যারা হার্নিয়ার শিকার হয়েছেন তারা জানেন, এই অসুখ কতটা যন্ত্রণাদায়ক! অতএব, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হলে হার্নিয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। তবে হার্নিয়ার বিষয়ে অনেকের ভুল ধারণা আছে কিংবা এই অসুখটি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। যেমন– হার্নিয়া শুধু ছেলেদেরই হয় এবং কুঁচকিতে হয়, এমন ভুল ধারণা পোষণ করেন অনেকে। তাই সকলের সুবিধের জন্য  এই বিষয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন ডা. সঞ্জয় মন্ডল।

  •  হার্নিয়া কেন হয় এবং এর লক্ষণ কী?

হার্নিয়াকে আক্ষরিক অর্থে বলা হয় অন্ত্রবৃদ্ধি রোগ। আমাদের পেটের কিছু অংশ আছে, যেগুলি আশপাশের অংশ থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা পাতলা পর্দার মতো থাকে। অনেকের ওই অংশগুলি দুর্বল থাকে জন্মগতভাবে। কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে কিংবা খুব জোরে হাঁচলে কিংবা কাশলে যদি চাপ বেশি পড়ে পেটের ভেতরে, তাহলে দুর্বল অংশগুলি দিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্র (খাদ্যনালি) বেরিয়ে আসতে পারে। ভারী কোনও জিনিস তুললে কিংবা বহন করলেও এই সমস্যা হতে পারে। সাধারণত উদর (পেট) এবং উরুর সংযোগস্থলে হার্নিয়া হয় পুরুষদের। ফুলে ওঠে অণ্ডথলি। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে নাভির চারপাশে কিংবা একপাশে ফুলে গিয়ে হার্নিয়া হয়। আগে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে এমন কোনও জায়গাতেও হার্নিয়া হতে পারে। সন্তান প্রসবের পর ভারী কাজ কিংবা বারবার সিঁড়ি ভাঙলেও হতে পারে হার্নিয়া।

  •  বাচ্চারাও কী হার্নিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে?

যে-কোনও বয়সের নারী-পুরুষের হার্নিয়া হতে পারে। বাচ্চারাও হার্নিয়ার কবলে পড়তে পারে।

  •  হার্নিয়ার রোগনির্ণয় করা হয় কীভাবে?

শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। কুঁচকির আশপাশের ফোলা ভাব দেখে হার্নিয়া নির্ণয় করা হয় প্রাথমিক ভাবে। আর কাশলে যেহেতু হার্নিয়া স্পষ্ট রূপ নেয়, তাই রুগিকে জোরে কাশতে বলেও রোগনির্ণয় করা হয়। তাছাড়া, বেশি হাঁটাচলা করলে রুগি যদি যন্ত্রণাবিদ্ধ হন, তাহলেও হার্নিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় অনেকটাই।

  •  হার্নিয়া বড়োরকম শারীরিক জটিলতা তৈরি করে কি?

অপারেশন-এর মাধ্যমে যদি হার্নিয়ার চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে হার্নিয়া ক্রমশ বড়ো আকার ধারণ করে চারপাশের টিস্যুগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এর থেকে বড়োরকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে হার্নিয়ার মারাত্মক জটিলতা হল, যদি অন্ত্রের অংশ পেটের দেয়ালের দুর্বল জায়গায় আটকে যায়। এক্ষেত্রে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, বমি পায় এবং মলত্যাগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেইসঙ্গে অন্ত্রের আটকে পড়া অংশে রক্ত চলাচল কমে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় স্ট্রাংগুলেশন। এতে আক্রান্ত অন্ত্রের টিস্যুর মৃত্যু ঘটতে পারে। স্ট্রাংগুলেটেড হার্নিয়া একটি জীবন-মরণ সমস্যা। এই ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে সার্জারির প্রয়োজন হয়।

  •  হার্নিয়ার চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?

হার্নিয়া কোনও ওষুধে ঠিক হয় না। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান– সার্জারি। হার্নিয়া ছোটো থাকলে, অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় থাকলে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হয়। তিন কিংবা চারটি ছোট্ট ছিদ্রকে মাধ্যম করে হার্নিয়ার সমস্যা দূর করা যেতে পারে কিন্তু হার্নিয়া বেড়ে গেলে তা আর সম্ভব নয়। তখন কয়েক ইঞ্চি কেটে হার্নিয়োগ্রাফি কিংবা হার্নিয়োপ্লাস্টি করতে হবে। হার্নিয়োগ্রাফিতে বেরিয়ে আসা অন্ত্রকে ঠেলে পেটের মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়। তারপর দুর্বল বা ছেঁড়া মাংসপেশি সেলাই করে ঠিক করতে হয়। আর হার্নিয়োপ্লাস্টিতে এক টুকরো সিনথেটিক মেশ লাগিয়ে সেলাই, ক্লিপ অথবা স্টেপল করা হয়। তবে হার্নিয়া প্রাথমিক অবস্থায় (ছোটো) থাকলে ল্যাপরোস্কোপিক সার্জারি করাই ভালো। কারণ, এক্ষেত্রে মাত্র দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। আর যদি কয়েক ইঞ্চি কেটে হার্নিয়া অপারেশন করতে হয়, তাহলে স্বাভাবিক হয়ে কাজে ফিরতে সময় লাগবে চার থেকে ছয় সপ্তাহ।

জরুরি পরামর্শ

  •  বয়স এবং উচ্চতা অনুসারে সঠিক মাত্রায় দেহের ওজন বজায় রাখতে হবে। এতে হার্নিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে হবে। এর জন্য ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে উপযুক্ত পরিমাণে। কারণ, মলত্যাগের সময় পেটে চাপ পড়লে হার্নিয়া হতে পারে।
  • বেশি ভারী জিনিসপত্র হাত দিয়ে তোলা কিংবা বহন করা উচিত নয়। আর যদি ভারী জিনিস বহন করতেই হয়, তাহলে হাঁটু ভাঁজ করে করবেন। কারণ, ভারী জিনিস তোলার চাপেও হার্নিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • ধূমপান বন্ধ করতে হবে। কারণ, ধূমপান দীর্ঘস্থায়ী কাশির সৃষ্টি করে। আর জোরে কাশলে হার্নিয়া হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হবে।
  • একটানা দীর্ঘ সময় হাঁটবেন না কিংবা দাঁড়িয়ে থাকবেন না, মাঝেমধ্যে বসে-শুয়ে বিশ্রাম নেবেন।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...