কুড়ি পাতা দীর্ঘ আট পরিচ্ছদের গল্পটার ফোটোকপির বদলে হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নেওয়ায় মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল। তবে আনন্দও হচ্ছিল। লিটিল ম্যাগাজিন হলেও, এই প্রথম কেউ বাড়ি বয়ে এসে লেখা চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাও শারদ সংখ্যার জন্য। তখন কি ঘুণাক্ষরে আঁচ পেয়েছিল, এই অমল চক্রবর্তীই পুজোর পর শ্রীতমা ফোন করলে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাবে না এবং বিরাটাকার গল্পটা ‘পরিব্রাজক’-এর দফতরে না পৌঁছে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হতচ্ছাড়া নির্ঘাত অন্যত্র নিজের নামে ছাপিয়েছে।
আর একটা সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুপ্রেম। অমলের পরম বান্ধব মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের সাথে শ্রীতমার একটা মনোমালিন্য হয়েছিল। এমন তস্করবৃত্তির প্রেরণা নিজের যশলোভ, না বন্ধুর প্রতিশোধস্পৃহা কে জানে। বন্ধুটি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সঞ্চালক, সংগঠক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। সাড়ে ষাট হাজার শব্দের একটা স্বাস্থ্যকর সুপুষ্ট গল্প তার কাজে লাগবে বেশি। অবশ্য সবটাই অনুমান। হতেই পারে শ্রীতমাকে খানিকটা হয়রান করে মজা পাওয়াটাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। তারপর থেকে কাউকে লেখা দিলে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু লেখা চাইলে দেবে না এত হুপো দেখানোর জায়গায় পৗঁছোয়নি শ্রীতমা। তাছাড়া বড়ো পত্রিকায় লেখাগুলো পড়া হয় কিনা, তাই নিয়েও সংশয় থাকে। তাই বিশ্বাস করতেই হয় কাউকে না কাউকে। যেমন এখন করছে গৌরব পাত্র নামে এক মাঝবয়সি লেখককে এবং দেবপ্রিয় দামকে।
দেবপ্রিয় দামের প্রযোজনা সংস্থায় শ্রীতমা যোগাযোগ করেছিল কন্যা ও নিজের মডেলিং-এর জন্য। সে সব কিছু না হলেও শ্রীতমার একটি কবিতার বই কিনেছিল দেবপ্রিয়। সেখান থেকেই বইটা পড়ে অমল চক্রবর্তী, শ্রীতমার কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়। সেই সূত্রেই অমলের পত্রিকা ‘পরিব্রাজক’এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু ছড়া ও কবিতা দিয়ে। অমলের বন্ধু হিসাবেই আলাপ মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। আলাপ থেকে প্রলাপ। প্রলাপের পর বিলাপ। এক সময় – শ্রীতমার তখন একুশ, কারও সাথে অ্যাফেয়ার আছে শুধু এই গুজবটুকুর জন্য ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা পূর্ণতা পায়নি। সঙ্কল্প সরে গিয়েছিল নীরবে। আজ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে সে বিবাহিতা এবং এক সন্তানের জননী – এগুলোও অধুনার প্রেমপ্রার্থীদের নিরস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এক নাছোড়বান্দা ছোকরাকে তো রুঢ়ভাবেই কাটাতে হয়েছে, কারণ ভালো ব্যবহার প্রশয় দেওয়ার সমার্থক হয়ে যাচ্ছিল। সমাজ এতটাই বদলেছে যে নিজেকে সেকেলে লাগে। অবশ্য তলিয়ে দেখলে আধুনিকতার বুলি আসলে আদিম রিপুর ছদ্মবেশ।
মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ ওর চেয়ে বছর দুই তিন বড়োই, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে পড়ে না। তবে আঁতেল সমাজে নাম লেখানো ব্যাটাছেলেদের ছোঁকছোঁকানির লাইসেন্স থাকে। প্রথম আলাপ অমল চক্রবর্তীর সাথে শ্রীতমার ফ্ল্যাটে ‘পরিব্রাজক’ সঙ্গে এনে। এক কাপ চা-ও স্পর্শ করেনি। দুর্দান্ত গরমে শরবত দিতে চাইলে বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘ওসব মেয়েলি ড্রিংক’। পরে শ্রীতমাও বার কয়েক রহড়ায় ওর বাড়ির আড্ডায় গিয়েছিল। ক্রমশ ফোনে কথা হলে শ্রীতমাকে মদ্যপান ও চুম্বনের ওপর থিসিস শোনানো শুরু করে।
ধরা যাক মৃত্যুঞ্জয় শ্রীতমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছে শুনে শ্রীতমা ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘তাহলে দেখা করে যান।’ প্রশ্ন এসেছে, ‘গেলে কী খাওয়াবেন?’
‘আগে খবর দিয়ে এলে আয়োজন রাখতাম। এখন না হয় চা পান করবেন টা সহযোগে। শরবত মেয়েলি পানীয় হতে পারে, কিন্তু চা তো দেখেছি আপনি ঘন ঘন খান।’
‘ধুর মশাই, আপনার কাছে গেলে চা খাব কেন? অন্য জিনিস চাই।’
বিব্রত করেই আনন্দ। সত্যি সত্যি এসে হানা দেয়নি কোনও দিন শ্রীতমাকে বাড়িতে একা পেতে।
শ্রীতমার কবিতার বই হাতে পেয়ে ক্যাটকেটে তির্যক মন্তব্য করলেও একটা দায়সারা প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দিয়েছিল। সেটা কোথাও ছাপেনি, শংসাপত্রের মতো নিজেরই সংগ্রহে রাখতে হয়েছে। শ্রীতমার একখানা কবিতাও চেয়ে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেটা চটপট ছেপে বেরোনোর পর ফোন করে বলে, ‘আপনার বইয়ের রিভিউ লেখা হল, কবিতা ছাপা হল, আমার তো কিছু প্রাপ্য হয়।’
চড়াক করে মাথায় রক্ত উঠলেও ইঙ্গিতটা উপেক্ষা করতে হল, উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে।
‘আপনার লেখা তো আমার পাঠানোর অপেক্ষা রাখে না। তবে আপনার বইয়ের রিভিউ আমাকে দিয়ে করাতে চাইলে করতে পারি।’
‘আপনার ভাষায় বলি, আমি হালুম করলাম। পাওনাটাও সেই মতো হয়।’
আর ন্যাকা সেজে থাকা সম্ভব নয়। পরের দিন দুপুরে একটা বার্তা পাঠায় মুঠোফোন থেকে, ‘আপনার সহযোগিতার দাম দিতে না পারায় আমি দুঃখিত।’
সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি কল। ঝাড়া পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে বক্তৃতা উপদেশের বন্যা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ যা করে, মনে ধান্দা নিয়ে নয়। সে যে রসিকতা করেছে সেগুলো আদি রসাত্মক হতে পারে কিন্তু তাতে নাকি যৗনতা নেই। কথাটার মাথা-মুণ্ড বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নও করল না শ্রীতমা। লোকটা দর্পিত ভাবে নিজের চরিত্রের সাফাই দিয়ে গেল– ‘সঙ্গ পেলাম না বলে অন্যদের মতো আপনার লেখা প্রকাশে ব্যাগড়াও দেব না। আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতই বা দূর? সেরকম মতলব থাকলে তো বাড়িতেই যেতে পারতাম। আপনাকে একা পাওয়া কি অসুবিধার ছিল?’… ইত্যাদি। শেষে যোগ করল, ‘কিন্তু ভেবে দেখুন আপনি যদি এটুকুও না নিতে পারেন, তা হলে লোকে আপনার জন্য করবে কেন?’
অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়ে সেদিন আমতা আমতা করে গিয়েছে শ্রীতমা। ঘণিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েও এমন কথা ঘোরাল যেন শ্রীতমার চিন্তাটাই অপরিচ্ছন্ন। জবাব খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কি এই ভয়টাও কাজ করেছিল, প্রভাব খাটিয়ে যদি শ্রীতমার সদ্য তৈরি হওয়া লেখার জায়গাগুলো নষ্ট করে দেয়? ফোন রাখার পর জুতসই জবাবটা মনে মনে সাজানো গেল, ‘আপনার অশালীন রসিকতা বরদাস্ত করে আমায় এগোতে হবে না, নিজের কলমের জোরেই যত দূর পারি যাব।’ আগেও বলবে ভেবেছিল,বলেনি। এবারেও শুনেই গেল। একতরফা।
এর কদিন পরেই তার বন্ধুটি পুজো সংখ্যার জন্য কবিতা নয়, ঐ বড়োসড়ো গল্পটা যাকে নভেলেটও বলা যায়, নিয়ে গিয়েছিল। পুজোর আগে পর্যন্ত ফোন করলে বলেছে, ‘আপনার কপি আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।’ কিন্তু পরে যখন অন্য সূত্রে শ্রীতমা পত্রিকাটির শারদ-সংখ্যা প্রকাশের খবর পেল, তখন অমল চক্রবর্তী ফোনের টাওয়ার পাওয়া ছেড়ে দিল।’ ‘হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছি না’ পরিব্রাজকের প্রধান সম্পাদককে ফোন করে প্রশ্ন করায় সে তো আকাশ থেকে পড়ল। এমন কোনও লেখা তাদের দফতরে জমাই পড়েনি। বিশুদ্ধ হাপিশ! অন্য কোথাও অন্য কোনও শিরোনামে, স্থান-কাল-পাত্র বদলে, লেখকের নাম বদলে প্রকাশিত হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখা হয়নি। এর পেছনে তার চুম্বন রসিক বন্ধুর কোনও ইন্ধন ছিল কিনা সেটাও প্রমাণিত নয়।
তবে ব্যাপারটা শ্রীতমা, দেবপ্রিয়কে জানায়। মনে হয় দেবপ্রিয় একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। শ্রীতমাকে মডেল বা অভিনেত্রী হিসাবে না হলেও লেখিকা হিসাবে পথ খুলে দেওয়ার ব্যক্তিগত রাস্তাগুলো দেখছিল। অন্তত ব্যাপারটা শ্রীতমার কাছে এমনই। সেই সাথে শ্রীতমার প্রতি মানুষটার একটা আলগা ভালোলাগা যে কাজ করছে, সেটা টের পেলেও তেমন আপত্তিকর বলে মনে হয়নি। শ্রীতমাকে অপমান করেনি, ছুতোনাতায় গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেনি, রুঢ় ব্যবহারও করেনি। বস্তুত দেবপ্রিয় ফোন করলে শ্রীতমা খুশিই হয়। গলাটা বেশ আশ্বাস জাগানো।
‘হ্যালো। শ্রীতমা বলছি।’
‘আরে গুড মর্নিং। কী খবর বলুন?’
‘খবর নিতেই তো ফোন করা। ওই লেখাগুলোর কোনও গতি হয়েছে?’
‘সুখবরটা আমিই জানাতাম। তার আগেই আপনার ফোন এল। ‘পিঁপড়ের রানি’ গল্পটা বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিলাম। সুরেন্দ্র নস্কর নামে আমার এক বন্ধুরও লেখা পাঠিয়েছিলাম। ওরা সুরেন্দ্রর কবিতাটা নিয়ে খুঁতখুঁত করছে, কিন্তু আপনার গল্পটা পড়েই পছন্দ করেছে। তা দেখা কবে হচ্ছে?’
‘যবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব।’
‘আরে, সুন্দরী নায়িকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটাই তো সৌভাগ্যের। কাল, না কাল একটা কাজ আছে, পরশু আসুন। আছেন কেমন বলুন। কেমন ঘুরলেন?’
‘আমার যে শনি-রবি ছাড়া বেরোনোর উপায় নেই। তাও চূর্ণীর বাবা অফিস গেলে হয়ে গেল। জানেন তো মা বাবাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মায়ের অ্যাক্সিডেন্টে হিপজয়েন্ট ভেঙে যায়। নড়াচড়া অসম্ভব। ট্রাভেল এজেন্টকে যা দেওয়া হয়েছে, তা তো ফেরত হলই না, কাশ্মীরের কোথাও কিছু না দেখে কাটরায় বাড়তি হোটেল ভাড়া গুণে ফেরার দিন পর্যন্ত বসে রইলাম। কী ভাবে যে একটা গাড়ি নিয়ে জম্মু এসে ফেরার ট্রেনে উঠেছি, তা ভাবলে এখনও অবাক লাগে…!’
‘কেন, বিকেলে কী অসুবিধা?’ লোকটা মায়ের অত বড়ো দুর্ঘটনার কথা শুনেও গ্রাহ্য করল না। শ্রীতমার কথা শেষ করতে না দিয়ে এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বলছে দেখা করতে!
‘দুপুর সোয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে চূর্ণী স্কুল থেকে ফেরে। ওকে নাইয়ে খাইয়ে সব সারতে বিকেল সোয়া তিনটে ছাড়িয়ে যায়। মেয়েকে কার জিম্মা করে যাব? যাঁর দায়িত্বে রেখে বেরোতাম, তিনি তো নিজে পাশও ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ আয়া আছে, আছে। তারপর বাকি সময়টা আয়া তো আমিই। খড়দা থেকে বেহালা শখের বাজার– একটুখানি রাস্তা তো নয়। চূর্ণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারি, কিন্তু ও টায়ার্ড থাকে। ওর কোনও কাজ হলে না হয় কষ্ট দেওয়া যেত। তিন চারটে ট্রান্সপোর্ট চেঞ্জ করে বেহালা যেতেই হয়তো ছ’টা বেজে যাবে। ফিরতে–’
‘আরে, বাচ্চা আনলে আপনার সাথে অভিসারটা হয় কী করে? আজ পর্যন্ত ঠিকমতো প্রেমালাপটাই তো হল না। চলে আসুন সময় করে।’
শ্রীতমা এবার হোঁচট খেল। ভদ্রলোক তাকে অনেকবার সুন্দরী বলেছে। চূর্ণী অর্থাৎ কাজু সম্পর্কেও প্রথম বার উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেখে যেহেতু কন্যার মডেলিং-এর উদ্দেশ্যেই যোগাযোগ, তাই রূপের প্রশংসাটা শংসাপত্র হিসাবেই নিয়েছে বরাবর। শ্রীতমাকে সংস্কার ত্যাগ করে তথাকথিত সাহসী হবার প্রস্তাব দিলেও ব্যবহারের মধ্যে এমন এক মার্জিত ভাব থাকে, যে অসভ্যতা মনে হয় না। আসলে মনে হলে চলবেও না। আলগোছে এড়িয়ে না চটিয়ে যদি সখ্যতা বজায় রাখা যায়। রূপের জন্য দরাজ সার্টিফিকেট দিলেও এবং একাধিক বিজ্ঞাপনের জন্য অফিসে ডেকে বিস্তর আলাপ আলোচনা করলেও আজ পর্যন্ত মা মেয়ে কাউকেই কাজ করায়নি। কেবল শ্রীতমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাগ্রহে কিনে নিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই। সেই সূত্রেই পরিব্রাজক এবং জোচ্চুরি কাণ্ড।
চমক সামলে হেসে উঠল শ্রীতমা, ‘দূর মশাই, আমার প্রেমে পড়লে কি অমল চক্রবর্তীর মতো তস্করের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন? ভয়েস ওভার করার মতো মেল ভয়েস কি নেই বাজারে?’
‘অমলের সঙ্গে অনেকদিন পর কাল যোগাযোগ হল। ওই ফোন করেছিল।’
‘আমার গল্পটার খোঁজ নিয়েছেন?’
‘না, না। সেসব কথা হয়নি। সে এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানান ডক্যুমেন্ট্রিতে কমেন্ট্রি করে।’
‘বাঃ! চুরির পুরস্কার? ভালো। ওই যে ডোর বেল বাজছে। মেয়ে চলে এসেছে। দেখছেন, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে নীচেই নামা হয়নি। বেচারা ভারী ব্যাগ নিয়ে একাই উঠে এসেছে। ঠিক আছে…’
দরজা খুলে মেয়েকে ঢুকিয়ে নিল শ্রীতমা। ‘রাখছি এখন। চূর্ণীর জন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে দেখুন না। মেয়েটাকে যে দেখে অটো-অটো করে। কিন্তু কোনও কাজই মেটিরিয়ালাইজ করছে না।’
‘ওকেও লাগবে আর একটা অ্যাডে। আগে আপনাকে কাস্ট করি। নেচার কিওরের অ্যাডে আপনাকে লাগতে পারে।’
‘আচ্ছা। ওকে খাওয়াতে হবে। পরে কথা হবে।’
‘আমি কল ব্যাক করব? ধরুন এক ঘণ্টা পরে?’
‘করুন। রাখছি। বাই।’
‘কার ফোন?’ মায়ের গলা। শোবার ঘর থেকে। এসি চালাতে হয়েছে বলে দরজা বন্ধ থাকার কথা। এখন দেখছে খোলা। বোধ হয় বাবা খুলে এসেছে।
সুন্দর মুখের জয় নাকি সর্বত্র। কিন্তু শ্রীতমার ক্ষেত্রে তো বিড়ম্বনা। ওর লেখা যারা পছন্দ করে অথবা যারা করে না, প্রায় সব পুরুষ কবি লেখকই, শ্রীতমা সৌন্দর্যের খাতিরে সুবিধা পাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করতে ছাড়ে না। শ্রীতমার কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রায় নিঃশেষিত, সবটাই যদিও নিজে ফেরি করে। সেটা নাকি ওর মুখ দেখে, কবিতার গুণে নয়। এমন মন্তব্য কবি নির্মল সমাদ্দারের মতো বরিষ্ঠ মানুষেরও, যাঁর স্নেহ-ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক স্তাবক প্রতিপালিত। নির্মলকাকু যথেষ্ট সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গাত্রদাহ কীসের? ওঁর পারিষদবর্গ কুড়ি বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনে ঘষ্টেও বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে, নাকি শ্রীতমা কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখিয়ে হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বলে? কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় গল্প বার হওয়ার কথা জানলেই অভিনন্দন জানাতে গিয়েও বেশির ভাগ কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বয়ং কবিতার বইয়ের প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তোমার বই বি ডাবল ও কে – বুক দেখে বিক্রি হয়নি, হয়েছে বয় হ্রস্ব-উ ক – দেখে।’ মাথাটার ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও না বোঝার ভান করতে হয়।
শ্রীতমার হাবেভাবে মাঝেমাঝে একটু অপরিণত মনস্কতা ফুটে ওঠে। নিজেও বুঝতে পারে। কাউকে তোয়াজ করে না, বরং একটু অসহিষ্ণু, কিন্তু লেখার জন্য ব্যকুলতা গোপন থাকে না। এটাই কি অপমানের আমন্ত্রক? এ যাবৎ দেবপ্রিয় দামকে তো হিতৈষী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ কথাবার্তায় এমন লাগাম ছাড়া ভাবগতিক? এর সাথেও সম্পর্ক টিঁকলে হয়। দেবপ্রিয় চেয়েছিল বলেই কয়েকটা লেখার ফোটোকপি দিয়ে এসেছিল, সেখান থেকেই একখানা ‘বাল্যবন্ধু’-তে প্রকাশিতব্য। গল্পটা সন্ধ্যাতারাতেও মনোনীত, কিন্তু কত বছর পরে ছাপবে কেউ জানে না। ‘বাল্যবন্ধু’ টাকা না দিলেও চটপট বার করে দেবে। এই অবস্থায় দেবপ্রিয়কে অসন্তুষ্ট না করাই মঙ্গল।
সারা দিন নানা কাজের ব্যস্ততা, রাতে আয়ার বদলে নাইট ডিউটি। ব্যস্ততার মধ্যেও খচ্খচানিটা বিঁধে রইল। রাত বারোটায় ফোন।
‘বলুন।’
‘বড্ড অসময়ে ফোন করলাম না? কথা বলা যাবে?’
‘এতক্ষণে আপনার এক ঘণ্টা হল? অসময় তো বটেই, বলুন।’
‘নাথিং স্পেসিফিক। ওই নেচার কিওরের অ্যাডটার ব্যাপারে আপনাকে একবার আসতে হবে। পেমেন্ট বেশি নয়। হাজার টাকা। ডাবিংও করতে হবে। ডায়ালগ আছে। ওরাই শিখিয়ে দেবে। এমন কিছু নয়। আপনার আবার উইক-ডে-তে প্রবলেম। একটু দুপুর করেও যদি আসতে পারতেন। ঠিক আছে শনিবারেই আসুন।’
‘বেশ কয়েকবার তো দেখলেন। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত মেটিরিয়ালাইজ করল না। আবার বেকার দৌড়াদৗড়ি না হয়। তাছাড়া শনিবার কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে কয়েকজনকে লেখা দিতে হবে।’
‘কখন যাবেন?’
‘বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছোতে হবে।’
‘তার আগেই আমার সাথে দেখা করে যান না। কাজটা ফেলে রাখতে চাই না। আর আপনাকেও অনেক দিন দেখিনি।’
শ্রীতমা নিরুত্তর।
‘কিছু বলছেন না যে।’
‘শনিবার আসুক, দেখব।’
‘শনিবার তো কাজের কথা হবে। একটু অকাজের কথাও তো হওয়া দরকার। আমার তো আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা ইনোসেন্স আর সেক্স অ্যাপিলের দারুণ কম্বিনেশন। আর এখন কাশ্মীর থেকে ফিরে কাশ্মীর কি কলি হয়েছেন কিনা দেখতে আরও ইচ্ছা করছে।’
‘আপনার কি মনে নেই যে আমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কাশ্মীর ঘোরাই হয়নি? তাছাড়া শর্মিলার তখন বয়স ছিল ষোলো সতেরো। আমি এখন চল্লিশ। এই ভুঁড়িদার চেহারা আপনার ফ্যান্টাসির সাথে মিলবে না।’
শ্রীতমা ওপাশে কোমরতলি ভাঙা মায়ের দিকে তাকাল। এখনও ঘুমোয়নি। মেয়েটাও দিদা আর মায়ের মাঝখানে শুয়ে উশখুশ করছে। ওর গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েই বিপত্তি। জানলাহীন বসার ঘরে উদ্ভব মশা তাড়ানো তরল জ্বালিয়ে শুয়ে আছে। এমনিতে মশারি ছাড়া শুতেই চায় না। ফ্ল্যাটের একমাত্র বাতানুকুল ঘরখানা শাশুড়ির জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে কষ্ট করছে। মাকে গাড়িতে তোলা নামানো ছাড়াও বাথরুম ইত্যাদির ব্যাপারেও যেভাবে শ্রীতমাকে সাহায্য করেছে, নিজের ছেলেও পারে না। কলকাতায় ফিরে অবধি তার বিশ্রাম নেই। গাড়ি অ্যাম্বুল্যান্স দৌড়াদৌড়ি তো আছেই, জটিল অপারেশনের অনেকটা খরচই আপাতত উদ্ভব দিয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসা বিমার টাকা না পেলে ফেরত নেবে না পণ করে আছে। সারা দিন অফিস ডাক্তার ওষুধ-পত্র করে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে বসে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই ঘরের বাতাস ওর নাকের গর্জনে মন্দ্রিত হতে থাকে। মেয়ে বাবাকে পাশে না পেয়ে ঘুমোবে না বলে একদিন এই গরমের মধ্যেই বসার ঘরের সরু ডিভানে পাশে শুয়ে উদ্ভবকে সারা রাত এক কাতে রেখেছিল। আর শ্রীতমা! অসুস্থ মাকে আর মেয়েকে পাশে নিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে মাঝরাতে পরপুরুষের সঙ্গে হেজাচ্ছে? কীসের জন্য? ক্যামেরার সামনে আসার তাগিদটা তো মরেই গেছে, তবু সুযোগ এলে না করতে পারে না বলে? নাকি তার লেখা কবিতা গল্পগুলো যাতে মাঝপথে হারিয়ে না যায়, সেই দুর্ভাবনায়? ওর তো এক্ষুনি ফোন কেটে দেওয়া উচিত। মায়ের নাক বিরতি দিয়ে ডাকছে। কাজু চুপচাপ শুয়ে। উদ্ভবের নাকের শব্দ মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘর থেকে আসা সেই আওয়াজ শ্রীতমাকে কিছুটা আশ্বস্তর সাথে অনেকটা অপরাধবোধে বিক্ষত করছে।
‘কোথায় ভুঁড়ি? ওটুকু না থাকলে তো আইটেম গার্লদের বাজার পড়ে যেত। ওই পেটের নাভিতে চুমু খাওয়াতেই তো মজা।’
‘হোয়াট? আর ইউ ড্রাংক?’ গলাটা চড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে গলা নামিয়ে আনল শ্রীতমা। ‘এরকম সর্বনেশে ইচ্ছা হলে তো আপনার সাথে দেখা করাই চলবে না। রাখছি।’
‘এতেই সর্বনাশ বললে কী করে হয়? একটু ইনহিবিশন ত্যাগ করে দেখুন, আপনারও ভালো লাগবে। আর আমি ড্রিংক করি না। যা বলছি পরিষ্কার মাথাতেই বলছি।’
‘পরে কথা হবে গুড নাইট।’
‘গুড নাইট। শনিবার আসার আগে ফোন করে নেবেন। দেখি বাল্যবন্ধু যদি ছাপায় তাহলে জানাব।’
বালিশের ফাঁকে চলভাষ ঢোকানোর পর মায়ের প্রশ্ন, ‘কার ফোন তপা?’
‘আমার কয়েকটা লেখা আছে এর কাছে। আসলে প্রযোজক। আবার হোটেলও আছে শঙ্করপুরে। এখনও পর্যন্ত তোমার নাতনিকে বা আমাকে কোনও কাজ দেয়নি। তবে কয়েকটা পত্রিকায় যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রে আমার একটা ছোটোদের গল্প বাল্যবন্ধুতে পাঠিয়েছিল। শুনছি এ মাসেই বেরোবে।’
‘এত রাতে ফোন করে কী এত বকছিল?’
‘আমার মতো বেকার তো নয়। সারা দিন ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত। শুটিং-ফুটিংও থাকে। কখনও কখনও সারা রাতই হয়তো জেগে থাকতে হয়।’
মনটা আবার খচ্খচ্ করছে। লোকটা বলল শনিবার যাওয়ার আগে ফোন করতে। তাছাড়া আগে বলেছিল ‘বাল্যবন্ধু’-তে গল্প বেরোচ্ছেই। এখন ‘যদি’ যোগ করল কেন? এভাবে ‘গুড নাইট’ বলে ফোন কেটে দেওয়া কি ঠিক হল? মৃত্যুঞ্জয়ের উপদেশ মনে পড়ল। সামান্য রসিকতাও যদি না নিতে পারে তাহলে লোকে আনস্পোর্টিং ভেবে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেবে। দেবপ্রিয়র মতো একজন হিতৈষীর রসিকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানানোটা কি ঠিক হল? নির্ঘাত রসিকতাই। লোকটার বউ আছে, ছেলে আছে। আর অমন ডাকসাইটে প্রযোজক চাইলেই অনেক অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে। হয়তো শ্রীতমার জন্য সত্যিই একটু কোমল জায়গা আছে, অমলের জোচ্চুরির জন্য একটা সংকোচবোধও আছে। কলকাতায় ফিরে এসে শ্রীতমাই তো ফোন করে জানল যে দেবপ্রিয় তার লেখা পাঠিয়েছে যেটা ছাপতেও চলেছে। লোকটা তো পাওনা গণ্ডার হিসাব বুঝে নিয়ে কাজটা করেনি। আজ সকালে শ্রীতমা ফোন না করলে এখন এতসব কথা হতোই না। প্রার্থী যদি তেজ দেখায়, তাহলে ‘নিশ্চিত’ প্রকাশিত হচ্ছেগুলো ‘যদি তবে’র গেরোয় পড়ে যাবে। মাথার বালিশের পাশ থেকে মোবাইল তুলে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে একটা ‘স্পোর্টিং’ বার্তা পাঠাল, ‘সর্বনেশে কথা শুনতে মন্দ লাগে না, যদি সেগুলো কথার জায়গাতেই থাকে।’
মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরতি দুটো বার্তা। টুংটাং টুংটাং। ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আনজনে, আমার আঙুলের আর ঠোঁটের আদর রইল ওই বুকে আর নাভিতে। যদি এসএমএস করার থাকে এক্খুনি করুন। সকালে ফোন সুইচ অন করার পর আর কারও চোখে পড়লে অসুবিধা আছে।’
কান-মাথা গরম হয়ে গেল। শ্রীতমার চলভাষ সারা রাত জাগ্রত থাকে। যা কোনওদিন করে না, তাই করল আজ– সুইচ অফ।
‘কাকে মেসেজ করলে মা?’ কাজু জেগে আছে!
সত্যিই কি শ্রীতমার এই লোকটার সাহায্য দরকার? সে ‘সন্ধ্যাতারা’য় যেসব গল্প ও ছড়া দিয়ে এসেছিল, সেগুলোর মধ্যে দুটো মনোনীত হবার চিঠি পেয়েছে জমা দেওয়ার এগারো মাস পরে। তার পরেও সাত মাস পেরোল। পত্রিকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে আরও অন্তত বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পটাও মনোনীত জানল তখন, যখন সেটা অন্যত্র প্রকাশ পেতে চলেছে। এখন সন্ধ্যাতারার ভরসায় বাল্যবন্ধু থেকে গল্পটা তুলেও নেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু এইটুকুর জন্য মাত্রা ছাড়ানো, মুখোশ খোলা পুরুষটাকে টুইয়ে চলা? ছিঃ!
কিন্তু কিছু প্রাপ্তির জন্য একটু উদার হওয়ার অভিনয় কি খুব দোষের? গত দু বছরে এইভাবে শ্রীতমা অনেককেই শত্রু করেছে। তাদের ক্ষেত্রে সরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তারা আগেই নিজেদের পাওনাটা আদায়ের তালে থাকত। দেবপ্রিয় কি একটু ব্যতিক্রম নয়? এই লোকটাকে যে ভালো মানুষ বলে শ্রীতমা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একটা নির্ভরতাও তৈরি হচ্ছে। এই সময় সব কিছু একদিনের ফোনের বাচালতায় নষ্ট করে ফেলতে হবে? নিশ্চই দেবপ্রিয় দাম নিজের কাঁচা আবেগ দেখিয়ে ফেলার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো দেখা হলে ঘুণাক্ষরেও এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করবে না। ভিড়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজা পুরুষ যেমন আছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার মতো ভদ্রলোক কি ও দেখেনি ট্রেনে বাসে? কিন্তু….?
মা বোধহয় এখনই বেডপ্যান চাইবে। নড়ছে। মেয়ে কচি হাতে গলায় বেড় দিয়ে গায়ে পা চাপিয়ে বলল, ‘মা, তুমি শুধু গল্প লিখে যাও। আমায় বলো না।’
সকাল বেলা আয়া আসার আগে যথারীতি মাকে বেডপ্যান দিতে হল। শ্রীতমা দু জোড়া একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাভস্ বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে। একটা ও নিজে পরে আর একটা যে আয়া আসে তাকে দেয়। আয়া থাকলে রান্নার মেয়ের খুব একটা দরকার পড়ে না। একটু হাতে হাতে সাহায্য করলে নিজেই চালিয়ে নিতে পারে। তবু পুরোনো রান্নার মহিলা এসে টুকি দেওয়ায় হাতছাড়া করবে না বলে তাকেও বহাল করেছে এই বিপুল খরচের মধ্যে। উদ্ভবই বলেছে।
সকালে বর বেরিয়ে যেতে কম্পিউটারে বসেছে শ্রীতমা লেখা নিয়ে। মাঝে কয়েকদিন খুব উঠে পড়ে লেগেছিল মেয়ের মডেলিং কেরিয়ার গড়বে বলে। নিজেরও ছবি পাঠিয়েছে কয়েক জায়গায়। কেউ ঘরোয়া ছবি চায়, তো কেউ পোর্টফোলিও। বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় এখন সে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। এখন ও লেখালিখি নিয়েই ভাবতে চায়। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদক্ষেপে আপোস। মাঝারি পত্রিকাও ভাব করে যেন বিশাল কিছু। তারা কেউ লেখার শিরোনাম বদলে দেয় তো কেউ কবিতার পিণ্ডি চটকে প্রকাশ করে। কেউকেটা নয় বলে অপছন্দসই সম্পাদনাও মাথা পেতে নেয়। আর শ্রীতমার গল্পের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েও গৗরবদার যা মেজাজ। খোঁজ নিলেই বলেন, তাড়া থাকলে লেখা তুলে নাও।
শ্যামের বাঁশি। দেবপ্রিয় ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে।
‘তাহলে শনিবার আসছেন তো।’
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘ফোনটা ড্রিম শেয়ার করছে না দেবপ্রিয় করছে?’
‘দু জনেই। কাজ তো আছেই। প্রেমটাও আছে।’
‘….আসলে আমি একটা ট্রাভেলগ লিখছি। সিকিম ভ্রমণের ওপর। কাশ্মীর দর্শন তো রসাতলে গেল। লেখাটা রবিবারের মধ্যে শেষ করতে হবে, মানে শনিবার বেরোলে অসুবিধা–’
‘আচ্ছা, আপনি লেখার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, না? আমায় দেখতে ইচ্ছা করে না? আর আপনি কমিট করাতেই কিন্তু অ্যাডটা নিয়ে এগিয়েছি।’
লোকটা নিজের টপিক থেকে সরছে না। একটু চুপ করে থেকে শ্রীতমা বলল, ‘যেতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। কলেজ স্ট্রিটে যেতেই হবে।’
লেখার প্রবাহ ঝিমিয়ে গেল। যেচে বিপদ ডেকে আনছে না তো। উদ্ভবকে জানাতে হবে। একটা ছোটো পত্রিকায় শ্রীতমার খাতিরে দেবপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর উদ্ভব ঠাট্টা করেছিল, দেবপ্রিয় দামকে বিয়ে করলে তোমার বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু ইদানীং রাত বিরেতে ফোন এলে বিরক্তি চাপা থাকে না। এতদিন পরস্পরের অনুরাগী বা অনুরাগিনীদের নিয়ে দুজনে খোঁচাহীন নির্দোষ রসিকতাই করে এসেছে। মাঝে মাঝে শ্রীতমাই কপট সন্দহের ভান করে। বারো বছরের দাম্পত্যে কোনও দিন তৃতীয় ব্যক্তি বা সন্দেহের মতো বিষয় দানা বাঁধেনি। এখন সাহিত্যিক পরিচিতি লিপ্সার অপরাধে কি সিনেমা সিরিয়ালে এই বহু ব্যবহূত ক্লিশে বিষয়টার অনুপ্রবেশ ঘটছে? শ্রীতমার একটাই জোরের জায়গা সে বরকে কিছুই গোপন করে না। নিজের পুরোনো কিছু একতরফা অন্ভুূতির কথা লুকোয়নি। কেউ বিরক্ত করলে তো নয়ই। কিন্তু কিছু পাবার আশায় এভাবে? ঠিক পাওয়ার আশাও নয়, যেহেতু একটু সহযোগিতা পেয়েছে তাই সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও ভদ্রতায় বাধছে। নাঃ! পানি না ছুঁয়ে মাছ ধরার খেলা ওর জন্য নয়।
মা কিচ্ছু খাচ্ছে না। শরীর ভয়ানক দুর্বল। অন্যের হাতের রান্না পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই অনশনে শরীর আরও বিগড়োলে কে দায়িত্ব নেবে? বাবা? থাক, তার কথা না বলাই ভালো। একেই সারাটা দিন অস্বস্তি আর উশখুশানির মধ্যে কাটছে। দুপুরে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকাটা শ্রীতমার ভীষণ প্রিয় ব্যাপার। অনেক অশান্তি অতৃপ্তির উপশম ঘটে বুকের ওপর ছোট্ট হাতের স্পর্শে, পেটে তুলে দেওয়া আলতো পায়ের চাপে। আজ যে এতেও স্বস্তি হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আদর করল। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ‘বুজকু-বুজকু, মাম্মাম্ মাম্মাম্’ গন্ধ নিল। তবুও না।
বাড়ির যা অবস্থা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বরের সঙ্গে দুটো কথা বলারও অবকাশ ঘটছে না। ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট-রিপোর্ট, মেডিক্লেম, আয়া, ঝি, রাঁধুনি এসবের ফাঁকে কাজুর পড়া, ইউনিট টেস্ট, উদ্ভবের অফিসে আবার ট্রান্সফারের গুঞ্জন। বেশ হয় কলকাতার বাইরে বদলি হলে। যে নগরটিকে নিজের কেরিয়ার, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য একদা গন্তব্য আর বর্তমানে আশ্রয় করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। লেখালিখির জগতে সেরা রাজনীতিকরা বিরাজমান। পৃষ্ঠ দংশন, লেঙ্গি মারা, ঈর্ষা, হরেক কিসিমের নোংরামি। এসবের মধ্যে টিঁকে থাকার চামড়া বা কৗশল কোনওটাই শ্রীতমার নেই। আবার এমন বিরাট মাপের প্রতিভাও ও নয়, যে পর্বত সরিয়ে জায়গা করে নেবে। আর এত দৌড়েই বা কী হবে? পারবে সুনীল, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রাদের মতো বছরে ডজন ডজন গল্প, সাত আটখানা করে উপন্যাস, ছোটোদের গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে, যদি তেমন বরাত পায়ও? আসলে পারবে না ভাবলেই কান্না পায়।
উদ্ভব আজকাল শ্রীতমার দেহের ভাষা খেয়াল করে না। একটা ভালো মতো চটকাই মটকাই দিলেই পাগলি বউটা শান্ত হয়ে যায়, ভালো করেই জানে। তবু কেন যে না দেখার ভান করছে? আগে বউয়ের সামান্যতম ভাবান্তরও ওর নজর এড়াত না। কোনও দিন কোনও কথায় আহত হলে শ্রীতমা যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, ও যে রাগ করে আছে এটা ইঙ্গিতেও প্রকাশ করতে হতো না। এখন ওর চূড়ান্ত অস্থিরতা, বিরক্তি কোনওটাই যেন চোখে পড়ছে না। উদ্ভবের মতো মানুষ বছরের পর বছর পারে নিস্পৃহ থাকতে। শ্রীতমা এগিয়ে না গেলে এমনটাই চলতে থাকবে কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই। ঘুমের মধ্যে কখনও স্ত্রী-র ঘনিষ্ঠ হবার অনীহা প্রকাশ পেলে মাসের পর মাস আর কাছে আসে না। এখন তো বাড়ি ভর্তি মানুষ। পালানোর অনেক পরিসর। কিন্তু শ্রীতমার যে আদর ছাড়াও আশ্রয় দরকার এই সংকটে।
উদ্ভব অফিস থেকে ফিরেছে। মাকে আজকাল ডিভানে খানিকটা ঠেকের ব্যবস্থা করে দিলে সন্ধে বেলায় টিভি দেখতে পারে। বাবার দখলে রিমোট থাকে। তাই নিয়ে এক দিকে স্ত্রী আর এক দিকে নাতনিকে যুঝে চলে। গ্লোকোমা আক্রান্ত চোখ দিয়ে একটা মানুষ এত টিভিই বা দেখে কী করে, আর এত বই-ই বা পড়ে কী করে? শ্রীতমা বরকে ছোটো ঘরটায় ডাকল, ‘শোনো।’
‘কী?’
‘তুমি তো এখন আমার সাথে কথা বলার সময়ই পাও না। গলা ধরে এল।’
উদ্ভবের ভাবান্তর নেই।
‘ওই দেবপ্রিয় দাম। …এতদিন তো বেশ নিঃস্বার্থ হিতৈষীই মনে হচ্ছিল। এখন দুটো লেখা দুটো পত্রিকায় পাঠিয়েই গলার সুর বদলে গেছে। তাও তো রবিবারের ‘হট্টমেলা’ থেকে পরমার্থ সেনের কাছে ঠোক্বর খেয়ে তো ছড়াটা বাউন্সই করেছে। ‘বাল্যবন্ধু’-তে’ পাঠানো গল্পটাও এখন দেনা পাওনায় আটকে যেতে পারে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নেমে এল।
‘পৃথিবীতে একশো জনের মধ্যে নববইজন পুরুষ মেয়েদের একই রকম নজরে দেখে। তুমি যদি বোকা সেজে থাকো আমার কী করার আছে? তুমি কম্প্রোমাইজ করে লেখিকা হতে চাও না নিজের জোরে, সেটা নিজেই ঠিক করবে।’
‘একটা অ্যাডে কাস্ট করার কথাও বলছিল।’
‘তাহলে আর কী? যা ইচ্ছা করো। যে লোক রাত সাড়ে বারোটার সময় কোনও ভদ্রমহিলাকে ফোন করে গ্যাঁজায়, সে কী ধরনের মানুষ তা যদি তুমি এই চল্লিশ বছরেও না বোঝ, তাহলে কিছু বলার নেই।’
‘সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ফিল্ম লাইনের লোক। সারা রাত জেগে থাকাটাও স্বাভাবিক।’
‘তাহলে আমায় প্রশ্ন করছ কেন?’
‘আর কাকে করব?’
‘আমার উত্তর তো আমি দিয়েই দিয়েছি। জাস্ট যোগাযোগ রাখবে না। নম্বরটাই ডিলিট করে দাও। ফোন এলে রিসিভ কোরো না।’
‘বলছিল এই জুনেই বাল্যবন্ধু-তে বেরোবে। অন্য দিকে ‘সন্ধ্যাতারা’য় লেখা জমা দেওয়ার এক বছর পর চিঠিতে কনফার্ম করার পরেও সাত মাস পেরিয়ে গেল। শুনছি পুজো পর্যন্ত সব সংখ্যা তৈরি। তারপর ভূত-স্পেশাল। কবে আমার গল্প বেরোবে কোনও ঠিক নেই। লিটল ম্যাগগুলোতেও দলাদলি। ‘দিনকাল’-এ যে আমার গল্প ছাপল অজস্র ভুল করে, সেন্টেন্সগুলো পর্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে গল্পের বারোটা বাজিয়ে। বড়ো পত্রিকা বলে ওরা চাইলেই আমি আবার লেখা দিতে এক পায়ে খাড়া– এটা কম্প্রোমাইজ নয়? তাই এই লোকটাকে চটাতে পারছি না। লেখার কয়েকটা জায়গা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েন্শিয়াল…’
উদ্ভব উত্তর না দিয়ে স্নানঘরে চলে গেল।
শনিবার কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে বাস ধরল। ট্রেন জার্নিটা ভিড়ের জন্য এড়াতেই চায়। তাছাড়া স্টেশনগুলোর চত্তরে বড়ো কটু গন্ধ। শহর ও শহরতলির সমস্ত রাস্তা ঘাটই অবশ্য পুরুষ মানুষের জল বিয়োগ ক্ষেত্র। এই গন্ধের জন্য হাঁটতে চলতে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে প্রাণায়াম করে যেতে হয়। সময় অনেক বেশি লাগলেও তাই বাসটাই ধরতে চায়। বেরোতে বেরোতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। এখন বেহালা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ফোন।
‘আসছেন তো?’
‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। সামনের সপ্তাহে না হয় উইক ডে দেখেই সময় করে যাব।’
‘নেচার কিওয়ের অ্যাডটাও তো ফাইনাল করা দরকার। পরের শনি নয়তো রবি শ্যুটিং। আজই ফাইনাল করে নিতাম।’
‘আ..চ্ছা। আমার কিন্তু দেরি হবে। আর যখন পৌঁছোব, তখন বসার সময় বেশি থাকবে না।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মিনিট পনেরো থেকে আধ ঘণ্টার ডিসকাশন।’
‘আপনার অ্যাড দেওয়া ‘ক্রমাগত’টাও অবশ্য সঙ্গে রয়েছে।’
‘ওটা এমন কিছু না। আপনি আসুন।’
দোনোমনো করে শ্যামবাজারে নেমে মেট্রো ধরল। কালীঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বদলে বা টানা বাস পেলে বেহালা শখের বাজার। আজ কফি হাউসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। একটা পত্রিকা হাতে পাওয়ার কথা, আর দুটোতে লেখা দেওয়ার। আর শনিবার গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। লেখার পরিসর বাড়তে পারে। নিছক আড্ডা মারতে যাওয়ার তাগিদ নেই। তাছাড়া ওই মাছের বাজারকে মাত দেওয়া শোরগোলে গলা তুলে কথা বলায় কোনও সুখ নেই। কেউ কেউ অবশ্য এজন্য শ্রীতমাকে ধান্দাবাজ ইঙ্গিত করে।
শখের বাজারে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয়। জেমস্ লং সরণি পেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গলির ভেতর হাঁটলে, তবে মহাশয়ের বাড়ি তথা দফতর। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ পেল। মোবাইল কোম্পানির বা অন্য কোনও প্রমোশনাল মেসেজ হতে পারে। দেখা হল না। জৈষ্ঠের আকাশে আলো ম্লান হয়নি তখনও। আধ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিটটাও ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করবে।
গেট দিয়ে ঢুকে লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দারোয়ানকে বলে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হয়। অফিসের রিসেপশনের মতো জায়গাটা ফাঁকাই দেখেছে এযাবত। ভেতরের ঘরে বসে মালিক। দারোয়ান দোতলার অফিসের বাইরের ঘরে শ্রীতমাকে বসিয়ে তিনতলা গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘স্যার চান করছেন। এক ঘণ্টা বসতে হবে।’
পাঁচবার ফোন করে ডেকে এনে এ কী রসিকতা! ফোন বার করে দেখল রাস্তায় আসা মেসেজটা দেবপ্রিয়ই করেছে। সেটা না পড়ে অসহিষ্ণু ভাবে ফোন করল। দূর! বাথরুমে গেলে কি মোবাইল ধরতে পারবে? অবশ্য বাড়ির লোক ধরতে পারে। কাটতে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে পরিচিত গলা, ‘হ্যালো। কোথায়?’
‘আপনার অফিসে। কিন্তু আমাকে ডেকে আপনি এখন কী করছেন?’
‘স্নান করছি। মিনিট পনেরো কুড়ি বসুন।’
‘আমার তাড়া আছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’
লাইন কেটে মেসেজটা পড়ল। ‘আজ আমার আঙুল আর ঠোঁট– আদরে পাগল করে দেবে ঠিক তো?’
চড়াং! কাজের দোহাই দিয়ে ডেকে এনে বাথরুম থেকে পরনারীকে এই বার্তা? এরপর বসে থাকার একটাই অর্থ হয়। তরতর করে নীচে গিয়ে দারোয়ানকে বলল শ্রীতমা, ‘আমায় বেরিয়ে যেতে হবে। একটা বই আপনার স্যারের জন্য রেখে যাচ্ছি। এক টুকরো কাগজ দিতে পারবেন? চিঠি লিখে দিয়ে যাব।’
কাঁপা হাতে নোটপ্যাডের পাতায় লিখল, ‘দেবপ্রিয়বাবু, আজ আমার পক্ষে অপেক্ষা করা আর সম্ভব হল না। ‘ক্রমাগত’র কপি রেখে গেলাম। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এসএমএসটা আমার সঙ্গে রইল।’
এর আগের বার্তাগুলো মুছে ফেলেছে। এটাকে না মুছে একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখবে। ভাগ্যিস লোকটা স্নানে ঢুকেছে। উর্দ্ধ্বশ্বাসে ছুটল ডায়মন্ড হারবার রোডের দিকে। বড়ো রাস্তায় পৗঁছেই একটা ডাবের খোলায় হোঁচট খেয়ে সপাটে আছাড়। সর্বনাশ! বাড়ির এই অবস্থায় ওরও কিছু হলে আর দেখতে হবে না। বাঁ হাতের কবজির ষন্ত্রণায় প্রথমটায় খেয়াল করেনি তালুটাও সামান্য ছড়ে গেছে।
সাড়ে ছটা। এখন আর কফিহাউস নয়। সোজা বাড়ি। সামনে যে বাস এল তাতেই চড়ে পড়ল। শিয়ালদা যাচ্ছে। ভালোই।
বাসে পরের স্টপেই জায়গা পেল মহিলা সিটে। তবে জানলার দিকে নয়। বসতে না বসতেই আবার চলভাষে সুরধবনি। কাঁপা হাতে ফোন ধরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন।’
‘কী বলি বলুন তো। কীভাবে স্যরি বলব?’
‘বলতে হবে না। শুধু বুঝুন বেকারদের সময়ও দামি। আর স্যরি যদি বলতেই হয়, আপনার মেসেজটার জন্য বলুন।’
‘মেসেজ মানে? ওহ্! হো হো হো! এই ব্যাপার? হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলেন? এতদিন তো…’
‘এতদিন কী? আপনার রসিকতাকে রসিকতা হিসাবেই দেখেছি।…’
‘এভাবে পৃথিবীর সাথে মানাবেন কী করে? সুমনের একটা গান আছে, …। আমার নিজেরও একটা কবিতা আছে, শুনবেন…’
‘…নিজের ই-ইল্লিসিট ইচ্ছাকে …র-র্যাশনালাইজ করার জন্য হাজারটা উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। আর নেচার কিওর অ্যাডটার জন্য বোধহয় আমাকে আর দরকার লাগবে না।’
‘ওটার জন্য তো আপনার সিলেকশন হয়েই আছে। আপনি এখন নিজে রাজি না থাকলে–’
‘প্রফেশনালি কাজ তো হবার নয়।’
‘আপনি চাইলেই হতে পারে।’
ছিছিঃ! শ্রীতমা এখনও লোকটার মুখের ওপর উচিত কথা না শুনিয়ে নিজেকে খেলো করে যাচ্ছে? নিজের লেখায় যে এত আপসহীন, এত সাহসী, এত অকপট, লেখাগুলোর প্রতি অপত্যস্নেহে সেই মানুষ এত দুর্বল? দেবপ্রিয় দামের কত বড়ো হাত?
‘চুপ করে আছেন যে?’
‘আপনার সঙ্গে এখনও কথা বলছি, ইজন্ট ইট স্ট্রেঞ্জ? সুরেন্দ্র নস্করের কাছেও কি একই এক্সপেক্টেশন রাখেন?’
কী জবাব এল বোঝা গেল না বাসের আওয়াজে। বোধহয় সুরেন্দ্র আর শ্রীতমা এক নয় সেটাই বোঝাতে চাইল।
‘ওই ভদ্রলোক আপনার বন্ধু। তিনি ভাগ্যবান। বিকজ ইউ আর নট আ গে আই থিংক। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারলেন না। গিভ এ্যান্ড টেক চলে এল। আমি দেখতে ভালো, এটা কি আমার দোষ?’
‘ও হো হো হো। আচ্ছা, আপনি সুন্দর কে বলেছে? কতজন বলেছে?’
মনে হল সপাটে গালে চড় পড়ল। দাঁত চিপে বলল, ‘অনেকেই। আর একজন মিথ্যুক তো অনেকবার বলেছে।
আবার হাসি, উপদেশ। খেলো মেলোড্রামা ভরা স্থূল বার্তা পাঠিয়ে এখন এমন ভাবে হাসছে যেন শ্রীতমার মতো অপরিণত মেয়ে আর হয় না। এখনও কেন লোকটাকে বাজে বকার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে? কেন গল্প, উপন্যাসের নায়িকাদের মতো, সিদ্ধান্তহীনতায় না ভোগা ঋজু চরিত্রের মানুষের মতো কড়া কথা বলে ফোন কেটে দিতে পারছে না? অ্যাড ফিল্ম না বাল্যবন্ধু পত্রিকা? দুটোই তো গেল। নাকি নিজের বোকার মতো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার মরিয়া চেষ্টা, বন্ধুত্বের লোভ?
কথা যখন শেষ হল তখন খেয়াল করল, তার ডান কাঁধে ভর দিয়ে তার গোপন অঙ্গটিকে একরকম শ্রীতমার কাঁধে চেপে ধরে জুত করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীতমা ফোন কেটে সচকিত হতেই জানোয়ারটা ঝট্ করে সরে গেল।
‘ইতর কোথাকার! কেটে ফেলতে হয়! বাসে কী এমন ভিড় যে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যায় না?’
ঘেন্নায় অপমানে উদ্গত অশ্রু সামলাতে গিয়ে গলা কন্কন্ করে উঠল। শ্রীতমা সত্যিই অপরিণত। তার বয়সি মহিলাদের সাথে বাসে ট্রেনে এমন বজ্জাতি করার সাহস চট্ করে দেখানো যায় না। ও একাই চেঁচিয়ে গেল। বাসে কেউ কিছু বলল না। কন্ডাক্টর বোবা।
দেবপ্রিয়র প্রতি আর কোনও বিদ্বেষ নেই। বাসের এই নরকের কীটটা দেবপ্রিয়র মতো বুকে পেটে চুমু খাওয়ার আবেদন করেনি। সুযোগ বুঝে নিজের নোংরা প্রত্যঙ্গটা ওর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। পোশাকের আবরণ সত্ত্বেও ঘেন্না আর রাগে গা রিরি করছে।
যে মানুষটা দু বছরের পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্রীতমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, হয়তো মতলবই করেছিল, সে তো স্নান করে পরিষ্কার হয়ে তৈরি হচ্ছিল অভিসারের জন্য। নৈতিকতার খাতিরে তার কাছ থেকে সব সহযোগিতার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে এসে ভাগ্যের কাছে কী প্রতিদান পেল?
অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসের জানলা দিয়ে ভেসে আসা উন্মুক্ত পুরুষ ইউরিনালের গা গোলানো দূষিত গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারছে অনুমতির তোয়াক্বা না করে।