দুটো হাঁড়ি প্রায় কাঁকড়াতে ভরে এসেছে। জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে এখন কোমরের কাছে। মঙ্গলা সতর্ক হয়। হাঁড়িদুটো ভেসে যেতে পারে। সে কোমর থেকে গামছা খুলে তার দু’প্রান্ত দিয়ে হাঁড়িদুটোকে বাঁধল। তারপর একটা গরান গাছের গায়ে জড়িয়ে দিল।

সেই সকাল থেকে সে কাঁকড়া ধরছে। মাতলা যেখানে পিয়ালির সঙ্গে মিশেছে, সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে চর পড়েছে। আর সেই চরে হেঁতাল, গরান, বাইন আর গেঁয়ো গাছের জঙ্গল বসেছে। জঙ্গলের কাদামাটির মধ্যে অসংখ্য গর্ত। গর্তে বাস করে সুন্দরবনের গাঙের রাক্ষুসে সব কাঁকড়ারা। জোয়ারের জলে যখন গর্তগুলো ডুবে যায়, পেল্লাই সাইজের বড়ো বড়ো দাড়াওয়ালা সব কাঁকড়া বেরিয়ে আসে খাবারের সন্ধানে। আর সেই ক্ষুধার্ত কাঁকড়াগুলোর সামনে তখন টোপ হিসেবে ফেলা হয় মরা মাছ, পচা শামুক। একটা লাঠির মাথায় দড়ি বাঁধা হয়। দড়ির শেষ প্রান্তে খোলামকুচি বা ইটের টুকরো বেঁধে ভারী করা হয়। একে বলে সুতো। এই সুতোর ডগায় চার বেঁধে লাঠিটা মাটিতে পুঁতে দিয়ে সরে আসতে হয়। ক্ষুধার্ত কাঁকড়াগুলো যখন বড়ো বড়ো দাড়া দিয়ে চার খেতে আসে, তখন লাঠিতে টান পড়ে। আর মঙ্গলারা হাতের ছোটো ঝাঁকনিজাল দিয়ে কাঁকড়াটাকে ধরে হাঁড়ির মধ্যে চালান করে। সুন্দরবন অঞ্চলের অনেক মানুষেরই জীবিকা এই কাঁকড়া ধরা।

মঙ্গলারও তাই। মেয়ে তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। একমুঠো পান্তা খেয়ে সুতোর গোছা হাঁড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে আরও অনেকের সঙ্গে। গাঁয়ের অনেক মেয়ে-বউ কাঁকড়া ধরতে আসে। নোনাজলের বাদাবন। ঠিকমতো চাষবাস হয় না, অভাব তাই নিত্যসঙ্গী। মাছের মীন, কাঁকড়া এইসব ধরে গেরস্তবাড়ির মেয়েরাও সংসারের হাল ফেরাতে চায়। তাছাড়া কাঁকড়ার বেশ বাজারদর আছে। শহরে চালান হয়। এককুড়ি বড়ো সাইজের কাঁকড়া বেচে কমবেশি চারশো টাকা পাওয়া যায়। সারাদিন যা কাঁকড়া হয়, হাঁড়িতে রাখা থাকে চুপড়ি চাপা দিয়ে। ভোররাতে জামতলা হাট থেকে তাজউদ্দিন তার মোটরভ্যান নিয়ে আসে। গুনতি করে কাঁকড়ার সাইজ অনুযায়ী বড়ো বড়ো ঝাঁকার মধ্যে ঢালে। দাড়াভাঙা মরা কাঁকড়া সব বাদ দেয়। ওগুলো ওরা বাড়িতে রান্না করে খায়।

জোয়ারের জল বাড়ছে। মঙ্গলার সঙ্গে যারা কাঁকড়া ধরতে এসেছিল, তারা সবাই প্রায় ফিরে গেছে। কিন্তু মঙ্গলার যাওয়া হয়নি। তাকে অনেক বেশি কাঁকড়া ধরতে হবে আজ। কেননা মেয়েটা এবছর মাধ্যমিক পাশ করেছে। ওকে নতুন ক্লাসে ভর্তি করতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। তাছাড়া নতুন ড্রেস, বই-খাতা। খরচের শেষ নেই।

সকালে ওরা যখন আসে তখন ভাটা থাকে। পিয়ালিতে হাঁটুজল। পার হয়ে আসতে কোনও অসুবিধা হয় না। এখন ভরা জোয়ার। কোনওমতে সে ওপারে যেতে পারবে না। অথচ জলে যেভাবে বাড়ছে তাতে পুরো চরটা প্রায় ডুবে গেছে। কুমির না এলেও কামটের বেশ উৎপাত। জোয়ারের জল ভেসে এসে হাঙরের মতো দেখতে এই জীবটা পা বা হাতের মাংস খাবলে নিয়ে চলে যায়। কুমির যে একদম আসে না তা নয়। তাই মঙ্গলা ভাবল, আর নীচে থাকা ঠিক নয়। সে এবার সুতোগুলো গুছিয়ে তুলে নিল। কাঁকড়ার হাঁড়িদুটোর মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলল। একটা বড়ো ঝাঁকড়া দেখে বানীগাছের নীচের ডালে হাঁড়িদুটো বাঁধল। তারপর নিজে সেই গাছের উঁচু ডালে চড়ে বসল।

ভাটা না-পড়া পর্যন্ত তাকে এই গাছেই থাকতে হবে।

মঙ্গলার কাছে এটা নতুন না। খিদে পেয়েছে খুব, তেষ্টাও। মেয়েটা কী করছে কে জানে। হাঁড়িতে পান্তাভাত রেখে এসেছে। এখন ওর ইস্কুল নেই। ওটা খেয়ে দুপুরটা কাটিয়ে দেবে। ওর তবু তো মাথার ওপর মা আছে। কিন্তু মঙ্গলার মাথার ওপর কেউ না। বাবা রমানাথ ভাগচাষি ছিল। বারুইপুরের জমিদার চৌধুরীদের অনেক জোতজমি ছিল সুন্দরবনের লাট অঞ্চলে। অতদূর থেকে এখানে এসে চাষবাস করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা জমি ভাগে দিত। মঙ্গলাদের আন্ধারিয়া গ্রামেও চৌধুরীদের বেশ কিছু জমি ছিল। হাতেপায়ে ধরে রমানাথ তার অল্প খানিকটা ভাগে চাষ করত। চাষের খরচ তার, ফসলের অর্ধেক জমিদারকে দিতে হতো।

কিন্তু তারপর ঘটল পালাবদল। নতুন সরকার এল। জমিদারদের অতিরিক্ত জমি ভেসটেড করে ভূমিহীনদের পাট্টা দেওয়া হল। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে রমানাথ ছুটে গিয়েছিল গ্রামের অঞ্চলপ্রধান সহদেব মণ্ডলের বাড়ি।

– ‘ইসব কী হচ্ছে, সহদেব? তোমরা তো সব জানো। আমি সেই কবে থেকে ওই জমি ভাগে চাষ কচ্চি। তাহলে পাট্টা তো আমি পাব। নকুল দাস কেন?’

– ‘তাতো আমি তোমাকে বলতি পারবুনি রমানাথ। সরকারি খাতাপত্তরে ও-জমির ভাগচাষি হল গিয়ে নকুল দাস। তাই পাট্টায় ওর নামে এসেছে। জমির দখল তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে।’

রাতারাতি ভাগচাষী থেকে জনমজুর হয়ে গেল রমানাথ।

মাথাগোঁজার চালটুকু ছাড়া আর কিছুই রইল না। উদয়-অস্ত খেটে মুখে দুটো অন্ন জোটাত। কিন্তু রমানাথের ভাগ্যই ছিল খারাপ। এত অভাবের মধ্যে লড়াই করে যখন একটু থিতু হয়েছে, ঠিক সেইসময় কাউকে কিছু না বলে মঙ্গলার মা একদিন ঘর ছাড়ল, পাশের গাঁয়ের রাজমিস্ত্রি রাজু শেখের সঙ্গে কোলের ছেলেটাকে নিয়ে।

মঙ্গলা খুব কেঁদেছিল। মা তাকে ছেড়ে চলে গেল। কতবা বয়স তখন তার। সাত-আট হবে। ছোটো ভাইটার মুখটা মনে পড়ত। বাবা কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। সংসারে থেকেও যেন উদাস উদাস। বাবার মুখের দিকে তাকালে মায়ের ওপর খুব রাগ হতো। ওই একটা ঘটনাই মঙ্গলাকে রাতারাতি পরিণত করে দিল। যে-বয়সে মেয়েরা স্কুলে যায়, মাঠঘাট-দৌড়ে খেলা করে, মঙ্গলা সেই বয়স থেকে বাপ-মেয়ের সংসার আগলাচ্ছে। আর এই সংসার আগলাতে আগলাতে কখন যেন সে বড়ো হয়ে গেল। জীবন তার কিশোরীবেলার সব চমক রোমাঞ্চকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে, তাকে একেবারে যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল।

গাঁয়ের পাঁচজন পাঁচকথা বলে। মাতব্বর হরিচরণ একদিন মঙ্গলার বাবা রমানাথকে ডেকে বলল, ‘কী রমানাথ, মেয়ে তো বেশ ডাগরডোগর হয়েছে। তা এবার বাবার কর্তব্য করো। মেয়ের বে’থা দাও।’

রমানাথ আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে, ‘না, আসলে, মানে হল গিয়ে কি– ও চলে গেলে আমাকে কে দেখবে?’

– ‘তা বলে তুমি মেয়ের বে দেবেনি? তোমাকে কিন্তু একঘরে হতে হবে রমানাথ।’

রাতে বাবাকে খেতে দিয়ে মঙ্গলা কথাটা পেড়েছিল, ‘গাঁয়ের মানুষজন যা বলে বলুক, আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবুনি।’

‘তা কী করে হয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস বে করবি নে! লোকে নিন্দে করবে। গাঁয়ে বাস করা মুশকিল হবে।’

‘মুশকিল বললেই হল। তোমার বয়স হচ্ছে, শরীরের তাকত কমছে। আর জনমজুরের কাজ কত্তি পারবে?

বুড়ো বয়সে কে তোমার দেখবে? আমি বে করে চলে গেলে কে তোমাকে খেটে খাওয়াবে?’

‘সে যা হয় হবে। তাবলে তুই বে করবি নে, তা হয়?’

মঙ্গলা বাপের এঁটো হাতটা টেনে নেয়।– ‘তাহলে কথা দাও, এমন ছেলে দেখবে যে আমাকে বিয়ের পর বাড়ি ছাড়া হতে হবে না। সে এখানে থাকবে।’

রমানাথের দু’চোখ জলে ভরে গেল। বুড়ো বাপের জন্যি এত দরদ মেয়েটার বুকের মধ্যি! অথচ যার দরদ দেখানোর কথা ছিল, সে তো সবকিছু ফেলে চলে গেল।

রমানাথ বাঁহাত দিয়ে মেয়ের মাথাটা বুকের কাছে টেনে নেয়।

অনেক খোঁজ-খবরের পর রমানাথ একটা সন্ধান পেল। জামতলা হাটে সুধীর ময়রার মিষ্টির দোকানে কাজ করে সুবল। তিনকূলে কেউ নেই। সুধীর ময়রা যেন কোথা থেকে নিয়ে এসে মানুষ করেছিল। একটু বড়ো হতে দোকানের কাজে লাগিয়ে দেয়। ছেলেটা বেশ শান্ত, খাটতে পারে। দেখতে শুনতেও মন্দ না। রমানাথের পছন্দ হয়ে গেল। সুধীর ময়রার একটাই শর্ত, সারাদিন দোকানে থাকবে, রাতে বাড়ি যাবে।

ঘড়ি আর একটা হালকা ওজনের সোনার আংটি দিয়ে জামাই বরণ করেছিল রমানাথ। মঙ্গলার মুখের হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছিল সুবলকে তার মনে ধরেছে।

কিন্তু সে সুখ কপালে সইল না মঙ্গলার। বছর ঘুরে যেতে পোয়াতি হল সে। তিন-চার মাস হবে, এমন সময় ঘটল সেই দুর্ঘটনা। ও তখন কাঠপাতা দিয়ে উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড় করছিল। কে একজন বাইরে থেকে তার বাবার নাম ধরে ডাকছে। বাবা বাড়ি ছিল না। মঙ্গলা হন্তদন্ত হয়ে বাইরে এল। দেখে দুটো ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে।

মঙ্গলাকে দেখে তারা বলতে শুরু করল, ‘জামতলা হাটের সুধীর ময়রা পেইঠেছে। একটা খুব খারাপ খবর আছে।’

অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে মঙ্গলার বুক। সে দৌড়ে ছেলেদুটোর সামনে এসে দাঁড়ায়।– ‘কী হয়েছে? কী খারাপ খবর?’

‘তোমার বাবা কোথায়? একবার জামতলা হসপিটালে যেতি হবে। সুবলের বড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।’

হাটবার ছিল। দোকানে ভিড় ছিল খুব। তার ওপর একটা বিয়েবাড়ির অর্ডার। সেই অর্ডারের মিষ্টিটা রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো গাড়িতে তুলে দিতে গিয়েছিল সুবল। পেছন দিক থেকে একটা মারুতি ভ্যান এসে সজোরে ধাক্বা মারে। সুবল ছিটকে গিয়ে পড়ে রাস্তার লাইটপোস্টের গায়ে। মাথা ফেটে যায়। সুধীর ময়রা লোকজন নিয়ে সুবলকে জামতলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর অবস্থা ভালো ছিল না। রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না কিছুতেই।

মঙ্গলা তার বাবার সঙ্গে যখন হাসপাতালে পৌঁছোল, তখন সব শেষ। সুবল মঙ্গলার সঙ্গে, এই পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ করে সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা হয়ে হাসপাতালের লোহার বেডে শুয়ে আছে। সে এখন কারও স্বামী নয়। শুধু একটা ডেডবডি।

মঙ্গলা ওই ডেডবডির ওপর পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। মানুষটার সঙ্গে কোনও কথা হল না। তাকে এই পোয়াতি অবস্থায় একা ফেলে রেখে চলে গেল। মুখটা ভালো করে একবার দেখতেও দিল না। পুলিশ এসে বলল,– ‘অ্যাকসিডেন্ট কেস, বডি পোস্টমর্টেমে যাবে, ছেড়ে দাও।’

সেই শুরু মঙ্গলার দুর্ভাগ্যের। জীবন তাকে এক হাঁ-মুখ অন্ধকার গর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। সুবলের মৃত্যুর পর তিনমাস কাটল না, বাবা রমানাথ একদিন কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এল বুকে হাত দিয়ে। কেমন হাঁপাচ্ছিল। ঘরের দাওয়াতে বসে নেতিয়ে পড়ল।

মঙ্গলা ছুটে এসে বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ও বাবা– কী হল তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? জল খাবে?’

রমানাথের ঠোঁট সামান্য নড়ল, কথা ফুটল না। মঙ্গলা ঘটি থেকে জল নিয়ে বাবার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিল। সামান্য জল মুখে দিল। সেই জলটুকু খেয়ে মেয়ের কোলে মাথা রেখে রমানাথ চোখ বুজল আর খুলল না।

মঙ্গলা তখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী নেই, মা থেকেও নেই, শেষে বাবাও চলে গেল। এতবড়ো নির্বান্ধব পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ল। বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হল। শুরু হল আর-একটা প্রাণকে রক্ষা করার লড়াই।

জনমজুরের ভারী কাজ তখন সে করতে পারত না। নদীতে মীন ধরে, কাঁকড়া ধরে কায়ক্লেশে জীবন কাটাত। এরই মধ্যে তার মেয়ে আরতি জন্মাল। সে মেয়ে আজ মাধ্যমিক পাশ করেছে। ভাগ্যের বিপর্যয়ে মঙ্গলা স্কুলের মুখ দেখেনি। কিন্তু সে চেয়েছিল তার মেয়ে লেখাপড়া শিখে, চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াক।

প্রাইমারি স্কুল পাশ করার পর মঙ্গলা আরতিকে জামতলার ভগবান চন্দ্র হাইস্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিল। হেডমাস্টার রতনবাবু কথায় কথায় মঙ্গলার জীবন, তার একা লড়াইয়ের কথা, তার অভাবের কথা জেনে তাকে সাহায্য করেছিলেন। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার পাশাপাশি তারও একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

রতনবাবু স্কুলের একটা ঘরে থাকেন। বাড়ি কলকাতার যাদবপুরে। ছুটিছাটায় বাড়ি যান। নিজে রান্না করে খান। তাতে স্কুলের কাজে অসুবিধা হতো। তাই তিনি প্রস্তাব দিলেন, মঙ্গলা যদি রান্না আর টুকিটাকি কাজ করে দেয়, তাহলে তিনি ভালো মাইনে দেবেন। তাতে মঙ্গলার সংসারের সুরাহা হবে আর তার মেয়ের পড়াশোনাও চলবে।

মঙ্গলাও বুঝেছিল একটা বাঁধা রোজগার হলে ভালো হয়। জনমজুরের কাজ সবসময় পাওয়া যায় না। তাছাড়া গাঙে দিনকেদিন মীন কাঁকড়া সব কমে আসছে। তাই রতনবাবুর প্রস্তাবটা ও লুফে নিয়েছিল। একটু সুখের মুখ দেখেছিল।

কিন্তু এই সুখের আড়ালেই ছিল অসুখ। মঙ্গলা বুঝতে পারেনি, মাস্টার রতন আসলে তার সামনে একটা টোপ রেখেছিল। যেমন করে সে কাঁকড়াদের সামনে মরা মাছ, পচা শামুকের চার টোপ হিসেবে রাখে। আর সেই চারের লোভে টোপের ফাঁদে পা দিয়ে কাঁকড়াগুলো মঙ্গলার জালে আটকে পড়ে।

রান্নার কাজটা রতন মাস্টারের একটা ছুতো ছিল। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গলাকে নষ্ট করা। সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। মঙ্গলা যথারীতি কাজে গেছে। সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছিল, একসময় জোরে বৃষ্টি এল। বৃষ্টির ছাট আসছে এই আছিলায় রতন মাস্টার ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ করে দিল। তারপর মঙ্গলাকে জড়িয়ে ধরল। মঙ্গলা চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি করছেন মাস্টারমশাই?’

– ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মঙ্গলা। আর তাছাড়া তোমার তো স্বামী নেই, এই অল্প বয়স– দেহের চাহিদা তো একটা আছে।’

– ‘না, এটা পাপ। আমি গরিব হতে পারি, খেটে খাব, তবু পাপ করতি পারবুনি।’

রতন মাস্টার কথা শোনেনি। মত্ত জন্তুর মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মঙ্গলাও বাদাবনের খেটে খাওয়া মেয়ে। গায়ের জোর তারও কম নয়, বরং একটু বেশি। এক ধাক্বায় রতন মাস্টারকে মেঝেতে ছুড়ে সে বেরিয়ে এসেছিল। লোকটার প্রতি ঘেন্নায় তার গা রি-রি করছে। একে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। মঙ্গলা সোজা পঞ্চায়েতে গিয়েছিল। পরদিন বিচারসভা বসেছিল। রতন মাস্টার বলেছিল, ‘ও অভাবী বলে ওকে কাজে রেখেছিলাম। কিন্তু ও আমার কাছে বাড়ি করার জন্য অনেক টাকা চাইল। আমার কাছে অত টাকা নেই, দিতে পারব না বলতেই ও এইসব করল। আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিল।’

পঞ্চায়েত মঙ্গলার কোনও কথা বিশ্বাস করল না। তারা রতন মাস্টারের পক্ষ নিল। মাস্টারের শাস্তি তো হলই না, উলটে মঙ্গলার মেয়ের নাম কাটা গেল স্কুলের খাতা থেকে।

মঙ্গলা কিন্তু লড়াই ছাড়ল না। পরদিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিডিও দিদিমণির কাছে গেল। দিদিমণি সব শুনে দরখাস্ত জমা দিতে বললেন। আর থানাতে গিয়ে একটা ডায়ারি করতে বললেন। মেয়েকে দিয়ে অভিযোগ লিখিয়ে নিজে টিপছাপ দিয়ে বিডিও দিদিমণির কাছে দরখাস্ত জমা দিল। থানাতে ডায়ারিও করল।

দিদিমণি তদন্ত করে ডি.এম. সাহেবের কাছে রিপোর্ট জমা দিলেন। একমাসের মধ্যে রতন মাস্টার বদলি হয়ে গেল। আর মঙ্গলার মেয়ে আরতি আবার স্কুলে যেতে শুরু করল।

অনেকক্ষণ ধরে একটা শব্দ কানে আসছিল। বসে বসে একটু তন্দ্রা এসেছিল। শব্দটা স্পষ্ট হল। দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। পিয়ালি ড্যামের ওদিক থেকে হাটফেরতা নৌকো সব ঘরে ফিরছে। মঙ্গলা দেখল, ভাটা পড়ে গেছে। চর জেগে উঠেছে আবার। লালকাঁকড়ার দল ঘোরাঘুরি করছে। আর একটু পরেই পিয়ালি নদীর জল কোমরে নামবে। মঙ্গলা গাছ থেকে নেমে পড়ে। কাঁকড়ার হাঁড়িদুটোর মুখে সুতোগুলো বেঁধে নেয়। এবার একটা বড়ো গামছার দুপ্রান্তে হাঁড়িদুটো বেঁধে তার মাঝখান ধরে টেনে নিয়ে চলল জলের দিকে। বড়োগাঙের ওপারে ঝড়খালির দিকে লাল সূর্যটা আপেলের মতো দেখাচ্ছে। গাঙশালিখ আর বকগুলো সব ঘরে ফিরছে। মঙ্গলারও এবার ঘরে ফেরার পালা।

দূর থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। মঙ্গলা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ভাটি গাঙের পলিকাদা ঠেলে তাদের গাঁয়ের পঞ্চায়েত সদস্য নিমাই মাল তার দিকে আসছে। মঙ্গলার মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে নিমাই তাকে জ্বালাচ্ছে। নানারকম কু-প্রস্তাব দিচ্ছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সে নিজেকে প্রস্তুত করে।

নিমাই মাল মঙ্গলার কাছে এসে হলদেটে দাঁত বের করে খ্যাক খ্যাক করে হাসে।– ‘তোদের বাড়ি গিছলুম। তোর মেয়ে বলল, মা সকালে কাঁকড়া ধরতে গেচে একনো ফেরেনি। তাই ভাবলুম এট্টু এইগে দেখি– কতদূর তুই।’

– ‘তাই এই কাদা গদ ঠেলে আমাকে দেখতে এইচিস?’ মঙ্গলা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘তোর আসল মতলবটা কী বল।’

– ‘আসল মতলব আবার কী। আমি তোর ভালো চাই। আমি থাকতে তুই খেটে খাবি এটা আমার সহ্য হচ্ছে না।’

– ‘তা কি সহ্য হবে তোর।’

– ‘আমাকে বে কর। মাইরি বলচি, তোর কোনও দুখ্যু রাখব নে। প্রধানকে বলে তোকে ইন্দিরা আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি বানিয়ে দেব।’

নিমাই মঙ্গলার আরও কাছে সরে আছে। ওর লোভাতুর গরম নিঃশ্বাস মঙ্গলার সর্বাঙ্গে পড়ে।

– ‘ঠিক আছে, যদি বড়ো মেয়ে আছে বলে বিয়ে করতে রাজি না হোস, তাহলি বে কত্তি হবেনি। শুধু রাতে আমাকে আসতে দিস।’

নিমাই মাল মঙ্গলার হাত ধরতে যায়। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে মঙ্গলা সুতোগুলো মুঠোর মধ্যে নেয়।

– ‘দেখেছিস, হাতে কী? এই বয়সে মার খেতে চাস আমার হাতে? যা ভাগ। আমার পাকাবাড়ি চাই না। আমি সৎপথে থেকে গতরে খেটে আমার মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব। ও চাকরি করে আমাকে পাকাবাড়ি বানিয়ে দেবে। ভাগ আমার সামনে থেকে, নইলে এই সুতো দিয়ে তোকে পেটাব।’

– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেচি, সতীপনা দেখানো হচ্চে। শালি হারামি মাগি।’

মঙ্গলা তেড়ে যেতে নিমাই পালায়।

অনেক দেরি হয়ে গেল। লাল সূয্যিটা অনেকক্ষণ হল ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে এল বলে। মঙ্গলা কাঁকড়ার হাঁড়িদুটো টানতে টানতে এগিয়ে চলল। আজ সে ভালো কাঁকড়া পেয়েছে। এই কাঁকড়া বেচে সে মেয়েকে নতুন ক্লাশে ভর্তি করাতে পারবে। তারপর আরতি একদিন কলেজে পড়বে। চাকরি পাবে। অভাবী দুঃখী মা মঙ্গলার বারোমাস্যার শেষ হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...