দীর্ঘদিন ধরে কব্জির চিনচিনে ব্যথায় ভুগছেন? ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে হাতের আঙুল? এর কারণ কারপল টানেল সিনড্রোম নয়তো? সিংহভাগ মানুষই এই কারপাল টানেল সিনড্রোম রোগটি সম্পর্কে সচেতন নন কিংবা নামও শোনেননি। কিন্তু, অজান্তেই এই রোগের শিকার হয়ে পড়লে, হয়তো প্রতিবন্ধীও হয়ে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে, বেশি সচেতন হওয়া উচিত মহিলাদের। কারণ, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি আক্রান্ত হন এই রোগে। এমনই তথ্য সম্প্রতি তুলে ধরলেন অর্থোপেডিক সার্জন ডা. অরুনাভ লালা। সেইসঙ্গে, এই রোগটির সম্পর্কে সবরকম কৌতূহলও মেটালেন তিনি।
কারপাল টানেল সিনড্রোম রোগটি আসলে কী?
কারপাল টানেল সিনড্রোম একটি সাধারণ এবং ক্ষুদ্র সমস্যা। কিন্তু সচেতন না থাকলে এটি মানুষকে অথর্ব বা বিকলাঙ্গ করে দিতেও পারে। কারপাল টানেল সিনড্রোম আসলে হাতের তালুর নীচের অংশে একটি লিগামেন্ট-এর মধ্যে জল শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। লিগামেন্ট-এর মধ্যে থাকা হাতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্নায়ুর নাম মিডিয়ান নার্ভ। এই নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেখা দেয় সমস্যা।
কী কী কারণে এই রোগটি হয়?
বার্ধক্য, রিউমেটয়েড আথর্রাইটিস, থাইরয়েড-এর সমস্যা, গর্ভাবস্থায় কানেকটিভ টিস্যু ডিসঅর্ডার্স প্রভৃতি কারণে কারপাল টানেল সিনড্রোম হতে পারে। অনেকক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে টাইপিং-এর কাজ, অনেকক্ষণ গাড়ি চালানো কিংবা অনেকক্ষণ হাতের মাংসপেশির উপর চাপ পড়লে হতে পারে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম।
এই রোগের প্রধান উপসর্গগুলি কী কী?
এই রোগের প্রধান উপসর্গ হল, অল্প হলেও চিনচিনে ব্যথা হবে হাতের কব্জিতে। ব্যথা আপনার বুড়ো আঙুল এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ আঙুলের একদিকে থাকবে। অন্য যে-কোনও নিউরোলজিক্যাল ব্যথার মতো এই ব্যথাটি রাতের দিকে বা ঘুম থেকে উঠলে বেশি বাড়ে। যত সময় যেতে থাকে, ব্যথা আরও তীব্র হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে হাতের সূক্ষ্ম কাজকর্ম ব্যহত হয়। পেন দিয়ে লেখার অভ্যাস থাকলে, হাত থেকে পেন-ও পড়ে যেতে পারে। যারা বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি হাতের সূক্ষ্ম কাজকর্ম করেন, তাদের কাজের স্মুদনেসও থাকে না। শেষের দিকে ধীরে ধীরে হাতের মাংসপেশিগুলো শুকিয়ে যায় এবং ওই হাত দিয়ে কোনও সাধারণ কাজকর্মও করা সম্ভব হয় না।
কারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন?
গবেষণায় দেখা গেছে যে, মহিলারা সাতগুন বেশি আক্রান্ত হন এই ব্যধিতে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় বেশি আক্রান্ত হন মহিলারা। তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও এই রোগ দেখা যাচ্ছে। তার প্রধান কারণ হল তাদের অস্বাস্থ্যকর লাইফ-স্টাইল।
কীভাবে করা হয় এই রোগের চিকিত্সা?
এই রোগের ডায়াগনোসিস সাধারণত রোগটির উপসর্গ দেখে এবং নার্ভ কনডাক্টিভ ভেলোসিটি টেস্ট করে কনফার্ম হতে হয় যে, কারপাল টানেল সিনড্রোম-এর সমস্যা আছে কিনা।
আর যে-কোনও চিকিত্সাকে মেডিকেল এবং সার্জিক্যাল এই দুভাগে ভাগ করা হয় এবং এক্ষেত্রেও তাই করা।
প্রথম পর্যায়ে দেখা উচিত, রোগের উপসর্গ কী? যদি গর্ভাবস্থার জটিলতার কারণে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হয়, তাহলে খুব সাবধানে এমন ভাবে ওষুধপথ্য দিতে হয় কিংবা চিকিত্সা করতে হয় যাতে গর্ভস্থ সন্তানের কোনও ক্ষতি না হয়। তবে, অনেকেরই ডেলিভারির পরে এই সমস্যা কমে যায়। সুতরাং, গর্ভাবস্থায় বেসিক পেইন ম্যানেজমেন্ট এবং সামান্য ফিজিওথেরাপি-র মাধ্যমেও এই রোগের চিকিত্সা করা যায়। আর সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে চিকিত্সা শুরু করার আগে, রোগের উপসর্গ দেখে, সেইমতো চিকিত্সা করা হয়।
আথর্রাইটিস, থাইরয়েড ডিসঅর্ডার প্রভৃতির কারণে এই রোগ হলে অথবা অস্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল-এর জন্য এই সমস্যা হলে তাদেরকে সেইমতো ওষুধ দেওয়া হয় কিংবা প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন, লাইফস্টাইল মডিফিকেশন-কেও চিকিত্সার মাধ্যম করা হয় অনেক সময়। বেশিক্ষণ কম্পিউটার টাইপিং অ্যাভয়েড করা এবং হাতের কিছু সামান্য ব্যায়াম করা, কিছু অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগস, লোকাল ইঞ্জেকশনস এবং উচ্চমানের ফিজিওথেরাপির মাধ্যমেও চিকিত্সা করা হয়। হাতের সমস্যার জন্য স্পেশালিস্ট হ্যান্ড ফিজিওথেরাপিস্ট-কেও নিযোগ করা হয়। অনেক সময় রিস্ট স্প্লিন্ট ব্রইস্ট ইমোবিলাইজার পরলেও ব্যথা কম হয়।
আর যদি সমস্যা জটিল হয়, অর্থাত্ হাত কাঁপতে থাকে কিংবা ব্যথা বেড়ে যায়, তখন প্রযোজন হলে সার্জারি-কেও চিকিত্সার মাধ্যম করতে হতে পারে। হাতের ছোট্ট একটা অপারেশন করেও কারপাল লিগামেন্ট রিলিজ করা যায়। এটি পনেরো-কুড়ি মিনিটের সার্জিক্যাল প্রসিডিযোর এবং সাধারণত এটি একটি ডে-কেয়ার প্রক্রিয়া। অর্থাত্, সকালবেলা ভর্তি হলে, সন্ধেবেলা ছাড়া পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একটি রাতও হাসপাতালে থাকার প্রযোজন হয় না। ডিরেক্ট সার্জারি বা আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি হিসেবেও করা যেতে পারে। ওপেন সার্জারি হলে, হাতের তালুর দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার ওপেন করে, লিগামেন্ট রিলিজ করা হয়। আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি করলে
রিস্ট-এর মধ্যে ক্যামেরা ঢুকিয়ে সার্জারি করা হয়। তবে, দুটো পদ্ধতিতেই সার্জিক্যাল টাইম অ্যান্ড রিকভারি টাইম সমান।
অতএব, যদি আপনার এই রোগের উপসর্গ থাকে, তাহলে এখনই চিকিত্সকের পরামর্শ নিন এবং আপনার ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন এবং বিভিন্ন ডায়াগনোস্টিক টেস্ট করিয়ে নিন। আপনি যদি এই রোগটির প্রথম পর্যাযে থাকেন, তাহলে শুধু ওষুধ দিয়ে রোগ সারানো সম্ভব। কিন্তু যদি দেরি হয়ে যায়, তাহলে অপারেশনের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, একবার অপারেশন হলে আবার কি এই ব্যাধি হতে পারে? দেখা গেছে, ঠিকঠাক অপারেশন হলে এবং রোগের উপসর্গগুলি দূর করতে পারলে, দ্বিতীয়বার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।