আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বারবার রজত ওই অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজের চ্যাট বক্সটা খুলছে, ডিপিটা দেখছে, আবার রেখে দিচ্ছে।
ভদ্রমহিলার মুখটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড় বেয়ে কোমর অবধি নেমে এসেছে। সুঠাম দেহের গঠন, চুলের পাশ থেকে প্রসারিত হয়েছে ফরসা দুটো হাত যেন কোনও চিত্রকরের অঙ্কিত দুটি বঙ্কিমরেখা। বয়স বড়োজোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। প্রথম মেসেজটা ওপার থেকেই এসেছিল, ছোট্ট একটা, হাই!
রজত প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো কোনও উড়ো মেসেজ। তাই অফিসিয়ালি রিপ্লাই দিয়েছিল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
একসাথে অনেকগুলো স্মাইলি এসেছিল। রজত একটু অবাক হয়। এত রাতে সচরাচর এরকম রিপ্লাই কে দেবে?
কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল,
কে আপনি?
ধরুন, আপনার কোনও বান্ধবী।
মানে?
কেন আপত্তি আছে? ছবি না দেখে বুঝি বন্ধুত্ব করা যায় না?
রজতের আকর্ষণটা বেড়ে গেছিল। এরকম প্রত্যুত্তর সে অনেক দিন পায়নি।
আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?
এই মহাবিশ্বের কোনও একটি ক্ষুদ্র শহরের বাসিন্দা।
হেঁয়ালি করছেন?
সরকারি আধিকারিকের সাথে হেঁয়ালি? না, অত সাহস নেই।
ভদ্রমহিলার চমকপ্রদ জবাবগুলো রজতের আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন প্রায় সারাদিনই ও ফোন কাছে কাছে রাখে। কিন্তু সেই রহস্যময়ী সারাদিনে একবারও অনলাইন আসে না। শুধুমাত্র একবার। রাত বারোটার পর।
অতএব, রজতও সেই সময়টাই বেছে নিয়েছে। মনে মনে একবার কল্পনা করে অবয়বটাকে। আজ সে ঠিক করেছে, ভদ্রমহিলার নাম জানতে চাইবে।
তাই প্রথমেই বলে, এতদিন কথা বলছি, আপনার নামটা জানতে পারি কি?
লোকে মধুরিমা বলে!
বেশ, আমিও ওই নামেই ডাকব।
যা ইচ্ছা!
একবার দেখা করা যায় কি?
এই প্রশ্নের পর টানা কুড়ি মিনিট কোনও রিপ্লাই আসেনি। ইতিবাচক কোনও কিছুর আশা নিয়ে রজত ফোনের দিকে তাকিয়েছিল। চার্জটা ক্রমশ কমে আসছে। প্লাগে চার্জারটা কানেক্ট করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল। অবশেষে রিপ্লাই এল, সেই কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকেই
অবশ্যই, আগে চিনি, জানি..
রজত নিরাশ হয়নি। বরং আশার একটা ক্ষীণ আলেয়া জ্বলে উঠেছিল। ওর পুরো মনটা আলোকিত করে তুলেছিল। মুখভঙ্গি না দেখেও শুধু কয়েটা রিপ্লাই যে, কোনও মানুষকে এতটা সম্মোহিত করতে পারে সেটা জানা ছিল না রজতের।
আজকাল আর তার কাজে মন নেই। সে এখন শুধু বারবার ওই নম্বরটাতে কল করে।
সুইচ অফ! ট্রু কলারে দেখেও কোনও লাভ হয়নি।
তাই শুধু রাতের গহিন অপেক্ষা। এখন রাত হলেই কেমন নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সে। অমোঘ জালে জড়িয়ে পড়েছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বলেই ফেলে, মধুরিমা, মধুরিমা, আমি তোমায় ভালো…
কী?
ভালোবেসে ফেলেছি!
তাই বুঝি! এত তাড়াতাড়ি?
দেরির কী আছে শুনি? তোমার কি আমাকে পছন্দ না?
তুমি যে বিবাহিত!
হ্যাঁ, রজত তো বিবাহিত। দীর্ঘ সংসারজীবন অতিক্রম করে এসেছে। এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথক ভাবে। একই বাড়িতে থাকলেও রজতের স্ত্রী মল্লিকা থাকে নীচের তলায়, রজত উপরতলায়। এখনও মল্লিকা সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুর ছোঁয়ায়।
রজতের আজকের চাকরির পদটা একদা মল্লিকার বাবারই দেওয়া। বিয়ে পর বেকার জামাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া শ্বশুরের দাযিত্ব! সেই দাযিত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন মল্লিকার বাবা পরিমলবাবু। নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে জামাইকে সরকারি অফিসে পার্মানেন্ট পদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের বুকে জমি কিনে ঝাঁ চকচকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বদলে চেয়েছিলেন, মেয়ে কাছে বাকি জীবনটা কাটাতে। সেটাই কাল হয়েছিল। মরতে হয়েছিল জামাইয়ে হাতে। তাও সুখ। মরেও সুখ। মেয়ে তো ভালো আছে। কিন্তু সত্যিই কি ভালো ছিল মল্লিকা?
রজতের এনে দেওয়া ওষুধগুলো খেতে খেতে দিন দিন কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছিল মল্লিকা। শুধু ঘুম পেত, অনিচ্ছাকৃত কোনও ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত না। ক্রমে নীরবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করাই ওর ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। রজত বলত, ওগুলো নাকি বাতের ব্য়থার ওষুধ, খেলে বার্ধক্য আসবে না কোনও দিন।
মল্লিকাও সরল বিশ্বাসে দিনের পর দিন নিঃশব্দে জলের তোড়ে গিলত সেগুলো। কখনও কোনও প্রশ্ন করত না। আসলে বাঙালি মেযো কখনওই স্বামীর সামনে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে না। দৃঢ় গলায় কোনও কিছুর সদর্থক কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এই চিরকালীন ব্যর্থতাই হয়তো কালের নিষ্ঠুর নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে।
এই অনাড়ম্বর জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই রজতের। তাই সে আবারও প্রেমে পড়েছে। এবারের প্রেক্ষাপটটা অন্যবারের থেকে একটু অন্যরকম। কথা বলতে বলতে সেই সুতোর জটে সে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার থেকে বেরোনোর উপায় পাচ্ছে না। সে বেরোতে চায়ও না। বরং আরও প্রবল ভাবে নিজেকে সেই জটের মধ্যে বেঁধে ফেলতে চায়। সংসার সুতোয় গিঁট দিতে চায়। অতঃপর, মধুরিমার সম্মতি চাই। তাই আবারও মুষ্টিভিক্ষা করে, তুমি কি আমার হবে মধুরিমা?
সম্ভব?
জীবনটা বড়ো বিষাদ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই। ব্যস।
বেশ, তবে দেখা কোরো।
বলো। কোথায় আসতে হবে?
কাল, পার্ক হোটেলে। বাকি ডিটেলস কাল সকালে আমি তোমাকে সেন্ড করে দেব।
ওকে!
মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সবকিছুই যেন নিমেষে রঙিন হয়ে গেছে রজতের কাছে। পাথুরে মাটিতে আবার জলীয় স্পর্শে ঘাস গজিয়েছে। কাল সে অনেকগুলো গোলাপ নিয়ে যাবে মধুরিমার জন্য। ভালো করে দেখতে পাবে ওর মুখটা। না জানি, সে কতই না সুন্দর হবে! এইসব ভাবতে ভাবতে চোখটা বুজে আসে রজতের।
পরদিন সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে, প্রায় দশটা বাজতে যায়। চটপট করে ব্রেকফাস্ট সেরে মোবাইল খুলে দেখে, মধুরিমা অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে। দেরি না করে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।
আজ রজত অনেকটা পারফিউম দিয়েছে। তার এক বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। কোনও দিনও খুলে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ প্রয়োজন পড়ল।
এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল পার্ক হোটেলে। তারপর রিসেপশনে ফরম্যালিটিস কমপ্লিট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দুশো বাহাত্তর নম্বর রুম। সেখানেই অপেক্ষা করছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত সুন্দরী।
ঘরের সামনে এসে আলতো করে নক করে রজত। আপাদমস্তক কালো ওড়নাতে ঢাকা একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। সম্মোহিতের মতো কোনও অজানা স্নায়বিক নির্দেশনায় ঘরে ঢুকে আসে রজত। বসে পড়ে সোফার উপর। প্রশ্ন করে, তুমিই মধুরিমা?
ইঙ্গিতে উত্তর আসে, হ্যাঁ!
এখনও কি নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে?
ভদ্রমহিলা কোনও কথা না বলে একটা মদের গেলাস বাড়িয়ে দেয় রজতের দিকে। বশীভূতের মতো সেটা হাতে নিয়ে একচুমুকে শেষ করে ফেলে সে। এভাবে পরপর তিনবার। রজতের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সোফার উপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, কালো ওড়নাটা সরিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মল্লিকা। বিস্ফারিত দৃষ্টি, যেন আগুন ঝরছে সমস্ত দেহটা থেকে!
চিত্কার করে বলে ওঠে, কেন এরকম করলে তুমি বলো? আমাকে ঠকিয়ে দিনের পর দিন একের পর এক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে গেলে? একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না? কত সম্মান করেছিলাম তোমাকে। আমার ভগবান ভাবতাম।
সেদিন যখন তুমি ফোনটা ভুল করে আমার ঘরে রেখে চলে গেছিলে, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তুমি আমায় এতদিন যে-ওষুধগুলো খাইয়ে, ওগুলো কোনও সুস্থ মানুষের সেবনযোগ্য নয়। ওই ড্রাগসগুলো নিলে যে-কোনও সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে।
অ্যাকচুয়ালি, তুমি আমাকে বদ্ধ পাগল বানিয়ে রাখতেই চেয়েছিলে! যাতে বাইরের দুনিয়ার সামনে কখনও আমাকে না নিয়ে যেতে হয়, আর তুমি নিজের মতো করে স্বেচ্ছাধীন জীবনযাপন করতে পারো, ইচ্ছামতো নারীসঙ্গে বুঁদ হতে পারো! কিন্তু আমি আর তা হতে দেব না মি. রজত সান্যাল! কারণ আসল মনের অসুখ তো তোমার, অসুস্থ তুমি! উন্মাদ তুমি, নাহলে এভাবে একের পর এক নারীসঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারো না। বিকৃত মানসিকতাও একপ্রকার ভয়ংকর অসুখ, যার একমাত্র ওষুধ মৃত্যু!
রজত মল্লিকার হাত দুটো আটকাতে যায়। কিন্তু পারে না। শরীর ইতিমধ্যেই অবশ হয়ে গেছে। মল্লিকা হিংস্র বাঘিনীর মতো ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সেই শেষের মুহূর্তটা আসতে আর কিছুক্ষণ মাত্র বাকি!