ঘড়িটাতে প্রায় নিভে যাওয়া টর্চের আলো ফেলতেই সুনন্দর একটা ঝটকা লাগল। অন্ধকারে এগারোটা বেজে গেছে। বাজবে না-ই বা কেন, সেই কতক্ষণ আগে সাড়ে দশটা দেখে গুটিগুটি পায়ে শেষ মোমবাতিখণ্ডটা জ্বালিয়ে, খাওয়া শেষ করেই নিভিয়ে দিয়েছে। কিছুটা গাফিলতি থেকেই ঘরে আর মোমবাতি কিনে রাখেনি। সেরকম দরকারও পড়েনি। কোনওদিন এই তিন বছরে দু পাঁচ মিনিটের জন্য কারেন্ট গেলেও সেটা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে নয়। কিন্তু গত রাতে ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পর, কত যে ইলেকট্রিকের পোল উপড়ে পড়েছে তার কোনও হিসেব নেই। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোথাও তার ছিঁড়েছে তো কোথাও গাছের ডাল বা আস্ত একটা গাছই পড়ে গেছে পোলে ।

সকালে স্কুলে যে যার খুশি মতো কারেন্টের কথা বলতে আরম্ভ করেছিল। তবে ইতিহাসের তাজমুল সাহেব একটু আশার কথা শোনাল, ‘ম্যাক্সিমাম কালকের দিন, কারেন্ট চলে আসবে, জোর কাজ হচ্ছে।’ সবাই শুনে বলে উঠল, ‘আপনার মুখে ফুল চন্দন পডুক।’ সুনন্দ কিছু মন্তব্য করেনি, যে বিষয় জানে না, সে বিষয়ে কোনও রকমের মন্তব্য করা থেকে সবসময় নিজেকে সরিয়ে রাখে। তাছাড়া মাত্র তিনবছর হল এখানে এসেছে। এখনও এখানকার ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে কোনও জ্ঞান হয়নি বলে নিজে মনে করে। কারেন্ট না থাকলেও অর্থদফতরের একটা বিশেষ বিজ্ঞপ্তির জন্য স্কুলের সবাই বারবার মোবাইলের নেট খুলেছে। সেখানে সুনন্দের মোবাইলটাও বাদ পড়েনি। বাড়িতেও মা, ঝুমা এমনকী বিটকুর সাথে কথাও বলেছে, সকালে সন্ধেবেলাতেও। ঝুমা কারেন্টের কথাও জিজ্ঞেস করেছে। আসেনি, শুনে বলেছে, ‘তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘সেটা এমনিতেই করতে হবে। যা দু-এক টুকরো মোমবাতি আছে তা দিয়ে কোনও রকমে খাওয়াটুকু হবে।’ সুনন্দ বলে।

ঝুমা প্রতিবারের মতো সেই একই রেকর্ড করা কিছু বুলি আউড়ে ফোন বন্ধ করে। সুনন্দ ফোনটা কাটবার সময় লক্ষ্য করে চার্জ শেষ। ইন্ডিকেটরটাও ব্রিম করছে। উপায় না দেখে ফোনটা পুরোপুরি বন্ধ করে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। মাঝে একবার উঠে মোম জ্বেলেই খান চার রুটি তৈরি করে দুধ গরম করে নেয়। তরকারি করতে আর ইচ্ছে করে না। আধপো দুধ, একটা মিষ্টি, তিনটে রুটি খাওয়া হয়ে যাবে। একটা বাড়তি করা থাকল। কোনদিন কীরকম খিদে থাকে। না হলে সকালে ভুলো তো আছেই। প্রতি সকালে গোপালদা দুধ দিতে আসার সময় ওটাও চলে আসে, লেজ নাড়ে। সুনন্দ রুটি, বিস্কুট কিছু একটা দিলে খেয়ে পালিয়ে যায়, পরের দিনের আগে আর ওর পাত্তা পাওয়া যায় না। এই বাড়িতে ভাড়া আসার মাস কয়েক পর থেকেই ভুলোর রুটিন মোটামুটি এই রকম। অবশ্য মাঝে কোনওসময় আর ঘুরতে আসে কিনা সুনন্দ জানে না। সারাদিন স্কুল, ফিরে সামনের লাইব্রেরিতে ছোটোখাটো একটা আড্ডা দিয়ে, রুটি তৈরি করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। বেশির ভাগ শুক্রবার বাড়ি চলে যায়, ফেরে হয় রবিবার রাতে না হয় সোমবার সকালে। এই প্রোগ্রাম বদল বলতে মাঝে মাঝে স্কুলের কোনও স্যার বা দিদিমণিদের বাড়িতে গেট টুগেদার, তাও সব সময় যায় না।

প্রথম প্রথম ভাড়ার এক কামরার এই ঘরটাও গিলে খেতে আসত। কোনওদিন বাবা-মাকে ছেড়ে একা থাকেনি। ভালো কাজ পেয়েও ভিন রাজ্যে যায়নি। তবে সব সময় তো সবকিছু নিজের মর্জি মতো হয় না। বাবা মারা গেল। সেই বছরই আবার স্কুলে চাকরি পেল। প্রথম বছরটা প্রতিদিন আড়াইশো কিলোমিটার আপ ডাউন যাতায়াত করে শরীরের কলকব্জা সব ঢিলে হতে আরম্ভ করল। তারপরেই স্কুলের কয়েকজন স্যার দিদিমণির পরামর্শে বাড়ি ভাড়া করে মাকে এনে রাখলেও, মায়ের শরীর মন কোনওটাই জায়গাটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারল না। অগত্যা আবার ডেলি-প্যাসেঞ্জারি। তারপরেই ঝুমা এল, এক বছরের মাথায় বিটকু। বিটকু জন্মাবার পরেও কয়েকটা মাস

ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে বাধ্য হয়ে স্কুলের কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিল, একটাই ঘর সঙ্গে বাথরুম। বাড়ি মালিকের সাথে দেখা হওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে ভাড়া দেওয়ার সময় প্রায় কান কামড়ে বলে দিয়েছিল, ‘সামনের স্কুলের মাস্টার তাই ঘরটা দিলাম, না হলে একা পুরুষ মানুষকে কোনওমতেই ঘর ভাড়া নয়।’ সুনন্দ কথাগুলো ঝুমাকে বলতেই সে কি হাসি। মজা করে বলে উঠল, ‘তাহলে আমি সব থেকে নিশ্চিন্ত, কিছু হলে ঠিক খবর পেয়ে যাব, ফোন নম্বরটা দিয়ে আসতে হবে।’

আবার বৃষ্টি নামল। সন্ধে থেকে একভাবে হয়ে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়ে আবার। মাঝে কয়েকটা ঘন্টা হুডুম হাডুম থাকলেও বৃষ্টিটা পড়েনি। সুনন্দ ঘরে চেয়ারে বসে বসে পাশে গোয়ালঘরের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার শব্দ শুনতে পেল। জানলার পর্দা টেনে মশারি খাটিয়ে শুতে যাবে, এমন সময় দরজার কড়া নাড়াবার শব্দ পেল। সুনন্দ প্রথমবার কোনও আমল না দিয়ে আগের মতোই শোওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগল। কিন্তু আবার শব্দটা পেতে চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। ঠিক বিপদে পড়লে কেউ কড়া নাড়লে যেমন শব্দ করে, তেমনি শব্দ।

চেষ্টা করেও মনের ভুল এটা নিজেকে বোঝাতে পারল না। দরজাটাও খুলতে সাহস হল না। কানের বা মনের কোনও ভুল নয় তো? তাও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। আবার সব চুপচাপ। অন্ধকার এখন আরও প্রকট। ঘরের ভিতরটা আরেকবার দেখে নিল। একটু গিয়ে দরজার উলটো দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করল। সেই অন্ধকার, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকানি। দরজার কড়াটা আবার নড়ে উঠল। সুনন্দ আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় ‘কে…?’ জিজ্ঞেস করতে ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি গলা শুনল, ‘একটু দরজাটা খুলবেন, খুব বিপদে পড়ে গেছি।’

মেয়ের গলা পেয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। মেয়েটিরও গলাতে শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির কাকুর কি কোনও বিপদ হল? বউদি এসেছে নাকি না, বউদি হলে তো নাম ধরে ডাকত। কিছুসময় দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, বাইরের কড়া নড়ে উঠল আবার।

আস্তে আস্তে দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘে ঢাকা। অন্ধকার রাত্রি চোখ দুটো আটকে দিল। কিছু বুঝতে পারল না। কিছু সময় পরেই একটা গলা শুনতে পেল, ‘ভিতরে আসব, বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে , দরজাটা ভালো ভাবে খুলুন।’

–আপনি কে, হঠাৎ আমার এ ঘরে তাও রাত্রিবেলা?

–সব পরে বলছি আপনি আগে দরজাটা খুলুন।

সুনন্দ দরজাটা ভালো ভাবে খুলে কিছু বলবার আগেই আগন্তুক ঘরের ভিতর সুনন্দকে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকে দরজার কাছে, সুনন্দের বিপরীতে বাঁদিক থেকে হাত পাঁচ দূরে দাঁড়িয়ে, বলে উঠল, ‘একটা গামছা টামছা কিছু দিতে পারবেন?’

সুনন্দের ঘোর তখনও কাটেনি। অন্ধকার হলেও চোখের সামনে দিয়ে একজন ভিতরে ঢুকল। রোগা নয় বোঝা গেল, সুনন্দের শরীরের সঙ্গে  হালকা ধাক্বা লাগল। চুড়িদার বা পাঞ্জাবি কিছু একটা পরে আছে।

আগন্তুকের পোশাকের জল গায়ে লাগার পরে দরজার ছিটকিনিটা তখনও না লাগিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল ,‘আপনি এভাবে ঘরে ঢুকে গেলেন?’

–দেখছেন না বাইরে কি অবস্থা!

–বাইরে এমন অবস্থা তো আমার বাড়িতে এলেন কেন? আর বাড়ি ছিল না?

–আসলে রাস্তার থেকে এই বাড়িটাই সামনে পেলাম, আলোও জ্বলছিল একটু আগে।

–আমি এ বাড়িতে একা থাকি।

–সেটা আমি বাইরে থেকে কীভাবে জানব?

–এবার তো জানলেন, তাহলে আসুন এবার। আমি আপনাকে পাশের বাড়ির বউদির কাছে দিয়ে আসছি।

–ভয় পাচ্ছেন? আপনার অতো ভয় কীসের?

–দিনকাল তো ভালো নয়।

–সে ভয় তো আমারও থাকবার কথা।

বাইরের বৃষ্টির ঝাপটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর আসছে দেখে মেয়েটি বলে উঠল, ‘দরজাটা লাগিয়ে দিন, জল আসছে।’ সুনন্দ বুঝল মেয়েটির কথাগুলো একটু স্বাভাবিক হয়েছে। একটু আগেই হাঁপাচ্ছিল।

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। সুনন্দ মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে না পাবার জন্য মেয়েটির বয়স, কালো না ফরসা, মুখ শরীর কিছুই বুঝল না।

–আপনি এত রাতে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন, ঘরে ঢুকলেন, কি অসম্ভব আতান্তরে পড়লাম বলুন তো।

–সব বলছি, তার আগে কিছু একটা দিন মাথাটা মুছতে হবে। একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

একটু কষ্ট করে হেঁটে আগন্তুককে একটা বোতল ধরিয়ে বললাম, ‘জলটা নিন, গামছা দিচ্ছি।’ পিছনের দিকে ফিরতেই মেয়েটির জল পানের শব্দ শুনতে পেল। তার পরে একটা তৃপ্তির শব্দ এল, ‘আঃ।’

সুনন্দর হাত থেকে গামছা নিয়ে মাথাটা মুছে বলে উঠল, ‘আমি নন্দিতা। যাত্রাাদলে কাজ করি, কুশপুর গ্রামে যাচ্ছিলাম, কমলপুর চেনেন? এখান থেকে এক কিলোমিটার হবে নাকি?

–আরও বেশি। আমাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী আসে।

–ও আপনি স্যার? কোন স্কুলে পড়ান?

–এই গ্রামের হাইস্কুলে।

–যাই হোক। কমলপুরে আমার মাসি থাকে। ওখানে দেখা করে ভেবেছিলাম হেঁটে বা ভ্যানে কুশপুরে চলে যাব। বেরিয়েও ছিলাম। মাঝরাস্তায় এই বৃষ্টি।

–আপনি কি পাগল, রাত্রিবেলা এই গ্রামে ভ্যান কোথায় পাবেন?

–না না, রাত্রিবেলা নয়। আমি সন্ধের আগেই বেরিয়ে ছিলাম।

–তাহলেও এই গ্রামে-ঘরে এমনি ভাবে সন্ধেবেলাতে একা বের হতে নেই।

–আসলে আমি তো এদিককার কিছু জানি না। মাসিও একা থাকে। বাসে চেপেছিলাম। ঠিক চললে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতাম। কিন্তু মাঝরাস্তায় বাস খারাপ। বাসেই বলল, ‘ভ্যান পেয়ে যাবেন।’ ভ্যানের আশায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। মোবাইলে চার্জ নেই, তার উপর জল ঢুকে গেছে, দলের কারোর সাথে কথাও বলতে পারলাম না। মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নামতে একটা মন্দিরে দাঁড়ালাম।

–কোন দিকে

এই বাড়ির পূর্ব দিকে মনে হয়।

–পূর্ব দিকে কোনও মন্দির নেই, উত্তরে আছে, ধর্মরাজের মন্দির।

–যাই হোক, সেই মন্দিরের চাতালে বসেছিলাম।

–আপনি তো অদ্ভুত, একে অন্ধকার, তার উপর এই বৃষ্টি, আর আপনি একা মন্দিরে বসেছিলেন! যে-কোনও রকম বিপদ হতে পারত।

–প্রথমে একাই ছিলাম, তাতে অসুবিধা হয়নি, কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে তিন-চারজন ছেলে এসে বিরক্ত করতে আরম্ভ করল, তাই পালিয়ে এদিকে চলে এলাম। আপনাদের গ্রামে তো সন্ধেবেলাতেই রাত্রি নেমে আসে দেখছি।

–আপনি এখানে কখন এসেছেন?

–আধঘণ্টা হবে।

–এখন এগারোটার বেশি বাজে, এই বৃষ্টিতে কি সবাই বাইরে নাচবে? কারেন্ট নেই, খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আপনি কটার সময় মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?

–ক’টা হবে, সাড়ে ছটা, সাতটা।

–তখন তো বৃষ্টি পড়ছিল।

–সেই রকম জোরে পড়েনি।

–আপনার কথাবার্তাতে কীরকম সন্দেহ হচ্ছে। গ্রামে রাতেরবেলা কেউ বের হয় না, তারপর ওই মন্দিরেও সন্ধেবেলা কেউ যায় না।

–স্যার পৃথিবীর সব কিছু কি অঙ্কের নিয়মে হয়?

কিছু সময় দুজনেই চুপ থাকল। বাইরে তখনও সমানে বৃষ্টি পড়ছে, কমবার কোনও লক্ষণই নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক ঘরের ভিতরের অন্ধকারকে কাঁপিয়ে আরও অন্ধকার করে, অদৃশ্য হয়ে নিজে সেই আগন্তুককে আরও রহস্যের চাদরে ঢেকে দিচ্ছে।

–আমি আজকের রাতটা আপনার ঘরে থাকব।

নিঃশব্দ অন্ধকার ঠেলে কথাটা কানে যেতেই সুনন্দের গলাতেও বজ্রপাত হল– মানে?

–মানে, যেটা বললাম।

–ক্ষ্যাপা পেয়েছেন নাকি আমাকে?

–কাল সকালেই চলে যাব।

–শুনুন একা থাকি, তাতে আবার স্কুলটিচার, কেউ জানতে পারলে আমাকে পিটিয়ে পায়েস বানিয়ে দেবে, সঙ্গে উপরি পাওনা বদনাম। বাড়ি থেকেও বের করে দেবে।

–এই যে বললেন আপনি এখানে একা থাকেন, তাতে আপনাকে কে বের করবে?

– বাড়ির লোক জানতে কতক্ষণ।

–কে আছে বাড়িতে?

–মা, বউ, ছেলে।

–তার মানে আপনি বউকে ভয় পান।

– আপনি খুব বাজে বকছেন।

–কেউ কিছু জানতে পারবে না, আমি খুব ভোরেই বেরিয়ে যাব।

–যত ভোরেই বের হন, এটা হতে পারে না। এমনি ভাবে রাতে আপনাকে আমি থাকতে দিতে পারি না।

–আপনি এক কাজ করুন, বউয়ের ফোন নম্বরটা দিন। আমি সব জানিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি তো আমাকে আচ্ছা ঝামেলাতে ফেললেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি প্লিজ বোঝবার চেষ্টা করুন। দরজা খুলে দিচ্ছি আপনি বাইরে চলে যান। সুনন্দর গলার উষ্মা বাড়তে লাগল।

–আপনি আস্তে আস্তে কথা বলুন, সবাই চলে আসবে।

সুনন্দ একপা এগিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুলতে গিয়ে ডান হাতে আরেকটা নরম হাতের ছোঁয়া পেল, সেই সঙ্গে ডান কানে একটা ফিসফিস হাওয়া, ‘আমাকে বের করে দেবেন না প্লিজ।’

সুনন্দর সারা শরীর ঝন্ঝন্ করে উঠল। ছিটকিনি থেকে হাতটা সরিয়ে দরজার ডানদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতেই সামনের জন বলে উঠল, ‘এই মুহূর্তে আমি যদি বাইরে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি, কী হবে বলুন তো?’

–মানে! কথাটা বলবার সময় সুনন্দ ঢোঁক গিলল।

–মানে কাল সকালের আগেই আপনার স্কুল, বাড়ি, সবাই জানতে পারবে আপনি…

–কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছু করিনি।

–রাতটা থাকি। কাল আলো ফোটার আগে বেরিয়ে যাব, কেউ কিছু জানতে পারবে না, কথা দিলাম।

সুনন্দ একটা শ্বাস ফেললেও বৃষ্টির শব্দে নিজের জায়গায় ঢাকা পড়ে গেল। কিছু সময় চুপ থেকে বলল, ‘আপনি কিন্তু ভোর তিনটে সাড়ে তিনটের সময় বেরিয়ে যাবেন, এখানে চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ সবাই উঠে পড়ে। কেউ দেখতে পেলে আমাকে সুইসাইড করতে হবে।

–আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি আমার এত উপকার করলেন আর আমি এইটুকু করব না?

সুনন্দ সামনের দিকে এগোতেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনার ঘরে শাড়িটাড়ি তো নেই। আমার সালায়োরটা ভিজে জবজব করছে। এখানটাও ভিজে গেছে। এটা পড়ে থাকলে তো সমস্যা।

– লুঙ্গি চলবে ?

–লুঙ্গি! দারুণ। যাত্রাতে অনেকবার পরেছি। তাছাড়া র‍্যাপার তো পরি।

–তাহলে লুঙ্গি আর একটা শার্ট দিয়ে দিচ্ছি। তবে আর একটা সমস্যা হবে। আপনি এই ভিজে জামা কাপড়গুলো নিয়ে কী করবেন, এখানে তো রাখা যাবে না।

–না না এখানে রাখব কেন? চার পাঁচ ঘন্টাতে জল ঝরে যাবে, তারপর আমি পরে চলে যাব। সুনন্দ অন্ধকার হাতড়ে দেয়ালে ঝোলানো দড়ি থেকে লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে আগের মতোই অন্ধকার হাতড়ে এসে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে, সোজা আস্তে আস্তে হেঁটে বাথরুমে গিয়ে পোশাকটা ছেড়ে নিন।’

–অত দূর যাওয়া যাবে না। আপনার ঘরটা পুরো ভিজে যাবে। আমি এখানে চেঞ্জ করে নিচ্ছি, আপনি একটু দূরে দাঁড়ান।

–বাথরুমে গেলে ভালো হতো না?

–এখানেও খারাপ হবে না।

সুনন্দ সেই ছায়ানারীর কথামতো চেয়ারে বসল। অন্ধকারে ছায়ানারীর পোশাক বদলানো না- দেখতে পেলেও, বুঝতে পেরে চোখদুটো বন্ধ করে নিল। বন্ধ চোখেও মাঝে মাঝে ভালো দেখা যায়।

কিছু সময় পরে কানে এল, ‘ঘরে কিছু খাবার হবে?

কথাটা শুনে সুনন্দ চোখ খুললে সামনেটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল।

কিছু বললেন?

–ঘুমিয়ে গেছিলেন?

না না, চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম।

–ও! কিছু খাবার হবে?

–একটা রুটি আছে। মুড়ি হতে পারে। আর তো কিছু নেই।

–চিনি গুড় কিছু?

–চিনি আছে।

–ব্যস ব্যস। একটা রুটি চিনি মুড়ে দিয়ে দিন। প্লেট-ফেট দিতে হবে না।

–তা কি করে হয়, আমি প্লেটেই দিচ্ছি, আপনি ততক্ষণ ভিজে জামাটামাগুলো বাথরুমে মেলে দিয়ে আসুন। সোজা, আস্তে আস্তে হাঁটুন অসুবিধা হবে না। আমার টর্চটারও ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।

–ভালোই হয়েছে, মাঝে মাঝে অন্ধকার ভালো।

কিছুসময় পর একটা জোরে শব্দ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উফ্ কথাটা শুনেই সুনন্দ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হল, কোথায় ধাক্বা লাগল?’

–এই যে শক্ত মতন কিছুতে।

–বিছানা, একটু আস্তে আস্তে চলুন।

আগন্তুক বাথরুমে গেলে সুনন্দ একটা প্লেটে চারটে বিস্কুট, রুটি, চিনি নিয়ে বিছানাতে রেখে বলল, ‘এই বিছানাতে রাখলাম, খেয়ে নেবেন।’

আবার চেয়ারের জায়গায় ফিরে বসতেই বাথরুম থেকে ছায়ানারীর গলার আওয়াজ পেল, ‘বাথরুমে মেলব কোথায়?’

–একটা দড়ি আছে, দেয়ালের দিকে, সাবধানে দেয়াল ধরে ধরে যাবেন। চেয়ারে বসে থাকবার কিছুসময় পরেই কাঠের আলমারির উপর কিছু একটা পড়বার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে বলল ‘কিছু ফেললেন নাকি?’

– এখানে ধাক্বা লাগল।

–আপনি ওদিকে গেছেন কেন, সোজা যেভাবে গেছিলেন সেভাবেই চলে আসুন। আস্তে আস্তে আসুন, বিছানাতে খাবার দেওয়া আছে।

চেয়ারে বসেই সুনন্দ পায়ের আওয়াজ এবং কিছুপরে বিছানার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পেল। কিছু সময় পরে মেয়েটি বলে উঠল, ‘আপনি বিস্কুটও দিয়েছেন, ভালো।’

সুনন্দের কানে চেবানোর আওয়াজ এল।

–আপনার বাড়িতে বউ মা আর ছেলে, বাঃ বেশ ছোটো পরিবার।

প্রথমবার কথাটার কোনও জবাব না পেয়ে আগন্তুক খেতে খেতেই বলে উঠল, ‘ঘুমিয়ে গেলেন?’

–আপনি তো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।

–আপনি রেগে গেছেন?

–কী হবে আপনার এই সব জেনে?

–মাত্র তো কয়েক ঘন্টা, চাপ নেবেন না।

–আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ।

–শুয়ে পডু়ন। আমি মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি।

–আপনি?

–আমার কথা অনেক ভেবেছেন, ঘুমোন।

–ছিঃ ছিঃ। তা কি করে হয়। তার থেকে আপনি ঘুমোন আমি বসে থাকি। আমার রাত জাগা অভ্যাস আছে।

–বিছানাতে শুলে আমি আর উঠতে পারব না। ভোরে আপনাকে ডাকতেও পারব না। ।

–বাঃ বাঃ আপনি সেই একই কথা ভাবছেন। আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছি।

–ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–আমি কি এই বিছানাতে শোবো?

–তাছাড়া, মাটিতে শুতে পারবেন না, জায়গাও নেই।

কিছুসময় দুজনেই চুপচাপ। বাইরে বৃষ্টির সাথে ঝড় উঠেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো। ঘরের ভিতর দুজন অচেনা অল্প জানা মানুষদের একে অপরের কাছে কিছুসময়ের জন্য দৃশ্যমান করেই আবার নিজেকে লুকিয়ে দিচ্ছে।

–শুনুন না, আমার খুব খারাপ লাগছে, আপনি এইভাবে সারারাত বসে থাকবেন, আর আমি শুয়ে থাকব। তার থেকে আপনি শুয়ে পড়ুন।

–অনেক জ্বালিয়েছেন এবার একটু ক্ষ্যামা দিয়ে শান্তিতে বসতে দিন। রাতে ঘরে ঢুকেছেন, খেতে পেয়েছেন, শুতে পেয়েছেন, এবার ঘুমোন। আমাকে শুধু চাদরটা বের করে দিন। বালিশের নীচে পাবেন।

চাদর ঢাকা নিয়ে পাদুটো সোজা করে বসতে সুনন্দ স্পষ্ট বুঝতে পারল আগন্তুক শুয়ে পড়েছে।

সুনন্দ চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। এই অন্ধকার বৃষ্টির রাতে ঝুমা থাকলে অন্যরকম সমীকরণ তৈরি হতো। সুনন্দ চারদিকটা আরেকবার দেখে নিল। ছায়ানারী শুয়ে আছে। সুনন্দের শরীরের অনেক অঙ্ক, অসমীকরণ ঝাঁপাঝাঁপি আরম্ভ করলেও উত্তর নেই, পাতা উলটে সমাধান করবার উপায় নেই। এক একটা দিনের উচ্চতা, দূরত্ব বাকি সব দিন বা রাতের সূচক ছাড়িয়ে যায়। উত্তর মেলে না, শুধু পাতার পর পাতা ব্যর্থ কষা। সমীকরণ, অসমীকরণের গ্রাফ, লগ, বা পাটিগণিতে শরীর নষ্ট হয়, পায়জামা, লুঙ্গি ভিজে দাগ হলেও শুধু জয় জগন্নাথ বলে রণে ভঙ্গ দেওয়ার অঙ্ক শিখে নেওয়ার মধ্যেই তো সব গ্রাফ, সব জটিল বিষয়ের মিল!

–মাস্টারদা, ও মাস্টারদা।

বাইরের আওয়াজে থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুনন্দ। ঘরের ভিতরে সব আলো জ্বলছে। মশারিটা এখনও খাটানো রয়েছে। তার মানে গতরাতের মেয়েটা এখনও শুয়ে আছে। মাথার ভিতরটা দপ্দপ্ করতে লাগল। জীবন, জীবিকা সবের বারাটো বেজে যাবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে দুধের বাটি নিয়ে দরজার কাছে আসতেই জলে হালকা পিছলে গেলেও সামলে নিয়ে, ছিটকিনি খুলে ডান হাতটা বের করে দুধ নিল।

–কি ব্যাপার মাস্টারদা, আজ এত ঘুম, কখন থেকে ডাকছি।

–কাল সারারাত কারেন্ট ছিল না, ঘুম হয়নি, ভোরে ঘুমিয়ে গেছি।

বেশি কথা আর না বাড়িয়ে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিল। মেয়েটা কথা রাখল না। বলেছিল ভোরে চলে যাবে। এবার কী হবে? সুনন্দ মশারির কাছে আসতেই দেখল বিছানা ফাঁকা। মেয়েটা? বাথরুমে!

সুনন্দ বাথরুমের কাছে এসে দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। তাহলে মেয়েটা!

চোখ পড়ল বাথরুমের দেয়ালের টাঙানো দড়িটাতে, ওই তো, লুঙ্গি, শার্ট।

তাহলে মেয়েটা! চলে গেল? না, তাহলে তো দরজার ছিটকিনিটা ভিতর থেকে দেওয়া থাকত না। কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। মেয়েটা তো গতকাল রাতে ঘরে এসেছিল, অন্ধকার হলেও সুনন্দ এতটা ভুল দেখেনি।

সুনন্দ রুটির জায়গাটা খুলল, কী আশ্চর্য এই তো রুটিটা আছে। কিন্তু কাল রাতে নিজে একটা প্লেটে মেয়েটাকে রুটিটা দিয়েছিল, তাহলে!

মশারিটা তাড়াতাড়িতে খুলতে গিয়ে দুটো দড়ি ছিঁড়ে ফেলল। দলা পাকিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখে বিছানাতে হাত দিল। এই তো পায়ের দিকটা ভিজে। বালিশটাও সাঁতস্যাত করছে। চাদরটা কুঁচকে আছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ শুয়ে ছিল।

সুনন্দর শরীরে একটা অসমীকরণের স্রোত বইতে আরম্ভ করলেও, এবারেও কোনও সমাধান বা উত্তর মেলাতে পারল না। বালিশটা সরাতে একটা ভাঁজ করা ছোটো কাগজ দেখতে পেল। হাতে নিয়ে খুলতেই বুঝল বাসের টিকিট। ভাড়ার টাকা কিছু না লেখা থাকলেও টিকিটের নীচের দিকে ধন্যবাদ লেখাটাতে চোখদুটো আটকে গেল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...