বেঙ্গালুরু থেকে সুলগ্না বিএসসি নার্সিং পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছে। বহুকষ্ট স্বীকার করে, প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে সে কোনওরকমে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বছর দশের আগে পরিস্থিতি এতখানি খারাপ ছিল না। সুলগ্নার বাবা প্রভাসবাবু আমেদাবাদে একটা টেক্সাইল মিলে কাজ করতেন। তাঁর ভালো উপার্জন ছিল। সুলগ্নার মা সুনীতা সুনিপুণ হাতে সংসার চালাতেন।
সুলগ্নার বাড়িতে একটা জায়গা কমজোরি ছিল তার বড়ো দিদিকে নিয়ে। বড়ো দিদি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। হুইল চেয়ারে বসেই সে সাতাশ বছর কাটিয়ে দিল। তবু সেই ব্যাপারে সুলগ্নার বাবা-মা-র কোনও আক্ষেপ অথবা কোনও অনুতাপ ছিল না। তাঁদের একটা মানসিক কষ্ট ছিল। বাবা-মা ভাবতেন যে, তাঁরা মারা গেলে তাঁদের মেয়েকে কে দেখবে। বড়ো মেয়ে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো হলে তাঁদের আর ভাবতে হতো না। আর্থিক সচ্ছলতা অনেক কমজোরিকে অতিক্রম করার সাহস জোগায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
প্রভাসবাবুর উপার্জনের টাকায় সংসারের চাকা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল। সুলগ্নার এগারো ক্লাসে পড়ার সময় হঠাৎই তার পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। প্রভাসবাবু দুর্গাপুজোয় ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। তাঁর এক পা কাটা যায় ও মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। বহু ডাক্তার দেখিয়ে, বহু অর্থ ব্যয় করে প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলেন না। সংসারের মোড় ঘুরতে লাগল।
প্রভাসবাবুর শারীরিক অবনতি ও আর্থিক দুরবস্থা সদাহাস্যমুখী সুনীতার চরিত্রের পরিবর্তন করে দিল। ভাগ্যের উপর দোষারোপ করতে করতে তাঁর মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। তিনি দুই মেয়ের সঙ্গে কোনও সময় ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতেন না। কারণে-অকারণে মায়ের মুখঝামটা খেতে খেতে দিন কাটত সুলগ্নার ও তার দিদির। সময়ের স্রোতে ভেসে কোনওরকমে উচ্চমাধ্যমিক পাশ হল সুলগ্নার। তাকে খুঁজতে হল স্বল্প সময়ের মধ্যে ভালো রোজগারের পথ।
রোজগারের পথ দেখালেন সুনীতার এক বন্ধু। তিনি সুনীতাকে পরামর্শ দিলেন মেয়েকে বিএসসি নার্সিং পড়ানোর। তিনি সুনীতাকে এই ভরসাও দিলেন যে, পাশ করার পর সুলগ্না যে-কোনও সরকারি অথবা বেসরকারি হাসপাতালে অনায়াসে চাকরি পাবে। সুনীতা তাঁর বিয়ের গহনা বন্ধক দিয়ে সুলগ্নাকে বেঙ্গালুরু পাঠিয়ে দিলেন বিএসসি নার্সিং পড়তে।
দেখতে দেখতে বেঙ্গালুরু থেকে সাত বছর হয়ে গেল সুলগ্নার ফিরতে। নার্সিং পড়া শেষ হওয়ার তিন মাস পরেই বেঙ্গালুরুর এক নামী বেসরকারি হাসপাতালে তার চাকরির সুযোগ আসে। সংসারের হাল ধরার জন্য সে চাকরিতে যোগ দেয়। তিন বছর হল তার চাকরি জীবন। বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে সুলগ্না টোটো ধরে তার বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে।
বাড়ি ফেরার পথে অপ্রত্যাশিত ভাবে রাস্তায় শিশির কাকার সঙ্গে তার দেখা হয়। তাকে একই টোটো-তে দেখে কিছুটা ভয়ে কেঁচোর মতো কুঁচকে যায় সুলগ্না। সে একপলক শিশির কাকাকে দেখে চোখ নামিয়ে নেয়। কুড়ি মিনিট এক টোটোতে যেতে হবে ভেবে সে ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নেয়। বড়ো ফ্রেমের রোদ চশমায় সে চোখ ঢাকে। শিশির কাকা বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে মাথাটা নাড়িয়ে টোটো চালককে বলল— ‘এ ভাই তাড়াতাড়ি চল।’
শিশির কাকা এবং সুলগ্না ব্যতীত একে একে যে-যার গন্তব্যস্থানে নেমে গেল কিছুক্ষণ পরেই। দশ মিনিট পর সুলগ্নাও নেমে টোটোচালককে বলল— ‘দাদা, টাকাটা ধরুন।’ শিশির কাকার সুখটানে হঠাৎ ছেদ পড়ল চেনা কণ্ঠস্বরে। বিড়ির শেষাংশ হাত থেকে ফেলে খ্যাকখ্যাঁক করে হেসে সে বলল – “আরে সুলগ্না তুই! কতদিন পর দেখলাম। বাড়ি এলি বুঝি। আমিও নেমে যাই। বাকি পথ হেঁটেই ফিরব।” শিশির কাকা টোটোচালকের হাতে টাকা দিয়ে তাকে বিদায় দিল।
সুলগ্না হনহন করে হাঁটছিল। শিশির কাকা বলল— এত তাড়া কিসের তোর! আমি তোর বাবার বন্ধু। বয়স তোর বাবার মতো। এত জোরে হাঁটলে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলি ক্যামনে!’
সুলগ্না বলল, ‘মা বাড়িতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করবে।’
শিশির কাকা বলল— ‘তোর মায়ের অপেক্ষাটাই দেখলি শুধু! আমার অপেক্ষাটা দেখলি না। এতগুলো বছর তোকে দেখিনি। চিন্তা তো আমারও হয়। তুই চলে যাবার পর আমি তোদের বাড়িমুখো হইনি। স্মৃতি বয়ে একা পড়ে আছি জগৎ সংসারে।’
সুলগ্না বলল— ‘কাকা, আমার এসব কথা শোনার সময় নেই। আমি আমার পরিবার ছাড়া অন্য কারও কথা মনেও রাখি না।” শিশির কাকা তার সর্পিল লকলকে জিভ দিয়ে দুটো ঠোঁট চেটে বলল – “আচ্ছা, তোর পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে নেই। আমার তো তোর গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ, তোর স্পর্শ সব মনে আছে। হাওয়ায় ভাসে জানিস সব পুরোনো গন্ধগুলো। দেখবি এখুনি আমি বলতে পারব তোর গায়ে কোথায় কোথায় কতগুলো তিল আছে।’
সুলগ্না বিরক্তির সুরে বলল– ‘তুমি কী মানুষ কাকা! ছি!”
শিশির কাকা বলল— ‘মানুষ না অমানুষ সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমার একটা বড়ো মন আছে। যে মনে আমি সব পূর্বস্মৃতিকে জায়গা দিয়েছি।’
কথা না বাড়িয়ে শিশির কাকার মুখের উপর সুলগ্না বাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শিশির কাকা উচ্চৈঃস্বরে হাঁক পেড়ে বলল— ‘আসব একদিন তোর হাতের চা খেতে।’
সুলগ্নার মা তাকে দেখে দাওয়া থেকে ছুটে উঠোনে এসে বললেন— ‘এসেছিস! আমি ভাবছি ট্রেন বোধহয় দেরি করেছে। তোর মুখ চোখ এমন কেন! কী হয়েছে! সদর দরজা বন্ধ করলি কেন ওভাবে?”
সুলগ্না বলল— “কিছু না মা। চলো ঘরে। কেমন আছো তুমি? বাবা-দিদি কেমন আছে?’
সুনীতা হতাশ সুরে বলল – ‘আমি আর কেমন থাকব তোর অক্ষম বাবা-দিদিকে নিয়ে! তুই যে টাকা পাঠাস সেটা দিয়ে চিকিৎসা তো চলছে। উন্নতির কোনও লক্ষণ নেই। কপালে আর কী লেখা আছে কে জানে।’
সুলগ্না মায়ের মেজাজ ঠিক করার জন্য বলল— “মা, কতদিন তোমার হাতের রান্না খাইনি। আজ জমিয়ে রান্না করো। আমি বাবা আর দিদির সঙ্গে দেখা করে আসি।’
সুনীতা বলল— “ঠিক আছে। তাই হবে। হাত মুখ ধুয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করে আয়।”
সুলগ্না হাত মুখ ধুয়ে বাবার কাছে এল। শয্যাশায়ী বাবা করুণ দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়েছিল। খাটের পাশে হুইল চেয়ারে দিদি বসে ঝিমুচ্ছিল। সুলগ্নাকে দেখে হুইল চেয়ারটা কিছুটা এগিয়ে এনে তার বাকশক্তিহীন দিদি হাস্যমুখে গোঁয়ানির স্বরে ‘আ-আ-আ’ করে উঠল। সুলগ্নার হাতটা চেপে ধরে সে যেন কিছু বলার চেষ্টা করল। দিদির এলোমেলো রুক্ষ্ম চুল দুহাতে সরিয়ে সুলগ্না বলল— ‘ভালো আছিস দিদি?’ দিদির কাছে এই প্রশ্ন করা নিরর্থক সে জানে। দিদি তার প্রশ্নের উত্তরে শুধু ডান হাতটা নাড়াল। দিদির চোখ দুটো সুলগ্নাকে দেখে আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠল।
সুলগ্নার দিদির আওয়াজে প্রভাসবাবু সুলগ্নার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। সুলগ্না বাবার পায়ের কাছে বসে বলল- “বাবা, কেমন আছো? চিনতে পারছ আমাকে?’
প্রভাসবাবু অস্ফুট কণ্ঠে বললেন— ‘ভালো আছি। তোমাকে তো চিনলাম না। কে তুমি? কোথায় বাড়ি তোমার?’
সুলগ্নার দুচোখ জলে ভরে এল। বাবার বুকে মাথা রেখে বলল— ‘বাবা, তোমার মেয়েকে তুমি চিনতে পারছ না!” কথা বলতে বলতে সুলগ্না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে বলল – “বাবা, তোমার কি কিছু মনে পড়ে না। এই বাড়ি। তোমার নিজের তৈরি করা বাড়ি। মা-দিদি-আমার সঙ্গে কাটানো সময় তোমার কি কিছু মনে পড়ে না! মনে করো বাবা। মনে করার চেষ্টা করো।’
প্রভাসবাবু খেঁকিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন— “না আমার কিছু মনে নেই। কেন আমাকে সবাই বিরক্ত করছ দিনরাত? তোমাদের কাউকে আমি চিনি না।’ একটা স্মৃতিবিস্মিত মানুষের কাছে কিছু মনে করানো যে কত চাপের সুলগ্না বুঝতে পারল।
সুনীতা ঘরে এসে বললেন— ‘দেখলি তো আমি কত ভালো আছি! নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটা আজ তার স্ত্রী সন্তানদের মনে করতে পারে না। চিনতেই পারে না কাউকে।’ সুলগ্না কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরল। সুনীতা মেয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন— ‘কাঁদিস না। ভাগ্যটাই খারাপ আমাদের।’
রাত্রে সুলগ্না মায়ের কাছে শোওয়ার পর তার ফোনের রিং বেজে উঠল। সুনীতা পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। সুলগ্না ফোন রিসিভ করে বলল— ‘আরে বাবা, আমি বাড়ি এসেছি। এত ঘন ঘন ফোন কোরো না। আমি কবে ফিরব বলতে পারছি না।’
ফোনের ওপার থেকে পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল— ‘তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না। চিন্তা হয় খুব। তুমি ভালো করে জানো। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।’
সুলগ্না বলল— ‘ঠিক আছে। আমি খুব শিগগিরি তোমার কাছে ফিরব।’ ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল সুলগ্না।
সুনীতা মেয়েকে প্রশ্ন করলেন— ‘ছেলেটা কে? কী সম্পর্ক তোদের?”
সুলগ্না একটু চমকে উঠল। সে বলল— “তুমি জেগে আছো মা !”
সুনীতা বললেন— ‘যার মাথার উপর এত দায়িত্ব তার কি নিশ্চিন্তে ঘুম হওয়ার জো আছে! সুলগ্না চুপ করে গেল। সুনীতা মেয়েকে পুনরায় একই প্রশ্ন করলেন।
সুলগ্না না বোঝার ভান করে বলল— ‘কোন ছেলেটা?”
সুনীতা বললেন— ‘যার সঙ্গে একটু আগে ফোনে কথা বলছিলি। আমি তোর মা। আমাকে আড়াল করে কোনও কাজ করলে আমি ঠিকই জানতে পারব। মাকে কিছু লুকাতে নেই।”
সুলগ্না একটু ঢোক গিলে বলল— “মা, ওর নাম অর্পণ। আমরা একই হসপিটালে চাকরি করি। অর্পণ ওই হসপিটালে প্রায় দশ বছর চাকরি করছে। ওর বাবা-মা পাঁচ বছর হল মারা গেছে। আমাকে খুব ভালোবাসে। আমাদের সম্পর্ক দু’বছরের। বেঙ্গালুরুতে ওর নিজের ফ্ল্যাট আছে।’
সুনীতা সুলগ্নাকে জড়িয়ে ধরে বললেন— ‘তোর ভুল হচ্ছে না তো কোনও! অর্পণ তোকে সত্যিই ভালোবাসে তো? কেন জানি না ভালো কিছু শুনলেও আজকাল বিশ্বাস করতে কেমন ভয় হয়। কিছু শুরু হলেই মনে হয় কোনও অঘটনের সূচনা।’
—অর্পণ ভালো ছেলে। ও আমাকে ঠকাবে না। এইটুকু বলতে পারি। ও তো যে কোনও দিন রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে রাজি। আমি বাধা দেওয়ায় সেটা হচ্ছে না।
—রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করলেই তো ভালো ছেলে তা প্রমাণ হয় না। নিজের জীবনটা বড়ো অগোছালো হওয়ায় আতঙ্ক হয় তোর জীবন নিয়েও। একটা ভুল মানুষের সবকিছু বদলে দিতে পারে। ধরে নিলাম তোর কথা মতো অর্পণ ভালো ছেলে। তা বিয়েতে কেন তুই বাধা দিচ্ছিস?