রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডারলিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখলেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ বাজার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না। ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের ঘুম উড়ে যাওয়ার অবস্থা হল।

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে পর, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল ওর। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিলে। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেযেটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া করা ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই বদ্ধমূল ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয় সাগরে নৈঃশব্দ্যের তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

সন্দেহ

(১ )

এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।

বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।

ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।

পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।

দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।

সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।

চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।

—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।

—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।

—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?

পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।

কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।

রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।

বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।

জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।

রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!

রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!

—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।

রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!

রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।

( ২ )

বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।

শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!

বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।

এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।

পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।

—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।

—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!

—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।

—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।

—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।

—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।

—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।

—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?

—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?

ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।

বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?

চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!

ইতি ঊর্মি

সকাল এখন আটটা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমার বিপরীতে অমর। আমাদের সংসারের তৃতীয়জন অর্থাৎ ঊর্মি আজ টেবিলে নেই। ঊর্মির কথা মনে পড়তেই ল্যান্ডফোন বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে ব্যারিটোন ভেসে আসে এটা কি ঊর্মি দাশগুপ্তর বাড়ি?

—হ্যাঁ, বলছি, জবাব দিই আমি।

—আপনি?

—ওর মা, মিসেস দাশগুপ্ত।

—শুনুন মিসেস দাশগুপ্ত, ময়দান থানা থেকে বলছি, আপনার মেয়েকে সেন্সলেস অবস্থায় ময়দানে পাওয়া গেছে। ওকে আমরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করিয়েছি। পকেটে ভাগ্যিস মোবাইলটা ছিল। ওটা থেকেই আপনাদের নম্বর পেলাম। শিগগির একবার নার্সিংহোমে আসুন।

লাইন কেটে যায়।

পুরো ঘটনাটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। গতকাল রাতে ঊর্মি বাড়ি ফেরেনি। থানা, পুলিশ, নার্সিংহোম শব্দগুলি একসঙ্গে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। আমি ঘামতে থাকি। ইদানীং সামান্য উত্তেজনাতেই প্রেসারটা বেড়ে যায়।

বিপরীতে বসে থাকা অমর নির্বিকার চিত্তে টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে কফির মধ্যে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাথাটা ঝাঁ করে জ্বলে ওঠে। হাতে থাকা স্যান্ডউচটা ধাঁই করে ছুড়ে মারি ওর মুখে। আচমকা আঘাতে অমর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চলকে পড়ে কফি। থতমত খেয়ে বলে, কী-কী মানে কী হল!

—কী হল! তোমার মেয়েকে ময়দানে আনকনসাস অবস্থায় পুলিশ পেয়েছে। ওকে ওরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করেছে।

—সে কী! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ওর। বলে, চলো চলো, এক্ষুনি চলো। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অমর টেবিলে এমন জোরে ধাক্কা মারে যে টেবিলের কফিমাগ, ব্রেড, ডিমের পোচ, জলের জাগ, ইত্যাদি ছিটকে পড়ে আমার গায়ে।

রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলি, আচ্ছা অপদার্থ ব্যাটাছেলে একটা!

—বেবি, ইয়ে মানে, কিছু মনে কোরো না, আমি ইচ্ছে করে…, ঘাবড়ে গেলে তোতলানো অমরের পুরোনো অভ্যাস।

—চোপ, একদম চোপ। এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করো। আর হ্যাঁ, তোমার ক্রেডিট কার্ড, ঊর্মির মেডিক্লেম কার্ডটা নিতে ভুলো না। যাও শিগগির।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাই, ধ্যাতানি খেয়ে অমর ছোটে। আমিও তৈরি হয়ে নিই চটপট! এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব? অমরটা চিরকাল নার্ভাস। কোনও ঘটনা ফেস করার মতন মানসিক জোর নেই। কী করে অফিস সামলায় কে জানে? ইদানীং একটু ঘাবড়ে গেলেই হুইস্কি নেয়। আর হুইস্কি পান করে আরও বোদাটে মেরে যায়। মাথা একদম কাজ করে না। তখন বলে, বেবি, প্লিজ ডু সামথিং। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। একটা যা তা।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অমর বলে, বেবি, ঊর্মির ইন ফ্যাক্ট কী হয়েছে বলল পুলিশ?

—বলল, ওকে আনকনসাস অবস্থায় ময়দানে আজ ভোরে পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ঘটেনি, জবাব দিই আমি।

অমর খানিক থম মেরে থেকে আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এইসব, সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই মেয়েটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছ। উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে মুখ-চোখ।

আমারও মাথা গরম হয়ে যায়, মুখ সামলে কথা বলো অমর। সাবধানে গাড়ি চালাও। ইদানীং মাঝেমধ্যেই ও কেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে জ্বলে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এরকম করত। একবার শ্যামলদাকে দিয়ে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছিলাম। এতদিন ঠিক ছিল। আবার বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই উকিল বন্ধুটাই মাথা খাচ্ছে ওর। কী সাম চ্যাটার্জী যেন। ওটাকে একটু সাইজ করতে হবে।

গাড়ি পার্কিং লটে দাঁড় করিয়ে ছুটে যাই আমরা। দেখি ক্যালকাটা পুলিশের এক সাবইন্সপেক্টর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনাসামনি আসতেই বলল, আপনারা মি. অ্যান্ড মিসেস…

—দাশগুপ্ত, কথা শেষ করি আমি, হোয্যার ইজ আওয়ার চাইল্ড?

—আসুন আমার সঙ্গে, বলে অফিসার লিফটের দিকে এগোন। ওকে অনুসরণ করে একটি কেবিনের সামনে পৌঁছোই, উনি ইঙ্গিতে বোঝান ওটাই ঊর্মির কেবিন। ধন্যবাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ঊর্মি আনকনসাস। পাশে একটি নার্স বসে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।

দ্রুত ঊর্মির সামনে যাই। ঠোঁট ফুলে উঠেছে, নীলচে বাদামি জমাট রক্ত। গালে, গলায় দাঁতের দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। অমরের দিকে তাকাই।

—ঊর্মি, মাই চাইল্ড, হাউমাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমর ওর বুকে। কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতো। ওকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি। নার্স বলে ওঠে, আরে আরে করছেন কী, শি নিডস কমপ্লিট রেস্ট। আপনারা ডক্টরের সঙ্গে দেখা করুন।

—কে দেখছেন ওকে? আমি প্রশ্ন করি। অমর চোখের জল মোছে। ডক্টর সোম। আসুন আমার সঙ্গে, নার্স এগিয়ে যায়। সোম-এর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়টুকু দিয়ে ও চলে যায়।

—প্লিজ বি সিটেড। ডক্টর সোম বলেন, আচ্ছা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মেয়ে কোনও ড্রাগস নিত?

অমর বা আমি কেউই এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। দুজনে দুজনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর আমিই দিলাম, না, সেরকম তো কোনওদিন দেখিনি। এ প্রশ্ন করছেন কেন?

—মেয়েটি ডেডলি আনকনসাস। ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিক পর্যায় জানা গেছে কোনও উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত ড্রাগ ওর শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাগটা ল্যাবে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।

—বললাম, আপনি ডাক্তার, আপনার কাছে কিছু লুকোনো উচিত নয়। ইদানীং ঊর্মি ড্রিংকস নিত একটু আধটু। তবে ড্রাগস যে নিত না সে ব্যাপারে আমি শিওর।

—খোঁজ নিন ভালো করে। ওর ঘর সার্চ করুন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আজকালকার হাইপ্রোফাইল অ্যাফ্লুয়েনট ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এইসব নেশার কবলে পড়ে জীবন শেষ করে ফেলছে। মনে রাখবেন, ইয়োর চাইল্ড ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস ব্লেসিং অন ইউ। একটা বাচ্চার জন্য চাইল্ডলেস কাপলসরা কী মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছেন তা তো দেখছি।

আমি চুপ করে থাকি। অমরের অবস্থা বুঝি এক্ষুনি ফেটে পড়বে। ইদানীং আবেগটাবেগ একদম চেপে রাখতে পারে না। স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করেই বার্স্ট করে, অত্যধিক অ্যালকোহল ইনটেকের ফল। কিন্তু মনে যে আশঙ্কা উঁকি মারছে সেটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া প্রয়োজন। বলি, ইজ শি ওকে অ্যাজ আ উয়োম্যান?

ডক্টর সোম কঠিন স্বরে বলেন, আই অ্যাম সরি টু সে মিসেস দাশগুপ্ত, শি ওয়াজ ব্রুটালি রেপড অ্যাজ অ্যান আনফ্রেমড প্রপার্টি। সম্ভবত, বাই আ গ্যাং অফ পার্সনস। আওয়ার এগজামিনেশন ইজ গোয়িং অন।

—ওহ্ মাই গড! শোনামাত্র অমর চেঁচিয়ে ওঠে পাগলের মতো। দুহাতে মুখ ঢাকে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। আমার মেয়ে এত বড়ো বোকামি করল? কিন্তু কেন? আমারই মতো ফাস্ট লাইফ চায় ও। হ্যাঁ, ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমি। তবে সেজন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা নিতেও কি শেখাইনি ওকে? অমরটা কেঁদেই চলে।

—শান্ত হোন, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। ডক্টর সোম বলেন, থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। ইয়োর কেস হ্যাজ অলরেডি বিন লজড।

মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, এখন আমাদের কী করণীয়?

—মেডিক্লেম কার্ড আছে নিশ্চয়ই? ওটা রেখে যান, সঙ্গে আপনাদের ভিজিটিং কার্ড। অমর ওগুলি এগিয়ে দেয়, ফের দুহাতে মুখ ঢাকে। বলে, উফ্ আমি, আমি ভাবতে পারছি না।

ডক্টর সোম এগিয়ে এলেন। অমরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভেঙে পড়বেন না মি. দাশগুপ্ত। ঘটনা এর থেকেও খারাপ হতে পারত। মেয়েকে ফেরত না-ও পেতে পারতেন। দুষ্কৃতিরা ওকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিংবা শরীর থেকে অপারেট করে কিডনি, আই, ব্লাড ইত্যাদি বের করে নিতে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন সেসব কিছুই ঘটেনি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন আপনারা। নাও প্লিজ গো হোম, অ্যান্ড কিপ ক্লোজ কনট্যাক্ট উইথ আস। ওর জ্ঞান আসলে জানানো হবে।

ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অমর আর আমি থানা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মানসিক ভাবে দারুণ বিপর্যস্ত আমি। ঊর্মির এই মারাত্মক পরিণতিটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। এইমাত্র ডক্টর সোম ফোনে জানালেন যে, ঊর্মির জ্ঞান ফিরেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। এক্ষুনি ওর চোখের সামনে দুএকটি প্রিয়জনের মুখ বড়ো প্রয়োজন।

সাধারণত অফিস ছাড়তে আমার আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু এরকম ফোন পাওয়ার পর আর অফিসে থাকা সম্ভব নয়। গাড়ি নিয়ে দ্রুত নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিই।

গাড়ির গতি বাড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে ঊর্মির জন্য। চোখের কোল ভিজে যায়। ওর এই পরিণতির জন্য কি আমি দায়ী? ওকে তো সব সময় বোঝাতাম আমি। তা ছাড়া নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতন বয়স ওর হয়েছে। একুশ বছর বয়স নেহাত কম নয়! মানুষ হতে গেলে যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খামতি ছিল না। তবু মেয়েটা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?

—আচ্ছা বেবির কি উচিত ছিল না, একটু সংযত জীবন যাপন করা? নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতাকে ও পলিশড স্বাধীনতার মোড়কে মুড়ে নিয়েছে। মায়ের অসংযত জীবনযাত্রা কি ঊর্মির মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। মা হিসাবে কতটুকু কর্তব্য করেছে বেবি? সেই ছোট্টবেলা থেকে তো মেট্রনের দাযিত্বে বাচ্চা। মাত্র চার মাসের বাচ্চাকে ফেলে অফিস জয়েন করেছিল, আমার বারংবার বারণ সত্ত্বেও। তিন বছর বয়স থেকেই ও ক্রেশে। ক্লাস ওয়ান থেকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বন্ডিংটা তৈরি হবে আর কী করে?

গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে চারতলায় ঊর্মির কেবিনে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঊর্মি, আমার দিকে তাকাল, অস্ফুটে উচ্চারণ করলে, বাপী। বলেই জ্ঞান হারাল।

দ্রুত ওর কাছে যাই। মাথায় হাত বুলোতে থাকি। চোখ দুটো আমার কেন যে এত অবাধ্য?

কতক্ষণ এভাবে কাটে জানি না। ঈশ্বরকে ডাকি, ভগবান, ওকে সুস্থ করে তোলো তুমি। নার্সের তাগাদায় বাইরে আসি। ডক্টর সোমের চেম্বারে যাই। বসুন মি. দাশগুপ্ত, বলেন ভদ্রলোক। এখন কেমন বুঝছেন?

—বেটার দ্যান বিফোর। সকালে বেশ কয়েকবার জ্ঞান এসেছে এবং গেছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে মাইল্ড। আমরা চাইছি পেশেন্ট যতটা সম্ভব মেন্টাল রেস্টে থাক। জেগে উঠলেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে।

—ওর শরীরের ড্রাগটা আইডেন্টিফাই হয়েছে?

—হ্যাঁ, অতি পরিচিত একটা ওষুধ, কমনলি নোন অ্যাজ ক্লাব ড্রাগস। সম্ভবত ওর অজান্তেই ড্রিংকসে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। শুনলাম ও সেদিন কলকাতার এক ডিসকো ঠেক-এ মাঝ রাত অবধি ছিল।

—ড্রাগটা কি খুব মারাত্মক?

—ইয়েস, ভিক্টিমের বিন্দুমাত্র বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে না।

পুলিশ এসেছিল শুনলাম। আমি আবার প্রশ্ন করি।

—হ্যাঁ, ওরা তদন্তের স্বার্থে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল বলে শুনলাম। আমি তখন ছিলাম না, রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম।

—ঊর্মির এ অবস্থায় ওদের অ্যালাউ করলেন কেন? অনুযোগ তীব্র হয় আমার।

—বারণ করে দিয়েছি, পেশেন্ট সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা আর ডিস্টার্ব করবে না, বললেন ডক্টর সোম।

—থ্যাংক ইউ ডক্টর।

—ইটস অল রাইট। মনে জোর রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইট ইজ আ গ্রেট শক ফর হার। শি নিডস প্রপার কাউন্সেলিং। ওকে শারীরিক ভাবে একটু সুস্থ করে সে ব্যবস্থা আমরা করব।

ডক্টর সোমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের ঊর্মির কাছে যাই। ও এখনও অচেতন। মাথায় হাত বুলোই। নীরবে চোখের জল ফেলি। একসময় নার্সিংহামে ছেড়ে গাড়িতে এসে বসি। নিজেকে এত দুঃখিত, এত অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি।

ড্রাইভ করতে করতে মনে হয়, ঊর্মিকে বড়ো করে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। যদিও মেয়ের এডুকেশনাল ব্যাপারগুলি বরাবরই বেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছে। বেবির ইচ্ছাতেই ঊর্মি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গার্লস হস্টেলে। ঊর্মি ছুটিতে বাড়ি আসলে বেবি অসন্তুষ্ট হতো।

গাড়িটা ক্লাবে পার্ক করি। আজ আর কারুর সঙ্গে নয়, একা একাই মদ্যপান করব। কোনার দিকে এক টেবিলে বসে দুটি ড্রিংকসের অর্ডার দিই।

ড্রিংকস নিতে নিতে মনে হয়, আমি নিশ্চিত, ঊর্মির আজকের পরিণতির জন্য বেবিই দায়ী। হ্যাঁ ঠিক তাই, বেবিই দায়ী। একবার শক্ত হাতে হাল ধরতে গিয়ে যা অবস্থা হয়েছিল, ল্যাজে-গোবরে একদম। ক্যালকাটা পুলিশের কোন ইন্সপেক্টর নাকি ওর দাদা, সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী অপমান!

শালা, এমন হড়কানি দিল, পিলে চমকে যাবার জোগাড়। ব্যাটা বলে কিনা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার স্ত্রী যে কমপ্লেন দিয়েছেন তাতে এক্ষুনি ফোরনাইনটি এইট-এ ধারায় কেস স্টার্ট করতে পারি, সেটা জানেন কি? অ্যারেস্ট করে আজ সারা রাত লকআপে রাখব, কাল কোর্টে চালান করব। নব্বই দিনের আগে জামিন পাবেন না। আর উনি আমাকে আপনার সম্পর্কে যা যা বললেন, তা যদি কোর্টে বলেন, কম সে কম বছর দশেক জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে। যাবেন নাকি?

—কোথায়? সভয়ে প্রশ্ন করি আমি।

—ঘানি টানতে?

আমি চুপ করে থাকি। লজ্জায় মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিই। নিজের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে… উফ্ ভগবান!

শালা আইসি বলে, স্ত্রীকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ওকে ঘাঁটালে কী হতে পারে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? যান, বাড়ি যান এখন। কমপ্লেনটা আমার কাছে থাকল, দেখবেন এটা যেন আমাকে ব্যবহার করতে না হয়।

ধ্যাতানি খেয়ে গরুচোরের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর কোনওদিন বেবির সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়নি। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো। বেবি কী একটা এনজিও চালায়। তাছাড়া নানারকম মিটিং-ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বছর খানেক কথাবার্তা বন্ধ ছিল। পরে বন্ধুবান্ধব, লোকজনের নিন্দামন্দের কথা ভেবে আমাকে আপস করতে হল, বিশেষ করে ঊর্মির মুখ চেয়ে। ঊর্মি তুই কি বুঝবি না মা, আমার যন্ত্রণার কথা? এই নীরব রক্তক্ষরণের কথা? চোখ ফেটে জল আসে আমার।

—স্যার, আর কিছু? দেখলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য ছেলেটি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে টু মোর প্লিজ, জবাব দিলাম আমি। বেয়ারা সোডা বরফ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে দিল। গেলাসে ঠোঁট ঠেকাই আমি। আমার মনে হয়, বেবির সঙ্গে দাম্পত্যের এই ফাটলের প্রভাব আমি কোনওদিন ঊর্মির ওপর পড়তে দিইনি। আমার কর্পোরেট লাইফের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও যখন যতটা পেরেছি সময় দিয়েছি ওকে।

আশ্চর্য! গত তিন-চার বছরে ঊর্মি কত দ্রুত বদলে গেল! যা সব বন্ধুবান্ধব জুটল। কী তাদের অদ্ভুত সাজগোজ, কানে দুল, নাকে দুল, চুলে রং। ঊর্মিকে কত বুঝিয়েছি, যে-ফাস্ট লাইফ তুমি লিড করছ, ইটস নট অফ ইয়োর কালচার। টেক ইয়োর লাইফ সিরিয়াসলি, সব সময় সাবধানে থাকবে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে বাবা হিসাবে এর বেশি আর কী বলা যায়?

বছর খানেক হল ঊর্মি কেন সাইলেন্ট হয়ে গেছিল। প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দিত না। বকাবকি করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। কেবলই হাত খরচের টাকা বাড়াতে বলত। একুশ বছরের একটি মেয়ের পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচে পোষায় না? কী করে ও অত টাকা নিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ করে, শুনেছি। ওখানে মাইনেপত্তর ভালো। এত টাকা উড়িয়ে কী সুখের সন্ধানে তুই মেতে ছিলি মা? একটিবার আমার কথা ভাবলি না?

কিন্তু সেদিন ডিসকো ঠেক-এ ঊর্মিকে কারা নিয়ে গিয়েছিল? কে ওর ড্রিংকসে ক্লাব ড্রাগস মিশিয়েছিল? এভাবে কারা রেপ করল ওকে? পুলিশ কি পারবে কালপ্রিটগুলোকে ফিক্স আপ করতে? হাজার প্রশ্নেরা আমাকে তাড়া করে। পাগলা কুকুরের মতো আমার ভিতর ছুটতে থাকি আমি। উত্তেজনায় মদের মাত্রা বাড়ে। এক সময় সব কেমন জেবড়ে যায়।

শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা,

এ চিঠি যখন তোমরা পাবে আমি তখন অনেক অনেক দূরে। এখন রাত্রি তিনটে। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া শেষ। আজ ষষ্ঠ দিন। শরীরের ব্যথা অনেকটা কমেছে, বেশ সুস্থ বোধ করছি। কয়েকটি ক্ষত থেকে যাবে মনে হচ্ছে।

এ কয়দিনে আমাকে নিয়ে পেপারে যা লেখালেখি হয়েছে তাতে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তাই এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাব মনস্থ করেছি। যাবার আগে তোমাদের সব জানানো উচিত বলে লিখে যাচ্ছি এ চিঠি।

কীভাবে যে এত সব ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কোনও না কোনও পরিচিত মুখ পেয়ে যাব এই আশায় ডিসকো ঠেক-এ আমি গেছিলাম। এক পেগ হুইস্কি নেবার পর ইচ্ছা করল একটু নাচতে। ডান্স ফ্লোরে একটা ছেলে হেসে নাচতে ডাকে। ছেলেটা স্মার্ট। নাচতে নাচতেই পরিচয় দেয়, ওর নাম জাভেদ। নিউ মার্কেটে ওর নাকি লেদার গুডসের দোকান আছে।

নাচ শেষ করে একটু দম নেবার জন্য বসি। আর একটা পেগের অর্ডার দিই। আমার সামনে এক জোড়া ছেলে মেয়ে দারুণ নাচছিল। সম্ভবত সেই সময়ে পাশে থাকা চাপ দাড়িওলা লোকটা আমার ড্রিংকসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, তাতে ড্রিংকসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।

পরের গান শুরুর মুহূর্তে আমার মনে হয়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ বনবন করে ঘুরতে থাকে মাথাটা। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে চারপাশ দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। খেয়াল হয়, জাভেদ, পাশের চাপদাড়ি, আরও দু-তিনজন ছুটে এসেছে আমাকে সাহয্যের জন্য। ধরাধরি করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। বিপদ বুঝতে পেরে আমি প্রাণপণে বাধা দিতে থাকি, চেঁচাতে থাকি, হেল্প, হেল্প। অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। টের পাই প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। ছেলেগুলোর কথা কানে আসে ভাসা ভাসা, হঠ যাইয়ে হঠ যাইয়ে সামনে সে। মাই সিস্টার ইজ ফিলিং সিক।

আশ্চর্য! কেউ ওদের কোনও বাধা দিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যতদূর মনে পড়ে ওরা পাঁচজন আমাকে লিফটে করে নামিয়ে ধরাধরি করে একটা বড়ো গাড়িতে তোলে। বোলেরো কিংবা টাটা সুমো হতে পারে। একজন বলল, জলদি ভাগ হিয়াসে।

গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিল। গাড়ির মধ্যেই ওরা আমার শরীর থেকে জামাকাপড় টেনেহিঁচড়ে খুলছিল হিংস্র ভাবে। জানোয়ারগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে ছিড়েখুঁড়ে খেতে চাইছিল আমার দেহ। একজন জিন্সটা খোলার চেষ্টা করছিল। আমার বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন নেই। ক্রমশ জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান হল, দেখি আমি নার্সিংহোমে। পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছি।

বাবা, তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এও বুঝি তুমি নিজেকে কতটা অসহায় বোধ করো। তোমার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার আর মায়ের মধ্যে যে বিরাট এক শূন্যতা তা আমাকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছে। জানি এতে তোমার কোনও দোষ নেই। কেন যে এত মদ খাও তাও বুঝেছি। তবে এত মদ খেও না বাবা। অন্তত আমার কথা ভেবে মদ খাওয়াটা কমাও।

আমার দুঃখ কেবল একটাই তোমরা আমার যন্ত্রণার খোঁজ কখনও নাওনি। আমার মনে পড়ে না, তোমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে আমাকে দেখতে এসেছ কখনও। জীবনে কোনওদিন একসঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। যে কটা জন্মদিন পালন করেছ, সেগুলিও কেমন যেন মেকি, ফাঁকা ফাকা, এলোমেলো।

মা, তোমাকে বলি, আমাকে তুমি কোনওদিন ভালোবাসোনি। চিরকাল নিজেকেই ভালোবেসেছ। নিজের সুখ, নিজের ভোগ নিয়ে মত্ত থেকেছ। তোমার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব কথা এখানে লিখতে চাই না। তবে বলতে লজ্জা নেই, পুরুষের প্রতি আসক্তি তোমার আজও কমেনি।

মা, তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তা কেবল মিনিমাম কর্তব্যবোধ। আমার এই ছোট্ট জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি তাতে মনে হয়, দাম্পত্যে যদি ভালোবাসা না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান নেওয়া কোনওদিনই উচিত নয়। তুমি এ ঘটনার পর যে কবার দেখা করতে এসেছ, কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছ, আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড়ো ভুল করলি কী করে? মা, কীভাবে তোমাকে বোঝাই যে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।

বাবা, তুমি চিরকালই আমাকে বড়ো ভালোবাসো। তবু চিরকালই কেন যেন আমি নিজেকে খুব একা বলে বোধ করেছি। আজ তোমার মধ্যে আমি নিজের অসহায়তা, একাকিত্ব, যন্ত্রণা সব উপলব্ধি করতে পারছি বাবা।

বাবা, কাল তুমি এসেছিলে। বারবার আমার হাতখানা ধরে বলেছ, তোকে বাঁচতে হবে মা, বাঁচতে হবে নতুন করে। এসব দুর্ঘটনা ভুলে, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে তোকে। জীবনে তুই যত বড়ো পথ দেখেছিস, জীবন তার থেকে অনেক অনেক বড়ো।

নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। বুঝেছি, মুহূর্তের অসাবধানতা আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে জীবন। তবে আমি বাঁচব বাবা। অন্তত একটি বার প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করব আমি।

এ মুহূর্তে আমার মুখময় অন্ধকার। এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কোনও নতুন শহরে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমার চারপাশে থাকবে না কোনও পরিচিত লোকজন, থাকবে না এই কালিমাখা অতীত।

তোমরা আমার খোঁজ কোরো না। প্রয়োজনে আমিই তোমাদের খোঁজ নেব। বিদায়, ভালো থেকো তোমরা। বাবা, আমার জন্য চোখের জল ফেলো না। তোমার কথাকে সম্মান দিয়ে যদি নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি তবেই ফিরব, নতুবা নয়।

প্রণাম

ইতি,

তোমাদের ঊর্মি।

চিঠি শেষ। ভোরের আলো উঠি উঠি। ব্যাগ গোছানোই আছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন গভীর ঘুমে। বাড়ির পিছনের গেট খুলে নিঃশব্দে পথে নামে ঊর্মি।

ক্রমশ ভোর হচ্ছে। ভোর এত সুন্দর! এত স্নিগ্ধ! পাখিরা ডাকছে। সকালের প্রশান্তি তার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক আশ্চর্য অনুভব। সামনে দূরের আকাশ, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওটা।

সই চম্পাবতী

এক

গুপ্তিপাড়ার এক কবিরাজের কাছে গোপনে গোপনে ওষুধ খাচ্ছিল চম্পা মণ্ডল। যৌনতা-বর্ধক ওষুধ। না, কবিরাজকে সে চেনে না। জানেও না এর জন্য কত দাম নেয় সে। ওষুধের গুণ টের পাওয়া যাবে তিনমাস পর থেকেই। পুরো ফল পেতে হলে আরও তিনমাস মোট ছমাস খেতে হবে।

তাকে নিয়মিত এই ওষুধ এনে দেয় তার স্বামীর বন্ধু সুনীল। এমন উপকারী লোক, অথচ দ্যাখো পয়সা দিতে গেলে নেবে না। জোর করলে বলবে, এই কোবরেজের খুব নাম। অনেকেই তার ওষুধ খায়, শুনি কাজও হয়। যদি কাজ হয়, তখন তুমি আমাকে পয়সা দেবে, কেমন?

বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু বলেনি হারান। দিন কয়েক যাবার পর সে মুখ খুলতে থাকে। মিলন শেষে নিরুত্তাপ গলায় বলত, তুমি বড়ো ঠান্ডা! কিছুতেই গা-গরম হয় না তোমার! অথচ তুমি যা গায়েগতরে। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপ দিই ওই উত্তুঙ্গ যৌবনের ভিতর। প্রাণের জ্বালা জুড়াই। কিন্তু আসলে তুমি একটি ঠান্ডা সাপ ছাড়া আর কিছু নও। ঝাঁপ দিয়ে আগুন মেলে না, বরফের জলে গা ভিজে ওঠে।

কথাটা গায়ে মাখেনি চম্পা। যৌনতা তার ভালো লাগে না। ওই সময় সে কেন যে আড়ষ্ট হয়ে থাকত, তা সে নিজেই জানে না। পরের দিকে হারান নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সে চম্পাকে মারধর করত। রাগে গরগর করতে করতে মাঝরাতেই ঘরের বাইরে চলে যেত।

একাকী বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদত চম্পা। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু সুডৌল স্তন, ভরাট কোমর, চওড়া কাঁধ ও তার কালোর উপর সুন্দর মুখশ্রীতে এমন কিছু ছিল যে, একবার দেখতে গিয়ে হারানের তাকে ভালো লেগে যায়।

হারানের এক প্রাণের বন্ধু হল সুনীল রাজবংশী। সুনীল নৌকো বানায়। ঘর ছেড়ে নৌকো বানানোর জন্য কোথায় না কোথায় পাড়ি দেয় সে। এক মাস দিঘা তো কোনও মাস মেদিনীপুরের অচেনা কোনও এক নদীর ধারে, আবার কখনও তার ডাক আসত শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ থেকে। কখনও বা ঘরের পাশে কুন্তীঘাটে যেত নৌকো বানাতে।

নৌকোর কারিগর হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু তার নিজের কোনও নৌকো নাই। সে যখন হারানের সন্ধানে আসত, তাকে ঠেস মেরে চম্পা বলত, এবার এট্টা নৌকো বানাও মাঝি, গাঙ্গ-এ ভেসে পড়ি।

সুনীল তখন রসিক নাগরের মতো হাসত। বলত, তোমায় নিয়ে কোথা যাব, বউ? সুনীল তাকে গোপনে বউ বলে ডাকত। মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারত সুনীল। চম্পার মাঝে মাঝে মনে হতো, তার যদি সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তবে সে সুখী হতে পারত।

হারান ছিল রাজমিস্ত্রি। বড়ো রাজমিস্ত্রি নয়, সে ছিল সহকারী। কাজের টানে তাকেও বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন সে সুনীলকে বলে যেত, বউটা রইল, দেখিস। সুনীল সেইসব দিনে আসত কিন্তু ঘরে ঢুকত না।

চম্পা ডাকত ঘরে বসার জন্য কিন্তু সে বলত, দিনকাল তো ভালো নয় বউ, কে কখন কী বদনাম দেয় তার ঠিক কী! তার চেয়ে এই ভালো। তোমার খবর করা হল, দেখা হল, কথা হল, সবদিক বজায় থাকল, আর কী চাই? এমনটাই থাক না।

চম্পা রেগে বলত, বদনাম আবার কী মাঝি? কে করবে বদনাম? তুমি কি আমার পর? তুমি আসবে, রোজ আসবে এই আমি কয়েক দি। শুনে মিটিমিটি হাসে সুনীল।

—আর বদনাম হলে? মুখটি ফিরিয়ে নেয় চম্পা।

—সে তো আমার ভাগ্য গো! এমন বদনামে যে মরেও সুখ!

বুক ভরে ওঠে সুনীলের। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, বলো কী, বউ! তারপর?

—তারপর আর কী, একখান নাও নিয়ে ভেসে পড়ব দুজনাতে।

সুনীল তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তা ভেসে ভেসে যাবে কদ্দূর?

—যাব না। নাও-তেই থেকে যাব। সারারাত, সারাজীবন।

—সংসার তোমার ভালো লাগে না, না বউ?

নীচু মুখে, বাঁ হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে চম্পা বলে, পালাইনি তো তোমার সঙ্গে। পালালে, একটা সংসার পেতুম।

—তবে ভেসে পড়বার কথা বারবার কও কেন, বল দিকি?

—সে আমার ইচ্ছে!

—কেবলি ইচ্ছে? আর কিছু নয়?

উদাস গলায় চম্পা বলে, আমি কোনওদিন নদী দেখি নাই! অনেক অনেক জল দেখি নাই! পাড় থেকে দেখা কি আর দেখা হল মাঝি? নদীকে দেখতে হলে নদীর বুকে থাকতে হবে। কেন, তোমার কি আমাকে নিয়ে ভেসে পড়তে আপত্তি আছে?

সুনীল বলে, তা নয় বউ। তুমিই আমার সব। আমার জীবনমরণ। আমার নাও, আমার নদী, আমার নৌকো। পর তো নও তুমি আমার। কিন্তু জানো কী, যেখন তুমি নাও ভাসাবার কথা কও, তোমাকে কেমন যেন উদাস লাগে।

—আর কেমন লাগে?

—বেউলা লাগে তোমায়। বেউলা- সুন্দরী। এক কলার মান্দাসে চলেছ তুমি।

—সেই মান্দাস তুমি, মাঝি বোঝ না?

—বুঝি বউ, বুঝি।

—তবে আমাকে নিয়ে ভেসে পড়ো না, কেন?

—পারি না যে!

—কেন পারো না মাঝি? আমার এ জীবন কি জীবন? পারো না আমায় একটা নতুন জীবন দিতে?

—ও এমনি করে তোমার গায়ে হাত তুলবে আমি কল্পনাও করতে পারি নাই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চম্পা বলে, দেহ ছাড়া সুখ হয় না মাঝি। দেহ ছাড়া দেহসুখ যে সোনার পাথরবাটি, মাঝি! দেহ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হয় না, সংসার হয় না, প্রেম-পিরিতি হয় না। দেহ ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য মাঝি! এ-পৃথিবী দেহের বশ। আর সেই দেহ আমার নেই!

তার দীর্ঘশ্বাস নিজ গায়ে মেখে নিতে নিতে সুনীল বলে, এ-যে তোমার মনের কথা নয়, সখি চম্পাবতী। তুমি যেমনি করে আমাকে বোঝো, তেমনি আর কে বোঝে বলো দিকি। হারানের কথা বলছ? ও কিন্তু সহজ সরল ছেলে। ছোটো থেকেই তো দেখছি তাকে।

—সেটাই তো বিপদ মাঝি। সহজ-সরলেরা যে মনের গভীর কথা পড়তে পারে না! ওদেরকে সব যে বলে বলে দিতে হয়, বুঝিয়ে দিতে হয়!

মাথা নেড়ে সুনীল বলে, কেন যে হারান এমনি করে! ওকে এখন আমি বুঝতে পারি না। মাথা নীচু করে চম্পা।

—ওর শরীর যে আমি সুখে সুখে ভরাতে পারি না, মাঝি। ওকে খুশি করতে পারি না! এবার আমাকে নিয়ে একখানা নাও বানাও মাঝি। সে নাওয়ের নাম দিয়ো সই চম্পাবতী। আমি মরে যাই যদি, তোমার সেই নাও-এর মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। আমার এই দুই চোখ এঁকে দিও নাও-এর গায়।

—তুমি নাও হবে, বউ? সুনীল চোখ বড়ো বড়ো করে। বলে, তুমি যে গহিন গাং বউ, নাও হতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? গহিন গাং, তার এপার, ওপার দেখা যায় না। মনের গভীর-গোপনে কোন ধন খেলা করে, তাকে কে বোঝে, কে ছোঁবে বউ? গহিন গাং তাই চিরকাল মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়।

—আমি যদি গহিন গাং হই, তুমি তার বুকে এক নাও।

—না বউ। আমি তা নয়।

—তবে? গহিন গাং যদি তোমার কোনও কাজেই না-লাগে, তবে লাভ কী আমার গাং হয়ে

—তোমায় ডুবে মরে যে সুখ, সখি!

এর পর আর নিজেকে সামলাতে পারেনি চম্পা। দুবাহু এগিয়ে দিয়ে সে জাপটে ধরে সুনীলকে।

সুনীল থরথর করে কেঁপে ওঠে। চম্পার উষ্ণ নিঃশ্বাসের কাছে সে পুড়ে যেতে থাকে। নতজানু হয় তার শরীরী-সুবাসে। ক্রমে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে তার। আর চম্পা তাকে দিয়ে নিজেকে চেনে। সে বোঝে, গহিন গাং-এ জোয়ার এসেছে। সেটা কবিরাজি ওষুধের কাজ নাকি সুনীলের সোহাগভরা ব্যবহার— তা সে নিজেই জানে না। মোটেই একটি ঠান্ডা সাপ নয়। সেও পারে। সেও জানে, কীভাবে প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় ডুবাতে হয়, কীভাবে ভাসাতে হয়, একটি নাও-কে। কীভাবে সেই নাও-কে নিজের গোপন খাঁড়ির দিকে গভীরে নিতে হয়।

দুই

এক পথ-দুর্ঘটনায় হারান মণ্ডল মারা গেল। লরি-বাস নয়, তাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা বাইক। সকালে যেমন কাজে বের হয়, সেদিনও তেমনি বেরিয়েছিল। সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাস্তা পেরোনোর সময় একটি দ্রুতগতির বাইক তাকে সজোরে ধাক্কা মারে, হারান রাস্তার ধরে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। লোকজন জমা হয়। একটা ভুটভুটি ভ্যানে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেখানে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল তিনদিন।

লোকমুখে খবর পেয়ে সুনীলকে নিয়ে সেখানে যায় চম্পা। মৃত হারানকে দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তাকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখনই জানা যায়, সে তিনমাসের পোয়াতি!

হারানের মৃত্যুর পর বাপের ভিটেতে ফিরে গেল না চম্পা। সে রয়ে গেল শ্বশুরের ভিটেতেই। কিন্তু সে এখন পড়েছে অথৈ জলে। তাকে দেখার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। তার সংসার চলে না। হারান বেঁচে থাকাকালীন সে বিড়ি বাঁধার কাজ করত। হাজারটা বিড়ি বাঁধলে আশি টাকা মিলত। কিন্তু এখন তাকে আর কেউ কাজ দেয় না।

সকলে বলে, হারানকে সে-ই চক্রান্ত করে মেরেছে। নইলে বাইকের ধাক্কায় কেউ মরে? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনীলের নাম। ফলে সুনীল আর আসে না তার বাড়িতে। নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না সুনীল। কাজের অছিলায় সে নানাস্থানে চলে যায়, ফেরে না। আগে যেমন সে ফিরলেই চলে আসত চম্পাকে দেখতে, তার নাভি-পদ্মের দর্শনে, তার শরীরী সৌরভে মাতোয়ারা হতে— এখন এসবের ধারেকাছে নেই সুনীল।

সে শুনেছে, এই অবসরে সুনীলের দাদারা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের কিছু জমিজমা আছে। তা থেকেও বেদখল করা হতে পারে সুনীলকে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে সুনীলের বুড়ি মাকে নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাঠের ধারে, জলাজঙ্গলের মধ্যে, একটেরে এই মাটির বাড়িতে একাকী এক বিপন্ন যুবতি বিধবা কীভাবে বাস করে, এই নিয়ে সমাজের কিন্তু কোনও মাথাব্যথা নেই!

হারান মারা যাবার পর যে-মানুষটি সর্বদা তার পাশে ছিল, সে সুনীল। সেইসময় একদম ভেঙে পড়েছে চম্পা, ঘরে দুদিনের মতো খাবারও মজুত নেই, তখন সেই সুনীলই তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই বা কতদিন দেবে। বিয়ের সময় একজোড়া দুল দিয়েছিল তাকে, বাপেরবাড়ি থেকে। সেটা বেচে দিল সে সুনীলেরই হাত দিয়ে কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এইভাবে সুনীল আর বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। তাকে কাজে বেরোতে হবে। আর সে কাজে গেলে মহাসমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে চম্পা। তাই হাতে বেশ কিছু অর্থ থাকা দরকার। কারণ সে আর একা নয়। তার পেটের মধ্যে একটা প্রাণ বাড়ছে, তার কথা চম্পাকে আগে ভাবতে হবে।

দুলজোড়া হাতে নিয়ে সুনীল বলেছিল, সোনা বেচে দিচ্ছ বউ? একবার ঘর থেকে গেলে আর গড়াতে পারবে?

ম্লান গলায় চম্পা বলে, ও-জিনিস কী হবে আমার? ঘরে রেখে কী করব, বল দিকি! বিপদের দিনে সোনা যদি কাজে না-আসে মানুষের, তবে ঘরে সোনাদানা রাখা কেন?

—তা বটে!

—তিন-চার হাজার টাকা মিলবে না এ-থেকে?

—তা হয়তো মিলবে। কিন্তু এই দুলজোড়ায় যে-তোমাকে স্বপ্নের মতো লাগে, বউ!

—এ দুটি বেচে ঝুটো একজোড়া দুল এনো না হয়!

মুষড়ে পড়ে সুনীল বলে, আমার টাকা নিতে মানে লাগছে বুঝি?

—আমার মান বলো, মন বলো— সবই তুমি। তোমার এই ঋণ ফিরত দিব কী প্রকারে?

—না-হয় নাই দিলে, কে চাইছে তোমার থেকে?

—তুমি চাইবে না জানি, মাঝি। তুমি নাও বানাও, দূরে দূরে যাও টাকার দরকার কত লাগে তোমার। তাছাড়া তুমি দাদাদের সংসারে থাকো। সেখানেও টাকা দিতে হয়।

—আমার সংসার তো তুমি।

চম্পা কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কালো গায়ে সেই রোশনাই আর নেই। মুখ মলিন। সেই এক ঢাল কালো চুল রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সব সময় সে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সব সময় চিন্তিত। সে যে পোয়াতি! একজন সহায় সম্বলহীন বিধবা কী করে একাকী একটি বাচ্চার জন্ম দেয়? তার প্রতিবেশী বা গ্রামের লোকদের আপত্তি এখানেই।

ওদের সকলেরই বক্তব্য, এই বাচ্চা আদৌ হারানের নয়। হারান জানতই না তার বউ পোয়াতি। তাদের ধারণা, এই বাচ্চা আসলে সুনীলের। এই নিয়ে নাকি তার আর হারানের মধ্যে রোজকার অশান্তি হতো। তাই তাকে ষড় করে সরিয়ে ফেলেছে সুনীল। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে চম্পা।

তিন

একদিন রাতেরবেলা, ঘুম আসছিল না চম্পার। বিছানায় শুয়ে খালি এ-পাশ ও পাশ করছে। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু সে ঘুমুতে পারছে না। নিজের কী যে হচ্ছে, কিছু বুঝছে না সে। এইসময় তার দরজায় তিনটি টোকা পড়ল পরপর। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসল সে। সাড়া দিল না। কোনও শব্দ করল না। কে হতে পারে দরজার ওপারে? সুনীল? কিন্তু সুনীল এইরকম করে না। রাতে কোনওদিন তার ঘরে আসে না সে। যতবার সে মিলিত হয়েছে সুনীলের সঙ্গে, সেটা দুপুর। উদ্দাম দুপুর, মিলনও তেমনি দুরন্ত। আর সেটা এতটাই চুপিসাড়ে যে, কারও টের পাবার উপায় নেই।

এই যে, লোকজন তার নামে এত অকথা-কুকথা বলে, সেটা হারান মারা গেছে বলেই। সুনীলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল চম্পা। আর বুঝেছিল, সব নারীর মধ্যেই যৌনতা থাকে। সেটাকে বের করে আনা, উপলব্ধি করার দাযিত্ব হল পুরুষের। পুরুষ যদি না পারে, সেখানে নারীর কিছুই করার থাকে না। সুনীল তাকে আবিষ্কার করেছিল। তারও কামনা আছে। তার স্পর্শেই একজন সত্যিকারের নারী হয়ে ফুটে উঠেছিল সে।

কিন্তু দরজার ওপারে কে? যে আছে, সে কোনও সাড়া করছে না। আর এমনি করে টোকা মারছে, নিশাচরের মতো, যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। মনের শঙ্কা এবার ভয়ে পরিণত হল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে…?

ওপাশ থেকে আওয়াজ এল— আমি, দরজা খোলো!

মেয়েমানুষের গলা! এবার নামল সে বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। আস্তে আস্তে দরজার খিল সরাল। তবে পাল্লা দুটি হাট করে খুলে দিল না। একটা বন্ধ রেখে অপরটি একটু ফাঁক করল। ওপারের মানুষটির ছোটোখাটো চেহারার অল্প একটু দেখা গেল।

—খোলো হারানের বউ, ভয় পেয়ো না। আমি সুনীলের মা।

সুনীলের মা! সে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিল। এত রাতে সুনীলের মা তার কাছে কেন! সুনীলের কোনও বিপদ হল?

ঘরে ঢুকে বুড়ি বলল, নাও, এবার দরজা আটকে দাও। খিল তুলে দিল চম্পা।

—কিছু হয়েছে মাসিমা? আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কী হল?

—আমার বড়ো বিপদ!

—বিপদ! আপনি বসুন। জল খান। বলে বুড়িকে সে বসাল। এক গেলাস জল দিল।

বুড়ি ধাতস্থ হয়ে বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এলাম। আমাকে থাকতে দেবে আজকের রাতটা? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

—সেকি! কেন?

—ওই যে, আমি বলেছি, সুনীলকে জায়গা-জমির ভাগ দেব, তাই।

—সুনীল কোথায়?

—সে আছে নদীয়ায়।

—কবে ফিরবে?

—ফিরবে না। যদি মেরে দেয়, ওই ভয়ে ওখানে গেছে একমাস হতে চলল। যাবার আগে বলে গেছে, এবার ওখানেই থেকে যাব মা। আমি ঘর দেখছি। তার মধ্যেই এইসব ব্যাপার।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল চম্পার। বহুদিন হয়ে গেল, সুনীল তার কাছে আসে না। তাকে ভালোবাসে না। কতদিন সে দেখে না সুনীলকে। তার জন্য মন কেমন করে চম্পার। কিন্তু বাইরের কাউকে কিছুই বলার উপায় নেই। এমনিতেই ঢিঢি পড়ে আছে চারিদিকে। এবার তার মনকেমনের কথা একবার চাউর হলে, সে এখানে আর বাস করতে পারবে না।

সুনীলের মা গর্জে ওঠে, আমিও ছাড়ব বলে ভেবেছ? রাজবংশী পরিবারের বউ আমি। আমার এক ছেলেকে বঞ্চিত করে বাকিরা সুখ ভোগ করবে, এ আমি হতে দেব না। আমি উইল বদলাব। সমান ভাগ আর থাকবে না। তুমি একবার সুনীলকে ফোন করো।

—এত রাতে?

—হ্যাঁ, এখুনি করবে। আমি কথা বলব। তিনবার রিং হবার পর সুনীল ফোন ধরে হ্যালো বলল।

আহা! কতদিন পর সে সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনছে। সে ফোনটা সুনীলের মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল।

সুনীলের মা বললে, শোন সুনীল, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কাল ভোরের ট্রেনেই আমি আর চম্পা তোর ওখানে চলে যাচ্ছি। ঘর ঠিক করেছিস তো… আচ্ছা আচ্ছা ও… রাখ।

ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সুনীলের মা বললে, আমাদের কাল ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে, ওদের কোনও বিশ্বাস নেই। আর ওখানে গিয়ে তোমার এই চম্পা নামটি থাকবে না। তুমি হবে চম্পাবতী রাজবংশী। নাও বউমা, কাপড়-জামা গুছিয়ে নাও। তুমি পোয়াতি, খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদের। ভোরের ট্রেনে ভিড় কম হয়। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।

কিছু বুঝতে পারছিল না চম্পা। কেবল আমতা আমতা করে বলল, আমি, মানে…!

—বুঝতে পারছ না? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমি সুনীলের বিয়ে দেব। তোমাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে দেব। ওখানে তোমরা নিজের মতো করে সংসার পাতবে।

ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল চম্পা। মনে পড়ল, সুনীলকে একদিন বলেছিল সে, কদ্দিন আর পরের পোয়াতি বিধবার পিছনে ঘুরঘুর করবে। তোমায় এবার নিজের সংসার পাততে হবে, নিজেরটা দেখতে হবে। তোমার এখানে আর না-আসাই ভালো।

সুনীল বলেছিল, তুমি আবার পরের কোনখানটায়? পুরোটাই তো আপন।

চম্পাবতী হু-হু করে কাঁদছিল। চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল তার। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের মা। তবু এক কষ্ট জাগে বুকের ভেতর। এত আনন্দের মাঝেও বুকের ভেতর এই এক দমচাপা কষ্ট চম্পার, কে জানে কার জন্যে!

 

 

আমেরিকান ডায়মন্ড

সরলা মাসি একেবারে খাঁটি বাঙাল। খাসা হাতের রান্না। ‘বাঙালরা আনাজপাতির খোসাও ছাড়ে না’ কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনালেও, কোনও ঘটি মাইয়ার পক্ষে ওই খোসাকেই অতুলনীয় সুস্বাদু করে তোলা প্রায় অসম্ভব। আমার রান্নার লোক। বহুদিন হয়ে গেল রয়েছে এবাড়িতে। তার টানটান বাঙাল ভাষার সঙ্গে রসিকতা তো তুলনাহীন। বেশ মজায় কাটে সকালটা। সেদিন সকালে রান্নাবান্না নিয়ে মাসির সঙ্গেই কথা বলছি, সেই সময় পাশের বাড়ি থেকে সোমার চিৎকার, ‘কেয়া আছিস? আয় শিগগির একটা জিনিস দেখে যা।’

ক্ষণিক বিলম্ব না করেই জবাব দিলাম, ‘আসছি আসছি।’ কারণ, খুব ভালো করেই জানি সাড়া না দিলে এক্ষুনি বাড়িতে চড়াও হবে। কালই মুম্বই থেকে ওর বর ফিরেছে। নিশ্চয়ই ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। সেটা দেখানোর জন্যই এত তৎপর। যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাসি বেশ মজা করেই বলল, ‘যাও তোমারে হোয়াগ কইরা ডাকতাসে, কত কী দ্যাহাইব।’

‘ওঃ মাসি তুমিও না। ও যদি একটু দেখিয়ে শান্তি পায়।’

‘যাও যাও। তোমারে কেডা আটকাইতাসে।’

খানিক হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি রান্না করো। আমি আসছি।’

সোমার বাড়িতে ঢোকা মাত্রই একপ্রকার পাকড়াও করে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েই হাতে একটা সালোয়ার কামিজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ কী সুন্দর, না?’

‘দারুণ রে, কাপড়টাও খুব ভালো। কৌশিক এনেছে না?’

‘আর কে আনবে বল? ওই একজনই তো আছে আমার ডার্লিং। দ্যাখ না এইবার তো তিনটে নাইটিও নিয়ে এসেছে। এটা তো আমি কাল রাতেই পরেছিলাম। কী সেক্সি না।’ সোমার চোখেমুখে খুশি ফুটে উঠল। ‘মাসে একবারই তো বাড়িতে আসে। যা যা নিয়ে আসে সব ওকে পরে পরে দেখাতে হয়, না হলেই তেনার মুখভার।’

‘তবে একটা কথা মানতেই হবে কৌশিকের আনা নাইটিগুলো সত্যিই অন্যরকম। এগুলো পরলে অটোমেটিক একটা রিচ লুক চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে বললাম বটে, কিন্তু কেন জানি না খটকা একটা ছিলই। আমরা যে-স্ট্যান্ডার্ডে বিলং করি সেখানে এইধরনের ড্রেস একেবারেই খাপ খায় না। যে-কোনও কিছুর জন্যই যথাযথ পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সেই পরিবেশ আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে কোথায়? ছোট্ট পরিসরে ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে গেলে এমন ভাবনাই ভুল। সেখানে কৌশিকের এমন পছন্দ…! ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও তো তেমন সাউন্ড বলে মনে হয় না যে বলব,

বংশপরম্পরায় পাওয়া। তারপরেই মনে হল দূর এসব কী নিয়ে পড়লাম আমি, নিজেকে সংযত করলাম।

সোমা তখনও স্বামীর নাম জপে চলেছে। সেই সময় আমার বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাড়ি যাওয়ার একটা ছুতো পেয়ে গেলাম। ‘আমি আসি রে। কে ফোন করছে কে জানে। মাসিও তো রান্না সেরে বাড়ি ফিরবে। সব দেখে-টেখে নিই। যাই।’ বলেই বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল।

ফিরে আসার পরেও মনটা ওই নাইটির মধ্যেই আটকে রইল। শুধু কেন কেন কেন – মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। স্বামীর এত প্রশংসা – কেন কী দেখাতে চায় ও? ওর স্বামী ওকে কত ভালোবাসে, নাকি কৌশিক এখন অনেক টাকা রোজগার করছে, সেটা জানানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য।

কদিন আগেও তো কৌশিক স্টেজ-শো করে বেড়াত। সুদর্শন হওয়ার সুবাদে দু-একজন পরিচালকের দয়ায় সিরিয়ালে ছোটোখাটো রোলে অভিনয় করত। হঠাৎ বউয়ের কথা শুনে নতুন ব্যাবসা শুরু করে এত টাকা উপায় করে ফেলল যে, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলল।

ভাবনায় এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে, বুঝতেই পারিনি, মাসি এর আগেও আমাকে ডেকেছে। এবার বেশ জোরেই বলে উঠল, ‘কী ভাবতাস কও তো। তহন থেইকা ডাকতাসি।’

‘ও! হ্যাঁ হ্যাঁ। বলো কী বলছ?’

‘কইতাসি, রান্না হইয়া গেসে। আমি আইতাসি।’

দুপুরে খাবার পর শুয়ে শুয়ে টিভিতে খবর দেখছি, ফোনটা আবার বেজে উঠল। রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল খুনশুটি মেশানো স্বর, ‘হাই জানু, কী করছ?’

‘আরে টিভি দেখছিলাম…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপার থেকে বলতে শুরু করল, ‘টিভির দোহাই কেন দিচ্ছ ডিয়ার, বলোই না অজিত ছাড়ছিল না, তাই ফোন ধরতে এত দেরি করলে।’ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে যাচ্ছিল রাইমা।

‘রাইমা, সত্যি তুই আর শোধরালি না।’

‘শোধরাতে চাইলে তবে না শোধরাব। মুম্বইতে এসে তো আরও বিগড়ে গেছি। তুইও আয় তোকেও বিগড়োনোর সব পথ বাতলে দেব। অ্যায়েশ কাকে বলে দেখবি তখন।’

‘কী করে যাব বল। জানিসই তো অজিতের ব্যাবসার চক্বরে এখন আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। এখন তো বিজনেসের খানিকটা দায়িত্ব আমার কাঁধেও চাপিয়ে দিয়েছে। সময়ের অভাবে এখন আর স্ক্রিপ্টও লিখতে পারি না।’ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।

‘ডোন্ট ওরি কেয়া, ম্যায় হু না। সামনের মাসেই কলকাতায় আসছি। তোকে দিয়েই পুরো স্ক্রিপ্ট লেখাব ভেবেছি। কলকাতায় তো সময় দিতে পারবি নাকি?’

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ এখানে হলে আমি ঠিক সময় বার করে নেব। তুই শুধু জানাস কবে আসবি, সেইমতো তোর থাকার ব্যবস্থা করব আমি।’ এক ঝটকায় মনটা ভালো হয়ে গেল।

‘না না, আমি হোটেলেই থাকব। কেন আমার আনন্দটা মাটি করতে চাইছিস বলতো।’ বেশ অবাক হয়েই বললাম, ‘মানে। ঠিক বুঝলাম না।’

‘জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়, সেটা এখনও শিখিসনি তুই।’

‘তুই কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বোকার মতো বলে বসলাম।

‘স্টুপিড কোথাকার। তোকে বুঝতেও হবে না। যখন কলকাতায় আসব সময় নিয়ে তোকে সব বোঝাব। চল ফোন রাখছি। আমার স্পেশাল খাবার এসে গেছে।’

‘স্পেশাল খাবার! হ্যাঁ তো ঠিক আছে না খেতে খেতেও তো…’ ততক্ষণে ফোনটা কেটে গেছে। রাইমাটা কী যে করে! যাকগে আমার জন্য এটাই ভীষণ খুশির খবর যে, ও কলকাতায় আসছে। হিন্দির পাশাপাশি বাংলাতে অনেক সিরিয়াল, টেলিফিল্ম বানিয়েছে ও।

সাত বছর আগে সেই যে সিরিয়ালের শ্যুটে মুম্বই গেল, ওখানকার হয়েই থেকে গেল। মাঝে ওর বাংলা সিরিয়ালের জন্য বার চার-পাঁচেক স্ক্রিপ্টও লিখেছি। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। অনেকে তো ভাবত, আমরা দুই বোন। আজ ও উচ্চতার শিখরে পৌঁছে গেছে। একডাকে সবাই চেনে। বলা যেতে পারে সেলিব্রিটি। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমাকে ভোলেনি। ওখানে গিয়ে বহুবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু সংসারের জন্য সম্ভব হয়নি। এখন যখন রাইমা এখানে আসছেই, কাজের জন্য বেশ কিছুদিন থাকার প্ল্যানও আছে, তখন আমারও কাজ করতে অসুবিধা নেই।

সেইদিন রাতেই অজিতকে, রাইমার শহরে আসা থেকে আমার স্ক্রিপ্ট লেখা সব কিছুই জানালাম। আনন্দে উচ্ছ্বসিত অজিত, আমার হাতদুটো ধরে বলেছিল, ‘বিশ্বাস করো কেয়া, আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ব্যাবসার চক্বরে তোমার ট্যালেন্ট চাপা পড়তে বসেছে। হয়তো তোমাকে বলতে পারিনি, মনে মনে ভীষণ অনুশোচনা হতো। যাক, আজ আমি খুব খুশি।’

এখন শুধু রাইমা আসার অপেক্ষা।

দিনকতক পরে শহরে পৌঁছে একটি পাঁচতারা হোটেলে উঠল সে। হোটেলে চেক-ইন করার পরেই ফোন করে ডেকে নিল আমাকে। তৈরি হয়ে বেরোতে যাব, সেই সময় সোমা এসে হাজির। ঘরে ঢুকে কোনও দিকে না দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ, আংটিটা। কাল শপিং করতে গিয়েছিলাম। সামনে জুয়েলারি শপ দেখে লোভে পড়ে ঢুকে গেলাম। কিনে ফেললাম আর কী। কেমন হয়েছে রে?’

কোনওরকমে দেখে বললাম, ‘ভালো হয়েছে।’

আমার দেখার ধরনটা ঠিক ওর পছন্দ হল না। মুখটা কেমন একটু বাঁকিয়েই বলল, ‘কোথায় এমন যাচ্ছিস যে একটু ভালো করে দেখবি সেই সময়ও নেই তোর।’

‘হ্যাঁ সত্যিই সময় নেই রে। সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট লেখার একটা কাজ পেয়েছি। প্রোডিউসারের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। সরি রে আমি ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলব।’

জানি এসব টিভি সিরিয়াল, অ্যাক্টিং ওর একেবারেই পছন্দের নয়। সেই কারণেই কৌশিকের পিছনে সর্বক্ষণ পড়ে থাকত। এসব ছোটোখাটো কাজ ছেড়ে যাতে মোটা টাকা উপার্জন করতে পারে, সেরকম কাজ করার কথাই বলত। আজ অবশ্য প্রপার্টি ডিলিং-এ ভালোই ইনকাম করছে সে। সোমার খুশি থাকার কারণই হল তাই। কৌশিক সোমাকে এত টাকা দেয়, যখন যা খুশি কিনে ফেলে।

‘অজিতদা জানে যে তুই…’

দরজায় তালা দিতে দিতেই বললাম, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ।’ সোমা মুখ ব্যাজার করে চলে গেল। আমিও তর্কে না জড়িয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।

হোটেলে পৌঁছেই দেখলাম রাইমাকে ঘিরে সাত-আটজন বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই উঠে এসে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল সে।

‘হাই, মাই সুইটহার্ট… অনেকদিন পর দেখা হল আমাদের।’

‘সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেল। তোকে ভীষণ মিস করতাম।’

‘ওহ্ রিয়েলি, সো সুইট। আয় বস।’ ওর পাশেই বসাল আমাকে।

‘আলাপ করিয়ে দিই, এ হল আমার সুইটহার্ট, কেয়া। আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু আর খুব ভালো রাইটারও… দশ বছর তো হয়েই গেছে না আমাদের বন্ধুত্বের… কী রে কেয়া তাই তো?’

হেসে উত্তর দিলাম, ‘বেশি হবে।’ সবার চোখেই তার প্রতি বেশ একটা সমীহ নজরে পড়ল।

‘কেয়া, ইনি হলেন ডাইরেক্টর বিনয়, ইনি মিউজিক ডিরেক্টর শতদ্রু। আর এরা রাহুল, সুমিত, প্রিয়ংকা আর শামসের। এরা সবাই শিল্পী তো বটেই, সঙ্গে আমার সমস্ত কাজ এরাই দেখাশোনা করে। আমাকে কিছু করতেই দেয় না।’

বুঝতেই পারলাম এরা সবাই রাইমার সহকারী। ‘রাহুল খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। অর্ডার দেওয়া হয়েছে তো?’ প্রশ্ন করল রাইমা।

‘হ্যাঁ, ম্যাডাম এক্ষুনি চলে আসবে।’

মিনিট চল্লিশ পর খাওয়াদাওয়ার শেষে রাইমা সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল। ঘরে এখন ও আর আমি। ‘দ্যাখ পরের সিরিয়ালে আমি বাছা বাছা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। সেইমতো কথাও হয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। সুতরাং স্ক্রিপ্ট-টা কিন্তু ফাটাফাটি হওয়া চাই।’ ওর কথা বলার স্টাইল দেখেই মনে হল ও ওর কাজের প্রতি কতটা যত্নশীল।

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। তারপর কিছু রিসার্চ পেপার দিল আমাকে, যেগুলোকে বেস করেই স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে আমাকে।

ওর কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলেই ফেললাম, ‘এই কয়েক বছরেই ইন্ড্রাস্ট্রির খুঁটিনাটি সব কিছু বিষয়ে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে গেছিস।’

‘ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করব আর সেই জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকবে না তা কখনও হয় বল? তুইও আমার সঙ্গে থাক, তোকেও সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব।’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘মনেই হচ্ছে না যে, তুই আমার সেই পুরোনো বন্ধু রাইমা।’

‘মনে হবে কী করে। আমি তো সত্যিই আর আগের মতো নেই।’ কথাটা শেষ করে আবার হেসে ফেলল সে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, এসব প্রসঙ্গ ছাড়। বলতো, অজিত তোর ঠিকঠাক দেখাশোনা করে তো?’

ওর চোখের দুষ্টু চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম, এবার আমাকে রাগাবার ধান্ধায় আছে।

বললাম, ‘খুব ভালো করেই দেখাশোনা করে, খেয়াল রাখে…, আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে না?’

‘আচ্ছা আর একটা কথা বল?’ ঠোঁটের কোণায় সেই শয়তানি হাসি।

‘আবার কী?’ বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম।

‘না, বলছি রোজরোজ একই মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে তুই বোর হয়ে যাস না। না মানে, নতুন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তোর?’

‘এই, তোর এই কথাগুলোই আমার ভালো লাগে না। ভালো কিছু বলতে পারিস না?’

‘দ্যাখ সেটাই তো বলছি, আমার একই কথা যেমন তোর ভালো লাগে না, সেইরকমই রোজরোজ একই জিনিস… মনে হয় না, নতুন কিছু করে দেখাই? বিলিভ মি, এই বিন্দাস লাইফ উপভোগ করতে শিখেছি মুম্বই গিয়ে। এখানে তো বেশিরভাগই মুখোশধারী।’ কথার মাঝেই ফোনের কি-বোর্ডে তার ফাইলকরা নেলপেইন্ট লাগানো আঙুলগুলো খেলা করে বেড়াচ্ছিল। আধুনিক জীবনের জনসংযোগ ব্যাবস্থা।

‘দ্যাখ সেই সকালে এসেছি, এখন সন্ধে হয়ে গেছে। কত কাজ, ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক বল। এখন মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য তো আর জয়পুর থেকে বরকে আসতে বলতে পারি না। যখন খিদে পায়, তখনই খাওয়া উচিত, বাড়ি ফিরে ঘরের খাবারই খাব এটা তো অযৌক্তিক ভাবনা, তাই না। বল এব্যাপারে তোর কী অভিমত।’

‘রাইমা, ক্ষ্যামা দে বাবা। ওহ্ তুই আর তোর চিন্তাভাবনা।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নক করে রাহুল ভিতরে এল।

‘বলুন ম্যাডাম।’

‘জয় কোথায়?’ বলেই আগ্রহী ভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘জয় পরশুদিনের শুটিং-এর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে গেছে। মিনিট পাঁচেক আগেই ফোন করেছিল। আসার সময় হয়ে এসেছে।’

‘ঠিক আছে। এলেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। তুমি একটু ড্রিংকস বানাও।’

‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’ বলেই সে তার কাজে লেগে গেল।

রাহুলকে ড্রিকংস বানাতে বলার পর মুচকি হেসে হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘এনজয় করেছিস কখনও? জীবন কাকে বলে জানিস?’

‘এ আবার কেমন কথা হল! গতবারই তো গৌহাটিতে গিয়ে দারুণ মজা হল। অজিত, আমি, মা, বাবা, অজিতের বন্ধুর ফ্যামিলি।’

রাইমা মাথা চাপড়ে বলল, ‘ধ্যাত তেরি কা। তোর দ্বারা কিস্সু হবে না।’ রাহুল ততক্ষণে ড্রিংক তৈরি করে দিয়ে চলে গেছে।

‘চল আজ আমরা দুজনে একসাথে জীবনটা উপভোগ করব।’ বলেই রাইমা আমার হাতে একটা আলতো চাপ দিল।

‘মানে!’ বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।

‘জয় বলে যে-ছেলেটাকে ডেকে পাঠালাম, দেখবি দারুণ হ্যান্ডসাম আর খুব চার্মিং। রাজস্থানের ছেলে… টুকটাক অভিনয় করত। অ্যাক্টিং-টা একেবারেই পারত না। আমি ওকে প্রোডাকশন কন্ট্রোলার-এর কাজটা দিলাম। ওকে দেখে যে কত অ্যাক্টর ফিদা হয়ে আমার কাছে কাজের জন্য আসে জানিস না। তাছাড়া আমার স্পেশাল কাজে তো লাগেই।’ রাইমার উপর কেমন যেন নেশা চড়ে বসল।

মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলাম না। কিছু বলতে গেলে যদি ও রেগে যায়। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করল রাইমা, ‘জানিস কেয়া, আমার সিরিয়ালে প্রথম যে-ভদ্রলোক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি তো আমাকে দেখে একেবারে পাগল। ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী রঞ্জনা আবার জয়কে দেখে নাছোড়। ওকে ওর চাই-ই। কতবার তো রঞ্জনা আর আমি জয়কে একসাথে শেয়ার করেছি।’

হাঁ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে দেখে বলল, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, নিজেকে ভালো রাখতে গেলে এগুলো দরকার। জাস্ট ফর রিল্যাক্সেশন। অবশ্য আমিও ওর জন্য কম করি না। কাজের দরুন প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার আর আমার মাইন্ড ফ্রেশ রাখার জন্য প্রতিবার দশ-কুড়ি হাজার দিই। সঙ্গে ওর বউয়ের জন্য কাপড়চোপড়। এছাড়া যখন যা সঙ্গে থাকে।’ এসব শুনে সামনের মানুষটা যে ওর সম্পর্কে ঠিক কেমন ধারণা করতে পারে, সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই রাইমার।

ওর সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও, নিজেকে সংযত করে বললাম, ‘দ্যাখ, প্রত্যেকটা মানুষই নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। তুই তোর পৃথিবীতে খুশি, আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে। যাক এসব কথা এখন থাক। তুই এনজয় কর, আমি চললাম।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আমাকে উঠতে দেখেই বলল, ‘হ্যাভ এ চেঞ্জ ডিয়ার। একবার ওকে দেখলে তোর আর ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করবে না। আমি তো তোকে অজিতকে ছাড়তে বলছি না। তোদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও থাকল আর এক্সট্রা… মাঝে মাঝে তো এটা হতেই পারে নাকি।’ এক পেগ শেষ হওয়ার পর আর এক পেগ তুলে নিল রাইমা। ঠিক তখনই দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে এল জয়। দরজার দিকে পিছন করে বসেছিলাম বলে মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না।

‘কাম ডার্লিং, কাম।’ রাইমা ওর হাত ধরে নিয়ে একেবারে বিছানায় গিয়ে গা-ঘেঁষে বসল। অবশ্য গা-ঘেঁষে বললে বোধহয় ভুল হয়, কারণ রাইমার অর্ধেক শরীরটাই তখন জয়ের কোলে।

‘আমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই… কেয়া।’ মুখ তুলে আগন্তুককে দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ভুল দেখছি না তো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জয়েরও একই অবস্থা। কোনও কিছু বোঝার আগেই রাইমা জয়কে জড়িয়ে ধরে জয়ের শার্টের বাটন খুলতে শুরু করল। আর নিজেও প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।

‘উঃ ডিয়ার জয়… জয়… জয়…’

বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না আমার। কৌশিক-ই তাহলে জয়। নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করছে এখানে। তা হলে এটাই ওর প্রপার্টি ডিলিং-এর বিজনেস! মাথা ঘুরছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বারবার সোমার সেই হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কৌশিক খুব ভালোবাসে। নতুন নতুন নাইটি, শাড়ি, দামি গিফট এনে দেয়। এই তার ভালোবাসার নমুনা! ওদের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কোনওরকমে আসছি বলে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হল জয় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ ছটফট করছে।

‘উঃ ছটফট করছ কেন। মুড খারাপ কোরো না আমার।’ রাইমার এই অস্ফুট স্বর সারা রাস্তা কানে বাজতে থাকল আমার। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। চেনামুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই রক্তমাংসের কদর্যতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। ভাবলাম বাড়ি ফিরে স্নান করব। মাথাটা ঠান্ডা হবে।

বাড়ি ফেরার পথেই মোড়ের দোকানে রমলার সঙ্গে দেখা। রমলা ও-বাড়ির কাজের লোক। থাকা-খাওয়া সবই ওখানে। ও-ই বোধহয় আমার ফেরার খবরটা দিয়েছে। জিরোব বলে সবে ফ্যানটা চালিয়েছি, অমনি দরজায় ধাক্বা। খুলে দেখি ‘সোমা’। ওকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন যেন শিউরে উঠলাম।

‘কীরে ভূত দেখলি নাকি। এমন চমকে উঠলি কেন?’

‘না না এমনি। বস। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’

ফিরে এসে দেখলাম হাতের আংটিটা নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। দেখেও না দেখার ভান করলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই জিজ্ঞাসা করল, ‘যে-কাজে গিয়েছিলি সব ঠিক হয়ে গেছে?’ উত্তরের আশা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘তখন তো ঠিক করে দেখলিই না। এই দ্যাখ ডায়মন্ড রিং এটা।’

প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘কৌশিক কোথায় রে? ফেরেনি এখনও?’

‘না সকালে বলেই বেরিয়েছে কী যেন বড়ো একটা ডিল আছে, দুদিন ফিরতে পারবে না। কেন রে কিছু হয়েছে নাকি?’

‘নাঃ। এমনিই, কী আর হবে?’

একবার মনে হল ওকে সবকিছু জানিয়ে দিই, ওরও জানাটা প্রয়োজন। আবার পরক্ষণেই ওর মুখের হাসিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। চুপ হয়ে গেলাম।

ওকে দেখে ভীষণ মায়া হল। বেচারি। একজন মধ্যবিত্ত মহিলার পক্ষে পাঁচতারা হোটেলের অন্দরমহলে কী হচ্ছে, সেটাও তো জানা সম্ভব নয়। আর বড়ো বড়ো লোকেদের মাইন্ড রিল্যাক্সেশন – এসব তো ওর ভাবনাচিন্তার উর্দ্ধে।

টুকটাক শপিং ছাড়া মেয়েটা আর যায়ই বা কোথায়, যে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতার কথা জানতে পারবে। স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আজ ও কত সুখী। সেই খুশিতে বাধ সাধতে ইচ্ছে হল না। কাজেই আমিও ওকে খুশি করতে আংটিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম। কখন যে হিরের দ্যুতি ঠিকরে এসে চোখের কোণায় জল জমিয়ে দিয়েছে বুঝিনি।

 

কলকাতার জিগোলো

।।১।।

গাড়িটা এটিএম-এর সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এল এক স্মার্ট সুদর্শনা যুবতি। সে নিজেই ড্রাইভ করছিল।

এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়েছিল সিকিউরিটি গার্ড যুবকটি। সে যেন তার জন্যই অপেক্ষায়। ভদ্রমহিলাকে স্যালুট করে সে বলল– গুড ইভিনিং ম্যাডাম।

যুবতিটি মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিল– গুড ইভিনিং। কেমন আছো ঋষভ?

– ভালো। ক’দিন এটিএম-এ আসেননি ম্যাডাম?

– হ্যাঁ, ক’দিন আসা হয়নি। অফিস অফিস করে কেটে গেছে। তবে টাকার-ও বোধহয় অতটা প্রয়োজন হয়নি। নইলে এটিএম-এ না এসে পারা যায়? তুমি আমার আসা যাওয়ার হিসাব রাখো নাকি?

– না না, ঠিক হিসাব রাখা নয়। আমাদের তো এটিএম-কেন্দ্রিকই চাকরি। কিছু কাস্টমার মাঝেমাঝেই আসেন। তাদের আসারও নির্দিষ্ট সময় আছে। আপনি তাদেরই একজন।

যুবতিটি ঋষভের পাশে দাঁড়াল। পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে তার সারাদিনের একাকিত্বের ক্লান্তি এক নিমেষে ভেসে গেল। যুবতিটি এলে এমনই হয় বারবার। ঋষভ কি করে তাকে বলবে–সে দীর্ঘদিন এটিএম-এ না এলে মনের মধ্যে এক ধরনের আকুলতা তৈরি হয়। অথচ সে যুবতিটির প্রায় কিছুই জানে না। এমনকী নামও নয়। জানতে ইচ্ছা হলেও উপায় নেই। কোনও কাস্টমারের ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করার হক তার নেই। কাস্টমারদের় এটিএম থেকে টাকা তোলার তারা শুধু নীরব দর্শক। কাস্টমারের টাকা তোলার সময় পারতপক্ষে স্ক্রিনে চোখ রাখে না তারা।

আট বাই দশ-বারো সাইজের ঘরে এটিএম বক্স-এর পিছনে এক টুকরো ড্রেসিংরুম আর একটি মাত্র বসার টুল নিয়ে অফিস পরিধিতে সে একমাত্র কর্মী। কথা বলার সঙ্গী বলতে কেউ নেই। এখানে উপরওয়ালার রক্তচক্ষু নেই। তারা নিধিরাম সর্দারের মতো ঢালতরোয়ালহীন। শুধু অর্থদাতা যন্ত্র আগলে পড়ে থাকা। নিজেই নিজের বস আর আর্দালি। এই বসকে কেউ পাত্তা দেয় না। তাকে গুরুত্ব দিয়ে কী-ই বা লাভ? এটিএম-এর ছোট্ট রুমটায় ঢুকে বড়োজোর কাস্টমাররা আড়চোখে তার দিকে তাকায়। তবে হ্যাঁ, অর্থদাতা যন্ত্রের যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দিলে দু’-চার জন কথা বলে। ব্যাংকের অপদার্থতার অভিযোগ তার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। হয়তো বা কেউ বলে– ফালতু সব লোকজন। সত্যিই তো, কে দেবে তার মতো একজন তুচ্ছ ব্যক্তিকে পাত্তা। অথচ যুবতি যেন একটু আলাদা–ঋষভের সাথে এক আধটা কথা বলে।

এটিএম-এ সাধারণত রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আসে। তখন প্রায় দিনই অন্য কাস্টমার থাকে না। প্রথম প্রথম একটু আধটু হাসত। নিউ টাউনের এমন জনমানবশূন্য জায়গায় অন্তত একটি লোকের দেখা মিলছে ভেবে হয়তো হাসত। এখন কখনও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে আর নরম চোখে মৃদু হাসে। সেই হাসি ঋষভের শরীর মন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগা অনুভূতি। যুবতি চলে যাওয়ার পরও এটিএম ঘর মেখে থাকে পারফিউম আর মেয়েলি গন্ধে। ঋষভ কাস্টমার না থাকলে ঘরটার মধ্যে ঘুরে ঘুরে যুবতির রেখে যাওয়া গন্ধ শোঁকে। কখনও এটিএম-এর কি-বোর্ডে নাক ঘষে। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে যায় নির্জনতার গহ্বরে। ফিরে পায় নিজেকে। রাত বাড়ার সাথে আরও গুটিয়ে যায় নিজের গণ্ডির খোলসে।

– ঋষভ।

– অ অ, টাকা তোলা হয়ে গেছে ম্যাডাম?

– তুমি কোন ভাবের ঘোরে ঘুরে এলে? টাকা তুলেছি কিনা দেখতে পাওনি?

ঋষভের সম্বিত ফিরল। সে মাথা নীচু করে থাকল। বুঝতে পারল যুবতি তার সামনেই আসা অবধি দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবনার ঘোরে ডুবেছিল এতক্ষণ। মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক হাসি হেসে বলল,

– টাকা তুলবেন না ম্যাডাম?

– না। তুমি আমাকে সারাক্ষণ ম্যাডাম, ম্যাডাম করো কেন? আমি তোমার বসও নই দণ্ডমুণ্ডের কর্তাও নই।

– তা নন কিন্তু আমরা সব কাস্টমারকে স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করি। আজকাল তো অনেক সবজিওয়ালাও খরিদ্দারকে স্যার বলে। সুবিধাও কম নয়, সব ভাষাভাষি লোকেদের একটি শব্দ দিয়েই জুড়ে দেওয়া যায়। খরিদ্দাররাও খুশি হয়।

– ঋষভ, তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলো তো। একটা কথা বলবে?

– বলুন ম্যাডাম।

– আমি এই এটিএমটায় প্রায় দু’আড়াই বছর ধরে নিয়মিত আসি। তোমার সাথে আমার সম্পর্কও বেশ ভালো অথচ তুমি আমার নাম পর্যন্ত জানতে চাওনি কখনও। কেন?

– পেশাগত কারণে আমরা কোনও খরিদ্দারের প্রতি অহেতুক উৎসাহ দেখাই না। যদি না সন্দেহজনক কিছু থাকে।

– আমার নাম জানতে তোমার ইচ্ছা হয় না ঋষভ?

সে মাথা নীচু করে। কী বলবে? শুধু নামই বা কেন আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়। অথচ সে তো জানে বাতুলতার পরিণতি কী ভয়ংকর হতে পারে। অভাবী সংসারে ঠেকা দেওয়া সামান্য চাকরিটার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর কথা ভেবে সে কখনও অতটা মরিয়া হতে পারবে না। ঋষভ তার সীমার গণ্ডি ভালো করে জানে।

মৃদুস্বরে যুবতি বলল– আমি মেয়েমানুষ। আমরা পুরুষদের না বলা কথা বুঝতে পারি। চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঋষভ, আমাকে তোমার ভালোলাগে?

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের অভিঘাতে ঋষভ চমকে উঠল। অন্ধ আবেগে অনেক কথা বলতে চেয়েছে সে কিন্তু বলা হয়নি কখনও। নিয়ন জ্যোৎস্না মাখা যুবতির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল– আপনি এলে দু’টো কথা বলে প্রাণ বাঁচে। মনে হয় কেউ অন্তত আমাদের মানুষ ভাবে।

যুবতি মেয়েটি ঠোঁটে কমনীয় হাসি ঝুলিয়ে বলল আজ আমি টাকা তুলতে আসিনি। তোমাকে নিতে এসেছি। চলো আমার সঙ্গে।

– আমি! ডিউটি ছেড়ে কোথায় যাব? কেন যাব? আপনি কি জানেন আমাদের চাকরি কত ঠুনকো?

– হ্যাঁ, তুমি আমার সঙ্গে যাবে। কলকাতার কত এটিএম-ই তো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া অরক্ষিত থাকে। তুমি এক রাতের জন্য শুধু আমার সঙ্গে হারিয়ে যাবে। তোমার ক্লান্তি থেকে মুক্তি।

– কিন্তু কেন যাব?

– সব কথা এখানে বলা হয়ে গেলে রাতভর কী বলব তোমার সাথে। তোমার চাকরির কোনও সমস্যা হলে আমি দেখব। আর কথা নয়। ঋষভ, গাড়িতে ওঠো।

ঋষভের মনে হল সামনে দাঁড়িয়ে নারী মরীচিকা। তবু নারীর ডাকে তার জাটিঙ্গা পাখি হতে ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো পুড়ে, পালক নিকষ কালো হয়ে যাবে। কিন্তু সে মনের থেকে কিছুতেই মায়াটান কাটাতে পারছে না। ঐন্দ্রজালিক জাদুকাঠিতে সম্মোহিত মানুষের মতো অচেনা যুবতির পিছু পিছু ঋষভ গাড়িতে উঠল।

জ্যোতি বসু নগরী দিয়ে গাড়ি ছুটছে এয়ারপোর্টের দিকে। তীব্রবেগে পিছনে ছুটে যাচ্ছে এক একটি বাতিস্তম্ভ। যুবতির হাতে স্টিয়ারিং, গাড়িটি যেন পক্ষীরাজ ঘোড়া। তার মুখে ঝুলে মৃদু হাসি। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। সত্যিই আজ একই দিনে অনেকগুলো পালক জুটেছে তার ঝুঁটিতে। গাড়ি এসে দাঁড়াল নীল আলো মাখা অনিমিখ-এর এইচআইজি কমপ্লেক্স-এ।

ড্রয়িংরুমে একা বসে আছে ঋষভ। খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে একটি সোফার মধ্যে প্রায় ডুবে আছে সে। এমন আধুনিক সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে আগে কখনও আসেনি। দামি আসবাবপত্রে পরিকল্পিত সাজানো ঘরদোর, ফ্ল্যাটের এমন রুম ঋষভ দেখেছে টিভি-তে, সিনেমায়। গোটা ঘরটায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। কিন্তু ঘরটা প্রাণহীন অচঞ্চল। বাড়িতে বোধহয় মালকিন বাদে আর কেউ থাকে না। তালা খুলে তারা দু’জনে রুমে ঢুকেছে। ঋষভকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে মেয়েটি চলে গেল অন্দরমহলে। অন্দরমহল মনে আসতেই ঋষভের মনে হল তার ভাবনার মধ্যে একটা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ছায়া আছে। ফ্ল্যাট তেমনটি কেমন করে হবে? ফ্ল্যাট মানেই তো কয়েকটি ঘরের সমষ্টি। বেশি হলে ডাইনিং, ড্রয়িংরুম। অবশ্য ছোটো বড়ো সব ফ্ল্যাটেই ডাইনিং, কিচেন, বাথরুম থাকে। এ বাড়ির ভিতর সে আন্দাজ করতে পারছে না। যুবতি হয়তো সারাদিনের ক্লান্তির আভরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তার পোশাকটা কী হবে? ভাবতেই ঋষভের গা ঘিনঘিন করে উঠল। নিজের শরীরে এখনও সারাদিনের ডিউটি করা ইউনিফর্ম। ইউনিফর্মে সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাচ। মানুষটার পরিচয় আটকে আছে শুধুমাত্র এজেন্সির লোগোতে। ঘরের ম-ম করা সুবাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজের জামা প্যান্টের বাসি দুর্গন্ধ। তার অস্তিত্ব কী? তার অস্বস্তি ক্রমিক হারে বেড়ে যাচ্ছিল ঘরময় আভিজাত্যের নিস্তব্ধতায়। তার অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের সংকটে।

ডোরবেল বেজে উঠল। ঋষভ ভাবছিল খুলবে কি খুলবে না। তখনই ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে এল যুবতি। সাদা রঙের হাফ প্যান্ট আর উপরে টপ্ পরেছে। আধুনিকা মেয়েটির আয়নায় নিজেকে দেখে ঋষভ আরো গুটিয়ে গেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,

– কে?

বাইরের থেকে উত্তর এল – হোম ডেলিভারি ম্যাডাম।

দরজা খুলে সে বলল, – ডাইনিং টেবিলে রেখে যাও।

সাদা রঙের হোটেল ইউনিফর্ম পরা একটি লোক পলি-প্যাকেটে খাবার হাতে ঋষভের সামনে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেল। লোকটা তার দিকে কোনও আগ্রহ দেখাল না। তার দিকে একবার তাকিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল। মনে হল অভ্যস্ত চোখ। ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে মালকিন লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,

– ক্যাসা লাপোসতোলে পেয়েছ?

– হ্যাঁ, ম্যাডাম। ম্যানেজার অনেক ফোনাফোনি করে জোগাড় করেছে। ওয়াইনটা জোগাড় করা খুব কঠিন। খাবার সার্ভ করে দেব ম্যাডাম?

– না, থাক। তুমি এখন এসো।

– গুড নাইট ম্যাডাম। পেমেন্ট নিয়ে ডেলিভারি বয় চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর গৃহকর্ত্রী একটা বারমুডা আর টি-শার্ট এনে বলল– ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

পুরুষহীন বাড়িতে পুরুষদের পোশাক দেখে ঋষভ একটু অবাকই হল।

– কিন্তু আমাকে কেন ডেকে এনেছেন? সে আবার জানতে চাইল।

– ঋষভ, সব কথা হবে। আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। দেরি হলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। মাইক্রোওভেন অন করো, খাবার গরম করো, ওসব পারব না। এই উঠে পড়ো তো শিগ্গির।

ডাইনিং টেবিলে তারা দু’জন মুখোমুখি বসেছে। যুবতিটি কাচের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে ঋষভকে বলল – গোমড়া মুখে থেকো না। তুমি এখনও আমার নাম জানতে চাইলে না।

– হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনার নাম জানা হয়নি।

– আমি হিমিকা। হিমি বলে ডাকতে পারো। আমি খুশিই হব। আজ রাতে তুমি আমার অতিথি।

– কিন্তু আমাকে ডিউটি থেকে তুলে আনার উদ্দেশ্যটা কী?

হিমিকা ঋষভের নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঋষভের নীল চোখের মায়াজাল তাকে পাগল করে দেয়। অথচ কোনও দিন সামাজিক অবস্থানের খাতিরেই প্রকাশ করতে পারেনি। ঋষভকে দেখলে তার মনে হয় ইউরোপীয় রক্ত বইছে তার ধমনিতে। টিকোলো নাক আর রেশমি চুলে ঋষভ গড়পড়তা ভারতীয়দের থেকে কোথায় যেন আলাদা। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঋষভের বুঝতে অসুবিধা হল না রাত কুহেলিকা হিমিকা কি ভাবছে। তাকে ঘিরে এমন ভাবনা অনেকেরই হয়। তারা ঋষভের মধ্যে আভিজাত্যের যোগসূত্র খুঁজতে চায়। এখানেই সবাই ভুল করে বসে। সেই অর্থে শিক্ষাদীক্ষা বা ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকার তার নেই বা বিখ্যাত পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া কোনও সংরক্ষিত উত্তরণপথ। হিমিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৌতূহল আর চাপতে পারল না – ঋষভ, তুমি কোথায় পেলে এমন ব্লু আই?

– জানি না ম্যাডাম।

– আবার ম্যাডাম বললে! আমি বলছিলাম, তোমার বাবা-মা কার চোখ এমন নীল?

– আমার বাবা-মা’র চোখ আপনার মতো গভীর কালো। তবে লোকে মশকরা করে বলে আমার শরীরে নাকি ইউরোপীয় রক্ত বইছে।

– তাই নাকি? হিমিকা নিজের কল্পনার সমর্থন পায়।

– আমি একটি মফসসল শহরের ছেলে। কোনও কোনও শিশু এখনও চোখ কটা-নীল, ফর্সা চামড়া নিয়ে জন্মায় ওখানে। কোনও এক সময়ে ফরাসি বেনিয়া রক্ত মিশে গিয়েছিল কয়েক পুরুষ আগের মহিলাদের জঠরে। এখনও তলে তলে ধারা বইছে। সুযোগ পেলেই জিন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে বেনিয়াদের লালসার ফল। রং যাই হোক না কেন এ তো একধরনের উপজাতপ্রাপ্তি।

– নিজেকে ওভাবে ভাবছ কেন? চেহারা তো মানুষের সম্পদই। শুধু জানতে হয় সম্পদের সদ্ব্যবহার। নারীমন বোঝ ঋষভ? বলতে বলতে বাঁহাতে ঋষভের হাত চেপে ধরল হিমিকা। অন্য হাতে গ্লাস ভরিয়ে দিল নীল মদিরায় – কাছে এসো ঋষভ। আজ রাতে তোমার আগুনে আমাকে গলিয়ে দাও লাভার মতো। স্রেফ্ তোমাতে ভাসার জন্য তোমাকে এমনভাবে নিয়ে এসেছি। আমি আর পারছি না ঋষভ। হিমিকা উঠে গিয়ে ঋষভকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। মদিরার নীল নেশায় ঋষভ ক্রমশ ডুবে গেল তার নারীক্ষুধার কাছে। যাবতীয় পৌরুষত্বের সংযম ভেসে গেল বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসে।

গড়ে ওঠা জ্যোতি বসু নগরে অর্ধেক আকাশ জুড়ে অর্ধেক চাঁদ। পড়ে থাকা ফাঁকা জমি রাতের আঁধারে বিষন্নতায় ঢাকা। দাঁত মুখ খিঁচোনো নির্মীয়মান বাড়িঘর রাতের কোটরে কেমন নির্জীব। রাত দ্বিপ্রহরে বিমানবন্দরগামী বাবুদের গাড়ি উল্কাপাতের মতো ছুটে যাচ্ছে। ঋষভের অনুরোধে জানালা খুলেছে হিমিকা। হিমিকার ঘর রৌদ্র ছোঁয় না বা বলা যেতে পারে এসি ঘরে সে জানালা খোলার তাগিদ অনুভব করে না। খোলা জানালা দিয়ে রাতের নরম হাওয়া তেরো তলার ঘরে ঢুকছে। জানালার পাশে বসে আছে দুই আদিম নরনারী। দিদির বয়সি হিমিকাকে আরও বুকের কাছে টেনে এনে ঋষভ বলল – শুধু এ জন্যই আমাকে ডেকে এনেছ?

– আজ আমার প্রাপ্তির দিন, ভোগের দিন।

– ভোগের দিন না হয় বুঝলাম কিন্তু ভোগেই কি প্রাপ্তি ঘটে?

– না, আনন্দ উপভোগের এটা একটা দিক। প্রাপ্তি অন্য জায়গায়। আমি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে প্রোমোশনের চিঠি আজই হাতে পেয়েছি।

– সত্যিই আনন্দের দিন তোমার হিমি।

হিমিকা বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন উদাসীন হয়ে গেল। নিশ্চুপে কেটে গেল অনন্ত প্রহর। তাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ঋষভ ডাকল, – হিমি।

– ও হ্যাঁ, বিনিময়ে আমাকে দিতে হয়েছে কত জানো?

– না, আমি কী করে জানব? আমার জানার পরিধি শুধু আট ফুট বাই বারো ফুট ঘর।

– আমি কাজ করি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢোকার দিন থেকেই কোম্পানি টার্গেট বেঁধে দেয়। টার্গেটে পৌঁছোও তো টিকে থাকো। না পৌঁছোও তো পিছনে ঘন্টাধবনি– কেটে পড়ো। কেটে পড়ো। লক্ষ্যে পৌঁছোলেও নিস্তার নেই। টার্গেটের পরিধি আরও বেড়ে যাবে। সামনে খুঁড়োর কলের মতো অনেক রঙিন স্বপ্ন। গাড়ি, বাড়ি, পয়সা ওড়ানো ক্লাবের মেম্বারশিপ, বিদেশ ভ্রমণ এমন অনেক রঙিন ফানুস। সামনে ঝোলানো একটি মাত্র টোপ প্রোমোশন। আখের ছিবড়ার মতো রক্তশূন্য অবস্থায় জিভ বের করে কেউ সত্যি সত্যিই হয়তো পৌঁছাবে চূড়ায়। আবার এমনও হতে পারে যার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে সে হয়তো ঘোড়সওয়ারদের মধ্যেই নেই। সেখানে অন্য সমীকরণ, অন্য কেউ। বুঝলে ঋষভ, এই ডার্ক হর্সকে কেউ চেনে না। কিন্তু সে-ই জয়ী হবে। আমি জোকা থেকে ম্যানেজমেন্টে পিজি করে এখানে ঢুকেছি। তখন আমার কত আর বয়স হবে? পঁচিশের নীচে। এখন? না থাক, মেয়েদের বয়স গুপ্ত থাকাই ভালো। আমাকে দেখে তোমার যত বয়স মনে হয় ধরে নাও সেটাই আমার বয়স। চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিয়ে করার সময় বের করতে পারিনি। এ তো এক ধরনের নেশা। প্রথম প্রথম সম্পদের মোহ টানে। তারপর বলতে পারো ক্ষমতা, পজিশনের মোহে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সমাজ টমাজ কাউকে চিনতে চায় না। ছোটে, দমবন্ধ করে নিজেকে বাজি রেখে ছোটে। আমিও ছুটেছিলাম। বেশ কয়েক বছর ধরেই আড়াই হাতের মধ্যে ফসকেই যাচ্ছিলাম। অথচ আমার পারফর্মেন্স, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার মধ্যে কোনও ঘাটতি ছিল না। বেশ কয়েক জন অযোগ্য লোকও আমাকে সুপারসিড করে গেল। আমার দুর্বলতা নিয়ে অনেক ভেবেছি আর হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। মানসিক অবসাদে রাত আমাকে সর্ব অর্থে গ্রাস করে নিত। একাকিত্ব, অবসাদ সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে প্রতি রাতে আমি তুলে আনতাম পেশাদার জিগোলোদের।

ঋষভ আবছা আলোয় হিমিকার মুখের দিকে তাকাল। অনেক ইংরাজি শব্দই তার বোধগম্য নয়। জিগোলো শব্দটা তার কানে ঠকাস করে লাগল। মুখে কিছু বলল না।

হিমিকা আবার বলতে শুরু করল – পরে আমি বুঝেছি রোগটা মনের, শরীরের নয়। রাতের অতিথিরা কী করবে? একদিন মরিয়া হয়ে দেখা করলাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর সাথে। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,

– স্যার, হোয়াট ইজ মাই ডেফিসিয়েন্সি টু গেট প্রমোশন?

সে রিভলবিং চেয়ারে মৃদু দুলে দুলে বলল– ইউ আর দ্য মোস্ট এফিশিয়েন্ট অফিসার। কিন্তু মিস্ ব্যানার্জী যোগ্যতাই কি সব উন্নতির মাপকাঠি? পৌরাণিক যুগ থেকেই চলে আসছে বিনিময় প্রথা। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়।

– আমাকে কী দিতে হবে?

– ইউ আর অ্যান ইনটেলিজেন্ট বিউটিফুল গার্ল। ইউ ক্যান হ্যাভ আ সলিটরি মিটিং টু ডিসাইড ইয়োর ফিউচার। মিস্ ব্যানার্জী, একটা সিদ্ধান্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে।

এমডি একটা বুড়ো ভাম। ওর লালসার চোখ দেখে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল শরীরের সতীত্ব কি আমার আছে? আমি তো পয়সার বিনিময়েই কামনা হতাশা ঝলসাই প্রতি রাতে। আর একদিন বুড়োর সাথে নির্জন অবসর কাটালেই যদি খুলে যায় উন্নতির সিঁড়ি, দোষের কি? ঋষভ, সাফল্য অবশেষে এসেছে। আজ রাতে তুমি আনকোরা আলট্রা ফ্রেশ উত্তাপে আমাকে পাগল করে দিয়েছ। ইউ আর ট্রুলি…।

ঋষভ হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হিমিকাকে তার অত্যাশ্চর্য মনে হয়।

সকাল সাড়ে আটটা। ঋষভ চালক আসনের পাশে বসতে গেল। হিমিকা তাকে বলল

– পিছনের সিটে বসো। হিমিকা গাড়ি চালাচ্ছে। আর একটাও কথা বলল না ঋষভের সাথে। ঋষভ সিকিউরিটি গার্ডের ইউনিফর্মের মধ্যে আরও গুটিয়ে যেতে লাগল। হু হু করে ছুটছে গাড়ি। গাড়িটা এসে থামল এটিএম-এর সামনে। ঋষভ নেমে চালক আসনের কাছে এসে বলল – আর কি দেখা হবে?

হিমিকা তার সামনে এগিয়ে দিল একটা প্যাকেট

– এটা ধরো।

– কী আছে এতে?

– তোমার রাতের চার্জ।

– সে কি হিমি, তুমি আমাকে টাকা দিচ্ছ!

– আমি বিনা পয়সায় কাজ করাই না। খুশি হয়ে অন্যদের থেকে একটু বেশিই দিয়েছি।

– ম্যাডাম, আমি…।

ঋষভ কথা শেষ করতে পারল না। গাড়ির চাকা গড়াল। তার চোখের সামনে গাড়িটা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের মুঠোয় টাকার প্যাকেট নিয়ে কাঁদবে না ছুড়ে ফেলবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ঋষভ। তার হাত-পা কেমন অসাড় মনে হল।

এটিএম-এ ঢুকতে বাধা পেল সে – সারা রাত কোথায় ছিলে? যমদূতের মতো সামনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি সুপারভাইজার। জাঁদরেল গোঁফের নীচে কঠিন কঠোর চেহারা। সে প্রাক্তন সেনাকর্মী। চাকরি থাকার সময় যা না গোঁফের বহর ছিল এখন বুড়ো বয়সে আরো পোক্ত হয়েছে। বুড়োকে আড়াল আবডালে সিকিউরিটি গার্ডরা বলে ঢ্যাঁড়স। সেই সিকিউরিটি সুপারভাইজার যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা হাতেনাতে টের পাচ্ছে ঋষভ।

সুপারভাইজার গোঁফে পাক দিতে দিতে বলল,

– রাত বারোটায় আমি রাউন্ড আপে এসেছিলাম কিন্তু এটিএম খোলা হাট। তোমার দেখা নেই। বুঝেশুনে বড়ো নৌকায় পাল তুলেছ ভাই। তবে উড়ে উড়ে মধু খাবে আর সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করবে, দু’টো একসাথে তো হবে না। এই ধরো তোমার টার্মিনেশন লেটার। আর ডুবে ডুবে জল খেতে হবে না।

ঋষভের চাকরিটা ঠুনকো চুড়ির মতো চলে গেল।

।।২।।

– ঋষভ, কেমন আছ?

সে প্রথমে হতচকিত হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল – ম্যাডাম, আপনি এখানে? টাকা তুলতে এসেছেন?

– না, টাকাপয়সা নয়। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে দু’বছর কেটে গেছে। কাল হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তুমি এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছো। তখনই আসতাম কিন্তু কোন মু্খে তোমার সামনে দাঁড়াই? কালকে সাহস পাইনি। রাতভোর নিজের সীমাহীন অপরাধের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে মনের কাছে। হতাশা বা উন্নতির সর্পিলরেখার দোহাই দিয়েও আমার কর্মের কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। তবু মরিয়া হয়েই তোমার কাছে এসেছি। তোমার গভীর নীল চোখের সরলতার কাছে আমি আগেই হেরেছি ঋষভ।

– ম্যাডাম, এখন আমি ডিউটিতে আছি। কাল ডে-শিফটে ডিউটি। চাইলে সন্ধ্যায় আমি আপনার ফ্ল্যাটেও যেতে পারি। দেয়ার উই ক্যান নেগোশিয়েট দ্য ডিল।

বিস্মিত চোখে ঋষভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল হিমিকা খানিকক্ষণ। তারপর বলল– আমার ফ্ল্যাটটা একটা শয়তানের গুহা। আমি চাই না ওখানে আর আমাদের এভাবে দেখা হোক। ফোন নম্বর বলো, কথা বলে মিটিং প্লেস ঠিক করব।

প্রিন্সেপঘাটে আগেই এসে বসে আছে হিমিকা। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো খানিকটা কেটে কেটে পড়ছে জেমস প্রিন্সেপ-এর স্মৃতিসৌধের উপর। খোদ কলকাতায় বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু আর ঐতিহাসিক স্থাপত্যে সূর্যের আলোর আচ্ছন্নতা ভেঙে দিল ঋষভ – হাই ম্যাডাম, হাউ লং? ঋষভ এসেছে। কালো গেঞ্জি-জিন্স আর পায়ে নর্থস্টার শু-তে তাকে শার্প-স্মার্ট লাগছে।

হিমিকা বলল – অনেকক্ষণ। নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা আগেই।

– তা বলুন ম্যাডাম, কেন আমাকে খুঁজছেন।

– আমি জানি ঋষভ, তোমার প্রতি আমি অন্যায় করেছি। পেশাগত জীবনে যেখানেই পৌঁছাই না কেন, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই– আমি ক্লেদাক্ত। তবু ভিতরে ভিতরে তোমার জন্য আমি দুর্বলতা অনুভব করি। আমার মনে হয়েছে তুমিই পারো আমাকে ফিরিয়ে আনতে। আমাকে একটু আশ্রয় দেবে ঋষভ?

– ম্যাডাম, টু ইয়ার্স ব্যাক আই হ্যাভ বিন অ্যান ইনোসেন্ট ইয়ুথ। কিন্তু আপনি আমার সামনে অনেকগুলো রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। আয়ের রাস্তা আর নরকের রাস্তা। বাস্তবে আপনি ছিলেন আমার প্রথম খরিদ্দার। কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে বিনা পয়সায় আজ বিকালে আপনার সাথে সঙ্গ দিতে এলাম। যদিও আমার সঙ্গদান থেকে বেডরুম শেয়ারের আলাদা আলাদা রেট আছে। তা বলতে পারেন দু’বছর আগের থেকে রেটটা একটু হাই। আর প্রোফাইল বুঝে রেট হেরফের হয় বটে। হাজার থেকে দশ হাজার। এখন অন-লাইনে শরীর বিকিকিনি হয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়েও ঘরে বসে ডিল হয়। হাতে একটা সেলফোন – ব্যস যৌনতার জগৎ হাতের মুঠোয়। একান্ত প্রয়োজন হলে স্টাইলিশ কালো ব্যান্ড হাতে চিরাচরিত পদ্ধতিতে পথের পাশে রেলিং-এ এসে ইশারাময় শরীর খোঁজা। কেউ কেউ বোল্ড পত্রমিতালির বিজ্ঞাপন দেয়। আপনার মতো মেয়েদের কাছে বিজ্ঞাপনের বক্তব্য মানে অন্য কিছু। তাই না?

– ঋষভ! একি কথা বলছ?

– ওকে। আই নো ইউ ক্যান্ট অ্যাকসেপ্ট মি লাইক দিস। আপনি সেই সরল নীল চোখের ঋষভকে খুঁজছেন। সে তো আর নেই। আপনি কি কখনও জানতে চেয়েছেন আমি কেমন আছি?

হিমিকা মাথা নীচু করে রইল। এমন প্রশ্নের সামনে তাকে পড়তে হবে তার কল্পনায় ছিল না। সে বলল – আমার নেশা কাটতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। তারপর যখন ফিরে এলাম তখন তোমার বদলি হয়ে গেছে। পাগলের মতো রাস্তার অলিগলিতে কোথায় খুঁজিনি তোমায়?

– আপনি ভুল শুনেছেন। আমার বদলি হয়নি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য সিকিউরিটি গার্ডের সামান্য চাকরিটা চলে যায়। মাস গেলে ন্যূনতম মজুরি আর ওভারটাইম মিলিয়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা আসত। এক রাতের ফুর্তির ধাক্বায় তা বন্ধ হয়ে গেল। একটা অভাবের সংসারে হঠাৎ চার-পাঁচ হাজার টাকার রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে তার অভিঘাত কত ভয়ংকর হতে পারে ভাবতে পারেন ম্যাডাম?

হিমিকা কোনও উত্তর খুঁজে পেল না।

– আমি জানি আপনি কোনও দিন এতটা মাপা জীবন দেখেননি। আমার সেই অর্থে কোনও যোগ্যতা বা বিদ্যা নেই যা দিয়ে তৎক্ষণাৎ কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারতাম। ভালো থাকার ইচ্ছা আছে সব মানুষের কিন্তু ভালো থাকার রসদ উপার্জনের মুরোদ নেই অধিকাংশ মানুষের। অনেকে তাই চাহিদাপূরণের সহজ পথ বেছে নেয়। অপরাধের উৎসভূমি বিস্তৃত হয়। আমারও হয়েছিল। তখন আপানার কথা মনে পড়ে গেল। আমার নীল চোখে নাকি নারীহূদয় বশ করার জাদু আছে। চেহারার সদ্ব্যবহার জানলে নাকি আয়ের রাস্তা খুলে যায়। আপনার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম জিগোলো শব্দটা। তখন মানে জানতাম না। কিন্তু রাতের শয্যাসঙ্গী হওয়ার বিনিময়ে আপনি আমাকে টাকা দিয়েছিলেন। তাই একটা ভাবার্থ মনে হয়েছিল। অভিধানে জিগোলোর মানে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের অর্থপুষ্ট তরুণ প্রণয়ী। আমার শরীর আছে – যৌবন আছে, তা হলে ক্ষুধার কাছে মার

খাওয়া কেন?

– ঋষভ!

– জানেন, প্রথমে জানতাম না কারা জিগোলো। কোথায় থাকে তারা। কোন মেয়ে পয়সার বিনিময়ে যৌন সঙ্গী খুঁজছে। শুধু একটা সিনেমা থেকে জেনেছি পার্ক স্ট্রিট জিগোলোদের স্বর্গরাজ্য। তারা হাতে কালো রুমাল বাঁধে। একদিন সত্যি সত্যিই কালো রুমাল বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লাম পার্ক স্ট্রিটে। কিছু সময় যেতে না যেতে কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল – এখানে কী চাই?

আমি ঘাবড়ে গেলাম– না মানে…

হো হো করে হেসে উঠল তারা – মুরগি, …কক্-কক্। ব্লাডি হোর, উড বি মেল এসকর্ট। পার্ক স্ট্রিট শুধুমাত্র ক্যালকাটা জিগোলো ক্লাব সদস্যদের জন্য। হেই রাসটিক গাই, এখানে ফের এলে বটল শুদ্ধু নিপল ধরিয়ে দেব। তারা আমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্বা দিয়ে পার্ক স্ট্রিট থেকে তাড়িয়ে দিল। চকচকে লালটুস চেহারার যুবকের দল। বেশভূষায় হিপি হিপি ভাব। অনর্গল ইংরাজিতে কথা বলে। ফিরে এলাম সেদিন। কিন্তু পেটে খিদে থাকলে পশুরা বিপদ অগ্রাহ্য করেও ফিরে আসে, আমাকেও ফিরতে হয়েছিল। পরদিন থেকে দাঁড়াতে শুরু করলাম পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে। কখনও ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে, কখনও লিনডসে স্ট্রিটে। ক’দিন যেতে না যেতে আমার মতো ছুটকো পাবলিকদের চিনতে শুরু করলাম। শহরের রাস্তা সবার অথচ ভিতরে ভিতরে করে খাওয়ার এলাকা ভাগ থাকে। প্রথম প্রথম এরাও আমাকে এক চুল জায়গা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন ম্যাডাম?

– কী? হিমিকা শুকনো গলায় জানতে চাইল।

– কে বা কারা খরিদ্দার তাই চিনি না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের মহিলাদের মনে হতো প্লেবয় খুঁজছে। আবার তাদের বেশভূষা চাল-চলনে ভড়কে যেতাম। আমার মফসসল শহরের গাঁইয়া চেহারা প্রকট হয়ে উঠত। একজন বয়স্ক জিগোলোর সাথে পরিচয় হল। সে বলল – তুমি ভাই সারা জীবন বঁড়শিতে একটাও গাঁথতে পারবে না। এ তো মাছ নয় যে ফাতনা ডুবিয়ে তোমায় টেনে নেবে। এদের পেটে খিদে নেই। চোখে খিদে। শরীর অভুক্ত। তোমাকে চোখের অভুক্ত  চাহনি পড়তে হবে। চালচলনে চেকনাই চাই। অর্ধেক কথা হবে চোখে চোখে।

– তুমি দুষ্টু লোকটার কথা শুনে পালটে গেলে ঋষভ?

হায় ভগবান!

– আমার তো কোনও ভার্জিনিটির অহংকার ছিল না। তা আপনার কাছে আগেই খুইয়েছি। আমার দরকার ছিল একজন অভিজ্ঞ লোকের টিপস। লোকটার পরামর্শে ইংরেজি শিখতে লাগলাম। আর সামর্থ্যের মধ্যে সাজগোজ পালটে ফেললাম। মানুষের পোশাক এক ধাক্বায় বদলে দেয় অনেকটা। একটু ব্যক্তিত্ব যোগ করতে পারলেই কেল্লাফতে। ওর পেশাগত নাম পিটার। পিটার আমাকে ইন্দ্র, ইন্দ্রজিৎ বলে ডাকত। বলত – পুরুষরা সব সময় ইন্দ্রর মতো। যা পেতে ইচ্ছা হয় তা যেনতেনপ্রকারেণ আদায় করে নেবে। নারীকে জয় করায় কোনও পাপ নেই। পুরুষ বহুগামী। যথা সময়ে ঋষি হয়ে গেলেই হল। পৌরাণিক যুগ থেকে পুরুষরা এরকমই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক সাধু। প্রথম প্রথম পিটার আমাকে দু’চারটে খরিদ্দার ধরে দিত। তবে কমিশনের ব্যাপারে পিটারের কোনও আপস নেই। অন্যের গতর খাটানো পয়সা কে না খায়। হোটেল ম্যানেজারগুলো এক একটা তিলে খচ্চর। ফরেনারদের সাথে মোটা টাকার ডিল হয়। আমরা পাই সামান্যই। ম্যানেজার হারামিগুলো মেরে দেয় সিংহভাগ।

– ঋষভ, আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না।

– ফিরে যখন এসেছেন তখন কষ্ট করে না হয় একটু শুনলেন ম্যাডাম। এখন আমি সমাজের উচ্চবিত্ত মহিলাদের সাথে কাজ চলার মতো কমিউনিকেটিভ ইংলিশ শিখেছি। আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের স্টুডেন্ট, ওয়ার্কিং লেডি, হাউস ওয়াইফ, উইডো, ডিসস্যাটিসফায়েড লেডি– সবাই আমাদের খরিদ্দার। আইটি সেক্টরের অনেক ওয়ার্কিং লেডি আজকাল আর লিভ টুগেদারের ঝামেলাও চায় না। তারা সব ফ্যান্টাস গাইদের হায়ার অ্যান্ড ফায়ার করতে অভ্যস্ত। টাকায় রেডিমেড আনন্দ পেলে কে পোহায় হ্যাপা-বিয়ে-শাদি-লিভ টুগেদার-এর? সবাই মেতে থাকতে চায় সেল্ফ-অ্যাপোতে। নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা। সংসার নামক সনাতনী জোয়ালটি কে বইতে চায়? পিটার আমাকে পিএসএল পদ্ধতি-র মতো আধুনিক এবং পৌরাণিক কামসূত্র শিখিয়েছে। নাও আই নো দ্যা আর্ট অফ স্যাটিসফায়িং ওমেন।

– চুপ করো, চুপ করো। আমি আর শুনতে চাই না।

– আমি আবার একটা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নিয়েছি। এজেন্সি আমার অনুরোধে পার্ক স্ট্রিটের এটিএম-এ পোস্টিং দিয়েছে। বলতে পারেন এই পোস্টিংটা আমার সোনায় সোহাগা হয়েছে। প্রতিদিন ইভিনিং ডিউটি করি আর এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি উপোসি চোখের খোঁজে। চাকরিটা এখন আমার গৌণ আয়ের জায়গা, তবু ইউনিফর্মে ঢেকে রাখি নষ্ট আমিটাকে। আর কিছু খরিদ্দার ছাড়া ইন্দ্রজিৎকে কে চেনে বলুন? ম্যাডাম, আমি এখন শুধু মেয়েদের কামনাময় চোখ খুঁজি। আপনার চোখ এখন স্বাভাবিক। অসুস্থ অস্থিরতা নেই। চোখের অস্থিরতার কাছে আমরা জিগোলোরা বিকিয়ে যাই। কেউ আনন্দ করতে গিয়ে বিকিয়ে যায় – কেউ বা পেটের টানে। আমি জানি না পুরুষ যৌনকর্মী বলে অভিধানে কোনও শব্দ আছে কিনা, বা বেশ্যার পুংলিঙ্গ কী হবে? কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি বাস্তবে একজন জিগোলো। প্রয়োজন হলে ডাকবেন, আপনার ক্ষেত্রে অল্প টাকায় কাজ করে আসব। আপনি ফিরে যান ম্যাডাম।

হিমিকা হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার নিজেকে মনে হচ্ছে সাপ-লুডোর নিরানব্বই-এ সাপে খাওয়া ঘুঁটি। যাবতীয় বিষন্নতা শরীরে ভর করেছে। তবু মরিয়া হয়ে সে ঋষভের হাত জড়িয়ে বলল – বুকের পাথরটা একটু নেমেছে ঋষভ?

– বিষের ব্যথা কখনও নামে?

– তোমার সব দুঃখ যন্ত্রণার ভার আমাকে বইতে দেবে…

– তা হয় না ম্যাডাম। আপনি ফিরে যান। আমাদের আর কোনওদিন না দেখা হওয়াই মঙ্গল। জিগোলোদের কখনও প্রেমে পড়তে নেই। জিগোলো একট ব্যাধি।

হিমিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগাল। তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ঋষভের বুকের মধ্যে হঠাৎ কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। মনে হল একটা আলোর বিন্দু এসেছিল। এখন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার তীব্র ইচ্ছে হল হিমিকার হাত ধরে নতুন করে বাঁচতে। দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকতে – হিমি, যেও না। চলো আমরা গঙ্গার পাড় দিয়ে হাঁটি। শুনেছি গঙ্গা সব গ্লানি ধুয়ে দেয়।

 

জলার হাওয়া

পুলিশ দুই প্রকার, ভালো পুলিশ আর খারাপ পুলিশ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সাধারণ মানুষ কখনওই পুলিশকে সুনজরে দেখে না। পুলিশ মানেই যেন খারাপ চরিত্রের। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার আগেই শুভ্রজ্যোতি জানতেন এটা। যুবক বয়সে নিজেও থানাপুলিশ এড়িয়ে চলেছেন। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সময় বাছাবাছিতে যাননি। কারণ, তখনই চাকরির বাজার বেশ খারাপ। এমনই কপাল, শিকে ছিঁড়ল পুলিশের চাকরিতেই। গুরুজন এবং চেনাজানারা সকলেই বলল, যতই হোক সরকারি চাকরি। এইবেলা ঢুকে পড়।পরে এই চাকরিও দুর্লভ হয়ে যাবে।

জয়েন করে গেলেন শুভ্রজ্যোতি। ট্রেনিং পিরিয়ডে, বিশেষকরে থিয়োরির ক্লাসগুলোতে মনে হতো আমি ভালো পুলিশ হয়ে উঠব। পুলিশের চাকরি যথেষ্ট মর্যাদাকর। কতিপয় খারাপ মানুষ এই চাকরিতে ঢুকে পুলিশের বদনাম তৈরি করে। প্রথম পোস্টিং হল ডক এরিয়ার থানায়। অপরাধপ্রবণ এলাকা। সেই থানাতে একটাও ভালো পুলিশ ছিল না। দু’জন সৎ পুলিশ ছিল। তারা পয়সা খেত না, কোনও কাজও করত না। একেবারে নিস্ক্রিয়। শুভ্রজ্যোতি বসে বসে মাইনে নিতে পারবেন না। অলসতা তাঁর স্বভাবে নেই। কাজ করতে গেলেন, ধরে রাখতে পারলেন না সততা। প্রলোভন এবং পরিস্থিতির চাপের কাছে হার মানলেন। অনেক পুলিশ আছে, যারা হার মানে না। শুভ্রজ্যোতির কাছে তারা প্রণম্য।

সেইসব নমস্য পুলিশদেরও বিশ্বাস করে না সাধারণ পাবলিক। বলাবলি করে, পুলিশ ঘুষ খায় না, তা আবার হয় নাকি! বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনওদিন হয়তো বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবে। পুলিশ ঘুষ খাওয়া ছাড়বে না। এরকম একটা ধারণা শুভ্রজ্যোতির প্রতি

আত্মীয়-পরিজনেরও ছিল। ঠাকুরদার দেওয়া অমন সুন্দর নাম ওই বদনামকে আড়াল করতে পারেনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে চন্দ্রিমা দু’চার কথার পরই জানতে চেয়েছিল, স্যালারি কত পাও সে তো বাবার থেকে শুনেছি, উপরি কীরকম হয়?

বেশি নয়। নিতে হয় বলে নিই। নয়তো চাকরি টেকাতে পারব না। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

চন্দ্রিমা বলে, বেশি নিয়ে কাজ নেই বাবা। স্বভাব নষ্ট হয়ে যাবে।

নববধূর ইমেজ রাখতেই কথাটা বলেছিল চন্দ্রিমা। পরবর্তীকালে বিলাসব্যসনের এই যে এত আয়োজন, জানতে চায়নি কোথা থেকে, কীভাবে আসছে? স্বভাব সত্যিই নষ্ট হল কিনা, কখনও খোঁজ করেনি।

চরিত্র ধীরে ধীরে অধঃপাতেই গেছে শুভ্রজ্যোতির। এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি হয়েছেন। বেড়েছে পদমর্যাদা। শুকনো থানায়, মানে যেখানে দুনম্বরি পয়সার আমদানি কম, সে সব জায়গায় পোস্টিং-এর খবর কানে এলেই দৌড়েছেন ওপর মহলে। নানান কৌশলে আটকেছেন বদলির চিঠি। তার জন্য প্রশাসনের হয়ে অন্যায় কাজ করে দিয়েছেন অনেক। যতদিন গেছে শাসকদল এবং প্রশাসনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তবে এটাও ঠিক গোটা দেশ কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির ওপর ভর করে চলে না। এখনও সততা, ন্যায়নিষ্ঠার জোর অপরিসীম। এমনই এক সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ বড়োকর্তা শুভ্রজ্যোতির ডানা ছাঁটতে দেবনগরের আইসি করে পঠিয়ে দিলেন। বহু তদ্বির করেও বদলি ঠেকাতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। দেবনগর একেবারেই বন্ধ্যা জায়গা। কলকারখানা নেই, পুরোনো হাইওয়ে যেটা আছে, মাল পাচারকারীদের কাছে সেটা পরিত্যক্ত। বড়ো মার্কেট নেই। ক্রাইম প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখানে ভাই-ভাই। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন হয় রাখি উৎসবের মেজাজে।

দেবনগরে এসে প্রথমদিকে খুবই ডিপ্রেশনে ভুগতেন শুভ্রজ্যোতি। বউ-ছেলে থাকে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। ওদের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং বাড়িয়ে ফেলেছেন শুভ্রজ্যোতি। কীভাবে খরচ জোগাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। থানার অন্যান্য সহকর্মীদের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। দেবনগরের সামাজিক আবহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে। আলস্যে দিন কাটায়। শুভ্রজ্যোতি খুঁটেখুঁটে ক্রাইম বার করে দু’চার পয়সা কামাতে লাগলেন। এই যেমন, হেলমেটহীন বাইক আরোহীকে থানায় ধরে নিয়ে আসতে বলা। অন্ধকার মাঠে মাতাল, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরপাকড় করা। যা টাকা পাওয়া যায়, তাই নিয়ে ছেড়ে দেওয়া। এরকম বিবিধভাবে তোলা তুলতে লেগেছিলেন শুভ্রজ্যোতি। নিজের ওপরে ধিক্বার এসে যাচ্ছিল। আগে যে থানাগুলোতে ঘুরে এসেছেন, বাঁয়া-ডাঁয়া দু’পা গেলেই পাঁচ-দশ হাজার আপনা থেকেই হাতে এসে যেত। কিন্তু ওই যে, কী যেন বলে না, ‘যেখানেই যাও কপাল যায় সঙ্গে সঙ্গে’, শুভ্রজ্যোতির হচ্ছে ঘুষের কপাল। দেবনগরের মতো শুখা থানাতেই বিরাট একটা দাঁও মারার চান্স এসে গেছে। যাকে বলে বিগ শট। এতটাই বিগ, কাজটা সাকসেসফুলি উতরে গেলে যে-টাকাটা পাবেন, বাকি জীবন চাকরি না করলেও আরামে চলবে। ছেলের জীবনও কেটে যাবে ওই টাকাতেই।

লটারি লাগার মতো এরকম একটা সুযোগ যে আসবে, এই দেবনগরে বসে, কল্পনাও করতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। রেলের লাইনের ওপারে নসিবপুর, দেবনগর থানার আন্ডারে। ওখানে একটা স্টিল ফ্যাক্টরি আছে। অনেকদিন ধরেই টিমটিম করে চলছে। কারখানার গায়ে প্রায় বিশ একর জুড়ে জলাভূমি। লোকে বলে হাতিডোবার বিল। বিশ একরের দশ একর কারখানার সম্পত্তি, বাকিটা খাস। বিলের মাঝে বড়ো একটা চরা আছে। সেখানে প্রায় তিরিশ ঘরের বসবাস। সকলেই উদ্বাস্তু। র্যাশন কার্ড নেই। জায়গাটার নাম মেছোডাঙা। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা একমাত্র নৌকো। কারখানা সমেত গোটা এলাকা জুড়ে আধুনিক শহর তৈরি হবে। ডেভলপমেন্ট হওয়ার কথা দেশি-বিদেশি সংস্থার কোলাবোরেশনে। কারখানার মালিক নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি। খাসজমি অধিগ্রহণের সময় সরকার চোখ বুজে থাকবে। কারণ, সরকার উন্নয়ন চায়। বাধ সেধেছে একটা গোষ্ঠী। যারা নিজেদের পরিবেশকর্মী বলছে। জলাজমি বুজিয়ে ফেললে জনবসতির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যাবে চতুর্দিক। বিলে প্রত্যেক বছর পরিযায়ী পাখি আসে, তারা আর আসবে না। প্রচুর মাছ চাষ হয় বিলে। মেছোডাঙার বাসিন্দাদের ওটাই জীবিকা। এছাড়াও আছে ক্ষতির নানান ফিরিস্তি। সব ছাই মনেও থাকে না শুভ্রজ্যোতির। পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই যোগ দিয়েছে মেছোডাঙার পরিবারগুলো। সাকুল্যে দু থেকে আড়াইশো জন এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। স্টিল ফ্যাক্টরি সবে নিজের জমি ভরাট করতে শুরু করেছে, হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে তারা। ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার থানার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রথম যেদিন কারখানার গেটের সামনে বিক্ষোভ হল। আড়াইশোজনের অ্যাজিটেশন লাঠি উঁচিয়ে ফাঁকা করে দেওয়া পুলিশের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। ঘটেওছিল তাই। তারপরই ম্যানেজার শুভ্রজ্যোতিকে ডেকে পাঠান নিজের চেম্বারে। গোটা পরিকল্পনাটা ভেঙে বলেন, বিশ একরে আধুনিক শহরের প্ল্যান। বলেছিলেন, অত কম বিক্ষোভকারী দেখেঞ্জভাববেন না ওদের শক্তি কম। আইনের জোর আছে ওদের পিছনে। কারখানা বাড়ানোর নাম করে আমরা নিজেদের জলাজমি ভরাট করছি, এখনকার আইন বলছে তা আমরা করতে পারি না। পরিবেশ দফতরের পারমিশন লাগবে। ‘জলাজমি’ ব্যাপারটা এখন এত সেনসেটিভ, অনুমতি পাওয়া যাবে না। আন্দোলনকারীরা কোর্টে যাওয়ার আগেই কারখানার দশ একর ভরাট করে ফেলতে হবে আমাদের। কয়েকটা রাতের মধ্যে চুপিচুপি সেরে ফেলতে হবে কাজ। আপনি আমাদের প্রোটেকশন দেবেন। কোর্টের রায় যদি এসেও যায় আপনার হাতে, আপনি অ্যাকশন নিতে গড়িমসি করবেন। একবার ভরাট হয়ে গেলে বাকিটা সামলে নিতে পারব আমরা। আমি ইতিমধ্যে মেছোডাঙার বাসিন্দাদের অফার দিয়েছি, কারখানা বড়ো করে চাকরি দেব তোমাদের। আমরা যে কারখানা বিক্রি করে সরে পড়ার তাল করছি, এটা ওদের বুঝিয়েছে আন্দোলনে থাকা শিক্ষিত মানুষ। মেছোডাঙার লোকেরা আমাদের বিশ্বাস করছে না। আপনি যদি পুরো অবস্থাটা আমাদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারেন, প্রচুর টাকা দেব।

টাকার অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠেছিল শুভ্রজ্যোতির। তখনও জানতেন না আরও দু’টো পার্টির থেকে এরকমই আকর্ষণীয় অফার আসবে। সরকারের এক প্রভাবশালী ফোন করে বললেন, কাজটা করে দিন। ভালো জায়গায় বদলি এবং প্রোমোশন দেব। পার্টির ছেলেদের দিয়ে কাজটা অনায়সে করানো যেত। আড়াইশোজনের প্রতিবাদ ধোপে টিকত না। কিন্তু এইসব সেনসেটিভ ইস্যুতে ইন্টারফিয়ারেন্স নিলে পার্টির বদনাম হবে। বিরোধী পার্টির সঙ্গেও আপসরফা হয়ে গেছে। আপনি শুধু ওই আড়াইশোজনকে সামলান।

এরপর ফোন এসেছিল ডেভলপারের কাছ থেকে। কাজটা করে দেওয়ার জন্য তারা যে-টাকার অফার দিয়েছে, স্বপ্নেও তা কল্পনার অতীত।

এত সব উজ্জ্বল প্রস্তাব পেয়ে নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের মতো হয়ে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। তিনটে পার্টির কাছেই তিনি সময় চেয়ে নেন। বলেন, আমাকে প্ল্যান সাজাতে দিন। আমি না-বলা পর্যন্ত আপনারা কোনও স্টেপ নেবেন না।

কাজ অনেকটাই মেরে এনেছেন শুভ্রজ্যোতি। মাথা ঠান্ডা রেখে ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়েছে ভালোই। এখন লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল অপারেশনটা বাকি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন। টেনশন বাড়ছে, নাগালের মধ্যে এসে গেছে বিপুল টাকা, চাকরির উন্নতি! স্টেপিং-এর সামান্য ভুলে সমস্ত কিছু চলে যেতে পারে হাতের বাইরে। উৎকণ্ঠায় কাহিল হয়ে শুভ্রজ্যোতি, জীবনে প্রথমবার কোনও প্রফেশনাল জ্যোতিষীর কাছে চলেছেন। সন্তানের কোষ্ঠীবিচার বাবা হয়তো কখনও করিয়েছিলেন, ফলাফল জানা নেই শুভ্রজ্যোতির। আত্মীয়বন্ধু মহলে দু’চারজনের কাছে হাত দেখিয়েছেন। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই মেলেনি। ভাগ্যবিচারকে বুজরুকি, দুর্বল মনের আশ্রয় বলেই গণ্য করতেন শুভ্রজ্যোতি। টেনশনের চোটে এখন মনে হচ্ছে সামনেটা যদি একটু জানা যেত, মনটা বশে থাকত অ্যাটলিস্ট।

জ্যোতিষীর কাছে যাচ্ছেন, একজন ছাড়া কেউ জানে না। সেই ব্যক্তিই দিয়েছিল জ্যোতিষীটির হদিস। জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়াটা গোপন রাখতে চান শুভ্রজ্যোতি। চন্দ্রিমাকে বলার প্রয়োজন নেই। দূরে থাকে বলে জানতেও পারে না, শুভ্রজ্যোতি কোথায় যান না যান। থানার সহকর্মীদেরও কিছু বলেননি। চেনা একজনের গাড়ি নিয়ে সিভিল ড্রেসে চলেছেন চণ্ডীতলা। সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি, একতলায় চেম্বার।

দেবনগরের পর দু’টো থানা-এরিয়া পেরিয়ে গঙ্গার খালের ব্রিজের ওপারে চণ্ডীতলা। জ্যোতিষীর বাড়ি নাকি খালের গায়েই। সঙ্গে কোনও সহকর্মী এবং থানার গাড়ি নিয়ে আসতেই পারতেন শুভ্রজ্যোতি। আনেননি দুটো ভিন্ন কারণে। এক, জ্যোতিষীর কাছে পুলিশ পরিচয় লুকোতেই পরনে সিভিল ড্রেস এবং ‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়ি নেননি। সামান্য ক্লু পেলেই জ্যোতিষীরা অ্যানালিসিস করে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় কথা বলে দেয়। ফালতু সময় নষ্ট। শুভ্রজ্যোতি সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পেতে চান। আর সহকর্মী কারওকে আনেননি নিজের ইমেজের কথা ভেবে। থানার সকলেই জানে তিনি রাফ অ্যান্ড টাফ। এইসব মানুষের জ্যোতিষীর শরনাপন্ন হওয়া মানায় না।

সাবঅর্ডিনেটরা সমীহ করবে না। ওদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে না পারলে জলাভূমি দখল করা মুশকিল। এখন অবধি ওরা যে কো-অপারেশনটা করছে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়, সমীহ থেকে। এই তো যেদিন মেছোডাঙার চার মাথাকে ফল্স কেস-এ চালান করলেন কোর্টে, কাজ মিটিয়ে ফিরে আসছেন থানায়, গাড়িতে পাশের সিটে বসেছিল সিনিয়র স্টাফ বাসুদেব গড়াই। বলেছিল, হাতিডোবার বিলটা না বোজালেই নয় স্যার? ওদিক থেকে দারুণ একটা হাওয়া দেয় বলেই দেবনগর এলাকাটা এত শান্ত। তারপর ধরুন সস্তায় টাটকা মাছ পাওয়া যায়। শীতকালে কাছে পিঠে এত সুন্দর পিকনিক স্পট! সেই সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসে…

উত্তরে শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, আপনি এক কাজ করুন, চাকরিতে রিজাইন দিয়ে পছন্দসই গ্রামে বসবাস করতে চলে যান। রিটায়ারমেন্টের সময় তো হয়েই এল, লস খুব একটা হবে না।

বাসুদেব গড়াই আর কথা বাড়ায়নি। কাজ শেষের মুখে গড়াইয়ের ন্যাকামি শুনে গা জ্বলে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। কত সতর্ক হয়ে মিশনটাতে এগিয়েছেন। অফারগুলো আসার পর প্রথমে মিটিং করলেন পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে। জলাজমি বুজিয়ে কী হতে চলেছে বললেন পুরোটাই। যদিও ওরা সবই জানত। শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, জায়গাটার উন্নয়ন হচ্ছে, আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন?

ওদের বক্তব্য, কারখানা বন্ধ করে বড়োলোকদের বাসস্থান কী ধরনের উন্নয়ন। গরিব সাধারণ মানুষের কী উপকার হবে এতে? পরিবেশ নষ্ট হয়ে বরং ক্ষতিই হবে মানুষের।

এর পরের মিটিং শুভ্রজ্যোতি করলেন মেছোডাঙার বাসিন্দাদের সঙ্গে। মেছোডাঙায় গিয়ে ওদের বোঝালেন, তোমরা প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। জীবনের মান উন্নত হবে তোমাদের। চরা ছেড়ে চলে যাও।

ওরা বুঝল না। বলল, আমরা ছিটেবেড়ার ঘরে ভালোই আছি। খেয়েপরে দিন চলে যাচ্ছে। কোনও উন্নতির দরকার নেই আমাদের।

কিন্তু সকলেই তো আর নির্লোভ নয়। শুভ্রজ্যোতি ছোট্ট একটা দান চেলে রেখে এসেছিলেন মেছোডাঙায়। বলেছিলেন, ঠিক আছে, তোমরা ভালো করে ভেবে দ্যাখো। আমি জোর করব না। যদি মত পরিবর্তন হয় থানায় এসে আমাকে জানিও। তোমাদের জন্য দরজা সব সময় খোলা।

ওদের মধ্যে মাত্র দু’জন এসেছিল চুপিচুপি। তারা জীবনে উন্নতি চায়। তাদের ইনফর্মার হিসেবে নিয়োগ করলেন শুভ্রজ্যোতি। তিনি জানতেন মেছোডাঙায় মাঝে মাঝে বাইরের থেকে দুষ্কৃতিরা এসে গা ঢাকা দেয়। মেছোডাঙার বাসিন্দারা ভয় পেয়ে আশ্রয় দেয় তাদের। দুই ইনফর্মার এক দাগি অপরাধীর গাঞ্জঢাকা দেওয়ার খবর দিল। ফোর্স নিয়ে তাকে ধরতে গেলেনঞ্জশুভ্রজ্যোতি। নৌকো করেই যেতে হয়েছিল। তাছাড়া অন্য উপায় তো নেই। অপরাধী পালাল। শুভ্রজ্যোতি জানতেন নৌকোর মতো ধীর গতির যান নিয়ে অপরাধীকে ধরা যাবে না। দুষ্কৃতিরা সেটা বুঝেই ওখানে গা ঢাকা দেয়। শুভ্রজ্যোতির আসল উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হল। দাগি দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে মেছোডাঙার চার মাথাকে অ্যারেস্ট করলেন।

এতেই আন্দোলনকারীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে গেছে।

যে-কেসে অ্যারেস্ট করেছেন, থানায় এসে বিক্ষোভ জানাতে পারছে না তারা। তবে ওরা খুব শীঘ্রই বিক্ষোভ জানাবে কারখানার গেটে। শুভ্রজ্যোতির নির্দেশে কারখানার ম্যানেজার ভরাট করতে যাবেন জলা। এটা আসলে টোপ। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে সামিল হলেই, শুভ্রজ্যোতি তার দুই ইনফর্মার এবং দু’চারটে ভাড়াটে গুন্ডা ঢুকিয়ে দেবে ভিড়ে। তারা ভাঙচুর করবে কারখানায়। পুলিশ এলে ইট ছুড়বে। শুভ্রজ্যোতি বেছেবেছে আন্দোলনকারীদের মাথাগুলোকে অ্যারেস্ট করবেন। এবার তারা বেল পেয়ে জেল থেকে বেরোতে বেরোতে ঠিকাদাররা ভরাট করে ফেলবে হাতিডোবার বিল। বাধা দেওয়ার মতো লোকবল, পাকামাথা ওদের দলে থাকবে না। কারণ, হাতিডোবার বিল নিয়ে দেবনগর এবং আশপাশের শহর মফস্সলের বাসিন্দাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। জলার হাওয়ায় তারা শান্তি পায়। দেখতে যায় না হাওয়াটা আসছে কোথা থেকে? হাওয়া যে দেখা যায় না। এমনই স্বার্থপর হয়ে উঠেছে মানুষ। অথচ যত দোষ শুধু পুলিশের!

এই ফুলপ্রুফ প্ল্যানে একটাই কাঁকর, গোপার ছেলে সৌম্য। সে আন্দোলনকারীদের একজন। গোপার সঙ্গে শুভ্রজ্যোতির ফস্টিনস্টির সম্পর্ক। শুভ্রজ্যোতি যখন যে থানায় গেছেন, সেই এরিয়ায় নিশ্চিত করে একটা নষ্টামির রিলেশন তৈরি হয়েছে, যার অাঁচ কিছুতেই পেৌঁছোতে দেন না বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। পার্টনারের সঙ্গে সেরকমই অ্যাডজাস্টমেন্ট করা থাকে। গোপা হাজব্যান্ড সলিলকে নিয়ে থানায় এসেছিল বাড়িওলার নামে অভিযোগ জানাতে। দোষ যদিও গোপাদের। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া দেয় না। স্বাভাবিক কারণেই বাড়িওলা ওদের উঠে যেতে বলছে। হুমকি দিয়েছে অল্পবিস্তর। জলের লাইন কেটে দিয়েছে। গোপাকে পছন্দ হয়ে গেল শুভ্রজ্যোতির। ওদের বাড়িতে চা খেতে আসার নেমতন্ন পেলেন গোপার থেকে, সঙ্গে গোপার ভ্রূ ভঙ্গিতে আরও গোপন কিছু পাইয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত। শুরু করলেন ওদের বাড়িতে যাওয়া। বাড়িওলা জলের লাইন জোড়া লাগিয়ে দিল। ভাড়াও চায় না। সলিলটা ভেডুয়া টাইপের, শুভ্রজ্যোতি ওদের বাড়ি গেলেই কোনও একটা অছিলায় বেরিয়ে যায়। সমস্যা সৌম্যকে নিয়ে। কলেজে পড়া ছেলে। বাড়ির বাইরেই থাকে বেশিরভাগ। তবু কখনও যদি বাড়ি এসে শুভ্রজ্যোতিকে দেখে, এমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়, সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে শুভ্রজ্যোতির পক্ষে।

পরিবেশকর্মী বা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেবনগর, নসিবপুরের লোক হাতেগোনা। বেশিরভাগ বাইরের। হাতেগোনা ক’জনের মধ্যে কেন যে সৌম্য কাঁকরের মতো রয়ে গেল… বিক্ষোভে কিংবা মিটিংয়ে যতবারই আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, সৌম্যর মতো ঘৃণার দৃষ্টিতে কেউ তার দিকে তাকায়নি। ও রাগ তো জলাভূমি নিয়ে নয়।

শুভ্রজ্যোতি গোপাকে বলেছেন, ছেলেকে ওসব আন্দোলনে থাকতে বারণ করো। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।

গোপা বলেছে, ও যেমন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে এবাড়িতে আসতে বারণ করে না, আমিও ওর ইচ্ছেতে বাধ সাধব না।

শুভ্রজ্যোতি একটা ব্যাপারে ভীষণ আশঙ্কিত হচ্ছেন, প্ল্যান মাফিক যে- গন্ডগোলটা কারখানার গেটে পাকাবেন ঠিক করেছেন, কোনও ভাবে যদি সৌম্য উন্ডেড হয়, একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। ফোর্সকে তিনি যতই একজনকে বাঁচিয়ে অ্যাকশন করতে বলুন, ওই পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশ পালন করা বেশ কঠিন।

সৌম্য পুলিশের মারে জখম হলে গোপা ছেড়ে দেবে না শুভ্রজ্যোতিকে। প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে মায়ের মন। গোপা হয়তো চলে যাবে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে শুভ্রজ্যোতির সংসারে। এই সব সম্ভাবনার কথা ভেবে শুভ্রজ্যোতির মনে উৎকন্ঠার পারদ ক্রমশ চড়ছে। ভবিষ্যতের আভাস পাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে সেই কারণেই।

চণ্ডীতলার জ্যোতিষীর সন্ধান দিন দশেক হল পেয়েছেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করে জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দেবাংশুর এখন ফার্স্ট ইয়ার। মেধাবী স্টুডেন্ড, জয়েন্টে র্যাংক করে চান্স পেয়েছে। বাবার ঘুষের টাকায় প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে হয়নি।

সে যাই হোক, এই ট্রিপে চন্দ্রিমা সঙ্গে ছিল না। শুভ্রজ্যোতির অপোজিট বার্থে বছর তিরিশের এক কো-প্যাসেঞ্জার বারবার পাথর লাগানো আংটিতে চুমু খেয়ে আংটির হাতটা কপালে ঠেকাচ্ছিল। চোখের সামনে ক্রমাগত একই ঘটনা ঘটতে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলেটিকে একসময় বলেই ফেললেন, আপনি তো বেশ ভক্ত লোক মশাই। আপনার বয়সে এত ভক্তি সহজে দেখা যায় না।

খোঁচাটা খেয়ে ছেলেটি রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে ছিল। মুখে কিছু বলেনি। ঘটনাটা কিন্তু ঘটিয়েই যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সহযাত্রীর কাণ্ডকারখানা থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছোনোর পর যে কাণ্ডটা ঘটল, জানা গেল সহযাত্রীর ওই আচরণের কারণ। প্ল্যাটফর্মে নেমে ছেলেটি একটু বুঝি ত্রস্ত পায়ে হাঁটছিল শুভ্রজ্যোতির সামনে। ওর ধরনধারণ দেখে একটু ছিটিয়াল টাইপের বলেই মনে হচ্ছিল। আচমকা কোথা থেকে দুটো ছেলে ছুটে এসে ধাক্বা মারল ওই সহযাত্রীকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর কাঁধের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে দু’জনেই ধাঁ।

পুলিশ হয়েও শুভ্রজ্যোতি ঘটনাটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। দুষ্কৃতিদের চেজ করা হয়ে ওঠেনি। সহযাত্রী ছেলেটি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে বসে পড়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। বলছে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। সব গেল আমার… ও মা, এবার আমি কী করব…

শুভ্রজ্যোতি সহযাত্রীটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসেছিলেন। পিঠে হাত রেখে সহমর্মীর গলায় বলেন, মনে হচ্ছে ওদের কাছে খবর ছিল দামি কিছু ক্যারি করছেন আপনি। কী ছিল ব্যাগে?

হা-হুতাশ থামিয়ে ছেলেটি রাগের চোখে তাকিয়ে ছিল শুভ্রজ্যোতির দিকে। মুখ ঝামড়ে বলেছিল, প্রচুর টাকা ছিল। আমার বিজনেসের টাকা। ট্রেনে আপনি বলছিলেন না, আমার ভক্তি বেশি। ভক্তি এই কারণে। বলে ছেলেটি হাতের আংটিটা দেখিয়ে মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিল। আংটিতে পান্না বসানো। যে-জ্যোতিষী দিয়েছিলেন, বলে দেন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই রত্নের রং গাঢ় হতে শুরু করবে। তখনই যেন সতর্ক হয়ে যায় ছেলেটি। ট্রেন জার্নি-তে পান্নার রং আরও সবুজ হতে দেখে ছেলেটি চিন্তায় পড়ে যায়। সামনের স্টেশনে নেমে পড়বে, নাকি পুরোটাই যাবে? বিপদ দু-জায়গাতেই ওত পেতে থাকতে পারে। তাই সে আংটিতে চুমু খেয়ে আংটি কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল, এ যাত্রায় সে যেন বেঁচে যায়।

শেষ রক্ষা হয়নি। শুভ্রজ্যোতি কিন্তু তাঁর এই টেনশনের সময়কালে পাওয়ারফুল জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ছেলেটিকে বলেছিলেন, ব্যাপারটা আপনি আগে বলবেন তো আমাকে! আমি পুলিশ। আর্মস আছে সঙ্গে। অ্যালার্ট থাকতে পারতাম।

আপনি পুলিশ, আমি জানব কী করে! বলেছিল ছেলেটি। ভুল কিছু বলেনি। ছেলেটিকে শুভ্রজ্যোতি নিয়ে যান জিআরপি-তে। নিজের পরিচয় দিয়ে ডায়ারি লেখান। ততক্ষণে জ্যোতিষী চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যর ঠিকানা নিয়েছেন ছেলেটির থেকে। জ্যোতিষী সপ্তাহে তিনদিন দুপুর দু’টো থেকে সন্ধে ছ’টা অবধি চেম্বারে বসেন। প্রবল ভিড় হয়। নাম লেখাতে হয় আগে থেকে। সোমবার ভিড় একটু কম।

আজ সোমবার। গত শনিবার ফোন করেছিল পল্লব, ট্রেনের সেই সহযাত্রী। সুখবর শোনাল। বলল, আপনার সঙ্গে গিয়েছিলাম বলেই জিআরপি উঠে পড়ে লেগে আমার অনেকটা টাকাই উদ্ধার করে ফেলেছে। আপনি পুলিশ অফিসার বলেই কেসটা সিরিয়াসলি নিয়েছিল ওরা। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব আপনাকে… যাই হোক চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন নাকি ইতিমধ্যে?

না, যাইনি। দু’একদিনের মধ্যেই যাব। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

পল্লব বলল, সোমবার চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। নাম লিখিয়ে রাখব। ক’টা নাগাদ আসবেন বলুন।

বিকেল চারটের আশেপাশে যাবেন বলে রেখেছেন শুভ্রজ্যোতি। আধঘন্টা মতো দেরি হয়ে গেল। পল্লব নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।

খালের ব্রিজে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছেন শুভ্রজ্যোতি। খালে টলটলে জল। ব্রিজ থেকে নেমে যে-রাস্তাটা খাল বরাবর চলে গেছে, সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি।

রাস্তাটা অপ্রশস্ত এবং শুনসান। ডানপাশে খাল, বাঁ দিকে পরপর চালাঘর, পাকা ছাদের বাড়ি চোখেই পড়ছে না। গাড়ির স্পিড আস্তে করে নিয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে জ্যোতিষীর বাড়ি কোনটা?

ছেলেটি এসে পড়ল। শুভ্রজ্যোতি গাড়ি থামালেন। ছেলেটিকে বললেন, চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িটা কোথায়?

– সোজা চলে যান। লাল রকওলা দোতলা বাড়ি। বলার পর ছেলেটি জানতে চাইল, আপনি কি হাত দেখাতে এসেছেন?

হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না শুভ্রজ্যোতি। শুধু ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন, এটা পুলিশি অভ্যেস। ছেলেটা নিজের থেকেই প্রশ্নের কারণটা বলবে। এবং বলল, উনি হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন মাস খানেক হল। গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

কেন ছেড়ে দিয়েছেন জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলেন না শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। পল্লব কি তাহলে জানে না হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন? ও যে বলল নাম লিখিয়ে রাখবে? নাম না লেখাতে পেরে একটা ফোন করতে পারত। পল্লবকে এখন কি একবার ফোন করবেন শুভ্রজ্যোতি? না, থাক। জ্যোতিষীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। এতটা যখন এসেই পড়েছেন।

নীচের তলার ঘরে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য গোমড়া মুখে বসে রয়েছেন তক্তপোশের ওপর। সামনে কাঠের চেয়ারে শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল আরোহী সঠিক খবরই দিয়েছে, ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পর পর ছ’জনের হাতে আসন্ন মৃত্যুযোগ দেখার পর তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বর চান না তিনি আর ভাগ্যবিচার করুন। তাই সেই সব মানুষকেই হাত দেখাতে পাঠাচ্ছেন, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। যে ছ’জনের গণনা তিনি করেছিলেন, চারজনের মৃত্যুর খবর কানে এসে পৌঁছেছে, দু’জনের কী হয়েছে জানেন না। মৃত্যুযোগ প্রতিকারের ক্ষমতাও নেই চিত্তরঞ্জন জ্যোতিষীর। মিছিমিছি ভাগ্যগণনা করে কী লাভ! ঈশ্বর তাঁকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, বাকি জীবনটা ওতেই চলে যাবে।

শুভ্রজ্যোতি অনেক অনুনয়-বিনয় করে নিজের হাতটা দেখানোর চেষ্টা করলেন। পল্লবের রেফারেন্স দিলেন। বললেন ওঁরই দেওয়া সেই আশ্চর্য পান্নার কথা, বিপদ কাছে এলে যার রং গাঢ় হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন পল্লবকে মনে করতে পারলেন না। পরপর খারাপ হাত দেখে জ্যোতিষ ব্যাপারটা থেকে মন উঠে গেছে তাঁর। বাধ্য হয়ে শুভ্রজ্যোতি হুমকি দিলেন, হাত আপনাকে আমি দেখিয়েই ছাড়ব। এতেই ঠিক হয়ে যাবে কার মরণ আসন্ন, আপনার না আমার।

এরপর থেকেই গুম মেরে গেছেন চিত্তরঞ্জন। এবার মুখ তুললেন। বললেন, আপনি পুলিশ বলেই এভাবে জোর খাটাচ্ছেন। ভাগ্যবিচার আমি করে দিচ্ছি। দেখে যেটা বুঝব, সেটাই বলব। ধাক্বাটা সহ্য করতে পারবেন তো?

আমি পুলিশ, কী করে জানলেন? নিশ্চয়ই পল্লব বলেছে। অথচ বলছেন পল্লবকে মনে করতে পারছেন না।

আপনার কথা কেউ আমাকে বলেনি। চুলের ছাঁট, কোমরে বেল্ট, জামা গুঁজে পরা, ঠায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসা, এক দু’বার ঝোঁকার চেষ্টা করেও পারলেন না। বগলের তলায় বেল্টের সঙ্গে বাঁধা আছে পিস্তল। সর্বপরি আপনার শীতল চাহনি, দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি না করলে এমনটা হয় না। পিস্তল আর চাহনির চাপে পড়েই আপনার ভাগ্য গণনায় রাজি হলাম আমি। একটু বসুন, ওপর থেকে খাতাপত্তর নিয়ে আসি।

তক্তপোশ থেকে নেমে ঢিমেতালে বাড়ির ভিতরে গেলেন চিত্তরঞ্জন। শুভ্রজ্যোতির একটু ভয় ভয় করছে, লোকটা যা বলছেন, সত্যি হবে না তো? মৃত্যুযোগ কি আমার হাতেও আছে? ভগবানের পাঠানো সাত নম্বর ব্যক্তি কি আমি? …চিন্তাটা কাক তাড়ানোর মতো মাথা থেকে তাড়ান শুভ্রজ্যোতি। আগের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাছাড়া ছ’জনের মধ্যে দু’জন হয়তো বেঁচে আছে, যাদের খবর পাননি চিত্তরঞ্জন। পল্লবের ব্যাপারটা নিয়ে শুধু ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। বলল, আজ আসবে। নাম লিখিয়ে রাখবে…

চিত্তরঞ্জন ফিরে এলেন। হাতে হালখাতার মতো লাল পুরোনো খাতা আর ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। তক্তপোশে উঠে বসে চিত্তরঞ্জন বললেন, বলুন, আপনার জন্মের সময় আর তারিখ।

বললেন শুভ্রজ্যোতি। খাতা খুলে ছক কাটতে লাগলেন চিত্তরঞ্জন। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। আঁক কাটা শেষ হতে বললেন, দিন, এবার ডানহাতটা দিন।

হাত বাড়ালেন শুভ্রজ্যোতি। হাতটা ধরে ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে দেখছেন চিত্তরঞ্জন। মোটা কাচের চশমা তো আছেই, আতসকাচও ব্যবহার করছেন।

এবার বাঁ-হাতটাও চেয়ে নিলেন। শুভ্রজ্যোতি নিবিষ্ট হয়ে জ্যোতিষীর এক্সপ্রেশন পড়ার চেষ্টা করছেন। চিত্তরঞ্জনের কপালের ভাঁজ এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্তি দেখা দিচ্ছে চেহারায়। এবার মুখ তুলে একগাল হেসে বললেন, নাঃ, নেই মৃত্যুযোগ। এখনও বহুদিন বাঁচবেন। উন্নতি করবেন জীবনে। প্রচুর অর্থ উপার্জনও হবে। সুখে কাটবে বাকি জীবনটা।

শুভ্রজ্যোতির মুখে হাসি ফিরে এসেছে। হাত দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, দেখলেন, কেমন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। আমি জোর না করলে ভুলটা আপনার ভাঙত না, থেকেই যেত।

আসলে একের পর এক মৃত্যুর গ্রহণ লাগা হাত দেখতে কার ভাল লাগে বলুন! বিষণ্ণ গলায় বললেন চিত্তরঞ্জন।

শুভ্রজ্যোতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। পার্স বার করে একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন চিত্তরঞ্জনের দিকে। বললেন, এতে হয়ে যাবে তো?

টাকা দিচ্ছেন কেন! আমি তো ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছি। আপনি জোর করলেন বলেই…

শুভ্রজ্যোতি জ্যোতিষীর ডানহাতটা তুলে ধরে নোটটা রাখলেন। বললেন, প্রফেশন ছেড়ে দেবেন কেন? এই তো আজ একটা ভালো হাত পেলেন। এবার থেকে দেখতে থাকুন। মিছিমিছি নিজের ক্ষমতাকে অপচয় করবেন না।

শুভ্রজ্যোতি রিল্যাক্সড্ ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নোটটা ফতুয়ার পকেটে ঢোকাতে অস্বস্তি হচ্ছে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের। আবার অবসাদ ঘিরে ধরেছে তাকে। এই লোকটাও বাঁচবে না। মানুষটাকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কালসর্প যোগ আছে লোকটার। মানে অপঘাতে মৃত্যু। ফণা উঁচিয়ে আছে নিয়তি। আর ঘন্টা খানেকও বাঁচবে কিনা সন্দেহ। এরকম দাপুটে মানুষটা নিয়তির কাছে বড়ো অসহায়! লোকটার প্রতি মায়া হয় চিত্তরঞ্জনের। মানুষটাকে শেষবার দেখার জন্য বাড়ির রকে এসে দাঁড়ালেন। আঁতকে উঠলেন সামনের দৃশ্য দেখে! মৃত্যু যে বাইরেই ওত পেতে ছিল, ভাবতেই পারেননি। চার, নাকি পাঁচজন যুবক পুলিশ লোকটার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ির বনেটে শুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিলেন চিত্তরঞ্জন। এক্ষুনি গুলি চালানোর শব্দ আসবে কানে।

আসছে না দেখে চোখ খুললেন। এখন অন্য দৃশ্য, কপালে বন্দুক ঠেকানোই আছে পুলিশের। লোকটাকে দিয়ে একটা কাগজে কী সব লেখাচ্ছে ছেলেগুলো। বেশি লিখতে হল না। সই করাল সম্ভবত। লোকটাকে ছেড়ে দিল ওরা। পুলিশটা দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। দু’টো বাইকে পাঁচজন যুবক চেপে চলে গেল জুটমিল বস্তির দিকে। নিয়তি তার মানে ছেলেগুলির ইচ্ছে অনুযায়ী ফণা নামিয়ে নিল। বেঁচে গেল লোকটা। ওই যুবকরা কি তা হলে নিয়তির চেয়েও শক্তিমান।

ছেলেগুলো খুন করেছে। শুভ্রজ্যোতিকে নয়, ওঁর ভিতরে থাকা খারাপ পুলিশটাকে। ব্রিজের ওপর উঠে এসে শুভ্রজ্যোতি আর গাড়ি চালানোর রিস্ক নেননি। হাত কাঁপছে, ধড়াস ধড়াস করছে বুক। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। খারাপ পুলিশটার নগ্ন দেহ যেন খালের জলে ভেসে আসতে দেখছেন। এরকম হুমকিই দিয়েছিল ছেলেগুলো। আচমকা মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল পাঁচজন। শুভ্রজ্যোতি নিজের আর্মস বার করার সুযোগই পাননি। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলল, কোনও সেয়ানাগিরি নয়। যা বলছি শোন। নয়তো দানা ভরে জামাকাপড় খুলে লাশ ফেলে দেব খালে। ভাটার টাইম, ভাসতে ভাসতে অন্য জেলায় চলে যাবি।

শুভ্রজ্যোতিকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে আসাটা ছিল ট্র্যাপ। শুনশান এলাকা। খালটা জেলার সীমানায়। এখানে বডি ফেলে দিলে নিখোঁজ শুভ্রজ্যোতিকে জেলার পুলিশ খোঁজার পর সারা রাজ্যজুড়ে তল্লাশি চলত। ততক্ষণে বডিটা হয়তো পৌঁছে যেত সাগরে। খুনের কোনও প্রমাণ থাকত না।

পাঁচজনের দলে পল্লব তো ছিলই আর ছিল গোপার ছেলে সৌম্য, সঙ্গে আরও দু’জন আন্দোলনকারী। বাকি দু’টো ছেলেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। ওরা যে-কাগজে সই করাল, তাতে শুভ্রজ্যোতি পুলিশ জীবনে যা যা অপরাধ করেছেন, সমস্ত লেখা আছে। ছেলেগুলো এতসব জোগাড় করল কী ভাবে, কে জানে! কাগজটা ছিল স্বীকারোক্তির বয়ান। শুভ্রজ্যোতিকে সাইন করিয়ে ওরা বলল, হাতিডোবার বিলে হাত বাড়াবি না। পুলিশ হওয়ার অ্যাডভান্টেজ নিবি না আর কখনও। যদি নিস, এই ডিক্লেয়ারেশনের এক কপি যাবে সিআইডি  ডিপার্টমেন্টে, আর একটা কপি মিডিয়ায়। প্রাণে বেঁচেছিস, এটাই জানবি তোর চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি।

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা! এখন অনেকটা ধাতস্থ লাগছে। খারাপ পুলিশটা ব্রিজের তলা দিয়ে আবর্জনার মতো ভেসে গেছে সাগরের দিকে। পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস বয়ে আসছে। সম্ভবত হাতিডোবা বিলের হাওয়া। শুভ্রজ্যোতি এবার চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবনগরে নিয়ে আসবেন। বলবেন, ছেলে যখন বাইরে, কলকাতায় একা থেকে কী করবে! দেবনগরে একসঙ্গে থাকি চলো। জায়গাটা বেশ ভালো। হইচই নেই। নিরিবিলি। পশ্চিমি হাতিডোবার বিল থেকে উঠে আসা হাওয়ার প্রভাবেই এলাকাটা এত শান্ত! যে-কথা বলবেন না, তা হল, কিছু অশান্ত, দামাল যুবক অহর্নিশ হাওয়াটাকে পাহারা দেয়।

মা

ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…

শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে প্রিয়া।

‘হ্যালো।’

হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে ওঠে প্রিয়ার ছোটোপিসি সুশীলার গলা।

‘পিসি! এত রাতে ফোন করছ, কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে তো বটেই। কিন্তু তোকে যে কীভাবে বলি। শুনলেই তুই তো আবার রাগারাগি করবি। আমার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। ব্যাপারটা কীভাবে নিবি কে জানে?’

‘দ্যাখো পিসি হেঁয়ালি ছাড়ো, পরিষ্কার করে বলো তো কী হয়েছে?’

বেশ ত্রস্তকণ্ঠেই সুশীলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া, একটু আগেই বড়দি ফোন করে বলল, দাদা নাকি আবার

বিয়ে করেছে।’

‘কী যা তা বলছ… মাথার ঠিক আছে তো তোমার?’

‘যা তা বলছি না রে। দিদিই নাকি কোনও এক ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে দাদার বিয়েটা দিয়েছে।’

এত রাতে ফোনের আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল প্রিয়ার। ভয় পেয়েছিল কোনও খারাপ সংবাদ নয়তো! তার ভাবনাটাই সত্যি হল, কোনও মৃত্যুসংবাদ না পেলেও এই বয়সে তার বাবার বিয়েটা তার কাছে মৃত্যুসংবাদের থেকে কম শকিং নয়। পিসির কাছ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই হকচকিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছিল প্রিয়া। এ তার কাছে এক বিশাল লজ্জার ঘটনা। শাশুড়ি, বড়ো-জা, ননদ এমনকী স্বামী নীলাদ্রিকেই বা কী করে মুখ দেখাবে। তাদের সকলের কাছে তো হাসির পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে সে। একী করল বাবা। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না প্রিয়া, অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছিল।

প্রিয়ার বিয়ের সময়তেও তার বড়োপিসির এহেন কথার জন্য বেশ গোল বেধে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রিয়া রেগেমেগে পিসিকে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছিল। আজ এতদিন পরে প্রিয়া হাড়েহাড়়ে টের পাচ্ছে ওই মহিলা সেদিন সেই মুহূর্তের জন্য চুপ করলেও মনে মনে বদ্ধপরিকর ছিল তার একাকী, নিঃসঙ্গ দাদার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে পিসিকে দুষতে থাকে প্রিয়া। ‘পিসিকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু বাবা…! বাবা একবারও তার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এই ঘটনা তার বিবাহিত মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? সবাই বলত বাবা নাকি মেয়ে অন্ত প্রাণ। তাহলে বাবা এমন অবিবেচক হল কেন? ভারি অভিমান হল প্রিয়ার।

সংসার বলতে তো ছিল চারটে প্রাণী। প্রিয়া, প্রিয়ার বাবা নরেনবাবু, মা মোহিনীদেবী এবং অন্ধ, বিকলাঙ্গ ভাই হেমেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে এমন হওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মোহিনীদেবীর ভালোবাসা সংসারে যেন এক আশ্চর্য সুখশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসারে হঠাৎই একদিন বাধ সেধে বসে এক মারণ ব্যাধি। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন মোহিনীদেবী। ব্যস, দু’বছরের মধ্যেই সব শেষ। তখন প্রিয়া তেরো আর হেমেন বছর নয়েকের। তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। সময় তার নিয়মেই বয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাবা-মেয়ে মিলে সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছে। পাশাপাশি প্রিয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। বছর তিনেক হল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়েও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি মোহিনীদেবীর প্রতি সকলের ভালোবাসা।

তার নিজের বিয়ের পরেও কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। মাস আষ্টেকের একটি মেয়েও আছে। সবই তো ঠিক চলছিল। ভাইকেও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মিনতিদি বেশ যত্ন নিয়েই দেখাশোনা করছিল। তাহলে আজ কী এমন ঘটে গেল যে, এই বয়সে বাবাকে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হল? এই কথাগুলি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল প্রিয়াকে।

অনেকক্ষণ প্রিয়া আসছে না দেখে ঘর থেকে নীলাদ্রি ডাকতে থাকে প্রিয়াকে। নীলাদ্রির ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পায় প্রিয়া। কোনওরকমে চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ আসছি। এক্ষুনি আসছি।’

প্রিয়াকে দেখেই চমকে ওঠে নীলাদ্রি। ‘কী হল এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায়, চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন? কেঁদেছ নাকি? কার ফোন এসেছিল?

নীলাদ্রির প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারে না নীলাদ্রি। খানিকবাদে প্রিয়া নিজেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘জানো, বাবা আবার বিয়ে করেছে!’

অবিন্যস্ত, অগোছালো, বেদনাতুর প্রিয়াকে দেখেই নীলাদ্রি বুঝে গিয়েছিল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সুতরাং বৃষ্টি তো নামারই ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পরিস্থিতি সামলাতে ইয়ার্কির ছলে নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘সেকি বাবা বিয়ে করেছেন? এই বয়েসে? তা আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন না কেন?’

রেগেমেগে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘সবটাতে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। ভেবে দেখেছ এরপর লোকের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’

পরিস্থিতি হালকা করতে হাসতে হাসতে নীলাদ্রি বলে, ‘না দ্যাখো, সাদা চুলে টোপর পরে বাবাকে কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগাটা কি অন্যায় বলো? নাকি বাবা, বিয়ের আগে ডাই করেছিলেন কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না, জানলে না হয় একটু ফেসিয়াল, টেসিয়াল…’

নীলাদ্রির কথা শোনামাত্রই আরও জোরে কেঁদে ওঠে প্রিয়া।

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সরি, বাবা আর ইয়ার্কি করব না, কিন্তু দ্যাখো ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে তখন মেনে নেওয়াটাই কি…’

নীলাদ্রির কথার ইঙ্গিত বুঝেই একপ্রকার গর্জে ওঠে প্রিয়া। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ এই বলে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।

ভাবগতিক খারাপ দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রিয়ার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায় নীলাদ্রি। নিজেও তার পাশে বসে তার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তুমি এখন কী চাইছ?’

নীলাদ্রির এই স্নেহস্নিগ্ধ আচরণে প্রিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। একটু শান্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বলো বাবা এটা কী করল? একবারও আমার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এসব জানলে শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে আমি কতটা হাস্যকর হয়ে উঠব। শুধু তাই নয় বাবা যে দেখাত মার মৃত্যুর পরেও বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, বাবার পৃথিবী নাকি মায়ের স্মৃতি জুড়েই, তাহলে সবই লোক দেখানো, মিথ্যে!’

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, ‘তুমি তো জানো আমি ওদের কতটা ভালোবাসি। আমার বিয়ের পর আমি কতটা চিন্তায় থাকতাম। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব বাবাকে একা হাতে সামলাতে হতো। প্রথমে বাবাকে হেল্প করার মতো কেউ ছিল না। ভাইয়ের পক্ষে তো নিজেরটাই নিজের সামলানো সম্ভব নয়। কাজেই সবসময় ওদের জন্য চিন্তা হতো। তারপর পাশের বাড়ির রমামাসি ওদের গ্রাম থেকে মিনতিদিকে এনেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকে তো বাবাকে আর সংসারের দিকে তাকাতে হয়নি। তাহলে, আজ কেন এই ডিসিশন?’

কথার মধ্যেই নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘প্লিজ আর কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। একটু জল খাবে?’

একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করে প্রিয়া। ‘রোজকার মতো কালকেও দু’তিনবার ফোন করেছি বাবাকে। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, বাবা এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে চলেছে। শুধু বলেছিল পিসির সঙ্গে নাকি কী দরকার আছে তাই পিসির বাড়ি যাবে। বাবার মনে এই ছিল!’

কথা বলতে বলতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যায় নীলাদ্রির। রাত আড়াইটে বেজে গেছে দেখে নীলাদ্রি বলে, ‘প্রিয়া অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে মিষ্টুর ভ্যাকসিনের ডেট আছে। শুয়ে পড়ো প্লিজ। একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল না হয় যা হোক একটা…।’

মেয়ের কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রিয়া একটু স্থির হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। আমি জানব মার সঙ্গে সঙ্গে বাবাও এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’

কথাগুলি শুনে নীলাদ্রি বলে, ‘ছিঃ প্রিয়া, উনি না তোমার বাবা। আজ না হয় একটা তোমার অপছন্দের কাজ করেছেন, কিন্তু এতদিন তো তাঁর কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করে এসেছেন। সম্পর্ক রাখবে না মনে হলে রেখো না, কিন্তু এরকম বাজে কথা বোলো না। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’

নীলাদ্রি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত প্রিয়া দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে এল। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির সকলে যে-যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর, ভাসুর অফিস যাবার জন্য আর শাশুড়ি, বড়ো-জা তাদের টিফিন, খেয়ে যাওয়ার রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অন্যান্য দিন প্রিয়াও তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগায়, কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার জন্য আজ তার হেঁশেল থেকে ছুটি। তাই সকালে প্রিয়াকে কারওরই মুখোমুখি হতে হল না।

তবে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও শ্বাশুড়ি স্নিগ্ধাদেবীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না প্রিয়া। ক্ষণিকের দেখাতেই তিনি প্রিয়ার চোখ-মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণবন্ত, ফুটফুটে ছোটোবউমাটির কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত শ্বাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও প্রিয়া আর তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক ব্যতিক্রমীই বলা যেতে পারে। স্নিগ্ধাদেবীর কোনও মেয়ে না থাকার কারণে তিনি তাঁর দুই বউকেই মেয়ের মতো ভালোবাসেন, তবে ছোটোবউমা প্রিয়াকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। ছটফটে, মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটির, শাশুড়ির মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। আর এই কারণেই বড়ো-জা সহেলির প্রচ্ছন্ন রাগও আছে। তবে সেটা মনে মনে। এমনিতে প্রিয়া আর বড়ো-জায়ের মধ্যে বেশ মিল, তবে মাঝেমধ্যে সংসারের নিয়মে যেমন ঘটি-বাটি ঠোকাঠুকি হয়, তেমনি আর কী। কিন্তু সেটা কোনওদিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছোয় না।

ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াকে চুপচাপ দেখে বড়ো-জা সহেলি তাকে ডেকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ আছিস যে!’

একটু চুপ থেকে প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কই কিছু হয়নি তো, মাথাটা একটু ধরেছে এই যা।’

দুপুরবেলাতেও খাবার টেবিলে একই জিনিস, যে প্রিয়া একমুহূর্ত বকবক না করে থাকতে পারে না, সেই প্রিয়া এত শান্ত, অথচ আজ আবার নীলাদ্রিও বাড়িতে। অফিস যায়নি। বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকে, খানিক বাদে বাদেই শাশুড়ির কাছে ছুটে যায় স্বামীর বিরূদ্ধে নালিশ করতে। আজ হঠাৎ করে তার স্বভাবে এতটা পরিবর্তন সত্যিই বাড়ির লোকের কাছে বিস্ময়কর বই-কি।

খাওয়া শেষ হতেই স্নিগ্ধাদেবী ছোটোছেলে আর বউমাকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বল তো তোদের কী হয়েছে রে? দ্যাখ সহেলির মতো আমাকে বোঝাতে যাস না। তোকে পেটে ধরেছি, আর ওকে পেটে না ধরলেও ওর শিরা-উপশিরা সব চিনি। কী হয়েছে বলে ফেল।’

ছলছলে চোখে মাথা হেঁট করে বসে থাকে প্রিয়া।

খানিক চুপ থেকে নীলাদ্রি বলে, ‘মা, ওর বাবা কাল হঠাৎ বিয়ে করে বসেছেন। তাই…।’

স্নিগ্ধাদেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বউমা, তোমার রাগ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একবার বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে দ্যাখো তো, বাড়িতে বিকলাঙ্গ ছেলে, যে নিজেরটুকু নিজে করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তার উপর অফিস, এই বয়সে একটা মানুষের পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? এতদিন তুমি ছিলে, দুজনে মিলে কোনওরকমে পরিস্থিতি সামলেছ, কিন্তু এখন তুমি নেই…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই জল ভর্তি চোখে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘কিন্তু মিনতিদি তো আছে!’

‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু সে তো আদপে একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু নয়। তার উপর তুমিই তো বলতে, ইদানীং মিনতি মাঝেমাঝেই ছুটি নেয়। তাহলে সেই অবস্থাতে তিনি অফিস সামালাবেন না ঘর সামলাবেন। বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মুখের সামনে যে কেউ একগ্লাস জল ধরবে, সেরকমও কেউ নেই। তিনিও তো একটা মানুষ। চোখের সামনে অমন সমর্থ ছেলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই… এমন অবস্থায় তারও তো মনের দুটো কথা বলার লোক চাই। আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ওনার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত, যে তোমার বাবা-ভাইকে দেখাশোনা করার মতো একজন লোক এসেছে।’

শাশুড়ির কথায় খানিকটা হলেও মন হালকা হয় প্রিয়ার। গত দেড় দিনের ধকলে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়া।

এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। বহুবার চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন করে উঠতে পারেনি প্রিয়া, নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে।

হঠাৎ একদিন বিকালে বড়োপিসির আগমন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই বড়োপিসিকে দেখে বেশ অবাকই হল প্রিয়া। হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট আর ব্যাগ।

‘কিরে ভিতরে আসতে বলবি না?’

মনে মনে রাগ থাকলেও বলে, ‘হ্যাঁ এসো।’

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়ে বলে, ‘নে এগুলো, তোর জন্যই এনেছি।’

‘আমার জন্য? কী এগুলো।’ প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় পিসির দিকে। মনে মনে ভাবে আর যাই হোক বড়োপিসি তার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবে না। ছোটোপিসি হলেও না হয়…। পিসির হঠাৎ এই দরদের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই, পিসি যেই ব্যাগটা থেকে নারকেলনাড়ু বার করেছিল সেই ব্যাগটার উপর নজর যায় প্রিয়ার। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ সে ঠিকই ধরেছে। এই ব্যাগটাতেই তো তার বাবা দোকান-বাজার করে। এটা থেকে প্রিয়া যেন তার বাবার গায়ের গন্ধ পেল। উৎসুক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তো বাবার ব্যাগ পিসি, তাহলে কি বাবাও এসেছে?’

‘হ্যাঁ এসেছে তো। কিন্তু তোর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে। এই সমস্ত জিনিস তো তোর নতুন মা-ই পাঠিয়েছে তোর জন্য। তোর বাবা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছে রে।’

মা-বাবা দুজনেই বাইরে অপেক্ষা করছিল।

পিসির কথা শুনে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে দরজার দিকে ছুটে যায় প্রিয়া।

মেয়েকে দেখামাত্রই মেয়ের দিকে অপরাধীর মতো এগিয়ে এসে নরেনবাবু বলেন, ‘আমায় ক্ষমা করে দিস মা, আমি তোর অপরাধী।’

এ ক’দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে বাবার চেহারাটা। প্রিয়ার মনে হয় বাবাও যেন এক দুর্নিবার মানসিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাগ নয়, এই মুহূর্তে ভারি মায়া হল প্রিয়ার। যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, তাতে যে-কোনও সময় কোনও ভারি অসুখে পড়তে পারে। কে দেখবে তখন বাবাকে। ভাবতে গিয়ে মনটা কেমন ভিজে যায়। বাবার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় প্রিয়া বলে, ‘না, বাবা এমন করে বোলো না। আমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছি, একবারও তোমাদের কথা ভাবিনি। ভাবিনি যে তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে।’

হঠাৎই প্রিয়া অনুভব করে পিঠে কারও একটা নরম হাতের স্পর্শ। ভারি মায়াময় সেই হাত। ঘুরে তাকাতেই এক বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধ চেহারার মহিলাকে দেখতে পায় প্রিয়া। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে মহিলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া আমি সোমলতা। আমি জানি, তোমার মায়ের জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না, ভরে দিতে পারব না তোমার মনে তাঁর অভাববোধ। কিন্তু দুটো অচেনা মানুষ, মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্ধুও কী হতে পারে না? হবে আমার বন্ধু?’

প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে যায়। কোনও কথা সরছে না মুখে। কিন্তু সোমলতার আন্তরিকতা তাকে কোথাও যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সমাজ আর সংস্কারে বাঁধা পড়া মনটা যেন শিকল ভেঙে বেরোতে চায়। বাবা ছোটো থেকেই তার আদর্শ ছিল, মানুষটা ব্যতিক্রমী বলে। আজ সেই বাবাকেই যেন আবার ফিরে পায় প্রিয়া।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব