অফিসের জন্য তৈরি হয়ে অনন্যা বাইরের ঘরে এসে দেখল, শাশুড়ি-মা বসে শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করছেন। অনন্যা এসেই সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরে অফিস যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বাই বলে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। অজয়ের বাবা অনিরুদ্ধবাবু খুবই ভালোবাসেন অনন্যাকে।

সুগন্ধা বললেন, অনন্যা, আজ কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। অজয়ের পিসিমা আসবেন সন্ধেবেলা।

মা, তাড়াতাড়ি আসা তো মুশকিল। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা তো বাজবেই। এসে দেখা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। বলে নিজেই জোর করে হাসি টেনে আনে মুখে। আর তাছাড়া পিসিমা তো আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন না। নিজের গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।

খানিক আগেই স্বামী অজয় ঘরে ঢুকেছে, অনন্যা খেয়াল করেনি। অজয়ে গলার আওয়াজে ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল অনন্যার। ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসতে হাসতেই অজয় বলল, বাজে কথা বোলো না অনন্যা। ঠিক সময় চলে এসো।

হাসতে হাসতেই অনন্যা বেরিয়ে গেল।

মায়ে গম্ভীর মুখ দেখে অজয় সুগন্ধাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? মুড খারাপ?

না, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়ে অজয় বাবার দিকে তাকাল। অনিরুদ্ধবাবু ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ইশারায় কথা বলে বাবা ছেলে দুজনের মুখেই চাপা হাসি ফুটে উঠল।

অজয় অফিস চলে গেলে অনিরুদ্ধবাবু নিজের স্ত্রীকে বললেন, আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চেষ্টা করব, দিদি আসার আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু তুমি এত কেন চুপচাপ?

স্বামী প্রশ্ন করতেই রাগে ফেটে পড়লেন সুগন্ধা। চুপ করে থাকব না তো আর কী করব? আর কত অ্যাডজাস্ট করব? সকাল থেকে ওইরকম বেহায়া ছেলের বউকে দেখে এমনিতেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

বেহায়া? অনন্যা? একথা কেন বলছ?

হাবভাব দেখছ তো, একে দেখে এ বাড়ির বউ বলে মনে হয়? সবসময় ঠাট্টা, ইয়ার্কি, সাজগোজ তারপর এই প্রাইভেট চাকরি! আর কথাবার্তার তো কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কত ভেবেছিলাম বাড়ির বউ নম্র, ভদ্র হবে, মা-বাবার দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে। কিন্তু না, যাই বলি না কেন এমন উত্তর দেবে যে, তারপর আর কিছু বলা চলে না। সব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। অথচ আমাদের মেয়ে অপর্ণাকে দেখো, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শাশুড়ি যা বলছেন তাই মাথা নীচু করে মেনে নিচ্ছে। আর আমাদের অজয় এমন একটা বেহায়া মেয়েে এনে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে তার কাঁধে হাত রাখলেন, এখনই এত অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ কেন? মাত্র চারমাস হয়েছে অনন্যা এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি ওর কোনও রকম ছবি মনের মধ্যে এঁকে ফেলো না। তুমিও তো পড়াশোনা করেছ, তুমিও যথেষ্ট মডার্ন। এই কদিন অনন্যাকে দেখেই তুমি ওর নামকরণ করে ফেলেছ বেহায়া! এটা ঠিক নয় সুগন্ধা। অজয় যথেষ্ট দাযিত্ববান ছেলে। ও অনন্যাকে যখন নিজের বউ হিসেবে স্বীকার করেছে, তখন নিশ্চই সে অনন্যার গুণ দেখেই ঘরে এনেছে।

হ্যাঁ, গুণ তো আছে বটেই। সেই জন্যই তো অজয়কে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অনন্যা যা বলে তাতেই সায় দেয় অজয়। ও সাজগোজ আর বউয়ে রূপ দেখে এমন মজেছে যে, অনন্যা যাই করুন না কেন তাতে তার সাত খুন মাপ হয়ে যায়। আমিই শুধু ওর কোনও গুণ দেখতে পাই না কেন কে জানে!

অনিরুদ্ধবাবু স্ত্রীয়ের রাগ দেখে হেসে ফেলেন। একটু রসিকতা করার ইচ্ছা সামলাতে পারেন না। সুগন্ধা কখনও কোনও শাশুড়িকে দেখেছ ছেলের বউয়ে গুণ এত সহজে মেনে নিতে? তোমার তো কত গুণ ছিল কিন্তু তোমার শাশুড়ি কোনও দিন সেটা স্বীকার করেছেন?

এত রাগের মধ্যেও স্বামীর কথা শুনে সুগন্ধা হেসে ফেলেন।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, ঠিক আছে, আমি এখন বেরোচ্ছি। রাগ কোরো না, বিশ্রাম নাও। দিদি এলে তুমিও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, এই বলে অনিরুদ্ধবাবু বেরিয়ে যান।

সুগন্ধা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজের লোককে দিয়ে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে দুপুরে একটু ফ্রি হয়ে সবে শুতে যাবেন, ফোনটা বেজে উঠল। বড়ো ননদের ফোন যিনি সন্ধেবেলায় ওঁদের বাড়ি আসছেন থাকতে।

সুগন্ধা, আমি ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ তোমাদের বাড়ি পৌঁছে যাব। ততক্ষণে আমাদের বউমাও নিশ্চয় বাড়ি এসে যাবে? বিয়ের সময়ে ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি।

হ্যাঁ দিদি, অনন্যা বলেছে ও চেষ্টা করবে তাড়াতাড়ি ফিরতে, বলে ফোন নামিয়ে রাখেন সুগন্ধা। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সুগন্ধা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। সন্ধেবেলায় অনেক কাজ আছে। কিন্তু শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। তিন বছর আলাপের পর মাত্র চারমাস আগে অজয় আর অনন্যার বিয়ে হয়েছে। অনন্যার মা-বাবা দুজনেই প্রফেসর। বেঙ্গালুরুতে অনন্যা বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, মডার্ন, সুশিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে

অজয় অনন্যাকে পছন্দ করে, এটাই সুগন্ধার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সন্তনের খুশিতে, সংসারের আনন্দেই সুগন্ধা পরিপূর্ণ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু অনন্যার সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার পরেই একটাই শব্দ দিনরাত ওনার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করল, বেহায়া।

সুগন্ধা ভালোমতোই জানেন, অনন্যা অজয়কে চোখে হারায়। অনন্যার অফিস বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। যার ফলে অজয়ে আগে ওকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় আর ফেরেও অজয় ফেরার অনেকটা পরে।

কলকাতায় অফিস যাতায়াত করাটা একটা সমস্যা কিন্তু অনন্যা বাড়ি এসেই চটপট জামাকাপড় বদলে, ফ্রেশ হয়ে সকলের সঙ্গে বসে গল্প করতে শুরু করে দেয়। কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও থাকে না ওর চেহারায়। সুগন্ধা অবাক হয়ে যান যত ওকে দেখেন। বাড়িতে এমন ভাবে থাকে, দেখে যে কেউ ভাববে ও বাড়ির মেয়ে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ নয়।

রান্নাবান্নার কোনও শখ নেই অনন্যার। একদিন সুগন্ধা খুব আদর করেই অনন্যাকে বলেছিলেন, অনন্যা, ছুটির দিনগুলোতে একটু একটু করে রান্নাটা শিখে নাও।

কেন মা? ঝট করে অনন্যা বলে ফেলে।

রান্নার জন্য লোক আছে ঠিকই কিন্তু একটু আধটু রান্না তো সকলেরই শিখে নেওয়া উচিত।

সে কাজ চালাবার মতো রান্না আমি করে নিতে পারব। ওটাতেই এখন কাজ চলবে। পরে কখনও শিখে নেব, বলেই অনন্যা শাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে।

মা রান্নাঘরে ঢুকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি একবার হ্ঁযা বলো, এখুনি একজন ফুল টাইম রান্নার লোকের ব্যবস্থা করছি। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আমি তো বলি তুমি সবসময়ে জন্য একটা লোক রেখেই নাও।

বাড়ির ভিতর সবসময় কাজের লোক ঘোরাফেরা করবে ভেবেই সুগন্ধা মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তখনকার মতো অনন্যাকে চুপ করানোর জন্য বলেন, ঠিক আছে, যখন ইচ্ছে হবে শিখে নিও। এখন লোকের আমার কোনও প্রযোজন নেই। প্রমিলা সব কাজই তো করে দিচ্ছে।

অনন্যা আর সুগন্ধার কথোপকথন যখন হচ্ছিল তখন অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবা আর ছেলে, দুজনের কথা শুনে শুধু মুচকি মুচকি হেসেছিলেন।

আজ সুগন্ধা অনিরুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে অনন্যার বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগ উগরে দিলেন, নিজের চোখেই দেখছ বাড়ির কোনও কাজ করতে চায় না। যখনই কিছু শেখার কথা বলি অমনি গলা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যে, রাগও করতে পারি না।

স্ত্রীয়ে নালিশ শুনে হেসে ফেলেন অনিরুদ্ধবাবু, তুমি কতটা শাশুড়ি হিসেবে রাগ দেখাতে পারো আমার খুব জানা আছে।

সন্ধেবেলায় উমাদিদি আসার আগেই অনিরুদ্ধবাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন, যাতে সুগন্ধার মনে ক্ষোভ না তৈরি হয়।

চা-জলখাবার খেতে খেতে উমা অনন্যা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। কেমন বউ হয়েছে? শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে কিনা? অফিসে এতটা সময় কাটায়, তাহলে বাড়ির কাজ করে কখন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তরটা অনিরুদ্ধবাবুই দিলেন, আমাদের সেবার কীসের দরকার! আমরা কি কেউ অসুস্থ? অনন্যা খুব ভালো মেয়ে দিদি। দাযিত্ব নিয়ে সব কাজ করে।

অনন্যার কথা ওঠাতে সুগন্ধার মুখের উপর কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। উমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবই নজর করল। মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন উমা। অনিরুদ্ধর থেকে বেশ অনেকটাই বড়ো উমা। মা-বাবার মৃতু্যর পর ভাই-বোনের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। সম্পর্কের মান দুজনেই রক্ষা করে চলেছেন।

বরাবরই খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলেন উমা। এখন বয়ে হওয়ায় আরও বেশি পূজাপাঠ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। সেকেলে

আচার-বিচার মেনে চলেন। কোনও এক মহারাজ-এর কাছে দীক্ষিত। কাশীধামে থাকেন মহারাজ। দেশের যেখানেই মহারাজের প্রবচন থাকে, উমা ঠিক কিছু একটা করে

চার-পাঁচদিনের জন্য সেখানে পৌঁছে যান।

কলকাতার রাজারহাটে এবার মহারাজের শিবির অনুষ্ঠিত হয়। সেটার জন্যই উমার রাঁচি থেকে কলকাতায় আসা। ওঁরা বসে গল্প করতে করতেই অজয় আর অনন্যাও অফিস থেকে চলে এল। পিসিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনন্যা নিজের ঘরে চলে এল ফ্রেশ হবে বলে। ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে ডিনার করতে করতে সকলে আড্ডায় মেতে উঠল। অন্যান্য সময়ে মতো অনন্যাও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল। অনন্যার এই ব্যবহার উমার চোখে অতিরিক্ত স্পর্ধার বলেই মনে হতে লাগল।

এরপর শুরু হল নাগরিকতা বিল নিয়ে আলোচনা। অনন্যা তো সোজাসুজি জানিয়ে দিল এই বিল সে সমর্থন করে না। অথচ উমা নিজের বাড়িতে স্বামীকে এই বিলের সমর্থনে সবসময় কথা বলে আসতে শুনেছেন। অনন্যার কথাবার্তায় উমার খালি মনে হতে লাগল, অনন্যা একপ্রকার তার স্বামীকেই অপমান করছে। প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল উমার। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান স্বল্প হওয়াতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

অনন্যা অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলছিল, বাবা আমাদের অফিসে আমার কিছু সহকর্মী এই বিলের বিরোধিতা করে একটা মিছিল বার করার প্ল্যান করছে। আমার এতে পুরো সমর্থন রয়েছে।

উমা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ইচ্ছে করে অনন্যাকে থামাবার জন্য বলে উঠলেন, আমি ভাবছিলাম এবার মহারাজের শিবিরে যাওয়ার সময় সুগন্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ওখানে দুটো দিন থেকেও নেবে আর মহারাজের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। কী বউমা, তোমার শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে ওই দুটো দিন সংসার সামলে নিতে পারবে তো?

কিন্তু পিসিমা, মা তো শিবিরে যাবেন না।

সুগন্ধা হতচকিত হয়ে পড়েন। এই বেহায়া মেয়েটা বলে কী? আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা ও ঠিক করবে? উমাও অনন্যার কথা শুনে যেন শক খেলেন। দুদিন হল বাড়িতে এসেছে, এর মধ্যেই ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস পাচ্ছে মেযো? একটু গম্ভীর হয়ে উমা বললেন, মহারাজের কাছে দু’দণ্ড বসে ওনার কথা যে-শোনে, তার জীবনে কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকে না।

পিসিমার কথায় রসিকতা করার ইচ্ছেটাকে কিছুতেই দমাতে পারল না অনন্যা। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, সে কী পিসিমা, তাহলে আপনার মহারাজের জন্য দেখছি, ডাক্তারদের ক্লিনিকগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে! সাবধান হতে বলবেন মহারাজকে, নাসা থেকে ওনাকে তুলে নিয়ে না চলে যায়, হা হা হা বলে হাসিতে ফেটে পড়ে অনন্যা।

খুব গম্ভীর দেখায় উমাকে। বলেন, বউমা, আমার মনে হয় আধ্যাত্মিক বিষয়ে তোমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সেজেগুজে অফিসে যাওয়া এক ব্যাপার আর আধ্যাত্মিক চেতনা অন্য জিনিস।

পিসিমার কঠোর স্বর শুনে অনন্যা ভিতরে ভিতরে একটু মুষড়ে পড়লেও, স্বভাবসুলভ কৌতুকের বশেই বলে ফেলল, পিসিমা সত্যিই আধ্যাত্মিক আলাপ-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।

অনন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার উমা সুগন্ধাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তাহলে তুমি যাবে তো সুগন্ধা?

সুগন্ধার কাছে বাড়ির শান্তি সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু ননদের মুখের উপর কিছু বলার সাহস কোনও দিনই তাঁর হয়নি। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, আমি মনে হয় যেতে পারব না দিদি। বেশিক্ষণ বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় আজকাল। পায়ে ব্যথাটা খুব বেড়েছে।

উমার মুখের উপর অসন্তোষের ছায়া এসে মিলিয়ে গেল। অজয়ও বলে উঠল, হ্যাঁ মা, তোমার তো ওখানে একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। পিসি, তুমি বরং একাই ঘুরে এসো।

রাতে সবাই ঘরে শুতে চলে গেলে উমা, সুগন্ধার সঙ্গে সোফায় এসে বসলেন, সুগন্ধা তোমার ছেলের বউ তো দেখছি খুব স্মার্ট। ফটফট করে মুখের উপর কথা বলে।

সুগন্ধা কী বলবেন ভেবে পান না। চুপ করে থাকেন।

তোমাকে সাবধান করছি সুগন্ধা, ওকে এত বেশি বাড়তে দিও না। লাগাম নিজের হাতে রাখো।

হেসে ফেলেন সুগন্ধা। দিদি ও বাড়ির বউ। ঘোড়া হলে না হয় লাগাম কষে ধরতাম। সুগন্ধা বরাবরই শান্তিপ্রিয়। অশান্তি কোনও দিনই ওনার পছন্দ নয়।

সুগন্ধাকে চুপ থাকতে দেখে উমাই আবার মুখ খুললেন, এ যেরকম মেয়ে দেখলাম বাড়ির কাউকে ও পরোযা করে না বলেই মনে হয়। সবসময় সেজেগুজে, মেক-আপ করে রয়েছে। বড়োদের সামনে মুখ বন্ধ করে থাকার সভ্যতাটুকুও ওর জানা নেই। এইসব মেযো স্বামীকে ভালো মতন আঁচলে বেঁধে রাখতে জানে। দেখো তোমার সংসারে ভাঙন না ধরায়।

ছেলের বউকে কীভাবে রাখা উচিত, এ বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার সুগন্ধার কাছে উজাড় করে দিয়ে উমা পরের দিন সকালে মহারাজের শিবিরে চলে গেলেন। ওখান থেকেই উমা নিজের বাড়ি চলে যাবেন এটাই প্রথম থেকে স্থির ছিল।

পিসিমা চলে যেতে অজয় অনন্যাকে বলল, তুমি তো পিসির সামনে প্রচুর কথা বলছিলে দেখলাম। এত কথা মা কোনও দিন বলতে সাহস করেননি।

মা যত ভালোমানুষ না অজয়, সেরকম ভালোমানুষ হয়ে আজকের দুনিয়ায় কোনও কাজ করা যায় না। মাঝেমধ্যে বলতেও হয়। শান্ত এবং গম্ভীর স্বরে কথাগুলো অনন্যা বলতেই, সুগন্ধা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দেখলেন অনন্যাকে। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি অনন্যা। ওর চেহারায় সবসময় একটা তরতাজা ভাব, মুখে প্রশান্তি এবং যথেষ্ট সুন্দরী সে।

অপর্ণা, অজয়ে থেকে চার বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়ি বরোদায়। বছরে একবার আসে

মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছেলেকে আনে।

স্বামী সুজয় সবসময় আসতে পারে না। ভাই অজয়ে বিয়ে সময় মাত্র পাঁচদিনের জন্য আসতে পেরেছিল। তাই ছেলের স্কুলের ছুটি পড়তেই, এবার কুড়ি দিনের জন্য ছেলেকে নিয়ে অপর্ণা হাজির হল বাপের বাড়িতে। বাড়তি আগ্রহ, অনন্যার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার। সুজয় আসতে পারেনি অফিসে জরুরি কাজ থাকার জন্য। এমনিতে অপর্ণা খুবই স্বামীর অনুগামী। কিন্তু একলা বাপের বাড়ি আসায় বেশ একটা মুক্তির আনন্দ উপভোগ করে।

অনন্যার সঙ্গে জমেও গেল খুব অপর্ণার। সুগন্ধা দেখে অবাক হয়ে গেলেন অপর্ণার সঙ্গে বেশি করে, সময় কাটাবার জন্য অনন্যা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল।

দুদিন যেতে না যেতেই অনন্যা একদিন অপর্ণাকে বলল, এ কী দিদি, আজকাল ম্যাচিং গয়না পরে সাজগোজ করে থাকার যুগ। আর তোমার গলায়, হাতে লাল-কালো সুতোয় খালি মাদুলি পরা! এসব কোথা থেকে জোগাড় করেছ?

অপর্ণা আমতা আমতা করে উত্তর দিল, আমার শাশুড়ি-মা সারাদিন মন্দির, দেবতা, বাবাজি, পুরোহিতদের নিয়ে থাকেন। বাড়িতে কিছু একটা হলেই, একটা মাদুলি নিয়ে পরের দিনই উপস্থিত হন। আমাকে এরকম দেখছ, তাহলে সুজয়কে দেখে কী বলবে? সারা শরীরে এই মাদুলি। এভাবেই ওকে অফিস করতে হয়। ওর অফিসে নিশ্চই ওকে নিয়ে ওর কলিগরা হাসাহাসি করে।

অনন্যা এবার জোরে হেসে উঠল, দিদি, সুজয়দার অফিসে যদি আমার মতো মেয়ে থাকে, তাহলে তো নিশ্চই সুজয়দাকে নিয়ে হাসবেই।

অনন্যার কথা বলার ভঙ্গিতে অপর্ণাও হেসে উঠল। অনন্যা এটা কিন্তু খুব খারাপ। নন্দাইকে নিয়ে এরকম রসিকতা তাও আবার ননদেরই সামনে!

সন্ধেবেলা শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। অনন্যা জিজ্ঞেস করল, দিদি তুমি শাড়ি আর সু্য়ট ছাড়া আর কিছু পরো না? যেমন ধরো ওযে্টার্ন ড্রেস?

না, অনন্যা। আমার শাশুড়ির শাড়িই পছন্দ।

তুমি তো তোমার পছন্দের কথাও ওনাকে জানাতে পারো। এখন তো সবাই সবরকমের পোশাক পরছে।

অপর্ণাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে অনন্যা।

বাইরের ঘরে বসে অপর্ণা এবং অনন্যার সব কথাই সুগন্ধা শুনতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল বেহায়া মেযোর এতদূর স্পর্ধা যে, নিজের নন্দাইকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে একটুও আটকায় না। আবার ভিতরে ভিতরে খুশিও হচ্ছিলেন নিজের মেয়ে অপর্ণার প্রতি অনন্যার ভালোবাসা দেখে। মেয়ে আগেও যতবার এসেছে এতটা আনন্দে ওকে কখনও থাকতে দেখেননি সুগন্ধা।

অপর্ণা আসার চার-পাঁচদিন পরেই হঠাৎ সুগন্ধার ভাই ফোন করে জানাল, ওনার ছেলে রাতুল তার ফ্যামিলির সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে আসছে। ফোন আসার পর থেকে সুগন্ধা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধবাবু এবং অজয় যখন খবরটা শুনলেন তখন ওদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক মনে হলেও অনন্যা, শাশুড়ি এবং ননদের মুখের উপর লক্ষ্য করে কালো মেঘের ঘনঘটা।

সারাদিনই অপর্ণা কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা না বলে নিজের ঘরেই বন্ধ থাকল। হাসিখুশি মেযো হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। অপর্ণার ছেলে খুবই শান্ত, ও নিজের মতো অাঁকা, বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাকে বিরক্ত করার কথা ওর মনেও হয় না।

পরের দিন অনিরুদ্ধবাবু আর অজয় অফিস চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করল সুগন্ধার ঘরে অপর্ণা। নীচু স্বরে দুজনে কিছু কথা বলছে। অপর্ণার ছেলে বসে টিভি দেখছে। অনন্যা, শাশুড়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এতদিনে এই বাড়িটা, বাড়ির লোকজনগুলো বড়ো আপন হয়ে উঠেছে তার। ও জানতে চাইছিল, কেন ওদের দুজনের মুখে অমাবস্যার ছায়া পড়েছে, মামার ছেলে রাতুলের নাম শুনে।

অপর্ণার গলা শুনতে পেল, মা, আমি কালই বরোদায় ফিরে যাচ্ছি। টিকিটের ব্যবস্থা এখুনি অজয়কে বললেই করে দেবে।

না অপু, এত কষ্ট করে এই তো এলি, এরই মধ্যে…

মা আমি রাতুলের মুখও দেখতে চাই না।

কিন্তু রাতুল তো ফ্যামিলির সঙ্গে আসছে, তুই চিন্তা করিস না। ইগনোর করিস।

মা, তুমি সবসময় এই একই কথা বলো, ইগনোর কর। আমি কিছুতেই ওর মুখ দেখতে পারব না।

বাইরে দাঁড়িয়ে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা রহস্য আছে। সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে। অপর্ণাকে বলে, দিদি তুমি কেন এখান থেকে যাবে? এটা তোমার বাপের বাড়ি, মানে তোমারও নিজের বাড়ি। তোমরা আমার আপন। তোমার কষ্ট মানে আমারও কষ্ট। আমাকে আপন ভেবে নিজের কষ্টের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?

অপর্ণা জড়িয়ে ধরে অনন্যাকে, নিশ্চই শেয়ার করব। এতদিনে তুইও আমার বড়ো আপন হয়ে উঠেছিস। রাতুল আমার মামার ছেলে। অত্যন্ত অভদ্র, রুঢ় এবং চরিত্রহীন। আমার বিয়ে কিছুদিন আগে এখানে এসেছিল এবং আমাকে একদিন একা পেয়ে আমার শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে। আমি চ্ঁযাচাতে এবং থাপ্পড় মারাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। অথচ ওকে কিছু বলার বদলে মা আমাকেই চুপ থাকতে বলে, ইগনোর করতে বলে। আমার বিয়েে আসেনি। এতদিন পর যখন আসছে, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না।

অনন্যা ননদের হাত চেপে ধরে, তোমাকে ওর মুখ দেখতে হবে না দিদি।

কিন্তু ও তো আসছে!

সুগন্ধা চুপ করে ছিলেন। অনন্যা বলে, মা তুমি শুধু নও, অনেক মা-ই এমন করেন। মেয়েেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু বাড়ির সাপোর্ট না পেলে এই ক্ষত আরও গভীর হয়ে ওঠে মেয়েের মনে। সেদিন দিদির কাছে শোনার পর, রাতুলের গালে চারটে থাপ্পড় মেরে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তাহলে দিদিকে আজ চলে যাওয়ার কথা বলতে হতো না। যাই হোক, যা হওয়ার ছিল হয়েছে। দিদি তুমি একদম চিন্তা কোরো না। এছাড়াও দেখছি, যে যখন খুশি কলকাতায় মানে এখানে চলে আসছে। ফলে মা-কে একগাদা কাজ করতে হয়। মা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিও অফিসে থাকি। ইচ্ছে করলেও কোনও সাহায্য করতে পারি না। দিদিকে তো আমি কোনও ভাবেই কষ্টে থাকতে দেব না। বলেই অনন্যা তত্ক্ষণাৎ অজয়কে ফোন করল।

অজয়, প্লিজ একটা কাজ করতে হবে। মামাকে ফোন করে বলো, যে-হঠাৎই আমরা বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি। মা কিছু জানত না। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে আগে থেকে টিকিট কেটে, কাউকে জানাওনি।

অজয়ে উত্তর কেউ শুনতে না পেলেও অনন্যার মুখ হাসিতে ভরে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, এখুনি ফোনটা করো। বলে ফোন কেটে দিল।

অপর্ণার মুখের উপর থেকে চিন্তার ছায়া কেটে গিয়ে হাসিতে মুখ ঝলমল করে উঠল। সুগন্ধার মুখে হাসি ফুটতেই অনন্যা সুগন্ধার কোলে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, মা, এইসব করতে হয়। ভালোমানুষ হয়ে কাজ চলবে না। আমার মতো স্পষ্টবক্তা এখনকার দিনে দরকার। অজয় তোমার ভালোমানুষির অনেক গল্প শুনিয়েছে। কিন্তু আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি এসে গেছি।

এমন ভাবে কথাগুলো বলল অনন্যা, সুগন্ধা আর অপর্ণা জোরে হেসে উঠলেন।

সুগন্ধা অনন্যার চুলে বিলি কাটতেই ঝট করে অনন্যা উঠে বসল, আমার চুলে এখন হাত দেওয়া যাবে না মা, সবে স্ট্রেটনিং করিয়েছি।

সুগন্ধা হেসে হাত সরিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধার ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলেন উমার ফোন। ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন।

উমা মহারাজের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই অনন্যার প্রসঙ্গে চলে এলেন, কী সুগন্ধা তোমার বেহায়া বউটার কী খবর?

দিদি, ওই বেহায়া বউটাই আমার মনের পুরো জায়গাটা জুড়ে বসে গেছে। আরও অন্য কিছু কথা বলে সুগন্ধা ফোন রেখে আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় উমাদি যথেষ্ট আশ্চর‌্য হয়েছেন।

ঘরে আসতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করল, পিসি কী বললেন?

কিছু না। ওই আমরা সবাই কেমন আছি।

কেন মা, জিজ্ঞেস করলেন না, বেহায়া মেযো নতুন কী খেল দেখাচ্ছে?

সুগন্ধা শক খেলেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ একথা বলছ কেন?

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনন্যা। মা চিন্তা কোরো না। আমার খুব ভালো লেগেছে এই নামটা। আজকে দিদি আর তোমার কথা যেমন কানে এসেছিল, সেরকমই ওইদিনও পিসিমা আর তোমার কথাগুলো কানে গিয়েছিল। তোমাকে বললাম না, ভালোমানুষির যুগ শেষ। এখন চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়। কিন্তু এটা সত্যি আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি। বলে সুগন্ধার গলা জড়িয়ে ধরল অনন্যা।

অপর্ণা লক্ষ্য করছিল। হেসে বলল, মা, এটা কী হচ্ছে?

সরি সরি রে বাবা, বলে সুগন্ধা নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের কান ধরতেই তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। অনন্যা মিছিমিছি কলার তোলার ভান করে বলল, দেখলে তো, এই বেহায়া মেযে শাশুড়িকেও কান ধরিয়ে ছাড়ল।

তিনজনেরই মিষ্টি হাসিতে ঘরের ভিতরটা আনন্দে ভরে উঠল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...