১৫ বছরের তনিমা লেখাপড়ায় ভালো বলে স্কুলে নামডাক আছে। ক্লাস টেনের প্রি-বোর্ডের রেজাল্ট বেরোলে ও হতাশ হয়ে পড়ে। ওর আশা ছিল ৯৫ শতাংশের বেশি নম্বর পাবার। কিন্তু নম্বর কম হওয়ায় ওর চোখ জলে ভরে উঠেছিল বারবার, টিচার এবং মা-বাবার আশাপূরণ করতে পারেনি বলে। বাড়িতে এসে বাবার হাতে রেজাল্ট তুলে দিতে গিয়ে নিজের চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না তনিমা। বাবা মেয়েকে দেখে ভয় পেয়ে যান। রেজাল্ট খুলে দেখেন ৮৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছে মেয়ে। বাবা মেয়েকে কাছে বসিয়ে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ‘আরে কাঁদছিস কেন? আমি খুব খুশি হয়েছি তোর রেজাল্ট দেখে। যথেষ্ট ভালো নম্বর পেয়েছিস। আর ফাইনালের জন্য এখন থেকে পড়া আরম্ভ কর। নিশ্চয়ই মনের মতো নম্বর পাবিই পাবি, আমি বলে রাখছি। মিলিয়ে নিস আমার কথা। যা এখন মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’ বাবার সান্ত্বনা বাক্য তনিমার মনে নতুন আশার সঞ্চার করল। ও নিজের হারানো মনোবল ফিরে পেল।

‘মা, কেন তুমি শুধু শুধু বউদির কথায় দুঃখ পাচ্ছ। বউদি এই বাড়িতে নতুন এসেছে, তোমাকে এখনও ঠিকমতো চিনে উঠতে পারেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে বউদিকে সবকিছু শিখিয়ে নিতে পারবে। ওকে একটু সময় দাও দেখবে তোমার সঙ্গে বউদি ঠিক মিলেমিশে যাবে’, চন্দ্রার কথাগুলো এবং প্রশংসা ওর মা মিতালির হারানো বিশ্বাস নতুন করে আবার ফিরিয়ে দিয়েছিল।

এইসব পরিস্থিতিতেই, কারও প্রশংসা অথবা প্রশংসাযুক্ত কিছু কথা ব্যক্তির মধ্যে সাকারাত্মক বোধ জাগাতে সাহায্য করেছে। ছোটো বাচ্চাই হোক অথবা যুবক থেকে বয়স্ক, সকলের মনেই নিজের প্রশংসা শোনার সুপ্ত আকাঙক্ষা থাকেই। আপনজনের কাছ থেকে স্নেহভরা কিছু প্রশংসাবাক্য, মানুষের মনে ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে।

আধুনিক সুবিধা এবং প্রযুক্তির ভরসায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এর ফলে অনেক সময় জটিল পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং অবসাদ মানুষকে গ্রাস করছে। মানুষ নিরাশায় ডুবে যাচ্ছে। যদি কোনও কারণে কেউ মনের মতো কাজ না করতে পারল অথবা প্রচণ্ড পরিশ্রম করা সত্ত্বেও আশাতীত ফল পেল না, তাহলেও মানুষ জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। এই উদাসীনতাই বাড়তে বাড়তে অবসাদের রূপ নেয় এবং শেষপর্যন্ত মানুষকে আত্মহত্যা করতেও প্ররোচিত করে।

অবসাদ একবার যদি মানুষকে গ্রাস করে তাহলে জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ এবং চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ বদলে যায় মানুষের। মনে হয় জীবনের সমস্ত আনন্দ হঠাৎ যেন হারিয়ে গেছে, নৈরাশ্য ঘিরে ধরে অবসাদে পীড়িত মানুষকে। অবসাদগ্রস্ত মন, নেগেটিভ চিন্তাভাবনার সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে এবং পীড়িত মানুষটির আশেপাশে নৈরাশ্যের চাদর বিছিয়ে দেয়। অজানা ভয় মনকে গ্রাস করে। আশেপাশের আনন্দ তখন আর মনকে স্পর্শ করে না এবং নিজে থেকে কিছু করার আর সামর্থ্য থাকে না।

সকলেরই জীবনে একটা সময় আসে যখন মানুষ একাকিত্বে ভোগে। নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সেই সময় একটা প্রশংসাবাক্য মানুষের মনে আশার দীপ জ্বালাতে পারে। ভয় দূর করে মনকে আবার সতেজ করে তুলতে পারে।

অনেকেই মনে করেন, শুধুমাত্র প্রশংসার দরকার পড়ে বাচ্চাদেরই। কিন্তু আসলে বাচ্চা বা বয়স্ক, বিশেষ কোনও বয়সের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই। বরং সব বয়সের মানুষেরই প্রশংসার প্রয়োজন পড়ে। কারণ মানুষের বয়স বাড়তে থাকলেও, মানুষের মনের ভাবনা চিন্তার ধারা একই খাতে বইতে থাকে। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আমরা কিছুটা আমাদের ভাবনা-চিন্তাগুলোকে নিজেদের বশে রাখতে পারি। কিন্তু বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন মানুষ নিজেকে দুর্বল এবং স্বজনহারা মনে করতে শুরু করে, তখন যে-কারওরই তার উদ্দেশ্যে বলা দুটো প্রশংসাবাক্য তার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মনোবল, উদ্যম নতুন করে জাগিয়ে তুলতে পারে। ফলে অবসাদ গ্রাস করতে পারে না। দুর্বল মানসিক অবস্থায় মানুষ যখন অবসাদে ডুবে যেতে থাকে তখন সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আত্মহননের পথই একমাত্র উপায় বলে তাদের মনে হয়। সেই সময় পজিটিভ মতাদর্শে বিশ্বাসী কোনও মানুষের সংস্পর্শেই একমাত্র সে পারে আত্মহত্যা করার ভাবনা মন থকে ত্যাগ করতে।

বৈশাখী হাসিখুশি, আধুনিক চিন্তাধারার মেয়ে। তার চরিত্রের এই দিকটার সুযোগ নিয়ে, তারই কলেজের সহপাঠী অন্বেষ তার সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব করে এবং পরে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে। নিজেদের সম্পর্কটাকে মুঠোফোনে কামেরাবন্দি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেবে বলে বৈশাখীকে ব্ল্যাকমেল করা আরম্ভ করে। প্রাণবন্ত মেয়েটা ধীরে ধীরে অবসাদে ডুবে যেতে শুরু করে।

তার স্বভাবের এই পরিবর্তন ওর মায়ের চোখ এড়ায় না। তাঁর শত জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও সত্য ঘটনা কিছুতেই খুলে বলতে পারে না বৈশাখী। এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরে মা ওর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলা শুরু করেন, ওর মনে সাহস জোগাতে থাকেন। এমনকী মেয়ের মনে এমন বিশ্বাসও ঢুকিয়ে দেন যে মেয়ের জীবনে সমস্যা যাই আসুক না কেন, উনি সবসময় মেয়ের সঙ্গে থাকবেন।

মায়ের স্নেহে এবং মায়ের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে বৈশাখী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। পুরো ঘটনা মায়ের কাছে বিস্তারিত জানায় এবং এটাও স্বীকার করে যে এই বিশ্বাসঘাতকতার জাল ছিঁড়ে বেরোবার রাস্তা না পেয়ে ও মনে মনে আত্মহত্যার রাস্তাই বেছে নিচ্ছিল।

মেয়ের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখার ফলে বৈশাখীর মা সহজেই মেয়ের জীবনে আসা ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন এবং মেয়েকে আত্মহত্যা করার হাত থেকে বিরত করতে পেরেছিলেন। মেয়ের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে, অন্বেষের দোষ প্রমাণ করে ওর সাজার ব্যবস্থা করেন এবং মেয়েকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনতে পূর্ণ সহযোগিতা দেন।

সাইকায়াট্রিস্ট-দের মতে আজ ডিপ্রেশনের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে সাধারণ মানুষ এটাকে অসুখ বলে মানতেই চায় না। কিন্তু সমস্যা যদি জটিল হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত কারণ নয়তো অসুস্থতা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

আধুনিক জীবনের জটিলতা এবং সামাজিক ও আর্থিক সমস্যার কারণে মানুষ বেশি করে অবসাদের শিকার হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হচ্ছে, নিজের নিজের সমস্যা বোঝার জন্য দৃষ্টিকোণ বদলানো, আপনজনকে দুটো প্রশংসা বাক্য বলা এবং তাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। আমেরিকা এবং কানাডার মতো দেশে ৬ ফেব্রুয়ারি ‘প্রশংসা দিবস’ হিসেবেই পালন করা হয়। বাড়ি, অফিস, কর্মক্ষেত্র সবজায়গাতেই গ্রিটিং কার্ডস-এর আদানপ্রদান হয় এবং মৌখিক সৌজন্য দেখিয়ে থাকে ওখানকার মানুষ।

আমরাও কি পারি না প্রশংসার মাধ্যমে পরকে আপন করে নিতে, তার জীবনের সব সমস্যা, গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন জীবনের পথে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে?

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...