বাড়িঘর, প্রতিমা কিংবা প্যান্ডেল, সবকিছুরই একটি কাঠামো থাকে। এইসব কাঠামোর উপকরণ হিসাবে থাকে রড, বাঁশ কিংবা কাঠ। কোনও কারণে যদি কাঠামোর উপকরণ দুর্বল হয়ে পড়ে কিংবা ভেঙে পড়ে, তাহলেই বিপদ। মানবদেহেরও যে কাঠামো আছে, তার উপকরণ হল অস্থি বা হাড়। ক্যালসিয়াম-এর অভাবে কিংবা কোনও আঘাতজনিত কারণে যদি এই অস্থি বা হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে মেরামতের প্রয়োজন হয়। সেইসঙ্গে, যদি সমস্যা জটিল হয়, তাহলে মেরামতের জন্য মেজর সার্জারিরও প্রয়োজন হয়। আর সার্জারি যাতে সহজ ও সফল হয়, তারজন্য বর্তমানে মাধ্যম করা হচ্ছে আর্থ্রোস্কোপ-কে। কিন্তু কী এই আর্থ্রোস্কোপ, অর্থোপেডিক সার্জারিতে একে মাধ্যম করে কতটা সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে, এই সমস্ত বিষয়ে আলোকপাত করলেন ডা. সুঘ্রাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর্থ্রোস্কোপির বিবরণ
আর্থ্রোস্কোপির অর্থ হল, অস্থিসন্ধির ভিতরে ক্যামেরা দিয়ে দেখা এবং চিকিৎসাযোগ্য কোনও অসুবিধা থাকলে তাকে নিরাময় করে তোলা। তাই, আধুনিক চিকিৎসায় আর্থ্রোস্কোপি হল আর্থোপেডিক সার্জারির একটি অন্যতম মাধ্যম।
আর্থ্রোস্কোপির সুবিধা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের প্রায় সমস্ত অস্থিসন্ধি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারানো যেতে পারে। সাধারণত হাঁটু, কাঁধ, কনুই এবং পায়ের গোড়ালির অস্থিসন্ধির অপারেশন এই আর্থ্রোস্কোপি পদ্ধতিতে করে সুফল পাওয়া যায়। এই অপারেশন-এর বড়ো সুবিধে হল, সাধারণ ভাবে প্রতিটি অপারেশনেই খুব অল্প সময়ে রুগিকে সুস্থ করে তোলা যায়। এরজন্য হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া, এই অপারেশন ব্যয়বহুলও নয়।
বিদেশে এই অপারেশন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এই অপারেশন-এর প্রকৃত তালিমও দেওয়া হয়। আমাদের দেশে খুব অল্প-সংখ্যক চিকিৎসক বিদেশে তালিম নিয়ে এই পদ্ধতিতে (আর্থ্রোস্কোপি) অপারেশন করে থাকেন।
এই অপারেশন-এ ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। কিন্তু চিকিৎসার প্রকৃত সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত।
চিকিৎসার রকমফের
- হাঁটুতে যে সমস্ত জটিল সমস্যা হয়, যেমন – কার্টিলেজ ছেঁড়া, লিগামেন্ট ছেঁড়া, অস্টিয়ো আর্থারাইটিস প্রভৃতি আর্থ্রোস্কোপির মাধ্যমে চিকিৎসা করে সাফল্য পাওয়া যায়।
- কাঁধের সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে সাবঅ্যাক্রোমিয়ান ডিকমপেশন (কাঁধের ব্যথা), রোটেটার কাফ ছিঁড়ে যাওয়া, ফ্রোজেন শোল্ডার প্রভৃতি। এই সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি সুফলদায়ক।
- গোড়ালিতে ব্যথা কিংবা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলেও আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারিতে সাফল্য পাওয়া যায়।
- কনুইর অসাড় ভাব দূর করতে কিংবা কনুই ভেঙে গেলে, ভাঙা হাড়ের টুকরো বের করতে আর্থ্রোস্কোপির সাহায্য নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
- হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে এবং দৗড়োতে অসুবিধা হয়। সেইসঙ্গে, হাঁটু লক্ হয়ে যায়। তাই হঠাৎ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই জটিল চিকিৎসাও আর্থ্রোস্কোপির দ্বারা সহজে করা যায় এবং খুব তাড়াতাড়ি রুগিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
- যাদের আর্থারাইটিস আছে, তাদেরও হাঁটু আটকে (লক) গিয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই পড়ে গিয়ে যদি হাঁটুতে ভাঙা হাড়ের টুকরো থেকে যায়, তাহলে বড়ো বিপদ। এই জটিল অবস্থাতেও আর্থ্রোস্কোপির সাহায্যে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- কখনও আবার হাঁটুতে কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে আর্থ্রাইটিস বাড়ে। তাই কার্টিলেজ বেশি হয়ে ক্ষয়ে যাওয়ার আগে আর্থ্রোস্কোপির সাহায্যে কন্ডোপ্লাস্টি অপারেশনকে মাধ্যম করে নতুন কার্টিলেজ তৈরি করা যায়। আর এর সঙ্গে ভাস্কোসাপ্লিমেন্টেশন দিলে বহুদিন পর্যন্ত রোগীকে ভালো রাখা যায়।
- হাঁটুর ভিতরে দুটি কার্টিলেজ থাকে এবং এগুলি ছোটোখাটো আঘাত প্রতিরোধ করে। কিন্তু, এই কার্টিলেজ যদি ছিঁড়ে যায়, তাহলে আর্থ্রোস্কোপির সাহায্যে এই কার্টিলেজ সারানো যায়। এক্ষেত্রে ছেঁড়া অংশ বাদ দিয়ে জায়গাটি মসৃণ করে রোগীকে আগের মতো স্বাভাবিক হাঁটাচলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
আর্থ্রোস্কোপির জনপ্রিয়তা
কয়েকবছর আগে আমাদের দেশে আর্থ্রোস্কোপির সাহায্যে অপারেশন-এর ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু বর্তমানে সেই ব্যবস্থা রয়েছে। আর যেহেতু এই পদ্ধতিতে কোনও কাটাছেঁড়া না করে মাত্র ছোট্ট দুটো ফুটো করে খুব সহজে জটিল অপারেশন করে সাফল্য পাওয়া যায়, তাই আর্থ্রোস্কোপির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।