কাকভোরে রাজপালের ঘুমটা ভেঙে গেল। কী কারণে সেটা প্রথমে ঠাউর করতে করতে কিছুটা সময় গেল। তারপরেই খেয়াল হল তাকের উপর সযত্নে তুলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙেছে। মালিকের ফোন। মালিক হচ্ছেন বড়ো হাভেলির দেওয়ান সাহেব। আজ তো শনিবার ওর ছুটির দিন। তাহলে সকাল সকাল ফোন, কী ব্যাপার!

চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাজপালের কপালে। আজকের দিনে ওকে দেওয়ান সাহেবের জঙ্গলের দেখাশোনা করতে যেতে হয়। জঙ্গলের পুরো দাযিত্বই রাজপালের ওপর ছেড়ে রেখেছেন মালিক। অত বড়ো হাভেলিতে দেওয়ান সাহেব একাই থাকেন। দু’-দু’বার বিয়ে করেছেন। কোনওটাই স্থায়ী হয়নি।

প্রথম স্ত্রী ছেলের সঙ্গে বিদেশে থাকেন। মালিকের এক ছেলে এক মেয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীও আলাদাই থাকেন, তবে যাওয়ার আগে দেওয়ানজির অনেক টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। মালিকের বিরাট ব্যাবসা।

হ্যালো, রাজপাল ফোনটা হাতে নিল। দেওয়ানজির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রাজপাল, কাল ঠিক এগারোটার সময় হাভেলি আসতে হবে।

মনে মনে আশ্চর্য হল রাজপাল। মালিক ভালো করেই জানেন, শনি আর রবিবারটা জঙ্গলে কাটিয়ে সোমবার রাজপাল ফেরে। কী আর করা? মালিকের আদেশ অমান্য করা চলবে না। হয়তো মালিকের শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়েছে। বেশ কয়েদিন ধরে ওনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। একা একা থাকা। শুধুমাত্র একজন গুজ্জর মহিলা নুরা মালিকের দেখাশোনা করে।

প্রথম প্রথম নুরা হাভেলির দোতলাটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দাযিত্বে ছিল। কিন্তু ওর কাজ দেখে খুশি হয়ে দীনানাথ পুরো বাড়ির দায়িত্ব ওকে সঁপে দিয়েছিলেন। অত বড়ো হাভেলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে বাবলু, নুরাকে সাহায্য করত আর রাত্রে দীনানাথের কাছে শুত।

দীনানাথের মেয়ে মুম্বইয়ে থাকত। তার দুটি সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে স্বামীর জুতোর ব্যাবসা ছিল যার অবস্থা তখন প্রায় পড়ন্ত। অবশ্য মেয়ে উপাসনার স্বামীর সঙ্গে তখন বনিবনাও ছিল না। উপাসনার মদ্যপানে আসক্তির অভ্যাস স্বামী আনন্দকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। শুধুমাত্র স্ত্রীকে বরদাস্ত করত এই আশায় যে, শ্বশুরের মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তির মালকিন হবে উপাসনা। যেনতেন প্রকারেণ ওই সম্পত্তি স্ত্রীকে ঠকিয়ে কী করে নিজের করা যায়, তারই নানা ফন্দিফিকির মাথায় আনাগোনা করত সবসময়। উপাসনার সঙ্গে ভালোবাসার বিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু সম্পর্কটা তিক্ততার দিকে মোড় নিয়েছিল। আনন্দ দেনায় আকণ্ঠ ডুবে ছিল।

দীনানাথের ছেলে অতুল একেবারে নিষ্কর্মা বলতে যা বোঝায় তাই। আজ পর্যন্ত কোনও কাজই ঠিক ভাবে করে উঠতে পারেনি। অতুলেরও এক ছেলে। সবাই বিদেশেই থাকত। অতুলের যত ফুটানি সবই মায়ের টাকায়। কিন্তু মায়ের প্রতি কোনও দায়িত্বই ও পালন করত না। এই নিয়ে নিত্যদিন বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত।

দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গেই দীনানাথের বনিবনা একেবারেই হতো না। মাঝেমধ্যে কখনও কখনও দেখাসাক্ষাৎ হতো। মা-কে ডিভোর্স করার জন্য উপাসনা বাবাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারেনি। যদিও সে জানত তার মা খুবই ঝগড়ুটে, স্বার্থপর একজন মহিলা। দুই-তিন বছরে একবার ভাইবোন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাও কিছু টাকা আদায় করার ধান্দায়।

নাতি-নাতনিদেরও কোনও খবর দীনানাথের কাছেও ছিল না। উনি কোনও দিন তাদের চোখেই দেখেননি। এই হল দীনানাথের পুরো পরিবারের চিত্র যা আজকের পটভূমিকাতেও অদ্ভুত বলেই সকলে গণ্য করবে।

ঠিক এগারোটায় হাভেলি পৌঁছোতেই রাজপাল দেখল সদরে বহু মানুষ ভিড় করেছে। ঘাবড়ে গেল সে। গাড়ি রাস্তাতেই দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। দেখল পুলিশের কিছু লোক রয়েছে। একটা চৌকির উপর দীনানাথের নিষ্প্রাণ শরীরটা শোয়ানো আছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে নুরা, মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি করেই এমন অবস্থা হয়েছে।

রাজপালকে দেখেই ইন্সপেক্টর রমন এগিয়ে এলেন ওর দিকে, আপনি কি দেওয়ানজি মারা যাওয়ার খবরটা আগেই পেয়েছিলেন?

রাজপাল সংযত হয়ে উত্তর দিল না, ইন্সপেক্টর। আমার জন্য এটা একটা বিরাট শক্। আমাকে তো স্যার নিজেই ফোন করে বলেছিলেন, আজ ঠিক এগারোটায় হাভেলি পেঁছে যেতে।

নুরা আর রাজপালকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ইন্সপেক্টর রমন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে, এটা আত্মহত্যার কেস। শুধুমাত্র এই দুজনই জানত মালিক ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। দুই ছেলে-মেয়ে সম্প্রতি জানতে পেরেছিল, বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে তারা নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, বাবার কাছে আসার কারওরই সময় হয়নি।

ইন্সপেক্টর রমন পকেট থেকে একটা বাদামি রঙের খাম বার করে রাজপালকে জিজ্ঞেস করলেন, এই খামটা অ্যাডভোকেট লোকেশ বক্সির নামে। আপনি একে চেনেন নাকি?

হ্যাঁ, উনি, দেওয়ানজির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই হাভেলির চার-পাঁচটা বাড়ি পরেই উনি থাকেন।

আপনি কি দেওয়ান সাহেবের ছেলেমেয়ে আর আত্মীয়স্বজনদের খবর পাঠিয়েছেন? রমন রাজপালকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করলেন।

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎই অ্যাডভোকেট বক্সি উদভ্রান্তের মতো ভিতরে প্রবেশ করলেন। একনজর দেখেই ওনার তীক্ষ্ম দৃষ্টি বুঝে ফেলেছিল, বন্ধু আর নেই। ওনার হাতেও একটা বাদামি রঙের খোলা খাম ধরা। ইন্সপেক্টর, মিস্টার বক্সিকে আগে থেকেই চিনতেন। নানা কেসের সুবাদে আদালতে দেখাসাক্ষাৎ হতেই থাকত। দীনানাথ, বক্সি আর রমন তিনজনেই জম্মুর পুরোনো বাসিন্দা।

চিঠি আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল, বক্সি সাহেব খামটা ইন্সপেক্টরের হাতে ধরাল। দুটো খামেই চিঠির বর্ণনা হুবহু একই। রমন লক্ষ্য করলেন একই ব্যক্তির লেখা। পরিষ্কার তাতে লেখা আছে, আমি দীনানাথ, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে নিজের জীবন শেষ করছি। আজ চার-পাঁচ বছর হল ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য অসুখে ভুগছি। হয়তো আর বেশীদিন বাঁচব না। এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আমার কাছে যারা কাজ করে তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত। সুতরাং তাদেরও আমি আর কষ্ট দিতে চাই না। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তে পেঁছেছি।

আমার মৃত্যুর পর আমার গোটা সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ অর্থাৎ এই বাড়ি, আমার গ্রামের আমবাগান আর নগদ ধনরাশিরও অর্ধেক ভাগ নুরা পাবে। রাজপাল যে-কিনা কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, সে আমার কুদ-এর জমি বাড়ি সব পাবে। এছাড়া আমার নগদ অর্থের কুড়ি শতাংশ ওকে যেন দেওয়া হয়।

বাকি যা অর্থ পরে থাকবে তা আমি আমার বাড়ির পাশের মন্দিরের ট্রাস্ট-কে দিয়ে যাচ্ছি। বাকি যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে খালি ব্যবহার করে গেছে, তাদের জন্য আমার কাছে দেওয়ার কিছুই নেই। বেঁচে থাকতে আমি যা কষ্ট পেয়েছি, আমি চাই ওরাও এই কষ্ট ভোগ করুক। যদি এর থেকে ওরা কোনও শিক্ষা নিতে পারে।

আমার কাজ ধুমধাম করে করার কোনও দরকার নেই। যে-মন্দিরে আমি প্রতি মঙ্গল আর রবিবার যেতাম সেখানেই যেন আমার শ্রাদ্ধশান্তি সম্পন্ন করা হয়। আর লোকেশ, তোমার দাযিত্ব হচ্ছে আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করা। আর নুরা আর রাজপাল যেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা দেখা। নয়তো মৃত্যুর পরেও আমি শান্তি পাব না।

রমনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতেই বক্সি বললেন, হাতে লেখা উইল কোনও কোর্ট অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সবথেকে আশ্চর‌্যের বিষয় হল দীনানাথ নিজের সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে গেলেন না।

ইন্সপেক্টর রমন বললেন, বাচ্চারা তো এই উইল-টাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারে।

হ্যাঁ পারে, কিন্তু সেটা খুবই দীর্ঘ প্রসেস। কত বছর যে লাগবে কিছুই বলা যায় না, তার উপর আলাদা করে খরচও আছে।

আপনি তো দীনানাথের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি নিশ্চই সব জানেন? প্রশ্ন করেন রমন।

হ্যাঁ, জানি তো সব। রোজ সন্ধেবেলায় দেখা করতে যেতাম। রবিবারও বাদ যেত না। তবে দুই বছরের বেশি হল, ওর শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ে। খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও মনের কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল, উত্তর দেন বক্সি।

আপনি নুরা সম্পর্কে কী জানেন?

বক্সি আর রমন কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে এসেছিলেন। বাড়িতে লোকজন আসতে আরম্ভ করছিল। সন্ধের মধ্যে

দাহ-সংস্কার করার কথা ঠিক করা হয়েছিল কারণ ছেলে-মেয়ে দূর থেকে আসতে সময় লাগবে।

নুরা প্রায় দশ বছর ধরে দীনানাথের কাছে কাজ করছে। নুরার বাবা ও তার গোটা পরিবারকে দীনানাথ চিনতেন। প্রথম প্রথম নুরা ঘরদোর পরিষ্কার করে বাড়ি চলে যেত। কিন্তু যখন থেকে দীনানাথ অসুস্থ হলেন, নুরা সারা বাড়ির দাযিত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। শেষ দুবছর তো ও-ই প্রায় সব কাজ করত। ওদের বাড়ির অবস্থা বেশ খারাপ। মদ খেয়ে খেয়ে স্বামীটা মরে গেছে, ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তবে মেযো ভালো। মেযো নার্সিং পড়া সবে শেষ করেছে, বক্সিবাবু জানালেন রমনকে।

নুরার মেয়ে এখন কোথায়? রমন আগ্রহ প্রকাশ করল।

লুধিয়ানায় চাকরি করছে। নুরার বুড়ি মা নাতনির সঙ্গে থাকে।

দাহ-সংস্কার হয়ে যাওয়ার পর উইলের দুটো কপি বানানো হল। একটা রমন নিজে রাখল, অন্য অরিজিনাল কপিটা বক্সির কাছে থাকল। ঠিক করা হল, দীনানাথের সন্তানরা এলে ওনার পারিবারিক উকিল হিসেবে বক্সিবাবু ছেলে-মেয়েে উইল-এর বিষয়ে জানাবে।

মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা ও তার স্বামী আনন্দ রাতেই পেঁছে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল দাদা অতুলের পৌঁছোনোর। সে-ও দুদিন বাদেই বিদেশ থেকে এসে পৌঁছোল।

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উপাসনা অনুশোচনার আগুনে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছিল। সারা জীবন মায়ের কথা শুনে এসেছে। বাবার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ শুনতে শুনতে বাবার প্রতি ঘৃণার মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল উপসনার। কিন্তু আজ বাবা না থাকাতে মনের মধ্যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে।

আনন্দর এই পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছিল। ওর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, টাকা আত্মসাৎ করার। ওল্ড ম্যান-এর মৃত্যুতে ওর কোনওরকম আপশোশ ছিল না।

বাবার মৃত্যুতে অতুলের মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। বারবার শেষবারের আসার কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথমবার দীনানাথ ওর সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বাবা-ছেলের মধ্যে মতের মিল ছিল কোথায়, যে দুজনে কোনও বিষয় নিয়ে বসে আলোচনা করবে এবং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে!

অত দূর কানাডা থেকে এসে মাত্র পাঁচদিন থেকেই অতুল ফিরে গিয়েছিল। বাবার মৃতু্য়র পর বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, চলো একটা অধ্যায় তো শেষ হল। এখন বাবা তার জন্য যে-সম্পত্তি, টাকাপয়সা রেখে গেছেন তাই দিয়ে সে নতুন করে নিজের ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে।

নুরা অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। হাভেলির প্রত্যেকটা ঘর পরিষ্কার করে সকলের থাকার ভালো ভাবে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল।

দীনানাথের শ্রাদ্ধশান্তির কাজ শেষ হলে অতুল আর উপাসনা মিলে ঠিক করল, এবার নুরা আর রাজপালকে ওদের দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়ার সময় হয়েছে। এদের বদলে নতুন লোক রাখা হবে বাড়ির কাজের আর রান্নাবান্না করার জন্য। রাজপালের জায়গায় একজন স্মার্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখা দরকার, যে-কিনা ব্যাবসা থেকে শুরু করে জঙ্গলের সব কাজকর্ম একাই সামলাতে পারবে। অতুল জানাল, এখন থেকে সে মাঝেমাঝেই দেশে আসবে সবকিছু দেখাশোনা করার জন্য।

ভাইবোনের আলোচনার মাঝেই ইন্সপেক্টর রমন এবং বক্সি সাহেব হাভেলি এসে পৌঁছোলেন। ওনাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল অতুল আর উপাসনা। কারণ তারা জানত আজ বাবার উইল পড়া হবে। নুরাকে অতিথিদের জন্য চা আনতে বলে দুজনে এসে বসল।

অতুল, অ্যাডভোকেট বক্সিকে লক্ষ্য করে বলল, আংকেল, আমি ভাবছি এবার বাড়ির হাল নিজের হাতে ধরব। বাবার পর আমারই দাযিত্ব সবকিছু দেখাশোনা করার। আমরা ঠিক করেছি নুরা আর রাজপালকে আর রাখব না। এমনিতেও ওদের দু’জনকে আমরা কেউ পছন্দ করি না। নুরাকে দেখলে তো মনে হয়, ওই এ বাড়ির মালকিন।

রমন আর বক্সির চোখাচোখি হল, যেন ওরা বলতে চাইছে, এরা বেচারারা কী করে জানবে, যে কী হতে চলেছে ওদের সঙ্গে।

আংকেল আপনি কিছু বলবেন না এই ব্যাপারে? উপাসনা জিজ্ঞেস করল।

উত্তর দিল রমন, তোমাদের যা বলা হচ্ছে মন দিয়ে শোনো। তোমার বাবার লেখা চিঠি যেটা ওনার কাছ থেকে পাওয়া গেছে, সেটা পড়ে তোমাদের শোনানো হচ্ছে এখন।

বাবার এত বড়ো সম্পত্তি পেতে চলেছে এই ভেবে উপাসনা আর অতুল মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেও, চোখেমুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে রেখে দু’জনেই সাগ্রহে রমনের দিকে তাকাল।

রমন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দীনানাথের পত্রটা পড়ে দুই ভাইবোনের দিকে তাকাল।

কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না। ওদের দুজনের মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ওরা রীতিমতো শকড। এমনটা কেউ আশা করেনি।

এ কী করে সম্ভব? উপাসনাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

আমরা দুজন ওনার সন্তান। নুরা, রাজপাল ওনার কে? কোথা থেকে ওরা এসেছে কেউ জানে না। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল কোথাও একটা রহস্য আছে…। নুরাটা এক নম্বরের চরিত্রহীন, বাবাকে ফাঁসিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

সেই মুহূর্তে উপাসনার স্বামী আনন্দ ঘরে ঢুকে ওদের কথাবার্তায় যোগ দিল। উপসনার কথা শেষ হতেই বলে উঠল, আমার তো প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল, বাড়িতে যেভাবে গৃহকত্রী হয়ে ঘুরে বেড়াত, তাতে যে কেউই ভাবতে পারে বাড়িটা ওরই।

অতুল কোনও কথাই বলতে পারল না। রাগে ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। দীনানাথ কোনও দিন বাবা হিসেবে কোনও কর্তব্য পালন করেননি। শুধু খরচ দিয়ে গেছেন। কখনও ওর স্কুলে যাননি। স্পোর্টস-এ এত ভালো ছিল অতুল কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোনও দিন একটা বাহবাও ওর কপালে জোটেনি। মায়ে সঙ্গেও দীনানাথ মানিয়ে নিতে পারেননি এবং বহু অর্থ নিয়ে তবেই দীনানাথের থেকে আলাদা হয়েছিলেন মা ঠিকই কিন্তু তাতে অতুলের দোষটা কোথায় ছিল! অতুল তো দীনানাথের নিজের সন্তান। তাহলে বাবা হয়ে সন্তানের এত বড়ো সর্বনাশ কী করে করতে পারলেন, অতুল কিছুতেই সেটা ভেবে পেল না।

নুরা নুরা উপাসনা গলার জোর বাড়াল।

জি বিবিজি, নুরা মুহূর্তে সামনে এসে হাজির হল।

নুরা, এসব কী শুনছি! তুই জানতিস বাবা এত সম্পত্তি তোর নামে করে গেছেন? জানতিস তো নিশ্চয়ই নয়তো কোনও সম্পর্ক ছাড়াই দিনরাত কেন এখানে পড়ে থাকতিস? তিক্ততা ফুটে ওঠে উপাসনার গলায়।

না বিবিজি, আমি কিছুই জানতাম না, চোখে জল ভরে যায় নুরার।

আপনি এসব কী বলছেন? আমি তো এখনই আপনার মুখ থেকে শুনছি। আমি তো স্বপ্নেও এসব ভাবতে পারি না।

নুরা, তুমি যাও নিজের কাজ করো, অ্যাডভোকেট বক্সি এতক্ষণে মুখ খুললেন।

এটা কী করে সম্ভব আংকেল। আমি তো রাজপাল আর নুরাকে ছাড়ব না। এটা এদের বাপের সম্পত্তি নয় যে, এগুলো নিয়ে নেবে। প্রযোজনে আদালতে যাব, ওখানেই মীমাংসা হবে। রাগের মাথায় বলে ওঠে আনন্দ। শুনে সকলের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

বক্সি উত্তরে বলেন, হাতে লেখা উইলকে চ্যালেঞ্জ করাটা খুবই ঝুঁকির কাজ। বছর গড়িয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর কী হবে হয়তো কোনও জজ সাহেব হাতের লেখার পরীক্ষা করাতে পাঠাবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত দুটো চিঠিই দীনানাথ নিজের হাতেই লিখেছেন।

কিন্তু এদের কেন? আমরা কেন নই? এতক্ষণে অতুল কথা বলে।

ইন্সপেক্টর রমন এবার বলেন, এটা তো নিজের নিজের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। ওনার একাকিত্বটা একটু ভাবার চেষ্টা করো যেটার মধ্যে দিয়ে ওনাকে একাই যেতে হয়েছে। তার উপর ক্যান্সারের মতো রোগ, তোমরা তো কেউ খোঁজও রাখোনি। এই দুজনই তোমাদের বাবার সেবা করেছে।

শেষের এক দেড় বছর তো অসম্ভব মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। কখনও খুশি তো কখনও ডিপ্রেশনের শিকার হত। আমি ওর এই মুড সুইং দেখেছি আর এও দেখেছি নুরার কি অসীম ধৈর‌্য আর সহনশীলতা। নিজের কাজ নিয়ে থাকত ও। অত্যন্ত প্রভুভক্ত এবং বিশ্বাসী। শেষের বেশ কিছুদিন দীনানাথ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে কাপড়চোপড় বদলানো, পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়া সব নুরাই সামলাত। অ্যাডভোকেট বক্সি বললেন।

ইন্সপেক্টর রমনের আর কিছু করার ছিল না। উনি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মনে মনে জানতেনই নতুন কিছু ঘটলে, সেটা বক্সি সাহেবের কাছেই জানতে পেরে যাবেন।

রমন চলে যেতেই বক্সি বললেন, তোমরা জানতে চাও, এরকম কেন করেছে দীনানাথ। আমি জানি এটার সম্পর্ক তোমাদের পরিবারের সঙ্গে। সেজন্য রমনের সামনে আমি কিছু বলতে চাইছিলাম না।

শ্লেষ মিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে উঠল আনন্দের ঠোঁটে, কী এমন কথা আছে যে বাড়ির লোকেরা কিছু জানে না অথচ আপনি জানেন? আবার নুরার সাপোর্টে নতুন গল্প নয় তো?

ভদ্র ভাবে কথা বলো। তুমি এ বাড়ির জামাই। তাই তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার মাথার সাদা চুলের সম্মানটুকু করো। বক্সি রাগত স্বরে আনন্দকে বললেন।

অতুল বলে উঠল, আংকেল আপনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

বক্সি বলতে আরম্ভ করলেন, তোমরা সকলেই আশ্চর‌্য হয়ে গেছ, দীনানাথ কেন এরকম করল এই ভেবে! ১৯৪৬-৪৭ সালের কথা হবে। তোমাদের ঠাকুরদা নতুন নতুন ব্যাবসা আরম্ভ করেছেন। ব্যাবসা বাড়াবার জন্য তিনি কুদ-এ বেশ কিছু জমি নিয়ে রেখেছিলেন। ওখানে ওনার ছোটো একটা বাড়ি ছিল। সেখানে পাশেই এক গুজ্জর পরিবার থাকত। ওদের অনেক জমিজমা ছিল।

অশিক্ষিত গুজ্জরের কাছে অত জমি দেখে তোমাদের ঠাকুরদার মনে লোভ জন্ম নেয়। উনি সেগুলো হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। যখন কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেন না, তখন একদিন রাতের অন্ধকারে ওদেরকে মেরে ফেলা হয়, সেটা তোমাদের বাবা দেখে ফেলে। ওর বয়স তখন মাত্র সাত। গুজ্জরের বউ একমাত্র মেয়ে নুরাকে নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে জম্মু চলে আসে। নুরা তখন খুব ছোটো।

কিন্তু বাবা ওদেরকে কী করে খুঁজে পেল? উপাসনা জানতে চাইল।

আমি এটুকুই জানি, দীনানাথ ওদেরকে অনেক খুঁজেছিল, হয়তো পরিচিত কাউকে একাজে বহাল করেছিল। নুরা যখন এই বাড়িতে কাজে লেগেছে তখন হয়তো দীনানাথ ওদের ঠিকানাও খুঁজে বার করে ফেলেছে। হ্যাঁ, তবে নুরাকে ও কখনও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ সবসময় কাজ করত ওর। হয়তো সেই থেকেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীনানাথ।

তোমাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা

না-হওয়া, দীনানাথের দুরারোগ্য ব্যাধি এই সবই হয়তো ওকে নতুন করে চিন্তা করতে প্ররোচিত করেছে। রক্তের সম্পর্ক নয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভালোবাসা দিয়ে যখন দীনানাথ ভয়ানক যন্ত্রণায় ছটফট করত, তখন নুরাই ওর দেখাশোনা করত, ওষুধ এগিয়ে দিত।

আনন্দ বলে ওঠে, তবুও নিজের সন্তানের জায়গা কেউ নিতে পারে না। সে কাছেই থাকুক বা দূরেই থাকুক।

উপাসনা আর অতুল একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা এর বিরুদ্ধে কোর্টে অ্যাপিল করব।

বক্সি সাহেব মৃদু হেসে বললেন, অতুল তোমাকে কানাডা থেকে বারবার আসা-যাওয়া করতে হবে। উপাসনা তুমিও ভেবে দেখ এটা কিন্তু সহজ নয়. বেশ কিছু বছর হয়তো লেগে যেতে পারে। কিন্তু হাতে লেখা উইল কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...