বিবাহ বলতে যেমন বোঝায় দু’জনের সম্পর্কের স্থায়ী সামাজিক এবং আইনি স্বীকৃতি, ঠিক তেমনই ‘বিবাহ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল— বিশেষ রূপে বহন করা। সুতরাং, বিয়ের অনুষ্ঠানকে সফল এবং স্মরণীয় করে তোলার জন্যও কিছু দায়দায়িত্ব বহন করতেই হবে। আসলে, জীবনসঙ্গী খুঁজে কিংবা বুঝে নেওয়ার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ হল বিয়ে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অথবা সাজ- সরঞ্জাম সময়মতো সংগ্রহে রাখা। শুধু তাই নয়, বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের খুশি করারও চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখবেন, বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা সঠিক এবং নিখুঁত হলেই বিয়ের অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গীন সফল এবং স্মরণীয় করে তোলা সম্ভব।

আগে থেকে পড়াশোনা না করে পরীক্ষা দিলে যেমন ফল ভালো হয় না, রেসের আগে ব্যাপক প্রশিক্ষণ ছাড়া আপনি যেমন ম্যারাথন-এ সফল হতে পারবেন না, ঠিক তেমনই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রেও এটি একই ভাবে প্রযোজ্য। কারণ, ভারতীয় বিয়ে কোনও বড়ো উৎসবের থেকে কম নয়। যে-কোনও উৎসব শুরু হওয়ার আগে আমরা যেমন প্রস্তুতি নিই, তেমনই বিয়েও একটা বড়ো উৎসবের মতো।

বিয়ের আগে অনেক কিছু করার আছে। ভেবেচিন্তে সবকিছু পরিকল্পনা করলে আত্মীয়স্বজনকে যেমন খুশি করতে পারবেন, ঠিক তেমনই নিজেরাও তৃপ্তি পাবেন। তাই হবু জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করে বিয়ের প্রস্তুতি নিন। আর এই প্রস্তুতি যাতে নিখুঁত হয়, তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা দরকার।

প্রেম কিংবা দেখেশুনে, যে-বিয়েই করুন-না কেন, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, হবু স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে একান্তে আলোচনায় বসার জন্য সময় বের করুন। যেদিন আলোচনায় বসবেন, কাগজ-কলম নিয়ে বসুন। কাজকর্ম থেকে অন্তত দু’সপ্তাহের জন্য দু’জনে বিরতি নিতে পারবেন, এমন একটা সময়কে বেছে নিন বিয়ের জন্য। কারণ, বিয়ের ঠিক পরেই হনিমুনও সেরে নিতে পারবেন এবং তা খুব সুখকরও হবে।

যাইহোক, হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ যদি শুভ-অশুভ সময়ের বিষয়টি মানেন, তাহলে পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করুন। এরপর আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিন যে, বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় করবেন বাড়িতে নাকি অনুষ্ঠান বাড়ি ভাড়া নিয়ে? এক্ষত্রে ভাবতে পারেন ডেস্টিনেশন

ম্যারেজ-এর বিষয়টিও, অবশ্য যদি বাজেট বেশি থাকে। কারণ ডেস্টিনেশন ম্যারেজ মানেই তো দূর-দূরান্তে গিয়ে বিয়ে এবং তা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। তবে খরচ করতে পারলে, ডেস্টিনেশন ম্যারেজ-এর মজাই আলাদা।

বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করার আগে মাথায় রাখুন বাজেটের বিষয়টি। অর্থ সাশ্রয় করতে চাইলে, বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ মিলে এক জায়গায় বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। যদি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করেন, তাহলে জেনে নিন কত টাকা ভাড়া এবং কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে। আর যদি ডেস্টিনেশন ম্যারেজ-এর কথা ভাবেন, তাহলে যে লোকেশন-এ বিয়ের অনুষ্ঠান করবেন, সেখানে যাতায়াতের জন্য এবং অনুষ্ঠান করার জন্য কত টাকা খরচ হবে, তার হিসেব করুন খোঁজখবর নিয়ে।

বরযাত্রী, কনেযাত্রী এবং বউভাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা তৈরি করে রাখুন আগেভাগে। কারণ, আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ। প্রি-ওয়েডিং এবং ওয়েডিং টাইম-এ স্টিল এবং ভিডিয়ো শ্যুট-এর ইচ্ছে থাকলে, সেই বিষয়টিও রাখতে হবে বাজেটে।

যদি নিজেরা অনুষ্ঠান অয়োজনের দায়িত্ব না নিতে চান, তাহলে কোনও ওয়েডিং প্ল্যানার এজেন্সি-কে দিয়ে সবকিছু করিয়ে নিতে পারেন, তবে তা ব্যয়সাপেক্ষ। আর যদি নিজেরা সবকিছু করতে চান, তাহলে বাড়ির লোকজনদের বিয়ের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভাগ করে দিন। কে অনুষ্ঠান বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব নেবে, কে বিয়ের কার্ড পৌঁছে দেবে আমন্ত্রিত অতিথিদের বাড়িতে, কে কেটারিংয়ের দায়িত্ব নেবে, কে আপ্যায়নের ভার নেবে, কে ছোটোখাটো প্রয়োজন মেটাবে, কে সবকিছু তদারকি করবে— এই সবকিছুর দায়িত্ব আগেই ভাগ করে দিন। তবে এক্ষেত্রে যে-ব্যক্তি, যেই বিষয়টিতে পারদর্শী বলে জানেন, তাকে সেই কাজটাই দিন বুঝেশুনে।

নিমন্ত্রণ পত্র

বিয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর, প্রথমে নিমন্ত্রণযোগ্য অতিথিদের তালিকা তৈরি করুন। তবে বাজেট ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়োজনে তালিকা ছোটো করতেও দ্বিধা করবেন না। এরপর বাজারে গিয়ে রুচিসম্মত নিমন্ত্রণ পত্র কিনে আনুন এবং অল্প কথায় ইংরেজি অথবা বাংলায় ম্যাটার (ইনভিটেশন স্ক্রিপ্ট) লিখে নিমন্ত্রণ পত্র ছাপতে দিন। বিয়ের কার্ড অর্থাৎ নিমন্ত্রণ পত্রের ডিজাইন কেমন হবে, তা ঠিক করুন দু’জনে মিলে। এর জন্য সাহায্য নিতে পারেন গুগল-এরও কিংবা শিয়ালদা বৈঠকখানা বাজারে গিয়ে বেছে নিতে পারেন কার্ড। কোনও আর্টিস্ট বন্ধু থাকলে তারও সাহায্য নিতে পারেন এই বিষয়ে।

উল্লেখ্য, এখন ই-কার্ড-এরও প্রচলন হয়েছে। তাই যদি নিমন্ত্রণ পত্র হাতে হাতে পৌঁছে দিতে না পারেন কিংবা যদি দূর-দূরান্তে থাকা কোনও আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে তা মেইল বা হোয়াটস অ্যাপ কিংবা ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে একবার ফোন করে দেবেন নিমন্ত্রিত অতিথিদের। বিয়ের অন্তত পনেরো দিন আগে নিমন্ত্রণ পত্র আত্মীয়-স্বজনদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। বন্ধুদের হাতে নিজেই দিয়ে আসুন নিমন্ত্রণ পত্র।

কেনাকাটা

দল বেঁধে কেনাকাটা করতে যাবেন। কারণ, সবাই মিলে দেখেশুনে কেনাকাটা করলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। বিয়ের রীতিনীতি থেকে শুরু করে হনিমুন পর্যন্ত যা কিছু প্রয়োজন, সেগুলির তালিকা তৈরি করে কেনাকাটা করতে যাওয়া উচিত। জীবনসঙ্গীর জন্য কোনও কিছু কিনতে হলে, আগেই তার পছন্দের ব্যাপারে জেনে নিন। প্রয়োজনে তাকে সঙ্গে নিয়েও কেনাকাটা করতে যেতে পারেন। খুব পুরোনো গয়না বাড়িতে থাকলে তা বদলে নতুন ডিজাইনের গয়না গড়ে নিতে পারেন। তবে তা বিশ্বস্ত গয়নার দোকান থেকেই কেনা উচিত।

বিয়ের অনুষ্ঠানের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল — পোশাক। গায়েহলুদ, বিয়ের দিন, বউভাতের দিন ভিন্ন পোশাকের প্রচলন আছে আমাদের ভারতীয় বিয়েতে। তাই পোশাক কেনার ব্যাপারেও আগাম পরিকল্পনা দরকার। দু’জনের রুচি, পছন্দ এবং বাজেট অনুযায়ী কিনে রাখুন এইসব প্রয়োজনীয় পোশাকগুলি। এক্ষেত্রে পরস্পরের পছন্দকে গুরুত্ব দিন।

শপিংমল কিংবা ফ্যাশন ডিজাইনার-এর থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন বিয়ের পোশাক। আর আত্মীয়স্বজনদের জন্য অপরিহার্য পোশাকগুলি কেনার আগে গুরুজন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া ভালো। শুধু তাই নয়, যাকে পোশাক উপহার দেবেন, প্রয়োজন মনে করলে তার সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে আলোচনা করে নিয়েও কিনতে পারেন পোশাক। যদি অনেক শাড়ি কিনতে হয়, তাহলে নদিয়া জেলার ফুলিয়া থেকেও কিনতে পারেন শাড়ি। কারণ ওখানে কম দামে ভালো শাড়ি পাওয়া যায়।

মণ্ডপসজ্জা

পেশাদার ডেকরেটর দিয়েই মণ্ডপ সাজানো উচিত। ফুল, পাতা, পাটকাঠি, ওড়না, থার্মোকল প্রভৃতি দিয়ে আজকাল সুন্দর ভাবে মণ্ডপ সাজানো হয়। আপনার পছন্দের বিষয়টি আগেই জানিয়ে দিন। বন্ধু-বান্ধবদের বিয়ের মণ্ডপসজ্জা দেখে আইডিয়া নিন এবং সেইসঙ্গে ইন্টারনেটে সার্চ করে মণ্ডপ তৈরির আইডিয়া নিতে পারেন।

ফোটোগ্রাফি

বিয়ের অনুষ্ঠানের স্টিল এবং ভিডিয়ো ফোটোগ্রাফি করান প্যাকেজে। পেশাদার আলোকচিত্রীদের দিয়েই বিয়ের ছবি তোলানো উচিত। কারণ ছবিগুলিকে প্রেজেন্টেবল করার জন্য ভালো ফ্লেমিংও হওয়া চাই। স্টিল ছবিগুলিকে ভালো অ্যালবামে সাজিয়ে রাখবেন এবং ভিডিয়োগ্রাফি এডিট করে পেন-ড্রাইভে সংরক্ষণ করুন।

রেজিস্ট্রেশন

সিঁদুরদান, মালাবদল যা-ই করুন না কেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন করা অত্যন্ত জরুরি। এই আইনসিদ্ধ বিয়ে ভবিষ্যতের রক্ষাকবচই শুধু নয়, নানা সরকারি কাজকর্মেও তা একান্ত ভাবে আবশ্যক। একমাস আগে নোটিশ করেও রেজিস্ট্রেশন করা যায়, আবার বিয়ের পরও রেজিস্ট্রেশন করানো যায়। তবে বিয়ের পরে রেজিস্ট্রেশনে খরচ বেশি। অন্তত পাঁচ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন বাবদ বিয়ের বাজেটে রাখবেন।

রেজিস্ট্রেশনের পরে পেমেন্ট রিসিট মনে করে নিয়ে সযত্নে রাখবেন। কারণ রেজিস্ট্রেশনের সপ্তাহখানেক বাদে যখন সার্টিফিকেট তুলতে যাবেন কোর্ট থেকে, তখন পেমেন্ট রিসিট দেখাতে হবে। পাত্রপাত্রী দু’জনেরই চার কপি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি, অ্যাড্রেস প্রুফ ইত্যাদি লাগে রেজিস্ট্রেশনের জন্য। উভয়পক্ষের দু’জন সাক্ষীও থাকতে হবে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন-এর সময়।

আপ্যায়ন

দূরের নিমন্ত্রিত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা রাখবেন। আপ্যায়নের জন্য মিষ্টভাষী এবং মিশুকে কাউকে দায়িত্বে রাখা জরুরি। নিমন্ত্রিত অতিথিদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেই ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য গান-বাজনার আয়োজনও রাখতে পারেন।

প্রীতিভোজ

নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজেরা না নিয়ে, কোনও কেটারার দিয়ে করালে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। ভেজ এবং ননভেজ দু- রকম খাবারই রাখার চেষ্টা করুন মেনুতে। তবে খুব বেশি পদ না রেখে, পছন্দসই অল্পসংখ্যক পদের ভালো খাবার রাখুন। বন্ধু- বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং বাজেট মাথায় রেখে খাদ্য তালিকা তৈরি করুন। মূল খাবারের সঙ্গে দই, মিষ্টি এবং পান রাখা জরুরি। আর বিয়ের অনুষ্ঠান শীতকালে না হলে, দইয়ের পরিবর্তে আইসক্রিম রাখতে পারেন। আজকাল বুফে সিস্টেমে খাওয়ানোর রীতি চালু হয়েছে। আপনিও এই পদ্ধতিতে খাইয়ে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করুন।

হনিমুন পর্ব

জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করে আগে থেকে ঠিক করে ফেলুন হনিমুন স্পট। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার আগে, গন্তব্য স্থানের বিষয়ে বিশদে খোঁজখবর নিয়ে রাখুন। সেইসঙ্গে, গন্তব্যস্থানে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে রাখুন। প্রয়োজনে কোনও ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নিন।

চাকুরিজীবীরা হনিমুনে যাওয়ার জন্য আগেভাগে কর্মস্থলে ছুটির আবেদন করতে ভুলবেন না। বিদেশে হনিমুন করার ইচ্ছে থাকলে, সুনাম আছে এমন কোনও ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়ে ভিসা-র আবেদন করুন এবং ওই এজেন্সিকে টাকা দিয়ে পুরো ট্যুর-এর প্যাকেজ নিন। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, কমপক্ষে দু-মাস আগে ভিসা-র আবেদন করা উচিত।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...