‘সাগ্নিক, আজ দিদি আর জামাইবাবু আসছে খেয়াল আছে তো? ট্রেনের সময়টা নেট-এ চেক করে স্টেশনে পৌঁছে যেও। দেখো দিদিদের যেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করতে হয়। আমি আজ কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না। বাইরে থেকে ডেলিগেট্স আসছে। ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর হবে না’, অরুণিমার কথাগুলো সাগ্নিকের কানে ঢুকল। কাজের থেকে চোখ না তুলেই স্ত্রীকে উত্তর দিল, ‘আমি যেতে পারব না। ফোন করে দাও, ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে।’
‘বিয়ের পর প্রথমবার ওরা আমাদের বাড়ি আসছে। এখান থেকে কেউ না গেলে ওরা খারাপ মনে করবে। তোমার দিদি যখন এখানে এসেছিল তখন তুমি এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে কাজ করেছিলে। এখন একটা দিন তুমি করতে পারছ না?’ বিরক্তি চাপতে পারে না অরুণিমা।
নিরুত্তাপ গলায় সাগ্নিক উত্তর দেয়, ‘দিদি আমাদের সুখের সংসার দেখতে এসেছিল। আমরা যে অত্যন্ত সুখে রয়েছি সেটা দিদিকে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় দিদিকে খুব নিরাশ মনে হল। বিয়ের পরেই ভেবে নিয়েছিলাম যখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে, নিজের টাকাপয়সাও যার যার নিজের, বন্ধুবান্ধবও দুজনের আলাদা তখন তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার হয় কী করে? এটাই বেশ ভালো ব্যবস্থা। তুমিই বলো না?’
অরুণিমার নিজের করা ব্যবস্থাই আজ হঠাৎ করে মোড় ঘুরে ওকেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।
ছয় বছরের প্রেমপর্ব শেষ করে সাগ্নিক আর অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বিয়ের আগের গভীর প্রেম ওদের দুজনের সংসারের চৌকাঠ পার করে বাইরে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। একে অপরকে অপমান করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করত না। মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে ওদের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে হোটেল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিল হোটেলের ম্যানেজার। অগত্যা হোটেল ছাড়তে ওরা বাধ্য হয়েছিল।
অথচ হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল ছ’দিনের জন্য। ম্যানেজারের কথা শুনেই অরুণিমা তাই রেগে ওঠে, ‘আমরা আগে থেকে পুরো টাকা দিয়ে রুম বুক করেছি। আপনি আমাদের চলে যেতে কীভাবে বলছেন?’
‘আপনি ঠিকই বলছেন ম্যাডাম। কিন্তু আপনাদের জন্য হোটেলের অন্যান্য অতিথিদের আমি অসুবিধায় ফেলতে পারি না। আর আপনি অ্যাডভান্স টাকা দেওয়ার কথা বলছেন, তাহলে আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাগের মাথায় আপনারা স্বামী-স্ত্রী হোটেলের সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করেছেন। কাপ, কাচের বাসন ভেঙেছেন। সুতরাং সেগুলোর টাকা তো আপনাদেরই চুকোতে হবে। এই সব টাকা কেটে নিয়ে যে-টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ ম্যানেজারের উত্তরে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারে সাগ্নিক আর অরুণিমা।
হোটেলের ঘরে ফিরে আসে ওরা। হোটেল ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে স্থির করে নেয় পরের দিনই ওরা হোটেল ছেড়ে দেবে। ব্যস, আর কোনও কথা হয় না ওদের মধ্যে।
পরের দিন হোটেল ছেড়ে অন্য হোটেল খুঁজে নেয় সাগ্নিক। কারণ ফেরার টিকিট কাটা ছিল চারদিন পরের তারিখে। সুতরাং দু’জনেরই আগে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় ছিল না ওদের কাছে।
‘হ্যাঁ রে কেমন কাটল তোদের ওখানে?’ সাগ্নিকের মায়ের কণ্ঠস্বরে অরুণিমা মোবাইল থেকে মুখ তোলে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফেরার আগে সাগ্নিকের বাবা-মায়ের অনুরোধে তিনদিনের জন্য ওরা এখানে এসেছে। সাগ্নিকের বাবা, মা দুজনেরই বয়স হয়েছে তারপর ওই একমাত্র ছেলে। সুতরাং ছেলে-ছেলে বউয়ের কাছেই ওদের যা কিছু আশা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে সুতরাং ইচ্ছে থাকলেও মেয়েকে কাছে পাওয়া হয় না। আর অরুণিমাও মেয়েই হয়ে উঠেছিল ওদের কাছে কারণ পাঁচ বছরেরও বেশি দেখছেন ওনারা ওকে।
‘হ্যাঁ জায়গাটা তো বেশ ভালোই, খারাপ কাটেনি কয়েকটা দিন’, কম কথায় সারবার চেষ্টা করে অরুণিমা কিন্তু ওর নিষ্প্রভ চেহারা সাগ্নিকের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।
‘কী ব্যাপার বল তো? তোকে আর বাপ্পাকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। মনেই হচ্ছে না এই কদিন আগে তোদের বিয়ে হয়েছে। কোনও সমস্যা?’
‘মা, তোমাকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল করে ফেলেছি। সাগ্নিক আর আমার একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।’
‘কী বলছিস তুই? ছয় বছর তো একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারতিস না। বাপ্পাকে কত বলেছিলাম, দিদির বিয়েটা হয়ে যেতে দে, তারপর বিয়ে করিস কিন্তু তোরা দুজন আমার কথাই শুনিসনি।’
‘তুমি ঠিকই বলছ। সত্যি বলতে কি এই কয়দিনে সাগ্নিকের আসল রূপটা আমার সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। মনেই হচ্ছে না এই মানুষটার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম,’ গলা বুজে আসে অরুণিমার।
‘কী ভেবেছিলাম আর কী হল। ভেবেছিলাম তোরা দুজন সুখী হলে আমরাও আনন্দে থাকব। এখন তো সবই কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমার এটাই দুঃখ যে ছয় বছরের পরিচয়েও তোরা একে অপরকে চিনতে পারলি না।’
‘মা, এটা নিয়ে এত চিন্তা কোরো না। কয়েকটা দিন আরও দেখি। সাগ্নিক বলছিল একান্তই যদি কেউ কাউকে মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব।’
‘খবরদার, ভবিষ্যতে কখনও এই কথা মুখে আনবি না। বাপ্পার সাহস তো কম নয়। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনও ডিভোর্সের কথা উচ্চারণই করেনি আর করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চারদিন বিয়ে হয়েছে তোদের আর এখনই ডিভোর্স নেওয়ার কথা ভাবছিস!’ অরুণিমা বেশ বুঝতে পারে সাগ্নিকের মা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।
‘মা, এখনই এতটা উত্তেজিত হয়ে পোড়ো না। ছয় মাসের মধ্যে কিছু করব না। তবে সব ফ্যামিলিতেই কোনও কাজ কখনও না কখনও প্রথমবারই করা হয়। বিয়ে করার অর্থ এও তো নয় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলেও বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে,’ অন্যমনস্কভাবে অরুণিমা কথাগুলো বললেও, সাগ্নিকের মায়ের ছায়াঘন অন্ধকার মুখখানা তিরের মতো অরুণিমার বুকে গিয়ে বিঁধল।
দিদিকে স্টেশন থেকে আনা নিয়ে অরুণিমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সাগ্নিকের মন বারবার অশান্ত হয়ে উঠছিল। ভাবল মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনটা একটু শান্ত হবে, এই ভেবে বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করল সাগ্নিক।
‘কী রে, ব্যাপার কী তোর? আজ হঠাৎ মায়ের কথা কী করে মনে পড়ল?’ সাগ্নিকের গলা শুনেই মা অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন।
‘তুমি কী যে বলো মা! কাউকে ভুলে গেলে তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন আসে। আর তুমি তো সবসময় আমার সঙ্গেই আছ।’
‘ভালো লাগল বাপ্পা তোর কথা শুনে। আর বল, কেমন সংসার করছিস?’
‘আজ অরুণিমার দিদি, জামাইবাবু আমাদের এখানে আসছেন। অরুণিমা খুব খুশি। আমাকে বলেছে ওদের স্টেশন থেকে গিয়ে নিয়ে আসতে কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার কাজ আছে, যেতে পারব না,’ বলে হালকা হবার চেষ্টা করে সাগ্নিক।
‘তোর কী হয়েছে বাপ্পা? পাড়ার মধ্যে কারও দরকার হলে, সাহায্যের জন্য তুই ঝাঁপিয়ে পড়তিস…অতিথি আমার তোমার হয় না, সকলেরই তার জন্য করা উচিত,’ মা বোঝাবার চেষ্টা করেন।
‘দিদিও তো এসেছিল। অরুণিমা দিদির সঙ্গে অপরিচিতের মতোই ব্যবহার করেছে। এটা আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।’
‘সংসারে নানা কথা হয় কিন্তু তাই বলে অশান্তি বাড়ালে বাড়তেই থাকে। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে সুতরাং একটু বুঝে চললে পথ চলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’
‘মা, তুমি সবসময় আমারই দোষ ধরো। আমি যদি ঠিকমতো উত্তর না দিতে পারি তাহলে সেটা আমার হার হবে। তুমি তো জানো হার স্বীকার করা আমার ধাতে নেই।’
‘সব কিছুকেই হার-জিত হিসেবে ধরছিসই কেন? বিবেক বলেও তো মানুষের কিছু থাকে। বিবেক যা বলে তাই সকলের করা উচিত। যাই হোক, তোদের খবরাখবর বল।’
‘এমনি সব ঠিকঠাকই আছে। তুমি আর বাবা কয়েকদিনের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যাও। তোমাদের ভালো লাগবে।’
‘ঠিক আছে দেখছি। এখন ফোন রাখি। অরুণিমাকে বলিস পরে ওর সঙ্গে কথা বলব কারণ এখন ওর অফিস বেরোনোর সময়।’ এই বলে ফোন রেখে দেন সাগ্নিকের মা।
ছোটো থেকেই অরুণিমার উপর ওর মায়ের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। বাবা বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন তাই মায়ের সঙ্গেই সময় কেটেছে বেশি অরুণিমা ও ওর দিদি অমৃতার। বয়সে ছোটো বলেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, অরুণিমা একপ্রকার মায়ের ন্যাওটাই ছিল। ছোটো থেকেই মায়ের কাছে অরুণিমা শিখেছে, নিজের ভালোর জন্য সবসময় সজাগ থাকাটা এবং ব্যক্তিত্ব রাখাটা খুব দরকার যাতে অপর পক্ষ দেখে ভয় পায়। এমনকী কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের ভয় দেখাতে হবে এমনটাও অরুণিমার, মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা সবসময় বলতেন, ‘সবরকম বিপদ থেকে আমি তোদের বুক দিয়ে আগলেছি। তোদের বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার পরিবারের লোকজন আমার জীবন প্রায় নরক করে তুলেছিল। ওরা তখন বুঝতে পারেনি যে আমি নরম মাটি দিয়ে তৈরি হইনি, রুখে দাঁড়িয়েছি ওদের বিরুদ্ধে।’
অরুণিমার কাছে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথাই ছিল অটল সত্যি। এমনকী মায়ের অনুমতিতেই সাগ্নিকের সঙ্গে প্রেমটা এগোতে পেরেছিল।
বিয়ের পরেও নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সাগ্নিক এবং ওর মা-বাবা-দিদির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল অরুণিমা।
সংসারে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে সাগ্নিকের মনকে বিরূপ করে তুলেছিল। সাগ্নিকের প্রতিশোধপ্রবণতার প্রমাণ হাতেনাতে পেল যখন সাগ্নিক অরুণিমার দিদিকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে অস্বীকার করে মুখের উপরে ওকে জানিয়ে দিল। অরুণিমারও স্টেশন যাবার উপায় ছিল না অফিসের কাজের জন্য। অগত্যা ফোন করে অরুণিমা দিদিকে জানিয়ে দিল ট্যাক্সি করে ওদের বাড়ি চলে আসতে। বাড়িতেও কাজের লোককে অতিথিদের ঠিক করে অভ্যর্থনা করার কথা বুঝিয়ে অফিসের জন্য রওনা হল অরুণিমা। কিন্তু মন পড়ে রইল বাড়িতে।
‘জানিনা, দিদি কী ভাবছে আমাদের সম্পর্কে। বিয়ের পর প্রথমবার আমাদের বাড়ি আসছে তাও জামাইবাবু মানে কৃষ্ণেন্দুদা-র সঙ্গে। মুম্বই যখন পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম তখন প্রায়ই হস্টেল থেকে দিদির ওখানে পালিয়ে যেতাম। দিদির যত্নের কোনও ত্রুটি ছিল না। আর রান্না করতে দিদি প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং সেই সঙ্গে খাওয়াতেও। রোজই নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াত। আর আজ যখন দিদিরা আসছে তখন আমরা কেউই বাড়িতে রিসিভ করার জন্য থাকছি না,’ অফিসের সহকর্মীর কাছে মনের অস্থিরতাটা চেপে রাখতে পারে না অরুণিমা।
অরুণিমা নিজে রান্নাঘরে ঢুকতে পছন্দ না করলেও দিদির কাছে শুনেছিল, কৃষ্ণেন্দুদা বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই আগে থেকেই সব রকমের ফল, সবজি, খাবার কিনে ফ্রিজ ভরে রেখেছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলায় অফিস থেকে যখন বাড়ি পৌঁছোল, ভিতরে পা দিতেই হাসির শব্দ ভেসে এল অন্য ঘর থেকে। নিজের অজান্তেই অরুণিমার ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল। ঘরের দিকে পা বাড়াল অরুণিমা।
‘কী ব্যাপার? এত হাসাহাসি কীসের জন্য? আমাকেও তো কিছু বল দিদি।’ কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে অরুণিমা বলল, ‘ভেরি সরি, কৃষ্ণেন্দুদা। কিছুতেই স্টেশন যেতে পারলাম না, অফিসে ছুটি পেলাম না। নিজের লোকেদের জন্যই চাকরি করা অথচ দেখুন তাদের দরকারেই ছুটি পাওয়া যায় না।’
‘নিমি, এত দুঃখ পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সাগ্নিক, অতিথি সৎকারে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বরং বলতে পারো, তোমার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই হয়নি,’ কথাটা বলেই কৃষ্ণেন্দু হেসে ফেলে।
‘আঃ! তুমি রাখবে। নিমিকে দেখলেই হল। ওর পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চাও না। বেচারা অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছে,’ অমৃতা কৃষ্ণেন্দুকে থামাবার চেষ্টা করে।
‘আমি তোমার বোনকে কেন খ্যাপাব? আমাদের জন্য বেচারা শুধু শুধু অপরাধবোধে ভুগবে কেন? আমরা তো দিব্যি আরামেই সময় কাটাচ্ছিলাম,’ কৃষ্ণেন্দু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি কৃষ্ণেন্দুদা। আমি না থাকলেই সবাই বেশি খুশি থাকে,’ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে অরুণিমা।
‘দ্যাখো ভাই, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাগ্নিকই দিতে পারে। আমরা তো মাত্র কয়েক ঘন্টাই এসেছি। আমার তো আবার শালির সঙ্গ বেশি ভালো লাগে।’ কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে অরুণিমাও হেসে ফেলে।
সাগ্নিক শান্তস্বরে বলে ওঠে, ‘কৃষ্ণেন্দুদা, আপনি ভুল করছেন। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি কবেই বন্ধ করে দিয়েছি। কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিই।’
‘বাঃ, ভায়া! কৌশলটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেছ দেখছি। এত বছর বিয়ে হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এটা এখনও আমি রপ্ত করতে পারলাম না,’ কৃষ্ণেন্দু আবার হেসে ফেলে।
‘দেখছিস দিদি, যে আমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তার কাছে আমার কী আর এক্সপেকটেশন থাকতে পারে?’ অরুণিমার স্বরে কথার ঝাঁঝ স্পষ্ট ধরা পড়ে।
‘তুই শুধু শুধু সিরিয়াস হয়ে পড়ছিস। সাগ্নিক তোর সঙ্গে মজা করছে। সব কথার কি মানে ধরতে আছে?’ অমৃতা বোনকে বোঝাবার চেষ্ট করে।
‘আমি তো বলা, শোনা সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছি দিদি। মা তো প্রথমেই সাবধান করেছিল যে আমাদের আর সাগ্নিকদের বাড়ির কালচারে আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু আমিই তখন কথা শুনিনি।’
‘বুঝেছি। আজকাল বুঝি মায়ের কথাতেই উঠছিস বসছিস?’ গম্ভীর হয় অমৃতা।
‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, আর এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মায়ের থেকে ভালো আমার ভালো-মন্দের কথা আর কে ভাববে বল? মা আমাদের দু’জনের বন্ধুও তো বটে। কেন, তোর এটা মনে হয় না দিদি?’
‘মায়ের কথায় সংসার চালাচ্ছিস? সংসারটা তোর আর সাগ্নিকের না আমাদের মায়ের যে, মা তোর সংসারের চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে চাইছে?’ সাগ্নিক আর অরুণিমা দুজনের মধ্যে একটা টেনশন চলছে এমন আাঁচ পেয়ে, রাগত গলায় অমৃতা বোনকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
দুই বোনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে কৃষ্ণেন্দু অনেকক্ষণই সাগ্নিককে নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসে। অমৃতা ঠিকই করে নেয় বোনকে বোঝানো দরকার কারণ কথাবার্তার মাঝেই বুদ্ধিমতী অমৃতা বুঝে নিয়েছিল সাগ্নিক আর ওর বোনের সম্পর্কটা একটু শুধরোনো দরকার।
‘দিদি, আমি জানি সংসারটা আমাদের, কিন্তু মায়েরও আমাকে বলার অধিকার আছে। মা-কে আমি প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। প্রয়োজনে আমি মায়ের জন্য সবকিছু করতে পারি। এখন আমাদের বিয়েটা বাঁচাবার জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছে। তুই বিশ্বাস করবি না দিদি, বিয়ের পর সাগ্নিক কতটা বদলে গেছে। সব সময় নিজের মত আমার উপর চাপাবার চেষ্টা করে। আমার যে আলাদা একটা আইডেনটিটি আছে সেটা ও মানতে চায় না। মা প্রথমেই বলে দিয়েছিল শক্ত হাতে সাগ্নিকের এই অভ্যাসটা দমন করতে, নয়তো আমাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ফেলতে ও এক মুহূর্তও দেরি করবে না। সুতরাং সাগ্নিক যাই করুক না কেন আমি সাবধান হয়ে গেছি।’
‘কী বলছিস তুই?’ অমৃতা বিস্ময় চাপতে পারে না। ‘সাগ্নিকের নিন্দে করাটা মায়ের কাছে কি খুব দরকার ছিল? আমাদের জন্য মায়ের চিন্তাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও একটা সংযমের সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। তুই এখন বাচ্চা নোস যে সব কথায় মা-কে টেনে আনতে হবে। নিজের ডিসিশন নিজেকেই নিতে হবে।’
‘আচ্ছা ছাড় দিদি, এসব কথা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে তোদের কষ্ট হয়নি তো?’
‘কষ্ট কেন হবে? সাগ্নিক তো স্টেশনেই ছিল। বাড়ি নিয়ে আসা থেকে খাওয়াদাওয়া যত্নের কোনও ত্রুটি রাখেনি।’
‘আর একটা দিন দিদি কষ্ট কর। এর পর পাঁচদিনের ছুটি রোববার নিয়ে। খুব মজা করব। বাইরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নেব। বাড়িতে ওসব ঝঞ্ঝাটই রাখব না,’ অরুণিমা দিদির গলা জড়িয়ে ধরে।
‘না রে সে হবে না। কৃষ্ণেন্দু বাইরের খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। আমি রান্না করতে ভালোবাসি, আমিই নতুন নতুন রান্না করে তোদের খাওয়াব। সাগ্নিক রান্না করে?’
‘হ্যাঁ। আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেরাই আলাদা করে খাবার বানিয়ে নিই। মায়ের কথামতো রান্না করে খাইয়ে সাগ্নিকের অভ্যাস আমি খারাপ করতে চাই না। রান্না করাটা কি খালি মেয়েদেরই কাজ, তুই বল না দিদি?’ দিদির কাছে সব কথা বলতে পেরে, এখন কিছুটা হালকা অরুণিমা। প্রায় জড়তাহীনভাবে বলল, ‘সংসার করবার প্রথমেই মা সাবধান করে দিয়েছিল যে, রান্না না করার সবথেকে ভালো দিক হল, বাড়িতে ভালো রান্না হলে খেয়েদেয়ে বাড়ির পুরুষ-মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হবে। অযথা মেদ বাড়বে। এই ভালো, এতে চেহারাও ভালো থাকবে, বাড়িঘর নোংরাও হবে না।’
‘হ্যাঁ। তাই জন্যই মা, বাবাকেও নিজের জীবন এবং সংসার থেকে দূরে রেখেছিল,’ অমৃতার গলায় মায়ের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ে।
‘কী বলছিস তুই দিদি?’ অরুণিমার স্বরে অবিশ্বাস।
‘না, না কিছু না। আমার মুখ থেকে জাস্ট বেরিয়ে গেছে।’
‘না, দিদি। তুই আমার থেকে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিস। তোকে বলতেই হবে,’ অরুণিমা জেদ ধরে।
‘লুকোবার মতো কিছু নয়। মা তোকে যেটা শেখাচ্ছে নিজের জীবনেও ওই একই জিনিস করেছে। তুই তখন খুব ছোটো ছিলি। কিন্তু আমার সব মনে আছে। বাড়িতে রান্নার লোক ছিল কিন্তু মা ওকেও রান্না করতে দিত না আর নিজেও করত না। বাবা অফিস যেত চা পাউরুটি খেয়ে, বাড়ি এসেও কপালে কিছু জুটত না। মা বদারও করত না। বাবা নিজেই রাতে কিছু বানিয়ে নিত, আমার বাবার জন্য কষ্ট হতো, তাই বাবাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতাম। রান্না করার শখটা হয়তো আমি বাবার থেকেই পেয়েছি,’ অমৃতা বলে।
‘কিন্তু বাবা তো শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল।’
‘হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে বদলি নেয় বাবা। রান্নার লোকটাকে বাবা ছাড়িয়ে দেয় মায়ের জেদের কাছে হার মেনে। ছোটোবেলায় আমরা মানুষ হয়েছি বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে।’
‘বাবার মুখটাই আমার ঠিক করে মনে পড়ে না,’ স্মৃতি হাতড়াতে থাকে অরুণিমা।
‘তোর মনে থাকার কথাও নয়। আমারই তখন দশ বছর বয়স। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বাবা অন্য শহরে চলে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলে স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, গিফ্টও নিয়ে আসত আমাদের জন্য। মা জানতে পেরে, স্কুলকর্তৃপক্ষকে বলে, বাবার স্কুলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই থেকে আমার মায়ের ওপর রাগ বাড়তে থাকে। মায়ের স্বার্থপরতার জন্য মা-কে আমি ভালোবাসতে পারিনি। মা-ও বুঝেছিল আমার মনের কথা। তাই আমাকেও হস্টেলে পাঠিয়ে নিজের কর্তব্যে ইতি টেনে দিয়েছিল মা,’ না চাইতেও অমৃতার চোখ চলে ভরে যায়।
‘মনে আছে দিদি, তুই শুধু ছুটিতে বাড়ি আসতিস। তখন আমরা দুই বোন খুব মজা করতাম।’
‘তোর জন্যই তো বাড়িতে আসতাম। মা-র কোথায় সময় ছিল আমাদের জন্য?’
‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। পরে মা আমাকেও তো হস্টেলে পাঠিয়ে দিল। সুমন কাকু সেসময় খুব বড়িতে যাতায়াত করত। আমাদের ফ্যামিলিটা ভেঙে দেওয়ার পিছনে ওনারও বিশাল ভূমিকা রয়েছে।’ অমৃতা বুঝতে পারে সুমন কাকুর উপর অরুণিমার রাগ আজও এতটুকু কমেনি।
‘নিজের সমস্যার জন্য অপরকে দোষারোপ করিস না নিমি। এই অভ্যাস ছাড় দেখবি তোরই ভালো হবে। এখন নিজের সংসার সামলা। তোর সংসার ভেঙে গেলে আমি খুব কষ্ট পাব।’
‘তোর কি মনে হয় সব দোষ আমার?’
‘আমি তোর দিদি হই। তোর থেকে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। দোষ কার সেটা বিচার করার আমি কে? কিন্তু একটা কথা বলতে চাই, তোর নিজের সংসার তুই নিজেই একমাত্র বাঁচাতে পারিস,’ অমৃতা স্পষ্ট কথাটা বোনকে বলেই ফেলে।
‘কী হল? দুই বোনের না হয় অনেকদিন বাদে একসঙ্গে দেখা হয়েছে মানছি কিন্তু তাই বলে খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ নাকি?’ কৃষ্ণেন্দু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সহাস্যে দু’জনকে প্রশ্নটা করে।
‘ওঃ সরি কৃষ্ণেন্দুদা। কথা বলতে বলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না। আমাকে দশ মিনিট দিন, ফ্রেশ হয়ে সোজা ডিনার টেবিলে পৌঁছোচ্ছি,’ জিভ কেটে অরুণিমা উত্তর দেয়।
অরুণিমার সংসারে অমৃতা আর কৃষ্ণেন্দুর আসাটা একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ নিয়ে এসেছিল, যেটা অরুণিমার অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলতে পেরেছিল। একটা সপ্তাহ হইচই, ঘোরাফেরা করে অমৃতারা চলে যেতেই আবার বাড়িটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেল।
দিদির বলে যাওয়া কথাগুলো সারাদিন অরুণিমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকত। অফিসেও কাজে মন দিতে পারত না অরুণিমা।
একদিন রোজকার মতো সাগ্নিক নিজের ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। অরুণিমা এসে পিছন থেকে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে। সাগ্নিক অবাক হয়, কারণ এই স্পর্শ ও প্রায় ভুলতেই বসেছিল।
‘চলো খাবে চলো। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ অরুণিমার গলায় সেই প্রথম অন্তরঙ্গতা অনুভব করল সাগ্নিক। টেবিলে সাজানো খাবার দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আনালে?’
‘আনাইনি, নিজে বানিয়েছি। রেস্টুরেন্টে এই খাবার পাওয়া যায়?’ অরুণিমা হাসে। সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে দেয় অরুণিমা। সুরভিত গন্ধের আবেশে সাগ্নিকের অরুণিমাকে যেন নতুন লাগে। অরুণিমা সাগ্নিকের বুকের মধ্যে মুখ গোঁজে। মনের কথাগুলো ঠোঁটে এসে পড়ে সাগ্নিকের, ‘ইশ, দিদি যদি আরও কয়েকদিন আগে আসত!’ অরুণিমা কিছু বলে না মুখে। পরম নিশ্চিন্তে সাগ্নিকের বুকে মাথা রাখে। মোমবাতির জ্বলন্ত অগ্নিশিখা শুধু সাক্ষ্য থাকে বিরল এই মিলন দৃশ্যের।