সূর্যটা দিঘির জলে ডুব দিতেই হালকা মেঘাবৃত আকাশটা বেশ রঙিন হয়ে উঠল। আপাত নিস্তরঙ্গ দিঘির জলে তার অপূর্ব ছায়া বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সাঁঝবেলার অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকল। দিঘির জলও কেমন কালো হয়ে উঠতে লাগল।

প্রতিদিন নন্দিতা এই সময়টা বাড়িটার দোতলার পশ্চিমমুখী বারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখে। সাত সকালে অবশ্য পূর্বমুখী বারান্দায় বসে, সূর্যোদয় দেখতেও কখনও ভুলে যায় না। তখন অবশ্য সুকান্তকে ও কাছে পায় কিছুক্ষণের জন্যে। খানিক পরেই অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে তার। সকালের চা খেতে খেতে একসাথে সূর্যোদয় দেখার খানিক পরেই নন্দিতাকেও ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়, সুকান্তর ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চবক্স রেডি করার জন্য।

বাইপাসের কাছে দক্ষিণ কলকাতার এই ফ্ল্যাটটিতে এটাই একটা মস্ত বড়ো সুবিধে। পুব আর পশ্চিম, দুই প্রান্তেই দুটো বারান্দা আছে বলে। ওরা প্রায় দুবছর ধরে দোতলার এই ফ্ল্যাটটিতে ভাড়া থাকে। এর আগে সুলেখার কাছে একটা ছোটো ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। বছর খানেক বাদে দক্ষিণ কলকাতার এই ফ্ল্যাটটিতে চলে আসে সুকান্তর কর্মস্থলে যাতায়াতের সুবিধের জন্য। এছাড়া ওই পুরোনো জায়গাটা যথেষ্ট ঘিঞ্জিও ছিল। ঘিঞ্জি জায়গা ওদের দুজনের একদম পছন্দ নয়।

সুকান্ত আর নন্দিতা দুজনেই খুব প্রকৃতি প্রেমিক। বাইপাসের কাছে এই ফ্ল্যাটটি তাই স্বাভাবিক ভাবেই ওদের খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। প্রকৃতিকে সবসময় চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমে দেখতে পায় বেশ বড়ো একটা দিঘি, তার একপাশে খালি মাঠ, সার দিয়ে অন্তত দুডজন নারকেল গাছ।  কিছু দিঘির পাড় ধরে, কিছু মাঠটির ধার দিয়ে মাঠের চারপাশে আর দিঘির এক প্রান্তে বেশ কিছু সবুজ গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়ও দেখতে পাওয়া যায়।

ফ্ল্যাটটির পূর্বদিকটাও ভীষণ আকর্ষণীয়। ওদিকে অদূরেই ঘন সবুজ অরণ্য। সূর্য প্রতিদিন ওই অরণ্যের ফাঁকফোকর দিয়ে ধীরে ধীরে দেখা দেয়, খানিক পরেই পূর্ণাকার নিয়ে অরণ্যের মাথায চড়ে বসে। সোনালি আলোয় ঝলমল করে ওঠে চারপাশ। সুকান্তদের নিজেদের বসতবাড়ি জলপাইগুড়িতে আর নন্দিতার বাপের বাড়ি কুচবিহারে। বছর আড়াই হল ওদের বিয়ে হয়েছে।

দরজায় কলিং বেলটা বাজতেই নন্দিতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজা খুলতে গেল। একতলাতে বাড়ির মালিক স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। দুজনেই যথেষ্ট প্রবীণ। ভদ্রলোকের আটষট্টি এবং ওঁনার স্ত্রীর বাষট্টির ওপর বয়স হবে বলেই নন্দিতার ধারণা। ওঁদের একমাত্র ছেলে, নিজের স্ত্রী এবং একটি পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে নিউ জার্সিতে থাকে। বিগত প্রায় দশ বছর ধরে ওখানেই আছে। বছরে একবার করে সবাই মিলে বাড়িতে আসে খ্রিসমাসের ছুটিতে। নতুন বছর একসাথে কাটিয়ে দিন পনেরো থাকার পরে ফিরে যায় স্টেটসে। ভদ্রলোক এবং ওঁনার স্ত্রী দুদিন আগে দার্জিলিং বেড়াতে গেছেন। একতলাটা তাই ফাঁকা।

সদর দরজা খুলতেই নন্দিতার চোখ বিস্ময়ে কপালে গিয়ে ঠেকল যেন! বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে নন্দিতা বলে উঠল, কী সৌভাগ্য! তোরা? হঠাৎ এতদিন বাদে মনে পড়ল আমাদের? পাপিয়া, আয় আয় ভিতরে আয়। চিন্ময়দা, খুব ভালো লাগছে তোমরা এসেছ। শুক্রবারের সন্ধেটা বেশ ভালো কাটবে একসাথে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে পাপিয়া বলল, তোরাও তো আসিস না আমাদের বাড়িতে, অনেক দিন হয়ে গেল। সুকান্তদা অফিস থেকে ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই?

না রে, এখনও ফেরেনি, তবে বেশ কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বলেছিল যে, ও এখন ড্রাইভ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এসে গেল বলে।

চিন্ময় দোতলার হল ঘরে এসে সোফায় বসে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা ফোন করে আসিনি। আমি পাপিয়াকে বলেছিলাম, বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ফোন করে খোঁজ নিতে। তোমাদের অন্য কোনও প্ল্যান ছিল না তো? আজ আবার উইক-এন্ড।

নন্দিতা বলল, কী যে বলো, চিন্ময়দা। বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি যেতে গেলে অত ফর্ম্যালিটিস করলে চলে? আর একটু পরেই তোমাদের দেখতে পেয়ে সুকান্ত যে কী ভীষণ খুশি হবে, তা নিজের চোখেই দেখতে পাবে। আচ্ছা, তোমরা দুমিনিট বসো, আমি চায়ের জল ইন্ডাকশন-এ চাপিয়ে এখুনি আসছি।

পাপিয়া, নন্দিতার সহপাঠিনী ছিল স্কুলে এবং কলেজে। বিয়ের পরে পাপিয়াকে কলকাতা ছেড়ে রাঁচিতে বছর দুই থাকতে হয়, চিন্ময়ের কর্মস্থলের পরিবর্তনের জন্যে। মাস ছয়েক আগে রাঁচি থেকে ফিরে আসে কলকাতায়। নন্দিতাদের বাড়ির কাছেই বাইপাসের ধারে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া নিয়ে থাকে। মাত্র দুকিলোমিটার মতো দূরত্ব! ইচ্ছে করলে হেঁটেই যাতায়াত করা যায়। কাছাকাছি থাকার দরুন ওরা মাঝেমাঝেই সান্ধ্য আড্ডা জমাত, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে।

ঘুরিয়েফিরিয়ে কখনও সুকান্তদের ফ্ল্যাটে, কখনও-বা চিন্ময়দের ফ্ল্যাটে। হালে এই আড্ডা মুলতুবি ছিল মাস দুয়েক হল, নিজেদের কর্মব্যস্ততার কারণে।

সিঁড়িতে পদশব্দ শুনে নন্দিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে হল ঘরে এল। সুকান্তর কাছে সদর দরজার ইয়েল লকের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। তাই দিয়ে দরজা খুলে দোতলায় চলে আসে। দোতলার ফ্ল্যাটে ঢোকার মেন দরজার ডুপ্লিকেট চাবিও থাকে ওর কাছে। নন্দিতার আজ অবাক হবার পালা। সুকান্তর সাথে অজয় আর চৈতালিকে দেখে চিন্ময় এবং পাপিয়াও খুব অবাক আর উত্ফুল্ল হয়ে উঠল। অজয় সুকান্তর কলেজমেট। সুকান্তর অফিসপাড়া, সল্টলেকে থাকে। অত ঘনঘন সুকান্তদের এই আড্ডায় যোগ না দিতে পারলেও, মাঝেমধ্যেই ওরাও সামিল হয়।

সবার মনে ওঠা কৌতহলের ইতি টানার জন্য সুকান্ত হেসে একটু গম্ভীর স্বরে বলল, অজয়ের সাথে আজ ফোনে কথা হয়, ও-ই কলটা করেছিল। ওকে আমাদের ফ্ল্যাটে আসার প্রস্তাবটা দিতেই রাজি হয়ে গেল। অফিস শেষে তাই ওদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে একসাথে চলে এলাম।

নন্দিতা কৃত্রিম রাগ করে বলল, তুমি আমার কাছেও চেপে গেলে, একটু আগেই তো কথা বলছিলাম তোমার সাথে। সুকান্ত কোনও উত্তর দিল না। শুধু মুখ টিপে হাসল।

নন্দিতা অজয়দা আর চৈতালির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, সত্যিই, তোমরা কতদিন পরে এবার এলে বলো তো? আজ সত্যিই যেন চাঁদের হাট বসেছে। অজয়দা প্রতিবাদের ভাষায় বলে উঠল, কিন্তু পূর্ণিমা আসতে এখনও এক সপ্তাহ বাকি যে! চৈতালি শুধু হাসল। অজয়দাকে সোফায় বসিয়ে বলল, তোমরা সবাই গল্প করো, আমি এখুনি আসছি। নন্দিতা রান্নাঘরে চা বানাতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে ছকাপ চা, বিস্কুট, চানাচুর, ঘরে বানানো কেক সমেত একটা বড়ো ট্রেতে সাজিয়ে নন্দিতা হল ঘরে প্রবেশ করে, সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিল। চায়ের কাপ সবার হাতে দিয়ে নন্দিতা স্মিত হেসে বলল, এবার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সবাই মিলে গল্প করা যাক। আচ্ছা আজ ডিনারের মেনু কিন্তু শুধু ভাত, ডাল, বেগুনি, ডিমের ঝোল আর টম্যাটোর চাটনি। ঠিক আছে?

চিন্ময় আর অজয় সমস্বরে বলে উঠল, আবার বাড়িতে ঝঞ্ঝাট করা কেন, কাছাকাছি কোনও হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে নিলেই তো হয়। সবাই মিলে ভালো করে আড্ডা দেওয়া যাবে তাহলে।

নন্দিতা আপত্তি করে বলল, রাইস কুকারে ভাত বানাতে কোনও ঝঞ্ঝাটই নেই। ডিম আর আলু সেদ্ধ বসিয়ে দিলে আপনা আপনিই হয়ে যাবে আর ঝোল বানাতে কয়েক মিনিট। ডাল আর টম্যাটোর চাটনি আমার সকালেই বানানো আছে। খেতে বসার আগে বেগুনি ভাজতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। এখন চায়ের সাথে আড্ডাটা জমানো যাক।

খানিক পরে চা আর স্ন্যাক্স খাওয়ার শেষে সুকান্ত, চিন্ময় আর অজয় পশ্চিম দিকের বারান্দায় গেল সিগারেট খেতে। বাইরে তখন বেশ অন্ধকার। দিঘির পাশে খালি মাঠটাতে ছড়িয়ে থাকা আলোর ফুলকি দেখে, অজয় আর চিন্ময় খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। অজয় আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। হঠাৎ বলে উঠল, তোদের এখানে এত ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি! দেখে মনে হচ্ছে যেন মাঠজুড়ে প্রচুর আলোর ফোয়ারা কেউ লাগিয়ে রেখেছে। কেমন নীলাভ-সবুজ, হলুদ আর ফিকে লাল রঙের আলো উড়ে বেড়াচ্ছে, মাঝে মাঝেই মাটি থেকে উপরে উঠে আসছে।

সুকান্তও ওর সাথে একমত হয়ে বলল, সত্যিই তাই। রোজ ডিনার শেষে এই বারান্দায় চেয়ারে বসে আমি আর নন্দিতা অনেক সময় ধরে জোনাকিদের ঝিকিমিকি দেখতে থাকি। অমন আলোর রোশনাই দেখতে দেখতে চোখে তন্দ্রাও চলে আসে। এক এক দিন বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে মনে হয়, আকাশের তারারা বুঝি মর্তে নেমে এসে ঝিকমিক করছে! ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে যায়।

চিন্ময় বলে উঠল, সত্যিই এটা অপূর্ব দৃশ্য। আমরা যেখানে থাকি এমন দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাই না। মেয়েদেরকে ডেকে নেওয়া যাক। পাপিয়া আর চৈতালি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যাবে।

অজয় মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বলল, একদম ঠিক বলেছ। আমাদের বাড়ির কাছে এই দৃশ্য কল্পনাতীত। মেয়েদেরকে ডেকে নেওয়া যাক। আড্ডাটা এই বারান্দায় বসেই জমানো যাক তাহলে। ঘরে ফ্যানের হাওয়া খাওয়ার থেকে বারান্দার এই ফুরফুরে বাতাস হাজার গুনে ভালো।

অজয় আর চিন্ময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মেয়েরা সবাই বারান্দায় এসে হাজির হল। খালি মাঠটাতে ওরকম আলোর রোশনাই দেখে চৈতালি আর পাপিয়া শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল না, সমস্বরে বলে উঠল, অপূর্ব! এমন আলোর ফোযারা আগে দেখিনি কখনও।

নন্দিতা ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমি আর সুকান্ত ডিনার শেষে এখানে বসে অপলক দেখতে থাকি। জানিস, এর মধ্যে পাঁচবার ওই মাঠটাতে জোনাকি ধরতে গিয়েছিলাম। কতবার হাতের তালুতে নিয়ে জোনাকিদের দপদপ করে আলো জ্বলতে দেখেছি। ঠান্ডা নরম আলো। গায়ে মাথায় বসে পড়ত ওদের কেউ কেউ। দু-তিন দিন তো বেশ কয়েকটা জোনাকি বাড়ি বয়ে নিয়ে এসেছিলাম, মাথার চুলে বসে ছিল!

চল না, ওই মাঠটাতে সবাই মিলে যাই, কিছুক্ষণ থেকেই চলে আসব। পাপিয়া ওর ধৈর্য আর ধরে রাখতে পারল না, নন্দিতার কাছে আবদার জানাল। ওর অনুরোধ সবাই মেনে নিতে রাজি হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। নন্দিতা অল্প কিছু সময় ওদের থেকে ধার চেয়ে নিয়ে রাইস কুকারে ভাত চাপিয়ে দিল। ডিম আর আলু সেদ্ধ করে রাখল। বেগুনি ভাজার প্রস্তুতিও রেডি করে রাখল।

 

মাঠে পৌঁছে সবাই বিশেষ করে মেয়েরা একদম শিশুসুলভ আচরণ শুরু করে দিল। একই স্থানে অমন শয়ে শয়ে জোনাকি সুকান্ত আর নন্দিতা ছাড়া বাকি সবাই আগে কখনও দেখেনি। জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল যেন, চলমান আলোর ঝরনা সাথে নিয়ে কখনও ফোয়ারার মতো, কখনও যেন উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো রূপ নিচ্ছিল জোনাকির ঝাঁক। মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছিল জোনাকির দল- ফুরফুরে বাতাসে ভেসে।

পাপিয়া খুব ভালো রবীন্দ্র সংগীত গায়। জোনাকি কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ গানটি গুনগুন করতে শুরু করতেই সুকান্ত বলে উঠল, শুধু গুনগুন করলে সবাই শুনতে পাবে কী করে? স্পষ্ট করে গাও। অনেকদিন তোমার গান শুনিনি। বাকি সবাই চেপে ধরতেই শেষমেশ ওকে পুরো গানটাই গাইতে হল।

অজয় আর চৈতালিও ভালো গায়। সবার অনুরোধ ফেলতে পারল না। শুধু একটা শর্ত করে নিল অজয়। বলল, পূর্ণিমা আসতে যদিও বেশ দেরি, আকাশে তেমন আলো নেই তবুও রবীন্দ্রনাথের এই গানটি গাইতে ইচ্ছে করছে। তোদের বাড়ির পূর্বদিকের ওই বিশাল অরণ্যটার কথা মনে পড়ছে। ওরা দুজনে গাইতে শুরু করল আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে…।

গানটি শেষ হলে সুকান্ত অজয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, না বন্ধু, আজ না পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে, না কারও ইচ্ছে করছে ওই বনের গহিনে যেতে এই অন্ধকার রাতে। সবাই ওর কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগল। আরও কিছুক্ষণ জোনাকিদের ঝিকিমিকি আলোর মাঝে থেকে ওরা সবাই ফিরে এল সুকান্তদের ফ্ল্যাটের পশ্চিম বারান্দায়।

নন্দিতা বাড়িতে এসেই বলে উঠল, আর এক রাউন্ড চা হয়ে যাক, কারও আপত্তি নেই তো?

চিন্ময় সায় দিয়ে বলল, একদম মনের কথাটা বললে…।

নন্দিতাকে হেল্প করতে পাপিয়া আর চৈতালি চলে গেল রান্নাঘরে। নন্দিতা চা বসিয়ে ডিমের ঝোল বানাতে লেগে গেল। খানিক বাদে সবার জন্যে কাপে করে চা নিয়ে হাজির হল বারান্দায়।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অজয় বলল, আচ্ছা আজ এমন একটি সুন্দর দিনে, সুকান্ত আর নন্দিতার কোনও গান শোনা হল না এখনও পর্যন্ত। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

পাপিয়া নালিশের সুরে বলল, একদমই নয়। কিছুতেই এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না যে, সুকান্তদা আর নন্দিতা ডিনার শেষে এই বারান্দায় বসে শুধু জোনাকিদের ঝিকিমিকি দেখে সময় কাটায়! এমন একটা রোমান্টিক দৃশ্যপট যেখানে বিদ্যমান, সেখানে একটাও আধুনিক গান হবে না এটা আমি অন্তত মানতে পারছি না। চিন্ময়, অজয় আর চৈতালি ওর সাথে মাথা নাড়িয়ে সহমত ব্যক্ত করে সমস্বরে বলল, পাপিয়া একদম ঠিক কথা বলেছে। সুতরাং ওদের একটা আধুনিক গান গাইতেই হবে।

নন্দিতা ওদের কথার ভঙ্গিতে না হেসে পারল না। বলল, ঠিক আছে গাইব, আমাকে অন্তত মিনিট পাঁচেক সময় দাও। আমি ডিমের ঝোলটা বসিয়ে এসেছি, ওটা নামিয়ে আসছি। তোমরা ততক্ষণ চা খাও আর গল্প করো।

কিছুক্ষণ বাদে নন্দিতা বারান্দায় ফিরে এসে সুকান্তর সাথে গান ধরল, এই রাত তোমার আমার, শুধু দুজনে…।  বাকি সবাই চোখ বুজে শুনছিল ওদের গান। গানটাতে দুজনেই হৃদয় উজাড় করে আবেগের সুর ঢেলে দিয়েছিল। গান শেষ হওয়ার পরে কেমন একটা রেশ রয়ে গিয়েছিল বাতাসে। পাপিয়াই নিস্তব্ধতা ভাঙতে বলল, সত্যিই, সুকান্তদা আর নন্দিতার মতো এমন রোমান্টিক জুটি বুঝি দ্বিতীয় আর একটিও নেই!

ঠিক, ঠিক। অজয় সম্মতি জানিয়ে বলে চলল, কলেজে একসাথে পড়াকালীন তো দেখেছি ওকে, কী ভীষণ রোমান্টিক ছিল। তখন থেকেই জানতাম ওর নন্দিতার সাথে প্রেমের কথা।

অজয়দা, একদম ঠিক বলেছ। স্কুল থেকেই তো নন্দিতাকে আমি জানি। আমার কাছে ও কোনও কথাই গোপন রাখত না। পাপিয়া সম্মতি জানাল।

চিন্ময় আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, ভাগ্যিস জোনাকিদের প্রেমোত্সব দেখতে গিয়েছিলাম একটু আগে, তাই তো সুকান্ত আর নন্দিতার রোমান্টিক মনের কথা আরও ভালো করে জানতে পারলাম আজ।

আমিও। চৈতালি মুখ টিপে হেসে বলল।

নন্দিতা প্রতিবাদের সুরে বলল, তোরা কিন্তু খুব লেগ পুলিং করছিস! চিন্ময়দা একটা কথা কিন্তু ঠিক বলেছে। জোনাকিরা কিন্তু ওই দপদপ করা আলোর মাধ্যমে প্রেমের সাংকেতিক বার্তা পাঠায়। সেইজন্যই বুঝি ওদের এই প্রেমোত্সব চলতে থাকে প্রতিদিন সন্ধের পর থেকেই!

নন্দিতার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। চৈতালি বলল, সে যাই হোক, জোনাকিদের এই দীপ জ্বেলে যাই আচরণ, ওই প্রেমোত্সবের আড্ডায় গিয়ে অনুভব না করলে, সুকান্তদা আর নন্দিতার কী অমন সুন্দর গানটার কথা মনে পড়ত আজ?

সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। খাওয়াদাওয়ার পাট শেষ করে সোফায় বসে খানিক সময়ের বিশ্রাম নিতে নিতে অজয় আর চিন্ময় আড্ডার যবনিকা টানতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

অজয় ধীর কণ্ঠে বলল, দারুণ আড্ডা হল আজ। জোনাকিদের ঝিকিমিকি, ওদের কাছ থেকে দেখা, সত্যিই একটা পরম প্রাপ্তি হল আজ। খুব সুন্দর কাটল সন্ধেটা। নন্দিতার ডিমের ঝোলটা এখনও মুখে লেগে রয়েছে। এবার উঠতে হবে, বেশ রাত হয়ে গেছে, ট্যাক্সির খোঁজ করতে হবে রাস্তায় গিয়ে৷

চিন্ময় অজয়কে আশ্বস্ত করে বলল, আমি তোমাদের পৌঁছে দেব। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।

অজয়, চিন্ময়, পাপিয়া আর চৈতালি চলে যাবার পরে সুকান্তদের ফ্ল্যাটটা খুব ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু জোনাকিদের ঝিকিমিকি থেমে থাকল না। কী একটা অপ্রতিরোধ্য মোহ যেন সেদিনও সুকান্ত আর নন্দিতাকে টেনে নিয়ে গেল পশ্চিম বারান্দায়, আবার সেই রমণীয় দৃশ্য দেখতে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...