উন কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে টাটানগর থেকে হাওড়া ফিরছিল প্রকাশ। তার এমআর-এর চাকরি। আগের দু-দিনে সব ডক্টর্স চেম্বার ভিজিট করা হয়নি। শনি-রবিতে প্রায় সব চেম্বারে রোগীর এত লাইন থাকে যে,পাঁচ মিনিট ডেমনস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য এক দেড় ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই আজ সকালেও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ঘন্টা চারেক টাটানগরে টো টো করে ঘুরতে হল। অভ্যাস অনুযায়ী সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ারও সময় মেলেনি। ট্রেনে চেপে ব্যাগটা কোনও মতে বাংকে তুলে প্রকাশ দৈনিকটা খুলে বসেছে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে আর তার হুঁশ ছিল না। কাগজের ষোলো-সতেরো পাতা যখন প্রায় মুড়ো ল্যাজা করে পুরোপুরি পড়া হল, তখন ট্রেন ঝাড়গ্রামে ঢোকার আগে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছে।

ঘড়ি দেখে বিরক্ত হল প্রকাশ, কুরলা এক্সপ্রেস টানা দুঘন্টা টাটায় লেট ছিল, আর এখন তিন ছুঁই ছুঁই। কত রাত করে যে হাওড়া ঢুকবে, ভগবানেরও অজানা। ওঠার পরে এতটা সময় পার করে দিয়ে, এই প্রথম কামরার অভ্যন্তরে চোখ বুলোবার ফুরসত পায় প্রকাশ। লম্বা সিটে তাকে নিয়ে চার চার আটজন, ওপাশে জানালার ধারে সিঙ্গল সিটে আরও দু’জন। সকলেই দেহাতি, মলিন পোশাক। এদের কেউ খড়গপুরের এপারে যাবে বলে মনে হয় না। তাতে অবশ্য প্রকাশের কিছুই হেলদোল নেই। যেন আগুনের পরশমণি প্রাণে জাগিয়ে বসে আছে।

প্রায় দু’বছর ধরে মাসে দু’তিনবার ট্রেনে জার্নি করা খাওয়া-শোয়ার মতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কথা বলার মতো সঙ্গীর দরকার হয় না। অনেকে বলে খালি ট্রেনে চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়, প্রকাশ আমল দেয় না। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ে, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন, ভাববে কী বিষম এই কান্ডখানা।’ হঠাৎ আলো মানে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠির গুঁতো আর গুলির খোঁচা। তবে কুরলা নিয়ম করে লেট করে ঠিকই, কিন্তু ভিড় কমে গেলে কামরায় চুরি ছিনতাই হয়, এই গাড়ির বেলায় এমন বদনাম শোনেনি। নিজেও তো এল গেল এবার নিয়ে সাত-আটবার।

ফালতু কথা আর না ভেবে প্রকাশ ঝাড়গ্রাম প্ল্যাটফর্মে চোখ বোলাতে থাকে। সকালে ইস্পাত এক্সপ্রেসে আসার সময় দেখেছে, স্টেশন লোকের ভিড়ে জমজমাট আছে। এখন শুনশান। ঝাঁকড়া গাছগুলোয় কিচিরমিচির করে পাখিরা আসর জমিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর, মানে লুপ লাইনে গাড়ি থেমেছে। হয়তো, এখানেও খানিক লেট করানো হবে। বিরক্ত মুখ কামরার ভেতরে ফেরাতে গিয়েই চোখ পড়ল ভদ্রমহিলার দিকে। এখান থেকেই উঠলেন। হাতে ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগ, জলের বোতল। উলটোদিকের সিটে বসতে চাইতেই দুই দেহাতি বুড়ো নিজেদের মধ্যে ছ’ইঞ্চি জায়গা খালি করে দিল। ভদ্রমহিলা বেশ দ্বিধায় পড়েছেন, প্রকাশ দেখেই বুঝতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনি বরং এই জানলার ধারে এসে বসুন, আমি ওপাশে চলে যাচ্ছি।

– থাক না, একটু বাদে খড়গপুরে অনেকে নেমে যাবে মনে হয়। তখন ভালো করে বসব।

– আরে বসুন। আমি টাটা থেকে জানালার ধারে এলাম।

ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ালেন না। বসতে গিয়ে প্রকাশকে একটা অনুরোধ করলেন– আমার এই ব্যাগটা যদি বাঙ্কের একটু ভিতর দিকে তুলে দেন। বেঁটে চেহারার মানুষকে এই সাহায্যটা প্রতিবারই কারও না কারও কাছে চাইতে হয়।

প্রকাশ হেসে ফেলল। ‘বেঁটে’ শুনে ভদ্রমহিলাকে প্রথম ভালো করে দেখল। তখনই মনে হল, আগে কোথাও দেখেছে।

এইমাত্র জানালা ছেড়েছে, এইবার গায়ে পড়ে ‘মনে হচ্ছে আগে কোথাও যেন দেখেছি আপনাকে’ বলাটা নাটকের মতো হয়ে যাবে। মহিলা সুন্দরী হলেও বিবাহিতা, বয়সে ওর সমান কিংবা খানিক বড়োও হতে পারেন। বাড়তি মনোযোগ দেবার তেমন কোনও কারণ নেই। তাই প্রশ্নটা ঢোঁক গিলে মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কে ব্যাগ ওঠাল প্রকাশ। দুই বুড়োর মাঝখানে আলগোছে বসতেই ট্রেন নড়ে উঠল।

বাঁশতলা এবং সারদিয়া স্টেশন পার হয়ে খেমাশুলিতে গাড়ি আবার ঘটাং করে থেমে গেল। তখনই কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পিলপিল করে উঠতে থাকে আদিবাসী মহিলারা। মিনিট দুই তিনেকের মধ্যে লোকাল ট্রেনের চেহারা নিল কুরলা এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস। দুই সিটের মধ্যে এত লোক ঢুকেছে যে, নড়াচড়া করাই দায় হল। কুরলা এক্সপ্রেসে এতবার ফিরেছে প্রকাশ, এরকম ঘটনা আগে কখনও চোখে পড়েনি। মনে করে দেখল, স্টপেজই নেই লো-লেভেল স্টেশন খেমাশুলিতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল চমকে মোড়া বিস্ময়– এত লোক এই জঙ্গল দেশে কোথা থেকে এল?

– কপালে সিঁদুর লেপা দেখে বুঝতে পারছেন না, এরা গুপ্তমণির পুজো দিতে গিয়েছিল। আজ হয়তো কোনও বিশেষ উৎসব আছে। হাইওয়েতে বাস বন্ধও হতে পারে। জানলার ধারে ভদ্রমহিলা বললেন।

অনেকক্ষণ পরে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল প্রকাশ। ভিড়ের মধ্যে মুখটুকুই শুধু দেখতে পাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল, সবার কপালে টিপ তো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু গুপ্তমণি আবার কে?

– তিনি আমাদের দুর্গা বা কালীর মতো এই এলাকার আদিবাসীদের প্রিয় এক দেবী। সবাই বলে খুব জাগ্রত। হাইওয়ে দিয়ে বাসে গেলে দেখতেন, যাত্রী থেকে ড্রাইভার কন্ডাক্টর, সকলে মন্দির পার হওয়ার সময় নমস্কার করে পয়সা ছুড়ে দেয়। সেই পয়সা কুড়োতে মন্দিরের পনেরো কুড়ি জন লোক সবসময় ছুটে বেড়ায়।

প্রকাশ এমন বিচিত্র দেবীস্থানের মাহাত্ম্যের কথা শুনে মজা পায়। উপরন্তু অবাক ভাব চাপতে না পেরে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করে– আপনি এখানকার অনেক কিছুই জানেন দেখছি!

– এটা জানার মতো কোনও বিষয় নয়। ঝাড়গ্রামে আমার প্রায় আঠারো উনিশ মাস মানে দেড় বছরেরও বেশি চাকরি হয়ে গেল। উইকেন্ডে ফিরে যাই। এই ট্রেন প্রায় দিনই লেট করে। তখন বাস ধরে খড়গপুর বা গিরি ময়দান যেতে হয় লোকাল ট্রেন ধরার জন্য। সেই বাসেই দেখেছি গুপ্তমণির মন্দির।

প্রকাশ কথা ঘোরায়– আপনার চাকরি ঝাড়গ্রামে, রাজ কলেজে নাকি?

– বাঃ, আপনিও তো দেখছি অনেক কিছু জানেন। রাজ কলেজের নাম বলে দিলেন। তবে, আমি স্কুলে পড়াই, রানি বিনোদ মঞ্জরী।

– এ নামটাও শুনেছি মনে হচ্ছে। মেয়েদের স্কুল। বোধহয় সরকারি।

– ঝাড়গ্রাম তো দেখছি, আপনার নখদর্পনে। অথচ গুপ্তমণির নাম শোনেননি?

– আসলে, আমার এক মেসোমশাই বেশ কয়েক বছর আগে রাজ কলেজে পড়াতেন। সরকারি কলেজ তো, হুগলি মহসিন থেকে দু-বছরের জন্য ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছি। বলে রাখি, আমার সেই মেসোমশাইয়ের নাম জগৎ লাহা।

– তাই বলুন।

– এখনও রাজবাড়ি, জঙ্গলমহল, চিলকিগড় আর ডুলুং নদীর কথা ভালোই মনে আছে। মেসোমশাই যে জায়গাটায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেখানকার নাম রঘুনাথপুর না রঘুনাথগঞ্জ কী যেন।

এবার ভদ্রমহিলার অবাক হওয়ার পালা। বললেন– আপনার স্মৃতি দেখছি একেবারে টাটকা রয়েছে। আমিও রঘুনাথপুরে থাকি, স্টেশনের কাছেই।

ভিড়ের চাপে, বাচ্চাদের তারস্বরে কান্না আর বায়নায় একসময় কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। আধঘন্টা বাদে শেষ বিকেলের সোনা হলুদ আলো মেখে খড়গপুর স্টেশনে ঢুকল ডাউন কুরলা এক্সপ্রেস।

কামরা খালি করে প্রায় সবাই নেমে গেল। প্রকাশদের খোপে সে এবং ভদ্রমহিলা ছাড়া উলটোদিকের জানালার ধারের লোকদুটো শুধু বসে রইল। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি জানালায় সরে গেল প্রকাশ। দেখতে চেষ্টা করল, প্ল্যাটফর্মে কোনও কফিওয়ালা দেখা যাচ্ছে কি না। তখনই এদের খোপে ফাঁকা সিটের দখল নিল জনা পাঁচেক লোক। হাবভাব দেখে ডেলিপ্যাসেঞ্জার বলে মনে হচ্ছে। ধুপধাপ বসেই কোনও কথা না বলে সিগারেট ধরাল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় খোপটা নরক গুলজার করে তুলল। প্রকাশ দেখল, উলটোদিকে ভদ্রমহিলা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করছেন। বিরক্ত মুখে ও লোকগুলোর দিকে ফিরল। বলল– কম্পার্টমেন্টের ভিতরে এভাবে স্মোক করছেন কেন? জানেন না, এটা নিষিদ্ধ? দরজায় দাঁড়িয়ে শেষ করে আসুন।

লোকগুলো উঠে যাওয়ার কোনও গরজ দেখায় না। যেন কথা শুনতেই পায়নি। প্রকাশ আবার তাই গলার জোর আরেকটু বাড়িয়ে বলে– আপনাদের বলছি, সিগারেটগুলো দরজায় গিয়ে ফিনিশ করে আসুন। আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।

এইবার দলের একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল– বেশি বকবেন না তো। রোজই আমরা এই ট্রেনে যাই।

এইবার প্রকাশের রাগ বেড়ে যায়। উঁচু গলায় বলে কী বলতে চান আপনারা, রোজ এক ট্রেনে গেলে কি আইন ভাঙার অধিকার জন্মায়?

– আইন আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখাবেন। জানালায় বসেছেন, খানিকক্ষণ এখন নাকে রুমাল চাপা দিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখুন। সিগারেট একসময় নিজেই ফুরিয়ে যাবে।

রাগে লাল হয়ে উঠল প্রকাশ। কোনওরকম সিভিক সেন্স নেই এদের। একবার ভাবে, টিটিই-র কাছে কমপ্লেন করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভেস্টিবিউল কম্পার্টমেন্ট নয়, টিটিই-কে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, তার ঠিক নেই। কমপ্লেন করেও কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে প্রকাশের। যাতায়াতের পথে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকজন তো কম দেখল না। তাই প্রকাশ একবার ভাবল, তর্ক চালিয়ে যাবে। তাতে পরের রাউন্ডে সিগারেট ধরানোর আগে লোকগুলো অন্তত দ্বিতীয়বার ভাববে। শেষ পর্যন্ত উলটোদিকে বসা সদ্য পরিচিতার অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ভদ্রমহিলাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার আবার মনে হল, খুব চেনা। স্মৃতি হাতড়ে বিরক্তি আর সময় কাটাতে থাকল প্রকাশ। সংবিৎ ফিরল মেচেদা পৌঁছে, জানালার কাছে ‘গরম চপ-সিঙাড়া’ ওয়ালার বাজ পড়ার মতো হাঁক শুনে। কামরার ভেতরে তখন টিমটিমে আলো জ্বলে উঠেছে। পাশের লোকগুলো যথারীতি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাঁটুতে হাঁটুতে তোয়ালে পেতে তাস খেলার আসরে মেতে উঠেছে। অকারণে তর্ক জুড়ে কামরা ফাটাচ্ছে। সামনে ভদ্রমহিলা যথারীতি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে রয়েছেন, দৃষ্টি প্রকাশের দিকে। এক পলকে দেখল ও, তার চোখেও কেমন অবাক করা ভাব। এ চোখের ভুল, ভেবে প্রকাশ দৃষ্টি ফেরাল মেচেদার ভিড়ের দিকে।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই বাইরের ঝুপসি অন্ধকার ধেয়ে এল। ভিতরে পরিবেশ এতই বিরক্তিকর যে, বাইরের সে অন্ধকার রাজ্যে চোখ সওয়াবার চেষ্টা করতে থাকে প্রকাশ। গাড়ি এবারে বেশ গতি নিয়েছে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের সেতু পার হওয়ার পর ও আবার ভাবতে শুরু করে, সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ও কোথায় দেখতে পেয়েছে আগে। এমন সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হয়তো টয়লেটে যাবেন। তাসখেলা লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন– তোয়ালেটা একটু সরিয়ে নিন, আমি বাইরে যাব। খেলা থেকে চোখ না সরিয়ে একজন কড়া গলায় জবাব দেয়– এখন গোটানো যাবে না। সিটে গিয়ে বসুন। সাঁতরাগাছি ঢুকলে খেলা শেষ হবে।

– তা কেন? আমাকে যেতে দিন।

তাসুড়ের গলা এবার আরও চড়ল– বাইরে যাওয়ার এত তাড়া থাকলে জানালার ধারে বসেন কেন? নিজের বাড়ির সব সুবিধা তো ট্রেনে মেলে না।

একে ভদ্রমহিলা, তায় তার ওপর মানসিক জবরদস্তি। মনে হচ্ছিল প্রকাশের, ভদ্রমহিলার বাথরুমে যাওয়ার কথা শুনে তাঁর মন এবং শরীরকে মানসিক ভাবে ভিসুয়ালাইজ করছিল তারা।

আরেকজন চোখ নাচিয়ে বলল– আমি ঘোড়াঘাটা যাচ্ছি। এই তো ঘোড়াঘাটা চলে এল বলে। আর বড়োজোর ঘন্টা খানেকের মামলা। মেয়েরা তো ঘন্টার পর ঘন্টা বাথরুম চেপে রাখতে পারে।

সংকোচে বাক্রুদ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বসে পড়লেন। এতক্ষণ প্রকাশ চুপচাপই ছিল। মন বসাতে চেষ্টা করছিল বাইরের অন্ধকারে। এবারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। উঠে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে বলল– খেলা বন্ধ করুন এবার।

লোকগুলো কথা শোনার পাত্র নয়। ওর চেয়েও এক কাঠি বেশি রাগ দেখিয়ে একজন বলল– আপনি তখন থেকে ফালতু বকে চলেছেন কেন বলুন তো। সব প্রসঙ্গের মধ্যে ঢুকছেন! যার বাথরুম যাওয়ার দরকার ছিল তিনি তো চুপচাপ বসে রয়েছেন।

– নোংরা কথা বলবেন না। মহিলাদের সঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে কথা বলতে জানেন না আপনারা?

– আমরা জানি না, আর আপনি দরকারের চেয়ে বেশি কথা বলেন। এই তো শোধবোধ হয়ে গেল। এবারে তবে থামুন।

নিজেকে প্রকাশ আর সামলে রাখতে পারল না। কলার চেপে ধরল সবচেয়ে উঁচু গলার লোকটার। তখন বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাশের উপর– ছাড় শালা। রাজার চালে যাবি তো এসিতে চাপতে পারতিস। মেয়েরা সেখানে সারাদিন বার্থ আর বাথরুম করে কাটালেও কেউ কিছু বলবে না।

সিঙ্গল সিটে বসা লোকদুটোর দিকে ফিরে মরিয়া ভাবে প্রকাশ বলে– শুনুন আপনারা। আবার নোংরা কথা বলছে। এরা মহিলাদের সম্মান করে না। আপনারা চুপ করে থাকবেন?

প্রকাশের আশা বৃথা। গ্রাম্য লোকদুটো এদিকেই তাকিয়ে বসেছিল, কথা শুনে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জানালার দিকে ঘুরে বসল। পাশের খুপরি থেকে কয়েকটা উৎসুক মুখ উঁকি দিল। তাদের একজন তাসপার্টির নেতাকে জিজ্ঞাসা করে– কীসের ঝামেলা, মজুমদারবাবু? হাত লাগাতে হবে নাকি?

– আরে না দাদা, একজন অসভ্য লোক সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ভাট বকেই যাচ্ছে। আমরা চেপে বসিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে মহিলা থাকলে সবাই তো একটু বীরত্ব দেখাতে চায়। প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয়ে গেল নিজের অসহায়তা অনুভব করে। নোংরা লোকগুলো দলে ভারী। এদেশে সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক ক্রমেই কমে আসছে। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিজের সিটে বসে পড়ল প্রকাশ। ও এবং সামনের মহিলা, দু’জনের দৃষ্টি মাটির দিকে। তাসুড়েরা কিন্তু নির্বিকার, তাসের চাল নিয়ে আবার তুমুল তর্কে ফিরে গেল। একটু বাদে খুপরির ভিতরের অস্বাভাবিক গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করে প্রকাশ– আপনি যাবেন কোথায়?

– চন্দননগর।

– আজ অনেক রাত্রি হয়ে যাবে হাওড়া ঢুকতে। ন’টা আটান্নোর মেন লাইন বর্ধমানটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে।

– আপনি কি ওদিকেই?

– হ্যাঁ, কিন্তু আপনার অনেক আগে নামব, কোন্নগর।

মৌড়িগ্রামে কুরলা ঢুকছে। আউটার সিগনাল লাল হয়ে থাকায় থেমে গিয়ে ঘন ঘন হুটার বাজাচ্ছে। এইবার তাসপার্টির আসর গোটানোর তাড়া লাগল। তোয়ালে ভাঁজ করতে করতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল– আমি ভাবলাম লোকটা নিজের লোকের জন্য গলা ফাটাচ্ছে, এখন দেখছি অচেনা।

আরেকজন হেসে গড়িয়ে গিয়ে বলল– মজুমদার, মেয়েদের মতো ন্যাকামি কোরো না। তুমিও বয়সকালে পরিচিত মহিলার কাছে এমনই হিরো সাজতে চাইতে।

– তা হতে পারে, কিন্তু মালটাকে কোন্নগরে আগে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

– ফি হপ্তায় আটটা দশটা করে ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে উঠছে আর কত উটকো লোক রোজ থাকতে আসছে। কোন্নগরের বনেদি লোক বলে কি সবাই তোমার চেনা হবে?

– তা একরকম ঠিকই বলছ। আমরাই এখন কোন্নগরে কোণঠাসা।

ওরা ভাব এমন করছিল যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু প্রকাশ ও ভদ্রমহিলা দুজনের কানেই যাতে পৌঁছোয়, ততটাই জোরে বলছিল।

মহিলা আবার সংকুচিত হলেন। তাসের আসর গোটানো হতেই টয়লেটের দিকে চলে গেলেন। প্রকাশ একটুক্ষণ আগে যে লোকটার জামার কলার চেপে ধরেছিল, সে এই সুযোগে ওর দিকে ফিরল। গলায় দারুণ ঘৃণা ঝরিয়ে বলল– ঝামেলা পাকানো ধাতে নেই বলে আজ ছাড় পেয়ে গেলে। অন্য কারও গায়ে হাত দিলে মেরে শুইয়ে দিত। আমিও কোন্নগরে থাকি, তিনপুরুষের বাস। মুখটা ভালো করে চিনে রাখো।

বিরক্ত প্রকাশ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা যে-দিকে গিয়েছেন তার উলটোদিকের টয়লেটের পথে পা বাড়াল।

শেষবার প্রতিদিনের নিয়মমতো ট্রেনটা মার খেল টিকিয়াপাড়া ইয়ার্ডে। হাওড়া ঢুকল দশটা বাজার পর। তাসপার্টি শেষবার প্রকাশের দিকে আগুনের মতো দৃষ্টি হেনে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। বাংক থেকে নিজের ও ভদ্রমহিলার ব্যাগ নামাতে নামাতে বলল প্রকাশ– চলুন, একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে দশটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকালটা মনে হয় পেয়ে যাব। কোন্নগর পর্যন্ত একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। তারপরেও ট্রেনে ভালো ভিড় থাকে। ভয় পাবেন না।

ভাগ্যক্রমে ব্যান্ডেল লোকালে পাশাপাশি দুটো সিট পাওয়া গেল। ট্রেন ছাড়ল। মাত্রই কয়েকটা স্টেশন পার হয়ে কোন্নগর। প্রকাশ ‘এবার আসি’ বলে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল ভিড় ঠেলে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে বলে। কোন্নগরে ট্রেন ঢোকার মুখে ভদ্রমহিলা গলা তুলে জানতে চাইলেন– এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, আপনার নাম কী ভাই?

পিছনে প্রবল ঠেলা খেতে খেতে প্রকাশ কোনওমতে জবাব দিল– প্রকাশ সেনগুপ্ত, আপনার?

উত্তর শোনার আগেই এক ধাক্বায় প্লাটফর্মে। প্রকাশ ট্রেনের জানালায় হাত নাড়তে যেতেই ভদ্রমহিলা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এলেন জানালার সামনে। বললেন– প্রকাশ আমি তোমার পারমিতা দিদি। ঝাড়গ্রাম থেকে মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি। এইমাত্র চিনতে পারলাম। আর কোনও কথা হওয়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ব্যান্ডেল লোকাল। প্লাটফর্মে হতবাক প্রকাশ। সেও এইমাত্র চিনতে পেরেছে পারমিতা দিদিকে। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হারিয়ে যাওয়া।

দুঃখিত প্রকাশ মনে মনে ফিরে গেল চব্বিশ পচিঁশ বছর আগে। স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে। তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে ঢাকুরিয়ায়। স্কুল বাসে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে স্কুলে যাতায়াত করত ও। বড়ো ছেলেরা বাসের জানালা আর প্যাসেজের দিকের সিট সবসময় আগলে রাখত, ওকে কিছুতেই মাঝখানে ছাড়া বসতে দিত না। দুজনের মাঝখানে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে স্কুলে যাওয়া যেন অলিখিত নিত্যনৈমিত্তিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওঠা নামার সময় তাড়াহুড়ো করলেও দাদারা টেনে ধরে আটকে, অকারণে চড়চাপড় লাগাত। বাসের কাকুদের কাছে দু-একবার কাঁদো কাঁদো হয়ে অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। বাসযাত্রার ভয়ে ‘কাল স্কুলে যাব না’ একসময় নিত্যনৈমিত্তিক বোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকাশের। রোজ শুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ আর সকালে ঘুম থেকে চোখ ছাড়ানোর পর একপ্রস্থ।

সমস্যাটা কী, তা জানতে বাবা-মা বারদুয়েক স্কুলের আন্টির সঙ্গে দেখাও করে এলেন। স্কুল থেকে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ না পেয়ে তারাও দিশাহারা হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় একদিন স্কুলবাসে যেতে পাদানিতে উঠতে আরম্ভ করে ডাকাবুকো পারমিতা দিদি। প্রকাশ যখন ক্লাস ওয়ান, পারমিতা তখন সিক্স। ওদের স্টপ থেকে দুটো কালো সাপের মতো লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে উঠত। ছোট্ট প্রকাশের ওপর বড়োদের অত্যাচারের কথা শুনে দু-তিনদিন পরেই কাছে ডেকে নিল। জানালার সিট ছেড়ে সেখানে বসতে দিল। বড়ো ছেলেদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে দিল– আজ থেকে রোজ তুই আমার পাশের সিটেই বসবি। কেউ মেরে তুলে দিতে এলে আমাকে বলবি, তাকে উচিত সাজা দেব। এরপর থেকে অনেকদিন ধরে প্রকাশকে আগলে আগলে রাখত পারমিতা দিদি। এর জন্য দাদাদের সঙ্গে ঝগড়াও করত। একসময় তাই বাসের সকলে পারমিতা দিদিকে ‘প্রকাশের বডিগার্ড’ বলে ডাকতে শুরু করে।

অভিভাবক মহলেও নামটা ছড়িয়েছিল। প্রকাশের বাবা-মা ছেলের বডিগার্ডকে খুব ভালোবাসতেন। প্রকাশ স্কুল বদল করার আগে পর্যন্ত তার প্রত্যেক জন্মদিনে বডিগার্ড-এর নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। প্রকাশরা কোন্নগরে নিজেদের বাড়িতে উঠে আসতে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আজকের ঘটনার কথা ভেবে অসহায় প্রকাশের নিজের প্রতি চরম বিরক্তি জাগল, অসভ্য লোকগুলো দিদিকে অপমান করে গেল আর উচিত জবাবটুকুও একজন পুরুষ হয়ে সে দিতে পারল না। নিজের দু’গালে চড় কষালেও বোধহয় খারাপ লাগা দূর হবে না।

কোন্নগরে তখন রাত প্রায় এগারোটা। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশ। কুরলা এক্সপ্রেসের সেই তাসুড়েদের মধ্যে কোন্নগরের বাসিন্দা দু’জন প্লাটফর্ম থেকে নামার পথে আবিষ্কার করল তাকে। শুনিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে বলল– দ্যাখ, ভ্যাবলাটা দাঁড়িয়ে আছে। বউদির বডিগার্ড।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...