আছে দার্জিলিং-এ খেয়েছিল। কিন্তু এটায় সেই স্বাদ পেল না। মায়া নিজের প্লেট থেকে চাউমিন তুলে সুবিমলের প্লেটে দিল। খেয়ে দেখুন কি চমত্কার করেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে ওরা জানল, শিলিগুড়ি যাবার শেষ গাড়ি বেরিয়ে গেছে। তার মানে আজ রাতটা হোটেলেই থাকতে হবে।

সবজিবাজারের গলির ভেতর একটা ছোটো কিন্তু সুদৃশ্য হোটেল। চয়েস লজিং অ্যান্ড ফুডিং। সেটাতেই ঢুকল ওরা। ম্যানেজার অল্পবয়সি একটা ছেলে।

সুবিমল প্রশ্ন করল, ইঁহা কেয়া রুম মিলেগা?

ছেলেটি একটু হেসে বলল, দোতলায় একটা ঘরই খালি আছে, চাইলে দেখতে পারেন?

তুমি বাংলা বলতে পারো!

আমি শ্যামনগরের ছেলে, নাম রাজা। আপনারাও তো বাঙালি, দেখেই বুঝেছি।

বাঃ, তাহলে তো খুব ভালোই হল সুবিমল খুশি হয়ে ওঠে।

আসুন আপনাদের ঘরটা দেখিয়ে দিই।

সিঁড়ি দিয়ে ওদের ওপরে নিয়ে আসে রাজা। এটা বোধহয় হোটেলের পেছন দিক। একটা সরু করিডর দিয়ে হেঁটে ওরা একটা ছোটো বারান্দায় এসে দাঁড়াল আর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল। পুরো বারান্দাটাই ঝুলছে পাহাড়ের খাদের ওপর। একদিকে পাহাড়ের দেয়াল। সামনে মেঘে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া। হু হু করে কুয়াশা উঠে আসছে নীচ থেকে। বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই ওদের দেখায়। সুন্দর সাজানো ঘর। পাশেই অ্যাটাচড বাথরুম।

ওদের অবাক করে দিয়ে মাত্র আটশো টাকা ঘর ভাড়া চায় রাজা। মায়া তবু বলে, ছশো টাকায় হবে না?

কম পড়ে যাবে দিদি।

না ওটাই রাখো।

আর কিছু না বলেই খাতায় ওদের নাম লিখে ঘরের চাবি তুলে দেয় রাজা।

ঘরের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মায়া বলে, কখনও কল্পনাই করিনি এরকম ঘরে থাকব। ঘর থেকেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে ওরা বাইরে বার হয়। অন্ধকার নেমে এসেছে এখনই। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা বড়ো রাস্তা সোজা চলে গেছে। তার দুপাশে গভীর জঙ্গল। পুরো নির্জন পথ। কোনও শব্দ নেই, একটাও আলো নেই। শুধু উজ্জল তারার আলোয় নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকে ওরা।

মায়া বলে, দিয়া এখন যদি বাঘ বেরোয় তো কী করবি?

দিয়া একটু ভেবে বলে, বাঘ এলে যেন আমাকেই খায়।

কেন?

বাঃ, তোমাদের বাঘে খেলে আমি কার সাথে বাড়ি ফিরব? সুবিমল হেসে ওঠে। মায়াও। ফেরার পথেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা।

হোটেলে ফিরে দিয়া টিভি চালায়। চ্যানেল পালটায় সুবিমল। জি সিনেমায় এসে দ্যাখে অনুসন্ধান সিনেমাটা চলছে। দ্যাখা ছবি, তবু আবার দেখতে বসে ওরা।

জানো তো, এই ছবিটার শুটিং পুরোটাই দার্জিলিং-এ হয়েছিল।

তাই?

ভোর হচ্ছে। ছবির মতো সাজানো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বেতের ঝুড়ি পিঠে ঘুরে ঘুরে নামছে পাহাড়ি মেয়েটা।

সত্যি কি সুন্দর! মায়া বলে।

অন্ধ নায়িকা গান করছে, ওঠো ওঠো সূর‌্যাইরে, ঝিকিমিকি দিয়া, কালকে তুমি আঁধার রাতে, কোথায় ছিলে গিয়া।

ইস, ওর কী কষ্ট তাই না?

কেন?

ও তো কোনওদিন সূর্যটা দেখতেই পাবে না।

সিনেমা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে দিয়া। ওরা জেগে থাকে। সিনেমা শেষ হচ্ছে, অমিতাভ বচ্চন রাখির কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে।

সুবিমল বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায় একটা। ভেতরে গান চলছে, আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ।

মায়াও কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বইটা সত্যিই খুব ভালো তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু অবাস্তব!

এমন কেন বলছেন?

অমিতাভের মতো একজন হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসার একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করছে। অবাস্তব নয়?

কেন, এরকম কি হতে পারে না?

জানি না। একটু চুপ করে থেকে সুবিমল বলে, এই যে তুমি আর আমি একসাথে ঘুরছি, রাতে শুচ্ছি। কিন্তু আমি কি তোমায় বিয়ে করতে পারব কোনও দিন?

না। আপনি করবেন না, আমি জানি।

তাহলে?

চুপ করে যায় মায়া। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। মুখ না ফিরিয়ে সুবিমল কেমন করে বুঝতে পারে, মায়া কাঁদছে। কোনও শব্দ না করেই।

আচ্ছা মায়া, এই যে আমি তোমাকে কোনও সম্মান দিতে পারি না। সবার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কটা লুকোতে চাই। এতে তোমার খারাপ লাগে না?

খারাপ লাগলেই বা কী করতে পারি।

মায়া বলে, আমি জানি তো আমি আপনার যোগ্য নই। আমি গরিব, পড়াশোনা জানি না। আবার একটা মেয়ের মা। আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি নিজেই ভাবতে পারি না।

তুমি তো জোর করতে পারো।

কেন করব। জোর করে কি সব কিছু পাওয়া যায়?

কিছুক্ষণ আবার চুপ থাকে দুজনে।

আমি জানি কেন আপনি দার্জিলিং যাননি…

কেন?

আসলে বিয়ের পর বউকে নিয়ে দার্জিলিং যাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?

কেন এরকম মনে হল তোমার?

এমনিই। আগে ভাবিনি, এক্ষুনি মনে হল। বলুন, ঠিক বলেছি কিনা।

জানি না।

হঠাৎ করেই সুবিমলের পাশে সরে এসে তার বুকে চুমু দেয় মায়া, আর তাকে জড়িয়ে ধরে। সুবিমল বুঝতে পারে তার বুকের কাছটা মায়ার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সুবিমল বলে, কাঁদে না মায়া। বেড়াতে এসে এমন করে না।

আমি আপনাকে ছাড়তে পারব না।

কে ছাড়তে বলেছে তোমাকে। কেঁদো না।

আমায় ছ়েড়ে চলে যাবেন না তো?

যাবো না।

ঠিক?

ঠিক।

বাইরে লাভার নক্ষত্রভরা আকাশ ভগবান বুদ্ধের করুণাঘন দ্যুতিরময় চোখের মতো তাদের দুজনের দিকে চেয়ে থাকে।

 

গেরস্থালি

ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে অসীমার টনক নড়ল। এক্ষুনি রঞ্জন ওর বন্ধুকে নিয়ে এসে পড়বে। রঞ্জন বারবার বলে গিয়েছিল চা-জলখাবার তৈরি করে রাখতে। অসীমা তড়িঘড়ি চোখ মুছে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নিজের মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে— জ্বালা করছে। কী যে করবে কিছুই বুঝছে না, সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই ক’মাসে। অসীমা জীবনের নেগেটিভ দিক, অভাব-অস্বচ্ছলতা কোনওদিন দেখেনি। আজ যেন ও মাঝপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খড়কুটোও নেই যা আঁকড়ে ধরবে। বাবার কথা আজ এত বেশি মনে পড়ছে। বাবার জন্যই ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠা রঞ্জনের। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

‘সীমা… সীমা,’ বলতে বলতে রঞ্জন বাজারের থলে নিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। অসীমা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রঞ্জন অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের ব্যাগ নামিয়ে কাছে এসে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসা করল ‘কী হয়েছে?’ অসীমা ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে রঞ্জনকে দিল, ‘আজ আবার সরকারবাবু এসেছিলেন।’

‘কী বললেন? চিৎকার করেননি তো!’

‘না, শুধু বললেন তাড়াতাড়ি ঘরগুলো ছেড়ে দিতে।’ রঞ্জন কিছু না বলে শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে বাইরে চলে এল। অসীমা জানিয়ে দিল, ‘একটু বাদেই রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ বলল বটে কিন্তু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে বাড়িওয়ালার কথাগুলোই ধাক্বা দিচ্ছে। এক মাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে না দিলে কোর্টের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবে। রঞ্জনকে তো সব কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। মানুষটাকে তো দেখছে, এত চেষ্টা করছে তবু আশার আলো দেখছে কোথায়? বিগত পাঁচ-ছ’মাস ধরে ব্যাবসার ভরাডুবি। মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার উপর বাড়িওয়ালার হুমকি। ‘শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছেন, আমার ছেলের বিয়ে, ঘর দরকার, তাই ভদ্রভাবে বলছি, উঠে যান।’

অসীমারা গত তিনমাস বাড়িভাড়ার টাকাটাও দিতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে রাগটা সেখানেই, তাই বাহানা জুড়ে দিয়েছে। আবার কোর্টের ভয় দেখাচ্ছে। হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে তো, তাই গুমরও বেড়ে গেছে সরকারবাবুর। আজ যে সমাজে সরকারবাবু উঠে যাচ্ছে রঞ্জন একদিন সেখানেই ছিল। সরকারবাবুর বখে যাওয়া ছেলেটা হঠাৎ শুরু করেছে প্রোমোটারি ব্যাবসা। একসময়ে সরকারবাবু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে উপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। তাই ছেলের হয়ে সুপারিশ করাটা সরকারবাবুর কাছে জলভাত। মাত্র কয়েক মাস হল বেশ জমজমাট শুরু করেছে। উঠোনের ওপাশের ঘরটা আর বৈঠকখানা নেই, হয়ে গেছে অফিস ঘর। বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য যোগাযোগ করুন। প্রোমোটার – সনাতন সরকার। যোগাযোগের সময় সকাল : ১১টা – ৪টা।’

এতদিন অসীমা জানত না সরকারবাবুর ছেলের নাম। এখন সাইনবোর্ডের সুবাদে জেনে গেছে। সেই ছেলের বিয়ে। সরকারবাবুর স্ত্রীকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিল অসীমা। কিন্তু মহিলার বাচনভঙ্গির সামনে অসীমা খুবই অসহায় বোধ করছিল। উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল মাথা হেঁট করে। ঘরে এসে কেঁদে ফেলেছিল, আবার আপশোশও হয়েছিল রঞ্জনকে না বলে উপরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল আর্জি জানাতে। মাত্র কয়েক মাস আগেও অসীমারও তখন বোধহয় এখনকার মতো ছিল না। পতি গরবে গরবিনি ছিল সে। কী যে হল।

দশবছর আগে সে যখন নতুন বউ হয়ে শ্বশুড়বাড়িতে এল তখন শুধু দু’চোখে স্বপ্ন। বড়োলোক ঘরের মেয়ে অসীমা। বাবার আদুরে মেয়ের আবদারে সবাই অস্থির। সেই অসীমা এল শ্বশুরঘর করতে। তুলনায় রঞ্জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অসীমাদের মতন বড়োলোকি ব্যাপার না থাকলেও সম্পন্ন গৃহস্থ যৌথ পরিবার ছিল রঞ্জনদের। দুপক্ষই জানত অসীমা-রঞ্জনের মেলামেশার কথা। আপত্তি থাকলেও উভয়পক্ষই রাজি হয়েছিল এ বিয়েতে। রঞ্জনের মা-বাবা, দাদা-বউদির মনে ছিল একরাশ দ্বিধা। পারবে তো অত বড়ো ঘরের মেয়ে এই সাধারণ ঘরে এসে মানিয়ে নিতে। অসীমাকে নিয়ে রঞ্জন যেদিন প্রথম তার মায়ের কাছে এসেছিল, সেদিনটা অসীমার আজও মনে আছে। রঞ্জনের মাকে প্রণাম করতে গিয়ে উনি সহাস্যে বলেছিলেন ‘বসো মা, এই ছোট্ট ঘরে তোমায় স্বাগত জানাই। বাড়িটা তোমাদের মতো বড়ো নয় কিন্তু আমাদের সকলের মন অনেক বড়ো, তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু আদর-ভালোবাসায় কোনও খামতি হবে না।’

এই কথা শুনে অসীমা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কেউ তো বলেনি। তার দুচোখে তখন রঙিন স্বপ্ন-উচ্চাশা। রঞ্জন যেন অতিরঞ্জিত হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে-মাখিয়ে আছে। অসীমা, রঞ্জনের মাকে মৃদু স্বরে জানিয়েছিল, ‘এই ছোট্ট ঘর-বাড়িই হবে তার সোনার সংসার।’

কোথায় গেল তার সোনার সংসার, স্বপ্ন! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই ছোটো বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। স্বামীর বাঁধাধরা চাকরি। বাঁধাধরা সময়। অসীমা ব্যবসায়ীর মেয়ে। বাবা-কাকা, খুড়তুতো ভাইদের সচ্ছলতা দেখতেই অভ্যস্ত। গোনা টাকায় কোনওদিন জীবনযাপন করেনি সে। সারাদিনই বাড়ি জমজমাট। সকালে বাবা-জেঠু কারখানায় যায় তো দুপুরে বাড়ি আসে, ওই সময় দুই দাদা আর কাকা যায়। বাবা-জেঠু সারাটা দুপুর বাড়িতে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়ে আবার বিকেল চারটের চা-পর্ব চুকিয়ে বের হয়। দাদা-কাকারা মর্জি মতো বাড়ি আসে। আড্ডা মারে, কারুর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে কারখানা-দোকান যেখানে হোক ফোন করলে কেউ না কেউ এসে হাজির, এভাবেই বড়ো হয়েছে অসীমা।

এখানে রঞ্জন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছোটে। বাড়ি আসতে সেই সন্ধ্যা। যতই বাড়িতে জা-শাশুড়ি থাকুক, ভালো লাগে না অসীমার। রাতে রঞ্জনকে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে রঞ্জন হেসে বলে, ‘সীমা, আমরা প্রায় পাঁচ বছর মেলামেশা করে তবেই বিয়ে করেছি, তুমি জানো আমার কাজের ধারা। অফিসের পর তুমি আমি এক জায়গায় মিট করতাম তারপর সারা সন্ধ্যা হইচই করে কাটিয়ে তোমায় বাড়ি দিয়ে আমি ফিরতাম। এখন সারারাত তুমি আমার কাছে, তবু তোমার আক্ষেপ। প্লিজ অবুঝ হয়ো না। এটাই তো জীবন, আমরা সবাই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করি, চাকরিজীবী।’ অসীমা কিছুই বলার সুযোগ পায় না কিন্তু তার মন মানে না।

অসীমার বাবা এ বাড়িতে এলে প্রায়শই রঞ্জনকে ব্যাবসা করার কথা বলেন। অসীমার নামে যে মোটা অঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট আছে তা থেকে লোন নিয়ে, ব্যাবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু রঞ্জনের তাতে সায় নেই। তার এক বোনের বিয়ে হয়নি এখনও। অসীমার সবসময় ভয় করত যদি রঞ্জন ওই টাকাটা চেয়ে বসে বোনের বিয়ের জন্য। বাবা-মায়ের প্ররোচনায় অসীমা বারবার বলত রঞ্জনকে ব্যাবসা করার জন্য। শ্বশুরবাড়ি গেলে শালারাও সবাই বোঝাত রঞ্জনকে ব্যাবসার পজিটিভ দিকগুলো। সকলের তাড়নাতেই বোধহয় রঞ্জন ব্যাবসা করা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সাথিও পেয়ে গেল ললিতকে। শ্বশুরমশাই কাপড়ের ব্যাবসায়ী। তাই কাপড়ের ব্যাবসা করাই সুবিধা। এমন ভাবনা চিন্তা নিয়েই ললিত-রঞ্জন শুরু করল কাপড়ের ব্যাবসা। মাঝারি মাপের একটা দোকান-ঘর ভাড়া নিল বড়ো রাস্তার উপরেই। মাস ছয়েকের মধ্যে রঞ্জন ইস্তফা দিল চাকরিতে। বাড়িতে সবাই ব্যাবসাটাকে খুব একটা ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলল না।

অসীমার নিস্তেজভাব উধাও। সেই আবার ছটফটে হইচই করা, ননদের সাথে আড্ডা। যেমনটি ছিল বিয়ের পরপরই। রঞ্জনও বেশ খুশি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে অনেক ইচ্ছাই মনের কোণে চেপে রাখতে হয়। খুব শখ ছিল বাড়ির জন্য একট ফোর-হুইলার থাকবে। সে শখ পূর্ণ হয়নি। শখ ছিল মাকে, বাবাকে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধে হলে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাবে। দারুণ জমজমাটি পরিবার হবে তাদের। পরিবারটা রঞ্জনদের জমজমাটি কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই। কাপড়ের ব্যাবসা শুরুর ঠিক দেড়বছরের মাথায় রঞ্জন এক্সপোর্ট পারমিট পেয়ে গেল। বাড়িতে বাবাকে বলতে খুব খুশি। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমার বোনের বিয়ের গুরুদায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি ব্যাবসা করছ, দাদা চাকরিজীবী। তাই এখন তোমার ওপর আমার, দাদার অনেকটাই ভরসা।’

শ্বশুর মশাইয়ের এই ধরনের আশাভরসার কথা অসীমার মন কিন্তু সোজাভাবে নিল না। সে চেয়েছিল ব্যাবসার প্রথম লাভের টাকাটায় রঞ্জন একটা গাড়ি কিনুক। ইনস্টলমেন্টে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বশুর মশাইয়ের কথায় যেন অসীমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। সে চাইল সবাই যা টাকা দেবে, তার স্বামীও তাই দেবে। এই নিয়ে অশান্তি। রঞ্জন বাবা-দাদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এক ঝটকায় অসীমা থামাল তাকে, ‘কার পয়সায়, কার সাহায্যে ব্যাবসা করছ? আমার এফডি, বাবার যোগাযোগ না থাকলে তুমি পারতে আজ এমন কাজ করতে?’

অসীমার গলার স্বর বেশ উঁচু পর্দায় ছিল। ভাসুর-শ্বশুর সবই শুনতে পেল। তারাই রঞ্জনকে আলাদা ডেকে এনে কি পরামর্শ দিল কে জানে, একমাসের মধ্যে হঠাৎই রঞ্জন বাড়ি বদল করল, উঠে এল ভাড়া বাড়িতে। অসীমা খুবই অবাক হয়েছিল, বিরক্তও। কেন রঞ্জন বাড়ি বদল করছে এবং ভাড়াবাড়িতে যাচ্ছে এ নিয়ে বহু বার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও সদুত্তর পায়নি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে যেতে অসীমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু রঞ্জনের কঠিন মুখ, কঠোর ব্যবহার, অসীমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল, এ রঞ্জনকে সে চেনে না। সে চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল। আসার সময় সবাই প্রাণহীন পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। অসীমা-রঞ্জন আলাদা ভাড়া বাড়িতে উঠে এল। রঞ্জনের জন্যই অসীমা ভাড়া বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখত নিজেদের বাড়ির। রঞ্জনের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা কষ্ট পেয়েছিল অসীমার আচরণে। রঞ্জনের মা কিছু বুঝতে না পেরে অসীমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটো বাড়ি মা, একদিন এতটা ছোটো মনে হবে না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ঘর ফাঁকা। তোমার যদি মনে হয় তুমি ওই ঘরটাও ব্যবহার করতে পারো। এভাবে চলে যেও না। সবাই একসঙ্গে থাকো, আনন্দে থাকো।’ কিন্তু অসীমা তখন অন্য জগতের মানুষ। দর্পে মাটিতে পা পড়ছে না।

অসীমা-রঞ্জন আলাদা সংসার পাতল। নতুন ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে অসীমার বাবার স্ট্রোক হল। বাবা প্রতিমাসে মেয়েকে একটা থোক টাকা দিতেন, সেটা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অসীমা মানিয়ে নিল, রঞ্জনের টাকাতেও তাদের দুজনের সংসার হেসেখেলে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জন মা-বাবাকেও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল। ওনারা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, রঞ্জন-ললিত মিলেমিশে উদ্যোগী হয়ে কাপড়ের ব্যাবসাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু নিজেদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ডিনার করা। বেশ কাটছিল। ললিতের মেয়েটা দারুণ ছটফটে। ললিতের বউ মেধা। বেশ নরম স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু রঞ্জনের কথা অনুযায়ী খুব বুদ্ধিমতি ও হিসেবি। অসীমা নিজে বিএ পাশ। তাই প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। মেধা বেশিদূর পড়েনি, স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি। একসাথে মেলামেশায় মেধা বুঝতে পারত অসীমা খুব অহংকারী। তবু অল্প সময়ের জন্য একসঙ্গে থাকা তাই খুব পছন্দের না হলেও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাসি মুখে। এই বন্ধু জায়াকে রঞ্জন কিন্তু বেশ পছন্দ করত।

রঞ্জন-ললিতের ব্যাবসা বেশ তরতর করে এগিয়ে চলছিল। কারও জীবনে কোনও ছন্দপতন নেই। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একসময় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। দোকানটা সাধারণত সামলাত রঞ্জন। ললিত যেত অর্ডার আনতে। টাকা আনতে। এমনই কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বিদেশি অর্ডার নিয়ে মনের আনন্দে স্কুটারে দোকানের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে ললিতের স্কুটার আর একটা গাড়িকে পুরো পিষে দিয়ে ধাক্বা মারল দেয়ালে।

মেধার কান্না, বিলাপ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রঞ্জনের কান্নাও যে চোখে দেখা যায় না। বন্ধুর জন্য এত হাহাকার। বারবার একই কথা, ‘ললিত, তুই প্রমিস করেছিলি দুজনে একসঙ্গে থাকব, পাশাপাশি বাড়ি বানাব, দুজনে ছোটো দুটো গাড়ি কিনব সব মিথ্যে, তুই মিথ্যুক ললিত। আমায় না বলে তুই চলে যেতে পারলি!’ দোকান বন্ধ করে রঞ্জন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকে। অসীমা অনেক বোঝায় কিন্তু কিছুই হয় না। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল রঞ্জনের বন্ধুশোক ভুলতে। বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্বা খেল রঞ্জনের এক্সপোর্ট বিজনেসে। ললিত যে-অর্ডারটা নিয়ে স্কুটারে আসছিল তা ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল দুসপ্তাহের মধ্যে। তা হয়নি। বিদেশি অর্ডার। অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। বেশ বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল রঞ্জনের। বিদেশিদের কাছে একবার ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ পাওয়া দুষ্কর। ললিতের কাজের দায়িত্ব এখন একাই বহন করতে হচ্ছে রঞ্জনকে, সে দিশাহারা।

এরপরেই রঞ্জনের ব্যাবসায় শুরু হল শনির দশা। দোকান কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সারাদিন বাইরে থাকা। ক্ষতির পর ক্ষতি। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকেও বলেছিল দোকানে বসার জন্য। উনি রাজি হননি। ফলে যা হবার তা হল। কর্মচারীরা সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল অল্প দিনের মধ্যেই। ললিত-রঞ্জনের সংসারে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ বেলা হয়ে গেল, তবু অসীমা বাইরে এসে জলখাবার দিয়ে গেল না। রঞ্জন কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করেও সাড়া পেল না, নিজে উঠে ভেতরে গিয়ে অবাক, রান্না ঘরেও নেই। গেল কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অসীমা বিছানায়। চোখের কোনে জল, রঞ্জন অসীমার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সীমা ওঠো, কখন আমায় আর গোপালকে জলখাবার দেবে। আজ প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছে, কী ভাবছে বলোতো। ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো, আমি আর গোপাল সামনের দোকান থেকে কচুরি-তরকারি খেয়ে নিচ্ছি। তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’ হঠাৎ অসীমা রঞ্জনের দিকে ঘুরে বসল, ‘আমি এই বাড়িতে আর থাকব না।’

‘কোথায় যাব? এত অগোছালো অবস্থায় রয়েছি আমরা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যে-বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে আমরা দুজনে চলে এসেছি, সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়!’ রঞ্জন কথাগুলো বলে কপালে হাত দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অসীমা বলে, ‘তুমি জানো না,  ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় অবুঝ কাজ করুক না কেন, মা-বাবা দুঃখ পেলেও তাদের কখনওই মন থেকে দূরে ঠেলে না। প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনাই করে। তুমি মা-বাবার কাছে যাও। আমরা ওই বাড়িতেই ফিরে যাব।’

‘তা হয় না সীমা। যেদিন আবার আমার ব্যাবসা ঠিকঠাক চলবে, আমরা হইচই করে সেদিন আবার ও বাড়ি যাব। অসীমা কিছু না বলে একটু মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। রঞ্জন শুনতে পেল, ‘যার বাড়ি ভাড়া তিন মাস বাকি, সে আবার দোকান চালানোর স্বপ্ন দেখে, বড়ো ব্যবসাদার হবে। কিচ্ছু হবে না।’

রঞ্জন কেমন যেন চুপ মেরে গেল। জীবনের প্রতিকূল সময়ে তার সীমা আজ কোথায় তাকে সাহস জোগাবে তা না, আরও নিরাশ করে দিচ্ছে। রঞ্জনের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সে তো এমনটা চায়নি। সে অসীমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত বছরের প্রেম, বড়োলোকের মেয়ে। রঞ্জন সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যেদিন অসীমা একবাড়ি লোকের সামনে উঁচু গলায় টাকার কথা বলেছিল, সেদিনই তো বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘সবার আগে সম্মান, শান্তি। এই বাড়িতে সবাই আমরা শান্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচি। এমন কথা কেউ কোনওদিন বলেনি যাতে অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। হ্যাঁ, ঝগড়া হয় তবে তা মনে দাগ কাটার মতন নয়। ওটা তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে আঘাত দিয়ে কথা এ বাড়িতে কেউ কাউকে বলে না। আজ বউমা যা বলল, তুমি যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাও, বউমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও কারণ ওর দায়িত্ব তোমারই। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি আমাদেরই সন্তান। তোমার মঙ্গল হোক।’ বাবার এই কথার পর রঞ্জন একটা কথাও বলেনি। ও বাড়ি বদল করেছিল।

পরের দিন রঞ্জন সকাল-সকাল উঠে স্নান করে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ গোপাল এসে ডাকতেই রঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, অসীমাকে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’বন্ধু গেল ব্যাংকে। গোপালের জানাশোনা। গোপাল ছোটোবেলার বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না, গত মাসেই হঠাৎ দেখা তারপর কত গল্প, স্মৃতিচারণ, কেউ কাউকে ছাড়তেই চায় না। কথায় কথায় গোপাল জানাল ও কাপড়ের ব্যাবসা করে। সোজাসুজি আহমেদাবাদ থেকে কাপড়ের রিল আনায়, তারপর ব্লিচ করে বিভিন্ন দোকানে রঙিন থান শাড়ির অর্ডার সাপ্লাই করে। বেশ ভালো লাভজনক ব্যাবসা। রঞ্জন ইতস্তত করে গোপালকে তার দুরাবস্থার কথা, ব্যাবসায়ে ক্ষতির কথা জানাল। গোপাল কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে সাধ্যমতন সাহায্য করবে। এজন্যই তাদের আজ ব্যাংকে আসা।

সকালবেলাই রঞ্জন কোথায় গেল, ভাবতে গিয়ে অসীমার সব কাজে বেশ দেরি হল। চা বানিয়ে নিয়ে বসতে গিয়েই শুনতে পেল দরজায় ধাক্বার শব্দ, সঙ্গে কথা বলারও আওয়াজ। অসীমা বুঝল রঞ্জনের সঙ্গে কেউ আছে কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল, চমকে গেল, মেধা। ভিতরে আসতে বলল। মেধাকে বেশ রোগা লাগছে, মুখটা শুকনো। অসীমা ওদেরকে চা দিল, মেধা চা নিয়ে অল্প হেসে অসীমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’  অসীমা শুকনো গলায় বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ। থাকা আর না থাকা সমান। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।’ রঞ্জন দুজনের এই কথোপকথনে মাথা হেঁট করে বসে চা খেতে লাগল। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রইল।

সবাই চা শেষ করলে অসীমা চায়ের কাপ নিয়ে উঠতে উদ্যোগী হতেই মেধা নীরবতা ভাঙল। ‘ললিত চলে যাওয়াতে শুধু আমরা নই, তোমরাও বেশ অসুবিধার সামনে পড়ে গেছ। মনে হয় সবাই মিলে যদি এই ব্যাবসাটাই আবার অন্যভাবে শুরু করি।’

অসীমা রঞ্জনের দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই ভেবেছিল মেধা হয়তো ললিতের ভাগের টাকাটা চাইতে এসেছে। কিন্তু মেধার উদ্দেশ্য শুনে দুজনেই চুপচাপ। মেধা আবার বলতে শুরু করল, ‘নিজের খরচ কমালেও বাচ্চাটার খরচ তো কমানো যায় না। তাই ভাবছি আমার তো তিনটে ঘর, যদি একটা ঘরে একজন সেলাই জানা লোক রেখে কাজ করাই আর কাঁচামাল তো রঞ্জনদাই আনবে, তাহলে বোধহয় দুটো সংসারেই সাশ্রয় হবে।’ রঞ্জন বা অসীমা কেউ-ই মেধাদের কথা ভাবেনি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মেধার চিন্তা ভাবনা ওদের দুজনের মাথা হেঁট করিয়ে দিল। গোপালের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া গোপালও বলেছে যদি যৌথ ব্যাবসায় উদ্যোগী হয় তারা দুজনে মিলে। মেধার ভাবনাচিন্তা রঞ্জনকে আরও বেশি উসকে দিল কাপড়ের ব্যাবসার দিকে। রঞ্জন-গোপাল-মেধা আর যদি অসীমাও তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই কাজে তাহলে আর বাইরে থেকে লোক রাখতে হয় না। কথামতন কাজ, রঞ্জনের উৎসাহ সব থেকে বেশি। রঞ্জন হঠাৎই ভাবল, কেন অসীমা এমনভাবে ভাবল না! মেধা ললিতের পথে হাঁটতে অর্থাৎ ব্যাবসা করতেই আগ্রহী। আর অসীমা, উৎসাহ তো দেয়ই না উলটে রাগ ঝগড়া। রঞ্জনের মধ্যে এক দোলাচল শুরু হয়। মেধা জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে পাশে সশরীরে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তার অবর্তমানেও তারই ধ্যানধারণা নিয়ে চলাই ভালোবাসা। জীবনের সঠিক জীবনসঙ্গী সে-ই, যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ললিত আজ নেই তবু মেধা চলতে চাইছে ললিতেরই স্বপ্নকে বাস্তব করতে।

রঞ্জন মেধাকে বলল, ‘অসীমাও তোমার সঙ্গে কাজের দেখভাল করবে। তিনজনে মিলে আর গোপালের সাহায্যে আমরা আগের মতন গড়ে তুলব। আমাদের ব্যাবসা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।’ তাকিয়ে দেখল অসীমা হাসছে, চোখে জল।

অসীমা এতদিনে বুঝতে পারল শুধু টাকা-সম্পত্তি জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষের জন্য মানুষের এগিয়ে আসা, দুঃসময়ে তার পাশে থাকা, মানবিকতার হাত এগিয়ে দেওয়াতেই চরম সুখ। অল্পশিক্ষিত মেধার যে সহজাত বুদ্ধি ও তৎপরতা আছে, কলেজ পাঠ শেষ করা অসীমার মধ্যে সেই বোধের অস্তিত্ব ছিল না এতদিন। অসীমা আজ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

 

নতুন বৃত্ত

‘শুনছ? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

শাড়িগুলো ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল অদিতি। প্রশ্নটা কানে ঠিকই গেছে সুব্রতর। কিন্তু সে কোনও উচ্চবাচ্য করল না।

আসলে সে খুব ক্লান্ত। অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আজ অসম্ভব ভিড় ছিল। বসার জায়গা পায়নি। অবিরত কনুইয়ের ধাক্বা খেতে খেতে একঘণ্টার রাস্তাটা আসতে হয়েছে। স্টেশনে নেমেও কি শান্তি আছে? স্টেশন থেকে বাড়ি বাসে নেয় দশ মিনিট। কিন্তু বাসটা সাধারণত এড়িয়েই চলে সুব্রত। সেই তো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হবে। তার চেয়ে ফুটপাথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া অনেক আরামের। শরীরের ব্যায়ামও হয়, আবার পয়সাও বাঁচে।

কিন্তু সব মিলিয়ে এই ধকলটা তাকে খুব নাকাল করে দেয়। বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মনটা হাঁকুপাঁকু করে। কোনওমতে ঘামে ভেজা জামাটা ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। তাদের এই নতুন বাসাবাড়িতে ট্যাংকের জল পাওয়া যায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ে। অদিতি সেই জল বালতিতে জমিয়ে রাখে। সন্ধেয় সেই বালতির জলই হুড়মুড় করে মাথায় ঢেলে, ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। তারপর সটান বিছানায় গিয়ে চিতপাত হয়। টেলিভিশনটা খোলাই থাকে। তবে, ছবি দেখে না সুব্রত। কেবল কানে শোনে। খবর শোনে। স্টুডিয়োয় নেতা-নেত্রীদের বিতর্ক শোনে। অদিতি সাধারণভাবে এ সময়টা তাকে বিরক্ত করে না। চা করে এনে রেখে যায়। কিন্তু আজ অন্যরকম হল।

সুব্রতর কোনও সাড়া না পেয়ে অদিতি আবার ডাকল তাকে, ‘কী গো? ডাকছি যে, শুনতে পাচ্ছ না?’

সুব্রত এবার অসহিষ্ণু গলায় উত্তর দেয়, ‘কী?’

‘এদিকে ফেরো না! কেমন মানুষ গো তুমি?’

সুব্রত এপাশ ফিরে বলে, ‘ফিরেছি। বলো–!’

‘আজ এপাড়ায় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে, জানো?’ অদিতির কণ্ঠে উদ্বেগ।

সুব্রত চোখ বুজে রেখেই বলল, ‘কী হল আবার? এ পাড়াতেও কি তোমার মন বসছে না?’

হাতের শাড়িটাকে এলোমেলোভাবেই আলনার উপর ফেলে রেখে অদিতি, সুব্রতর পাশে খাটের উপর এসে বসল। সুব্রতর ডানপাশে জানলাটা খোলা আছে। তাই অদিতি গলা নামিয়ে বলল, ‘আজ এ পাড়ায় খুব মারপিট হয়েছে। ছুরি মেরেছে।’

‘কী?’ সুব্রত উত্তেজনায় আধশোয়া হয়, ‘কখন? কোথায়?’

‘এই তো আমাদের দরজার প্রায় সামনে। দুপুরবেলা। বাইরে হঠাৎ হইচই। দরজা খুলে দেখতে গেলাম, কে যেন কড়া গলায় বলল, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিন বউদি।’ আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছি। অনেকক্ষণ হইচইটা চলল। তারপর সেটা একটু থেমে যেতেই কান্নাকাটির রোল, আর-এক রকম হইচই শুরু হয়ে গেল।’

সুব্রতর চোখে পড়ল জানলাটা খোলা। সে ত্রস্ত হাতে সেটা বন্ধ করে দিয়ে ঘন হয়ে বসল।

‘কে কাকে ছুরি মেরেছে?’

‘পল্টুকে চেনো তো? ওই যে গো, টাইম-কলের সামনের বাড়িটায় থাকে! ওর বাড়িতে নাকি একটা লোক প্রায়ই যাওয়া-আসা করে। ওর বন্ধু। আজ বোধহয় সেই লোকটা মদ খেয়ে এসেছিল। পল্টু বাড়িতে ছিল না। সুযোগ পেয়ে পল্টুর বউয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করতে যায়। ইতিমধ্যে পল্টু ফিরে এসে ঘটনাটা দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে একটা ছুরি এনে সোজাসুজি বসিয়ে দিয়েছে বন্ধুর পেটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওহ্…!’

বলতে বলতে অদিতির চোখমুখের ভাব পালটে গেছে। এতক্ষণ পরেও ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল এই শীতের সন্ধেতেও।

সুব্রত নিজেও কম উদ্বিগ্ন হল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী,’ অদিতি বিরস গলায় বলল, ‘কেউ বোধহয় থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ এল। লোকটা তখনও মরেনি। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল দেখলাম। কে জানে লোকটা বাঁচল না মরল!

‘আর, পল্টু?

‘নাহ্, পল্টুকে ধরতে পারেনি। সে ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়েছে। পুলিশ সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না সে কোথায় গেছে। নাকি জেনেও বলল না, কে জানে!’

‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল নাকি, পুলিশ?’

‘করেছিল। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সাফ বলে দিয়েছি, সেসময় দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিলাম, তাই কিছুই কানে আসেনি।’

‘ওরা বিশ্বাস করল?’

‘বিশ্বাস করল কিনা জানি না। তবে, মাথা নেড়ে চলে গেল। আর কিছু জানতে চায়নি!’

‘খুব ভালো করেছ!’

‘মাথা খারাপ? কেউ এইসব ঝামেলায় পড়ে?

অদিতির মুখ সাদা হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে উত্তেজনায়। চোখের সামনে আহত লোকটির চেহারাটা যেই ভেসে উঠছে, অমনি শিউরে উঠছে অদিতি। মুহূর্তের মধ্যে মুখটা ঘামে তেলতেল করছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে ভীত চোখে সে সুব্রতর দিকে তাকাল।

তারপর বলল, ‘এদিকে পাড়ার লোকেরা সবাই দেখলাম পল্টুরই পক্ষ নিয়েছে। বলছে, পল্টু যা করেছে ঠিক করেছে। দুর্বৃত্ত বন্ধুটির এমন কঠোর শাস্তিই পাওনা ছিল। মাতাল অবস্থায় লোকটি নাকি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে মেয়ে-বউদের সঙ্গে অভব্যতা করত, রাস্তায়-ঘাটে তাদের উত্ত্যক্ত করে মারত। পল্টু ছিল ওর দোস্ত। বন্ধুর বউকেও শেষে লোকটা ছাড়েনি…!

সুব্রত আনমনাভাবে বলল, ‘কিন্তু তা বলেই তো আর নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে আর-একটা বড়ো অপরাধ করে বসা যায় না!’

এ কথার কোনও জবাব দিল না অদিতি। আধ-ভাঁজ করা শাড়িটাকে নিয়ে সে গোড়া থেকে ভাঁজ করতে থাকে। সুব্রতর ভয়টা অন্য জায়গায়। সারাদিন সেও বাড়িতে থাকে না। অদিতি একা থাকে। পল্টুর বন্ধুর মতো আরও কত লোক এ অঞ্চলে আছে কে জানে! কোনওদিন তারা তো এ বাড়িতেও ঢুকে পড়তে পারে সুব্রতর অবর্তমানে। সেই ভাবনাটা মনে আসতেই শিউরে উঠল সুব্রত।

এবং যে-সমাধানটাকে সে আর ভাবতে চায় না, সেটাই খুব সহজে বলে উঠল অদিতি।

‘আমরা অন্য কোনও জায়গায় বাসা ভাড়া করে চলে যেতে পারি না?’

অদিতিকে এর আগে অনেকবার সে বুঝিয়েছে, নিজের জায়গা থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পালাতে পালাতে একদিন দেখা যাবে, পালানোর জায়গাটাই আর নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সুব্রতর সেই যুক্তিটাকেও নেহাত জোলো বলে মনে হওয়ায়, সে মনে মনে অসহায় বোধ করতে থাকে।

অদিতি থেমে থেমে বলে চলেছে, ‘তুমি সকালবেলা চাকরিতে বের হয়ে যাও। সারাদিন এ বাড়িতে আমি একলা থাকি। ভীষণ ভয় করে, জানো! তাও তো কত ঘটনার কথা বলি না তোমায়! প্রত্যেকদিনই এ পাড়ায় কোথাও না কোথাও ঝগড়া, মারামারি! কখনও ছুরি-চাকু চলছে, কখনও লাথি-ঘুসি। যখন-তখন পুলিশ এসে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। ধরা পড়ছে মদের ড্রাম, আফিম কিংবা চুরির মাল। কখনও দিনের বেলা প্রকাশ্যে রাস্তায় পাড়ার কোনও মস্তান কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করছে। আবার কখনও কাছেপিঠের কোনও বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সি মেয়েদের। তারা নাকি মধুচক্র বসিয়েছিল। আর কতদিন এই বিশ্রী অবস্থাটা দেখে যেতে হবে বলো তো? মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ ভয় করে।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অদিতি। সুব্রত তাকে কোনও সান্ত্বনার কথা বলে না। তার সংকোচ হয়। অদিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে তার দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ করল। অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে সিলিংয়ের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাবনারা গতি পায়।

অদিতি তার সামনে যে-প্রশ্নটা রেখেছে, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় তার নেই। আবার এই প্রশ্নটার সামনে সে অসহায়ও। চাইলেও অদিতির আপাতসরল প্রশ্নের জবাব দিতে সে অপারগ। সে যদি বলতে পারত, ঠিক আছে, আমরা কালই অন্য কোনও পাড়ায় উঠে যাব, নতুন কোনও বাসায়, সে যেন বেঁচে যেত। কিন্তু সুব্রত জানে, এই শহরে নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কত কষ্ট করে এখনকার বাসাটা পাওয়া গেছিল, সে কথা সুব্রত ভোলেনি। ভালো টাকা সেলামি দিতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে রাজি হতে হয়েছিল উচ্চহারে ভাড়ার শর্তে।

সে কথা অবশ্য অদিতিরও অজানা নয়। অঞ্চলটা ভালো, কিন্তু সেখানে থাকার জন্য গুণাগারও দিতে হচ্ছে উচ্চ হারে, এ কথা সুব্রতর মুখ থেকে শোনার পর প্রথম বেঁকে বসেছিল সে নিজে।

‘এত টাকা ভাড়া?’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁগো, বাড়িভাড়াতেই তো আমাদের সংসারের সব টাকা বেরিয়ে যাবে, আমরা খাব কী?’

‘কী আর করা? ভদ্রলোকের পাড়ায় থাকতে হলে এটুকু খেসারত তো দিতেই হবে–!’

তারপর আর আপত্তি করেনি অদিতি। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সেদিন নিজের আপত্তিকে আরও জোরালো করে তুলতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। নিত্যদিনের এই উদ্বেগ আর হ্যাপা সইতে হতো না!

সারাসন্ধে, তারপর সারারাত পাড়াটা অদ্ভুত রকম নীরব আর শান্ত হয়ে রইল। সেই নীরবতা, যা সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর। যে নীরবতা ভয়ের বার্তাবহ। ভোর হওয়ার পরও থমথমে ভাবটা গেল না। গোটা পাড়াটা যেন দমবন্ধ করে অপ্রিয় কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময়ই সেটা টের পেল সুব্রত।

বাসস্টপে পৌঁছে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। স্বপ্নেন্দুর একটা ছোটোখাটো ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের দোকান আছে। প্রয়োজনে কখনও-সখনও স্বপ্নেন্দুর দোকানে যেতে হয়েছে সুব্রতকে। সেই থেকেই মুখ চেনা।

তাকে দেখতে পেয়েই স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞেস করল, ‘কাল আপনাদের পাড়ায় একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে শুনলাম! কী কাণ্ড বলুন তো!’

সুব্রত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘ভাবছি এ পাড়া থেকে চলে যাব। আপনি তো জানেন ভাই, আপনার বউদি সারাদিন একা বাড়িতে থাকেন! কাল যা ঘটেছে শুনলাম, তাতে এখানে পরিবার নিয়ে থাকাটাই তো দেখছি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে!’

‘কোথায় যাবেন?’ স্বপ্নেন্দু জানতে চায়।

‘ঠিক নেই। এখনও তো কাউকে কিছু বলিনি। তা ছাড়া এ সময়ে সুবিধেজনক ভালো জায়গায় বাড়ি পাওয়াও তো সহজ ব্যাপার নয়!’

স্বপ্নেন্দু শুনে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নিজের একটা বাসা আছে, দাদা! দশ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে নিয়েছিলাম। ভাড়া দিই মাসে দু-হাজার। ভেবেছিলাম পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকব আর বাড়ির বাইরে একটা দোকান দেব। কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত হয়নি।’

সুব্রত ভাবে, সকাল-সকাল স্বপ্নেন্দু তাকে পাকড়াও করে তার নিজের ইতিহাস শোনাতে বসল কেন!

স্বপ্নেন্দু অবিচলিত মুখেই বলে যেতে থাকে, ‘শেষপর্যন্ত পুরোনো বাড়িতেই রয়ে গেলাম, জানেন! ওই বাড়িটা তালা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। এখন ভাবছি, ভালো ভাড়াটে পেলে তাকে ছেড়ে দেব!’

সুব্রত হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল।

‘ছেড়ে দেবে? টাকাপয়সা কী দিতে হবে?’

স্বপ্নেন্দু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য কীসের টাকাপয়সা, কীসের কী দাদা? আপনি ওই দশ হাজার টাকাই সেলামি দেবেন। ভাড়া দু’হাজার। তাড়া নেই। রাজি থাকলে দশ-বারো দিনের মধ্যে একটু জানিয়ে দেবেন আমায়!’

স্বপ্নেন্দু তার মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

চিন্তায় পড়ল সুব্রত। দশ হাজার টাকা সেলামিতে ভালো জায়গায় বাসা পাওয়া এই সময়ে সহজ কথা নয়। তার উপর ভাড়াটাও মোটামুটি সামর্থ্যের মধ্যেই বলছে। এখন দেখার, পাড়াটা কেমন। সুব্রত ভাবল, আজ একবার অফিস থেকে ফেরার সময় স্বপ্নেন্দুর দোকানে যাবে। স্বপ্নেন্দু সেসময় যদি ফাঁকা থাকে, তাহলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটাও দেখে আসবে একবার।

রাতে বাড়ি ফিরতে অদিতি অন্য নানা-প্রসঙ্গের পরে জানতে চাইল, ‘কাউকে বলেছিলে নতুন একটা বাসা দেখার কথা?’

সুব্রত তখন দু-আঙুলে রুটি ছিঁড়ে আলু-পটলের তরকারিতে ডুবিয়ে মুখে দিয়েছে। চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আজই একটা দেখে এলাম অদিতি। পাড়াটা বেশ ভালো। বাড়িটাও। কিন্তু নিতে হলে দশ-বারো দিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এত অল্প সময়ে এত টাকা কোথায় পাই, বলো তো!’

অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘শোনো বিয়ের সময় বাবা কিছু গয়না দিয়েছিলেন। এমনিতেও সেগুলো খুব পুরোনো ডিজাইনের। আমি তো পরিই না–!’

আঁতকে উঠল সুব্রত, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমার গয়না বেচে টাকা জোটাব? আমার দ্বারা হবে না।… আর তা ছাড়া পরে কখনও তোমার বাবা জানতে চাইলে কী জবাব দেবে?

‘জবাবের ভারটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। সংসারের প্রয়োজনেই যদি কাজে না লাগল তো ওই গয়না দিয়ে আমার হবে কী?’

‘তবু, আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অদিতি,’ সুব্রত কিন্তু-কিন্তু করে।

‘তাহলে কি এভাবেই আমাদের জীবন কেটে যাক, এটাই বলতে চাইছ? প্রত্যেক মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে? তোমার আর কী? তুমি তো সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দাও! ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি আমি’– অদিতির চোখের কোলে জল টলটল করে।

অদিতিকে কিছু বলতে পারল না সুব্রত। সত্যিই তো, ত্রুটি তার দিক থেকেই হয়েছে। সুব্রতর বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছিলেন। তিনকূলে কেউ ছিল না সুব্রতর, এক দিদি ছাড়া। দিদি নয়নার বিয়ে হয়েছিল মফসসলের দিকে। উপরন্তু বিয়ের পর ওরা পাকাপাকিভাবে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা হয়ে যায়। কারণ, তার স্বামী অখিলের অফিস তাকে মুম্বাইয়ে বদলি করে। মুম্বাইয়ে যাওয়ার পরেই সুব্রতর উপরে বিয়ের জন্য চাপসৃষ্টি করা শুরু করে দেয় নয়না। স্বাভাবিক, দিদি হিসাবে তার গভীরতর চিন্তা ভাইকে নিয়ে। ভাইকে জীবনে সেটলড দেখলে  খুশি ও আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সুব্রতরও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও তার দরকার ছিল কয়েকটা বছর। সে অনেকবারই এ কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছে একাদিক্রমে নয়না ও অখিলকে। ওরাও অনড় ছিল। অখিল তো এমনও বলেছিল, ‘তোমার তো বাড়তি চিন্তা করার কিছু নেই সুব্রত! আমরা তো রইলাম!’

সুব্রত বলতে চেয়েছিল, ‘বউকে এনে তুলব কোথায়? এই ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়িতে?’

‘ভাঙাচোরা বাড়ি সারিয়ে নিলেই সুশ্রী হয়ে যাবে,’ অখিল সহজ সমাধান করে দিল।

‘কিন্তু, তা সত্ত্বেও কিছু হওয়ার নয় অখিলদা। একখানা মাত্র ঘর। তাও এইটুকু–!’

‘তাহলে অন্য একটা বাড়ি দ্যাখ! যত তাড়াতড়ি পারিস! আমি পাত্রী দেখা শুরু করি,’ কঠোর সিদ্ধান্তের মতো জানিয়ে দিয়েছিল নয়না।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সুব্রতর কান্না পেয়েছিল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়া মলিন ঘরের অবিন্যস্ত চেহারা দেখে সে ভেবে পাচ্ছিল না কোন স্পর্ধায় কোনও তরুণীকে এ বাড়িতে থাকতে সে বাধ্য করতে পারে! নতুন বাসা যে দেখবে, সেও অনেক টাকার ব্যাপার। সেলামি দিতে হবে। পুরোনো বাড়ির মতো পুরোনো ভাড়ায় থাকা যাবে না।

আলমারির লকার থেকে ব্যাংকের পাশবই বের করে সে নানারকম হিসেবনিকেশ করে দেখল। সঞ্চয় সামান্যই। তবু, সেটাকেই সম্বল করে সে একটি ভদ্রস্থ বাসাবাড়ির সন্ধান চালাতে থাকে। অখিল অবশ্য বলেছিল, ‘আজকাল কলকাতায় এঁদো গলিতেও কত ফ্ল্যাট উঠছে!’ সুব্রত এড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাট কিনতে হলে তাকে লোন নিতে হবে। কিন্তু এখনই ঋণের জালে জড়াতে রাজি নয় সে।

নতুন বাসাবাড়ি ঠিক করে অখিল আর নয়নার সঙ্গে অদিতিকে দেখতে গেছিল সুব্রত। অফিসের কাজ উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসেছিল অখিল। সঙ্গে নয়নাকেও নিয়ে এসেছিল। এক সন্ধ্যায় তারা গেছিল অদিতিদের বাড়িতে। শীতকাল। বড়ো রাস্তার হ্যালোজেনের নীচে মৌচাকের মতো কুয়াশা জমে আছে।

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার অদিতিদের। আড়ম্বর বিশেষ নেই। প্রথম দর্শনেই ধীর-স্থির, শান্ত, ভীরু চোখের মেয়েটিকে দেখে তার প্রতি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করেছিল সুব্রত। অখিলের ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল। সুব্রতর সম্মতি আছে দেখে, এখানেই সম্বন্ধ পাকা করে এসেছিল নয়না। বলেছিল, ‘তাহলে, আসছে ফাগুনেই চার হাত এক হয়ে যাক–!’

অদিতি এ বাড়িতে আসার পর, দৈনন্দিন জীবনের চেনা ছকটাই পালটে গেল সুব্রতর। সংসারের প্রতি, বাড়ির প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ, প্রতিদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরিয়ে আনত বাড়িতে। জীবন একটা নতুন ছন্দে বয়ে যেতে থাকল স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর মতো।

কিন্তু সেটা অন্তরের উন্মাদনা। তাদের নতুন পাড়ায় আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তাদের চোখের আড়ালে, যা সেই উন্মাদনার প্রাবল্যে কিছুদিন ঢাকা পড়ে রইল। উন্মাদনা কিঞ্চিৎ স্থিমিত হয়ে এল যেদিন, সেদিন থেকে চোখে পড়তে থাকল বাহিরের আসল চিত্রটা। তখনই চারপাশের পরিবেশটা যেন দীর্ঘ এক অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরতে থাকল তাদেরকে, এমনকী তাদের সম্পর্কের সারল্য, নিরাপত্তা আর নৈকট্যকেও।

একদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাদের বাসার ঠিক সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষের অশালীন ঝগড়া শুনল সুব্রত। আর-একদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরতে অদিতি জানাল, পাড়ায় বোমা পড়েছে। একদিন গভীর রাতে তারা শ্বাস চেপে রেখে শুনল, পুলিশের জিপ আসার আওয়াজ। তার কিছুক্ষণ পরেই দ্রুত কিছু পায়ের দৌড়ে যাওয়া, চাপা গলায় চিৎকার। পরদিন সকালে শোনা গেল, কয়েক গ্যালন দেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে। নিত্যদিন এমনই চলতে থাকল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অদিতির কাছে পাড়া সম্পর্কে এক-একটি নতুন কাহিনি শুনতে থাকল সুব্রত। শেষে একদিন অত্যন্ত অসহিষ্ণু গলায় অদিতি প্রশ্ন করল, ‘আমি তোমার স্ত্রী তো, নাকি?’

‘হঠাৎ এমন অদ্ভুত প্রশ্ন?’

‘বলো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও–!’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!’

‘এবার বলো, কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এরকম একটা অসুরক্ষিত জায়গায় সারাদিনের জন্য একা রেখে চলে যায়?’ অদিতির চোখের কোলে অভিমানে টলমল করে জল।

সুব্রত খুব অসহায় হয়ে যায়। সহজে কোনও উত্তর দিতে পারে না। কতবার সে অধৈর্য হয়ে ভেবেছে অদিতিকে বলবে, ‘তুমি তাহলে আপাতত সেই মফসসল শহরে তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকো। এখানে একটা ভালো বাড়ি পেলে, তোমাকে নিয়ে আসব।’

কিন্তু বাক্যগুলো শেষপর্যন্ত জিভ থেকে ঠোঁটের গোড়ায় আসেনি। কেন-না, এই সাময়িক বিরহের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাকে তার সহকর্মীরাও বলেছে, কলকাতা শহরে এ ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া মুখের কথা নয়। এই অবস্থায় কোন মুখে অদিতিকে সে বাপেরবাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে?

এইসব চিন্তাভাবনা তাকে তিষ্ঠোতে দেয় না। অফিসের কাজেও মন বসে না তার। অনেকেই তার মধ্যে এই উন্মনা ভাবটা লক্ষ করেছে। সেদিন তার সহকর্মী অয়ন তাকে রীতিমতো চেপে ধরল, ‘কী হয়েছে তোর?’

‘কই, কিছু না তো!’

‘কিছু তো হয়েছেই। তোকে এত আনমনা আগে কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই কিছ লুকোচ্ছিস!’

সুব্রত খানিকটা বাধ্য হয়েই সব কথা খুলে বলে। অয়ন সব শুনে গম্ভীর হল। খানিকক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘এটা তো ঠিক-ই কলকাতা শহরে ভাড়াবাড়ি পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর। চতুর্দিকে সব ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। রেস্ত থাকলে কিনে নাও। না হলে একটা ভালো পাড়ায় কোনও ভদ্র গৃহস্থের বাড়ির একচিলতে ঘরের জন্য মাথা কুটে মরো!’

এসবই সুব্রত জানে। তবু অয়নের কথা শুনে যায়। শেষে অয়ন আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল।

‘ঠিক কলকাতা শহরের মধ্যে না, একটু দূরে যাবি? এই ধর, বাসে করে অফিস পৌঁছোতে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট লাগবে!’

‘সে তো অনেক দূর!

‘দূর হলেই বা, শান্তি আছে। ওখানে আমার মামার বাড়ি। শরিকি বাড়ি। দিদিমা যে-অংশটায় থাকত, দিদিমা মারা যাওয়ার পরে সে অংশটা ফাঁকাই। দুটো বড়ো ঘর। রান্নাঘর। বাথরুম। রাজি থাকলে বল, কথা বলি!

সুব্রত মাথা চুলকে বলল, ‘একটু গ্রামের দিক হয়ে গেল না?’

‘গ্রাম?’ অয়ন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘গ্রাম কী রে? আগে ছিল মফসসল। এখন রীতিমতো শহর। কলকাতা শহরটা ক্রমশ ওদিকে বাড়ছে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে গোল গোল তরঙ্গ হতে দেখেছিস? ঠিক ওরকম করে বৃত্ত বড়ো হচ্ছে। মূল শহরে তারাই থাকবে, যাদের ট্যাঁকের জোর আছে, বুঝলি? আর, আমাদের মতো হাভাতেরা সেই তরঙ্গের ঘাড়ে চেপে ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে নতুন বৃত্ত তৈরি করে। ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট, বস্!’

অদিতিকে বলতে সে লাফিয়ে উঠল। সে মফসসলেরই মেয়ে। তার তো খুশি হওয়ারই কথা। তার দুটো গয়না বাঁধা দিতেই হল। নইলে সেলামির টাকাটা জোটানো যাচ্ছিল ন।

ওরা উঠে এল নতুন বাসায়। পুরোনো বাড়ি। কিন্তু অনেকটা জায়গা নিয়ে। পিছনের দিকে বেশকিছু গাছগাছালিও আছে। সুব্রত বলল, ‘নাও, এবার খুশি তো? এখানে আর দিনদুপুরে খুনখারাবির প্রশ্ন নেই। কত ভদ্র পাড়া!’

অদিতি আকর্ণ হেসে বলল, ‘সত্যি!’

তবে সুব্রতকে ইদানীং একটু তাড়াতাড়িই অফিসে বের হতে হয়। অনেকটা রাস্তা। আগে থেকে বোঝা যায় না, কখন যানজট হবে! ফিরতেও আগের তুলনায় রাত হয়। সেসবই হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সুব্রত।

দেখতে দেখতে নতুন বাসায় দু-মাস কেটে গেল তাদের। ভরা বর্ষায় তাদের ভাগের কিচেন গার্ডেনে লকলকিয়ে উঠল লাউগাছ। সুব্রত এক রবিবার বাঁশের কঞ্চি কেটে মাচা বানিয়ে দিল।

মরশুমের শেষ বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। ছাতা মাথায় আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে সদর দরজার কড়া নাড়তেই হাট করে খুলে গেল দরজাটা। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল অদিতি। লোডশেডিং হওয়ায় তার অবয়বটা শুধু আন্দাজ করতে পারছিল সুব্রত। তাতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

অদিতি বলল, ‘ওগো, আমরা আবার একটা খারাপ জায়গায় চলে এসেছি।’

‘মানে?’

‘আজ এ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’

‘কেন?’

‘পাশের বাড়িতে অনেকদিন ধরে নাকি মধুচক্র চলে। কলকাতার বেশ কিছু রাঘব বোয়ালের এখানে যাতায়াত। আজ পুলিশ এসে সবকটাকে হাতেনাতে ধরেছে। সব বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে, মা গো। কী নোংরা, কী নোংরা…!’

বলতে বলতে আন্ধকারের বুক চিরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অদিতি। আকাশটা ভেঙেচুরে গিয়ে উথালপাতাল বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুব্রত। অনুভূতিহীন। বৃষ্টির ধারাল ফোঁটাগুলি চৌবাচ্চার জলে লাফিয়ে পড়ছে। জমা জলে হুটোপুটি করছে। জলের তরঙ্গে বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। একটার পরে আর-একটা।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব