বেশিদিনের ঘটনা নয়, মাত্র কদিন আগেই পর্দায় দেখেছি আমরা সেই বেপরোয়া প্রেমের বন্দিশ। ‘বেফিক্রে’। এক যুবক-যুবতির নির্ভার লিভ ইন করার গল্প। দায়-দায়িত্বহীন, ঝরঝরে থাকার নামই লিভ ইন। পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মতো শ্বাসরোধী অনুভূতি নেই যেখানে। নেই দুটো পরিবারকে, তাদের প্রত্যাশা, দাবি আকাঙক্ষাকে অযথা বহন করার মানসিক চাপ। এক কথায় লিভ-ইন যেন এক ঝলক টাটকা খোলা হাওয়া, অর্গলমুক্ত প্রেমই যার সারকথা।

কিন্তু গোল বাধে তখনই যখন লিভ ইন-এও হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে কিছু অযাচিত সমস্যা। যখন দুজন পার্টনারের কোনও একজন, অন্য কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক এমনটাই ঘটতে দেখি আমরা বেফিক্রে ছবিটিতে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এই খোলামেলা নির্ভার সম্পর্কে দায়বদ্ধতা কি আদৌ আছে নাকি নেই? পরস্পরের সঙ্গে ইমোশনালি জড়িয়ে পড়ার মতো ‘প্যানপেনে’ সেন্টিমেন্টের কোনও মূল্য আছে না কি নেই? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আরও একটু গভীরে ঢোকা প্রয়োজন।

বস্তুত মেয়েদের তুলনায় লিভ-ইন-এ আগ্রহী হতে দেখা যায় এই প্রজন্মের তরুণদের। কারণ একটাই। দায়-দায়িত্বহীন সম্পর্কে যৌনতার সুযোগ অবাধ। কারও শাসন বা মতামতের তোয়াক্বা না করে একটা বন্ধনহীন সম্পর্কের স্বাধীনতা উপভোগ করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু খুব কম মেয়েই এই সম্পর্কজনিত ইনসিকিউরিটিকে অ্যাকসেপ্ট করার সাহস দেখায়। হয়তো প্রথম কয়েকটা মাস দুজনেই এনজয় করে এই সম্পর্কের সুফল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রায়শই একটা একঘেয়েমি এবং উত্তাপহীনতা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে সম্পর্কটার মধ্যে। কমিটেড থাকার দায় নেই বলেই এরপর পার্টনার চেঞ্জ করার তাগিদ আসতে পারে যে-কোনও পক্ষের থেকে।

আরও একটি সমস্যা হল দুজনের মধ্যে যদি সন্তান এসে পড়ে। ‘সালাম নমস্তে’ ছবিতে যেমনটা আমরা দেখেছিলাম। অবাধ যৌনতার সুযোগ আছে যেমন, তেমন প্রায়শই প্রকৃতির নিয়মে মা হওয়ার তাগিদ এসে পড়তেই পারে মেয়েটির মধ্যে। আর তখন যদি পুরুষটি সেই দায় গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তার প্রভাব গিয়ে পড়ে নবজাতকটির উপর। অযাচিত সন্তানকে নিয়ে প্রায়শই মা-কে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়।

বিশ্বস্ততার অভাব এই সম্পর্কের আরও একটি দিক। পায়েল ও অনুব্রতর সম্পর্কেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ভিন্ন শহর থেকে পড়তে আসা দুই তরুণ-তরুণী, এ শহরেই ফ্ল্যাট শেয়ার করে। তারা লিভ ইন সম্পর্কে কমিটেড বলে বন্ধু মহলে সকলে জানত। বছর ঘুরে গেল। বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর থেকেই পায়েল, অনুব্রতর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। ছেলেটি যেন আগের মতো পায়েলের ব্যাপারে ইনভল্ভড নয়। কিছুটা দূরত্ব, এড়িয়ে চলার মানসিকতা দেখে পায়েল তার কাছ থেকে খোলাখুলি জানতে চাইল এই পরিবর্তনের কারণ। তাকে অবাক করে দিয়ে অনুব্রত জানাল, পরিবারের পছন্দ করা একটি মেয়ের সঙ্গে তার বাড়ির লোকেরা তার রেজিস্ট্রি করিয়ে দিয়েছে। অনুব্রত তার পরিবারকে জানাতে পারেনি তার লিভ ইন রিলেশনের কথা। অর্থাৎ কিনা সময়মতো সে সাহাসী হতে পারেনি, সামাজিক ভাবে এই সম্পর্ক অ্যাকসেপ্টেড হবে না এই ভয়ে। এ যেন বাস্তবিক সেই ‘ইজাজত’ ছবির গল্প। এখন পায়েলের সামনে দুটোই পথ। হয় সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা অথবা অনুব্রতর ডিভোর্স না হওয়া অবধি অপেক্ষা করা।

সামাজিক ভাবে স্বীকৃত হলেও অধিকাংশ পরিবারেই এই সম্পর্ককে খোলামনে মেনে নেওয়া হয় না। উভয় পরিবার থেকে দুজনের পরিণয় ঘটানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে সকলে। ফলে গোপনে কেউ কেউ লিভ ইন করে ঠিকই, কিন্তু সেখানেও আবার পারস্পরিক বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনাও আকছার ঘটে। এই সম্পর্ক যতটা স্বাধীনতা দেয়, ততটাই অপরাধ মনস্কতার দিকেও ঠেলে দেয়। লিভ ইন রিলেশন-এ থাকতে থাকতেই, একটি মেয়ে তার পরিবারের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অন্য একটি পাত্রকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে, শুনেই তার বয়ফেন্ড তাকে খুন করে– সংবাদপত্রে এমন ভয়ংকর ঘটনার কথাও আমরা পড়ে থাকি। সম্প্রতি সবচেয়ে চাঞ্চল্য ফেলেছে যে ঘটনা, সেই আকাঙ্খা শর্মা ও উদয়ন দাস লিভ ইন রিলেশনে থাকতে থাকতেই আকাঙ্খা হত্যার জঘন্য অপরাধটি ঘটায় উদয়ন। ফলে লিভ ইন-এর সুফল যেমন আছে, কুফলের বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া চলে না।

লিভ ইন এর আইনি দিক

 সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় লিভ ইন-এর আইনি দিক নিয়ে অনেকেই বেশ নড়ে চড়ে বসেছেন। সুপারস্টার রাজেশ খন্নার মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে লিভ ইন সূত্রে সম্পর্কিত অনিতা আডওয়ানিকে রাজেশের পরিবারের লোকেরা বহিষ্কার করে। গত চার বছর তারা লিভ ইন করা সত্ত্বেও সম্পর্কটার আইনি বৈধতা ছিল না। এমনকী অনিতা এমন কোনও প্রমাণপত্রও দাখিল করতে পারেননি যা আইনত গ্রহণযোগ্য, যা তাঁকে রাজেশের সম্পত্তির অংশীদার বলে প্রমাণ করতে পারে। ফলে অনিতা আডওয়ানি দু’শো কোটির সম্পত্তির ছিটেফোঁটাও পেলেন না রাজেশের মৃত্যুর পর। তাই জেনে রাখা দরকার, সম্পত্তি দাবি করার ক্ষেত্রে, লিভ ইন সম্পর্কটির যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ দরকার। তবেই সম্পর্কটি বৈধ বলে স্বীকৃত হবে। সুপ্রিম কোর্ট লিভ ইন-এর বিষয়ে যে-আইনগুলি প্রণয়ন করেছে, তাতে লিভ ইন সম্পর্ক ভেঙে গেলেও মহিলারা খোরপোশ পেতে পারেন। কিন্তু তার জন্য

ক)   এই যুগলকে সমাজের সামনে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে

খ)   যুগলকে এই সম্পর্কের বৈধতা দিতে সাবালকত্ব প্রাপ্ত হওয়া আবশ্যক

গ)   যুগলের মধ্যে সম্পর্ক বা আত্মীয়তা বিবাহের পক্ষে অনুপযুক্ত হবে না

ঘ)   দুজনে স্বেচ্ছায় অন্তত ছয় মাস একসঙ্গে শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কে আবদ্ধ থেকে বসবাস করলে, তবেই তা আইনি ভাবে সিদ্ধ হবে

২৬ নভেম্বর ২০১৩ থেকে লিভ ইন আইনি বৈধতা লাভ করেছে। লিভ ইন সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই সফলও হয়। যেখানে সাধারণ বৈবাহিক সম্পর্কে বোঝাপড়ার অভাব দেখা যায়, সেখানে লিভ ইন-এর ক্ষেত্রে সম্পর্কটা বোঝাপড়ার উপরই দাঁড়িয়ে থাকে। অধিকাংশ আত্মনির্ভর মহিলা বিয়ে জনিত ঝক্বি এড়াতে এখন লিভ ইন-এর স্বপক্ষে। তবে কয়েকটা জিনিস খেয়াল করা জরুরি।

উভয়েই পরবর্তীকালে বিবাহ করতে ইচ্ছুক কিনা নিশ্চিত হোন। যদি ছেলেটি একেবারেই এতে রাজি না থাকে তাহলে তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। দুজনের যৌথ আয় একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে রেখে খরচ করুন। যদি একেবারেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন উভয়েই, তাহলে উকিলের মাধ্যমে স্ট্যাম্প পেপারে যে যার অংশ লিখে নিন।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...