পরিতোষের সিদ্ধান্ত শেষ পর্ব

পরিতোষ শান্ত গলায় পূর্ণিমাকে জবাব দিলেন ‘মেয়ের বিয়ে দেব, বেচব না।’ পূর্ণিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘মেয়ের বিয়েতে কোন বাবা না খরচ করে? তুমি কী রকম মানুষ!’ পরিতোষ উঠে চলে গেলেও পূর্ণিমা একা বসে কাঁদতেই থাকলেন। হঠাৎ কাঁধে মৃদু চাপ পড়তেই ঘুরে দেখলেন পাপিয়া-কে। মায়ের হাত ধরে নরম গলায় সে বলল, ‘মা বাবা তো ঠিকই করেছে, তুমি কাঁদছ কেন? আমার শিক্ষাদীক্ষার কি কোনও দাম নেই? তুমি চিন্তা করো না, আমার জীবনসঙ্গী আমি নিজেই খুঁজে নেব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।’ মেয়ের আশ্বাসবাণীতেও মা শান্ত হলেন না, নিজের মনেই কেঁদে চললেন।

এরপর ছ’মাস কেটে গেছে। একদিন বিকেলে পাপিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি এল, মা-বাবা দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। পাপিয়া হেসে বললো, ‘আজ তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম। এসো অমৃত, ভেতরে এসো।’

পূর্ণিমা-পরিতোষ দুজনেই দরজার দিকে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন সুগঠিত চেহারার মানুষ। বয়সটা পাপিয়ার তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। পরিচয় পর্বের পর জানা গেল লোকটি পাপিয়ার থেকে অন্তত বারো তেরো বছরের বড়ো এবং সে দক্ষিণ ভারতীয়। অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে পূর্ণিমা পাপিয়াকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বকুনির স্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি করছিস তুই! ছেলেটি আমাদের স্বজাতি নয়, তোর থেকে এত বড়ো এমন একজনকে তুই ভালোবাসিস!’

‘মা!’ পূর্ণিমার হাতটা চেপে ধরল পাপিয়া। ‘কী আসে যায়, অমৃত খুবই মেধাবী ছেলে, ও বিজ্ঞানী। আজকাল নর্থ-ইন্ডিয়ান, সাউথ-ইন্ডিয়ানে কিছু এসে যায় না। আমরা কি ইডলি-ধোসা খাই না, হোটেলে গিয়ে রসম-ভাত খাই না? অমৃত তো রাজমা-অড়হড় ডাল-ভাত বেশ পছন্দ করে। আলুর পরোটা ওরও খুব প্রিয়, তোমারও প্রিয়, মা। আমরা দুজনে দুজনকে বুঝি, ভালোবাসি। আমি সারা জীবন ওর সঙ্গে সুখে থাকব। তুমি বাধা দিও না।’ বলতে বলতে পাপিয়ার দু’চোখে জল ভরে উঠল।

‘তোর সুখই আমার কাছে সব থেকে বড়ো পাওয়া, তুই যা ভালো বুঝিস কর মা, আমার কিছুই বলার নেই।’ পাপিয়া চোখের জল মুছে হাসতে হাসতে মাকে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখল, বাবা আর অমৃত দুজনে খোসগল্পে মেতেছে। সেদিন রাতে অমৃত ওদের বাড়িতে খেয়ে গেল, বেশ তৃপ্তি করে। পূর্ণিমা-পরিতোষ বেশ খুশি হল অমৃতর ব্যবহারে।

এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই পাপিয়া-অমৃতর রেজিস্ট্রি হয়ে গেল! ছোট্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। পিকলু আসতে পারেনি। এজন্য সে দারুণ আপসোস করে দিদিকে ‘মেল’ পাঠিয়েছে। বলেছে সে ফিরে এলে আবার অনুষ্ঠান হবে। পূর্ণিমা একটু নিমরাজি ছিলেন বিয়ের তেমন ঘটা না হওয়ার জন্য কিন্তু অমৃতই বুঝিয়েছিল ‘শুধু শুধু খরচা করার কোনও মানে হয় না।’ পরিতোষ কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত এমন জামাই পেয়ে। সময় পেলেই অমৃতকে নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যান। পাপুও তাই।

আস্তে আস্তে অমৃত-পাপিয়ার যাওয়া আসা এ বাড়িতে কমে গেল। কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সকলের। এক বছরের মধ্যে পাপুও অন্য চাকরি নিয়ে পিকলুর কাছে চলে গেল সপরিবারে। চার বছরের কনট্রাক্ট। বাড়িটা একদম ফাঁকা। পরিতোষ চুপচাপ থাকেন, পূর্ণিমারও একইরকম অবস্থা। বাড়িটা যেন খাঁ-খাঁ করছে। একসময় বাড়িটা ভরে থাকত। তিন ভাইবোনের হাসি ঝগড়া কান্নায়। বিশেষ করে পিকলুর। সবার ছোটো, অল্পেতেই বায়না। পাপু সব সময় পিকলুর পক্ষ নিত। দু’ভাই একদিকে, তো পাপিয়া একা। বেশ ছিল দিনগুলো। পরিতোষ না বুঝেই মেয়ের পক্ষ নিতো। কি হইচই আনন্দের দিন ছিল সেগুলো। একবার বেশ মনে আছে পূর্ণিমার, দুই ভাইয়ে কোথা থেকে ক’টা পেয়ারা নিয়ে এসেছে, বোধহয় রতনদাদের বাগান থেকে, এনে বাপ-ব্যাটারা মিলে সব খেয়ে নিয়েছিল হঠাৎ পাপিয়া হাজির। দেখেই চিৎকার, ‘আমার ভাগ কই?’ সবাই মুখ মুছে চুপচাপ। পাপিয়া ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নালিশ জানাতেই, পূর্ণিমা খুন্তি হাতে দুই ছেলের দিকে ছুটে গেলেন। পিকলু ছুটে পালাতে পালাতে জানাল ‘বাবা দুটো পেয়ারা খেয়েছে।’ রেগে পরিতোষের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন পূর্ণিমা। বেচারা মাথা হেঁট করে বলির পাঁঠার মতো বসে আছে। সেবার পাপিয়া অভিমানে দু-তিন দিন বোধহয় বাবার সাথে কথা বলেনি। সেদিন রাতেই অবশ্য পরিতোষ মেয়ের মান ভাঙাতে একটা নতুন গল্পের বই কিনে এনেছিলেন। পাপিয়া ছুঁয়েও দেখেনি। সে রাত কাটলেও পরের দিনও পাপিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলেনি, তখন দু’ভাই বেশ ভড়কে গিয়েছিল। চুপচাপ দুজনে দুটো পেয়ারা এনে দিয়েছিল। বাপরে কি জেদ ছিল মেয়ের। দেখতে বেশ শান্ত কিন্তু দারুণ একরোখা। কত সুখ-স্মৃতি।

আচমকা একদিন, পরিতোষ-পূর্ণিমা রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন পূর্ণিমা সকালে উঠে অবাক! পরিতোষ রোজ মর্নিংওয়াক করতে যান, আজ কী হল! এত ঘুমোচ্ছেন কেন?

‘তোমার হলো কী! শরীর খারাপ নাকি?’ সাড়া না পেয়ে এবার একটু ধাক্বা দিতেই মানুষটার মাথাটা এক পাশে হেলে পড়ল।

পাপিয়া-অমৃত এল। ছেলেরা কেউ আসতে পারল না বাবার শেষকৃত্যে। পাপিয়ারা কয়েকদিন মায়ের কাছে থেকে গেল। দিন-দিন বাড়িটা যেন পূর্ণিমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। পরিতোষের মৃত্যুর মাস চারেক পর পূর্ণিমা ছেলেদের আইএসডি করে খবর পাঠালেন একবার অন্তত তারা যেন আসে। এই বাড়ির কোনও ব্যবস্থা করতে হবে। যে যার সম্পত্তির ভাগ যেন বুঝে নেয়। পাপু-পিকলু সোজাসাপটা বলল, ‘মা আমরা দু’ভাই কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই। তুমি তোমার ইচ্ছামতো বাড়ি কোনও অনাথালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করো। তুমি চলে এসো। বাবার আত্মা শান্তি পাবে।’

পূর্ণিমার দুচোখে জল। পরিতোষের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো, যে-সম্পত্তির জন্য তুমি ছেলেদের দূরে পাঠালে, যে টাকাপয়সা তুমি কাউকে দিলে না, নিজের ভবিষ্যতের জন্য ভয় পেলে, সেই পয়সা আজ কারুর কাজে লাগল না। ছেলেরা শুধু মাকেই চায়। সময় বড়ো কম। আমি চলে যাব, আমি ওদের কাছেই থাকব। সব দিয়ে দেব গরিবদের। আমার সন্তানরা আমারই।’

পরিতোষের সিদ্ধান্ত পর্ব-১

পরিতোষের ধৈর্য এত কমে যাচ্ছে! পূর্ণিমা বেশ বিরক্তই হচ্ছেন মাঝেমধ্যে। সকালবেলা এত কীসের হাঁকডাক? বেশ তো চায়ের কাপ, খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে, তবু ‘পূর্ণিমা, পূর্ণিমা’। রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরোতে না বেরোতেই মুখোমুখি পরিতোষের। পূর্ণিমা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর মুখের দিকে। ‘দ্যাখো দ্যাখো কী লিখেছে! সম্পত্তির জন্য ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে খুন করিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। কুপুত্তুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব কবুল করেছে। বুঝেছ, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ পূর্ণিমাকে পড়ে শোনানোর পরই পরিতোষ কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর নিজেরও তিন ছেলেমেয়ে।

‘আরে বাবা এত ভাবাভাবির কী আছে। কোন কালচারের লোকজন এমন করেছে সেটা তো দেখবে। শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেটাও তো ভাবা উচিত।’ পরিতোষ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ‘থামো তো, বলছি বাড়ি সম্পত্তি অর্থাৎ নিশ্চিত ভাবে বড়োলোক! তাছাড়া এমবিএ করেছে ছেলে, বিদেশ থেকে।’ বলতে বলতে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন। পূর্ণিমা তাই দেখে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললেন ‘কাগজে কি পড়ার আর কিছুই থাকে না? খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, তা না যত্তসব আজে বাজে খবরে আগে দৃষ্টি যায়! আর ক’দিন বাদেই তোমার রিটায়ারমেন্ট। নিজের বাড়ি-বউ-ছেলেমেয়ে, পেনশনের মোটা টাকা— তোমার ভাবনা বা দুশ্চিন্তা কেন হয়? কী চাও তুমি?’

পরিতোষ আবার এক ঢোঁক জল খেয়ে বললেন ‘এক পয়সাও আর কাউকে দেব না। ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছি, এবার নিজেরা বুঝে নিক।’ পূর্ণিমা চমকে উঠলেন ‘কী বলছ। পাপুর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। দু’দিন পরে মেয়ে অর্থাৎ পাপিয়ার বিয়ে। আর কয়েকদিন আগেই তো পিকলু বলছিল আরও পড়বে।’ ‘ব্যস— চুপ। যথেষ্ট পড়িয়েছি, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এবার যা করার নিজের টাকায় করো। আমার পেনশনের এক নয়া পয়সাও কাউকে দেব না।’ পরিতোষ উঠে বাইরে হাঁটা দিলেন।

আজ সকাল থেকে পরিতোষের মন ভালো নেই। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়ে দেখেন রতন চুপচাপ বসে আছে। খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করায় হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল, ছেলে বলেছে, তারা চাকরির জায়গায় চলে যাচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দু’কামরার ছোটো অফিস-ফ্ল্যাটে খুবই অসুবিধা হয় বেশি লোক হলে। ছেলের এটুকু কথাতেই রতন বুঝে নিয়েছে ছেলে-বউ কী বলতে চাইছে। জমানো টাকা যেটুকু ছিল স্ত্রী-র অসুখে বেরিয়ে গেছে, চাকরির কোনও পেনশন নেই। নিজের বাড়ি ছিল। বন্ধক রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল, মানুষ হবে বলে। হায়রে!

রতনের মুখে ওই ঘটনা শুনে এবং বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে পরিতোষের মনমেজাজ সবই তিরিক্ষে হয়ে গেল। সেই যে বাসের পিছনে একবার লেখা দেখেছিলেন ‘টাকা আপন, সবই পর টাকার টুঁটি চেপে ধর’, সেদিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন দেশটা উচ্ছন্নে গেল! আজ চকিতে মনে পড়ে গেল সে কথা। ওই কথাগুলোই ঠিক। পূর্ণিমা জানতেন পরিতোষ একবার যা ভেবে নিয়েছেন তা-ই করবেন। গত রাতে পিকলু আবদার করেই বলেছিল, ‘বাবা, স্পনসরশিপের টাকাতেই বিদেশ যাব। কিন্তু আরও অন্যান্য খরচার জন্য টাকা লাগবে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার। তারপর সব টাকা সুদে-আসলে আমাদের ঘরেই আসবে। পিকলু থামল, বাবার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকাল। তারপর মা’র দিকে। মায়ের চাহনি দ্বিধাবিভক্ত। পিকলু বুদ্ধিমান ছেলে। যা বোঝার সে বুঝে নিল।

রাতের সব কাজ সেরে পরিতোষের পাশে বসে পূর্ণিমা বেশ অভিমান করে বললেন ‘কী হয়েছে তোমার? যদি ছেলেদের সাথে এমন ব্যবহার করো, তাহলে সংসার টিঁকবে কী করে? রাতে টেবিলেও এলে না। ছেলেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। দিন রাত কী ভাবছ?’ পরিতোষ ধীর-ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন ‘আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি, অপেক্ষায় ছিল আমি টাকা দেব কিনা সেটা জানার জন্য।’ অবাক পূর্ণিমা তাকালেন স্বামীর দিকে। এ মানুষটাকে তিনি চেনেন না! এ কোন পরিতোষ! কি হলটা কী!

পরের দিন সকালে খাবার টেবিলে বসেই পাপু জিজ্ঞাসা করল পিকলুর কথা— টাকার কথা। পূর্ণিমা চুপ। আবার প্রশ্ন করতে পিকলুই ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘দাদা চুপ কর।’

‘চুপ করব কেন? তোর বিদেশ যাওয়া হবে না? টাকার জন্য আটকে যাবি?’

পরিতোষ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন ‘ইঞ্জিনিয়ার করে দিয়েছি। তোমাদের দুজনের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। আর নয়। এবার যা করবে, তা নিজেরাই করো।’ পিকলু মাথা হেঁট করে পাউরুটি চিবোতে থাকল। পাপু বেশ থতমত খেয়ে গেল বাবার এই আচরণে। নীচু স্বরে বলল সে, ‘আমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়া টাকার জন্য আটকে যাবে? এ হতে পারে না। আমি দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়।’ পরিতোষ তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। নিজের মনেই, অথচ সবাই যেন শুনতে পায়, এমন স্বরে বলে চলে গেলেন, আমি কারুর কাছ থেকে কিছু আশা করি না, কেউ যেন আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা না করে। সবাইকে বড়ো করে দিয়েছি, মানুষ করেছি, আর নয়।’

‘মা, বাবার আজকাল কী হয়েছে?’ পিকলুর প্রশ্ন শুনে পূর্ণিমা ঘুরে তাকালেন, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। ‘জানি না, কী যে হয়েছে, বুঝি না। কাল রাতে শোবার সময় বললেন ‘পূর্ণিমা, আর টাকাপয়সা কাউকে নয়। সব নিজেদের নিজেদের,’ বলে শুয়ে পড়লেন।

‘কি! আমরা বাবার টাকা নেব? ভাই-বোন, ছোটো থেকে এক সাথে বড়ো হওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সব কিছুতেই যে তোমরা মা। বাবা কি বোঝে না! আমি তো এই বাবাকে চিনতেই পারছি না’, পাপু উঠে চলে গেল। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার দোষ কোথায়? দিনরাত কাগজে-টিভিতে খবর– সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে হেনস্তা, কখনও খুন। আকছার এমন খবর পড়া-শোনা-দেখার পর বৃদ্ধ, পেনশনভোগি মানুষটা নিজেকে কতটা ঠিক রাখতে পারে? চোখের সামনে রতন জ্যাঠার ছেলেটাকে দ্যাখো। কত ভালো মানুষ রতন জ্যাঠা, তার ছেলের এই ব্যবহার! বাবা তো ভয় পাবেই, এমন ঘটনা শুনে।’

পরের মাসেই পিকলু চলে গেল বিদেশে। বোন পাপিয়াও ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে খুশি। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই সকালে বেরিয়ে বাড়ি আসতে আসতে প্রায়দিনই আটটা বেজে যায়। এ নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মন কষাকষি হয়। পাপিয়া মাকে বুঝিয়েও হাল ছেড়ে দেয়, এখন অফিসে সকাল ন’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতেই হয়। তারপর ওভারটাইম থাকলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সারাদিন একা একা থাকতে হয় তাঁকে। একদিন রাতে পরিতোষের কাছে পূর্ণিমা কথাটা পাড়লেন, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কি চিন্তাভাবনা করছ? বয়স বাড়ছে। চাকরি করছে, এবার খোঁজখবর শুরু করো।’ পরিতোষ শুনলেন চুপচাপ।

দিনকয়েক পরে এক রাতে খাবার টেবিলে পরিতোষ সবাইকে জানালেন, ‘কাল পাপিয়াকে দেখতে আসবে,’ পাপিয়া বেশ অবাক হয়ে গেলেও বাবাকে কিছু বলল না। পরে মাকে বলল, ‘বেশি আয়োজন করো না। প্রথমবার দেখতে আসছে, চা, বিস্কুট দিলেই হবে। মা হেসে কিছুই বললেন না। মেয়ে অফিস গেলে নিজেই বসে গেলেন মিষ্টি তৈরি করতে। গোলাপজাম, নারকেল বরফি, নিমকি, সিঙাড়া, কাটলেট আর পনির মানচুরিয়ান। এছাড়া ঘরে জলজিরার শরবত তো আছেই।

সন্ধ্যায় যথা সময়ে পাত্রপক্ষ হাজির হলেন পরিতোষের বাড়িতে। পাত্র প্রমোদ বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। সঙ্গে এসেছেন মা সৌদামিনী। বসামাত্রই সৌদামিনী শুরু করে দিলেন তাঁর ছেলের প্রশংসা। ছেলেকে সিএ তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে, তার হিসেবও তিনি দিতে ভুললেন না। পরিতোষ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘এগুলো তো সব মা-বাবারই কর্তব্য, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যতটা প্রয়োজন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। আপনি টাকা-পয়সার কথা কী যেন বলছিলেন?’ প্রমোদের মা বেশ হকচকিয়ে গেলেন পরিতোষের কথা এবং গলার গম্ভীর স্বর শুনে। পরিতোষ না থেমেই বলে উঠলেন ‘আমার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি কোনও পণ, মানে টাকা পয়সার লেনদেনের কথা আপনারা বলেন, তাহলে এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’ ব্যস কথাবার্তার এখানেই ইতি। পূর্ণিমা স্বামীকে একলা পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ‘কী ভেবেছ তুমি, এভাবে পাত্রপক্ষকে বললে কেউ কি আর বিয়ের কথা এগোবে!’

দার্জিলিং

দুপুর একটা পঞ্চান্নর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চেপে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে দার্জিলিং। এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ট্রেনটা ওরা মিস করল।

তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুবিমল। ঘুম ভেঙেছিল মোবাইলের রিংটোনে। ফোন ধরতেই মায়ার গলা, কোথায় আছেন? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি, ফোন ধরছেন না কেন?

এই আসছি, ট্রেন তো এখনি ঢুকবে!

ব্যাগ গোছানোই ছিল। তাড়াহুড়ো করে দরজায় তালা দিয়ে বেরোয় সুবিমল। টোটো ধরে স্টেশন। মায়া তার মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কোনওমতে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ওরা দেখে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। একা থাকলে লাফিয়ে উঠে পড়ত সুবিমল। কিন্তু মায়া আর দিয়াকে নিয়ে তো সেটা সম্ভব নয়।

এবার কী হবে? মায়ার গলা কাঁদো কাঁদো শোনায়।

এনকোয়ারিতে গিয়ে ওরা জানল চারটের আগে আর শিলিগুড়ির দিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই। তার মানে আরও দুঘন্টা স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সুবিমল বলল, চলো ফিরেই যাই। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। বলে, আমায় নিয়ে আপনি দার্জিলিং যেতে চান না তাই তো?

এরকম ভাবছ কেন? আসলে ট্রেন পেতে দেরি হলে শিলিগুড়ি যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আর তখন হোটেল-টোটেল পাব কিনা…

হোটেল না পেলে স্টেশনে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব। কিন্তু বেরিয়েছি যখন যাবই! সুবিমলকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল মায়া, দার্জিলিং নিয়ে কত কথা বললেন। কম্পিউটারে ছবি দেখালেন। আর এখন যেতে চাইছেন না?

দার্জিলিং-এর কথাটা বলতেই মায়ার মুখটা কেমন নরম হয়ে গেল আর চোখদুটো চকচক করে ওঠে, একটা কষ্ট অনুভব করল সুবিমল। বেচারি! কখনও দূরে কোথাও যায়নি। কিছু দেখেনি। পাহাড়, সমুদ্র কিছু না। কেউ নিয়ে যাবার নেই!

আচ্ছা মা, দার্জিলিং-এ তো এখন খুব ঠান্ডা তাই না? পাশ থেকে দিয়া বলে।

সেটা তোর কাকুকেই জিজ্ঞেস কর না।

আঃ তুমিই বলো না। ওখানে কি এখন বরফ পড়ছে? কী মজা!

মেলা বকিস না তো। এখন যাওয়া হবে কিনা তারই ঠিক নেই, আর ইনি চোখে বরফ দেখছেন।

বকুনি খেয়ে একটু চুপ করে যায় মেয়েটা। একটু পরেই আবার বলে, আমি কিন্তু দার্জিলিং গিয়ে টয়ট্রেনে চড়ব।

হ্যাঁ, তুমি টয়ট্রেন চাপবে! কত টাকা টিকিট লাগবে জানিস? তুই দিবি?

টয়ট্রেনের ছবি দেখিয়েছিল সুবিমল কিন্তু তার টিকিট-ফেয়ার নিয়ে কিছু বলেনি। সে নিজেও ঠিক জানে না। তবে মায়া হয়তো ধরেই নিয়েছে, এত সুন্দর দেখতে একটা ট্রেনে উঠতে অনেক টাকা লেগে যাবে। এসব কথা হতে হতেই একটা ট্রেন চলে এল।

পুরি-কামাখ্যা এক্সপ্রেস।

মায়া তড়িঘড়ি বলল, দেখুন না, এই ট্রেনটা শিলিগুড়ি যাচ্ছে কিনা?

এখন তো ওদিকে যাবার কোনও ট্রেন নেই, শুনলে না?

আঃ দেখুনই না একবার।

কী মনে করে সুবিমল সিট ছেড়ে এগোয়। ট্রেনের জানলার ধারে বসে থাকা একজন প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে। লোকটা হিন্দিতে জবাব দেয়, শিলিগুড়ি যায়েগে কেয়া নহি জানতে, পর ইয়ে এনজিপি যায়েগা।

এনজেপি মানে নিউ জলপাইগুড়ি। শিলিগুড়ির আগের স্টেশন। ওখান থেকেও তো দার্জিলিং যাওয়া যায়! মায়া ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সুবিমল ব্যস্ত হয়ে বলে, চলো চলো এটা যাবে। মালপত্র নিয়ে ছুটতে ছুটতে ওরা সামনের কামরাটাতে উঠে পড়তেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

এনকোয়ারির লোকটা এই ট্রেনটার কথা বললই না। ভাবো এরা কি জন্যে যে চাকরি করে, সুবিমল সিটে বসতে বসতেই বলে।

দেখলেন তো, আমার কথা শুনলেন বলেই… মায়ার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। জানলার পাশে দিয়াকে বসিয়ে সে নিজেও বসেছে। কামরা একদম ফাঁকা। রিজার্ভেশন হয়নি বলে আসতে চাইছিলেন না। এখন দেখুন শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। আমার বেড়াবার ভাগ্য কী ভালো।

সুবিমল ঘর থেকে তিনটে বড়ো বড়ো ক্ষীরসাপাতি আম আর লিচু নিয়ে এসেছে। বার করল সেগুলো। ট্রেনে উঠলেই তার খিদে পায়, কেন কে জানে!

নাও আমগুলো কাটো। লিচু খাও।

আম কেটে, টিফিনবাটির ঢাকনায় তুলে প্রথমেই সুবিমলের দিকে এগিয়ে দেয় মায়া। তারপর মেয়েকে দিয়ে নিজেও নেয়। সিটের ওপর পা তুলে গুছিয়ে বসে, আম খায়।

আঃ পাটা নামিয়ে বসো না, সুবিমল বলে।

কেন, কী হয়েছে?

সুবিমল আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। কেন যে আসতে গেল এদের সাথে। নোংরা পা দুটো একেবারে সিটের ওপর তুলে বসল। যেন ঘরের বিছানা! কম শিক্ষিত হলে যা হয়। এই যে, আবার পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলা হচ্ছে জানলা দিয়ে। এত থুতু আসে কী করে মুখে ও বুঝে পায় না!  দিয়ার ওপর চোখ পড়তেই মাথা আবার গরম হয় সুবিমলের। কালো মুখে রং মেখেছে!

দার্জিলিং-এর ছবিগুলো আবার দেখান না, আবদারের সুরে বলে মায়া।

সুবিমল বিরস মুখে ব্যাগ খুলে তার ল্যাপটপটা বার করে, সুউচ অন করে। মোডেম লাগায়। ইউ টিউব চালায়।

ওই তো টয়ট্রেন, লাফিয়ে ওঠে দিয়া।

চিৎকার করছিস কেন? মেয়ের দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া। দিয়ার মুখ শুকনো হয়ে যায়।

টয়ট্রেন ততক্ষণে ঘুম স্টেশনে এসে থেমেছে। কুয়াশায় আবছা দেখা যাচ্ছে। এবার দার্জিলিং-এর বাজার দেখাচ্ছে নেপালি মেয়েটা, রংবেরং-এর উলের পোশাক বিক্রি করছে। দোকানে দোকানে কত জিনিস সাজানো, নীল সবুজ পাথরের মূর্তি। বাজার ছেড়ে পথ ওপরে উঠছে। এবার ম্যালে এসে থামল।

কী চমৎকার জায়গাটা। এটাই তো বলেছিলেন মল। তাই না?

মল নয়, ম্যাল সুবিমল হাসে।

ওঃ ম্যাল। লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকায় মায়া। তারপর বলে, আপনি বলেছিলেন না, ম্যালে গেলে কোনও না কোনও পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে যাবেই।

হ্যাঁ, লোকে তো সেরকমই বলে, একটু অন্যমনস্ক হয় সুবিমল। আমি যখন খুব ছোটোবেলায় মা বাবার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, ম্যালে গিয়ে মনে আছে একজন দূর সম্পর্কের রিলেটিভ মানে আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে গেছিল। পরে আর কখনও ওনাকে দেখিনি। এখনও মনে আছে, উনি আমাকে গাল টিপে আদর করেছিলেন, ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন।

আমিও ম্যালে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ব।

সুবিমলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত হয়ে সে দিয়ার দিকে তাকায়।

আঃ কতবার তোকে বলেছি, কথার মাঝখানে কথা বলবি না। দেব কানপাট্টিতে এক থাপ্পড়। তারপর বলুন না কী হয়েছিল?

সুবিমলের মনে তখন অন্য একটা চিন্তা জন্ম নিয়েছে। ম্যালে গিয়ে যদি… ম্যালে তো যেতেই হবে। গিয়ে যদি আবার কোনও আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় অথবা তারই স্কুলের কোনও কলিগের সাথে! তখন সে কী করবে। কী পরিচয় দেবে মায়ার আর মায়ার মেয়ে। কী বলবে সে?

কী হল, কী ভাবছেন?

কিছু না লিচুর খোসা ছাড়ায় সুবিমল।

এসব কথা বলতে বলতে ওরা যখন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোল তখন রাত আটটা বাজে।

ট্রেন থেকে নেমেই দিয়া বলল, মা দেখেছ, কত্ত বড়ো স্টেশন! সঙ্গে বেশি টাকা আনেনি সুবিমল। স্টেশনের পাশে একটা ছোটো দেখে হোটেলেই ওঠে।

হোটেল মালিক টাকা নিয়ে খাতা খুলে সুবিমলকে সই করাল। তারপর বলল, আপনাদের আধার কার্ডটা দেখাবেন। মায়ার কার্ডটা দেখে বলল, আপনার পদবি তো দেখছি দাস আর ওনার ভট্টাচার্জি।

সুবিমল বুঝতে পারল না লোকটা কি বলতে চাইছে। কিন্তু মায়া একবার সুবিমলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা বাবার নামে করেছিলাম তো। বিয়ে পর আর পালটানো হয়নি।

আপনারা সত্যিই ম্যারেড তো?

কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে বুঝি?

সুবিমল বলল, রেজিস্ট্রি পেপার দেখাতে হবে?

না, না, ঠিক আছে। আচ্ছা আপনারা ঘরে যান।

ঘরে গিয়ে ওরা আর বসল না। মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল যত সকাল সকাল বেরোনো যায় ততই ভালো।

ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছেই অনেকগুলো খাবার হোটেল। তারই একটায় ঢুকে ওরা বসে। সুবিমল মাছ ভাত বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়া বলল ডিম ভাত নিতে। খরচ যেটুকু বাঁচানো যায়।

রাতে বিছানায় শুয়ে ওদের চোখে ঘুম আসে না। মায়া আর সুবিমলের মাঝে দিয়া শুয়েছে। সে বলে, মা ঘুম পাচ্ছে না। একটা গল্প বলো না। ওই দুষ্টু শেয়ালের গল্পটা।

হ্যাঁ, আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তোকে এখন গল্প বলব। চুপ করে ঘুমো। ভোর ভোর উঠতে হবে।

না, বলো না একটা।

মায়া কী ভেবে বলে, তোর কাকুকে বল। কাকু অনেক ভালো ভালো গল্প জানে।

অন্ধকারের মধ্যেই সুবিমলকে উদ্দ্যেশ্যে করে সে বলে, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে? নাহলে ওকে একটা গল্প বলুন না। আমিও শুনব।

সুবিমল ভাবছিল, দিয়া এখন সঙ্গে না থাকলে কত ভালো হতো। মায়াকে এখন সে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারত। বদমাইস মেয়েটা একেবারে তাদের মাঝখানে এসে শুয়েছে। মায়া বলেছিল একপাশে শুতে। কিন্তু শুনলে তো! তবে এটাও মনে হয়েছে ওর, দিয়া সঙ্গে না থাকলে হয়তো হোটেলে ঘর পেতে অসুবিধে হতো। ও আছে বলেই সবাই ওদের একটা পরিবার বলে ধরে নিচ্ছে। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের মেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। মনটা হঠাৎই জ্বালা করে ওঠে সুবিমলের। পরিবার! সত্যিই কি কোনও দিন তার নিজস্ব পরিবার হবে? তার নিজের সন্তান, তার নিজের বউ। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেল। আর কবে সে বিয়ে করবে?

বলবেন একটা গল্প, বলুন না। মায়ার গলায় আবদারের সুর।

মায়ার সাথে প্রথম পরিচয়টা একটু অদ্ভুত ভাবেই হয়েছিল। বাউল মেলা দেখতে গিয়েছিল সুবিমল। দিয়াকে একটা এগরোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দ্যাখে। ভিড়ের মধ্যে ওর হাত ছুটে নাকি ওর মা হারিয়ে গেছে। সুবিমলই শেষপর্যন্ত দিয়ার হাত ধরে মায়াকে খুঁজে বার করে। সেদিন মনে আছে একটা চুমকি বসানো জংলা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিল মায়া। বেশ লাগছিল। বিশেষ করে ওর ফিগারটা। এক মেয়ের মা বলে ওকে বোঝাই যায় না! মেলাতেই ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। তারপর কীভাবে যে ওরা দুজন কাছে চলে এল। স্বামী নেই বলে মায়ার দিক থেকেও নিশ্চয়ই একটা শারীরিক চাহিদা ছিল!

ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

হঠাৎ করেই মায়ার কথা ভেবে মনটা কেমন নরম হয়ে যায় সুবিমলের। বেচারি। বিয়ে হতে না হতেই বর মারা গেছে। শুধু একটা ছোটো দোকান রেখে গেছে, পান-বিড়ি-সিগারেটের, আর এই মেয়েটা। ওকে বোনের বাড়ি রেখে বেড়াতে আসবার কথা মায়া বলেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত পারেনি। মায়ের মন। বলল, আমি ঘুরব আর ও পাহাড় দেখবে না?

সুবিমল পাশ ফিরে বলে, আচ্ছা শোনো। এই দিয়া শোন, একটা গল্প বলছি। হ্যাপি প্রিন্স ও সোয়ালো পাখির গল্প। এক দেশে এক রাজার ছেলে ছিল। দুঃখ কাকে বলে সে জানত না, তারপর একদিন সে মারা গেল।

এত তাড়াতাড়ি মারা গেল?

কথা বলছিস কেন? ধমকে ওঠে মায়া চুপ করে শোন।

সুবিমল বলতে থাকে, দিয়া চুপ করে শুনছে। কতটা বুঝছে বলা মুশকিল কিন্তু সুবিমল যখন যখন বলল সোয়ালো, সোয়ালো, ও লিটল সোয়ালো। দিয়াও সুর করে বলল, সোয়ালো সোয়ালো ও লিটল সোয়ালো…

গল্প শেষ হলে মায়া বলল, ওরা দুজন দুজনকে কত ভালোবেসেছিল। সত্যিই কি কেউ কাউকে এত ভালোবাসতে পারে? তারপর তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ার ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাঙল সুবিমলের।

আর কত ঘুমোবেন?

উঠে বসে সুবিমল। এঃ, পৌনে ছটা বাজে। রোদ উঠে গেলে তো পাহাড়ে ওঠার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি বাথরুমে যায় সুবিমল। হাত মুখ ধুয়ে বেরোয়। দিয়াও এইমাত্র উঠল। ঘুমচোখে বিছানার ওপর বসে আছে। মায়া ওকে টেনে হিঁচড়ে নামায়।

শিলিগুড়ি সদর মোড়ে এসে ওরা ট্রেকার থেকে নামে। একটু দূরেই দুটো বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। একটা গাড়ির চালক হাঁক দিচ্ছে দার্জিলিং দার্জিলিং। মায়া সুবিমলের হাত চেপে ধরে, একটু তাড়াতাড়ি চলুন, গাড়িটা বোধহয় ছেড়ে দেবে এক্ষুনি কিন্তু সুবিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কী হল চলুন,

সুবিমল এবার এগোয়। গাড়ির চালককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে। কালিম্পং যাবার কোনও গাড়ি নেই?

এই তো পাশের গাড়িটাই যাবে, যান উঠে পড়ুন। মায়া অবাক হয়ে সুবিমলের দিকে তাকায়।

কী হল? আমরা তো দার্জিলিং যাব।

না মায়া। একটু ইতস্তত করে সুবিমল বলে, সাত হাজার টাকায় দার্জিলিং ঘোরা যাবে না। ওখানে হোটেল ভাড়াই অনেক হবে।

কেন, আমার কাছেও তো কিছু টাকা আছে, এতে হবে না?

না, তোমার টাকায় আমি হাত দেব না। কালিম্পং কাছে। খরচ কম পড়বে। চলো ওখানেই ঘুরে আসি। মায়ার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

দার্জিলিং যাব বলে এলাম আর এখন বলছেন…

না মায়া, দার্জিলিং-এ খুব ঠান্ডা পড়ে। তুমি তো জানো আমার বেশি ঠান্ডা সহ্য হয় না।

কেন, গরম কাপড় তো সঙ্গে এনেছেন। এতে হবে না?

না।

ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। ওর জন্য কষ্ট হয় সুবিমলের। বেচারি কত আশা করে এসেছিল!

গাড়ি সমতল ছেড়ে সেবকের কাছে এসে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরতেই মায়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দিয়া জানলার পাশে বসেছে। বাইরে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, মা দ্যাখো নদী কত নীচে। মায়া জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। সুবিমলকে ডেকে বলে, দেখুন পাহাড়ি নদী।

কী নাম নদীটার? জলটা কেমন সবুজ। দেখবে কী করে সুবিমল। সে বসেছে মাঝখানে।

বাঃ, বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে সে, আর সে-ই কিছু দেখতে পাবে না! একটু রাগ রাগ মুখ করেই বসে থাকে সুবিমল। থাক, ওরাই দেখুক। একটু পরে অবশ্য সে নিজেও সরে এসে মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকায়। আর কী আনন্দই যে হয়। দিয়ার মতো বয়সে সে এই পথ দিয়ে গিয়েছিল। এই সুবিস্তীর্ণ পাহাড়, পাহাড়ের খাদ থেকে উঠে আসা এই লম্বা লম্বা গাছ, আর গাছের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ওই রূপসি রঙ্গীত এরা কি তাকে চিনতে পারছে! দার্জিলিং যাওয়া হল না!

কাকু তোমার কাছে স্মার্ট ফোন নেই? তাহলে ছবি তুলব, দিয়া বলে।

মাথা নেড়ে না বলে সুবিমল। অন্য যাত্রীরা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও করছে। দিয়া মায়ের কাছ থেকে ছোট্ট কমদামি মোবাইলটা নিয়ে তাতেই ছবি তুলতে থাকে। দেড় ঘন্টা বাদেই ওরা মেঘের রাজ্যে পৌঁছে যায়। পাহাড়ের বুকে শুয়ে থাকা মেঘগুলো সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে।

কী সুন্দর! মায়া অস্ফুটে বলে, এরকম জিনিস দেখতে পাব কখনও ভাবিইনি।

মেঘ দেখা ভুলে গিয়ে সুবিমল চেয়ে থাকে মায়ার ঝলমলে খুশিভরা মুখের দিকে।

 

কালিম্পং গাড়ি স্ট্যান্ডে এসে নামার পর মায়া অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। পাহাড়ের এত ওপরে এত বড়ো সুন্দর শহর! ওরা প্রথমেই একটা দোকানে ঢুকে লুচি মিষ্টি খেয়ে নেয়। তারপর হোটেল খুঁজতে বার হয়। বেশি খুঁজতে হয় না। স্ট্যান্ডের পাশেই প্রচুর হোটেল। শেষপর্যন্ত হোটেল প্যারাডাইস বলে একটা দোতলা ঝকঝকে সুন্দর হোটেলে ওরা সাহস করে ঢোকে। আর এমনই ভাগ্য, মাত্র হাজার টাকায় একটা বড়ো ঘর পেয়ে যায়। ঘরে দুটো সিংগল বেড, টিভি সেট আছে, বড়ো আয়না আছে, জানলায় শৌখিন পর্দা ঝুলছে, টাইলস বসানো বাথরুমের সাইজটাই শিলিগুড়ির হোটেল ঘরটার থেকে বড়ো।

ওরা আরও অবাক হল যখন হোটেল ম্যানেজার ওদের কাছে আধার কার্ড দেখতে চাইল না, এমনকী আগাম ভাড়াও চাইল না। শুধু খাতায় নাম তুলে নিল। তারপর বলল, যান, মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নিন। সাইট সিযিং করবেন তো? আমার চেনা ভালো ড্রাইভার আছে। বারোশো টাকা নেবে, সেভেন পয়েন্টস ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।

সেভেন পয়েন্টসটা কী? প্রশ্ন করে সুবিমল।

কালিম্পং-এ মেইন দেখার জায়গা সাতটা। নতুন আসছেন বুঝি?

হ্যাঁ।

মায়া বলল, আমরা স্নান খাওয়া সেরেই বেরোব। আপনি ড্রাইভারকে বলে দিন।

ঠিক বারোটা বাজতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হোটেলের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা তখন সবে ভাত খেয়ে হোটেলে ঢুকছে। তড়িঘড়ি ওপরে উঠে ওরা ড্রেস চেঞ্জ করে। মায়া বলে, দেখুন না কোন শাড়িটা পরব?

শাড়ি কেন, যে-সবুজ সালোয়ারটা এনেছ ওটা পরো।

ওটা পরব? একটু ছোটো হয় আমার। গায়ে চেপে বসে।

পরোই না।

সালোয়ার গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মায়া। পেছন থেকে সুবিমল বলে, তোমায় দেখতে সেই হট লাগছে।

যাঃ, মায়ার মুখে লজ্জা। তারপরেই জিভ কেটে বলে, ওড়নাটাই আনতে ভুলে গেছি। ওড়না না পরে বেরোব?

ভালোই হল, সুবিমল হাসে। বলে আরও বেশি সেক্সি লাগবে।

মা, সেক্সি মানে কি? দিয়া বলে।

গাড়ির ড্রাইভারের চেহারা একেবারে সিনেমার হিরোর মতো। লম্বা, ফরসা, ধারালো চোখ মুখ। ওরা আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দেয়।

ডেলো আর দুরপিন, এই দুটো উঁচু পাহাড়ের মাঝে কালিম্পং। ড্রাইভারটা প্রথম ওদের ডেলো পিকে নিয়ে যায়। পিকের ওপরে একটা খুব বড়ো হনুমানজির মূর্তি। পাশে ফুলের বাগান। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠে দিয়া, হনুমানজির পায়ে কাছে রেলিং ঘেরা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে বলে, মা দ্যাখো মেঘ। সত্যিই, একেবারে হাতের কাছ দিয়ে শরীরের ওপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে।

সুবিমল মায়াকে বলে, দ্যাখো এই মেঘগুলো যেন আমাদের স্বপ্নের মতো তাই না? মনে হচ্ছে ধরা যায় কিন্তু হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

মায়া হেসে বলে, আপনার আবার কী স্বপ্ন আছে? দার্জিলিং, মনে মনে বলে সুবিমল। একদিন আমি দার্জিলিং যাব।

সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামছে, পাশেই দুহাত উঁচুতে পাথরের খাঁজে খাঁজে অদ্ভুত সুন্দর এক ধরনের জংলি ফুল ফুটে আছে দেখতে পায় সুবিমল। জুতো খুলে রেখে, ওপরে ওঠবার চেষ্টা করে। একবার পা পিছলে পড়ে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ফুলগুলোর কাছে হাত পৌঁছোয়। কয়েটা তুলে এনে দিয়াকে দেয় আর একটা মায়ার চুলে গুঁজে দেয়। মায়া সলজ্জ মুখে হাসে, কী যে ছেলেমানুষি করেন, পায়ে লাগল তো?

ডেলো পার্কটাও চমৎকার জায়গা। সেখানে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ার বায়না ধরে দিয়া। কিন্তু দশ মিনিট ঘোরাতে দুশো টাকা নেবে শুনেই না করে দেয় মায়া। এরপর মর্গান হাউস, নেচার মিউজিয়াম ইত্যাদি আরও কয়েটা ভালো ভালো জায়গা দেখে সন্ধের সময় ওরা হোটেলে ফেরে।

বিছানায় বসে মায়া বলে, ড্রাইভারটা কী ভালো বলুন। আমরা যেখান থেকেই ঘুরে বেরোচ্ছি, একেবারে সামনে গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াচ্ছে, একটুও হাঁটতে হয়নি। অন্যদের গাড়িগুলো কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়েছিল। কত সামান্য জিনিসও মেয়েদের চোখে পড়ে, ভাবে সুবিমল।

একটু তাড়াতাড়িই বাইরে বেরিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা। ফেরার পথে ওপরে তাকায় সুবিমল। এই আকাশ সমতলে দেখা যাবে না। তারাগুলো কী ঝকঝক করছে, যেন কাছে নেমে এসেছে। তারপরেই দূরের পাহাড়ে চোখ পড়তে চমকে ওঠে সুবিমল। মায়ারাও দেখেছে। প্রথমটা বুঝতে পারেনি ওরা। যেন হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলছে! তারপর ভালো করে দেখে বুঝল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সারি সারি বসতবাড়ি। তার আলো।

দুটো সিংগল বেড পাশাপাশি এনে ওরা শুতে যায়। দিয়া সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মায়াও। সুবিমল জেগে থাকে। আর একটু রাত হলে মায়া এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কখন ঘুম ভাঙল ওর!

মায়া ফিসফিসিয়ে বলে, চলুন, আপনার খাটটা ওই পাশে সরিয়ে নিই।

এর আগেও তো কতবার ওরা মিলিত হয়েছে। কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। মাটি থেকে চার হাজার ফিটের ওপরে, মেঘের রাজ্যে। অনেকটা সময় পার করতে করতে এই ঠান্ডা রাতেও তারা ঘেমে গেল। তারপর, সেই ভিজে ভিজে সুখ মেখেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙে ওদের।

দিয়া উঠেই বলে, কাকুর খাটটা ওখানে কেন? সুবিমল মায়ার দিকে তাকায়।

মায়া মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, রাতে তোর কাকুর একা শুতে ইচ্ছে হল, তাই খাটটা সরিয়ে নিল।

সত্যি কাকু? দিয়া সুবিমলকে দ্যাখে।

মুখ-টুখ ধোওয়া হলে সুবিমল বলে, বেল টিপে ম্যানেজারকে ডাকব? চা দিতে বলি আর সঙ্গে কিছু খাবার।

ডাকবেন? ঘরে এসে দিলে হয়তো বেশি দাম চাইবে।

তা হোক।

চা, লুচি-তরকারি এল। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে খেতে খেতে মায়া বলল, এটা আমার মনে থাকবে। একেবারে হাতের কাছে এসে দিয়ে গেল, হোটেলের বিছানায় বসে খাচ্ছি।

কালিম্পং দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। নীচে এসে হোটেলের খাতায় সই করার সময় ম্যানেজার বলল, ফিরে যাচ্ছেন? এখানে এলেন যখন লাভা ঘুরে যান। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। খুব শান্ত। একটা গুম্ফা আছে, ভালো লাগবে আপনাদের। লাভার নাম আগে শুনেছে সুবিমল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কীরকম সে জানত না।

বাইরে বেরোতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। ভিজতে ভিজতেই ওরা গাড়ি স্ট্যান্ডে এল। ওযেদার খারাপ, শিলিগুড়ি ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে লাভায় যাবার গাড়িই ধরল সুবিমল। মায়া আর দিয়া খুব খুশি। গাড়ি যখন ছাড়ল তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ড্রাইভার যদিও বলল, পাহাড়ের এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। আর হলও তাই। মিনিট কুড়ি পরেই আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ।

যেতে যেতে কম্পিউটার বার করল সুবিমল। লাভা সম্বন্ধে একটু জেনে নিলে ভালো হয়। আর যা জানল তাতে সে অবাকই হল। লাভার উচ্চতা সাত হাজার ফিটের বেশি। দার্জিলিং-এর চেয়ে কয়েকশো ফিট ওপরে। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিমল, মায়া, আমরা দার্জিলিং-এর চেয়ে বেশি উঁচুতে উঠছি।

আধঘন্টা পর থেকেই ওদের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। আর এই প্রথম ওদের ব্যাগ থেকে গরম পোশাক বার করতে হল। সোয়েটার পরেও সুবিমল কাঁপছে। মায়া ওর হাতে নিজের শালটা দিয়ে বলল, কানে জড়িয়ে নিন। আপনার তো আবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।

একদম সরু পথ দিয়ে গাড়ি ওপরে উঠছে। ভাঙাচোরা রাস্তা। বেশি টুরিস্ট বোধহয় এদিকে আসে না। ডানপাশে খাদের তলা থেকে অতিকায় লম্বা লম্বা গাছ আকাশে উঠে গেছে। কুয়াশায় ভিজে ভিজে তাদের গুঁড়ির রং কালো। তাদের গা থেকে মোটা মোটা দড়ির মতো সবুজ শ্যাওলা ঝুলছে। কি সুবিপুল গাম্ভীর্যে পূর্ণ চারিদিক। একটা অদ্ভুত অনুভতি হল সুবিমলের। এই অমর্তলোকে ওরা যেন অনধিকার প্রবেশকারী!

লাভা পৌঁছোতে দুঘন্টার বেশি লাগল। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই একটা সরু পথ নীচে নেমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানল, গুম্ফা দেখতে এই রাস্তাটা ধরেই যেতে হবে। খাড়াই পথটা ধরে ভারি ব্যাগ হাতে নিয়ে তরতরিয়ে নামতে থাকে মায়া। সুবিমল পিছিয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে, একটু আস্তে হাঁটো না। মায়ার হাসি শোনা যায়, আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন।

বহুদূর থেকেই গুম্ফাটা দেখা যায়। রাস্তার দুপাশে ছোটো বড়ো দোকান। সবজির বাজার। লোকজন কম। গাড়ি চলছে না। দুএকজন সাইকেল চেপে যাচ্ছে। পথ ঘেঁষে রঙিন কাঠের বাড়ি। বড়ো বড়ো কিছু হোটেলও অবশ্য দেখা যাচ্ছে।

দূর থেকে যা মনে হয়েছিল গুম্ফাটা তার থেকেও অনেক বড়ো। কালিম্পং-এও গুম্ফা দেখেছে ওরা। কিন্তু সেগুলো আয়তনে এর অর্ধেকও হবে না। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে প্রায় আধ কিলোমিটার লম্বা পাঁচিল চলে গেছে। তার ওপরে সারি সারি রঙিন নিশান উড়ছে। ভেতরে ঢুকে ওরা একটুক্ষণ পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ায়। নীচেই কুয়াশা ঢাকা গভীর খাদ। দিয়া হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে যায়। আশপাশে কেউ নেই।

সুবিমল বলে, এখান থেকে লাফ দিতে পারবে মায়া? মায়া ভুরু কুঁচকে তাকায়।

যত অদ্ভুত কথা আপনার।

না বলছি, ওই কুয়াশার মধ্যে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না?

বাজে কথা রাখুন, চলুন দিয়া কোথায় গেল দেখি।

একটা বাঙালি পরিবারের সাথে দেখা হয়। স্বামি-স্ত্রী আর তাদের মেয়ে। বউটি ফরসা ও সুন্দরী। মেয়ে কিন্তু দিয়ার মতোই কালো তবে খুব স্মার্ট। কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। ওরাও কালিম্পং ঘুরে এসেছে শুনে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করেন, ডেলো পার্ক তো গিয়েছিলেন, ওখানে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলেন?

প্যারাগ্লাইডিং, কাঁধে নকল ডানা বেঁধে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া, ডেলোতে ছিল বটে। না ওটা হয়নি।

করেননি! সাচ্ আ প্লেজন্ট এক্সপেরিযে্নস। একেবারে কুয়াশার ভেতর দিয়ে উড়তে উড়তে এসে নীচে নামলাম। কিন্তু রেটটা একটু হাই। তিনজনের সাতহাজার টাকা পড়ে গেল।

সাত হাজার! একটা লাফের জন্য! তিনহাজার টাকায় ওদের কালিম্পং ঘোরা হয়ে গেল।

মহিলা ও তার মেয়ে সাথে গল্প করতে করতেই সুবিমল এগোয়। মায়ারা পিছিয়ে যায়। একবার মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে সুবিমল, বউটির হাজব্যান্ড মায়ার পাশে পাশে আসছে। এক ঘন্টার বেশি লাগল পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে। একটা জপযন্ত্র দেখল, দুমানুষ সমান উঁচু। তার চাকা ঘুরিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। ওরাও একটু ঘোরাল।

লাল জোব্বা পরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এদিক ওদিক ঘুরছে। নিজেদের ভাষায় কিসব কথা বলছে। প্রত্যেকেই খুব হাসিখুশি। এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতির কোলে, ভগবান বুদ্ধের অর্চনায় এরা যেন সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। একজন সন্ন্যাসীকে দেখল, মেঝেতেই বসে বসে খাচ্ছে। সাধারণ ডাল ভাত একটা তরকারি তাতেই মুখে ওনার কি অপরূপ আনন্দের ছাপ।

কী পিসফুল জায়গাটা বলুন। ভদ্রমহিলা বল্লেন, মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে এখানেই থেকে যাই।

ভালোই হয় তাহলে! সুবিমল ভাবে। সেও এর সাথে থেকে যেতে রাজি আছে।

প্রার্থনা ঘরটা বিশাল। দেয়ালে কী সুন্দর রঙিন কারুকাজ। উঁচু আসনের ওপর নিমীলিতচোখ বোধিসত্ত্বের মূর্তির সামনে এসে একটু দাঁড়ায় সুবিমল। হাজার বছর বা তারও আগে, রাজার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল যেই রাজার কুমার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে বলে। সেই বিশাল-হৃদয় পুরুষের জন্য হঠাৎ করেই এক অপরিমেয় শ্রদ্ধায় সুবিমলের মন অভিভত হল, কেন যেন হ্যাপি প্রিন্সের গল্পটা মনে পড়ে গেল। চোখ বুজে মনে মনে উচ্চারণ করল সে, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি হে অমিতাভ, হে তথাগত বুদ্ধ আমার প্রণাম নাও।

প্রার্থনা ঘর থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আসুন আপনাদের নিয়ে একটা ছবি তুলি। তাঁর হাতে বড়ো লেন্সওয়ালা দামি ক্যামেরা। বললেন, আপনার কি কম্পিউটার আছে? তাহলে মেইল করে ছবি পাঠিয়ে দেব। মায়া খুব খুশি। লাভার একটা তো স্মৃতি থাকল। চলে যাবার সময়ে বউটা দিয়ার গাল টিপে একটা ক্যাডবেরি দিয়ে যায়।

ওরা যেতেই মায়া হাসতে হাসতে বলে, ভদ্রলোক আমার ফোন নম্বর চাইছিলেন।

দিলে?

না। দিলে বুঝি খুশি হতেন?

হতাম, সুবিমল হাসে।

ভদ্রলোক কিন্তু বুঝতে পেরেছেন আমরা বিবাহিত নই।

কী করে বুঝলেন?

ছবি তোলবার সময় আপনি আমার থেকে দূরে দূরে দাঁড়াচ্ছিলেন।

ওঃ!

আপনি তো ওই বউটা আর তার মেয়ে সাথেই সারাক্ষণ গল্প করে গেলেন। একটু থেমে মৃদু গলায় বলে মায়া, মা-মেয়ে দুজনেই কী সুন্দর ইংরেজি বলছিল। আপনার তো ভালো লাগবেই।

দিয়ার দিকে কটমটিয়ে তাকায় মায়া, আর এই ভ্যাবলা মেয়েটা সারাক্ষণ চুপ করেই থাকল। আন্টি যখন চকোলেট দিলেন একটা থ্যাংক ইউ বলতে পারলি না?

আঃ ছাড়ো। ছোটোদের অত থ্যাংক্স বলতে হয় না।

গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ওরা সেই রাস্তাটা ধরে উঠছে। মায়া আর দিয়া একটু এগিয়ে ছিল। হঠাৎ করেই ওরা হারিয়ে গেল! একঝাঁক মেঘ এসে ওদের ঢেকে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ওদের দেখতে পেল না সুবিমল। তারপরেই মেঘ সরে গেল। ওই তো মায়া। আবার নতুন একদল মেঘ এসে তাদের আড়াল করে দাঁড়াল। মায়া নেমে এসে সুবিমলের হাত ধরল। বলল, কী দারুণ না? সুবিমল মায়ার হাতটা চেপে ধরে। মেঘের ভেতর সাঁতার কাটতে কাটতেই ওরা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মায়া বলে, চলুন এটায় ঢুকি। দিয়ার খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টটা পুরোই ফাঁকা। দরজার কাছের টেবিলটায় এসে ওরা বসে। এখান থেকে রাস্তায় উড়ে যাওয়া মেঘ দেখা যাচ্ছে।

মায়া আর দিয়ার জন্য দু-প্লেট চিকেন চাউমিন আর নিজের জন্য থুপ্পা চাইল সুবিমল। থুপ্পা সেই মনে আছে দার্জিলিং-এ খেয়েছিল। কিন্তু এটায় সেই স্বাদ পেল না। মায়া নিজের প্লেট থেকে চাউমিন তুলে সুবিমলের প্লেটে দিল। খেয়ে দেখুন কি চমত্কার করেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে ওরা জানল, শিলিগুড়ি যাবার শেষ গাড়ি বেরিয়ে গেছে। তার মানে আজ রাতটা হোটেলেই থাকতে হবে।

সবজিবাজারের গলির ভেতর একটা ছোটো কিন্তু সুদৃশ্য হোটেল। চয়েস লজিং অ্যান্ড ফুডিং। সেটাতেই ঢুকল ওরা। ম্যানেজার অল্পবয়সি একটা ছেলে।

সুবিমল প্রশ্ন করল, ইঁহা কেয়া রুম মিলেগা?

ছেলেটি একটু হেসে বলল, দোতলায় একটা ঘরই খালি আছে, চাইলে দেখতে পারেন?

তুমি বাংলা বলতে পারো!

আমি শ্যামনগরের ছেলে, নাম রাজা। আপনারাও তো বাঙালি, দেখেই বুঝেছি।

বাঃ, তাহলে তো খুব ভালোই হল সুবিমল খুশি হয়ে ওঠে।

আসুন আপনাদের ঘরটা দেখিয়ে দিই।

সিঁড়ি দিয়ে ওদের ওপরে নিয়ে আসে রাজা। এটা বোধহয় হোটেলের পেছন দিক। একটা সরু করিডর দিয়ে হেঁটে ওরা একটা ছোটো বারান্দায় এসে দাঁড়াল আর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল। পুরো বারান্দাটাই ঝুলছে পাহাড়ের খাদের ওপর। একদিকে পাহাড়ের দেয়াল। সামনে মেঘে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া। হু হু করে কুয়াশা উঠে আসছে নীচ থেকে। বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই ওদের দেখায়। সুন্দর সাজানো ঘর। পাশেই অ্যাটাচড বাথরুম।

ওদের অবাক করে দিয়ে মাত্র আটশো টাকা ঘর ভাড়া চায় রাজা। মায়া তবু বলে, ছশো টাকায় হবে না?

কম পড়ে যাবে দিদি।

না ওটাই রাখো।

আর কিছু না বলেই খাতায় ওদের নাম লিখে ঘরের চাবি তুলে দেয় রাজা।

ঘরের বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মায়া বলে, কখনও কল্পনাই করিনি এরকম ঘরে থাকব। ঘর থেকেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

একটু রেস্ট নিয়ে ওরা বাইরে বার হয়। অন্ধকার নেমে এসেছে এখনই। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা বড়ো রাস্তা সোজা চলে গেছে। তার দুপাশে গভীর জঙ্গল। পুরো নির্জন পথ। কোনও শব্দ নেই, একটাও আলো নেই। শুধু উজ্জল তারার আলোয় নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকে ওরা।

মায়া বলে, দিয়া এখন যদি বাঘ বেরোয় তো কী করবি?

দিয়া একটু ভেবে বলে, বাঘ এলে যেন আমাকেই খায়।

কেন?

বাঃ, তোমাদের বাঘে খেলে আমি কার সাথে বাড়ি ফিরব? সুবিমল হেসে ওঠে। মায়াও। ফেরার পথেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় ওরা।

হোটেলে ফিরে দিয়া টিভি চালায়। চ্যানেল পালটায় সুবিমল। জি সিনেমায় এসে দ্যাখে অনুসন্ধান সিনেমাটা চলছে। দ্যাখা ছবি, তবু আবার দেখতে বসে ওরা।

জানো তো, এই ছবিটার শুটিং পুরোটাই দার্জিলিং-এ হয়েছিল।

তাই?

ভোর হচ্ছে। ছবির মতো সাজানো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বেতের ঝুড়ি পিঠে ঘুরে ঘুরে নামছে পাহাড়ি মেয়েটা।

সত্যি কি সুন্দর! মায়া বলে।

অন্ধ নায়িকা গান করছে, ওঠো ওঠো সূর‌্যাইরে, ঝিকিমিকি দিয়া, কালকে তুমি আঁধার রাতে, কোথায় ছিলে গিয়া।

ইস, ওর কী কষ্ট তাই না?

কেন?

ও তো কোনওদিন সূর্যটা দেখতেই পাবে না।

সিনেমা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে দিয়া। ওরা জেগে থাকে। সিনেমা শেষ হচ্ছে, অমিতাভ বচ্চন রাখির কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে।

সুবিমল বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায় একটা। ভেতরে গান চলছে, আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ।

মায়াও কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বইটা সত্যিই খুব ভালো তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু অবাস্তব!

এমন কেন বলছেন?

অমিতাভের মতো একজন হ্যান্ডসাম পুলিশ অফিসার একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করছে। অবাস্তব নয়?

কেন, এরকম কি হতে পারে না?

জানি না। একটু চুপ করে থেকে সুবিমল বলে, এই যে তুমি আর আমি একসাথে ঘুরছি, রাতে শুচ্ছি। কিন্তু আমি কি তোমায় বিয়ে করতে পারব কোনও দিন?

না। আপনি করবেন না, আমি জানি।

তাহলে?

চুপ করে যায় মায়া। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। মুখ না ফিরিয়ে সুবিমল কেমন করে বুঝতে পারে, মায়া কাঁদছে। কোনও শব্দ না করেই।

আচ্ছা মায়া, এই যে আমি তোমাকে কোনও সম্মান দিতে পারি না। সবার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কটা লুকোতে চাই। এতে তোমার খারাপ লাগে না?

খারাপ লাগলেই বা কী করতে পারি।

মায়া বলে, আমি জানি তো আমি আপনার যোগ্য নই। আমি গরিব, পড়াশোনা জানি না। আবার একটা মেয়ের মা। আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি নিজেই ভাবতে পারি না।

তুমি তো জোর করতে পারো।

কেন করব। জোর করে কি সব কিছু পাওয়া যায়?

কিছুক্ষণ আবার চুপ থাকে দুজনে।

আমি জানি কেন আপনি দার্জিলিং যাননি…

কেন?

আসলে বিয়ের পর বউকে নিয়ে দার্জিলিং যাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?

কেন এরকম মনে হল তোমার?

এমনিই। আগে ভাবিনি, এক্ষুনি মনে হল। বলুন, ঠিক বলেছি কিনা।

জানি না।

হঠাৎ করেই সুবিমলের পাশে সরে এসে তার বুকে চুমু দেয় মায়া, আর তাকে জড়িয়ে ধরে। সুবিমল বুঝতে পারে তার বুকের কাছটা মায়ার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সুবিমল বলে, কাঁদে না মায়া। বেড়াতে এসে এমন করে না।

আমি আপনাকে ছাড়তে পারব না।

কে ছাড়তে বলেছে তোমাকে। কেঁদো না।

আমায় ছ়েড়ে চলে যাবেন না তো?

যাবো না।

ঠিক?

ঠিক।

বাইরে লাভার নক্ষত্রভরা আকাশ ভগবান বুদ্ধের করুণাঘন দ্যুতিরময় চোখের মতো তাদের দুজনের দিকে চেয়ে থাকে।

 

গেরস্থালি

ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে অসীমার টনক নড়ল। এক্ষুনি রঞ্জন ওর বন্ধুকে নিয়ে এসে পড়বে। রঞ্জন বারবার বলে গিয়েছিল চা-জলখাবার তৈরি করে রাখতে। অসীমা তড়িঘড়ি চোখ মুছে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নিজের মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে— জ্বালা করছে। কী যে করবে কিছুই বুঝছে না, সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই ক’মাসে। অসীমা জীবনের নেগেটিভ দিক, অভাব-অস্বচ্ছলতা কোনওদিন দেখেনি। আজ যেন ও মাঝপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খড়কুটোও নেই যা আঁকড়ে ধরবে। বাবার কথা আজ এত বেশি মনে পড়ছে। বাবার জন্যই ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠা রঞ্জনের। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

‘সীমা… সীমা,’ বলতে বলতে রঞ্জন বাজারের থলে নিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। অসীমা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রঞ্জন অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের ব্যাগ নামিয়ে কাছে এসে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসা করল ‘কী হয়েছে?’ অসীমা ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে রঞ্জনকে দিল, ‘আজ আবার সরকারবাবু এসেছিলেন।’

‘কী বললেন? চিৎকার করেননি তো!’

‘না, শুধু বললেন তাড়াতাড়ি ঘরগুলো ছেড়ে দিতে।’ রঞ্জন কিছু না বলে শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে বাইরে চলে এল। অসীমা জানিয়ে দিল, ‘একটু বাদেই রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ বলল বটে কিন্তু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে বাড়িওয়ালার কথাগুলোই ধাক্বা দিচ্ছে। এক মাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে না দিলে কোর্টের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবে। রঞ্জনকে তো সব কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। মানুষটাকে তো দেখছে, এত চেষ্টা করছে তবু আশার আলো দেখছে কোথায়? বিগত পাঁচ-ছ’মাস ধরে ব্যাবসার ভরাডুবি। মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার উপর বাড়িওয়ালার হুমকি। ‘শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছেন, আমার ছেলের বিয়ে, ঘর দরকার, তাই ভদ্রভাবে বলছি, উঠে যান।’

অসীমারা গত তিনমাস বাড়িভাড়ার টাকাটাও দিতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে রাগটা সেখানেই, তাই বাহানা জুড়ে দিয়েছে। আবার কোর্টের ভয় দেখাচ্ছে। হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে তো, তাই গুমরও বেড়ে গেছে সরকারবাবুর। আজ যে সমাজে সরকারবাবু উঠে যাচ্ছে রঞ্জন একদিন সেখানেই ছিল। সরকারবাবুর বখে যাওয়া ছেলেটা হঠাৎ শুরু করেছে প্রোমোটারি ব্যাবসা। একসময়ে সরকারবাবু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে উপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। তাই ছেলের হয়ে সুপারিশ করাটা সরকারবাবুর কাছে জলভাত। মাত্র কয়েক মাস হল বেশ জমজমাট শুরু করেছে। উঠোনের ওপাশের ঘরটা আর বৈঠকখানা নেই, হয়ে গেছে অফিস ঘর। বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য যোগাযোগ করুন। প্রোমোটার – সনাতন সরকার। যোগাযোগের সময় সকাল : ১১টা – ৪টা।’

এতদিন অসীমা জানত না সরকারবাবুর ছেলের নাম। এখন সাইনবোর্ডের সুবাদে জেনে গেছে। সেই ছেলের বিয়ে। সরকারবাবুর স্ত্রীকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিল অসীমা। কিন্তু মহিলার বাচনভঙ্গির সামনে অসীমা খুবই অসহায় বোধ করছিল। উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল মাথা হেঁট করে। ঘরে এসে কেঁদে ফেলেছিল, আবার আপশোশও হয়েছিল রঞ্জনকে না বলে উপরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল আর্জি জানাতে। মাত্র কয়েক মাস আগেও অসীমারও তখন বোধহয় এখনকার মতো ছিল না। পতি গরবে গরবিনি ছিল সে। কী যে হল।

দশবছর আগে সে যখন নতুন বউ হয়ে শ্বশুড়বাড়িতে এল তখন শুধু দু’চোখে স্বপ্ন। বড়োলোক ঘরের মেয়ে অসীমা। বাবার আদুরে মেয়ের আবদারে সবাই অস্থির। সেই অসীমা এল শ্বশুরঘর করতে। তুলনায় রঞ্জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অসীমাদের মতন বড়োলোকি ব্যাপার না থাকলেও সম্পন্ন গৃহস্থ যৌথ পরিবার ছিল রঞ্জনদের। দুপক্ষই জানত অসীমা-রঞ্জনের মেলামেশার কথা। আপত্তি থাকলেও উভয়পক্ষই রাজি হয়েছিল এ বিয়েতে। রঞ্জনের মা-বাবা, দাদা-বউদির মনে ছিল একরাশ দ্বিধা। পারবে তো অত বড়ো ঘরের মেয়ে এই সাধারণ ঘরে এসে মানিয়ে নিতে। অসীমাকে নিয়ে রঞ্জন যেদিন প্রথম তার মায়ের কাছে এসেছিল, সেদিনটা অসীমার আজও মনে আছে। রঞ্জনের মাকে প্রণাম করতে গিয়ে উনি সহাস্যে বলেছিলেন ‘বসো মা, এই ছোট্ট ঘরে তোমায় স্বাগত জানাই। বাড়িটা তোমাদের মতো বড়ো নয় কিন্তু আমাদের সকলের মন অনেক বড়ো, তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু আদর-ভালোবাসায় কোনও খামতি হবে না।’

এই কথা শুনে অসীমা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কেউ তো বলেনি। তার দুচোখে তখন রঙিন স্বপ্ন-উচ্চাশা। রঞ্জন যেন অতিরঞ্জিত হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে-মাখিয়ে আছে। অসীমা, রঞ্জনের মাকে মৃদু স্বরে জানিয়েছিল, ‘এই ছোট্ট ঘর-বাড়িই হবে তার সোনার সংসার।’

কোথায় গেল তার সোনার সংসার, স্বপ্ন! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই ছোটো বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। স্বামীর বাঁধাধরা চাকরি। বাঁধাধরা সময়। অসীমা ব্যবসায়ীর মেয়ে। বাবা-কাকা, খুড়তুতো ভাইদের সচ্ছলতা দেখতেই অভ্যস্ত। গোনা টাকায় কোনওদিন জীবনযাপন করেনি সে। সারাদিনই বাড়ি জমজমাট। সকালে বাবা-জেঠু কারখানায় যায় তো দুপুরে বাড়ি আসে, ওই সময় দুই দাদা আর কাকা যায়। বাবা-জেঠু সারাটা দুপুর বাড়িতে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়ে আবার বিকেল চারটের চা-পর্ব চুকিয়ে বের হয়। দাদা-কাকারা মর্জি মতো বাড়ি আসে। আড্ডা মারে, কারুর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে কারখানা-দোকান যেখানে হোক ফোন করলে কেউ না কেউ এসে হাজির, এভাবেই বড়ো হয়েছে অসীমা।

এখানে রঞ্জন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছোটে। বাড়ি আসতে সেই সন্ধ্যা। যতই বাড়িতে জা-শাশুড়ি থাকুক, ভালো লাগে না অসীমার। রাতে রঞ্জনকে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে রঞ্জন হেসে বলে, ‘সীমা, আমরা প্রায় পাঁচ বছর মেলামেশা করে তবেই বিয়ে করেছি, তুমি জানো আমার কাজের ধারা। অফিসের পর তুমি আমি এক জায়গায় মিট করতাম তারপর সারা সন্ধ্যা হইচই করে কাটিয়ে তোমায় বাড়ি দিয়ে আমি ফিরতাম। এখন সারারাত তুমি আমার কাছে, তবু তোমার আক্ষেপ। প্লিজ অবুঝ হয়ো না। এটাই তো জীবন, আমরা সবাই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করি, চাকরিজীবী।’ অসীমা কিছুই বলার সুযোগ পায় না কিন্তু তার মন মানে না।

অসীমার বাবা এ বাড়িতে এলে প্রায়শই রঞ্জনকে ব্যাবসা করার কথা বলেন। অসীমার নামে যে মোটা অঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট আছে তা থেকে লোন নিয়ে, ব্যাবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু রঞ্জনের তাতে সায় নেই। তার এক বোনের বিয়ে হয়নি এখনও। অসীমার সবসময় ভয় করত যদি রঞ্জন ওই টাকাটা চেয়ে বসে বোনের বিয়ের জন্য। বাবা-মায়ের প্ররোচনায় অসীমা বারবার বলত রঞ্জনকে ব্যাবসা করার জন্য। শ্বশুরবাড়ি গেলে শালারাও সবাই বোঝাত রঞ্জনকে ব্যাবসার পজিটিভ দিকগুলো। সকলের তাড়নাতেই বোধহয় রঞ্জন ব্যাবসা করা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সাথিও পেয়ে গেল ললিতকে। শ্বশুরমশাই কাপড়ের ব্যাবসায়ী। তাই কাপড়ের ব্যাবসা করাই সুবিধা। এমন ভাবনা চিন্তা নিয়েই ললিত-রঞ্জন শুরু করল কাপড়ের ব্যাবসা। মাঝারি মাপের একটা দোকান-ঘর ভাড়া নিল বড়ো রাস্তার উপরেই। মাস ছয়েকের মধ্যে রঞ্জন ইস্তফা দিল চাকরিতে। বাড়িতে সবাই ব্যাবসাটাকে খুব একটা ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলল না।

অসীমার নিস্তেজভাব উধাও। সেই আবার ছটফটে হইচই করা, ননদের সাথে আড্ডা। যেমনটি ছিল বিয়ের পরপরই। রঞ্জনও বেশ খুশি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে অনেক ইচ্ছাই মনের কোণে চেপে রাখতে হয়। খুব শখ ছিল বাড়ির জন্য একট ফোর-হুইলার থাকবে। সে শখ পূর্ণ হয়নি। শখ ছিল মাকে, বাবাকে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধে হলে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাবে। দারুণ জমজমাটি পরিবার হবে তাদের। পরিবারটা রঞ্জনদের জমজমাটি কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই। কাপড়ের ব্যাবসা শুরুর ঠিক দেড়বছরের মাথায় রঞ্জন এক্সপোর্ট পারমিট পেয়ে গেল। বাড়িতে বাবাকে বলতে খুব খুশি। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমার বোনের বিয়ের গুরুদায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি ব্যাবসা করছ, দাদা চাকরিজীবী। তাই এখন তোমার ওপর আমার, দাদার অনেকটাই ভরসা।’

শ্বশুর মশাইয়ের এই ধরনের আশাভরসার কথা অসীমার মন কিন্তু সোজাভাবে নিল না। সে চেয়েছিল ব্যাবসার প্রথম লাভের টাকাটায় রঞ্জন একটা গাড়ি কিনুক। ইনস্টলমেন্টে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বশুর মশাইয়ের কথায় যেন অসীমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। সে চাইল সবাই যা টাকা দেবে, তার স্বামীও তাই দেবে। এই নিয়ে অশান্তি। রঞ্জন বাবা-দাদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এক ঝটকায় অসীমা থামাল তাকে, ‘কার পয়সায়, কার সাহায্যে ব্যাবসা করছ? আমার এফডি, বাবার যোগাযোগ না থাকলে তুমি পারতে আজ এমন কাজ করতে?’

অসীমার গলার স্বর বেশ উঁচু পর্দায় ছিল। ভাসুর-শ্বশুর সবই শুনতে পেল। তারাই রঞ্জনকে আলাদা ডেকে এনে কি পরামর্শ দিল কে জানে, একমাসের মধ্যে হঠাৎই রঞ্জন বাড়ি বদল করল, উঠে এল ভাড়া বাড়িতে। অসীমা খুবই অবাক হয়েছিল, বিরক্তও। কেন রঞ্জন বাড়ি বদল করছে এবং ভাড়াবাড়িতে যাচ্ছে এ নিয়ে বহু বার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও সদুত্তর পায়নি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে যেতে অসীমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু রঞ্জনের কঠিন মুখ, কঠোর ব্যবহার, অসীমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল, এ রঞ্জনকে সে চেনে না। সে চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল। আসার সময় সবাই প্রাণহীন পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। অসীমা-রঞ্জন আলাদা ভাড়া বাড়িতে উঠে এল। রঞ্জনের জন্যই অসীমা ভাড়া বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখত নিজেদের বাড়ির। রঞ্জনের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা কষ্ট পেয়েছিল অসীমার আচরণে। রঞ্জনের মা কিছু বুঝতে না পেরে অসীমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটো বাড়ি মা, একদিন এতটা ছোটো মনে হবে না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ঘর ফাঁকা। তোমার যদি মনে হয় তুমি ওই ঘরটাও ব্যবহার করতে পারো। এভাবে চলে যেও না। সবাই একসঙ্গে থাকো, আনন্দে থাকো।’ কিন্তু অসীমা তখন অন্য জগতের মানুষ। দর্পে মাটিতে পা পড়ছে না।

অসীমা-রঞ্জন আলাদা সংসার পাতল। নতুন ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে অসীমার বাবার স্ট্রোক হল। বাবা প্রতিমাসে মেয়েকে একটা থোক টাকা দিতেন, সেটা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অসীমা মানিয়ে নিল, রঞ্জনের টাকাতেও তাদের দুজনের সংসার হেসেখেলে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জন মা-বাবাকেও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল। ওনারা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, রঞ্জন-ললিত মিলেমিশে উদ্যোগী হয়ে কাপড়ের ব্যাবসাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু নিজেদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ডিনার করা। বেশ কাটছিল। ললিতের মেয়েটা দারুণ ছটফটে। ললিতের বউ মেধা। বেশ নরম স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু রঞ্জনের কথা অনুযায়ী খুব বুদ্ধিমতি ও হিসেবি। অসীমা নিজে বিএ পাশ। তাই প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। মেধা বেশিদূর পড়েনি, স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি। একসাথে মেলামেশায় মেধা বুঝতে পারত অসীমা খুব অহংকারী। তবু অল্প সময়ের জন্য একসঙ্গে থাকা তাই খুব পছন্দের না হলেও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাসি মুখে। এই বন্ধু জায়াকে রঞ্জন কিন্তু বেশ পছন্দ করত।

রঞ্জন-ললিতের ব্যাবসা বেশ তরতর করে এগিয়ে চলছিল। কারও জীবনে কোনও ছন্দপতন নেই। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একসময় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। দোকানটা সাধারণত সামলাত রঞ্জন। ললিত যেত অর্ডার আনতে। টাকা আনতে। এমনই কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বিদেশি অর্ডার নিয়ে মনের আনন্দে স্কুটারে দোকানের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে ললিতের স্কুটার আর একটা গাড়িকে পুরো পিষে দিয়ে ধাক্বা মারল দেয়ালে।

মেধার কান্না, বিলাপ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রঞ্জনের কান্নাও যে চোখে দেখা যায় না। বন্ধুর জন্য এত হাহাকার। বারবার একই কথা, ‘ললিত, তুই প্রমিস করেছিলি দুজনে একসঙ্গে থাকব, পাশাপাশি বাড়ি বানাব, দুজনে ছোটো দুটো গাড়ি কিনব সব মিথ্যে, তুই মিথ্যুক ললিত। আমায় না বলে তুই চলে যেতে পারলি!’ দোকান বন্ধ করে রঞ্জন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকে। অসীমা অনেক বোঝায় কিন্তু কিছুই হয় না। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল রঞ্জনের বন্ধুশোক ভুলতে। বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্বা খেল রঞ্জনের এক্সপোর্ট বিজনেসে। ললিত যে-অর্ডারটা নিয়ে স্কুটারে আসছিল তা ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল দুসপ্তাহের মধ্যে। তা হয়নি। বিদেশি অর্ডার। অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। বেশ বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল রঞ্জনের। বিদেশিদের কাছে একবার ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ পাওয়া দুষ্কর। ললিতের কাজের দায়িত্ব এখন একাই বহন করতে হচ্ছে রঞ্জনকে, সে দিশাহারা।

এরপরেই রঞ্জনের ব্যাবসায় শুরু হল শনির দশা। দোকান কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সারাদিন বাইরে থাকা। ক্ষতির পর ক্ষতি। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকেও বলেছিল দোকানে বসার জন্য। উনি রাজি হননি। ফলে যা হবার তা হল। কর্মচারীরা সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল অল্প দিনের মধ্যেই। ললিত-রঞ্জনের সংসারে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ বেলা হয়ে গেল, তবু অসীমা বাইরে এসে জলখাবার দিয়ে গেল না। রঞ্জন কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করেও সাড়া পেল না, নিজে উঠে ভেতরে গিয়ে অবাক, রান্না ঘরেও নেই। গেল কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অসীমা বিছানায়। চোখের কোনে জল, রঞ্জন অসীমার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সীমা ওঠো, কখন আমায় আর গোপালকে জলখাবার দেবে। আজ প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছে, কী ভাবছে বলোতো। ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো, আমি আর গোপাল সামনের দোকান থেকে কচুরি-তরকারি খেয়ে নিচ্ছি। তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’ হঠাৎ অসীমা রঞ্জনের দিকে ঘুরে বসল, ‘আমি এই বাড়িতে আর থাকব না।’

‘কোথায় যাব? এত অগোছালো অবস্থায় রয়েছি আমরা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যে-বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে আমরা দুজনে চলে এসেছি, সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়!’ রঞ্জন কথাগুলো বলে কপালে হাত দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অসীমা বলে, ‘তুমি জানো না,  ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় অবুঝ কাজ করুক না কেন, মা-বাবা দুঃখ পেলেও তাদের কখনওই মন থেকে দূরে ঠেলে না। প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনাই করে। তুমি মা-বাবার কাছে যাও। আমরা ওই বাড়িতেই ফিরে যাব।’

‘তা হয় না সীমা। যেদিন আবার আমার ব্যাবসা ঠিকঠাক চলবে, আমরা হইচই করে সেদিন আবার ও বাড়ি যাব। অসীমা কিছু না বলে একটু মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। রঞ্জন শুনতে পেল, ‘যার বাড়ি ভাড়া তিন মাস বাকি, সে আবার দোকান চালানোর স্বপ্ন দেখে, বড়ো ব্যবসাদার হবে। কিচ্ছু হবে না।’

রঞ্জন কেমন যেন চুপ মেরে গেল। জীবনের প্রতিকূল সময়ে তার সীমা আজ কোথায় তাকে সাহস জোগাবে তা না, আরও নিরাশ করে দিচ্ছে। রঞ্জনের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সে তো এমনটা চায়নি। সে অসীমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত বছরের প্রেম, বড়োলোকের মেয়ে। রঞ্জন সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যেদিন অসীমা একবাড়ি লোকের সামনে উঁচু গলায় টাকার কথা বলেছিল, সেদিনই তো বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘সবার আগে সম্মান, শান্তি। এই বাড়িতে সবাই আমরা শান্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচি। এমন কথা কেউ কোনওদিন বলেনি যাতে অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। হ্যাঁ, ঝগড়া হয় তবে তা মনে দাগ কাটার মতন নয়। ওটা তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে আঘাত দিয়ে কথা এ বাড়িতে কেউ কাউকে বলে না। আজ বউমা যা বলল, তুমি যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাও, বউমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও কারণ ওর দায়িত্ব তোমারই। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি আমাদেরই সন্তান। তোমার মঙ্গল হোক।’ বাবার এই কথার পর রঞ্জন একটা কথাও বলেনি। ও বাড়ি বদল করেছিল।

পরের দিন রঞ্জন সকাল-সকাল উঠে স্নান করে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ গোপাল এসে ডাকতেই রঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, অসীমাকে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’বন্ধু গেল ব্যাংকে। গোপালের জানাশোনা। গোপাল ছোটোবেলার বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না, গত মাসেই হঠাৎ দেখা তারপর কত গল্প, স্মৃতিচারণ, কেউ কাউকে ছাড়তেই চায় না। কথায় কথায় গোপাল জানাল ও কাপড়ের ব্যাবসা করে। সোজাসুজি আহমেদাবাদ থেকে কাপড়ের রিল আনায়, তারপর ব্লিচ করে বিভিন্ন দোকানে রঙিন থান শাড়ির অর্ডার সাপ্লাই করে। বেশ ভালো লাভজনক ব্যাবসা। রঞ্জন ইতস্তত করে গোপালকে তার দুরাবস্থার কথা, ব্যাবসায়ে ক্ষতির কথা জানাল। গোপাল কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে সাধ্যমতন সাহায্য করবে। এজন্যই তাদের আজ ব্যাংকে আসা।

সকালবেলাই রঞ্জন কোথায় গেল, ভাবতে গিয়ে অসীমার সব কাজে বেশ দেরি হল। চা বানিয়ে নিয়ে বসতে গিয়েই শুনতে পেল দরজায় ধাক্বার শব্দ, সঙ্গে কথা বলারও আওয়াজ। অসীমা বুঝল রঞ্জনের সঙ্গে কেউ আছে কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল, চমকে গেল, মেধা। ভিতরে আসতে বলল। মেধাকে বেশ রোগা লাগছে, মুখটা শুকনো। অসীমা ওদেরকে চা দিল, মেধা চা নিয়ে অল্প হেসে অসীমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’  অসীমা শুকনো গলায় বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ। থাকা আর না থাকা সমান। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।’ রঞ্জন দুজনের এই কথোপকথনে মাথা হেঁট করে বসে চা খেতে লাগল। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রইল।

সবাই চা শেষ করলে অসীমা চায়ের কাপ নিয়ে উঠতে উদ্যোগী হতেই মেধা নীরবতা ভাঙল। ‘ললিত চলে যাওয়াতে শুধু আমরা নই, তোমরাও বেশ অসুবিধার সামনে পড়ে গেছ। মনে হয় সবাই মিলে যদি এই ব্যাবসাটাই আবার অন্যভাবে শুরু করি।’

অসীমা রঞ্জনের দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই ভেবেছিল মেধা হয়তো ললিতের ভাগের টাকাটা চাইতে এসেছে। কিন্তু মেধার উদ্দেশ্য শুনে দুজনেই চুপচাপ। মেধা আবার বলতে শুরু করল, ‘নিজের খরচ কমালেও বাচ্চাটার খরচ তো কমানো যায় না। তাই ভাবছি আমার তো তিনটে ঘর, যদি একটা ঘরে একজন সেলাই জানা লোক রেখে কাজ করাই আর কাঁচামাল তো রঞ্জনদাই আনবে, তাহলে বোধহয় দুটো সংসারেই সাশ্রয় হবে।’ রঞ্জন বা অসীমা কেউ-ই মেধাদের কথা ভাবেনি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মেধার চিন্তা ভাবনা ওদের দুজনের মাথা হেঁট করিয়ে দিল। গোপালের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া গোপালও বলেছে যদি যৌথ ব্যাবসায় উদ্যোগী হয় তারা দুজনে মিলে। মেধার ভাবনাচিন্তা রঞ্জনকে আরও বেশি উসকে দিল কাপড়ের ব্যাবসার দিকে। রঞ্জন-গোপাল-মেধা আর যদি অসীমাও তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই কাজে তাহলে আর বাইরে থেকে লোক রাখতে হয় না। কথামতন কাজ, রঞ্জনের উৎসাহ সব থেকে বেশি। রঞ্জন হঠাৎই ভাবল, কেন অসীমা এমনভাবে ভাবল না! মেধা ললিতের পথে হাঁটতে অর্থাৎ ব্যাবসা করতেই আগ্রহী। আর অসীমা, উৎসাহ তো দেয়ই না উলটে রাগ ঝগড়া। রঞ্জনের মধ্যে এক দোলাচল শুরু হয়। মেধা জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে পাশে সশরীরে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তার অবর্তমানেও তারই ধ্যানধারণা নিয়ে চলাই ভালোবাসা। জীবনের সঠিক জীবনসঙ্গী সে-ই, যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ললিত আজ নেই তবু মেধা চলতে চাইছে ললিতেরই স্বপ্নকে বাস্তব করতে।

রঞ্জন মেধাকে বলল, ‘অসীমাও তোমার সঙ্গে কাজের দেখভাল করবে। তিনজনে মিলে আর গোপালের সাহায্যে আমরা আগের মতন গড়ে তুলব। আমাদের ব্যাবসা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।’ তাকিয়ে দেখল অসীমা হাসছে, চোখে জল।

অসীমা এতদিনে বুঝতে পারল শুধু টাকা-সম্পত্তি জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষের জন্য মানুষের এগিয়ে আসা, দুঃসময়ে তার পাশে থাকা, মানবিকতার হাত এগিয়ে দেওয়াতেই চরম সুখ। অল্পশিক্ষিত মেধার যে সহজাত বুদ্ধি ও তৎপরতা আছে, কলেজ পাঠ শেষ করা অসীমার মধ্যে সেই বোধের অস্তিত্ব ছিল না এতদিন। অসীমা আজ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

 

নতুন বৃত্ত

‘শুনছ? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

শাড়িগুলো ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল অদিতি। প্রশ্নটা কানে ঠিকই গেছে সুব্রতর। কিন্তু সে কোনও উচ্চবাচ্য করল না।

আসলে সে খুব ক্লান্ত। অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আজ অসম্ভব ভিড় ছিল। বসার জায়গা পায়নি। অবিরত কনুইয়ের ধাক্বা খেতে খেতে একঘণ্টার রাস্তাটা আসতে হয়েছে। স্টেশনে নেমেও কি শান্তি আছে? স্টেশন থেকে বাড়ি বাসে নেয় দশ মিনিট। কিন্তু বাসটা সাধারণত এড়িয়েই চলে সুব্রত। সেই তো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হবে। তার চেয়ে ফুটপাথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া অনেক আরামের। শরীরের ব্যায়ামও হয়, আবার পয়সাও বাঁচে।

কিন্তু সব মিলিয়ে এই ধকলটা তাকে খুব নাকাল করে দেয়। বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মনটা হাঁকুপাঁকু করে। কোনওমতে ঘামে ভেজা জামাটা ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। তাদের এই নতুন বাসাবাড়িতে ট্যাংকের জল পাওয়া যায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ে। অদিতি সেই জল বালতিতে জমিয়ে রাখে। সন্ধেয় সেই বালতির জলই হুড়মুড় করে মাথায় ঢেলে, ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। তারপর সটান বিছানায় গিয়ে চিতপাত হয়। টেলিভিশনটা খোলাই থাকে। তবে, ছবি দেখে না সুব্রত। কেবল কানে শোনে। খবর শোনে। স্টুডিয়োয় নেতা-নেত্রীদের বিতর্ক শোনে। অদিতি সাধারণভাবে এ সময়টা তাকে বিরক্ত করে না। চা করে এনে রেখে যায়। কিন্তু আজ অন্যরকম হল।

সুব্রতর কোনও সাড়া না পেয়ে অদিতি আবার ডাকল তাকে, ‘কী গো? ডাকছি যে, শুনতে পাচ্ছ না?’

সুব্রত এবার অসহিষ্ণু গলায় উত্তর দেয়, ‘কী?’

‘এদিকে ফেরো না! কেমন মানুষ গো তুমি?’

সুব্রত এপাশ ফিরে বলে, ‘ফিরেছি। বলো–!’

‘আজ এপাড়ায় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে, জানো?’ অদিতির কণ্ঠে উদ্বেগ।

সুব্রত চোখ বুজে রেখেই বলল, ‘কী হল আবার? এ পাড়াতেও কি তোমার মন বসছে না?’

হাতের শাড়িটাকে এলোমেলোভাবেই আলনার উপর ফেলে রেখে অদিতি, সুব্রতর পাশে খাটের উপর এসে বসল। সুব্রতর ডানপাশে জানলাটা খোলা আছে। তাই অদিতি গলা নামিয়ে বলল, ‘আজ এ পাড়ায় খুব মারপিট হয়েছে। ছুরি মেরেছে।’

‘কী?’ সুব্রত উত্তেজনায় আধশোয়া হয়, ‘কখন? কোথায়?’

‘এই তো আমাদের দরজার প্রায় সামনে। দুপুরবেলা। বাইরে হঠাৎ হইচই। দরজা খুলে দেখতে গেলাম, কে যেন কড়া গলায় বলল, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিন বউদি।’ আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছি। অনেকক্ষণ হইচইটা চলল। তারপর সেটা একটু থেমে যেতেই কান্নাকাটির রোল, আর-এক রকম হইচই শুরু হয়ে গেল।’

সুব্রতর চোখে পড়ল জানলাটা খোলা। সে ত্রস্ত হাতে সেটা বন্ধ করে দিয়ে ঘন হয়ে বসল।

‘কে কাকে ছুরি মেরেছে?’

‘পল্টুকে চেনো তো? ওই যে গো, টাইম-কলের সামনের বাড়িটায় থাকে! ওর বাড়িতে নাকি একটা লোক প্রায়ই যাওয়া-আসা করে। ওর বন্ধু। আজ বোধহয় সেই লোকটা মদ খেয়ে এসেছিল। পল্টু বাড়িতে ছিল না। সুযোগ পেয়ে পল্টুর বউয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করতে যায়। ইতিমধ্যে পল্টু ফিরে এসে ঘটনাটা দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে একটা ছুরি এনে সোজাসুজি বসিয়ে দিয়েছে বন্ধুর পেটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওহ্…!’

বলতে বলতে অদিতির চোখমুখের ভাব পালটে গেছে। এতক্ষণ পরেও ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল এই শীতের সন্ধেতেও।

সুব্রত নিজেও কম উদ্বিগ্ন হল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী,’ অদিতি বিরস গলায় বলল, ‘কেউ বোধহয় থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ এল। লোকটা তখনও মরেনি। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল দেখলাম। কে জানে লোকটা বাঁচল না মরল!

‘আর, পল্টু?

‘নাহ্, পল্টুকে ধরতে পারেনি। সে ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়েছে। পুলিশ সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না সে কোথায় গেছে। নাকি জেনেও বলল না, কে জানে!’

‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল নাকি, পুলিশ?’

‘করেছিল। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সাফ বলে দিয়েছি, সেসময় দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিলাম, তাই কিছুই কানে আসেনি।’

‘ওরা বিশ্বাস করল?’

‘বিশ্বাস করল কিনা জানি না। তবে, মাথা নেড়ে চলে গেল। আর কিছু জানতে চায়নি!’

‘খুব ভালো করেছ!’

‘মাথা খারাপ? কেউ এইসব ঝামেলায় পড়ে?

অদিতির মুখ সাদা হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে উত্তেজনায়। চোখের সামনে আহত লোকটির চেহারাটা যেই ভেসে উঠছে, অমনি শিউরে উঠছে অদিতি। মুহূর্তের মধ্যে মুখটা ঘামে তেলতেল করছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে ভীত চোখে সে সুব্রতর দিকে তাকাল।

তারপর বলল, ‘এদিকে পাড়ার লোকেরা সবাই দেখলাম পল্টুরই পক্ষ নিয়েছে। বলছে, পল্টু যা করেছে ঠিক করেছে। দুর্বৃত্ত বন্ধুটির এমন কঠোর শাস্তিই পাওনা ছিল। মাতাল অবস্থায় লোকটি নাকি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে মেয়ে-বউদের সঙ্গে অভব্যতা করত, রাস্তায়-ঘাটে তাদের উত্ত্যক্ত করে মারত। পল্টু ছিল ওর দোস্ত। বন্ধুর বউকেও শেষে লোকটা ছাড়েনি…!

সুব্রত আনমনাভাবে বলল, ‘কিন্তু তা বলেই তো আর নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে আর-একটা বড়ো অপরাধ করে বসা যায় না!’

এ কথার কোনও জবাব দিল না অদিতি। আধ-ভাঁজ করা শাড়িটাকে নিয়ে সে গোড়া থেকে ভাঁজ করতে থাকে। সুব্রতর ভয়টা অন্য জায়গায়। সারাদিন সেও বাড়িতে থাকে না। অদিতি একা থাকে। পল্টুর বন্ধুর মতো আরও কত লোক এ অঞ্চলে আছে কে জানে! কোনওদিন তারা তো এ বাড়িতেও ঢুকে পড়তে পারে সুব্রতর অবর্তমানে। সেই ভাবনাটা মনে আসতেই শিউরে উঠল সুব্রত।

এবং যে-সমাধানটাকে সে আর ভাবতে চায় না, সেটাই খুব সহজে বলে উঠল অদিতি।

‘আমরা অন্য কোনও জায়গায় বাসা ভাড়া করে চলে যেতে পারি না?’

অদিতিকে এর আগে অনেকবার সে বুঝিয়েছে, নিজের জায়গা থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পালাতে পালাতে একদিন দেখা যাবে, পালানোর জায়গাটাই আর নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সুব্রতর সেই যুক্তিটাকেও নেহাত জোলো বলে মনে হওয়ায়, সে মনে মনে অসহায় বোধ করতে থাকে।

অদিতি থেমে থেমে বলে চলেছে, ‘তুমি সকালবেলা চাকরিতে বের হয়ে যাও। সারাদিন এ বাড়িতে আমি একলা থাকি। ভীষণ ভয় করে, জানো! তাও তো কত ঘটনার কথা বলি না তোমায়! প্রত্যেকদিনই এ পাড়ায় কোথাও না কোথাও ঝগড়া, মারামারি! কখনও ছুরি-চাকু চলছে, কখনও লাথি-ঘুসি। যখন-তখন পুলিশ এসে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। ধরা পড়ছে মদের ড্রাম, আফিম কিংবা চুরির মাল। কখনও দিনের বেলা প্রকাশ্যে রাস্তায় পাড়ার কোনও মস্তান কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করছে। আবার কখনও কাছেপিঠের কোনও বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সি মেয়েদের। তারা নাকি মধুচক্র বসিয়েছিল। আর কতদিন এই বিশ্রী অবস্থাটা দেখে যেতে হবে বলো তো? মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ ভয় করে।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অদিতি। সুব্রত তাকে কোনও সান্ত্বনার কথা বলে না। তার সংকোচ হয়। অদিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে তার দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ করল। অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে সিলিংয়ের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাবনারা গতি পায়।

অদিতি তার সামনে যে-প্রশ্নটা রেখেছে, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় তার নেই। আবার এই প্রশ্নটার সামনে সে অসহায়ও। চাইলেও অদিতির আপাতসরল প্রশ্নের জবাব দিতে সে অপারগ। সে যদি বলতে পারত, ঠিক আছে, আমরা কালই অন্য কোনও পাড়ায় উঠে যাব, নতুন কোনও বাসায়, সে যেন বেঁচে যেত। কিন্তু সুব্রত জানে, এই শহরে নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কত কষ্ট করে এখনকার বাসাটা পাওয়া গেছিল, সে কথা সুব্রত ভোলেনি। ভালো টাকা সেলামি দিতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে রাজি হতে হয়েছিল উচ্চহারে ভাড়ার শর্তে।

সে কথা অবশ্য অদিতিরও অজানা নয়। অঞ্চলটা ভালো, কিন্তু সেখানে থাকার জন্য গুণাগারও দিতে হচ্ছে উচ্চ হারে, এ কথা সুব্রতর মুখ থেকে শোনার পর প্রথম বেঁকে বসেছিল সে নিজে।

‘এত টাকা ভাড়া?’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁগো, বাড়িভাড়াতেই তো আমাদের সংসারের সব টাকা বেরিয়ে যাবে, আমরা খাব কী?’

‘কী আর করা? ভদ্রলোকের পাড়ায় থাকতে হলে এটুকু খেসারত তো দিতেই হবে–!’

তারপর আর আপত্তি করেনি অদিতি। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সেদিন নিজের আপত্তিকে আরও জোরালো করে তুলতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। নিত্যদিনের এই উদ্বেগ আর হ্যাপা সইতে হতো না!

সারাসন্ধে, তারপর সারারাত পাড়াটা অদ্ভুত রকম নীরব আর শান্ত হয়ে রইল। সেই নীরবতা, যা সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর। যে নীরবতা ভয়ের বার্তাবহ। ভোর হওয়ার পরও থমথমে ভাবটা গেল না। গোটা পাড়াটা যেন দমবন্ধ করে অপ্রিয় কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময়ই সেটা টের পেল সুব্রত।

বাসস্টপে পৌঁছে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। স্বপ্নেন্দুর একটা ছোটোখাটো ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের দোকান আছে। প্রয়োজনে কখনও-সখনও স্বপ্নেন্দুর দোকানে যেতে হয়েছে সুব্রতকে। সেই থেকেই মুখ চেনা।

তাকে দেখতে পেয়েই স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞেস করল, ‘কাল আপনাদের পাড়ায় একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে শুনলাম! কী কাণ্ড বলুন তো!’

সুব্রত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘ভাবছি এ পাড়া থেকে চলে যাব। আপনি তো জানেন ভাই, আপনার বউদি সারাদিন একা বাড়িতে থাকেন! কাল যা ঘটেছে শুনলাম, তাতে এখানে পরিবার নিয়ে থাকাটাই তো দেখছি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে!’

‘কোথায় যাবেন?’ স্বপ্নেন্দু জানতে চায়।

‘ঠিক নেই। এখনও তো কাউকে কিছু বলিনি। তা ছাড়া এ সময়ে সুবিধেজনক ভালো জায়গায় বাড়ি পাওয়াও তো সহজ ব্যাপার নয়!’

স্বপ্নেন্দু শুনে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নিজের একটা বাসা আছে, দাদা! দশ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে নিয়েছিলাম। ভাড়া দিই মাসে দু-হাজার। ভেবেছিলাম পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকব আর বাড়ির বাইরে একটা দোকান দেব। কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত হয়নি।’

সুব্রত ভাবে, সকাল-সকাল স্বপ্নেন্দু তাকে পাকড়াও করে তার নিজের ইতিহাস শোনাতে বসল কেন!

স্বপ্নেন্দু অবিচলিত মুখেই বলে যেতে থাকে, ‘শেষপর্যন্ত পুরোনো বাড়িতেই রয়ে গেলাম, জানেন! ওই বাড়িটা তালা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। এখন ভাবছি, ভালো ভাড়াটে পেলে তাকে ছেড়ে দেব!’

সুব্রত হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল।

‘ছেড়ে দেবে? টাকাপয়সা কী দিতে হবে?’

স্বপ্নেন্দু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য কীসের টাকাপয়সা, কীসের কী দাদা? আপনি ওই দশ হাজার টাকাই সেলামি দেবেন। ভাড়া দু’হাজার। তাড়া নেই। রাজি থাকলে দশ-বারো দিনের মধ্যে একটু জানিয়ে দেবেন আমায়!’

স্বপ্নেন্দু তার মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

চিন্তায় পড়ল সুব্রত। দশ হাজার টাকা সেলামিতে ভালো জায়গায় বাসা পাওয়া এই সময়ে সহজ কথা নয়। তার উপর ভাড়াটাও মোটামুটি সামর্থ্যের মধ্যেই বলছে। এখন দেখার, পাড়াটা কেমন। সুব্রত ভাবল, আজ একবার অফিস থেকে ফেরার সময় স্বপ্নেন্দুর দোকানে যাবে। স্বপ্নেন্দু সেসময় যদি ফাঁকা থাকে, তাহলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটাও দেখে আসবে একবার।

রাতে বাড়ি ফিরতে অদিতি অন্য নানা-প্রসঙ্গের পরে জানতে চাইল, ‘কাউকে বলেছিলে নতুন একটা বাসা দেখার কথা?’

সুব্রত তখন দু-আঙুলে রুটি ছিঁড়ে আলু-পটলের তরকারিতে ডুবিয়ে মুখে দিয়েছে। চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আজই একটা দেখে এলাম অদিতি। পাড়াটা বেশ ভালো। বাড়িটাও। কিন্তু নিতে হলে দশ-বারো দিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এত অল্প সময়ে এত টাকা কোথায় পাই, বলো তো!’

অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘শোনো বিয়ের সময় বাবা কিছু গয়না দিয়েছিলেন। এমনিতেও সেগুলো খুব পুরোনো ডিজাইনের। আমি তো পরিই না–!’

আঁতকে উঠল সুব্রত, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমার গয়না বেচে টাকা জোটাব? আমার দ্বারা হবে না।… আর তা ছাড়া পরে কখনও তোমার বাবা জানতে চাইলে কী জবাব দেবে?

‘জবাবের ভারটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। সংসারের প্রয়োজনেই যদি কাজে না লাগল তো ওই গয়না দিয়ে আমার হবে কী?’

‘তবু, আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অদিতি,’ সুব্রত কিন্তু-কিন্তু করে।

‘তাহলে কি এভাবেই আমাদের জীবন কেটে যাক, এটাই বলতে চাইছ? প্রত্যেক মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে? তোমার আর কী? তুমি তো সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দাও! ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি আমি’– অদিতির চোখের কোলে জল টলটল করে।

অদিতিকে কিছু বলতে পারল না সুব্রত। সত্যিই তো, ত্রুটি তার দিক থেকেই হয়েছে। সুব্রতর বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছিলেন। তিনকূলে কেউ ছিল না সুব্রতর, এক দিদি ছাড়া। দিদি নয়নার বিয়ে হয়েছিল মফসসলের দিকে। উপরন্তু বিয়ের পর ওরা পাকাপাকিভাবে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা হয়ে যায়। কারণ, তার স্বামী অখিলের অফিস তাকে মুম্বাইয়ে বদলি করে। মুম্বাইয়ে যাওয়ার পরেই সুব্রতর উপরে বিয়ের জন্য চাপসৃষ্টি করা শুরু করে দেয় নয়না। স্বাভাবিক, দিদি হিসাবে তার গভীরতর চিন্তা ভাইকে নিয়ে। ভাইকে জীবনে সেটলড দেখলে  খুশি ও আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সুব্রতরও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও তার দরকার ছিল কয়েকটা বছর। সে অনেকবারই এ কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছে একাদিক্রমে নয়না ও অখিলকে। ওরাও অনড় ছিল। অখিল তো এমনও বলেছিল, ‘তোমার তো বাড়তি চিন্তা করার কিছু নেই সুব্রত! আমরা তো রইলাম!’

সুব্রত বলতে চেয়েছিল, ‘বউকে এনে তুলব কোথায়? এই ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়িতে?’

‘ভাঙাচোরা বাড়ি সারিয়ে নিলেই সুশ্রী হয়ে যাবে,’ অখিল সহজ সমাধান করে দিল।

‘কিন্তু, তা সত্ত্বেও কিছু হওয়ার নয় অখিলদা। একখানা মাত্র ঘর। তাও এইটুকু–!’

‘তাহলে অন্য একটা বাড়ি দ্যাখ! যত তাড়াতড়ি পারিস! আমি পাত্রী দেখা শুরু করি,’ কঠোর সিদ্ধান্তের মতো জানিয়ে দিয়েছিল নয়না।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সুব্রতর কান্না পেয়েছিল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়া মলিন ঘরের অবিন্যস্ত চেহারা দেখে সে ভেবে পাচ্ছিল না কোন স্পর্ধায় কোনও তরুণীকে এ বাড়িতে থাকতে সে বাধ্য করতে পারে! নতুন বাসা যে দেখবে, সেও অনেক টাকার ব্যাপার। সেলামি দিতে হবে। পুরোনো বাড়ির মতো পুরোনো ভাড়ায় থাকা যাবে না।

আলমারির লকার থেকে ব্যাংকের পাশবই বের করে সে নানারকম হিসেবনিকেশ করে দেখল। সঞ্চয় সামান্যই। তবু, সেটাকেই সম্বল করে সে একটি ভদ্রস্থ বাসাবাড়ির সন্ধান চালাতে থাকে। অখিল অবশ্য বলেছিল, ‘আজকাল কলকাতায় এঁদো গলিতেও কত ফ্ল্যাট উঠছে!’ সুব্রত এড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাট কিনতে হলে তাকে লোন নিতে হবে। কিন্তু এখনই ঋণের জালে জড়াতে রাজি নয় সে।

নতুন বাসাবাড়ি ঠিক করে অখিল আর নয়নার সঙ্গে অদিতিকে দেখতে গেছিল সুব্রত। অফিসের কাজ উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসেছিল অখিল। সঙ্গে নয়নাকেও নিয়ে এসেছিল। এক সন্ধ্যায় তারা গেছিল অদিতিদের বাড়িতে। শীতকাল। বড়ো রাস্তার হ্যালোজেনের নীচে মৌচাকের মতো কুয়াশা জমে আছে।

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার অদিতিদের। আড়ম্বর বিশেষ নেই। প্রথম দর্শনেই ধীর-স্থির, শান্ত, ভীরু চোখের মেয়েটিকে দেখে তার প্রতি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করেছিল সুব্রত। অখিলের ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল। সুব্রতর সম্মতি আছে দেখে, এখানেই সম্বন্ধ পাকা করে এসেছিল নয়না। বলেছিল, ‘তাহলে, আসছে ফাগুনেই চার হাত এক হয়ে যাক–!’

অদিতি এ বাড়িতে আসার পর, দৈনন্দিন জীবনের চেনা ছকটাই পালটে গেল সুব্রতর। সংসারের প্রতি, বাড়ির প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ, প্রতিদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরিয়ে আনত বাড়িতে। জীবন একটা নতুন ছন্দে বয়ে যেতে থাকল স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর মতো।

কিন্তু সেটা অন্তরের উন্মাদনা। তাদের নতুন পাড়ায় আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তাদের চোখের আড়ালে, যা সেই উন্মাদনার প্রাবল্যে কিছুদিন ঢাকা পড়ে রইল। উন্মাদনা কিঞ্চিৎ স্থিমিত হয়ে এল যেদিন, সেদিন থেকে চোখে পড়তে থাকল বাহিরের আসল চিত্রটা। তখনই চারপাশের পরিবেশটা যেন দীর্ঘ এক অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরতে থাকল তাদেরকে, এমনকী তাদের সম্পর্কের সারল্য, নিরাপত্তা আর নৈকট্যকেও।

একদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাদের বাসার ঠিক সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষের অশালীন ঝগড়া শুনল সুব্রত। আর-একদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরতে অদিতি জানাল, পাড়ায় বোমা পড়েছে। একদিন গভীর রাতে তারা শ্বাস চেপে রেখে শুনল, পুলিশের জিপ আসার আওয়াজ। তার কিছুক্ষণ পরেই দ্রুত কিছু পায়ের দৌড়ে যাওয়া, চাপা গলায় চিৎকার। পরদিন সকালে শোনা গেল, কয়েক গ্যালন দেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে। নিত্যদিন এমনই চলতে থাকল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অদিতির কাছে পাড়া সম্পর্কে এক-একটি নতুন কাহিনি শুনতে থাকল সুব্রত। শেষে একদিন অত্যন্ত অসহিষ্ণু গলায় অদিতি প্রশ্ন করল, ‘আমি তোমার স্ত্রী তো, নাকি?’

‘হঠাৎ এমন অদ্ভুত প্রশ্ন?’

‘বলো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও–!’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!’

‘এবার বলো, কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এরকম একটা অসুরক্ষিত জায়গায় সারাদিনের জন্য একা রেখে চলে যায়?’ অদিতির চোখের কোলে অভিমানে টলমল করে জল।

সুব্রত খুব অসহায় হয়ে যায়। সহজে কোনও উত্তর দিতে পারে না। কতবার সে অধৈর্য হয়ে ভেবেছে অদিতিকে বলবে, ‘তুমি তাহলে আপাতত সেই মফসসল শহরে তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকো। এখানে একটা ভালো বাড়ি পেলে, তোমাকে নিয়ে আসব।’

কিন্তু বাক্যগুলো শেষপর্যন্ত জিভ থেকে ঠোঁটের গোড়ায় আসেনি। কেন-না, এই সাময়িক বিরহের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাকে তার সহকর্মীরাও বলেছে, কলকাতা শহরে এ ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া মুখের কথা নয়। এই অবস্থায় কোন মুখে অদিতিকে সে বাপেরবাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে?

এইসব চিন্তাভাবনা তাকে তিষ্ঠোতে দেয় না। অফিসের কাজেও মন বসে না তার। অনেকেই তার মধ্যে এই উন্মনা ভাবটা লক্ষ করেছে। সেদিন তার সহকর্মী অয়ন তাকে রীতিমতো চেপে ধরল, ‘কী হয়েছে তোর?’

‘কই, কিছু না তো!’

‘কিছু তো হয়েছেই। তোকে এত আনমনা আগে কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই কিছ লুকোচ্ছিস!’

সুব্রত খানিকটা বাধ্য হয়েই সব কথা খুলে বলে। অয়ন সব শুনে গম্ভীর হল। খানিকক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘এটা তো ঠিক-ই কলকাতা শহরে ভাড়াবাড়ি পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর। চতুর্দিকে সব ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। রেস্ত থাকলে কিনে নাও। না হলে একটা ভালো পাড়ায় কোনও ভদ্র গৃহস্থের বাড়ির একচিলতে ঘরের জন্য মাথা কুটে মরো!’

এসবই সুব্রত জানে। তবু অয়নের কথা শুনে যায়। শেষে অয়ন আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল।

‘ঠিক কলকাতা শহরের মধ্যে না, একটু দূরে যাবি? এই ধর, বাসে করে অফিস পৌঁছোতে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট লাগবে!’

‘সে তো অনেক দূর!

‘দূর হলেই বা, শান্তি আছে। ওখানে আমার মামার বাড়ি। শরিকি বাড়ি। দিদিমা যে-অংশটায় থাকত, দিদিমা মারা যাওয়ার পরে সে অংশটা ফাঁকাই। দুটো বড়ো ঘর। রান্নাঘর। বাথরুম। রাজি থাকলে বল, কথা বলি!

সুব্রত মাথা চুলকে বলল, ‘একটু গ্রামের দিক হয়ে গেল না?’

‘গ্রাম?’ অয়ন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘গ্রাম কী রে? আগে ছিল মফসসল। এখন রীতিমতো শহর। কলকাতা শহরটা ক্রমশ ওদিকে বাড়ছে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে গোল গোল তরঙ্গ হতে দেখেছিস? ঠিক ওরকম করে বৃত্ত বড়ো হচ্ছে। মূল শহরে তারাই থাকবে, যাদের ট্যাঁকের জোর আছে, বুঝলি? আর, আমাদের মতো হাভাতেরা সেই তরঙ্গের ঘাড়ে চেপে ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে নতুন বৃত্ত তৈরি করে। ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট, বস্!’

অদিতিকে বলতে সে লাফিয়ে উঠল। সে মফসসলেরই মেয়ে। তার তো খুশি হওয়ারই কথা। তার দুটো গয়না বাঁধা দিতেই হল। নইলে সেলামির টাকাটা জোটানো যাচ্ছিল ন।

ওরা উঠে এল নতুন বাসায়। পুরোনো বাড়ি। কিন্তু অনেকটা জায়গা নিয়ে। পিছনের দিকে বেশকিছু গাছগাছালিও আছে। সুব্রত বলল, ‘নাও, এবার খুশি তো? এখানে আর দিনদুপুরে খুনখারাবির প্রশ্ন নেই। কত ভদ্র পাড়া!’

অদিতি আকর্ণ হেসে বলল, ‘সত্যি!’

তবে সুব্রতকে ইদানীং একটু তাড়াতাড়িই অফিসে বের হতে হয়। অনেকটা রাস্তা। আগে থেকে বোঝা যায় না, কখন যানজট হবে! ফিরতেও আগের তুলনায় রাত হয়। সেসবই হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সুব্রত।

দেখতে দেখতে নতুন বাসায় দু-মাস কেটে গেল তাদের। ভরা বর্ষায় তাদের ভাগের কিচেন গার্ডেনে লকলকিয়ে উঠল লাউগাছ। সুব্রত এক রবিবার বাঁশের কঞ্চি কেটে মাচা বানিয়ে দিল।

মরশুমের শেষ বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। ছাতা মাথায় আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে সদর দরজার কড়া নাড়তেই হাট করে খুলে গেল দরজাটা। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল অদিতি। লোডশেডিং হওয়ায় তার অবয়বটা শুধু আন্দাজ করতে পারছিল সুব্রত। তাতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

অদিতি বলল, ‘ওগো, আমরা আবার একটা খারাপ জায়গায় চলে এসেছি।’

‘মানে?’

‘আজ এ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’

‘কেন?’

‘পাশের বাড়িতে অনেকদিন ধরে নাকি মধুচক্র চলে। কলকাতার বেশ কিছু রাঘব বোয়ালের এখানে যাতায়াত। আজ পুলিশ এসে সবকটাকে হাতেনাতে ধরেছে। সব বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে, মা গো। কী নোংরা, কী নোংরা…!’

বলতে বলতে আন্ধকারের বুক চিরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অদিতি। আকাশটা ভেঙেচুরে গিয়ে উথালপাতাল বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুব্রত। অনুভূতিহীন। বৃষ্টির ধারাল ফোঁটাগুলি চৌবাচ্চার জলে লাফিয়ে পড়ছে। জমা জলে হুটোপুটি করছে। জলের তরঙ্গে বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। একটার পরে আর-একটা।

 

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডারলিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখলেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ বাজার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না। ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের ঘুম উড়ে যাওয়ার অবস্থা হল।

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে পর, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল ওর। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিলে। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেযেটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া করা ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই বদ্ধমূল ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয় সাগরে নৈঃশব্দ্যের তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

সন্দেহ

(১ )

এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।

বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।

ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।

পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।

দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।

সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।

চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।

—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।

—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।

—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?

পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।

কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।

রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।

বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।

জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।

রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!

রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!

—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।

রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!

রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।

( ২ )

বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।

শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!

বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।

এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।

পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।

—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।

—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!

—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।

—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।

—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।

—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।

—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।

—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?

—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?

ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।

বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?

চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!

ইতি ঊর্মি

সকাল এখন আটটা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমার বিপরীতে অমর। আমাদের সংসারের তৃতীয়জন অর্থাৎ ঊর্মি আজ টেবিলে নেই। ঊর্মির কথা মনে পড়তেই ল্যান্ডফোন বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে ব্যারিটোন ভেসে আসে এটা কি ঊর্মি দাশগুপ্তর বাড়ি?

—হ্যাঁ, বলছি, জবাব দিই আমি।

—আপনি?

—ওর মা, মিসেস দাশগুপ্ত।

—শুনুন মিসেস দাশগুপ্ত, ময়দান থানা থেকে বলছি, আপনার মেয়েকে সেন্সলেস অবস্থায় ময়দানে পাওয়া গেছে। ওকে আমরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করিয়েছি। পকেটে ভাগ্যিস মোবাইলটা ছিল। ওটা থেকেই আপনাদের নম্বর পেলাম। শিগগির একবার নার্সিংহোমে আসুন।

লাইন কেটে যায়।

পুরো ঘটনাটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। গতকাল রাতে ঊর্মি বাড়ি ফেরেনি। থানা, পুলিশ, নার্সিংহোম শব্দগুলি একসঙ্গে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। আমি ঘামতে থাকি। ইদানীং সামান্য উত্তেজনাতেই প্রেসারটা বেড়ে যায়।

বিপরীতে বসে থাকা অমর নির্বিকার চিত্তে টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে কফির মধ্যে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাথাটা ঝাঁ করে জ্বলে ওঠে। হাতে থাকা স্যান্ডউচটা ধাঁই করে ছুড়ে মারি ওর মুখে। আচমকা আঘাতে অমর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চলকে পড়ে কফি। থতমত খেয়ে বলে, কী-কী মানে কী হল!

—কী হল! তোমার মেয়েকে ময়দানে আনকনসাস অবস্থায় পুলিশ পেয়েছে। ওকে ওরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করেছে।

—সে কী! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ওর। বলে, চলো চলো, এক্ষুনি চলো। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অমর টেবিলে এমন জোরে ধাক্কা মারে যে টেবিলের কফিমাগ, ব্রেড, ডিমের পোচ, জলের জাগ, ইত্যাদি ছিটকে পড়ে আমার গায়ে।

রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলি, আচ্ছা অপদার্থ ব্যাটাছেলে একটা!

—বেবি, ইয়ে মানে, কিছু মনে কোরো না, আমি ইচ্ছে করে…, ঘাবড়ে গেলে তোতলানো অমরের পুরোনো অভ্যাস।

—চোপ, একদম চোপ। এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করো। আর হ্যাঁ, তোমার ক্রেডিট কার্ড, ঊর্মির মেডিক্লেম কার্ডটা নিতে ভুলো না। যাও শিগগির।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাই, ধ্যাতানি খেয়ে অমর ছোটে। আমিও তৈরি হয়ে নিই চটপট! এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব? অমরটা চিরকাল নার্ভাস। কোনও ঘটনা ফেস করার মতন মানসিক জোর নেই। কী করে অফিস সামলায় কে জানে? ইদানীং একটু ঘাবড়ে গেলেই হুইস্কি নেয়। আর হুইস্কি পান করে আরও বোদাটে মেরে যায়। মাথা একদম কাজ করে না। তখন বলে, বেবি, প্লিজ ডু সামথিং। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। একটা যা তা।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অমর বলে, বেবি, ঊর্মির ইন ফ্যাক্ট কী হয়েছে বলল পুলিশ?

—বলল, ওকে আনকনসাস অবস্থায় ময়দানে আজ ভোরে পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ঘটেনি, জবাব দিই আমি।

অমর খানিক থম মেরে থেকে আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এইসব, সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই মেয়েটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছ। উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে মুখ-চোখ।

আমারও মাথা গরম হয়ে যায়, মুখ সামলে কথা বলো অমর। সাবধানে গাড়ি চালাও। ইদানীং মাঝেমধ্যেই ও কেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে জ্বলে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এরকম করত। একবার শ্যামলদাকে দিয়ে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছিলাম। এতদিন ঠিক ছিল। আবার বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই উকিল বন্ধুটাই মাথা খাচ্ছে ওর। কী সাম চ্যাটার্জী যেন। ওটাকে একটু সাইজ করতে হবে।

গাড়ি পার্কিং লটে দাঁড় করিয়ে ছুটে যাই আমরা। দেখি ক্যালকাটা পুলিশের এক সাবইন্সপেক্টর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনাসামনি আসতেই বলল, আপনারা মি. অ্যান্ড মিসেস…

—দাশগুপ্ত, কথা শেষ করি আমি, হোয্যার ইজ আওয়ার চাইল্ড?

—আসুন আমার সঙ্গে, বলে অফিসার লিফটের দিকে এগোন। ওকে অনুসরণ করে একটি কেবিনের সামনে পৌঁছোই, উনি ইঙ্গিতে বোঝান ওটাই ঊর্মির কেবিন। ধন্যবাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ঊর্মি আনকনসাস। পাশে একটি নার্স বসে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।

দ্রুত ঊর্মির সামনে যাই। ঠোঁট ফুলে উঠেছে, নীলচে বাদামি জমাট রক্ত। গালে, গলায় দাঁতের দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। অমরের দিকে তাকাই।

—ঊর্মি, মাই চাইল্ড, হাউমাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমর ওর বুকে। কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতো। ওকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি। নার্স বলে ওঠে, আরে আরে করছেন কী, শি নিডস কমপ্লিট রেস্ট। আপনারা ডক্টরের সঙ্গে দেখা করুন।

—কে দেখছেন ওকে? আমি প্রশ্ন করি। অমর চোখের জল মোছে। ডক্টর সোম। আসুন আমার সঙ্গে, নার্স এগিয়ে যায়। সোম-এর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়টুকু দিয়ে ও চলে যায়।

—প্লিজ বি সিটেড। ডক্টর সোম বলেন, আচ্ছা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মেয়ে কোনও ড্রাগস নিত?

অমর বা আমি কেউই এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। দুজনে দুজনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর আমিই দিলাম, না, সেরকম তো কোনওদিন দেখিনি। এ প্রশ্ন করছেন কেন?

—মেয়েটি ডেডলি আনকনসাস। ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিক পর্যায় জানা গেছে কোনও উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত ড্রাগ ওর শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাগটা ল্যাবে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।

—বললাম, আপনি ডাক্তার, আপনার কাছে কিছু লুকোনো উচিত নয়। ইদানীং ঊর্মি ড্রিংকস নিত একটু আধটু। তবে ড্রাগস যে নিত না সে ব্যাপারে আমি শিওর।

—খোঁজ নিন ভালো করে। ওর ঘর সার্চ করুন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আজকালকার হাইপ্রোফাইল অ্যাফ্লুয়েনট ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এইসব নেশার কবলে পড়ে জীবন শেষ করে ফেলছে। মনে রাখবেন, ইয়োর চাইল্ড ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস ব্লেসিং অন ইউ। একটা বাচ্চার জন্য চাইল্ডলেস কাপলসরা কী মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছেন তা তো দেখছি।

আমি চুপ করে থাকি। অমরের অবস্থা বুঝি এক্ষুনি ফেটে পড়বে। ইদানীং আবেগটাবেগ একদম চেপে রাখতে পারে না। স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করেই বার্স্ট করে, অত্যধিক অ্যালকোহল ইনটেকের ফল। কিন্তু মনে যে আশঙ্কা উঁকি মারছে সেটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া প্রয়োজন। বলি, ইজ শি ওকে অ্যাজ আ উয়োম্যান?

ডক্টর সোম কঠিন স্বরে বলেন, আই অ্যাম সরি টু সে মিসেস দাশগুপ্ত, শি ওয়াজ ব্রুটালি রেপড অ্যাজ অ্যান আনফ্রেমড প্রপার্টি। সম্ভবত, বাই আ গ্যাং অফ পার্সনস। আওয়ার এগজামিনেশন ইজ গোয়িং অন।

—ওহ্ মাই গড! শোনামাত্র অমর চেঁচিয়ে ওঠে পাগলের মতো। দুহাতে মুখ ঢাকে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। আমার মেয়ে এত বড়ো বোকামি করল? কিন্তু কেন? আমারই মতো ফাস্ট লাইফ চায় ও। হ্যাঁ, ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমি। তবে সেজন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা নিতেও কি শেখাইনি ওকে? অমরটা কেঁদেই চলে।

—শান্ত হোন, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। ডক্টর সোম বলেন, থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। ইয়োর কেস হ্যাজ অলরেডি বিন লজড।

মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, এখন আমাদের কী করণীয়?

—মেডিক্লেম কার্ড আছে নিশ্চয়ই? ওটা রেখে যান, সঙ্গে আপনাদের ভিজিটিং কার্ড। অমর ওগুলি এগিয়ে দেয়, ফের দুহাতে মুখ ঢাকে। বলে, উফ্ আমি, আমি ভাবতে পারছি না।

ডক্টর সোম এগিয়ে এলেন। অমরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভেঙে পড়বেন না মি. দাশগুপ্ত। ঘটনা এর থেকেও খারাপ হতে পারত। মেয়েকে ফেরত না-ও পেতে পারতেন। দুষ্কৃতিরা ওকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিংবা শরীর থেকে অপারেট করে কিডনি, আই, ব্লাড ইত্যাদি বের করে নিতে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন সেসব কিছুই ঘটেনি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন আপনারা। নাও প্লিজ গো হোম, অ্যান্ড কিপ ক্লোজ কনট্যাক্ট উইথ আস। ওর জ্ঞান আসলে জানানো হবে।

ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অমর আর আমি থানা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মানসিক ভাবে দারুণ বিপর্যস্ত আমি। ঊর্মির এই মারাত্মক পরিণতিটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। এইমাত্র ডক্টর সোম ফোনে জানালেন যে, ঊর্মির জ্ঞান ফিরেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। এক্ষুনি ওর চোখের সামনে দুএকটি প্রিয়জনের মুখ বড়ো প্রয়োজন।

সাধারণত অফিস ছাড়তে আমার আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু এরকম ফোন পাওয়ার পর আর অফিসে থাকা সম্ভব নয়। গাড়ি নিয়ে দ্রুত নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিই।

গাড়ির গতি বাড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে ঊর্মির জন্য। চোখের কোল ভিজে যায়। ওর এই পরিণতির জন্য কি আমি দায়ী? ওকে তো সব সময় বোঝাতাম আমি। তা ছাড়া নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতন বয়স ওর হয়েছে। একুশ বছর বয়স নেহাত কম নয়! মানুষ হতে গেলে যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খামতি ছিল না। তবু মেয়েটা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?

—আচ্ছা বেবির কি উচিত ছিল না, একটু সংযত জীবন যাপন করা? নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতাকে ও পলিশড স্বাধীনতার মোড়কে মুড়ে নিয়েছে। মায়ের অসংযত জীবনযাত্রা কি ঊর্মির মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। মা হিসাবে কতটুকু কর্তব্য করেছে বেবি? সেই ছোট্টবেলা থেকে তো মেট্রনের দাযিত্বে বাচ্চা। মাত্র চার মাসের বাচ্চাকে ফেলে অফিস জয়েন করেছিল, আমার বারংবার বারণ সত্ত্বেও। তিন বছর বয়স থেকেই ও ক্রেশে। ক্লাস ওয়ান থেকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বন্ডিংটা তৈরি হবে আর কী করে?

গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে চারতলায় ঊর্মির কেবিনে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঊর্মি, আমার দিকে তাকাল, অস্ফুটে উচ্চারণ করলে, বাপী। বলেই জ্ঞান হারাল।

দ্রুত ওর কাছে যাই। মাথায় হাত বুলোতে থাকি। চোখ দুটো আমার কেন যে এত অবাধ্য?

কতক্ষণ এভাবে কাটে জানি না। ঈশ্বরকে ডাকি, ভগবান, ওকে সুস্থ করে তোলো তুমি। নার্সের তাগাদায় বাইরে আসি। ডক্টর সোমের চেম্বারে যাই। বসুন মি. দাশগুপ্ত, বলেন ভদ্রলোক। এখন কেমন বুঝছেন?

—বেটার দ্যান বিফোর। সকালে বেশ কয়েকবার জ্ঞান এসেছে এবং গেছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে মাইল্ড। আমরা চাইছি পেশেন্ট যতটা সম্ভব মেন্টাল রেস্টে থাক। জেগে উঠলেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে।

—ওর শরীরের ড্রাগটা আইডেন্টিফাই হয়েছে?

—হ্যাঁ, অতি পরিচিত একটা ওষুধ, কমনলি নোন অ্যাজ ক্লাব ড্রাগস। সম্ভবত ওর অজান্তেই ড্রিংকসে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। শুনলাম ও সেদিন কলকাতার এক ডিসকো ঠেক-এ মাঝ রাত অবধি ছিল।

—ড্রাগটা কি খুব মারাত্মক?

—ইয়েস, ভিক্টিমের বিন্দুমাত্র বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে না।

পুলিশ এসেছিল শুনলাম। আমি আবার প্রশ্ন করি।

—হ্যাঁ, ওরা তদন্তের স্বার্থে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল বলে শুনলাম। আমি তখন ছিলাম না, রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম।

—ঊর্মির এ অবস্থায় ওদের অ্যালাউ করলেন কেন? অনুযোগ তীব্র হয় আমার।

—বারণ করে দিয়েছি, পেশেন্ট সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা আর ডিস্টার্ব করবে না, বললেন ডক্টর সোম।

—থ্যাংক ইউ ডক্টর।

—ইটস অল রাইট। মনে জোর রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইট ইজ আ গ্রেট শক ফর হার। শি নিডস প্রপার কাউন্সেলিং। ওকে শারীরিক ভাবে একটু সুস্থ করে সে ব্যবস্থা আমরা করব।

ডক্টর সোমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের ঊর্মির কাছে যাই। ও এখনও অচেতন। মাথায় হাত বুলোই। নীরবে চোখের জল ফেলি। একসময় নার্সিংহামে ছেড়ে গাড়িতে এসে বসি। নিজেকে এত দুঃখিত, এত অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি।

ড্রাইভ করতে করতে মনে হয়, ঊর্মিকে বড়ো করে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। যদিও মেয়ের এডুকেশনাল ব্যাপারগুলি বরাবরই বেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছে। বেবির ইচ্ছাতেই ঊর্মি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গার্লস হস্টেলে। ঊর্মি ছুটিতে বাড়ি আসলে বেবি অসন্তুষ্ট হতো।

গাড়িটা ক্লাবে পার্ক করি। আজ আর কারুর সঙ্গে নয়, একা একাই মদ্যপান করব। কোনার দিকে এক টেবিলে বসে দুটি ড্রিংকসের অর্ডার দিই।

ড্রিংকস নিতে নিতে মনে হয়, আমি নিশ্চিত, ঊর্মির আজকের পরিণতির জন্য বেবিই দায়ী। হ্যাঁ ঠিক তাই, বেবিই দায়ী। একবার শক্ত হাতে হাল ধরতে গিয়ে যা অবস্থা হয়েছিল, ল্যাজে-গোবরে একদম। ক্যালকাটা পুলিশের কোন ইন্সপেক্টর নাকি ওর দাদা, সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী অপমান!

শালা, এমন হড়কানি দিল, পিলে চমকে যাবার জোগাড়। ব্যাটা বলে কিনা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার স্ত্রী যে কমপ্লেন দিয়েছেন তাতে এক্ষুনি ফোরনাইনটি এইট-এ ধারায় কেস স্টার্ট করতে পারি, সেটা জানেন কি? অ্যারেস্ট করে আজ সারা রাত লকআপে রাখব, কাল কোর্টে চালান করব। নব্বই দিনের আগে জামিন পাবেন না। আর উনি আমাকে আপনার সম্পর্কে যা যা বললেন, তা যদি কোর্টে বলেন, কম সে কম বছর দশেক জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে। যাবেন নাকি?

—কোথায়? সভয়ে প্রশ্ন করি আমি।

—ঘানি টানতে?

আমি চুপ করে থাকি। লজ্জায় মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিই। নিজের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে… উফ্ ভগবান!

শালা আইসি বলে, স্ত্রীকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ওকে ঘাঁটালে কী হতে পারে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? যান, বাড়ি যান এখন। কমপ্লেনটা আমার কাছে থাকল, দেখবেন এটা যেন আমাকে ব্যবহার করতে না হয়।

ধ্যাতানি খেয়ে গরুচোরের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর কোনওদিন বেবির সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়নি। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো। বেবি কী একটা এনজিও চালায়। তাছাড়া নানারকম মিটিং-ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বছর খানেক কথাবার্তা বন্ধ ছিল। পরে বন্ধুবান্ধব, লোকজনের নিন্দামন্দের কথা ভেবে আমাকে আপস করতে হল, বিশেষ করে ঊর্মির মুখ চেয়ে। ঊর্মি তুই কি বুঝবি না মা, আমার যন্ত্রণার কথা? এই নীরব রক্তক্ষরণের কথা? চোখ ফেটে জল আসে আমার।

—স্যার, আর কিছু? দেখলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য ছেলেটি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে টু মোর প্লিজ, জবাব দিলাম আমি। বেয়ারা সোডা বরফ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে দিল। গেলাসে ঠোঁট ঠেকাই আমি। আমার মনে হয়, বেবির সঙ্গে দাম্পত্যের এই ফাটলের প্রভাব আমি কোনওদিন ঊর্মির ওপর পড়তে দিইনি। আমার কর্পোরেট লাইফের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও যখন যতটা পেরেছি সময় দিয়েছি ওকে।

আশ্চর্য! গত তিন-চার বছরে ঊর্মি কত দ্রুত বদলে গেল! যা সব বন্ধুবান্ধব জুটল। কী তাদের অদ্ভুত সাজগোজ, কানে দুল, নাকে দুল, চুলে রং। ঊর্মিকে কত বুঝিয়েছি, যে-ফাস্ট লাইফ তুমি লিড করছ, ইটস নট অফ ইয়োর কালচার। টেক ইয়োর লাইফ সিরিয়াসলি, সব সময় সাবধানে থাকবে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে বাবা হিসাবে এর বেশি আর কী বলা যায়?

বছর খানেক হল ঊর্মি কেন সাইলেন্ট হয়ে গেছিল। প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দিত না। বকাবকি করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। কেবলই হাত খরচের টাকা বাড়াতে বলত। একুশ বছরের একটি মেয়ের পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচে পোষায় না? কী করে ও অত টাকা নিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ করে, শুনেছি। ওখানে মাইনেপত্তর ভালো। এত টাকা উড়িয়ে কী সুখের সন্ধানে তুই মেতে ছিলি মা? একটিবার আমার কথা ভাবলি না?

কিন্তু সেদিন ডিসকো ঠেক-এ ঊর্মিকে কারা নিয়ে গিয়েছিল? কে ওর ড্রিংকসে ক্লাব ড্রাগস মিশিয়েছিল? এভাবে কারা রেপ করল ওকে? পুলিশ কি পারবে কালপ্রিটগুলোকে ফিক্স আপ করতে? হাজার প্রশ্নেরা আমাকে তাড়া করে। পাগলা কুকুরের মতো আমার ভিতর ছুটতে থাকি আমি। উত্তেজনায় মদের মাত্রা বাড়ে। এক সময় সব কেমন জেবড়ে যায়।

শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা,

এ চিঠি যখন তোমরা পাবে আমি তখন অনেক অনেক দূরে। এখন রাত্রি তিনটে। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া শেষ। আজ ষষ্ঠ দিন। শরীরের ব্যথা অনেকটা কমেছে, বেশ সুস্থ বোধ করছি। কয়েকটি ক্ষত থেকে যাবে মনে হচ্ছে।

এ কয়দিনে আমাকে নিয়ে পেপারে যা লেখালেখি হয়েছে তাতে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তাই এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাব মনস্থ করেছি। যাবার আগে তোমাদের সব জানানো উচিত বলে লিখে যাচ্ছি এ চিঠি।

কীভাবে যে এত সব ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কোনও না কোনও পরিচিত মুখ পেয়ে যাব এই আশায় ডিসকো ঠেক-এ আমি গেছিলাম। এক পেগ হুইস্কি নেবার পর ইচ্ছা করল একটু নাচতে। ডান্স ফ্লোরে একটা ছেলে হেসে নাচতে ডাকে। ছেলেটা স্মার্ট। নাচতে নাচতেই পরিচয় দেয়, ওর নাম জাভেদ। নিউ মার্কেটে ওর নাকি লেদার গুডসের দোকান আছে।

নাচ শেষ করে একটু দম নেবার জন্য বসি। আর একটা পেগের অর্ডার দিই। আমার সামনে এক জোড়া ছেলে মেয়ে দারুণ নাচছিল। সম্ভবত সেই সময়ে পাশে থাকা চাপ দাড়িওলা লোকটা আমার ড্রিংকসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, তাতে ড্রিংকসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

পরের গান শুরুর মুহূর্তে আমার মনে হয়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ বনবন করে ঘুরতে থাকে মাথাটা। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে চারপাশ দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। খেয়াল হয়, জাভেদ, পাশের চাপদাড়ি, আরও দু-তিনজন ছুটে এসেছে আমাকে সাহয্যের জন্য। ধরাধরি করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। বিপদ বুঝতে পেরে আমি প্রাণপণে বাধা দিতে থাকি, চেঁচাতে থাকি, হেল্প, হেল্প। অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। টের পাই প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। ছেলেগুলোর কথা কানে আসে ভাসা ভাসা, হঠ যাইয়ে হঠ যাইয়ে সামনে সে। মাই সিস্টার ইজ ফিলিং সিক।

আশ্চর্য! কেউ ওদের কোনও বাধা দিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যতদূর মনে পড়ে ওরা পাঁচজন আমাকে লিফটে করে নামিয়ে ধরাধরি করে একটা বড়ো গাড়িতে তোলে। বোলেরো কিংবা টাটা সুমো হতে পারে। একজন বলল, জলদি ভাগ হিয়াসে।

গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিল। গাড়ির মধ্যেই ওরা আমার শরীর থেকে জামাকাপড় টেনেহিঁচড়ে খুলছিল হিংস্র ভাবে। জানোয়ারগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে ছিড়েখুঁড়ে খেতে চাইছিল আমার দেহ। একজন জিন্সটা খোলার চেষ্টা করছিল। আমার বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন নেই। ক্রমশ জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান হল, দেখি আমি নার্সিংহোমে। পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছি।

বাবা, তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এও বুঝি তুমি নিজেকে কতটা অসহায় বোধ করো। তোমার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার আর মায়ের মধ্যে যে বিরাট এক শূন্যতা তা আমাকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছে। জানি এতে তোমার কোনও দোষ নেই। কেন যে এত মদ খাও তাও বুঝেছি। তবে এত মদ খেও না বাবা। অন্তত আমার কথা ভেবে মদ খাওয়াটা কমাও।

আমার দুঃখ কেবল একটাই তোমরা আমার যন্ত্রণার খোঁজ কখনও নাওনি। আমার মনে পড়ে না, তোমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে আমাকে দেখতে এসেছ কখনও। জীবনে কোনওদিন একসঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। যে কটা জন্মদিন পালন করেছ, সেগুলিও কেমন যেন মেকি, ফাঁকা ফাকা, এলোমেলো।

মা, তোমাকে বলি, আমাকে তুমি কোনওদিন ভালোবাসোনি। চিরকাল নিজেকেই ভালোবেসেছ। নিজের সুখ, নিজের ভোগ নিয়ে মত্ত থেকেছ। তোমার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব কথা এখানে লিখতে চাই না। তবে বলতে লজ্জা নেই, পুরুষের প্রতি আসক্তি তোমার আজও কমেনি।

মা, তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তা কেবল মিনিমাম কর্তব্যবোধ। আমার এই ছোট্ট জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি তাতে মনে হয়, দাম্পত্যে যদি ভালোবাসা না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান নেওয়া কোনওদিনই উচিত নয়। তুমি এ ঘটনার পর যে কবার দেখা করতে এসেছ, কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছ, আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড়ো ভুল করলি কী করে? মা, কীভাবে তোমাকে বোঝাই যে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।

বাবা, তুমি চিরকালই আমাকে বড়ো ভালোবাসো। তবু চিরকালই কেন যেন আমি নিজেকে খুব একা বলে বোধ করেছি। আজ তোমার মধ্যে আমি নিজের অসহায়তা, একাকিত্ব, যন্ত্রণা সব উপলব্ধি করতে পারছি বাবা।

বাবা, কাল তুমি এসেছিলে। বারবার আমার হাতখানা ধরে বলেছ, তোকে বাঁচতে হবে মা, বাঁচতে হবে নতুন করে। এসব দুর্ঘটনা ভুলে, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে তোকে। জীবনে তুই যত বড়ো পথ দেখেছিস, জীবন তার থেকে অনেক অনেক বড়ো।

নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। বুঝেছি, মুহূর্তের অসাবধানতা আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে জীবন। তবে আমি বাঁচব বাবা। অন্তত একটি বার প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করব আমি।

এ মুহূর্তে আমার মুখময় অন্ধকার। এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কোনও নতুন শহরে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমার চারপাশে থাকবে না কোনও পরিচিত লোকজন, থাকবে না এই কালিমাখা অতীত।

তোমরা আমার খোঁজ কোরো না। প্রয়োজনে আমিই তোমাদের খোঁজ নেব। বিদায়, ভালো থেকো তোমরা। বাবা, আমার জন্য চোখের জল ফেলো না। তোমার কথাকে সম্মান দিয়ে যদি নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি তবেই ফিরব, নতুবা নয়।

প্রণাম

ইতি,

তোমাদের ঊর্মি।

চিঠি শেষ। ভোরের আলো উঠি উঠি। ব্যাগ গোছানোই আছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন গভীর ঘুমে। বাড়ির পিছনের গেট খুলে নিঃশব্দে পথে নামে ঊর্মি।

ক্রমশ ভোর হচ্ছে। ভোর এত সুন্দর! এত স্নিগ্ধ! পাখিরা ডাকছে। সকালের প্রশান্তি তার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক আশ্চর্য অনুভব। সামনে দূরের আকাশ, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওটা।

সই চম্পাবতী

এক

গুপ্তিপাড়ার এক কবিরাজের কাছে গোপনে গোপনে ওষুধ খাচ্ছিল চম্পা মণ্ডল। যৌনতা-বর্ধক ওষুধ। না, কবিরাজকে সে চেনে না। জানেও না এর জন্য কত দাম নেয় সে। ওষুধের গুণ টের পাওয়া যাবে তিনমাস পর থেকেই। পুরো ফল পেতে হলে আরও তিনমাস মোট ছমাস খেতে হবে।

তাকে নিয়মিত এই ওষুধ এনে দেয় তার স্বামীর বন্ধু সুনীল। এমন উপকারী লোক, অথচ দ্যাখো পয়সা দিতে গেলে নেবে না। জোর করলে বলবে, এই কোবরেজের খুব নাম। অনেকেই তার ওষুধ খায়, শুনি কাজও হয়। যদি কাজ হয়, তখন তুমি আমাকে পয়সা দেবে, কেমন?

বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু বলেনি হারান। দিন কয়েক যাবার পর সে মুখ খুলতে থাকে। মিলন শেষে নিরুত্তাপ গলায় বলত, তুমি বড়ো ঠান্ডা! কিছুতেই গা-গরম হয় না তোমার! অথচ তুমি যা গায়েগতরে। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপ দিই ওই উত্তুঙ্গ যৌবনের ভিতর। প্রাণের জ্বালা জুড়াই। কিন্তু আসলে তুমি একটি ঠান্ডা সাপ ছাড়া আর কিছু নও। ঝাঁপ দিয়ে আগুন মেলে না, বরফের জলে গা ভিজে ওঠে।

কথাটা গায়ে মাখেনি চম্পা। যৌনতা তার ভালো লাগে না। ওই সময় সে কেন যে আড়ষ্ট হয়ে থাকত, তা সে নিজেই জানে না। পরের দিকে হারান নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সে চম্পাকে মারধর করত। রাগে গরগর করতে করতে মাঝরাতেই ঘরের বাইরে চলে যেত।

একাকী বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদত চম্পা। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু সুডৌল স্তন, ভরাট কোমর, চওড়া কাঁধ ও তার কালোর উপর সুন্দর মুখশ্রীতে এমন কিছু ছিল যে, একবার দেখতে গিয়ে হারানের তাকে ভালো লেগে যায়।

হারানের এক প্রাণের বন্ধু হল সুনীল রাজবংশী। সুনীল নৌকো বানায়। ঘর ছেড়ে নৌকো বানানোর জন্য কোথায় না কোথায় পাড়ি দেয় সে। এক মাস দিঘা তো কোনও মাস মেদিনীপুরের অচেনা কোনও এক নদীর ধারে, আবার কখনও তার ডাক আসত শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ থেকে। কখনও বা ঘরের পাশে কুন্তীঘাটে যেত নৌকো বানাতে।

নৌকোর কারিগর হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু তার নিজের কোনও নৌকো নাই। সে যখন হারানের সন্ধানে আসত, তাকে ঠেস মেরে চম্পা বলত, এবার এট্টা নৌকো বানাও মাঝি, গাঙ্গ-এ ভেসে পড়ি।

সুনীল তখন রসিক নাগরের মতো হাসত। বলত, তোমায় নিয়ে কোথা যাব, বউ? সুনীল তাকে গোপনে বউ বলে ডাকত। মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারত সুনীল। চম্পার মাঝে মাঝে মনে হতো, তার যদি সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তবে সে সুখী হতে পারত।

হারান ছিল রাজমিস্ত্রি। বড়ো রাজমিস্ত্রি নয়, সে ছিল সহকারী। কাজের টানে তাকেও বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন সে সুনীলকে বলে যেত, বউটা রইল, দেখিস। সুনীল সেইসব দিনে আসত কিন্তু ঘরে ঢুকত না।

চম্পা ডাকত ঘরে বসার জন্য কিন্তু সে বলত, দিনকাল তো ভালো নয় বউ, কে কখন কী বদনাম দেয় তার ঠিক কী! তার চেয়ে এই ভালো। তোমার খবর করা হল, দেখা হল, কথা হল, সবদিক বজায় থাকল, আর কী চাই? এমনটাই থাক না।

চম্পা রেগে বলত, বদনাম আবার কী মাঝি? কে করবে বদনাম? তুমি কি আমার পর? তুমি আসবে, রোজ আসবে এই আমি কয়েক দি। শুনে মিটিমিটি হাসে সুনীল।

—আর বদনাম হলে? মুখটি ফিরিয়ে নেয় চম্পা।

—সে তো আমার ভাগ্য গো! এমন বদনামে যে মরেও সুখ!

বুক ভরে ওঠে সুনীলের। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, বলো কী, বউ! তারপর?

—তারপর আর কী, একখান নাও নিয়ে ভেসে পড়ব দুজনাতে।

সুনীল তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তা ভেসে ভেসে যাবে কদ্দূর?

—যাব না। নাও-তেই থেকে যাব। সারারাত, সারাজীবন।

—সংসার তোমার ভালো লাগে না, না বউ?

নীচু মুখে, বাঁ হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে চম্পা বলে, পালাইনি তো তোমার সঙ্গে। পালালে, একটা সংসার পেতুম।

—তবে ভেসে পড়বার কথা বারবার কও কেন, বল দিকি?

—সে আমার ইচ্ছে!

—কেবলি ইচ্ছে? আর কিছু নয়?

উদাস গলায় চম্পা বলে, আমি কোনওদিন নদী দেখি নাই! অনেক অনেক জল দেখি নাই! পাড় থেকে দেখা কি আর দেখা হল মাঝি? নদীকে দেখতে হলে নদীর বুকে থাকতে হবে। কেন, তোমার কি আমাকে নিয়ে ভেসে পড়তে আপত্তি আছে?

সুনীল বলে, তা নয় বউ। তুমিই আমার সব। আমার জীবনমরণ। আমার নাও, আমার নদী, আমার নৌকো। পর তো নও তুমি আমার। কিন্তু জানো কী, যেখন তুমি নাও ভাসাবার কথা কও, তোমাকে কেমন যেন উদাস লাগে।

—আর কেমন লাগে?

—বেউলা লাগে তোমায়। বেউলা- সুন্দরী। এক কলার মান্দাসে চলেছ তুমি।

—সেই মান্দাস তুমি, মাঝি বোঝ না?

—বুঝি বউ, বুঝি।

—তবে আমাকে নিয়ে ভেসে পড়ো না, কেন?

—পারি না যে!

—কেন পারো না মাঝি? আমার এ জীবন কি জীবন? পারো না আমায় একটা নতুন জীবন দিতে?

—ও এমনি করে তোমার গায়ে হাত তুলবে আমি কল্পনাও করতে পারি নাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চম্পা বলে, দেহ ছাড়া সুখ হয় না মাঝি। দেহ ছাড়া দেহসুখ যে সোনার পাথরবাটি, মাঝি! দেহ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হয় না, সংসার হয় না, প্রেম-পিরিতি হয় না। দেহ ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য মাঝি! এ-পৃথিবী দেহের বশ। আর সেই দেহ আমার নেই!

তার দীর্ঘশ্বাস নিজ গায়ে মেখে নিতে নিতে সুনীল বলে, এ-যে তোমার মনের কথা নয়, সখি চম্পাবতী। তুমি যেমনি করে আমাকে বোঝো, তেমনি আর কে বোঝে বলো দিকি। হারানের কথা বলছ? ও কিন্তু সহজ সরল ছেলে। ছোটো থেকেই তো দেখছি তাকে।

—সেটাই তো বিপদ মাঝি। সহজ-সরলেরা যে মনের গভীর কথা পড়তে পারে না! ওদেরকে সব যে বলে বলে দিতে হয়, বুঝিয়ে দিতে হয়!

মাথা নেড়ে সুনীল বলে, কেন যে হারান এমনি করে! ওকে এখন আমি বুঝতে পারি না। মাথা নীচু করে চম্পা।

—ওর শরীর যে আমি সুখে সুখে ভরাতে পারি না, মাঝি। ওকে খুশি করতে পারি না! এবার আমাকে নিয়ে একখানা নাও বানাও মাঝি। সে নাওয়ের নাম দিয়ো সই চম্পাবতী। আমি মরে যাই যদি, তোমার সেই নাও-এর মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। আমার এই দুই চোখ এঁকে দিও নাও-এর গায়।

—তুমি নাও হবে, বউ? সুনীল চোখ বড়ো বড়ো করে। বলে, তুমি যে গহিন গাং বউ, নাও হতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? গহিন গাং, তার এপার, ওপার দেখা যায় না। মনের গভীর-গোপনে কোন ধন খেলা করে, তাকে কে বোঝে, কে ছোঁবে বউ? গহিন গাং তাই চিরকাল মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়।

—আমি যদি গহিন গাং হই, তুমি তার বুকে এক নাও।

—না বউ। আমি তা নয়।

—তবে? গহিন গাং যদি তোমার কোনও কাজেই না-লাগে, তবে লাভ কী আমার গাং হয়ে

—তোমায় ডুবে মরে যে সুখ, সখি!

এর পর আর নিজেকে সামলাতে পারেনি চম্পা। দুবাহু এগিয়ে দিয়ে সে জাপটে ধরে সুনীলকে।

সুনীল থরথর করে কেঁপে ওঠে। চম্পার উষ্ণ নিঃশ্বাসের কাছে সে পুড়ে যেতে থাকে। নতজানু হয় তার শরীরী-সুবাসে। ক্রমে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে তার। আর চম্পা তাকে দিয়ে নিজেকে চেনে। সে বোঝে, গহিন গাং-এ জোয়ার এসেছে। সেটা কবিরাজি ওষুধের কাজ নাকি সুনীলের সোহাগভরা ব্যবহার— তা সে নিজেই জানে না। মোটেই একটি ঠান্ডা সাপ নয়। সেও পারে। সেও জানে, কীভাবে প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় ডুবাতে হয়, কীভাবে ভাসাতে হয়, একটি নাও-কে। কীভাবে সেই নাও-কে নিজের গোপন খাঁড়ির দিকে গভীরে নিতে হয়।

দুই

এক পথ-দুর্ঘটনায় হারান মণ্ডল মারা গেল। লরি-বাস নয়, তাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা বাইক। সকালে যেমন কাজে বের হয়, সেদিনও তেমনি বেরিয়েছিল। সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাস্তা পেরোনোর সময় একটি দ্রুতগতির বাইক তাকে সজোরে ধাক্কা মারে, হারান রাস্তার ধরে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। লোকজন জমা হয়। একটা ভুটভুটি ভ্যানে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেখানে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল তিনদিন।

লোকমুখে খবর পেয়ে সুনীলকে নিয়ে সেখানে যায় চম্পা। মৃত হারানকে দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তাকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখনই জানা যায়, সে তিনমাসের পোয়াতি!

হারানের মৃত্যুর পর বাপের ভিটেতে ফিরে গেল না চম্পা। সে রয়ে গেল শ্বশুরের ভিটেতেই। কিন্তু সে এখন পড়েছে অথৈ জলে। তাকে দেখার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। তার সংসার চলে না। হারান বেঁচে থাকাকালীন সে বিড়ি বাঁধার কাজ করত। হাজারটা বিড়ি বাঁধলে আশি টাকা মিলত। কিন্তু এখন তাকে আর কেউ কাজ দেয় না।

সকলে বলে, হারানকে সে-ই চক্রান্ত করে মেরেছে। নইলে বাইকের ধাক্কায় কেউ মরে? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনীলের নাম। ফলে সুনীল আর আসে না তার বাড়িতে। নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না সুনীল। কাজের অছিলায় সে নানাস্থানে চলে যায়, ফেরে না। আগে যেমন সে ফিরলেই চলে আসত চম্পাকে দেখতে, তার নাভি-পদ্মের দর্শনে, তার শরীরী সৌরভে মাতোয়ারা হতে— এখন এসবের ধারেকাছে নেই সুনীল।

সে শুনেছে, এই অবসরে সুনীলের দাদারা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের কিছু জমিজমা আছে। তা থেকেও বেদখল করা হতে পারে সুনীলকে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে সুনীলের বুড়ি মাকে নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাঠের ধারে, জলাজঙ্গলের মধ্যে, একটেরে এই মাটির বাড়িতে একাকী এক বিপন্ন যুবতি বিধবা কীভাবে বাস করে, এই নিয়ে সমাজের কিন্তু কোনও মাথাব্যথা নেই!

হারান মারা যাবার পর যে-মানুষটি সর্বদা তার পাশে ছিল, সে সুনীল। সেইসময় একদম ভেঙে পড়েছে চম্পা, ঘরে দুদিনের মতো খাবারও মজুত নেই, তখন সেই সুনীলই তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই বা কতদিন দেবে। বিয়ের সময় একজোড়া দুল দিয়েছিল তাকে, বাপেরবাড়ি থেকে। সেটা বেচে দিল সে সুনীলেরই হাত দিয়ে কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এইভাবে সুনীল আর বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। তাকে কাজে বেরোতে হবে। আর সে কাজে গেলে মহাসমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে চম্পা। তাই হাতে বেশ কিছু অর্থ থাকা দরকার। কারণ সে আর একা নয়। তার পেটের মধ্যে একটা প্রাণ বাড়ছে, তার কথা চম্পাকে আগে ভাবতে হবে।

দুলজোড়া হাতে নিয়ে সুনীল বলেছিল, সোনা বেচে দিচ্ছ বউ? একবার ঘর থেকে গেলে আর গড়াতে পারবে?

ম্লান গলায় চম্পা বলে, ও-জিনিস কী হবে আমার? ঘরে রেখে কী করব, বল দিকি! বিপদের দিনে সোনা যদি কাজে না-আসে মানুষের, তবে ঘরে সোনাদানা রাখা কেন?

—তা বটে!

—তিন-চার হাজার টাকা মিলবে না এ-থেকে?

—তা হয়তো মিলবে। কিন্তু এই দুলজোড়ায় যে-তোমাকে স্বপ্নের মতো লাগে, বউ!

—এ দুটি বেচে ঝুটো একজোড়া দুল এনো না হয়!

মুষড়ে পড়ে সুনীল বলে, আমার টাকা নিতে মানে লাগছে বুঝি?

—আমার মান বলো, মন বলো— সবই তুমি। তোমার এই ঋণ ফিরত দিব কী প্রকারে?

—না-হয় নাই দিলে, কে চাইছে তোমার থেকে?

—তুমি চাইবে না জানি, মাঝি। তুমি নাও বানাও, দূরে দূরে যাও টাকার দরকার কত লাগে তোমার। তাছাড়া তুমি দাদাদের সংসারে থাকো। সেখানেও টাকা দিতে হয়।

—আমার সংসার তো তুমি।

চম্পা কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কালো গায়ে সেই রোশনাই আর নেই। মুখ মলিন। সেই এক ঢাল কালো চুল রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সব সময় সে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সব সময় চিন্তিত। সে যে পোয়াতি! একজন সহায় সম্বলহীন বিধবা কী করে একাকী একটি বাচ্চার জন্ম দেয়? তার প্রতিবেশী বা গ্রামের লোকদের আপত্তি এখানেই।

ওদের সকলেরই বক্তব্য, এই বাচ্চা আদৌ হারানের নয়। হারান জানতই না তার বউ পোয়াতি। তাদের ধারণা, এই বাচ্চা আসলে সুনীলের। এই নিয়ে নাকি তার আর হারানের মধ্যে রোজকার অশান্তি হতো। তাই তাকে ষড় করে সরিয়ে ফেলেছে সুনীল। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে চম্পা।

তিন

একদিন রাতেরবেলা, ঘুম আসছিল না চম্পার। বিছানায় শুয়ে খালি এ-পাশ ও পাশ করছে। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু সে ঘুমুতে পারছে না। নিজের কী যে হচ্ছে, কিছু বুঝছে না সে। এইসময় তার দরজায় তিনটি টোকা পড়ল পরপর। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসল সে। সাড়া দিল না। কোনও শব্দ করল না। কে হতে পারে দরজার ওপারে? সুনীল? কিন্তু সুনীল এইরকম করে না। রাতে কোনওদিন তার ঘরে আসে না সে। যতবার সে মিলিত হয়েছে সুনীলের সঙ্গে, সেটা দুপুর। উদ্দাম দুপুর, মিলনও তেমনি দুরন্ত। আর সেটা এতটাই চুপিসাড়ে যে, কারও টের পাবার উপায় নেই।

এই যে, লোকজন তার নামে এত অকথা-কুকথা বলে, সেটা হারান মারা গেছে বলেই। সুনীলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল চম্পা। আর বুঝেছিল, সব নারীর মধ্যেই যৌনতা থাকে। সেটাকে বের করে আনা, উপলব্ধি করার দাযিত্ব হল পুরুষের। পুরুষ যদি না পারে, সেখানে নারীর কিছুই করার থাকে না। সুনীল তাকে আবিষ্কার করেছিল। তারও কামনা আছে। তার স্পর্শেই একজন সত্যিকারের নারী হয়ে ফুটে উঠেছিল সে।

কিন্তু দরজার ওপারে কে? যে আছে, সে কোনও সাড়া করছে না। আর এমনি করে টোকা মারছে, নিশাচরের মতো, যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। মনের শঙ্কা এবার ভয়ে পরিণত হল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে…?

ওপাশ থেকে আওয়াজ এল— আমি, দরজা খোলো!

মেয়েমানুষের গলা! এবার নামল সে বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। আস্তে আস্তে দরজার খিল সরাল। তবে পাল্লা দুটি হাট করে খুলে দিল না। একটা বন্ধ রেখে অপরটি একটু ফাঁক করল। ওপারের মানুষটির ছোটোখাটো চেহারার অল্প একটু দেখা গেল।

—খোলো হারানের বউ, ভয় পেয়ো না। আমি সুনীলের মা।

সুনীলের মা! সে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিল। এত রাতে সুনীলের মা তার কাছে কেন! সুনীলের কোনও বিপদ হল?

ঘরে ঢুকে বুড়ি বলল, নাও, এবার দরজা আটকে দাও। খিল তুলে দিল চম্পা।

—কিছু হয়েছে মাসিমা? আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কী হল?

—আমার বড়ো বিপদ!

—বিপদ! আপনি বসুন। জল খান। বলে বুড়িকে সে বসাল। এক গেলাস জল দিল।

বুড়ি ধাতস্থ হয়ে বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এলাম। আমাকে থাকতে দেবে আজকের রাতটা? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

—সেকি! কেন?

—ওই যে, আমি বলেছি, সুনীলকে জায়গা-জমির ভাগ দেব, তাই।

—সুনীল কোথায়?

—সে আছে নদীয়ায়।

—কবে ফিরবে?

—ফিরবে না। যদি মেরে দেয়, ওই ভয়ে ওখানে গেছে একমাস হতে চলল। যাবার আগে বলে গেছে, এবার ওখানেই থেকে যাব মা। আমি ঘর দেখছি। তার মধ্যেই এইসব ব্যাপার।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল চম্পার। বহুদিন হয়ে গেল, সুনীল তার কাছে আসে না। তাকে ভালোবাসে না। কতদিন সে দেখে না সুনীলকে। তার জন্য মন কেমন করে চম্পার। কিন্তু বাইরের কাউকে কিছুই বলার উপায় নেই। এমনিতেই ঢিঢি পড়ে আছে চারিদিকে। এবার তার মনকেমনের কথা একবার চাউর হলে, সে এখানে আর বাস করতে পারবে না।

সুনীলের মা গর্জে ওঠে, আমিও ছাড়ব বলে ভেবেছ? রাজবংশী পরিবারের বউ আমি। আমার এক ছেলেকে বঞ্চিত করে বাকিরা সুখ ভোগ করবে, এ আমি হতে দেব না। আমি উইল বদলাব। সমান ভাগ আর থাকবে না। তুমি একবার সুনীলকে ফোন করো।

—এত রাতে?

—হ্যাঁ, এখুনি করবে। আমি কথা বলব। তিনবার রিং হবার পর সুনীল ফোন ধরে হ্যালো বলল।

আহা! কতদিন পর সে সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনছে। সে ফোনটা সুনীলের মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল।

সুনীলের মা বললে, শোন সুনীল, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কাল ভোরের ট্রেনেই আমি আর চম্পা তোর ওখানে চলে যাচ্ছি। ঘর ঠিক করেছিস তো… আচ্ছা আচ্ছা ও… রাখ।

ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সুনীলের মা বললে, আমাদের কাল ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে, ওদের কোনও বিশ্বাস নেই। আর ওখানে গিয়ে তোমার এই চম্পা নামটি থাকবে না। তুমি হবে চম্পাবতী রাজবংশী। নাও বউমা, কাপড়-জামা গুছিয়ে নাও। তুমি পোয়াতি, খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদের। ভোরের ট্রেনে ভিড় কম হয়। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।

কিছু বুঝতে পারছিল না চম্পা। কেবল আমতা আমতা করে বলল, আমি, মানে…!

—বুঝতে পারছ না? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমি সুনীলের বিয়ে দেব। তোমাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে দেব। ওখানে তোমরা নিজের মতো করে সংসার পাতবে।

ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল চম্পা। মনে পড়ল, সুনীলকে একদিন বলেছিল সে, কদ্দিন আর পরের পোয়াতি বিধবার পিছনে ঘুরঘুর করবে। তোমায় এবার নিজের সংসার পাততে হবে, নিজেরটা দেখতে হবে। তোমার এখানে আর না-আসাই ভালো।

সুনীল বলেছিল, তুমি আবার পরের কোনখানটায়? পুরোটাই তো আপন।

চম্পাবতী হু-হু করে কাঁদছিল। চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল তার। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের মা। তবু এক কষ্ট জাগে বুকের ভেতর। এত আনন্দের মাঝেও বুকের ভেতর এই এক দমচাপা কষ্ট চম্পার, কে জানে কার জন্যে!

 

 

আমেরিকান ডায়মন্ড

সরলা মাসি একেবারে খাঁটি বাঙাল। খাসা হাতের রান্না। ‘বাঙালরা আনাজপাতির খোসাও ছাড়ে না’ কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনালেও, কোনও ঘটি মাইয়ার পক্ষে ওই খোসাকেই অতুলনীয় সুস্বাদু করে তোলা প্রায় অসম্ভব। আমার রান্নার লোক। বহুদিন হয়ে গেল রয়েছে এবাড়িতে। তার টানটান বাঙাল ভাষার সঙ্গে রসিকতা তো তুলনাহীন। বেশ মজায় কাটে সকালটা। সেদিন সকালে রান্নাবান্না নিয়ে মাসির সঙ্গেই কথা বলছি, সেই সময় পাশের বাড়ি থেকে সোমার চিৎকার, ‘কেয়া আছিস? আয় শিগগির একটা জিনিস দেখে যা।’

ক্ষণিক বিলম্ব না করেই জবাব দিলাম, ‘আসছি আসছি।’ কারণ, খুব ভালো করেই জানি সাড়া না দিলে এক্ষুনি বাড়িতে চড়াও হবে। কালই মুম্বই থেকে ওর বর ফিরেছে। নিশ্চয়ই ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। সেটা দেখানোর জন্যই এত তৎপর। যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাসি বেশ মজা করেই বলল, ‘যাও তোমারে হোয়াগ কইরা ডাকতাসে, কত কী দ্যাহাইব।’

‘ওঃ মাসি তুমিও না। ও যদি একটু দেখিয়ে শান্তি পায়।’

‘যাও যাও। তোমারে কেডা আটকাইতাসে।’

খানিক হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি রান্না করো। আমি আসছি।’

সোমার বাড়িতে ঢোকা মাত্রই একপ্রকার পাকড়াও করে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েই হাতে একটা সালোয়ার কামিজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ কী সুন্দর, না?’

‘দারুণ রে, কাপড়টাও খুব ভালো। কৌশিক এনেছে না?’

‘আর কে আনবে বল? ওই একজনই তো আছে আমার ডার্লিং। দ্যাখ না এইবার তো তিনটে নাইটিও নিয়ে এসেছে। এটা তো আমি কাল রাতেই পরেছিলাম। কী সেক্সি না।’ সোমার চোখেমুখে খুশি ফুটে উঠল। ‘মাসে একবারই তো বাড়িতে আসে। যা যা নিয়ে আসে সব ওকে পরে পরে দেখাতে হয়, না হলেই তেনার মুখভার।’

‘তবে একটা কথা মানতেই হবে কৌশিকের আনা নাইটিগুলো সত্যিই অন্যরকম। এগুলো পরলে অটোমেটিক একটা রিচ লুক চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে বললাম বটে, কিন্তু কেন জানি না খটকা একটা ছিলই। আমরা যে-স্ট্যান্ডার্ডে বিলং করি সেখানে এইধরনের ড্রেস একেবারেই খাপ খায় না। যে-কোনও কিছুর জন্যই যথাযথ পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সেই পরিবেশ আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে কোথায়? ছোট্ট পরিসরে ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে গেলে এমন ভাবনাই ভুল। সেখানে কৌশিকের এমন পছন্দ…! ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও তো তেমন সাউন্ড বলে মনে হয় না যে বলব,

বংশপরম্পরায় পাওয়া। তারপরেই মনে হল দূর এসব কী নিয়ে পড়লাম আমি, নিজেকে সংযত করলাম।

সোমা তখনও স্বামীর নাম জপে চলেছে। সেই সময় আমার বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাড়ি যাওয়ার একটা ছুতো পেয়ে গেলাম। ‘আমি আসি রে। কে ফোন করছে কে জানে। মাসিও তো রান্না সেরে বাড়ি ফিরবে। সব দেখে-টেখে নিই। যাই।’ বলেই বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল।

ফিরে আসার পরেও মনটা ওই নাইটির মধ্যেই আটকে রইল। শুধু কেন কেন কেন – মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। স্বামীর এত প্রশংসা – কেন কী দেখাতে চায় ও? ওর স্বামী ওকে কত ভালোবাসে, নাকি কৌশিক এখন অনেক টাকা রোজগার করছে, সেটা জানানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য।

কদিন আগেও তো কৌশিক স্টেজ-শো করে বেড়াত। সুদর্শন হওয়ার সুবাদে দু-একজন পরিচালকের দয়ায় সিরিয়ালে ছোটোখাটো রোলে অভিনয় করত। হঠাৎ বউয়ের কথা শুনে নতুন ব্যাবসা শুরু করে এত টাকা উপায় করে ফেলল যে, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলল।

ভাবনায় এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে, বুঝতেই পারিনি, মাসি এর আগেও আমাকে ডেকেছে। এবার বেশ জোরেই বলে উঠল, ‘কী ভাবতাস কও তো। তহন থেইকা ডাকতাসি।’

‘ও! হ্যাঁ হ্যাঁ। বলো কী বলছ?’

‘কইতাসি, রান্না হইয়া গেসে। আমি আইতাসি।’

দুপুরে খাবার পর শুয়ে শুয়ে টিভিতে খবর দেখছি, ফোনটা আবার বেজে উঠল। রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল খুনশুটি মেশানো স্বর, ‘হাই জানু, কী করছ?’

‘আরে টিভি দেখছিলাম…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপার থেকে বলতে শুরু করল, ‘টিভির দোহাই কেন দিচ্ছ ডিয়ার, বলোই না অজিত ছাড়ছিল না, তাই ফোন ধরতে এত দেরি করলে।’ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে যাচ্ছিল রাইমা।

‘রাইমা, সত্যি তুই আর শোধরালি না।’

‘শোধরাতে চাইলে তবে না শোধরাব। মুম্বইতে এসে তো আরও বিগড়ে গেছি। তুইও আয় তোকেও বিগড়োনোর সব পথ বাতলে দেব। অ্যায়েশ কাকে বলে দেখবি তখন।’

‘কী করে যাব বল। জানিসই তো অজিতের ব্যাবসার চক্বরে এখন আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। এখন তো বিজনেসের খানিকটা দায়িত্ব আমার কাঁধেও চাপিয়ে দিয়েছে। সময়ের অভাবে এখন আর স্ক্রিপ্টও লিখতে পারি না।’ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।

‘ডোন্ট ওরি কেয়া, ম্যায় হু না। সামনের মাসেই কলকাতায় আসছি। তোকে দিয়েই পুরো স্ক্রিপ্ট লেখাব ভেবেছি। কলকাতায় তো সময় দিতে পারবি নাকি?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ এখানে হলে আমি ঠিক সময় বার করে নেব। তুই শুধু জানাস কবে আসবি, সেইমতো তোর থাকার ব্যবস্থা করব আমি।’ এক ঝটকায় মনটা ভালো হয়ে গেল।

‘না না, আমি হোটেলেই থাকব। কেন আমার আনন্দটা মাটি করতে চাইছিস বলতো।’ বেশ অবাক হয়েই বললাম, ‘মানে। ঠিক বুঝলাম না।’

‘জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়, সেটা এখনও শিখিসনি তুই।’

‘তুই কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বোকার মতো বলে বসলাম।

‘স্টুপিড কোথাকার। তোকে বুঝতেও হবে না। যখন কলকাতায় আসব সময় নিয়ে তোকে সব বোঝাব। চল ফোন রাখছি। আমার স্পেশাল খাবার এসে গেছে।’

‘স্পেশাল খাবার! হ্যাঁ তো ঠিক আছে না খেতে খেতেও তো…’ ততক্ষণে ফোনটা কেটে গেছে। রাইমাটা কী যে করে! যাকগে আমার জন্য এটাই ভীষণ খুশির খবর যে, ও কলকাতায় আসছে। হিন্দির পাশাপাশি বাংলাতে অনেক সিরিয়াল, টেলিফিল্ম বানিয়েছে ও।

সাত বছর আগে সেই যে সিরিয়ালের শ্যুটে মুম্বই গেল, ওখানকার হয়েই থেকে গেল। মাঝে ওর বাংলা সিরিয়ালের জন্য বার চার-পাঁচেক স্ক্রিপ্টও লিখেছি। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। অনেকে তো ভাবত, আমরা দুই বোন। আজ ও উচ্চতার শিখরে পৌঁছে গেছে। একডাকে সবাই চেনে। বলা যেতে পারে সেলিব্রিটি। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমাকে ভোলেনি। ওখানে গিয়ে বহুবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু সংসারের জন্য সম্ভব হয়নি। এখন যখন রাইমা এখানে আসছেই, কাজের জন্য বেশ কিছুদিন থাকার প্ল্যানও আছে, তখন আমারও কাজ করতে অসুবিধা নেই।

সেইদিন রাতেই অজিতকে, রাইমার শহরে আসা থেকে আমার স্ক্রিপ্ট লেখা সব কিছুই জানালাম। আনন্দে উচ্ছ্বসিত অজিত, আমার হাতদুটো ধরে বলেছিল, ‘বিশ্বাস করো কেয়া, আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ব্যাবসার চক্বরে তোমার ট্যালেন্ট চাপা পড়তে বসেছে। হয়তো তোমাকে বলতে পারিনি, মনে মনে ভীষণ অনুশোচনা হতো। যাক, আজ আমি খুব খুশি।’

এখন শুধু রাইমা আসার অপেক্ষা।

দিনকতক পরে শহরে পৌঁছে একটি পাঁচতারা হোটেলে উঠল সে। হোটেলে চেক-ইন করার পরেই ফোন করে ডেকে নিল আমাকে। তৈরি হয়ে বেরোতে যাব, সেই সময় সোমা এসে হাজির। ঘরে ঢুকে কোনও দিকে না দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ, আংটিটা। কাল শপিং করতে গিয়েছিলাম। সামনে জুয়েলারি শপ দেখে লোভে পড়ে ঢুকে গেলাম। কিনে ফেললাম আর কী। কেমন হয়েছে রে?’

কোনওরকমে দেখে বললাম, ‘ভালো হয়েছে।’

আমার দেখার ধরনটা ঠিক ওর পছন্দ হল না। মুখটা কেমন একটু বাঁকিয়েই বলল, ‘কোথায় এমন যাচ্ছিস যে একটু ভালো করে দেখবি সেই সময়ও নেই তোর।’

‘হ্যাঁ সত্যিই সময় নেই রে। সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট লেখার একটা কাজ পেয়েছি। প্রোডিউসারের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। সরি রে আমি ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলব।’

জানি এসব টিভি সিরিয়াল, অ্যাক্টিং ওর একেবারেই পছন্দের নয়। সেই কারণেই কৌশিকের পিছনে সর্বক্ষণ পড়ে থাকত। এসব ছোটোখাটো কাজ ছেড়ে যাতে মোটা টাকা উপার্জন করতে পারে, সেরকম কাজ করার কথাই বলত। আজ অবশ্য প্রপার্টি ডিলিং-এ ভালোই ইনকাম করছে সে। সোমার খুশি থাকার কারণই হল তাই। কৌশিক সোমাকে এত টাকা দেয়, যখন যা খুশি কিনে ফেলে।

‘অজিতদা জানে যে তুই…’

দরজায় তালা দিতে দিতেই বললাম, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ।’ সোমা মুখ ব্যাজার করে চলে গেল। আমিও তর্কে না জড়িয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।

হোটেলে পৌঁছেই দেখলাম রাইমাকে ঘিরে সাত-আটজন বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই উঠে এসে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল সে।

‘হাই, মাই সুইটহার্ট… অনেকদিন পর দেখা হল আমাদের।’

‘সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেল। তোকে ভীষণ মিস করতাম।’

‘ওহ্ রিয়েলি, সো সুইট। আয় বস।’ ওর পাশেই বসাল আমাকে।

‘আলাপ করিয়ে দিই, এ হল আমার সুইটহার্ট, কেয়া। আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু আর খুব ভালো রাইটারও… দশ বছর তো হয়েই গেছে না আমাদের বন্ধুত্বের… কী রে কেয়া তাই তো?’

হেসে উত্তর দিলাম, ‘বেশি হবে।’ সবার চোখেই তার প্রতি বেশ একটা সমীহ নজরে পড়ল।

‘কেয়া, ইনি হলেন ডাইরেক্টর বিনয়, ইনি মিউজিক ডিরেক্টর শতদ্রু। আর এরা রাহুল, সুমিত, প্রিয়ংকা আর শামসের। এরা সবাই শিল্পী তো বটেই, সঙ্গে আমার সমস্ত কাজ এরাই দেখাশোনা করে। আমাকে কিছু করতেই দেয় না।’

বুঝতেই পারলাম এরা সবাই রাইমার সহকারী। ‘রাহুল খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। অর্ডার দেওয়া হয়েছে তো?’ প্রশ্ন করল রাইমা।

‘হ্যাঁ, ম্যাডাম এক্ষুনি চলে আসবে।’

মিনিট চল্লিশ পর খাওয়াদাওয়ার শেষে রাইমা সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল। ঘরে এখন ও আর আমি। ‘দ্যাখ পরের সিরিয়ালে আমি বাছা বাছা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। সেইমতো কথাও হয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। সুতরাং স্ক্রিপ্ট-টা কিন্তু ফাটাফাটি হওয়া চাই।’ ওর কথা বলার স্টাইল দেখেই মনে হল ও ওর কাজের প্রতি কতটা যত্নশীল।

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। তারপর কিছু রিসার্চ পেপার দিল আমাকে, যেগুলোকে বেস করেই স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে আমাকে।

ওর কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলেই ফেললাম, ‘এই কয়েক বছরেই ইন্ড্রাস্ট্রির খুঁটিনাটি সব কিছু বিষয়ে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে গেছিস।’

‘ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করব আর সেই জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকবে না তা কখনও হয় বল? তুইও আমার সঙ্গে থাক, তোকেও সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব।’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘মনেই হচ্ছে না যে, তুই আমার সেই পুরোনো বন্ধু রাইমা।’

‘মনে হবে কী করে। আমি তো সত্যিই আর আগের মতো নেই।’ কথাটা শেষ করে আবার হেসে ফেলল সে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, এসব প্রসঙ্গ ছাড়। বলতো, অজিত তোর ঠিকঠাক দেখাশোনা করে তো?’

ওর চোখের দুষ্টু চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম, এবার আমাকে রাগাবার ধান্ধায় আছে।

বললাম, ‘খুব ভালো করেই দেখাশোনা করে, খেয়াল রাখে…, আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে না?’

‘আচ্ছা আর একটা কথা বল?’ ঠোঁটের কোণায় সেই শয়তানি হাসি।

‘আবার কী?’ বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম।

‘না, বলছি রোজরোজ একই মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে তুই বোর হয়ে যাস না। না মানে, নতুন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তোর?’

‘এই, তোর এই কথাগুলোই আমার ভালো লাগে না। ভালো কিছু বলতে পারিস না?’

‘দ্যাখ সেটাই তো বলছি, আমার একই কথা যেমন তোর ভালো লাগে না, সেইরকমই রোজরোজ একই জিনিস… মনে হয় না, নতুন কিছু করে দেখাই? বিলিভ মি, এই বিন্দাস লাইফ উপভোগ করতে শিখেছি মুম্বই গিয়ে। এখানে তো বেশিরভাগই মুখোশধারী।’ কথার মাঝেই ফোনের কি-বোর্ডে তার ফাইলকরা নেলপেইন্ট লাগানো আঙুলগুলো খেলা করে বেড়াচ্ছিল। আধুনিক জীবনের জনসংযোগ ব্যাবস্থা।

‘দ্যাখ সেই সকালে এসেছি, এখন সন্ধে হয়ে গেছে। কত কাজ, ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক বল। এখন মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য তো আর জয়পুর থেকে বরকে আসতে বলতে পারি না। যখন খিদে পায়, তখনই খাওয়া উচিত, বাড়ি ফিরে ঘরের খাবারই খাব এটা তো অযৌক্তিক ভাবনা, তাই না। বল এব্যাপারে তোর কী অভিমত।’

‘রাইমা, ক্ষ্যামা দে বাবা। ওহ্ তুই আর তোর চিন্তাভাবনা।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নক করে রাহুল ভিতরে এল।

‘বলুন ম্যাডাম।’

‘জয় কোথায়?’ বলেই আগ্রহী ভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘জয় পরশুদিনের শুটিং-এর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে গেছে। মিনিট পাঁচেক আগেই ফোন করেছিল। আসার সময় হয়ে এসেছে।’

‘ঠিক আছে। এলেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। তুমি একটু ড্রিংকস বানাও।’

‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’ বলেই সে তার কাজে লেগে গেল।

রাহুলকে ড্রিকংস বানাতে বলার পর মুচকি হেসে হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘এনজয় করেছিস কখনও? জীবন কাকে বলে জানিস?’

‘এ আবার কেমন কথা হল! গতবারই তো গৌহাটিতে গিয়ে দারুণ মজা হল। অজিত, আমি, মা, বাবা, অজিতের বন্ধুর ফ্যামিলি।’

রাইমা মাথা চাপড়ে বলল, ‘ধ্যাত তেরি কা। তোর দ্বারা কিস্সু হবে না।’ রাহুল ততক্ষণে ড্রিংক তৈরি করে দিয়ে চলে গেছে।

‘চল আজ আমরা দুজনে একসাথে জীবনটা উপভোগ করব।’ বলেই রাইমা আমার হাতে একটা আলতো চাপ দিল।

‘মানে!’ বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।

‘জয় বলে যে-ছেলেটাকে ডেকে পাঠালাম, দেখবি দারুণ হ্যান্ডসাম আর খুব চার্মিং। রাজস্থানের ছেলে… টুকটাক অভিনয় করত। অ্যাক্টিং-টা একেবারেই পারত না। আমি ওকে প্রোডাকশন কন্ট্রোলার-এর কাজটা দিলাম। ওকে দেখে যে কত অ্যাক্টর ফিদা হয়ে আমার কাছে কাজের জন্য আসে জানিস না। তাছাড়া আমার স্পেশাল কাজে তো লাগেই।’ রাইমার উপর কেমন যেন নেশা চড়ে বসল।

মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলাম না। কিছু বলতে গেলে যদি ও রেগে যায়। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করল রাইমা, ‘জানিস কেয়া, আমার সিরিয়ালে প্রথম যে-ভদ্রলোক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি তো আমাকে দেখে একেবারে পাগল। ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী রঞ্জনা আবার জয়কে দেখে নাছোড়। ওকে ওর চাই-ই। কতবার তো রঞ্জনা আর আমি জয়কে একসাথে শেয়ার করেছি।’

হাঁ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে দেখে বলল, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, নিজেকে ভালো রাখতে গেলে এগুলো দরকার। জাস্ট ফর রিল্যাক্সেশন। অবশ্য আমিও ওর জন্য কম করি না। কাজের দরুন প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার আর আমার মাইন্ড ফ্রেশ রাখার জন্য প্রতিবার দশ-কুড়ি হাজার দিই। সঙ্গে ওর বউয়ের জন্য কাপড়চোপড়। এছাড়া যখন যা সঙ্গে থাকে।’ এসব শুনে সামনের মানুষটা যে ওর সম্পর্কে ঠিক কেমন ধারণা করতে পারে, সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই রাইমার।

ওর সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও, নিজেকে সংযত করে বললাম, ‘দ্যাখ, প্রত্যেকটা মানুষই নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। তুই তোর পৃথিবীতে খুশি, আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে। যাক এসব কথা এখন থাক। তুই এনজয় কর, আমি চললাম।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আমাকে উঠতে দেখেই বলল, ‘হ্যাভ এ চেঞ্জ ডিয়ার। একবার ওকে দেখলে তোর আর ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করবে না। আমি তো তোকে অজিতকে ছাড়তে বলছি না। তোদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও থাকল আর এক্সট্রা… মাঝে মাঝে তো এটা হতেই পারে নাকি।’ এক পেগ শেষ হওয়ার পর আর এক পেগ তুলে নিল রাইমা। ঠিক তখনই দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে এল জয়। দরজার দিকে পিছন করে বসেছিলাম বলে মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না।

‘কাম ডার্লিং, কাম।’ রাইমা ওর হাত ধরে নিয়ে একেবারে বিছানায় গিয়ে গা-ঘেঁষে বসল। অবশ্য গা-ঘেঁষে বললে বোধহয় ভুল হয়, কারণ রাইমার অর্ধেক শরীরটাই তখন জয়ের কোলে।

‘আমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই… কেয়া।’ মুখ তুলে আগন্তুককে দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ভুল দেখছি না তো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জয়েরও একই অবস্থা। কোনও কিছু বোঝার আগেই রাইমা জয়কে জড়িয়ে ধরে জয়ের শার্টের বাটন খুলতে শুরু করল। আর নিজেও প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।

‘উঃ ডিয়ার জয়… জয়… জয়…’

বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না আমার। কৌশিক-ই তাহলে জয়। নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করছে এখানে। তা হলে এটাই ওর প্রপার্টি ডিলিং-এর বিজনেস! মাথা ঘুরছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বারবার সোমার সেই হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কৌশিক খুব ভালোবাসে। নতুন নতুন নাইটি, শাড়ি, দামি গিফট এনে দেয়। এই তার ভালোবাসার নমুনা! ওদের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কোনওরকমে আসছি বলে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হল জয় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ ছটফট করছে।

‘উঃ ছটফট করছ কেন। মুড খারাপ কোরো না আমার।’ রাইমার এই অস্ফুট স্বর সারা রাস্তা কানে বাজতে থাকল আমার। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। চেনামুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই রক্তমাংসের কদর্যতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। ভাবলাম বাড়ি ফিরে স্নান করব। মাথাটা ঠান্ডা হবে।

বাড়ি ফেরার পথেই মোড়ের দোকানে রমলার সঙ্গে দেখা। রমলা ও-বাড়ির কাজের লোক। থাকা-খাওয়া সবই ওখানে। ও-ই বোধহয় আমার ফেরার খবরটা দিয়েছে। জিরোব বলে সবে ফ্যানটা চালিয়েছি, অমনি দরজায় ধাক্বা। খুলে দেখি ‘সোমা’। ওকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন যেন শিউরে উঠলাম।

‘কীরে ভূত দেখলি নাকি। এমন চমকে উঠলি কেন?’

‘না না এমনি। বস। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’

ফিরে এসে দেখলাম হাতের আংটিটা নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। দেখেও না দেখার ভান করলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই জিজ্ঞাসা করল, ‘যে-কাজে গিয়েছিলি সব ঠিক হয়ে গেছে?’ উত্তরের আশা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘তখন তো ঠিক করে দেখলিই না। এই দ্যাখ ডায়মন্ড রিং এটা।’

প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘কৌশিক কোথায় রে? ফেরেনি এখনও?’

‘না সকালে বলেই বেরিয়েছে কী যেন বড়ো একটা ডিল আছে, দুদিন ফিরতে পারবে না। কেন রে কিছু হয়েছে নাকি?’

‘নাঃ। এমনিই, কী আর হবে?’

একবার মনে হল ওকে সবকিছু জানিয়ে দিই, ওরও জানাটা প্রয়োজন। আবার পরক্ষণেই ওর মুখের হাসিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। চুপ হয়ে গেলাম।

ওকে দেখে ভীষণ মায়া হল। বেচারি। একজন মধ্যবিত্ত মহিলার পক্ষে পাঁচতারা হোটেলের অন্দরমহলে কী হচ্ছে, সেটাও তো জানা সম্ভব নয়। আর বড়ো বড়ো লোকেদের মাইন্ড রিল্যাক্সেশন – এসব তো ওর ভাবনাচিন্তার উর্দ্ধে।

টুকটাক শপিং ছাড়া মেয়েটা আর যায়ই বা কোথায়, যে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতার কথা জানতে পারবে। স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আজ ও কত সুখী। সেই খুশিতে বাধ সাধতে ইচ্ছে হল না। কাজেই আমিও ওকে খুশি করতে আংটিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম। কখন যে হিরের দ্যুতি ঠিকরে এসে চোখের কোণায় জল জমিয়ে দিয়েছে বুঝিনি।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব